পরিণয়ে নোলককন্যা পর্ব-৫+৬

0
240

#পরিণয়ে_নোলককন্যা (কপি নিষেধ)

[০৫]

শীতের সকালে আতংকের আরেক নাম হচ্ছে ট্যাংকিতে জমে থাকা ঠান্ডা পানি। লেপের নিচের ওম থেকে বেরিয়ে যা দিয়ে হাত মুখ ধুতে হয়। কাকডাকা ভোরে ঘুম থেকে উঠে সেই বরফ সমতুল্য পানি হাত ছুঁয়ে পরখের সর্বাঙ্গ ঝাঁকুনি দিয়ে উঠলো। শব্দবিহীন আত্মচিৎকার বেরিয়ে এলো গলা থেকে।
মটর চালু করে আবার পানি তোলার ইচ্ছে হলো না৷ সেই ঠান্ডা পানি দিয়ে হাত মুখ ধোয়ার পর কী যেনো মনে করে গটগট করে ঘরে চলে গেলো। তোয়ালে এবং শুকনো জামা কাপড় নিয়ে এসে বাথরুমে ফিরে গিয়ে শাওয়ার চালু করে পানির ধারার নিচে দাঁড়িয়ে পরলো।

শীতল পানির সংস্পর্শে এসে মুহুর্তের মধ্যে শরীরের পেশির মধ্যে মৃদু ব্যথা অনুভব হলো। কিন্তু পরখ দাঁতে দাঁত চিপে ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো বরফ শীতল পানির ধারার নিচে। একসময় তাপমাত্রার সাথে খাপ খেতে বাধ্য হলো শরীর৷

হাতে বেশি সময় না থাকায় ঝটপট পোশাক পাল্টে কিচেনে গিয়ে একটা ডিম ভেজে পাউরুটি দিয়ে খেতে শুরু করলো। ওদিকে চুলায় চায়ের পানি ফুটতে দিয়েছে। চা খেতে খেতে ঘরময় পায়েচারি করে ব্যাগ গোছাচ্ছে৷ আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ভেজা চুলগুলো চিরুনি করে নিচ্ছিলো তখনি মোবাইলটি বেজে উঠলো।

অপরিচিত নাম্বার থেকে কল এসেছে হোয়াটসঅ্যাপে। পরখ ভালোভাবে তাকিয়ে দেখলো নাম্বারটি বাংলাদেশের নয়৷ মন থেকে সায় দিচ্ছিলো না, তবুও রিসিভ করলো।
হ্যালো বলার অপেক্ষা না করেই ওপাশ থেকে উচ্ছ্বসিত কন্ঠস্বর হড়বড়িয়ে বলে উঠলো,
– শুভ জন্মদিন পরখ।

চেনা কন্ঠস্বরটি ওকে কিছুপল স্তব্ধ করে রাখলো। অদ্ভুত এক ঘৃণায় সারা গা শিরশির করে উঠলেও কীভাবে সে ঘৃণা জাহির করতে হয় তা পরখের অজানা। ফোঁস ফোঁস করে লম্বা শ্বাস ফেলে সে বললো,
– তুই আর কখনো আমাকে কল দিবি না৷

ওপাশের ব্যক্তিটির উত্তরের অপেক্ষা না করে কল কেটে দিয়ে নাম্বারটি ব্লকলিস্টে রেখে দিলো। এই ছেলে যে পরিমাণ আত্মকেন্দ্রিক! নিজের সন্তুষ্টির জন্য বারবার কল দিয়ে পরখের মানসিক শান্তির বারোটা বাজিয়ে দিবে৷
ভাবতেই অবাক লাগে, এই ছেলেটির সাথে বিগত একটা বছর সে এই বাড়িতে ছিল। এমন স্বার্থপর ব্যক্তির সাথে সখ্যতা গড়ে তোলার অপরাধে রোজ আত্মদহনে দগ্ধ হতে থাকে সে। তাই তো এখান থেকে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য আরও বেশি তোড়জোড় করছে৷

মোবাইলটি বিছানার উপর রেখে দেয়ালে ঝুলিয়ে রাখা কাচের টুকরোয় ভেসে উঠা নিজের প্রতিবিম্বের দিকে তাকিয়ে পরখ নিজেকে প্রবোধ দিলো,
– অন্যের কথা ভেবে নিজের সুখ শান্তি নষ্ট করার মানে হয় না৷ আজকের দিনটা আমার জন্য বিশেষ। সবকিছু ভুলে নিজের কাজে মনোযোগ দেওয়া যাক।

কৃত্রিম হাসি ফুটিয়ে আয়নায় নিজের সুশ্রী মুখের দিকে তাকিয়ে সে ঘর ছাড়লো৷

পাসপোর্ট ও ভিসা অফিসের লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে পরখ অপেক্ষা করছিলো। আশেপাশে বিভিন্ন সেকশনে কয়েকটা লম্বা লাইন দেখা যাচ্ছে৷ এর মাঝে একটি লাইন হতে একজন ভদ্র মহিলার উচ্চ কন্ঠস্বর ভেসে আসছে৷ দায়িত্বরত অফিসার বারবার বিনীত অনুরোধ করছেন,
– আপনি এভাবে চিল্লাচ্ছেন কেনো? আস্তে কথা বলুন।

