#পরিণয়ে_নোলককন্যা (কপি নিষেধ)
|৪৯|
টানা বারান্দায় সকালের মিঠারোদ খেলা করছে। বেতের চেয়ারে বসে রঙ চা পান করছে মোকাররম। টয়লেটে যাতায়াত কমলেও শরীরটা এখনো বেশ দূর্বল। গলার হাড়গুলো সদর্পে উঁকি দেয় আজকাল। স্বামীর চেহারায় পূর্বের জৌলুশ ফিরিয়ে আনতে ব্যস্ত সময় কাটে নীহারের৷ এটা ওটা পুষ্টিকর রান্না বসায় চুলায়। কিন্তু মোকাররম তাকে খুব একটা কাছ ছাড়া করে না৷
অসুস্থতার দ্বিতীয়দিনে যখন শরীরের সমস্ত শক্তি নিঃশেষ হতে শুরু করল, মোকাররমের মনে হয়েছিল এই তার শেষ যাত্রার সূচনা। তখনি মৃত্যুর ভয় জেঁকে বসল মনে।
সবাই মিলে ওকে যখন হাসপাতালে নেওয়ার উদ্দেশ্যে ঘর থেকে বের করছিল, মোকাররম খুব করে চাইছিল বাবার তৈরিকৃত বাড়িটা, নিজের ঘরটা প্রাণ ভরে দেখে নিতে৷ আর ফিরে আসা হয় কি না হয়! কিন্তু এতোটা ক্লান্ত লাগছিল, যে চোখ দুটো কিছুতেই খুলতে পারল না।
হাসপাতালে অবস্থানকৃত সময়গুলোও কেটেছে তীব্র ভয়ে। এখানে মৃত্যুর আনাগোনা বেশি৷ আজরাইলের থাবাও এখানে প্রকট। এই বুঝি আত্মা ধরে টান মারল।
হাসপাতাল ত্যাগ করলেও সেই ভয় এখনো মোকাররমের মনে বিদ্যমান। তাই নীহারকে সারাক্ষণ আশেপাশে রাখে৷ নিজের বলতে এই একটা মানুষই রয়ে গেছে মোকাররমের৷ ছোটবেলায় বাবা খুব আদর করতেন। তারপর তিনি একসময় মারা গেলেন।
যুবক বয়সে খুব আগলে রাখত মা। তিনিও একসময় মোকাররমকে ছেড়ে পরলোকগমন করলেন। বড় একজন ভাই আছেন, কিন্তু তিনিও নিজ সংসারে ব্যস্ত হয়ে ছোট ভাইয়ের মায়া কাটিয়ে উঠেছেন।
শুধু মায়া কাটাতে পারল না নীহার নামের কিশোরী মেয়েটি। হ্যাঁ, মোকাররমের কাছে নীহার এখনো সেই কিশোরী মেয়েটি রয়ে গেছে৷ যাকে কোনো এক বর্ষাকালে দূর গ্রাম থেকে বিয়ে করে নিয়ে এসেছিল সে৷
শুরুর দিকে নিজের ঘরটায়, নিজের বিছানায় আরেকজনের রাজত্ব দেখে নিভৃতচারী মোকাররমের খুব রাগ হতো৷ সেই রাগ মোকাররম মিটাতো নীহারের উপর। যেই কারণেই মেজাজ খারাপ হোক না কেনো, মোকাররমের ক্ষোভ মেটানোর জায়গা ছিল নীহার। কিশোরী নীহারকে বকত, মারতো৷ তারপর মোকাররমের মেজাজ ভালো হয়ে যেত।
এমন অনাচারের বিপরীতে সর্বংসহা নীহার তখনো কিছু বলেনি। এখনো কিছু বলে না৷ মাথা নিচু করে এখনো স্বামীর পেছনে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে।
তাই মোকাররমের মনে হয় নীহারের বয়স বাড়লেও মন থেকে সেই কিশোরী মেয়েটিই রয়ে গেছে।
চায়ের কাপটি শেষ হওয়ার আগেই মোকাররম ক্লান্ত স্বর উঁচু করে ডাকল,
‘নীহার?’
রান্নাঘর থেকে প্রায় ছুটে এলো নীহার। পাশে দাঁড়িয়ে জানতে চাইল,
‘কিছু লাগবে তোমার?’
‘চায়ের কাপটা নিয়ে যাও।’
উত্তর দিয়ে চায়ের কাপে আয়েশ করে চুমুক দিল মোকাররম। পাশে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল নীহার৷
সদর দজরার বাইরে ট্রাক রেখে হন্তদন্ত হয়ে চুপকথায় প্রবেশ করল রওশন আলী। বারান্দায় মোকাররমকে বসে থাকলে দেখে বলল,
‘শরীর কেমন এখন?’
‘আলহামদুলিল্লাহ। মোটামুটি ভালো। আগের মতো শক্তি পাই না। দাঁড়াইলে হাঁটু কাঁপে।’
নীহার ভেতর থেকে একটি চেয়ার এনে দিল৷ চেয়ারে বসে রওশন আলী চিন্তিতভাবে বলল,
‘বাজার যাওয়া লাগত একবার। চাল নিতে ট্রাক আসবে।’
এবার মোকাররমকেও চিন্তিত দেখাল। পুরনো ক্রেতাগুলো হাত ফসকে গেলে আর পাওয়া যাবে না। বাজারে নতুন নতুন ব্যবসায়ী শকুনের চোখে চেয়ে আছে। মোকাররম অসুস্থ থাকায় বেশ কয়েকদিন ধরে আড়ত বন্ধ। এই সুযোগে তারা মোকাররমের ক্রেতাদের হাত করতে চাইবে।
কিছুপল ভেবে মোকাররম নীহারকে উদ্দেশ্য করে বলল,
‘আদ্রতা কই?’
বাবার অসুস্থতাকে কেন্দ্র করে বাড়িতে ফিরলেও মোকাররমের সাথে আদ্রতার তেমন কথাবার্তা হয়নি৷ নীহার মোকাররমের সেবাযত্নে ব্যস্ত থাকায় রান্নাবান্না এবং সংসার সামলানোর পুরো দায়িত্ব পড়েছে আদ্রতার কাঁধে। এখনো সে রান্নাঘরে সকালে নাস্তা তৈরিতে ব্যস্ত সময় পার করছে।
হঠাৎ আদ্রতার খোঁজে নীহারের চেহারায় ভয় ফুটে উঠল। আদ্রতা পালিয়ে যাওয়ার পর স্বভাবতই ক্ষেপে আছে মোকাররম। এতোদিন অসুস্থ থাকায় কিছু বলতে পারেনি। এখন তো মোকাররম সুস্থ। না জানি আবার কোন ঝামেলা শুরু হয় বাড়িতে।
নীহার ভয়ার্ত কণ্ঠে উত্তর দিল,
‘রান্নাঘরে। নাস্তা বানায়।’
‘ডাক দেও।’
নীহার সেখান থেকেই উঁচু কণ্ঠে আওয়াজ দিল,
‘আদ্রতা, এগিয়ে আয়।’
কাজ ফেলে ছুটে এলো আদ্রতা। বাবার অসুস্থতার পর থেকে সদা সতর্ক থাকতে হয়। ভয়ে বুকটা ঢিপঢিপ করে। বাবা-মায়ের বয়স বাড়তে থাকা সন্তানের নিকট বড় আতংকের বিষয়।
ওড়নায় ভেজা হাত মুছে আদ্রতা স্বাভাবিকভাবেই জানতে চাইল,
‘কি হয়েছে?’
নীহারকে প্রশ্ন করলেও জবাব দিল মোকাররম। চিন্তিত দৃষ্টি সামনে রেখে প্রশ্ন করল,
‘তোর জামাই কই?’
আগে কখনো বিকল্পের খোঁজ করেনি মোকাররম। অসুস্থ মোকাররম নিজের ঘরে বেশিরভাগ সময় ঘুমিয়ে কাটাতো কিংবা আধো জাগরণে থাকত। আজ হঠাৎ বিকল্পের খোঁজে আদ্রতা মায়ের দিকে তাকিয়ে কারণ জানতে চাইল। নীহার নিজেও কিছু বুঝতে পারছে না। নিচু কণ্ঠে আদ্রতা জবাব দিল,
‘ঘরেই আছে। অফিস যাবে কিন্তু বিকালে৷ কেনো?’
মোকাররম বলল,
‘আলমারির উপর আড়তের চাবি রাখা আছে। রওশনের সাথে আড়তে যাইতে বল। কুমিল্লা থেকে ট্রাক আসবে চালের বস্তা নিতে। দোকানের ছেলেরটার কাছে হিসাবপত্র জেনে নিয়ে চালের বস্তাগুলা ঠিকঠাক ডেলিভারি দিতে হবে।’
আদ্রতার রক্তশূন্য মুখে হাসি ফুটল। হাঁফ ছেড়ে বাঁচল নীহারও। ঘরের দিকে ছোটার আগে আদ্রতা বলল,
‘আচ্ছা। পাঠিয়ে দিচ্ছি।’
আড়তে যাওয়ার আগে বিকল্প এলো মোকাররমের কাছে। দোকানের সাহায্যকারী ছেলের থেকে হিসাব বুঝিয়ে না নিয়ে মোকাররমের থেকেই হিসাব বুঝে নিল। চাবির ঝোপায় কোনটা কোন তালার চাবি সেটাও মোকাররম দেখিয়ে দিল।
ট্রাক ভর্তি করে চাল নিয়ে যাওয়ার পর ভরদুপুরে বাড়ি ফিরল বিকল্প। উদ্বিগ্ন আদ্রতা ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিল। ঘর্মাক্ত গায়ে আদ্রতাকে বুকে জড়িয়ে দিল বিকল্প। আদ্রতা মিষ্টি হেসে দ্রুত ছাড়িয়ে নিল নিজেকে।
‘সরো৷ ড্রয়িংরুমে আব্বু আছে। দেখে ফেলবে।’
‘তোমার আব্বুর কাজ করেই তো ফিরলাম। এখন বউকে সময় দিব না!’
বিকল্পকে ঘরে ঢুকতে দিল না আদ্রতা। টেনে আবার বারান্দায় নিয়ে এসে জিজ্ঞাসা করল,
‘ঠিকঠাক ডেলিভারি দিয়েছো?’
বাবার জায়গায় মেয়ের জেরার মুখে পড়ে হাসল বিকল্প। হাসি মুখে ছদ্ম গাম্ভীর্যতা ধরে রেখে বলল,
‘জ্বি ম্যাডাম।’
‘পেমেন্ট ঠিকঠাক কালেক্ট করেছো?’
‘হ্যাঁ। কিন্তু লেবার পেমেন্টটা বাকি রেখে গিয়েছে।’
মোকাররমের মানসিকতা সম্পর্কে অবগত আদ্রতা আতঙ্কে কেঁপে উঠল। অন্যকে খুব কম বিশ্বাস করে মোকাররম। লেনদেনের ব্যাপারে তো একদমই বিশ্বাস করে না। উল্টো সন্দেহ পুষে রাখে মনে। বাকি বকেয়ার নাম শুনলেই মেজাজ খারাপ হয়ে যায়৷
‘কেনো? বাকি আব্বু একদম বাকি পছন্দ করে না। আব্বু থাকলে ঠিকই আদায় করে নিত।’
চিন্তিত আদ্রতার দু কাঁধে হাত রেখে বিকল্প বলল,
‘এখন বিশ্বাসের উপর ব্যবসা চলে। উনাদের কাছে সত্যি টাকা ছিল না। আমি নিজে দেখেছি। লেবারের আর কতো খরচ? এই তিন-চার হাজার টাকা মাত্র। যারা চালের পঞ্চাশ হাজার টাকা দিতে পারল তারা মাত্র কয়েক হাজার টাকার জন্য বেইমানি করবে বলে তোমার মনে হয়?’
‘আমার মনে হওয়াতে কিছু এসে যায় না। আব্বু মানবে না, এটাই হলো কথা।’
‘এভাবে ব্যবসায় লস করে ফেলবে। ক্রেতার উপর বিশ্বাস না রাখলে বড় বড় পার্টি হাতছাড়া হয়ে যাবে।আজকাল টুকটাক বকেয়া সব ব্যবসায় রাখে।’
‘উনারা আগের যুগের মানুষ। উনাদের নিয়মনীতি আলাদা৷ নতুন যুগের সাথে উনাদের ব্যবসায়িক পদ্ধতি মিলবে না। এই শেষ বয়সে এসে উনাদের চিন্তা ভাবনায় পরিবর্তন আনাও সম্ভব নয়। যেভাবে চলছে, চলুক না। কী দরকার ভেজাল করার?’
