#পরিণয়ে_নোলককন্যা (কপি নিষেধ)
|২১|
উত্তপ্ত দুপুরের রেশ কেটে প্রকৃতিতে বইছে স্নিগ্ধ বাতাস৷ মধ্যাহ্নভোজের পর এই সময়টুকু ভাতঘুমে কাটায় পিয়াস লহরি। নিত্যদিনকার নিয়মে আজ সামান্য পরিবর্তন ঘটেছে৷ এই মুহূর্তে তিনি বসে আছেন নিজের বাড়ির বসার ঘরে৷ উনার সামনে সোফায় বসে আছে পরখ৷ এই অসময়ে পরখকে নিজ বাড়িতে দেখে তিনি অবাক হয়েছেন বটে৷
গৃহকর্মী এসে টেবিলের উপর চায়ের পেয়ালা রেখে গেলো৷ পিয়াস লহরি বললেন,
‘চা নেও।’
পরখ হাত বাড়িয়ে চাপের পেয়ালা তুলে নিল কিন্তু চুমুক দিলো না। পিয়াস লহরির বড্ড ঘুম পাচ্ছে৷ অনেকদিনের স্বভাব তো; হঠাৎ ব্যাঘাত ঘটায় মাথা ধরেছে সামান্য। পেয়ালায় সুদীর্ঘ চুমুক দিয়ে বললেন,
‘তারপর কি মনে করে? জরুরি কিছু না হলে সকালের অপেক্ষা না করে সোজা বাড়িতে চলে আসার ছেলে তুমি নও৷’
পরখ সামান্য বিব্রত হলো। পরিস্থিতি সম্পূর্ণ বিগড়ে না গেলে সে কিছুতেই অন্যের দারস্থ হতো না। কিন্তু এই মুহূর্তে তাকে সাহায্যের হাত পাততে হচ্ছে। আত্মসম্মানটুকু বাচিয়ে যতোটুকু সাহায্য গ্রহণ করা সম্ভব, সেটা নিতে চাইছে৷
চায়ের পেয়ালা আবার টেবিলের উপর নামিয়ে রেখে অনিচ্ছা সত্ত্বেও সে বলল,
‘আপনার কাছে নিশ্চয়ই গেস্ট লেকচারার এর রিকুয়েষ্ট আসে। ভাবছি, এটেন্ড করবো৷ পরবর্তীতে এমন কোনো অফার পেলে আমাকে জানাবেন।’
পিয়াস লহরি আশ্চর্য হলেও তা প্রকাশ করে পরখের অস্বস্তিবোধ বাড়াতে চাইলেন না৷ তাড়া দিয়ে বললেন,
‘আরে চায়ের কাপ নামিয়ে রাখলে কেনো? চা ভালো হয়নি? দেখো কান্ড, আমি ভুলেই গিয়েছিলাম। তুমি লাঞ্চ করেছো তো?’
দ্রুত চায়ের পেয়ালা তুলে নিয়ে তাতে চুমুক দিয়ে পরখ জানালো,
‘জ্বি করেছি।’
‘বেশ, বেশ। তাহলে তুমি ভূবনভোলার পাশাপাশি অন্যত্রও লেকচার এটেন্ড করতে চাইছো?’
‘হ্যাঁ। যদি সুযোগ পাই তবে।’
‘সে পাওয়া যাবে। প্রায়শই প্রাইভেট ভার্সিটি থেকে লেকচারারদের তলফ করা হয়৷ ভালো শিক্ষকের বড় অভাব এই দেশে৷ ব্রাইট স্টুডেন্টগুলো আর দেশে থাকছে কই! সবাই ছুটছে বিদেশে।’
পরখ নিজেও একই নায়ের মাঝি। তাই মাথা নিচু করে বসে থাকা উচিত মনে হলো৷ পিয়াস লহরি বললেন,
‘তবে তোমার উপর বেশ চাপ পরে যাবে। আজ ঢাকা তো কাল দিনাজপুর, চট্টগ্রাম। বিভিন্ন জেলা থেকে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুরোধ আসে৷ ভূবনভোলায় ক্লাস নেওয়ার পর আবার যদি বাইরে ক্লাসে নিতে যাওয়া শুরু করো তাহলে নিজে পড়বে কখন? একদম সময় পাবে না। সামান্য কিছু টাকার জন্য তোমার পড়াশোনার বিরাট ক্ষতি হয়ে যাবে৷ আর্থিক সমস্যায় পরলে আমি কিছুটা সাহায্য করতে পারি। লাগলে বোলো?’
‘নাহ, নাহ। তেমন কিছু নয়। আপাতত একটু ব্যস্ত থাকতে চাইছি। নিজের লেখাপড়ার জন্য কিছু সময় এখনও বাকি আছে। সমস্যা হবে না।’
‘কেনো? তোমার ভার্সিটিতে ক্লাস হচ্ছে না? সরাসরি ক্লাস এটেন্ড করতে না পারলে ওরা নিশ্চয়ই অনলাইন ক্লাসের ব্যবস্থা করে?’
পরখ কীভাবে বলবে, তার ভার্সিটিতেও সে ব্যবস্থা আছে৷ কিন্তু তার ভর্তির ব্যাপারে এখনও নিশ্চিতভাবে সংবাদ প্রেরণ করা হয়নি বলে তাকে অপেক্ষা করতে হচ্ছে৷ সূক্ষ্ম তন্তুর মতো সে বর্তমান ভবিষ্যতের মধ্যকার এক অনিশ্চয়তায় অবস্থান করছে৷
‘ক্লাস শুরু হতে কিছু সময় বাকি আছে।’
‘আচ্ছা ঠিক আছে। তোমার যেহেতু সমস্যা হবে না, তবে আমি ব্যবস্থা করছি৷ সপ্তাহে কতদিন সময় দিতে পারবে?’
‘ভার্সিটির ক্লাস বাদে বাকিটা সময় ফ্রি আছে। যত বেশি এটেন্ড করা যায়, ততোই ভালো।’
‘হুম। তোমার বয়সটাই এখন চ্যালেঞ্জের। যুবক বয়স, শারীরিক ও মানসিক উভয় শক্তি সমান। চেষ্টা করলেই পারবে।’
পিয়াস লহরির বাড়ি থেকে মাত্রই বাইরে বেরিয়েছে তখনি পর্তুলিকার কল এলো। রিসিভ করতেই পর্তুলিকা বলল,
‘আদ্রিকা কোথায়? তখন থেকে কল দিচ্ছি তুলছেই না।’
‘ দেখো গিয়ে আবার কোথাও মোবাইল রেখে রান্নাঘরে নতুন রেসিপির মাঝে ডুবে আছে।’
‘তুই বাড়িতে এখন?’
‘বাইরে আছি।’
‘কখন ফিরবি?’
‘দেরী হবে বোধহয়। তুমি ওকে খুঁজছো কেনো?’
‘কিছু গাছ পাঠাবো। গাড়িতে তুলে দিয়ে ভাবলাম ওকে জানিয়ে দেই। কিন্তু এখন খোঁজ পাচ্ছি না।’
‘গাছ দিয়ে কি হবে?’
‘ছাদে বাগান করবে।’
‘এসব আবার কেনো? কে দেখাশোনা করবে এসব গাছপালা?’