যা শুনে ভদ্র মহিলার কন্ঠস্বরের জোর যেনো আর‍ও একধাপ বেড়ে যাচ্ছে। বাধ্য হয়ে দায়িত্বরত অফিসার মহিলাটিকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে নিজের কাজে মনোযোগ দিলেন। কিন্তু উৎসুক জনতা তাকে উপেক্ষা করতে পারলো না। তারা প্রবল আগ্রহ নিয়ে মহিলাটির কথা শুনে যাচ্ছে।

– পাসপোর্ট তৈরি করতে দিয়েছিলাম প্রায় একমাস হলো। আমি সব কাগজপত্র ঠিকঠাক জমা দিয়েছি৷ উনারা পাসপোর্ট তৈরি করে আমার হাতে দিলো, কিন্তু আমার নাম আসছে ভুল। কেমনে কাজ করে এরা যে এতো গুরুত্বপূর্ণ একটা কাগজে নাম ভুল আসে? এই পাসপোর্ট নিয়ে আমি কতোদিন ধরে ঘুরতেছি জানেন? অনলাইনে আবেদন করলাম, পাসপোর্ট জমা দিলাম। এখন উনি বলতেছে নাম ঠিক করা যাবে না। বাইরে দারোয়ান বলতেছে এক হাজার টাকা দেন, আমি ব্যবস্থা করতেছি। যদি নাম সংশোধন করা না যাবে, তাহলে দারোয়ান আমার কাছে টাকা চাচ্ছে কেনো? এখানের অফিসার যদি ঠিক করে দিতে না পারে, তাহলে ও কীভাবে ঠিক করে দিবে? আর যদি ঠিক হয় তাহলে এই অফিসার আমাকে না বললো কেনো? টাকা লাগবে সেটা আমাকে বলতো। আমি উনাকে টাকা দিতাম। আমি দারোয়ানকে টাকা দিয়ে কেনো ঠিক করায় নিবো?

লজ্জায় মাথা তুলছেন না দায়িত্বরত অফিসার। ওদিকে দারোয়ানটি এক পা দু পা করে এগিয়ে এসে মহিলাটিকে ধমক দিয়ে বললেন,
– এই আপনি যান তো এখান থেকে। বাকিদের কাজ করতে দেন।
– নাহ আমি যাবো না। আমার কাজ না হওয়া পর্যন্ত আমি এখান থেকে নড়বো না। আমার জানা দরকার। আপনি আমার কাছে টাকা চাইলেন কেনো? একটা দারোয়ান যদি আমার পাসপোর্টের ভুল নাম সংশোধন করে দিতে পারে তাহলে উনারা কেনো পারবে না?

দারোয়ান কাচুমাচু করে আবার ফিরে গেলেন নিজের জায়গায়। উপস্থিত জনতা একে একে নিজেদের সাথে ঘটে যাওয়া দূর্নীতির বর্ণনা দিতে শুরু করলেন। কিছুক্ষণের মধ্যে চারপাশে বেশ গুঞ্জন শোনা গেলো।
হঠাৎ সিড়ি বেয়ে দোতলা থেকে অফিসের প্রধান কর্মকর্তাকে নেমে আসতে দেখা গেলো। যা দেখে কর্মীরা নড়েচড়ে বসে নিজের কাজে আরও বেশি করে ডুবে গেলেন। প্রধান কর্মকর্তা বেশ বিনয়ের সাথে ভদ্র মহিলার সামনে দাঁড়িয়ে অনুরোধ করলেন,
– আপনি প্লিজ আমার সাথে উপরে আসুন। আপনার কি সমস্যা আমি দেখছি।

ভদ্র মহিলার আন্দোলন এতো দ্রুত সফল হয়েছে, তা তিনি নিজেও বিশ্বাস করতে পারছেন না। কাগজপত্র গুছিয়ে চুপচাপ উপরে চলে গেলেন। উপস্তিত জনতা সবাই নিজের কাজে ফিরে যেতে যেতে ভদ্র মহিলার প্রশংসা করে বললেন,
– মহিলার বুদ্ধি আছে। চিৎকার চেচামেচি না করলে উনার কাজ জীবনেও হইতো না৷ হট্টগোল করায় বড় অফিসারের কানে কথা গেছে। এখন দেখবেন আজকের মধ্যে উনার কাজ হয়ে যাবে৷

ভীড়ের মাঝে দাঁড়িয়ে ওদের মুখের হাসি দেখে পরখ অবাক হলো। কারন এরাই কিছুক্ষণ আগ পর্যন্ত ভদ্রমহিলার উপর বেজায় বিরক্ত হচ্ছিলেন। মহিলা মানুষ মানেই চিল্লাপাল্লা। উনি অযথা চিৎকার করে অফিসের পরিবেশ নষ্ট করছেন। উনার জন্য বাকিদের কাজ আটকে গেছে বলে ফিসফিস করছিলেন।

খানিকক্ষণ পরেই পরখের ডাক পরলো৷ একটি স্লিপ হাতে দিয়ে দোতলায় যেতে বললেন কর্মীটি। ভিসার সকল কার্যক্রম দোতলায় সম্পন্ন হয়৷ আটাশ কিংবা ত্রিশ বছরের একজন যুবক পরখের কাগজপত্র অন্তিমবার চেক করে দেখলেন। পাসপোর্টের পাতা উল্টিয়ে হঠাৎ অবাক ভঙ্গিমায় প্রশ্ন করলেন,
– আজকেই তো ছয় ফেব্রুয়ারি। আরেহ! আজ আপনার জন্মদিন নাকি?