‘পরের সপ্তাহের ডেলিভারির সাথে টাকা দিয়ে দিবে বলেছে। তাই আমিও জোর করিনি।’
‘আব্বু হিসাব চাইলে কি বলবে?’
‘সে নিয়ে তুমি ভেবো না। আমি সামলে নিব।’
বিকল্প ভেতরে ঢুকতেই মোকাররমের ডাক পড়ল। আদ্রতার গলা শুকিয়ে এলো ভয়ে৷ একটু দূরে দাঁড়িয়ে চুপচাপ নজর রাখল ড্রয়িংরুমের সোফার দিকে। টিভির ভলিউম কমিয়ে দিয়ে মোকাররম বলল,
‘ট্রাক চলে গেছে?’
‘হ্যাঁ। ওদের বিদায় দিয়ে এলাম।’
মোকাররম প্রশ্ন করার আগেই পেমেন্টের রশিদসহ টাকাগুলো টেবিলের উপর রেখে বিকল্প বলল,
‘এখানে চুয়ান্ন হাজার আছে। চালের পঞ্চাশ হাজার, লেবারের চার হাজার।’
‘আচ্ছা যাও ফ্রেশ হও। ঘেমে গেছো একদম।’
বিকল্প কক্ষে প্রবেশ করা মাত্র দৌড়ে এলো আদ্রতা। ওর প্রশ্নাত্মক চাহনী দেখে বিকল্প হাসল। কাছে টেনে নিয়ে শুষ্ক ঠোঁটে চুমু দিয়ে বলল,
‘আমার কাছে কিছু টাকা ছিল, সেটা দিয়ে হিসাব মিটিয়ে দিলাম। ক্রেতাও খুশি, আড়তের মালিকও খুশি।’
******
সকালবেলা রেস্তোরাঁয় এসে উপস্থিত হয়েছে আদ্রিকা। ওকে এতো সকালে রেস্তোরাঁয় দেখে অবাক হলো রুমি৷ কফি বানানোর প্রস্তুতি নিতে নিতে প্রশ্ন করল,
‘কী ব্যাপার? আজকে এতো সকালে!’
আদ্রিকার আঁধারে ঢাকা মুখমণ্ডলে কোনো ভাবান্তর দেখা গেল না। নিরুৎসাহিত কণ্ঠে কাঁধ ঝাকিয়ে জবাব দিল,
‘এমনিতেই। চলে এলাম৷’
‘কফি খাবে?’
‘খাওয়া যায়।’
‘নাস্তা?’
‘ভালো হয়৷ ক্ষুধা লেগেছে সামান্য।’
‘স্যান্ডউইচ চলবে?’
‘চলবে।’
রুমির তৈরি স্যান্ডউইচে কামড় বসিয়ে আদ্রিকা বলল,
‘আমাকে ওভানের ব্যবহার শেখানোর কথা ছিল।’
‘হাতের ক্ষত সেরেছে?’
আদ্রিকা দু হাতের তালু উঁচু করে দেখাল। দুদিনের হাতের ক্ষত সেরে গেছে দেখে রুমি হাসল।
‘জামাই দেখছি ভালোই সেবাযত্ন করেছে৷’
আদ্রিকা মুখটা ঝামটা মেরে বিদ্রুপ করব বলল,
‘সেবাযত্ন না ছাই৷ ঝগড়া করতেই দিন কেটে যায়।’
‘পরখ আর ঝগড়া! যাহ! আমার ওমন ভোলাভালা বন্ধুটির নামে মিথ্যে অপবাদ দিও না৷ পরখের মতো সুবোধ বালক আমাদের পুরো কলেজে আর একটিও ছিল না। আজ পর্যন্ত পরখ কখনো কোনো ঝামেলায় জড়ায়নি। কারো সাথে মারামারি তো দূরের কথা ঝগড়াটিও করেনি কখনো। এমনি লক্ষ্মীমন্ত ছেলে ও।’
দিনেদুপুরে এমন মিথ্যাচার শুনে আদ্রিকার চোখ দুটি কপালে উঠে যাওয়ার উপক্রম। বিস্ময়ে বিহ্বল হয়ে বলল,
‘আমার সাথে কীভাবে পায়ে পা লাগিয়ে ঝগড়া করে তা যদি আপনি দেখতেন, তবে এ কথা বলতেন না৷ আপনাদের সুবোধ বালকটির কথার এমন ধার যে গা গুলিয়ে উঠে।’
আদ্রিকার এমন কথা কিছুতেই বিশ্বাস হলো না রুমির। কীভাবেই বা হবে? পরখকে সে চিনে আজ প্রায় সাত বছর। কখনো উচ্চস্বরে কথা না বলা ছেলেটি আদ্রিকার মতো একটি মেয়ের সাথে ঝগড়া করে শুনতেই কেমন অবিশ্বাস্য লাগছে। রুমির চোখে মুখে তীব্র অবিশ্বাস দেখে আদ্রিকা হায় হায় করে উঠল।
‘বিশ্বাস হচ্ছে না তো?’
‘মোটেও হচ্ছে না।’
‘তার মানে আমি মিথ্যে কথা বলছি?’
‘সেটাও মনে হচ্ছে না।’
‘হতেই পারে। আপনার বন্ধু বলে কথা৷ আমাকে কেন বিশ্বাস করবেন৷’
‘তোমাকেও তো আমি চিনি। মিথ্যে অপবাদ দেওয়ার মেয়ে তুমি নও। মনে হচ্ছে দুজনের মধ্যে কিছু একটা ঝামেলা আছে।’
‘উহু৷ দুজনের কথা বলবেন না। শুধু আপনার বন্ধুর কথা বলুন। সব ঝামেলা উনার মধ্যে৷ আমি সাদা মনের মানুষ। যা মুখে আসে, বলে দেই। মুখে এক, অন্তরে আরেক-এমনটা আমি পারি না৷ যতো জিলাপির প্যাচ আপনার বন্ধুর মনে৷ কখন কি বলে, কি করে নিজেই জানে না। এই ভালো, এই খারাপ।
উল্টাপাল্টা কথা বলে আমার ভালো মেজাজটাকেও চটিয়ে দেয়৷’
আদ্রিকা রাগান্বিত লালচে মুখটি দেখে রুমে বুঝে গেল, ঘটনা বেশ সিরিয়াস মোড় নিচ্ছে৷ তাই আদ্রিকাকে শান্ত করতে বেশ আগ্রহ দেখিয়ে বলল,
‘বেশ ক্ষেপে আছো দেখছি! ঝগড়াঝাটি চলছে নাকি? সকালবেলা এভাবে নাওয়াখাওয়া ছেড়ে রেস্টুরেন্টেও চলে এসেছো!’
‘ক্ষেপবো না? ক্ষ্যাপার মতো কথা বললে যে কেউ ক্ষেপে যাবে৷ আপনার লক্ষ্মীমন্ত, সুবোধ বন্ধুটি আমাকে কি বলেছে জানেন?’
‘কি বলেছে?’
‘বলেছে, আমি নাকি মা হওয়ার অযোগ্য। কতো জঘন্য অপবাদ দিয়েছে আমাকে, বুঝতে পারছেন? আমার মাতৃত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলে! যেনো সে এ জগতের সেরা বাবা৷ বাচ্চার সব দায়িত্ব একা পালন করছে, আর আমি পায়ের উপর পা তুলে বসে আছি। ফাজিল লোক।’
রাগে গজগজ করতে করতে হাতের কফির মগটা বেশ জোরেই রাখল টেবিলের উপর। জোরালো শব্দে খানিক চমকালো রুমি৷ আদ্রিকার রণচণ্ডী আবতারের সামনে ভয়ার্ত, বেচারার মতোন প্রশ্ন রাখল,
‘যে বাচ্চার লালনপালন নিয়ে তোমাদের মধ্যে বিশাল ঝামেলা চলছে, সে বাচ্চাটি কোথায়?’
রুমির প্রশ্ন বুঝতে না পেরে ভ্রু জোড়া কুঞ্চিত করে আদ্রিকা বিরস মুখে জানতে চাইল,
‘কোন বাচ্চা?’
‘যার আদর্শ বাবা-মা হওয়ার লড়াই করছো তোমরা দুজনে।’
‘আরে ধুর! বাচ্চার কথা বলতেই আপনার বন্ধু ক্ষেপে গেল। আর আপনি এখনি তার খোঁজ করছেন!’
গা দুলিয়ে হেসে উঠল রুমি। হো হো হাসিতে নেচে উঠল পুরো ফ্লোর।
‘একটা অনাগত শিশুকে কেন্দ্র করে তোমরা ঝগড়া বাঁধিয়ে দিয়েছো! এতো গাছে কাঁঠাল গোঁফে তেল এর মতো অবস্থা।’
থাকুক সে কাঠাল গাছে, তবুও পরখ এভাবে বলবে কেন? এই অপমান আদ্রিকা কিছুতেই ভুলবে না৷ বেয়াদব, অসভ্য, পাঁজি লোক একটা। রুমির হাসি উপেক্ষা করে আদ্রিকা মুখ মুচড়ে কফির কাপে চুমুক দিল।
দুপুর পর্যন্ত পরখের মুখদর্শন করল না আদ্রিকা। লাঞ্চের জন্য ডাকতে এলো রুমি৷ অনিচ্ছা সত্ত্বেও আদ্রিকাকে যেতে হলো পরখের কক্ষে। সেখানেই মধ্যাহ্নভোজের আসর জমেছে। অন্যদিন বকবক করে সবার মাথা ধরিয়ে দেওয়া আদ্রিকা আজকে চুপচাপ নিজের খাবার খাচ্ছে৷ বিশ্বাস হচ্ছে না রুমির।
রুমি একবার পরখের শুকনো মুখের দিকে তাকায়, আরেকবার আদ্রিকার অভিমানী মুখটার দিকে চায়। নিস্তব্ধতায় কেমন গা ছমছম করে উঠে রুমির। একবার পরখকে সাধে,
‘ভাত নিবি?’
পরখ দুদিকে মাথা দুলিয়ে অসম্মতি জানায়। বেচারা রুমি কথা খুঁজে না পেয়ে আদ্রিকাকে বলল,
‘চিংড়ির মালাইকারিটা দারুণ হয়েছে। তোমার রান্না অসাধারণ।’
প্রশংসা শুনে অন্যদিনের মতো খুশিতে গদগদ হয় না আদ্রিকা। বিনয়ী হাসিও দেখা যায় না ওর মুখে৷ উলটো চোখ মুখ শক্ত করে চিংড়ির বাটি থেকে আরেকটা চিংড়ি তুলে দেয় রুমির প্লেটে৷
রুমি আতংকিত চোখে নিজের প্লেটের তিনটে চিংড়ির দিকে তাকায়৷ সে কি রাক্ষস নাকি? ভালো লেগেছে বলে একাই এতগুলো চিংড়ি খাবে?
নিরুপায় রুমি একটি চিংড়ি তুলে পরখের প্লেটে দেয়। পরখ হাত উঁচু করে নিতে অস্বীকার জানালে, রুমি অবাক হয়ে বলল,
‘নিবি না কেনো? তুই কি বলতে চাইছিস আদ্রিকা ভালো রাঁধেনি?’
পরখ হকচকিয়ে গিয়ে আদ্রিকার দিকে তাকাল। দেখল, রক্তচক্ষু মেলে আদ্রিকা পরখকেই দেখছে৷ রান্নাকে অবমাননা করায় ইতিমধ্যে আদ্রিকার কপালের শিরাগুচ্ছ ফুলে উঠতে শুরু করেছে৷ আসন্ন তান্ডব এড়াতে পরখ হাত সরিয়ে নিয়ে চিংড়িটি গ্রহণ করে বলল,
‘নাহ। ভালো হয়েছে৷ পেটে জায়গা নেই আরকি।’
রুমি অতি বিজ্ঞ ব্যক্তির মতো বলল,
‘বউয়ের হাতের রান্না একটু বেশি খেলে কিছু হয় না। এখন ডায়েট ফায়েট করে বডি মেইনটেইন করে কি করবি মামা? বিয়ে তো করেই ফেলেছিস। সুন্দরী বউ পেয়েই গিয়েছিস। এখন আর তোর মেয়ে পটানোর মতো ফিটনেসের কি দরকার? ওসব ডায়েট এখন আমরা করবো। তোরা বউয়ের হাতের মজাদার খাবার কব্জি ডুবিয়ে খাবি আর বউয়ের প্রশংসা করবি।’
রুমির অতি জ্ঞানবার্তা বন্ধ করতে দৃষ্টি দ্বারা সতর্ক করার চেষ্টা করল পরখ। বিনিময়ে রুমি ঠোঁট চেপে হাসল।
খাবার শেষে একমুহূর্ত বসল না আদ্রিকা। গটগট করে হেঁটে পরখের কক্ষ ত্যাগ করল। রুমি আয়েশ করে পরখের সামনের চেয়ারে বসে বলল,
‘কি মামা, বউ ক্ষেপেছে কেন?’
