#পরিণয়ে_নোলককন্যা (কপি নিষেধ)
|২৯|
গতরাত না ঘুমিয়ে নিজের উপর অযাচিত অত্যাচারের ফলস্বরূপ অনেক বেলা অব্দি ঘুমিয়েছে আদ্রিকা। আশানুরূপভাবে দেখা মেলেনি পরখের। কোন ঘোড়ার ডিমের কাজে ব্যস্ত আছে কে জানে! আজকাল দুপুরবেলা খেতেও আসে না৷ আদ্রিকার মনে হয়, সে কোনো ভূতের সাথে সংসার করছে। আহা রে! তার সংসার করার কতো শখ ছিল! সেই শখ তাকে প্রতিদিন নাকানিচুবানি খাচ্ছে৷
কিন্তু আদ্রিকা মন খারাপ করলো না৷ সে আজকাল অনেক মোটিভেশনাল স্পিস শুনছে৷ সেসব আরেকবার মনে করে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেলো নিজের কাজে। কিন্তু নিজের মতো করে সুখে থাকতে চাইলে এই জগত সংসার তা মেনে নিবে কেনো? কেউ সুখে থাকতে চাইলে, তাকে খোঁচা দেওয়া এ সমাজের প্রধান দায়িত্ব।
ক্যাটক্যাট শব্দ করে বেজে উঠল মোবাইলটি। বিরক্ত হলো আদ্রিকা। আজকেই এই মোবাইলটিকে সে ভ্যাইব্রেট মুডে রেখে দিবে। যার জন্য এই মোবাইল ব্যবহার করা সে মহাশয় কখনো ভুল করেও একটি কল দেয় না। তবে সে কেনো এই মোবাইলটি ব্যবহার করবে?
শাড়ির আঁচলে হাত মুছে মোবাইলটি হাতে তুলে নিল। নীহারের কল দেখে এবার মেজাজটাই বিগড়ে গেল৷ একজন অপমান করে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেয়, আরেকজন মমতার আঁচলে আষ্টেপৃষ্টে বেঁধে রাখে৷ জগতে প্রতিটি মানুষ বোধহয় পিতা-মাতার মমতা এবং অবহেলার মধ্যকার একটি বন্ধনে আবদ্ধ থাকে। পরিবারের মায়া প্রকৃতপক্ষে কেউ পুরোপুরি ত্যাগ করতে পারে না৷ নিজ পরিবারের অন্তত একজন সদস্য তাকে মায়ার বাঁধনে বেঁধে রাখে৷ আদ্রিকার ক্ষেত্রে সেই বন্ধনটি তার মা। তাই মেজাজ খারাপ হলেও কলটি সে রিসিভ করল।
‘কি হয়েছে? বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়ে এখন আবার কেনো কল দিয়েছো?’
‘রাগ করেছিস মা?’
নীহারের গলার স্বরে আজ অপরিসীম নমনীয়তা। মেয়ের বিয়ে হয়ে গেলে মায়েরা একটু বুঝেশুনে তাদের সাথে কথাবার্তা বলে।
কিন্তু আদ্রিকা দ্বিগুণ তেজ দেখিয়ে বলল,
‘নাহ, রাগ করবো কেন? রাগ করার মতো কোনো ঘটনা তোমরা ঘটেছে কি?’
‘তোর বাপের তো মাথার ঠিক নাই৷ কখন, কেমন ব্যবহার করার দরকার সেটা সে আজ পর্যন্ত শিখল না। জীবনে শিখবেও না। শেখার আর বয়সও নাই। দু’দিন পর আল্লাহ ডাক দিবে। এখন আর দিন দুনিয়ার রীতিনীতি শেখার বয়স আছে!’
‘তোমাদের জানাশোনা কম থাকলেও সমস্যা নাই। কিন্তু বাচ্চাদের জানাশোনায় একটুখানি কমতি থাকলে, কাজে একটুখানি ভুল হলে সেটা মাফ করা যাবে না। মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যায় তখন।’
‘মানতেছি তোর বাপ ভুল করছে। বয়স্ক মানুষ সে। এতো কিছু মনে রাখতে নাই মা। তুই এসে টাকাটা নিয়া যা।’
‘তোমার ওই বাড়িতে আমি আবার যাবো! অসম্ভব। পরখের সামনে তোমরা আমাকে কী অপমানটা করছো, সেটা ভুলে গেছো? টাকা দিবে না, বলছিল না? এখন আবার টাকা কই থেকে আসলো?’
‘রাগের মাথায় বলছে তখন। মানুষটার মাথায় কতো যে চিন্তাভাবনা ঘুরে! সেই খবর কেউ রাখিস না৷ তোর চাচা জমিজমা নিয়া ঝামেলা করতেছে। সেই নিয়ে মানুষটা আছে নানান দুশ্চিন্তায়। এই বয়সে কী এসব ঝামেলা ভালো লাগে! এখন বয়স হইছে, ঘরে বসে বিশ্রাম নিবে, নামাজ কালাম পড়বে। তা না করে এই বয়সেও ব্যবসা সামলাতে হচ্ছে। মন মেজাজ কি ভালো থাকে বল? তার একটা ছেলেও নাই যে এই বয়সে এসে ব্যবসার হাল ধরবে, সংসারের খরচ চালাবে৷ ভাইজানের দুই ছেলে ইনকাম করতেছে। উনি এখন সব কাজকর্ম ছেলেদের উপর ছেড়ে দিয়ে বিশ্রাম করেতেছে। আর তোর বাপ এখনো আড়তে যায়, নার্সারির কাজ করে। কেন মন মেজাজ খারাপ হবে না, বল?’
‘তো সেই দায় আমার? তার মেজাজ খারাপ আমারে কেন দেখাবে? ছেলে নাই, সেটা আমাদের দোষ?’
‘তোদের দোষ হবে কেন! আমিই তারে একটা ছেলে দিতে পারি নাই। একটা ছেলে থাকলে শেষ বয়সে এসে ছেলের শক্ত কাঁধে সংসারের হাল ছেড়ে দিতে পারতাম।’
‘যা নাই, তা নিয়া আফসোস করে লাভ নাই। আল্লাহ যা দিছে তাই নিয়া সন্তুষ্ট থাকো। আর শোনো, আল্লাহ যা করে ভালোর জন্য করে৷ তোমার ঘরে আজকে একটা বড় ছেলে থাকলে তার সাথে তোমার জামাইয়ের প্রতিদিন ঝামেলা লাগত। তোমার জামাইয়ের যা আচরণ, যা বাজে ব্যবহার! আমরা মেয়ে বলে সহ্য করতেছি। ছেলে হইলে একটা কটু কথা সে সহ্য করত না। হয় সে নিজে ওই বাড়ি থেকে বাইর হয়ে যাইত। না হলে তোমাদের বাইর করে দিতো। বুঝছ? আল্লাহ তোমার ভালোর জন্যেই তোমাকে ছেলে দেয় নাই।’
‘ছেলে না থাকলে নাই। তা নিয়া আমাদের ওতো আফসোসও নাই। আমার মেয়ে দুইটা কম কীসে! তোর বাপ তোদের অনেক ভালোবাসে। খালি মুখে স্বীকার করে না, এই যা৷ আজকে সকালে ঘর থেকে বের হওয়ার সময় বিছানার উপর দশ হাজার টাকা বাইর করে রাখছে। যাওয়ার সময় আমাকে বলে গেছে, নীহার, ঘরে টাকা রাখছি। তোমার মেয়ের কাছে পাঠায় দিও।
তুই যখন চাইছিস তখন মনে হয় হাতে টাকা ছিলো না। এজন্য ওমন রাগ দেখাইছে৷’
‘এখন টাকা কই থেকে আসলো?’
‘কারো কাছে ধার নিছে বোধহয়। সেই কথা আমাকে বলবে না৷ পুরুষ মানুষ ধার-দেনার কথা বলতে লজ্জা পায়।’
‘যার কাছে টাকা নিছে, তারে ফেরত দিতে কইয়ো। আমার লাগবে না।’
‘কেন লাগবে না? আজকে লাস্ট ডেট না?’
‘হ্যাঁ। কিন্তু আমি পরীক্ষা দিবো না৷’
‘কেন দিবি না?’
‘কারন পরীক্ষার ফি দেওয়ার মতো আর্থিক অবস্থা আমার নাই। যখন হবে, তখন দিবো।’
এ যাত্রায় নীহারের নরম স্বর কোথাও হারিয়ে গেলো। জোরালো ধমক দিলো মেয়েকে।
‘ফাজলামি কথাবার্তা! তাড়াতাড়ি এসে টাকা নিয়ে গিয়ে কলেজে জমা দিয়ে আয়।’
‘আমি পরীক্ষা দিবো না। এটাই ফাইনাল। আমারে এখন আর তুমি ধমকাবা না। আমি তোমার বাড়িতে থাকি না। জামাইয়ের বাড়িতে থাকি। তার ধমক খাই। দুই বাড়ির ধমক নিতে পারবো না। ফোন রাখো। আমার অনেক কাজ পরে আছে।’
মোবাইলের ওপাশে নীহার তখনো চিল্লিয়ে কিছু একটা বলছিল তা উপেক্ষা করে আদ্রিকা কল কেটে দিল। লেখাপড়া ব্যাপারটাই মস্ত ঝামেলার। কষ্ট করে পড়াশোনা করো, আবার টাকা দিয়ে পরীক্ষা দেও। সে টাকার জন্য কথাও শোনো। কী দরকার এতো ঝামেলার করার! এর থেকে ভালো সে এক হাড়ির জায়গায় দু হাড়ি ভাত রান্না করে ফেলবে।
দুপুরবেলা পরখ আসবে না সেটা জানা আছে। তাই দুপুরের রান্নায় বিশেষ কিছু আয়োজন করা হলো না। তেলে পেয়াজ, মরিচ কুচি ভেজে নিয়ে তাতে ডিম ভেঙে দিয়ে ঝুড়ি করে নেওয়া হলো৷ গত রাতের বেঁচে যাওয়া ভাত দিয়ে সামান্য হলুদ, লবণ দিয়ে নাড়াচাড়া করে সামান্য ধনেপাতা কুচি ছিটিয়ে দিয়ে নামিয়ে নিল। ফ্রিজে পাবদা মাছের ঝোল ছিল, সেটা আর গরম করল না৷ ঠান্ডা হয়ে জমে থাকা মাছের ঝোলের সাথে গরম গরম ধোঁয়া উঠা ভাত খেতে বসেছে আদ্রিকা। তখনি ভোঁ ভোঁ শব্দ করে বেজে উঠল মোবাইলটি।
নীহার যদি আবার কল দিয়ে থাকে, তাহলে আদ্রিকা এবার বড্ড মেজাজ দেখাবে। এই প্রতিজ্ঞা করে সে খাবার টেবিল থেকে উঠে গিয়ে সোফার উপর থেকে মোবাইলটি হাতে তুলে নিল। নাম্বারটি অপরিচিত হলেও খানিকটা চেনা। গতকাল আদ্রতা এই নাম্বার থেকে কল দিয়েছিল৷
কল রিসিভ হতেই আদ্রতা কোনোরকম সম্ভাষণ ছাড়া হড়বড়িয়ে বলল,
‘ফরমফিলাপের টাকা কোথায় পেলি? আব্বুর থেকে নিয়েছিস আবার?’
প্রশ্নটি বুঝতে আদ্রিকার কিছুক্ষণ সময় লাগল৷ সে কখন তার বাবার থেকে টাকা নিল? সকালবেলা এই নিয়ে মায়ের সাথে একদফা চোটপাট হয়ে গেছে৷ এখন আবার একই আলোচনা! সে হতভম্ব হয়ে রইল কিছুপল। নাক মুখ কুচকে বলল,
‘আমি কারো থেকে টাকা নেই নাই, ফরমফিলাপও করি নাই। কোনো পরীক্ষা-টরিক্ষাও দিতাম না৷ তোমরা আমারে বিরক্ত করা বন্ধ করো। শান্তিমতো একটু খাইতেও দিবে না এরা৷ উফ!’
আজন্ম চেনা বোনটির মুখে এমন কথাবার্তা শুনে অবাকের সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছে গেল আদ্রতা৷ সবিস্ময়ে বলল,
‘এভাবে কথা বলতেছিস কেনো? কোথায় শিখেছিস এমন আচরণ? আদব কায়দা সব ভুলে গিয়েছিস নাকি? তোর হাসবেন্ডের সাথে এভাবে কথা বলিস তুই?’
‘আমার কথাবার্তা যথেষ্ট শালীন। জামাইয়ের কথা আরও জঘন্য। তার সাথে থাকতে থাকতে আমিও শিখতেছি। কথায় আছে না, সঙ্গ দোষে লোহা ভাসে? আমার হয়েছে সেই দশা।’
ইদানীং আদ্রিকার কথাবার্তা অর্ধেকগুলোই আদ্রতা বুঝতে পারে না। সামান্য দুরত্ব তাদের মাঝে বিস্তর দেয়াল দাঁড় করিয়ে দিয়েছে৷ সে বিড়বিড় করে বলল,
‘কোন ঘরে তোর বিয়ে দিয়েছে আল্লাহই জানে! যাক সেসব কথা। শোন, তোর ভাইয়ার এক বন্ধুকে পাঠিয়েছিলাম তোর ফরমফিলাপ করতে৷ সে বলল তোর ফরমফিলাপের টাকা নাকি সকালেই জমা দেওয়া হয়েছে৷ তুই না দিলে কে দিল? তোর হাসবেন্ড দিয়েছে?’
