পরিণয়ে নোলককন্যা পর্ব-৫৮+৫৯

0
84

#পরিণয়ে_নোলককন্যা (কপি নিষেধ)

|৫৮|

ছাদে শনশন করে বাতাস বইছে। তাল মিলিয়ে বইছে আদ্রিকার শাড়ির আঁচল। আদ্রিকা আঁতিপাঁতি করে তাকিয়ে দূর সড়ক পর্যন্ত দেখার চেষ্টা করছে৷ ওর সরু চোখ দুটো চমকে উঠল প্রেশারকুকারের শব্দে৷ চুলায় ডাল বসিয়ে এসেছে৷ আঁচল সামলে হুড়মুড় করে ছুটে গেলো রান্নাঘরে।

গতকাল থেকে খাওয়া, না খাওয়ার মধ্যে আছে পরখ। আদ্রিকা নিজেও কিছু মুখে দিতে পারেনি৷ পরখের নিশ্চয়ই ক্ষুধা লেগেছে। তাই নাস্তা বাদ দিয়ে ভাতের আয়োজন করছে আদ্রিকা। গরম ভাতের সাথে ঝাল দিয়ে গরুর গোশত ভুনা, বুটের ডাল।

রান্না প্রায় শেষের দিকে। আশেপাশেই বাইকের শব্দ কর্ণগোচর হলো আদ্রিকার। আঁচলে হাত মুছে দ্রুত পায়ে বাইরে এলো আদ্রিকা৷ ছাদ থেকে উঁকি দিয়ে দেখল মাটির রাস্তা দিয়ে এগিয়ে আসছে রুমির বাইক৷ পেছনে বসে আছে পরখ৷ মুখে অকৃত্রিম হাসি নিয়ে একপ্রকার ছুটে সিঁড়ি বেয়ে নামতে লাগল আদ্রিকা৷

বাড়ির সামনের আমগাছের নিচে বাইক থামতেই আদ্রিকা চঞ্চল পায়ে সামনে দাঁড়িয়ে একবার পরখের দিকে তাকালো আরেকবার রুমির দিকে৷ কণ্ঠের অস্থিরতা বহাল রেখে শুধালো,

‘আপনারা ঠিক আছেন?’

পরখের মুখটি থমথমে। সে কোনো জবাব দিল না। রুমি হেসে বলল,

‘যার কথা জানতে চাইছ, সে একদম ঠিক আছে৷’

বিপরীতে আদ্রিকা লাজুক হেসে বলল,

‘আমি আপনার কথাও জিজ্ঞাসা করেছি।’

‘হ্যাঁ, হ্যাঁ। সেসব আমরা বুঝি। এখন ওকে উপরে নিয়ে যাও।’

‘আপনিও আসুন। সকালে নিশ্চয়ই কিছু খাননি। আমার রান্না শেষ। খেয়ে যান।’

‘এখন কিছু খাবো না। বাড়ি গিয়ে লম্বা শাওয়ার নিব। তারপর খেয়েদেয়ে একটা গভীর ঘুম৷ আজকে অফিস টফিস সব বাদ।’

আদ্রিকার আর জোর করল না। এমনিতেই রুমি ওদের জন্য অনেক করেছে। কাল সারারাত ঘুমায়নি। বিস্ময়কে নিয়ে হাসপাতালে ছুটেছিল। এরপর সকালটা পরখের জন্য থানায় কাটিয়ে দিয়েছে। ওর এবার বিশ্রাম নেওয়া দরকার।

ঘরে এসে পরখ দেখল আলমারি থেকে পরখের কাপড় বের করে ওয়াশরুমে রাখা হয়েছে, গতকালের এলোমেলো ঘরদোর পরিপাটি করে গুছানো। রান্নাঘর থেকে খাবার এনে দ্রুত হাতে টেবিল সাজাচ্ছে আদ্রিকা৷

পরখকে থমকে থাকতে দেখে বলল,

‘তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে আসুন। প্রচন্ড ক্ষুধা লেগেছে।’

খাবার টেবিলে বসে প্লেটের খাবার নাড়াচাড়া করছে পরখ। বাড়ি ফিরে সে একটি বাক্য ব্যয় করেনি৷ কেমন যেনো অস্বস্তি হচ্ছে৷ অথচ আদ্রিকা নির্বিকার। এতো সাবলীলভাবে চলাচল করছে যেনো কিছু হয়নি।

‘কী হলো? খাচ্ছেন না কেনো?’

আদ্রিকার ডাকে ধ্যান ভাঙল পরখের। প্লেট থেকে হাত গুটিয়ে নিয়ে গলা পরিষ্কার করে বলল,

‘বাবাকে জানাতে বারণ করেছিলাম। তবুও জানালে কেনো?’

আদ্রিকা অবাক হয়ে বড় বড় চোখে তাকাল। সবিস্ময়ে বলল,

‘আমি কখন জানালাম?’

কপালে ভাঁজ পড়লো পরখের। সরু চোখে চেয়ে বলল,

‘তাহলে কে জানালো?’

‘পিউ মা, বাবা বোধহয় এখনো কিছু জানেন না। জানলে এতোক্ষণে ছুটে আসতো।’

ঠিকই তো। পরখকে পুলিশ থানায় আটকে রেখে জানলে বাবা নিশ্চয়ই ঘরে বসে থাকত না। এতোক্ষণে উকিল, জর্জ ঘাড়ে তুলে নিয়ে আসত। এতো মানসিক চাপে যুক্তিসঙ্গত কোনো চিন্তা মাথায় আসছে না পরখের। সে মুখে দুশ্চিন্তার ছাপ ফেলে বলল,

‘তাহলে ওসিকে এমপি কল করলেন কেনো?’

সূর্যের মতো ঝলমল করে হেসে উঠল আদ্রিকা। পুলকিত হয়ে শুধালো,

‘সত্যি এমপি কল করেছিল! আমি ভাবলাম আমাকে সান্ত্বনা দিতেই উনি বললেন।’

পরখ সরু চোখে আদ্রিকার ঝলমলে হাসি দেখে বলল,

‘উনি কে?’

