পরিণয়ে নোলককন্যা পর্ব-২৩+২৪+২৫

0
120

#পরিণয়ে_নোলককন্যা (কপি নিষেধ)

|২৩|

নতুন মাসের প্রতিটি দিন ব্যস্ততায় কাটছে পরখের। সপ্তাহে তিনদিন নিজের ভার্সিটিতে ক্লাস নেয়, বাকি তিনদিন অন্য ভার্সিটিতে৷ মাত্র এক সপ্তাহে তিনদিন যাতায়াত করে ক্লান্ত হয়ে পরেছে শরীর৷ ভোরবেলা বাইক নিয়ে বেরিয়ে পরে ফিরে আসতে আসতে গভীর রাত। পরেরদিন সকালে আবার নিজের ভার্সিটিতে ক্লাস। সে যে এভাবে বেশিদিন ছুটতে পারবে না, তা এক সপ্তাহেই বুঝে গেছে৷

আজ শুক্রবার, সাপ্তাহিক ছুটির দিন। অলসতায় জেঁকে ধরেছে৷ ঘড়ির কাটা কতোদূর পৌঁছালো তাতে বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই। পাতলা চাদরে মাথা মুড়ে সে ঘুমিয়ে আছে।

সকালের নাস্তা তৈরি করে আদ্রিকা আবারও পরখের দরজায় উঁকি দিলো৷ নাহ, সে মহাশয় এখনো বিছানা ছাড়েনি৷ আজকাল পরখের সাথে খুব একটা দেখা সাক্ষাৎ হয় না৷ তাই ঝগড়াটাও হচ্ছে না। একলা বাড়িতে আদ্রিকার দিন কাটে গাছপালার দেখাশোনা করে৷ বাকিটা সময় সে ইউটিউবে বিভিন্ন ধরনের ভিডিও দেখে। রান্নার ভিডিও দেখলে রাঁধতে মন চাইবে, তাই সেসব বাদ।

আপাতত তার আগ্রহ মোটিভেশনাল ভিডিওতে৷ বোকা আদ্রিকা নিজেকে উন্নত করার যথাসাধ্য চেষ্টা করছে৷ কিন্তু শক্ত খোলসের ভেতরের নরম মনটার কি পরিবর্তন সম্ভব?

পরখ বাড়িতে না থাকায় একলা সময় কাটানোর অভ্যাস অবশ্য হয়ে গেছে৷ খাওয়া দাওয়াটাও করা হয় একলা একেলা। কিন্তু ঘরে একটি মানুষ বিদ্যমান, তাকে রেখে একলা নাস্তার টেবিলে বসে যাওয়াটা সম্ভব হচ্ছে না৷ এদিকে ক্ষুধাও লেগেছে ভীষণ। আদ্রিকা বাধ্য হয়ে দরজায় কড়া নাড়ল। মুখ হতে চাদর সরিয়ে উঁকি দিলো পরখ।

ঘুমকাতুরে চোখ দু’টো আরও ছোট দেখাচ্ছে। মাথার পরিপাটি চুলগুলো এলোমেলো। অত্যাধিক ঘুমের কারনে পরখের সুশ্রী, চিকন চোয়ালের মুখটি সামান্য ফুলকো দেখাচ্ছে৷

কি বলতে এসেছিল, তা ভুলে গিয়ে আদ্রিকা নির্নিমেষ চেয়ে রইলো। দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষার পরও কোনো জবাব না পেয়ে বিরক্ত পরখ জানতে চাইল,

‘কি হয়েছে?’

সদ্য জাগ্রত ভারী কণ্ঠস্বর কর্ণযুগলে পৌঁছানো মাত্র আদ্রিকার গায়ে সামান্য ঝাঁকুনির সৃষ্টি হলো। নিজস্ব দৈহিক প্রতিক্রিয়ায় সে সামান্য বিব্রত হয়ে চোখ নামিয়ে নিয়ে থেমে থেমে উত্তর দিলো,

‘নাস্তা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে৷’

‘আসছি।’

মোবাইলে সময় দেখে পরখ বিছানা ছাড়ল। সময় কীভাবে নয়টা পেরিয়ে গেছে বুঝতেই পারেনি৷ কক্ষ ত্যাগ করে চলে গেলো ওয়াশরুমের দিকে৷ কিন্তু আদ্রিকা অনড় রইল। পরখের কক্ষের দরজার পাশের দেয়ালে হেলান দিয়ে গভীর চোখে পরখের প্রতিটি কার্যকলাপ সে দেখতে থাকল।

কচুপাতা রঙের ঢিলেঢালা টি শার্ট, ধূসর রঙের ট্রাউজার গায়ে পরখ দাঁড়িয়ে আছে ওয়াশরুমের সামনের দেয়াল লাগোয়া বেসিনের সম্মুখে। আয়নায় নিজস্ব প্রতিবিম্বের দিকে দৃষ্টি রেখে দাঁত ব্রাশ করছে। রোজ সকালে পরখ এই কাজটি করে। তবুও আদ্রিকার চোখে আজ সবকিছু অন্যরকম লাগছে৷ কিছুটা নতুন, কিছুটা কাব্যিক৷ কাজের ফাঁকে আনমনে পরখ যখন চোখের পলক ফেলছে, আদ্রিকার বুকে ধক করে বেজে উঠছে কোনো সুরেলা বাদ্যযন্ত্র।

খাবার টেবিলে বসে প্লেটে খাবার তুলে নিয়ে পরখ তাকালো আদ্রিকার দিকে৷ দরজার সামনে নিশ্চল দাঁড়িয়ে থাকতে থেকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল,

‘তুমি খেয়েছো?’

আনমনে দুপাশে মাথা দুলালো আদ্রিকা। তা দেখে পরখ বিরক্ত হয়ে নিজের কাজ থামিয়ে আদ্রিকার দিকে পূর্ণ মনোযোগ দিয়ে বলল,

‘তাহলে ওখানে মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছো কেনো?’

ধমক শুনে আদ্রিকাকে ঘিরে রাখা ভ্রমের প্রজাপতিগুলো ডানা মেলে ফুড়ুৎ করে উড়ে গেলো। সে গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে এসে বসলো নাস্তার টেবিলে।

সচরাচর শুক্রবার মার্কেট বন্ধ থাকে। কিন্তু ভূবনভোলায় এখনো সে রীতি খুব একটা মান্যি করা হয় না। একটা দুটো দোকানবাদে বাকিসব খোলা আছে৷ রিক্সা থেকে নেমে পরখ চলে গেলো কাঙ্খিত দোকানটিতে৷ দোকানী এগিয়ে এসে বলল,

‘আপনার অর্ডার রেডি আছে। আসেন দেখাচ্ছি।’

দোকানের পেছনের অংশটিতে কয়েকজন শ্রমিক তখনো কাজ করছে৷ খোলা আকাশের নিচে সবুজ ঘাসের উপর রাখা কাঠের আসবাবপত্রের দিকে ইশারা করে দোকানী বলল,

‘এই যে এগুলা আপনার।’

কাঠের তৈরি একটি সিংগেল চৌকি, টেবিল এবং চেয়ার। নিরক্ষণ করার পর পরখ জানালো,

‘সব ঠিক আছে। নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দিন।’

দোকানীর নিজস্ব ডেলিভারি সিস্টেম আছে। সেখান থেকে একটি ভ্যান ডেকে নিয়ে এসে আসবাবপত্রগুলো তুলে দিয়ে রশি দিয়ে ভালোভাবে বেঁধে দিল। মূল্য পরিশোধের সময় খানিকটা বাড়তি আগ্রহ দেখিয়ে দোকানী জানতে চাইল,

‘মেসের জন্য নিচ্ছেন?’

পরখ খানিকটা বিব্রত হলো। বাড়ির জন্য সবাই মনে হয় দামী খাট ক্রয় করে৷ সে একমাত্র ব্যক্তি যে নিজের স্ত্রীর জন্য সিংগেল চৌকি কিনেছে৷ ভ্যানের একপাশের ফাঁকা জায়গায় বসে সে উত্তর দিল,

‘নাহ, বাড়ির জন্য।’

বন্ধ দরজায় ঠকঠক আওয়াজে আদ্রিকা ভ্রু কুঁচকে তাকালো। প্রথম কয়েকদিন দরজায় নক করলেও পরখ এখন সেসব কিছু করে না। স্লাইডিং ডোর খুলে ভেতরে প্রবেশ করলে এমনিতে যা সামান্য শব্দ হয় তাতেই আদ্রিকা বুঝে যায় পরখ এসেছে।
কিন্তু আজকে হঠাৎ দরজায় ঠকঠক আওয়াজ শুনে অন্য কারো আগমনের চিন্তা মাথায় এলো৷ এ আবার বাড়িতে কে আসতে পারে?

গায়ের ওড়নাটা আরেকবার টেনেটুনে নিজেকে ভালোভাবে ঠেকে দরজা খুলে পরখকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আদ্রিকা থমকালো। আজ এ মহাশয় দরজায় কড়া নাড়ছে কেনো?

ভ্রু নাচিয়ে সে জানতে চাইল,

‘কি হয়েছে?’

‘বাইরে এসে ছাদে দাঁড়াও।’

অবাক হলেও পরখের আদেশের বিপরীতে কোনো মন্তব্য না করে বিভ্রান্ত আদ্রিকা ছাদে এসে দাঁড়ালো। সিঁড়ি বেয়ে পরখ চলে গেলো নিচে। ছাদ থেকে উঁকি দিয়ে ভ্যানটি দেখতে পেলো আদ্রিকা। ভ্যানের উপর রাখা মালপত্র দেখে ভীষণ আগ্রহ ভরে তাকিয়ে রইল। ভ্যানচালক সহ পরখ সেগুলোকে তুলে নিয়ে গেল বাড়ির ভেতর। আদ্রিকা শুধু চেয়ে চেয়ে দেখল।

ভ্যানচালক চলে যাওয়ার পর সে দ্রুত পায়ে বাড়ির ভেতর ঢুকে পরখকে নিজের কক্ষে দেখে আরও খানিকটা অবাক হলো। কিন্তু সর্বোচ্চ ধাক্কাটা তখনো বাকি। ওর বিছানাপত্র মেঝে থেকে তুলে চৌকির উপর রেখে বিছানা গুছাচ্ছে পরখ।

কক্ষের চর্তুদিকে তাকিয়ে আদ্রিকা যানপরান অবাক। পশ্চিমের জানালার সাথে চৌকি রাখা হয়েছে। চৌকির পাশেই টেবিল এবং চেয়ার৷ সে বোকা বোকা চোখে সেগুলোর দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল,

‘এগুলো আমার জন্য?’

বিছানা গুছানো শেষে পরখ সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে আদ্রিকার দিকে তাকিয়ে বলল,

‘নাহ, আমার নিজের জন্য। ওই রুমে রাখার জায়গা নেই বলে এখানে রেখে গেলাম।’

নতুন বিছানায় পা ঝুলিয়ে বসে পা নাচাচ্ছে আদ্রিকা। আনন্দ, উচ্ছ্বাসে ছোট শিশুর ন্যায় উত্তেজিত সে। নতুন বিছানায় চিৎ হয়ে শুয়ে কিছুক্ষণ গড়াগড়ি দিয়ে শুয়ে সে ভাবল, আজকে স্পেশাল কিছু রান্না করা উচিত। এমনিতে আজ শুক্রবার বিধায় পরখ বাড়িতে থাকবে। ওর জন্য এতোকিছু কেনাকাটা করার বিপরীতে একটা ধন্যবাদ পরখের প্রাপ্য। খাটাস লোকটাকে মুখে ধন্যবাদ জানাতে গেলে দু’টো তিক্ত কথা বলে আদ্রিকার মন খারাপ করিয়ে দিবে। তাই সেসব না করে ভালো কিছু রান্না করে খাওয়ানো সহজ।

ফ্রিজ খুলে যা যা সামনে পেলো সবই বের করে নিয়ে এলো। ঘরদোর পরিষ্কারের কাজ বাদে আজকের সকল মনোযোগ রান্নায়৷ তাই বলে বাসি ঘরদোরকে এভাবে ফেলে রাখা যায় না। কোমরে ওড়না প্যাচানো অবস্থায় আদ্রিকার মাথায় সামান্য বুদ্ধি খেলে গেলো। নোংরা হাতে উঁকি দিলো পরখের কক্ষে। পরখ তখন নিজের ঘর গুছাচ্ছিল। আদ্রিকা বলল,

‘বসার ঘরটাও একটু পরিষ্কার করে নিয়েন। আমি রান্নার কাজে ব্যস্ত।’

নিজের কথা জানিয়ে আর অপেক্ষা করলো না। ঝটপট পালিয়ে এলো কক্ষ ছেড়ে। আদ্রিকার আদেশ যতোক্ষণে পরখের মস্তিষ্কে জায়গা করে নিয়েছে ততোক্ষণে আদ্রিকা কর্পূরের ন্যায় উড়ে গেছে৷ দু একটা ঝারি মারা যেতো কিন্তু সেই সুযোগ সে পেল না। নিজের কক্ষ পরিষ্কার করে বসার ঘরে গিয়ে দেখল সত্যিই একগাদা জিনিসপত্রের মাঝখানে হাবুডুবু খাচ্ছে আদ্রিকা৷ পরখ আর কিছু বললো না। বসার ঘর থেকে শুরু করে খোলা ছাদ পর্যন্ত পরিষ্কারের কাজে লেগে গেল। অবশ্য আদ্রিকার আসার আগে সাপ্তাহিক ছুটির দিন সে নিজেই এসব কাজ করতো৷ বিস্ময় তো ফুলবাবু সেজে ঘুরে বেড়ানোর কাজ থেকে ফুসরত পেতো না।

দুপুরের আয়োজনে ভাত, গরুর গোশত ভুনা, বুটের ডাল, মাছের চচ্চড়ি, কলমিশাক ভাজি, আলুভর্তা, এবং সালাদ। ভরা টেবিলে এলাহি আয়োজন দেখে পরখ খুশি হলেও কিছু বলল না৷ ক্ষুধা লেগেছ ভীষণ তাই সরাসরি খেতে শুরু করল। খানিক সময় বাদে আদ্রিকা ভীষণ আগ্রহ নিয়ে জানতে চাইল,

‘রান্না কেমন হয়েছে?’

খাওয়া থামিয়ে পরখ তাকালো ওর দিকে৷ হাসিমুখে ভীষণ আগ্রহ ভরা বড় বড় চোখ দুটো পরখের মুখের উপর নিবদ্ধ। সে দায়সারাভাবে জবাব দিলো,

‘ভালো।’

আদ্রিকার মুখের হাসি বিস্তৃত হলো। সকালের পবিত্র রোদের মতো ঝলমল করে বলল,

‘আমি এখন অনেককিছু রান্না করতে পারি। আগের মতো বাজে হয় না৷ পাক্কা রাঁধুনি হয়ে গেছি না?’