দৃঢ় আত্মবিশ্বাসের সহিত তাচ্ছিল্য ভরে জবাব দিল আদ্রিকা,
‘আমার জামাই! সে দুন্নিয়ার কিপ্টা। শুনো, আমি তোমাকে আগেই বলে দিচ্ছি। জীবনেও কখনো শিক্ষকের সাথে মেয়ের বিয়ে দিবা না৷ এরা খুবই কিপটা আর গোমড়ামুখো স্বভাবের হয়। বাইরে সারাদিন স্টুডেন্ট এর সাথে কথা বলে, হাহা হিহি করে নিজের সমস্ত এনার্জি শেষ করে দিয়ে বাড়ি ফিরে বউয়ের সামনে আসে চুপসানো বেলুন হয়ে। ভেতরে কোনো হাওয়া বাতাস নাই৷ সব বাইরে দান করে আসে৷ নতুন করে হাওয়া বাতাস ভরে পরের দিন আবার কাজে যাওয়ার জন্য এদের তখন বিশ্রামের দরকার হয়। এইসময় বউ এসে যাই বলুক, এরা ছ্যাঁত করে উঠে। কারন এদের ভেতরটা তখন শুষ্ক মরুভূমি। নিস্তব্ধতা দরকার, প্রশান্তি দরকার, ঘুম দরকার। কিন্তু বউয়ের দরকার নাই। এমন মানুষকে বিয়ে করে জীবনটা নষ্ট করার কোনো মানে আছে? এর থেকে রাস্তার ফকিরকে বিয়ে করা ভালো।’
আদ্রিকার কথা শুনে হতভম্ব আদ্রতা হতাশ চোখে তাকাল বিকল্পের দিকে। ও বেচারা অনেক আগ্রহ নিয়ে বউয়ের দিকে তাকিয়ে আছে। একমাত্র শ্যালিকার ফরমফিলাপের টাকাটি সে নিজের জমানো অর্থ থেকে দিয়েছে। আদ্রতা অবশ্য প্রথমে নিতে রাজি হয়নি। অনেক অনুরোধ করার পর রাজি হলেও দ্বিধা ভরা কণ্ঠে জানতে চেয়েছিল,
‘তোমার খুব চাপ হয়ে যাবে না? সত্যি তোমার কাছে টাকা আছে? কারো কাছে ধার নিয়ে থাকলে আমাকে বলো। লুকিও না।’
বিকল্প সত্যি কথাই বলেছে। সে ধার নেয়নি। তার জমানো টাকা থেকে আদ্রিকার ফরমফিলাপের টাকাটি সে দিয়েছে। ওর নিজের আত্মীয় বলতে কেউ নেই। স্ত্রীর বোনকে নিজের বোন ভেবে নিয়েছে। ওর পরিবারকে মেনেছে নিজের পরিবার। নিজ পরিবারের জন্য অর্থ ব্যয় করতে পেরে ওর ভালোই লাগছে৷ মা বেঁচে থাকতে তার পেছনে খুব বেশি ব্যয় করতে পারেনি৷ তখন আয় ছিল সামান্য। তবুও সে সাধ্যমতো যথেষ্ট চেষ্টা করেছে। এখন আবারও সুযোগ মিলেছে পরিবারের জন্য কিছু করার। খুশিমনে তা সেই দায়িত্ব পালন করতে ব্যস্ত হয়ে পরেছে সে।
বিকল্প ইশারায় জানতে চাইল, কি হয়েছে?
দু কাঁধ নাচিয়ে আদ্রতা জবাব দিল, সে বুঝতে পারছে না।
তবে আদ্রিকার কথা মাঝে বাঁধা দিল না। অভিমানী বোনটি তার কাছে নালিশ জানাতে ভালোবাসে সেটা সে জানে। যেকোনো মন খারাপের কথা আদ্রতাকে বলার সাথেই আদ্রিকার মন ভালো হয়ে যায়। তাই আদ্রতা তাকে অভিযোগ জানানোর সুযোগ দিল। এতে আদ্রিকার মন হালকা হয়ে যাবে।
‘আচ্ছা ঠিক আছে। আমার মেয়ে হলে তার জামাই খুঁজে দেওয়ার দায়িত্ব তোকে দিব।’
আদ্রিকার হঠাৎ মনে পরায় সে অতল গহ্বর থেকে বাস্তবতায় ফিরে এসে কণ্ঠে তীব্র ঝাঁঝ নিয়ে শুধাল,
‘দুলাভাইয়ের বন্ধুকে দিয়ে ফরমফিলাপ করাতে পাঠিয়েছ! তার মানে তুমি সত্যি ছেলের সাথে পালিয়েছ? ও মাই গড!’
অন্য কেউ এভাবে বললে আদ্রতা বোধহয় কষ্ট পেতো। কিন্তু আদ্রিকার শিশুসুলভ আচরণ এবং কোমল কণ্ঠ শুনে আদ্রতার ভীষণ হাসি পেল। সে খিলখিল করে হেসে বলল,
‘হ্যাঁ। ছেলের সাথে পালিয়েছি এবং বিয়ে করে এখন সুখের সংসার করছি।’
‘বাহ! চমৎকার। সবাই সবার জীবনে সুখে আছে। শুধু আমি ঠোকর খাচ্ছি।’
‘কেনো রে? মা যে বলল, অনেক ভালো ঘরে তোর বিয়ে হয়েছে!’
‘ঘর ভালো হলে কি হবে? বর ভালো হতে হবে না?’
‘কি করেছে সে? অত্যাচার করলে বল, নারী নি/র্যাতনের মা/মলায় একদম জে/লে পু/ড়ে দিব।’
‘থাক, এখন এতো আদিখ্যেতা দেখাতে হবে না। আমাকে রেখে চলে যাওয়ার সময় ভাবোনি, এখন ভেবে কী লাভ!’
‘তখন সিচুয়েশন সেরকম ছিল না। তবে তোকে আমি কখনো একা ছেড়ে দেইনি। এখন কি সমস্যা হচ্ছে আমাকে বল। ভুলে যাস না, আমি সবসময় তোর সাথে আছি।’
‘এই সাথে থেকেই তো কাল হয়েছে। ভালো ঘরে বিয়ে দিয়েছে, অথচ আমাকে ঘর সামলাতে শেখায়নি। রাঁধতে পারি, ঘর গোছাতে পারি না, কাপড় ধুতে পারি না, বাজারসদাই কিনতে পারি না। কিছুই পারি না আমি। এমন আমড়া কাঠের ঢেঁকিকে লোকে বকবে না?’
‘কেনো বকবে? তুই পারিস না, তোকে শিখিয়ে দিবে। সবাইকে সব জানতে হবে এমন কোনো বাধ্য বাধকতা নেই। এই জগতে কেউ কিছু শিখে আসেনি। নিজ প্রয়োজনে সবাই শিখে নিয়েছে৷ তুইও ধীরে ধীরে শিখে নিবি। অবশ্য আমাদেরও ভুল আছে। সবসময় আগলে রাখতে গিয়ে তোকে কিছু শেখার সুযোগ দেইনি। কিন্তু এখনো সময় শেষ হয়ে যায়নি। প্রয়োজন অনুযায়ী শিখে নে। প্রথমবার ভুল হবে, এটাই স্বাভাবিক। বরং ভুল না হওয়াটাই অস্বাভাবিক। আমি যেদিন প্রথমবার ভাত রেঁধেছিলাম, সেটা খাওয়ার অযোগ্য হয়েছিল। অতিরিক্ত সেদ্ধ হয়ে ভাত গলে গিয়েছিল। ধীরে ধীরে আমিও শিখে গিয়েছি। বেশ কয়েকবার ভুল করেছি, ঠকে গিয়েছি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত শিখেছি। তুইও পারবি।
ভুলগুলো নিয়ে আফসোস করবি না৷ সবসময় মনে রাখবি, জগতে কোনো কিছুই অসম্ভব নয়। ব্যর্থতার গল্প কেউ শুনতে চায় না। তাই ব্যর্থতা নিয়ে আফসোস করতে বসবি না।
ভবিষ্যতে কি হবে আমাদের জানা নেই। তাই বর্তমান জীবনকে পুরোপুরি উপভোগ করতে হয়। অনিশ্চিত ভবিষ্যতের চিন্তা করে কী লাভ! যা হবে দেখা যাবে। আমরা বড়জোর ভবিষ্যতের জন্য কিছু পরিকল্পনা করে রাখতে পারি। এর বেশি কিছু না। জীবন যেভাবে যাচ্ছে চলতে দে। হতাশ হবি না। সবসময় নিজেকে বলবি, আমি খুব ভালো আছি, সুখে আছি। দেখবি এই বিশ্বাসটাই তোকে একদিন সত্যি সুখী করবে৷’
প্রায় ঠান্ডা হয়ে যাওয়া ভাত মেখে মাখতে মাখতে আদ্রিকা কেমন উদাশ গলায় বলল,
‘তুমি আমার সাথে থাকলে খুব ভালো হতো। আজকাল আমার কেমন হতাশ লাগে! সারাক্ষণ কান্না পায়। বড্ড একা হয়ে গেছি।’
এবেলা আদ্রতার সত্যি খুব চিন্তা হতে লাগল। মন সন্দেহের দানা বেঁধে যাচ্ছে। সে প্রশ্ন করল,
‘ওখানে তোর খুব সমস্যা হচ্ছে? শ্বশুরবাড়ির লোকজন ভালো নয়?’
‘সবাই অনেক ভালো। সেসব নিয়ে কোনো সমস্যা নেই। আমাকে নিয়ে আমার যতো সমস্যা। আমি মানিয়ে নিতে পারতেছি না। আসলে আমি কিছুই পারি না। অকর্মা, নির্বোধ, লবডঙ্কা।’
‘তুই যদি নিজের প্রতি বিশ্বাস হারিয়ে ফেলিস, তবে কারো পক্ষে তোকে সাহায্য করা সম্ভব না। আগে নিজের প্রতি বিশ্বাস ঠিক রাখতে হবে। সবসময় নিজেকে ভরসা দিবি, আমি পারবো। চাইলেই পারবো। দেখবি সত্যি, কঠিন কাজে সহজে উতরে গেছিস।’
প্রায় আধাঘন্টা ধরে দুজনের কথা হলো। কিন্তু কেনো যেনো একবারও পরখের নামে নালিশ করতে ইচ্ছে হলো না আদ্রিকার। পরখের কটু কথা, মানসিক অত্যাচার, অপমানজনক কার্যক্রম এসব ব্যাপার চাইলেই আদ্রতাকে বলা যায়। কিন্তু আদ্রিকা বলল না। কেনো যেনো মন সায় দিল না।
পরখ বাড়ি ফিরল একেবারে রাতের বেলা। ঘেমে-নেয়ে একাকার শরীর। সকালের পরিপাটি চুল উসকোখুসকো। গায়ের শার্ট কুচকে আছে। দেখেই বুঝা যাচ্ছে সারাদিন যথেষ্ট পরিশ্রম করেছে৷ যা শুধুমাত্র ক্লাস নেওয়ার কারনে হওয়ার কথা নয়৷ আদ্রিকা ভেবে পেল না, পরখ এমন কি কাজ করছে যেখানে এতোটা পরিশ্রম করতে হয়। রান্নার ফাঁকে সে ঘাড় বাঁকিয়ে বারবার পরখকে দেখলেও সামনাসামনি কিছু বলল না। পরখের শুকনো মুখ দেখে ওর ভীষণ মায়া হচ্ছিল। তাই ইচ্ছে করেও দূরে অবস্থান করল।
তবে খেতে বসে পরখ নিজেই খানিকটা বিব্রতবোধ করল। খাবারে আজ এলাহি আয়োজন। বিরিয়ানি, রোস্ট, গলদা চিংড়ি ভুনা, কাবাব, চাটনি, সালাত। শেষ পাতের জন্য রাখা আছে ছানার পায়েশ। মুখে কিছু না বলেও আদ্রিকার কর্মকাণ্ডে গতরাতের কথা মনে পরে গেল পরখের।
পরখ খেয়াল করেছে, যখনি আদ্রিকা তার কাছে আসে, বিশেষ সান্নিধ্য পায় তখনি সে রান্নায় বিশেষ পদের আয়োজন করে। বিষয়টি লক্ষ্য করার পর পরখ ঠিকঠাক খেতে পারল না। মনে হচ্ছে, খাবারের আড়ালে আদ্রিকা ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসছে৷
পরপর তিনটি ক্লাস নিয়ে রেস্তোরাঁ তৈরির কাজের দেখাশোনার পর এমনিতেই শরীর বেশ ক্লান্ত। সামান্য একটু খেয়ে পরখ সোজা চলে গেল নিজের কক্ষে। ভাগ্যিস আগামীকাল শুক্রবার। এই শরীরে আগামীকালকের জন্য লেকচার তৈরি করা পরখের পক্ষে সম্ভব ছিল না। সে সোজা বিছানায় চলে গিয়ে হাত পা ছড়িয়ে শুয়ে পরল।
কিন্তু বরাবরের মতো তার শান্তি আদ্রিকার পছন্দ হলো না। সে দরজায় উঁকি দিয়ে ডাকল,
‘পরখ, ঘুমাচ্ছেন?’
