পরিণয়ে নোলককন্যা পর্ব-৬২+৬৩

0
86

#পরিণয়ে_নোলককন্যা (কপি নিষেধ)

|৬২|

রান্নাঘরের মাটির চুলায় লাকড়ি পু/ড়ছে প্রচন্ড উত্তাপে। এর আগে নীহারকে মাটির চুলায় রান্না করতে দেখলেও আদ্রিকা নিজে কখনো মাটির চুলায় রান্না করেনি। তখন রান্নাবান্না কিংবা রান্নাঘরের প্রতি কোনো আগ্রহ ছিল না আদ্রিকার। কিন্তু আজ উর্মির রান্নাঘরের প্রবেশ করে কোমরে আঁচল বেঁধে কাঠের পিড়িতে বসে পড়ল আদ্রিকা। মাটির হাড়িতে গরম পানি ফুটছে। হাড়ির উপরে মাটির ঢাকনা বসিয়ে আটা গুলিয়ে চারপাশের ছিদ্র বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। হাড়ির ঢাকনার মধ্যখানে চারটি ছোট ছোট ছিদ্র৷ সেখানেই বাটি বসিয়ে তৈরি করা হচ্ছে ভাপা পিঠা৷

উর্মির পাশে বসে আদ্রিকা বলল,

‘কাকি, আমি একটা বানাই?’

উর্মি গা দুলিয়ে হেসে বললেন,

‘আগে কখনো বানিয়েছো?’

আদ্রিকা দু পাশে মাথা দুলিয়ে জানালো, সে আগে কখনো পিঠা বানায়নি।

‘এসো, আমি শিখিয়ে দিচ্ছি।’

উর্মি হাতে ধরে আদ্রিকাকে শিখিয়ে দিলেন। প্রথমবার পিঠার বাটি বসাতে গিয়ে আদ্রিকার হাতে গরম পানির ভাপ লাগলেও সে দমে গেল না৷ অনেক কসরত করে হাড়ির মুখ থেকে পিঠার ছাঁচ তুলে আবারও অতিউৎসাহে পিঠা বানাতে শুরু করলো।

চায়ের কাপে গাঢ় দুধ চা ঢেলে উর্মি বললেন,

‘তুমি কয়েকটা বানাও। আমি সবাইকে চা দিয়ে আসি।’

সকালবেলা চাচা ইসহাকের সাথে বাজারে গিয়েছিল পরখ। তাজা শাকসবজি নিয়ে ফিরে এসেছে মাত্র। ওদের সামনে ধোঁয়া উঠা গরম ভাপা পিঠার প্লেট এবং চায়ের কাপ রাখলেন উর্মি।

জয়নব বসে আছেন বারান্দার চৌকিতে। পাশে বসে জয়নবের জন্য সুপারি কাটছেন পর্তুলিকা। জয়নবের নাস্তার প্লেটটি চৌকির উপর রেখে উর্মি বললেন,

‘ভাবি, তুমিও নাস্তা করে নেও। ঠান্ডা হয়ে যাবে।’

‘শেষ প্রায়। এক্ষুনি আসছি।’

‘রান্নাঘরে যেতে হবে না। আমি এখানেই পাঠিয়ে দিচ্ছি।’

শাক সবজি রাখতে রান্নাঘরে এসেছিল অধরা। ঘর ধোঁয়ায় ভরে যেতে দেখে কাশতে কাশতে বলল,

‘একী অবস্থা! এতো ধোঁয়া কেনো?’

কুয়াশার মতো গাঢ় ধোঁয়ার আড়াল থেকে শোনা গেল আদ্রিকার কণ্ঠস্বর।

‘চুলা নিভিয়ে ফেলেছি। আর জ্বলছে না।’

ব্যাগ রেখে অধরা সামনে এগিয়ে গিয়ে দেখল চুলার সামনে দিশাহারা মুখে বসে আছে আদ্রিকা৷ ধোঁয়ায় ওর চোখে জল জমে গেছে।

চুলার পাশে রাখা বাঁশের তৈরি ফুঁকনি দিয়ে চুলায় ফুঁ দিল অধরা৷ ধক করে আ/গুন জ্বলে উঠল। ধীরে ধীরে ধোঁয়া মিলিয়ে গিয়ে পরিষ্কার হয়ে এলো চারপাশ। অধরা বলল,

‘মা কোথায়?’