‘ওসব নিয়ে তোকে ভাবতে হবে না। আদ্রিকা নিজেই করবে। তোর কাজ না থাকলে এখন বাড়ি চলে যা। আমি গাছ পাঠিয়ে দিচ্ছি৷ মেয়েটা একা এগুলো ছাদে তুলতে পারবে না। ড্রাইভারের সাথে মিলে তুই গাছগুলো ছাদে তুলে দিবি।’
অগত্যা বাধ্য হয়ে পরখকে বাড়ির দিকে ফিরে যেতে হলো। যদিও দুপুরের মনোমালিন্যের কারনে মন মেজাজ এখনো সপ্ত আসমানে উঠে আছে। বাড়ি ফিরে আবার যদি ওই মেয়ে অযথা কথা বলে মাথা ধরিয়ে দেয় তবে পরখ আজ সত্যি খুব খারাপ কিছু করে ফেলবে। ঠাটিয়ে দুটো চড় দিতে হলে তাও দিবে।
আধা ঘন্টার মধ্যে বাড়ি পৌঁছে পরখ দেখল বাড়ির সামনে গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। বাইক থেকে নেমে ড্রাইভারের সাথে মিলে গাছগুলো ছাদে তুলতে গিয়ে কোমরের অবস্থা নাজেহাল৷
একটি করে জুই, বেলী, রঙ্গন, শিউলি, গোলাপ এবং দুটো বাগানবিলাস এর গাছ। কয়েকটি মাটির বড় পাত্র। দু বস্তা মাটি, গোবর সার সব পাঠিয়ে দিয়েছেন পর্তুলিকা। বাগানের প্রতি মায়ের এমন যত্নশীল আচরণে পরখ এখন আর অবাক হয় না। গাছগুলো ছাদে তুলে সে কয়েকবার আদ্রিকাকে ডাকল, কিন্তু কোনো সাড়া পেল না।
মাটি, সার, পট তুলে দিয়ে ড্রাইভার ফিরে গেলে সে বসার ঘরে প্রবেশ করে আরও দু’বার ডেকে যখন সাড়া পেল না তখন কপাল কুচকে বেসিনে হাত ধুয়ে নিল। আদ্রিকার শোবার কক্ষ, নিজের কক্ষসহ পুরো বাড়িতে অনুসন্ধান চালাতে খুব বেশি সময় অপচয় হলো না। মাত্র দু মিনিটের ব্যবধানে পরখের মাথায় পুরো আকাশ হুড়মুড় করে ভেঙে পরল। পকেট থেকে মোবাইল বের করে আদ্রিকার মোবাইল নাম্বার ডায়াল করলে খাবার টেবিলের উপর ছড়িয়ে রাখা জিনিসপত্রের আড়াল থেকে মোবাইলটি বেজে উঠল।
অবিন্যস্ত চুলগুলো এক হাতে চেপে ধরে কিছুক্ষণ স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল পরখ। অন্য কোনো প্রাণীর নিকট এই খবর পৌঁছানোর আগেই আদ্রিকার খোঁজ পেতে হবে। ইবনূল ইবতেহাজের নিকট কোনোভাবে এ খবর পৌঁছানোর মানে পরখের অস্তিত্ব ধূলিসাৎ হওয়া৷ কিন্তু এই পাগল মেয়েকে সে এখন খুঁজবে কোথায়?
ওর যাওয়ার জায়গা বলতে বাবার বাড়ি এবং শ্বশুরবাড়ি। পর্তুলিকা নিজেই ওর খোঁজ করছে মানে, সেখানে যায়নি৷ বাবার বাড়ি গেলে সেখানে আরেকদফায় ধাক্কা খাবে। পরখ দ্রুত পায়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামল। যতদ্রুত সম্ভব বাইক চালিয়ে সে চললো চুপকথার দিকে।
চুপকথার পরিবেশ এখন একদম চুপচাপ। কিন্তু আশেপাশে এখনো চুপিসারে চলছে আলাপচারিতা। উত্তেজনার বশবর্তী হয়ে এতোটা পথ আসার পর পরখের মনে হলো, শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে সে কি বলবে? তারা অবশ্যই হঠাৎ আগমনের কারন জানতে চাইবে, তখন পরখ কি উত্তর দিবে? আপনার মেয়েকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, ওর খোঁজে এসেছি। এই খবর পাওয়া মাত্র মোকাররম মজুমদার তাকে শূলে চড়াবে। মানুষ হিসেবে সে প্রশ্নচিহ্ন যুক্ত হতে পারে কিন্তু মেয়ের বাবা হিসেবে সে আর পাঁচটা বাবার মতোই সাধারণ।
বাড়ির পাশের চায়ের দোকানে দাঁড়িয়ে সে ফন্দি আঁটছিল তখনি কানে এলো কিছু কথোপকথন। মাহিন নামটি তার বড্ড চেনা। সেদিন বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আদ্রিকার বাবা যখন মধ্যরাতে তাদের বাড়িতে উপস্থিত হলো তখন এই ছেলেটির চরিত্রস্খলনের সামান্য বর্ণনা পরখ শুনেছে৷ তাই আগ্রহভরে আলোচনা শুনল। বেশ রসিয়ে রসিয়ে মাহিনের বিয়ের গল্প বলা হচ্ছে৷
ধোঁয়া উঠা চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে পরখ পরিকল্পনা সাজালো।
আঙ্গিনায় বাইকের আওয়াজ শুনে নীহার বেরিয়ে এসে পরখকে দেখে অবাক হয়ে শুধালো,
‘তুমি! এসো, এসো ভেতরে এসো।’
মিষ্টি এবং ফলের প্যাকেট নিয়ে পরখ সহাস্যে বাড়ির ভেতর প্রবেশ করল। বসার ঘরে বসে পত্রিকায় চোখ বুলাচ্ছিলো মোকাররম। পরখকে দেখে সরু চোখে তাকিয়ে বলল,
‘হঠাৎ কি মনে করে?’
নীহার পরে গেল অস্বস্তিতে। নতুন জামাই প্রথমবার বাড়িতে এলো। এভাবে কে কথা বললে তাকে অপমান করা হয় না? সে বলল,
‘তুমি বসো, বাবা। চা খাবে নিশ্চয়ই?’
‘মাত্র খেয়ে এলাম। আপনি ব্যস্ত হবেন না। আমি কিছু খাবো না।’
পত্রিকা ভাঁজ করে রেখে মোকাররম বলল,
‘তোমাকে আসতে কেউ দেখেনি তো?’
এই লোকটির আচরণ গ্রীষ্মের দুপুরের মতো। এই ঝলমলে রোদ্দুর, এই মেঘে ঢাকা আঁধার। পরবর্তীতে কি হবে ঠিকঠাক অনুমান করা যায় না।
পরখ সামান্য বিব্রত হয়ে নীহারের দিকে তাকালো। নীহার ব্যতিব্যস্ত হয়ে বলল,
‘আহ! তুমি চুপ করো। ওর কথায় কিছু মনে করো না পরখ। সকাল থেকে এদিকে যা কান্ডকারখানা ঘটে গেলো! তাই নিয়ে এখনো ঘোরে আছে। ’
‘সেই সংবাদ শুনেই এলাম। মাহিন নাকি বিয়ে করেছে?’
‘মেয়ে পক্ষ জোর করে ধরেবেঁধে বিয়ে দিয়েছে। ওর মা কিছুতেই বউকে ঘরে তুলবে না৷ তাই নিয়ে সকাল থেকে এখন পর্যন্ত ঝামেলা করে যাচ্ছে।’
মোকাররম বিরক্ত হয়ে বলল,
‘আজকালকার মানুষগুলো পুরো অসামাজিক। নিজের বাড়ির ঝামেলায় আরেকজনকে দোষারোপ না করলে তাদের চলবে না। তোমাদের ছেলের বিয়ে, তোমরা সামলাও। এখানে আমার মেয়েদের টানার কি দরকার? উঠতে বসতে আমার মেয়েদের অভিশাপ দিয়ে যাচ্ছে। অসভ্য মহিলা। এখন আবার তোমাকে এ বাড়িতে আসতে দেখে ফেললে, আরেক কান্ড বাঁধাবে।’
‘তাহলে তো আমার আসা ঠিক হয়নি।’
‘হ্যাঁ তাই তো বলছি।’
নীহার ধমকে উঠল,
‘কী যে বলো না তুমি! ছেলেটা প্রথমবার আমাদের বাড়িতে এলো।’
‘সমস্যা নেই আন্টি। উনি ঠিকই বলেছেন। এই মুহূর্তে আমাকে দেখলে ঝামেলা বাড়তে পারে। আমি বরং আজকে উঠি।’
‘আরে তুমি হঠাৎ কি মনে করে এলে তাই জানা হলো না?’
‘মাহিনের ব্যাপারটা জানতেই এলাম।’
চেয়ারে বসেই মোকাররম প্রশ্ন করল,
‘আদ্রিকা কেমন আছে?’
শুকনো ঢোক গিলে পরখ সামান্য হেসে জবাব দিলো,
‘জ্বি ভালো।’
‘ঘরের কাজকর্ম পারে?’