পরখ আলতো হেসে সম্মতি জানালো। যুবকটি কাগজপত্র পরখের হাতে দিয়ে চওড়া হেসে বললেন,
– শুভ জন্মদিন। আপনার সকল মনো কামনা পূর্ণ হোক। আগামীর জন্য শুভকামনা।

নিজের স্বপ্নের সন্নিকটে পৌঁছে ভেতরে ভেতরে বেশ উৎকন্ঠা অনুভব করলো সে। সেই সাথে সম্পূর্ণ অপরিচিত ব্যক্তিটির শুভেচ্ছা তার দিনটিকে আরোও রঙিন করে তুললো। অথচ দিনের শুরুটা হয়েছিল বিস্ময়ের তিক্ত কন্ঠস্বরের মাধ্যমে।

*****

পড়ন্ত বিকেল আজকাল দেখা যায় না। পড়ন্ত দুপুরের পর হুট করে একদম সন্ধ্যা নামে৷ মাথার উপরের সূর্যটা পশ্চিমদিকে একটুখানি ঢলতেই সন্ধ্যার প্রস্তুতি নিতে হয়। শুকনো পাতাগুলো আস্তে-ধীরে চটের বস্তায় ভরছিলো নীহার। বাড়ির ওপাশ থেকে নিজের নামের ডাক শুনে ভ্রু কুঞ্চিত হলো। ওর পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা আদ্রিকাকে বললো,
– দেখতো কে ডাকছে?

আদ্রিকা আজকাল মায়ের পেছনে ঘুরঘুর করে। মায়ের কাজে সাহায্য করতে চাইলেও নীহার ওকে কিছু করতে দেয় না৷ এমনিতেই শীতের দিন। হঠাৎ করে বেশি পানি ছুলে ঠান্ডা লেগে যাবে৷ আদ্রিকার তো এসবের অভ্যাস নেই৷ তাই ওকে ঘরেই থাকতে বলেছিল। বাইরে যা ঠান্ডা বাতাস! কিন্তু বরাবরের মতো মেয়ে তার কথা শুনলো না। মায়ের পিছু চলে এসেছে বাইরে৷ নীহার ওকে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে বলে নিজের কাজ করছিলো।

ইচ্ছে না থাকা সত্ত্বেও গুটিগুটি পায়ে বাড়ির দিকে এগিয়ে গেলো আদ্রিকা। বারান্দার সামনে মোজাম্মেল মজুমদারকে দেখে সালাম দিলো। সালামের জবাব দিয়ে মোজাম্মেল বললেন,
– তোমার মা কোথায়?
– বাড়ির পেছন পাশে।

একতলা বাড়িটির দুপাশে বিস্তর ফাঁকা জায়গা৷ উনারা দু ভাই এই বাড়িতে জন্ম নিয়েছেন। ছোট ছেলের প্রতি বরাবর দূর্বল ছিলো মোজাম্মেলের বাবা মহিউদ্দিন। পড়াশোনায় মনোযোগ ছিলো না মোকাররমের। সারাক্ষণ গাছপালার সাথে সময় কাটাতো। এর বাইরে কোনো কাজে ওর মন নেই। অন্যদিকে মোজাম্মেল ছিলো ভালো ছাত্র। অনার্স পড়াকালীন সময়ে পড়াশোনার পাশাপাশি চাকরি করতে শুরু করলেন। যুবক বয়সেই বড় ছেলের সফলতা দেখে মহিউদ্দিন আরও বেশি চিন্তিত হয়ে পরলেন। মোকাররম তখনো ভবঘুরে। বাবার সংসারে খায় আর বাড়ির চারপাশে গাছ লাগায়। কোথায়, কোন নতুন জাতের ফুল পাওয়া গেছে, তার পেছনে সারাদিন কাটিয়ে বাড়ি ফিরে রাতে৷ নেই কোনো বন্ধুবান্ধব, নেই কোনো শুভাকাঙ্ক্ষী। পরিবারের লোকজন কিংবা আত্মীয়স্বজন কারও সাথে মোকাররমের তেমন সখ্যতা নেই।
ছোট ছেলের প্রতি বিরক্ত থাকলেও মনে মনে তার চিন্তায় সারাক্ষণ অস্থির থাকতেন মহিউদ্দিন।

