পরিণয়ে নোলককন্যা পর্ব-৫৭

0
86

#পরিণয়ে_নোলককন্যা (কপি নিষেধ)

|৫৭|

পুলিশস্টেশনের বাইরের বারান্দায় পায়েচারি করছে রুমি৷ ভেতরে ওসির কক্ষে অবস্থান করছে পরখ। ওখানে কী নিয়ে আলোচনা চলছে রুমি জানে না৷ পরখের ধারের কাছেও কাউকে ঘেষতে দিচ্ছে না ওরা৷ হাসপাতালে বিস্ময়ের অবস্থাও খুব একটা ভালো নয়। বিস্ময়ের অবস্থা যত খারাপ হচ্ছে, বারাশাত খন্দকারের প্রকোপ ততই বাড়ছে৷

আকাশের দিকে তাকিয়ে সূর্যের তেজিয়ান রূপ দেখল রুমি। ধীরে ধীরে তাপ বাড়ছে আরও। ওরা যখন পুলিশস্টেশনে এসেছিল তখন সূর্যের আলো ফুটেনি। অথচ এখন সূর্যের দাপটে চোখ তুলে তাকানো দায়। ক’টা বাজতে চলল? দশটা-সাড়ে দশটা হবে নিশ্চয়ই।

পকেটের ভেতরে থাকা ফোনটির শব্দে ধ্যানমগ্ন রুমির ঘোর কাটলো। পকেট হাতড়ে ফোন বের করে দেখল আদ্রিকা কল করেছে।

কক্ষের এককোনায় কাঠের টেবিলের উপর একগাদা কাগজ নিয়ে বিরস মুখে বসে আছে একজন যুবক। উনি ভূবনভোলা থানার সাব ইন্সপেক্টর। উনার মুখে সারাক্ষণ আঁধার ঘিরে থাকে।
রুমি ত্রস্ত পায়ে সাব ইন্সপেক্টরের সামনে দাঁড়িয়ে বিনীতভাবে বলল,

‘আমি কি আমার বন্ধুর সাথে একটিবার দেখা করতে পারি?’

সাব ইন্সপেক্টর গরম চোখে কিছুক্ষণ রুমির দিকে নিষ্পলক চেয়ে থেকে স্পষ্ট করে বললেন,

‘নাহ।’

রুমি থমথমে খেয়ে গেল। হাতের ধরে রাখা ফোনটি দেখিয়ে বলল,

‘পরখের স্ত্রী কল দিয়েছে। ভীষণ দুশ্চিন্তা করছে। অনেকক্ষণ হলো পরখের কোনো খবর পাচ্ছে না বেচারি।’

নারী বিষয়ক আলোচনায় সাব ইন্সপেক্টরকে খানিক আগ্রহী দেখাল। স্ত্রী দুশ্চিন্তা করছে ব্যাপারটা বোধহয় উনাকে আহত করেছে। কী যেন ভেবে হুট করে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন,

‘স্যারের সাথে কথা বলে দেখছি।’

এতো তাড়াতাড়ি রাজি হয়ে যাবে, আশা করেনি রুমি। দ্রুত পা চালিয়ে চলল সাব ইন্সপেক্টর এর পিছু পিছু।

ওসির সামনের চেয়ারে মূর্তিমান বসে আছে পরখ এবং বারাশাত খন্দকার। বারংবার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বিস্ময়ের সাথে শেষবার সাক্ষাৎকারের কথা জানতে চাইছেন ওসি সাহেব। প্রতিবারই একই ঘটনার বিবরণ দিতে দিতে পরখ ক্লান্ত।

