#পরিণয়ে_নোলককন্যা (কপি নিষেধ)
|৫৬|
জগতের সবচেয়ে ঘৃণিত কাজটিও মানুষ বিনা দ্বিধায় করে ফেলতে পারে শুধুমাত্র রাগের বশবর্তী হয়ে। রাগ অনুভূতিটি কতোটা ভয়াবহ, আদ্রিকার থেকে বেশি কেইবা জানে! জন্মলগ্ন থেকেই সাদাসিধা বাবাকে ক্রোধে উন্মাদ হতে দেখেছে সে৷ বাবা যখন রেগে যায় তখন ন্যায় অন্যায় বোধ ভুলে অসুর হয়ে উঠে৷ মে রে কে টে, ভেঙেচূড়ে সব একাকার করে ফেলে। স্ত্রী, সন্তান, প্রতিবেশী কিংবা বড়-ছোট কোনো বাছবিচার থাকে না৷ রাগ মানুষকে এমনি জ্ঞানহীন করে তোলে।
মেঝেতে বসে সোফায় মাথা এলিয়ে দিয়ে চোখ বুজে রয়েছে আদ্রিকা। মাথায় ঘুরছে নানান দুশ্চিন্তা। অথচ সমাধানের পথ জানা নেই৷ কারো সাহায্য চাইবে সেই উপায়ও নেই৷
একবার মনে হলো, রুমিকে কল দেওয়া যায়৷ কিন্তু রুমির কাছে পরখের খোঁজ চাইলে কিংবা উদ্বিগ্নতা জাহির করলে রুমি নিশ্চয়ই কারণ জানতে চাইবে। আদ্রিকা তাকে কি জবাব দিবে?
কেনো আদ্রিকা এতো দুশ্চিন্তা করছে সেটা রুমিকে কীভাবে বুঝাবে? বিস্ময়ের এক্সিডেন্টে আদ্রিকার আগ্রহ এবং ভয়ের কারণ কি?
“বিস্ময় আমার প্রাক্তন। সে আজকে আমাদের বাড়িতে এসেছিল। আমার সুখ সহ্য করতে না পেরে অপমান করার চেষ্টা করেছে৷ আপদটাকে তাড়াতাড়ি বিদায় করতে তার আবদার মোতাবেক আমি এক চা বানাতে গিয়েছিলাম, তখনি পরখ এলো। আমাকে চা বানাতে দেখে পরখ গিয়েছে ক্ষেপে। পরবর্তী ঘটনা আমার জানা নেই। তবে অনুমান করতে পারি৷ দুই বন্ধুর বাকবিতন্ডা যে কতোদূর গড়িয়েছিল, তা পরখের রাগের তীব্রতা দেখে আপনিও অনুমান করতে পারতেন। আমি আগে কখনো পরখকে এতোটা রেগে যেতে দেখিনি, রুমি৷ এজন্যই আমার ভয় করছে৷
বিস্ময়কে আমি কিছুটা হলেও চিনি৷ সে খানিকটা বেপরোয়া হলেও ভীষণ আত্মসচেতন। বিস্ময়ের ড্রাইভিং স্কিল নিয়ে নতুন করে কী আর বলব! সে আপনার বন্ধু হয়৷ আপনিও নিশ্চয়ই জানেন, ড্রাইভিং-এ সে কী পরিমাণ দক্ষ? এমন দক্ষ চালক এভাবে এক্সিডেন্ট করে কী করে!
আমার সন্দেহ হচ্ছে, পরখ রাগের মাথায় ভুল কোনো পদক্ষেপ নিয়ে ফেলল না তো। ক্রোধে উন্মাদ হয়ে পরখ ঘরে ছেড়েছে। এখনো ফিরে আসেনি৷ আমার ভীষণ চিন্তা হচ্ছে, রুমি৷ আপনি কি একবার খোঁজ নিয়ে দেখবেন?”
নিজের মনে কথা গুছাচ্ছে আদ্রিকা। সে কী কী বলবে তা না হয় চট করে সাজিয়ে ফেলা গেলো কিন্তু বিপরীতে রুমির প্রতিক্রিয়া কেমন হবে? তারও তো কিছু প্রশ্ন থাকতে পারে। সেসবের জবাব কীভাবে দিবে আদ্রিকা?