‘মোটামুটি সবই পারে। যা বাকি আছে শিখে নিচ্ছে।’
‘ওকে এসব জানানোর দরকার নাই। শুধু শুধু চিন্তা করবে।’
বিদায় জানিয়ে পরখ বেরিয়ে এলো। নাহ, এখানেও সে নেই। এখন তাকে কোথায় খুঁজবে? এই এলাকায় সে চিনেই বা কয়টা জায়গা! সেই তো স্কুল, কলেজ, বাড়ি এইটুকুই ছিল গন্ডি৷ এর বাইরে আছে সেই মনতরীর চর৷ ভর সন্ধ্যে বেলায় সেখানে নিশ্চয়ই একা যাবে না? বলা যায় না, জেদের বসে যেতেও পারে।
পরখ দ্রুত বাইকে উঠে বসল। একটানে চলে গেল মনতরীর চরে। শূণ্য স্থানে বালির কণা চিকচিক করছে৷ তার উপর মাদুর বিছিয়েছে শুকনো ঘাস। পরখ ফিরে এসে ভূবনভোলা একাডেমির দিকে গেলো। সম্পূর্ণ বাজার চষে বেড়ালো। কিন্তু কোথাও তাকে পেলো না।
সময় বয়ে যাচ্ছে দ্রুত। সন্ধ্যার ঝাপি নামিয়েছে প্রকৃতি। এই তো রাত নামলো বলে। সূর্যাস্তের পর এখনো কিছু আলো রয়ে গেছে প্রকৃতিতে। ধূসর সন্ধ্যায় ধীরে ধীরে কৃত্রিম আলোয় আলোকিত হচ্ছে শহর। রাস্তার দুপাশে জ্বলে উঠছে নিয়ন বাতি।
পরখের বাইক তখনো এলোমেলো চলছে। ছোট শহর ভূবনভোলা। যার দশ শতাংশও আদ্রিকা চিনে না। পথের দুধারের দোকানগুলোর দিকে দৃষ্টি রেখে পরখের বাইক ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছে। বাজারহাট ফুরিয়ে এলো। তবুও কাঙ্খিত মানুষটির দেখা নাই।
হঠাৎ পরখের মনে হলো, রাগের মাথায় বের হয়ে গেলেও কোথাও যাওয়ার জায়গা না পেয়ে আদ্রিকা বাড়িতে ফিরে যেতে পারে। দেখা গেলো, পরখ এদিকে সারা শহর জুড়ে তাকে খুঁজছে অথচ সেই অভিমানী বাড়ির সিঁড়িতে হাঁটুতে মুখ গুঁজে বসে আছে। হতে পারে না এমনটা?
কিছুটা দৈবিক চিন্তাধারা। তবুও সৃষ্টিকর্তার কাছে সে খুব করে চাইলো, এমনটাই যেনো হয়। ছোট জীবনে অহেতুক ঝামেলা কি কম রয়েছে যে এখন আরেকটা ঝামেলা যুক্ত হতে চলল! এই মেয়ের বোকামির ফলে যদি কোনো বিপদ আপদ ঘটে যায় তবে পরখের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের দরজায় তালা ঝুলে যাবে। আদ্রিকার রগচটা হিটলার বাবা এক মুহূর্ত দেরী না করে তার নামে মামলা ঠুকে দিবে। যার মদদ দিবে, স্বয়ং পরখের বাবা ইবনূল ইবতেহাজ। ছেলের নামে একটা পুলিশ কেস ফাইল হয়ে গেলে, তার বিদেশ যাত্রা চিরতরে বন্ধ হয়ে যাবে। এই সুযোগ তিনি হাতছাড়া করবেন কেনো?
নিজের স্বার্থ হাসিলের উদ্দেশ্যে প্রিয় ছেলেকে দুটো দিন হাজতবাস করালে ইবনূল ইবতেহাজের বিশেষ কোনো ক্ষতি হবে না। অবশ্য পরখের দীর্ঘ বিশ্বাস, তাকে দু’দিনের বেশি জেলে রাখতে দিবে না ইবনূল ইবতেহাজ। কিন্তু একটা পুলিশ কেসে ঠিকই ফাঁসানো হবে।
এমন ভবিষ্যতের পরিকল্পনা মাত্র পরখের শরীর জমে বরফ শীতল হতে চলল। নাহ, এবার ফিরতে হবে। ততক্ষণে বাজার পেরিয়ে বাইক এগিয়ে যাচ্ছে গড়গড় করে।
পরখ বাইক ঘুরিয়ে নিলো। বাড়িতে বসে অপেক্ষা করাটাই ভালো হবে৷
মনোযোগ একাগ্র করে সামনে তাকাতেই বাইকের সম্মুখ আয়নায় উজ্জ্বল আলোর প্রতিবিম্ব দেখে পরখ খানিকটা থমকে গেলো। ‘অভয়ারণ্য’ এর প্রধান ফটকে দু টো বৈদ্যুতিক বাতি জ্বলে উঠল মাত্র। ফটকের একপাশে বিরস মুখে দাঁড়িয়ে আছে দারোয়ান অমলেশ। তার চোখে মুখে যে অস্বস্তি ফুটে উঠেছে তা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না।
তবে রাতের প্রথম প্রহর পর্যন্ত পার্কে দারোয়ানের উপস্থিতি সন্দেহজনক বটে৷ কী যেনো মনে করে পরখ আরেকবার বাইক ঘুরিয়ে নিল। পার্কের কাছাকাছি আসতেই অমলেশের অস্বস্তি, উত্তেজনা, বিবশতা স্পষ্ট হলো। পরখ বাইক থেকে নামলো না। তবে তা রাস্তার পাশে দাঁড় করিয়ে রেখে প্রশ্ন করল,
‘চাচা, কোনো সমস্যা?’
অথৈ দরিয়ায় খেই হারিয়ে অমলেশ দিশেহারা। শতবর্ষ পর হঠাৎ মনুষ্যের সাক্ষাৎ পাওয়ার মতো চমকে উঠে কিছুক্ষণ পরখের দিকে তাকিয়ে থেকে দু’দিকে মাথা নাড়ালো। নাহ, তার কোনো সমস্যা হয়নি।
কিন্তু পরখের তা বিশ্বাস হলো না। সে বাইক থেকে নেমে দারোয়ানের দিকে এগিয়ে গেল। সামনাসামনি দাঁড়াতেই অমলেশ ঢোক গিলে আড়চোখে পার্কের ভেতরটা আরেকবার দেখে নিল।
মেয়েটা এখনো ওখানেই বসে আছে। অন্ধকারে স্পষ্ট বুঝা না গেলেও ল্যাম্পপোস্টের আলোয় তার অস্তিত্ব অনুধাবন করা যায়। এই ছেলেটা উঠতি বয়সের যুবক। স্বভাব চরিত্র কেমন তা অমলেশ জানে না। একলা মেয়ে মানুষ দেখে যদি আক্রমণ করে বসে? অমলেশ বুড়ো মানুষ। সে কীভাবে রক্ষা করবে মেয়েটিকে?
এই বিপদের কথা ভেবেই তখন থেকে বলতেছিল,
‘বাড়ি যাও মা। একলা মেয়ে মানুষ এমন ফাঁকা জায়গায় থাকতে নাই। কখন কোন দিক থেকে বিপদ আসে বলা যায় না।’
কিন্তু মেয়েটিকে বড্ড জেদি। নিজ সিদ্ধান্তে সে অনঢ়। ওভাবে বসে থেকে কাঁদতে কাঁদতে বারবার একই কথা বলে যাচ্ছিলো,
‘দরজায় তালা দিয়ে আপনি চলে যান। আমি কোথাও যাবো না। এখানেই থাকব।’
মেয়েটাকে একা রেখে দারোয়ান কী করে চলে যায়? তার অনুপস্থিতিতে মেয়েটি বিপদে পরবে নিশ্চিত। তখন অমলেশ নিজেকে ক্ষমা করতে পারবে? কখনোই না। কতোই বা বয়স হবে মেয়েটির? সতের আঠারো বোধহয়। কুসুম রঙ্গা সালোয়ার কামিজ গায়ে। আলগা বেণী নেতিয়ে আছে কাঁধের একপাশে। বেশ কয়েক গাছি চুল এলোমেলো হয়ে মুখ ঢেকেছে। অনেকক্ষণ কাঁদছিলো বোধহয়৷ নাকের ডগাসহ দু চোখ লালচে বর্ণ ধারণ করেছে। অমলেশের ছোট ছেলের মেয়েটা সবে স্কুল যাওয়া শুরু করেছে। ও কাঁদলে এমন চোখ, মুখ লাল হয়ে যায়।
দরজায় সে তালা ঠিকই দিয়েছে। কিন্তু নিজে চলে যেতে পারেনি। দরজার এপাশে দাঁড়িয়ে অপেক্ষায় আছে এই বুঝি মেয়েটির হিতাহিতজ্ঞান ফিরে এলো, এই বুঝি বাড়ি যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল।
কিন্তু এতো ঝামেলার মাঝে এই ছেলেকে দেখে অমলেশ বিরক্ত হলো। এ আবার কই থেকে জুটল কে জানে!
অমলেশের দৃষ্টি অনুসরণ করে পরখ তাকালো পার্কের ভেতরে। প্রবেশ পথেই বড় বটগাছের নিচটা সিমেন্ট দিয়ে বাঁধাই করা৷ তারই নিচে একটি মানবমূর্তি নিশ্চল বসে আছে। নাহ, একদম নিশ্চল নয়। ক্ষণে ক্ষণে কেঁপে উঠছে তার দেহ।
চোখ সয়ে আসা অন্ধকারে কিছুপল তাকিয়ে থেকে পরখ বুঝতে পারল, মানবমূর্তিটি একটি মেয়ের।
সে ঘাড় ফিরিয়ে অমলেশের দিকে সন্দিহান চোখে তাকিয়ে বলল,
‘মেয়েটি কে?’