‘কাকি চা নিয়ে গেছে।’

‘দেখো কান্ড! তোমাকে চুলা সামলানোর কাজে রেখে গেছে। তুমি পারো এগুলা! সরে এসো। আমি বানিয়ে দিচ্ছি।’

আদ্রিকা মন খারাপ করে বলল,

‘আমি বানাতে চেয়েছিলাম বলে কাকি আমাকে রেখে গেল। কিন্তু আমি সব ধোঁয়া ধোঁয়া করে ফেললাম।’

একটা পিড়ি টেনে আদ্রিকার পাশে বসে অধরা বলল,

‘তুমি পিঠা বানাও। আমি চুলা সামলাচ্ছি।’

উঠোনে সবাই নাস্তা খাচ্ছিলো। একটি প্লেট নিয়ে আদ্রিকা ছুটে এলো। পর্তুলিকার সামনে দাঁড়িয়ে উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে জানালো,

‘পিউ মা, দেখো আমি পিঠা বানিয়েছি।’

পর্তুলিকা মিষ্টি হেসে পিঠার প্লেট হাতে নিয়ে বললেন,

‘কী সুন্দর বানিয়েছো! আমিও এতো ভালো বানাতে পারি না। চমৎকার হয়েছো।’

‘খেয়ে দেখো। ভেতরে অনেকগুলো গুড়, নারকেল দিয়েছি।’

পর্তুলিকা পিঠে ভেঙে মুখে দেওয়ার আগে পাশ থেকে জয়নব বললেন,

‘দেখি আমারে দেও। কী বানাইছে দেখি।’

প্লেট থেকে একটি পিঠা তুলে নিলেন জয়নব। আদ্রিকা শ্বাস আটকে জয়নবের প্রতিক্রিয়ার অপেক্ষা করতে থাকল। পিঠা মুখে পুড়ে অনেকসময় নিয়ে চিবিয়ে বেশ কিছুক্ষণ ভেবে তারপর প্রতিক্রিয়া জানালেন জয়নব। গম্ভীর মুখে বললেন,

‘ভালোই হইছে।’

আদ্রিকার মুখে ঝলমলে হাসি ফুটল। একটি পিঠা ভেঙে পর্তুলিকা খানিকটা মুখে দিলেন, খানিকটা আদ্রিকাকে খাইয়ে দিলেন। পিঠা খেতে খেতে আদ্রিকা সগৌরবে তাকাল খানিক দূরে বসে থাকা পরখের দিকে। উঠোনে বাবা, চাচার সাথে বসে পরখ পুরো ঘটনাটি লক্ষ্য করেছে। আদ্রিকার বাঁধ ভাঙা উচ্ছ্বাসের সাথে সে পরিচিত। সামান্য প্রাপ্তিতে খুশি হয়ে যায় মেয়েটা। খুব অল্প তার চাহিদা৷ আদ্রিকার উল্লাস, উচ্ছ্বাস স্বাভাবিকভাবেই নেয় পরখ৷ কিন্তু দাদী কীভাবে গ্রহণ করবে সেটা নিয়ে পরখ চিন্তিত ছিল। কিন্তু আদ্রিকার উদযাপনে জয়নবকে বিরক্ত হতে না দেখে পরখও যেনো স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ল। দূর থেকে দেখতে থাকল আদ্রিকার আনন্দ।

পর্তুলিকা পরখের দিকে চেয়ে হাঁক দিলেন।

‘তোর বউ পিঠা বানিয়েছে। টেস্ট করে দেখ।’

পরখ যেভাবে নীরবে উঠে এলো তেমনি ভাবে প্লেট থেকে পিঠা তুলে নিয়ে আবার নিজের জায়গায় ফিরেও গেলো। ভালো মন্দ কিছুই বলল না।

আদ্রিকা অবশ্য আশাও করেনি৷ একজন প্রশংসা করেছে তাতেই সে খুশি৷ এতো এতো প্রশংসা দিয়ে সে কী করবে?