স্বামী-স্ত্রী বুদ্ধি করে একদিন প্রায় জোর করেই মোকাররমের বিয়ে দিলেন। গরীব ঘর থেকে মেয়ে আনলেন, যাতে ছেলের উদাসীনতার বিপরীতে ঘরের বউ বড় কথা শুনিয়ে দিতে না পারে৷ বিয়ের পর কয়েকমাস ছেলে এবং ছেলের বউকে নিজের টাকায় খাওয়ালেন। তবুও যদি ছেলে সংসারী হয়, ঘরের দিকে মন ফিরে। কিন্তু মোকাররম বরাবরের মতো উদাসীন, নির্লিপ্ত। বাধ্য হয়ে সংসারের দায়িত্ব মোকাররমের কাঁধে চাপিয়ে দিয়ে তাকে আয় রোজগারের পথে নামতে বাধ্য করলেন। কিন্তু মহিউদ্দিনকে চরম হতাশ করে দিয়ে মোকাররম শুরু করলো গাছের কারবার। তার ক্ষুদ্র নার্সারির আয় দিয়ে সংসার চলে মন্থর গতিতে। তবুও নীহার কখনো দ্বিরুক্তি করেনি।

আদ্রতার পর যখন আদ্রিকা জন্ম নিলো তখন মহিউদ্দিনের স্ত্রী গত হয়েছেন। মহিউদ্দিন নিজেও শয্যাশায়ী। নীহারের সেবাশুশ্রূষায় কোনোরকমে বেঁচে আছেন। দুই মেয়ে নিয়ে তার এই উদাসীন ছেলে ভবিষ্যতে কি করবে তাই ভেবে তিনি একদিন কঠিন সিদ্ধান্ত নিলেন।

মোজাম্মেল তখন বাড়ির পাশেই জমি কিনে তাতে বিশাল দোতলা বাড়ি তৈরি করে ফেলেছেন। সস্ত্রীক সেখানেই বাস করছিলেন। একদিন রাতের বেলা দুই ছেলেকে ডেকে বৃদ্ধ মহিউদ্দিন বললেন,
– আল্লাহর কৃপায় মোজাম্মেল তোমার অনেক উন্নতি হয়েছে। সরকারি চাকরি করো, নিজের ব্যবসা আছে৷ তোমার কোনো অর্থকষ্ট নাই। দোয়া করি ভবিষ্যতেও কখনো অর্থকষ্ট না হোক। বৃদ্ধ বয়সে সাহারা দেওয়ার মতো দুইটা ছেলেও তোমার আছে। কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও আমি আমার ছোট ছেলেকে মানুষ করতে পারি নাই। সংসারে তার বিন্দুমাত্র মন নাই। আয় রোজগারও সামান্য। সবই আল্লাহর রহমত, তবুও মোকাররমের ঘরে দুইটা মেয়ে তিনি দিয়েছেন। বৃদ্ধ বয়সে আমার ছেলেটা কী করবে সেই চিন্তায় আমি চিন্তিত। তবুও ও পুরুষ মানুষ, দিন কোনোরকমে কেটে যাবে। কিন্তু যেই মেয়েটাকে আমি আশা ভরসা দিয়ে একদিন এই সংসারে নিয়ে এসেছি, সে বৃদ্ধ বয়সে কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে? তার প্রতি আমার তো একটা দায় থেকেই যায়৷
তাই আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছে আমার এই বাড়িটা আমি নীহারের নামে লিখে দিবো। বাড়িসহ পেছনের জমিটা নীহারকে দিবো। আর সামনের অংশটুকু মোকাররমের থাকবে। ও ওইখানে নার্সারি করে খাক। বাবা মোজাম্মেল, তুমি এই বাড়ির উপর কোনো দাবী রাখিও না। আমার সামান্য আবাদী জমি আছে। বিঘা দুয়েক হবে। সেগুলা আমি তোমাকে দিয়ে গেলাম৷ চাষাবাদ করে সেখান থেকে যে আয় আসবে তা তুমি নিও। যদিও তা খুব সামান্য কিন্তু বাবার সম্পত্তিতে তোমারও হক আছে। আবাদের জমি তোমাকে দিচ্ছি না বলে নারাজ হবা না মোকাররম। ওসব চাষাবাদ তোমাকে দিয়ে হবে না। তোমার মনোযোগ গাছগাছালিতে। তুমি সেগুলা করেই খাও।

সেদিন মোজাম্মেল বিনাবাক্যে বাবার কথা মেনে নিলেও মনে মনে ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। তাকে দুই বিঘা আবাদি জমি দিয়ে মোকাররমকে তিন বিঘার একটা বাড়িসহ জমি দিয়ে দিলেন। বাজারের কাছাকাছি এই জমিটার দাম কোটির ঘরে৷ অথচ উনার জমির দাম হবে মাত্র কয়েক লাখ। উনাকে এভাবে ঠকানোর বিপরীতে কিছু বলতে গেলে লোকে তাকে লোভী বলবে। এতো সম্পদ থাকার পরেও ছোট ভাইয়ের সাথে হিংসা করছে। এই অপবাদ তিনি মেনে নিতে পারবেন না৷ তাই চুপ ছিলেন। কিন্তু এই বাড়িতে আসলেই পুরনো ক্ষত জেগে উঠে। বাবার সম্পত্তিতে তারও হক আছে। যা মোকাররম এবং তার বউ পুরোটাই আত্মসাৎ করে বসে আছে৷

