#পরিণয়ে_নোলককন্যা (কপি নিষেধ)
[০৩]
প্রধান সড়ক থেকে একটি গলি ভেতরের দিকে চলে গেছে। সেই গলিটি ডানে বামে কতো যে বাঁক নিয়েছে, গুনে শেষ করা যায় না। বিকল্প নিজেই মাঝেমধ্যে পথ ভুলে যায়৷
আজ রোদ উঠেছে বেশ। সূর্যের আলোয় চারদিক ঝলমল করছে৷ গ্রামের দিকে এখনো শীতের আমেজ থাকলেও ঢাকা শহরে শীতকালের কোনো চিহ্ন নেই। ভোর হতেই দাপুটে সূর্য উঁকি দেয় আকাশে৷ সারাদিন নিজের হাক ডাকে ব্যস্ত রাখে সবাইকে।
গলির শেষ মাথায় একটা চারতলা বাড়ির সামনে এসে থামলো বিকল্প। ক্লান্ত, ঘর্মাক্ত শরীর তবে মন ফুরফুরে। সিঁড়ি দিয়ে আস্তেধীরে উঠলো তিনতলায়৷ বাইরে চনচনে রোদ থাকলেও ভবনটির ভেতর অন্ধকার। চারপাশ স্যাঁতস্যাঁতে। অনেকদিন রোদবিহীন দিন কাটিয়ে ছত্রাক জন্মাতে শুরু করেছে৷
তিনতলায় উঠতে উঠতে চারদিকে তাকিয়ে বিকল্পের মন খারাপ হয়। তার গ্রাম ভূবনভোলা, উন্নত শহর না হলেও একদম গেঁয়ো গ্রামও কিন্তু নয়৷ শহর এবং গ্রামের মাঝামাঝি এক পর্যায়ের এলাকায় সে বড় হয়েছে৷ দিনে সূর্যের ঝলমলে আলো, রাতে চাঁদের মায়াবি ছায়ায় যে ছেলেটির দিন কেটেছে, তার এই অন্ধকারে কি মন টিকে? একদম টিকতে চায় না৷ তবুও টিকে থাকতে হয়। অবশ্য এসব নিয়ে বিকল্পের খুব একটা মন খারাপ হয় না।
পকেট থেকে চাবী বের কর দরজার লক খুলে ভেতরে ঢুকে সোজা চলে গেলো নিজের রুমে৷ বিছানার উপর একটি বাচ্চাকে কোলে বসিয়ে মোবাইলে কিছু একটা দেখে খিলখিলিয়ে হাসছিলো আদ্রতা। ওর হাসিমাখা মুখটি দেখে বিকল্পের মুখেও হাসি ফুটলো। ভুলে গেলো সারাদিনে ক্লান্তি৷
টেবিলের উপর মানিব্যাগ, মোবাইল রেখে হাতঘড়িটি খুলতে খুলতে বললো,
– আজকে আবার এই বাচ্চাটাকে নিয়ে এসেছো?
আদ্রতা মাথা তুলে বিকল্পের দিকে চাইলো। কোলে বসিয়ে রাখা বাচ্চাটিকে বিছানার উপর রেখে তার হাতে মোবাইলটি দিয়ে বললো,
– বাকিটা তুমি একাই দেখো। আমি তোমার ভাইয়াকে খেতে দেই।
দ্রুত পায়ে বেলকনিতে গিয়ে শুকনো কাপড় এনে বিকল্পের হাতে দিয়ে বললো,
– অন্নফ এতো কাঁদছিলো! ওভাবে কীভাবে রেখে আসতাম বলো?
হাত থেকে কাপড়গুলো নিয়ে ওয়াশরুমের দিকে যেতে যেতে বিকল্প বললো,
– ও কোথাও পালিয়ে গেলে ওর বাবা-মাকে কি জবাব দিবে? তখন দোষ তোমার ঘাড়েই পরবে। কেনো যে নিজের বিপদ ডেকে আনছো, আমি বুঝি না।
ওয়াশরুমের বন্ধ দরজার দিকে তাকিয়ে আদ্রতার মুখে আঁধার নামলো। ঘাড় ফিরিয়ে আরেকবার তাকিয়ে দেখলো নিজের ঘরে বিছানায় আসন পেতে বসে থাকা অন্নফের দিকে৷
অন্নফ, বয়স নয় বছর। গ্রামের বাড়ি পলাশবাড়ী, গাইবান্ধা। ওখানের এক স্কুলে চতুর্থ শ্রেণী পর্যন্ত পড়েছে৷ এরপর বাবা শাফায়াতের চাকরি হলো ঢাকা শহরে৷ স্ত্রী রুবাইয়া এবং ছেলে অন্নফকে নিয়ে শাফায়াত চলে এলো ঢাকায়। বড় মেয়ে অর্পিতাকে রেখে এলো নিজের মায়ের কাছে৷ গ্রামের হাইস্কুলে অষ্টম শ্রেণীতে পড়ছে অর্পিতা৷ এ বছর জেএসসি পরীক্ষা দিবে৷ পড়াশোনায় যাতে কোনো বাঁধা না আসে, তাই ওকে মায়ের কাছে রেখে আসা৷ তাছাড়া শহরে এতোগুলো মানুষের থাকা খাওয়ার খরচ হবে অনেক। নেহাৎ অন্নফ ছোট, তাই ওকে সাথে নিয়ে আসা।
তবুও বাড়ি ভাড়া, খাওয়া-দাওয়া, গ্রামের বাড়িতে টাকা পাঠানো সবমিলিয়ে বেশ টানাপোড়েনে দিন কাটে৷ রুবাইয়াকে বাড়ি ফিরে যাওয়ার কথা বলায় এ নিয়ে বেশ ঝামেলা হয়েছিল। স্বামীকে রেখে সে বাড়িতে যাবে না। আয় নিয়ে সমস্যা হচ্ছে দেখে রুবাইয়া নিজেও চাকরিতে ঢুকে গেলো। পাশেই একটা হাসপাতালে রিসেপশনিস্টের চাকরী। বেতন মোটে সাত হাজার টাকা। হোক অল্প টাকা তবুও সংসারের খরচ করতে শাফায়াতের অনেক সাহায্য এখন সে করতে পারে। ঝামেলাটা হয়েছে অন্নফকে নিয়ে।