নিজ অতীত প্রসঙ্গে বরাবরই বিমূঢ় হয়ে পড়ে আদ্রিকা। পরখের সম্মুখে এই অপারগতা লজ্জাজনক মনে হয় না। কিন্তু রুমির সম্মুখে ভীষণ অস্বস্তিতে পড়তে হবে৷
আদ্রিকা উঠে দাঁড়ালো। মাথা ঝিমঝিম করছে। বিশাল জানালা দিকে তাকিয়ে দেখল, রাতের অন্ধকার মিলিয়ে চারদিকে ধোয়াশা৷ ঘোলাটে আলো জানান দিচ্ছে ভোর হতে বেশি বাকি নেই।
রাতে কিছু খাওয়া হয়নি৷ এখনো ক্ষুধা লাগছে না৷ পেট ভারি হয়ে আছে। গ্যাস্ট্রিক হয়েছে বোধহয়। তবুও আদ্রিকা এক কাপ দুধ চা বানালো।
খোলা ছাদে হাঁটতে হাঁটতে চায়ে কাপে চুমুক দিল।
ঘরের ভেতর তীব্র স্বরে মোবাইলের রিংটোন বাজছে। আদ্রিকা ছুটে গেলো সেদিকে৷ পরখের নয় আদ্রিকার মোবাইল বাজছে৷
বিস্ময়কর বিষয় হলো, এতো সকালে রুমি কল করেছে।
তবে কী ভয়াল কোনো বার্তা ঠিকানা পেয়েই গেলো! শীতল একটা স্রোত বেয়ে গেলো আদ্রিকার শিরদাঁড়া বরাবর। সৃষ্টিকর্তাকে স্মরণ করে আদ্রিকা কলটি রিসিভ করল৷
হাসপাতালে টানা বারান্দার এককোনায় দাঁড়িয়ে আছে রুমি। তার কপালে দুটো সমান্তরাল ভাঁজ স্পষ্ট। অদূরে ডিউটিরত চিকিৎসকের উপর ক্ষোভ ঝাড়ছেন বারাশাত খন্দকার। গতকাল মধ্যরাতে তিনি ঢাকা হতে ভূবনভোলায় পৌঁছেছেন। ভদ্রলোক তখন থেকেই অনবরত চিৎকার চেঁচামেচি করে যাচ্ছেন। তাই নিয়ে উনাকে অবশ্য দোষ দেওয়া যায় না। একমাত্র ছেলের এমন দূরাবস্থায় বাবা হিসেবে উনার অস্থিরতা মোটেও অতিরঞ্জিত নয়৷ বরং তিনি যথেষ্ট শক্ত মানসিকতার মানুষ বলেই এখনো ডাক্তার, নার্সদের সাথে শলাপরামর্শ করে যাচ্ছেন।
তবে এরই মধ্যে থানা, পুলিশ একাকার করে ফেলার ব্যাপারটি কিছুতেই ভালো চোখে দেখতে পারছে না রুমি৷ বারাশাত খন্দকারের অতিরিক্ত সন্দেহবাতিক আচরণে বিরক্ত হয়ে রুমি একপাশে দাঁড়িয়ে আদ্রিকাকে কল দিলো।
এমন কাকডাকা ভোরে কল দেওয়া ঠিক হচ্ছে না, জেনেও রুমিকে কাজটি করতে হচ্ছে। পরখের সাথে কোনোভাবেই যোগাযোগ করা সম্ভব হচ্ছে না। অথচ বিপদের তীর তার দিকেই ছুটছে৷
আদ্রিকা কল রিসিভ করা মাত্রই নিচু স্বরে রুমি বলল,
‘পরখ কোথায়, আদ্রিকা?’