‘হুম।’

পরখের এক শব্দের জবাবে আদ্রিকার আগ্রহে ভাঁটা পরলো। আড়ালে ভেংচি কেটে সে নিজের খাওয়ায় মনোযোগ দিল।

খাওয়া শেষে একগাদা থালাবাসন পরিষ্কার করতে গিয়ে আদ্রিকার কোমর ব্যথা হয়ে যাচ্ছে। এতোগুলো রান্না করতে গিয়ে খুব একটা কষ্ট হয়নি৷ কষ্ট হলেও খাওয়াদাওয়ার উত্তেজনায় তা অনুভব করেনি। কিন্তু এখন খাওয়ার পর থালাবাসন ধুতে গিয়ে সে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলো, আর জীবনেও এতোগুলো পদ একসাথে রাঁধবে না।

গোমড়া মুখে এঁটো থালা দুটো ধুয়ে কিচেন র‍্যাকে রাখলো। তখনি র‍্যাকের উপর পোলারের একটি ছোট বাটি আইসক্রিম রেখে দিয়ে পরখ গটগট করে নিজের কক্ষে চলে গেলো৷
লাজুক হাসি দেখা দিল আদ্রিকার মুখে। দাঁত দ্বারা নিচের ঠোঁট আকড়ে সেই উচ্চ হাসি রোধ করলো। তারপর নতুন উদ্যোমে বাসন ধোঁয়ার কাজ শেষ করলো।

কানে ইয়ারফোন গুজে পায়ের উপর ল্যাপটপ রেখে কিছু একটা দেখছিল পরখ। হাতে আইসক্রিমের বাটি। দরজায় ঠকঠক আওয়াজে এক কান হতে ইয়ারফোন খুলে আদ্রিকার দিকে তাকালো। দরজা সামান্য ফাঁকা করে সেখান থেকে উঁকি দিয়ে নিজ হাতে ধরে থাকা আইসক্রিমটি দেখিয়ে আদ্রিকা বলল,

‘থ্যাঙ্কিউ।’

তারপর সে চলে গেল নিজের কক্ষে৷ পরখ মনোযোগ দিলো ল্যাপটপের স্ক্রীনে।

________

পরখের ব্যস্ততার কারনে পুরো সপ্তাহের বাজার একদিনে করা হয়। শুক্রবার সকালে নাস্তা শেষ করে ব্যাগ নিয়ে চলে যায় বাজারে৷ আদ্রিকার তৈরি লিস্ট অনুযায়ী বাজার করে নিয়ে আসে৷ আজকে বাজারের ব্যাগটি টেবিলের উপর রেখে পরখ বলল,

‘মিষ্টি আলুর সাথে বিটরুট দিয়ে কোরমা তৈরি করা যায়৷ বেশ সুন্দর লালচে একটা কালার আসে। ইউ ক্যান ট্রাই দ্যাট।’

ব্যাগ হতে বাজার-সদাই বের করতে গিয়ে কিছু বিটরুট পেলো আদ্রিকা। মায়ের বাড়ি থেকে পাঠানো মিষ্টি আলুগুলো এখনো আছে। ইউটিউব ঘেটে সহজেই রেসিপিটি পেয়ে গেলো। বিটরুট, মিষ্টিআলু ভাপ দিয়ে সেদ্ধ করে নিয়ে বিকালের নাস্তায় কোরমা তৈরি করে দেখল সত্যি বেশ লোভনীয় লালচে রঙ এসেছে৷

সেই মুহূর্তে কেনো যেনো আবারও অদ্ভুত সব রেসিপি তৈরির ভূতটা জেগে উঠলো। তবে কি পরখও চাইছে সে নতুন নতুন রেসিপি উদ্ভাবনের কাজে আবার ফিরে যাক?

পরখ যেদিন শহরের বাইরে ক্লাস নিতে যায় সেদিন বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় আদ্রিকাকে বলে যায়,

‘ফিরতে দেরী হবে।’

এতোটুকু কথায় আদ্রিকা ভীষণ খুশি হয়৷ কেনো দেরী হবে, কোথায় যাচ্ছে সেসব ও জানতে চায় না৷ হয়তো দায়িত্ববোধ থেকে পরখ ওকে জানিয়ে যায় কিন্তু পরখের জীবনে এইটুকু গুরুত্ব পাওয়াতেই আদ্রিকা ভীষণ খুশি।

এক কক্ষে না হোক, একই ছাদের নিচে ওরা রাত কাটায়। প্রতি বেলা না হোক, অন্তত একবেলা ওরা একই টেবিলে একসাথে বসে খাবার খায়। সব কথা বলা না হোক, প্রয়োজনীয় কিছু কথা অন্তত ওদের মাঝে হয়। এইটুকুই বা কম কীসে!

আজকে পরখ বাড়ি ফিরিছে একগাদা খাতাপত্র নিয়ে। ক্লাসটেস্ট নিয়েছে বোধহয়। ভার্সিটি থেকে ফিরে সেগুলো নিয়েই ব্যস্ত হয়ে আছে। যত্নবান বউ হওয়ার চেষ্টায় আদ্রিকা অবশ্য বেশ কয়েকবার চা করে দিয়ে এসেছে৷ কিন্তু সে মহাশয় মুখ তুলে একটা ধন্যবাদ পর্যন্ত দেয়নি৷ তা নিয়ে আদ্রিকার অবশ্য বিশেষ মন খারাপ নেই। এই মুহূর্তে সে নিজের নতুন বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে মোবাইলে নতুন রেসিপি খুঁজতে ব্যস্ত।

পাশের কক্ষ থেকে মৃদু শব্দে গানের সুর ভেসে আসছে। গান শুনতে শুনতে খাতা কাটছে পরখ।
খাওয়া দাওয়ার পর পরখের কক্ষে আরেক কাপ চা নিয়ে হাজির হয়েছিল সে। বিছানার উপর খাতাপত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে রেখে চোখে রিডিংগ্লাস পরে লাল কলম হাতে হৃদয়হীন মানুষটি একটি খাতায় কচ কচ করে ক্রস চিহ্ন এঁকে দিল। চায়ের কাপ টেবিলের উপর নামিয়ে রেখে আদ্রিকা দাঁড়িয়ে থেকে দেখল খাতার প্রথম পাতায় বড় করে দুটো শুন্য লিখে সেটিকে অবহেলায় আরেকপাশে রেখে দিল পরখ।

কোন বেচারার খাতার উপর এই ক/সাই লোকটি এমন ঝাঁঝ মিটালো কে জানে! ভাগ্যিস এমন শিক্ষক আদ্রিকার কলেজে নেই। কলেজের কথা মনে পরায় সামান্য মন ভার হয়ে এলেও সেটিকে তেমন একটা পাত্তা দিল না। এক জীবনে সব পেতে হবে এমন কোনো কথা নেই। যা পাচ্ছে তাই বা কম কীসে!

সে ভাবলো এই পরীক্ষার্থীদের কথা। যাদের খাতায় গোল গোল ডিম আঁকা হচ্ছে৷ আগামীকাল খাতা হাতে পেয়ে এরা নিশ্চয়ই আদ্রিকাকে বকবে।

বউয়ের সাথে ঝগড়া করে তাদের শিক্ষক মহাশায় বউয়ের রাগ তাদের খাতার উপর ঝেড়েছে। এই ভেবে তারা মুখ ভার করে আদ্রিকাকে দুষবে৷ অথচ এখানে আদ্রিকার কি দোষ? এই মহাশয়ের মেজাজ খারাপ করার মতো কোনো কাজ সে আজকে করেনি৷ তবুও তার মেজাজ খারাপ হলে আদ্রিকার কি করার আছে!

এখন কি সে এই মহাশয়ের গালে একটা চুমু এঁকে দিয়ে তার মেজাজ ঠিক করে দিবে? আদ্রিকার বিশ্বাস এই মুহুর্তে একটা চুমু দিলে পরখের মেজাজ ভালো না হয়ে উল্টো আরও ভয়ংকর পর্যায়ে চলে যাবে। নিরপরাধ পরীক্ষার্থীদের কথা ভেবে তাই সে আর চুমু দিলো না। চুপচাপ বেরিয়ে এলো কক্ষ থেকে।

নিজ কাজে ব্যস্ত আদ্রিকার কানে হঠাৎ কিছু শব্দ ভেসে আসায় সে স্তম্ভিত হয়ে গেছে। নিশ্চিত হতে কান পেতে ভালোভাবে শুনল। নাহ, সত্যিই সেই গানটি বাজছে পরখের মোবাইলে।

‘তুমি সন্ধ্যার মেঘমালা,
তুমি আমার সাধের সাধনা।’

আদ্রিকা ভেবেছিল অতীতের অধ্যায় এমনভাবে বন্ধ হয়ে গেছে যে সে নির্বিঘ্নে ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যেতে পারবে৷ কিন্তু তাকে সম্পূর্ণ ভুল প্রমাণিত করে হাত পা কাঁপতে লাগল ঠকঠক করে। উত্তপ্ত মস্তিষ্কে ঝড়ো বাতাসের ঝাপটা সবকিছু এলোমেলো করে দিচ্ছে৷ মনোযোগ সরিয়ে নিতে চাইলেও সম্ভব হচ্ছে না৷ স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হচ্ছে গানের কথাগুলো৷ পরখের কক্ষ থেকে ভেসে আসা শব্দের ধ্বনিকে ছাপিয়ে যাচ্ছে আরেকটি কণ্ঠস্বর। যা গুনগুন করছে আদ্রিকার মস্তিষ্কের ভেতর।

টুংটাং গিটারের শব্দের সাথে খোলাকণ্ঠে বিস্ময় গাইছে,

‘তুমি আমারি, তুমি আমারি,
মম বিজনজীবনবিহারী।
মম মোহের স্বপন-অঞ্জন
তব নয়নে দিয়েছি পরায়ে’

দু হাতে কর্ণযুগল চেপে ধরে দ্রুত বিছানা ত্যাগ করে কম্পনরত পায়ে সে ছুটে গেলো পরখের কক্ষে৷ কোনোরকম অনুমতি ব্যাতিত হুড়মুড় করে কক্ষে প্রবেশ করে মোবাইলটি খুঁজতে লাগল।
খাতাপত্রের নিচে চাপা পরে ছিল সেটি। এলোমেলো হাতে খাতাপত্র হাতড়ে সেটিকে উদ্ধার করে গানটি বন্ধ করে দিল।

নিরক্ষণকৃত খাতা এবং নিরক্ষণের অপেক্ষায় অপেক্ষারত খাতাগুলো আলাদা করে রাখা ছিল। সেগুলো একখানে করে ফেলায় পরখের মেজাজ নিয়ন্ত্রণ হারাল৷ কটমট দৃষ্টি ছুড়ে দিয়ে চিৎকার করে উঠল,

‘হোয়াট দ্যা হেল৷ আর ইউ আউট অফ ইউর মাইন্ড?’

আদ্রিকা তখনো কাঁপছে৷ এক হাত দ্বারা নিজের অন্য হাত চেপে ধরে অন্যদিকে এলোমেলো দৃষ্টি ফেলে বলল,

‘আর কোনো গান নেই আপনার মোবাইলে? অন্য গান শুনুন।’

আদ্রিকার চোখে জল টলমল করছে৷ পরখের কাছে ধরে পরে যাওয়ার ভয়ে সে মুখ লুকিয়ে কথা বলছে৷ পরখ হয়তো কিছুটা অনুমান করে ফেলেছে। শিরদাঁড়া সোজা করে সেও জেদ দেখিয়ে বলল,

‘এই গানে কি সমস্যা? আমি এটাই শুনবো।’

সে কথা শুনে আদ্রিকাও রক্তিম দৃষ্টি মেলালো পরখের দৃষ্টিতে৷ এলোমেলো খাতার উপর মোবাইলটি ছুঁড়ে দিয়ে বলল,

‘যা ইচ্ছে করুন।’

সে যেভাবে ঝড়ের বেগে এসেছিলো, সেভাবেই বেরিয়ে গেলো। মোবাইলটি তুলে নিয়ে পরখ আবারও গানটি চালু করে দিয়ে নিজের কাজে মনোযোগ দিল।

নিজের কাছে দৃঢ় প্রতিজ্ঞারত আদ্রিকা ভেবেছিল, সে নিজেকে ঠিকই নিয়ন্ত্রণে রাখবে। কিন্তু ওপাশ থেকে গানের আওয়াজ আরও তীব্র হলো। পরখ যে ইচ্ছে করে এটা করছে তা বুঝতে আর কিছু বাকি রইলো না। বিছানায় শুয়ে বালিশ দ্বারা কান চেপে ধরেও রক্ষা পাওয়া গেলো না৷

বিরক্ত হয়ে সে উঠে দাঁড়াল। চোখের পানি মুছে বালিশটি তুলে নিয়ে আবারও প্রবেশ করলো পরখের কক্ষে। অতীতকে ভুলতে বর্তমানকে আঁকড়ে ধরার মতো সহজ আর কোনো পন্থা নেই। এই মুহূর্তে সে তাই করবে।

কোনোদিকে না তাকিয়ে বিছানার একপাশের খাতা পত্র তুলে সেগুলো পরখের কোলের উপর রেখে দিল৷ ফাঁকা স্থানে নিজের বালিশটি রেখে চুপচাপ শুয়ে পরলো পরখের পাশে।

আদ্রিকা এমন আকস্মিক কর্মকাণ্ডের পরখ হতভম্ব। কোলের খাতাপত্র সামনে বিছানার উপর নামিয়ে রেখে সে বলল,

‘এটা আবার কোন নাটক?’

