পরিণয়ে নোলককন্যা পর্ব-২৬+২৭+২৮

0
107

#পরিণয়ে_নোলককন্যা (কপি নিষেধ)

|২৬|

টেবিলের উপর চায়ের কাপে ধোঁয়া উঠছে অবিরাম। উড়ে উড়ে তারা কোথায় চলেছে জানা নেই। সেদিকে গভীর চোখে তাকিয়ে থেকে রুমি বলল,

‘আর ইউ শিওর?’

হাতে ধরে রাখা চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বেশ উৎসাহ নিয়ে পরখ বলল,

‘হান্ডেড পার্সেন। সেদিন আমি নিজে দেখেছি ওই অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বসে কতো লোকজন খাবার খাচ্ছিলো। শুধু মাত্র একটি ভালো রেস্টুরেন্টের অভাবে অনেকে বাধ্য হয়ে সেই অখাদ্য গলাধঃকরণ করে।’

চায়ের কাপের দিকে হতে দৃষ্টি সরিয়ে পরখের দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকাল রুমি। নারাজ কণ্ঠস্বরে প্রশ্ন করল,

‘তুই এমন হোটেলের খাবার খেতে গিয়েছিলি কেনো? বাড়ি থেকে টিফিন নিয়ে যাবি। আন্টির হাতের রান্না ছেড়ে ওসব ছাইপাঁশ মুখে রুচে কি করে!’

জবাবে পরখ সামান্য হেসে কোনোরকমে এড়িয়ে যেতে চাইল,

‘একদিন গিয়েছিলাম।’

রুমির কেমন সন্দেহ হলো। সরু চোখে চেয়ে প্রশ্ন করল,

‘এক মিনিট, তুই কি এখনো সেই ভাড়া বাড়িতেই আছিস?’

অযথা বাম চোখের ভ্রু ছুঁয়ে অস্বস্তি নিয়ে পরখ জবাব দিলো,

‘হ্যাঁ। একা থাকা অভ্যাস হয়ে গিয়েছে। বাড়িতে গিয়ে থাকতে ভালো লাগে না।’

‘কী আশ্চর্য! ভার্সিটিতে ক্লাস, বাসাবাড়ির দেখাশোনা একা হাতে সামলাচ্ছিস কীভাবে?’

‘চলে যাচ্ছে কোনোরকম। সেসব কথা বাদ দে। আমার আইডিয়া কেমন লেগেছে সেটা বল। সন্ধ্যা হতে চলল। আমাকে ফিরতে হবে।’

‘প্ল্যান ভালোই। আসলেই ভার্সিটির আশেপাশে তেমন ভালো কোনো রেস্টুরেন্ট নেই। ভালো সার্ভিস দিতে পারলে ব্যবসা জমে যাবে।’

‘তাহলে বেশি না ভেবে কাজে নেমে পর। আমার বিশ্বাস তুই পারবি।’

‘সময় লাগবে রে। এক্স্যাক্ট প্লেসে ফ্ল্যাট খুঁজতে হবে। বড় পরিসরে রেস্টুরেন্ট ওপেন করতে হলে জনবল লাগবে বেশি। ফার্নিচার, কিচেন স্টাফ, টেকনোলজি, ডেকোরেশন, ফার্নিচার, গ্রোসারি, মার্কেটিং কতো কাজ! এগুলো আমি একা হাতে কীভাবে সামলাবো?’

‘আরে ভয় পাচ্ছিস কেনো? পেস্ট্রিশপের মতোই। তোর অলরেডি অভিজ্ঞতা আছে। আপাতত ছোট করে কুইক সার্ভিস রেস্টুরেন্ট চালু কর। পরে ধীরে সুস্থে ফুল সার্ভিসে শিফট করবি।’

রুমি কিছু বলল না। টেবিলের উপর থেকে চায়ের কাপটি তুলে নিয়ে চুমুক দিলো। চুপচাপ কাপের চা টুকু শেষ করে কাপ নামিয়ে রেখে টেবিলের উপর দু হাত রেখে পরখের দিকে সামান্য ঝুঁকে বিনীত স্বরে অনুরোধ করল,

‘মামা, শোন। তুই ভার্সিটির ক্লাসের পাশাপাশি গেস্ট লেকচারার হিসেবেও কাজ করতেছিস। অনেকটা সময় এভাবে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। তার উপর যাতায়াত তো আছেই। এভাবে শরীরের অবস্থা খারাপ হয়ে যাবে। আমি বলি কি, গেস্ট লেকচারের কাজটা বাদ দে। এই সময় তুই আমাকে দে।’

পরখ কিছু বলতে উদ্যোত হলে রুমি ঝট করে ওর হাত ধরে হুড়মুড় করে বলল,

‘প্লিজ, না করিস না। বিশ্বাস কর, তোর বর্তমান স্যালারির থেকে দুই গুন ইনকাম করবো আমরা। এখানে ওখানে ছুটাছুটি করা লাগবে না। টাকা দিয়ে লোক খাটাবো আর বসে বসে আয়। আমাদের শুধু বুদ্ধি খরচ করতে হবে। আর কিছুই না।’

রুমির গায়ের রঙ কিছুটা শ্যামলা। প্রথম দর্শনে সুপুরুষ খেতাব পাওয়ার মতো গায়ের গঠন। লম্বা উচ্চতা, সুগঠিত শারীরিক গঠনের সাথে মায়াকাড়া চেহারা। তার উপর যখন ছোট ছোট চোখ করে নিষ্পাপ ভঙ্গিমায় তাকায় তখন তার অনুরোধকে নাকচ করে দেওয়া কঠিন। তবুও পরখ কিছুক্ষন সময় নিলো। তারপর কী ভেবে যেনো স্বাভাবিক ভাবে সম্মতি জানালো।

‘ঠিক আছে। কালকে থেকে কাজে নেমে পরি তাহলে।’

পরখ সম্মতি জানাবে তা ভাবেই নি রুমি। নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারলো না। হতভম্ব হয়ে গোল গোল চোখে তাকিয়ে অবিশ্বাসের স্বরে বলল,

‘এহ! সত্যি বলতেছিস? তুই আমার সাথে রেস্টুরেন্টের ব্যবসা করবি? একবার বলায় হ্যাঁ বলে দিলি! বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে মামা।’

কপট রাগ দেখিয়ে পরখ বললো,

‘আচ্ছা ঠিক আছে। না করে দিচ্ছি। আরও চার পাঁচবার অনুরোধ কর তারপর হ্যাঁ বলবো।’

‘যাহ। একবার হ্যাঁ বলেছিস, আমি শুনে ফেলেছি। এখন আর মন থেকে আকুতিভরা অনুরোধ আসবে নাকি! তাহলে পার্টনারশীপের কাজপত্র রেডী করে ফেলি।’

‘কীসের পার্টনারশীপ? পাগল নাকি! আমার কাছে চার আনা পুঁজি নেই।’

‘আমার টাকা, তোর মেধা। আগেই বলেছি। একদম ফিফটি ফিফটি পার্টনারশীপ।’

‘নাহ। এভাবে হয় না। তোর ইনভেস্টমেন্টে আমাকে সমান অংশিদারিতব দেওয়া যায় না। ব্যবসা করতে হয় নিয়ম মেনে।’

‘আচ্ছা ঠিক আছে। ইনভেস্টমেন্টও আমাদের সমান সমান। আমি তোকে ধার দিচ্ছি। ব্যবসা করে তুই যখন বড়লোক হয়ে যাবি তখন আমার ধার শোধ করে দিবি।’

‘অলরেডি দশ হাজার ধার নিয়ে বসে আছি।’

‘যার কথা দেখা হলেই তুই একবার অন্তত মনে করিয়ে দিস।’

‘ভুলে যাস যদি?’

‘ভুলতে চাইলেও তুই ভুলতে দিবি না, মামা।’

‘এই দশ হাজার শোধ করতে পারছি না, উনি আবার আমাকে লাখ লাখ টাকা ধার দিতে আসছেন!’

‘লস নাই মামা। আমার পরিকল্পনা বুঝতে পারলি না। তুই বিদেশে চলে গেলে ব্যবসা তখন পুরাটাই আমার।’

‘হ্যাঁ তোর মাথায় অনেক বুদ্ধি। বুদ্ধির চোটে থাকা যাচ্ছে না। আমি এবার উঠি। কালকে আবার আসবো।’

রুমির ওখান থেকে ফিরতে ফিরতে রাত গড়িয়ে গেলো। পরখ ভেবেছিল, বাড়ি ফিরে আজ একটু ভিন্ন পরিবেশ দেখতে পাবে। কিন্তু তেমন কিছু চোখে পরছে না। রোজকার মতো রান্নাঘরে রান্নার কাজে ব্যস্ত আদ্রিকা। খাবারের ঘ্রাণে পুরো ঘর জুড়ে মৌ মৌ ঘ্রাণ। নিজ কাজে ব্যস্ত আদ্রিকা গুন গুন করে গাইছে,

‘তোমারি পরশে ভালোবাসা
আসে মনেরি আঙ্গিনায়
নয়ন ভরে দেখি তোমায়
তবুও বুঝি দেখার শেষ নাই…’

কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে সে দৃশ্য দেখে দু’পাশে মাথা দুদালো পরখ। গতকাল রাতে কার সাথে দীর্ঘ আলাপ হলো! কাকে এতো কিছু বুঝালো! এই অধমের সাথে কথা বলা আর দেয়ালে নিজের মাথা ঠুকা একই জিনিস। দীর্ঘশ্বাস ফেলে পরখ চললো নিজের কক্ষে।

আদ্রিকার গায়ে সরষে ফুল রঙ্গের হাফ সিল্ক শাড়ি। দু হাত ভর্তি একই রঙের কাঁচের চুড়ি। সিলভার কালারের ঝুমকো জোড়া কানে। কপালের ঠিক মাঝখানে একটি কালো টিপ। শাড়ির আঁচল কোমরে গুঁজে রাখার ফলে উঁকি দিচ্ছে মেদহীন মোম রঙ্গা ত্বক। পরখের এলোমেলো দৃষ্টি সেদিকে পরতেই সে চোখ ফিরিয়ে নিলো। নির্বিকার আদ্রিকা দ্রুত হাতে খাবারের বাটি রাখলো টেবিলে। আলু দিয়ে খাসির কলিজা ভুনা এখনো চুলার উপর। ঠান্ডা হয়ে গেলে খেতে ভালো লাগবে না। তাই টেবিলে সব গুছিয়ে রেখে আবার ছুটলো রান্নাঘরে।

গতকাল হেয়ালি করলেও আজ শহরের বাইরে যায়নি পরখ। রাতে ঠিক সময় বাড়ি ফিরে আসায় আদ্রিকা ভীষণ খুশি হয়েছে। আজ যদি পরখ বাড়ি না ফিরতো তবে সে তার পিউ মাকে কল দিয়ে কান্নাকাটি জুড়ে দিতো, এ ব্যাপারে সে বদ্ধ পরিকর ছিলো। এতো কিছু করতে হলো না ভেবেই স্বস্তি। পরখের প্লেটে তরকারি তুলে দিয়ে নিজের প্লেটেও খাবার তুলে নিয়ে আদ্রিকা বলল,

‘গতকাল আপনি কি যেনো বলছিলেন? উম, পড়াশোনার কথা তাই না?’