অনেকদিন পর দেশে ফিরে পুরনো বন্ধুর সাথে দেখা করতে এসেছিল বিস্ময়। কিন্তু পরখ বাড়িতে ছিল না। বাড়ির দরজা খুলে দেয় আদ্রিকা। স্বামীর বন্ধুকে সসম্মানে ঘরে স্থান দিয়ে আপ্যায়নের ব্যবস্থা করতে রান্নাঘরে যায়৷ তখনি ফিরে আসে পরখ। নিজে হাতে চা বানিয়ে খাওয়ায় বিস্ময়কে। তারপর আরও কিছুক্ষণ আড্ডা চলে। বিস্ময়ের নতুন কাজ, মস্ত বড় অফিস, সুইজারল্যান্ডের মতো স্বপ্নীল জায়গা – এতো এতো গল্পের মাঝে সময় বয়ে যায়। রাত গড়াতেই বিস্ময় তার কার নিয়ে ফিরে যায়।

টেবিলের উপরে রাখা মেডিকেল রিপোর্টে চোখ বুলিয়ে ওসি সাহেব গম্ভীরমুখে বললেন,

‘ডাক্তার বলছেন, এক্সিডেন্টের আগে বিস্ময়ের শরীরে এলার্জিক রিয়েকশন দেখা গিয়েছিল। সে ব্যাপারে আপনার কি মন্তব্য?’

এলার্জির বিষয়টি এতো দ্রুত সামনে এসে যাবে, পরখ ভাবেনি। তবুও সে ঘাবড়ালো না। মুখভঙ্গি স্বাভাবিক রেখে জবাব দিল,

‘এ ব্যাপারে আমার কী মতামত থাকতে পারে!’

বারাশাত খন্দকার উত্তেজিত হয়ে বললেন,

‘ও নিশ্চয়ই আমার ছেলে উল্টোপাল্টা কিছু খাইয়েছে। না হলে আমার সুস্থ স্বাভাবিক ছেলের হঠাৎ এলার্জি দেখা দিল কেনো?’

এখানে আসার পর থেকে বারাশাত খন্দকারের অহেতুক উত্তেজনার রোষে পড়তে পড়তে পরখ এখন অনেকটাই অভ্যস্ত৷ ওসি সাহেবকেও তেমন একটা বিচলিত দেখাচ্ছে না। তিনি গাম্ভীর্যতা বজায় রেখে বললেন,

‘হতে পারে আপনার পরিবেশনকৃত খাবার গ্রহণের কারণে বিস্ময়ের দেহে এলার্জি দেখা দিয়েছে।’

পরখ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,

‘ও শুধু এককাপ চা খেয়েছিল।’

‘এতোদিন পর ঘনিষ্ঠ বন্ধু আপনার বাড়িতে এলো, আপনি শুধুমাত্র এক কাপ চা খাওয়ালেন! আর কিছু নয় কেনো?’

‘ডিনার করে যেতে বলেছিলাম। কিন্তু বিস্ময়ের ঠান্ডা লেগে সর্দি ধরেছিল। এজন্য কিছু খেতে চাইল না।’

‘আপনিও জোর করলেন না?’

‘জোর করলেও ও খেতো না। বিস্ময় নিজের মনমর্জি মতো কাজকর্ম করতে পছন্দ করে। অন্যের কথা খুব কমই ভাবে। আমার কথা বিশ্বাস না হলে ওর বাবাকে জিজ্ঞাসা করুন।’

জিজ্ঞাসা করার প্রয়োজন হলো না। ওসি সাহেব বারাশাত খন্দকারের দিকে তাকানো মাত্র তিনি মুখ নিচু করে বসে রইলেন।

ওসি সাহেব ফের পরখের দিকে তাকিয়ে বললেন,

‘আপনার কি মনে হয়, এলার্জির কারণ কী হতে পারে?’

‘সেটা আমার জানা নেই।’

‘আপনারা দুজন এতোদিন একসাথে ছিলেন, অথচ আপনার ফ্ল্যাটম্যাটের কীসে এলার্জি সেটা জানেন না?’