চোখ বন্ধ করে আদ্রিকা বলল,

‘যে নাটক আপনি শুরু করেছেন, এটা তার শেষ ভাগ।’

পরখ ওর বাহু ধরে টেনে বলল,

‘অযথা ঝামেলা না করে নিজের রুমে গিয়ে ঘুমাও।’

‘আমি এখানেই ঘুমাবো।’

হাত ছাড়িয়ে নিয়ে আদ্রিকা ঘাপটি মেরে পরে রইলো। ওর বন্ধ চোখ জোড়ায় দিকে তাকিয়ে পরখ রেগেমেগে টগবগ করতে থাকলেও মুখ ফুটে বলার মতো কোনো ভাষা পেলো না। রাগ মিটালো নিজের মোবাইলের উপর। গানটি বন্ধ করে ফোল্ডার ঘেটে একদম ডিলিট করে দিলো। ভেবেছিল এবার আদ্রিকাকে ফিরে যেতে বলবে। কিন্তু পাশ ফিরে দেখল, ওর ভারী নিঃশ্বাস আছড়ে পরছে বালিশে। কেউ এতো তাড়াতাড়ি ঘুমাতে পারে তা পরখের জানা ছিল না।

সামান্য দুরত্ব বজায় রেখে বিছানার এককোনায় বসে আরও কিছুক্ষণ আদ্রিকার দিকে তাকিয়ে দেখল। আসলেই কি ঘুমিয়েছে? সে একদম নিশ্চল পরে আছে বিছানায়৷

বাধ্য হয়ে কিছু খাতাপত্র গুছিয়ে টেবিলের উপর সাজিয়ে রেখে বাকিগুলো নিয়ে নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে গেলো পরখ। গতকালকে ফলাফল জমা দিতে হবে। আদ্রিকার সাথে ঝামেলা করার মতো অজস্র সময় এখন তার হাতে নেই৷

প্রায় মধ্যরাত অব্দি খাতা কেটে সেগুলো গুছিয়ে রেখে এবার ঘুমানোর পালা। সারারাত জেগে থাকা পরখের পক্ষে সম্ভব নয়। দুরন্তর জীবনে শুধু রাতটুকুই তার বিশ্রামের জন্য বরাদ্দ। সামান্য হেয়ালি করলে পুরো সপ্তাহজুড়ে তার খেসারত দিতে হবে। যা দিতে রাজি নয় সে।

আদ্রিকা অবশ্য বিছানার একপাশে ভদ্র ভাবে ঘুমাচ্ছে। অপরপাশের জায়গাটি দখল করে নিলো সে। বালিশটি খাড়াভাবে দুজনের মাঝঝানে রেখে বালিশবিহীন শুয়ে পরলো বিছানায়।
অন্ধকার কক্ষে চাঁদের আলোয় আলোকিত আদ্রিকার ঘুমন্ত মুখশ্রী ব্যতীত অন্য কিছুতে আর চোখ পরলো না। নির্নিমেষ তাকিয়ে থাকতে থাকতে কখন যেনো পরখও ঘুমিয়ে পরলো৷

চলবে..
#অক্ষরময়ী

#পরিণয়ে_নোলককন্যা

|২৪|

‘কোথায় সে কত দূরে জানিনা ভেসে যাই
মনে মনে জেনো স্বপ্নেরও দেশে যাই
আজ তাইকি জীবনে বাসর গড়ি
এই চাঁদের অতিথিরে বরন করি
ওগো মায়াভরা চাঁদ আর
ওগো মায়াবিনী রাত
ঘুম ঘুম চাঁদ ঝিকিমিকি তারা এই মাধবী রাত
আসেনি তো বুঝি আর, জীবনে আমার..’

বেসিনের সাথে যে আয়নাটি রয়েছে তাতে নিজের প্রতিবিম্বের দিকে তাকিয়ে গুনগুন করে গান গাইছে আদ্রিকা। মুখে তার রাজ্যের দুশ্চিন্তা। চোখ জোড়ায় শতাব্দীর সুদীর্ঘ অনুসন্ধান। সম্মুখে উপস্থিত সুশ্রী মুখশ্রীর মাঝে সে খুঁজে বেড়াচ্ছে সূক্ষ্ম, সামান্য ত্রুটি।

ঘন ভ্রু জোড়ার নিচে বড় বড় দুটি চোখ, তীক্ষ্ম নাক, পাতলা ঈষৎ গোলাপি বর্ণের ঠোঁট দুটোর দিকে তাকিয়ে যে কারো অন্তরে মায়ার সৃষ্টি হবে। সৃষ্টিকর্তার কৃপায় আদ্রিকার নিষ্পাপ, কোমল মনের ছায়া তার মুখশ্রীতেও বিদ্যমান। চেহারা দেখে সহজেই অনুমান করা যায়, মেয়েটির মনে কোনো পাপবোধ নেই। চাতুরতা, কুটিলতা হতে শত ক্রোশ দূরে তার অবস্থান।

কোমর সমান দৃঢ়, সোজা, সতেজ চুলগুলো কুচকুচে কালো। বংশপরম্পরায় মায়ের ঘন চুল পেয়েছে ওরা দু বোন। ঘন কালো মেঘের মতো কেশের আলাদা যত্নআত্তির প্রয়োজন পরে না।

পাতলা, ছিমছাম শরীরটির আঁকাবাঁকা খাঁজ পুরুষের মনে মোহের সৃষ্টি করার ক্ষমতা রাখে, সে ব্যাপারে আদ্রিকা পুরোপুরি নিশ্চিত। যা সে সুশীল পোশাকে আড়াল করে রাখে। কিন্তু একই বাড়িতে, একই কক্ষে সন্নিকটে অবস্থানের সুবাদে তা পরখের নজরে পরেছে নিশ্চয়ই। তবুও পরখের আগ্রহ জন্মালো না কেনো? তবে আদ্রিকার মাঝে সমস্যাটা কোথায়?

কেনো সেদিন সে সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে বিছানার অপরপ্রান্ত ফাঁকা পেলো? বর্তমানকে আঁকড়ে ধরে এগিয়ে চলার যে বাসনা নিয়ে আদ্রিকা স্বপ্ন বুনেছিলো তা ওর সঙ্গে একই বিছানায় রাত্রিযাপনে অনীহা প্রকাশ করে পরখ ভেঙে দিয়েছে। অনেকখানি পেছনে ছুঁড়ে দিয়েছে তাকে।

সেদিন ঘুম ভেঙে পরখকে সে আবিষ্কার করেছিল রান্নাঘরে। গ্যাসের চুলায় আ/গুন জ্বালিয়ে চায়ের পাতিল বসাচ্ছিল। তা দেখে এলোমেলো চুলগুলো হাতখোঁপা বেঁধে নিয়ে আদ্রিকা এগিয়ে গিয়ে বলেছিল,

‘আমাকে দিন। আমি চা করে দিচ্ছি৷’

মনের ভেতর সূক্ষ্ম অপমানবোধ তখনো কড়া নাড়ছিল। বিরস মুখে চায়ের কাপ পরখের টেবিলের উপর রেখে প্রস্থানের সময় শুনেছিল পরখের হিমশীতল কণ্ঠের সতর্কবার্তা।

‘কালকে যা করেছো, তা খুবই অস্বস্তিকর ছিল। প্রথমবার বলে ক্ষমা করে দিয়েছি৷ ভবিষ্যতে আমার সাথে এমন নিম্নমানের জেদ খাটাতে আসবে না। তোমার সাথে একই বিছানায় ঘুমানোর চেয়ে ঢের ভালো, আমি রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে রাত কাটিয়ে দিবো। নিজের বাড়ি থাকা সত্ত্বেও রাতটুকু শান্তিমতো ঘুমাতে না পারার মতো দুর্দিনও দেখতে হচ্ছে আমাকে। অদ্ভুত নিয়তি!’

সেদিন আদ্রিকা কোনো জবাব দেয়নি। অপরাধবোধ সাথে নিয়ে ফিরে এসেছিল নিজের কক্ষে। ধীরে ধীরে অবশ্য সেই অপরাধবোধ নিঃশেষও হয়ে গিয়েছে। জেদের সূত্রপাত পরখ নিজেই ঘটিয়েছিল। সে যদি গানটি তখনি বন্ধ করে দিত তবে আদ্রিকাকে ওর কক্ষে গিয়ে ঘুমাতো হতো না। তাই এই ঘটনায় প্রকৃত দোষী পরখ নিজেই।

আয়নার প্রতিবিম্বকে আঙ্গুল দেখিয়ে আদ্রিকা প্রশ্ন করল,

‘তোর মধ্যে ঠিক কি সমস্যা? পরখ তোকে পছন্দ করে না কেনো?’

প্রতিবিম্বটি উত্তর দিল না। বরং সূক্ষ্ম চোখে তাকিয়ে রইলো আদ্রিকার দিকে। আদ্রিকা বিভ্রান্ত হয়। বিড়বিড় করে বলে,

‘ভালো না বাসলেও সমস্যা নেই৷ কিন্তু সে প্রতিবার তীব্র ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নেয়। ঘৃণাই যদি করবে তবে এতো কেয়ার করে কেনো? খাট এনে দিলো, সেদিন আমাকে খুঁজতে গেলো, জড়িয়ে ধরলো। এখনো দিনরাত খেটে অতিরিক্ত আয় করে আমার জন্য রান্নার জিনিসপত্র এনে দিচ্ছে, এই বাড়িতে থাকতে দিচ্ছে, স্ত্রী হিসেবে পরিচয় দিচ্ছে। এতো সবকিছু কেনো? সবটাই কি লোক দেখানো? এসব কি শুধু নিজের বাড়ির মানুষের কাছে দায়িত্ববান ছেলে হিসেবে পরিচিতি পাওয়ার আশায়?’

আয়নায় কপাল ঠেকিয়ে চোখ দুটো বন্ধ করে সে ফিসফিসিয়ে বলল,

‘আপনাকে আমি ঠিকঠাক বুঝতে পারি না, পরখ। হয় ঘৃণা করুন, নয় তো ভালোবাসুন। দোটানায় রাখবেন না।’

কিছুপল সেভাবেই রয়ে এবার সে সোজা হয়ে দাঁড়ালো। দীর্ঘশ্বাস ফেলে জোরপূর্বক মুখের হাসিটি ফিরিয়ে এনে সম্মুখের অপরূপার সাথে দৃষ্টি মিলিয়ে প্রকৃতপক্ষে মুগ্ধ হলো।

‘হাসলে তোকে খুব সুন্দর দেখায় আদ্রিকা। জামাইয়ের সামনে বেশি বেশি করে হাসবি। এমন মিষ্টি হাসি দেখে প্রেমে না পরে সে যাবে কোথায়!’

নিজ প্রশংসায় লাজুক হেসে দৃষ্টি সরিয়ে নিতে গিয়ে সে থমকালো৷ স্থির দৃষ্টি মেলে নিজের নোলকটিকে পরীক্ষণ করে দেখে এক হাতে তা ছুঁয়ে দিল। গোল বৃত্তের নিচের ঝুলন্ত পানপাতাটি দু আঙ্গুলে ধরে বলল,

‘এই সুন্দর মুখে তুই বাঁদরে মতো ঝুলে আছিস বলে পরখ আমার দিকে তাকিয়ে মুখ কুঁচকে ফেলে৷ তোকে এক্ষুণি বিদায় করে দেওয়া উচিত। কিন্তু এটা খুলে কি করে?’

সে খুব সাবধানে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে নোলকটি পর্যবেক্ষণ করছে। নোলকটি আদ্রিকার নাকে পরানো হয়েছিল দশ বছর আগে৷ একবারের জন্যও স্বর্ণের এই গয়নাটি দেহ থেকে অপসারণ করার সুযোগ মিলেনি তার৷ তাই খোলার স্থানে প্রলেপ জমে তা প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছে।

কিন্তু আদ্রিকা দৃঢ় পরিকর। যে করেই হোক, আজকে এই জঞ্জাল থেকে মুক্তি পেতে হবে৷ দাঁত চিপে ধরে আংটায় চাপ প্রয়োগ করলো। সামান্য কাজ হলেও তীব্র বৃথা সৃষ্টি হলো নাকের মধ্যভাগের ছিদ্রে৷ চোখের কোল ভরে উঠলো জলে। দাঁত দ্বারা নিচের ঠোঁট চিপে ধরে তা সহ্য করে নিল আদ্রিকা।

নিজের দেহে আঘাত করার মতো সাহসী সে কখনোই ছিল না। তবুও কাঁপাকাঁপা হাতে আবারও নোলকটি ধরে আংটায় দ্বিগুণ উৎসাহে চাপ দিল। আংটা খুলে গেলেও নাকের ছিদ্র হতে সামান্য র/ক্তক্ষরণ শুরু হলো। সেই সাথে চোখের ভরাডুবি হতে গড়িয়ে পরলো দু ফোটা জল।

আয়নায় র/ক্তার্ত নাকের দিকে চেয়ে আদ্রিকা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। তীব্র ব্যথায় নাক টনটন করছে। এর মাঝে সে কীভাবে নোলকটি নাকের ছিদ্র হতে বের করবে?

কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর অনেকখানি সাহস নিয়ে আবারও নোলকটি বের করার উদ্দেশ্যে হাত বাড়িয়ে টান দিতেই অজান্তেই মুখ হতে সূক্ষ্ম আর্তনাদ বেরিয়ে এলো।

‘কি করছো তুমি?’

পরখের আকস্মিক প্রশ্নে আদ্রিকা ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল। ভার্সিটি থেকে আজ তাড়াতাড়ি ফিরে এসেছে সে। টেবিলের উপর ল্যাপটপ ব্যাগটি রেখে আদ্রিকার কাছে এগিয়ে এসে দেখল র/ক্তার্ত নাকে হাত দিয়ে অশ্রুসিক্ত নয়নে ভ্যালভ্যাল করে তাকিয়ে আছে আদ্রিকা। পকেট থেকে রুমাল বের করে ওর হাত সরিয়ে দিয়ে নাকের র/ক্ত মুছে দিতে দিতে প্রশ্ন করল,

‘কা/টলো কীভাবে?’

মাথা নিচু করে আদ্রিকা জবাব দিল,

‘কা/টেনি। নোলক খুলতে গিয়ে ব্যথা লেগেছে। অনেকদিন ধরে খোলা হয়নি তাই জ্যাম লেগে গেছে।’

র/ক্ত পরিষ্কারের কাজ থামিয়ে পরখ ওর থুতনি ধরে মুখ উঁচু করতে বাধ্য করলো। আদ্রিকার বুকের ভেতর জোরসে টিপটিপ শব্দ হচ্ছে। যা আজকাল পরখের কাছাকাছি আসলেই শোনা যায়৷ সে নিজের শ্বাস প্রঃশ্বাস নিয়ন্ত্রণ করার আপ্রাণ চেষ্টায় পরখের বাদামি চোখের মণিতে মনোযোগ দিলো। পরখও গভীর চোখে ওর দিকেই তাকিয়ে। প্রশ্ন করল,

‘খুলতে গিয়েছিলে কেনো?’

‘এটা খুলে নাকফুল পরবো।’

‘কেনো?’

‘নোলক পরে বাজে দেখায় তাই।’

‘যেটা যেভাবে আছে সেভাবেই থাকতে দেও। কিছু জিনিস নড়চড় করতে গেলে নষ্ট হয়ে যায়। প্রকৃতির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে পরিবর্তন সবাই চায় না। কেউ কেউ সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে সাচ্ছন্দ্যবোধ করে। নিজ মনমর্জি মতো কম কাজ তো করোনি। এবার একটু সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে চলো।’

বোকা আদ্রিকা এতোকিছু বুঝলো না। সে চোখ দুটো বড় বড় করে আগ্রহভরে জানতে চাইল,

‘তার মানে, আপনি বলছেন নোলক পরে আমাকে সুন্দর দেখায়? এটা পরেই থাকবো?’

