#পরিণয়ে_নোলককন্যা (কপি নিষেধ)
|৫২|
খাবার টেবিলে কলকল শব্দের বন্যা বয়ে যাচ্ছে। তা নিয়ে শব্দদূষণকারীর কোনো মাথা ব্যথা নেই৷ সে অবিরাম, অন্তহীন।
শান্তিপ্রিয় পরখ শান্তভাবে বসে খাবারের সাথে আদ্রিকার অন্তহীন বকবক চর্বন করে যাচ্ছে বিনয়ের সাথে।
আদ্রিকাকে বাড়িতে রেখে যাওয়া হয়েছিল, যাতে সে পড়াশোনা করে। কিন্তু রেস্তোরাঁ থেকে বাড়ি ফিরে পরখ দেখল, ঘরজুড়ে খাবারের ঘ্রাণের ছড়াছড়ি। পরীক্ষার্থী পড়াশোনা ফেলে রেখে রান্নাবান্নায় ব্যস্ত। স্বভাবই এমন দৃশ্য দেখে মেজাজ বিগড়ে গিয়েছিল পরখের। বকা দেওয়ার প্রস্তুতি নিয়ে রান্নাঘরে গেল। পরখকে আসতে দেখে ঘাড় ফিরিয়ে যেইনা আদ্রিকা তাকাল, পরখের আর বকা দেওয়া হলো না।
আদ্রিকার ঠোঁটে হাসি, মুখে অন্যরকম এক দীপ্তি। পরখকে দেখে উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়ে বলেছিল,
“জানেন আজকে কি হয়েছে?”
কি ঘটেছিল জানার আগ্রহ জন্মালেও পরখ নিরাগ্রহের মতো জানতে চেয়েছিল,
“নাহ, জানি না।”
এমন অপমানেও আদ্রিকা দমে না গিয়ে দ্বিগুণ আগ্রহ নিয়ে বলেছিল,
“আজ আমার বাবা এসেছিল। সাথে একটা বাগানবিলাস গাছ নিয়ে এসেছে। গাছটা এতো সুন্দর!”
বাবার আগমনের গল্পের সেই যে সূচনা হয়েছিল, তা এখনো চলমান। কবে, কখন এ গল্পের ইতি টানা হবে পরখ জানে না। এই যে এখনো খাবার টেবিলে আদ্রিকা বলে চলেছে,
“চা বানাতে গিয়ে দেখি সিলিন্ডারের গ্যাস শেষ। আব্বুকে বলা মাত্র ফাঁকা সিলিন্ডার কাঁধে তুলে নিয়ে আব্বু চলে গেল মার্কেটে। সিলিন্ডারে গ্যাস ভরে দিয়ে গেল বলে আজকে রান্না হলো। না হলে আজকে আমাদের না খেয়ে থাকতে হতো।”
পরখের খুব বলতে ইচ্ছে হলো, এর আগেও সিলিন্ডারের গ্যাস শেষ হয়েছিল। তখন তোমার বাবা রিফিল করে নিয়ে আসেনি। কই, আমাদের তো না খেয়ে থাকতে হয়নি।
প্রতিমাসে পরখ সিলিন্ডার রিফিল করে নিয়ে আসে। তখন কেউ আগ্রহ নিয়ে গ্যাস ফুরিয়ে যাওয়ার গল্প করে না। একদিন বাবা করে দিয়ে গেল, তাতেই এমন এলাহী কান্ড!
পরখ মহা আগ্রহসহকারে আদ্রিকার কথা শুনতে শুনতে খাওয়া সম্পন্ন করে উঠল। যাওয়ার আগে সামান্য অনুরোধের সুরে বলল,
“সম্ভব হলে পড়াশোনাটাও একটু আগ্রহ নিয়ে করো।”
এই যে এভাবেই দুটো কথা বলে আদ্রিকার মনটা ভেঙে দেয় পরখ৷ তারপর এমন ভদ্র মানুষের ভান ধরে থাকে যেনো সে কিছুই করেনি৷ এমন নাটুকেপনার কারণেই রুমির মতো কাছের বন্ধুও আজ পর্যন্ত পরখের পুরোটা জানতে পারেনি। তারা পরখকে সাধু সন্ন্যাসী পর্যায়ের কেউ মনে করে। শুধুমাত্র আদ্রিকা জানে পরখের আসল চেহারা।
সময়ের সাথে ভারি হয়ে আসছে রাতের অন্ধকার৷ আমগাছের ডালে বাসা বেঁধে বসবাসকারী পাখিগুলোও ঘুমের কোলে ঢলে পড়েছে৷ রান্নাঘরের কাজ সম্পন্ন করে আদ্রিকা আরেকবার পরখের কক্ষে উঁকি দিল। পরখ এখনো জানালার দিকে উদাসীনভাবে চেয়ে আছে৷
পরখের চোখে মুখে দুশ্চিন্তা, সম্মুখে খোলা ল্যাপটপ, টেবিলের বইপত্র বন্ধ ৷ পরখের এমন ছন্নছাড়া রূপ কখনো দেখা যায় না। অন্তত নিজের কাজের বেলায় পরখ কখনোই উদাসীনতা দেখায় না। অথচ আজকে রাতের খাবারের পর থেকেই পরখ এভাবে জানালার পানে চেয়ে সময় অপচয় করছে৷ অনেকক্ষণ ধরে খেয়াল করছিল আদ্রিকা।
পরখের পাশে বসে কারণ জানার ভীষণ আগ্রহ হলো আদ্রিকার। কিন্তু আবার ঝগড়াঝাটি বেধে যাওয়ার ভয়ে মনের ইচ্ছেকে সেখানেই বাতিলের খাতায় ফেলে দিয়ে পা বাড়ালো নিজের কক্ষে৷
বালিশে মাথা ঠেকিয়ে চোখ দুটো বুজলেও ঘুমের দেখা মিলল না। ভালোবাসার কী এক অদ্ভুত ক্ষমতা! কোনো প্রকার যোগাযোগ ব্যবস্থা ছাড়াও একজনের হৃদয়ের অনুভূতি আরেকজনের হৃদয়ে পৌঁছে যায়৷ কোনো অ্যান্টেনা রয়েছে কি?
যদি নাইবা থাকবা তবে পরখের হৃদয়ের অস্থিরতা কেনো আদ্রিকার হৃদয়কে অস্থির করে তুলেছে?
কেনোইবা পরখের অনিদ্রা আদ্রিকার চোখে জড়ো হয়েছে?
বিছানায় এপাশওপাশ করে অস্থির সময় অতিবাহিত করছিল আদ্রিকা, তখনি ধীমে একটা সুর ভেসে এলো বাতাসে৷ গানের কোনো কথা নেই, শব্দ নেই শুধু গুনগুন একটা সুর৷ সুরটি চেনা। কোথায় যেনো শুনেছে আদ্রিকা। কিন্তু মনে পড়ছে না৷ এই মাঝরাতে পরখ গুনগুন করছে কেনো? অজান্তেই ভ্রু জোড়া কুঞ্চিত হয়ে এলো আদ্রিকার৷ বিছানা থেকে নেমে অন্ধকার হাতড়ে বেরিয়ে এলো বাইরে৷
হলরুমের দরজাটা হাট করে খোলা। শরতের ফুরফুরে বাতাস সবেগে ভেতরে প্রবেশ করছে৷ রাতের আকাশে তারার মেলা। আজ বোধহয় পূর্ণিমা। মস্ত বড় একটা চাঁদ উঁকি দিচ্ছে আকাশে৷ চাঁদের দিকে তাকিয়ে খোলা ছাদে দাঁড়িয়ে আছে পরখ। পরখকে হলরুম থেকেই কিছুক্ষণ নিরবে অবলোকন করল আদ্রিকা৷
সুরটা সে চিনে ফেলেছে৷ কয়েকদিন আগেই শুনেছিল গানটা।
‘কস্তুরি মৃগ তুমি
যেন কস্তুরি মৃগ তুমি
আপন গন্ধ ঢেলে এ হৃদয় ছুঁয়ে গেলে
সে মায়ায় আপনারে ঢেকেছি।’
এই লাইনগুলোর সুর গুনগুন করছে পরখ৷ কষ্ট, হিংসা, খারাপলাগা, জ্বালাপোড়া সবই জাগ্রত হলো আদ্রিকার মনে৷ নিশ্চয়ই ওই ডাইনিটার কথা ভেবে মাঝরাতে গুনগুন করছে এই মহাশয়৷ ল্যাপটপে কি এতোক্ষণ ওই ডাইনিটার ছবি দেখছিল?
ইশ! তখন যদি আদ্রিকা ঘরে ঢুকে একবার উঁকি দিতো তবে মেয়েটাকে দেখতে পেতো৷ নিশ্চয়ই ভূবনভোলার কোনো মেয়ে-ই হবে৷ চেহারাটা দেখতে পেলে আদ্রিকা ঠিক চিনে ফেলতো৷ বড্ড আফসোস হলো আদ্রিকার৷
শাড়ির আঁচল কোমরে গুজে ধীর পায়ে খোলা ছাদে চলে এলো আদ্রিকা৷ ঝগড়াঝাটি, ঝামেলা না করার প্রতিজ্ঞা চুলোয় যাক৷ রাত বিরাতে জামাই মহাশয় ছাদে দাঁড়িয়ে প্রাক্তনের স্মৃতিচারণ করবে আর আদ্রিকা সেটা মেনে নিবে, এ হতেই পারে না। পান থেকে চুন খসলেই বিস্ময়ের ব্যাপারে আদ্রিকাকে খোঁচা দেয় পরখ৷ তবে আদ্রিকা আজকে ছেড়ে দিবে কেনো?
পরখের পাশে দাঁড়িয়ে শান্ত স্বরে খানিকটা ঠেস মেরে আদ্রিকা বলল,
‘রাত বিরাতে আমার সতীনের স্মৃতিচারণ করছেন নাকি?’
পরখ শুকনো মুখে ঘাড় ফিরিয়ে আদ্রিকার দিকে চেয়ে বলল,
‘তুমি ঘুমাওনি?’
আদ্রিকা রেলিংয়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে বলল,
‘ঘুমিয়েছিলাম। এখন ঘুমের মাঝে হাঁটাচলা করছি।’
এমন বাঁকা জবাবে পরখ মনে মনে হাসল। সে হাসি মুখে ফুটে না উঠলেও নাকের নিচে হাসির রেখা স্পষ্ট বুঝা গেল৷ এমন তাচ্ছিল্যের হাসির পর কতোক্ষণ ভালোমানুষি করা যায়? আদ্রিকা থমথমে মুখে জানতে চাইল,
‘চাঁদ দেখে গার্লফ্রেন্ডের কথা মনে পড়ছে? আপনার গার্লফ্রেন্ড কি চাঁদের মতো সুন্দর? অবশ্য জগতের সব ছেলের কাছে তার ভালোবাসার মানুষটি চাঁদের মতো সুন্দর, উজ্জ্বল। আর বাকি মেয়েরা পাতিলের তলার মতো কুৎসিত।’
আদ্রিকার গায়ে সাদা গোলাপি মিশেলে একটা শাড়ি৷ চাঁদের আলোয় বেশ ফুটে উঠেছে৷ বিছানায় গড়াগড়ি দেওয়ার কারণে শাড়ি খানিকটা এলোমেলো। চুলের বেণি আলগা হয়ে এসেছে৷ কোমরে শাড়ি গুজে রাখার কারণে উঁকি দিচ্ছে ফর্সা, নগ্ন উদর।
পরখ গাঢ় চোখে আদ্রিকার সৌন্দর্য অবলোকন করে এক হাতে বাড়িয়ে আদ্রিকাকে কাছে টেনে নিল। আদ্রিকার পিঠ ঠেকেছে পরখের বুকে। নগ্ন উদরে পরখের শীতল হাত ছোঁয়া মাত্র আদ্রিকা কেঁপে উঠল।
প্রাক্তনের স্মৃতিরোমন্থনে পরখ কি এতোটা ডুবে গেছে যে চোখে ভুলভাল দেখছে? আদ্রিকাকে ওই ডাইনিটা ভেবে এমন মাখোমাখো ভাব করছে না তো?