আদ্রিকা নিজেই জানে না, পরখ কোথায়। সে ভেবেছিল রুমির কাছে খোঁজ খবর জানতে চাইবে। কিন্তু এখন রুমি নিজেই খোঁজ করছে দেখে আদ্রিকার দুশ্চিন্তা আরও বাড়তে লাগল। শুকনো ঢোক গিলে আদ্রিকা বলল,
‘কোথায় আছে জানি না৷ রাতে বাড়ি ফিরেনি।’
রাতভর বাইরে অবস্থানের স্বভাব কখনোই ছিল না পরখের। আজ হঠাৎ তার এমন আচরণে রুমি নিজেও হকচকিয়ে গেল৷ কপালে চিন্তার ভাঁজ আরও গাঢ় করে বলল,
‘কোথায় গিয়েছে জানো?’
‘নাহ। বলে যায়নি।’
‘ভালোই ঝামেলা হলো দেখছি। এই খবর বিস্ময়ের বাবার কানে গেলে আর রক্ষে নেই।’
আদ্রিকা আঁতকে উঠে বলল,
‘বিস্ময়ের বাবা এসেছে?’
‘হ্যাঁ। এসেছে থেকে সবাইকে দৌড়ের উপরে রেখেছে। ডাক্তাররা পর্যন্ত উনার আচরণে বিরক্ত। মানছি ছেলের কারণে কষ্ট পাচ্ছেন৷ আমরাও পাচ্ছি৷ তাই বলে নিজের ছেলের দোষ অন্যের কাঁধে চাপানোর কী আছে, বুঝি না। থানায় গিয়ে কেস পর্যন্ত করে এসেছেন।’
‘কীসের কেস?’
‘এটেমড টু মা/র্ডা/র কেস।’
‘বিস্ময়ের না এক্সিডেন্ট হয়েছে?’
‘সমস্যা তো এখানেই। উনি কিছুতেই মানছেন না, এটা একটা দূর্ঘটনা। কেউ নাকি উনার ছেলেকে মে রে ফেলার পরিকল্পনা করেছে। বিস্ময় কিছুতেই এক্সিডেন্ট করতে পারে না। কী আশ্চর্য কথাবার্তা!’
আদ্রিকা নিজেও সে কথা জানে এবং বিশ্বাস করে। তাই আনমনে বলে ফেলল,
‘তা অবশ্য ঠিক। বিস্ময়ের ড্রাইভিং স্কিল খুব ভালো।’
‘আরে ধুর! বিপদ কী বলে কয়ে আসে? ভালো ড্রাইভিং জানলেই সে কখনো এক্সিডেন্ট করবে না, এই নিশ্চয়তা কীভাবে দেওয়া সম্ভব? পুলিশগুলোও বড্ড ঝামেলাবাজ৷ বিস্ময়ের বাবার আগেপিছে মাছির মতো ভনভন করতেছে। এইটুকু সময়ের মধ্যে এক্সিডেন্টের নাড়ীনক্ষত্র পর্যন্ত বের করে ফেলেছে৷ এদিকে পরখটাও এই মুহূর্তে গায়েব হয়ে গেলো।’
‘এসবে পরখকে কী দরকার?’
‘ওকেই এখন সবার দরকার। যে জন্য তোমাকে কল দিলাম সেটা শুনো। বিস্ময় কি গতকাল তোমাদের বাড়িতে গিয়েছিল?’
বিস্ময় এসেছিল সে খবর রুমি কী করে জানল? তবে কী বিস্ময় সবাইকে জানিয়ে দিয়েছে আদ্রিকার কথা? ভয়ে কেঁপে উঠল আদ্রিকা।
‘আমাদের বাড়িতে!’
‘আরেহ পরখের সাথে দেখা করতে গিয়েছিল না, কালকে?’
‘ওহ হ্যাঁ। এসেছিল তো। পরখের সাথে দেখা করে চলে গেলো। কেনো?’
‘পুলিশ সেই খবর পেয়েছে। এক্সিডেন্টের আগে বিস্ময়ের মোবাইলের লোকেশন তোমাদের বাড়ি দেখাচ্ছে৷ সেটা জানার পর থেকে বিস্ময়ের বাবা পরখকে সন্দেহ করতেছে।’
‘পরখকে সন্দেহ করতেছে মানে? পরখ কি করেছে?’