অমলেশ কেমন চুপসে গিয়ে জানাল,
‘আমি চিনি না। দুপুর থাইকা বইসা রইছে। যাইতাছে না।’
পরখের মস্তিষ্কে সদ্য উন্মোচিত হলো নতুন আশংকা। সে দ্রুত পায়ে দরজার দিকে এগিয়ে গিয়ে দেখল সেখানে তালা ঝুলছে। এদিকে অমলেশ নিজেও হকচকিয়ে গিয়ে পরখের পিছু ছুটল।
‘আরে করেন কি? আপনে কই যান?’
‘দরজা খুলেন।’
‘খুলুন যাইবো না। পার্ক বন্ধ হইয়া গেছে।’
‘ভেতরে এখনো একজন বসে আছে। অথচ আপনি দরজা বন্ধ করে দিয়েছেন!
‘ভেতরে আপনার কি কাম? কোনো ঝামেলা কইরেন না। পুলিশে খবর দিমু কইলাম। একলা মাইয়া দেখলে হুশ থাকে না? যান এইখান থাইকা।’
অমলেশের আশংকাজনক কথায় পরখের কপালে সামান্য ভাঁজ পরল। সে ঝাঝালো কণ্ঠে শুধালো,
‘এক্সকিউজ মি? কীসব বাজে কথা বলছেন? আমাকে দেখে ধান্দাবাজ মনে হচ্ছে? আমি একজন ভার্সিটির লেকচারার৷ সবাইকে এক পাল্লায় মাপবেন না।’
অমলেশ হার মানলো না। একগুঁয়ে স্বরে বলল,
‘আইডি কার্ড দেখান।’
পকেট থেকে আইডি কার্ড বের করে অমলেশকে দেখিয়ে দিয়ে পরখ বলল,
‘এবার তালা খুলুন। আমার মনে হচ্ছে, মেয়েটিকে আমি চিনি।’
মনের অজান্তেই একজন শিক্ষক এর প্রতি সম্মান চলে আসে৷ একটু আগে অমলেশ যাকে বখাটে কেউ ভেবেছিল, এখন তার প্রতি সম্মান, বিশ্বাস দুটোই জন্ম নিল। মুহূর্ত ব্যয় না করে অমলেশ দ্রুত তালা খুলে দিলো। বেশি ঝামেলা হলে এমনিতেই তাকে পুলিশে খবর দিতে হবে। সেই ক্ষেত্রে সঙ্গে আরেকজন থাকলে সুবিধা হয়।
আদ্রিকা বসে আছে ঠান্ডা সিমেন্টের উপর। নিচ থেকে শীতলতা অনুভব করলেও দুই কান উত্তপ্ত হয়ে আছে। চোখ বেয়ে গড়িয়ে পরছে উষ্ণ জলের ধারা। দারোয়ানের পিছু পিছু সে পার্কের বাইরে চলেই এসেছিল। তখনি পার্কের সামনের রাস্তা দিয়ে দ্রুত বেগে চলে গেল বাইকটি। আদ্রিকা থমকে দাঁড়িয়েছিল কিছুক্ষণ। তারপর দ্রুত বেগে ফিরে এসে এখানে বসে পরেছে।
ঘুটঘুটে অন্ধকার রাতে রাস্তায় একলা চলাকালীন বাইক চালক তার যেকোনো ধরনের ক্ষতি করতে পারে। ওর বহুদিনের নিশানা আদ্রিকা। সুযোগ পেলে ছাড়বে কেনো? আদ্রিকার মনে হচ্ছে, সে খুব বিশ্রী একটা ফাঁদে আটকে গেছে। সামনে কুয়া পেছনে খাল। বাড়ির বাইরে বের হওয়াটাই বিশাল ভুল হয়ে গিয়েছে৷
এর থেকে পরখের বাড়িতে বসে ওর ভৎসনা শুনা সহজতর। শুধু একটু সয়ে নিলেই হয়ে যায়৷ কোনো বিপদের ভয় নেই।
আজ এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে আদ্রিকা নিজের মায়ের পরিস্থিতি অনুধাবন করতে পারছে। কেনো তার মা, এতোকিছু সহ্য করে ওমন একটা সংসারে বছরের বছর পরে আছে।
মেয়েদের বড্ড লোভ। ওই মাথার উপর সুরক্ষার ছাদটার লোভ। ছায়াতল হতে একবার বেরিয়ে গেলে ঘাপটি মেরে থাকা বিপদগুলো চর্তুদিক থেকে হা রে রে রে করে বেরিয়ে আসে। থাবা মারে খুব সহজে৷ এই বিপদ সম্পর্কে পুরুষ নারী উভয়ই অবগত। তাই তো নারী তার সুরক্ষা চক্র থেকে বের হওয়ার সাহস করে না। অন্যদিকে পুরুষ নারীর সেই দূর্বলতার সুযোগ নিতে পিছপা হয় না।
নিজস্ব পুরুষ ব্যতীত এ সমাজে নারী আজও অরক্ষিত। একবার শুধু রাতের আঁধারে বেরিয়ে দেখো। এই সমাজ তোমার সমস্ত সাহসীকতা এক নিমিষেই শুষে নিয়ে তোমাকে নিঃস্ব করে ছুড়ে ফেলে দিবে। ভাবতেই আদ্রিকার সারা গায়ে কাটা দিয়ে উঠছে।
নিশ্চল বসে থেকে সে অনুভব করতে পারছে কিছু হিংস্র দৃষ্টি৷ অগণিত কালো হাত। যারা দিনের আলোয় আদ্রিকার দিকে শুধু ফ্যালফ্যাল করে চেয়েছিল। তাদের অপেক্ষা আঁধারের। যার সম্মুখে এখন আদ্রিকা বসে আছে৷ নিরুপায়, নিঃসঙ্গ।
পরখ দ্রুত পায়ে আদ্রিকার দিকে এগিয়ে গিয়ে ঠিক দু হাত দূরত্বে দাঁড়িয়ে সাবধানতার সাথে ডেকে উঠল,
‘আদ্রিকা?’
আদ্রিকা তখনো মাথা নিচু করে নিঃশব্দে চোখের জল ফেলছে৷ পরখের ডাকে মুখ তুলে চেয়ে হঠাৎ ঠোঁট উল্টে সশব্দে কেঁদে উঠল। তা দেখে পরখ দ্রুত এগিয়ে গিয়ে দুরত্ব মিটিয়ে সামনাসামনি দাঁড়ালো। ততক্ষণে আদ্রিকা উঠে দাঁড়িয়েছে৷ দু হাতের শক্ত বাঁধনে পরখকে জড়িয়ে ধরে বুকে মুখ গুঁজে সে কাঁদতে থাকল।
অমলেশ বেচারা এমন দৃশ্যের সাক্ষী হয়ে খানিকটা বিব্রত। তবুও নিরাপত্তার খাতিরে তাকে জানতে হবে। প্রশ্ন করল,
‘আপনার কে হয়?’