খানিকটা ঝুকে উদর হতে পরখের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে চেষ্টা করল আদ্রিকা। পরখ আরও ঘনিষ্ঠভাবে আদ্রিকাকে জড়িয়ে ধরে থুতনি ঠেকাল আদ্রিকার মাথায়৷
দীর্ঘশ্বাস ফেলে স্পষ্ট উচ্চারণ করল,
‘সে পদ্মফুলের মতো সুন্দর।’
অনেকদিন পর আদ্রিকার সেই ডায়েরিটার কথা মনে পড়ল। মন খারাপের মেঘেরা এসে ঘিরে নিতে থাকল আদ্রিকাকে৷ চোখের জলের ধারাকে অবরোধ করতে দাঁতের ফাঁকে পিষ্ট করল অধর৷
আদ্রিকার মন খারাপের মেঘ বোধহয় পরখকে ভিজিয়ে দিতে পারেনি৷ পরখ নিজ ধ্যানে বিভোর। জাগতিক চিন্তা থেকে মুক্তি পেতে নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছে লক্ষ কোটি দূরত্বে অবস্থানরত চাঁদের মাঝে৷
পরখের উদাসী কণ্ঠটি ধীমে সুরে আবার গুনগুন করে উঠল,
‘ঐ কপোলে দেখেছি লাল পদ্ম
যেন দল মেলে ফুটেছে সে সদ্য
ঐ কপোলে দেখেছি লাল পদ্ম
যেন দল মেলে ফুটেছে সে সদ্য।
আমি ভ্রমরের গুঞ্জনে তোমারেই ডেকেছি
দূর হতে তোমারেই দেখেছি
আর মুগ্ধ এ চোখে চেয়ে থেকেছি।’
আদ্রিকা ঠোঁট বাকিয়ে বলল,
‘স্ত্রীকে জড়িয়ে ধরে প্রেমিকার উদ্দেশ্যে গান গাইছেন, আপনার লজ্জা করছে না?’
‘নাহ। বরং ভালোই লাগছে।’
পরখের হেয়ালি জবাবে আদ্রিকা রেগেমেগে ফোঁস ফোঁস করে উঠল।
‘এখন যদি আমি আমার প্রাক্তনকে উদ্দেশ্যে গান গাই তখন কেমন লাগবে?’
‘তুমি গান জানো নাকি?’
‘ঢং! যেন আগে শুনেনি। সেদিন গেয়ে শুনালাম। ওই যে আর যাবো না..’
‘থাক আর গাইতে হবে না৷ মনে পড়েছে। সেই অশ্লীল গানটা মনে রাখার মতো কিছু না। এখনও কোনো অশ্লীল গান মনে পড়ছে নাকি? অবশ্য তোমার মাথায় সব সময় অশ্লীল চিন্তাই ঘুরাঘুরি করে।’
‘মোটেও না। এটা একটা সুন্দর গান। দরদ মিশানো।’
‘তুনে ক্যেয়া আর ডালা,
মার গায়ি ম্যে,
মিট গায়ি ম্যে।
ও জি, হা জি…
হো গায়ি ম্যে তেরি দিওয়ানি।’
আদ্রিকার গানের গলা খুব সুন্দর না হলেও খুব একটা খারাপ না। শখের বসে গান গাওয়ার মতো চলনসই। পরখ মনোযোগ দিয়ে গান শুনল। খানিকটা ভাবুক হয়ে বলল,
‘এটা তোমার প্রাক্তনের উদ্দেশ্যে ছিল বুঝি? তেমন কিছু মনে হচ্ছে না কেনো?’
আদ্রিকা ভেবেছিল অন্যদিনের মতো পরখ রেগে যাবে৷ কিন্তু আজ পরখের হয়েছেটা কি? কেমন অদ্ভুত আচরণ করছে? এতোটা খোশমেজাজ কি ওই ডাইনিটার কারণে? ওর ভাগ্যে খোশমেজাজি পরখ আর আদ্রিকার ভাগ্যে বদমেজাজি পরখ? এতোটা তফাৎ কেনো?
আদ্রিকা ঘাড় ফিরিয়ে পরখকে দেখার চেষ্টা করল৷ ওর সূক্ষ্ম চাহনির বিপরীতে পরখ নিজের নাক ঘষল আদ্রিকার গালে৷ কেমন রহস্য করে হেসে বলল,
‘অনেক রাত হয়েছে, ঘুমাতে যাও।’
আদ্রিকার হঠাৎ মনে হলো, এটা পরখ হতেই পারেনা। নিশ্চয়ই পরখের বেশে কোনো প্রেতাত্মা। নয়তো পরখের উপর কোনো প্রেতাত্মা ভর করেছে৷ না হলে আচরণে আমূল পরিবর্তন কী করে সম্ভব?
****
সকাল থেকে বইয়ে মুখ ডুবিয়ে রেখেছে আদ্রিকা। একই পড়া আরেকবার পড়তে ইচ্ছে করে না৷ শুধু একবার পড়লে মনেও থাকে না৷ কী এক মুশকিল! আদ্রিকার ইচ্ছে করছে মাথাটা পড়ার টেবিলে ঠুস মারে।
জেদ ধরে অনেকক্ষণ পড়ার পর মাথা ধরে গেছে। যোহরের আযান হতে কতোক্ষণ বাকি? আশেপাশে তাকিয়ে মোবাইলটি কোথাও দেখত পেল না আদ্রিকা৷ এই মোবাইলটা হুটহাট কোথায় লুকিয়ে পড়ে কে জানে?
আদ্রিকা চেয়ার ছাড়ল। পুরো ঘর খুঁজলো। কিন্তু পেল না। অনেক খোঁজাখুজির পর মোবাইলটিকে পাওয়া গেল রান্নাঘরের সবজির ঝুড়িতে। সকালে রান্নার সময় ওখানে রেখে দিয়েছিল। এখনও আলু, পেঁয়াজের সাথে সেখানেই অবস্থান করছে আদ্রিকার মোবাইলটি।
সেটিকে অবহেলায় কুড়িয়ে নিল আদ্রিকা৷ সময় দেখতে গিয়ে নজরে এলো অনাকাঙ্ক্ষিত নোটিফিকেশন। পরখের দুটি মিসড কল। কপালে ভাঁজ পড়ল আদ্রিকার৷ মোবাইলের লক খুলে কল ব্যাক করতে যাবে তখনি কল এলো রুমির৷
রিসিভ করা মাত্র হড়বড়িয়ে প্রশ্ন করল,
‘আদ্রিকা, কোথায় তুমি?’
‘কোথায় আবার! বাড়িতেই। কেনো?’
‘পরখ তোমাকে কল দিয়েছিল। রিসিভ করোনি।’
‘ফোনের কাছে ছিলাম না৷ পড়ছিলাম।’
‘ওহ৷ পড়া শেষ হলে দ্রুত রেস্তোরাঁয় চলে এসো।’
‘কেনো? কি হয়েছে?’
‘এসোই না।’
‘পরখ যেতে নিষেধ করেছে। পরে বকা দিবে।’
‘ওরে পতিব্রতা স্ত্রী! আপনার পতিদেব নিজেই আপনাকে আসতে বলেছেন। সেজন্যই কল দিচ্ছিলেন৷ এবার দয়া করে আসুন।’
রুমির সাথে কথা বলার পর থেকে আদ্রিকার কেমন জানি ভয় হচ্ছে৷ গতরাত থেকে পরখের আচরণ সন্দেহজনক। এখন আবার এমন কি হলো যে এভাবে কল দিয়ে ডাকতে হলো?
ঝটপট তৈরি হয়ে আদ্রিকা ছুটল রসনাবিলাসীর উদ্দেশ্যে। দুপুরের খাবার পড়ে রইল খাবারের টেবিলে।
ভরদুপুরে নিচতলায় তেমন একটা ভীড় নেই। পুরোটা ফাঁকা-ই বলা চলে। উপরতলায় মানুষজন গিজগিজ করছে৷ পেছনের সিঁড়ি দিয়ে আদ্রিকা দ্রুত উঠে এলো উপরে। পরখের অফিসকক্ষের দরজা খুলে ভেতরে দেখা মিলল রুমির।
পরখ ও রুমি উভয়ই টেবিলের উপর ঝুঁকে ল্যাপটপের স্ক্রীনের দিকে তাকিয়ে আছে। দরজার খোলার শব্দে দুজনে মুখ তুলে চাইল দরজার পানে। আদ্রিকাকে দেখে রুমি উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠল। বিস্তৃত হাসি হেসে বলল,
‘তুমি এসো গেছো! ভেতরে এসো৷ এসে দেখো তোমার জামাইয়ের তো ঈদ লেগে গেছে।’
ভেতরে পা বাড়িয়েও থমকে গেল আদ্রিকা। পরখ চেয়ে আছে আদ্রিকার দিকে। মুখে নরম রোদের মতো বিগলিত হাসি। যে মিষ্টি হাসিতে পাষাণের হৃদয়ও গলে যায়।
দরজায় হেলান দিয়েই আদ্রিকা নির্নিমেষ চেয়ে দেখল পরখের সেই হাসি। বলল,
‘এতো খুশি হওয়ার মতো কী এমন ঘটল? আমি তো এখনো পরখের জীবন থেকে চলে যাইনি৷ এখন পর্যন্ত গলায় ঝুলেই আছি।’
রুমি হো হো করে হেসে বলল,
‘এবার গলা ছাড়তে হবে৷ জামাই তোমার উড়াল দিল বলে। ভার্সিটি থেকে মেইল এসেছে৷ সুইজারল্যান্ড ডাক পাঠিয়েছে।’
এবার যেনো রুমির হাসি ছুঁয়ে গেল আদ্রিকাকে। চোখ দুটো বড় বড় করে কিছুপল রুমির দিকে চেয়ে আদ্রিকা ঝলমলিয়ে হেসে উঠল৷ দ্রুত পায়ে পরখের নিকট পৌঁছে সবিস্ময়ে বলল,
‘সত্যি?’
অনাকাঙ্ক্ষিত আনন্দে হতভম্ব পরখ মাথা উপর নিচ করে উত্তর জানাল। পাশ থেকে রুমি ল্যাপটপের স্ক্রীনের দিকে ইশারা করে বলল,
‘এই যে মেইল। কিছুক্ষণ আগেই এসেছে।’
এমন আনন্দবার্তায় উচ্ছ্বসিত আদ্রিকা পরখের আরও কাছে গিয়ে হুট করে জড়িয়ে ধরল পরখকে৷
‘আলহামদুলিল্লাহ। কংগ্রাচুলেশনস পরখ।’
পরখও এক হাত বাড়িয়ে জড়িয়ে ধরল আদ্রিকাকে। বিব্রত রুমি খুক খুক করে কেশে মনোযোগ আকর্ষণ করে বলল,
‘তোমরা কথা বলো, আমি নিচে গিয়ে দেখি মিষ্টি তৈরি হলো কিনা।’
আদ্রিকা সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বলল,
‘মিষ্টি কীসের?’
‘পরখ তার বিদেশযাত্রা উপলক্ষে সবাইকে ট্রিট দিচ্ছে।’
‘আরে বাহ!’