ব্যক্তিগত আলোচনায় সদা বিব্রতবোধ করে পরখ। আজও তাই করল। বিরক্ত হয়ে বলল,
‘তুই বেশ মজা পাচ্ছিস মনে হচ্ছে?’
‘আমাদের ব্যাচেলরদের জীবনে এই একটা মজা-ই আছে। বিবাহিত বন্ধুদের বিবাহিত জীবনের নাট্যশালা উপভোগ করা৷’
‘নিজে বিয়ে করে দেখ, বউ কেনো ক্ষেপে।’
‘আমার অনুসন্ধান বলে, মেয়েরা অকারণ ক্ষেপে যায়। কোনো কারণ লাগে না।’
‘তোর রিসার্চ ঠিক আছে।’
‘কিন্তু তোর সাথে আমার অনুসন্ধান মিলে নাই। তোর মতো সুবোধ বালক, বউয়ের সাথে ঝগড়া করতেছে বিষয়টা মেনে নেওয়ার মতো না৷ আমি তো ভাবতেই পারি না, তুই চিৎকার করে আদ্রিকার সাথে ঝগড়াঝাটি করতেছিস৷ আমার কল্পনাতে এমন কিছু আসে না। আমি চোখ বন্ধ করলে দেখতে পাই, বউয়ের অত্যাচারে অতিভদ্র ইবতেহাজ পরখ ঘরের এককোনায় মুখ লুকিয়ে কাঁদছে।’
রুমি দাঁত ক্যালানো হাসি দেখে পরখ কটমট করে তাকিয়ে বলল,
‘আর একটা বাজে কথা বললে তোর জায়গা মতো লাথি মারব। আমাকে বিরক্ত না করে নিজের কাজ কর। যা।’
‘মামা, আমি নিজের কাজই করতেছি৷ বন্ধুর ঘরে ঝামেলা চলতেছে, মিটমাট করা আমার নৈতিক দায়িত্ব।’
‘কোনো ঝামেলা চলতেছে না। ও এমনিতেই মুখ ফুলিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কয়েকদিন পর পর আমার সাথে ঝামেলা না বাঁধলে ওর ভালো লাগে না।’
‘তুমি তো মামা ঝামেলা এড়িয়ে চলা লোক। নরম স্বভাবের পরখের শান্ত মেজাজ চটে যাচ্ছে কি করে?’
‘এমন আধপাগলের সাথে দুদিন থাকলে যে কারো মেজাজ বিগড়ে যাবে। আমি তবুও কয়েকমাস ধরে সহ্য করতেছি। আমারও ধৈর্যের একটা সীমা আছে। এতো ইমম্যাচিউর মানুষ হয়, একে না দেখলে বিশ্বাস করতে কষ্ট হতো।’
‘নাহ মামা। শুধু একপক্ষকে দোষারোপ করলে চলবে না। দোষ তোরও কিছু কম নাই। আদ্রিকা না হয় ইমম্যাচিউর কিন্তু তুই একটা ম্যাচুউর মানুষ। বিশাল শিক্ষিত। ভার্সিটির লেকচারার বলে কথা৷ তুই কেনো একটা না হওয়া বাচ্চাকে নিয়ে বউয়ের সাথে ঝগড়া করবি? তোর বুদ্ধিসুদ্ধি কোথায় গেছে?’
পরখের মনে হলো সে আকাশ থেকে একঝটকায় দুম করে মাটিতে পড়ে গেল। হতবিহ্বলতায় চক্ষুচড়ক গাছ। সর্বোচ্চ পর্যায়ের বিরক্ত হয়ে বলল,
‘এটাও তোকে বলেছে!’
পরখের লজ্জা মিশ্রিত মুখটি দেখে রুমি হো হো করে হাসল। রুমির এই বন্ধুটি অতিমাত্রায় লাজুক এবং মুখচোরা। মনের কথা মনে চেপে রাখে শুধুমাত্র লজ্জার খাতিরে৷ বাবার সামনে লজ্জা পায়, বন্ধুর সামনে লজ্জা পায়৷ এখন তো রুমির মনে হচ্ছে, পরখ তার বউয়ের সামনেও লজ্জা পায়।
খুব গোপনীয় কিছু বলার মতো সাবধানতা অবলম্বন করে রুমি টেবিলের সামনে ঝুঁকে পরখের মুখোমুখি হয়ে ফিসফিসিয়ে বলল,
‘বন্ধু, তুমি কি বউকে চুমু খাওয়ার আগেও লজ্জায় এমন মুখ লুকাও?’
বিস্ময়ে পরখের মুখটি হা হয়ে গেল। মুষ্টিবদ্ধ হাতটি দ্বারা সজোরে রুমির কাঁধে আঘাত করে বলল,
‘তুই বের হ আমার রুম থেকে।’
পরখের রক্ত জমে লালচে হওয়া কান দুটো দেখে রুমি হো হো করে হেসে চেয়ার ছাড়ল। দরজার হাতলে হাত রেখে ঘাড় ফিরিয়ে বলল,
‘ইতিহাস সাক্ষী, ম্যাচুউর ছেলেদের কপালে এমন ন্যাকাবোকা বউ জুটে। এবং ম্যাচুউর ছেলেরা বউয়ের ন্যাকামি ইনজয় করে। এসব বিরক্ত হওয়ার নাটক করা বন্ধ করো, বন্ধু। তোমার বোকা বউ না বুঝলেও আমরা ঠিকই বুঝি।’
সন্ধ্যে নামার কিছুক্ষণ আগে আদ্রিকা ব্যাগ গুছিয়ে নিয়ে রসনাবিলাসীর বাইরে এলো। রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে রিক্সার অপেক্ষা করছিল। পার্কিং থেকে বাইক নিয়ে এলো রুমি। আগে কখনো রুমির বাইকটিকে গুরুত্বসহকারে দেখেনি আদ্রিকা৷ আজকে হঠাৎ চোখের সামনে কালো কুচকুচে বাইকটি দেখে আদ্রিকার বুক ধক করে উঠল।
এটাই সেই পালসার ওয়ান ফিফটি বাইকটা না?
‘এই আদ্রিকা?’
রুমির ডাকে হকচকিয়ে তাকাল আদ্রিকা। আনমনে উত্তর দিল,
‘হুম?’
‘কোথায় যাবে?’
সে প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে আদ্রিকা বলল,
‘এটা আপনার বাইক?’
‘হ্যাঁ। কেনো?’
‘চেনা চেনা লাগছে। কোথায় যেনো দেখেছি।’
‘ভূবনভোলায় দেখেছো?’
‘হ্যাঁ।’
‘এই মডেলের বাইক ভূবনভোলায় এখনো তেমন একটা আসেনি। আমরা কয়েকজন মিলে বাইরে থেকে ইমপোর্ট করে এনেছি৷ তুমি আবার কার কাছে দেখলে? আর কেউ এনেছে বলে শুনিনি তো।’
আদ্রিকা এগিয়ে এসে বাইকের সামনের অংশে আঙ্গুল ছুঁলো। ছাদে দাঁড়িয়ে বাইকটিকে স্পষ্ট দেখা যেতো। তখনো আদ্রিকা কারো বাইকে উঠেনি৷ ছাদে দাঁড়িয়ে বাইকটি দেখতে দেখতে একবার ইচ্ছে হয়েছিল, বাইকে উঠার। এমন বাসনায় নিজেই নিজেকে ধমক দিয়ে আত্মসংবরণ করেছিল আদ্রিকা। এরপর অবশ্য বিস্ময়ের বাইকে পুরো শহর ঘুরেছিল।
আজকে এতো কাছ থেকে বাইকটিকে দেখে নিজেকে সংবরণ করতে পারল না আদ্রিকা। আলতো হাতে অনেকক্ষণ ছুঁয়ে দেখল বাইকের হেডলাইটের অংশটি।
আদ্রিকার এমন স্মৃতিকাতরতায় রুমি সূক্ষ্ম চোখে তাকিয়ে বলল,
‘কার কাছে দেখেছো বলতো?’
‘মনে পড়ছে না।’
হাত সরিয়ে নিয়ে আদ্রিকা একপাশে দাঁড়িয়ে রসনাবিলাসীর দোতলার দিকে তাকাল। পরখের কক্ষের জানালা দিয়ে এই সড়কটি স্পষ্ট দেখা যায়।
‘কোথায় দেখেছো?’
‘বাড়ির সামনে, রাস্তায়, কলেজের ওদিকে।’
‘কি জানি! কার কাছে যে দেখেছো! বুঝতে পারছি না। আমরা মাত্র পাঁচটা বাইক এনেছিলাম।’
‘কার কার কাছে আছে?’
‘এই বাইক?’
‘হ্যাঁ।’
‘আমরা একই মডেলের, একই কালারের পাঁচটা আনিয়েছিলাম। পরখের ফ্ল্যাটমেট ছিল একটা ছেলে। বিস্ময় নাম। ওর বাবার আবার দেশ বিদেশ জুড়ে ব্যবসার। বিস্ময় ওর বাবার মাধ্যমেই আনিয়েছিল। একটা আমার, একটা পরখের, একটা বিস্ময়ের। আর দুটো আমাদের আরও দুজন বন্ধুর কাছে আছে। সাজ্জাদের কাছে আছে একটা। ওই যে রুফটপ রেস্টুরেন্টের মালিক। ওখানে গিয়েছিলা কখনো?’
আদ্রিকার হাতের তালু ঘামতে লাগল। মুখে কিছু না বলে, দু দিকে মাথা দুলিয়ে জানাল সে যায়নি। ভাবখানা এমন করল যেনো কস্মিনকালেও নামটি শুনে নি।
‘আরেকটা আমাদের আরেক বন্ধু রাকিনের কাছে আছে। ও অবশ্য এখন ভূবনভোলায় নাই। অনার্স শেষ করার কয়েকমাস পর ঢাকা চলে গেছে। এই পাঁচজন বাদে ভূবনভোলায় আর কারো আছে এই বাইক নাই। আমাদের মধ্যেই কাউকে দেখেছো হয়তো।’
‘হতে পারে।’
শাড়ির আঁচলে গলার ঘাম মুছে জবাব দিল আদ্রিকা। রুমির বাড়ি ফেরার তাড়া ছিল। বাইকে উঠে বসে আদ্রিকাকে বলল,
‘বাড়ি ফিরবে তো? চলো তোমাকে নামিয়ে দিব এখন।’
রিক্সার অপেক্ষা না করে রুমির বাইকে খুব তাড়াতাড়ি বাড়ি পৌঁছে যাওয়া যাবে। আদ্রিকার একবার মনে হলো, বাইকে উঠে পড়বে৷ কিন্তু পরক্ষণে দোতলার জানালার দিকে তাকিয়ে একটি ঘোলাটে মানব অবয়ব দেখে সিদ্ধান্ত বদলালো।
‘মার্কেটে আমার কিছু কাজ আছে। আপনি যান।’
রুমির বাইকটি বেরিয়ে যাওয়ার কিছুক্ষণ পর আদ্রিকা একটি রিক্সা পেয়ে গেল।
চলবে..
#অক্ষরময়ী
#পরিণয়ে_নোলককন্যা (কপি নিষেধ)
|৫০|
পর্তুলিকা অনেকদিন পর আমড়ার আচার বানিয়েছেন৷ কাচের বয়ামে ভরে কয়েকদিন ধরে রোদে শুকানোর পর আজকে সেগুলো নিয়ে যাওয়ার জন্য আদ্রিকাকে কল করে আসতে বললেন৷ চাইলেই আচাররের বয়ামগুলো ড্রাইভারের হাতে পাঠিয়ে দেওয়া যায়। কিন্তু আদ্রিকার সাথে অনেকদিন দেখাসাক্ষাৎ হয় না। এই সুযোগে দেখা হয়ে যাবে বলে পর্তুলিকা ড্রাইভারের হাতে পাঠালেন না।
পরখ মাসে একবার এসে মায়ের সাথে দেখা করে যায়। পর্তুলিকার নিকট ছেলের সে আগমন, শীতের দুপুরের এক চিলতে রোদের মতো। চমচমে একটা অনুভূতি ছড়িয়ে খানিকপরেই বিদায় নেয়। পর্তুলিকা মুখ গোমড়া করে আবদার করেন, এতো কীসের তাড়া তোর? একটু বেশি সময় নিয়ে আসা যায় না?