একতলার ডানপাশের রাস্তাটি ধরে বাড়ির পেছনে গিয়ে নীহারকে পাওয়া গেলো। সে তখন পাতা দিয়ে বস্তা ভর্তি করে ফেলেছে৷ মোজাম্মেলকে দেখে ওড়না দিয়ে মাথা ঢেকে সালাম দিলেন। মোজাম্মেল বললেন,
– এই ধূলা ময়লার মধ্যে পাতা ঝাড়তে আসছ কেন? ঘরে খড়ি নাই?
– পাতা পড়ে জায়গাটা ময়লা হয়ে আছে। ভাবতেছি শাক ফেলবো৷ তাই ঝাড়ু দিলাম। শুকনো পাতা জ্বলে ভালো। বস্তা ভরে রাখি, দরকারের সময় কাজে লাগবে।
– এতো ঝামেলা না করে আগুন লাগায় দিলেই পারতা। ছাই হলে জমির সার হইতো। যাই হোক, যা বলতে আসলাম। মোকাররম তোমারে কিছু বলছে?
– কী ব্যাপারে ভাইজান?

নীহারের প্রশ্নাত্মক দৃষ্টির সামনে দাঁড়িয়ে মোজাম্মেল নিশ্চিত হলেন, তার ছোট ভাইটি আদ্রিকার বিয়ে বিষয়ে বাড়িতে কোনো আলোচনা করেনি৷ তিনি এমনটাই আশংকা করে নিজেই নীহারের সাথে কথা বলতে এসে ভালোই করেছেন।

পাশে দাঁড়িয়ে থাকা আদ্রিকার দিকে তাকিয়ে মোজাম্মেল বললেন,
– এই সন্ধ্যা বেলায় তুমি বাইরে কেন? সময়টা ভালো না। যাও মা, ঘরে যাও।

আদ্রিকা তাকালো নীহারের দিকে। সে চোখের ইশারায় মেয়েকে চলে যেতে বলছে। আদ্রিকা গুটিগুটি পায়ে বাড়ির দিকে চলে গেলো।

তার যাওয়ার পাণে তাকিয়ে মোজাম্মেল কথা গুছিয়ে নিলেন। এর আগেও আদ্রিকার বিয়ের ব্যাপারে কথা উঠেছিলো। সে আলোচনা বেশিদূর আগায়নি৷
পূর্ববর্তী আলোচনার সুর ধরেই বললেন,
– মাহিন আর আদ্রিকার বিয়ে ডেট ফাইনাল হলো সেদিন। আমি ভাবলাম, মোকাররম তোমাকে জানিয়েছে। এখন দেখি, আমার ভাইটা আজও দায়িত্ব জ্ঞানহীন-ই আছে। ওর এই গা ছাড়া স্বভাবের চিন্তায় চিন্তায় বাবা তাড়াতাড়ি দুনিয়া ছেড়ে চলে গেলেন। অথচ এতো বয়স হওয়ার পরেও তার কান্ড জ্ঞান হলো না। মেয়ের বিয়ে অথচ মা কিছুই জানে না।

নীহার যেনো শ্বাস নিতে ভুলে গেলো৷ আদ্রিকার বিয়ের কথা যখন উঠেছিল তখন পরিস্থিতি উত্তাল ছিলো। আদ্রতার উপর ক্ষেপে গিয়ে অনেকেই মাহিনের সাথে হওয়া অন্যায়ের মাসুল স্বরুপ আদ্রিকার দিকে ইঙ্গিত করেছিল।
বলেছিল,
– মোকাররমের আরেকটা যুবতি মেয়ে আছে। সে এখনো অবিবাহিত। তার সাথে মাহিনের দিলেই ঝামেলা চুকে যায়। দুই পরিবারের সম্মানও বেঁচে যাবে। ভবিষ্যতে আর কোনো মনোমালিন্যও হবে না।

মোকাররমের মানসিকতা অবস্থা তখন ভালো ছিল না বলে, সে আলোচনা বেশিদূর আগানোর সাহস করেনি কেউ৷ কিন্তু এরা যে সেই প্রস্তাবকে এতোটা গুরুত্ব সহকারে দেখছে তা নীহারের জানা ছিলো না।
মাহিনের সংসারে যেমনতেমন ভাবে আদ্রতা মানিয়ে নিলেও নিতে পারতো। আদ্রতা বুদ্ধিমতি মেয়ে৷ মায়ের মতো সীমাহীন ধৈর্য্য তার। তাছাড়া সে যথেষ্ট বুঝদার। একা হাতে সংসার সামলানোর মতো দক্ষতা অর্জন করেছে৷ কিন্তু আদ্রিকা? যে মেয়ে এখনো ঠিকঠাক বিছানা গুছাতে পারে না, সে একটা সংসার গুছাবে কীভাবে?