*****

বিকালে বাড়ি ফিরে যাওয়ার কথা থাকলেও বাঁধ সাধলেন জয়নব। নতুন বউ নিয়ে এসে একদিনে ফিরে যাওয়া চলবে না। মায়ের কথায় সায় দিয়ে ইসহাকও বললেন,

‘নতুন বউকে ভালোভাবে আদর আপ্যায়ন করার সুযোগ তো দিবা। এখনো ঘরের চালের পোলাও খাওয়ানো বাকি, পুকুরের মাছ তোলা বাকি। উর্মি বলল দুধ চিতুই বানাবে। আমিও কাল সকালে পুকুরে জাল ফেলবো ঠিক করে রাখছি। এখনি ফিরে যাওয়ার তাড়া কীসের? থাকো কয়েকটা দিন।’

বিকালের চায়ের আসরে বসেছে সকলে। পরখ কিছু বলার আগে পর্তুলিকা বললেন,

‘আগামী শুক্রবার পরখের ফ্লাইট। আদ্রিকারও সামনে পরীক্ষা।’

অনেকদিন পর দাদু বাডি এসেছে পরখ। আগে স্কুল ছুটি হলেই মায়ের সাথে চলে আসতো। কলেজে উঠার পর আসা যাওয়া অনেকটা কমে গেছে। এবার এতোদিন পর এসেও এতো দ্রুত যাওয়ার কথা শুনে অধরার মন খারাপ হয়ে গেল। সে বলল,

‘শুক্রবার আসতে এখনো পাঁচদিন বাকি। আমাদের এখানে দুদিন থাকো, পরখ ভাইয়া। তারপর তো বিদেশে চলেই যাবা।’

পরখ কিছু না বলে আড়চোখে আদ্রিকার দিকে তাকালো৷ ওর কি এখানে থাকতে ভালো লাগছে? নাকি ফিরে যেতে চাইছে?

পরখের অনুসন্ধানী দৃষ্টি আদ্রিকা খেয়াল না করলেও অধরা খেয়াল করেছে৷ সে দ্রুত আদ্রিকাকে পটানোর প্রচেষ্টা করে বলল,

‘পিঠা বানানোর জন্য ঢেঁকিতে চাল কুটা হবে। তুমি আগে কখনো ঢেঁকি দেখেছো, আদ্রিকা।’

আদ্রিকা দুপাশে মাথা দুলালে অধরা বলল,

‘থেকে যাও। ঢেঁকিতে চাল কুটবো আমরা। অনেক মজা হবে।’

অতঃপর সকলে নিশ্চিত হলো, গ্রামে তারা আরও দুদিন অবস্থান করছে।

*****

রান্নাঘরের ছাদ থেকে বড় মাটির হাড়ি নামানো হয়েছে। সেখান থেকে কালোজিরা চাল বের করেছেন উর্মি৷ সেগুলো দিয়ে পোলাও রান্না করা হবে। ছোট দানাদার চাল, মনমাতানো তার সুগন্ধ৷ আদ্রিকা দু হাতের আঁজলায় কিছু চাল তুলে নাকের কাছে নিয়ে ঘ্রাণ নিলো৷

কুলায় চাল রেখে ধান, পাথর, ময়লা খুঁজে বের করছেন উর্মি। আদ্রিকার আগ্রহ দেখে উর্মি মিটি মিটি হাসছেন।

প্রাণভরে সুঘ্রাণ নিয়ে আদ্রিকা বলল,

‘এগুলোর কী মিষ্টি ঘ্রাণ! আমাদের বাড়ির পোলাওয়ের চালে এতো ঘ্রাণ নেই।’

উর্মি হেসে বললেন,

‘রান্নার পর দেখবে আরও ঘ্রাণ ছড়াবে।’

আদ্রিকা মুঠো ভরে চাল নিয়ে বলল,

‘আমি পিউ মাকে দেখিয়ে আসি?’