‘ওখানেই বিস্ময়ের সাথে পরখ কিছু একটা করেছে, যার জন্য বিস্ময়ের এক্সিডেন্ট হয়েছে৷ না হলে সুস্থ স্বাভাবিক ছেলেটা সার্ভিসিং করা গাড়ি নিয়ে ভূবনভোলায় এলো। হুট করে এক্সিডেন্ট করে কী করে? উনার যতোসব আজগুবি সন্দেহ! উপর মহলের চাপে পুলিশও বিস্ময়ের বাবার কথায় উঠছে বসছে।’
‘ওরা দুজনে কতো ভালো বন্ধু ছিল! পরখ কেনো বিস্ময়ের ক্ষতি করতে যাবে?’
‘সেটা এখন উনাকে কে বুঝায়? আমার সমস্ত যুক্তিতর্ক উনার কাছে নস্যি।’
‘এখন কী হবে, ভাইয়া? পুলিশ কি পরখকে নিয়ে যাবে?’
‘বিস্ময়ের বাবার যোগাযোগ অনেক হাই লেভেল পর্যন্ত আছে। পুলিশ কেসটা সিরিয়াসলি হ্যান্ডেল করতেছে। আমি বুঝতেছি না কী করবো। পরখের সাথে যোগাযোগ করতে পারলে ভালো হতো। গতকাল বিস্ময়ের সাথে কেমন আলাপ আলোচনা হয়েছে সেটা ও ভালো বলতে পারবে৷ বিস্তারিত শুনলে পুলিশের সন্দেহ দূর হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু পরখকে যদি খুঁজে পাওয়া না যায়, তবে পুলিশের সন্দেহ আরও গাঢ় হবে। বুঝতেই পারছো, সেক্ষেত্রে ঘটনা কতোদূর গড়াতে পারে।’
রুমির কথা শুনে আদ্রিকার চিন্তা বাড়ল বই কমলো না। পুলিশ যদি জানে বিস্ময় ও পরখের মধ্যে কী আলোচনা হয়েছে তবে সন্দেহ দূর হওয়া তো দূরের কথা, উল্টো ফেঁসে যাবে পরখ। দুই বন্ধুর মধ্যে বাকবিতন্ডা থেকে হাতাহাতি পর্যন্ত হয়ে গেছে। তা জানার পর বিস্ময়ের বাবা নিশ্চয়ই আর কোনো প্রমাণের অপেক্ষায় থাকবেন না। নিজের যোগাযোগ কাজে লাগিয়ে জেলে পুরে দিবেন পরখকে। ভাবতেই আদ্রিকার গা শিউরে উঠল। এ কোন ঝড় এলো আদ্রিকা-পরখের সংসারে!
******
দরজার পাশের আম গাছটার নিচে আয়েশ করে ঘুমাচ্ছে দুটো কুকুর। পথের ধার থেকে একটি পাথর কুড়িয়ে নিয়ে কুকুর দুটির দিকে ঢিল ছুড়লো পরখ৷ আচমকা আক্রমণে তড়াৎ করে লাফিয়ে উঠল ওরা। ঘুমঘোর চোখে পরখের দিকে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ৷ সকালবেলা এ কোন নিষ্ঠুর ব্যক্তির সাথে দেখা হলো! এভাবে কেউ নির্দয়ের মতো কারো ঘুমের ব্যাঘাত ঘটায়! বিস্মিত কুকুর দুটি আরও কিছুক্ষণ নীরবে পর্যবেক্ষণ করে ক্রুদ্ধ মনে হেলেদুলে স্থান ত্যাগ করলো।
ক্লান্ত শরীরটিকে আস্তেধীরে সিঁড়ি বেয়ে ছাদ পর্যন্ত নিয়ে এলো পরখ। স্লাইডিং ডোরটি অর্ধেক খোলা৷ সেটুকু দিয়েই ভেতরে প্রবেশ করলো সে। বসার ঘরের সোফার সামনে মেঝেতে হাঁটু ভেঙে বসে আছে আদ্রিকা৷ এতোক্ষণ হাঁটুতে মাথা এলিয়ে দিয়েছিল। পরখের আগমণে মাথা তুলে তাকালো।
পরখ স্পষ্ট দেখলো আদ্রিকার ফোলা চোখ, কান্নাভেজা মুখ। কাঁদছে কেনো মেয়েটা?
ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে সামনে দাঁড়িয়ে ক্লান্ত স্বরে জানতে চাইল,
‘এখানে এভাবে বসে আছো কেনো?’
আদ্রিকা সেভাবেই বসে থেকে মুখ উঁচু করে পরখের চোখে চোখ রেখে বলল,
‘বিস্ময় এক্সিডেন্ট করেছে৷ আপনি জানেন?’
পরখ বোধহয় একটু চমকালো। নাকি আদ্রিকার চোখের ভুল? সেকেন্ড পেরোনোর আগেই নিজেকে আড়াল করে ফেলল পরখ৷ থমথমে মুখে খানিকটা তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে আদ্রিকার পাশে নিজেও হাঁটু মুড়ে বসে বলল,
‘ওহ আচ্ছা৷ এজন্য এখানে বসে কান্নাকাটি করছো! বিস্ময়ের জন্য চিন্তা হচ্ছে, কষ্ট হচ্ছে? দেখতে যাবে ওকে? রাতের অন্ধকারেই হাসপাতালে ছুটে না গিয়ে এখনো এখানে বসে আছো দেখে, আমি সত্যি অবাক হচ্ছি। বিস্ময়ের বিপদে তোমার তো সবার আগে ছুটে যাওয়ার কথা।’
এমন ধারা কথা শুনে আদ্রিকা এলোপাতাড়ি পরখের বুকে কিল ঘুসি মেরে হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করল। এই মানুষটার চিন্তায় সারাটা রাত কতোটা অস্থিরতায় কেটেছে, তা সে কীভাবে বুঝাবে? নিজের কষ্টগুলো বুকে চেপে পরখ কোথায় কোন সুনশান পথে একাকী ঘুরে বেড়াচ্ছে ভেবেই আদ্রিকার দু চোখের ঘুম উড়ে গিয়েছিল। আত্মকেন্দ্রিক পরখ যে শত কষ্টেও কারো সামনে ব্যথা জাহির করবে না, একটুখানি আশ্রয় চাইবে না – সেটা এই কয়েকদিনে আদ্রিকা বুঝে গেছে। তাই তো পরখের জন্য দুশ্চিন্তাটা এবার একটু বেশিই হচ্ছিল।
হৃদপিণ্ড বরাবর একটি আঘাতে ব্যথাটা একটু বেশিই পেল পরখ। সামান্য কুঁকড়ে গিয়ে বুকে হাত রাখল। তা দেখে থেমে গেল আদ্রিকা। শান্ত হয়ে বসে হাঁপাতে হাঁপাতে নালিশ করল,
‘রাগ করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার বাজে অভ্যাসটা কবে থেকে শুরু করেছেন? ফোনটা পর্যন্ত বাড়িতে ফেলে গেছেন৷ সারাটা রাত কী পরিমাণ দুশ্চিন্তায় কাটিয়েছি, কোনো ধারণা আছে আপনার? কীসের শাস্তি দিচ্ছেন আমাকে? বিস্ময় হুট করে বাড়িতে চলে আসবে, আমি জানতাম? নাকি আমি ডেকেছি ওকে? আমার দোষটা কোথায়? কোন অন্যায় অপরাধ করেছি আমি?’
পরখ অভিমানী চোখে আদ্রিকার দিকে একপলক তাকিয়ে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে বলল,
‘ডেকে না আনলেও মেহমানের খাতিরযত্নের কমতি তো তুমি রাখোনি৷ ভালোবেসে চা বানিয়ে খাওয়ানো হচ্ছিল।’
‘ভালোবেসে চা বানাচ্ছিলাম আমি? আপনার বন্ধু কী পরিমাণ ছ্যাচড়া, আপনি জানেন না? আমি ওকে বেরিয়ে যেতে বললে, ও চলে যেতো? কথার প্রসঙ্গে কথা বলেই যাচ্ছিলো। এজন্য চা খাইয়ে তাড়াতাড়ি বিদায় করতে চাচ্ছিলাম। আপনাকেও তো কল দিচ্ছিলাম। রিসিভ করেছিলেন আপনি? খুব ব্যস্ততা দেখাচ্ছিলেন তখন। এখন সব দোষ আমার, তাই না?’