‘নাহ, জেগে জেগে স্বপ্ন দেখছি।’
চোখ বন্ধ করে জবাব দিল পরখ। বিপরীতে আদ্রিকা ভেংচি কাটল। জবাব না পেয়ে পরখ চোখ খুলে তাকিয়ে দেখল আদ্রিকা এখনো খোলা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে। সে হতাশ হয়ে জানতে চাইল,
‘কি চাই?’
বেশ ভাব নিয়ে জবাব দিল আদ্রিকা,
‘প্রতিদিন চাইতে আসব নাকি! এতো লোভ আমার নাই।’
পরখের ইচ্ছে করল মাথার নিচের বালিশটা ছুঁড়ে মারে ওই মাথা মোটা মেয়েটাকে। কিন্তু আপাতত সে অনেক ক্লান্ত। নীরবে আলোচনায় ইস্তেফা দিতে সে হাত বাড়িয়ে বাতি নিভিয়ে দিয়ে অন্যপাশে মুখ ঘুরে শুয়ে পরল।
গটগট করে পায়ে হেঁটে কক্ষে প্রবেশ করে আদ্রিকা আবারও বাতি জ্বালিয়ে দাঁড়িয়ে রইল পরখের মাথার পাশে। চোখে আলো পরায় পরখ বিরক্ত হয়ে পাশ ফিরে তাকিয়ে প্রশ্ন করল,
‘কি বলবে, তাড়াতাড়ি বলে বিদায় হও প্লিজ।’
নির্ভীক আদ্রিকা কোমরে দু হাত রেখে প্রশ্ন করল,
‘আপনি আমার ফরমফিলাপের টাকা জমা দিয়েছেন?’
‘হ্যাঁ দিয়েছি।’
‘কেনো দিয়েছেন? আমি চেয়েছি আপনার কাছে?’
‘হিসেব মতে আমার কাছেই তোমার চাওয়া উচিত ছিল। কিন্তু তুমি নির্বোধ এবং মাথামোটা। তাই তোমার বাবার কাছে চেয়েছ। নিজেও অপমানিত হয়েছ, আমাকেও করিয়েছো।’
‘কেনো আপনার কাছে চাইব? আপনি দিবেনই বা কেনো?’
‘স্ত্রীর ভরণপোষণসহ প্রয়োজনীয় যাবতীয় খরচ স্বামী হিসেবে আমারই দেওয়ার কথা, তাই।’
‘তার মানে আপনি মানছেন, আমি আপনার স্ত্রী?’
‘আমি কখনো অস্বীকার করিনি।’
‘আপনি কখনো স্বীকার করতেও চাননি।’
‘তাতে কিছু যায় আসে না। সত্যটি মিথ্যেও হয়ে যায় না।’
‘আপনি কি চাইছেন, তা আমি বুঝতে পারছি না৷’
‘তুমি নিজে কি চাও, সেটা বুঝত পারো? আমি তোমাকে বারণ করেছিলাম৷ সেদিন এতো করে বুঝিয়ে বললাম৷ তবুও গতরাতে তুমি কীভাবে এই কাজটি করলে?’
আদ্রিকার দুষ্টু হেসে কোমর থেকে হাত নামিয়ে পরখের মুখের উপর ঝুঁকে বলল,
‘কীভাবে করেছি আবারও দেখিয়ে দিবো?’
হতাশ পরখ দীর্ঘশ্বাস ফেলে শোয়া থেকে উঠে দেয়ালে হেলান দিয়ে বসল। মুখে গম্ভীরভাব ধরে রেখে আদ্রিকাকে বলল,
‘এখানে বসো। তোমার সাথে আমার জরুরি কথা বলা প্রয়োজন।’
আদ্রিকা দু পা পিছিয়ে গিয়ে বিরক্ত স্বরে বলল,
‘নাহ। আমি আপনার সাথে কোনো জরুরি কথা বলবো না। আপনার সাথে কথা বললে আমার মন খারাপ হয়ে যায়। আজকে আমার মনটা অনেক ভালো। যেচে খারাপ করতে চাইছি না৷’
হেয়ালি কথায় কান না দিয়ে পরখ ওর ডান হাতটি আলতো করে ধরে টেনে এনে বিছানার একপাশে মুখোমুখি বসিয়ে দিল। কোমল এবং ধীর স্বরে জানতে চাইল,
‘তুমি কি চাইছ আমাকে একটু বলবে?’
‘সংসার করতে চাইছি।’
‘সেটা আমার সাথে সম্ভব নয়, তোমাকে সেদিন বলেছি। খুব বেশি হলে আর চার, পাঁচ মাস আছি আমি এখানে। এরপর চলে যাবো।’
‘যেই কয়েকদিন আপনি আছেন, সেই কয়েকদিনই আমি সংসার করতে চাইছি৷ ভবিষ্যৎ নিয়ে আমি ভাবতে চাই না। কারন আমার ভবিষ্যৎ আপনার মতো উজ্জ্বল নয়৷ আমার ভবিষ্যৎ পুরোই অন্ধকার। সেটা নিয়ে ভাবতে বসলে, হতাশায় ডুবে যেতে হবে। তা আমি চাইছি না। এখান থেকে বের হয়ে গেলে আমার যাওয়ার কোনো জায়গা নেই। বাবার বাড়ির অবস্থা সেদিন আপনি নিজেই দেখলেন। ভবিষ্যতে কোনো জায়গা পাবো কিনা জানি না।
জীবন কোনো রূপকথার গল্প কিংবা সিনেমা নয়। চোখের পলকে মলিন শাড়ি বদলে স্যুট-বুট পরে কর্পোরেট ওম্যান হয়ে গেলাম। এমনটা সম্ভব নয়।
পড়াশোনা করতে বলছেন, ঠিক আছে করছি৷ কিন্তু এইচএসসি পাশ করে এই যুগে কিছুই হয় না সেটা আপনিও জানেন। আমার অবস্থানে দাঁড়িয়ে দেখেন,
আজ থেকে পাঁচ মাস পরে নিজেকে একই জায়গায় দেখতে পাবেন। হাতে কোনো টাকা নেই, মাথার উপর ছাদ নেই।
তাহলে এমন ভবিষ্যতের কথা ভেবে কেনো আমি বর্তমানকে হেলাফেলা করবো? আজকে যেভাবে আছি, সেভাবে বাঁচবো। আমার হাতে কিছু নেই, তাই সৃষ্টিকর্তার হাতে ছেড়ে দিয়েছি। উনি যেভাবে পরিকল্পনা করেছেন, আমি সেভাবেই এগিয়ে যাবো৷ কোনো প্রকার হাত পা ছোড়াছুড়ি না করে স্রোতের টানে ভেসে যাব। উনি যদি পাঁচ মাস পর আমাদের আলাদা হওয়া লিখে রাখেন, তবে তাই সই। আমি হাসি মুখে মেনে নিব।
তবে আপনি ভয় পাবেন না, আপনার স্বপ্ন পূরণের পথে আমি বাঁধা হয়ে দাঁড়াব না। ভবিষ্যতে আমার কারনে আপনার বিদেশ যাত্রায় কোনো ঝামেলা হবে না, এ আমি কথা দিচ্ছি। তাই ভয় পাওয়া বন্ধ করুন৷’
‘আমি মোটেও ভয় পাচ্ছি না। শুধু তোমার এই সংসার খেলা বন্ধ করতে বলছি। আমি প্রচন্ড বিব্রত হচ্ছি।’
আদ্রিকা হো হো করে হেসে উঠে দাঁড়াল।
‘বিব্রত হচ্ছেন কেনো? একটু আগেই না বললেন, আমরা স্বামী-স্ত্রী? আপনার স্বপ্ন প্রতিষ্ঠিত হওয়া, আর আমার স্বপ্ন সুখে সংসার করা৷ আপনি আপনার স্বপ্ন পূরণ করুন, আমি আমারটা করছি৷ এরপর সময় এলে সৃষ্টিকর্তা যাকে যেই পথে নিয়ে যাবেন, সে সেই পথে যাবো। ব্যাস, হয়ে গেল৷ এই নিয়ে এতো চিন্তা করার কি আছে মহাশয়?’
আদ্রিকার এমন সহজ স্বীকারোক্তি পরখের সুবিধাজনক মনে হচ্ছে না। এই মেয়ের মাথায় কখন কোন ভূত চেপে বসে বলা যায় না। অতি আদরে বড় হওয়ায় যখন যা মাথায় এসেছে, তাই করে সে অভ্যস্ত। তাই এবেলাও তেমনিভাবে সামনে এগিয়ে যেতে চাইছে। পরখ জানে, সে বাঁধা দিলেও আদ্রিকা মানবে না, বুঝতেও চাইবে না। দুদিন পরে একতরফা সংসারে বিরক্ত হয়ে আদ্রিকা আবারও কোনো পরিকল্পনার ছক কষতে বসে যাবে সে ব্যাপারে পরখ শতভাগ নিশ্চিত। তাই সেও বেশিকিছু চিন্তাভাবনা করল না।
বিছানায় শুয়ে আদ্রিকার উদ্দেশ্যে বলল,
‘আলো নিভিয়ে দিয়ে যেও।’
চলবে…
#অক্ষরময়ী
#পরিণয়ে_নোলককন্যা (কপি নিষেধ)
|৩০|
ইদানীং নিজেকে খুব অলস প্রকৃতির মানুষ মনে হয় পরখের। সমস্ত নিয়ম-কানুনের বালাই ভুলে যাচ্ছে সে৷
রোজ সকালে ঘুম থেকে উঠে রান্না করে দৌড়ে দৌড়ে ভার্সিটিতে গিয়ে ক্লাস করা, লাইব্রেরির পড়াশোনা, বাড়ি ফিরে ঘর গোছানো, রাতের রান্না – সবকিছু সে একা হাতে সামলাতো৷ কখনও বিরক্তি আসতো না৷ অথচ এখন! একটুতেই বিরক্তি এসে যায়৷ ভার্সিটি থেকে ফিরে রেস্তোরাঁর কাজ দেখাশোনা করে বাড়ি ফেরা ক্লান্ত শরীরটি আজ বড্ড অলসতা করছে৷ শুক্রবার বলে তার তাল-বাহানার অবধি রইল না।
ঘুমকাতুরে চোখ দুটো মেলে একবার দেয়াল ঘড়িতে সময় দেখে নিল। সকালটা আটটা বাজে। মুখের উপর লেপ্টে যাওয়া আদুরে রোদ্দুরকে উপেক্ষা করে আবারও চোখ বুজে ঘুমের দেশে পাড়ি দিল৷ রোদকে উপেক্ষা করতে পাতলা কাঁথায় ঢেকে নিল মুখটি।
রোদকে না হয় উপেক্ষা করা গেল কিন্তু দরজার ওপাশ হতে ধেয়ে আসা শব্দকে কি করে উপেক্ষা করবে?
দুমদাম দরজায় করাঘাতে পরখের কানের পর্দা ফেটে যাওয়ার উপক্রম। কানে বালিশ চাপা দিয়ে সে নিরুত্তর পরে রইল। এবার আর আদ্রিকার সহ্য হলো না৷ দরজা খুলে কক্ষের ভেতর প্রবেশ করে তেজিয়ান কণ্ঠে প্রশ্ন করল,
‘আপনি উঠবেন না?’
পরখ তখনও অনড়, নিরুত্তর। আদ্রিকা গটগট করে এগিয়ে গিয়ে পরখের মাথার উপর চেপে রাখা বালিশটি ছিনিয়ে নিল।
‘নয়টা বাজতে চলল। নাস্তা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে।’
নিভু নিভু চোখ দুটো একটুখানি মেলে মুখে চ’কারান্ত বিরক্তিসূচক শব্দ উচ্চারণ করে ওর হাত থেকে বালিশটি উদ্ধার করে পরখ জবাব দিল,
‘হোক। ঠান্ডা নাস্তা খাবো।’
‘এতোবেলা করে কে ঘুমায়!’