পরখ খেয়াল করলো, আদ্রিকার পুরো শরীর থরথর করে কাঁপছে৷ খুব ভয় পেয়েছে মনে হয়। সে এক হাত তুলে আদ্রিকার পিঠে রাখল। অন্য হাতে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে জবাব দিলো,
‘আমার স্ত্রী।’
অমলেশ ভেবেছিল উঠতি বয়সের ছেলেমেয়ের প্রণয় ঘটিত ব্যাপার। এই পার্কে এমন অগণিত দৃশ্যের সাক্ষী সে হয়েছে৷ মারামারি, ঝগড়াঝাটি, মাটিতে গড়াগড়ি দিয়ে কান্নাকাটি সবই তার দেখা শেষ। এবার স্বামী স্ত্রীর মান অভিমানও দেখা হয়ে গেল। সে আর দাঁড়িয়ে রইল না। উল্টোপথে ফেরার আগে জানাল,
‘তাড়াতাড়ি বের হয়ে আসেন। তালা দিতে হবে।’
ক্রন্দনরত আদ্রিকাকে সামলানো কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। সে গলা ছেড়ে একদম ছোট শিশুর মতো কেঁদে চলেছে। পরখ নিরুপায় স্বরে বলল,
‘আচ্ছা হয়েছে৷ আর কেঁদো না। বাড়ি চলো।’
আদ্রিকা ওকে আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বুকের আরও গভীরে মুখ ডুবালো। পরখের গায়ের জ্যাকেট বোধহয় কান্নার স্রোতে ভিজে জবজবে হয়ে যাবে আজ৷ সে মাথা থেকে হাত নামিয়ে ওর বাহু ধরে নিজের থেকে দূরে সরানোর চেষ্টা করে বলল,
‘রাত নেমেছে। দরজায় দারোয়ান তালা দিবে৷ বাড়ি গিয়ে কান্নাকাটি করো। চলো এখন।’
বুক হতে মাথা তুলে আদ্রিকা সোজা হয়ে দাঁড়াল। পরখের হাতের বাঁধন থেকে বাহু ছাড়িয়ে নিয়ে দু হাত মুষ্টিবদ্ধ করে প্রশস্ত বুকে অনবরত আঘাত করতে করতে বলল,
‘আপনি ইচ্ছে করে এমন করেন। প্রতিনিয়ত অপমান করেন, আজেবাজে কথা বলেন। আপনি জানেন আমার যাওয়ার কোনো জায়গা নেই৷ তাই আমার সাথে সবসময় এমন করেন। আমার দুর্বলতার সুযোগ নেন। একটা ভীতু, কাপুরুষ আপনি৷ দূর্বলকে আঘাত করে আনন্দ পান। আপনি জানেন আমি কোথাও যেতে পারবো না, তাই বারবার তাড়িয়ে দেন। দূরছাই করেন।’
পরখ অনড়ভাবে দাঁড়িয়ে রইল। আদ্রিকার দূর্বল মুষ্টির আঘাতে তার শরীর সামান্য দুলে উঠছে মাত্র। অন্যদিকে আদ্রিকা নিজেই হাঁপিয়ে গেছে। পরখ আলতো হাতে ওর দু হাতের কব্জি ধরে ওকে থামাল। দূর্বল দেহটিকে নিজের বুকের মাঝে জায়গা দিয়ে বলল,
‘হুশ। অনেক হয়েছে আর কেঁদো না।’
আদ্রিকার শ্বাস খাটো হয়ে এসেছে৷ অনবরত শ্বাস ফেলার মাঝে কোনোরকমে বিড়বিড় করে বলল,
‘ওরা আমার মাকে অভিশাপ দিয়েছে। এখন আর আমি ও বাড়িতে যেতে পারবো না। আমার কোথাও যাওয়ার জায়গা রইলো না। আমার আর কিছুই নেই, কেউ নেই। আপনি সব জানতেন, তাইতো কথায় কথায় আমাকে বের হয়ে যেতে বলেন। আপনি জানতেন, আমার যাওয়ার কোনো জায়গা নেই। যতোই লাথি ঝাটা মারেন, প্রতিবাদ করার সামর্থ্য নেই৷ আপনারা পুরুষ মানুষ শুধু নারীর দূর্বলতার সুযোগ নিতে পারেন। আর কিছুই পারেন না। আপনারা ভীষণ স্বার্থপর। আপনি পরখ ভীষণ, ভীষণ অহংকারী। বাজে একটা মানুষ আপনি।’
পরখ কিছু বলল না। শুধু চুপচাপ শুনে গেলো। দূর হতে অমলেশ হাঁক দিচ্ছে৷ বুকের মধ্যে লেপ্টে আছে নিশ্চল একটি দেহ। অসাঢ় শরীরটির মধ্যে সামান্য প্রাণের স্পন্দন ছাড়া আর কিছুই অনুভব করা যায় না। দীর্ঘ লড়াই শেষে সে জীবনীশক্তি শুণ্য।
পরখ আর দাঁড়ালো না। গায়ের জ্যাকেট খুলে আদ্রিকার গায়ে জড়িয়ে দিয়ে ওর এক হাত ধরে ওকে নিয়ে পার্কের বাইরে চলে এলো। আদ্রিকা কিছু বললো না, প্রতিবাদ করলো না। কোনোদিকে না তাকিয়ে চাবি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত পুতুলের মতো হেঁটে গিয়ে পরখের বাইকের পেছনে বসল।
বাইকটি চলে যেতেই অমলেশ দরজায় তালা ঝুলিয়ে দিয়ে বাড়ির দিকে চলল। আকাশে আজ সম্পূর্ণ চাঁদ জেগেছে। তাকে ঘিরে রেখেছে অজস্র তারা৷ কেউ ডুবছে, কেউ হাসছে। কিন্তু নিজ গড়িয়াম স্থির নীলাম্বরের মহামান্য। গায়ে কলঙ্কের দাগ নিয়েও সে আত্মবিশ্বাসে পরিপূর্ণ। হাসিমাখা ঝলমল চন্দ্রের সামনে দাঁড়িয়ে কার সাধ্য তার কলঙ্কের কথা কয়? ত্রুটিপূর্ণ চন্দ্রকে তার দৃঢ় আত্মবিশ্বাসী মনোভাব ত্রুটিহীন বানায়।
চলবে
#অক্ষরময়ী
#পরিণয়ে_নোলককন্যা (কপি নিষেধ)
|২২|
রোজকার নিয়মে আজও সূর্য উঁকি দিচ্ছে জানালার পর্দায়। ওর নিত্যদিনের কাজ হচ্ছে ঘুমন্ত পরখকে বিরক্ত করা। আজও নিম্নবর্গের লম্পটের মতো পরখের গালে, ঠোঁটে, কপালে লেপ্টে গেলো। এক হাতে চোখ আড়াল করে পরখ তাকাল খোলা জানালার দিকে৷ শুভদৃষ্টি বিনিময়ে মিষ্টি রোদ লাজুক হেসে দৃষ্টি নামিয়ে নিল। আলতো হেসে পরখ বিছানা ছাড়ল। ধীর পায়ে হেঁটে গিয়ে সরিয়ে দিলো জানালার পর্দা। অনুমতি পেয়ে হুড়মুড় করে কক্ষে প্রবেশ করল দস্যি রোদ্দুর। দীর্ঘ হাই তুলে পরখ কক্ষ ত্যাগ করল। ওয়াশরুমে যাওয়ার আগে উঁকি দিলো আদ্রিকার কক্ষে। নাহ, এখন বন্ধ রয়েছে।
দ্রুত গোসল সেরে শুকনো জামা কাপড় পরে কক্ষে যাওয়া উচিত ছিল। ভার্সিটিতে আজ নয়টায় একটা ক্লাস আছে৷ অথচ পরখ কক্ষের দিকে গেলো না। খাবার টেবিলের উপর ঢেকে রাখা বাটির ঢাকনা তুলে দেখল, রাতের খাবার ওভাবেই রয়েছে৷
গত রাতে বাড়ি পৌঁছে আদ্রিকা সোজা চলে গিয়েছে নিজের কক্ষে৷ সারা রাস্তায় যে মৌনব্রত সে পালন করেছিল, তা এখনও চলমান। পরখ নিজের হাতে খিচুড়ি রেঁধে, ফ্রিজে রাখা মুরগির তরকারি গরম করে আদ্রিকাকে ডেকেছিল। কিন্তু সে সাড়া দেয়নি৷
বাধ্য হয়ে পরখ কক্ষের দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করেছিল।
মেঝের উপর জীর্ণশীর্ণ তক্তপোষের উপর বিপরীত দিকে মুখ করে শুয়ে ছিল আদ্রিকা৷ সে দৃশ্য মোটেও সুখকর নয়। এক মুহূর্তে পরখের মনে পরে গিয়েছিল, পথের ধারে অবস্থানরত গৃহহীন মানুষগুলোর কথা। তাদের সাথে আদ্রিকার যেনো অদ্ভুত মিল। একা, অবহেলিত, অরক্ষিত প্রাণী। অবশ্য পার্থক্য একটি আছে। ওদের মাথার উপর খোলা আকাশ, অন্যদিকে আদ্রিকার মাথার উপর ইট সিমেন্টের ছাদ৷ মাঝেমধ্যে আদ্রিকা ঠিকই বলে, পরখকে বিয়ে করে সে মোটেও সুখে নেই। অন্য কোথাও বিয়ে হলে কিংবা বাবার বাড়িতে থাকলে ওকে নিশ্চয়ই মেঝেতে শুতে হতো না।
অজান্তেই একটা অপরাধবোধ পরখকে গ্রাস করে নিল। সে খোলা দরজায় টোকা দিয়ে মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করলো, কিন্তু আদ্রিকা অনড়। ও যে জেগে আছে, তা পরখ খুব ভালো করে জানে। ইচ্ছে করেই সাড়া দিচ্ছে না। পরখ বলল,