‘জানাটা কি জরুরি? বিস্ময় বেশিরভাগ সময় বাইরে থাকত, বাইরের খাবার খেতো। তাই ওর কোন বিশেষ খাবারে এলার্জি আছে সেটা আমার জানা নেই। আপনি বরং ওর বাবাকেই জিজ্ঞাসা করে দেখুন। ছেলের এলার্জির ব্যাপারে উনি নিশ্চয়ই জানবেন।’

বারবার পরখ তাঁর দিকে তীর ঘুরিয়ে দেওয়ার কারণে প্রচন্ড বিরক্ত হলেন বারাশাত খন্দকার। চোখ রাঙিয়ে পরখের দিকে তাকিয়ে থেকে উত্তর দিলেন,

‘আমার জানামতে বিস্ময়ের তেমন কোনো খাবারে এলার্জি ছিল না।’

পরখ মনে মনে খানিকটা হেসে নিল। কখনো এলার্জি ছিল না বলে ভবিষ্যতেও হতে পারে না, এমনটা নিশ্চয়ই নয়। বারাশাত খন্দকার এবং তাঁর স্ত্রী নিজেদের নিয়ে এতোটাই ব্যস্ত থাকেন যে পাঁচ বছর ধরে বিস্ময়ের দেহে এলার্জি বাস করছে, সেটাও উনারা জানেন না।

অথচ প্রথমদিনেই পরখ বুঝেছিল, তুলসি পাতায় বিস্ময়ের এলার্জি আছে। ব্যাপারটি বিস্ময় নিজেও জানত না।
বিস্ময় যেদিন প্রথম বাসায় এলো, তখন পরখের ঠান্ডা লেগেছিল। জ্বর, সর্দি, কাশিতে নাস্তানাবুদ অবস্থা। পরখ নিজের জন্য আদা, লবঙ্গ, তুলসি, লেবু, মধু দিয়ে চা বানিয়েছিল। এক কাপ বিস্ময়কেও দিয়েছিল। কিন্তু চা পানের আধাঘণ্টা পর বিস্ময়ের সারা গায়ে লাল লাল ছোপ পড়ে গেল। অস্থির বিস্ময়ে দু হাতে সারা গা চুলকে দিশেহারা হয়ে উঠেছিল। সে যাত্রায় এলার্জির ঔষধ খেয়ে নিরাময় হলেও পরখ সেদিনই খুঁজে বের করতে সক্ষম হয়েছিল বিস্ময়ের এলার্জির রহস্য।
যা এখন পরখের হাতিয়ার হিসেবে কাজ করেছে।

ওসি সাহেব বুঝতে পারছেন না উনার কী করা উচিত। তিনি রিপোর্টের পাতা উল্টেপাল্টে দেখতে দেখতে দুজনের উদ্দেশ্যেই বললেন,

‘আমাদের ইনভেস্টিগেশন বলছে, হুট করে এলার্জিক রিয়েকশনের কারণে বিস্ময়ের মনোযোগের বিঘ্ন ঘটে। গা চুলকাতে গিয়ে স্টিয়ারিং থেকে হাত সরিয়ে নিয়েছিল। সেই ফাঁকে গাড়ি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে একদিকে বেঁকে যায়। সামনে থেকে আসা একটি ট্রাকের সাথে সংঘর্ষ থেকে বাঁচতে বিস্ময় তৎক্ষণাৎ হার্ডব্রেক কষেছিল। কিন্তু পেছন থেকে আসা ট্রাকের কথা তার স্মরণে ছিল না। পেছনের ট্রাক ড্রাইভার ব্রেক করার আগেই ট্রাকটি এসে বিস্ময়ের গাড়িতে ধাক্কা দেয়। সামনে পেছনে দুটো ট্রাকের ধাক্কায় মুহূর্তেই চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যায় বিস্ময়ের গাড়ি। বুঝতেই পারছেন এখানে এলার্জিক রিয়েকশনটা কতোটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।’

এমন মর্মান্তিক দূর্ঘটনার বর্ণনা শুনে চোখ ভিজে এলো বারাশাত খন্দকারের। তিনি সিক্ত গলায় তীব্র রোষ নিয়ে বললেন,