‘আমি। বিরক্ত করো না। যাও তো।’
‘বাজারে যেতে হবে। উঠুন তাড়াতাড়ি।’
‘একটু পরে উঠছি। পাঁচ মিনিট।’
কিছুক্ষণ নীরব আক্রোশে পরখের ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে আদ্রিকা চলে গেল। ভীষণ রাগ লাগলেও পরখকে কিছু না বলতে পারার আক্রোশ প্রকাশ করল বেচারা পরোটাগুলোর উপর। গরম পরোটাগুলো হটপট থেকে বের করে প্লেটের উপর তুলে রাখল। দেরীতে উঠার শাস্তিস্বরূপ ঠান্ডা পরোটা খাওয়াবে পরখকে। আলু ভাজি, অমলেটসহ প্লেটটি নিয়ে রাখল টেবিলের উপর৷
ঘরদোর পরিষ্কার করা শেষ করে হঠাৎ ঘড়ির দিকে তাকিয়ে আদ্রিকার চক্ষু চড়কগাছ। সাড়ে নয়টা বেজে গেছে। অথচ পরখের নিদ্রাদেবী বিসর্জনের কোনো আয়োজন নেই৷ কোমরে আঁচল পেচিয়ে সে সোজা উপস্থিত হলো পরখের কক্ষে। সে মহাশয় তখনও গভীর ঘুমে মগ্ন। কটমট করে তাকিয়ে আদ্রিকা গম্ভীর স্বরে হুশিয়ারি দিল,
‘আপনি উঠবেন না?’
আধো ঘুমন্ত পরখের জবাব এলো,
‘হুম।’
‘কখন?’
‘একটু পর।’
আদ্রিকা ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে পরখের পাশে বিছানায় বসল। ওর মুখের উপর ঝুঁকে বলল,
‘এবার না উঠলে খুব খারাপ হয়ে যাবে কিন্তু।’
বিরক্তিমাখা চোখ দুটো মেলে তাকাল পরখ। এক হাতে আদ্রিকার মুখটি সরিয়ে দিয়ে অন্যপাশে মুখ ঘুরিয়ে আবারও ঘুমিয়ে গেল। এমন দৃশ্য দেখে ক্রোধে আদ্রিকার গা জ্বলে যাওয়ার দশা। সে বেশি কিছু না ভেবে নিচু হয়ে চটাস করে পরখের ডান গালে গভীর চুমু খেলো। চকিতে চোখ মেকে তাকাল পরখ। দু হাতে ঢেলে নিজের উপর থেকে সরিয়ে দিল আদ্রিকাকে৷ এতোক্ষণে হতভম্ব পরখের ঘুম ছুটে গেছে৷ জোরসে ধমক দিল আদ্রিকাকে।
‘কী সমস্যা? সকালবেলা ফাজলামি করার জায়গা পাও না, না? অসভ্য কোথাকার!’
আদ্রিকার বিশেষ ভাবান্তর হলো না। সে আস্তে-ধীরে বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
‘তাড়াতাড়ি উঠে পরুন। অনেক কেনাকাটা আছে।’
বুকের উপর থেকে কাঁথাটি টেনে ভালোভাবে গায়ে মুড়ে নিয়ে পরখও জেদ দেখিয়ে বলল,
‘পারব না বাজারে যেতে। নিজে বাজার করে নিয়ে এসো।’
এমন অলক্ষুণে কথা শুনে আদ্রিকা কিছুক্ষণ হতবাক চেয়ে রইল। দাঁত কটমট করে আবারও নিচু হয়ে দু হাতের আঁজলায় পরখের মুখটি ধরে ফিসফিসিয়ে বলল,
‘এবার না উঠলে ঠোঁটে চুমু দিবো।’
ধমকে কাজ হলো বেশ। হুড়মুড় করে উঠে বসল পরখ। রাগে কাঁপতে কাঁপতে কঠিন কিছু কথা বলার প্রস্তুতি নিচ্ছিল কিন্তু সুযোগ দিল না আদ্রিকা৷ লম্বা চুলের বিনুনি কাঁধের উপর থেকে সরিয়ে পিঠের দিকে ছুড়ে দিয়ে সে ঘুরে দাড়াল। দরজার দিকে হাঁটতে হাঁটতে উচ্চ স্বরে গান ধরল,
‘আর যাবো না বেগুন তুলিতে
ও লো লোলিতে!
আর যাবো না বেগুন তুলিতে!
হাতে নাতে পরলাম ধরা
শরম লাগে বলিতে…’
আদ্রিকায়ায়ায়ায়া! – পরখের গগনবিদারী চিৎকারে মাঝপথে থেমে যেতে হলো আদ্রিকাকে। স্বরের প্রখরতা পরিমাপ করে সে বুঝে গেছে এর থেকে বেশি ইতরামি করলে আজকে তার কপালে শনি আছে। তাই এ দফায় নিজের অট্টহাসি গিলে নিল।
খেতে বসে পরখ বারবার তাকাচ্ছিল আদ্রিকার দিকে। সেই ক্রুদ্ধদৃষ্টিতে ভুলেও দৃষ্টি মেলাচ্ছে না আদ্রিকা। অযথা কাজের ব্যস্ততায় নিজেকে ডুবিয়ে রেখেছে সে। ঠান্ডা পরোটার সাথে একপাক্ষিক যুদ্ধ শেষে পরখ তার হিমশীতল কণ্ঠে প্রশ্ন করল,
‘কী এমন বাজার-সদাই লাগবে যার জন্য পুরো বাড়ি মাথায় তুলে নাচছ?’
কড়াইয়ে মুগ ডাল ভাজতেছিল আদ্রিকা। খুন্তি ধরে রাখা হাতটি মাথার উপর তুলে রেখে একটু বাঁকা হয়ে দাঁড়াল। ফলে মুহূর্তেই উন্মুক্ত হলো তার মোমের ন্যায় মসৃণ, কোমল উদর। মানব চক্ষুর আচরণ বড্ড বেপরোয়া। অতিদ্রুত নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতি আকৃষ্ট হয়। তাই নজরে আসামাত্র পরখ দ্রুত চোখ ফিরিয়ে নিল। তা দেখে মুচকি হেসে আদ্রিকা জবাব দিল,
‘আজকে নতুন রেসিপি ট্রাই করব। পোড়ানো মশলা দিয়ে মুরগী। সেটার জন্য কিছু মশলা লাগবে।’
জবাব পাওয়া মাত্র পরখ ছুটল নিজের কক্ষের দিকে৷ পোশাক বদলে বাজারে যেতে হবে। এই মেয়ের আশেপাশে থাকাটাও বিপদজনক। কখন, কী করে ঠিক নেই। রূপবতী নারীর আশেপাশে থাকলে পুরুষের মন পুলকিত হয়৷ আবার সেই নারীটি যদি হয় বিয়ে করা বৈধ স্ত্রী, তবে মন ছুক ছুক করবেই।
কক্ষের প্রবেশের আগে পরখ বিরক্তিসূচক প্রতিউত্তর করতে ভুলল না।
‘সামনে পরীক্ষা, পড়াশোনার কোনো চিন্তা নাই। সারাদিন এটা ওটা রান্না নিয়ে পরে আছে। সে হবে আত্মনির্ভরশীল।’
আদ্রিকাও উচ্চস্বরে জবাব দিল।
‘রান্নাবান্না করতে আমার ভালো লাগে। আমি হচ্ছি রসনাবিলাসী। যার জামাই এমন মেনিমুখো পেঁচা তার নিজের মন ভালো করার জন্য রান্না নিয়ে পরে থাকাই উত্তম।’
পরখ সিদ্ধান্ত নিল, সে আজ আর বাড়িতেই ফিরবে না। রেস্তোরাঁর কাজ চলছে জোর কদমে। রুমি একা সবদিক সামলাতে পারছে না। পুরো সপ্তাহের অক্লান্ত পরিশ্রমের পর রুমি নিজেই ওকে আজকে বিশ্রাম নিতে বলেছে। কিন্তু বাড়িতে বিশ্রাম নেওয়ার জন্যও অবস্থান করা আজকাল বিপদজনক হয়ে দাঁড়িয়েছে। পরখ ঠিক করল, বাজার-সদাই পৌঁছে দিয়ে সে রেস্তোরাঁয় চলে যাবে। কাজের তদারকি করলে শ্রমিকেরা আরও দ্রুত কাজ শেষ করে দিবে।
কিন্তু বাধ সাধল আদ্রিকা। চুলা বন্ধ করে বেসিন থেকে একটুখানি পানি নিয়ে মুখ ধুয়ে নিল। আঁচলে মুখ মুছে পরখকে বলল,
‘আমিও আপনার সাথে যাব। আরও কিছু কেনাকাটা আছে সেগুলো আপনি করতে পারবেন না।’
পরখ ভ্রু কুঁচকে সন্দিহান গলায় বলল,
‘তুমি এমন কি কিনবে, যা আমি কিনতে পারব না?’
‘অনেককিছুই আছে। নাম বললে আপনি আবার লজ্জা পেয়ে যাবেন।’
দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে যেতে যেতে পরখ বিড়বিড় করল,
‘অশ্লীল, অসভ্য।’
প্রধান সড়কে এসে বাইক থামাল পরখ। আদ্রিকা প্রশ্ন করল,
‘কি হলো?’
‘নামো।’
‘কেনো?’
‘নামো বলছি।’
আদ্রিকা বুঝতে পারছে না, কী হচ্ছে। তবুও মুখ গোমড়া করে বাইক থেকে নেমে পরখের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। হেলমেট খুলে ঘাড় ফিরিয়ে রাস্তার দিকে তাকিয়ে পরখ বলল,
‘তোমাকে বাইকে নিয়ে বাজারে যাওয়া যাবে না। তুমি রিক্সায় আসো।’
অপমানে আদ্রিকার মুখটি একটুখানি হয়ে গেলেও তা দ্রুত উধাও হয়ে গিয়ে হুড়মুড় করে এসে স্থান দখল করে নিল অপরিসীম রাগ। অত্যাধিক রাগে হতবাক আদ্রিকার অনেককিছু বলার থাকলেও সে বিশেষ কিছু বলতে পারল না৷ পরখ ততোক্ষণে রিক্সা থামিয়েছে। আদ্রিকা গটগট করে রিক্সায় গিয়ে বসল। পরখ অবশ্য রিক্সার ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে বাইক নিয়ে চলে গেল নিজের গন্তব্যে।
পুরোটা রাস্তা আদ্রিকা নীরবে চোখের পানি ফেলল। বাজারের কাছাকাছি আসা মাত্র শাড়ির আঁচলে ঘষে ঘষে মুছে ফেলল অশ্রুকণার শেষ চিহ্নটুকু। রিক্সা থেকে নামার আগে চারপাশে চোখ বুলিয়ে নিলেও পরখের দেখা মিলল না৷ বাজারে মাছি ভনভনে ভীড় দেখে আদ্রিকার হাতের তালু ঘামতে শুরু করে দিয়েছে। শুকনো ঢোক গিলে সে রিক্সা থেকে নিচে নামল। রাস্তায় পা রাখতেই পেছন থেকে ধীরে ধীরে সামনে এসে দাঁড়াল পরখের বাইক৷ বাইক চালিয়েও সে কীভাবে আদ্রিকার পরে এসে পৌঁছালো ভেবে পেল না আদ্রিকা। তবে কি পরখ ওর রিক্সার পেছনেই ছিল? মন খারাপের মেঘ এমন করে ওকে আঁকড়ে ধরেছিল যে পেছনের দিকে নজর রাখতে ভুলে গিয়েছে৷ চেনাজানা একটি দোকানের সামনে বাইক পার্ক করে রেখে পরখ এসে দাঁড়াল আদ্রিকার পাশে। তাড়া দিয়ে জিজ্ঞাসা করল,
‘কি কি কিনবে?’
আদ্রিকা উত্তর দিল না। গভীর চোখে পরখের মুখমন্ডলে নিজের প্রশ্নের উত্তর খুঁজল কিন্তু কাঙ্ক্ষিত জবাব পেল না৷ প্রশ্নের উত্তর না পেয়ে পরখ জানতে চাইল,
‘কি হলো?’
সম্মোহনী আদ্রিকা ভীষণ আবেগ নিয়ে জানতে করল,
‘আমাদের একসাথে কদম মিলিয়ে চলতে মানা, তবে কীসের টানে আমার পিছু নেওয়া?’
পরখকে বিভ্রান্ত দেখাল। ব্যস্ততার মাঝে এমন অদ্ভুত কথা কে শুধিয়েছে কবে! সে ধমক দিল।
‘কী উল্টাপাল্টা বকছ!’
আদ্রিকার আবেগ উবে গিয়ে হতাশা জেকে ধরল। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
‘আপনাকে আমি বুঝতে পারি না, পরখ।’
পরখ আরেকবার উন্মাদিনীকে দেখে নিল। সে যে এমন পাগলের প্রলাপ বকতেই থাকবে তা নিশ্চিত হওয়া মাত্র পরখ আর দাঁড়াল না। লম্বা লম্বা পা ফেলে মুরগির দোকানের দিকে হাঁটা শুরু করল। পিছু নিল আদ্রিকা। লেয়ার মুরগির দোকানের সামনে থামতেই আদ্রিকা বাঁধা দিল।
‘এগুলো না। পোল্ট্রি নিব।’
‘লেয়ারে কি সমস্যা?’
‘এই রেসিপিতে পোল্ট্রি লাগবে।’
‘দুটোই মুরগি। একটা দিয়ে রাঁধলেই হলো।’
‘আমি রাঁধবো নাকি আপনি?’