তাও আবার মোজাম্মেল মজুমদার এর মতো চতুর মানুষের ভরা সংসারে! ওই সংসারে আদ্রিকা এক দিনও টিকতে পারবে না। সবাই ওর মাথায় কাঁঠাল ভেঙে খেলেও আদ্রিকার বিন্দুমাত্র বোধ হবে না।

সন্ধ্যে নামার সেই ক্ষণে নীহার দু চোখে আঁধার দেখতে লাগলো। শুকনো ঢোক গিলে বললো,
– আদ্রতার বাবা, বিয়ের ডেট ঠিক করে ফেললো! আমাকে একবার জানালো না পর্যন্ত!
– কালকেই কথা হলো। ব্যস্ততার কারনে সুযোগ পায়নি হয়তো৷ আজকে এসে ঠিকই বলবে। তুমি মেয়ের মা, তোমাকে না জানিয়ে বিয়ে হয় নাকি?
– ওহ। আসুক তাহলে কথা বলে দেখি।
– কথা বলার তেমন কিছু নাই। পরিবারের লোকজন মিলে সামান্য আয়োজন। তোমার ভাবি আর আমি মাহিনকে নিয়ে আসবো৷ বড় ছেলের ছুটি নাই। সে আসতে পারবে না৷ বড় বৌমাও বাচ্চাদের নিয়ে একা আসতে চাইতেছে না। বাচ্চাদের নিয়ে একা জার্নি করা ঝামেলা। আজকে রবিবার। সামনের শুক্রবার বাদ এশা কাজি আর মওলানা ডেকে এনে বিয়েটা পরায় দিবো৷ এবার আর কোনো আয়োজন করতে চাচ্ছি না৷ আগেরবার আয়োজন করে তো দেখলাম। শুধু শুধু কতোগুলা টাকা খরচ করে লোক খাওয়ানো হইলো৷ এইবার আর কোনো হৈ হুল্লোড় হবে না৷

নীহার কোনো কিছু বললো না। শুধু ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থেকে মোজাম্মেল এর কথা শুনলো। তার হতবিহ্বলতার সামনে বেশিক্ষণ দাঁড়ালেন না মোজাম্মেল মজুমদার। বাজার যাওয়ার অজুহাতে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে গেলেন৷

চলবে…
লেখনীতে: অক্ষরময়ী

#পরিণয়ে_নোলককন্যা (কপি নিষেধ)

[০৬]

বৃহস্পতিবার, সকাল আট বেজে বিশ মিনিট৷ গায়ে পাতলা একটা চাদর জড়িয়েছে মোকাররম। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে মাথার আধাপাকা চুলগুলোতে চিরুনি করে নিচ্ছে৷ মৃদু পায়ে ঘরে প্রবেশ করল নীহার। মোকাররমের পেছনে দাঁড়িয়ে বিনীত স্বরে বলল,

– মোজাম্মেল ভাইজান আসছিল। আদ্রিকা আর মাহিনের বিয়ের কথা বলে গেল।

মোকাররম শুনল এবং প্রতিক্রিয়া হীন মুখভঙ্গি বজায় রাখল। মনের মতো করে চুল গুছিয়ে চিরুনি যথাস্থানে রেখে বলল,
– শুনছই তো। কালকে বাদ এশা কাজী এসে বিয়ে পরিয়ে যাবে৷

মোকাররম ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যাচ্ছে দেখে নীহারও পিছু নিল। পিছু যেতে যেতে বলল,
– আদ্রতা তবুও মানিয়ে নিতে পারত। কিন্তু আদ্রিকা? ও তো সংসারের কিছুই বুঝে না। এতো তাড়াতাড়ি বিয়ে দেওয়াটা কি ঠিক হবে?

মোকাররমের পা দুটো থমকাল। এক নিমিষেই ঘুরে দাঁড়িয়ে নীহারের মুখোমুখি হয়ে শাসিয়ে বলল,
– ওই মেয়ের নাম যেন আর কখনও তোর মুখে না শুনি। জিব টেনে ছিড়ে ফেলব একদম।

নীহার ভয় পেলেও দমে গেল না৷ মায়েরা কখনও ভয় পায় না। সন্তানের স্বার্থে তারা সদা নির্ভীক। বলল,
– ওই বাড়িতে আদ্রিকা কেমনে সবকিছু সামলাবে?
– মেয়ের বয়স হইছে, তাই বিয়ে দিচ্ছি। তোর বুদ্ধি শুনে একটাকে পড়াশোনা করায় দেখলাম। যথেষ্ট শিক্ষা হইছে। আর না৷ মেয়ে সংসার সামলাইতে পারে না, এটা কেমন কথা! মা হয়ে তুই কি করছিস এতোদিন? কিছু শিখাইতে পারিস নাই? সারাদিন খালি খাওয়াদাওয়া নিয়া ব্যস্ত। বিয়ে কালকেই হবে৷ যেমনে পারবে ওমনে সংসার করবে।

উল্টোদিকে ফিরে মোকাররম চলে গেল আড়তের দিকে। আজকাল আড়তে তেমন একটা বিক্রি হচ্ছে না৷ সামনে একুশে ফেব্রুয়ারি আসছে৷ ফুলের ব্যাপক চাহিদা হবে৷ মোকাররম ভাবল, একুশে ফেব্রুয়ারি উপলক্ষ্যে নার্সারিতে কিছু ফুল এনে রাখবে। স্কুল কলেজের বাচ্চারা এখান থেকে ফুল কিনলে মোকাররমের কিছুটা লাভ হবে।