শেষ র/ক্তের ছাপটুকু মুছে দিয়ে থুতনি থেকে হাত সরিয়ে নিয়ে পরখ বলল,

‘তোমার নাক, তোমার ইচ্ছে। খুলতে চাইলে খুলো। অবশ্য খুলতে গিয়ে পুরো নাক কে/টে গেলে সেটা খুব বড় ব্যাপার হবে না। রাবণের অতি সুশ্রী বোনটির নাকটিও একসময় কে/টে গিয়ে বিদঘুটে হয়ে গিয়েছিল। এ আর নতুন কি! পুরনো গাঁথা।’

র/ক্তমাখা রুমাল পকেটে ভরে নিয়ে পরখ সরে দাঁড়ালো। আর অপেক্ষা না করে টেবিল থেকে ল্যাপটপের ব্যাগটি তুলে নিয়ে চলে গেলো নিজের কক্ষে৷

বারবার চোখের পাতা ঝাপটে আদ্রিকা ভাবতে লাগল, নাক-কা/টা আদ্রিকাকে দেখতে কেমন লাগবে? বিদঘুটে একটি চেহারা কল্পনা করেই সে শিউরে উঠল। চুলোয় যাক পরখের ভালোবাসা। সে মহাশয়ের চোখে আবেদনময়ী হতে এই নোলক খুলতে গিয়ে সে কোনোভাবেই নিজের নাক কে/টে ফেলবে না।

বেসিনের কল থেকে পানি নিয়ে নাক পরিষ্কার করে নিল। তারপর কাঁপাকাঁপা হাতে ঝটপট নোলকের আংটা লাগিয়ে নিয়ে ফিরে গেলো রান্নার কাজে।

_______

আজ সারাদিন আকাশ ছিলো পরিষ্কার, ঝকঝকে। সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত হতেই সেই ভদ্র শান্ত আকাশের কী যে হলো কে জানে, রেগেমেগে ফুঁস ফুঁস করতে শুরু করলো। রাতের পুরো আকাশ জুড়ে আঁধারের বুকে আরও নেমে এলো ঘুটঘুটে আঁধার। ঘর ছেড়ে বাইরের খোলা ছাদে দাঁড়িয়ে আদ্রিকা সেই ভয়াল আকাশ পাণে চেয়ে বিড়বিড় করলো,

‘এতো রেগে আছিস কেন বলো তো? রাগে একদম ফুসফুস করে উঠছে দেখো! রাজ্যের কালো মেঘ নিয়ে এসেছে ভূবনভোলায়। ভাসিয়ে নিয়ে যাবি নাকি?’

আদ্রিকার প্রশ্নের বিপরীতে আকাশ পাতাল এক করে মেঘে মেঘে গর্জন করে উঠলো। এমন ভয়ানক শব্দে ভয় পেয়ে আদ্রিকা উঠে উল্টোদিকে এক ছুট দিয়ে ঘরের ভেতর ডুকে দরজা চাপিয়ে দিয়ে হাঁপাতে লাগলো। বৃষ্টি বাদলের দিনে এজন্যই সে ভয়ে থাকে। মেঘগুলো হুটহাট এমন গর্জে উঠে যে আদ্রিকার বুক কেঁপে উঠে।

মেঘের গর্জন শুনলেই সে আদ্রতার গা ঘেঁষে বসে থাকতো। যদি কখনো বিদ্যৎ চমকায় তাহলে তো কথাই নেই। ভয়ে থরথর করে কাঁপতে থাকে সে। আলোর ঝলকানি দেখলেই মনে হয়, এই বুঝি ছুটে এসে গায়ে পরছে। জ্বা/লিয়ে পু/ড়িয়ে ছারখার করে দিবে এখুনি।

খানিকবাদে মেঘের গর্জন থেমে গেলে জানালা দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে সে বেশ জোরেই বললো,

‘মেজাজ দেখছি ভীষণ খারাপ। একদম পরখের মতো গর্জন করে উঠছিস। এতো গড়গড় করার কি আছে! আজব! মানুষ ভয় পায় না বুঝি।’

রাতের বেলা একা একা দু মুঠো ভাত মুখে দিয়ে বিছানায় চলে এলো আদ্রিকা। বৃষ্টি আসার আগে ঘুমিয়ে পরলে আর চিন্তা নেই। কিন্তু ঘুম আসতে চাইছে না। আকাশের অবস্থা আরও অবনতির দিকে। বিছানার উপর রাখা ফোনটি হাতে তুলে নিয়ে সময় দেখে নিলো। সবে নয়টা বাজে। পরখকে ফোন করে ফিরে আসতে বলবে নাকি? করবে না, করবে না করেও ফোন করে বসলো। কিন্তু এই বৈরি আবহাওয়ায় ভূবনভোলার নেটওয়ার্ক সিস্টেম অনেকক্ষণ আগেই অচল হয়ে গিয়েছে।

কোনোভাবেই কল করা গেলো না। হতাশ হয়ে আদ্রিকা ফোন রেখে ঘুমানোর চেষ্টা করলো। একে তো ঘুম আসছে না তার উপর দুম করে বিদ্যুৎ চলে গেলো। ঝুপ করে নেমে আসা অন্ধকারে আদ্রিকা হকচকিয়ে গিয়ে শোয়া থেকে উঠে বসলো। দ্রুত হাতড়ে বালিশের পাশ হতে ফোনটি তুলে নিয়ে ফ্ল্যাশ লাইট অন করে আবার মাথার পাশে রাখলো।

ঝড় এলে লোডশেডিং খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। এই কথাটি এতক্ষণ মাথাতেই আসেনি। বদ্ধ, অন্ধকার এই ঘরে আদ্রিকার ভীষণ অস্থির লাগছে। জানালার ভারী পর্দা ভেদ করে বাতাসের শনশন শব্দ কানে বাজছে। আর দেরী না করে সে পরখের ফোনে কল করার চেষ্টা করলো। একের পর এক কল করে যাচ্ছে কিন্তু প্রতিবারই ফোন বন্ধ দেখাচ্ছে।

ভীত, অস্থির আদ্রিকা থামলো না। আবহাওয়া দেখে সহজেই অনুমান করা যাচ্ছে আজ রাতে ভীষণ ঝড় নামবে। এমন পরিস্থিতিতে একা থাকা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। বেশ কয়েকবার চেষ্টার পর ভাগ্যক্রমে একবার কল চলে গেলো। ফোনের ওপাশে রিং হওয়ার শব্দের সাথে আদ্রিকার হৃদয়ের ধুকফুকানি বেড়ে চলেছে অনবরত।

পাশের শহরের নামকরা ভার্সিটি থেকে পরখকে আমন্ত্রণ করা হয়েছে। গেস্ট লেকচারার হিসেবে লোকালয়ের বাইরে একদম অপরিচিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে লেকচার দেওয়ার ইচ্ছে পরখের ছিলো না। কিন্তু ভিসি স্যার নিজের কেবিনে ডেকে নিয়ে গিয়ে এতো করে অনুরোধ করলেন যে পরখ আর অমত করতে পারেনি।

ভার্সিটি থেকে গাড়ি পাঠাতে চেয়েছিলো কিন্তু পরখ না করে দিয়েছে। নিজের বাইকে যাতায়াত করতেই বেশি সাচ্ছন্দ্যবোধ করে সে। দীর্ঘপথ পাড়ি দিতে হবে, তাই ভোরবেলা ঘর ছেড়েছিলো। বের হওয়ার সময় আদ্রিকাকে বলে এসেছে,

‘কাজের প্রয়োজনে পাশের শহরে যাচ্ছি । আজকে ফিরতে পারবো না। সাবধানে থেকো। কোনো সমস্যা হলে কল দিও।’

গেস্ট লেকচারার হিসেবে বিভিন্ন ভার্সিটিতে কাজ করলেও আজ পর্যন্ত কখনো বাইরে রাত্রিযাপন করতে হয়নি। কিন্তু এই ভার্সিটি শহর হতে বেশ খানিকটা দূরে অবস্থিত। ক্লাস শেষ করে ফিরতে গেলে মধ্যরাত পেরিয়ে যাবে। তাই ভার্সিটি হতে রাত্রিযাপনের বন্দোবস্ত করা হয়েছে। আদ্রিকা নিজেও কোনো অভিযোগ করেনি বলে পরখ তেমন একটা গুরুত্ব দেয়নি। এখান থেকে সে বেশ ভালো অঙ্কের সম্মানী পাবে৷ তাই চলে এসেছে।

বাড়ি ফিরবে না বললেও সে মনে মনে ঠিক করে রেখেছিলো, বিকাল নাগাদ ক্লাস শেষ হওয়া মাত্রই বাড়ির উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে পরবে। কিন্তু বাস্তবে হলো তার বিপরীত। বিকালের মধ্যে ক্লাস শেষ হলেও ভার্সিটি কর্তৃপক্ষ পরখকে ছাড়লো না। ভিসি নিজে অনেকক্ষণ সময় গল্প করলেন এরপর রাতের খাবারের আমন্ত্রণ জানালেন। ডিপার্টমেন্টের প্রফেসাররা মিলে কিছুক্ষণ আড্ডা দেওয়ার পরে পরখকে বিশ্রামের সুযোগ দেওয়া হলো।

আজকে আর ঘরে ফেরা হচ্ছে না, ব্যাপারটা মন থেকে মেনে নিয়ে হোটেল রুমে ফ্রেশ হয়ে নিলো। রাত কাটানোর প্রস্তুতি নিয়েই এসেছিলো তাই খুব একটা অসুবিধা হলো না। আদ্রিকাকে ফোন করে খবর নিলো। ওর কোনো সমস্যা হচ্ছে না। হওয়ার কথাও না। সারাদিন একাই থাকে। নিজের দুনিয়াতে ব্যস্ত ভীষণ খুশি সে।

খানিকক্ষণ ঘুমানোর পর রাত আটটা সময় ভিসি স্যারের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিলো। ডিনারের আয়োজন ছিলো বেশ জমজমাট। অনেকক্ষণ আড্ডার পর নয়টার একটু পরেই গুড়িগুড়ি বৃষ্টি শুরু হলো। তাই পরখ দ্রুত বেরিয়ে পরলো হোটেলের উদ্দেশ্যে। পথে খানিকটা ভিজে গিয়েছে। তাই হট শাওয়ার নিয়ে ঘরে ফিরতেই ফোন বেজে উঠলো। এতো রাতে আদ্রিকার ফোন দেখে খানিকটা অবাক হলেও পরে ভাবলো, ঘুমানোর আগে খোঁজ নিতে ফোন দিয়েছে বোধ হয়। বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে ফোন রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে আদ্রিকার আওয়াজ ভেসে এলো,

‘হ্যালো?’

‘হ্যাঁ বলো।’

আদ্রিকা বোধহয় ঠিকঠাক শুনতে পেলো না। আবার হ্যালো বলে উঠলো। এবার পরখ ঠিকঠাক বুঝতে পারলো না।

‘তোমার কথা ভেঙে ভেঙে আসছে। নেটওয়ার্ক প্রবলেম মনে হচ্ছে।’

‘হ্যালো, পরখ। শুনতে পাচ্ছেন ? হ্যালো..’

আটকে আটকে আসা কথাগুলো স্পষ্ট না হলেও পরখ বুঝতে পারলো। সেই সাথে অনুভব করলো আদ্রিকার কন্ঠের উদ্যেগ। শোয়া থেকে সে উঠে বসলো। পাশের বেলকনির ফাঁকা জায়গায় দাঁড়িয়ে নেটওয়ার্ক প্রবলেম এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলো।

‘আমি শুনতে পাচ্ছি। কোনো সমস্যা হয়েছে? তুমি ঠিক আছো?’

ওপাশ থেকে আদ্রিকা কি যেনো একনাড়ে বলে যাচ্ছে। পরখ বুঝতে পারলো না। খুব করে বুঝার চেষ্টা করলো কিন্তু ব্যর্থ হলো। ওপাশে মনে হয় আদ্রিকা কাঁদছে।

‘….ভয় করছে।’

এই সামান্য কথাটি অস্পষ্ট শোনা গেলো। এরপর হঠাৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ায় পরখের অস্থিরতা বেড়ে গেলো। কল ব্যাক করে দেখলো ফোন বন্ধ দেখাচ্ছে। একটা দিন, কিছুটা মুহুর্ত মেয়েটা ওকে শান্তিতে থাকতে দিচ্ছে না। কাছে গেলেও অস্থির লাগে, দূরে গেলেও অস্থির করে তোলে। পরখ ভেবে পেলো না এই মুহুর্তে কি করবে।

পরিচিত সবার ফোন বন্ধ দেখাচ্ছে। বাইরে বৃষ্টি খানিকটা বেড়েছে। তা দেখে মনে হলো, ভূবনভোলাতেও কি বৃষ্টি হচ্ছে? ইন্টারনেটে আবহাওয়া বার্তা তার সন্দেহটি নিশ্চিত করলো। ভূবনভোলায় ভীষণ ঝড় বৃষ্টি হচ্ছে। বেশ কয়েক জায়গায় বজ্রপাত ঘটেছে। কিছু জায়গায় বিচ্ছিন্ন হয়েছে বৈদ্যুতিক সংযোগ। ঘরে ফিরে এসে কয়েক মিনিট সে পায়েচারি করলো। নিজেকে বুঝালো, ঝড় বৃষ্টিতে ভয় পেয়ে কান্নাকাটি করছে । বৃষ্টি কমে গেলে আপনা থেকেই ঠিক হয়ে যাবে। পরখ গিয়েই বা কি করবে! এখন রওনা দিলেও যতোক্ষণে বাড়ি পৌঁছাবে, ঝড় বৃষ্টি থেমে যাবে। এর থেকে ভালো এখন রেস্ট নিয়ে ভোরবেলা না হয় রওনা দিবে।

মনকে কোনোরকম বুঝিয়ে বিছানায় শুয়ে পরলো।
চোখ বন্ধ করে ঘুমানোর চেষ্টা করলো। বৃষ্টির ফোটা এসে জানালার কাচে পরছে। ঝিরিঝিরি শব্দ, শীতল আবহাওয়ায় ঘুম চলে আসার কথা। এমনিতেই সারাদিনের ছুটাছুটিতে ক্লান্ত শরীর। তবুও ঘুম এলো না। ঘরের লাইট বন্ধ ছিলো। অন্ধকারেই শোয়া থেকে উঠে বিছানায় বসে রইলো। বাইরের বৈদ্যুতিক বাতির আলোতে ভেজা শহরের দিকে তাকিয়ে সিদ্ধান্ত বদলে ফেললো সে। দ্রুত বিছানা ছেড়ে উঠে ঝটপট ব্যাগ গুছিয়ে নিলো। সেই বৃষ্টি ভেজা রাতে হোটেলে চেক আউট করে বাড়ির পথে রওনা দিলো পরখ।

ভেজা রাস্তায় বাইকের গতির দিকে তীব্র নজর রাখতে হচ্ছে। দ্রুত বাড়ি পৌঁছানোর তাগিদে নিজে দূর্ঘটনার স্বীকার হলে হীতে বিপরীত কিছু ঘটে যাবে। বৈরি আবহাওয়ার কারনে রাস্তাঘাট ফাঁকা। ট্রাফিক কিংবা জ্যাম কোনোটারই মুখোমুখি হতে হলো না। খুব দ্রুত পৌছে গেলো ভূবনভোলার সীমানায়। কিন্তু এখানে এসে পরতে হলো প্রবল ঝড়ের মুখে। পাগলা বাতাসে রাস্তার দুধারের গাছগুলো দুলে উঠছে। যেনো এখুনি কোমর ভেঙে লুটিয়ে পরবে পরখের সামনে। বাতাসের বেগের কারনে বাইকের গতি আরও কমিয়ে দিতে হলো।

বাড়িতে যখন পৌঁছালো তখন রাত বারোটার কাছাকাছি। একে তো লোকালয় থেকে দূরের সুনসান জায়গা। এই ঝড়ের রাতে আরও ভূতুড়ে লাগছে। নিজের বাড়িটি এই মুহুর্তে পরখের কাছে রুপকথার সেই হান্টেড হাউজ মনে হচ্ছে। যার দরজা খুললেই ভেতরে দেখা মিলবে কোনো রহস্যময় সত্তার।

বাইক থেকে নেমে দ্রুত সেটি গ্যারেজে পার্ক করে রাখলো। সারা শরীর ভিজে জবজবে। পানি গড়িয়ে পরছে নিচে। সিঁড়ি বেয়ে ওভাবেই উপরে উঠে গেলো। বন্ধ দরজায় কড়াঘাত করলো সাধারণভাবে। সাড়া না পেয়ে নিজের ভুল বুঝতে পারলো। এই ঝড়ের রাতে এই শব্দ কর্ণগোচর হবে না। পরক্ষণেই তীব্র কড়াঘাতে কাচের দরজাটি নড়বড়িয়ে উঠলো। তাতেই চমকে উঠলো আদ্রিকা। ফোনের ফ্ল্যাশ লাইটের আলোতে গুটিগুটি পায়ে হলরুমে আসলো। তাকিয়ে রইলো দরজার দিকে। বাতাসের ঝাপটায় এমন কেঁপে উঠলো কি? পরক্ষণেই আবার কড়াঘাতের শব্দ হতেই আদ্রিকা দু পা পিছিয়ে গিয়ে ভীত, শংকিত, কম্পিত কণ্ঠে জানতে চাইলো,

‘ কে? দরজার ওপাশে কে?’