পরখ কিছু না বলে কটমট করে তাকাল। মুরগি বিক্রেতা সদ্য যুবক। স্বামী স্ত্রীর খুনসুটিময় ঝগড়া দেখে মিটিমিটি হাসছে। পরখের রাগান্বিত চেহারা দেখে আদ্রিকার গলার স্বর সামান্য অনুরোধের স্তরে নেমে এলো।
‘একেক মুরগির একেক স্বাদ। পোল্ট্রির গোশত বেশি, তাই এটা পোল্ট্রি দিয়ে রাঁধতে হবে।’
পরখ আর দ্বিমত পোষণ করল না। ধুপধাপ পোল্ট্রির দোকানের সামনে গিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। আদ্রিকা পরল বিপাকে। দোকানী জানতে চাইছে,
‘পুরোটা নিবেন নাকি কা/টা মাংস?’
আদ্রিকা নিষ্পাপ দৃষ্টি মেলে চাইল পরখের মুখের পানে। কিন্তু সে মহাশয় মুখ বন্ধ করে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। তাই বাধ্য হয়ে আদ্রিকা জবাব দিল,
‘পুরোটা।’
একটি শব্দ উচ্চারণ করতে গিয়ে ওর গা কেঁপেছে, তা সে স্পষ্ট টের পেল। পরেরবার যখন দোকানী আবার প্রশ্ন করল,
‘কতোটুকু ওজনের দিব?’
এবারও পরখ জবাব দিল না। তবে এবার আর আদ্রিকার গলা কাঁপল না। বেশ স্বাভাবিকভাবে সে জবাব দিল। কিন্তু দোকানি যখন জানতে চাইল,
‘ড্রেসিং করে নিবেন?’
আদ্রিকা বুঝল না। ড্রেসিং আবার কোন প্রসেস! তার কেনা মুরগিকে না জানি কী করে দেয়! তাই অসম্মতি জানাতে যাচ্ছিল। পাশ থেকে পরখ জবাব দিল,
‘ড্রেসিং করে মাঝারি পিস করে দিবেন।’
নতুন শব্দটি আদ্রিকা মনে রেখে দিল। বাড়ি ফিরেই গুগলে সার্চ দিয়ে মানে জেনে নিবে। মুরগির দোকানে অপেক্ষা না করে ওরা চলে গেল সবজি মার্কেটে৷ কেনাকাটা করতে আদ্রিকার বেশ লাগছে৷ তাই প্রয়োজনীয়, অপ্রোয়জনীয় যাই পছন্দ হচ্ছে কিনে নিচ্ছে। দেখতে দেখতে পরখের দু হাতে দুটো বাজারের ব্যাগ বাজার-সদাই দিয়ে ভরে গেল।
ব্যাগগুলো একটি পরিচিত দোকানে রেখে পরখ বলল,
‘তোমার কি যেন কেনার ছিল?’
সবজি কেনার আনন্দে সেসবের কথা আদ্রিকা প্রায় ভুলেই গিয়েছে। পরখ মনে করিয়ে দেওয়ায় সে অবাক হয়ে জবাব দিল,
‘আরেহ! ভুলেই গিয়েছিলাম। সেসব পরে কিনছি। আগে বাজার-সদাই শেষ করি। আচ্ছা এখানে খৈল কোথায় পাওয়া যাবে?’
‘খৈল? সেটা আবার কি?’
‘সরিষার খৈল। সরিষা থেকে তেল বের করার পর যেটা থাকে।’
‘সেসব দিয়ে তুমি কি করবে?’
‘গাছে দিব। অনেকগুলো পানির মধ্যে মাত্র চার পাঁচটা খৈল ভিজিয়ে রেখে সেই পানি গাছের গোড়ায় দিলে দারুণ সার হিসেবে কাজ করে।’
‘তোমার গাছের জন্য আমি এখন খৈল এর দোকান খুঁজব?’
‘হ্যাঁ। পিউ মা বলেছে, আপনাকে বললেই আপনি এনে দিবেন। এই যে আমি আপনাকে বললাম, এখন আপনি এনে না দিলে পিউ মায়ের কাছে নালিশ জানিয়ে দিব।’
অগত্যা বাধ্য হয়ে সেই ভরা বাজারে পরখকে খৈল এর খোঁজে বের হতে হল। ভাগ্য ভালো ছিল বলে পাশেই একটি সরিষা ভাঙানোর ভ্রাম্যমাণ দোকান পাওয়া গেল। সেখানে থেকে খৈল কেনার পর জানা গেল আদ্রিকার বিশেষ কেনাকাটার খবর। পরখ অবাক হয়ে আরেকবার শুধাল,
‘তুমি এখন শাড়ি কিনবে?’
‘হ্যাঁ। আমার কাছে যেগুলো ছিল সব পড়া শেষ।’
‘একবার পরলে আর পরা যাবে না?’
‘যাবে। কিন্তু আমি পরব না। আমার মেয়ের জন্য রেখে দিব। তাছাড়া আমার জামাই তো অনেক বড়লোক। টাকার বিছানায় ঘুমায় বোধহয়। উনার বউ অন্য কারো থেকে টাকা নিলে উনার মানসম্মানে পাথরের বড় বড় ঢিল পরে। তার বউ হয়ে আমি কি একই শাড়ি বারবার পরতে পারি! তার অপমান হবে না? তাই আমি ঠিক করেছি, এখন থেকে আমি রোজ নতুন শাড়ি পরব।’
পরখ অবাক হয়ে বলল,
‘তোমার মেয়েও আছে নাকি! জানতাম না তো।’
‘আপাতত নেই। ভবিষ্যতে হবে।
‘প্রেগন্যান্ট নাকি তুমি?’
‘হতেও পারি। হতে কতোক্ষণ!’
‘কয় মাস? পাঁচ? ছয়? বিস্ময়ের সাথে একদিন শুয়েই প্রেগন্যান্ট হয়ে গেলে! ছেলের তারিফ করতে হয় দেখছি।’
পরখ বিদ্রুপের গা জ্বালানি হাসি হেসে কাপড়ের দোকানের রাস্তা ধরে হেঁটে যেতে থাকল। কিন্তু হাঁটার শক্তি হারিয়ে ফেলল আদ্রিকা। লজ্জায়, অপমানে হেঁট হয়ে এলো মাথা। কোনোভাবে যদি নিজের অতীতকে মুছে ফেলা যেতো! প্রয়োজনে সে নিজের জীবনের বিনিময় করে মুছে ফেলত সেই অভিশপ্ত দিনটি।
অনেকখানি পথ এগিয়ে গেছে পরখ। খেয়াল করা মাত্র আসন্ন চোখের জলের গতিরোধ করে আদ্রিকা লম্বা শ্বাস নিল। তারপর ছুটল পরখের পিছু।
শাড়ির দোকানে একেরপর এক শাড়ি দেখানো হচ্ছে। পছন্দ হচ্ছে না আদ্রিকার। তার আবদারের শেষ নেই।
‘আপনাদের এখানে কোন কোন কাপড়ের শাড়ি পাওয়া যায় সেগুলো দেখান।’
‘বিভিন্ন ডিজাইনের দেখান।’
‘এই ডিজাইনের অন্য রঙের দেখান।’
ক্লান্ত দোকানী বিরক্ত হলেও হাসি মুখে শাড়ি দেখিয়ে যাচ্ছে। মাঝেমধ্যে অবশ্য একটু সমর্থনের জন্য তাকাচ্ছে পরখের দিকে। ভদ্রলোক যদি নিজের স্ত্রীকে একটু হাঁকডাক দেন সেই আশায়। কিন্তু পরখ নির্বিকার ভঙ্গিমায় বসে আছে আদ্রিকার পাশের টুলে।
একটি শাড়ি হাতে তুলে নিয়ে আদ্রিকা বলল,
‘এই শাড়ির অন্য রং হবে না?’
‘হবে। লাল, নীল, কমলা, সাদা, বেগুনী…’
‘জলপাই রঙের হবে?’
‘একটু দেখতে হবে ম্যাডাম।’
‘দেখেন।’
তিনজন কর্মকর্তা অনেক খুঁজে অবশেষে জলপাই রঙ এর শাড়িটি নিয়ে এসে আদ্রিকার সামনে রাখল। কিন্তু আদ্রিকা মুখ ফুলিয়ে বলল,
‘এটা কাঁচা জলপাই রঙের। আমার পাকা জলপাই রঙেরটা লাগবে।’
দোকানি আবারও অনুসন্ধানে নেমে পরল। তারাও বুঝি নিজের কাছে প্রতিজ্ঞা করেছে, আদ্রিকার মনমতো শাড়ি খুঁজে দিয়েই নিস্তার নিবে। দুটো ভিন্ন শেডের সবুজ রঙা শাড়ি এনে রাখা হলো আদ্রিকার সামনে। এবার শাড়ি হাতে নিয়ে আদ্রিকা ফের অভিযোগ জানাল,
‘জলপাই আগুনে পোড়ালে যেমন রঙ আসে, এটার রঙ সেররকম। আর এটা জলপাই পানিতে সেদ্ধ করলে যেমন রঙ আসে, ঠিক তেমন। নাহ, নাহ। এগুলো চলবে না। জলপাই প্রাকৃতিকভাবে পাকলে যেমন রঙ আসে, আমার ওই রঙটা লাগবে।’
দোকানী এবার কাঁদো কাঁদো চেহারা নিয়ে পরখের দিকে চাইল। আড়ালে মুচকি হেসে হাতের মোবাইলটি পকেটে ভরে রেখে উঠে দাঁড়াল পরখ। সামনে রাখা শাড়ির পাহাড় থেকে নিজের পছন্দ মতো দশটি শাড়ি তুলে নিয়ে দোকানীর হাতে দিয়ে বলল,
‘এগুলো প্যাকেট করে দিন।’
দোকানী ভয়ার্ত চোখে তাকাল আদ্রিকার দিকে। এই না আবারও ভদ্রমহিলা রঙের শেড নিয়ে বাহানা শুরু দেয়। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে আদ্রিকা কোনো অভিযোগ করল না। চুপচাপ পরখের পছন্দের শাড়িগুলো নিয়ে নিল।
মূল সড়কে এসে আদ্রিকা হুট করর হাঁটা থামিয়ে দাঁড়িয়ে পরল। পেছনে পরখ আসছিল একগাদা শপিং ব্যাগ নিয়ে। তার দিকে ফিরে আদ্রিকা বলল,
‘আমি আপনার সাথে বাইকে যাব না। রিক্সায় যাব।’
পরখ কিছু বলার আগেই একটা রিক্সা ডেকে আদ্রিকা রিক্সায় উঠে বসল।
পরখ এগিয়ে এসে জিজ্ঞাসা করল,
‘কেনো যাবে না?’
‘আমি যার তার বাইকে উঠি না। আপনার মতো কিপটা মানুষের বাইকে তো আরও উঠি না।’
রিক্সাওয়ালাকে তাড়া দিয়ে বলল,
‘মামা তাড়াতাড়ি চলেন। রোদ করতেছে। আর যাওয়ার আগে উনার থেকে আপনার ভাড়াটা নিয়ে নেন।’
পরখ অবাক হয়ে শুধাল,
‘তুমি আমার বাইকে না গিয়ে রিক্সায় যাবে অথচ আমি তোমার রিক্সা ভাড়া দিব?’
‘হ্যাঁ দিবেন। আপনার বউয়ের রিক্সা ভাড়া আপনি দিবেন না তো কে দিবে? পাশের বাড়ির ভাবির স্বামী দিবে?’
আদ্রিকার কথা শুনে বৃদ্ধ রিক্সাওয়ালা হো হো করে হেসে ফেলল। সেদিকে তাকিয়ে আরও আড়ষ্ট হয়ে গেল পরখ। তাড়াতাড়ি পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করে রিক্সাওয়ালার ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে বলল,
‘সাবধানে নিয়ে গিয়ে একদম বাড়ির সামনে নামিয়ে দিবেন।’
রিক্সা চলে যাওয়ার পর পরখ পরল বিপাকে। চারটে শপিং ব্যাগ, দুটো বাজারের বড় ব্যাগ বাইকে নিয়ে সে একা বাড়ি ফিরবে কীভাবে!
চলবে…
#অক্ষরময়ী
#পরিনয়ে_নোলককন্যা (কপি নিষেধ)
|৩১|
রেস্তোরাঁ তৈরির কাজ শেষ হয়েছে। জোরকদমে চলছে স্টাফ নিয়োগের কাজ। সিভি জমা পরেছে বেশ কিছু। পরখের পরিকল্পনা অনুযায়ী নিয়োগের ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। রুমি এবং পরখ অফিসরুমে বসে সিভিগুলো দেখছিল। পর্তুলিকার কল এলো তখনি। এখনও সন্ধ্যার পরে বাড়ির বাইরে থাকলে মায়ের বকুনি খেতে হবে জেনে পরখ আগে ঘড়িতে সময় দেখে নিল। মাগরিবের আযান এখনও হয়নি নিশ্চিত হয়ে কলটি রিসিভ করল।
‘মা?’