আদ্রিকা পরখের দিকে সামান্য ঝুকে গলার স্বর খানিক নিচু করে বলল,

‘সেদিনের মেয়রটা আমাকে কার্ড দিয়ে গিয়েছিল না? আমি ভাবলাম একবার সাহায্য চেয়ে দেখি। কল দেওয়ার আগে ভেবেছিলাম চিনবে কিনা! কিন্তু উনি পরিচয় দেওয়া মাত্র চিনে ফেললেন। সত্যি সত্যি এমপির সাথে যোগাযোগ করে আপনাকে ছাড়িয়ে নিবে, এতোটাই আমি আশা করিনি।’

বিস্ময়ে পরখের মুখ হা হয়ে গেছে৷ বোকা আদ্রিকা এমন বিপদের মাঝেও বুদ্ধি খাটিয়ে এতো কিছু করেছে পরখের বিশ্বাস হচ্ছে না৷ সে নিজেই আকস্মিক ঘটনায় হতবুদ্ধি হয়ে পড়েছিল। অথচ আদ্রিকা কী দারুণ ভাবে পরিস্থিতি সামলে নিয়েছে!

পুলকিত চিত্তে খাবার প্লেটে মনোযোগ দিয়ে পরখ বলল,

‘ধীরে ধীরে তোমার বুদ্ধি বাড়ছে৷ চতুর হচ্ছো।’

সামান্য প্রশংসায় ভীষণ খুশি হলো আদ্রিকা। বিস্তৃত হাসি চাপতে নিচের ঠোঁট দাঁতে আটকে দিয়ে মাথা নিচু করে ফেলল।

*****

পুরোটা দুপুর ঘুমিয়ে পরখের যখন ঘুম ভাঙল তখন চারদিকে ক্লান্ত বিকেল। দেরী করে ভাত খাওয়ায় দুপুরে আর খেতে হয়নি। অতিরিক্ত ঘুমানোর ফলে শরীর ম্যাচম্যাচ করছে। আড়মোড়া ভেঙে বিছানা ছাড়ল পরখ। কক্ষের বাইরে এসে দেখলো পুরো বাড়িতে ঝুম নীরবতা। কী মনে করে যেনো আদ্রিকার কক্ষে উঁকি দিল পরখ। কক্ষে আদ্রিকা নেই। কোথায় যেতে পারে? ভ্রু কুঞ্চিত হলো পরখের।
চপল পায়ে খোলা ছাদে এসে চারপাশে তাকাতেই নিচে মূল ফটকের পাশে মাটিতে বসে থাকলে দেখল আদ্রিকাকে।

দ্রুত পায়ে নিচে নেমে এসে আদ্রিকার পেছনে দাঁড়িয়ে পরখ জানতে চাইল,

‘এখানে কি করছ?’

আদ্রিকা ঘাড় ফিরিয়ে চাইল। হাত খোপা থেকে পলায়নকারী দস্যি চুলগুলোকে মাটিমাখা হাতের উল্টোপিঠ দ্বারা কপাল থেকে সরিয়ে দিয়ে বলল,

‘আপনি উঠে গেছেন! ক্ষুধা লেগেছে নিশ্চয়ই। খাবার দিবো?’

বুকে দু হাত ভাঁজ করে ঋজু হয়ে দাঁড়াল পরখ। বলল,

‘এখনি ক্ষুধা লাগেনি। পরে খাবো। তুমি এখানে কি করছ?’

‘গাছ লাগাচ্ছি।’

‘আবার গাছ! কোন ফুল এটা?’

‘বাগানবিলাস।’

‘ছাদে কতোগুলো আছে! আর কতো বাগানবিলাস চাই তোমার?’

‘অনেক, অনেক। চারপাশ ভরে ফেলতে ইচ্ছে করে।’

‘এতো পছন্দ করো?’

‘উহু, পছন্দ নয়। বাগানবিলাসকে আমি স্নেহ করি। আমার শৈশবের অনেকটা সময় কেটেছে বাগানবিলাসের সাথে৷ আমাদের বাড়িতে মস্তবড় একটা বাগানবিলাসের গাছ ছিল। যার একটা ডাল ছিল আমার রুমের জানালার কাছে। হাত বাড়ালেই ফুল ছেড়া যেতো। সেই ফুল ছিড়ে মেঝেতে বিছিয়ে সারাদিন সেগুলো দিয়ে খেলতাম।’

গর্ত খোড়া শেষ। বাগানবিলাসের চারাটি গর্তে রেখে এক হাতে গাছটিকে সোজা করে ধরে অন্য হাতে মাটি চাপা দিচ্ছে আদ্রিকা। পরখ নিজেও এগিয়ে গিয়ে আদ্রিকা পাশে বসে গর্তে মাটি চাপা দিতে দিতে বলল,

‘এতোদিন ছাদে লাগাতে। এখন ছাদ রেখে নিচেও চলে এসেছো!’

‘আমার অনেকদিনের শখ ছিল, বাড়ির মেইন গেটের পাশে একটা বাগানবিলাস থাকবে। গোলাপি ফুলে ঢাকা থাকবে পুরো গেইট।’

‘অন্যের বাড়িতে গাছ লাগিয়ে কী লাভ! আমরা এই বাড়িটা ছেড়ে দিলে বাড়িওয়ালা কি গাছটা রাখবে? কেটেকুটে কোথায় ফেলে দিবে, কে জানে!’

পরখের কথা শুনে হাত থেমে গেল আদ্রিকার। অতি উৎসাহে ভাটা পড়লো হঠাৎ। আঁধারে ঢাকা মুখে ঘাড় ফিরিয়ে নিজের সাজানো গুছানো বাড়িটির দিকে তাকিয়ে বলল,

‘সত্যি কে*টে ফেলবে?’

গাছের গোড়ায় মাটিগুলোতে হাত দ্বারা চাপ প্রয়োগ করে উঠে দাঁড়ালো পরখ। আদ্রিকার দিকে তাকিয়ে মনমরা চেহারাটি দেখে খেয়াল হলো, সে মাত্র কি বলেছে। সত্য সবসময় কটু হয়। তাই তাড়া দিয়ে বলল,

‘গাছ লাগানো শেষ৷ উপরে চলো৷ মাটি মেখে একাকার করে ফেলেছো।’

আদ্রিকা নীরবে সায় জানিয়ে পা চালালো। মাথায় তখনো পরখের কথাটি ঘুরছে৷ ভাড়া বাড়ির এই এক মুশকিল৷ সাজানো গুছানো সংসার একদিন নিজে হাতে এলোমেলো করে চলে যেতে হয়৷ কিছু স্মৃতি মলিন পড়ে থাকে, কিছু স্মৃতি নতুন পদতলে পিষ্ট হয়৷