মায়ের এই আবদার ছেলে তেমন একটা আমলে নেয় না। ছেলে বড্ড একগুয়ে, অভিমানী। কিন্তু ছেলের বউটা বড্ড আদুরে৷ ডাকলেই দৌড়ে চলে আসে।
রসনাবিলাসী থেকে সবে বাড়ির ছাদে পা দিয়েছে আদ্রিকা তখনি কল এলো পর্তুলিকার৷ সন্ধ্যে নামতে তখনো অনেকটা সময় বাকি। চট করে গিয়ে ঘুরে আসা যায়। ক্লান্ত শরীরের সমস্ত অবসাদ ঠাণ্ডা জলে ধুয়ে মুছে পরিপাটি হয়ে নিল আদ্রিকা। নতুন বউ সে, একটুখানি সাজগোজ না করলে চলে না৷
বরাবরের মতোই ইবতেহাজ ভিলার ছাদে আড্ডা বসেছে বউ শাশুড়ির। বাগানে কি কি নতুন গাছ লাগিয়ে তা দেখাচ্ছিলেন পর্তুলিকা। চায়ের কাপ হাতে মুগ্ধ দৃষ্টি মেলে চেয়ে চেয়ে দেখছে উচ্ছ্বসিত আদ্রিকা৷ কথার ফাঁকে ফাঁকে বারবার চোখ চলে যাচ্ছে নিজের বনসাইয়ের দিকে৷ রূপের বাহার নেমেছে তার গায়ে। শাশুড়ির আদর যত্নে পুত্রবধূকে ভুলে ভালোই আছে সে৷
বাগানের মাঝখানে দোলনায় বসে পরখের ছোটবেলার গল্প বলছিলেন পর্তুলিকা। তখনি ছাদে এলেন ইবনূল ইবতেহাজ৷ অফিস থেকে ফিরে প্রাণপ্রিয় স্ত্রীকে না দেখে বাইরের পোশাকেই ছুটে এসেছেন ছাদে৷ ভেবেছিলেন ছাদে এসেই পর্তুলিকাকে বুকের মাঝে জড়িয়ে ধরে সারাদিনের ক্লান্তি মিটাবেন৷ কিন্তু এখানে এসে দেখলেন পর্তুলিকা বসে আছে দোলনায়৷ তার কাঁধে মাথা রেখে খিলখিলিয়ে হাসছে আরেক যুবতী৷
সবাই কেনো ইবনূল ইবতেহাজের একমাত্র স্ত্রীর সাথেই এমন ভাব জমায়, ভেবে পান না ইবনূল ইবতেহাজ। ভাব জমানোর আর কেউ নেই কি জগতে? ইবনূল ইবতেহাজের বউকে নিয়ে কেনো সবার টানাটানি?
ইবনূল ইবতেহাজের একটুখানি অভিমান হলেও পর্তুলিকার সুশ্রী মুখে প্রশান্তির হাসি দেখে অভিমানটুকু হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। তিনি এগিয়ে এসে পর্তুলিকার অপরপাশের জায়গা দখল করে নিয়ে বললেন,
‘কী নিয়ে এতো হাসাহাসি হচ্ছে?’
আদ্রিকা মাথা তুলে ইবনূল ইবতেহাজকে দেখে আবারও পর্তুলিকার কাঁধে মাথা এলিয়ে দিয়ে বলল,
‘পিউ মা পরখের ছোটবেলার গল্প বলছে৷ পরখ কীভাবে রোজ সকালে চিল্লিয়ে বাড়ি মাথায় তুলে নিত।’
অতীত স্মরণ করে ইবনূল ইবতেহাজ মলিন হেসে বললেন,
‘ছেলেটা আজও সেই গাধাই রয়ে গেল৷ আত্মবিশ্বাসের বড় অভাব৷’
পর্তুলিকা বিরোধিতা করে বললেন,
‘তুমি শুধু বাবুর ত্রুটির খোঁজে থাকো৷ আত্মবিশ্বাস নেই বলে বলে ছেলেটার মাথা বিগড়ে দিয়েছো৷’
‘আমাকে বাহানা খুঁজতে হয় না৷ তোমার ছেলে শ’খানেক সুযোগ এমনিতেই দিয়ে দেয়৷ রোজ সকালে তোমারকে দিয়ে আলমারি থেকে শার্ট বের করে নিত কিনা বলো? পরার জন্য একটা শার্ট যে নিজে চুজ করতে পারে না, তাকে কীভাবে আত্মবিশ্বাসী বলব?’
পর্তুলিকা চোখ রাঙিয়ে বললেন,
‘তোমার ছেলে তোমার মতোই হয়েছে। তুমিও কি আমার থেকে শার্ট চুজ করে নেও না? এখন যেটা পরে আছো, সেটাও আজকে সকালে আমিই আলমারি থেকে বের করে দিয়েছি৷ এতো তাড়াতাড়ি ভুলে গেলে?’
পুত্রবধূর সামনে এমন হেরে যাওয়ায় থমথমে খেয়ে গেলেন ইবনূল ইবতেহাজ। কিছু একটা বলতে হয় বলেই বোধহয় বললেন,
‘আমার এখন বয়স হয়েছে, নিজের আর পছন্দ অপছন্দের কী আছে! তাছাড়া স্ত্রী সবসময় স্বামীর জন্য সেরাটা পছন্দ করে৷ তাই বউয়ের পছন্দের পোশাক পরে একটু হ্যান্ডসাম হওয়ার চেষ্টা করছি।’
এমন কথায় লজ্জা পেয়ে খিলখিল করে হেসে উঠল আদ্রিকা৷ পর্তুলিকাও লজ্জা পেয়ে কনুই দিয়ে ইবনূল ইবতেহাজের পেটে গুতা দিলেন৷
ইবনূল ইবতেহাজ পেট চেপে ধরে দোলনা থেকে উঠে বললেন,
‘এই সন্ধ্যেবেলায় ছাদে বসে না থেকে নিচে আসো।’
আড্ডা দিতে দিতে সময় কীভাবে বয়ে গেছে বুঝতেই পারেনি আদ্রিকা। ইবনূল ইবতেহাজের কথায় চারপাশে তাকিয়ে দেখল অনেকখানি পশ্চিমে ঢলে পড়েছে সূর্য।
নিচে নামতে নামতে মাগরিবের আযান কর্ণগোচর হলো। আর বসল না আদ্রিকা। তাড়াহুড়ো করে বলল,
‘পিউ মা, এবার আমি বেরিয়ে পরি৷ পরখের বাড়ি ফেরার সময় হয়ে আসছে৷’
বাড়ির গাড়িতে যেতে বললেন পর্তুলিকা৷ কিন্তু আদ্রিকা মানলো না। পরখ দেখে ফেললে সে নিয়ে আরেক ঝামেলা হবে৷ পিতা-পূত্রের স্নায়ুযুদ্ধের অনেকখানি আদ্রিকার জানা৷
পর্তুলিকা মনে হয় আদ্রিকার ভয়ের কারণ বুঝতে পারলেন। গাড়ি না পাঠালেও নিজে নেমে এসে আদ্রিকাকে সিএনজিতে তুলে দিয়ে তবেই ছাড়লেন।
কিন্তু আদ্রিকার মন্দ ভাগ্য। মাঝরাস্তায় সিএনজির কী এক গন্ডগোল হলো কে জানে! অনেক চেষ্টা করেও সিএনজিটিকে এক কদম নড়ানো গেল না৷ ড্রাইভার ক্রমাগত বলেই যাচ্ছেন, আর কিছুক্ষণ সময় লাগবে। এই তো আর পাঁচ মিনিট৷
সেই মাঝরাস্তায় অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পরও সিএনজির কোনো উন্নতি দেখা গেল না৷ বাধ্য হয়ে অন্য সিএনজির খোঁজ করতে হলো আদ্রিকাকে। ডুবন্ত সন্ধ্যায় শহর থেকে বাড়ির দিকে ফিরছে সবাই। উল্টোদিক থেকে ক্রমাগত সিএনজি ধেয়ে আসছে৷
আরও কিছু সময় অপেক্ষার পর আরেকটি সিএনজির দেখা পেল আদ্রিকা। তাতেই চেপে আদ্রিকা যখন বাড়ি ফিরল তখন রাত আটটা৷
ছাদের প্রজ্জ্বলিত বাতি বলে দিচ্ছে, পরখ বাড়ি ফিরেছে। আলোকিত বাড়ির সিঁড়ি বেয়ে পা টিপে টিপে উপরে উঠছে আদ্রিকা। বুকের ভেতর ঢিপঢিপ শব্দ৷ অভিমানের সূত্র ধরে দুদিন ধরে পরখের সাথে কথাবার্তা বন্ধ৷ তাই পর্তুলিকার সাথে সাক্ষাতের কথা পরখকে জানানো হয়নি৷
স্লাইডিং ডোর খুলে ভেতরে প্রবেশ করে আদ্রিকা দেখল পরখ বসে আছে ড্রয়িংরুমের সোফায়৷ আচারের বয়ামটি কিচেনে রেখে গুটিগুটি পায়ে আদ্রিকা এসে দাঁড়ালো পরখের সামনে। সোফায় পা ছড়িয়ে বসে দুই হাঁটুর উপর দুই হাতের কনুই রেখে সূক্ষ্ম চোখে চেয়ে আছে পরখ। কিন্তু মুখে কিছু বলছে না। ওমন তীরের ফলার মতো তীক্ষ্ম দৃষ্টির সামনে দাঁড়িয়ে আদ্রিকা কেমন মিইয়ে গেলো। পরখ যে বেজায় ক্ষেপেছে সেটা পরখের শান্ত অবতার দেখে যে কেউ বুঝে যাবে।
হাতের নখ খুটতে খুটতে আদ্রিকা নিজ তাগিদ থেকেই বলল,
‘পিউ মা ডেকেছিল আচার নিয়ে আসতে। ওখান থেকে ফিরতে দেরি হয়ে গেল৷ স্যরি।’
পরখ কিছু বলল না। শুধু দৃষ্টি ঘুরিয়ে ফিরিয়ে আদ্রিকাকে দেখল৷ আদ্রিকার গায়ে হালকা মিষ্টি রঙের সুতি শাড়ি৷ লম্বা চুলগুলোর অর্ধেক পেছনে ক্লিপ দিয়ে আটকানো৷ বাকিগুলো পিঠ জুড়ে ছড়িয়ে দিয়েছে৷ কানে ঝুমকা, হাতে দুটো সোনার চিকন চুড়ি, গলায় একটা চিকন চেইন।
ফর্সা ত্বকে স্বর্ণ জ্বলজ্বল করছে। একপলক তাকালেই চোখ ধাধিয়ে যায়। এভাবে সেজেগুজে এতো রাত অব্দি বাইরে একা নেচে নেচে বেড়াচ্ছিল মেয়েটা! কোনো বিপদে পড়লে কি হতো? এমনিতেই যেখানে যায় সেখানেই একটা ঘটিয়ে আসে৷ বিপদ যেনো ওর সাথে সাথে ঘুরে।
রাগে পরখের কপালের শিরাগুলো ফুলে উঠল। যাওয়ার আগে একবার জানায়নি, সেটা মেনে নেওয়া যায়। কিন্তু আসতে দেরী হচ্ছে এটা কি পরখকে জানানো উচিত ছিল না?
কার থেকে কিইবা আশা করছে পরখ! এই মেয়ে যে এমনি স্বভাবের হবে সেটা পরখের জানা ছিল৷ তবুও আদ্রিকার থেকে ভালো কিছুর আশা সে কী করে করল?
দীর্ঘশ্বাস ফেলে পরখ চলে যেতে লাগল নিজের কক্ষের দিকে। পরখের রাগ কমে গেল নাকি বাড়লো কিছুই অনুমান করতে পারল না আদ্রিকা৷ তাই আদ্রিকাও পরখের পিছু নিল৷ সাফাই গাওয়ার উদ্দেশ্য বলল,
‘আমি ঠিক সময়ই বের হয়েছিলাম। রাস্তায় সিএনজিটা হঠাৎ নষ্ট হয়ে গেলো।’
ঘরের মাখখানে দাঁড়িয়ে পরখ আদ্রিকার দিকে ফিরে তাকাল। আদ্রিকা দরজা পেরিয়ে কক্ষে প্রবেশ করেছে মাত্র৷ লম্বা পা ফেলে পরখ ফিরে এলো আদ্রিকার কাছে। আদ্রিকার ডান হাতটা মুচড়ে পেছনে পিঠে ঠেকিয়ে ধরে অন্য হাতে কোমর চেপে ধরে নিজের কাছে টেনে আনল।
ব্যথায় হিসহিসিয়ে পরখের গায়ের উপর এসে পড়লো আদ্রিকা। কিন্তু মুখে কোনো রা করলো না।
ওর চোখে চোখ রেখে পরখ বললো,
‘তোমার মতো মেয়ের থেকে আমি কিছু আশা রাখি না। যেখানে ইচ্ছে যাও। যার সাথে ঘুরতে মন চায় ঘুরো। আমার আর কিছু বলার নেই। মান সম্মানের আর কিছু বাকি রেখেছো কি তুমি?’