পলাশবাড়ী থেকে এসে ওরা দুই কামরার একটা ফ্ল্যাটে উঠেছিল। ভাড়া দশ হাজার টাকা। সবদিক সামলে উঠতে না পেরে রুবাইয়া চাকরি করা শুরু করলো। সেই সাথে পাশের রুমটাও সাবলেটে ভাড়া দিয়ে দিয়েছে গতমাসে৷ এতে ফ্ল্যাটের ভাড়া অনেক কমে এসেছে।
অন্নফের ঝামেলাটাও সামনের বছর মিটে যাবে। পাশেই একটা মাদ্রাসার খোঁজ পেয়েছে রুবাইয়া। ওখানেই অন্নফকে ভর্তি করে হোস্টেলে রেখে দিবে। কয়েকদিন অন্নফকে রেখে যাওয়া হয়েছিল ঘরের ভেতর তালাবদ্ধ করে। কিন্তু ছেলেটা যা দুষ্টু! তালা খুলে বেরিয়ে যায়। একবার ভর দুপুরে দরজার লক খুলে অন্নফ বেরিয়ে গেলো। সন্ধ্যার দিকে অফিস থেকে ফিরে এসে রুবাইয়া দেখলো অন্নফ বাড়িতে নেই। শাফায়াতও হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলো অফিস থেকে। আশেপাশে খোঁজ খবর নিয়ে অন্নফকে পাওয়া গেলো গলির মোড়ের এক দোকানে৷ একলা বাচ্চাকে ঘুরঘুর করতে দেখে দোকানী ডেকে নিজের পাশে বসিয়ে রেখেছিল। এদিকে বাচ্চাটি নিজের বাড়ি হারিয়ে ফেলেছে৷ ঠিকানা ঠিকঠাক বলতে পারছে না৷
বাধ্য হয়ে দোকানি অন্নফের সাথে গল্প করেছে, খেতে দিয়েছে, পাশে বসে লুডু খেলেছে। মূলত সে বাচ্চার বাবা-মায়ের অপেক্ষা করছিল। বাচ্চাকে একলা ছেড়ে দিলে আবার না জানি কোথায় চলে যায়!
সে যাত্রায় অন্নফকে ফিরে পেলেও রুবাইয়া ভীষণ ক্ষেপে গিয়েছিলো৷ এখন অন্নফকে ঘরের ভেতর বেঁধে রেখে যায়৷ ওসব কান্নাকাটি আর মায়ের মন গলাতে পারে না৷
গোসল সেড়ে টি শার্ট, ট্রাউজার গায়ে তোয়ালে দিয়ে মাথার চুল মুছতে মুছতে বাইরে আসলো বিকল্প৷ ততোক্ষণে ফ্লোরে খাবারের আয়োজন করে ফেলেছে আদ্রতা৷ বিকল্প সোজা গিয়ে বসলো ভাতের প্লেটের সামনে। ওকে চুপচাপ খেতে দেখে আদ্রতা বললো,
– তুমি রাগ করেছো?
ওর প্রশ্ন শুনে খাওয়া বন্ধ করে বিকল্প মাথা উঁচু করে তাকালো৷ অবাক হয়ে বললো,
– রাগ? রাগ করবো কেনো?
– অন্নফকে নিয়ে এসেছি বলে।
– অন্যের ব্যক্তিগত বিষয়ে হস্তক্ষেপ করা আমার পছন্দ না, আদ্রতা। ওর বাবা-মা যদি বাচ্চাকে ওভাবে রেখে নিশ্চিন্তে অফিস করতে পারে তাহলে তুমি পারছো না কেনো?
– ও খুব কাঁদছিলো৷ দেখে আমি আর থাকতে পারলাম না।
– সহ্য করতে না পারলে দেখতে গিয়েছিলে কেনো?
– আন্টি, আন্টি বলে ডাকছিলো৷ আমি ভাবলাম পরে গিয়ে ব্যথা পেয়েছে। তাই দৌড়ে রুমের দরজা খুলে ভেতরে গিয়ে দেখি উপুড় হয়ে শুয়ে কাঁদছে৷ আমাকে দেখে বললো, আন্টি আমার ঘাড় ব্যথা করছে। একটু সোজা করে শুইয়ে দেও৷ সোজাভাবে শুয়ে দেওয়ার পর আবার চিৎকার করা শুরু করলো৷ হাতে নাকি ব্যথা লাগছে৷ উঠে বসিয়ে ভালোভাবে চেক করে দেখলাম হাতের কব্জি ছিলে গেছে৷ আমি কি করতাম বলো?
– ওর মাকে জানিয়েছো?
– ফোন করেছিলাম। বললাম, আপু অন্নফ খুব কাঁদছে৷ শেকলটা হাতের সাথে ঘষা খেয়ে অনেকটা কেটে গেছে। হাতটা খুলে দেই? উনি আঁতকে উঠে বললেন, না ভাই। হাত খুলে দিও না। দরজা খুলে পালিয়ে যাবে৷ এর আগেও বেশ কয়েকবার পালিয়েছে৷ ওর কান্নাকাটি তুমি দেখতে যেও না৷
– বেশ তো। তুমি চলে আসতে৷
– বাচ্চাটা কী অসহায় ভাবে তাকিয়ে ছিলো৷ বারবার বলতেছিল, আন্টি আমাকে এভাবে রেখে যেও না৷ হাতটা খুলে দেও না একটু৷ ব্যথা পাচ্ছি।
বলতে বলতে আদ্রতার কন্ঠ রোধ হয়ে এলো। কখন ওর দু চোখে জল জমেছে বিকল্প খেয়াল করেনি৷ হঠাৎ ওকে কাঁদতে দেখে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলো বিকল্প৷ অস্থির হয়ে বললো,
– আহা! তুমি কাঁদছো কেনো?
আদ্রতার কান্নার গতি আরও বাড়লো যেনো৷ কাঁদতে কাঁদতে বললো,
– এভাবে কে নিজের বাচ্চাকে শেকল পরিয়ে রাখে! পেছন দিকে হাত মুড়ে লোহার শেকল দিয়ে হাত বেঁধে রেখে যায় প্রতিদিন।
– অন্নফেরও তো দোষ আছে। দরজার লক খুলে পালায় কেনো বারবার?