আজকাল আদ্রিকার সাথে তর্কে হেরে যায় পরখ। একরত্তি ছিঁচকাঁদুনে মেয়েটা এতো কথা কবে শিখলো কে জানে! কিছু বলতে গেলেই ফটরফটর করে কথা বলে ঝগড়া বাঁধিয়ে দেয়। পরখ বিরক্ত হয়ে বলল,
‘এখন আমার সামনে খুব মুখ চলছে, আর তখন মুখে কুলুপ এঁটে বসেছিলে।’
আদ্রিকার মুখমণ্ডল গম্ভীর হলো। আশেপাশে আনমনে তাকিয়ে উদাস গলায় বলল,
‘ওই মানুষটার সাথে একলা থাকা আমার জন্য কতোটা অস্বস্তির, কতোটা ভয়ের আপনাকে বলে বুঝাতে পারবো না। ছেলেদের জন্য প্রাক্তন শব্দটা যতোটা সহজ, মেয়েদের জন্য ততোটা নয়৷ মেয়েদের কাছে হাজার টন পাথরের চেয়েও ভারী লাগে নিজের অতীত৷ এই অনুভূতির মাঝে কোনো দূর্বলতা নেই। আছে সীমাহীন অস্বস্তি, লজ্জা, ধিক্কার, আত্মগ্লানি। আপনারা চাইলেও আমাদের এই অনুভূতিটা কখনো বুঝতে পারবেন না।’
আদ্রিকা ঘাড় ফিরিয়ে পরখের দিকে চাইলো৷ দেখল পরখ ওর দিকেই চেয়ে আছে। সুগভীর চোখ দুটো আদ্রিকার চোখে কিছু একটা খুঁজতে চাইছে। হয়তো শব্দের সত্যতা যাচাই করছে৷ আদ্রিকা দৃষ্টি লুকালো না। পরখ পড়ে নিক আদ্রিকার মনের ভেতরটা৷ সেখানে কোনো ছল নেই, চটুলতা নেই৷ স্বচ্ছতা-ই আদ্রিকার শক্তি।
পরখের দিকে চেয়ে খানিকটা অসন্তোষ প্রকাশ করে আদ্রিকা বলল,
‘একা একা ভয় করছিল৷ সবকিছু তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছিলো। অথচ ওই মানুষটাকে আমার কতো কতো অপমান করার কথা ছিল! কতো প্রশ্নের উত্তর জানার ছিল! অন্তত ছলনার কারণটা জানতে চাওয়ার অধিকার ছিল আমার৷ আর কিছু না হোক, দুটো জুতার বারি মারতে পারলে শান্তি লাগত৷ আপনি আমাকে তখন ঘর থেকে বেরই হতে দিলেন না৷ ঘরে আটকা পড়ে আমার যে কী আফসোস হচ্ছিল!’