রুমি চলে গেলে আদ্রিকা পরখের দিকে তাকিয়ে দেখল পরখ অপলক চেয়ে রয়েছে তারই দিকে। আদ্রিকার চোখে চোখ রেখে পরখ বলল,
‘আমি কল দিয়েছিলাম তোমাকে।’
কপালে ছড়িয়ে থাকা চুলগুলো কানের পেছনে গুজে আদ্রিকা বলল,
‘ফোনের কাছে ছিলাম না। স্যরি৷ আপনি এটা জানাতে কল দিয়েছিলেন?’
‘একটার দিকে মেইলটা এলো। কাকে জানাবো বুঝতে পারছিলাম না। আমি তো ভেবেই নিয়েছিলাম এই সেমিস্টারটা যাবে। কিন্তু আমার সমস্যা বিবেচনা করে কর্তৃপক্ষ কনসিডার করেছেন। আগস্টে ফাইনাল এক্সাম এটেন্ড করলেই হবে।’
পরখের সরল স্বীকারোক্তিতে আদ্রিকার গালে লালচে আভা দেখা দিল। নিজেকে বিশেষ একজন মনে হলো। বলল,
‘ক্লাস না করে এক্সাম দিতে পারবেন? কিছুই তো পড়েননি।’
‘কয়েকটা অনলাইন ক্লাস দিয়েছে। কিছু নোটস কালেক্ট করতে হবে৷ ক্লাস ছাড়া পাশ করাটা কষ্টকর হবে৷ মূলত খাটতে হবে প্রচুর।’
’তবুও সেমিস্টার আটকে গেল না, এটাই স্বস্তি। আমার কী যে ভালো লাগছে!’
পরখ চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। আদ্রিকার দিকে এগিয়ে সামনাসামনি দাঁড়িয়ে সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে চেয়ে বলল,
‘তুমি সত্যি খুশি?’
খুশি না হওয়ার কী আছে, ভেবে পেল না আদ্রিকা। পরখের এতোদিনের স্বপ্ন এতো চেষ্টার পর পূরণ হতে চলেছে! আদ্রিকা কেনো খুশি হবে না?
প্রশ্নের কারণ বুঝতে না পেরে আদ্রিকা সরু চোখে তাকিয়ে বলল,
‘হ্যাঁ৷ খুশি হবো না কেনো?’
‘ভার্সিটির এডমিশন কনফার্ম হয়েছে মানে আমার অপেক্ষা শেষ হয়েছে। যার জন্য এতোদিন অপেক্ষা করেছি সেটা পেয়ে গেছি। এখন আর কোনো বাঁধা নেই৷ সমস্ত পিছুটান ত্যাগ করে আমাকে যেতে হবে৷ তুমি কি বুঝতে পারছো?’
আদ্রিকার ভেতরটা হঠাৎ হুহু করে উঠল৷ বুকে বিশাল শূন্যতা। কষ্ট, ভয়, উদ্বেগ মিশে আদ্রিকার চোখে মুখে সর্বহারা একটা ঢেউ খেলে গেল। তবুও পরিস্থিতি বিবেচনায় মুখের হাসি বজায় রেখে আদ্রিকা উপর-নিচে মাথা দুলালো।
স্বস্তির শ্বাস ফেলল পরখ। এতোক্ষণ চাপা একটা ভয় জেঁকে বসেছিল মনে। আনন্দটা ঠিকঠাক উপভোগ করতে পারছিল না। বারবার মনে হচ্ছিল, এই বুঝি আদ্রিকা বেঁকে বসল। আর কেউ না জানলেও পরখ জানে, তার স্বপ্নের পথে যদি কেউ প্রতিরোধ গড়তে পারে তা একমাত্র আদ্রিকা। একবার যদি আদ্রিকা নিজ অধিকারের দাবী নিয়ে সামনে দাঁড়ায়, পরখ হেরে যেতে বাধ্য।
সম্পর্কের সমাপ্তির ব্যাপারে পরখের স্পষ্ট সিদ্ধান্তের বিপরীতে আদ্রিকার নির্লিপ্ততা পরখের সন্দেহকে আরও গাঢ় করে তুলেছিল। নিকট ভবিষ্যতে সব হারিয়ে ফেলবে জেনেও কেউ কী করে এতো নির্লিপ্ত থাকতে পারে? বিশ্বাস হয়নি পরখের।
কিন্তু এই মুহূর্তে আদ্রিকার চোখে মুখে যে স্বচ্ছ হাসি উপচে পড়ছে তা মিথ্যে নয়। পরখের মাথা থেকে একটা বড় বোঝা যেনো নেমে গেল। সে আলতোভাবে আদ্রিকাকে জড়িয়ে ধরে বলল,
‘থ্যাঙ্কিউ আদ্রিকা।’
বিনা নোটিশে আগত হেঁচকিটি গলার ভেতরেই আটকে দিতে ঠোঁট দুটো চেপে রাখল আদ্রিকা।
*****
পরখের এডমিশন নিশ্চিত হওয়ার খুশিতে ইবতেহাজ ভিলায় আনন্দের আসর বসেছে৷ পর্তুলিকা নিভৃতচারী মানুষ। আপনজনকে সাথে নিয়ে নিজের মতো থাকতে পছন্দ করেন। অতি কোলাহল কখনোই পছন্দ ছিল না৷ তাই আজও নিজ পরিবারকে সাথে নিয়ে ছোট্ট ডিনারের আয়োজন করেছেন।
সকালবেলা আদ্রিকার পরিবারকে আমন্ত্রণ জানিয়ে এসেছে ইবনূল ইবতেহাজ। মোকাররম আসতে চাইছিল না। এমন নামীদামী, প্রভাবশালী লোকজনের সম্মুখীন হতে বেশ অস্বস্তি হয়। অনাড়ম্বর জীবনযাপনকারী মানুষ সে। ধনাঢ্য পরিবারের অতিরঞ্জিত নিয়মকানুন, আদবকায়দা আজও আয়ত্ত করতে পারেনি। মেয়ের শ্বশুরবাড়ি গিয়ে যদি কোনো অশিষ্ট আচরণ করে বসে, তাহলে বাবার জন্য মেয়েকে অপমানিত হতে হবে। মেয়ের সুখের সংসারে এমন ক্ষতির কারণ কোন বাবা হতে চায়? প্রথমবারেই না করে দিয়েছিল মোকাররম।
তা শুনে আপত্তি জানিয়ে বসল বিকল্প। সপরিবারে না গেলে সেও যাবে না। সেভাবে ভাবতে গেলে বিকল্প সরাসরি আদ্রিকার পরিবারের অংশ নয়। তাই বিকল্পের না যাওয়াটাই উচিত।
জামাই শ্বশুরের এমন দ্বিধা দ্বন্দ্বে আদ্রতার মাথায় হাত। অবশেষে অনেক অনুরোধের পর মোকাররমকে রাজি করানো হয়েছে। বিকল্পকে ফের অনুরোধ করার প্রয়োজন হয়নি৷ মোকাররম হ্যাঁ বলার সাথে সেও রাজি হয়ে গিয়েছে।
পর্তুলিকার শখের ডাইনিং টেবিলটি আজ প্রথমবার কানায় কানায় পূর্ণ হতে দেখে পর্তুলিকার মন আবেগে ভরে উঠল।
সবাই চুপচাপ খেতে থাকলেও অনর্গল কথা বলে যাচ্ছে ইবনূল ইবতেহাজ। মোকাররম মজুমদারের স্বাস্থ্যের খোঁজ খবর নেওয়ার পর নিজে থেকেই বললেন,
‘এইচএসসির পরেই পরখের বাইরের দেশে চলে যাওয়ার কথা ছিল। তখন আমিই ওকে যেতে দেইনি। সেই নিয়ে রাগ করে বাড়ি পর্যন্ত ছেড়ে দিল। তবুও আমি যেতে দিলাম না। কী করে দেই বলুন? আমার একটাই ছেলে। সেই যদি আমাদের ছেড়ে বিদেশভূইয়ে পড়ে থাকে তাহলে আমরা দুজন বুড়ো-বুড়ি মানুষ কী নিয়ে বাঁচবো? বাবা-মায়ের কষ্ট কি সন্তান বুঝে? বুঝে না। তারা নিজের জীবন, নিজের লড়াই নিয়ে এতোটা ব্যস্ত হয়ে পড়ে যে বাবা-মায়ের দিকে ফিরে তাকানোর সময় পায়না।’
এমন অসম্মানজনক আলোচনায় পরখ বেশ বিব্রত হয়ে মায়ের দিকে তাকাল। ছেলের পক্ষ নিয়ে পর্তুলিকা বিরোধ করে বলল,
‘আবার পুরনো কথা কেনো? খেতে বসে এতো কথা বলতে হয় না।’
‘আহা! কতোদিন পর আমাদের দেখা হলো, পিউ! একটু কথাবার্তা অন্তত বলতে দেও।’
পিতার অভিযোগের বিপরীতে সন্তান হিসেবে যুক্তি দেখাল বিকল্প।
‘এই ব্যাপারে পিতা-মাতা, সন্তান দু-পক্ষেরই কিছু অভিযোগ আছে৷ কারোটাই অযৌক্তিক নয়।’
‘তা বটে। প্রত্যেকের কাছে তার নিজের সমস্যাটাই বৃহৎ। সমতা আনতে দুপক্ষকেই কিছুটা স্বার্থ বিসর্জন দিতে হয়। যেটা একসময় পরখ দিয়েছে, এখন আমি দিচ্ছি। আশা করি ছেলে আমার ত্যাগের মান রাখবে। পড়াশোনা শেষ করে মায়ের ছেলে মায়ের কোলে ফিরে আসবে।’
মোকাররম সন্দিহান গলায় পরখকে প্রশ্ন করল,
‘তুমি কি বিদেশে স্থায়ীভাবে বসত গড়তে চাইছ নাকি?’
এমন প্রশ্নে পরখ আড়চোখে আদ্রিকার ভীতিকর মুখটির দিকে তাকাল। এরা কেউ সঠিক উত্তর তথ্য আজ এখানেই পরখের বিদেশ যাত্রার সমাপ্তি ঘটবে নিশ্চিত। পরখের মতোই আদ্রিকাও মনে মনে উক্ত আলোচনা এড়িয়ে যাওয়ার দোয়া করতে থাকল।
পরখ জবাব দেওয়ার আগেই ইবনূল ইবতেহাজ বললেন,
‘আমার উপর রাগ করে এমনি পরিকল্পনা গুছিয়ে ছিল। তখন যেতে দেয়নি বলে মন খারাপ করে এখানেই অনার্স শেষ করে মাস্টার্স এর জন্য বিদেশ যাবে। আর ফিরে আসবে না। আমার ছেলে তো, ওর জেদ সম্পর্কে আমি অবগত। এজন্যই তাড়াতাড়ি বিয়ে দিলাম। বাবা-মায়ের মায়া কাটানো সম্ভব হলেও বউয়ের টানে দেশে ফিরে আসতেই হবে। পালিয়ে যাবে কোথায়!’
আদ্রতা মিষ্টি হেসে বলল,
‘আমার মনে হয় না, পরখ ভাইয়া বাবা-মায়ের প্রতি দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়ার মতো ছেলে। যদি সত্যিই আপনাদের ত্যাগ করতে চাইত তবে বিয়ে দিয়েও লাভ হতো না। বিয়ে তেমন কোনো বাঁধা-ই নয়। স্পাউজ ভিসায় আদ্রিকাকে সাথে নিয়ে চলে যেতে পারত। তা কিন্তু উনি করেননি।’
পরখ শুকনো মুখে জোরপূর্বক হাসি ফুটিয়ে বলল,
‘থ্যাঙ্কিউ আদ্রতা। এখানে একমাত্র আপনিই আমার পক্ষে দুটো কথা বললেন। এতোক্ষণ নিজেকে অসহায় মনে হচ্ছিল।’
সকলে উচ্চস্বরে হেসে উঠলেও আদ্রিকার মুখের হাসি বিস্তৃত হলো না। খাবার প্লেট সামনে নিয়ে সে আড্ডার আসর ভাঙ্গার অপেক্ষা করত লাগল।
বিকল্প বলল,
‘আপনার কোর্স কয় বছরের?’