আদ্রিকার প্রশ্ন উত্তর দিলো আকাশের মেঘেরা। মেঘে মেঘে ঘর্ষণে কাছাকাছি কোথাও তীব্র বজ্রপাত হলো।

‘আহহহহ’ চিৎকার করে ফোন হাতেই দু কান চিপে ধরে মেঝের উপর বসে পরলো আদ্রিকা। ইতিমধ্যে সে ভয়ে হু হু করে কাঁদতে শুরু করেছে৷

ওর চিৎকার পরখের নিকট পৌঁছাতেই সে অস্থির ভাবে দরজায় আঘাত করলো। এই মেয়ের কিছু হয়ে গেলে ওর উজ্জ্বল ভবিষ্যতে ঘোর আঁধার নেমে আসবে। একেই বলে, যেচে বিপদ ডেকে আনা।

‘আদ্রিকা, দরজা খোলো। আমি পরখ।’

পরখের নাম শুনে হারানো সাহস কিছুটা ফিরে এলো। এক ছুটে গিয়ে দরজা খুলে দিলো। দরজার ওপাশে কাকভেজা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে পরখ। সে আদ্রিকার দিকে কিছুক্ষণ স্থির দ্রষ্টিতে তাকিয়ে থেকে চোখ মুখ কুঁচকে দৃষ্টি সরিয়ে নিলো। ঘরের ভেতরে প্রবেশ করতে করতে বললো,

‘রাস্তার মেয়েদের মতো পোশাক পরা করা শুরু করে দিয়েছো! এসব করে আমাকে আকৃষ্ট করে আমার কাছে আসতে পারবে ভেবেছো? কী নিকৃষ্ট চিন্তা ভাবনা! নিচে নামতে নামতে পথেই নেমে গেলে!’

পরখের যাওয়ার পাণে অবাক হয়ে চেয়ে রইলো আদ্রিকা। কী উত্তর দিবে বুঝতে পারছে না। ভয়ের কারনে এতোক্ষণ মস্তিষ্ক কাজ করা প্রায় বন্ধ করে দিয়েছে।

ভয়ে প্রাণ যায় যায় অবস্থায় সে যেই মানুষটার সান্নিধ্য কামনা করছিলো, সেই মানুষটা কিনা তাকে এভাবে অপমান করলো! কী এমন অন্যায় করেছে সে? কোন অশ্লীল পোশাকটা পরেছে? বরাবরের মত সালোয়ার কামিজ রয়েছে গায়ে।

নিজের দিকে তাকাতে আদ্রিকা চমকে উঠলো। গায়ে ওড়না নেই। একলা ঘরে সারাদিন ওড়না ছাড়াই ঘুরছিলো। ভয়ের কারনে ঘর ছেড়ে বের হওয়ার সময় ওড়না গায়ে জড়ানোর কথা মাথা থেকে বেরিয়ে গিয়েছে।

যেই জামাটা সে গায়ে দিয়ে আছে, সেটা বিয়ের পর বানানো। ওর গায়ের মাপ না জেনে পর্তুলিকা বানিয়ে এনেছিল ওর বিয়ের সময়। সেগুলো আদ্রিকার গায়ে ঠিকঠাকভাবে ফিট হয় না। ঢিলেঢালা পোশাকে আদ্রিকার খুব একটা সমস্যা হয় না বলে, সেগুলো চাপিয়ে নেওয়া হয়নি।

তবে এই জামাটির গলা একটু বেশি বড়। আদ্রিকার বুকের খাঁজের মোটামুটি স্পষ্টভাবে বুঝা যাচ্ছে। উন্মুক্ত খাঁজের দিকে নজর পরায় পরখ তখন চোখ নামিয়ে নিয়েছিলো।

আদ্রিকা ছুটে গেলো নিজ কক্ষের দিকে। পরখ তখন ওয়াশরুমে ভেজা কাপড় বদলাচ্ছিলো। বিছানার উপর থেকে ওড়নাটা তুলে গায়ে জড়িয়ে পরখের কক্ষে প্রবেশ করে ওর বিছানার একপাশে বসে অপেক্ষা করতে লাগলো।

ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে আদ্রিকাকে বিছানার উপর বসে থাকতে দেখেও ওর দিকে তাকালো না পরখ। ব্যাগ থেকে নিজের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র বের করে রেখে কক্ষ ছেড়ে বসার ঘরের দিকে যেতে লাগলো। তা দেখে আদ্রিকা বললো,

‘একা ঘুমাতে আমার ভয় করছে, আজকে এখানেই ঘুমাবো।’

পরখ ঘুরে তাকালো। এই মেয়েটার কারনে অযথা ঝড় বৃষ্টির রাতে পাগলের মতো ছুটে আসলো। কোনো বিপদ হলো কিনা ভেবে আত্মা উড়ে যাওয়ার দশা। এসে দেখে সে দিব্যি ঘরময় ঘুরে বেড়াচ্ছে।

বৃষ্টিতে ভিজে মুড়ে পরখের শরীরটা এখন ভালো লাগছে না। শীত লাগছে ভীষণ। জ্বর আসবে কিনা কে জানে। কম্বল গায়ে জড়িয়ে শান্তিমতো একটা ঘুম দিবে সেটাও দিতে পারছে না। কেনো তখন পাগলের মতো বাইক নিয়ে বেরিয়ে পরেছিলো এই ভেবে এখন পরখের মেজাজ খারাপ হচ্ছে। আদ্রিকাকে দেখলে নিজের বোকামির কথা বেশি করে মনে পরছে। নিজ কক্ষে হাত পা ছড়িয়ে শান্তির ঘুম ছাড়া মেজাজ ঠিক হবে না।

‘রাত বিরাতে কীসব নাটক শুরু করেছো! আমি অনেক ক্লান্ত, বিশ্রাম প্রয়োজন।’

‘এখানে নাটকের কি আছে? বিদ্যুৎ নেই, অন্ধকারে একা থাকতে আমার ভয় করছে। ’

‘ফোনের ফ্ল্যাশ লাইট আছে, ড্রয়ারে চার্জার লাইট আছে। আলো জ্বালিয়ে রেখে ঘুমাও।’

‘কী সমস্যা আপনার? বউয়ের পাশে ঘুমালে জাত চলে যাবে? বলছি তো, একা ঘুমাতে ভয় করছে।আমার প্রতি আপনার কোনো দায়িত্ব নেই? এমন ভাব করছেন যেনো আমার পাশে ঘুমালে আপনাকে আমি গিলে ফেলবো।’

‘তোমার মনে কোন ভাবনা চলছে আমি জানি না। যাই চলুক, সেটা বন্ধ করো।’

‘কীসের ভাবনা?’

‘ফোন করে কান্নাকাটি করছো, অর্ধনগ্ন হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছো, এখন আমাকে বউয়ের প্রতি দায়িত্ব দেখাচ্ছো। কি ভেবেছিলে, এভাবে লাস্যময়ী হয়ে আমার সামনে আসলে আমি নিজের কন্ট্রোল হারিয়ে ফেলবো? আর কতো নিচে নামবে তুমি?’

আদ্রিকার ভীষণ মেজাজ খারাপ হলো। একটা মানুষ এতোটা সেলফ অবসেসড হতে পারে, পরখকে না দেখলে সে জানতে পারত না। এই ছেলে কী ভাবে নিজেকে? বলিউডের বাদশা? বিছানা ছেড়ে পরখের সামনাসামনি দাঁড়িয়ে আদ্রিকা শাসিয়ে উঠলো,

‘কী ভাবেন আপনি নিজেকে? আপনাকে কাছে পাওয়ার জন্য আমি মরে যাচ্ছি না। নাচতে নাচতে বিয়ে করার সময় জানা ছিলো না, বিয়ে করলে বউয়ের দায়িত্ব নিতে হবে? সেসব আপনার মাথায় থাকবে কেনো! আপনি ব্যস্ত আমার দোষ ত্রুটি খুঁজে বের করায়। আমি কতো খারাপ, কতো বাজে, কতোটা পাপের সাগরে ডুবে আছি। সেসব নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে নিজেকে নিয়ে ভাবার সময় পান না। এই যে ঝড় বৃষ্টির রাতে বউকে একলা বাড়িতে ফেলে রেখে হোটেলে রাত কাটাচ্ছিলেন, খুব ভদ্র লোক না আপনি?’

‘হোটেলে রাত কাটাচ্ছি মানে? বাজে মিন করছো কেনো? আমি কাজে গিয়েছিলাম। মেয়ে নিয়ে ফূর্তি করতে যাইনি। ওসব তোমার স্বভাব।’

এভাবে, ঠিক এভাবেই প্রতিবার আদ্রিকার দূর্বলতায় আঘাত হানে লোকটা। যুদ্ধের ময়দানে আদ্রিকার সবচেয়ে দূর্বল জায়গায় আঘাত হেনে রণক্ষেত্রে জয়ী হয়ে বিজয়ী বেশে ফিরে যায়।

আদ্রিকার দু চোখ ছাপিয়ে জলের ধারা গড়িয়ে পরতে লাগলো। না হয় করেই ফেলেছে একটা ভুল। ভালোবেসেছিলো একটা ভুল মানুষকে। তার জন্য আর কতো শাস্তি ভোগ করতে হবে? ওকে চুপ হয়ে যেতে দেখে ঠোঁট বাঁকিয়ে হেসে পরখ কক্ষ ছেড়ে বেরিয়ে যাচ্ছিলো। আদ্রিকা পথ আটকে দরজার সামনে দাঁড়ালো।

‘রাস্তা ছাড়ো।’

পরখ ধমকে উঠলো তখনি। ভয় পেলেও আদ্রিকা দমে গেলো না। কিন্তু উপচে পরা কান্নাদের আটকাতে পারলো না। পরখের শার্টের কলার দু হাতে চিপে ধরে ওর মুখের কাছে মুখে এনে বললো,

‘সব জেনে শুনে কেনো বিয়ে করেছিলেন আমাকে? রোজ এভাবে শাস্তি দিতে? প্রতিনিয়ত আমার অপরাধের কথা স্মরণ করিয়ে দিতে?’

‘ধরে নেও সেটাই।’

‘একটা বাজে মেয়েকে যখন বিয়ে করেছেন, তাহলে এখন নাক ছিটকাচ্ছেন কেনো? বিয়ে যখন করে ফেলেছেন, এখন এই বাজে মেয়েটা আপনার দায়িত্ব। তার ভালো মন্দ সব কিছুর দায়িত্ব আপনার। আপনার বউ একটা বাজারের মেয়ে হলেও সে এখন আপনার বিয়ে করা বউ। তার উপর আপনার যা যা দায়িত্ব তা পালন করতে আপনি বাধ্য। আমি এখানে ঘুমাতে বলেছি, আপনি এখানে ঘুমাবেন।’

‘ঝামেলা করো না। সামনে থেকে সরো।’

আদ্রিকার জেদ চেপে গেলো। সে কিছুতেই এতো অপমান সহ্য করবে না। নিজেকে সেই ভয়ানক অতীত থেকে ফিরিয়ে আনা কতোটা কষ্টের কাজ তা কি এই লোকটা কখনো বুঝবে? নিজের সাথে প্রতিনিয়ত যে কতোটা যুদ্ধ করতে হয় আদ্রিকার সেটা সে কাউকে বলে বুঝাতে পারবে না।

এই মনের মধ্যে একজনের বাস ছিলো, প্রথম প্রণয় ছিলো। সবকিছুতেই সে আদ্রিকার প্রথম ছিলো। আজ তার চিন্তাকে মনের মধ্যে স্থান দেওয়া, তাকে নিয়ে ভাবাও পাপ। তবুও মন ছুটে যায় সেই পাপের পথে। মনকে শিকল পরাতে আদিকাকে প্রতিনিয়ত র/ক্তার্ত হতে হয়।

পরখ কি পারে না সেই ক্ষতগুলো যত্ন করে মুছে দিতে? অবশ্যই পারে। কিন্তু সে তা করে না। উল্টো প্রতিনিয়ত খুচিয়ে র/ক্তার্ত করে।

আদ্রিকা ঝরঝর করে কেঁদে ফেলে বলল,

‘এই আপনি আমার সাথে এমন করেন কেনো সবসময়? আমাকে সহ্যই করতে পারেন না। আমি কি জোর করে আপনার বাড়িতে পরে আছি? আমার কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই বলে আমাকে প্রতিনিয়ত অপমান করেন তাই না? বাপের বাড়ি যেতে পারবো না, শত অপমান করলেও আপনার সাথেই থাকতে হবে এটাই ভাবেন, তাই না? তবে শুনুন, বাপের বাড়ি যেতে না পারি, যেদিকে দু চোখ যায় সেদিকে চলে যাবো। আপনি যদি আজকে এই রুম ছেড়ে বের হয়ে যান, তবে আমিও এই বাড়ি ছাড়বো। আজকে, এক্ষুণি।

‘যা মন চায় করো। শুধু আমাকে বিরক্ত করা বন্ধ করো।’

ওকে দরজার সামনে থেকে সরিয়ে দিয়ে দরজা খুলে পরখ বেরিয়ে গেল। ওর যাওয়ার পাণে চেয়ে আদ্রিকা তার সব ভয়-ভীতি ভুলে গেলো নিমিষেই। হনহন করে সেও এগিয়ে গেলো সদর দরজার দিকে।

দরকার হলে ঝড় বৃষ্টিতে ভিজে প্রাণ ত্যাগ করবে তবুও এই বাজে লোকটার অপমান কিছুতেই সহ্য করবে না।
পরখ তখনো বসার ঘরে ডাবল সোফায় আসন গ্রহণ করার সুযোগ পায়নি। আদ্রিকাকে দরজার দিকে যেতে দেখে বিরক্ত হয়ে সেও পিছেপিছে গেলো। ও দরজা খুলতে যাবে তখনি পরখ এসে আটকে দিলো।

‘রাত বিরাতে এসব না করলেই নয়? নিজের ঘরে যাও।’

‘হাত ছাড়ুন। আমার হাত ধরলে আপনার জাত চলে যাবে। ছি! ছি! নষ্টা মেয়ের গা ছু্ঁয়েছেন আপনি!’