আদ্রিকার অভিযোগের বিপরীতে পরখ দীর্ঘশ্বাস ফেলে সোফায় মাথা এলিয়ে দিয়ে বলল,
‘নিজের মান সম্মান খুইয়ে তর্কে জিতে যাওয়ার থেকে সম্মানের সাথে নীরবে প্রস্থান করা বুদ্ধিমানের কাজ। নোংরা ঘাটতে গেলে তার ছিটেফোঁটা তোমার গায়েও এসে পড়বে। দুর্গন্ধ তোমার গা থেকেও ছড়াবে।’
হাঁটুতে মাথা এলিয়ে নীরবে পরখের মুখপানে চেয়ে কথাগুলোর মর্মার্থ বুঝার চেষ্টা করল আদ্রিকা। শব্দের মাঝে হারিয়ে যেতে গিয়েও আদ্রিকা হারালো পরখের ক্লান্ত চোখে, শুকনো ঠোঁটে, ফ্যাকাশে মুখমন্ডলে।
ভোরের পাখির কিচিরমিচির শোনা যাচ্ছে৷ কা কা শব্দে একঝাক উড়ে চলে গেলো পূর্ব প্রান্ত থেকে পশ্চিমের দিকে। আদ্রিকা সেদিকে তাকানোর আগেই ভোঁ ভোঁ শব্দে কেঁপে উঠল পরখের মোবাইল। পরখ মোবাইলের খোঁজ করার আগেই টেবিল থেকে সেটি তুলে নিল আদ্রিকা। স্ক্রীনে রুমির নাম দেখে চিন্তিত নয়নে তাকাল পরখের দিকে৷
‘রুমি ভাইয়া অনেকবার কল করেছিল। বিস্ময়ের এক্সিডেন্টের ব্যাপারে পুলিশ নাকি আপনাকে সন্দেহ করতেছে।’
আদ্রিকার কথায় ভ্রু কুঞ্চিত হলো পরখের। যা অক্ষুন্ন রেখে রুমির কল রিসিভ করলো সে। উদ্বিগ্ন রুমির কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে শুনে কল কেটে দিল। আদ্রিকা তখনো আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে আছে৷ পরখ জানে, এ আগ্রহ বিস্ময়ের কারণে নয়৷ চিন্তার পুরোটা জুড়ে রয়েছে পরখের সালামতির দোয়া। বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় পরখের। তবুও সে জানে, এটাই সত্যি।
অনিচ্ছা সত্ত্বেও ছাইরঙ্গা মুখে পরখ জানাল,
‘বিস্ময়ের বাবা আমার নামে থানায় আরেকটা ডায়েরি করতে যাচ্ছেন৷’
আদ্রিকা আঁতকে উঠে বলল,
‘এক্সিডেন্টে আপনার হাত রয়েছে, সেটা উনি নিশ্চিত হলেন কী করে? কি প্রমাণ আছে উনার কাছে?’
‘প্রমাণের দরকার নেই। উনারা যা বলে তাই আইন। যা চায় সেটাই নিয়ম।’
‘ক্ষমতা আছে বলে, যা খুশি তাই করবে?’
‘করতেছে তো।’
প্রশ্নটা এতোক্ষণ ধরে আদ্রিকাকে কুড়ে কুড়ে খেলেও আদ্রিকা তা এড়িয়ে গিয়েছে৷ কিন্তু এই মুহূর্তে আর এড়ানো গেলো না। বুকের ধড়াস ধড়াস শব্দটাকে আরেকটু বাড়িয়ে দিয়ে আদ্রিকা জানতে চাইল,
‘পুলিশ কেস হলে বিদেশে যেতে আপনার সমস্যা হবে না?’
পরখ আদ্রিকার দিকে তাকিয়ে ঠোঁট বাঁকিয়ে বিদ্রুপের হাসি হাসল। খুব তাচ্ছিল্যের সাথে বলল,
‘আর বিদেশে যাওয়া! জেলের ঘানি টেনে আসি গিয়ে।’
নির্বাক আদ্রিকাকে পেছনে ফেলে পরখ উঠে দাঁড়ালো। ম্লান মুখে ক্লান্ত শরীরটি ঘর ত্যাগ করে চলে গেল বাইরে। হতাশ আদ্রিকা স্তম্ভিত বসে রইল মেঝের উপর।
যেকোনো দৈববলে পরখের বিদেশ যাত্রা আটকে যাক, কখনো চায়নি আদ্রিকা। বরং নিজের স্বপ্ন, নিজের সংসার-সহ সম্পূর্ণ নিজেকে বিলীন করে দিয়ে সে চেয়েছিল, পরখের স্বপ্ন পূরণ হোক। অন্তত কেউ একজন স্বপ্ন পূরণের স্বাদ পাক।
তবে কার নজর লাগল পরখের স্বপ্ন পূরণের অধ্যায়ে? এ শুভ যাত্রায় কে বাঁধা হয়ে দাঁড়ালো? আদ্রিকার দীর্ঘশ্বাস নয় তো?
চলবে…
#অক্ষরময়ী