উর্মি মাথা দুলিয়ে সম্মতি জানালে আদ্রিকা শাড়ির কুচি সামলে ছুট লাগালো বারান্দায়। বারান্দার ডানদিকে জয়নবের ঘর। পর্তুলিকা সেখানেই আছেন।

হাসিমুখে ছুটতে ছুটতে হঠাৎ বামদিকে তাকিয়ে আদ্রিকার মুখের হাসি মুছে গেল। বারান্দার বামদিকের ওয়াশরুমের পাশে চিকন একটি রাস্তা আছে। ওদিক দিয়ে বাড়ির পেছনের বাগানে যাওয়া যায়। সেখান থেকেই আসছিল পরখ এবং অধরা৷

পরখের হাতে একটি পাকা বেল। আঙ্গুল দিয়ে বেলের আঁশ তুলে পরখ মুখে দিচ্ছে। অধরার হাতে আরও কয়েকটি বেল দেখা যাচ্ছে৷ সে কিছু বলছে, যা মনোযোগ দিয়ে শুনছিল পরখ।

এমনে দৃশ্য দেখে আদ্রিকা এতোটাও ভাবুক হতো না। যদি না অধরা হুট করে ওই কাজটা করতো।

বেল খেতে গিয়ে পরখের ঠোঁটের কোণায় একটু লেগে গিয়েছিল। পরখ হয়তো খেয়াল করেনি৷ কথা বলতে বলতে ওরা হাঁটছিল। অধরা হঠাৎ পরখের কাঁধে হাত দিয়ে পরখকে থামিয়ে দিল। সামনাসামনি দাঁড়িয়ে শাড়ির আঁচল তুলে সযত্নে মুছে দিল পরখের ঠোঁটের কোণে লেগে থাকা বেলের আঁশ। তারপর ওরা আবারও আনমনে হাঁটতে শুরু করলো।

কিন্তু আদ্রিকার পা দুটো সেখানেই থমকে রইলো৷ সুউচ্চ এই ভবন, মস্ত বড় উঠোন, পশুপাখিদের হাঁকডাক কিংবা বিকালের মরা রোদ – কোনোকিছুই বেঁধে রাখতে পারলো না আদ্রিকাকে।

নিজের ভাবনার ভেলায় আদ্রিকা ভেসে গেলো অনেকদূর। পরখ টেরও পেল না।

*****

সামনে খোলা মাঠ। ধান পেকে হলুদ হয়ে আছে। কিছুদিন পরেই সোনালী ফসল ঘরে তুলবে কৃষকেরা। কেউ কেউ তো ধান কাটতে শুরু করে দিয়েছে।

ধানের ক্ষেতের মাঝখান দিয়ে সোজা চলে গেছে গ্রামের বড় রাস্তাটা। পিচঢালা রাস্তা ধরে হাঁটছে আদ্রিকা। কোথায় যাচ্ছে সে জানে না।

শুধু জানে হাঁটতে ওর ভালো লাগছে। কিছুক্ষণ আগে যে দমবন্ধকর অনুভূতি হচ্ছিল, সেটা এখন আর হচ্ছে না। খোলা আকাশের নিচে বুকভরে শ্বাস নেওয়া যাচ্ছে। তবে চোখে স্পষ্ট কিছু দেখতে পাচ্ছে না। থেকে থেকে ঘোলা হয়ে আসছে দৃষ্টি। তখন হাতের উল্টোপিঠে চোখ মুছে দৃষ্টি স্বাভাবিক করে নিচ্ছে আদ্রিকা।

ইতিমধ্যে কতোটা পথ পেরিয়ে এসেছে, আদ্রিকা জানে না। বড্ড ক্লান্ত লাগছে। জড়িয়ে আসছে পা দুটো। রাস্তার ডানপাশে সুবিশাল খোলা মাঠ দেখতে পেয়ে আদ্রিকা সেদিকে এগিয়ে গেল। একটা সরকারি প্রাইমারি স্কুল। এই অবেলায় বিরানভূমির মতো অবহেলায় পড়ে আছে।

সবুজ মাঠে দাঁড়িয়ে আছে কয়েকটা গরু। ওরা মনের সুখে স্কুল মাঠের ঘাস খাচ্ছে। আদ্রিকা গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে গিয়ে মাঠের একপাশে দাঁড়িয়ে থাকা কৃষ্ণচূড়া গাছটির নিচে বসল।

হাঁটুতে মুখ গুজে পায়ের দিকে তাকাতেই দেখল শাড়ির নিচের অংশের পাড়টুকু চোরাকাঁটায় ভরে গেছে৷ আদ্রিকা অলসভাবে বসে আনমনে একটা একটা করে চোরাকাঁটা ছাড়াতে লাগল।

*****

দোতলা ভবনটির প্রতিটি দেয়ালে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে জয়নবের হুংকার।

‘একটা মানুষ বাড়ি থেকে বের হয়ে গেল, অথচ কারো চোখে পড়লো না। কই ছিলা তোমরা?’