সিঁড়ি বেয়ে উঠতে উঠতে আদ্রিকা বলল,

‘বাড়ি ছেড়ে দেওয়ার সময় আপনি বাড়িওয়ালাকে অনুরোধ করবেন, বাগানবিলাস গাছটা যেনো না কা*টে৷ ওটা বেশি জায়গা নিবে না। অল্প একটু জায়গাই তো৷’

পরখ ফিরে তাকালো। কিন্তু কিছু বলল না।

আদ্রিকার ফাইনাল এক্সাম দরজায় কড়া নাড়ছে। একটু আধটু করে পড়তে বসছে আদ্রিকা৷ রেস্তোরাঁয় যাওয়ার উপর নিষেধাজ্ঞা এখনও বহাল আছে। তাই একঘেয়েমি দূর করতে মাঝেমধ্যে পরখকে লুকিয়ে বাড়ি থেকে ঘুরে আসে আদ্রিকা৷

আদ্রতা এখন বাবার বাড়িতেই থাকে। মোকাররম ওদের ফিরে যেতে দেয়নি। বিকল্প কাজে চলে গেলে আদ্রতা একাই বাড়িতে থাকে। নীহারের অবস্থাও একইরকম। তাই মোকাররম বলেছে বিকল্প-আদ্রতা এখানেই থাকুক। বিকল্প তার চাকরিটা ছেড়ে দিয়েছে। মোকাররমের সাথে চালের আড়তে পাকাপোক্তভাবে কাজে নিয়োজিত হয়েছে। যা মোকাররমের জন্য সুবিধাজনক। ব্যবসাটা এমনিতেও ওর ভালো লাগে না৷ নার্সারিতে কাজ করে সে শান্তি পায়। তাই আজকাল নিজেকে পুরোপুরি নার্সারির কাজে নিযুক্ত করে ফেলেছে।

পুরোটা বিকেল মা-বোনের সাথে কাটিয়ে সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরেছে আদ্রিকা। পরখ আসার আগেই বাড়িতে ফিরে থিতু হতে হয় তাকে৷ তবে আজ পরখ তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে এসেছে, সেটা আদ্রিকা জানে না।

প্রধান সড়কে রিকশা থেকে নামছিল আদ্রিকা। ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে সবে সরু মাটির রাস্তায় পা ফেলেছে পেছন থেকে পরখের বাইক এসে হাজির।

আদ্রিকার পাশে বাইক দাঁড় করিয়ে হেলমেট খুলে সরু চোখে চেয়ে প্রশ্ন করল,

‘কোথা থেকে ফেরা হচ্ছে?’

হুট করে ধরা পরায় ভয়ে, আতংকে আদ্রিকার মুখখানি চুপসে গেল। শুকনো ঢোক গিলে মাথা নিচু করে জবাব দিল,

‘মায়ের সাথে দেখা করতে গিয়েছিলাম।’

রাগান্বিত পরখ কয়েক মুহূর্ত আদ্রিকার দিকে নীরবে চেয়ে থেকে আদেশ করল,

‘বাইকে উঠো।’

বিনাবাক্যে দ্রুত বাইকে চেপে বসলো আদ্রিকা। বাড়ি পৌঁছে বাইক থেকে নেমে একছুটে উপরে চলে গেল। পরখের পার্কিং এর অপেক্ষা করলো না। তাতেও বিশেষ লাভ কিছু হয়নি।

ঘরে পা রেখে পরখ গেল আদ্রিকার কক্ষে। সামনাসামনি দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করল,

‘আমি তোমাকে বাড়িতে রেখে গিয়েছিলাম, যাতে ঠিকমতো পড়াশোনা করতে পারো। এই তোমার পড়াশোনার নমুনা?’

ধমক খেয়ে কাচুমাচু করতে লাগল আদ্রিকা। হাতের আঙ্গুল মুচড়ে জবাব দিল,

‘বাড়িতে একা থাকতে আমার ভালো লাগে না। বোর লাগে। এভাবে পড়াশোনা হয়!’

আদ্রিকার শুকনো মুখটির দিকে তাকিয়ে পরখ দ্রুত কিছু সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল। পরদিন সকালে একটি বইসহ আদ্রিকাকে বগলদাবা করে নিয়ে গেল রসনাবিলাসীতে। নিজের অফিসরুমের সোফা, টেবিলে আদ্রিকার পড়ার ব্যবস্থা করে দিয়ে নিজে ল্যাপটপে মুখ গুজে কাজ করতে লাগল।

আস্ত একটি সিসি ক্যামেরার সামনে বসে থেকে নাস্তানাবুদ অবস্থা আদ্রিকার। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত টানা পড়ে বেচারির প্রাণ যায় যায় অবস্থা। দুপুরের খেতে বসে আদ্রিকার ক্লান্ত, বিরক্ত মুখশ্রী দেখে রুমি হাসতে হাসতে শেষ। রুমির সাথে মিলে সেদিন বিকালে আদ্রিকা একটি দুষ্ট বুদ্ধি বের করে ফেলল। পরখকে বলল,

‘শুধু আমার পরীক্ষা দরজায় কড়া নাড়ছে না। আপনারও তো পরীক্ষা সামনে। আপনি পড়াশোনা করছেন না কেনো? আপনারও পড়া উচিত।’

রুমি ভেটো দিয়ে বলল,

‘আদ্রিকা ঠিকই বলেছে। পরখ তুইও কিন্তু ফাাঁকিবাজ স্টুডেন্ট হয়ে যাচ্ছিস৷ পরে দেখা গেলো আদ্রিকা পাশ করে বসে আছে, অথয তুই ফেল মেরেছিস। এটা স্বামী জাতির জন্য কতো বড় অপমানের, সেটা জানিস? নাহ মামা। এমন হেয়ালি করলে চলবে না। তোর উপর পুরো স্বামী জাতির মানসম্মান নির্ভর করছে। তুইও কালকে থেকে পড়া শুরু করে দে।’

পরখ ধমক দিয়ে দুজনকেই কক্ষ থেকে বের করে দিলেও পরেরদিন আদ্রিকা ঠিকই নিজের বইয়ের সাথে পরখের একখানা বইও ব্যাগে ভরে নিয়ে এসেছে। বাধ্য হয়ে পরখকেও কাজের মাঝে দু এক পাতা করে পড়তে হচ্ছে।

দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে রুমি দেখল ডেস্কের উপর বই, খাতা, কলম, নোটবুক ছড়ানো।
এক্সিকিউটিভ চেয়ারে বসে কপালে হাত রেখে বইয়ের উপর মনোযোগী দৃষ্টি রেখে নীরবে পড়ছে পরখ। ডেস্কের অপরপাশের চেয়ার দুটোর একটিতে আধশোয়া হয়ে বসে আছে আদ্রিকা। অপর চেয়ারে তার দুটো পা ছড়িয়ে রাখা৷
চেয়ারে মাথা এলিয়ে দিয়ে মুখের উপর বই ধরে রেখে গুনগুন করে পড়ছে সে।

এমন দৃশ্য দেখে হো হো হাসতে শুরু করল রুমি। হাসত হাসতে বলল,

‘তোরা দুজনে অফিসটাকে লাইব্রেরি বানিয়ে ফেল। বইপুস্তক ছড়ায় ছিটায় এমনিতেও পড়ার টেবিল তো বানায় ফেলছিস।’

পরখ চোখ গরম করে তাকালেও আদ্রিকা স্নিগ্ধ হেসে সোজা হয়ে পরিপাটি হয়ে বসল। লাজুক ভঙ্গিমায় বলল,

‘আমি পড়তে বসলে টেবিল একটু এলোমেলো হয়ে যায়। পরখ অবশ্য গুছিয়ে পড়ে।’

আদ্রিকার পাশে চেয়ারে বসে রুমি বলল,

‘তোমরা দুজনে অফিসে কেনো আসছো, আমি বুঝতে পারছি না। এখানে তেমন কোনো কাজ নেই। যতটুকু আছে আমি সামলে নিতে পারব। তোমরা বাড়িতে বসেই ভালোভাবে পড়াশোনাটা করতে পারতে।’

আদ্রিকা নিচু স্বরে ফিসফিসিয়ে বলল,

‘এখানে পড়তে বেশি ভালো লাগে। এই রুমে লাইব্রেরি ভাইব আছে৷’

রুমি বাঁকা চোখে তাকিয়ে বলল,

‘লাগবেই তো। পরখের অফিসরুম বলে কথা। জামাইকে বিরক্ত করতে প্রত্যেক মেয়ের ভালো লাগে।’

দু হাতে মুখ ঢেকে খিল খিল করে হাসল আদ্রিকা। এদের দুজনের অবাঞ্ছিত কথায় বিরক্ত হয়ে দুপাশে মাথা দুলিয়ে আবারও বইয়ের মুখ ডুবালো পরখ। ওদিকে আদ্রিকা ও রুমির আড্ডা চলতেই থাকল।

*****

আজও যথারীতি রাতের খাবারটা একসাথে খেতে বসেছে আদ্রিকা-পরখ। সে সময় কল আসলো রুমির। কল রিসিভ হতেই রুমি নিরুদ্যোগ কণ্ঠে জানালো,

‘বিস্ময়কে ওর বাবা সুইজারল্যান্ড নিয়ে যাচ্ছে।’

পরখ একবার আড়চোখে আদ্রিকার দিকে তাকাল। কার কল এসেছে জানার জন্য আদ্রিকা উন্মুখ হয়ে পরখের দিকে চেয়ে আছে। পরখ চোখ সরিয়ে নিয়ে থমথমে মুখে জানতে চাইল,

‘কেনো? এখানে কি সমস্যা?’

‘ডাক্তার হাল ছেড়ে দিয়েছে৷ কোনো উন্নতি হচ্ছে না।
এক্সিডেন্টের সময় বিস্ময় মাথায় আঘাত পেয়েছে।
ব্রেইনস্টেমের পন্স নামে একটা অংশ আছে৷ ওটা গুরুতরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলে শরীরের মোটর ফাংশন পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়।

বিস্ময়ের ব্রেইনস্টেমের কার্যক্ষমতা নাকি নষ্ট হয়ে গেছে। চোখের পলক ফেলা, উপর-নিচে তাকানো ছাড়া আর কিছুই করতে পারছে না। পুরো শরীর প্যারালাইজড হয়ে গেছে৷

ওর ফিজিওথেরাপি, সাপোর্টিভ কেয়ার এর প্রয়োজন। যেটা এখানে সম্ভব না। আঙ্কেলেরও ব্যবসা বাণিজ্য সব ওখানে৷ কতোদিন আর এখানে পড়ে থাকবেন! এজন্য বিস্ময়কে সাথে নিয়ে যেতে চাইছেন। ওখানে নার্সের তত্ত্বাবধানে রেখে দিবে।’

‘সেটাই ভালো হবে।’

‘কালকে সকালের ফ্লাইট। তুই একবার এসে দেখা করে যা।’

‘ডিনার শেষ করে যাচ্ছি। তুই আছিস ওখানে?’

‘হ্যাঁ আছি। চলে আয়। একসাথে ফিরব।’

কল কেটে দিয়ে ফোনটি আলতো করে টেবিলের উপরে রেখে দিল পরখ। আদ্রিকা চট করে দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে খাবারে মনোযোগ দিল।

পরখও খাবার প্লেটে মনোযোগ দিয়ে শীতল কণ্ঠে বলল,

‘কিছু জানতে চাইলে জিজ্ঞাসা করতে পারো।’

আদ্রিকা আকাশসম বিস্ময় নিয়ে বলল,

‘কি জানতে চাইব?’

‘তোমার প্রাক্তনের শারীরিক অবস্থা সম্পর্কে।’

‘তার সম্পর্কে জানার কোনো ইচ্ছে নেই আমার।’ – থমথমে মুখে জবাব দিল আদ্রিকা।

পরখ চুপচাপ খাবার খেয়ে বেসিনে হাত ধুয়ে নিল। কক্ষের দিকে যেতে যেতে বলল,

‘বিস্ময়কে ওর বাবা কালকে সুইজারল্যান্ডে নিয়ে
যাচ্ছে। দেখতে যেতে চাইলে আজকে যেতে পারো।’

পরখের দিকে কটমট করে তাকালো আদ্রিকা। কিন্তু পরখ ওর প্রতিক্রিয়া দেখার প্রয়োজন বোধ করলো না। বাইরের পোশাক পরে তৈরি হয়ে নিল। আদ্রিকার তখনো খাবার টেবিলে বসে আস্তেধীরে খাচ্ছে। পরখ এসে জানাল,

‘আমি হাসপাতালে যাচ্ছি। ফিরতে দেরী হবে।’