‘দু বছর।’
‘এর মাঝে কোনো ছুটি পাবেন না? টানা দু বছর আপনাকে ছাড়া আমাদের আদ্রিকা আবার কান্নাকাটি শুরু করে দিবে।’
আদ্রিকা ছদ্ম অভিমান করে বলল,
‘আমি মোটেও কান্নাকাটি করি না। এসব আপনাকে আপুকে বলেছে না? আমার নামে মিথ্যে অপবাদ দেওয়া একদম ঠিক নয়।’
সবার চিন্তা দূর করতে পরখ বলল,
‘সেমিস্টার ব্রেক, সামার ভ্যাকেশন থাকবে।’
‘তাহলে তো ভালোই। বছরে দু একবার এসে দেখা দিয়ে যাবেন। নয়তো কারো চোখের জলের সমুদ্রে আমরা ভেসে যাবো।’
খাওয়া শেষ করে আরও কিছুক্ষণ আড্ডা দিয়ে সকলে চলে গেলেও আদ্রিকা ও পরখকে আটকে দিল পর্তুলিকা।
একই কক্ষে, একই বিছানায় নিদ্রাহীন সময় কাটছে আদ্রিকা ও পরখের। অন্ধকারের পথ চেয়ে দুটো প্রাণ নিজস্ব জগতে বিভোর। কে কী ভাবছে, কেউ জানে না।
অন্ধকারের নিস্তব্ধ দেয়াল ভেঙে পরখ বলল,
‘ঘুমিয়েছ?’
অপরপাশ ফিরে শায়িত আদ্রিকা বলল,
‘উহু।’
অন্ধকারের ঊর্ধ্বমুখে চেয়ে পরখ বলল,
‘আমি যে ফিরে আসবো না, সেটা জেনেও কাউকে বলোনি কেনো?’
‘আপনি কি চাইছেন আমি বলি?’
‘জেনে গেলে আমার যাওয়া হবে না। আমার যাওয়া আটকাতে যা করার দরকার হয়, আমার বাবা করবে।’
‘তাহলে জানতে চাইছেন কেনো?’
‘তুমি তো তোমার বোনকে সব কথা বলতে, এটা বলোনি কেনো?’
‘বিয়ের পরে মেয়েরা অনেক কথাই মনের ভেতর দাফন করে ফেলে। নিজের স্বার্থে, অন্যের স্বার্থে করতে বাধ্য হয়।’
‘ওখানে গিয়ে দ্রুত ডিভোর্সের কার্যক্রম শুরু করে দিব। একবার বিদেশে পা রাখলে আমার বাবা আর কিছু করতে পারবে না।’
‘হুম।’
আদ্রিকার নির্লিপ্ততায় পরখ কাঁধ বাঁকিয়ে আদ্রিকার দিকে তাকাল। অন্ধকারে তেমন কিছু দেখা গেল না। তবুও তাকিয়ে থেকে বলল,
‘তোমাকে বেশিদিন আমার সাথে বেঁধে রাখব না। ডিভোর্স হয়ে গেলে তুমি নতুন ভাবে জীবন শুরু করতে পারবে। পছন্দের কাউকে..’
পরখকে কথা শেষ করতে না দিয়ে আদ্রিকা বেশ বিরক্ত নিয়েই বলল,
‘আমার জীবন নিয়ে আমি কি করব, সেটা আমাকেই ভাবতে দিন।’
রাতের কতোতম প্রহর পর্যন্ত জেগে ছিল, ওরা জানে না। অন্ধকারে তাকিয়ে থাকতে থাকতে চোখজোড়া ক্লান্ত হয়ে একসময় নিজেই ঝুপ করে বন্ধ হয়ে গিয়েছে।
সকালে ভার্সিটি যাওয়ার আগে আদ্রিকাকে বাড়িতে নামিয়ে দিয়ে গিয়েছে পরখ। বাড়ি ফিরেই ঘরদোর গুছিয়ে বইপত্র নিয়ে বসেছে আদ্রিকা। ক্ষুধা না থাকা সত্ত্বেও দুপুরে ডাল চাল বসিয়ে একটু খিচুড়ি রেঁধেছে। একটুখানি খাওয়ার পর বাকিটুকু ওভাবে পড়ে আছে ফ্রিজে। মনটা আজ খুব একটা ভালো নেই।
এতোদিন নির্লিপ্ত থাকলেও গতরাতে আদ্রিকা হটাৎ করে অনুধাবন করেছে, পরখ ভীষণ স্বার্থপর একজন মানুষ। যে নিজের স্বার্থ ছাড়া আর কারো কথা ভাবে না, কারো পরোয়া করে না।
আদ্রিকার জীবনে দুজন পুরুষ এসেছিল। যারা দুজনই নিজ স্বার্থে আদ্রিকাকে ছেড়ে চলে গেছে। তবে কি পুরুষ মানুষ মানেই স্বার্থপর?
বিস্ময়ের ধোঁকা এবং স্বার্থপরতার পর আদ্রিকা তাকে দোষী সাব্যস্ত করেছে, খারাপ মানুষ মেনেছে। বিস্ময়কে গালি দিয়েছে, অভিশাপ দিয়েছে। মানুষ এতোটা জঘন্য হয়, ভেবে অবাক হয়েছে।
এরপর পরখের সাথে বিয়ে হলো। স্পষ্টবাদী মানুষটির মধ্যে কোনো রাখঢাক নেই৷ যা মনে আছে তাই মুখে বলে দেয়। শুনতে তেতো লাগলেও আদ্রিকার মনে হতো, এটাই ভালো৷ অন্তত বিস্ময়ের মতো মনে এক, মুখ আরেক তো নয়৷
যা ভাবছে, যা করছে, ভবিষ্যতে যা করতে চলেছে সবকিছু সরাসরি জানিয়ে দিচ্ছে। ধোঁকা খাওয়ার কোনো অবকাশ নেই। ধোঁকাবাজ বিস্ময়ের থেকে পরখ হাজারগুন ভালো। কিন্তু আজ আদ্রিকার চিন্তাধারা পাল্টেছে ৷ মানুষ মাপার মাপকাঠি বদলে গেছে।
আজ থেকে আদ্রিকা নিশ্চিত হলো, জগতের সব পুরুষ-ই স্বার্থান্বেষী। নিজের স্বার্থান্বেষণের যাত্রায় নারীর কোমল মন পায়ে পিষে প্রতিনিয়ত এগিয়ে যায় পুরুষ সমাজ।
গতরাতে পরখ নতুন জীবনের কথা বলছিল না? হাহ! আদ্রিকা আর কার সাথে নতুন জীবন গড়বে? কাকে বিশ্বাস করবে? কার উপর নির্ভর করবে? আরেকজন স্বার্থান্বেষী পুরুষ মানুষকে?
অসম্ভব। এই বেশ আছে আদ্রিকার। আর কাউকে দরকার নেই। কিন্তু থেকে থেকে মনটা পরখের জন্য হুহু করে উঠে। হৃদয়ের ভেতরকার শূন্যতা পূরণের জন্য কাউকে দরকার হয়। দুর্ভাগ্যবশত পরখের আশেপাশে থাকলে নিজেকে পূর্ণ মনে হয়।
খুব ভালো না হোক, খানিকটা মন্দ হোক। তবুও আমার একটা মানুষ আছে। যে একান্তই আমার। মাথার উপর একটা ছায়া আছে, কঠিন পথে একটা শক্ত হাত আছে, ভেঙে পড়েও সামলে নিতে একটা কাঁধ আছে। এটাই বা কম কীসের!
সেই একান্ত মানুষটাকে হারানোর ভয় আদ্রিকা ভুলে থাকতে চায়। এতোদিন অবশ্য ভুলেই ছিল। কিন্তু এখন ভয়টা জেঁকে বসেছে। শিশুর মনভুলানো কোনো বাহানা নেই আদ্রিকার কাছে। পরিণাম দিনের আলোর মতো পরিষ্কার৷
খাতায় অকারণ আঁকাবুকি করতে করতে আদ্রিকা ভাবছে নিজেকে কথা, পরখকে কথা, সংসারের কথা, দোতলা বাড়িটির কথা।
রক্তিম সূর্যটা পশ্চিমাশে ঢলে পড়তে পড়তে দূর আকাশে হারিয়ে যেতে শুরু করেছে। সেদিকে মনোযোগ নেই আদ্রিকার।
স্লাইডিং ডোর খোলার শব্দে আদ্রিকার ধ্যান ভঙ্গ হলো। পরখ এসেছে বোধহয়। আড়মোড়া ভেঙে চেয়ার ছেড়ে উঠে অলস পায়ে হেঁটে আদ্রিকা হলরুমের দিকে গেলো।
কক্ষ ত্যাগ করার জন্য দরজা খুলে হলরুমে পা রাখতে গিয়েও থেমে গেল আদ্রিকা। নিশ্চল পুতুলের মতো তাকিয়ে রইল সম্মুখে দন্ডায়মান মানুষটির দিকে৷
খুব চেনা মুখশ্রীর আড়ালে সম্পূর্ণ অচেনা একজন যুবক। আদ্রিকার জীবনের প্রথম অধ্যায়, আদ্রিকার জীবনের একমাত্র কলঙ্ক, আদ্রিকার জীবনের অভিশাপ। যে এই মুহূর্তটিকে কলুষিত করে দাঁড়িয়ে আছে আদ্রিকার সামনে।
দু’জোড়া চোখ একে অপরের পানে চেয়ে আছে। অতীতের খাতার খুলে দুজনে দাঁড়িয়ে আছে দুপ্রান্তে। অকস্মাৎ সাক্ষাতে তারা স্তম্ভিত, হতচকিত, নিস্তব্ধ। দুজনেরই চোখের তারা স্থির।
পার্থক্য শুধু তাদের চোখের ভাষায়। একজনের চোখের হতবুদ্ধিতা, অন্যজনের চোখে আতংক।
চলবে…
#অক্ষরময়ী
#পরিণয়ে_নোলককন্যা (কপি নিষেধ)
|৫৩|
সুইজারল্যান্ড, জুরিখ শহরের সুউচ্চ ভবনের ঊনচল্লিশতম তলার একটি ডেস্কের সামনে অলস সময় অতিবাহিত করছিল বিস্ময়। সুইজারল্যান্ডের সবচেয়ে বড় এই শহরটিতে যে কয়েকটি বিলাসবহুল হোটেল রয়েছে তার মধ্যে একটি এখন বিস্ময়ের। অবিশ্বাস্য বোধ হলেও উক্ত তথ্যটি শতভাগ সঠিক। এই তো আজ সকাল পর্যন্ত বিস্ময়ের নিজের কাছেও ঘটনাটি অবিশ্বাস্য মনে হয়েছিল। কিন্তু কিছুক্ষণ আগেই সমস্ত কাগজপত্র হাতে পেয়েছে বিস্ময়। সবই তার অবর্ননীয় পরিশ্রমের কর্মফল।
গত কয়েকটি মাস বিস্ময় নিজেকে বিলীন করে দিয়েছে “ডেস্টিনি” নামক প্রতিষ্ঠানটির মাঝে। মাত্র একরাতের নোটিশে বিস্ময় এসেছিল জুরিখে। ডেস্টিনির একমাত্র সচল হোটেল এন্ড রেস্টুরেন্টটির তখন টালমাটাল অবস্থা। আইনি জটিলতা, অভ্যন্তরীণ কোন্দল, কর্মীদের হরতালে মুষড়ে পড়েছিল। এমন নাজেহাল দশায় ডেস্টিনির হাল ধরেছিল বিস্ময়।
ভাবতেই অবাক লাগে, এই কয়েকমাসে বিস্ময়ের হাত ধরে ডেস্টিনি কোথা থেকে কোথায় পৌঁছে গেছে! সফলতার সর্বোচ্চ চূড়ায় অবস্থান করছে রেস্টুরেন্টসহ ডেস্টিনির অন্যান্য শাখা প্রতিষ্ঠানগুলো। রিসোর্ট, সুইস রেস্টুরেন্ট, ইন্টারন্যাশনাল রেস্টুরেন্ট এবং মিশেলিয়ান-স্টার এর মতো শাখাগুলো নিয়ে এখন শহর জুড়ে আলোচনা হয়।
বিস্ময়ের এমন সফলতায় হাসি মুখে হার মেনে নিয়েছে বিস্ময়ের বাবা তথা ডেস্টিনি গ্রুপের চেয়ারম্যান বারাশাত খন্দকার। আজ তিনি পূর্বে নির্ধারিত চুক্তিস্বরূপ জুরিখসহ পুরো সুইজারল্যান্ডের ব্যবসায়িক দায়িত্ব সদর্প করেছেন বিস্ময়ের হাতে।
সেসব কাগজপত্রে হাত বুলিয়ে গর্বের হাসি ফুটল বিস্ময়ের মুখে।
ঝকঝকে মেঝেতে ঠকঠক শব্দ তুলে উঁচু হিল পরিহিতা একজন সুদর্শনা এসে দাঁড়াল বিস্ময়ের সম্মুখে। সমধুর কণ্ঠে পেশাদারী স্বরে ইংরেজিতে জানাল,
“স্যার, আপনার গাড়ি তৈরি রয়েছে। এখনি কি বাড়ি ফিরবেন?”