– ওর কি দোষ? ছোট একটা বাচ্চা৷ এটা ওর খেলার বয়স, দৌড়ানোর বয়স, উড়ার বয়স৷ সারাদিন ঘরে আবদ্ধ হয়ে আর কতোই থাকবে? ও গ্রামের বাচ্চা৷ হৈ হুল্লোড় করে শৈশব কাটিয়েছে৷ এখন হঠাৎ করে শহরের বদ্ধ পরিবেশে একলা ওর মন টিকে? মা টাও পাশে থাকে না। এভাবে বাচ্চাটাকে কষ্ট দেওয়ার কোনো মানে হয়?
– এরা বাচ্চা নেয় কেনো? বাচ্চাকে দেওয়ার মতো সময় নেই অথচ বাচ্চা চাই। বাচ্চা নেওয়ার আগে ভাবে না৷ বাচ্চারও কষ্ট, নিজেরও কষ্ট৷ বাদ দেও এসব৷ তুমি অযথা রিস্ক নিতে যেও না৷ তুমি হাত খুলে দিবে, তারপর যদি তোমাকে ফাঁকি দিয়ে এই বাচ্চা বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায় তখন ওর বাবা মাকে তুমি কি জবাব দিবে?
– এসব দেখে আমি চুপ থাকতে পারি না, বিকল্প৷ আমার খুব খারাপ লাগে। অন্নফের মুখটা দেখলে আমার কান্না পায়। আমি তো ঘরে বসেই আছি৷ থাকলো এইটুকু সময় আমার কাছে৷
– তারপর তুমি যখন থাকবে না? তখন তো ওকে এভাবেই ঘরে বন্দী হয়ে দিন কাটাতে হবে৷
– কোথায় যাবো আমি?
– ভাবছি বাড়ি পাল্টাবো।
– আমার জন্য? নাহ, নাহ৷ এমন করো না৷ এখনো মাস শেষ হয়নি৷ এডভান্স দিয়েছো৷ এখন বাড়ি পাল্টানো আরেক ঝামেলা। অন্নফকে আমি আর নিয়ে আসবো না৷ তুমি চিন্তা করো না৷
– সেজন্য নয়৷ বাড়িটা স্যাঁতসেঁতে, ভেজা। কেমন অন্ধকার হয়ে থাকে সারাক্ষণ। এখানে বেশিদিন থাকলে তুমি অসুস্থ হয়ে পরবে।
– আমার কিছু হবে না৷ আমি এখানেই ঠিক আছি৷ এখন বাড়ি পাল্টানোর কোনো দরকার নেই৷ কয়েকটা মাস এখানেই থাকি৷ সবে নতুন চাকরিতে জয়েন করেছো৷ কতোটুকুই বা আয় আমাদের৷
বিকল্প মুচকি হাসলো। সামান্য ওই ‘আমাদের’ কথাটিতে কী যেনো ছিলো। যা বিকল্পের সমস্ত হতাশা, না পাওয়া মুছে দিলো নিমিষেই। সে আদ্রতাকে বললো,
– তুমি খাবার নিচ্ছো না কেনো? বেলা গড়াতে চললো। আর কখন খাবে?
প্লেটে ভাত তুলতে তুলতে আদ্রতা তাকালো অন্নফের দিকে। সে মোবাইলে মনোযোগ দিয়ে কার্টুন দেখছে। হঠাৎ বিকল্প ডাক দিলো।
– অন্নফ?
মোবাইল থেকে চোখ তুলে বিকল্পের দিকে তাকিয়ে অন্নফ হাসে। সেই স্নিগ্ধ হাসি দেখে ওদের দুজনের মন কেমন করে উঠলো। মনের হাহাকার লুকিয়ে বিকল্প বললো,
– এসো আমাদের সাথে ভাত খাবে।
– আমি তো খেয়েছি৷ একটু পর আম্মু এসে আবার খেতে দিবে।
– এখন আমাদের সাথে একটু খাও। এসো, আমার পাশে বসো।
মোবাইল রেখে অন্নফ ছুটে এসে বসলো বিকল্পের পাশে। আদ্রতা খুব যত্নসহকারে ভাতের প্লেটে ভাত তুলে অন্নফের সামনে দেয়। তরকারি দিতে গেলে অন্নফ বললো,
– আন্টি আমি মুরগীর রানটা খাবো।
আলতো হেসে আদ্রতা ওর পাতে মুরগীর রান তুলে দিলো।
******
এমন শীতের সকালবেলা আগে কখনো আদ্রিকার ঘুম ভাঙ্গতো না। নীহারের বকাঝকা দিয়ে শুরু হতো দিন। একসময় গালির বর্ষণে বিছানা ভারী হয়ে উঠলে সে বিছানা ছাড়তো৷ কিন্তু এখন আদ্রিকাকে ডেকে দিতে হয় না। সে নিজেই কাকডাকা ভোরে বিছানা ছেড়ে উঠে বেরিয়ে আসে বাইরে। বাড়ির আঙ্গিনার ঘাসের উপর নগ্ন পায়ে হাঁটে৷ ঘাসের উপর জমে থাকা শিশির মাড়িয়ে পর্তুলিকার হাসি দেখে। সাদা, গোলাপি, হলুদ কতো রঙের পর্তুলিকা ফুটেছে বাগানে।
হাত-মুখ ধুয়ে হাড়ি পাতিল নিয়ে বাইরে এসে মেয়ের কার্যকলাপ দেখে বিরক্ত হয় নীহার৷ সাবধান করে ওকে৷
– খালি পায়ে হাঁটতেছিস কেনো? স্যান্ডেল কই তোর? স্যান্ডেল পর।
মায়ের ডাকে পেছন ফিরে তাকায় আদ্রিকা৷ গতকাল দুপুরবেলা বাড়ি পেছনে পরে থাকা শুকনো পাতাগুলো ঝাড়ু দিয়ে বস্তা ভরে নিয়ে এসে রেখেছিলো নীহার৷ আজকে সেই বস্তা থেকে পাতা বের করে মাটির চুলায় আগুন দিলো। বাইরে শীতের হিমেল হাওয়া বইছে৷ মোটা সোয়েটারও সেই হাওয়ার সাথে লড়াইয়ে হেরে যায়।