হাত ছেড়ে দিয়ে আদ্রিকার কাঁধে ধাক্কা দিয়ে কক্ষ থেকে বের করে দিয়ে পরখ দরজা বন্ধ করে দিলো৷
আদ্রিকা হতবিহ্বল হয়ে কিছুক্ষণ সেখানেই দাঁড়িয়ে রইলো। পরখের অপমানজনক কথাগুলো আয়ত্তে আনতে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে৷ কিছু না বলেও কতো কিছু বলে দিল!
সিএনজি মাঝপথে নষ্ট হলে ওর কি দোষ। সে কি জানতো যে সিএনজি মাঝপথে নষ্ট হবে? ভুল করলে বকা দিক, তাহলে আদ্রিকা মেনে নিবে৷ কিন্তু অকারণ অপমান করবে কেন?
আদ্রিকা ঘুরে দাঁড়িয়ে ধুমধাম প্রহার করল বন্ধ দরজায়৷ পরখ বসে ছিলো বিছানার উপর। প্রথমে ভাবলো দরজা খুলবে না৷ কিন্তু আদ্রিকা থামার পাত্রী নয়। কানের পর্দা ফেটে যাওয়ার যোগাড় হতে শুরু করলে বাধ্য হয়ে পরখ দরজা খুলল।
ক্রোধান্বিত পরখ দেখল দাঁত মুখ শক্ত করে দরজার সামনে আদ্রিকা দাঁড়িয়ে আছে। মুখ টকটকে লাল। চোখে জল চিকচিক করছে৷ পরখ কিছু বলার আগেই তেজিয়ান স্বরে আদ্রিকা বলল,
‘শুনুন, সব সময় মানুষের মনমানসিকতা এক রকম থাকে না। যখন তখন আমাকে এভাবে অপমান করবেন না আপনি৷ আমিও একটা মানুষ। আমারও মাঝেমধ্যে ক্লান্ত লাগে, মন খারাপ হয়৷’
একনাগাড়ে কথাগুলো বলে গটগট করে আদ্রিকা নিজের কক্ষে চলে গেল৷
ওর পাগল প্রলাপে পরখ খুব একটা পাত্তা দিলো না। দরজা বন্ধ করে দিয়ে বাইরের পোশাক ছাড়ল৷ কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিল। পরবর্তী দিনের লেকচার তৈরি করে যখন ঘড়ির দিকে তাকালো তখন রাত এগারোটা৷ এতোক্ষণে একবারও আদ্রিকার দেখা পাওয়া যায়নি।
বাইরে এসে পরখ ওর ঘরে উঁকি দিয়ে দেখল, বিছানার উপর উপুড় হয়ে শুয়ে আছে আদ্রিকা। গায়ে এখনো বাইরের পোশাক।
ফ্রিজে ফ্রাইড রাইস, চিকেন রোস্ট ছিল৷ সেগুলো গরম করে টেবিলে সাজিয়ে ঘরে গিয়ে আদ্রিকাকে ডাকলো।
‘খেতে এসো৷’
যখন ইচ্ছে হবে, অপমান করবে। পরক্ষণেই এমনভাবে কথা বলবে যেনো কিছু হয়নি৷ পরখের এমন দ্বিমুখীতায় আজকাল প্রচন্ড বিরক্ত লাগে আদ্রিকার৷ মনে হয়, আদ্রিকার সহ্যসীমা এবার অতিক্রম হওয়ার পথে।
বিরক্তিতে মুখ তেতো হয়ে এসেছে। জবাব দেওয়ার ইচ্ছে না থাকলেও বেয়াদবি হবে বলে আদ্রিকা কোনোরকমে বলল,
‘খাবো না।’
‘খাবার গরম করেছি। ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে৷ তাড়াতাড়ি এসো৷’
আদ্রিকা ভীষণ বিরক্ত হলো। কেউ বলেছে উনাকে খাবার গরম করতে? গরম করেছে যখন তো খাবার খেয়ে নিক৷ ওর পেছনে পড়ে আছে কেনো? নাক টেনে কান্না আটকে বললো,
‘বললাম তো খাবো না।’
‘এসব কান্নাকাটি করার জন্য পুরো রাত পরে আছে। খেয়ে এসে সারারাত কান্না করো।’
আদ্রিকা এলো না। পরখ একাই খেয়ে নিলো। আদ্রিকার জন্য একটি প্লেট সাজিয়ে ঢেকে রেখে দিল টেবিলে। এঁটো থালাবাসন পরিষ্কার করে ঘরে ফেরার আগে আরেকবার উঁকি দিল আদ্রিকার ঘরে৷ এখনো ওভাবেই শুয়ে আছে।
যাবে না, যাবে না করেও গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে গিয়ে আদ্রিকার শিয়রে বসে মাথায় হাত রাখল পরখ। আদ্রিকা না ফিরে তাকাল, আর না চোখ খুলল৷
পরখ নিজেও জানে তখন রাগের মাথায় একটু বেশি বলে ফেলেছে। কিন্তু যা বলার বলে তো দিয়েছে৷ এখন কী আর করার আছে? কথার তীর একবার ধনুক থেকে বেরিয়ে গেলে আর ফিরিয়ে নেওয়া যায় না।
তখন মেজাজ প্রচন্ড খারাপ ছিল বলে কটু কথা বলেছে, গায়েও হাত তুলেছে। এখন মাথা ঠাণ্ডা হওয়ার পর খেয়াল হলো, একটু বেশি বাড়াবাড়ি হয়ে গেছে। কিন্তু পরখ নিজেকে খুব একটা দোষ দিতে পারছে না।
যে মেয়েটা বিকেলে রেস্তোরাঁ ছেড়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছে, রাতে বাড়ি ফিরে তাকে না দেখলে কার না দুশ্চিন্তা হবে? তার উপর আদ্রিকাকে নিয়ে পরখের পূর্বের অভিজ্ঞতা খুব একটা সুখকর নয়।
কখনো গিয়ে পার্কে বসে থাকে, কখনো অচেনা অটোতে উঠে পরে, কখনো মাঝরাস্তায় বসে প্রাক্তনের শোকে উন্মাদনা করে৷ এতোকিছুর পর পরখের ভয় পাওয়াটা স্বাভাবিক।
পরখ ঠিক করল, পরবর্তীতে আর আদ্রিকাকে এভাবে সময় অসময়ে কটু কথা শোনাবে না। সুযোগ বুঝে একেবারে অনেকগুলো কথা শুনিয়ে দিবে।
নিজ কৃতকর্মের দরুন সামান্য অপরাধবোধ জন্ম নিল পরখের মনে। আদ্রিকার মাথায় হাত বুলিয়ে জানতে চাইল,
‘আদ্রিকা, কি হয়েছে? শরীর খারাপ লাগছে?’
আদ্রিকার ইচ্ছে করলো এই খারাপ লোকটাকে হ/ত্যা করে তার র/ক্তে স্নান করতে। যখন ইচ্ছে হবে ঘাড় ধরে বের করে দিবে আবার যখন ইচ্ছে হবে চলে আসবে নাটক করতে।
আদ্রিকা ঘাড় ফিরিয়ে পরখের দিকে তাকিয়ে বললো,
‘আপনি আমার সাথে এমন করেন কেনো? আমার খারাপ লাগে না বুঝি? না হয় একটা ভুল করে ফেলেছি, তাই বলে সবসময় এভাবে অপমান করবেন?’
সেই প্রসঙ্গে না গিয়ে পরখ বলল,
‘খেয়ে এসে ঠিকঠাক ভাবে ঘুমাও।’
বিছানা ছেড়ে উঠতে যাচ্ছিল পরখ। কিন্তু আদ্রিকা এগিয়ে এসে পরখের ঊরুর উপর মাথা রেখে শুয়ে পড়লো।
‘আমি একটু ভালো থাকার চেষ্টা করছি। সব ভুল শুধরে নিতে চাইছি৷ সাহায্য করতে না পারেন, অন্তত এভাবে আমাকে হেয় করবেন না।’
পরখ ওকে জোর করে উঠিয়ে ডাইনিং টেবিলে নিয়ে এলো৷ সামান্য একটু খেয়ে আদ্রিকা ফিরে এলো নিজের কক্ষে। এতো ক্লান্ত লাগছে! পুরো শরীর ম্যাচম্যাচ করছে কেনো যেনো। পোশাক পাল্টানোর শক্তিও নেই দেহে। টলতে টলতে বিছানায় এসে শুয়ে পড়লো।
মাঝরাতে পরখের ঘুম ভাঙ্গল অদ্ভুত শব্দে৷ একটু মনোযোগ দিয়ে শোনার পর বুঝল, পাশের কক্ষ থেকে আদ্রিকার গোঙ্গানির শব্দ ভেসে আসছে। যেচে ঝামেলা ঘরে তুলে আনলে যা হয় আরকি! রাত-বিরেতে সুখের ঘুম জলাঞ্জলি দিয়ে পরখকে ছুটতে হলো আদ্রিকার কক্ষে৷
ছোট বিছানার একপাশে জড়োসড়ো হয়ে শীতে কাঁপছে আদ্রিকা৷ পরখ দ্রুত এগিয়ে গিয়ে আদ্রিকার কপালে হাত রেখে দেখলো, গায়ে ভীষণ জ্বর।
দ্রুত নিজের কক্ষের আলমারি থেকে মোটা কম্বল বের করে পরখ ফিরে গেল আদ্রিকার কক্ষে। ভালোভাবে গা ঢেকে দিতে গিয়ে দেখল আদ্রিকা এখনো বাইরের পোশাক ছাড়েনি।
বার বার ডেকেও আদ্রিকাকে সজ্ঞানে আনা গেল না। অথচ এই পোশাক পরে স্বস্তিতে ঘুমাতেও পারবে না।
বাধ্য হয়ে পরখকেই সেই দায়িত্ব কাঁধে নিতে হলো। ওকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে একে একে গয়নাগুলো খুলে টেবিলে রাখল। চুলের পাঞ্চক্লিপ খুলতে গিয়ে দেখল আদ্রিকার চুল এখনো ভেজা। ভেজা চুলগুলো বালিশে ছড়িয়ে দিল। তারপর গা থেকে শাড়িটি খোলার সময় পরখের সারা গা ঝিমঝিম করে উঠল। অস্বস্তি হতে শুরু করল৷ তখনি মনে পড়ল রুমির বলা কথাটি। হালকা নড়েচড়ে বসে খুকখুক করে কাশল পরখ। সত্যি সে লজ্জা পাচ্ছে। নিজের অকারণ লজ্জা, অস্বস্তিকে নিয়ন্ত্রণ করে ঘরের বাতি নিভিয়ে দিল।
আলমারি থেকে পোশাক বের করে অন্ধকার হাতড়ে আদ্রিকার শরীরের পোশাক খুলে টিশার্ট, পালাজো পরিয়ে দিয়ে আবার আলো জ্বালিয়ে আদ্রিকাকে ডাকলো।
হালকা চোখ মেলে তাকিয়ে বারবার ঘুমে ঢলে পড়ছে আদ্রিকা। ওভাবেই জ্বরের ঔষধ খাইয়ে দিয়ে, মোটা কম্বল গায়ে চাপিয়ে দিয়ে পরখ ফিরে গেল নিজের ঘরে।
*****
ঘুম থেকে উঠে বেশ হালকা লাগছে আদ্রিকার। নিজের দিকে তাকিয়ে রাতের কথা আবছা মনে পড়লো। গায়ের জামা কাপড় দেখে আপন মনে হেসে বিড়বিড় করলো,
‘রোবট একটা।’
লম্বা হাই তুলে মোবাইলে সময় দেখল। খুব একটা সকাল এখনো হয়নি৷ সারারাত ঘুমানোর কারণে শরীরে ব্যথা ধরে গেছে। দ্রুত বিছানা ছেড়ে উঠল পড়ল।
হেলেদুলে আদ্রিকা হাজির হলো পরখের কক্ষে৷ গতকালের অপমানের একটা প্রতিশোধ নেওয়া দরকার৷ এমনি এমনি ছেড়ে দিলে চলবে না।
রাতে ঘুমের ব্যাঘাত ঘটায় পরখ এখনো ঘুমাচ্ছে৷ আদ্রিকা ধুপ করে পরখের পাশের স্থানটিতে শুয়ে পড়ল।
চোখ মেলে পাশে আদ্রিকাকে শুয়ে থাকতে দেখে পরখের মাথায় প্রথমেই যে প্রশ্নটি উঁকি দিল তা হলো, এই মেয়ের জ্বর সেরেছে কি? কপালে হাত ছুয়ে একবার দেখা উচিত।
অথচ সেটি না করে থমথমে মুখে বলল,
‘তুমি এখানে কি করছ?’