কালো স্যুট, বুট পরিহিত যুবকটি মুখ তুলে চাইল সুদর্শনার দিকে। টেবিলের উপর কনুই ঠেকিয়ে মুষ্টিবদ্ধ হাতের উপর রাখল তীক্ষ্ণ থুতনি। বুদ্ধিদীপ্ত চোখের সুগভীর দৃষ্টিতে কিছুপল চেয়ে রইল রমণীর দিকে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“ভ্যালেরিয়া?”
স্বচ্ছ কাগজের মতো ফর্সা ত্বকের রমণীটি পূর্বেই মনোযোগী ছিল। বিস্ময়ের ডাকে আরও চকিত হয়ে বলল,
“ইয়েস স্যার।”
পেছনের খোলা জানালার দিকে মুখ ফিরিয়ে বিস্ময় কেমন উদাস স্বরে বলল,
“ফ্লাইটের একটি টিকিট কাটো। আমি আমার দেশ থেকে ঘুরে আসতে চাই।”
ভ্যালেরিয়ার সন্দিহান চোখজোড়া কয়েক সেকেন্ডের জন্য স্থির হয়ে রইল বিস্ময়ের উদাস মুখের উপর। তারপর বেশ চিন্তিত স্বরে বলল,
“স্যার, কালকের মিটিং?”
“দীর্ঘ যাত্রা শেষে সফলতা অর্জনের পর খানিক বিশ্রাম নেওয়া দরকার। তাই নয় কি?”
“হ্যাঁ। অবশ্যই।”
“তাহলে ঝটপট টিকিট কেটে ফেলো।”
“আমি কি আপনার সঙ্গে যাচ্ছি?”
“নাহ। তুমি এখানের কাজকর্ম দেখবে এবং আমাকে প্রতিনিয়ত খবরাখবর জানাবে।”
“ঠিক আছে স্যার।”
সেদিন রাতেই বিশাল বিমানে বসে কয়েক হাজার ক্রোশ পাড়ি দিয়ে বিস্ময় এসে পৌঁছাল নিজ মাতৃভূমির বুকে। বিমানবন্দরে তাকে স্বাগত জানাতে এসেছিল অফিসের সবচেয়ে আরামদায়ক কারটি। বাবা আসেনি, কোনো এক ব্যবসায়িক মিটিংয়ে তিনি ব্যস্ত। মা আসেনি, কারণ বিস্ময় উনাকে আগেই ফেরার খবর দেয়নি। দূর্ভাগ্যবশত এই সময় মিসেস খন্দকারের একটি স্পা শিডিউল পড়ে গিয়েছে। এক সপ্তাহ আগেই বুকিং করে রাখা স্পা কোনোভাবেই মিস দেওয়া গেল না।
বাড়ি ফিরে লম্বা শাওয়ার নিয়ে বিস্ময় আরাম করে ঘুমালো। রাতের বেলা দেখা হলো বাবা-মায়ের সাথে। ডিনারের টেবিলে আড্ডাটা ভালোই জমে উঠেছিল। কিন্তু পরেরদিন সকাল হতেই আবার একলা হয়ে গেল বিস্ময়। রাজপ্রাসাদের মতো মস্ত বড় বাড়িটিতে সারাদিন ভূতের মতো ঘুরেফেরা করার পর বিস্ময়ের মনে হলো, বিশ্রাম নিতে আর ভালো লাগছে না।
পরদিন সকালে বিস্ময় তার গাড়িটি নিয়ে বেরিয়ে পড়লো রাস্তায়। ড্রাইভার সাথে আসতে চেয়েছিল, কিন্তু বিস্ময় তাকে সাথে নেয়নি। কিছুক্ষণ গন্তব্যহীন গাড়ি চালানোর পর হুট করে মনে হলো, একবার ভূবনভোলা থেকে ঘুরে আসলে মন্দ হয় না। ভার্সিটি লাইফের বন্ধুরা কে কতোটা পথ পাড়ি দিল, জীবনে কতোটুকু উন্নতি করল দেখা দরকার।
দুপুরের খাওয়াটা সাজ্জাদের ওখানে খাওয়ার সময় কমবেশি সবার খোঁজখবর নেওয়া হয়ে গেল। কার নিয়ে ভূবনভোলা একাডেমি গেল টিচারদের সাথে দেখা করতে। ডিপার্টমেন্টের টিচারগণ প্রাক্তন শিক্ষার্থীর এমন সফলতায় ভীষণ গর্ববোধ করলেন। কথার প্রসঙ্গে একজন জানালেন পরখের কথা। একাডেমির আরেকজন কৃতি শিক্ষার্থী সে। যে ভার্সিটি পড়াশোনা করেছে, এখন সেখানেই শিক্ষকতা করছে। এটা কী কম সম্মানের!
পরখের বিদেশযাত্রা বানচালে খানিক দুঃখ পেলেও অন্যের মুখে বন্ধুর এমন প্রশংসা শুনে ভীষণ ভালো লাগল বিস্ময়ের।
জুরিখ যাওয়ার পর পরখের সাথে বিস্ময়ের যোগাযোগ হয়ে উঠেনি। বিস্ময়ের হঠাৎ প্রস্থানে বেশ ক্ষেপেছিল পরখ। বিস্ময় নিজেও অফিসের কাজে এতো ব্যস্ত ছিল যে নিজ থেকে যোগাযোগ করা হয়ে উঠেনি। আজ এতো কাছাকাছি এসে বন্ধুর সাথে দেখা না করে ফিরে যাওয়ার ইচ্ছে হলো না বিস্ময়ের।
কার নিয়ে সোজা চলে এলো দোতলা বাড়িটির সামনে। যা একসময়ের বিস্ময়ের বসতি ছিল। রুষ্ট বন্ধুর সাথে সাক্ষাতের উত্তেজনায় লাফিয়ে লাফিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠল। চঞ্চল হাতে স্লাইডিং ডোরের দরজা খুলে হলরুমে প্রবেশ করতেই ভাঁড়ারঘর থেকে বেরিয়ে এলো একজন রমণী।
বিস্ময় অবাক নয়নে তাকিয়ে রইল তার দিকে। খুব চেনা আদলে আদ্রিকার নতুন রূপ। হতবিহ্বল বিস্ময় পলকহীন চেয়ে চেয়ে দেখল আদ্রিকাকে।
কয়েক মিনিট বোধহয় ব্যয় হলো। খুব দ্রুত নিজেকে সামলে নিয়ে বিস্ময় অনুসন্ধানী চোখে পর্যবেক্ষণ করতে লাগল আদ্রিকাকে। পা থেকে মাথা পর্যন্ত বুলিয়ে নিলো চোখ। আদ্রিকার গায়ে হলুদ রঙা একটি হ্যান্ডলুম শাড়ি, চুলগুলো হাত খোঁপা করা। শরীর আগের তুলনায় খানিক ভারি হয়েছে। চোখে মুখে আরেকটু পরিণত ভাব। বিস্ময়ের মনে হলো সে একটি প্রস্ফুটিত সূর্যমুখীর সামনে দাঁড়িয়ে আছে।
রূপের মোহে পড়ে বিস্ময়ের মস্তিষ্ক সামান্য দূর্বল হলেও পুরোপুরি অকেজো হয়ে যায়নি। এক পা এগিয়ে বিস্মিত কণ্ঠে প্রশ্ন করল,
“তুমি এখানে?”
কাঠের দরজা শক্ত করে চেপে ধরে দাঁড়িয়ে আছে আদ্রিকা। তবুও পুরো শরীর থরথর করে কাঁপছে। মনে হচ্ছে এখুনি মাথা ঘুরে পড়ে যাবে। চোখের সামনের দৃশ্যটিকে ভ্রম বলে মনে হচ্ছে। ভ্রম না হলে অতীত কি করে বর্তমানে এসে দাঁড়ায়? আদ্রিকার ভ্রমের রাজ্যে আঘাত হানল বিস্ময়ের ডাক,
“আদ্রি?”
গায়ে এসে বিঁধল শব্দটা। গুলিয়ে উঠল আদ্রিকার সারা গা। সচকিত হয়ে দরজা ছেড়ে হলরুমে এগিয়ে এলো। সামান্য কেশে গলা পরিষ্কার করে বলল,
“আপনি এখানে?”
বাম ভ্রূ উঁচু করে তীক্ষ্ণ চোখে চাইল বিস্ময়। আপনি? তাকে আপনি বলল আদ্রিকা! চমকিত বিস্ময় জানতে চাইল,
“তুই এখানে কি করছিস?”
আদ্রিকা উত্তর না দিয়ে নিরবে তাকিয়ে রইল। এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হওয়ার কথা সে দুঃস্বপ্নের কখনো ভাবেনি। যদি কখনো ভাবার সাহস হতো তবে আদ্রিকা কিছু কথা গুছিয়ে রাখতে পারতো। এখন সবকিছু এলোমেলো লাগছে।
বাড়ির চর্তুদিকে নজর বুলিয়ে বিস্ময় আরেকধাপ অবাক হলো। পরিপাটি বাড়ির প্রতিটি কোণ বলে দিচ্ছে, তাদের গায়ে লেগে আছে নারীর আদুরে ছোঁয়া। বিস্ময় অবাক হয়ে বলল,
“তুই এখানে থাকিস? কী করে সম্ভব! তোর বাড়ির লোকজন তোকে এখানে থাকতে দিল? কী আশ্চর্য ব্যাপার!”