সেই ক্ষ্যাপাটে হাওয়া-বাতাসকে উপেক্ষা করে একটা টুল নিয়ে বাইরের আঙ্গিনায় নীহার বসেছে চা বানাতে৷ পাতিলে পানি নিয়ে চুলার উপর বসিয়ে দিয়ে আদ্রিকাকে আবার ডাক দিলো।
– পেছনের ক্ষেত থেকে একটা আদার গাছ তুলে নিয়ে আয়। তার আগে স্যান্ডেল পায়ে দে৷ একবার বললে কথা শোনার মানুষ না তোরা৷
প্রতিবার ‘তোরা’ বলতে নীহার কাদের বুঝায়? আদ্রিকা জানে না। নীহারের জীবনে এখন সে ছাড়া আর কেউ তো নেই৷ এই কথাটা বুঝতে এবং মেনে নিতে নীহারের কতোদিন লাগবে কে জানে! আদ্রিকার মাঝেমাঝে মনে হয়, আদ্রতা পালিয়ে যাওয়ায় ওর উপর যতোটা রেগে থাকা দরকার ততোটাও রেগে নেই নীহার৷ কখনো আদ্রতার নামে কোনো নালিশ করতে সে শুনেনি৷ শুধু নিজের মানসম্মান নষ্ট হওয়ায় বেজায় ক্ষেপেছে ওদের বাবা। এছাড়া আর কোনো কিছুর চিন্তা কারো মধ্যে দেখা যাচ্ছে না। বাড়ির মেয়ে কয়েকদিন ধরে নিখোঁজ, অথচ কেউ তার খোঁজ করার প্রয়োজন অনুভব করছে না৷ কারো মধ্যে কোনো দুশ্চিন্তা নেই৷ শুধু বাড়ি জুড়ে একটা শূণ্যতা অনুভব করা যায়৷
একটা আদার গাছ তুলে এনে নীহারকে দিয়ে আদ্রিকা বললো,
– এই নেও।
– ঘরে ব/টি আছে৷ নিয়ে এসে ছিঁলে দে৷ আসার সময় তুলসীগাছ থেকে কয়েকটা পাতা ছিঁড়ে নিয়ে আসিস।
আদা বেটে পানিতে দিয়ে ভালোভাবে ফুটিয়ে নিয়ে হালকা লিকার দিয়ে লাল চা বানালো। তাতে দুটো তুলসী পাতা ছেড়ে দিয়ে এক চামচ মধু মিশিয়ে আদ্রিকার হাতে চায়ের কাপ ধরিয়ে দিয়ে বললো,
– যা তোর বাপকে দিয়ে আয়।
চায়ের কাপ হাতে আদ্রিকা বিস্ফোরিত চোখে চেয়ে আছে ওর মায়ের দিকে। মেয়ের এমন চাহনীর সামনে পরে নীহার বুঝি খানিকটা থিতিয়ে গেলো৷ মাটির পাত্রে চাল দিয়েছে। সেগুলো নেড়েচেড়ে দিতে দিতে বললো,
– তোর বাপের ঠান্ডা লেগেছে। কালকে সারারাত মানুষটা কাশতে কাশতে একটুও ঘুমায় নাই। যা তাড়াতাড়ি দিয়ে আয়।
টানা কয়েকদিন এই মানুষটার হাতে বেধড়ম মা/র খেয়েছে নীহার। এখনো যে নীহারকে দেখলে তেড়ে আসে মা/রতে, তার জন্য যত্নসহকারে চা বানাতে দেখে সকালবেলা আদ্রিকার মেজাজটা বিগড়ে গেলো। বিকৃত মুখে চায়ের কাপ হাতে নিয়ে চললো বাবার ঘরের দিকে।
আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চিরুনি করছিলো মোকাররম। আদ্রিকার মনে হলো ওকে দেখতে পেয়ে এখুনি চিরুনি দিয়ে এক ঘা বসিয়ে দিবে ওর গায়ে। মনে মনে এক ছুটে ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নিয়ে সে চায়ের কাপটা রাখলো বিছানার পাশের টেবিলে। মাথা নিচু করে ধীমে স্বরে বললো,
– তোমার চা।
আয়নার মাধ্যমে মেয়ের দিকে তাকিয়ে মোকাররম জবাব দিলো,
– রেখে যা।
আদ্রিকা ফিরেই আসছিলো তখনি শুনলো মোকাররমের পরবর্তী কথা।
– হাতে টাকা পয়সা কিছু নাই। তোর বোন তো নাগরের হাত ধরে ভাগছে। লসের হাড়ি গলায় ঝুলছে আমার। পাওনাদার টাকার জন্য আড়তে এসে দাঁড়ায় ছিল। গাছগুলা বেঁচে ঋণ শোধ করা লাগছে৷ এখন আর আমার হাতে কোনো টাকা পয়সা নাই। বেঁচার মতোও কিছু নাই। কারো কোনো খরচ চালাইতে পারবো না আর। আমার আশা বাদ দিয়া সবাই নিজের নিজের রাস্তা মাপ। যতদিন সামর্থ্য ছিল, আমি খাওয়াইছি। আর পারবো না।
মোকাররমের কথা শেষ হতেই আদ্রিকা দ্রুত পায়ে ঘর ছাড়লো। বাইরে এসে দেখে নীহারের চাল ভাজা শেষ। দুটো কাপে চা ঢেলে মেয়ের অপেক্ষা করছে।
মায়ের পাশে বসে ওমন শীতল আবহাওয়ায় গরম চায়ের কাপে চুমুক দিতে মন্দ লাগছে না। চায়ের কাপে ভাজা চাল ছেড়ে দিয়ে সে প্রশ্ন করলো,
– যেই মানুষটা দুদিন আগেও তোমাকে মা/রলো, গালি দিলো তার জন্য রান্নাবান্না করো কেমনে? তোমার রাগ লাগে না?