খাওয়া থামিয়ে পরখ তাকালো আদ্রিকার দিকে। আবারও সে কথা উঠছে কেনো? এই মেয়ের মাথায় আবার কী ভূত চাপলো কে জানে! ভয়ার্ত পরখ শুকনো ঢোক গিলে বলল,

‘হ্যাঁ। তোমার পড়াশোনা করা উচিত।’

সম্মতি স্বরূপ আদ্রিকা মাথা দোলালো। খুবই গম্ভীর দৃষ্টিতে পরখের দিকে চেয়ে প্রশ্ন করলো,

‘আমি পড়াশোনা করলে, পরীক্ষা দিলে আমাকে নিয়ে আপনার আর কোনো অভিযোগ নেই, তাই তো?’

‘মানে?’

‘শিক্ষিত, স্বাবলম্বী বউ চাই আপনার, তাই না? আমি শিক্ষিত , স্বাবলম্বী হলে আমার সাথে সংসার করতে আপনার আপত্তি থাকার কথা না।’

হতাশ পরখ গ্লাস হাতে নিয়ে পানি পান করে নিজের রাগটুকু গিলে ফেলল। শান্ত, স্বাভাবিক স্বরে বলল,

‘আমার সাথে সংসার করার জন্য তুমি পড়াশোনা করবে, স্বাবলম্বী হবে?’

‘হ্যাঁ।’

‘গতকালকে আমার কথা শুনে তোমার তাই মনে হয়েছে?’

উত্তর না দিয়ে আদ্রিকা চেয়ে রইলো। পরখ কী কী বলেছে সবটা তার মনে নেই। এতো কঠিন কঠিন কথা মনে থাকে নাকি! জবাব না পেয়ে পরখ বলল,

‘লিসেন, অল আই ওয়ান্ট টু সে ইজ, অন্য কারো জন্য নিজেকে না বদলে, তোমার উচিত নিজেকে নিয়ে ভাবা। অন্যের জন্য নয়, নিজের জন্য নিজেকে ইমপ্রুভ করো। নিজেকে যোগ্য করে তোলো। যাতে কেউ তোমাকে অবহেলা না করে, হেলাফেলা না করে। এতো করে বুঝানোর পরেও, তুমি এখনো অন্যের জন্য নিজের উন্নতি সাধনের কথা ভাবছো।’

ভাত মাখতে মাখতে আদ্রিকা বলল,

‘এতো কিছু আমি জানি না। আত্ম নির্ভরশীল হতে হলে হবো। সমস্যা নেই। এ আর এমন কি কঠিন কাজ! পড়াশোনা করতে ভালো লাগে না, এটা একটু সমস্যা। ব্যাপার না। করে নিবো। কিন্তু আমি যোগ্য হলে বিস্ময়ের মতো ধোঁকাবাজের পেছনে ছুটবো কেনো? আমার স্বামী আছে। ছুটলে তার পিছনে ছুটবো।’

এসব কথা শুনে পরখের মনে হলো, সে এই মুহূর্তে ছাদ থেকে লাফ দিয়ে ম রে যায়। কিন্তু দোতলার ছাদ থেকে লাফ দিলে সে মা রা যাবে না, উল্টো হাত পা ভেঙে পরে থাকতে হবে বলে ঝাঁপ দিলো না। চুপচাপ ভাত খেয়ে বসার ঘর ত্যাগ করে নিজের কক্ষের দিকে চলে গেলো।

চলবে..
#অক্ষরময়ী

#পরিণয়ে_নোলককন্যা (কপি নিষেধ)

|২৭|

গুটি গুটি পায়ে আকাশ জুড়ে জমায়েত হচ্ছে কালো মেঘ। বর্ষার আগমন বার্তা নিয়ে মেঘদূত বর্ষণ নামাচ্ছে বলে। দ্রুত আচারের বয়ামগুলো ঘরে তুলে রেখে স্লাইডিং ডোর লক করে আদ্রিকা বাড়ি ছাড়লো।

রিক্সা থেকে নেমে সে যখন রাস্তায় পা রাখলো তখনো আকাশে ঘন মেঘ। আড়াল থেকে উঁকি দিচ্ছে মধ্যাহ্নের তেজীয়ান সূর্য। বৃষ্টি আসন্ন প্রকৃতির ভ্যাপসা গরমে জনজীবন বিপন্ন। শাড়ির আঁচলে গলার ঘাম মুছে বাড়ির ভেতর প্রবেশ করলো আদ্রিকা। রাস্তার পাশে অন্যান্য গাছের ভীড়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলো বেগুনী রঙের পিটুনিয়া। আদ্রিকা নিচু হয়ে বসে সাদা-বেগুনি রঙের পিটুনিয়া ফুলটি ছুঁয়ে দিলো। অপরপাশের একদম বেগুনি ফুলটি বুঝি একটু মুখ ভার করেছে। তা দেখে সামান্য হাসলো আদ্রিকা। ওর গায়েও হাত বুলিয়ে উঠে দাঁড়ালো। নার্সারি খোলা অথচ আশেপাশে কোথাও মোকাররমকে দেখা যাচ্ছে না।

গেইট পেরিয়ে ভেতরে প্রবেশ করতে গিয়েও আদ্রিকার পা থমকালো। চুপকথার নেমপ্লেটটি ঢেকে আছে ধুলোয়। নগ্ন হাতে ধুলো মুছে ম্লান হাসি ফুটলো ওর মুখে।
খাওয়াদাওয়ার পর্ব শেষে টেবিল গুছিয়ে মাত্রই বসেছে নীহার। দরজায় ঠকঠক আওয়াজ শুনে উঠে দাঁড়ালো। আদ্রিকাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে অবাক হয়ে শুধালো,

‘তুই!’

আদ্রিকা মুখ ফুলিয়ে বলল,

‘কেনো? আসতে পারি না?’

ওর হাত ধরে ভেতরে নিয়ে এসে সোফায় বসিয়ে নীহার কেমন বোকার মতো হাসলো।

‘কেন আসবি না! তোর নিজের বাড়ি। কিন্তু আসার আগে খবর দিবি তো। আমি খালি ফোনটা হাতেই নিছিলাম, তোকে কল দিবো বলে।’

আদ্রিকা আশেপাশে তাকালো। বাড়ির সাজসজ্জায় কোনো পরিবর্তন করা হয়েছে কি? এমন অচেনা, অন্ধকার লাগছে কেনো?

‘আব্বু কই? নার্সারিতেও দেখলাম নাই।’

‘ভাত খেয়ে বের হয়ে গেল। আশেপাশে আছে বোধহয়। তুই কিছু খেয়ে আসছিস? ভাত খাবি?’

‘আমি খেয়ে বের হইছি।’

‘ভাত তরকারি আছে। একটু খা।’

‘মাত্রই খেয়ে আসলাম।’

‘তাতে কি হইছে! আমার হাতের রান্না কতোদিন ধরে খাইস না। একটু নিয়ে আসি?’

‘পেটে একটুও জায়গা নাই। যাওয়ার সময় খেয়ে যাবো।’

‘আচ্ছা। দাঁড়া এক গ্লাস পানি এনে দেই। বাইরে যা গরম পরছে!’

মায়ের উচ্ছ্বলতায় আদ্রিকা মুচকি হাসলো। সামান্য পানি পান করে বলল,

‘নিজেকে মেহমান মনে হচ্ছে।’

আদ্রিকার অস্বস্তি নীহার বুঝি অনুভব করতে পারল। সে কি আসলেই বেশি সমাদোর করে ফেলতেছে? সমাদোর কোথায়! মেয়েটা কতোদিন পর এলো একটু আদর যত্ন করবে না, তা কি করে হয়!

‘এমন হঠাৎ করে এলি, কিছু হয়েছে? জামাইকেও নিয়ে আসিস নি। এমন একা একা কেউ আসে!’

‘বাহ রে! আমার বাড়িতে আমি একা আসতে পারবো না? এটা কোথাকার নিয়ম?’

‘নতুন বউরা একা একা ঘুরাফেরা করে না।’

‘তোমার জামাই ব্যস্ত। তার হাতে সময় নাই। উনার জন্য এখন আমি কাজকর্ম সব ছেড়ে বাড়িতে বসে থাকব?’

‘ওটাই জিজ্ঞাসা করতেছি। কোন কাজে বের হইছিস?’

আদ্রিকা নড়েচড়ে বসে জরুরি আলোচনার প্রস্তুতি নিলো। মায়ের দিকে ঝুঁকে বলল,

‘আজকে কলেজে গেছিলাম।’

আদ্রিকা যতোটা আগ্রহ নিয়ে কথাটি বলল, নীহার ততোটাই নিরাগ্রহ নিয়ে উত্তর দিলো,

‘ওহ। হঠাৎ কলেজে কেন?’

‘কতোদিন ধরে কলেজে যাই না, পড়াশোনার আশেপাশেও নাই। সবকিছু ভুলতে বসছি। এইচএসসি পাশ করতে হবে না আমাকে? না হলে লোকে কি বলবে! তাই আজকে নিজেই গেলাম খোঁজ খবর নিতে। না গেলে কতো ক্ষতি হয়ে যাইতো জানো?’

‘কেন? কি হইছে?’

‘আর বলো না! ফরমফিলাপের ডেট দিয়েছে। অথচ আমি জানি না। কালকে লাস্ট ডেট। স্যার আমাকে দেখেই ধমক দিলেন। উনারা নাকি আমার খোঁজ করছিলেন। বাড়ির নাম্বারে কল করেও আমাকে পায়নি। আমাদের বাড়িও চিনে না কেউ। কোনোভাবে খোঁজ খবর না পেয়ে ওরা ভেবেই নিয়েছে ,আমি আর পরীক্ষা দিবো না।’

‘তোর বান্ধবীরা কেউ তোকে জানায় নাই? কেউ একজন খবর দিলেই পারতো।’

‘কারো সাথে আমার তেমন আলাপ নাই। একজনের সাথে টুকটাক আলাপ হইতো, ওর বিয়ে হয়ে গেছে।’

‘এতোদিন একসাথে ক্লাস করলি তাও একজনের সাথে ভালো সম্পর্ক নাই? সারাক্ষণ কি মুখ বন্ধ করে থাকতি? মানুষ একটা নতুন জায়গা গেলে দুটো লোকের সাথে কথাবার্তা বলে, খোঁজ খবর নেয়। কে কখন, কোন কাজে লাগে, কোন উপকারে আসে বলা যায়! কিন্তু নাহ, তোদের মুখ দিয়ে তো কথা বের হয় না।’

বিরস মুখে বসে অনেকদিন পর আদ্রিকা নিজের মায়ের বকাবকি শুনলো। সত্যি বলতে মন্দ লাগছে না। আগে মেজাজ খারাপ হতো, কষ্ট পেতো। কিন্তু এখন কেমন আদর আদর লাগছে।

নীহারের কথার মাঝখানে বাড়িতে এসে উপস্থিত হলো মোকাররম। বাড়ির পেছনের জমিতে কাজ করে ধুলো মাখা হাত নিয়ে ফিরে এসেছে সে।

বাড়িতে আদ্রিকাকে দেখে খানিকটা অবাক হলো। তার ছোট মেয়েটির গায়ে লেমন গ্রীন কালারের একটি শাড়ি। কোলের উপর রাখা ডান হাতে কয়েক গাছি চিকন সোনালি চুড়ি। কানে খুব সাধারণ সোনালি ঝুমকো। চুলগুলো চূড়খোপা করে বাঁধা। দেখতে অনেকটা তোতাপাখির মতোই লাগছে।

মোকাররমকে দেখে আদ্রিকা সোফা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে সালাম দিলো। বেসিনে হাত ধুচ্ছে মোকাররম। সালামের জবাব নিয়ে চিরায়িত গম্ভীর স্বরে জবাবা দিলো,

‘এই ভরদুপুর বেলা কি মনে করে? জামাই ছাড়া এমন একলা ঘুরাঘুরি করতেছিস কেন? লোকে কি বলবে!’