সেই প্রশ্নের জবাব না দিয়ে আদ্রিকা সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকিয়ে কণ্ঠে সতর্কতার একটি আবহ নিয়ে বলল,

‘আমার মনে হয়, আপনার দ্রুত দেশ ছাড়া উচিত। যতদিন দেরী করছেন তত বিপদে পড়ছেন৷ নতুন কোনো ঝামেলা বাঁধার আগে আপনি চলে যান।’

পরখের বুকের ভেতরটা হঠাৎ হুড়মুড় করে ভেঙে পড়লো। কেনো ভাঙল, কেনো ব্যথা হলো পরখ জানে না। তবে অদ্ভুত এক শূন্যতা ঘিরে ধরলো তাকে। একটা হাহাকার নিয়ে সে নীরবে ঘর ছাড়লো। মন পুড়ানো এই অনুভূতি কতোদিন দীর্ঘস্থায়ী হবে পরখ জানে না।

চলবে…
#অক্ষরময়ী

#পরিণয়ে_নোলককন্যা (কপি নিষেধ)
|৫৯|

সেদিন আদ্রিকা বলার পর পরখেরও মনে হয়েছে, এবার সত্যি চলে যাওয়া উচিত। অপরিকল্পিত জীবনে কেনো অহেতুক জড়ানো!

বাধা দেমনি ইবনূল ইবতেহাজও। শুধু বলেছেন,

‘বাড়িতে এসো। সামনাসামনি বসে বিস্তারিত আলাপ আলোচনা হবে।’

গতরাতে পর্তুলিকারও কল দিয়ে বললেন,

‘সকাল সকাল দুজনে চলে আসিস। এখানে লাঞ্চ করবি।’

পর্তুলিকার আদেশে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছে পরখ এবং আদ্রিকা। পার্কিং থেকে বাইক বের করে দেখা গেলো আজকে হুট করে পরখের বাইকটিও হরতাল ডেকেছে৷ পেছনের চাকার বাতাস কখন বেরিয়ে গেছে টের পায়নি।

রাস্তায় সিএনজির দেখাও মিলছে না। ওদিকে পর্তুলিকা বারবার কল দিচ্ছে৷ অগত্যা আদ্রিকাকে নিয়ে পরখ চলে গেল বাসস্ট্যান্ডে। এই অসময়ে লোকাল বাসেই হুড়মুড় করে উঠতে হলো দুজনকে৷

লোকাল বাসে কোনো সীট নেই। মহিলাদের জন্য বরাদ্দকৃত আসনের একপাশে আদ্রিকাকে জানালা ঘেঁষে দাঁড় করিয়ে পরখ ওর সামনে ঢাল হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। মানুষের ভীড়ে বাসের মেঝেতে পা রাখা মুশকিল। এবড়োখেবড়ো রাস্তায় থেকে থেকে দুলে উঠছে বাস। কে যে কার গায়ে ঢলে পড়ছে ইয়াত্তা নেই। বিরক্তিতে ভ্রু কুচকে আছে পরখের। মেজাজ খারাপ হলেও কাউকে কিছু বলার সুযোগ নেই৷ বাস দুলে উঠলে যাত্রীরা ভারসাম্য হারাবে, সেটাই স্বাভাবিক।

ডান হাত বাড়িয়ে আদ্রিকার পাশের জানালার কাঁচে রেখেছে পরখ। বাস বাম দিকে মোড় নিতেই পাশে দাঁড়ানো একজন পৌঢ় ঢলে পড়লো সামনে। এই বুঝিয়ে হুড়মুড় করে আদ্রিকার গায়ে উপর পড়ে যাচ্ছে। ভয়ে কুকড়ে গেল আদ্রিকা৷
কিন্তু মাঝখানে বাঁধ সাধলো পরখের বলিষ্ঠ হাত। পৌঢ়ের সমস্ত দেহের ভার এক হাতে সামলে শিরদাঁড়া টানটান করে দাঁড়িয়ে রইল পরখ।

নিজেকে সামলে পৌঢ় অবশ্য বারকয়েক ক্ষমাও চাইল। অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনায় তিনি নিজেও লজ্জিত। আদ্রিকা আরেকটু গুটিশুটি হয়ে পরখের বুকের কাছটায় এগিয়ে এসে বিরস মুখে দাঁড়িয়ে রইল।

কিছুক্ষণ বাদে ভীড় ঠেলে আরও কিছু যাত্রী উঠলো। একটি বিশ অথবা বাইশ বছরের মেয়ে আদ্রিকার পাশে মহিলার আসনে বসে থাকা মহিলাগুলোর উদ্দেশ্যে বলল,

‘আমাকে একটু বসার জায়গা দিবেন? আমি প্রেগন্যান্ট। বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে কষ্ট হয়৷’

মহিলাগুলো একে অপরের দিকে চাওয়াচাওয়ি করল। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা আদ্রিকা মেয়েটিকে খুটিয়ে খুটিয়ে দেখলো৷ বাটিক প্রিন্টের একটি সালোয়ার কামিজ গায়ে মেয়েটিকে দেখে কোনোভাবেই গর্ভবতী বলে মনে হচ্ছে না৷ সে ফট করে বলেও ফেলল।

‘আপনি প্রেগন্যান্ট? কই আপনার পেট তো উঁচু হয়নি।’

‘প্রেগন্যান্ট হলেই বুঝি পেট উঁচু হয়? বাবুকে বড় হতে সময় দিতে হবে না?’