মেয়ের মুখে হঠাৎ এমন কথা শুনে নীহারে হাত থমকালো। আজকাল চারপাশে আশ্চর্যজনক ঘটনা ঘটছে। তার বোকাসোকা, নির্ভেজাল মেয়ের মুখে এমন প্রশ্ন শুনে নীহার নড়েচড়ে বসলো। মেয়ের মনে নিশ্চয়ই চলতি ঘটনার প্রভাব পরেছে। কিন্তু নীহার যে জ্ঞানের কথা জানে না। ছোট থেকে মায়ের কাছে শুনে এসেছে, স্বামীর বাড়ি মেয়েদের একমাত্র আশ্রয়স্থল। আর স্বামী একমাত্র ভরসা।
সে বলল,
– ওই মানুষটা ছাড়া আমার আর কে আছে? তার উপর রাগ করে আমার কোনো লাভ হবে? অযথা রাগ করবো কেনো? বাবা-মা মারা গেছে সেই কবে! ভাইদের নিজের নিজের সংসার হইছে৷ তোরা বিয়েশাদি করে নিজের সংসারে চলে যাবি। আমার জন্য থাকবে শুধু ওই মানুষটা। বুড়া-বুড়ি একজন আরেকজনের ভরসা হয়ে দিন কাটাবো। মা/রুক, কা/টুক যাই করুক। দিনশেষে স্বামী ছাড়া মেয়েদের আপন বলতে আর কেউ থাকে না। বাচ্চারা বড় হলে নিজের জীবন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে যায়৷ মানুষটা যতোদিন বেঁচে আছে, আমার একটা অভিভাবক আছে। এই সমাজে নিরাপত্তা আছে। একটা ঘর আছে, দু মুঠো খাওয়ার যোগাড় করে এনে দেওয়ার মানুষ আছে। এই মানুষটা না থাকলে আমি কই গিয়ে দাঁড়াবো। একটার মেয়ের মূল শক্তি তার স্বামী।
চামচ দিয়ে চায়ে ভেজা চালভাজা তুলে মুখে দিয়ে আদ্রিকা ঠোঁট বাঁকিয়ে হেসে বলল,
– ঘর আছে, খাবার আছে! পান থেকে চুন খসলেই বাড়ি থেকে বের করে দেয়। মাস খানেক ধরে বাড়ির বাজার-সদাই আনা বন্ধ করছে। একটু আগেই বললো, আমাদের ভরনপোষণ সে করতে পারবে না। এটাই তোমার শক্তি?
– রেগে আছে তাই এমন কথা বলেছে। খরচ নিয়ে আসেনি বলে কি আমরা না খেয়ে আছি? এই যে ভাত খাচ্ছি, চাল কই থেকে আসছে? তোর বাপের টাকায় কেনা চাল। একসাথে বস্তা ভরে এনে দিয়েছিল। তাই খেয়ে বেঁচে আছি। শাক সবজি রান্না করতেছি সেগুলাও তোর বাপের জমিতেই চাষ করছি। তেল, মশলা, নুন সব ওই মানুষটার টাকায় কেনা। আমি শুধু একটু জমিয়ে রেখেছিলাম। এখনো যে ঘরে ঘুমাচ্ছিস সেটাও ওই মানুষটার টাকায় তৈরি করা। বের করে দিবো বললেও কি বের করে দিয়েছে? তোদের নিয়ে আমাকে কি কখনো রাস্তায় থাকতে হয়েছে? হয়নি তো। পুরুষ মানুষ রেগে গেলে অনেক কথা বলে৷ তখন ওদের মাথা ঠিক থাকে না। সব কথা ধরতে নাই। মনে পুষে রাখতে নাই৷ এতো নাকউঁচু স্বভাব নিয়ে কখনো সংসার হয় না। সব সংসারে টুকটাক ঝামেলা হয়। অধৈর্য্য হইতে নাই৷
মেয়েদের একটু ধৈর্য্য ধরে, মাথা নিচু করে চলতে হয়৷ তবেই সংসারে উন্নতি আসে। না হলে যতো ভালো ঘরে বিয়ে হোক না কেন, কখনো সংসার টিকবে না৷
এঁটো থালা বাসন গুটিয়ে লম্বা লম্বা পা ফেলে নীহার চলে গেলো বাড়ির ভেতর। থালা বাসনগুলো ধুতে আবার দুপুরের রান্নার আয়োজন করতে হবে৷ চায়ের কাপ হাতে আদ্রিকা অসাড় হয়ে বসে রইলো। মা হঠাৎ এতো রেগে গেল কেনো? আজব! সে কী এমন অযৌক্তিক প্রশ্ন করছে? যার হাতে মা/র খেলো এখন তার হয়েই ল/ড়াই করছে! মেয়ে জাতটাই বেহায়া। স্বামী ছাড়া কিছু বুঝে না৷
চলবে….