আদ্রিকা হাত ছাড়িয়ে নেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করছে। সে কিছুতেই ফিরে যাবে না। ওর সাথে ধস্তাধস্তি করার কোনো ইচ্ছে হলো না পরখের। সারাদিনের পরিশ্রম শেষে রাতে একটু বিশ্রাম নেওয়া জরুরি। এসব নাটুকেপনা করা সময় তার নাই। ছোট শরীরটাকে পাঁজাকোলে তুলে নিয়ে নিজ কক্ষের দিকে চললো। আদ্রিকা বাতাসে নিজের হাত পা ছুঁড়েও কোনো গতি করতে পারছে না।

ওকে বিছানায় শুয়ে দিয়েই পরখ ওকে ছেড়ে দিলো। হেরে যাওয়ায় আদ্রিকার ভীষণ মন খারাপ হলো। তাকেই কেনো বারবার হারতে হয়? কেউ ওর ইচ্ছেকে, মতামতকে কখনো প্রাধান্য দেয় না। সবাই দু পায়ে মাড়িয়ে দিয়ে যায় ওর ক্ষুদ্র অনুভূতিগুলোকে। সে হাপুস নয়নে কেঁদে বললো,

‘সবাই শুধু আমার উপরেই জেদ খাটায়। দূর্বলের উপর অত্যাচার করা সহজ। আপনারা পুরুষ মানুষ শুধু স্বার্থপর নন। আপনারা সুবিধাবাদি, বর্বর প্রকৃতির। নিজের প্রয়োজনে কাছে আসেন। আবার মন ভরে গেলে ছুড়ে ফেলে দেন। একজনের মন চেয়েছে আমাকে কাছে টেনেছে, স্বপ্ন দেখিয়েছে। নিজের শখ মিটে গেছে ওমনি ছুড়ে ফেলে পালিয়ে গেছে। তার সকল দায় এখন আমাকে বয়ে বেড়াতে হচ্ছে। কেনো? পাপ যদি করে থাকি, সেটা কি আমি একাই করেছি? সে কি করেনি? অথচ সে কী সুন্দর গোটা বিশ্বে দাঁপিয়ে বেড়াচ্ছে। আর আমাকে মানুষ উঠতে বসতে কথা শুনাচ্ছে। কোন পাপটা করেছি আমি? বিশ্বাস করার পাপ, ভালোবাসার পাপ? ভালোবেসে বিয়েই তো করেছিলাম। কাছে গেলেও নিজের স্বামীর কাছে গিয়েছিলাম। কী এমন অন্যায় করেছি? স্বামীর কাছে নিজেকে সঁপে দেওয়া অন্যায় কেনো হবে?’

যাই কিছু হয়ে যাক, একজন পুরুষ নিজস্ব সম্পদে অন্যের হস্তক্ষেপ পছন্দ করে না। যা তার, তা শুধুই তার। পছন্দের হলেও, অপছন্দের হলেও। নিজের বিয়ে করা বউয়ের মুখে আরেকজনের কথা শুনে এই মুহুর্তে পরখ সব ভুলে গেলো। মাথার ভেতর প্রতিহিংসার ক্রোধ জ্ব/লে উঠল ধক করে। চকিতে ফিরে এসে আদ্রিকার চোয়াল চিপে ধরে বললো,

‘চুপ। একদম চুপ। পর পুরুষের কথা মুখে আনতে বাঁধছে না তোমার? কোন স্বামীর কথা বলছো? যে বিয়ে মানেই না? ভুলে গিয়ে থাকলে মনে করিয়ে দেই, সামাজিক ও আইনতভাবে তুমি এখন আমার স্ত্রী। স্বামী হিসেবে শুধুমাত্র আমার নাম থাকবে তোমার মুখে।’

‘আমাকে স্ত্রী হিসেবে মানেন আপনি? আপনার কাছে আমি একটা রাস্তার মেয়ে। শরীর দেখিয়ে আপনাকে বশ করার চেষ্টা করা নষ্টা একটা মেয়ে মাত্র। অন্য পুরুষের কাছে নিজেকে বিলিয়ে দেওয়া একটা মেয়ে। যার কাছে আসতেও আপনার রুচিতে বাঁধে, ঘৃণা হয়। এমন মেয়ের স্বামী হিসেবে পরিচিত হওয়া আপনার সাথে যায় নাকি! একি! আমার গায়ে হাত দিয়েছেন কেনো? অপবিত্র হয়ে যাবেন তো। ছাড়ুন ,ছাড়ুন।’

দু চোখ হতে অনবরত জল গড়িয়ে পরছে। চোয়ালে পরখের আঙ্গুলের চাপে অনুভব হচ্ছে সামান্য ব্যথা। মুখ লাল হয়ে গিয়েছে। হালকা ফুলে উঠা ঠোঁটের দিকে তাকিয়ে পরখের কি যে হলো হঠাৎ! ঠোঁট ডুবিয়ে দিলো আদ্রিকার ঠোঁটে।

অবাকের চূড়ান্তে পর্যায়ে পৌঁছে প্রতিক্রিয়া জানাতে ভুলে গেছে আদ্রিকা। পরে রইলো নিশ্চল। আদ্রিকার চোয়াল ছেড়ে দিয়ে দু হাত ওর গালে রেখে মুখটি খানিকটা উঁচু করে ধরলো পরখ। বৃষ্টিতে ভেজার কারনে জ্বর আসছে নিশ্চয়ই, তা না হলে শরীর নিজের নিয়ন্ত্রণে থাকছে না কেনো? পরখ খুব করে চাইলো আদ্রিকা ওকে থামিয়ে দিক। গভীর চোখে সেই মিনতি জানালো আদ্রিকাকে। কিন্তু সমস্ত বাঁধা ভেঙে দিয়ে আদ্রিকা নিজেও সাড়া দিতে শুরু করছে। পরখের মাথার দু পাশে হাত রেখে ওকে টেনে নিলো নিজের কাছে।

এক হাতে ভর দিয়ে পতন ঠেকিয়ে নিজের নিয়ন্ত্রণ সামলে নিলো পরখ। আবছায়া দৃষ্টি মেলে তাকালো মায়াভরা মুখটির দিকে। বৈদ্যুতিক আলোয় চোখের জল চিকচিক করছে। রক্তিম গাল হতে দৃষ্টি নামালো ঠোঁটে। তিরতির করে কাঁপছে গোলাপি পাপড়ি দুটো। নদীর জলে সকালের মিষ্টি রোদ যেভাবে মৃদু ঢেউয়ের সাথে কেঁপে উঠে উজ্জ্বলতা ছড়ায়, আদ্রিকার নাকের নোলকের নিচের পানপাতাটি তেমনি ভাবে জ্বলজ্বল করছে এবং কম্পিত ঠোঁটের সাথে তাল মিলিয়ে নিজেও কাঁপছে।

পরখ তার পুরুষালী পুরু ঠোঁট দ্বারা খুব আলতোভাবে চুমু এঁকে দিলো পানপাতাটির উপর। আবেশে বুঁজে এলো আদ্রিকার চোখ। পরখ একে একে চুমু এঁকে দিল বন্ধ চোখের পাতায়।
হাত বাড়িয়ে ওড়নাটি সরিয়ে রাখলো বিছানার কোনো এক পাশে। দৃষ্টিতে উদ্ভাসিত একই দৃশ্যের সাক্ষী সে হয়েছিল সদর দরজায়৷ কিন্তু তখনকার অস্বস্তি এখন আর দেখা গেলো না পরখের চোখে।

ওকে নির্নিমেষ তাকিয়ে থাকতে দেখে আদ্রিকা হাত বাড়িয়ে খুব ধীরে পরখের বলিষ্ঠ দেহের অতিরিক্ত আচ্ছাদন হতে তাকে নিস্তার দিতে সাহায্য করলো। উজ্জ্বল আলোয় পুমান গাত্রের বাঁকে বাঁকে দুরুহ সৌন্দর্য্য আদিম বাসনা সৃষ্টি করে। তার কম্পিত হস্তের অনুসন্ধানী বিচরণ পরখের উন্মুক্ত বক্ষে। পেশীবহুল বলিষ্ঠ গাত্রে সৃষ্টিকর্তার অদ্ভুত কারুকার্য। রুক্ষ, শুষ্ক, কঠোর, উগ্র কিন্তু তীব্র আকর্ষণীয়। মনোহর সে মুগ্ধতা অদম্য, দুর্দমনীয়, দুর্নিবার।
আদ্রিকার মন্ত্রমুগ্ধ দৃষ্টি প্রতিটি স্থান নিরিক্ষণ করে। পরখ তাকে বাঁধা দেয় না।

আদ্রিকার ঢিলেঢালা পোশাকটি খুব বেশি ঝামেলা করলো না। দ্রুত হস্তে পরখ তা ছুঁড়ে ফেলে দিল।
আবরণের আড়াল হতে প্রকাশিত ললিতা গাত্রের দৈবিক সৌন্দর্যে পরখের শ্বাস ভারী হয়ে আসে। কামিনীর সুবাসিত রহস্যমন্ডিত কায়ার আরও গহিনে পৌঁছানোর বাসনায় সে আরও নিবিড়ভাবে নিবিষ্ট হতে থাকে আদ্রিকার মাঝে৷

ভালোবাসা, হতাশা, ক্রোধ, কাম মিলে অদ্ভুত এক অনুভূতির দোলাচালে দোদুল্যমান পরখ তখনো কিছুটা জ্ঞানসম্পন্ন। স্পষ্ট বুঝতে পারছে নিজের উপর থেকে কীভাবে ক্রমশ ক্ষয়ে যাচ্ছে তার নিয়ন্ত্রণ।

চলবে…
#অক্ষরময়ী

#পরিণয়ে_নোলককন্যা (কপি নিষেধ)

|২৫|

নাস্তার টেবিলে ঘিয়ে ভাজা পরোটা, আলুর দম, মাখন, পাউরুটি, জেলি, ডিম সেদ্ধ, অমলেট, চপ, পায়েস। এতো আয়োজন দেখেও দেখছে না পরখ। মাথা নিচু করে পরোটার একটি অংশ ছিঁড়ে নিয়ে আলুর দমসহ মুখে পুরলো। সে স্পষ্ট অনুভব করতে পারছে, আদ্রিকার বদ্ধ দৃষ্টি এখনও তার দিকে নিবদ্ধ। তাই মুখ না তুলে সেভাবেই বলল,

‘ক্যাটক্যাট করে তাকানো বন্ধ করো।’

বাঁকা হাসি মুছে গিয়ে বিস্তৃত হাসি দেখা দিলো আদ্রিকার ওষ্ঠাধরে। অধরজোড়া একে অপরের সাথে চেপে ধরে উচ্ছ্বসিত হাসি আটকানোর চেষ্টা করলো। ধ্বনি রোধ হলেও বদ্ধ হাসির দমকে দুলে উঠলো আদ্রিকার দেহ।

অসন্তুষ্ট পরখ মাথা তুলে নেত্রযুগলের ক্রুদ্ধ দৃষ্টি মেলে তাকালো। ওর গম্ভীর মুখমণ্ডল দেখেও আদ্রিকার মধ্যে কোনো পরিবর্তন দেখা গেলো না। সে আগের মতোই টেবিলের উপর এক হাত রেখে তার তালুর উপর মুখ রেখে পরখের দিকে চেয়ে রইল।

গা জ্বালানো হাসি লুকানো চঞ্চুদ্বয়ের পেছনে। সারাটা সকাল এড়িয়ে গেলেও এই মুহূর্তে আর এড়ানো গেলো না। ঝাঁঝালো কণ্ঠে পরখ জানতে চাইল,

‘হাসছো কেনো?’

আদ্রিকা বিভ্রান্ত হলো না। উল্টো পরখের বিরক্তির পরোয়া না করে প্রশ্ন করলো,

‘এখনো জ্বর আছে আপনার?’

তীব্র অস্বস্তি নিয়ে দৃষ্টি নামিয়ে নিয়ে চায়ের কাপ হাতে নিয়ে তাতে চুমুক দিলো পরখ। সামান্য হেলে পরখের কাছাকাছি এসে মুখখানি গম্ভীর করে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার প্রস্তুতি নিয়ে গলার স্বর নামিয়ে প্রায় ফিসফিসিয়ে প্রশ্ন করলো আদ্রিকা,

‘সত্যি সত্যি আপনার জ্বর এসে গেলো? এতোটা ভয় পেয়ে গেছেন! ব্যাপারখানা বেশ ভাবনার।’

লজ্জায়, অস্বস্তিতে পরখের কোথাও ডুবে ম/রে যেতে ইচ্ছে করছে। প্রচুর আগ্রহ নিয়ে পরখের মুখের দিকে চেয়ে আছে আদ্রিকা। বাম হাত ওর কপালের উপর রেখে পেছনের দিকে সরিয়ে দিয়ে পরখ বললো,

‘দূরে সরে বসো। এভাবে গায়ের উপর উঠে আসছো কেনো! আর আমার সামনে এভাবে হাসবে না।’

কপট মুখ ফুলিয়ে আদ্রিকা বলল,

‘কীভাবে?’

‘মিচকে শয়তানের মতো।’

এবার সত্যিই গুরুতর অপরাধীর পৈশাচিক আনন্দ আয়োজনের মতো হো হো করে হেসে ফেললো আদ্রিকা। হাসতে হাসতে বলল,

‘এক রাতেই আপনি জ্বর বাঁধিয়ে ফেললেন, মনে পরতেই আমার হাসি পাচ্ছে। আমি জানতাম, এসব বিষয়ে মেয়েরা ভয়ে থাকে। এখানে পুরো ব্যাপারটাই উল্টে গেলো। আমার এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না। জ্বরে এখনো কেমন লাল হয়ে আছে আপনার চোখ মুখ। এক মিনিট, জ্বরের কারনে এমন লাল দেখাচ্ছে, নাকি এখনো লজ্জা পাচ্ছেন?’