আদ্রিকার নীহারে দিকে তাকালো। কিন্তু নীহার নিজেও নিশ্চুপ। তাই বাধ্য হয়ে আদ্রিকাকেই মুখ খুলতে হলো।

‘আসলে কলেজে গেছিলাম। তাই ভাবলাম বের হইছি যখন বাড়ি থেকেও ঘুরে যাই।’

শুকনো তোয়ালেতে হাত মুছে বসার ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে মোকাররম জানতে চাইলো,

‘কলেজে কেন? একলা মেয়ে মানুষ এতো ঘুরাঘুরি কীসের? জামাই জানে? বলে আসছিস?’

কয়েক কদম এগিয়ে এসে আদ্রিকা দাঁড়ালো বাবার সামনে। যেই প্রয়োজনে এখানে এসেছে, সেটা জানানো যাক। বাবার সাথে খোশগল্পের আশা আকাঙ্ক্ষা করাও বোকামি।

‘আমার ফাইনাল পরীক্ষার ফরমফিলাপ শুরু হয়েছে৷ কালকে লাস্টডেট। কিছু টাকা লাগত।’

মোকাররম হতবিহ্বল হয়ে একবার মেয়ের দিকে তাকালো, আরেকবার স্ত্রীর দিকে৷ অথচ দুজনেই মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। ক্রুদ্ধ মোকাররম ধমকিয়ে উঠল,

‘ফরমফিলাপ করবি মানে? এই নীহার, তোমার মেয়ে এইসব কি বলে?’

নীহার নিজেও এগিয়ে এসে মেয়ের পাশে দাঁড়িয়ে মিনমিন করে অনুরোধ করলো,

‘এইচএসসি পরীক্ষাটা দিলে ভালো হয়। এতোদিন পড়লো, এখন ফাইনাল পরীক্ষাটা দিবে না। কেমন দেখায় না? দেক না।’

‘পরীক্ষা দিবে! আরও পড়াশোনা করবে! তোমার মেয়েরা তো পড়াশোনা করতে কলেজে যায় না। ওরা যায় আমার মানসম্মান ডুবাইতে৷ একজনকে পড়াশোনা করায়, কোন প্রতিদান পাইছো তোমার মনে নাই? এখন আরেকজনরে নষ্ট করতে নামছো? এই বুদ্ধিতে দিতেছো তুমি মেয়েকে? একজন বিয়ের আগে ছেলে নিয়ে পালাইছে, এখন তুমি কি চাও আরেকজন বিয়ের পর ছেলে নিয়ে পালাক?’

এমন বিশ্রী, নোংরা অপবাদে আদ্রিকা অবাক চোখে নিজ জন্মদাতার দিকে তাকালো। সে কখনো বাবাকে এভাবে কথা বলতে দেখেনি। অন্তত ওর সাথে মোকাররম আগে কখনো এভাবে কথা বলেনি। নীহারকে গালিগালাজ করতো। প্রতিবাদ করার সুবাদে আদ্রতাকেও কখনো দু চারটে গালি শুনতে হতো। কিন্তু আদ্রিকা ছিলো এসবের আড়ালে আবডালে ছায়াঘেরা সতেজ প্রান্তরে। সেখানে হঠাৎ সূর্যের এমন ভয়াল দাবদাহ তার নরম, কোমল মনে গভীর আঘাতের সৃষ্টি করলো৷

কেমন অসার হয়ে আসছে দেহ। চেনাজানা মানুষগুলোর মুখ ঝাপসা। সে তার আদ্র কণ্ঠে বলল,

‘কলেজে যেতে হবে না। এখন আর ক্লাস হচ্ছে না৷ শুধু পরীক্ষা দিবো। কালকে কলেজে গিয়ে ফরমফিলাপের টাকা জমা দিলেই হয়ে যাবে। তুমি না হয় নিজে গিয়ে আট হাজার টাকা দিয়ে আসো। তাহলে আমার আর যাওয়া লাগবে না।’

টাকার প্রসঙ্গে মোকাররমের মেজাজ উত্তপ্ত লাভার ন্যায় ফুটতে থাকে। কেউ তার কাছে টাকা চাইলে তার ভালো লাগে না। নিজের রোজগারের টাকা নিজের ইচ্ছেমতো খরচ করতে পছন্দ করে। এখানে কারো দখলদারি, দাবিদাওয়া শুনলে ভীষণ রাগ উঠে যায়। কেনো সে নিজের উপার্জিত টাকা অন্যের পেছনে অযথা খরচ করবে? খাওয়াদাওয়া, পোশাকআশাকের মতো জরুরি প্রয়োজনগুলো মিটাচ্ছে সেগুলো কি কম নয়? তাহলে এই উপরন্তু খরচের দায়ভার কেনো তারা মোকাররমের উপর চাপাতে চায়? সে কড়া ধমক দিয়ে বলল,

‘টাকা চাইলেই পাওয়া যায়, তাই না? টাকা কি গাছে ধরে? ঝাঁকি দিলেই টুপটাপ করে পরবে? আট হাজার টাকা যেনো কোনো টাকাই না। এতো পয়সা নষ্ট করে পরীক্ষা দিবে! তোমাদের পিছনে আমি বহু টাকা পয়সা নষ্ট করছি, বহু পরিশ্রম করছি৷ আর না। এখন বিয়ে দিছি, চুপচাপ সংসার করো।’

আদ্রিকার মনে হলো, সে ভুল জায়গায়, ভুল মানুষের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। এটা কোনো ভাবেই তার চিরপরিচিত বাড়ি হতে পারে না। সারাজীবন জেনে আসা জন্মদাতা পিতাকে অচেনা লাগছে। এই বাড়ি, এই মানুষগুলো, ঘরের প্রতিটি জিনিসপত্র সবকিছু একটা ভ্রম। একটু আগে মনে হয়েছিল, বাড়ির সাজসজ্জায় পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু এই মুহূর্তে সে বুঝতে পারলো, বিয়ের পর মেয়েদের চেনা জগতের পুরোটাই পরিবর্তিত হয়ে যায়৷ নিজের ঘরটা থেকে শুরু ঘরের বাতাসটাও যেনো অচেনা হয়ে যায়।

সে ছলছল চোখে মায়ের দিকে তাকালো৷ মায়ের কাছে সবসময় সবকিছুর সমাধান থাকে। শূণ্য হাড়ি থেকেও ভাত তুলে ক্ষুধার্ত সন্তানের মুখে খাবার তুলে দেয়। কতোবার এমন হয়েছে, মোকাররম ঈদের জামা কিনে দিতে আপত্তি জানালে নীহারকে ওকে মানিয়ে নিয়েছে৷ তবে আজ কেনো মানাচ্ছে না?
অসহায় আদ্রিকা মাকে ডেকে উঠলো,

‘ও মা?’

নীহার কেমন অনিচ্ছা নিয়ে মোকাররমকে বলল,

‘একটা পরীক্ষা। এরপর তো আর খরচ নাই। চাইতেছে যখন দেও টাকাটা৷ বেশি তো না।’

মোকাররম জেদি, একগুঁয়ে। এসব লেখাপড়া করে কি হয় সে বুঝে না। এইচএসসি পাশ করে কয়জনের চাকরি হয়? তার হয়েছে? হয়নি তো৷ তবে এই অকাজের পরীক্ষার জন্য সে কেনো আট হাজার টাকা ব্যয় করবে?

‘চুপ থাকো তুমি। আট হাজার টাকা কিছু মনে হচ্ছে না? কখনো দুই টাকা আয় করেছো? আয় করলে বুঝবা প্রতিটা পয়সার কতো মূল্য। বসে বসে খাচ্ছো তো, টাকার মর্ম বুঝবা না।’

‘কয়টা টাকার জন্য ভরদুপুর বেলা চিল্লাচিল্লি শুরু করে দিলো। যেনো কেউ উনার রাজপ্রাসাদ লিখে চাইছে। বাদ দে তো এই লোকের কথা৷ ঘরে চল তুই।’

নীহার বিরক্ত হয়ে আদ্রিকার হাত ধরে সেখান থেকে নিয়ে গেলো। নিজের ঘরটা এখন কেমন আছে, কি অবস্থায় আছে দেখার ইচ্ছে হলো না আদ্রিকার। চুপচাপ বিছানায় পা ঝুলিয়ে বসে মেঝের দিকে তাকিয়ে রইলো। নীহার বলল,

‘চা খাবি? চা বানিয়ে দেই?’

দু চোখ বুজে আদ্রিকা লম্বা শ্বাস নিয়ে বলল,

‘দরকার নাই। কিছু খেতে ইচ্ছে করছে না।’

‘রোদ থেকে আসলি। হাত মুখ ধুয়ে একটু রেস্ট নে।’

আদ্রিকাকে একা ছেড়ে দিয়ে নীহার বেরিয়ে এলো। অবুঝ, একগুঁয়ে, জেদি একটা লোকের সংসার করতে গিয়ে নীহারের জীবনটা সবসময় দোটানায় কেটেচে। আজ কাটছে। আগে শ্বশুড়-শাশুড়ি এবং স্বামীর মধ্যকার দ্বন্দে সে পিষ্ট হতো। এখন সন্তান এবং স্বামীর দ্বন্দে পিষ্ট হচ্ছে।

বিয়ের পরও মোকাররমের উদাসীনতা গেলো না। ভবঘুরের মতো ঘুরে ঘুরে দিন কাটায়। যৌথ পরিবারে নীহার দিনরাত খাটে। বেকার স্বামীর বউ সে। সংসারে দেওয়ার মতো কোনো আয় তার স্বামীর নেই। তাই নিজের পরিশ্রম দিয়ে সে সংসারে বিনিয়োগ করতে চাইতো। কিন্তু তবুও বড় জায়ের খোঁচা থেকে রক্ষা পেতো না। রোজকার ঝামেলায় শাশুড়িও মাঝেমধ্যে মেজাজ খুইয়ে ছেলের জন্য বরাদ্দ তীব্র বাক্যবাণ নীহারের দিকেই ছুড়ে দিয়ে মনের ক্ষোভ প্রকাশ করতেন। কিন্তু নীহারের ক্ষোভ প্রকাশ করার কোনো জায়গা ছিলো না। মোকাররমকে আয় রোজগারের কথা বললে, সে উল্টো কথা শুনিয়ে দিতো৷

‘কী সমস্যা হচ্ছে তোমার? কীসে কমতি? রোজ তিনবেলা ভালোমন্দ খেতে পাচ্ছো, দামী কাপড়চোপড় পরছো৷ আর কি চাই তোমার? বাপের বাড়িতে যে পেট ভরে দু মুঠো খাবার পেতো না, তার এতো বিলাসিতায়ও মন ভরছে না!’