লেখনীতে: অক্ষরময়ী
#পরিণয়ে_নোলককন্যা (কপি নিষেধ)
[০৪]
অনেকক্ষণ ধরে খোঁজাখুঁজির পর আশেপাশে অনেক জিজ্ঞাসাবাদ করে অবশেষে ভূবনভোলা সরকারি কলেজের পেছনে যে নোংরা পুকুরটি রয়েছে তার পাশের চিকন রাস্তা ধরে একটু এগিয়ে কাঙ্খিত স্থানে এসে পৌঁছালো মোকাররম।
বাঁশের বেড়া দিয়ে ঘেরা কয়েক শতক জমির উপর একটি নার্সারি। জীর্ণশীর্ণ চারপাশ। ঘুপচি জায়গায় অন্ধকার পরিবেশে ফুটন্ত ফুলগুলো কেমন মলিন দেখাচ্ছে। মোকাররম এগিয়ে গিয়ে নার্সারির মালিকের খোঁজ করলো।
টিনের চালাঘরের ভেতর থেকে বেড়িয়ে এলো একজন পৌঢ়। উলের মোটা সোয়েটারের উপর কাশ্মীরি চাদর জড়ানো। ট্রাউজারের উপর লুঙ্গিও পরেছে। পায়ে কালো মোজা এবং রাবারের স্যান্ডেল। নাকের ডগার উপর পরে থাকা চশমাটি ঠিকভাবে চোখে পরে পৌঢ় তাকালেন মোকাররমের দিকে। উনার চোখে মুখে উপচে পরছে বিরক্তিভাব। সেদিকে তোয়াক্কা না করে মোকাররম বললো,
– শুনলাম আপনার কাছে বিভিন্ন রঙের বাগানবিলাস আছে। কয়েকটা চারা নিতাম।
শীতের দিনগুলো সময়ে অসময়ে ঘুমিয়ে কেটে যায়৷ ঘাড় উঁচু করে আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখলেন, সূর্য উঁকি দিচ্ছে এবং মাথার উপরে অবস্থান করার উদ্দেশ্যে অনেকখানি পথ অতিক্রম করে ফেলেছে। দুপুর গড়াতে আর বেশিক্ষণ বাকি নেই। আজ অনেকবেলা পর্যন্ত বিছানায় অবস্থানের কারনে পৌঢ় নিজের উপর বেজায় নারাজ হলেন। সামনে দিকে পা বাড়িয়ে মোকাররমের উদ্দেশ্যে বললেন,
– পেছনের দিকে আছে। আমার সাথে আসো।
চালাঘরের পেছনের দিকে কিছু বাগানবিলাসের দেখা পাওয়া গেলো। একটি গাছেও ফুল নেই৷ ছোট ছোট কয়েকটা চারাগাছ। মোকাররমের পছন্দ হলো না। পৌঢ় হয়তো ওর মনোভাব বুঝতে পেরেছেন। কিন্তু তোষামোদ করতে গেলেন না৷
নির্দিষ্ট চারাগাছ চিহ্নিত করে বললেন,
– এটা হলুদ, এটা লাল, এটা কমলা, এটা গোলাপি, এটাতে সাদা এবং সোনালি দুটোই ফুটে। মানে এক ফুলের অর্ধেকটা সোনালি, অর্ধেকটা সাদা৷ তুমি কোন রঙের নিবা?
মোকাররমের দ্বিধা হচ্ছিলো অনেক। বললো,
– গাছ এতো ছোট! ফুল ফুটবে কবে?
– কলম কেটে চারা করছি। চার মাসের মধ্যেই ফুল আসবে ইনশাআল্লাহ।
– ফুল আসার পর যদি আপনার কথামতো ফুলের রঙ না পাই? সাদা বাগানবিলাস মনে করে যত্ন করলাম, পরে দেখা গেল ফুল ফুটছে গোলাপি। আমি বরাবর দুধ কলা দিয়ে কালসাপ পুষি। শেষমেশ আমারেই ছোবল মারে।
– এমন হইলে আমার গাছ সসম্মানে আমারে ফিরায় দিয়ে যাবা। এখানেই থাকবো, কোথাও পালাবো না৷ গাছ ফেরত দিয়ে নিজের টাকা ফেরত নিয়ে যাবা। কোনটা নিবা তাড়াতাড়ি কও।
মানুষজনকে সহজেই বিশ্বাস করে ফেলার স্বভাবটা তার জন্মগত। সহজাত স্বভাবের বাইরে সে কি করে যায়! বললো,
– সবগুলা। আপনার কাছে যতোগুলো রঙের চারা আছে, সবগুলাই একটা করে দেন।
– যত্নআত্তি করতে পারবা তো? কলম গাছ হলেও অনেক যত্ন করতে হবে কিন্তু৷ না পারলে নেওয়ার দরকার নাই। শখের বশে গাছ কিনে নিয়ে গিয়ে অযত্নে গাছ মে/রে ফেলা আমার পছন্দ না। এর থেকে আমার গাছ আমার বাগানেই পরে থাকুক, তাও ভালো।
পৌঢ় ব্যক্তিটি নিজের মতো বকবক করতে করতে চারাগাছগুলো প্যাকিং করতে লাগলেন। এতোগুলো গাছ মোকাররমের একার পক্ষে বয়ে আনা সম্ভব হলো না। পৌঢ় নিজেই কিছু চারা রাস্তা পর্যন্ত বয়ে এনে একটা ভ্যানে তুলে দিলেন।
দাম দিতে গিয়ে হঠাৎ মোকাররমের খেয়াল হওয়ায় সে বললো,
– আপনার কাছে সাদা অপরাজিতা আছে?
– এখন নাই। দু সপ্তাহ পর পাবা।
– আচ্ছা। আমার একটা লাগবে৷
গাছগুলো নিয়ে বাড়ি ফিরে নীহার কিংবা আদ্রিকার দেখা পাওয়া গেলো না। ওরা বাড়ির ভেতর দুপুরের রান্নার আয়োজন করছে। মোকাররম কাউকে ডাকলো না। ভ্যানচালকসহ ছোট ছোট চারা গাছগুলোকে ছাদে নিয়ে গেলো। ছাদে একপাশে নতুন কিছু মাটির টব ছিলো। তাতে মাটি ভরে সযত্নে বাগানবিলাসের চারাগুলো রোপন করে ঝাঁঝড়ি দিয়ে পানি দিলো। রোদের দিকে টবগুলো সরিয়ে রেখে নেমে এলো নিচে।