চায়ের কাপ ঠাস করে নামিয়ে রেখে পরখ কিড়মিড় করে বলল,

‘তোমার অনেক অভিজ্ঞতা আছে, তাই তোমার কিছু মনে হচ্ছে না। তুমি আবার এসব ব্যাপারে এক্সপার্ট কিনা।’

ধপ করে নিভে গেলো আদ্রিকার মুখের হাসি। আমসে মুখে ডাগর ডাগর চোখ দুটো তুলে তাকালো দণ্ডায়মান পরখের দিকে। যে ল্যাপটপ ব্যাগ হাতে নিয়ে ঘর ছাড়ার পায়তারা করছে। তা দেখে একটু আগের অপমান ভুলে আদ্রিকা বলল,

‘শরীর বেশি খারাপ লাগলে ভার্সিটি যাওয়ার দরকার নেই। বাড়িতেই থাকুন। আমি আপনাকে একদম জ্বালাবো না। এই যে মুখ কুলুপ এঁটে নিলুম।’

সেসব কথা উপেক্ষা করে গটগট করে হেঁটে পরখ এগিয়ে গেল। এই মেয়ে সকাল থেকে ইনিয়েবিনিয়ে ওকে তিরস্কার করে যাচ্ছে। নেহাৎ পরখ একটা ঘোরের মধ্যে রয়েছে, তাই পার পেয়ে গেল। না হলে সেই কখনই আচ্ছা করে কথা শুনিয়ে দিত!

স্লাইডিং ডোর খুলে বাইরে পা রাখতে গিয়েও থেমে গিয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনের দিকে তাকিয়ে দেখলো, আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে আছে আদ্রিকা। ওর দিকে তাকিয়েই পরখ জানালো,

‘গতকাল বৃষ্টিতে ভিজেছি, ভোরবেলা শাওয়ার নিতে হয়েছে তাই জ্বর এসেছে। তোমার নোংরা মনের চিন্তা ভাবনায় ইস্তেফা দিলে খুশি হবো। ওয়ান মোর থিং, ফারদার আমার রুমে যাওয়ার দুঃসাহস করবে না। যদি করো, আমার থেকে খারাপ কেউ হবে না।’

উত্তরের অপেক্ষা না করে পরখ বেরিয়ে গেলো। আদ্রিকা ওভাবেই তাকিয়ে থেকে সম্মতিস্বরুপ উপর নিচে মাথা দুলিয়ে বিড়বিড় করে বলল,

‘একদিন ভোরে গোসল করে এই অবস্থা। রোজ রোজ করতে হলে নিউমোনিয়া না বাঁধিয়ে ফেলেন। নেহাৎ আপনার বউ আপনার কথা অনেক ভাবে। তাই পার পেয়ে গেছেন। না হলে রোজ আপনাকে জলে ডুবিয়ে মারতো।’

নিজের কথায় নিজেই লজ্জা পেয়ে ফিক করে হেসে দু হাতে মুখ লুকালো। আরও একবার রঙিন হতে থাকল গতকাল রাতের স্মৃতি।

উষ্ণ ভোরের ভাবনায় নিমজ্জিত আদ্রিকা কখন ঘুমিয়ে পরেছে নিজেই জানে না। চোখ খুলল একটু বেলা করে। দুষ্টু রোদ্দরের অশালীন ইঙ্গিতের হাসির ছোঁয়ায় আড়মোড়া ভেঙে নিজেকে আবিষ্কার করলো একলা, একাকিনী রুপে। বিছানার অপরপাশের ঠান্ডা স্থানে হাত বুলিয়ে সো উঠে বসে। অস্থির দৃষ্টি চর্তুদিকে ঘুরিয়ে স্থির হয় নিজের বালিশের পাশে। খসে যাওয়া আচ্ছাদন কেউ যত্নসহকারে ভাঁজ করে রেখেছে বালিশের পাশে। ক্ষণিকের মন খারাপ প্রজাপতির রঙ ছড়িয়ে দিয়ে উড়ে চলে গেলো। হাত বাড়িয়ে চটপট নিজেকে পোষাকে আচ্ছাদিত করে কক্ষের বাইরে চলে এলো সে।

পরখকে পেলো বসার ঘরের ডাবল সীট সোফায়। কম্বল মুড়ে গুটিশুটি হয়ে ঘুমিয়ে আছে। আদ্রিকার স্পষ্ট মনে আছে, গতকাল রাত্রে ক্লান্ত, সন্তুষ্ট দেহটি যখন বিশ্রামের সন্ধানে বালিশে নেতিয়ে পরেছিল তখন পরখের মাথাটি ছিল তার উন্মুক্ত বক্ষের উপর। ঘুমন্ত পরখের ভারী নিঃশ্বাস এখনো আদ্রিকার মন, মস্তিষ্কে সতেজ। তবে ও বিছানা ছেড়ে এখানে এলো কখন?

সে দ্রুত ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নেয়। বেসিনের আয়নার সামনে গভীর চোখে নিজেকে দেখতে থাকে। কোথাও কি কোনো পরিবর্তন ঘটেছে? কই? সেই একই চোখ, নাক, ঠোঁট। তবে মুখজুড়ে এই উজ্জ্বলতা কীসের? দেহ জুড়ে পূর্ণতা প্রাপ্তির আনন্দের জৌলুস। অধর জোড়ায় অপরিসীম লাজুক হাসির রেশ।

ডানে বামে ঘাড় কাত করে অনেক, অনেকক্ষণ আদ্রিকা নিজেকে দেখে। তারপর চঞ্চল পায়ে ছুটে যায় নিজের কক্ষে। টেবিলের ড্রয়ার হতে কাজলদানি নিয়ে এসে আবার দাঁড়ায় আয়নার সামনে। গাঢ় কাজল আঁকে তৃষ্ণার্ত আঁখিতে। ছোট একটি টিপ দেয় কপালের মাঝে। বলা যায় না, নিজের সুখে আবার নিজেরই না নজর লেগে যায়।

নিজেকে নিয়ে যখন ব্যস্ততা শেষ হয়, পরখ তখনো ঘুমে। সচরাচর ও এতোক্ষণ ঘুমায় না। পা টিপেটিপে আদ্রিকা উপস্থিত হয় পরখের নিকট। নিচু হয়ে পরখের মাথার দিকটায় মেঝেতে বসে। ঘুমন্ত পরখের তীক্ষ্ম চোয়ালে হাত বাড়িয়ে ছুঁয়ে চমকে উঠে। একি! গা এতো গরম কেনো? দ্রুত হাতে কপালে হাত দিয়ে নিশ্চিত হয়। জ্বরই তো। কিন্তু এবেলায় জ্বর এলো কেনো?

তখনি আদ্রিকার নজরে আসে পরখের ভেজা কেশ। ভিজে জবজবে হয়ে আছে। ঠিকঠাক মোছা হয়নি। নিজের দেহে জড়ানো সুতি ওড়নার এককোণ তুলে সযত্নে মুছে দেয় সিক্ত কেশ। ওকে আরও কিছুক্ষণ নিজের মতো ঘুমাতে দিয়ে চলে যায় রান্নার আয়োজনে। অথচ ঘুম থেকে উঠে সে মহাশয় আদ্রিকাকে এড়িয়ে যাচ্ছে। একবার তাকায় না, কথা কয় না। এমন আচরণের বিপরীতে আদ্রিকা কেনো তাকে তিরষ্কার করবে না? একশবার করবে, হাজারবার করবে। আদ্রিকা ঠিক করলো সে আরও বেশি বেশি বেহায়া হবে। পরখের তিক্ত কথাবার্তা এক কান দিয়ে শুনে অন্য কান দিয়ে বের করে দিবে। পারতপক্ষে উপেক্ষা করার চেষ্টা করবে।

আদ্রিকার সারাদিন কাটলো তুমুল উচ্ছ্বাসে। আজ সে নিজে থেকে নীহার ও পর্তুলিকাকে কল দিয়ে অনেকক্ষণ কথা বলল। সেদিনের নিয়ে আসা মশলাগুলো রোদে দিলো। বিকালে আচার বানাবে। বাগানের গাছগুলোকে আজ একটু বেশি আদর, যত্ন করলো। দুপুরের জন্য বেশ ভালোবেসে অল্প কিছু রান্না করলো। তবে দুপুরে খেতে এলো না পরখ। আদ্রিকা অবশ্য মন খারাপ করলো না। একলা বসে অনেক মজা করে খেলো।

______

আজ ভার্সিটির পাশের একটা সস্তা হোটেলে দুপুরের খাবার খেতে এসেছিল পরখ। হোটেলের অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ দেখে, অনুন্নত খাবার খেয়ে বাইরের খাওয়ার শখ মিটে গেছে। ভার্সিটি এবং কলেজ এর আশেপাশের ব্যস্ত এলাকায় একটা ভালো খাবারের হোটেল নেই। এমন চললে, লোকে বউয়ের সাথে রাগ করে বাইরে খাবে কী করে?

বাধ্য হয়ে রাতের খাবারের জন্য পরখকে সেই তো বাড়িতেই যেতে হলো। বাইক পার্ক করে রেখে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে স্লাইডিং ডোরে হাত দেওয়া মাত্র তা আজ আপনা থেকেই উন্মুক্ত হলো। অবাক পরখ হাত ফিরিয়ে নিয়ে দেখল হাসি মুখে সম্মুখে এসে দাঁড়িয়েছে আদ্রিকা।
ওর দিকে ভালোভাবে তাকিয়ে পরখ আরও বেশি অবাক হলো। আদ্রিকার গায়ে কমলা রঙের শাড়ি। লাল কমলা চওড়া পাড়ের সাধারণ সুতি শাড়িতে ওকে সকালের নবজাতক সূর্যের মতো লাগছে। এরপর যখন পরখের হতভম্ব মুখের দিকে তাকিয়ে ফিক করে ঝলমলিয়ে হেসে উঠল, সকালের মিষ্টি রোদের ছটা লাগলো পরখের চোখে। সেই সাথে মস্তিষ্কে উঁকি দিল সকালের স্মৃতি।

হালকা ঘুমটা হঠাৎ করে উবে গিয়েছিল যখন তখন চোখ খুলে আধো আলোছায়ায় একটি নগ্ন দেহের সাথে লেপ্টে থাকা অবস্থায় নিজেকে আবিষ্কার করেছিল। ঝট করে উঠে বসে ধাতস্ত করেছিল নিজেকে। বাইরে তখনো রাত শেষে আবছায়া অন্ধকার খানিকটা রয়ে গেছে। নিজেকে এবং অগোছালো কক্ষটিকে গুছিয়ে নিয়ে পরখ তাকায় ঘুমন্ত আদ্রিকার দিকে। লম্বা কেশ ছড়িয়ে ছিটিয়ে কী নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে! পরখ ভেবেছিল ওকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে অন্য কক্ষে পাঠিয়ে দিবে। তবে ঘুমন্ত মুখশ্রীটি দেখে তা সম্ভব হয়নি। কিন্তু পরখের পক্ষে ওর সাথে একই বিছানায়, এভাবে ঘুমানো সম্ভব নয়। তাই সে চলে আসে বাইরে। মনে করে অবশ্য বন্ধ করে দেয় ঘরের বৈদ্যুতিক বাতি।

আদ্রিকাকে পাশ কাটিয়ে পরখ ভেতরে প্রবেশ করলো। প্রকৃতিতে তখনোও খানিকটা ভ্যাবসা গরম। ঘামে ভেজা জামা কাপড়গুলো পাল্টানোর থেকে আরেকবার গোসল করে নেওয়া উত্তম মনে হলো। ওকে গোসল করে বের হতে দেখে ভ্রু কুচকালো আদ্রিকা। এই মহাশয় আজকে দু’বার গোসল করলো কেনো?
এসব করে কোনোভাবে কি ওকে আবার অপমান করার চেষ্টা করছে?

“যাই চেষ্টা করো না কেনো মহাশয়, আমার ছোঁয়া গা থেকে মুছে ফেলতে পারবে না। আবছা হয়ে গেলে আমি আবারও ছুঁয়ে দিবো।” ভেবেই আনমনে মুচকি হাসে আদ্রিকা। যা দেখে ফেললো পরখ। খাবার টেবিলে বসে বলল,

‘পাগলের মতো হাসছো কেনো?’

‘এমনি। আমার মন চাচ্ছে, হাসতেছি। আপনার মন চাইলে আপনিও হাসেন।’

কাঁধ নাচিয়ে জবাব দেয় আদ্রিকা। পরখ আর কথা বাড়ায় না। চুপচাপ খেতে থাকে।

খাওয়া শেষে নিজের কক্ষে গিয়ে ব্যাগ গোছানো শুরু করলো পরখ। পাশের একটি জেলা হতে গেস্ট লেকচারের আমন্ত্রণ পেয়েছে। পরখ ভাবছে, এবার ইচ্ছে করেই সেখানে রাত্রিযাপন করবে। গতরাতের পর থেকে আদ্রিকার সামনাসামনি হতে কেমন অস্বস্তি হচ্ছে। নিজের অজান্তেই কী বিশ্রী একটা কান্ড করে বসলো সে! এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না। এর থেকে ভালো, কয়েকটা দিন দূরে থেকে নিজেকে গুছিয়ে নেওয়া যাক।

‘আপনি কোথাও যাচ্ছেন?’

হঠাৎ ভেসে আসা শব্দে চমকে পেছনে তাকালো পরখ। দরজায় উঁকি দিয়ে ভেতরে দৃষ্টি রেখেছে আদ্রিকা। প্রশ্ন শুনেও উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করলো না সে। নিজের মতো কাজ করে যাচ্ছে দেখে আদ্রিকা নিজেই কক্ষের ভেতর এসে বিছানায় এক হাত রাখতেই পরখ বলল,

‘একদম বিছানায় বসবে না।’

চোখ বাঁকিয়ে তাকালেও আদ্রিকা বসলো না। দাঁড়িয়ে থেকে লুকিয়ে ভেংচি কেটে বলল,

‘ব্যাগ গুছিয়ে কোথায় চললেন?’

‘কাজ আছে। শহরের বাইরে যাচ্ছি।’

‘ফিরবেন কখন?’

‘দেরী হবে।’

‘আপনি আবার আমাকে একা রেখে যাচ্ছেন? এই ভূতুড়ে বাড়িতে আমি একা থাকবো? অসম্ভব। কিছুতেই না।’

‘থাকতে না চাইলে থাকবে না। কেউ জোর করছে না তোমাকে।’

দু হাত কোমরে রেখে কটকট দৃষ্টি মেলে আদ্রিকা কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। নাটকবাজ লোকের নাটক এবং তার সংলাপ কখনো বদলাবে না। একই দৃশ্য দেখে এবং একই সংলাপ শুনে দর্শক বিরক্ত। এর একটা বিহীত করা দরকার। আদ্রিকা খানিকটা মন ভার করে বলল,

‘ঠিক আছে। আমি পিউ মাকে বলছি গাড়ি পাঠিয়ে দিতে। আমার মতো রূপবান, গুণবান পুত্রবধূকে উনারা নিশ্চয় একলা বাড়িতে রাত্রিযাপন করতে দিবেন না। ক’টা দিন আমি না হয় শ্বশুরবাড়িতে থেকে আসি। আপনি শান্তিমতো ঘুরে আসুন।’

আদ্রিকার কথা শুনে পরখের হাত থমকালো। এই কর্মকান্ডের বিপরীত প্রতিক্রিয়া স্বরূপ পরখের যে কী পরিণতি হবে তা ভেবেই সে আতঙ্কিত হয়ে গেলো। ছেলে এমনভাবে এখানে-ওখানে বাইকে যাতায়াত করছে জানলে মায়ের মাথায় আকাশ ভেঙে পরবে। তার বাবা ছি, ছি রব তুলে দিবে পরখের চারপাশে।

সে ঘাড় বাঁকিয়ে আদ্রিকার দিকে তাকিয়ে শাসালো,

‘তুমি এমন কিছু করবে না।’

‘কেনো করবো না? অবশ্যই করবো। আপনি স্বামী যখন আমার নিরাপত্তার কথা ভাবছে না, তবে আমার নিরাপত্তার কথা আমাকেই ভাবতে হবে। তাই না?’