আদ্রিকার আহ্লাদী স্বরে বলল,
‘উফ! আপনার ঘুমকাতুরে কণ্ঠস্বরটা মারাত্মক। গপ করে খেয়ে ফেলার মতো মজার শোনায়।’
এমন কথা শুনে হকচকিয়ে গেল পরখ। তৎক্ষনাৎ ঘুমও ছুটে গেল৷ বিরক্ত হয়ে বিছানা ছাড়তে চাইলে আদ্রিকা দু হাতে পরখের গলা জড়িয়ে ধরে বলল,
‘কাল রাতে আপনি আমার শাড়ি খুলেছেন কেনো?’
প্রশ্নের ধরণ শুনে পরখের মনে হলো সে কোনো নিরীহ রমণীর ঘুমিয়ে থাকার সুযোগ নিয়েছে৷ বিস্মিত পরখ চোখ দুটো সরু করে বলল,
‘হোয়াট?’
‘শাড়ি খুলে আর কি কি করেছেন? আমার ঠিকঠাক মনে পড়ছে না।’
প্রশ্নের বাহার শুনে আদ্রিকার হাত থেকে মুক্তি পেতে মরিয়া হয়ে গেল পরখ। আদ্রিকা হাত তো ছাড়লোই না, উল্টো পরখের গায়ের উপর উঠে আরও ঘনিষ্ঠ হলো। পরখের ঠোঁটে চট করে একটা চুমু দিয়ে বলল,
‘এভাবে চুমু খেয়েছেন?’
পরখ একপাশে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে বলল,
‘সবাই তোমার প্রাক্তনের মতো সুযোগ সন্ধানী নয়। কারো অসহায়ত্বের সুযোগ নেওয়ার মতো অমানুষ আমি নই। অবশ্য তোমার অসহায়ত্বের সুযোগ নেওয়ার দরকার পড়ে না। তুমি এমনিতেই সুযোগ দেওয়ার জন্য মুখিয়ে থাকো।’
সকালবেলা এমন বিশ্রী কথা শুনে ক্ষণিকের জন্য স্তম্ভিত হয়ে গেল আদ্রিকা। সেই সুযোগে পরখ ওকে গায়ের উপর থেকে সরিয়ে দিয়ে বিছানা থেকে নেমে সোজা হয়ে দাঁড়াল।
আদ্রিকার কিছুটা সময় লাগল নিজেকে সামলাতে৷ পরখ আদ্রিকার দূর্বলতা জানে তাই বারবার সেখানে আঘাত করে। আদ্রিকাও এখন পরখের দূর্বলতা ধরতে পেরেছে। বোল্ড কথাবার্তা কিংবা কার্যকলাপে পরখের মুখে নুন পড়ে। পরখকে শায়েস্তা করতে যদি আদ্রিকাকে ছ্যাচড়া, বেহায়া, অশ্লীল মেয়ে হতে হয় আদ্রিকা তাই হবে। তবুও তিনদিনের সংসারের দুদিনের স্বামীকে সে একটা উচিত শিক্ষা দিয়ে তবেই ক্ষ্রান্ত হবে।
আদ্রিকা দ্রুত বিছানা ছেড়ে নিচে নামল। পরখের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আবার পরখের গলা জড়িয়ে ধরে পায়ের আঙ্গুলে ভর দিয়ে উঁচু হয়ে পরখের ঠোঁটে তপ্ত চুমু খেলো।
প্রতিবার অতীতের প্রসঙ্গে আদ্রিকা মুখ লুকিয়ে পালায়। কেঁদেকেটে একাকার হয়ে কয়েকটা দিন পরখের থেকে দূরে থাকে৷ কিন্তু এবার ঘটনা ঘটল উল্টো। হতবাক পরখ রাগে কাঁপতে কাঁপতে বললো,
‘তুমি… তুমি একটা বিরক্তিকর মেয়ে। অশ্লীল, অসভ্য। সরো সামনে থেকে৷’
আদ্রিকার সরলো না৷ গলা জড়িয়ে ধরে রেখেই পরখের গায়ের উপর ঢলে পড়ে আরেকটা চুমু খেলো। ওকে দু হাতে শক্তি প্রয়োগ করে সরিয়ে দিয়ে রাগে গজগজ করতে করতে পরখ চলে গেল বাথরুমে৷
দরজা চাপিয়ে জামা কাপড় খুলে নিম্নাঞ্চলে তোয়ালে পরে শাওয়ার চালু করতে গিয়ে পরখ দেখল শাওয়ার থেকে পানি পড়ছে না৷
ট্যাঙ্কিতে বোধহয় পানি শেষ। মোটরের সুইচ বাথরুমের বাইরের দেয়ালে৷ সুইচ অন করার জন্য দরজা খুলে বাইরে আসতেই আদ্রিকার সাথে ধাক্কা খেলো। নিজেকে সামলানোর আগেই আদ্রিকা ওকে ঠেলে বাথরুমের ভেতরে ঢুকিয়ে দিয়ে নিজেও ঢুকে পড়লো। হতবিহ্বল পরখ দেয়ালের সাথে সেঁটে দাঁড়িয়ে বড় বড় চোখে আদ্রিকার দিকে তাকিয়ে অবিশ্বাস্য কণ্ঠে বলল,
‘তোমার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে?’
পরখের উন্মুক্ত বক্ষে আবেদনময়ী ভঙ্গিমায় হাত ছুয়ে আদ্রিকা বললো,
‘আপনি আমাকে যখন তখন বাজে কথা বলবেন না। আমার মন খারাপ হয়।’
আদ্রিকার চোখে জল চিকচিক করছে৷ অথচ মুখে দুষ্টু হাসি। চোখের দৃষ্টি পরখের বুকের দিকে। যেনো খুব লোভনীয় কিছু দেখছে৷ পরখ বেশ লজ্জা পেলো এবং আদ্রিকার হাত সরানোর চেষ্টা করলো।
এক হাত সরিয়ে দিতেই আদ্রিকা আরেক হাত রাখল পরখের বুকের উপর। দু হাতে ওর হাত দুটো আটকে দিয়ে পরখ আদ্রিকার উপর নিয়ন্ত্রণে নিতে চাইলো। কিন্তু আদ্রিকার মাথায় লাভা টগবগ করছে। সে হার মানবে না। এই অসামাজিক গোঁয়ার লোকটাকে আজ সে চরম শিক্ষা দিবে৷
পরখের গায়ের উপর নিজের সম্পূর্ণ ভর ছেড়ে দিয়ে পরখের উন্মুক্ত বক্ষে ঠোঁট ছোয়ালো। কেঁপে উঠলো পরখ। ঝটপট করে আদ্রিকার হাত ছেড়ে দিয়ে ঝগড়ায় ইস্তফা দিয়ে পরখ বললো,
‘আচ্ছা বলবো না৷ যাও এখান থেকে।’
আদ্রিকা সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বাঁকা হাসলো। ঘুরে দাঁড়িয়ে প্রস্থান করার সময় একটানে খুলে নিলো পরখের নিম্ন বদনে পরিধানকৃত গামছা।
এক হাতে গামছা নিয়ে কোনোদিকে না তাকিয়ে দরজা খুলে সোজা বেরিয়ে এলো বাথরুম থেকে। দরজাটা হাট করে খুলে রাখা। বিস্ময়াভিভূত পরখ দৌড়ে গিয়ে দরজা বন্ধ করে ওখানেই কপাল ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো কিছুক্ষণ। কী থেকে কি হয়ে গেলো! পুরোটাই বিশ্রী একটা স্বপ্নের মতো লাগছে। আদ্রিকার মাথাটা কি এবার পুরোপুরি খারাপ হয়ে গেছে?
তখনি ঝিরঝির করে পড়ন্ত পানির ফোটা পরখের শরীর ভিজিয়ে দিলো।
গোসল শেষে পোশাক পরতে গিয়ে পরখ দেখল সেগুলোও উধাও। অথচ সে নিজে হাতে কাপড় এনে রেখেছিল বাথরুমে। নিশ্চয়ই আদ্রিকার কারসাজি৷ পরখ একবার এখান থেকে বেরিয়ে নিক, বেয়াদব মেয়েটাকে একটা উচিত শিক্ষা দিবে। কিন্তু এই মুহূর্তে মাথা গরম করা চলবে না।
দরজাটি সামান্য খুলে উঁকি দিয়ে পরখ বিনয়ের সাথে ডাক দিল,
‘আদ্রিকা?’
ভূতের মতো তখনি দরজার সামনে হুট করে হাজির হলো আদ্রিকা। হকচকিয়ে গেলেও পরখ নিজেকে সামলে নিয়ে এবার গুরুগম্ভীর কন্ঠে আদেশ করলো,
‘আমার তোয়ালে আর কাপড় দেও।’
সামান্য উন্মুক্ত দরজার ফাঁক গলে আদ্রিকা এমন ভাবে নিচের দিকে তাকাচ্ছে যেনো সে পরখের নগ্ন দেহকে যাচাই করে নিচ্ছে। এমন নির্যাতিত দৃষ্টির সামনে পরখ আরেকটু গুটিয়ে নিলো নিজেকে।
যদিও পরখের মুখমণ্ডল ছাড়া কিছু অবলোকন করা সম্ভব হচ্ছে না। তবুও পরখকে ভড়কে দিতে পেরে আদ্রিকা ভীষণ মজা পেলো।
মুখখানা স্বাভাবিক রেখে কোমর দুলিয়ে দুলিয়ে পরখের ঘরে আলমারির সামনে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে চিৎকার করে আদ্রিকা বলল,
‘আপনার জামা কাপড় কিছুই খুঁজে পাছি না।’
অথচ পরখের জামাকাপড় সব পরিপাটি করে আলমারিতে গুছিয়ে রাখা৷ পরখ দাঁতে দাঁত চেপে রাগ নিয়ন্ত্রণ করে বলল,
‘তোয়ালে নিয়ে এসো।’
আদ্রিকা তোয়ালে নিয়ে হাজির হলো কিন্তু সেটা পরখের নয়, ওর নিজের। তোয়ালে এগিয়ে দিয়ে বলল,
‘আপনার তোয়ালে খুঁজে পাইনি।’
‘আমি তোমার তোয়ালে ইউজ করবো?’
‘নিতে না চাইলে নিবেন না। ওভাবেই বেরিয়ে আসুন।’
ওর কথা শুনে পরখ কিছুক্ষণ বাক্যহারা হয়ে চেয়ে রইলো। তারপর হাত বাড়িয়ে তোয়ালেটি নিয়ে ঠাস করে দরজা বন্ধ করে দিলো। পরখকে জব্দ করতে পেরে আদ্রিকা খিলখিলিয়ে হেসে ফিরে গেলো নিজের কাজে৷ আদ্রিকার অতীত নিয়ে খোঁচা দেওয়া? এখন মুখ লুকিয়ে চলছে কেনো?
নিম্নভাগে তোয়ালে প্যাঁচিয়ে ঘরে ফিরে পরখ দেখলো আদ্রিকা ওর আলমারি গুছাচ্ছে। মুহূর্তেই রাগটা আবার মাথায় চেপে বসলো। রাগে তেড়ে গেল আদ্রিকার দিকে। হাত ধরে ঝটকা মেরে ওকে নিজের দিকে ফিরিয়ে প্রশ্ন করলো,
‘আমার কাপড় কোথায় তুমি জানো না? খুঁজে পাচ্ছিলে না? নাটক হচ্ছে আমার সাথে?’