বিস্ময় দ্রুতপায়ে আদ্রিকার কাছাকাছি পৌঁছে আদ্রিকার দিকে হাত বাড়াতেই পিছিয়ে গেল আদ্রিকা। ভ্রূ কুঞ্চিত করে কড়া চাহনী ছুড়ে দিয়ে বলল,
“আপনি এখানে কেনো এসেছেন? আপনার তো এখানে আসার কথা ছিল না।”
আদ্রিকার অভিমানে কৌতুকে হাসি দেখা গেল বিস্ময়ের মুখে। বুকে দু হাত ভাঁজ করে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বলল,
“আমি ফিরে আসব না জেনেও আমার জন্য অপেক্ষা করছিস। নিজের বাড়িঘর, আত্মীয়স্বজন ছেড়ে এখানে থাকছিস। হাউ সিলি!”
আদ্রিকার ঠোঁটে বিদ্রুপের হাসি খেলে গেলো। বলল,
“নিজেকে এতোটাও ইমপোর্টেন্ট ভাববেন না। প্রতারকের জন্য কেউ অপেক্ষা করে থাকে না।”
বিস্ময়ের মুখে ধুপ করে আঁধার নামলো। শক্ত হয়ে এলো চোয়াল। কটমট করে তাকিয়ে বলল,
“তবে এখানে কি করছিস? কেনো এসেছিস এখানে?”
আদ্রিকা মুখখানি উঁচু করে বিস্ময়ের চোখে চোখ রেখে বলল,
“বিয়ে হয়েছে আমার। স্বামীর বাড়িতে থাকব না তো কোথায় থাকব?”
বিস্ময়ের মনে হলো সে অসম্ভব কোনো কথা শুনল। আদ্রিকা বিয়ে করেছে? এ হতেই পারে না। এতো দ্রুত বিস্ময়কে ভুলে যেতে পারল মেয়েটা! বিস্ময়ের আদ্রি এটা করতেই পারে না।
বিস্ময় এক হাত বাড়িয়ে আদ্রিকার বাম হাতের বাহু শক্ত করে ধরে আদ্রিকাকে নিজের দিকে টেনে নিয়ে বলল,
“বিয়ে করেছিস তুই? আমি চলে যেতেই নাচতে নাচতে বিয়ে করে নিলি! আমার যাওয়ার অপেক্ষায় ছিলি৷ কবে আমি চলে যাবো আর কবে আরেকজনের গলায় ঝুলবি৷ এতোটা ডেস্পারেট তুই! আর আমাকে প্রতারক বলিস। নিজের স্বপ্ন পূরণের ছুটা কোনো অন্যায় না৷ আমি কোনো মেয়ের জন্য তোকে রেখে চলে যাইনি। কাজের জন্য গিয়েছিলাম। তুই পারতি না, আমার জন্য অপেক্ষা করতে? অবশ্যই পারতি। কিন্তু করিস নি৷ আসলে তোর মনে ছিল শয়তানি।”
আদ্রিকার মনে হচ্ছে, তার বাহুতে আগুন ধরে গেছে। জ্বলে পুড়ে যাচ্ছে। হাত ছাড়াতে ব্যস্ত আদ্রিকাকে কণ্ঠে ঝাঁঝ নিয়ে আদেশ করল,
“হাত ছাড়ুন৷”
“কাকে বিয়ে করেছিস? ছেলেটা কে? এক মিনিট, পরখ কোথায়? ও এখানে থাকত না? এখন থাকেনা? বাড়ি ছেড়ে দিয়েছে কি? কবে ছেড়েছে?”
“বিস্ময়, হাত ছাড়ুন৷ ছুঁবেন না আমাকে।”
“ওহ এখন আমার ছোঁয়াও বারণ! যেন কখনো ছুঁইনি তোকে। এই কাকে বিয়ে করেছিস তুই? ছেলেটা কি? কী আজব মেয়েরে তুই! পুরুষ সঙ্গ ছাড়া একটা দিন কাটাতে পারিস না। এতো খাই খাই স্বভাব কেন তোর? আমি চলে যেতেই নাচতে নাচতে বিয়ে করে নিলি।”
“তো আপনার জন্য অপেক্ষা করবো? একজন ধোঁকাবাজ, প্রতারকের অপেক্ষায় থাকব? নিজে আমাকে ফেলে রেখে গিয়েছিলেন। এখন এসে এমন ভাব করছেন যেনো আমি আপনাকে ধোঁকা দিয়ে অন্যত্র বিয়ে করে নিয়েছি৷ আমার বিয়ে নিয়ে আপনি এতো রিয়েক্ট করছেন কোন লজিকে? লজ্জা করছে না আপনার?”
“লজ্জা? হা হা৷ আমার লজ্জা করবে কেনো? লজ্জা তো তোর করা উচিত। কাকে বিয়ে করেছিস বল৷ সে জানে আমার সম্পর্কে? আমাদের সম্পর্কের কথা জানে? সে কি জানে তার বিয়ে করা বউ, একসময় আমার বিয়ে করা বউ ছিল৷ আমার সাথে শুয়ে ছিল। বলেছিস তাকে?”
আদ্রিকা থমকে গিয়ে অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তাকাল বিস্ময়ের দিকে। একটা মানুষ এতো নিকৃষ্ট কী করে হতে পারে? এই নিকৃষ্ট, অমানুষটাকে নাকি আদ্রিকা একদিন ভালোবেসে ছিল। ভাবতেই নিজের প্রতি ঘৃণা জন্মাচ্ছে আদ্রিকার। মনের সমস্ত ঘৃণা কণ্ঠে ঢেলে আদ্রিকা বলল,
‘আপনি একটা অমানুষ। পশুর চেয়ে অধম, নিকৃষ্ট।”
এক হাতে আদ্রিকার বাহু আরও জোরে চেপে ধরে অন্য হাতে আদ্রিকার গাল দুটো চেপে ধরে বিস্ময় বলল,
“যেই না অন্য ছেলে পেলি অমনি আমি অমানুষ হয়ে গেলাম না? একসময় এই অমানুষটার সাথে শুতে খুব মজা লেগেছিল, চুমু খেতে ভালো লেগেছিল। আর এখন আমি পশুর চেয়ে অধম?”
আদ্রিকাকে অবাক করে দিয়ে আদ্রিকার মুখের উপর ঝুকল বিস্ময়। এতোক্ষণ ক্রোধে উন্মাদ হয়ে হলেও এবার আতংকে জড়োসড়ো হয়ে গেল আদ্রিকা। বিস্ময়ের হাত থেকে ছাড়া পেতে অস্থির হয়ে উঠল। দু হাতে বিস্ময়ের বুকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিল। আকস্মিক আঘাতে দু পা পিছিয়ে গেল বিস্ময়। ক্রোধে চোখ দুটো লালচে হয়ে উঠেছে। আবারও আদ্রিকার দিকে এগিয়ে আসতেই খাবারের টেবিলের পেছনে সরে দাঁড়ালো আদ্রিকা।
থরথর করে কাঁপছে সে। ছলছল চোখে ভয়। সিক্ত কণ্ঠে সমস্ত সাহস একত্র করে বলল,
‘খবরদার আমার কাছে আসবেন না। দূরে থাকুন।”
বিস্ময় নারীসঙ্গপ্রেমী হলেও লম্পট নয়। জোর জবরদস্তি করার কথা সে কখনো কল্পনাও করেনি। কিন্তু আদ্রিকা চোখে এই মুহূর্তে সেই ভয়টাই স্পষ্ট।
বিস্ময় নিজের সীমারেখা টেনে দিয়ে সেখানেই দাঁড়িয়ে দাঁতে দাঁত চেপে ঘরময় পায়েচারি করতে লাগল।
স্তব্ধ, ভয়ার্ত আদ্রিকা নিশ্চল দাঁড়িয়ে হলরুমের বিশাল জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে সময় অনুমান করার চেষ্টা করছে। হলরুমে ঘড়ি নেই। আদ্রিকার মোবাইলটাও সাথে নেই। পরখ আসতে কতোক্ষণ বাকি? এখনো আসছে না কেনো এখনো?
ঘরময় পায়েচারির এক পর্যায়ে বিস্ময় ক্লান্ত হয়ে বসে পড়ল মলিন সোফায়। সামনের দিকে দু পা ছড়িয়ে বসে সোফায় মাথা এলিয়ে দিয়ে কয়েক সেকেন্ড চোখ বন্ধ করে নিজেকে শান্ত করল।
জুরিখ যাওয়ার পর এক মুহূর্তের জন্যেও আদ্রিকার খেয়াল করেনি বিস্ময়। নিজের জীবন নিয়ে এতোটাই ব্যস্ত ছিল যে আরেকজনকে নিয়ে ভাবার সময় হয়নি। ছুড়ে ফেলে যাওয়া আদ্রিকা কেমন আছে, কীভাবে আছে সেসব চিন্তা কখনো মনে আসেনি। এতো চিন্তা করারও তেমন কিছু ছিল না। অহরহ মানুষের প্রেমে বিচ্ছেদ হয়। তাদের নিয়ে আলাদা করে কে এতো ভাবে? ব্যস্ত নগরীতে এমন ছোটোখাটো দুটো ঘটনায় কী এসে যায়! কার জীবন থেমে থাকে!
আজকে হঠাৎ আদ্রিকা সম্মুখে এসে দাঁড়াতেই সোনালি অতীতের কথা হুট করে মনে পড়ল বিস্ময়ের। এভাবে সামনে না পড়লে হয়তো কখনো মনেই পড়ত না৷ কিন্তু আদ্রিকাকে এতোটা সাচ্ছন্দ্যে থাকতে দেখে বিস্ময়ের নিজেকে প্রতারিত মনে হচ্ছে।
বিস্ময়কে মুছে ফেলে আদ্রিকা এভাবে এগিয়ে গেছে, সেটা মেনে নেওয়া যাচ্ছে না।
সম্পর্ক ভাঙ্গনের অন্তত কয়েকটা মাস আদ্রিকার উচিত ছিল শোকে, কষ্টে, হতাশায় আকণ্ঠ ডুবে থাকা। তা না করে এমন সেজেগুজে বেড়াচ্ছে, বিস্ময়ের সাথে জবান লড়াচ্ছে! খানিকটা মোটাও হয়েছে না?
বিস্ময় চোখ মেলে আদ্রিকার দিকে তাকাল। হ্যাঁ, হয়েছে তো। ফর্সাও হয়েছে।
মেজাজটা আরও বিগড়ে গেল বিস্ময়ের। খুব সুখে আছে আদ্রিকা। তার সুখ আমদানিকারী ব্যক্তিটি কে? কে সে যে বিস্ময়ের উপরে ফেলা চারা গাছটিকে এমন আদর যত্নে রেখেছে৷ আদ্রিকার সজীবতার উৎসটি কে?
বিস্ময় কটমট করে চেয়ে তেজীয়ান স্বরে জানতে চাইল,
“ছেলেটা কে?”
আদ্রিকা জানে না, এই উন্মাদ লোকটি আরও কি কি অনাসৃষ্টি কান্ড করবে। কেনো সে এভাবে বসে আছে। কেনো বিরক্ত করছে আদ্রিকাকে? কি চাইছে সে?
বিস্ময় এখন যদি আরও কোনো অসংলগ্ন আচরণ করে এবং সেই মুহূর্তে পরখ এসে উপস্থিত হয়? আর ভাবতে পারছে না আদ্রিকা। সৃষ্টিকর্তা এ কোন পরিস্থিতির মধ্যে ফেলল তাকে?