আদ্রিকার অদ্ভুত প্রশ্নে মেয়েটি হাসিমুখে জবাব দিলো। আশেপাশের মহিলাগুলোকে উচ্চস্বরে হাসতে দেখে আদ্রিকা লজ্জা পেল ভীষণ। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা পরখের বুকে মুখ গুজে সবার দৃষ্টি এড়ানোর চেষ্টা করলো। পরখ কিছু বলছে না দেখে মুখ তুলে চেয়ে দেখলো পরখ নিজেও মুখ চিপে হাসছে৷

মহিলারা একটু নড়েচড়ে বসে মেয়েটিকে বসার জায়গা করে দিলো। আরাম করে বসে ওড়নায় মুখের ঘাম মুছে কাধের ব্যাগ থেকে পানির বোতল বের করে খানিকটা পানি পান করলো মেয়েটি।

সামনে তাকিয়ে আদ্রিকাকে ওমন লজ্জায় গুটিয়ে যেতে দেখে হাসি মুখে বললো,

‘ও যখন বড় হবে তখন একটু একটু করে আমার পেট বড় হবে। তখন বেবিবাম্প দেখা যাবে।’

বাস যতো এগিয়ে যেতে লাগলো দু একটা আসন ফাঁকা হলো। তবে সেগুলো দখল করে নেওয়ার মতো ক্ষিপ্রতা আদ্রিকার মধ্যে নেই। সে চুপচাপ পরখের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে রইলো।

এবার মহিলাদের আসন থেকে একজন উঠে যেতেই সেখানে নিজের ব্যাগটি রেখে জায়গা দখল করে গর্ভবতী মেয়েটি আদ্রিকাকে বললো,

‘এখানে এসে বসো।’

আদ্রিকা তাকালো পরখের দিকে। সে চোখ দ্বারা সম্মতি জানাতেই আদ্রিকা এগিয়ে এসে মেয়েটির পাশে বসলো।

‘তোমার স্বামী?’

‘হ্যাঁ।’

‘উনি কি করেন?’

‘ভার্সিটির লেকচারার।’

‘আর তুমি?’

‘এখনো কলেজে পড়ছি।’

‘নতুন বিয়ে হয়েছে?’

‘কয়েক মাস হয়েছে।’

‘দেখেই বুঝা যায়। স্বামীর আদেশ ছাড়া এক পা নড়লে না।’

আদ্রিকা লজ্জা পেয়ে আবার মাথা নিচু করে রইলো। খানিকবাদে নিজেই শুধালো,

‘আপনার কয়মাস চলছে?’

‘চার মাস।’

‘পেট উঁচু হতে কতোদিন লাগবে?’

‘একেকজনের ক্ষেত্রে একেকরকম। তবে ছয়মাস পর পুরোপুরি বুঝা যায়।’

‘বাবু পেটে নিয়ে মেয়েরা যখন হাঁটে, তখন অনেক কিউট দেখায়। আমার দেখতে খুব ভালো লাগে৷’

‘তুমি নিজেই একটা বাবু নিয়ে নেও। তখন নিজেই নিজেকে দেখবে।’

‘সবে বিয়ে হলো। আর কিছুদিন যাক৷’

আদ্রিকার রক্তিম মুখের দিকে তাকিয়ে মেয়েটি আর কিছু বললো না। হঠাৎ আদ্রিকা সামনের দিকে চেয়ে দু চোখের আঁধার দেখলো।

একি! পরখ কোথায়? এখানেই তো ছিল। এই তো ওর ডানদিকে দাঁড়িয়ে। অথচ এখন পরখকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। সে নিজে গল্পের মধ্যে এতোটাই মজে ছিল যে পরখের দিকে খেয়ালই করেনি।

বাসে এখন মানুষজন গিজগিজ করছে৷ এতোগুলো লোক কখন উঠলো? এই ভীড়ের মাঝে এখন সে পরখকে কীভাবে খুঁজবে?

আশেপাশে অস্থিরভাবে তাকিয়েও পরখের দেখা যখন পেলো না তখন ভীষণ ভয় পেয়ে গেলো৷ ওকে রেখে পরখ নেমে যায়নি তো?

ওর ভয়ার্ত মুখের দিকে তাকিয়ে মেয়েটি উদ্বিগ্ন হয়ে জানতে চাইলো,

‘কি হয়েছে? কোনো সমস্যা?’

দাঁত দিয়ে ঠোঁট আকড়ে ধরে আদ্রিকা কান্না নিয়ন্ত্রণ করে দু পাশে মাথা দুলিয়ে বললো,

‘উহু, কিছু না।’

মেয়েটি স্পষ্ট বুঝতে পারছে কিছু একটা হয়েছে৷ কিন্তু কারো ব্যক্তিগত জীবনে হস্তক্ষেপ শোভনীয় নয় দেখে চুপ রইল। আদ্রিকার চঞ্চল দৃষ্টি পুরো বাসময় ঘুরছে৷ যে কোনো সময় ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কান্না জুড়ে দিবে না তো আবার!

টুং শব্দ করে ফোন বেজে উঠতেই আদ্রিকার মনোযোগে বিঘ্ন ঘটলো। দরজার দিকে দৃষ্টি রেখে ব্যাগ হতে ফোন বের করে দেখলো পরখ মেসেজ দিয়েছে।

‘রিলেক্স। পেছনের দিকে দাঁড়িয়ে আছি। ভীড়ের কারণে দেখতে পাচ্ছো না৷ আমি তোমাকে দেখতে পাচ্ছি।’

মেসেজ পড়ে আদ্রিকার মনে হয় শ্বাস ফিরে এলো। এইতো আশেপাশেই পরখ আছে। সে শুধু দেখতে পাচ্ছে না৷ কিন্তু আছে তো। এই যে আদ্রিকা এখন তাকে ঠিকই অনুভব করতে পাচ্ছে।

বাস থেকে নেমে প্রথমেই পরখ একটা জোর ধমক দিয়ে বলল,

‘ব্যাগে ফোন ছিল। অন্ধের মতো এদিক ওদিক না খুঁজে একটা কল করতে পারতে না?’

আদ্রিকার সত্যি মনে ছিলো না৷ এই মোবাইলের কথাটা ওর মাথায় থাকে না৷ অপ্রয়োজনীয় জিনিসের মতো মোবাইলটিকে ফেলে রাখে এককোনায়। সে মিনমিন করে বললো,

‘মনে ছিলো না। স্যরি।’

*****

দুপুরের খাবারে এলাহি আয়োজন করেছে পর্তুলিকা। বাড়িতে প্রবেশ করে আদ্রিকাও কোমরে আঁচল গুজে ঢুকে গেছে রান্নাঘরে৷ শাশুড়ি-বউ দুজনে মিলে আয়েশ করে রেঁধেছে। এখন ডাইনিং টেবিলে খাবারের এতো পদ দেখে ইবনূল ইবতেহাজ সবিস্ময়ে বললেন,

‘এতো খাবার কে খাবে?’

পর্তুলিকার চোখ রাঙিয়ে উত্তর দিলেন,

‘খেতে না পারলে খাবে না৷ তোমার খাবারের আশায় কে রেঁধেছে?’

‘তবে এতো আয়োজন কার জন্য?’