‘কোথায় তুই?’
‘বাজারের দিকে আছি।’
‘বাড়ি যাবি কখন?’
‘এইতো যাচ্ছি একটু পর।’
‘যাওয়ার আগে দেখা করে যাবি।’
‘কেনো?’
‘আদ্রিকার কিছু জিনিস চেয়েছে। সেগুলো নিয়ে যাবি।’
‘আচ্ছা। আধা ঘন্টার মধ্যে যাচ্ছি।’
পরখ ভেবেই নিল তার হাতে আবারও কিছু ফুল গাছ ধরিয়ে দেওয়া হবে। কিন্তু বাড়ি গিয়ে পর্তুলিকা যখন ব্যাগটি হাতে ধরিয়ে দিল, পরখ হতভম্ব হয়ে গেল। সে একবার ব্যাগের দিকে তাকায় আবার পরক্ষণে মায়ের দিকে। সবিস্ময়ে প্রশ্ন করল,
‘আদ্রিকা তোমার কাছে এগুলো চেয়েছে?’
পর্তুলিকা স্বাভাবিকভাবে জবাব,
‘হ্যাঁ।’
‘ছাই! ছাই দিয়ে কি হবে?’
‘গাছের গোড়ায় দিবে।’
‘তোমাদের জন্য এখন আমাকে ছাই ডেলিভারির কাজ করতে হবে? কী যে করো না তোমরা!’
মানুষের কাজ না থাকলে সময় কাটানোর জন্য নানান অকাজ করে থাকে। পরখ তাই সিদ্ধান্ত নিল, আদ্রিকাকে ব্যস্ত রাখতে হবে। এই মেয়ে সারাদিন ঘরে বসে থাকে আর পরখকে জব্দ করার ফন্দি আঁটে।
বাড়ি ফেরার আগে সে লাইব্রেরি থেকে মানবিক বিভাগের এক সেট নতুন বই কিনে নিল। আদ্রিকার একহাতে ছাইয়ের ব্যাগ অন্য হাতে বইয়ের ব্যাগ তুলে দিলে আদ্রিকা বেশ আশাহত হলো। ঠোঁট উল্টে পরখের কাছে জানতে চাইল,
‘বই কেনো?’
‘পড়ার জন্য। না পরে পরীক্ষা দিয়ে ফেল করতে চাও?’
‘ফেল অন্তত করব না। আমি এতোটাও দূর্বল স্টুডেন্ট না।’
‘শুধু পাশ করলে হবে না। আমার কষ্ট করে আয়ের টাকা জলে ভেসে যাওয়ার জন্য দেইনি। গায়ে হাওয়া লাগিয়ে ঘুরে না বেরিয়ে কালকে থেকে কলেজে যাওয়া শুরু করো।’
কলেজে যেতে কোনোকালেই ভালো লাগেনি আদ্রিকার। বোনের সাথে সময় কাটাতে সাথে চলে যেত। লেখাপড়া করতে ভালো লাগত না। কোনোরকম পাশ করে চালিয়ে যাচ্ছিল এতোদিন। এখন এক কিপ্টে লোকের টাকায় ফরমফিলাপ করে সে এমনভাবে ফেঁসে যাবে কে জানত।
এজন্য অত্যাধিক বইপড়ুয়া জ্ঞানী ছেলেকে বিয়ে করতে হয় না। বিয়ের পর এরা রোমান্সের জায়গায় একাডেমিক জ্ঞান দেওয়া শুরু করে।
আগামীকাল কলেজ যেতে হবে, এই চিন্তায় সারারাত ঘুম হলো না আদ্রিকার। পড়াশোনার পাশাপাশি ঘর সংসার সামলানো আরেক ঝামেলার কাজ। বিছানায় এপাশ ওপাশ করতে করতে ভোর এসে গেল। অন্যদিনের তুলনায় আজ তাড়াতাড়ি বিছানা ছেড়েছে আদ্রিকা। মাথা ভার হয়ে আছে। নিজের ঘর গুছিয়ে ফ্রেশ হয়ে নিল। রান্নাঘরে একগাদা নোংরা থালাবাসন। এগুলো পরিষ্কার করে সকালের নাস্তা বানাতে হবে, আবার দুপুরের খাবার তৈরি করে রেখে যেতে হবে। যদিও পরখের খাবার নিয়ে চিন্তা করতে হবে না। কিন্তু সে নিজে বাড়ি ফিরে কি খাবে! কলেজ থেকে ফিরতে ফিরতে দুপুর হয়ে যাবে। ক্লান্ত শরীরে রান্না করা সম্ভব নয়। সেবেলা রান্না করতে শুরু করলে খাবার তৈরি হতে বিকাল গড়িয়ে যাবে। তাই রান্না করে রেখে যাওয়াই উত্তম।
পড়াশোনার পাশাপাশি সংসার সামলানো সবচেয়ে কঠিন কাজ। পড়াশোনা এবং সংসার দুটোর অবস্থান দুই প্রান্তে। সারাদিন সংসার সামলে মনটাকে পড়ার টেবিলে স্থির করতে করতে পরদিন সকাল হওয়ার সময় চলে আসে। নদীর এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত ছুটতে ছুটতে চঞ্চল মেয়েটি হারিয়ে ফেলে নিজেকে। মাঝখান থেকে রেজাল্ট খারাপ হলে নানান কটুক্তি শুনতে হয়।
‘ দিনরাত পড়াশোনা করল অথচ রেজাল্টের অবস্থা দেখো! পড়াশোনার নামে এতোদিন সংসারের কাজে ফাঁকি দিয়েছে শুধু।’
থালাবাসন ধোয়া শেষ করে উপরের র্যাক থেকে চায়ের পাতিল নামাতে গেলে আদ্রিকার আগেই আরেকটি হাত পাতিলটি তুলে নিল। অবাক আদ্রিকা ঘাড় ফিরিয়ে পরখকে দেখে ভূত দেখার মতো চমকে দু পা পেছনে চলে গেল। ওর প্রতিক্রিয়া দেখে পরখ ভ্রু কুঁচকে তাকালেও মুখে কিছু বলল না। পাতিলে পানি নিয়ে চুলায় বসিয়ে দিল। নিজেকে সামলে নিয়ে আদ্রিকা বলল,
‘আপনি এতো সকালে উঠে গেছেন! কটা বাজে?’
‘ছয়টা।’
‘রান্নাঘরে কেনো এলেন? চা খাবেন? আমাকে বললেই করে দিতাম। আমাকে দিন। আমি চা বানাতেই যাচ্ছিলাম।’
পরখ তার চেহারায় গম্ভীর্যতা বজায় রেখে বলল,
‘তুমি দুপুরের রান্না সামলাও। আমি নাস্তা তৈরি করে নিচ্ছি।’
পরখকে ফ্রিজ থেকে পাউরুটি বের করতে দেখে আদ্রিকা আলতো হাসল। দুপুরের জন্য একটি পদ রান্না করে দ্রুত চলে গেল নিজের কক্ষে। ঝটপট পোশাক বদলে খাবার টেবিলে ফিরে এসে দ্রুত নাস্তা খেয়ে দুজনে চলে গেল দুজনের গন্তব্যে।
ভূবনভোলা একাডেমির সামনে রিক্সা এসে থামল। আদ্রিকার মনে হচ্ছে, কোনো এক অচেনা জগতে চলে এসেছে। কাঁধের ব্যাগটি দু হাতে আঁকড়ে ধরে ধীর পায়ে প্রবেশ করল কলেজের ভেতরে। আজ কতোদিন পর সে এসেছে নিজের কলেজে অথচ কোনো আবেগ প্রকাশ পাচ্ছে না। আবেগ আসবে কোথা থেকে? কলেজের সাথে তার কোনো বন্ধন নেই। কোনো বন্ধু নেই, সুখকর স্মৃতি নেই, অপেক্ষারত পরিকল্পনা নেই।
মানবিক বিভাগের ভবনটি যতোই নিকটে আসছে, ততোই শ্বাস ছোট হয়ে আসছে আদ্রিকার। অতীতের বেশ কিছু স্মৃতি রচনা হয়েছিল এখানে। যা আদ্রিকাকে দিয়েছে অপরিসীম দুঃখ, যন্ত্রণা। ক্ষতগুলো আজও দগদগে। কলেজ প্রাঙ্গণের প্রতিটি কোণ, উঁচু বৃক্ষ, মুক্তমঞ্চ, খেলার মাঠ থেকে শুরু করে যেখানেই চোখ পরছে সেখানেই স্পষ্ট হয়ে উঠছে বিস্ময়ের মুখশ্রী। সেই সাথে চোখের জলে অস্পষ্ট হয়ে আসছে আদ্রিকার দৃষ্টি। নাক টেনে আসন্ন কান্না রোধ করে আদ্রিকা মনে মনে পরখকে কয়েকটি গালি দিল। মেনিমুখো বাঁদর ছেলেটা ইচ্ছে করেই আদ্রিকাকে কলেজে পাঠিয়েছে। যাতে অতীতের প্রতিটি ছু রিকাঘাত আদ্রিকাকে ক্ষতবিক্ষত করে দেয়। যেনো তার মুখনিঃসৃত বাণী আদ্রিকাকে প্রতিনিয়ত ক্ষতবিক্ষত করে দিচ্ছে না। আদ্রিকার আরও আঘাতের প্রয়োজন। আর কতো আঘাত করলে ক্ষান্ত হবে সে, জানে না আদ্রিকা। যত ইচ্ছে আঘাত করুক, আদ্রিকাও প্রতিজ্ঞা করেছে। সে হার মানবে না। সে দ্রুত গতিতে হাঁটতে শুরু করল।
ভবনের দরজা পেরিয়ে সিঁড়ির ধাপে পা রাখতেই পেছন থেকে কেউ একজন ওর হাত টেনে ধরল। অবাক হয়ে পিছু ফিরে আদ্রতাকে দেখে হতবাক হয়ে গেল আদ্রিকা। অনড়, বিমূর্ত আদ্রিকাকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকতে দেখে আদ্রতা মুচকি হেসে বলল,
‘কী রে ওমন থমকে গেলি কেনো? ভূত দেখেছিস নাকি?’
আদ্রিকার ঠোঁট নড়ল কিন্তু মুখ থেকে কোনো আওয়াজ বের হল না। সে তখনও হালকা কাঁপছে। আদ্রতা খানিকটা ধমক দিয়ে বলল,
‘কখন থেকে ডাকছি, ঘুরেও তাকালি না। আপনমনে হেঁটেই যাচ্ছিস। এখনা আবার কথাও বলছিস না।’
আদ্রিকা হুট করে আদ্রতাকে জাপটে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠল। ওকে ওমন করে কাঁদতে দেখে কয়েকজন শিক্ষার্থী ঘাড় ফিরিয়ে দেখল কিন্তু ক্লাস শুরু হয়ে যাবে বলে ওরা বেশিক্ষণ দাঁড়াতে পারছে না। ক্রন্দনরত আদ্রিকাকে বাঁধা দিল না আদ্রতা। ভীষণ যত্নে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকল।
অনেকক্ষণ কেঁদেকেটে শান্ত হলো আদ্রিকা। আদ্রতার সুশ্রী মুখটি আঁজলায় ভরে অবিশ্বাসের সুরে বলল,
‘তুমি আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছো, আমার একদম বিশ্বাস হচ্ছে না। মনে হচ্ছে স্বপ্ন দেখছি। আমাকে একটা চিমটি কাটো। স্বপ্ন হলে, তা এক্ষণি ভেঙে যাক।’
ওর হাত দুটো নিজের হাতে বন্দী করে নিয়ে আদ্রতা আবারও হাসল।
‘গতদিন দুদিন তোর ডিপার্টমেন্টের সামনে এসে দাঁড়িয়ে থেকেছি। অথচ তোর দেখা নেই। কলেজ আসিস নি কেনো? ক্লাস করিস না তুই?’
জবাবে আদ্রিকা দুপাশে মাথা দোলালে আদ্রতার মুখের হাসি দপ করে নিভে গেল।
‘কেনো? শ্বশুরবাড়ির লোকজন আসতে দেয় না?’
‘দেয়। আমার আসতে ভালো লাগে না।’
‘কেনো?’
‘বিয়ে হয়ে গেছে এখন আর পড়াশোনা করার ইচ্ছে নেই। আজকে পরখ জোর করে পাঠিয়ে দিল।’
‘ভালো করেছে। তোর সাথে এমনি করা উচিত। মায়ের কাছে শুনলাম, পরখ এখানেই শিক্ষকতা করে। তোরা একসাথে এলি?’
‘মায়ের সাথে তোমার কথা হয়? দেখা করেছো?’
‘দেখা হয়নি। ফোনে কথা হয়েছে কয়েকবার।’
‘তুমি ফিরলে কবে?’