আদ্রিকা কিছু না বলে ঠোঁট বাঁকিয়ে হেসে পরখের হাঁটুতে নিজের হাঁটু দিয়ে সামান্য ধাক্কা দিল। ভারসাম্য হারিয়ে দুলে উঠল পরখ। ওর বুকে আদ্রিকার নাজুক হাত সামান্য ধাক্কা দিতেই আদ্রিকাসহ পরখ দুম করে বিছানার উপর আছড়ে পড়ল।
পরখের বুক থেকে মুখ তুলে পাশে শুয়ে পরল আদ্রিকা। কনুইয়ে ভর দিয়ে পরখের মুখের উপর ঝুঁকে ঠোঁটে ঠোঁট চেপে ধরলো৷ চঞ্চল হাত বিচরণ করতে শুরু করল পরখের উন্মুক্ত শরীরে৷ পরখ নিজেও অন্য জগতে বিভোর। চোখ জোড়া বন্ধ করে দু হাতে জড়িয়ে ধরেছে আদ্রিকাকে। দীর্ঘ চুম্বন শেষে দুজনে শ্বাস নিয়ন্ত্রণে আনার প্রয়াসে ব্যস্ত। ভাবনার জগত থেকে বাস্তবিকতায় ফিরে আদ্রিকাই প্রথম কথা বলল।
‘অ্যাম আই এফেক্টিং ইউ, ইবতেহাজ পরখ?’
আদ্রিকার উচ্চারিত বাক্যগুলো পরখকে যতোটা না অবাক করে দিল তার থেকেও বেশি অবাক করে দিল দেহের নিম্নভাগে আদ্রিকার হাতের ছোঁয়া। চকিতে চোখ খুলে তাকিয়ে দেহের উপর থেকে আদ্রিকাকে সরিয়ে দিয়ে পরখ সোজা হয়ে বসলো।
ওদিকে বিছানায় গড়াগড়ি দিয়ে হাসছে আদ্রিকা৷ সেদিকে না তাকিয়ে আলমারি থেকে কাপড় বের করে পরখ বাথরুমের দিকে চলে গেলো। উন্মাদিনীর সাথে কথা বলে সময় ও সম্মান দুটোই নষ্ট করার কোনো মানে হয় না৷ আজকে নিশ্চয়ই আদ্রিকার মাথায় গন্ডগোল হয়েছে৷ নিরাপদ দূরত্ব বজার রাখা বাঞ্ছনীয়।
চলবে..
#অক্ষরময়ী
#পরিণয়ে_নোলককন্যা (কপি নিষেধ)
|৫১|
সকালের নরম রোদ ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে সূর্যের তেজিয়ান দাপটে। বাড়ন্ত বেলার সাথে রসনাবিলাসীতে ভীড় বাড়তে শুরু করেছে। দুজন দক্ষ রাধুনি উত্তপ্ত চুলার পাশে দাঁড়িয়ে রান্নায় ব্যস্ত। আরেকপাশে দাঁড়িয়ে আছে আদ্রিকা। মস্ত বড় কড়াইয়ের ঢাকনা সরিয়ে চুই-রসুন দিয়ে কষা গোশত আরেকবার দেখে নিল। ঝোল আরেকটু কমে গেলে নামিয়ে ফেলতে হবে।
চুলার আঁচ আরেকটু বাড়িয়ে দিল আদ্রিকা। হঠাৎ ঝড়ের গতিতে ছুটে এলো অনু। হাঁপাতে হাঁপাতে বলল,
‘ম্যাম, আপনাকে পরখ স্যার আপনাকে কল দিতে বললেন। কী যেনো জরুরি কথা আছে।’
আদ্রিকা শান্তভাবে পেছনে ফিরে তাকাল। রুমি ব্যতীত রেস্তোরাঁয় কেউ পরখ-আদ্রিকার সম্পর্কের ব্যাপারে অবগত নয়। কখনো ঘটা করে জানানোর প্রয়োজন হয়নি বলে, কেউ জানায়ও নি। অনুর কথায় আদ্রিকা ভাবলেশহীনভাবে জবাব দিল,
‘ঠিক আছে।’
অনু তখনও হাপাচ্ছে। আদ্রিকার এমন শান্ত জবাবে আরেকটু বিচলিত হয়ে বলল,
‘স্যার অনেকক্ষণ থেকে আপনাকে কল করছিল বোধহয়। আপনাকে না পেয়ে আমাকে কল দিয়ে জানালো।’
তরকারিতে মশলা ছড়িয়ে দিয়ে আদ্রিকা বলল,
‘কিচেনে ব্যস্ত ছিলাম। ফোন চেক করা হয়নি।’
আদ্রিকার এমন শান্ত অভিব্যক্তিতে অনু হতবাক হয়ে গেল। পরখ এই প্রতিষ্ঠানের মালিক। সে নিজে কল দিয়ে আদ্রিকার খোঁজ করেছে। অথচ আদ্রিকা এমন নির্লিপ্ত আচরণ করছে! চাকরির ভয় নেই নাকি?
অনুকে থমকে থাকতে দেখে আদ্রিকা ঘাড় ফিরিয়ে জানতে চাইলো,
‘আপনি আর কিছু বলবেন?’
অনু থমথমে খেয়ে জবাব দিল,
‘পরখ স্যার এক্ষুণি কল করতে বলেছিলেন। প্রয়োজনীয় কিছুই হবে হয়তো।’
‘রান্নাটাও প্রয়োজনীয় অনু। আপনি নিজের কাজ করুন। আমি পরখ স্যারের সঙ্গে কথা বলে নিবো।’
মাথা দুলিয়ে সম্মতি জানিয়ে অনু চলে গেল। আদ্রিকা নিজের মনে তরকারি রাঁধলো। অন্য রাধুনির সহায়তায় কড়াই নামিয়ে, রান্নাঘর গুছিয়ে গেল নিজের অফিসে। হাত মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে চেয়ারে আরাম করে বসে মোবাইলটি হাতে নিয়ে দেখল, পরখের চারটে মিসড কল।
সেদিনের আক্রমণের পর আদ্রিকার থেকে একরকম পালিয়ে বেড়াচ্ছে পরখ। হুট করে সামনে পড়লেও একপ্রকার দৌড়ে পালায়। আদ্রিকাও পরখকে খুব একটা বিরক্ত করে না। আজ হঠাৎ পরখের কী এমন দরকার পড়লো আদ্রিকাকে?
আদ্রিকা মোবাইল হাতে নিয়ে পরখকে কল করল। কল রিসিভ হওয়া মাত্র আদ্রিকা বিরক্তিভাব নিয়ে বলল,
‘কী প্রয়োজন?’
লেকচার মাঝপথে থামিয়ে, পুরো ক্লাসকে বসিয়ে রেখে আদ্রিকার কল রিসিভ করেছে পরখ। অথচ আদ্রিকা জানতে চাইছে, কী প্রয়োজন? পরখ থমথমে খেয়ে গেল। ফাঁকা বারান্দায় নিজের থমথমে চেহারাটা তৎক্ষনাৎ সামলে নিয়ে ভারিক্কি গলায় বলল,
‘অনেকবার কল দিয়েছিলাম।’
‘ব্যস্ত ছিলাম।’
‘ফোনের শব্দও শুনতে পাওনি? নাকি ইচ্ছে করেই রিসিভ করোনি?’
‘ফোন কাছে ছিল। আমি অকারণ ফোন সাথে নিয়ে ঘুরি না।’
‘আমি প্রয়োজনেই কল দিয়েছি।’
‘আপনি কি ক্লাস রেখে আমার সাথে ঝগড়া করার জন্য কল দিয়েছেন?’
সত্যিই তো? ক্লাসের মাঝে কেনো আদ্রিকার সাথে বাকবিতন্ডায় জড়ানো? আদ্রিকার এড়িয়ে চলায় সে কি বিরক্তবোধ করছে? নাকি রুষ্ট হচ্ছে? পরখ নিজের বিগড়ে যাওয়া মেজাজ সামলে নিয়ে বলল,
‘পরীক্ষার প্রবেশপত্র দিচ্ছে। এসে নিয়ে যাও।’
পরীক্ষার নামমাত্র আদ্রিকার মন খারাপ হয়ে গেল। কেনো আসে এই পরীক্ষাগুলো? এই তো সেদিন টেস্ট পরীক্ষা শেষ হলো। এখনি আবার ফাইনাল পরীক্ষার সংবাদ কেনো?
মুখখানা বাংলা পাঁচের মতো বাকিয়ে আদ্রিকা বলল,
‘আচ্ছা। ঠিক আছে।’
ফোনালাপে আদ্রিকার অনাগ্রহ এবং ফোন রাখবার তাড়ায় পরখ এবার সত্যি রুষ্ট হলো। কী এমন মহাকার্য করছে আদ্রিকা? এতো কীসের ব্যস্ততা? পরখ ক্লাস ফেলে রেখে এই অকৃতজ্ঞ মেয়েটাকে প্রবেশপত্রের কথা জানাতে একেরপর এক কল করে যাচ্ছিল, আর সে দু মিনিট ভালোভাবে কথা বলতে পারছে না?
পরখ তার বিরক্তিবোধ জাহির করার আগেই আদ্রিকা বলল,
‘রাখছি।’
‘আমি নিয়ে যেতে পারতাম। কিন্তু তোমার সিগনেচার লাগবে।’
কোনোকিছু না ভেবেই হঠাৎ কেনো আদ্রিকাকে এই কথা বলল পরখ জানে না। এতো সাফাই দিতে কেনো গেল সে জানে না? কিন্তু হড়বড়িয়ে কথাটি বলার পর পরখ বেশ অস্বস্তিতে পড়ল। পরখ স্পষ্ট বুঝতে পারছে, ওপাশে আদ্রিকাও পরখের এমন আচরণে বেশ চমকেছে। ওকে বিশেষ প্রতিক্রিয়া জানানোর সুযোগ না দিয়ে পরখ দ্রুত কলটি কেটে দিল।
দুপুরের কিছুক্ষণ আগে আদ্রিকা এসেছে কলেজে। ইতিমধ্যে বাকিরা এসে প্রবেশপত্র নিয়ে গেছে। পরখের সাথে কথা বলার পর আদ্রিকা ফোন চেক করে ইফফাতের মেসেজ পেয়েছে। গতকাল রাতেই প্রবেশপত্র সংগ্রহের খবরটি ইফফাত আদ্রিকাকে জানিয়েছে। কিন্তু আদ্রিকা নিজের হেয়ালির কারণে সে মেসেজ এতোক্ষণ পর দেখতে পেল।
অবশ্য দেরীতে কলেজ পৌঁছে বিশেষ ক্ষতি হয়নি।বরং লাভ-ই হয়েছে। ফাঁকা অফিস-রুমে অল্প সময়ের মধ্যে সমস্ত কার্যক্রম সম্পন্ন করে আদ্রিকা বেরিয়ে এলো।
হাতে প্রবেশপত্রটি নিয়ে মানবিক বিভাগের ভবন থেকে বেরিয়ে প্রধান সড়কের রাস্তা ধরে হাঁটছে আদ্রিকা। হঠাৎ সামনে এসে থামল পরখের বাইক। এসময় পরখকে দেখে আদ্রিকা ভ্রু কুচকে তাকাল। একাডেমির অভ্যন্তরে পরখ কখনোই আদ্রিকার সামনে আসেনি। এখানে আদ্রিকার ছায়াও এড়িয়ে চলার চেষ্টা করে সে। অথচ আজ আদ্রিকার চোখে চোখ রেখে পরখ বলল,
‘কাজ শেষ?’
আদ্রিকা তখনো আকস্মিক ঘটনার রেশ কাটিয়ে উঠতে পারেনি। ছোট করে হুম বলে উত্তর দিল। পরখ আশেপাশে সতর্ক দৃষ্টি ফিরিয়ে আদ্রিকাকে বলল,
‘ঠিক আছে। বাইকে উঠো।’
আদ্রিকা কিছু না বলে সূক্ষ্ম চোখে চেয়ে রইল। মাঝরাস্তায় বাইক থেকে নামিয়ে দেওয়া ব্যক্তিটির বাইকে উঠে পরা কতোটা যৌক্তিক হবে?