‘টেবিলে খাবার দিয়েছি। খেয়ে এসে ঘুমাও।’
আদ্রিকা উত্তর দেয়নি৷ বরং নিস্তব্ধতায় জানিয়ে দিয়েছে নিজের কথা। গায়ের চাদরটি টেনে মাথা পর্যন্ত ঢেকে নিয়েছে। সে দৃশ্য দেখে পরখের আর কিছুই বলার ছিল না। দরজা চাপিয়ে সে ফিরে এসে নিজের খাবার খেয়ে বাকিটা টেবিলেই ঢেকে রেখেছিল। যাতে রাতে ক্ষুধা লাগলে আদ্রিকা খেতে পারে। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, সারারাত ও ঘর থেকে বের হয়নি। রাগারাগির কারনে গতকাল দুপুরেও ওদের কিছু খাওয়া হয়নি। দীর্ঘসময় না খেয়ে থাকার ফলে আদ্রিকার ক্ষুধা লাগা স্বাভাবিক। কিন্তু কার প্রতি জেদ দেখিয়ে সে খাচ্ছে না তা স্পষ্ট নয়।
পরখ দ্রুত নিজের কক্ষে চলে গেল৷ ল্যাপটপ ব্যাগটি গুছিয়ে রেখে আবার চলে গেল রান্নাঘরে৷ কিছু একটা খেয়ে বের হতে হবে৷ তার জন্য রান্নার কাজটি আজকে ওকেই করতে হবে। পরখের পরণে ফর্মাল কালো প্যান্ট, জলপাই রঙের ফুলস্লিভ শার্ট, বামহাতের কব্জিতে চামড়ার ঘড়ি, পায়ে কালো জুতো সকালের আলোয় চকচক করছে। সে শার্টের স্লিভস কনুই পর্যন্ত গুটিয়ে নিলো। ফ্রিজ থেকে ডিম বের করে তাতে পাউরুটি ভিজিয়ে তেলে ভেজে নিল। সেগুলো টেবিলে রেখে গটগট করে চলে গেল আদ্রিকার কক্ষের সামনে। দরজায় টোকা দিয়ে কোনো সাড়া পাওয়া গেল না। এদিকে পরখের দেরী হয়ে যাচ্ছে। বের হতে হবে। সকালবেলা এক কাপ চা না খেয়ে বের হলে মাথা ধরা ভাবটা কমবে না। পরখ আবার চা খুব ভালো বানাতে পারে না। কোনোরকমে চলার মতো স্বাদহীন চা। যা খেলে সারাটি দিন খুব বিশ্রী কাটবে, সে ব্যাপারে সে নিশ্চিত।
হাত ঘড়িতে চোখ বুলিয়ে সশব্দে দরজা ঠেলে কক্ষের ভেতরে ঢুকে দেখল আদ্রিকার ঘুম ভেঙেছে৷ বিছানার ঠিক মাঝখানে বসে তাকিয়ে আছে জানালার দিকে৷ দরজা খোলার শব্দে পরখের দিকে একনজর তাকিয়ে আবারও জানালার দিকে তাকাল। পরখ এগিয়ে গিয়ে ওর ডান হাতের বাহু ধরে ওকে দাঁড় করিয়ে বলল,
‘দ্রুত ফ্রেশ হয়ে দু কাপ চা বানাও। আমার দেরী হয়ে যাচ্ছে৷ বের হতে হবে। ’
এমন আদেশ আদ্রিকার ঘুমকাতুরে মস্তিষ্ক ধাতস্থ করতে না পেরে সরু চোখে তাকালে পরখ ধমকিয়ে উঠল।
‘কাম অন হারি আপ। ইউ হ্যাভ অনলি ফাইভ মিনিটস।’
পরখ বেরিয়ে গেলে আদ্রিকা মনে মনে কয়েকটা গালি দিল। নাহ, নাহ৷ সকালবেলা উঠে বাজে ভাষায় গালিগালাজ করা মোটেও ঠিক হয়নি৷ সৃষ্টিকর্তার নিকট তওবা করে কক্ষ থেকে বের হয়ে দেখল টেবিলে বসে পরখ গাপুসগুপুস করে খাচ্ছে৷ আদ্রিকা দ্রুত ফ্রেশ হয়ে রান্নাঘরে গিয়ে দু কাপ চা বানালো।
টেবিলের উপর কাপ নামিয়ে রাখতেই পরখ হাত বাড়িয়ে তা তুলে নিল। আদ্রিকা ফিরে যাওয়ার আগেই একটি প্লেটে দুটো পাউরুটি তুলে দিয়ে পরখ আদেশ করল,
‘এখানে বসে নাস্তা করো।’
আদ্রিকা একবার প্লেটের দিকে তাকাল, আরেকবার নিজ কাজে ব্যস্ত পরখের দিকে। ক্ষুধার্ত অবস্থায় বেশি কিছু ভাবার দরকার হলো না। পরখের পাশের চেয়ারে স্থান দখল করে সে খেতে শুরু করল।
পরখ বেরিয়ে গেলে আজকে আদ্রিকার হাতে তেমন কোনো কাজ রইল না। দুপুরের জন্য দুটো পদের তরকারি, ভাত রান্না করে পুরো বাড়ির ধুলো ময়লা পরিষ্কার করে ফেলল। কাজ শেষ করে নীহারকে কল দিলে সে প্রথমেই প্রশ্ন করল,
‘আচার তৈরি করছিস?’
মেঝেতে পাতানো বিছানার উপর বসে আকাশে দিকে তাকিয়ে আদ্রিকা উদাস কণ্ঠে জবাব দিল,
‘নাহ। করিনি।’
‘কেনো?’
‘এখন আর ইচ্ছে করছে না।’
‘এই কয়েকদিনে সংসার করার শখ মিটে গেলো?’
‘খোঁচা দিয়ে কথা বলবে না তো। ভালো লাগছে না।’
‘কেনো? কি হয়েছে?’
‘কিছু না।’
‘জামাইয়ের সাথে ঝামেলা করছিস নাকি?’
‘নাহ।’
‘তোর কথা শুনে তেমনি মনে হচ্ছে। শোন, পুরুষ মানুষ একটু রেগে গেলে দু চারটে কথা শুনিয়ে দিবেই৷ সেটা ধরে থাকলে থাকলে চলব না। ওসব মনে রাখিস না। রাগ পরে গেলে দেখবি আবার আগের মতো হয়ে গেছে। তুই আবার ছোট ছোট কথা ধরে রেখে মুখ ফুলিয়ে বসে থাকিস না যেনো।’
আদ্রিকার কণ্ঠ সিক্ত হয়ে এলো। নাক টেনে বলল,
‘অযথা জ্ঞান দিয়ো না। খোঁচা মেরে কথা বলছিলে সেটাই বরং বলো।’
‘এই তুই কাঁদছিস নাকি?’
‘নাহ, কাঁদবো কেনো?’
‘কণ্ঠ শুনে ওমনি মনে হচ্ছে৷’
‘কথা শুনে, কণ্ঠ শুনে তোমরা মায়েরা কতোকিছু অনুমান করে নেও! তোমাদের কাছে কি সুপার পাওয়ার আছে?’
‘মন খারাপ লাগছে কেনো? দুজনে ঝগড়া না করলে আর কি হয়েছে?’
‘কিছু না। এমনিতেই মন খারাপ লাগতে পারে না?’
‘কী জানি বাপু! আজকাল তোদের কী সব মুড সুয়িং না কি যেনো হয়! ওসব আমাদের কালে ছিল না। পিরিয়ডের ডেট আসলেই তোদের মন খারাপ হয়, মেজাজ ঠিক থাকে না, খেতে ইচ্ছে করে না৷ কতো নাটক বাবা! তোরও বোধহয় এই কারনেই এমন হচ্ছে।’
মায়ের কথায় আদ্রিকার মনে পরল৷ সত্যিই তো, সময় আসন্ন। মন খারাপের, অতিরিক্ত আবেগপ্রবণ হওয়ার কারনটি সে কিছুটা অনুধাবন করতে পারল। এর আগেও পরখ তাকে হেয় করে বহু কথা বলেছে। তখন ওতোটা খারাপ লাগেনি যতোটা গতকাল এবং এখনো লাগছে। প্রথম প্রেমের উন্মাদনায় অতিমাত্রায় সাহসীকতা দেখিয়ে মুখ থুবড়ে পরার পর সে আর কখনো শিরদাঁড়া সোজা করে মাথা তুলে তাকানোর সাহস করেনি। সবসময় মনে হতো, সে যাই করুক না কেনো ফলাফল দাঁড়াবে ব্যর্থতা। কিন্তু গতকাল সে আবারও আবেগ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়ে ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে ভুল পথে পা বাড়িয়ে ছিলো।
এই মুহূর্তে শুরু থেকে শেষটা কল্পনা করে লজ্জা এবং ভয়ে সে কুঁকড়ে গেলো। ইশ! মাথার উপরে কী বিপদটাই না তান্ডব করছিলো! নেহাৎ পার্কের দারোয়ান লোকটি দয়ালু ছিল। সে অন্যান্য মন্দ লোকের মতোন হলে আদ্রিকার লা/শটাও বোধহয় খুঁজে পাওয়া যেত না।
নিঝুম সন্ধ্যায় একলা পার্কে সে হাঁটছিল দারোয়ানের পিছু পিছু৷ লোকটি যদি মুখ চিপে ধরে কোনো এক ঝোপের আড়ালে নিয়ে গিয়ে তার উপর ঝাঁপিয়ে পরতো? ঝোপের বা কি দরকার? জনমানবহীন স্থানটিতে চলার পথটুকুও আদ্রিকার জন্য নিরাপদ ছিল না। মনে মনে আদ্রিকা হাজারবার প্রতিজ্ঞা করল, আর যাই হয়ে যাক না কেনো ভুল করেও কখনো এমন বোকামি সে করবে না।
এপাশে কোনো সাড়া না পেয়ে নীহার ডাকল,
‘হ্যালো? হ্যালো? শুনতে পাচ্ছিস না?’