‘কারও জন্য নয়। আমার রাঁধতে ইচ্ছে করেছে তাই রেঁধেছি। সবার আগে নিজের স্যাটিসফেকশন জরুরি।’

পায়েশের বাটি নিয়ে ওরা যখন হলরুমের সোফায় বসল তখন পর্তুলিকা বললেন,

‘তুই কবে যেতে চাইছিস?’

পরখ বলল,

‘এই সপ্তাহেই যেতে চাইছি। নতুন মাসের কয়েকটা ক্লাস করতে পারলে এক্সামে সুবিধা হবে।’

ইবনূল ইবতেহাজ আদ্রিকার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল,

‘তুমি কি বলো, আদ্রিকা?’

আদ্রিকা চমকালো ভীষণ। থমথমে খেয়ে বলল,

‘আমি? আমি কী বলব?’

‘বাহ রে! তোমার হাসবেন্ড বিদেশ যাচ্ছে, এ ব্যাপারে তোমার মতামত থাকবে না?’

‘ওহ! এ ব্যাপারে। আমি তো পরখকে আরও আগে যেতে বলেছি। ইমেইল পাওয়ার সাথে সাথে উনার যাওয়া উচিত ছিল। তাহলে আরও কিছু ক্লাস করতে পারতেন। ক্লাস টেস্টগুলোও মিস যেত না৷ এখন গিয়ে ফাইনাল এক্সাম দিলেও মার্কস নিশ্চয়ই কম আসবে। যত তাড়াতাড়ি যাওয়া যায় ততই ভালো।’

ইবনূল ইবতেহাজ বেশ কিছুক্ষণ নীরব রইলেন। কপালে সূক্ষ্ম ভাঁজ ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেলে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,

‘ঠিকই বলেছো। ওখানে গিয়ে গোছগাছ করার একটা ব্যাপারও আছে। সেটেল্ড হতে সময় লাগবে। আমি সামনের সপ্তাহে টিকিট কাটার ব্যবস্থা করছি।’

প্রায় তখনি বিরোধিতা করে বসল পরখ৷ চোখ মুখ শক্ত করে বলল,

‘আমার টিকিট আমি নিজে কাটতে পারবো।’

পিতা-পুত্রের কলহের সুত্রপাতের চিন্তায় মনে মনে আঁতকে উঠলেন পর্তুলিকা। এখন যদি দুজনের বাকবিতন্ডা চূড়ান্ত পর্যায় পৌঁছে যায় তবে পুত্রবধূর সামনে বেশ লজ্জায় পড়তে হবে৷

কিন্তু পর্তুলিকাকে সম্পূর্ণ অবাক করে দিয়ে ইবনূল ইবতেহাজ রাগ না করে বিস্তৃত হাসলেন। খোশমেজাজে বললেন,

‘গতবারের টিকিট এর রিফান্ডটা তোমার পাওনা আছে। ধরে নেও সেটারই রিফান্ড পাচ্ছো।’

বাবার হাসিমাখা মুখ দেখে কিছু মুহূর্তের জব্য বাকহারা হয়ে গেল পরখ। আজ ঠিক কতোদিন পর বাবা তার সাথে হাসিমুখে কথা বলছে সে জানে না। এতোদিন শুধু খোঁটা মেরে কথা বলে এসেছেন। কথায় কথায় অতিরিক্ত শাসন বারণ করা, বকা দেওয়া, তিরষ্কার করা ছাড়া পরখের স্মৃতি আর কিছু ধরা দেয় না৷ এভাবেই তো বেড়েছিল বাবার প্রতি পরখের তিক্ততা।

সইতে সইতে একসময় পরখও প্রতিবাদী হয়ে উঠেছিল। তবে তর্ক করে বাবার সাথে বেয়াদবি করতে পারেনি। তাই নীরবে সরে এসেছে। বাবা যে কাজে বাঁধা প্রদান করেছে জেদ করে সেই কাজটি করে প্রতিশোধ নিয়ে শুরুটা হয়েছিল । ফলস্বরূপ সময়ের সাথে বেড়েছে পিতা পুত্রের দ্বন্দ্ব।

আজ পিতার পক্ষ হতে শান্তির সূচনা দেখে পরখ নিজেও শান্ত হয়ে গেল। হার মেনে নিয়ে চুপ করে রইল।

পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে পর্তুলিকা বললেন,

‘বিদেশে গেলে কবে ফিরে আসা হয়, তার ঠিক নেই৷ এই সুযোগে তোর দাদীর সাথে দেখা করে আয়। উনাকে না জানিয়ে বিয়ে করেছিস শোনার পর থেকে উনি এমনিতেই রেগে আছেন। আমার সাথে পর্যন্ত কথা বলছেন না। তুই আদ্রিকাকে সাথে নিয়ে একবার ঘুরে আয়। দেখাও হলো সেই সাথে দোয়াও নিয়ে এলি।’

পরখের দাদী বেঁচে আছে আদ্রিকা জানত না। নতুন সদস্যদের খোঁজ পেয়ে চকচক করে উঠল আদ্রিকার চোখ৷ সে উন্মুখ হয়ে চেয়ে রইল পরখের দিকে।
আদ্রিকার সমস্ত উৎসাহ, উত্তেজনায় পানি ঢেলে দিয়ে পরখ বিরক্তিমাখা স্বরে জবাব দিল,

‘গ্রামে যেতে আমার ভালো লাগে না। দাদীকে আসতে বলো। এখানে দেখা করে নিবো।’

‘উনি বৃদ্ধ মানুষ। বেশিরভাগ সময় অসুস্থ থাকেন। এতোটা পথ জার্নি করতে পারবেন না। তোরা দুজনে যা। দিনে গিয়ে দিনে চলে আসবি।’

‘আমি বললেই উনারা ফিরে আসতে দিবে? কখনো দিয়েছে? প্রতিবার জোরজবরদস্তি করে আটকে দেয়। নাহ, আমি যাব না ওখানে।’

পরখের কথা শুনে ইবনূল ইবতেহাজ ভীষণ আহত হলেন। সরু চোখে চেয়ে বললেন,

‘নিজের দাদু বাড়ি যেতে তোমার বিরক্ত লাগছে। শেকড়কে এতো দ্রুত ভুলে যেতে পারলে তুমি? খুব বিদ্যান হয়ে গেছো দেখছি।’

পরখ অবাক চোখে চেয়ে বলল,

‘বিরক্ত লাগে কখন বললাম? দাদু বাড়িতে বেড়াতে গেলে আমি ভীষণ উপভোগ করি।’

‘তাহলে সমস্যা কোথায়?’