‘আপনি ডাক্তারের সাথে কথা বলুন। বিস্ময়কে কি খাওয়ানো হয়েছে সেটা টেস্ট করে বের করতে বলুন। আমার বিশ্বাস, এই ছেলেটিই ইচ্ছাকৃতভাবে বিস্ময়কে এমন কিছু খাইয়েছে যাতে এলার্জিক রিয়েকশন হয়।’

পরখ ঘাড় বাকিয়ে বারাশাত খন্দকারের চোখে চোখ রেখে বলল,

‘আপনি বিস্ময়ের বাবা হয়েও জানেন না, ওর কোন খাবারে এলার্জি আছে। আমি ওর বন্ধু হয়ে কী করে জানবো? না জানলে ঠিক সেই খাবারটি খাইয়ে কী করে এক্সিডেন্ট প্ল্যান করবো?’

বারাশাত খন্দকার থমথমে মুখে ওসির দিকে চাইলেন। ওসি সাহেব কিছু বলার আগেই দরজায় ঠকঠক শব্দ করে উঁকি দিলো সাব ইন্সপেক্টর।

‘স্যার, উনার ওয়াইফ উনার খোঁজ করতেছেন।’

ওসি সাহেব প্রশ্নাত্মক চাহনীতে পরখের দিকে চাইলেন৷ পরখ নিজেও সরু চোখে চেয়ে আছে। আদ্রিকা থানায় এসেছে? কেনো? পরখ ওকে বারণ করেছিল। তবুও এমন একটা ভুল কী করে করল?

ওসি সাহেব অবশ্য এমন খবরে বেশ খুশি হলেন। স্বামী স্ত্রী দুজনে সেসময় বাড়িতে উপস্থিত ছিল। গতরাতে সেখানে কী কী ঘটেছিল পরখের স্ত্রী নিশ্চয়ই দেখেছে।
পরখ যদি সত্যি কিছু করে থাকে এবং এখানে বসে মিথ্যে বয়ান দেয় তাহলে আদ্রিকার সাক্ষ্য ওসি সাহেবের অনেক উপকারে আসবে। তিনি বললেন,

‘ভেতরে নিয়ে এসো।’

পরখ শ্বাসরোধ করে চুপচাপ বসে রইল। নিজের বোকামিতে মেয়েটা আবার বিপদে পড়তে যাচ্ছে। অথচ পরখ পইপই করে বারণ করেছিল।

সকলের আগ্রহভরা অপেক্ষার ইতি টেনে কক্ষে প্রবেশ করল রুমি। তা দেখে ওসি সাহেব ভ্রু কুচকে তাকিয়ে বললেন,

‘উনার স্ত্রী কোথায়?’

সাব ইন্সপেক্টর রুমির হাতের দিকে ইশারা করে বললেন,

‘এখানে স্যার। ফোনকলে।’

ওসি সাহেব দাঁত কটমট করে সাব ইন্সপেক্টরের দিকে তাকাতেই তিনি স্যালুট জানিয়ে বিদায় নিলেন। রুমি ততক্ষণে ফোনটি পরখের সামনে ধরে বলল,

‘আদ্রিকা তোর সাথে কথা বলতে চাইছে।’

পরখ হাত বাড়িয়ে ওসি সাহেবের দিকে তাকাল। ওসি সাহেব টেবিলের উপর দু হাত রেখে বললেন,

‘লাউডস্পিকারে দিন।’

পরখ এই ভয়টিই পাচ্ছিলো। রুমির থেকে এমন কান্ডজ্ঞানহীন আচরণ সে আশা করেনি৷ ছেলেটার বিবেক বুদ্ধি কী লোপ পেয়েছে? নাকি পরখের আশেপাশে সবাই বোকা হয়ে যাচ্ছে?

ফোন হাতে নিয়ে অতি সাবধানে হ্যালো বলল পরখ। ওপাশ থেকে আদ্রিকা উদ্বিগ্ন কণ্ঠ শোনা গেল।

‘পরখ, আপনি ঠিক আছেন?’