‘পাচ্ছি। ওমনি হবে হয়তো।’
‘নিজের মন খারাপের ঝাল আরেকজনের উপর মিটাতে যাবি না। তোর মুড সুয়িং এর দায় আরেকজনের নয়। এটা মাথায় রেখে চলবি। ভালো না লাগলে, একলা চুপচাপ ঘরে বসে থাক। তাও পরখের সাথে ঝামেলা করতে যাইস না। পুরুষ মানুষ এতোসব বুঝবে না। একটা দুটো কথায় লেগে যাবে ঝগড়া।’
দুপুরের খাবারের পর পরখ আবারও বেরিয়ে গেলো। বাড়িতে আদ্রিকা একা। আজ নতুন রান্নার তাড়া নেই। ভাতঘুমের প্রস্তুতি নিচ্ছিলো, তখনি পর্তুলিকা কল দিল। নতুন গাছগুলো ঠিকঠাক লাগিয়েছে কিনা জিজ্ঞাসা করতেই আদ্রিকা অবাক হয়ে শুধালো,
‘আপনি গাছ পাঠিয়েছেন?’
‘হ্যাঁ। দেখোনি তুমি? কালকে পাঠিয়ে ছিলাম।’
‘স্যরি, স্যরি। একদম খেয়াল ছিল না।’
‘গিয়ে দেখো, আছে নাকি আধমরা হয়ে গেছে। বেছে বেছে ভালো গাছগুলো পাঠিয়েছি৷ নষ্ট করে ফেললে তোমাকে কঠোর শাস্তি দেওয়া হবে। কেউ গাছের অযত্ন করলে তাকে আমি একদম অপছন্দ করি।’
‘আমি এখনি দেখছি। একদিনে ওদের কিছু হবে না। আপনি চিন্তা করবেন না। আমি প্রোপার টেককেয়ার করবো।’
এক ছুটে আদ্রিকা এসে খোলা ছাদে উপস্থিত হলো। পশ্চিম পাশের রেলিংয়ে হেলান দিয়ে রাখা হয়েছে গাছগুলোকে। পট, মাটি, সার সবই আছে। তবুও কেনো যেনো আদ্রিকা আগ্রহ পাচ্ছে না। নাহ, অবহেলা করলে চলবে না৷ মনের হাতে নিয়ন্ত্রণ ছেড়ে দিলে মন কেমনের মেঘে সারা আকাশ ছেয়ে যাবে। আদ্রিকা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মনের লাগাম টেনে ধরলো। মন তাকে নয়, সে মনকে নিয়ন্ত্রণ করবে৷
চুলগুলো হাত খোঁপা বেধেঁ ওড়না গুজলো কোমরে৷ এলোমেলো পায়েচারি করে সারা ঘর খুঁজে প্রয়োজনীয় বস্তুটি খুঁজে না পেয়ে সে পরখের কক্ষে এসে থামল। নিবে না, নিবে না করেও বাধ্য হয়ে পরখের বীনব্যাগটি তুলে নিয়ে একছুটে কক্ষ থেকে বেরিয়ে ছাদে চলে এলো।
বীনব্যাগের উপর আসন পেতে বসে সে লেগে গেলো বৃক্ষরোপণ কর্মসূচিতে৷
পরখ যখন বাড়ি ফিরল তখন সন্ধ্যার আকাশে সূর্য প্রায় অস্তাগত। ক্লান্ত পা দুটো টেনে হিচড়ে ছাদ পর্যন্ত নিয়ে এসে সে থমকে দাঁড়াল।
ছাদের এককোনায় বসে আদ্রিকা পটে মাটি ভরছে৷ সেসবে পরখের আগ্রহ নেই৷ সে দেখছে তার শখের বীনব্যাগটিকে। যার উপরে বসে সে মোবাইলে গেম খেলত, ল্যাপটপে রিসার্চের কাজ করতো। সেই প্রিয় আসনটিকে ছাদে ধুলোময়লার উপর রেখে আদ্রিকা মাটি নিয়ে খেলছে৷
সে রেগেমেগে আদ্রিকার কাছাকাছি পৌঁছে পেছনে থেকে বীনব্যাগটি টান দিলো। আদ্রিকার পলকা শরীরটি ধুপ করে ছাদের মেঝেতে পরতেই সে সামান্য আর্তনাদ করে মাথা তুলে তাকাতেই পরখের রণমূর্তি স্বরুপ দেখে ভ্রু কুচকালো। রেগে যাওয়া উচিত তার অথচ পরখ কেনো রেগে আছে? সে ঝাঁঝালো কণ্ঠে জানতে চাইলো,
‘ফেলে দিলেন কেনো?’
দু হাত ভর্তি মাটি, বাম পাশের কপালে কোনাকুনি একটি মাটির রেখা চলে গেছে। নাকের ডগায় মাটির ছাপ। খোপা থেকে বেরিয়ে কয়েকগাছি চুল এলোমেলোভাবে মুখমন্ডল ঢেকে রেখেছে৷ কাধের একপাশ দিয়ে ওড়না টেনে তা কোমরে বেধেছিল, সেটি এখন খানিকটা ঢিলে হয়ে গেছে। ধূলোমাখা মলিন পেয়াজ রঙা সালোয়ার-কামিজ গায়ে মেঝের উপর থুবড়ে পরে বিরক্তিমাখা দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আদ্রিকা। কয়েক সেকেন্ডের জন্য অন্যমনস্ক হলেও পরখ দ্রুত নিজেকে সামলে নিয়ে কাঠকাঠ কণ্ঠে চিবিয়ে চিবিয়ে স্পষ্ট উচ্চারণ করল,
‘হাউ ডেয়ার ইউ? এটা বাইরে এনেছে কে? তুমি নিশ্চয়ই। কী হাল করেছো এটার! ইশ! ধূলো-ময়লা মাখিয়ে অবস্থা পুরো খারাপ করে ফেলেছো।’
‘একটু মাটিই তো লেগেছে৷ কাজ শেষ হলে পরিষ্কার করে দিবো। এতো কান্নাকাটির কি আছে?’
‘শাট আপ। এটা কি তোমার কাছে সস্তা প্লাস্টিকের টুল মনে হচ্ছে? নিয়ে এসে ধুপ করে ধুলোর উপর রেখে দিলে! বদ্ধ উন্মাদ কোথাকার। খবরদার আমার জিনিসপত্রে হাত দিবে না।’
বীনব্যাগটি তুলে নিয়ে পরখ বাড়ির ভেতরের দিকে চলে গেল। স্লাইডিং ডোর খুলে ভেতরে পা রাখার আগমুহূর্তে হঠাৎ ঘাড় ঘুরিয়ে চোখ সরু করে সন্দিহান কণ্ঠে প্রশ্ন করল,
‘এক মিনিট, এটা আমার রুমে ছিল৷ তুমি আনলে কীভাবে? তুমি আবার আমার রুমে গিয়েছো? এই তোমাকে আমি বারণ করেছিলাম না? আমার রুমে যাবে না।’
আদ্রিকা তখনো ওভাবেই বসে অবাক চোখে পরখের দিকে চেয়ে ছিল। সামান্য বসার জিনিসে সে বসেছে বলে এমন লাফালাফি করার কি আছে? ওটা তো বসার জন্যই তৈরি করা। সে গলা বাড়িয়ে চেঁচিয়ে বলল,
‘রুমে ঢুকেছি বেশ করেছি। একশবার যাবো, হাজারবার যাবো, বারবার যাবো৷ যা করার করে নিন।’
তারপর ঘাড় ঘুরিয়ে মাটিমাখা মেঝেতে বসেই শেষ গাছটির গোড়ায় মাটি দিতে থাকল। অসভ্য, অসামাজিক মেয়েটির ব্যবহার দেখে পরখ ভাষা হারিয়ে বিড়বিড় করল,
‘বেয়াদব একটা।’
পরেরদিন সকালবেলা নাস্তা শেষ করে পরখ বেরিয়ে যাচ্ছিলো, আদ্রিকা এসে সামনে দাঁড়িয়ে একদম চোখে চোখ রেখে আদেশের সুরে বলল,
‘আমার কিছু জিনিসপত্র লাগবে। আসার সময় নিয়ে আসবেন।’
সামান্য প্রজার উপর রাজার হুকুমজারিতে পরখ ভ্রু কুঁচকে তাকাল। এই মেয়ে কি সেই যে গতকাল কান্নাকাটি করে নিজের দূর্দশার কথা জানাচ্ছিলো, আহাজারি করছিলো? আজকে তাকে কোথায় দেখা যাচ্ছে না কেনো? এক রাতেই সমস্ত আত্মগ্লানি কোথাও ভাসিয়ে দিয়ে এসেছে নাকি?