তখনি ঠংঠং করে ক্লাসের ঘণ্টা পরল। শব্দ শুনে আদ্রিকা ওর হাত ছেড়ে দিয়ে বলল,
‘ক্লাস শুরু হয়ে যাবে। ক্লাসে যা। কালকে দেখা হবে।’
ছুটে যাওয়া হাত দুটো আঁকড়ে ধরল আদ্রিকা। সিক্ত কণ্ঠে বলল,
‘নাহ। তুমি যেও না। তোমার সাথে আমার অনেক কথা আছে।’
‘কিন্তু তোর ক্লাস?’
‘একদিন ক্লাস না করলে কিছু হবে না।’
খানিকটা সময় ভেবে আদ্রতা রাজি হয়ে গেল।
‘আচ্ছা বেশ। চল কোথায় বসি। মুক্তমঞ্চে বসবি?’
‘নাহ। ক্যান্টিনে চলো।’
দু কাপ চায়ের অর্ডার দিয়ে আদ্রতা বলল,
‘তারপর? কেমন চলছে দিনকাল?’
আদ্রিকা ম্লান হেসে নিরাশ কণ্ঠে জবাব দিল,
‘কোনোরকম কেটে যাচ্ছে। তুমি ফিরলে কবে?’
‘তিনদিন হলো।’
‘ঢাকায় ছিলে না? ফিরে এলে কেনো?’
‘হ্যাঁ। ওখানে তোর ভাইয়া একটা শো-রুমে জব করত। গত সপ্তাহে আমাদের পরীক্ষার বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে। পরীক্ষা দিতে হবে, তাই জোর করে নিয়ে এলো।’
‘তুমি আসতে চাওনি?’
‘নাহ। কাছাকাছি থাকলে তোদের থেকে দূরে থাকতে পারব না। তাই আসতে চাইনি। তবুও আসতে হলো। দেখ না, এসেই তোর খোঁজে চলে এসেছি। মায়ের সাথে দেখা করার জন্য মনটা অস্থির হয়ে আছে।’
‘যেও না। বাবা খুব বাজে ব্যবহার করে। আমাকে তাড়িয়ে দিয়েছে।’
আদ্রতা গা দুলিয়ে হাসল। তা দেখে রেগে গেল আদ্রিকা। ওর অপমানে আদ্রতা কবে থেকে মজা নিতে শুরু করল? বিয়ে করলে মানুষ এতোটাও বদলে যায়!
‘তুমি হাসছ!’
‘তুই বোকামি করলে রাগ তো দেখাবেই।’
‘আমি কি করেছি?’
‘আমি পড়াশোনা করতে গিয়ে ছেলের সাথে পালিয়ে গেলাম, তুই বিয়ে করে আবারও পড়াশোনা করতে চাইছিস। এই দেখে তোর ভীতু বাপ ভয় পেয়ে গেছে। তার এই মেয়েও যদি এবার সংসার ছেড়ে পালিয়ে যায়, তখন তার মানসম্মানের কী দশা হবে!’
‘ছিঃ কী নিচু চিন্তাভাবনা!’
‘মানুষ একবার বাজেভাবে ঠকে গেলে, প্রতারিত হলে ন্যায় নীতির বালাই ভুলে যায়। তখন তারা এতো ভেবে চিন্তে কথা বলে না। মুখ খুললেই অন্তরের ক্ষোভ জাহির করে। আমার থেকে যে কষ্ট আব্বু পেয়েছে সেটা তোর উপর প্রকাশ করেছে। জানি সেটা অন্যায়। তবুও আমরা এভাবেই একজনের ক্ষোভ আরেকজনের উপর প্রকাশ করে অভ্যস্ত। ওসবে মন খারাপ করে লাভ নেই।’
‘সেসব নিয়ে আমার মন খারাপ নেই। মন খারাপের কম কারন আছে নাকি! কতোগুলো লাইন ধরে দাঁড়িয়ে আছে।’
ক্যান্টিনের কিশোর বালকটি চায়ের কাপ দুটো রেখে দিয়ে চলে গেল। একটি কাপ আদ্রিকার দিকে এগিয়ে দিয়ে আদ্রতা তাজে গভীর চোখে পর্যবেক্ষণ করে নিল। আদ্রিকাকে লজ্জা পেয়ে মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে বলল,
‘এভাবে তাকাবে না তো।’
আদ্রতা মুচকি হেসে আদ্রিকার থুতনিতে আঙ্গুল ছুঁয়ে বলল,
‘জামাইয়ের সাথে বেশ নোকঝোক চলে বুঝি?’
‘নোকঝোক না ছাই। কাঠখোট্টা মানুষ একটা।’
‘আর তোর কি চাই? রসে টইটম্বুর কেউ?’
আদ্রিকা অন্যমনস্ক হয়ে বামদিকের জানালা দিয়ে দূর আসমানে তাকাল। রসে টইটম্বুর একজনকে সে পেয়েছিল। যার অন্তরের নোংরা পঁচা গন্ধ তার জানা হয়ে গেছে। সেই থেকে অতি মিষ্টির প্রতি আসক্তি নেই বললেই চলে। এর থেকে কাঠখোট্টা-ই ভালো। তবুও কিছু একটা কমতি রয়ে গেছে। কিন্তু সেটা কি? কেনো সুখে নেই আদ্রিকা? অন্তরের ভেতর ঝুঁকে উত্তর খোঁজার চেষ্টা করল।
‘আমার কি চাই! আসলে আমি খুব বেশি চাই না জীবনে। তোমাদের মতো লেখাপড়ায় আগ্রহ নেই, নিজের পায়ে দাঁড়ানো, ক্যারিয়ার গড়ার স্বপ্ন নেই। আমি শুধু একটা সাধারণ জীবন চাই।
যেখানে আমাদের একটা ছোট ঘর হবে, তাতে একটা গোছানো রান্নাঘর থাকবে। সেখানে আমি অনেক অনেক রান্না করব। সে ভীষণ আগ্রহ নিয়ে আমার হাতের রান্না খাবে। রান্না ভালো হলে খুব বেশী লাগবে না, এক শব্দের একটু প্রশংসা করলেই চলবে।
রান্না প্রতিদিন ভালো হবে না, সেটা জানি। যেদিন ভালো হবে না, সে একটু হেসে বলবে, ‘আজকে লবণটা একটু বেশি হয়ে গেছে। ঝাল আরেকটু কম দিও। এতো ঝোল দিয়েছ কেনো?’
সপ্তাহে একদিন না হয় তার পছন্দের একটা কিছু রান্না হবে। অন্তত অলস শুক্রবারে সে আবদার করবে, ‘আজ একটু বিরিয়ানি রাঁধো। ভাপা ইলিশ, খাসির রেজালা, ডাব চিংড়ি।’
মাস শেষের অল্প বেতনে কমদামী একটা শাড়ি নিয়ে আসুক। ক্যাটক্যাটে রঙের হলেও আমি খুশি মনে সেই শাড়িতে নিজেকে সাজাবো। সে শুধু একটু মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে দেখুক। মুখে কিছু না বললেও আমি বুঝে নিব।
তার হাজার ব্যস্ততা আমি মেনে নিব। কিন্তু ব্যস্ততার মাঝে সে একবার লুকিয়ে চুপিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে দেখবে।
অফিসে যাওয়ার আগে কাজে ব্যস্ত আমাকে একটু খুঁজে নিক। ‘কোথায় তুমি? এদিকে এসো৷’
আমি সামনে এসে দাঁড়ালে আলতো হেসে বলুক, ‘আসছি আমি।’
সারাদিনে একবার কল দিয়ে আমার খোঁজ নিক। দুপুরে খেতে বসে একটা মেসেজ দিক, ‘তুমি খেয়েছ?’
ক্লান্ত বিকেলে কাজ থেকে ফিরে এসে আমাকে খেয়াল না করলেও আমি মেনে নিব। সারাদিন হাড়ভাঙা পরিশ্রম করেছে এবার তার বিশ্রাম প্রয়োজন।
সকালটা একলা বিছানায় সে হাত পা ছড়িয়ে ঘুমাক। রাতে অন্তত ঘুমের মাঝে হাত বাড়িয়ে আমাকে খুঁজুক।
মুখে ভালোবাসি না বলুক, আমি দূরে গেলে একটু তো উতলা হোক।
ছোট জীবনে এর চেয়ে আর কি চাই বলো? সুখ দুঃখে ভরা একটা সংসার ছাড়া।’
টেবিলের উপর অবহেলায় পরে থাকা আদ্রিকার হাতের উপর আলতোভাবে হাত রাখল আদ্রতা। আদুরে স্বরে ডাকল,
‘হেই বাচ্চা?’
স্বপ্নিল আদ্রিকা কল্পনার পর্দা সরিয়ে আদ্রতার দিকে তাকাল। আদ্রতা তার দিকে চেয়ে আছে গভীর দৃষ্টি মেলে। যেন চোখ দ্বারা মনের ভেতরটা পড়ে নিবে। বেঈমান অশ্রুদের লুকাতে মাথা নিচু করে আড়ালে চোখ মুছল আদ্রিকা। কিন্তু ততক্ষণে দেখে নিয়েছে আদ্রতা। উদগ্রীব হয়ে শুধাল,
‘তাকা এদিকে। তুই কাঁদছিস কেনো?’
মিথ্যে হাসি হেসে জবাব দিল আদ্রিকা,
‘কোনো বিশেষ কারণে কাঁদছি না। আজকাল একটুতেই ইমোশনাল হয়ে যাচ্ছি। কী মুশকিল হলো!’
আদ্রিকাকে সামলে নিতে সময় দিতে আদ্রতা চায়ের কাপে চুমুক দিল। নিজের চেয়ারে হেলান দিয়ে বলল,
‘মানুষ বৃষ্টি দেখে কখন অবাক হয় জানিস? গ্রীষ্মকালে যখন হুট করে বৃষ্টি নামে অথবা শীতের আগমনী বৃষ্টি কিংবা বৃষ্টিরাজ বর্ষাকালে যেদিন প্রথম বৃষ্টি নামে। শুধুমাত্র সেদিন আমরা খুব মনোযোগ দিয়ে বৃষ্টি দেখি। বৃষ্টিবিলাস করি, বৃষ্টির রুপ দেখে মুগ্ধ হই। অথচ বর্ষাকালে যখন অনবরত বৃষ্টি হয় কিংবা যখন তখন টুপটাপ বৃষ্টি পরে তখন কেউ বৃষ্টিকে বিশেষ গুরুত্ব দেয় না। কেনো বল তো?’
‘কেনো?’
‘কারন বর্ষাকালে এতো বেশি বৃষ্টি হয় যে আমরা বৃষ্টি দেখে অভ্যস্ত হয়ে যাই। কিন্তু গ্রীষ্মকালের তীব্র তাপদাহের পর হঠাৎ বৃষ্টি আসে স্বস্তি নিয়ে, নতুনত্ব নিয়ে। সচরাচর যা পাওয়া যায় না, যা কদাচিৎ, যা দূর্লভ আমাদের সমস্ত আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু তাতেই নিবদ্ধ থাকে। তোকে এসব কেনো বলছি জানিস?’
আদ্রিকা দু পাশে মাথা দুলালো। আদ্রতা ম্লান হেসে হাত বাড়িয়ে আদ্রিকার সিক্ত গালের অশ্রুকণা মুছে দিয়ে বলল,
‘অশ্রু অনেক মূল্যবান। যখন তখন অশ্রু নিঃসরণ করে এটাকে সস্তা বানিয়ে ফেলবি না। মনুষ্য হয়ে জন্মেছি, কাঁদতে আমাদের হবেই। কিন্তু এমনভাবে কাঁদবি যাতে তোর কান্নাকে মূল্যবান হিসেবে বিবেচনা করা হয়। সময়, সুযোগ বুঝে একদিন কাঁদবি। তোর কান্না হবে গ্রীষ্মের খরায় আকাঙ্ক্ষিত বর্ষণের মতো মূল্যবান। আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু হবি তুই। এভাবে যখন তখন ফ্যাচফ্যাচ করে কান্না করলে কেউ তোকে বিশেষ পাত্তা দিবে না।’
‘আমার যখন তখন কান্না পায়। আমি কি করব?’
কা‘ন্না পেলে কান্না করবি। সে কান্না লোকে দেখবে কেনো? যে কান্না নিজের জন্য কাঁদবি, তা শুধু তুই নিজে দেখবি। ঘুণাক্ষরেও যেনো অন্য কেউ দেখে না ফেলে।’
‘যা চলছে, যেভাবে চলছে তা মেনে নিয়ে হাসিখুশি থাকার অভিনয় করে যেতে বলছ?’
‘তোর জীবনে কি চলছে, তাই তো বুঝতে পারছি না, বাচ্চা।’
আদ্রিকা তাচ্ছিল্যের হাসি হাসে বলে,
‘আমার জীবনে তেমন কিছুই চলছে না। এজন্যই জীবন নিয়ে আমি হতাশ। যান্ত্রিক জীবন, যান্ত্রিক সংসার। ঘুম থেকে উঠো, রাঁধো, খাও, আবার ঘুমাও। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত আমি একলা সংসার করছি। অপরপক্ষের কোনো ইফোর্ট নেই। কখনো মনে হয়, আমি একটা একপাক্ষিক সংসার টেনে নিয়ে যাচ্ছি। বিরক্ত লাগাটা কি অস্বাভাবিক? আমার চাওয়াগুলো কি খুব বেশি?’