বাড়ির প্রতিটি ব্যক্তি ভয়ার্ত এবং তটস্থ। পরখ নিজেও কলকল করে ঘামছে। হারিয়ে যাওয়ার স্বভাব আদ্রিকার নতুন নয়। এর আগে যতবার সে পরখের চোখের আড়াল হয়েছে, পরখের জন্য তা মোটেও সুখকর হয়নি। নিজ শহরের অলিগলিতে তবুও কোনোভাবে খুঁজে নিয়েছিল পরখ। কিন্তু এই অপরিচিত গ্রামীণ এলাকায় কোথায় খুঁজবে আদ্রিকাকে? এই উন্মাদ মেয়েটি কাউকে কিছু না বলে হটাৎ কোথায় চলে গেলো?
একা একা বাড়ি থেকে বের হতে গেলোই বা কেনো?

সবার শুকনো, চিন্তিত মুখের দিকে তাকিয়ে অধরা খানিকটা সাহস যোগাতে বলল,

‘নিশ্চয়ই আশেপাশে কোথাও আছে। হাঁটতে বেড়িয়েছে হয়তো। একটু খুঁজে দেখলেই পেয়ে যাবো৷ এতো চিন্তা করো না। ছোট বাচ্চা তো নয় যে হারিয়ে যাবে।’

পরখ ঘাড়ে হাত বুলিয়ে চিন্তিত স্বরে বলল,

‘ছোট বাচ্চার হারানোর সম্ভাবনা না থাকলেও ওর হারিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। ওকে তুমি চেনো না।’

জয়নব চোখ রাঙিয়ে বললেন,

‘দাঁড়িয়ে না থেকে আশেপাশে খুঁজে দেখো। রাত নামতেছে। এরপর আর পথঘাট ঠাহর করা যাবে না।’

কাজের লোকসহ বাড়ির পুরুষ সদস্যরা দ্রুত পায়ে বেরিয়ে গেলো৷ অধরাও ছুটল পরখের সাথে।

পশ্চিমাকাশে তখন সূর্য ডুবে গিয়ে খানিকটা রঙ ছড়িয়েছে। ধীরে ধীরে নামছে অন্ধকার৷ পাখিরা নীড়ে ফিরতে শুরু করেছে। ওদের তীব্র চিৎকারে কেঁপে কেঁপে উঠছে পরখের বুক। এই শেষবেলায় এসে নতুন কোনো বিপত্তি না বাঁধলেই হলো। সুস্থ স্বাভাবিক ভাবে বাড়ি ফিরে গেলেই স্বস্তি।

বিপত্তির রাণীকে চোখের আড়াল করাটাই হয়েছে পরখের মস্ত বড় ভুল।

শেষবার যখন পরখে আদ্রিকাকে দেখেছিল, তখন ও কাকির সাথে রান্নাঘরে গল্প করছিল। পরখ কী করে জানবে এর মাঝে হুট করে গায়েব হয়ে যাবে মেয়েটা। অধরার সাথে বাগানের ফল আনতে গিয়েছিল মাত্র, এর মাঝেই আদ্রিকা উধাও।

ব্যাপারটি প্রথমে খেয়াল করেছেন জয়নব। অনেকক্ষণ আদ্রিকাকে দেখতে না পেয়ে ডাক দিয়েছিলেন। সেই থেকে শুরু হলো খোঁজাখুজি।

স্কুল মাঠের দিকে খুঁজতে গিয়েছিলেন ইসহাক। সাথে সাইকেল থাকায় একটু দূর পর্যন্ত খুঁজতে গিয়েছিলেন। যদিও ভেবেছিলেন, আদ্রিকা এতোদূর আসবে না। কিন্তু স্কুলের ফাঁকা মাঠে আদ্রিকর মতো কাউকে বসে থাকতে দেখে ইসহাক যানপরানাই অবাক হলেন।

নিশ্চিত হতে রাস্তা হতে সাইকেলের ঘন্টি বাজালেও আদ্রিকা ফিরে চাইল না৷ ইসহাক সামান্য দ্বিধা নিয়ে ডাক দিলেন,

‘আদ্রিকা, এই আদ্রিকা?’