শুকনো ঢোক গিলে খানিক অনুরোধের সুরেই আদ্রিকা বলল,
“আপনি চলে যাচ্ছেন না কেনো? প্লিজ চলে যান এখান থেকে।”
কথাগুলো বলতে গিয়ে আদ্রিকার বাম চোখ থেকে এক ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ল। কম্পিত হাতে তা দ্রুত মুছে ফেলল সে। যা দেখে হাসল বিস্ময়। মেয়েটা তাকে ভয় পাচ্ছে। ব্যাপার দারুণ না? দারুণই বটে৷ একজন পুরোদস্তুর ঘরসংসারী নারী, সংসার ভাঙ্গার ভয় পাবে সেটাই স্বাভাবিক। ভীতু মানুষকে আরও ভড়কে দিতে বরাবরই ভালো লাগে বিস্ময়ের। সে সোফার হাতলে হাত রেখে আরও আরাম করে বসে বলল,
“এই প্রথম তোর বাড়ি এলাম, না খাইয়ে বিদায় দিবি নাকি! একটা চুমু খেতে চাইলাম, তাও দিলি না।”
আদ্রিকার মুখে বিরক্তির ছাপ দেখে বিস্ময় ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসল।
“এক কাপ চা অন্তত খাওয়া। যাহ, দ্রুত চা বানিয়ে নিয়ে আয়। চা খেয়ে চলে যাবো।”
চলবে…
#অক্ষরময়ী
#পরিণয়ে_নোলককন্যা (কপি নিষেধ)
|৫৪|
জাপান থেকে একটি পেইন্টিং নিয়ে আসা হয়েছে রসনাবিলাসীর প্রবেশ পথে টাঙানোর জন্য৷ অথচ সেটি ভেতরের দেয়ালে ঝুলছে৷ এমন কাজ কে করেছে খোঁজ নিয়ে জানা গেল, গতমাসে রেস্তোরাঁর কাজে নিযুক্ত ছেলেটি নিজের খেয়াল খুশি মতো পেইন্টিংটি টাঙিয়ে দিয়েছে। পরখ তাকে নিজের কেবিনের ডেকে পাঠালো।
‘শচীন, আমি তোমাকে পেইন্টিংটি কোথায় সেট করতে বলেছিলাম?’
বসের উত্তপ্ত মেজাজ দেখে শচীন খুব একটা বিচলিত হলো না। কৈশোর থেকে সদ্য যুবক বয়সে পদার্পণ করেছে সে৷ এই সময় নিজের খেয়াল-খুশি মতো চলতে ভালো লাগে। কারো আদেশ উপদেশ অকারণ ক্যাচক্যাচ মনে হয়।
‘বাইরে লাগাতে বলেছিলেন। কিন্তু আমার মনে হয়েছে, ভেতরে ভালো লাগবে।’
বেপরোয়া ছেলেটির কথা শুনে তাজ্জব বনে গেল পরখ। বিস্মিত হয়ে শুধাল,
‘তুমি ভেবেছিলে! আমার আদেশে বিপরীতে তোমাকে ভাবতে হলো কেনো? কেউ তোমার থেকে সাজেশন চেয়েছিল কি?’
‘নাহ স্যার।’
‘এখানে কাজ করতে হলে একগুয়ে স্বভাব ছাড়তে হবে। এটা তোমার বাড়ি নয়। অর্ডার ফলো করতে না পারলে কাল থেকে কাজে আসার দরকার নেই।’
‘স্যরি স্যার। আর হবে না।’
‘এখন যাও। পেন্টিং যেখানে সেট করার কথা ছিল সেখানে সেট করো।’
শ্চীন বেরিয়ে যেতেই টেবিল থেকে মোবাইলটি তুলে নিল পরখ। অনরবত কল করে যাচ্ছে আদ্রিকা। মেয়েটা কি কখনো ক্লান্ত হয় না? বিরক্ত হয় না?
কল রিসিভ করে ধমকে উঠল পরখ,
‘কী সমস্যা? কল কেটে দিচ্ছি দেখেও অনবরত কল দিয়েই যাচ্ছো!’
এতোক্ষণ মনে কিছুটা সাহস জমে থাকলেও পরখের কণ্ঠ শোনার পর মোমের মতো গলে গেল আদ্রিকা। সমস্ত সাহস, ধৈর্য, কঠোরতা হারিয়ে গিয়ে একনিমিষেই ভেঙে পড়ল। পরখের ধমক আদ্রিকা আমলে না নিয়ে ভয়ার্ত, সিক্ত কণ্ঠে ফিসফিস করে ডাকল,
‘পরখ?’
পরখের কপালে সমান্তরাল ভাঁজ পড়ল। কাঁদছে কেনো মেয়েটা? আবার কোনো বিপদে পড়লো না তো! পরখ নড়েচড়ে বসে অধির আগ্রহে জানতে চাইল,
‘কাঁদছ কেনো? কি হয়েছে?’
হিচকি তুলে কাঁদতে কাঁদতে আদ্রিকা বলল,
‘আপনি কোথায়, পরখ? বাড়ি আসুন প্লিজ। এক্ষুণি চলে আসুন।’
পরখকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে কল কেটে দিল আদ্রিকা। হলরুমের সোফায় এখনো বসে আছে বিস্ময়। সেদিকে তাকিয়ে শুকনো ঢোক গিলল।
সোফায় বসে থেকে বিরক্ত লাগছে। উঠে দাঁড়াল বিস্ময়। গুটি গুটি পায়ে রান্নাঘরে গিয়ে দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে বলল,
‘এক কাপ চা বানাতে এতো সময় লাগে! তুমি কি এখনো রান্নাবান্না কিছু শিখতে পারো নি?’
বেসিনের সামনে দাঁড়িয়ে ছিল আদ্রিকা হঠাৎ বিস্ময়ের কথা শুনে চমকে উঠল। দ্রুত নিজেকে সামলে ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল,
‘কিচেনে আসবেন না। সোফায় গিয়ে বসুন। চা বানিয়ে দিচ্ছি, খেয়ে বিদায় হোন।’
আদ্রিকার ক্রোধমিশ্রিত লালচে মুখশ্রীর দিকে বেহায়া নজরে তাকিয়ে থেকে বিস্ময় হাসল। বলল,
‘গৃহিণী রূপে কাতিলানা লাগছে, মেঘমালা।’
একজন বিবাহিত নারীকে এমন কথা বলে কারা? দুশ্চরিত্র, লম্পট প্রকৃতির পুরুষ, তাই না? ঘৃণায় মুখ কুঁচকে ফেলল আদ্রিকা। এই চরিত্রহীন লোকটির সাথে বাক্যবিনিময় করতেও রুচিতে বাঁধছে।
আদ্রিকার নিস্তব্ধতায় বিস্ময় যেন আরও লাই পেলো। আরেকটু সাহসী হয়ে বলল,
‘আমি সুইজারল্যান্ড না গেলে আমাদের এমন একটি সংসার হতো, তাই না? রোজ সন্ধ্যায় তুই আমার জন্য চা বানাইতি। তিনবেলা রান্না করতি, ঘর গুছাইতি। এমন শাড়ি পরে আমার জন্য অপেক্ষা করতি। তোকে এই বেশে দেখে আমার তো ভীষণ আফসোস হচ্ছে। তোমার কষ্ট হয় না?’
‘একদমই হয় না। আপনার সুইজারল্যান্ড চলে যাওয়ার সিদ্ধান্তে আমি সৃষ্টিকর্তার দরবারে হাজার শুকরিয়া জানাই। আপনার সাথে সংসার না হওয়ার কষ্ট হওয়া তো দূরের কথা, সামান্যতম আফসোসও হয় না। বরং আজকের পর থেকে আরও খুশি লাগবে।’
আদ্রিকার মুখ থেকে কোনোদিন এমন কথা শুনতে হবে, কখনো ভেবেছিল বিস্ময়? ভাবেনি। আদ্রিকার রুষ্ট কণ্ঠস্বর, ক্রোধিত জ্বলন্ত দৃষ্টি, কঠিন মুখশ্রীর প্রতি ভীষণ আকর্ষণবোধ করছে বিস্ময়। সুশীল, শান্ত, বোকা আদ্রিকার থেকেও রাগী, দাম্ভিক, আত্মবিশ্বাসী আদ্রিকা বহুগুণ সুন্দর এবং আকর্ষণীয়।
বিস্ময় কেমন ঘোরের মাঝে এক পা বাড়ালো সামনে। চকিত আদ্রিকার সূক্ষ্ণ দৃষ্টি দ্বারা সাবধান করে বলল,
‘একদম ভেতরে আসার চেষ্টা করবেন না।’
সেই ধক করে জ্বলে উঠা চোখ জোড়ার দিকে তাকিয়ে বিস্ময় থমকে দাঁড়াল। বাঁকা হেসে বলল,
‘উফ! কথায় কথায় এমন রেগে যাচ্ছিস কেনো? আমার কি মনে হচ্ছে জানিস? তুই চাইলেই আমাদের এমন একটা সংসার হতো। তুই পারতি আমার জন্য অপেক্ষা করতে। কিন্তু তুই করিসনি। ইচ্ছে করেই করিসনি। ভালো ছেলে পেয়ে সুযোগ বুঝে কেটে পড়েছিস। বেঈমান।’
চোরের মায়ের বড় গলা প্রবাদটি শুনেছিল আদ্রিকা। কিন্তু আজ তার সম্মুখীন হয়ে বিস্ময়ে হতবুদ্ধি হয়ে গেল।
‘আমি বেঈমান? আমি উচিত ছিল আপনার জন্য অপেক্ষা করা? কেনো অপেক্ষা করবো? কোন সম্পর্ক অবশিষ্ট আছে আমাদের মধ্যে? তালাক দিয়েছেন আমাকে। ভুলে যাননি নিশ্চয়ই।’
‘আরে ধুর! ওটা কোনো বিয়ে ছিল নাকি! তুই গিল্টি ফিল করতেছিলি, কনসোল করার জন্য ওসব সাজিয়েছিলাম। এতো সিরিয়াসলি নেওয়ার কি আছে?’
আদ্রিকার সমস্ত বাঁধা নিষেধ ভুলে চিৎকার করে প্রতিবাদ করল,
‘আমার কাছে ঐ বিয়েটা সত্যি ছিল। ভীষণ সত্যি ছিল, দিনের আলোর মতো পরিষ্কার, ধ্রুব সত্য ছিল। আপনি সেটা জানতেন। সেই সুযোগটাই আপনি নিয়েছেন। আমি পবিত্র মনে নিজেকে আপনার কাছে সঁপে দিয়েছিলাম। আপনি তার ফায়দা লুটেছেন। আমার সরলতার সুযোগ নিয়েছেন। আমার বিশ্বাস, ভরসাকে এভাবে অপমান করতে বিবেকে বাঁধল না আপনার?’
‘তোর বিশ্বাস, ভরসা বড্ড ঠুনকো ছিল। না হলে আমি বলা মাত্র অন্যত্র বিয়ের পিঁড়িতে বসতি না। সব সম্পর্ক শেষ, আমি বললাম আর তুই মেনে নিলি। একটু চেষ্টাও করলি না, অপেক্ষাও করলি না। এখন আবার আমাকে দোষারোপ করছিস! চমৎকার।’
‘চোখে কাঠের চশমা পরে থাকলে সামনে পড়ে থাকা সত্যটা দেখতে পাবেন না, সেটাই স্বাভাবিক। আপনার সাথে কথা বলে নিজের সময় অপচয় করার কোনো মানে হয় না।’
‘তর্কে হেরে গেলে মানুষ এমন কথাই বলে। বাদ দে। তুই চা বানা। চা খেয়ে বিদায় নেই৷ তোর স্বামী কোথায়? বাড়ি ফিরে কখন?’
আদ্রিকা কোনো উত্তর না দিয়ে কঠিন চোখে বিস্ময়ের দিকে চেয়ে রইল। বিস্ময় কাঁধ নাচিয়ে বেরিয়ে এলো হলরুমে। হাটতে হাটতে গুনগুন করল,
“তুমি এত সহজে ভুলতে পারো
অন্য কাউকে জড়িয়ে ধরো
আমি কেনো শুধু ভুলে যেতে পারি না।
আজ অবাক লাগে তোমায় দেখে
আমায় আজ তোমার অচেনা লাগে
এত ভালো অভিনয় কেনো জানি না?”