‘রাত থাকতে আমার ভালো লাগে না। সবাই অনেক তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়ে। চারদিক কেমন সুনসান হয়ে যায়। আমার দমবন্ধ হয়ে আসে।’

ইবনূল ইবতেহাজ বুঝি আজ ছেলের মানসিক অবস্থা বুঝে ফেলার মানসিকতা নিয়ে আড্ডায় বসেছেন। তাই তো কোনো প্রত্যুত্তর না করে শান্ত চোখে পরখের দিকে চেয়ে রইলেন।

এই আলোচনায় একমাত্র শ্রোতা আদ্রিকা চুপচাপ বসে ঠোঁট কামড়াতে থাকল।
নীরবতা ভেঙে সমাধান দিল পর্তুলিকা। মিষ্টি হেসে বললেন,

‘আমরাও অনেকদিন গ্রামের বাড়িতে যাই না। ইবনূল চলো, সবাই মিলে গ্রাম থেকে ঘুরে আসি। আমরা সাথে থাকলে পরখের আর বিরক্ত লাগবে না। একদিন থেকে চলে আসবো।’

পর্তুলিকার প্রস্তাবে বিরোধিতা করলো না কেউ। অবশেষে আলোচনায় সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো, আগামীকাল সকালবেলা সবাই মিলে গ্রামে যাবে। সেই অনুযায়ী প্রস্তুতি নিতে বলা হলো।

পরখ ও আদ্রিকা যেহেতু সাথে কিছু নিয়ে আসেনি তাই গোছগাছের জন্য ওরা আজকে বাড়ি ফিরে গিয়ে কালকে সকালে আবার আসবে।

আলোচনার শুরু থেকে সবচেয়ে খুশি দেখালো আদ্রিকাকে। নতুন জায়গা ভ্রমণের খুশি উপচে পড়ছে তার চোখে মুখে। বাড়ি ফিরেও সে লাফিয়ে লাফিয়ে ঘরদোর গোছালো।
গ্রামের বাড়ি যাওয়ার জন্য ব্যাগপত্র গোছানোর কাজও ইতিমধ্যে শুরু করে দিয়েছে। কোন কাপড়টা নিবে, কোনটা রেখে যাবে সেগুলো ভাবতে গিয়ে রান্নাবান্না ভুলে গেছে।
বাধ্য হয়ে পরখ বাইরে থেকে খাবার নিয়ে এসেছে।
খেতে বসেও আদ্রিকার উত্তেজনার কমতি দেখা যাচ্ছে না। এক হাতে খাচ্ছে, অন্য হাতে ফোনের নোটপ্যাডে লিস্ট বানাচ্ছে।

পরখ একসময় আর চুপ থাকতে না পেরে বলল,

‘আমার চলে যাওয়ায় তোমাকে ভীষণ এক্সাইটেড দেখাচ্ছে। তুমি বোধহয় খুব খুশি হয়েছো।’

ফোন দেখে মুখ তুলে পরখের দিকে তাকিয়ে ঠোঁট চেপে হাসল আদ্রিকা। কণ্ঠে খানিক দুষ্টুমি মিশিয়ে বলল,

‘নাহ তো। আমি ভীষণ কষ্ট পাচ্ছি। কেঁদেকেটে ঘর ভাসাতে ইচ্ছে করছে৷’

এমন রসাত্মক কথায় পরখ চোখ রাঙিয়ে নিজের খাবার মনোযোগ দিল। আদ্রিকা অবশ্য চোখ সরালো না। পরখের দিকে গভীর চোখে তাকিয়ে দরদী গলায় আবৃত্তি করল,

“তোমায় বেঁধে রাখার সাধ্য আমার নেই।
তুমি যাবে চলে,
ম্লান হয়ে যাবে ধীরে ধীরে,
যোগ দেবে স্মৃতির পাতায়।

তোমায় না ভালোবেসে উপায় ছিল না,
তুমি যেমন, তেমন মানুষ আমি বোধহয় স্বপ্নে গড়ি।

তাই তোমায় স্বপ্ন ভাবি সহজ মনে হয়,
তোমায় স্বপ্ন ভেবে মিশিয়ে দেবো আঁধভাঙ্গা কিছু গল্পে,
ছেঁড়া কিছু বইয়ের পাতায় থেকে যাবে আফসোস, ঘুম ভেঙে যাওয়ার আফসোস,
আরো অল্প সময় তোমাকে না দেখতে পাওয়ার আফসোস।
তাও সব দ্বিধা ভুলে বলতে চাই,
আমি তোমার আদুরে নাম হবো।

ক্ষণে ক্ষণে ডেকে উঠবে সে নামে,
ডাকে সাড়া না পেলে অশান্ত হবে,
চতুর্দিক হন্যে হয়ে খুঁজবে আমার উপস্থিতি।

সাড়া পেয়ে হয়ে উঠবে শান্ত নদী,
আমি সে নদীতে বাতাসের মৃদু দোলনায় বয়ে চলবো নিরবধি।

আমি তোমার সর্বনাম হবো,
তোমার দেয়া ডাকনামে পরিচিত হবো,
নিভৃত ক্ষণে খুব আহ্লাদ হয়ে আমায় সর্বনামে ডেকো,

সর্ব-নাম ডাকা শেষে আমায় তুমি ডাকনাম দিও।পৃথিবীকে জানাবো আমার একটা নাম আছে।”

পরখ চমকে গেল, থমকে গেল। চোখ তুলে যখন তাকালো তখন আদ্রিকা স্নিগ্ধ হেসে বলল,

“কবিতাটি সুন্দর, না? ফেসবুকে দেখলাম, একজন পোস্ট করেছে।”

পরখ হতভম্বতা কাটিয়ে উঠে বলল,

“চোখের সামনে পড়লো বলে তুমি আবৃত্তি করে ফেললে?”

“আজকাল আমি টুকটাক আবৃত্তি শিখছি। কেমন আবৃত্তি করলাম, বললেন না তো।”

পরখ তার স্বভাবস্বরুপ কাঠখোট্টা কণ্ঠে জবাব দিল,

“ভালো হয়েছে।”

তবে আদ্রিকা তার পুর্বের স্বভাব অনুযায়ী মন খারাপ করলো না। মিষ্টি হেসে খাবারে মনোযোগ দিল।

চলবে…
#অক্ষরময়ী