মোকাররমের কথায় লজ্জায় মুখ লুকাতো নীহার। সত্যিই তো, ওর বাপের বাড়ির অবস্থা ছিল শোচনীয়। দু বেলা শাকপাতা দিয়ে আধপেট খেয়ে বড় হয়েছে। তার কি বিলাসিতা মানায়? রাগ, ক্ষোভ, কষ্ট, মান, অপমান এসব নিয়ে ভাবনাচিন্তা ওকে মানায় না।

এরপর সংসার আলাদা হলো, মোকাররম কিছু আয় রোজগার করা শুরু করলো। কিছু উদাসীনতা গেলো না। নীহার যতোটুকু সম্ভব সংসারের হাল ধরে রাখার চেষ্টা করে। সন্তানদের ছোটখাটো সমস্ত খরচ নিজে বহন করে। ওদের যতো আবদার পূরণ করে৷ কিন্তু ছোট্ট প্রাণগুলো কখনো শখের বসে বাবার কাছে আবদার করা মাত্র মোকাররমের তোপের মুখে পরে গুটিয়ে যেতো৷ সবচেয়ে বেশি ধমক খেয়েছে আদ্রতা। ওর নিষ্পাপ, কোমল মনটি বাবার ধমক, কটুক্তিতে নিষ্পেষিত হয়ে যেতে সময় লাগেনি। অল্প সময়ে সে নিজের বাবার রুক্ষ সত্তাকে চিনে ফেলেছে। এরপর থেকে সমস্ত আবদার নিয়ে হাজির হতো মায়ের কাছে। একদিকে সে নিজেকে বাবার কাছ থেকে গুটিয়ে নিয়েছিল। অন্যদিকে আদ্রিকাকে নিজের সুরক্ষা বেষ্টনীর মধ্যে বন্ধী করে রেখেছিল।

আদ্রিকার কোনো আবদার কখনো বাবা কিংবা মায়ের কাছে আসেনি। সবসময় বোনের কাছে আবদার জানাতো। ওকে কখনো না করেনি আদ্রতা। নিজের অপূর্ণতার লেশ মাত্র আদ্রিকাকে ছুঁতে দেয়নি।

আজ আদ্রতা থাকলে আদ্রিকা কখনো মোকাররমের কাছে ফরমফিলাপের টাকা চাইতো না। কলেজে থেকে ফিরে ডানা মেলে উড়ে চলে যেতো বোনের কাছে। উচ্ছ্বসিত কিশোরী কলকল করে জানাতো কলেজে আজকের অভিজ্ঞতা। কতো টাকা লাগবে, কখন, কোথায়, কীভাবে টাকা জমা দিতে হবে সবটা আদ্রতা সামলে নিতো। কারণ ওর অভিজ্ঞতা আছে। নিজের ভর্তি থেকে শুরু করে ফরমফিলাপ, ফাইনাল এক্সাম সবকিছু আদ্রতা নিজে নিজে ম্যানেজ করেছে। পরিবার থেকে কখনো কোনো সহযোগিতা সে পায়নি। শুধুমাত্র ওই আর্থিক সাহায্য ছাড়া নীহারও মেয়েকে কোনো সাহায্য করতে পারেনি। সেই স্বল্প শিক্ষিত, অনাড়ম্বর জীবনধারার একজন নারী। বাইরে চলতে ফিরতে তেমন একটা জানে না। তাই তো বড় মেয়েকে আত্ম নির্ভরশীলতা হতে বলেছিল। নিষ্ঠুর পৃথিবীতে একা লড়াই করতে ছেড়ে দেওয়া ছাড়া কোনো গতি ছিলো না।
নীহার জানতো, আদ্রতা পারবে। সত্যি সে পেরেছে। বিয়ে ছেড়ে আদ্রতার পালিয়ে যাওয়ায় নীহার সবচেয়ে বেশি খুশি হয়েছে। মা হিসেবে সে নিজের মেয়েকে রক্ষা করতে পারেনি। কিন্তু তার মেয়ে নিজেই নিজেকে রক্ষা করেছে। এ নিয়ে সে মনে মনে গর্ববোধ করে।

কিন্তু আদ্রতার উপর নীহারের রাগও হয় ভীষণ। আদ্রিকাকে রক্ষা করতে গিয়ে, ওকে পুরো আমড়া কাঠের ঢেঁকি বানিয়ে ফেলেছে। তোর ফরমফিলাপের টাকা লাগবে না কি লাগবে সেটা মাকে বলবি। তা না করে কেনো আবেগে ভেসে নাচতে নাচতে বাপকে বলতে গেলি? তোর বাপটা কি ওমন শখের? সে কখনো শখ পূরণ করতে জেনেছে? না তার জীবনে কোনো শখ আহ্লাদ আছে, না সে শখ আহ্লাদ বুঝে।

ড্রয়িংরুমে সোফায় বসে টেলিভিশনে খবর দেখছে মোকাররম। নীহার ধীর পায়ে কাছে এগিয়ে গিয়ে চাপাস্বরে অসন্তুষ্টি প্রকাশ করে বলল,

‘টাকা দিতে পারবা না, সেই কথাটা একটু ভালোভাবে বুঝিয়ে বলা যেতো না? এমন চিল্লাচিল্লি করার কি আছে? মেয়ে কি এখনো ছোট আছে যে এখনো ওর সাথে এমন চিল্লাচিল্লি করতেছো, ধমক দিতেছো? বিয়েশাদি দিছো, এখন সে পরের ঘরের সম্পদ। কথাবার্তা একটু দেখেশুনে বলবা না!’

নীহারের কথা শুনে মোকাররম বিরক্তিমাখা দৃষ্টি ছুড়ে দিলো। আজ সারাদিন কাজেকর্মে দুদন্ড শান্তিতে বসতে পর্যন্ত পারে নাই। এবেলা একটু বসেছে খবর দেখতে। এখানে এসে এই মহিলা জ্ঞান দেওয়া শুরু করেছে। সে জোরালে কণ্ঠে ধমক দিয়ে বলল,

‘তোমার মেয়েরে বিয়ে দিছি, এখন সে এই বাড়িতে কি করে? শ্বশুরবাড়ি রেখে এখানে আসছে কেন?’

‘ওর বাপের বাড়ি ও আসবে না?’

‘না আসবে না। নিজের ঘর সংসার নিয়ে থাকতে কও। আমার যা দায়িত্ব ছিলো আমি পালন করছি। এখন আর আমার কোনো দায়দায়িত্ব নাই৷ আমার বাড়িতে আর যেনো না আসে বলে দিবা৷’

‘আস্তে কথা বলো। মেয়েটা কতোদিন পর আসলো। এসব কথা শুনলে কি ভাববে! ওরা কি এখনো ছোট আছে যে যা মুখে আসতেছো বলে যাচ্ছো!’

‘কেন আস্তে বলবো? অকৃতজ্ঞগুলার শোনা দরকার। ডাক ওরে আমি হিসাব দেই, জন্মের পর থেকে এদের পিছনে আমার কতো টাকা পয়সা নষ্ট হইছে। এতোদিন এগুলারে খাওয়ায় আমার কোনো লাভ হইছে? খাওয়াও, পড়াও, বিয়ে দেও। এতো এতো খরচের পর এখন আবার আসছে টাকা চাইতে৷ ছেলে হইলে তাও শেষ বয়সে আমাদের দেখতো। মেয়ের পিছনে এতো টাকা খরচ করে কি লাভ? তোমারে কইছিলাম হাই স্কুল পাশ করতেই বিয়ে দিয়ে দেও। তুমি শুনো নাই। আরও পড়াবা। এই করতে করতে আমার টাকা পয়সা সব শেষ। এখন আবার আসছে টাকা চাইতে। কেন দিবো আমি?’

আর ঘরে থাকা সম্ভব হলো না আদ্রিকার। চোখের জল মুছে বাবার সামনে দাঁড়িয়ে সেও ক্রুদ্ধ বাঘিনীর মতো ফোঁস ফোঁস করে প্রতিবাদ করলো,

‘কোনো দিবা না? আমি তোমার মেয়ে না? বাবা হিসেবে তোমার দায়িত্ব নাই? খাওয়া দাওয়ার খোঁটা দিতেছো কেন? সব বাবা তার সন্তানকে আয় রোজকার করে এনে খাওয়ায়। তুমি একমাত্র ব্যক্তি না। সবাই খাওয়াইতে পারলে তুমি পারবা না কেন? আমাদের পেছনে তোমার কি এমন খরচ হইছে? তোমার কোন জমিদারি নিলামে উঠছে?’

পরপর এতোগুলা প্রশ্নের অতর্কিত আক্রমণে মোকাররম হতবিহ্বল হয়ে তাকালো নীহারের দিকে। রাগে কাপতে কাপতে বলল,

‘কেমন বেয়াদব মেয়ে মানুষ করছো? মুখে মুখে তর্ক করে। লেখাপড়া করে এগুলা শিখছে? এগুলারে তুমি শিক্ষিত বলো!’

নীহার মেয়েকে শান্ত করার চেষ্টায় লেগে পরলেন। হাত ধরে টেনে বললেন,

‘চুপ কর। ঘরে যা তুই।’

‘নাহ, আমি ঘরে কেনো যাবো? তখন থেকে উল্টাপাল্টা কথা বলে যাচ্ছে। যা মুখে আসতেছে বলতেছে। এখন আমি বলায় আমি বেয়াদব হয়ে গেলাম?’

‘বড়দের সাথে এভাবে কথা বলতে হয় না।’

‘আর বড়োরা যা খুশি তাই বলতে পারে, তাই না? কেনো সে আমার ফরমফিলাপের টাকা দিবে না? তার কাছে কি টাকা নাই? না থাকলে বলুক।’

মোকাররমও বৃথা জেদ দেখিয়ে বলল,

‘আমার টাকা আমি দিবো না। আমার ইচ্ছা।’

‘বাবা হইছো, কিন্তু বাবার দায়িত্ব পালন করবা, তা তো হবে না। ইচ্ছা অনিচ্ছার কথা আগে ভাবা উচিত ছিলো। বাচ্চাকাচ্চা নিছো কেন তুমি? বাচ্চা নিলে তার লালনপালন করতে হবে, তার পেছনে অর্থ ব্যয় করতে হবে সেটা তোমার জানা ছিলো না? তোমার তো বাচ্চা নেওয়াই উচিত হয়নি। আসলে তোমার বিয়ে করাই উচিত হয়নি।’

আদ্রিকার কথা শেষ হওয়া মাত্র মোকাররমের শক্তপোক্ত, রুক্ষ হাতটি তীব্র বেগে তার গাল ছুঁয়ে গেলো। থাপ্পড়ের দাপটে দু কদমে পিছিয়ে সোফা টেবিলের সাথে ধাক্কা খেয়ে পরেই যাচ্ছিলো, পেছন থেকে তার কোমর জড়িয়ে ধরে ওকে সামলে নিলো পরখ।

আশেপাশের কোনোকিছুই আদ্রিকার মস্তিষ্কে ঠাই পাচ্ছে না। সে অবাক চোখে চেয়ে দেখছে নিজের পিতাকে। যে ক্রুদ্ধ হয়্র এখনো ছুটে আসতে চাইছে আদ্রিকার দিকে। দু হাতে জাপটে ধরে মোকাররমকে সামলাচ্ছে নীহার। নীহারের হাত থেকে ছুটে আসতে না পারলেও মোকাররমের মুখ থেমে নেই৷ একনাগাড়ে গালিগালাজ করে যাচ্ছে সে।

পরখের গায়ে হেলান দিয়ে আদ্রিকা দেখছে সেই অদ্ভুত, অনাসৃষ্টি দৃশ্য। নিজের অদৃষ্টের এমন পরিনতি মানতে কষ্ট হচ্ছে৷ মোকাররমের এমন আচরণ নিশ্চয়ই নতুন নয়। কারন নীহারের চোখে কোনো বিহ্বলতা নেই। বরং মেয়ে জামাইয়ের সামনে এমন পরিস্থিতি সৃষ্টিতে সে লজ্জিত। আদ্রিকা প্রথমবার এমন পরিস্থিতির স্বীকার হলো বলে, ও খানিকটা বেশিই কষ্ট পাচ্ছে। তাইতো পাথরের মূর্তি ন্যায় স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু ক্ষণে ক্ষণে ঘোলাটে হয়ে আসছে দৃষ্টি। টুপটাপ করে ফোটায় ফোটায় জল গড়িয়ে পরে ক্ষণিকের জন্য চোখের কোটরে জলের পরিমাণ ক্ষীণ হলেও তা ক্ষণস্থায়ী মাত্র। আবারও নতুন জলকণা এসে ভীড় জমাচ্ছে চোখের কোটরে।

মোকাররম বারংবার বলে যাচ্ছে,

‘কেমন বেয়াদব মেয়ে মানুষ করছো? ঠাটায় আর দুটো চড় মারা দরকার। ওর মুখের ভাষা দেখছো!কতো বড় সাহস ওর!’