‘মোটেও না। তবে সমস্যাটি কি জানিস? অনেক সময় আমরা যেভাবে ভাবি, সামনের মানুষটি সেভাবে ভাবে না। তোর সামান্য চাওয়াগুলো হয়তো পরখ কখনো খেয়াল-ই করেনি। ছেলেরা সূক্ষ্ম বিষয়গুলো সহজে ধরতে পারে না। ওদের হাতে ধরিয়ে দিতে হয়, চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে হয়। তুই চাইলে খুব সহজে এগুলোর সমাধান করতে পারিস। আবার সমস্যাকে টেনে হিচড়ে আরও বড় করতে পারিস। পুরোটা তোর উপর নির্ভর করছে।’
‘আমার হাতে কিছু থাকলে আমি কবেই সবকিছু ঠিক করে ফেলতাম! আর তুমি বলছ আমার হাতে সবকিছু! কীভাবে?’
‘তোর হাতের রান্না খাওয়ার পর সে প্রশংসা না করলে, তুই নিজেই জিজ্ঞাসা করে নিবি। আজকে রান্না কেমন হয়েছে, জানতে চাইলে তুই মোটেও ছোট হয়ে যাবি না।
শুক্রবার তুই নিজেই বিশেষ কিছু রেঁধে নিলি। তা দেখে হয়তো একদিন সে নিজেও বিশেষ কিছু রান্নার আবদার করতে শিখে গেলো।
অফিসে যাওয়ার আগে তুই নিজে এসে দরজাটা খুলে দিয়ে তাকে বিদায় জানাবি। সামনে দাঁড়িয়ে থাকলে সে না তাকিয়ে যাবে কোথায়!
মাস শেষে তুই না হয় নিজেই একটা শাড়ি কিনে চাইলি। তখন যদি কিনে দিতে না চায়, তবে ঝগড়া বাঁধিয়ে দেওয়া যায়।
সেজেগুজে তুই তার সামনে দাঁড়িয়ে জানতে চাইবি, দেখো তো আমাকে কেমন লাগছে? তখন যদি তার চোখে মুগ্ধতা খুঁজে পাওয়া না যায় তবে অনুসন্ধানের ব্যাপার নিশ্চয়ই রয়েছে।
তোর ফোনে কি শুধু কল আসে? কল দেওয়ার অপশন নেই? তার কলের অপেক্ষা না করে তুই নিজেই কল দিবি।
দুপুরে তুই নিজেই একটা মেসেজ দিবি, তুমি খেয়েছ? সময় মতো খেয়ে নিও।
তার ডেকে নেওয়ার অপেক্ষা না করে তুই নিজেই তার বুকে মাথা রেখে ঘুমিয়ে যাবি।
সে কখন তোর স্বপ্নগুলো পূরণ করবে, সেই অপেক্ষায় না থেকে নিজের স্বপ্ন পূরণের পথে নিজেই এক পা এগিয়ে যা। দেখবি জীবন আর মোটেও বিরক্তিকর লাগছে না।’
আদ্রিকা মনে মনে বলল, সে মহাশয়ের ভাষার শ্রী সম্পর্কে তোমার ধারণা নেই। সে এমনভাবে কথা বলে যে, গায়ের গোশত ভেদ হাড্ডিতে গিয়ে আঘাত হানে।
তবুও বোনের উপদেশের মান রাখতে বলল,
‘তুমি বলছ যখন চেষ্টা করে দেখব। তোমার পরিকল্পনা যদি কাজ না করে তখন?’
‘যুদ্ধের ময়দানে নামার আগেই পরিণতি ভাবতে শুরু করলে সেই যুদ্ধে জেতার সম্ভাবনা অর্ধেক কমে যায়। যা হবে দেখা যাবে। তুই আগে শুরুটা কর।’
‘আচ্ছা। ঠিক আছে। তুমি বলছ যেহেতু, ট্রাই করে দেখি। পরখ আমার নতুন কর্মকান্ডে অতিষ্ট হয়ে আমাকে তুলে বাড়ির বাইরে ফেলি না দিলেই হয়।’
আদ্রতা হেসে বলল,
‘তুই ফেলনা নাকি! তুলে ফেলে দিলে আমি যত্ন করে তুলে নিব। তুই আমার বোন, আমার একমাত্র বাচ্চা।’
আবেগী আদ্রিকার চোখে আবারও জমা হতে থাকল অশ্রুকণা। নাক টেনে বলল,
‘তুমি এখানে কতোদিন আছো?’
‘হয়তো থেকেই যাবো। বিকল্প আগে যে শো-রুমে কাজ করত সেখানে রেজিগনেশন লেটার জমা দিতে গিয়েছিল। কিন্তু কোম্পানি ওকে ছাড়ল না। ওদের একটা শো-রুম আছে ভূবনভোলায়। বিকল্পের সমস্যার কথা শুনে ওকে ভূবনভোলায় ট্র্যান্সফার করে দিয়েছে। আগে সেলস এসোসিয়েট ছিল এখন বরং প্রোমোশন পেয়ে ফ্লোর ম্যানেজার হয়েছে।’
বোনের উজ্জ্বল মুখে ঝলমল হাসি দেখে আদ্রিকার ভীষণ ভালো লাগল। কতোদিন পর সত্যিকার অর্থে আনন্দিত হওয়ার একটা কারন খুঁজে পেল সে!
‘আলহামদুলিল্লাহ্। ভীষণ খুশির খবর। তোমরা এখন আছো কোথায়?’
‘আমার শ্বশুরবাড়ি। যদিও ওখানে কেউ নেই। আমার শাশুড়ি মা মা/রা যাওয়ার পর বাড়িটি ফাঁকা পরেছিল। খুব ছোট একটা আধাপাকা ঘর, টিনের একটা ছোট ঘর। তবুও আমাদের ছোট সংসারে আমরা ভীষন সুখে আছি। বিকল্প একটু একটু করে ঘরের জিনিসপত্র কিনতে শুরু দিয়েছে। আরেকটু গুছিয়ে নেই তারপর তোকে নিয়ে যাবো।’
‘ইশ! এখন নিয়ে যেতে কী সমস্যা?’
আদ্রিকার মাথায় হাত বুলিয়ে আদ্রতা বলল,
‘এখন এই পুতুলটাকে নিয়ে গিয়ে আমি কোথায় রাখব? জীর্ণশীর্ণ ঘর, বসার একটা ভালো চেয়ার পর্যন্ত নেই। এভাবে তোকে নিয়ে গেলে আমি ভীষণ লজ্জায় পরে যাবো।’
আদ্রিকা উঠে এসে বোনকে জড়িয়ে ধরে বুকে মুখ গুঁজে রইল। আদুরে বিড়ালের মত আদ্রতার গায়ের উষ্ণতা মেখে বলল,
‘তোমাকে ছাড়া আমার একদম ঘুম হয় না। মানে হতো না। আমার একদম একলা ঘুমানোর অভ্যাস নাই। তুমি সবসময় বলতে, আমি তোমার আদুরে বাচ্চা। অথচ আমাকে একলা ফেলে চলে গেলে। তোমার উচিত ছিল আমাকে সাথে নিয়ে যাওয়া। তখন নিয়ে যাওনি মেনে নিলাম। এখন ফিরে এসেছো, আমাকে সাথে নিয়ে যাও।’
‘আমি তোকে নিয়ে যাই, আর তোর জামাই আমার বাড়িতে গিয়ে ঘানা দিক। শুনেছি তোর জামাই অনেক ধনী পরিবারের ছেলে। ওমন ছেলে আমার ভাঙ্গাচোরা বাড়িতে গেলে, আমার মানসম্মান থাকবে কিছু? একটু গুছিয়ে নেই, দুজনকেই দাওয়াত দিয়ে নিয়ে যাব। আজকে বাড়ি ফিরে যা।’
‘তুমি আবার আমার সাথে দেখা করতে আসবে?’
‘আসব। আমিও এখন নিয়মিত ক্লাস করতে আসছি। সামনে পরীক্ষা। নিজে ক্লাস করে বাড়ি ফিরে আবার বিকল্পকে পড়াই। জামাই-বউ একই ক্লাসে পড়ার সুবিধা।’
‘তাহলে এখানেই দেখা করা যাবে। তুমি রোজ আমার সাথে দেখা করবে কিন্তু।’
‘হ্যাঁ। আর তুই রোজ ক্লাস মিস দিবি! মারব এক থাপ্পড়। সামনে পরীক্ষা, আর উনার তালবাহানা। ভালোমতো পড়াশোনা কর। এই বিয়ে, সংসারের চক্করে পড়াশোনা নিশ্চয়ই শিকেয় তুলে রেখেছিস। এই কয়েকটা দিন মনোযোগ দিয়ে পড়াশোনা কর। রেজাল্ট ভালো না হলে, শ্বশুরবাড়িতে মানসম্মান কিছু থাকবে না। শুনেছি, তোর জামাই অনেক ভালো স্টুডেন্ট। এখানে পড়ে এখানেরই ফ্যাকাল্টি হয়ে গেল! এমন মানুষের বউ হয়ে যদি ফেল করিস, মুখ লুকানোর জায়গা পাবি না।’
আদ্রিকা মুখ ফুলিয়ে বলল,
‘সবাই মিলে পড়াশোনার জ্ঞান দেওয়া বন্ধ করো। আমি ওতো ভালো স্টুডেন্ট না। যতোটুকু পারি চেষ্টা করব। তুমি আটটার আগেই এসে গেটের ওখানে দাঁড়িয় থাকবে। আমরা রোজ আধাঘন্টা আড্ডা দিব।’
আজকে আদ্রতা এবং আদ্রিকার ক্লাস করা হলো না। নির্দিষ্ট সময়ের পূর্বেই দুজনে নিজেদের গন্তব্যে রওনা দিল। আদ্রিকা যখন একাডেমি থেকে বের হচ্ছিল তখন বিস্ময়ের স্মৃতিরা বিদায় নিয়ে তার মস্তিষ্কে উঁকি দিল নতুন ভাবনা।
এই ক্যাম্পাসের কোনো একটি কক্ষে পরখ ক্লাস নিচ্ছে।
দৃশ্যটি কল্পনা করেই আদ্রিকার ভীষণ গর্ব হলো। কল্পনায় ময়ূরের ন্যায় পেখম মেলে নাচতে নাচতে সে একাডেমির বাকিটুকু পথ পাড়ি দিল।
প্রধান ফটকে এসে আদ্রিকাকে একটি রিক্সায় তুলে দিয়ে আদ্রতা আরেকটি রিক্সা নিয়ে বাড়ি চলে গেল। আদ্রিকার রিক্সাটি যখন ভূবনভোলা বাজারের কাছাকাছি চলে এলো তখন অনতিদূরে একটি মানব অবয়ব আদ্রিকার মনোযোগের আকর্ষণ করল।
সরু চোখে তাকিয়ে ভালোভাবে দেখার চেষ্টা করল আদ্রিকা। নিজের চোখকে তার বিশ্বাস হচ্ছে না। এই ব্যক্তি এই অসময়ে বাজারে কি করছে? তার না এখন ভার্সিটিতে থাকার কথা?
রিক্সাটি যখন কাছাকাছি এলো তখন অবয়বটি আরও স্পষ্ট হলো। পৃষ্ঠদেশের দর্শন হলেও চিনতে অসুবিধা হলো না আদ্রিকার। চিরচেনা বাইকটিও ব্যক্তিটির প্রকৃত পরিচয় প্রদান করতে সাহায্য করল। যা পরখের পাশেই দাঁড়িয়ে আছে।
সবকিছু বাদ দিয়ে আদ্রিকার দৃষ্টি আকর্ষণ করল পরখের সামনে হাস্যরত যুবতি। শাড়ি পরিহিতা অত্যন্ত সুশ্রী, সুবেশিত এবং মার্জিত নারীটির পাশে দাঁড়িয়ে পরখ নিজেও হাসছে।
আদ্রিকা অবাক চোখে দেখল পরখের সেই মুগ্ধ হাসি। যা সে আগে কখনো দেখেনি। স্ততঃস্ফূর্ত, নিস্কলুষ সে হাসি পরখের চোখে, মুখে ছড়িয়ে পরে অদ্ভুত উজ্জ্বলতা ছড়াচ্ছে। সংযত অথচ দীপ্ত সে হাসি নিশ্চিতভাবে যে কারো হৃদয়ে প্রশান্তি সৃষ্টি করতে পারে।
কিন্তু আদ্রিকার হৃদয় হয়ে উঠল অশান্ত। রিক্সা আরও সামনে এগিয়ে গিয়ে চোখের সামনে থেকে বিলীন হয়ে গেল পরখের উপস্থিতি। কিন্তু আদ্রিকার হৃদয়ে কাঁটার খচখচানি থামল না। কে সেই অপরূপ সুন্দরী নারী? পরখের সাথে তার কী সম্পর্ক?
চলবে
#অক্ষরময়ী