‘হাহ, তোমার নিরাপত্তা? এখানে তোমার কীসের বিপদ?’

গলার স্বর খাদে নামিয়ে রহস্যময়ী কণ্ঠে আদ্রিকা বলল,

‘গতরাতে কে যেনো জানালায় ঠকঠক করছিলো। আমি স্পষ্ট শুনেছি।’

স্থির চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে পরখ নিজের কাজে ফিরিয়ে গিয়ে বলল,

‘বসার ঘরের জানালার পেরেক ঢিলে হয়ে গেছে। জোরে বাতাস উঠলে ওখানে শব্দ হয়।’

আদ্রিকার গম্ভীর চেহারায় আবার বিদ্রুপের ছায়া নেমে এলো। হেয়ালি করে বলল,

‘সে যাই হোক। মূল বিষয় হচ্ছে একা থেকে আমি ভয় পেয়েছি এবং এখনো পাচ্ছি। আপনি আমাকে আবারও একা রেখে কোথাও যাচ্ছেন না।’

পরখ কোনো মন্তব্য না জানিয়ে নিজের মতো কাজ করে যাচ্ছে দেখে আদ্রিকার কণ্ঠ এবার আদ্র হয়ে এলো। বলল,

‘এতো দৌড়ঝাঁপ করার কি দরকার? ভার্সিটির বাইরে আরও কি কাজ করছেন আপনি? কেনো করছেন? ভার্সিটি থেকে যা স্যালারি পাবেন তাই দিয়ে আমাদের দিন কেটে যাবে। এখন আমি আজেবাজে রান্না করাও বন্ধ করে দিয়েছি। আগের মতো খরচ হবে না।’

পরখের মনে হলো, ওর অপারগতার কথা আদ্রিকা জেনে গেছে। স্বামীর অল্প আয়ের জন্য নিজের শখ বাদ দিয়ে সে পরখের উপর দয়া করলো, পরখকে ছোট করলো। পরখ কারো দয়া নিবে কীসের জন্য? যে ছেলে নিজের বাবার সাহায্য নিয়ে সফল হতে চায়নি, সে আদ্রিকার থেকে দয়া নিবে? কখনো না।

ব্যাগটির চেইন বন্ধ করে চেয়ারের উপর রেখে বলল,

‘তুমি এখান থেকে যাও এখন। আমি ঘুমাবো।’

আদ্রিকা খুব করে বুঝলো পরখ এই বিষয়টি এড়িয়ে যাচ্ছে। নিজের স্বল্প আয় বিষয়ক আলোচনায় পুরুষ মানুষের কষ্ট হয়, অস্বস্তি হয়। সেটা এই কয়েকদিনে আদ্রিকা বুঝে গেছে। তাই আর কিছু না বলে গুটিগুটি পায়ে বেরিয়ে এলো।

দরজা পেরিয়ে বাইরে গিয়েও ফিরে তাকিয়ে উচ্চস্বরে ডাক দিলো,

‘এই যে মহাশয়, আমি কিছুতেই এই বাড়িতে একলা রাত কাটাবো না। আপনি যদি শহরের বাইরে যান আমি সত্যি, সত্যিই পিউ মাকে বলে দেবো।’

চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেওয়ার ভঙ্গিমায় চোখ সরু করে তাকালো পরখ। তা দেখে গলার স্বর নামিয়ে খানিকটা ফিসফিসিয়ে আদ্রিকা বলল,

‘আর শুনুন,আমাকে বেশি ভয় পাবেন না। আমি অনেক ভদ্র মেয়ে। সময় অসময়ে আপনার উপর মোটেও চড়াও হবো না। পরিবেশ, পরিস্থিতি বুঝে তারপর। মুডের একটা ব্যাপার আছে না!’

কথাগুলো শোনা মাত্র এক হাতের আঙ্গুল উঁচু করে পরখ ধমক দিলো,

‘গেট আউট ইডিয়েট।’

হো হো করে হেসে চলে গেলো আদ্রিকা। রান্নাঘরের বেসিনে একগাদা থালাবাসন জমে আছে। সেগুলো পরিষ্কার করতে করতে নিজের বেসুরো কণ্ঠে গান ধরলো,

‘আমি যারে বাসি ভালো
কাজলের চেয়ে কালো
হয় না যে তার তুলনা।

এতো যে নিঠুর বন্ধু জানা ছিলো না গো
এতো যে নিঠুর বন্ধু জানা ছিলো না।

দিলো না, দিলো না
নিলো মন দিলো না।’

অত্যাচারে অতিষ্ঠ পরখ নিজের কক্ষ ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে এসে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে সেই গান শুনলো। মেয়েরা সাধারণ দৈহিক সংস্পর্শে আসার পর ছেলেদের থেকে বেশি আবেগপ্রবণ হয়ে পরে।শারীরিক সম্পর্কের পাশাপাশি মানসিকভাবেও অনেকখানি কাছাকাছি চলে আসে।
তাই সে ভেবেছিল, অন্তত এই কয়েকটা দিন সে কিছু বলবে না। কিন্তু আদ্রিকার বাড়াবাড়ি রকম অত্যাচারে সিদ্ধান্ত বদলাতে হলো।

ভেজা হাত আঁচলে মুছে কক্ষে প্রবেশ করে হকচকিয়ে গেলো আদ্রিকা। তার বিছানার উপর পা ঝুলিয়ে বসে আছে পরখ। হতভম্বতা কাটিয়ে উঠে দুষ্টু হাসি মুখে ঝুলিয়ে নাটকীয় ভঙ্গিমায় প্রশ্ন করল,

‘আজ আমার রুমে কি মনে করে, হুম? একদিনেই যে জ্বর বাঁধিয়েছেন, তারপর আর রিস্ক নেওয়া যাচ্ছে না।’

হতাশায় দু চোখের দীর্ঘ পলক ফেলে পরখ বলল,

‘এখানে এসে বসো। কিছু কথা আছে তোমার সাথে।’

বাধ্য মেয়ের মতো পরখের পাশে বসল আদ্রিকা। ডাগর চোখ জোড়ায় বেশ আগ্রহ। পরখ নিজেও আদ্রিকার মুখোমুখি হয়ে বসে বেশ নম্র স্বরে বলল,

‘আমার কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে শুনবে।’

‘ঠিক আছে।’

‘মাঝখানে কোনো কথা বলবে না।’

আদ্রিকা দু পাশে মাথা দুলালো। দীর্ঘশ্বাস ফেলে পরখ বলল,

‘লিসেন, আই নো কালকের ঘটনার পর তুমি অনেক কিছু ভাবতে শুরু করেছো। আমি তোমাকে দোষ দিবো না। তোমার জায়গায় যে কেউ থাকলে একইরকম ভাবে স্বপ্ন বাঁধতো। তবে তুমি এমন কোনো স্বপ্ন দেখো না, যা ভেঙে গেলে তুমি আবার কষ্ট পাবে না।’

না চাইতেও আদ্রিকার মুখে আঁধার নেমে এলো। কিছু ক্ষতের ঘা শুকিয়ে যাওয়ার পরেও লুকানো একটা অস্বস্তি কোথাও রয়ে যায়। পরখ বিরতি নিল না। বলল,

‘নাহ। গতকালকের ঘটনায় দায় আমি এড়িয়ে যাচ্ছি না। পুরো দায় আমি মাথা পেতে নিচ্ছি। তোমার প্রেমিকের মতো কাপুরুষ আমি নই। তবে আমাকে নিয়ে তুমি কোনো স্বপ্ন দেখো না। খুব অল্প সময়ের জন্য আমি তোমার দায়িত্ব নিয়েছি। যতোদিন আছি, তোমার পুরো দায়িত্ব আমি যথাসাধ্য পালন করে যাবো। কিন্তু একদিন আমাদের পথ আলাদা হতেই হবে।’

চোখের জলকে কড়া শাসনে রেখে আদ্রিকা প্রশ্ন করলো,

‘কেনো? আপনি কোথায় যাবেন?’

পরখ চোখ রাঙ্গিয়ে বলল,

‘কথা বলতে বারণ করেছিলাম।’

আদ্রিকা চোখ নামিয়ে নিলো। পরখ আবারও বলল,

‘আমি চলেই যেতাম, বিয়ে নামক এই দূর্ঘটনার কারনে আটকে গেলাম। তুমি হয়তো জানো না, আমার টিকিট পর্যন্ত কনফার্ম হয়ে গিয়েছিল। সেটা তোমার শ্বশুরমশাই কারসাজি করে ক্যান্সেল করিয়েছেন। সে যাই হোক, এতো কিছু তুমি বুঝবে না। তুমি শুধু এটা জেনে রেখো, তোমার যেমন বিস্ময়ের সাথে সংসার করাটা একমাত্র লক্ষ্য ছিল, তেমনি আমারও লক্ষ্য ছিলো আমি বিদেশে গিয়ে উচ্চ শিক্ষা নিবো। নিজের পরিচয় নিজেই তৈরি করবো। একটা স্বপ্ন পূরণ না হওয়ায় তুমি যেমন খুব দ্রুত আরেকটা স্বপ্ন দেখতে পারো, আমি তেমন পারি না। আমার সারাজীবনের লালিত স্বপ্ন, বিয়ে নামক একটা তুচ্ছ কারনে আমি বদলে ফেলতে পারি না। ভার্সিটিতে এখনো আমার এডমিশন পেন্ডিং আছে। হয়তো গ্রান্টেড হবে, না হলে ক্যান্সেল হবে। কিন্তু আমি চেষ্টা ছাড়বো না। বিদেশে আমি যাবোই। আর আমি একবার বিদেশে গেলে আর ফিরে আসবো না। এই দেশে, এই পরিবেশে ফিরে আসার কোনো ইচ্ছে আমার নেই। তখন তুমি কি করবে? তোমার কি হবে? আরেকটা স্বপ্ন ভেঙে যাওয়ায় আবারও কষ্ট পাবে।

তাই বলছি, আমার সাথে নিজেকে জড়ানোর বৃথা চেষ্টা করো না। তোমার মায়ায় আমি আটকাবো না। উল্টো তুমি এক গোলকধাঁধায় ফেঁসে যাবে। যেই সংসারের স্বপ্ন তুমি দেখছো, তা আমার সাথে সম্ভব নয়। যতদিন আমার সাথে আছো, নিজেকে গুছিয়ে নেও। আমি যতটুকু সম্ভব সাহায্য করতে রাজি আছি। যাতে আমি চলে গেলেও তুমি মাথা উচু করে বাঁচতে পারো। স্কিল ডেভলপ করো, পড়াশোনা করে নিজের পায়ে দাঁড়াও। তোমার বয়স অল্প, জীবনের অনেকটা সময় পরে আছে। দীর্ঘপথ পাড়ি দিতে হবে। পথ চলতে চলতে বলা যায় না, একসময় সুন্দর সংসারের স্বপ্নটাও পূরণ হয়ে যেতে পারে।

সেদিন আমার কাছে বিস্ময়ের খোঁজ জানতে চাইছিলে না? নিজেকে এমনভাবে তৈরি করো, যাতে তুমি নিজেই একদিন তার সামনে গিয়ে দাঁড়াতে পারো।’

আদ্রিকা অবাক চোখে পরখের দিকে তাকালে সে বলল,

‘আচ্ছা বিস্ময় না হোক, এর থেকে ভালো কাউকে পেতে পারো। সেই যোগ্যতা তোমার আছে। একটা দুটো ডিভোর্স এই যুগে এমন কোনো ব্যাপার না। শুধু ভুল মানুষের পেছনে নিজের সময় নষ্ট করো না।

প্রতিটি মানুষের নিজস্ব স্বপ্ন আছে। প্রত্যেকে নিজের স্বপ্নের পেছনে ছুটে। পথ চলতে দু একবার মোহমায়ায় আটকে পরে পা হড়কায়। এই বাঁধা অতিক্রম করে যারা সামনে এগিয়ে যায় তারাই সফল হয়।

বিস্ময় তার স্বপ্ন ছুঁয়ে ফেলেছে, আমি আমার স্বপ্নের পেছনে এখনো ছুটছি। একদিন ছুঁয়েও ফেলবো ইনশাআল্লাহ। কিন্তু তোমার নির্দিষ্ট কোনো স্বপ্ন নেই। স্বপ্ন ছাড়া, লক্ষ্য ছাড়া জীবন উড়ন্ত শিমুল তুলোর মতো অস্থির, মূল্যহীন। নিজের লক্ষ্য নির্দিষ্ট করো, তার পেছনে ছুটো। তোমার মেধা, শক্তি, সামর্থ্য অহেতুক কারনে নষ্ট করো না। কিপ দেম সেভ।

আমি যা বুঝাতেই চাইছি আশা করি, বুঝতে পেরেছো।’

মূর্তিমান বসে রইলো আদ্রিকা। পলকহীন দৃষ্টি, অনঢ় দেহ। পরখ উঠে চলে গেলো নিজের কক্ষে। কিছুক্ষণ অতিবাহিত হওয়ার পর আদ্রিকার ঠোঁটে বিদ্রুপের ছোট্ট হাসি দেখা গেল। বদ্ধ ঠোঁটের বাঁকা হাসির সাথে গড়িয়ে পরল চোখের অশ্রুকণারা। তা হাতের উল্টো পিঠে মুছে ফেলে হাত বাড়িয়ে মোবাইল ফোনটি হাতে নিলো। ফ্রন্ট ক্যামেরা অন করে ছড়িয়ে পরা কাজলরেখা সাবধানে মুছতে মুছতে গান ধরল,

“চুল কালো, আঁখি কালো, কাজল কালো আরও
কাজলের চেয়ে কালো কি বলতে কি কেউ পারো?

আমি যারে বাসি ভালো, কাজলের চেয়েও কালো।
আমি যারে বাসি ভালো, কাজলের চেয়েও কালো।

হয় না যে তার তুলনা।

এতো যে নিঠুর বন্ধু জানা ছিলো না গো
এতো যে নিঠুর বন্ধু জানা ছিলো না।”

চলবে…
#অক্ষরময়ী