বাইরের ট্যাবে হাত-পা ধুয়ে ওই ভ্যানে চড়ে চলে এলো আড়তে। নিজের চেয়ারে বসে মনটা একটু শান্ত হলো। ছোট মেয়েটা ওর মতোই গাছ পাগল। গাছের প্রতি ওর ভালোবাসা দেখে মোকাররমের ভীষণ ভালো লাগে। মেয়ের মাঝে নিজের কৈশোরকে খুঁজে পায়। সেও একসময় এমন গাছ পাগল ছিলো। যেখানেই ফুলের গাছ দেখতো তুলে নিয়ে চলে আসতো।
মোকাররমের এখনো মনে আছে, তখন সে নবম শ্রেণিতে পড়ে। বার্ষিক পরীক্ষা দেওয়ার সময় হাইস্কুলের পেছনের পরিত্যক্ত জমিতে অনেকগুলো মোরগঝুটির চারা দেখেছিলো। প্রতিদিন পরীক্ষা শেষে দুটো চারা তুলে নিয়ে সে বাড়ি ফিরে যেতো। শোয়ার ঘরের পেছনে চারাগুলো লাগিয়েছিল। ওদিকটায় ভারী সুন্দর রোদ পরে৷ শীতের ঘন কুয়াশার মাঝে মিঠে রোদ এসে খেলা করতো সবুজ-লাল পাতার গায়ে। দেখতে দেখতে গাছগুলো তড়তড়িয়ে বেড়ে উঠলো। একেকটা গাছে চার পাঁচটা করে শাখা হলো। শাখা-প্রশাখার ডগায় ফুটতে শুরু করলো লালচে মোরগঝুটি ফুল। ঠিক যেনো মোরগের মাথা শোভাকৃত রাজকীয় মুকুট। সকালে ঘুম থেকে উঠেই মোকাররম ছুটে যেতো ঘরের পেছনে। কুয়াশায় স্নান সেড়ে ফুলগুলো তখন সিক্ত। মুগ্ধ চোখে ওদের চেয়ে দেখতো, একটু ছুঁয়েও দিয়ে আসতো।
মোকাররম ভেবেছিল, ফুলগুলো থেকে যখন বীজ হবে, সেগুলো সংগ্রহ করে রাখবে পরের বছরের জন্য।
কিন্তু তা আর হলো কোথায়! একদিন মোকাররমের বাবা এলেন বাড়ির পেছনের জঙ্গল পরিষ্কার করতে৷ একজাতের এতো ফুলের গাছ দেখে ছেলের প্রতি বিরক্ত হলেন। হাতের দা দিয়ে একের পর এক কো/প বসালেন তাগড়া যুবতী গাছের গায়ে৷ ফুলসহ রূপবতী পূর্ণযৌবনা গাছগুলো লুটিয়ে পরলো মাটির উপর।
মাঠে ফুটবল খেলতে গিয়েছিল মোকাররম। বাড়ি ফিরে ফুলগুলোর এই অবস্থা দেখে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। একটা গাছ বাদে বাকিসব নিথর হয়ে পরে আছে মাটিতে। ওদের প্রাণহীন দেহের পাশে বসে সেদিন সূর্যের ঢলে পরা দেখেছিল সে৷ অভিমান হয়েছিল কিন্তু বরাবরের মতো তা প্রকাশে ব্যর্থ ছিল।
সেই জীবন্ত একটা গাছকে কেন্দ্র করে আবার উঠে দাঁড়িয়েছিল ঠিকই কিন্তু মৃ/ত গাছগুলোর শোক কি এতো সহজে ভুলা যায়?
আজ আদ্রিকার মলিন মুখের দিকে চেয়ে সেই দিনের স্মৃতি আবারও নাড়া দিয়ে উঠলো। কিন্তু মোকাররমের বা কি করার আছে! হাতে টাকা পয়সা তেমন একটা নেই। একশ-দুইশ টাকা তো নয়। এ যে লাখ টাকার ব্যাপার৷ এই বিপদ থেকে উদ্ধারের জন্য সে অবশ্য মনে মনে আদ্রিকার প্রতি প্রসন্ন এবং কৃতজ্ঞ। শুধু মুখ ফুটে মেয়েকে কিছু বলতে পারছে না, এই যা৷
মোকাররম ঠিক করলো, চারা গাছগুলো থেকে সে নিজ হাতে বাহারী রঙের বাগানবিলাসের একটি গাছ সাজিয়ে দিবে আদ্রিকাকে৷
*****
আজ যাবো, কাল যাবো করতে করতেও এদিকটায় আসা হয়ে উঠে না। তাই তো আজ সব কাজ ফেলে মোজাম্মেল এসেছে মোকাররমের চালের আড়তে। চেয়ারে আসন গ্রহণ করে মোকাররমের উদ্দেশ্যে বললেন,
– ব্যবসার কি অবস্থা?
ভাইয়ের জন্য চায়ের অর্ডার করে মোকাররম বসলো নিজ আসনে। প্রশ্ন শুনে মুখটা বাংলা পাঁচের মতো বাঁকিয়ে বললো,
– আর ব্যবসা! দোকানের ভাড়াটাও ঠিকঠাক উঠতেছে না। এই ব্যবসা আর চলবে না।
– উঠতি পোলাপাইনদের সাথে ব্যবসায় তুমি টিকতে পারবা না। ওরা কতো নতুন নিয়ম কানুন আনছে ব্যবসায়। আমরা পুরনো আমলের মানুষ সেসব বুঝিও না, মানিও না৷ এখন আর ব্যবসায় লাভের আশা করা বোকামি। ওসব বাদ দেও৷ নার্সারিটা যা একটু চলে। ওটাতেই মনোযোগ দেও। যা আয় হবে, তোমরা দুটো মানুষ দিব্যি চলতে পারবা৷
– দেখি কি করা যায়। আপনি চা নেন।
হাত বাড়িয়ে চায়ের কাপ হাতে তুলে নিয়ে তাতে চুমুক দিলেন মোজাম্মেল। কোন সস্তা হোটেল থেকে চা আনিয়েছে কে জানে! একটুও স্বাদ নাই। চায়ের কাপ নামিয়ে তিনি আলোচনায় ফিরে গেলেন।
– যা গেছে তা ধরে আর কতোদিন বসে থাকবা? শুনলাম, বাড়িতে খাওয়াদাওয়া বন্ধ করছো। ঠিকঠাক বাড়ি যাও না, খরচপত্র কিছু দেও না। এগুলা কী ধরনের কাজকর্ম? নাহ, নাহ। এসব অন্যায়। বাড়ির বউয়ের উপর এমন জুলুম আমি কিছুতেই বরদাস্ত করবো না।