আদ্রিকা ঘাড় ফিরিয়ে তাকালে ইসকাক নিশ্চিত হয়ে দ্রুত সাইকেল নিয়ে কৃষ্ণচূড়ার গাছের নিচে পৌঁছে গিয়ে প্রশ্ন করলেন,

‘এখানে কী করছ?’

আদ্রিকা কিছু না বলে অলস চোখে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। বাড়ির বৌ-ঝিরা গরু নিয়ে যেতে এসেছে। কয়েকজন ফিরে ফিরে চাইছে আদ্রিকার দিকে। ইসহাক তাড়া দিয়ে বললেন,

‘ওঠো, ওঠো। ওদিকে সবাই তোমাকে খুঁজছে। সাইকেলে বসতে পারবে তো?’

আদ্রিকা আস্তেধীরে মাটি থেকে উঠে দাঁড়ালো। ইসহাকের প্রশ্নের জবাবে ঘাড় কাত করে উত্তর দিয়ে সাইকেলের পেছনে গিয়ে বসল।

বাকিরা সবাই বাড়ির আশেপাশেই ছিল। সাইকেলের ঘন্টির আওয়াজে ওরা বাড়ি ফিরে এসে আদ্রিকাকে জয়নবের পাশে চৌকে বসে থাকতে দেখে স্বস্তির শ্বাস ফেলল। পরখ রেগেমেগে দ্রুত পায়ে আদ্রিকার সামনে দাঁড়িয়ে ধমকে উঠল,

‘কাউকে না বলে কোথায় গিয়েছিলে তুমি?’

আদ্রিকা কিছু না বলে তেমনি মাথা নিচু করে বসে রইলো। পরখ ওর বাহু ধরে ঝাকি দিয়ে বলল,

‘কী হলো? কথা বলছো না কেনো?’

জয়নব বিরক্ত হয়ে বললেন,

‘আহা! ধমকাধমকি করো কেন দাদু ভাই? নাত বউ হাঁটতে বের হইছিল। সন্ধ্যাবেলা গাছগাছালির নিচে বইয়া ছিল। বাতাস লাগছে মনে হয়। আসছে থাইকা থম মাইরা আছে। আমি একটু ঝাড়ফুঁক কইরা দিতেছি। তোমরা যে যার কাজে যাও। বিরক্ত কইরো না।’

পরখ রাগাত্মক চোখের আদ্রিকার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে উপরে নিজের কক্ষে চলে গেল।

রাতে খাবার আগপর্যন্ত জয়নব আদ্রিকাকে নিজের কাছে বসিয়ে রাখলেন। সূরা পড়ে আদ্রিকার গায়ে একটু পর পর ফুঁ দিলেন। আদ্রিকা পুরোটা সময় মাথা নিচু করে বসে কোলের উপর রাখা হাতের দিকে তাকিয়ে রইল।

বারান্দায় শীতল পাটি বিছিয়ে সবাই খেতে বসেছে৷ কালোজিরা চালের নরম পোলাও এর সাথে শোল মাছে ঝোল৷ ঘ্রাণে মৌ মৌ করছে চারপাশ।

আদ্রিকার প্লেটে আরেকটু পোলাও তুলে দিয়ে উর্মি বললেন,

‘পোলাও ভালো লাগছে না, আদ্রিকা? আমরা আবার ঝরঝরে পোলাও খাই না৷ নরম পোলাওটাই বেশি ভালো লাগে। তোমরা যে এভাবে খাও কিনা! জিজ্ঞাসা না করে ওভাবেই রেধে ফেলেছি।’

আদ্রিকা মুখ না তুলেই নিচু স্বরে জবাব দিল,

‘ভালো হয়েছে কাকি।’

উর্মি চিন্তিত দৃষ্টি মেলে পর্তুলিকার দিকে তাকালেন৷ পর্তুলিকা নিজেও বুঝতে পারছে না, উচ্ছ্বসিত মেয়েটার হঠাৎ কী হলো। এসেছে থেকে কেমন ঝিম ধরে আছে। কারো সাথে কথা বলছে না, হাসছে না। সদা উচ্ছল, চঞ্চল মেয়েটির এমন ম্লান মুখ দেখতে কার ভালো লাগে?