শীতের প্রকোপ ধীরে ধীরে কমছে। রাতভর সামান্য কুয়াশা দেখা গেলেও সকাল হতেই দাপুটে সূর্যের দেখা মিলে। সেনাসামন্ত ছাড়া একাই রাজত্ব দখল করে সারাদিন রাজ্য শাসন করে।
মিঠা রোদে বসে সবজি কাটছিল নীহার। তখনি আগমন ঘটল মনোয়ারার। আদ্রতার বিয়ের আয়োজনের পর ভদ্র মহিলা এ বাড়িতে পা রাখেননি৷ অথচ আজ উনার হাসি মুখখানা দেখে মনে হচ্ছে, যেন কতোটা আন্তরিকতা তার হৃদয় জুড়ে৷

মনোয়ারাকে দেখে নীহার গলা উঁচু করে আদ্রিকাকে ডাক দিল।
– আদ্রিকা, দুটো চেয়ার দিয়ে যা।

আদ্রিকা ঘরে অলস ভঙ্গিতে বসে ছিল। জানালার গ্রিলে মাথা ঠেকিয়ে বাড়ির পেছনের সবজি বাগানে রোদের আনাগোনা দেখছিল। তখনি নীহারের ডাক কানে এল। দুটো প্লাস্টিকের চেয়ার দু হাতে ধরে বাইরে এসে দেখল মনোয়ারা ও মাহিন দাঁড়িয়ে। তাদের দিকে কয়েক সেকেন্ড ভাবলেশহীন তাকিয়ে চেয়ার দুটো এগিয়ে দিয়ে মনোয়ারাকে সালাম দিল।

মনোয়ারার মুখ থেকে যেন হাসি সরছেই না। অন্যদিকে মাহিন চুপচাপ চেয়ারব বসে আছে।
নীহার বলল,
– এতো সকালে কী মনে করে বের হলেন ভাবি?
– নাস্তা খাওয়ার পর এমনি হাটতে হাটতে বের হয়ে এলাম। অনেকদিন দেখা সাক্ষাৎ হয় না।
– আসেন না অনেকদিন।
– আমি কি বাড়ি থেকে বের হই! সেই মুখ তো নেই। আদ্রতা যা কাহিনীটা করল! বাড়ির বাইরে বের হতে পারি না।

নীহার মাথা নিচু করে লাউয়ের খোসা ছাড়ার কাজে মন দিল। এসব আলোচনা ভালো লাগছে না আদ্রিকার। কিন্তু এখান থেকে চলেও যেতে পারছে না। মনোয়ারা অবশ্য থামল না। বলেই চলল,
– পাড়ার মহিলাগুলার আগ্রহের শেষ নাই। প্রতিদিন তিন চারজন এসে বাড়িতে হাজির। কীভাবে হল, কার সাথে মেয়ে ভাগল, মাহিনের এখন কি হবে, আদ্রতা এখন কোথায় – প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে আমাদের অবস্থা খারাপ।
– মেয়েটা যে এমন কাজ করবে কে জানত ভাবি!
– তোমাদের কোনো সমস্যা নাই নীহার৷ দুদিন পরে মেয়ে জামাই এসে হাজির হলে ঠিকই সব মেনে নিবা। যা সম্মান যাওয়ার আমাদের গেছে৷ আমার মাহিনটা বন্ধুমহলে যাইতে পারে না লজ্জায়।

আদ্রিকা তাকিয়ে দেখল মাহিন তার ফোনে কিছু একটা করছে আপনমনে। হয়তো বন্ধুদের সাথে কথা বলছে। মুখটা হাসি হাসি। সেখানে কোনো বেদনার ছাপ দেখা যাচ্ছে না।

– এত সহজ না ব্যাপারটা। আদ্রতার বাবা মেয়ের নামটাও শুনতে চায় না।
– ওসব আর কয়দিন! মেয়ে জামাই না মানো কিন্তু দুদিন পর নাতি নাতনির মুখ দেখলে আর নিজেকে আটকায় রাখতে পারবা না।

বাচ্চার কথায় মাহিন ঝট করে মুখ তুলে মনোয়ারার দিকে তাকাল। মায়ের মুখে কিছু আটকায় না। কতো সহজে কথাগুলো বলে দিল!