পরখ ভীষণ শান্ত দৃষ্টিতে চেয়ে দেখছে সে দৃশ্য। এতোক্ষণে সে আদ্রিকাকে আড়াল করে দাঁড়িয়েছে। নীহার যখন ফোন করে জানালো, আদ্রিকা এ বাড়িতে এসেছে। সে যেনো যাওয়ার সময় ওকে নিয়ে যায়। পরখ ভেবেছিলো, ভালোই হলো ঝামেলা বিদায় হয়েছে। দেরিতে হোক, আদ্রিকা যে বুঝেছে ওদের একসাথে কোনো ভবিষ্যত নেই, সেটাই অনেক।
তবুও ভদ্রলোকের মতো শেষ বিদায় জানাতে সে এসেছে শ্বশুরবাড়ি। কিন্তু এসেই এমন ভয়াবহ দৃশ্যের সাক্ষী হতে হবে জানা ছিল না। আদ্রিকা কী এমন বলেছে, কেন আদ্রিকার বাবা এমন হিংস্র হয়ে উঠেছেন – জানা নেই পরখের৷

তবে আদ্রিকার ছোট দেহটি এই মূহুর্তে অনবরত মৃদু কাঁপছে তা সে স্পষ্ট অনুভব করতে পারল। তাই আর দেরী না করে, শান্ত কিন্তু স্পষ্টভাবে জানালো নিজের বার্তা।

‘আই থিংক আমাদের ফেরা উচিত। চলো আদ্রিকা।’

‘হ্যাঁ, হ্যাঁ। ওকে নিয়ে যাও।’

মোকাররম কিছুটা শান্ত হলো। নীহারের পাশে দাঁড়িয়ে ঘৃণিত দৃষ্টি মেলে তাকালো পরখের পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা আদ্রিকার দিকে।

পরখ আর দাঁড়ালো না। আদ্রিকার হাত ধরে চলে এলো বাড়ির বাইরে। সামনের আঙ্গিনার পুরোটা পথ আদ্রিকার কেমন অপ্রকৃতস্থের মতো হেটে গেলো। প্রথমে নিজে বাইকে বসে আদ্রিকার হাত ধরে ওকে বাইকের পেছনে বসিয়ে নিলো পরখ। আদ্রিকা চুপচাপ বসলো, কিন্তু কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালো না।

না পরখের কাধে হাত রাখলো, না বাইকের পেছনের অংশ ধরলো। সে শুধু একদৃষ্টিতে ‘চুপকথা’ লেখাটির দিকে তাকিয়ে রইলো৷ পরখের বাইক চলছে খুব ধীর গতিতে৷ ওরা চুপকথা ছেড়ে অনেকটা পথ পেরিয়ে এসেছে, তবুও আদ্রিকা সেদিকেই চেয়ে আছে। ছেড়ে আসা পথে কী খুঁজে চলেছে কে জানে!

বাড়ি ফিরত্র ফিরতে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো। পরখ ভেবেছিল আদ্রিকার সাথে দেখা করে রাতের দিকে আবারও কাজে ফিরবে। বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনা করে তা আর সম্ভব হলো না।

রেস্টুরেন্টের জন্য একটি ফ্ল্যাটের খোঁজ পাওয়া গিয়েছে৷ ভাড়ার জন্য আজ রাতেই চুক্তিস্বাক্ষর হবে। কিন্তু বাইক থেকে নেমে দ্রুত পায়ে উপরে চলে গেলো আদ্রিকা। ওর পেছনে ছুটে এসে পরখ দেখলো, নিজ কক্ষে প্রবেশ করে দরজা বন্ধ করে দিয়েছে আদ্রিকা।

সাধারণত ওদের কক্ষের দরজা ভেজানো থাকে, খুব একটা ছিটকিনি তোলা হয় না। যখন কারো দ্বারে ছিটকিনি উঠে, তখন অপরপক্ষের সময় কাটে উৎকণ্ঠায়। এই যেমন এখন কাটছে পরখের৷

চলবে….
#অক্ষরময়ী
#পরিণয়ে_নোলককন্যা (কপি নিষেধ)

|২৮|

আকাশ থেকে টুপটাপ বৃষ্টি ঝরছে৷ ছাদে যেতে পারলে ভালো হতো। কিন্তু এ বাড়ির ছাদে যাওয়ার অনুমতি নেই ভাড়াটিয়াদের। আদ্রতার খুব বৃষ্টিতে বৃষ্টিতে ভিজতে ইচ্ছে করছে। ঝুম বৃষ্টি দেখলে কার না ভিজতে ইচ্ছে করে না?
উপায় নেই বলে বারান্দায় দাঁড়িয়ে সে গ্রিল ভেদ করে হাত বাড়িয়ে বৃষ্টি পানি ছুঁলো। বর্ষার প্রথম বৃষ্টি। হিতশীতল জলে গা শিরশির করে উঠল৷ আদ্রতা হাত সরিয়ে নিল না।

অফিস থেকে ফিরে আদ্রতাকে দেখতে না পেয়ে বারান্দায় এলো বিকল্প। চুপিচুপি আদ্রতার পেছনে দাঁড়িয়ে সেও হাত বাড়িয়ে বৃষ্টি ছুঁলো। তারপর যখন হাতের তালু জমা হলো জলের ধারা, সেগুলো ছুঁড়ে দিল আদ্রতার মুখে। চমকে ফিরে চাইল আদ্রতা। বিকল্পকে দেখে খিলখিল করে হেসে উঠে সেও হাতে জল জমিয়ে বিকল্পকে খানিকটা ভিজিয়ে দিল।

কে বলে সুখী হতে অনেক অনেক অর্থ দরকার? জীবনকে উপভোগ করতে জানলে যে-কোনো পরিস্থিতিতে নিজ সামর্থ্য অনুযায়ী সুখী হওয়া যায়। শুধু পাশে একজন চমৎকার মনের জীবনসঙ্গী প্রয়োজন।

ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে এসে বিকল্প দেখলো আদ্রতা ভেজা কাপড় পাল্টে ফেলেছে। মেঝেতে মাদুর বিছিয়ে তাতে খাবারের আয়োজন চলছে৷ বিকল্প খেতে বসল না।

আদ্রতার হাত ধরে ওকে বিছানায় বসিয়ে দিয়ে নিজে সামনে দাঁড়াল। অবাক চোখে চেয়ে আদ্রতা বলল,

‘আরে করছ কি!’

বিকল্প চমৎকার হাসল। গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,

‘রান্নাবান্না, ঘর সংসার করতে গিয়ে তুমি কি বাকিসব ভুলে গেছো?’

‘আবার কী ভুলে গেলাম আমি!’

‘মিডের ডেট দিয়েছে।’

আদ্রতা প্রথমে খুশি হলো। তারপর ধপ করে মুখখানা আঁধারে ডুবে গিয়ে চিন্তিত কণ্ঠস্বর শুধাল,

‘অফিস থেকে তোমাকে ছুটি দিবে?’

‘এক্সামের কথা জানালে অবশ্যই দিবে। তবে..’

‘তবে বলে কিছু নেই। তুমি অবশ্যই পরীক্ষা দিবে।’

‘আমি পরীক্ষা দিবো মানে? তুমি দিবে না কেনো?’

‘আমি! যাহ, আমার এখন ঐ শহরে ফিরে যাওয়ার মুখ আছে?’

‘শহরে ফিরে যাওয়া নিয় সমস্যা নাকি তোমার পরীক্ষার ফি দিতে পারবো না বলে পরীক্ষা দিতে চাইছো না?’

আদ্রতা হাত বাড়িয়ে বিকল্পের একটি হাত ধরল। মিষ্টি স্বরে বলল,

‘দুজনে একসাথে পরীক্ষা দেওয়ার কী দরকার? আমি না হয় এই সেমিস্টার ড্রপ দেই। এতোটুকু আয়ে সংসার চলছে, তার উপর দুজনের লেখাপড়া কীভাবে সম্ভব? তুমি প্লিজ জেদ করো না। পরীক্ষাটা দিয়ে এসো।’

‘তোমার মনে হচ্ছে আমি তোমার লেখাপড়ার খরচ চালাতে পারব না, তাই তো?’

‘তুমি চাইলে অবশ্যই পারবে। কিন্তু আমি চাইছি না, তোমার উপর চাপ দিতে। আমার একটুও মন খারাপ নেই, আফসোস নেই৷ বিশ্বাস করো। আমি তোমাকে ভরসা করি।’

‘তবে আরেকটু ভরসা করো। পরীক্ষা দিলে আমরা দুজনে পরীক্ষা দিব। এক্সট্রা টাইমের ডিউটি আমি এমনি এমনি করিনি। ওটার টাকা আলাদা করে জমিয়ে রেখেছি আমাদের পড়াশোনার জন্য।’

আদ্রতা ছলছল চোখে কিছুক্ষণ চেয়ে রইল। দৃষ্টি নামিয়ে নিতেই এক ফোটা জল টুপ করে ওর চোখ বেয়ে কপোল ছুঁলো। ওর থুতনিতে হাত রেখে মুখ তুলে তাকাতে বাধ্য করল বিকল্প। গভীর চোখে সেই জলের ফোটার দিকে চেয়ে প্রশ্ন করল,

‘কাঁদছ কেনো?’

‘আমি তোমার কোনো সাহায্য করতে পারছি না। তুমি একলা পরিশ্রম করে যাচ্ছো। তোমার উপর খুব চাপ হয়ে যাচ্ছে, তাই না? জব করতে চাইছি, তাও দিচ্ছো না। এভাবে ঘরে বসে না থেকে একটা কাজে জয়েন করলে অন্তত তোমাকে কিছুটা সাহায্য করতে পারতাম।’

‘তুমি চাইলে অবশ্যই জব করবে। তবে সেটা পড়াশোনা শেষ করে। তোমার যোগ্যতা অনুযায়ী কাজ করবে তুমি। আমি থাকতে এসব ছোটখাটো কাজ তুমি কেনো করবে? খেটে খেতে নিয়ে এসেছি নাকি তোমাকে! তুমি রাজরানি হয়ে থাকবে আমার সংসারে।’

‘হুহ, রাজমশাইয়ের শখ কতো!’