– ওই মহিলার জন্যই আমার মানসম্মান নষ্ট হইছে৷ ওই লাই দিয়া দিয়া মেয়েগুলারে মাথায় উঠাইছে৷ আগেই কইছিলাম, এতো পড়াশোনার দরকার নাই৷ মেয়ে বড় হইছে, বিয়ে দিয়ে দেই৷ নাহ, সে মেয়েরে পড়াবে৷ জর্জ, ব্যারিস্টার বানাবে৷ বানাইছে না? মুখে কালি মাখায় দিয়া মেয়ে ভাগছে৷ বাজারঘাটে চলা যায় না লজ্জায়৷ যারা কখনো আমার দিকে চোখ তুলে তাকানোর সাহস করে নাই, তারা এখন আমারে ডেকে প্রশ্ন করে৷ কি মোকাররম ভাই, শুনলাম আপনার বড় মেয়েটা বিয়ের আসর থেকে ভাগছে। কার সাথে ভাগছে, এখন কোথায় আছে? আরও নানান ধরনের প্রশ্ন। লজ্জায় বাইরে বের হওয়া যাচ্ছে না৷
– দোষ একার নীহারের না। তোমারও সমান দোষ আছে৷ তোমার ভাবি যখন বিয়ের কথা কইলো তখনি বিয়ের আয়োজন করে ফেললে এতো ঝামেলা হইতো না৷ তখন তোমারও ভাব বাড়ছিলো৷ মেয়ে ভার্সিটিতে চান্স পাইছে৷ অহংকারে মাটিতে পা পরে না। মেয়েরে ভার্সিটিতে ভর্তি করাইবা। ওই ভার্সিটিতে গিয়েই মেয়ের ডানা গজাইছে।
– তখন কি আর এতো কিছু বুঝছি? কে জানতো আদ্রতা এমন কিছু করবে? রক্ত জল করা টাকায় বাচ্চা মানুষ করছি, পড়া লেখা করাইছি। অকৃতজ্ঞের দল। বাপের সম্মানের কথা একবার ভাবলো না।
– যা গেছে তা নিয়ে আফসোস করে লাভ নাই। যেটা আছে সেটার কথা ভাবো। শীঘ্রই কোনো পদক্ষেপ না নিলে এটাও কবে যেনো মুখে চুন কালি মাখায় দেয়। কয়েক মাস পরে তো এটাই ভার্সিটিতে যাবে। তার আগেই ব্যবস্থা করে ফেলো।
– আবার ভার্সিটি? অসম্ভব। লেখাপড়া সব বন্ধ। যা পড়ছে তাই অনেক। লেখাপড়া যা বাকি আছে শ্বশুরবাড়ি গিয়ে করবে।
– মাহিনের সাথে বিয়ের কথা যে বলছিলাম, নীহারের সাথে আলোচনা করছো?
– আলোচনার তো কিছু নাই এখানে। আমি যখন বলছি মেয়ের বিয়ে আমি মাহিনের সাথে দিবো, তখন বিয়ে ওর সাথেই হবে। কোনো শালীর মতামতের ধার আমি ধারি না।
– তাও একবার কথা বলে নেওয়া ভালো৷ আমি ভাই বেশি দেরি করতে চাচ্ছি না। দেরী করার ফল তো হাতেনাতে পাইলাম একবার৷ একই ভুল আবার করতে চাই না৷ মাহিন নিজেও কিন্তু কিন্তু করতেছে। কখন কার মন ভড়কে যায়, ঠিক নাই। তার আগেই ভালোই ভালোই বিয়ের কাজটা সম্পন্ন করতে চাই। তুমি অতি শীঘ্রই একটা তারিখ জানাও। আজকেই নীহারের সাথে আলোচনা করো।
– আলোচনার কিছু নাই ভাইজান। আপনি যেমন চান তেমনি হবে। আমার কোনো আপত্তি নাই৷ আমার মেয়ের কারনে আপনাদের সম্মান নষ্ট হইছে। ছেলেটার অসম্মান হইছে৷ বন্ধু বান্ধবের সামনে হাসির পাত্রে পরিণত হইছে৷ এর দায় তো আমার উপরেই বর্তায়। কান্ডটা তো আমার মেয়েই ঘটাইছে।
– বিয়েটা শুধু মাহিনের ভালোর জন্য না, মোকাররম। তোমার বাড়ির মেয়ে বিয়ের আসর থেকে পালায় গেছে। এই খবর আশেপাশের দশ গ্রামে ছড়ায় গেছে। এরপর তোমার বাড়ির মেয়ের আর কোনো ভালো ঘরে বিয়ে হবে না। কোন ভদ্র পরিবার আসবে তোমার পরিবারের সাথে আত্মীয়তা করতে? আদ্রিকার জন্য কোনো ভালো ছেলে তুমি পাবা না৷ শুধু তোমার কথা কেন বলতেছি, আমাদের পুরো বংশের জন্য এটা একটা কলঙ্ক। পরিচিত অপরিচিত কতো মানুষ আমারেও পথে ঘাটে আটকায় আদ্রতার কথা জিজ্ঞাসা করে। সে তো আমারও ভাতিজি। আমাদের বংশেরই মেয়ে। সুযোগ পাইলে অপমান করতে কেউ পিছপা হয় না৷ যাই হোক, এসব নিয়ে রাগারাগি করে লাভ নাই৷ এখন ভবিষ্যত নিয়ে ভাবো। ঘরে যেটা আছে তাকে মানে মানে বিদায় করে নিজের দায়িত্ব পালন করো। ভার মুক্ত হও।
– মেয়ে যখন আছে বিয়ে দিতেই হবে। তবে ভাইজান, আমি আর কোনো আয়োজন করতে পারবো না। এসবের উপর থেকে আমার মন উঠে গেছে।
– জমজমাট আয়োজনের মানসিকতা কারও নাই। সামনের শুক্রবার কাজী ডেকে এনে দুই পরিবারের উপস্থিতি কলেমা পরে বিয়ে পরায় দিবো৷ এর বেশি কিছু করার ইচ্ছা আমারও নাই। তুমি রাতে বেলা একটু খাবারের আয়োজন করবা।
– তাই ভালো।
– আর শোনা, আশেপাশে কাউকে কিছু জানানোর দরকার নাই। কথা পাঁচ কান হইলে সমস্যা আছে। কখন কার বদনজর লাগে, বলা যায় না।
রাতের বেলা চুপেচাপে বিয়ে পরায় আমরা বউ নিয়ে আসবো। আজকে উঠি তাহলে। নীহার কি বলে আজ কালকের মধ্যে আমাকে জানাইয়ো।
চলবে…
লেখনীতে: অক্ষরময়ী