*****
রেস্তোরাঁর সমস্ত কাজ অগোছালো রেখে বাড়ি ফিরেছে পরখ। সর্বোচ্চ গতিতে ছুটেছে তার বাইক। বাড়ি ফিরে দেখল বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছে একটি কার দাঁড়িয়ে আছে। স্বল্প বন্ধুবান্ধব এবং আত্মীয়স্বজনের মাঝে কারে চলাচলকারী তেমন কেউ নেই। যারা আছে, তাদের সবার কার পরখের চেনা। আশ্চর্যজনকভাবে এই কারটি পরখের অচেনা৷
বাইক থেকে নেমে দ্রুত পায়ে সিড়ি বেয়ে উপরে উঠল পরখ। স্লাইডিং ডোর হাট করে খুলে রাখা৷ সতর্ক পা জোড়া ঘরের ভেতরে প্রবেশ করতেই সোফায় আসনরত বিস্ময়কে দেখে বুক ধক করে উঠল পরখের৷ একই প্রতিক্রিয়া বিস্ময়েরও।
বন্ধুকে দেখে সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে সরু চোখে তাকিয়ে বলল,
‘পরখ, তুই?’
একই ছাদের নিচে পরখ-আদ্রিকাকে দেখে বুঝতে কিছু বাকি রইল না বিস্ময়ের। তবুও বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে। ঘাড় বাকিয়ে আরেকবার তাকাল রান্নাঘরের দিকে৷
‘তুই আদ্রিকার হাসবেন্ড! তুই আর আদ্রিকা? কীভাবে সম্ভব?’
নিজ বোকামিতে তাচ্ছিল্যের হাসি দেখা গেল বিস্ময়ের ঠোঁটে। বিস্ময়ের দৃষ্টি অনুসরণ করে পরখ তাকাল রান্নাঘরের দিকে। থমকে থাকা মস্তিষ্ক দ্রুত স্মরণ করলো আদ্রিকার উপস্থিতি। কি করছে ও?
আশ্চর্যান্বিত বিস্ময়ের দিকে এগিয়ে গিয়ে পরখ শান্ত কণ্ঠে প্রশ্ন করল,
‘দেশে ফিরেছিস কবে?’
বিস্ময়ের মুখটা থমথমে। প্রেয়সী ও বন্ধুর প্রতারণায় প্রচন্ড অপমানিত বোধ করছে এই মুহুর্তে। পরখ তার সাথে এমন ধোঁকাবাজি করতে পারে, কস্মিনকালেও ভাবেনি। দাঁতে দাঁত পিষে জবাব দিল,
‘হবে কয়েকদিন।’
‘হুম। দাঁড়িয়ে রইলি কেনো? বস।’
বিস্ময় বসলো না। একদৃষ্টিতে পরখের দিকে চেয়ে থেকে বলল,
‘তুই আদ্রিকাকে বিয়ে করেছিস কেনো? তুই জানতি না, আমাদের সম্পর্কের কথা? ও আমার গার্লফ্রেন্ড জেনেও কী করে এমন কাজ করলি?’
পরখ এতোক্ষণ প্রতিক্রিয়াহীন রইলেও বিস্ময়ের মুখে গার্লফ্রেন্ড শব্দটি শুনে শক্ত হয়ে এলো চোয়াল। কিন্তু ধৈর্য হারালো না। শীতল কণ্ঠে বলল,
‘তুই বস। আমি একটু আসছি।’
নিজ কক্ষের দিকে পা বাড়ানোর আগে পরখ উচ্চ কণ্ঠে ডেকে উঠল,
‘আদ্রিকা?’
পাশ থেকে বিস্ময় জানাল,
‘রান্নাঘরে। আমার জন্য চা বানাচ্ছে।’
পরখ ঘাড় ফিরিয়ে সবিস্ময়ে তাকাল বিস্ময়ের দিকে। চা বানাচ্ছে! বিস্ময়ের জন্য? বাহ! চমৎকার। সর্বাঙ্গ জ্বলে উঠল পরখের। লম্বা কদম ফেলে ছুটল রান্নাঘরে।
কম্পিত হাতে সসপ্যানে পানি নিয়ে চুলায় বসাল আদ্রিকা। গ্যাস লাইটার দিয়ে বারকয়েক চুলা জ্বালানোর ব্যর্থ প্রয়াস করলো৷ একবার, দুবার, তিনবার চেষ্টার পরেও চুলা জ্বলল না। জরুরি প্রয়োজনে একটা জিনিসও ঠিকঠাক কাজ করে না।
গ্যাস লাইটার ছুড়ে ফেলে উপরের র্যাক থেকে দিয়াশলাই বের করল। দিয়াশলাইয়ের গায়ে ঘষা দিতেই ফস করে জ্বলে উঠল কাঠি। চমকে গিয়ে হাত থেকে ফসকে পড়ে গেল জ্বলন্ত কাঠিটি।
দু চোখ বুজে নিজেকে খানিকটা সময় দিল আদ্রিকা। দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে আবারও চেষ্টা করলে এবার চুলা জ্বলাতে সক্ষম হলো।
জ্বলন্ত চুলার পাশে দাঁড়িয়ে থেকে আদ্রিকা শুনতে পেলো পরখের ডাক। সাড়া দিতে পা বাড়িয়েছে মাত্র তখনি কর্ণগোচর হলো বিস্ময়ের কণ্ঠ। শয়তান ছেলেটা পরখকে বিভ্রান্ত করতেই কথাটা এভাবে বলল। পরখ কেমন প্রতিক্রিয়া দেখায় কে জানে! বিস্ময়ের নাম মাত্র যে মানুষ ফোঁস করে উঠে তার সামনে স্বয়ং বিস্ময় দাঁড়িয়ে। পরখের অবর্ণনীয় প্রতিক্রিয়া দেখানো স্বাভাবিক।
রাগ, ক্ষোভ, আতংকে চুলার সামনে দাঁড়িয়ে দু হাতে কচলাতে শুরু করল আদ্রিকা৷ পরখ এলো দ্রুত পায়ে৷ আদ্রিকার পাশে দাঁড়িয়ে সুক্ষ্ণভাবে পর্যবেক্ষণ করতে থাকল। ওমন করে তাকিয়ে কি দেখছে, কি খুঁজছে কে জানে! চোখ তুলে চাইবার সাহস হলো না আদ্রিকার৷ মাথা ঝুকে বুকের থুতনি ঠেকিয়ে আতংকে জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।
একদিকে বিস্ময়ের প্রতি ঘৃণা, অন্যদিকে পরখের প্রতিক্রিয়ার ভয় – এতো এতো মানসিক চাপে নিজেকে ভীষণ অসহায় মনে হলো আদ্রিকার৷ তাকে নিয়ে সৃষ্টিকর্তা এ কোন খেলায় মেতেছে! কেনোই এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন করলেন?
সৃষ্টিকর্তার প্রতি অমোঘ অভিমানে ভরে উঠল বুক। চোখের থৈ থৈ জল বর্ষার বাদলধারা হয়ে চোখের কোল বেয়ে ভূমিতে পতিত হতে থাকল।
প্রাক্তনের প্রত্যাবর্তনে প্রেয়সীর প্রতিক্রিয়া কীরূপ? উচ্ছ্বলতা কতোটুকু? বেশ কিছুক্ষণ যাবৎ তাড়িয়ে তাড়িয়ে দেখল পরখ।
আদ্রিকার চক্ষু নির্গত মুক্তদানা কপোল বেয়ে টপটপ করে ঝরে পড়ছে৷ পরখ হাত বাড়িয়ে এক আঙ্গুলে আদ্রিকার থুতনি ধরে মুখখানা উঁচু করতে বাধ্য করলো। আদ্রিকার চোখে চোখ রেখে জানতে চাইল,
‘খুশিতে কাঁদছো নাকি দুঃখে? নিজের দুর্দশা দেখে কষ্ট হচ্ছে?’
আদ্রিকা কী বলবে? বলার মতো কিছু আছে? বললেই বা পরখ বিশ্বাস করবে কেনো? সে তো যা ভাবার ভেবেই নিয়েছে৷ তবুও দুপাশে মাথা দুলালো আদ্রিকা৷
পরখ দৃষ্টি সরিয়ে চায়ের পানির দিকে তাকিয়ে উন্মত্তের মতো হাসল। বলল,
‘চা-ও বানাচ্ছো দেখছি! প্রাক্তন স্বামীর জন্য নিজ হাতে যত্ন করে বানানো এক কাপ চা।’
আদ্রিকা নাক টেনে কিছু বলতে উদ্যত হতেই পরখ তাকে ধাক্কা দিয়ে নিকটস্থ দেয়ালের সাথে চেপে ধরল৷ শক্ত করে চোয়াল চেপে ধরে আদ্রিকার সিক্ত ঠোঁটে ঠোঁট ছোঁয়ালো। শ্বাস রুদ্ধকর দীর্ঘ চুমু খেয়ে বলল,
‘হাউ ডেয়ার ইউ? হাহ?’
আদ্রিকার মুখের উপর পরখের তপ্ত শ্বাস পড়ছে। ঠোঁটে ঠোঁট ছুঁই ছুঁই৷ দুপাশে মাথা দুলিয়ে পরখের কাঁধে রাখতেই তা ঝটকা মেরে সরিয়ে দিল পরখ। একহাতে আদ্রিকার হাত দুটো চেপে ধরে মাথার উপরের দেয়ালের সাথে চেপে ধরল। অন্য হাতে কোমর জড়িয়ে আরও কাছে টেনে নিয়ে বলল,
‘ডোন্ট ফরগেট হু ইউ আর। ইউ আর মাই ওয়াইফ।’
আদ্রিকার তৃষ্ণার্ত চোখে সামান্য আশার আলো ঢেউ খেলে যাওয়া মাত্র পরখ ওর হাত জোড়া মুক্ত করে দিল। কোমর ছেড়ে দিয়ে এক পা পিছিয়ে গিয়ে নিজ বাক্যের সাথে যুক্ত করল,
‘এখন পর্যন্ত।’
আদ্রিকাকে সরিয়ে দিয়ে নিজেই চুলার সামনে দাঁড়িয়ে সসপ্যানটি নামিয়ে নিল। চায়ের পানি ফেলে দিয়ে আবারও নতুন করে পানি ভরলো।
আদা, দারুচিনি, লং, এলাচি, তেজপাতা সবকিছু দিল চায়ের পানিতে। পাশে দাঁড়িয়ে নীরবে দেখতে আদ্রিকা। অদ্ভুতভাবে পরখের রাগান্বিত মুখটি দেখতে ভালো লাগছে, শান্তি লাগছে৷
ধীর পায়ে পরখের পেছনে এসে দাঁড়ালো আদ্রিকা। দু হাতে পরখের কোমর জড়িয়ে ধরে মাথা রাখল সুঠাম পিঠে। পরখের ব্যস্ত হাত কিছুপলের জন্য
থমকালো। তবে ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল না৷
হাত বাড়িয়ে পট নামিয়ে ফুটন্ত পানিতে চা পাতা যুক্ত করলো। চিনি, দুধ মিশিয়ে দুধ চা বানিয়ে তিনটি কাপে ঢেলে দুটি দু হাতে তুলে নিল। সম্মুখে তাকিয়ে থেকে শান্ত, শীতল কণ্ঠে বলল,
‘চায়ের কাপ নিয়ে নিজের ঘরে যাও।’
ঘাড় বাকিয়ে সায় জানিয়ে চায়ের কাপ হাতে আদ্রিকা সত্যিই নিজের কক্ষে চলে গেলো।
চলবে…
#অক্ষরময়ী