‘অনেক শখ। রানির পায়ে জগতের সমস্ত সুখ অর্পণ করতে চাই।’

‘আল্লাহ তোমাকে সেই তৌফিক দান করুক। এখন আপাতত খাবার খেয়ে রানিকে উদ্ধার করো।’

সন্ধ্যার চায়ের কাপে আদ্রতা-বিকল্পের খুনসুটির মাঝে বিকল্পের মোবাইল বেজে উঠল। কল রিসিভ করে কথা বলার মাঝে ধীরে ধীরে মুছে গেল তার মুখের হাসি। সে দিকে তাকিয়ে চিন্তা হলো আদ্রতার। তবুও সে ধৈর্য্য নিয়ে অপেক্ষা করছে। কথা শেষ হলে সে জানতে চাইল,

‘তোমার সেই বন্ধুটা না?’

মোবাইলটি টেবিলের উপর বিকল্প বলল,

‘হ্যাঁ।’

‘কি বলল?’

‘এক্সামের খোঁজ খবর জানতে ওকে ভার্সিটিতে পাঠাইছিলাম। সেই বিষয়ে কথাবার্তা হলো।’

চায়ের কাপ দুটো নিয়ে আদ্রতা রান্নাঘরের দিকে যাচ্ছিল। বিকল্প বলল,

‘আদ্রতা?’

‘হুম।’

‘আদ্রিকা এবার সেকেন্ড ইয়ারে না?’

‘হ্যাঁ। কেন?’

‘এইচএসসি এক্সাম দিবে না?’

‘কেন দিবে না! অবশ্যই দিবে।’

‘না মানে, বিয়েশাদি হয়ে গেছে।’

‘বিয়ে হয়েছে বলে এক্সাম দিতে পারবে না, এটা কোনো কথা বললে? ও এখনো কতো ছোট!’

বিকল্প জানে নিজের বোন সম্পর্কে আদ্রতা কতটা সিরিয়াস। নিজের বাচ্চার মতো আগলে রেখেছিল আদ্রিকাকে। তাই আবেগ, ভালোবাসাটাও বেশি। সে শুকনো ঢোক গিলে বলল,

‘কলেজের একজন স্টুডেন্ট এইচএসসি পরীক্ষার ফরমফিলাপ করেনি। তাই নিয়ে টিচার্স রুমে কথ হচ্ছিল। আগে কখনো ভূবনভোলায় এমন হয়নি। তাই এই বিষয়টি নিয়ে বেশ চর্চ হচ্ছে। আমার বন্ধুটা সেই কথাই বলছিল আমাকে।’

আদ্রতার মনে হঠাৎ সন্দেহ উঁকি দিল। কাপ দুটো হাত নিয়েই ফিরে এসে দাঁড়াল বিকল্পের সামনে।

‘নাম কি স্টুডেন্ট এর?’

ওর হাত থেকে কাপ দুটো নিজের হাতে নিয়ে বলল,

‘আদ্রিকা এখনো ফরমফিলাপ করেনি। তুমি কি একটু খোঁজ নিয়ে দেখবে?’

আদ্রতা কিছুক্ষণ ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। অবিশ্বাসের সুরে বলল,

‘অসম্ভব। ওর কেনো পড়াশোনা বন্ধ হবে? তুমি বলেছিলে, অনেক সম্ভ্রান্ত পরিবারে ওর বিয়ে হয়েছে। পড়াশোনা বন্ধের মতো নিম্নমানের কাজ তারা কীভাবে করে!’

বিকল্প কিছু বলল না। শুধু আদ্রতাকে কাছে টেনে কিছুক্ষণ জড়িয়ে ধরে রাখল। আদ্রতার শরীর তখনো কাঁপছে। লেখাপড়া একবার থেমে গেলে তা পুনরায় শুরু করাটা বেশ কঠিন। এই কঠিন কাজ খুব স্বল্প ব্যক্তির পক্ষে সম্ভব।

সে অনেকদিন পর নিজের কেনা মোবাইলটি থেকে বাড়ির নাম্বার ডায়াল করল। ওপাশে প্রতিটি শব্দের সাথে আদ্রতার বুকে ধড়াস ধড়াস শব্দের সৃষ্টি হচ্ছে৷ আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে আছে বিকল্প। ওর এক হাত শক্ত করে ধরে আছে আদ্রতার কম্পনরত বাম হাতটি।

আদ্রিকা চলে যাওয়ার পর থেকে নীহারের ভীষণ মন খারাপ। ওদিকে মোকাররমও সেই যে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেছে আর ফিরেনি। ওদিকে পোড়ামুখো মোবাইল অস্থিরভাবে বেজে চলেছে।
অনিচ্ছাসত্ত্বেও নীহার কলটি রিসিভ করে রুক্ষ কণ্ঠে বলল,

‘হ্যালো, কে বলছেন?’

অনেকদিন পর মায়ের কণ্ঠস্বর কর্ণগোচর হওয়া মাত্র আদ্রতার চোখ সিক্ত হয়ে এলো। আদ্র কণ্ঠে সে ডেকে উঠল,

‘মা!’

নীহার থমকাল। স্তব্ধ হল। অনেক, অনেকদিন বাদে আয়েশ করে ডাকল,

‘আদ্রতা, আদ্রতা। এটা তুই?’

আদ্রতা ম্লান হেসে জবাব দিল।

‘হ্যাঁ আমি। আব্বু বাড়িতে আছে নাকি?’

‘নাহ। বাইরে।’

‘তুমি কেমন আছো মা?’

‘আমি? আছি, ভালো আছি। তুই কোথায়? কেমন আছিস?’

‘আমি ভালো আছি। এখন ঢাকায় আছি।’

‘হ্যা রে, তুই সত্যি কারো সাথে পালিয়েছিস? তোর বাপকে কতো বললাম, মেয়েটার একটু খোঁজ নেও। নিলো না। নিষ্ঠুর মানুষ একটা!’

আদ্রতার বড্ড অস্বস্তি হলো। কথা ঘুরিয়ে সে বলল,

‘আমি ভালো আছি মা। সেসব নিয়ে পরে কথা হবে। আদ্রিকা কোথায়, মা? শুনলাম ও নাকি পরীক্ষা দিচ্ছে না। এ কেমন বাড়িতে ওর বিয়ে দিয়েছো তোমরা! এমন গেঁয়ো মানসিকতা!’

আদ্রতা বরাবর এমনি। কখনো নিজের বোনের দোষ তার চোখে পরে না। সবসময় বিপক্ষকে দোষী বানিয়ে নিজের বোনের পক্ষ টেনে কথা বলে। বিরক্তি হলো নীহার।

‘মানুষের কী দোষ! তোর বোনটা একটা আস্ত মাকাল ফল। আল্লাহ শুধু একখানা চেহারা দিয়েছে। মাথায় কোনো বুদ্ধি দেয় নাই। আজকে কি করেছে জানিস? কলেজ থেকে ফরমফিলাপের কথা শুনে এসে তোর বাপে কাছে টাকা চেয়ে বসেছে। এই কিপ্টা লোক কখনো তোদের টাকা দিয়েছে? সবসময় আমি এটা ওটা থেকে টাকাজমিয়ে তোদের খরচ চালিয়েছি। তার উপর আজকাল তোর বাপের মেজাজ ভীষণ খারাপ থাকে।’

‘ভালো থাকে কোনদিন?’

‘তা অবশ্য ঠিক। কিন্তু এখন একটু বেশিই খারাপ। মাহিনের বাপ এসে ঝামেলা করেতেছে।’

‘কেনো? সে আবার কি চায়?’

‘তাকে ঠকিয়ে তোর দাদা বাড়িভিটা পুরোটাই তোর বাপকে লিখে দিয়েছে। এই নিয়ে তার অভিযোগ। তাকে ঠকানো হয়েছে। এখন সে ভাগ চায়। না দিলে থানা পুলিশ করবে। কোর্টে মামলা করবে। তোর বাপ কখনো এইসবে গেছে? মামলার কথা শুনে লোকটার মাথা গরম হয়ে আছে। তার উপর তোর বোন এসে আরেকদফা ঝামেলা করে গেলো। দুই মিলে বাড়িটা কুরুক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। আমার যে কী জ্বালা হয়েছে জীবনে!’

‘মামলা করলে বললেই হলো! করতে চাইলে করুক। দাদুর জমি, সে কার নামে লিখে দিয়ে সেটা তার ব্যাপার। এখানে কোন আইন এসে বাধা দিবে! সজ্ঞানে আব্বু আর তোমার নামে জমি লিখে দিয়ে গেছে। ওরা চাইলে তো আর হবে না। আব্বুকে অযথা ভয় পেতে বারণ করো। কোনো মামলা করে ওরা কোর্টে জিততে পারবে না। তুমি আমাকে আদ্রিকার ফোন নাম্বারটা দেও। আমি ওর সাথে কথা বলে দেখি।’

_______

অনেকদিন রান্নাবান্না করা হয় না। অভ্যাসটা বোধহয় নষ্ট হয়ে গিয়েছে। বেগুনের চপ ভাজতে গিয়ে প্রায় পুড়ে গিয়েছে। পরখ ভারি বিরক্ত হলো। রাইস কুকার হতে ভাত নামিয়ে নিয়ে বেগুনের চপ, শাক ভাজি, ডাল, আলু ভর্তা নিয়ে এসে চলে এলো খাবার টেবিলে। ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে উঁকি দিল আদ্রিকার ঘরে। সে এখনো বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে আছে। পরখ স্পষ্ট দেখল আদ্রিকা ফোপাঁচ্ছে। গলার স্বর গাঢ় করে ভারিক্কি গলায় সে ডাক দিল,

‘আদ্রিকা খেতে এসো।’

আদ্রিকা জবাব দিল না। এভাবে কাজ হবে না, পরখ জানে। তাই এবার ধমক দিয়ে বলল,

‘কী হলো! কথা কানে যাচ্ছে না? খাবার ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে। একে তো সারাদিন ভার্সিটিতে ক্লাস নেও, আবার বাড়ি ফিরে রান্না করো। লোকে আবার কান্নাকাটির মাঝে সময় কই রান্না করার!’

মাথা উঁচু করে ঘাড় ফিরিয়ে আদ্রিকা আগুন ঝরা দৃষ্টি ছুড়ে দিল। সেই দৃষ্টিকে পাত্তা না দিয়ে পরখ আরও জলদগম্ভীর স্বরে আদেশ করল,

‘দ্রুত উঠে এসো।’

আদ্রিকাও জেদ দেখিয়ে বলল,

‘খাবো না। আপনার কষ্টের রান্না আপনি একাই খান।’

পরখ এবার কক্ষে প্রবেশ করে আদ্রিকার বাহু ধরে ওকে টেনে তুলে দাড় করাল। টেনে খাবার টেবিলে নিয়ে আসতে আসতে বলল,

‘দুজনের খাবার রান্না হয়েছে। অনেক কষ্ট করে রোজকার করা অর্থ দিয়ে কেনা খাবার। নষ্ট করার দুঃসাহস করবে না।’

আদ্রিকার ইচ্ছে করল, বাটির খাবারগুলো পরখের মাথায় ঢেলে দিতে। সেটা যেহেতু করতে পারল না তাই খাবার টেবিলে বসে রাগের চোটে চোখের জল ফেলতে লাগল। তাতেও পরখের আপত্তি।

‘খবরদার, খাবার প্লেটে চোখের পানি ফেলবে না।’

চোখের জল মুছে আদ্রিকা কটকট করে তাকিয়ে জানতে চাইল,

‘কেনো?’