দেরী হয়ে যাচ্ছে বলে সে আর জল ঘোলা না করে এক হাত পকেটে রেখে মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়িয়ে আদ্রিকার দিকে পূর্ণ দৃষ্টি রেখে বলল,
‘কারো কাছে কিছু চাইলে গেলে বিনয়ী স্বরে, বিনম্রতার সাথে চাইতে হয়৷ তোমার উচিত আমাকে অনুরোধ করা। আমার কিছু জিনিসপত্র লাগবে। আপনি নিয়ে আসতে পারবেন, প্লিজ?’
আদ্রিকা কিছু না বলে চোখ, মুখ কুঁচকে তাকিয়ে রইল। বিনম্রতার অধ্যায় বন্ধ করে পরখ বাধ্য হয়ে প্রশ্ন করল,
‘কি লাগবে?’
‘প্যাড, টিস্যু, সেনিটাইজার।’
আদ্রিকা গটগট করে বলে যাচ্ছিলো। পরখ হকচকিয়ে গিয়ে পকেট থেকে হাত বের করে দৃষ্টি নামিয়ে বলল,
‘স্টপ, স্টপ। টাকা দিয়ে দিচ্ছি, নিজে গিয়ে নিয়ে এসো।’
‘আমি বাইরে যাবো না। আপনি নিয়ে আসবেন।’
‘এসব কিনতে আমি শপে যাবো?’
‘যাবেন। কি সমস্যা? এগুলো খারাপ কিছু?’
‘নাহ। তবুও ইট’স অকওয়ার্ড।’
‘এগুলো কী কাজে লাগে সবাই জানে। লুকানোর তো কিছু নেই। বিয়ে করেছেন, বউয়ের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনতেই পারেন৷ এতে লোকে কি বলবে ভাবার কি আছে? নিজের প্রয়োজনে দোকানে গিয়ে ঠিকই তো ওইসব কিনতে পারেন। তখন অকওয়ার্ড লাগে না। প্রত্যেক স্বামীর উচিত বুক ফুলিয়ে বউয়ের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কেনা৷ আমার কথা বাদ দিন, কোনো মেয়ের বাবা যদি নিজেই এমন অস্বস্তিবোধ করে তাহলে তার মেয়ে কীভাবে তার কাছে চাহিদার কথা জানাবে? পরিবারের লোকজন যথেষ্ট স্পেস দেয় না বলেই সন্তানদের অস্বস্তি হয়, বাধ্য হয়ে অনেককিছু লুকিয়ে যেতে হয়।’
‘এসব ব্যাপারে সাহায্যের জন্য বাড়িতে মহিলা সদস্য থাকে। সব ব্যাপারে পুরুষদের ইনভলভ না করলেও চলবে।’
‘সবসময় ইনভলভ করাটা জরুরি নয়। কিন্তু প্রয়োজনের সময় যাতে সাহায্য চাইতে দ্বিধাবোধ না করে সেই পরিবেশ তৈরি করা জরুরি৷ ধরুন একটা মেয়ের মা নেই৷ কিংবা তার পিরিয়ডের সময় কোনো জরুরি কাজে তার মা বাইরে গেছে৷ তখন মেয়েটি কি করবে?’
‘নিজে গিয়েও নিয়ে আসতে পারে।’
‘ধরুন সে অসুস্থ হয়ে পরল। অনেকের প্রচুর পেইন হয়। অনবরত বমি করে, হাঁটাচলা পর্যন্ত করতে পারে না। তার পক্ষে নিশ্চয়ই নিজের টেককেয়ার করা পসিবল নয়। পরখ, আপনি কিন্তু এখনো মাটির দিকে তাকিয়ে কথা বলছেন। আমার দিকে তাকাচ্ছে না৷ এটা খুবই সাধারণ ব্যাপার। প্রত্যেক প্রাপ্তবয়স্ক মেয়ের পিরিয়ড হয়, এটা সবাই জানে। ইভেন, মেয়েদের থেকেও ছেলেরা এই বিষয়ে বেশি জানে। ওই যে নিষিদ্ধ কিছুর প্রতি মানুষের ব্যাপক আগ্রহ।’
পরখ আনত দৃষ্টি তুলে আদ্রিকার দিকে চাইল। সে জ্বলজ্বল চোখে তাকিয়ে আছে। পরখের দিকে ওভাবেই তাকিয়ে বলল,
‘জানি এটা ঢাক ঢোল পিটিয়ে বলার মতো কোনো বিষয় না, কিন্তু কলঙ্কের মতো লুকিয়ে চুপিয়ে রাখার মতো কোনো বিষয়ও নিশ্চয়ই না। অথচ আমাদের সমাজে এখনও এই নিয়ে প্রকাশ্যে কথা বলা বারণ। মেয়েদের এতোটাই ভীত করে রাখা হয় যে নিজের বাবা, ভাইয়ের কাছে পর্যন্ত সাহায্য চাইতে পারে না৷ আগের কথা বাদ দিন, বিয়ের পর একজন পুরুষ পিরিয়ড এর ব্যাপারে সমস্তটাই জেনে যায়৷ তার কি উচিত নয় এই ব্যাপারে নিজের মেয়ের প্রতি যত্নশীল হওয়া?’
অকারণ গলার টাই ঠিক করে নিয়ে পরখ বলল,
‘আচ্ছা ঠিক আছে। নিয়ে আসব। মাঝেমধ্যে এমন অদ্ভুত আচরন করো তুমি! এতো জ্ঞান দেওয়া শুরু করো যে ভড়কে যেতে হয়।’
আদ্রিকা সামান্য হেসে বলল,
‘চেপে রাখা ক্ষোভ ঝাড়ছি আপনার উপর। বাবাকে কখনো বলতে পারিনি তো, তাই চাইছি আপনার মেয়ে যেনো অন্তত আপনাকে বলতে পারে৷ ওই যে বলে না, পরিবর্তনের সূচনা হোক নিজের পরিবার থেকে৷’
‘আমার মেয়ে? হাউ ফানি!’
আদ্রিকা এক পা এগিয়ে এসে পরখের কাছাকাছি দাঁড়ালো। দু চোখ গোল গোল করে তাকিয়ে খুব আগ্রহভরে প্রশ্ন করল,
‘কেনো? আপনার বাচ্চাকাচ্চা হবে না? কোনো সমস্যা আছে আপনার?’
হতভম্ব পরখের মুখটি বিস্ময়ে হা হয়ে গেল। পরক্ষণে আদ্রিকার কাঁধে ধাক্কা দিয়ে ওকে সামনে থেকে সরিয়ে দিয়ে বলল,
‘সরো সামনে থেকে। আমার দেরী হয়ে যাচ্ছে৷ যতোসব অদ্ভুত প্রশ্ন!’
পরখ চলে গেলেও আদ্রিকা সারাটা দিন ভাবতে থাকলো, বাচ্চার কথাকে পরখ ফানি বললো কেনো? আদ্রিকার তো বাচ্চা ভীষণ পছন্দ। যদি সত্যি পরখের কোনো সমস্যা থেকে থাকে, তাহলে আদ্রিকার ছোট ছোট ছানাদের স্বপ্ন অধরাই থেকে যাবে। নাহ, নাহ। হেয়ালি করলে চলবে না। পরখের সাথে এ ব্যাপারে জরুরি আলোচনায় বসতে হবে।
চলবে…
#অক্ষরময়ী