– কী জানি ভাবি! ভবিষ্যতের কথা এখনি কীভাবে বলি! আল্লাহ সহায় হোক। আপাতত আরেকটা মেয়ের চিন্তায় ডুবে আছি।
– ওর আর কি চিন্তা! পরিস্থিতি সামলে নিতে বিয়েটা আপাতত দিয়ে রাখি। মানুষের মুখ অন্তত বন্ধ হোক। না হলে মানুষজন ধরেই নিছে, আমার মাহিনের আর জীবনে কোথাও বিয়ে হবে না৷
– এখনি ওর বিয়ে দেওয়ার ইচ্ছা ছিল না৷
– তোমার ইচ্ছার কথা আর বলো না নীহার। এমন করে বড় মেয়েটাকে বিগড়ায় ফেলছ। ছোটটার জীবন আর নষ্ট করিও না। যা হইতেছে, হইতে দেও।
– ওর আসলে সাংসারিক জ্ঞান খুব কম।
– ও নিয়ে তুমি ভেব না। কেউ বাপের বাড়ি থেকে সংসার করা শিখে আসে না। নিজের সংসারে থাকতে থাকতে শিখে যায়। শুরুতে হাবুডুবু খাবে, আবার নিজেই নিজেকে সামলে নিবে। এতো ভাবাভাবির কিছু নাই। তুমি এক কাজ করো, আদ্রতার বিয়ের জন্য আমাদের বাড়ি থেকে শপিং করে যে লাগেজটা পাঠাইছে, ওটা আছে না তোমার কাছে?
– হ্যাঁ।
– ওটা এনে দেও। বিয়েতে খালি হাতে আসলে ব্যাপারটা কেমন দেখায়। এখন আবার আদ্রিকার জন্য বিয়ের কেনাকাটা করার মানসিক অবস্থা, পরিস্থিতি কোনোটাই নাই। আদ্রতার বিয়ের জন্য যে শপিং করা আছে, ওটাই কালকে সাথে করে নিয়ে আসব। মাহিনের বউয়ের জন্য কেনা জিনিসই তো। নতুন আর পুরাতন কি!

নীহারের বলতে ইচ্ছে করল, বর একই থাকলেও বউ পাল্টে গেছে। যে কেনাকাটা আদ্রতার জন্য করা হয়েছে সেটা আদ্রিকাকে পরানো কি ঠিক হবে? তাছাড়া আদ্রতার শারীরিক গঠনের সাথে আদ্রিকার শারীরিক গঠন মিলবে না। আদ্রতার গায়ের রংটা একটু চাপা। কিন্তু আদ্রিকা উজ্জ্বল ফর্সা। সেসব আর বলা হল না। নীহার বলল,
– একটু বসেন। লাউটা কেটে নেই।
– আরে এগুলা তুমি রাখো। আদ্রিকাকে দেও, ও কাটুক। আমি বেশিক্ষণ বসব না।

নীহার অবাক হয়ে তাকাল। এতোক্ষণ কাকে কি বুঝাল! আদ্রিকা কখনও রান্নাঘরে ঢুকেনি। সবজি কাটা তো দূরের কথা। ব/টি, লাউ সব সরিয়ে রেখে নীহার বলল,
– আমার ঘরে তুলে রাখা আছে। আসেন।

মনোয়ারা চলল নীহারের পিছু পিছু। আদ্রিকা কিছুপল তাকাল লাউয়ের দিকে৷ তারপর ঝটপট বসে পড়ল পীড়িতে। আজ বাদে কাল এসব করতেই হবে৷ তবে আজ কেন নয়!
নিজে কাজ না করলেও মাকে তো কাজ করতে দেখেছে৷

ব/টি দিয়ে লম্বালম্বিভাবে লাউ কেটে তা ছোট ছোট টুকরা করতে শুরু করল। একটু সময় লাগছে৷ তবে টুকরো হচ্ছে। তবে একেকটা একেক সাইজের, একেক আকৃতির। অথচ নীহার যেগুলো কেটেছে সেগুলো দেখতে একই রকম। তবুও আদ্রিকা কাটতেই থাকল।

পাশ থেকে হঠাৎ মাহিন বলল,
– তুই কখনও তরকারি কাটিস নি?

ফোন রেখে মাহিন কখন ওর দিকে তাকিয়েছে তা খেয়াল করেনি আদ্রিকা। হঠাৎ কথা শুনে মাথা তুলে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। তারপর আবারও মাথে নিচু করে নিজের কাজে মনযোগ দিয়ে বলল,
– নাহ।
– কখনও রান্না করেছিস?
– নাহ।
– কাপড় কেচেছিস?
– নাহ।
– ঘর গুছাতে পারিস?
– একটু আধটু। বিছানা গুছানো আর ঝাড়ু দেওয়া।
– ভাত খেয়ে নিজের থালাটা ধুয়ে রাখিস তো?

আদ্রিকা আবারও মাথা তুলে তাকাল। মাহিনের চোখে মুখে বিদ্রুপের হাসি। যা আদ্রিকা গায়ে মাখল না। ভার করে রাখা মুখটা আরোও ভার হয়ে এল। লাউয়ের শেষ খন্ডটি টুকরো করতে করতে বলল,
– থালা বাসন কে না ধুতে পারে! ঘরের কাজ করা আহামরি কোনো কঠিন কাজ না। একটু চেষ্টা করলে পারা যায়।
– কিন্তু সংসার করা অনেক কঠিন কাজ।

আদ্রিকা কিছু বলার আগেই মনোয়ারা ও নীহার বেরিয়ে এল। লাগেজ পেয়েই মনোয়ারা মাহিনকে আর এক মিনিটও বসতে দিতে রাজি নয়। তাড়া দিয়ে বলল,
– চল, চল। দেরী হয়ে যাচ্ছে। দুপুরের রান্না বসাতে হবে। এদের তরকারি কুটা শেষ। আমি এখনও কি রাধবো তাই ভাবিনি।

চলবে…
#অক্ষরময়ী