‘সংসারে অভাব বাড়ে।’

‘কে বলেছে আপনাকে?’

‘আমার দাদী।’

‘তাহলে আপনি মানছেন, আমাদের একটা সংসার আছে?’

‘আমি আমার সংসারের কথা বলছি।’

আদ্রিকা চুপচাপ খাবার খেয়ে কক্ষে ফিরে এলো। এঁটো থালাবাসন পরিষ্কার করল না। যার সংসার সে পরিষ্কার করুক। ও শুয়ে শুয়ে আকাশের উজ্জ্বল চাঁদ দেখছে। আদ্রিকার জীবনটাও চাঁদের মত উজ্জ্বল ছিল। সংসারের কলহ, বিবাদ তাকে খুব একটা ছুতে পারেনি। সে সবসময় নিজস্ব জগতে সুখী ছিল, সন্তুষ্ট ছিল। যখন যা আবদার করেছে, আদ্রতা পূরণ করে দিয়েছে। কখনো বিন্দু পরিমাণ অপ্রাপ্তির স্বাদ তাকে পেতে হয়নি। কলেজ পড়ুয়া সে এতোদিন জানতোই না, তার বাবা মেয়ের পড়াশোনায় অর্থ ব্যয় করতে নারাজ ছিলেন। আজ হঠাৎ এমন সত্যির মুখোমুখি হয়ে নিজেকে ভীষণ ছোট মনে হচ্ছে।

আদ্রিকা ভেবে দেখল, পর্দায় ঘেরা জীবনে সে খুব খুশি ছিল। যখন বোনের ছায়া মাথার উপর থেকে সরে গেল, তখন থেকে তার জীবনে একটার পর একটা বাজে ঘটনা ঘটে যাচ্ছে।

বোনকে লুকিয়ে প্রেম করেছে, তাই ধোঁকা খেয়েছে। বোন চলে যাওয়ার পর বাবা-মা জোর করে বিয়ে দিয়েছে। সেখানেও সে সুখী হতে পারছে না।

আদ্রিকার মনে হলো, আদ্রতা ছাড়া সে অসম্পূর্ণ, অচল। সে গায়ে গতরে বড় হলেও বাস্তবিক জ্ঞান শুন্যের কোঠায়। তার অনেক কিছু জানা বাকি, শেখা বাকি। এখনো অনেক কষ্ট পাওয়া বাকি।

আশেপাশে কোথাও ভোঁ করে শব্দ সৃষ্টি হলো। কেপে উঠল আদ্রিকা। তখনি খেয়াল হলো সে আবারও কাঁদতে শুরু করেছে। ভো ভো শব্দটি থামছে না। মোবাইলটি কোনো ভাবে ভাইব্রেট মুডে চলে গিয়েছে। বালিশের নিচ হতে সেটিকে বের করে আদ্রিকা দেখল একটি পরিচিত নাম্বার থেকে কল এসেছে। কলেজে সে নিজের নাম্বার দিয়ে এসেছে। সেখান থেকে কেউ খোঁজ করছে ভেবে কলটি রিসিভ করল।

‘হ্যালো, কে বলছেন?’

‘আদ্রতা বলছি।’

আদ্রিকার মনে হলো সে ভুল শুনেছে। খানিকক্ষণ চুপ থেকে আবারও প্রশ্ন করল,

‘কার কথা বললেন?’

আদ্রতার বেশ রাগ হল। একে তো পড়াশোনা ভুলে আছে। তার উপর এখন নিজের বোনকেও চিনতে পারছে না?

‘আমি তোর বড় বোন বলছি, বেয়াদব। বিয়ে করে স্মৃতিশক্তি লোপ পেয়েছে নাকি!’

আদ্রিকা রাগে কাপতে কাপতে বলল,

‘তুমি! তুমি আমাকে কল দিয়েছ কেনো? খবরদার আমাকে কল দিবে না। স্বার্থপর, লোভী একটা মেয়ে। কেনো কল দিয়েছো আমাকে?’

আদ্রতা নিজের কণ্ঠস্বরে সামান্য আদর ঢেলে বলল,

‘কাঁদছিস কেনো তুই? কি হয়েছে?’

‘এখন কেনো জানতে চাইছো? যখন ছেড়ে গিয়েছিলে তখন একবারও ভেবেছো আমার কথা? ভাবোনি। নিজের স্বার্থে সবাইকে পেছনে ফেলে চলে।গিয়েছিলে। তোমার জন্য মাহিন ভাইয়ার সাথে আমার বিয়ে হতে হতে কোনোরকমে বেঁচে গেছি। তুমি খুব স্বার্থপর একটা মেয়ে। অথচ তোমাকে আমি কতো ভালো ভাবতাম।’

‘মাহিনের সাথে বিয়ে না হয়ে খুব ভালো লোকের বিয়ে হয়েছে বুঝি? তবে পরীক্ষা দিচ্ছিস না কেনো? শুনলাম ফরমফিলাপ করিস নি এখনো।’

‘হ্যাঁ করিনি। ইচ্ছে হয়নি তাই করিনি। তোমাকে কৈফিয়ত দিবো কেনো? কে তুমি?’

‘পরীক্ষা দিবি না তুই?’

‘না, দিবো না। মেয়েদের এতো পড়ে কি হবে? কার জন্য পড়বো? নিজের বাবা যখন পড়াতে চায় না, তখন কীসের পড়াশোনা!’

‘থাপ্পড় মেরে সবকটা দাঁত ফেলে দিবো। খুন পাকনা হয়ে গেছিস না? পড়াশোনা না করে কি করবি শুনি? সংসার করবি? আজকাল বাচ্চাকে লালনপালন করতে গেলেও মিনিমাম একটা যোগ্যতা লাগে৷ তোর এখনো সেটাও হয়নি। আর বাবাকে চাইতে হবে কেন? তোর জীবন, তোর ইচ্ছে।’

‘আচ্ছা, শুধুমাত্র ইচ্ছেতে পড়াশোনা হবে? কই আমার তো হচ্ছে না। ইচ্ছে দিয়ে ফরমফিলাপ হলো না। কলেজ থেকে টাকা চাইলো। তোমার বাবা টাকা না দিয়ে দূর দূর করে তাড়িয়ে দিলো।’

‘বিয়ের পর তোর খরচ বাবা কেনো দিবে? তোর জামাই নাই? জামাইয়ের কাছ থেকে নিবি।’

‘আর জামাই! সবাই কি তোমার জামাইয়ের মতো হয় নাকি? বিয়ের আসর থেকে পালিয়ে নিয়ে যাওয়ার মত এতোটা প্রেমে বোধহয় মজাতে পারিনি। তাই আগেপিছে ঘুরে না।’

‘কীসব বাজে কথা বলছিস! কথাবার্তার ধরন এমন হয়েছে কেনে তোর?’

‘খারাপ হয়েছে? ঐ তো তুমি মাঝপথে ছেড়ে গেলে স্বার্থপরের মতো, তারপর থেকে সব এলোমেলো হয়ে গেলো। হুট করে হাত ছুটে গেলে একলা কীভাবে হাটতে হয় সেটা শিখিয়ে যাওনি। সবসময় বিপদ থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছো, বিপদ কেমন হয় সেটা আমি জানতেই পারিনি। তাই এখন সামলে উঠতে পারছি না। তুই এখন যে বড় খবরদারি করছো, এতোদিন কোথায় ছিল তোমার দায়িত্ববোধ? আজ হঠাৎ বিবেকবোধ জাগ্রত হলো কেনো?’

‘বড্ড বেয়াদব হয়ে গিয়েছিস তুই।’

আদ্রতার নরম সুরে আদ্রিকার বেশ রাগ হলোম এদিকে তার জীবন ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে, অথচ আদ্রতা ওকে এখনো বাচ্চাদের মতো আদুরে স্বরে বুঝাচ্ছে কেনো? সে কর্কশ কণ্ঠে চিৎকার করে উঠল,

‘হলে হয়েছি। তাতে তোমার কি? তুমি কখনো আমার কথা ভাবোনি। আজ ভাবার নাটক করে না।’

‘চিৎকার করছিস কেনো তুই! এতোদিন প্রয়োজন হয়নি তাই যোগাযোগ করিনি।’

‘আমার কাছে কীসের প্রয়োজন তোমার?’

‘ফরমফিলাপের লাস্ট ডেট কালকে না? আমি কারো হাতে টাকা পাঠিয়ে দিবো। তুই গিয়ে বাকি প্রসিডিওর কমপ্লিট করবি।’

‘খবরদার তুমি টাকা পাঠাবে না। দয়া দেখাতে এসেছো আমাকে? লাগবে না তোমাদের দয়া। আর কখনও আমাকে কল দিবে না তুমি।’

বিছানার উপর আছাড় মেরে মোবাইলটি ফেলে দিয়ে মাথা তুলতেই দেখল, দরজায় পরখ দাঁড়িয়ে আছে। ওর চিৎকার শুনে পাশের কক্ষ থেকে ছুটে এসেছে সে। আদ্রিকা এখনো কাপছে। পরখকে দেখে আরও রেগে গিয়ে আক্রোশ নিয়ে চিৎকার করে বলল,

‘সবার দয়ার পাত্রী হয়ে গেছি আমি। কেউ দয়া দেখিয়ে থাকতে দিচ্ছে, কেউ জ্ঞান দিচ্ছে। আপনারা সবাই স্বার্থপর। নিজের সুখের জন্য অন্যকে কষ্ট দেন। হিপোক্রেট কোথাকার!’