‘হ্যাঁ। ঠিক আছি।’

‘পুলিশ কি আপনাকে এরেস্ট করেছে?’

পরখ একবার আড়চোখে কক্ষে উপস্থিত সবার মূর্তিমান চেহারাগুলো দেখে নিল। সবাই পলকহীন চেয়ে আছে পরখের হাতের ফোনটির দিকে৷ এভাবে কথা বলতে খুব অস্বস্তি হচ্ছে পরখের। একবার এখান থেকে বেরিয়ে নিক শুধু, রুমির পশ্চাতে কয়েকটি লাথি বসানো অনিবার্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।

সে থমথমে মুখে জবাব দিল,

‘নাহ।’

‘তাহলে এখনো থানায় কি করছেন?’

‘ওসির রুমে বসে আছি। জিজ্ঞাসাবাদ চলছে।’

‘জিজ্ঞাসাবাদ করতে এতোক্ষণ লাগে! উনারা তো আপনাকে অপরাধীর মতো আটকে রেখেছে। না আছে কোনো প্রমাণ, না আছে এরেস্ট ওয়ারেন্ট। আইনের অপপ্রয়োগ করছে এরা।’

অভিযোগের তোপে চোয়াল শক্ত হয়ে এলো ওসি সাহেবের। তা অনুভব করতে পেরে পরখ সামান্য কেশে গলা পরিষ্কার করে বলল,

‘আমি ঠিক আছি। দ্রুত চলে আসবো।’

‘আমি জানি আপনি আসবে না। ওরা আপনাকে ঠিক ফাঁসিয়ে দিবে৷ টাকার জোরে সব করা যায়। একবার সন্দেহ যখন করেছে ঠিকই প্রমাণ করে ছাড়বে। দরকার হলে ফেক প্রুফ প্লান্ট করবে। তবুও আপনাকে সহজে ছাড়বে না। সবই ক্ষমতার অপব্যবহার।’

‘চুপ করো। তুমি অযথা চিন্তা করছো।’

‘চিন্তা করবো না! ছয় ঘন্টা ধরে আপনাকে থানায় আটকে রেখেছে। এগুলো কেমন আইন? উনাদের ক্ষমতার জোর থাকলে আমাদের নেই? আপনার বাবা কম কীসে! উনারও অনেক লিংকআপ আছে।’

অবস্থান-কাল ভুলে পরখ চোখ মুখ শক্ত করে একটা ধমক দিল।

‘ডোন্ট ইউ ডেয়ার। আমার ব্যাপার আমাকে ম্যানেজ করতে দেও।’

‘বিপদে জন্মদাতার পিতার কাছে সাহায্য চাইতে এতো কীসের ইতস্ততা? এতো ইগো নিয়ে চললে জীবনেও উন্নতি করতে পারবেন না।’

পরখ রেগেমেগে ঝট করে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। সবার থেকে একটু দূরে এগিয়ে গিয়ে উচ্চস্বরে বলল,

‘অযথা জ্ঞান দিতে আসবে না। আমার কী করা উচিত, কী করা উচিত নয় সেই বিষয়ে তোমার মতামত আমি চাইনি।’

স্বামী স্ত্রীর এমন আকস্মিক কলহের মাঝে হতবাক বসে আছে সকলে। সামনে বসে কথা বলার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল অথচ পরখ দরজার পাশে দাঁড়িয়ে কথা বলতে শুরু করেছে, সেটা ওসি সাহেব বেমালুম ভুলে গেলেন।

ফোনের অপাশে আদ্রিকা ক্ষেপে গিয়ে বলল,

‘সবসময় জেদ ধরে বসে থাকলে চলে না৷ উনি আপনার বাবা, ছেলে বিপদে পড়েছে সেটা জানার অধিকার উনার আছে। আমি উনাকে ফোন করে বুঝিয়ে বললে উনি ঠিকই বুঝবেন।’