আদ্রিকাকে ওভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে পরখ নিজ কর্মকাণ্ডের সাফাই দিয়ে বলল,
‘ক্লাস শেষ। আমিও বাড়ি ফিরব।’
আদ্রিকার একবার মনে হলো খুব কড়া করে কয়েকটা কথা শুনিয়ে দিবে। কিন্তু পরখকে সে না করতে পেরেছে কবে? ইহজনমে বোধহয় এই মানুষটিকে ফিরিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা আদ্রিকার হবে না। পরখের উজ্জ্বল চোখ জোড়ায় সম্মোহিত আদ্রিকা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিঃশব্দে বসে পড়ল পরখের বাইকের পেছনে।
*****
ফাইনাল পরীক্ষা কড়া নাড়ছে দরজায়। দম ফেলবার ফুরসত নেই শিক্ষার্থীদের। উঠতে বসতে চলতে শুতে বই হাতে ঘুরছে পরীক্ষার্থীরা। আদ্রিকা নিজেও একজন পরীক্ষার্থী। অথচ বই হাতে নিলেই আদ্রিকার মাথা ব্যথা শুরু হয়ে যায়। বইয়ের আশেপাশে থাকলে বিগড়ে যায় মেজাজ।
পরীক্ষার বাহানায় আদ্রিকার রেস্তোরাঁয় যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে পরখ। গতরাতে খেতে বসে এমন সুন্দরভাবে প্রস্তাবটি রাখল যে, মুখের উপরে অসম্মতি জানাতে পারেনি আদ্রিকা।
‘পরীক্ষার আর কয়েকটা দিন আছে মাত্র। এই কয়েকটা দিন না হয় বাড়িতে থাকো। খাওদাও, পড়াশোনা করো, রেস্ট নেও।’
এভাবে বললে আদ্রিকা কীভাবে না করে দেয়? কিন্তু এখন মনে হচ্ছে না করে দেওয়া উচিত ছিল। বাড়িতে একলা বসে সময় কাটতে চাইছে না আদ্রিকার। পড়াশোনা করা তো অনেকদূরের কথা। কিছু একটা রান্না করে সময় কাটানো যেতো। কিন্তু আদ্রিকার মন্দ ভাগ্য। সিলিন্ডারের গ্যাস একদম তলানিতে। রাতের রান্না করতে হলে সিলিন্ডার ভরিয়ে আনতে হবে। পরখ ফিরে না আসা পর্যন্ত সে উপায় নেই।
ছাদে অলস পায়চারি করছে আদ্রিকা। মূলত ছাদ বাগানের গাছগুলোর সাথে নীরব আলাপচারিতা চলছে। গুমোট বিকেলের নিস্তব্ধতা ভেদ করে বাড়ির সদর দরজায় ঠকঠক শব্দ হলো। এ বাড়িতে দরজায় কড়া নেড়ে আগমনবার্তা জানানোর মতো অতিথি কালেভদ্রেও দেখা যায় না। স্বাভাবিকভাবেই আদ্রিকার বুক ধক করে উঠল।
ছাদ থেকে উঁকি দিয়ে আদ্রিকা দেখল, বাড়ির সদর দরজায় দাঁড়িয়ে আছে তার বাবা। বিশ্বাস হতে চাইল না আদ্রিকার। দু চোখ কচলে আবারও তাকাল। নাহ, ভ্রম নয়। সত্যি আদ্রিকার বাবা মোকাররম সদর দরজায় দাঁড়িয়ে আছে।
আদ্রিকার ঘোর কাটতে কিছুটা কালবিলম্ব হলো। তারপর যখন বোধশক্তি ফিরে পেলো, তখন এক ছুটে ছাদ থেকে নিচে নেমে এলো।
বাবাকে দেখে আদ্রিকার চোখ জোড়া সিক্ত হয়ে উঠেছে। মুখে কেমন বোকা বোকা হাসি। এমন অভ্যর্থনায় মোকাররম নিজেও খানিকটা বিব্রত হলো।
শরীর খানিকটা সুস্থ হতেই আশেপাশে একটু হাঁটার নাম করে মোকাররম যে আদ্রিকার বাড়ি চলে আসবে তা জানলে নীহার হয়তো মোকাররম একলা ছাড়ত না।
খোলা দরজার একপাশে দাঁড়িয়ে আদ্রিকা বলল,
‘আব্বু, ভেতরে আসো।’
মোকাররম খানিকটা ঝুকে মাটি থেকে মাটির টবটি তুলল। আদ্রিকা অবাক হয়ে খেয়াল করল, তার বাবা খালি হাতে আসেনি। সাথে একটি ফুলগাছ নিয়ে এসেছে। এই অসুস্থ শরীরে বড় মাটির টব বইতে দেখে আদ্রিকা এগিয়ে গিয়ে বলল,
‘আমাকে দেও। আমি তুলছি।’
মোকাররম বাধা দিয়ে বলল,
‘বেশি ভারি না। নিতে পারব।’
আশেপাশে তাকিয়ে আদ্রিকা বলল,
‘তুমি একা এসেছো?’
‘হ্যাঁ। ’
‘আম্মু আসতে দিল? তুমি আসবে আমাকে কেউ জানাইয়ো নি। কী আজব!’
‘নীহার জানে না। এমনি হাটতে হাটতে চলে এলাম। কাউকে বলে আসিনি।’
অতি উচ্ছ্বাস, আনন্দে আদ্রিকা এতোক্ষণ মোকাররমের নিয়ে আসা গাছটিকে ভালোভাবে লক্ষ্য করেনি। কিন্তু মোকাররম যখন গাছটিকে ছাদ বাগানে রাখল তখন বাগানবিলাস গাছটিকে দেখে আদ্রিকার মুখের সমস্ত রঙ উড়ে গেল।
আদ্রিকাকে থমকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মোকাররম বলল,
‘একটা চেয়ার নিয়ে আয়। ছাদে বাতাস আছে এখানেই বসি। আজকাল একটু হাঁটতেই হাপায় যাই।’
আদ্রিকা দৌড়ে গিয়ে এক গ্লাস পানি ও চেয়ার নিয়ে এলো। আরাম করে বসে মোকাররম বলল,
‘একটা নার্সারিতে কয়েক রঙের বাগানবিলাস পাইছিলাম। ওগুলা দিয়ে কলম করে বনসাইটা করছি। গাছটা ভালোই হইছিল। অসুখে পড়ে কয়েকদিন ঠিকঠাক যত্ন নেওয়া হয়নি। এজন্য এমন নেতায় পড়ছে। তোর কাছে রাখ। ঠিকঠাক যত্ন নিলে আবার সুন্দর হয়ে উঠবে।’
গাছটির সামনে ছাদে আসন পেতে বসে আলতো হাতে বাগানবিলাসটির লিকলিকে পাতা ছুয়ে দেখল আদ্রিকা। ছোট গাছটি শিশুর মতো কোমল, সুন্দর, সতেজ।
আদ্রিকার ভেতরকার আবেগ উদ্বেলিত হতে শুরু করল। বনসাই, প্রিয় বনসাই, আদরের বনসাই। একদিন আদ্রিকার বুক থেক্ব ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছিল যাকে। আজ অনেকদিন পর আবারও আদ্রিকার কোল ভরে উঠল। বাবার দিকে চেয়ে আদ্রিকা বড্ড বোকা একটি প্রশ্ন করল,
‘এটা আমার জন্য?’
মেয়ের বেদনামিশ্রিত মুখের দিনে চেয়ে মোকাররম কিছু বলল না। শুধু অলস চোখে কিছুক্ষণ চেয়ে রইল৷
আদ্রিকা আরও কিছুক্ষণ বনসাইটির গা ছুয়ে আদর করল। তৃষ্ণার্ত গাছের গোড়ায় পানি দিয়ে ছাদের এককোনায় রেখে দিল।
মোকাররম তখনি ফিরে যেতে চাইলে আদ্রিকা খানিক জোর করে তার ছোট ঘরটিতে নিয়ে গেল মোকাররমকে। কাঠের সেই জীর্ণ সোফায় বাবাকে বসিয়ে আদ্রিকা ছুটল রান্নাঘরে।
এমনি তার কপাল যে বাবা যেদিন এলো সেদিনই সিলিন্ডারের গ্যাস ফুরিয়ে গেল। চুলায় চায়ের পানি বসিয়ে আদ্রিকা আপনমনে সৃষ্টিকর্তাকে ডাকতে থাকল। হে খোদা! অন্তত এক কাপ চা যেনো বানিয়ে খাওয়াতে পারি। আমার বাড়ি থেকে বাবা খালি মুখে ফিরে যাবে, এমন লজ্জায় ফেলিও না।
চা তৈরির পুরোটা সময় উৎকণ্ঠায় কাটল আদ্রিকার। অতঃপর এক কাপ চা, কয়েকটা বিস্কুট দিয়ে বাবাকে আপ্যায়নের লজ্জায় মাথা নুইয়ে বলল,
‘দুপুরের রাঁধতে গিয়ে গ্যাস ফুরিয়ে গেছে৷ এক চা ছাড়া কিছুই রেধে খাওয়াতে পারলাম না। আরেকদিন সময় নিয়ে এসো৷ এখন আমি অনেককিছু রাঁধতে পারি৷’
মোকাররম আয়েশ করে চায়ে চুমুক দিল। বেশ ভালো চা বানাতে পারে মেয়েটা। তবে বাড়ির দূরাবস্থা দেখে মোকাররমের মন খচখচ করছে। বাড়ি ছোট হলেও সমস্যা কিছু ছিল না। মাত্র দুটো লোক, ওতো বড় বাড়ির কিইব দরকার! কিন্তু বাড়িতে আসবাবপত্র তেমন কিছু নজরে পড়ছে না। একটা ছোট টেবিল দেখা যাচ্ছে। এটাতে বসেই বোধহয় খাওয়াদাওয়া করা হয়। যে সোফায় মোকাররম বসে আছে, সেটাও বেশ পুরোনো। গদি অনেকখানি তলিয়ে গেছে।
সাংসারিক বিষয়ে মোকাররম কখনো মাথা ঘামায়নি। নিজের বাড়িতে কি কি আসবাবপত্র আছে, তা কখনো খেয়াল করার সময় হয়নি। ওসব নীহার সামলায়। কিন্তু আজকে মেয়ের বাড়িতে বসে সবকিছু খুটিয়ে খুটিয়ে দেখল মোকাররম। চায়ের কাপ নামিয়ে বেশ ইতস্ততভাবে জিজ্ঞাসা করল,
‘সংসার কেমন চলছে? সব ঠিকঠাক আছে তো?’
একপাশে ঘাড় কাত করে আদ্রিকা হাসিমুখে জবাব দিল,
‘হ্যাঁ। সব ঠিক।’
‘জামাইয়ের আয় ইনকাম কেমন?’
‘ভালোই।’
‘কিছু লাগলে বলিস। আমরা ব্যবসাপাতি যা আছে সব তো তোদেরই। ব্যবসাটা এখন অবশ্য আদ্রতার জামাই দেখতেছে। কিন্তু তোরও ভাগ আছে। টাকাপয়সা কিছু লাগলে তোর মায়ের থেকে নিবি।’
‘আমাদের ছোট সংসার। অল্প আয়েও আলহামদুলিল্লাহ ভালোই চলে। তুমি চিন্তা কোরো না।’
‘চললে ভালোই। সিলিন্ডারটা কই? দে দেখি৷ ভরিয়ে এনে দেই।’
‘তুমি এই শরীরে সিলিন্ডার টানাটানি করতে যাবা এখন? দরকার নাই। পরখ এসে ভরায় নিয়ে আসবে।’
‘রিক্সায় নিয়ে যাব।’
আদ্রিকার হাজার বারণ মোকাররম আমলে নিল না। ফাঁকা সিলিন্ডার কাঁধে তুলে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে গেল। বাজার থেকে সিলিন্ডারে গ্যাস ভরিয়ে রিক্সায় চড়ে আবার ফিরিয়ে নিয়ে এলো আদ্রিকার বাড়িতে। রিক্সাওয়ালাসহ আদ্রিকার রান্নাঘরে পৌছে দিল সিলিন্ডারটিকে৷
বাড়ি ফিরে যাওয়ার সময় পকেট থেকে পাচশত টাকার একটি নোট বের করে আদ্রিকার হাতে গুজে দিল। যে ভালোবাসার জন্য হাহাকার করেছিল আদ্রিকার শৈশব তা এই পরিণত বয়সে পেয়ে আদ্রিকা যেনো আরেকবার শৈশবে ফিরে গেলো। টাকা হাতে নিয়ে উচ্ছ্বসিত কিশোরীর মতো আনন্দ হতে লাগল। বাবার সামনে বিব্রতকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়ার ভয়ে ঠোঁট চিপে সে আনন্দ, উচ্ছ্বাস মনের ভেতরেই আটকে রাখল।
মোকাররমকে বাড়ির সদর দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিতে এলো আদ্রিকা। রিক্সায় উঠে বসার আগে মোকাররম এক অভাবনীয় কাজ করল। আদ্রিকার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,
‘সাবধানে থাকিস।’
এরপর দ্রুত রিক্সায় উঠে চলে গেল। পেছনে রেখে গেল এক ভঙ্গুর কন্যাকে। যে বাড়ির সদর দরজায় দাঁড়িয়ে হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করল। কেনো এভাবে বাবা এলো? কেনোই বা এতো স্নেহ, মমতা লুটিয়ে দিয়ে চলে গেল? আজ হঠাৎ-ই সে কেনো এতো ভালো হলো?
চলবে..
#অক্ষরময়ী