অস্থির হাতে মাথার চুল খামচে ধরেছেআদ্রিকা। ওকে দেখাচ্ছে অপ্রকৃতস্থের মতো৷ বাবার সাথে খুব ভালো সম্পর্ক না থাকলেও আদ্রিকা ওর বাবাকে ভীষণ ভালোবাসত। তার থেকে আজ যে আচরণ পেয়েছে, তাতে সে প্রকৃত পক্ষেই আঘাত পেয়েছে। যেটুকু নিয়ন্ত্রণ নিজের উপর ছিল তা লোপ পেলো আদ্রতার ফোন কলে। মানসিক আঘাত সহ্য করার সমস্ত ধাপ সে পেরিয়ে এসেছে।

এই অভাগী মেয়েটির প্রতি পরখের ভীষণ মায়া হলো। সে এগিয়ে গিয়ে আদ্রিকার বিছানার পাশে পা ঝুলিয়ে বসে ওকে জোর করে শুইয়ে দিল। পাতলা কাথাটি খুলে আদ্রিকার গায়ে চাপিয়ে দিয়ে এলোমেলো চুলগুলোতে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,

‘অনেক রাত হয়েছে ঘুমাও।’

আদ্রিকা শান্ত হয়েছে। ভীষণ হাপাচ্ছে সে। ধীরে ধীরে শ্বাস নিয়ন্ত্রণে এলো। করুণ দৃষ্টি মেলে কিছুক্ষণ পরখের মুখমন্ডলে কিছু একটা খুঁজল। হয়তো পরখের দৃষ্টিতেও দয়া খুঁজে পেতে চাইল। কিন্তু তেমন কিছু পেল না। অনুভূতিহীন রুক্ষ চেহারা। আদ্রিকার দু চোখের কোন বেয়ে দু ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পরে কান ভিজিয়ে দিল। বিড়ম্বনা এড়াতে সে চোখ বন্ধ করে নিল।

পরখ আরও কিছুক্ষণ বসে থেকে ওর চুলে হাত বুলিয়ে দিয়ে যখন নিশ্চিত হলো আদ্রিকা ঘুমিয়েছে তখন সে নিজের কক্ষে ফিরে গিয়ে ঘুমিয়ে পরল।

_______

গভীর রাত৷ দোতলা ভবনের ছাদ জুড়ে জ্যোৎস্নার উজ্জ্বল আলো। আকাশে বিশাল একখানা চাঁদ। ছাদের একপাশে কিছু গাছে দু একটা ফুল ফুটেছে। মৃদু ঘ্রাণ বাতাসে। ছাদের ঠিক মাঝখানে মেঝেতে বসে আছে আদ্রিকা। ওর পরনে পাকা লেবু রঙয়ের শাড়িটা মলিন। আঁচল ছড়িয়ে আছে সিমেন্টের মেঝেতে। খোঁপা নেতিয়ে পরেছে ঘাড়ের উপর। সে মাথা নিচু করে অনেকক্ষণ ধরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে।

রাতের নিস্তব্ধ প্রকৃতিতে সেই কান্না ভীষণ গা ছমছমে আবহ সৃষ্টি করল। অপ্রাকৃত কিছুর আভাস বাতাসে। সুর ধরে মিহি কণ্ঠে করুণ কান্না। ঘুমের মাঝে পরখের কেমন গা শিউরে উঠল। হালকা ঘুমটা ধীরে ধীরে উবে যাচ্ছে। মস্তিষ্কের ভেতরটা ফাঁকা। কিছুক্ষণ শুয়ে থেকে শব্দটির উৎস খোঁজার চেষ্টা করল। সময়ের সাথে ভীতিটা মনের ভেতর জেকে বসছে। পরখের সাথে আগে এমনটি হয়নি। সে নিজেকে সামান্য ধমক দিয়ে জোর করে বিছানা ছাড়ল। আদ্রিকার কক্ষের দ্বার বন্ধ। বসার ঘরে পিনপতন নীরবতা। ধীরে ধীরে স্পষ্ট হচ্ছে কান্নার শব্দ। সে পা টিপে টিপে খুব সাবধানে স্লাইডিং ডোর খুলে বাইরে এলো।

ছাদের ঠিক মাঝখানে নারী মূর্তি দেখে কয়েক সেকেন্ডের জন্য তার গায়ের সমস্ত লোম দাঁড়িয়ে গিয়েছে। চাঁদের আলোয় উজ্জ্বল ফর্সা ত্বক দ্যুতি ছড়াচ্ছে। সুরেলা কান্না, মোহনীয় রুপ, অনঢ় প্রতিমা এমন নিশীরাতে যে কারো বুক কেপে উঠবে। ধীরে ধীরে পরখের মতিভ্রম দশা কেটে গেল।

কয়েক পা এগিয়ে গিয়ে ধীর কণ্ঠে সাবধানে ডাক দিল,

‘আদ্রিকা?’

তৎক্ষণাৎ ঘাড় ফিরে চাইল আদ্রিকা। না চাইতেও ভয়ে এক কদম পিছিয়ে গেল পরখ। ছোটবেলায় দাদীর মুখে পিশাচিনী কম গল্প সে শুনেনি। এই মুহূর্তে আদ্রিকা যদি চট করে দাঁড়িয়ে পরখের ঘাড় মটকে দেয়, সে মোটেও অবাক হবে না।

কিন্তু সে তেমন কিছু করল না। বিরক্ত মাখা মুখে শুধু চেয়েই রইল। সাহস ফিরে পেল পরখ। ধমক দিয়ে বলল,

‘তুমি এখানে কি করছো? নিজের রুমে যাও।’

আদ্রিকা চুপচাপ উঠে দাঁড়াল। সে গটগট পায়ে নিজের কক্ষে প্রবেশ করায় পরখ হাফ ছেড়ে নিজের কক্ষে ফিরে এসে আবার ঘুমিয়ে পরল।

রাত তখন প্রায় তিনটে বাজে। ঘুমন্ত পরখের মনে হলো তার আশেপাশের বাতাস সামান্য ভারী হয়ে উঠেছে। মুখের উপর চাঁদের আলোয় কিছু বাঁধা পাওয়ায় ছায়ার সৃষ্টি হয়েছে। হালকা ঘুমের মাঝে সে স্পষ্ট অনুভব করতে পারছে। বেশ অস্বস্তি নিয়ে চোখ খুলে সামনে তাকাতেই মুখ ফুটে আপনা থেকেই আর্তনাদ বেরিয়ে এল।

ওর বিছানায়, ওর পাশে আসন পেতে বসে আছে আদ্রিকা। শুধু বসেই নেই। বড় বড় চোখে একদৃষ্টিতে তার দিকেই চেয়ে আছে। দু হাতে ভর দিয়ে পরখ সামান্য পিছিয়ে গিয়ে দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে বড় বড় শ্বাস নিল। হাত বাড়িয়ে বৈদ্যুতিক বাতি জ্বালিয়ে আলোকিত করল চারপাশ। পরখের শরীর তখনো সামান্য কাঁপছে। নিজেকে যতোটা সম্ভব নিয়ন্ত্রণ করে সে আদ্রিকাকে প্রশ্ন করল,

‘তুমি এখানে কি করছ? এমন ভূতনির মতো ঘুরছ কেন?’

জবাবে আদ্রিকা তাকে আরেকধাপ অবাক করে দিল। রান্নার কাজে ব্যবহার বড় ছু রিটি আদ্রিকার হাতে। চাঁদের আলোয় রুপার মতো চকচক করছে। সেটি চট করে পরখের গলায় ঠেকিয়ে ভারি কণ্ঠে বলল,

‘আরেকবার ডির্ভোসের তকমা গায়ে মাখা অসম্ভব। এর থেকে ভালো আপনাকে খু ন করে আমি জেলে চলে যাবো।’

পরখ বুঝল মস্তিষ্কের ভেতর বিভিন্ন চিন্তা ভাবনা আদ্রিকাকে অস্থির করে রেখেছে। সে নিজের নিয়ন্ত্রণে নেই। বর্তমানের অপ্রিয় পরিস্থিতি, অদূর ভবিষ্যতের ভীতি তাকে উন্মাদ করে তুলেছে। এমন চলতে থাকলে পুরোপুরি উন্মাদ হতে দেরী নেই৷

আদ্রিকা ওর দিকে অপলক চেয়ে আছে। চোখের কোনো ভাষা নেই। মুখে নেই অনুভূতি। যেনো পরখ সামান্য নড়চড় করলে সে সত্যিই পরখের গলায় ছু রি চালিয়ে দিবে।

পরখ দু হাত উঁচু করে আত্মসমর্পণ করে শান্ত গলায় বলল,

‘আচ্ছা ঠিক আছে। কোনো ডিভোর্স নয়। তুমি এটা সরাও। যেকোনো সময় কে টে যেতে পারে।’

আদ্রিকা ছু রি টি সরিয়ে নিয়ে চুপচাপ বসে রইল। পরখ দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজের পাশের বালিশে হাত রেখে আদ্রিকাকে ইশারা করে বলল,

‘এখানে শোও।’

আদ্রিকা একবার পরখের দিকে চাইল। আরেকবার বালিশের দিকে। তারপর ওপাশে সরে গিয়ে চুপচাপ বালিশে মাথা দিয়ে শুয়ে পরল।
পরখ খুব সাবধানে ছু রিটি তুলে নিয়ে টেবিলের উপর রেখে আলো নিভিয়ে দিয়ে নিজেও শুয়ে পরল।

ও ভেবেছিল আদ্রিকা ঘুমিয়ে যাবে। কিন্তু আদ্রিকা ঘুমালো না। পরখের দিকে এগিয়ে এসে ওর গলা জড়িয়ে ধরে ঠোঁটে চুমু দিল।
আদ্রিকার গায়ে শাড়ি এলোমেলো। উন্মুক্ত ত্বকের সাথে পরখের গায়ের ছোঁয়া লাগা মাত্র সে শিউরে উঠল। পরখ নিজেকে কঠোর নিয়ন্ত্রণে রেখে আদ্রিকাকে বলল,

‘অনেক রাত হয়েছে। ঘুমাও।’

সে কথা আদ্রিকা শুনল না। পরখের গ্রীবাদেশে নাসিকার ডগা ঘষতে শুরু করল।

‘আমাকে একটু ভালোবাসুন। একটুখানি প্লিজ। আমাকে কেউ ভালোবাসে না।’

নিজ পতন ঠেকাতে কিছু আকড়ে ধরা জরুরি৷ পরখ তাই খুঁজল। কিন্তু পরখের হাত আশ্রয় নিতে ভুল করে জড়িয়ে ধরল আদ্রিকার উন্মুক্ত কটিবন্ধ। আদ্রিকা খুব কাছে এলে পরখের নিজের উপর থেকে নিয়ন্ত্রণ ছুটে যায়৷ দেহের ভেতর অদ্ভুত বেপরোয়া কম্পন ছড়িয়ে পরো দ্রুত। বেসামাল করে তুলে তাকে। পরখ খেয়াল করেছে এমনটা তার সাথে আগে কখনো ঘটেনি। শুধুমাত্র আদ্রিকার দেহে এমন কিছু আছে যা তার মস্তিষ্কে অবশ্যম্ভাবী ঢেউ তৈরি করতে পারে। তাই সে যথাসম্ভব চেষ্টা করে আদ্রিকাকে এড়িয়ে চলার। একই বিছানায় ঘনিষ্ঠভাবে অবস্থানের চিন্তা করার আগেও সে কয়েক শতবার ভাবে। কিন্তু কোনো না কোনোভাবে বিধাতা তাকে এই মেয়েটির সাথে জুড়েই দিচ্ছে।

পরখ কোনোভাবেই বিয়ের নামে আদ্রিকাকে ভোগ করতে রাজি নয়। এ কথা ভেবেই সে লজ্জায় কুকড়ে যায়। তাই তো সেদিন আদ্রিকাকে নিজের অপারগতার কথা জানিয়েছে। যাতে কখনো ওর পা ফসকে গেলেও আদ্রিকা যেনো নিজেকে রক্ষা করে। কারন পরখ জানে, সে কিছুতেই নিজের সাথে, স্বপ্নের সাথে সমঝোতা করে আদ্রিকাকে সঙ্গী করতে পারবে না। কিন্তু সব জেনেও এই মেয়ে বারবার নিজেকে উজাড় করে দিতে ছুটে আসে পরখের কাছে।

হাজার চেষ্টা করে শেষ মুহূর্তে পরখ ঠিকই হেরে যায়। আজও গেল। কেউ নিজে থেকে নিঃস্ব হতে চাইলে পরখের সেখানে কী করার আছে! সে যে নিজেই নিজেকে রুখতে বরাবর অক্ষম, অপরাগ।

চলবে…
#অক্ষরময়ী