পরখ চাপা স্বরে বলল,

‘সাথে বিস্ময়ের সাথে আমার রেষারেষির ঘটনাটাও বুঝিয়ে বলো, কেমন? কেঁচো খুড়তে গিয়ে সাপ বেড়িয়ে আসুক। স্টুপিড ওম্যান।’

আদ্রিকাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে কলটি কেটে দিয়ে নিজের চেয়ারে এসে বসল পরখ। রাগে সারামুখ লাল হয়ে আছে৷ তা দেখে ওসি সাহেব, রুমি দুজনেই নীরবতা বজায় রাখলেও বারাশাত খন্দকার চেয়ার হতে দাঁড়িয়ে অস্থিরভাবে প্রস্তাব রাখলেন,

‘এই মেয়েটিকেও থানায় আনার ব্যবস্থা করুন। এরা দুজনে মিলে চক্রান্ত করেছে।’

পরখ নিজেও চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। রাগে ফুলে উঠেছে কপালের শিরা। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

‘আপনার যা ইচ্ছে আপনি তাই করতে পারেন না৷ এসবের মাঝে আমার স্ত্রীকে জড়ানোর চেষ্টা একদমই করবেন না।’

পরখের রক্তচক্ষুর দিকে তাকিয়ে ক্ষণিকের জন্য ঘাবড়ে গেলেন বারাশাত খন্দকার। নিজেকে সামলে ওসি সাহেবের দিকে তাকিয়ে জেদ দেখিয়ে বললেন,

‘ব্রিং দ্যাট গার্ল নাউ।’

রুমি, পরখ দুজনে অবাক হয়ে দৃষ্টি বিনিময় করলো। পরখ কিছু বলার আগে রুমি ওর কাঁধে হাত রেখে ওকে শান্ত থাকার ইশারা করল। নিজে ওসিকে বলল,

‘আদ্রিকার সাথে পরখের রিসেন্ট বিয়ে হয়েছে। বিস্ময়কে ও ঠিকঠাক চিনেও না। গতকাল দেখা হয়েছে মাত্র। এসবের মাঝে ওকে কেনো টানছেন স্যার? এমনিতেই মেয়ে মানুষ। ব্যাপারটা খুব বাজে দেখাবে স্যার।’

ওসি সাহেব পড়েছেন বিপাকে৷ তিনি নিজেও বুঝতে পারছেন পরখকে অযথা হেনস্থা করা হচ্ছে৷ কিন্তু উপর মহলের আদেশের কারণে উনার হাত পা বাঁধা। বিপন্ন মুখে বললেন,

‘উনি যেহেতু সন্দেহ প্রকাশ করছেন। আসুক না। একটু কথাবার্তা বললে কী আর হবে! থানা তেমন একটা খারাপ জায়গা না।’

পরখ রুমি দুজনেই প্রচন্ড মেজাজ খারাপ নিয়ে আরও কিছুক্ষণ বাকবিতন্ডা চালিয়ে গেল। কিন্তু বিশেষ সুবিধা করা গেল না। ওসি সাহেব ইন্টারকমে সাব ইন্সপেক্টরকে ডাক দিয়ে টেলিফোনটি নামিয়ে রাখা মাত্র আবারও বেজে উঠল সেটি।

রিসিভার কানে তুলে ওসি সাহেব সশব্দে, সচকিতভাবে ‘স্যার’ বলে উঠলেন যে কক্ষে উপস্থিত সকলে চমকে উঠল।

সকলকে অবাক করে দিয়ে ওসি সাহেব বিস্ময়ের এক্সিডেন্ট কেসটি কলদাতাকে বর্ণনা করে শুনালেন। সব শুনে কলদাত বললেন,

‘এই কেসে ইবতেহাজ পরখকে এরেস্ট করার কারণ কী? ওর বিরুদ্ধে কি প্রমাণ আছে?’

ওসি সাহেব থমথমে খেয়ে বললেন,

‘এরেস্ট করিনি স্যার। শুধুমাত্র জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আনা হয়েছে।’

‘ভোর রাত থেকে এখন পর্যন্ত একজন ব্যক্তির জিজ্ঞাসা চলছে?’

‘স্যরি স্যার। এক্ষুণি শেষ হয়ে যাবে।’

‘খাবারের এলার্জিক রিয়েকশনকে বেস করে কেউ মা*র্ডার প্ল্যান করছে- বিষয়টি ভীষণ হাস্যকর, ওসি সাহেব। একটি এক্সিডেন্ট কেসকে আপনি যেভাবে জোরপূর্বক মা*র্ডার কেস বানানোর যে প্র‍য়াস করছেন সেটি এই মুহুর্তে বন্ধ করুন। থানায় অন্যান্য যে কেসগুলো অমীমাংসিত পড়ে আছে সেগুলোতে মনোযোগ দিলে বেশি খুশি হবো।’

‘ইয়েস স্যার।’

টেলিফোনের রিসিভার নামিয়ে রেখে পকেট থেকে রুমাল বের করে কপালের ঘাম মুছে ওসি সাহেব পরখের দিকে তাকিয়ে হাসার চেষ্টা করলেন। সে হাসি উনার চোখ ছুঁতে পারল না। তিনি ঠোঁট জোড়া প্রসারিত করে বিগলিত কণ্ঠে বললেন,

‘এমপি মহোদয় কল করেছিলেন। আপনার সাময়িক অসুবিধায় উনি দুঃখ প্রকাশ করেছেন। আপনি কিছু মনে করবেন না। বুঝেনই তো, আমাদের কতো রুলস রেগুলেশনের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। স্যারের সাথে দেখা হলে আমাদের দিকটাও একটু বুঝিয়ে বলবেন।’

ওসির এহেন পরিবর্তনে হতভম্ব পরখ রুমির দিকে চেয়ে দেখলো, তারও একই হাল। পরখ দ্বিধা জড়ানো কণ্ঠে প্রশ্ন করল,

‘আমি এখন যেতে পারি?’

‘নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই।’

বারাশাত খন্দকার প্রচন্ড ক্ষেপে গিয়ে টেবিলে চাপড় মেরে বললেন,

‘কী বলছ ওসি!’

‘খবরটা এমপি স্যারের কানে চল গিয়েছে। মনমর্জি মতো কাজ করার আর উপায় নেই। তবে আপনি চিন্তা করবেন না, স্যার। বিস্ময়ের এক্সিডেন্ট কেসের ইনভেস্টিগেশন যথাযথভাবে হবে।’

ক্রুদ্ধ বারাশাত খন্দকার, অপ্রস্তুত ওসি সাহেবকে পেছনে ফেলে পরখের হাত ধরে দ্রুত থানা ত্যাগ করলো রুমি। থানা জায়গাই অশুভ। এখানে থাকলে কেমন গা ছমছম করে।

পকেটে রুমির ফোনটি অনবরত বেজে চলেছে। স্ক্রীনে আদ্রিকার নামটি দেখে রুমি মুচকি হাসল। কল না ধরে ফোনটি সাইলেন্ট করে রেখে পরখকে বলল,

‘তোর বউ কল দিতে দিতে পাগল হয়ে যাচ্ছে। তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে নিজের চাঁদ মুখখানার দর্শন দে। কাল রাত থেকে তোর চিন্তায় বেচারির অস্থির সময় কাটচ্ছে। এর মাঝেও দেখ, বুদ্ধি খাটিয়ে তোর বাপের সাথে যোগাযোগ করে তোকে ছাড়ানোর ব্যবস্থাও করে ফেলল। দারুণ বুদ্ধিমতি মেয়ে পেয়েছিস, মামা। বানরের গলায় মুক্তার মালা।’

রুমির প্রশংসার বিপরীতে পরখের মুখটা আরও গম্ভীর হলো। মাথায় বাড়ল বোজা। না জানি বাড়িতে আবার কোন ঝামেলা অপেক্ষায় উন্মুখ হয়ে আছে!

চলবে…
#অক্ষরময়ী