খাবার পর জয়নব পরখকে পাকড়াও করে জিজ্ঞাসা করেই ফেললেন,

‘সত্যি কইরা কও তো দাদু ভাই, নাত বউরে তুমি বকাঝকা করছ নাকি?’

পরখ বিস্ময়ে কয়েক মুহূর্ত নির্বাক চেয়ে রইলো। তারপর বলল,

‘আমি ওকে কখন বকলাম? বকবোই বা কেনো?’

‘ধমক দিছো নাকি?’

‘নাহ, দাদী। কিছুই বলিনি।’

‘তাহলে মাইয়াটার হুট কইরা কী হইলো? আসছে থাইকা তোতাপাখির মতোন কলকল কইরা কথা কইতাছিল, এহন হুট কইরা চুপ হইয়া গেলো। দেখতে ভালো লাগে কও? তুমি ঘরে যাও। একটু আদর, সোহাগ দিয়া জিগাও কি হইছে৷ তোমারে কইবো।’

কাহিনি করবে আদ্রিকা, সবার তোপের মুখে পড়তে হবে পরখকে। এ কেমন বিচার? দীর্ঘশ্বাস ফেলে কক্ষে প্রবেশ করলো পরখ।
অবাক হয়ে দেখল, ঘরের বাতি বন্ধ করে ইতিমধ্যে ঘুমিয়ে পড়েছে আদ্রিকা।

পরখ আর বাতি জ্বালালো না৷ অন্ধকারে পা টিপেটিপে বিছানা পর্যন্ত পৌঁছে নিজেও শুয়ে পড়লো। যদিও পরখ ভেবেছিল, ঘুমন্ত আদ্রিকাকে বিরক্ত করা ঠিক হবে না। তবুও মন মানলো না।

পাশ ফিরে আদ্রিকার দিকে ঝুঁকে নিচু স্বরে ডাকল,

‘আদ্রিকা? ঘুমিয়েছো?’

আদ্রিকা কোনো জবাব না দিয়ে বন্ধ চোখে চুপটি করে রইলো। ঘুমিয়েছে নিশ্চিত হয়ে পরখও আর বিরক্ত করলো না। নিজের বালিশে মাথা রেখে চেয়ে রইলো অন্ধকারে।

চলবে…
#অক্ষরময়ী

#পরিণয়ে_নোলককন্যা (কপি নিষেধ)

|৬৩|

গ্রামের ভোর আসে উৎসবের আমেজ নিয়ে।
এই মুহুর্তে সকলের তোড়জোড় দেখে এমনি মনে হচ্ছে আদ্রিকার। ইতিমধ্যে গ্রামের কয়েকজন মহিলা এসে উপস্থিত হয়েছেন৷ চিড়া, মুড়ি ভাজা হবে৷ অধরার সাথে ঢেঁকিতে চাল কুটছে আদ্রিকা। গতকালের মন খারাপের কোনো ছাপ নেই আদ্রিকার মুখে৷ আগের মতো হাসছে, ছুটছে, কলকল করে কথা বলছে৷

‘আপনাদের বাড়ির সামনে এতখানি ফাঁকা জায়গা এভাবে ফেলে রেখেছেন কেনো? ফুলের গাছ লাগাতে পারতেন।’

আদ্রিকার প্রশ্নের জবাবে অধরা বলল,

‘বিশাল উঠোন কয়েকদিন পর ফাঁকা থাকবে না৷ ধান কে/টে এনে উঠোনে রাখা হবে৷ তিল পরিমাণ জায়গা বাকি থাকবে না।’

‘তাহলে বারান্দায় টবে লাগাতে পারেন। আপনাদের বাড়িতে কোনো ফুলগাছ নেই৷ আপনার কি ফুল পছন্দ নয়?’

‘ফুল কার না পছন্দ! আমারও ভীষণ পছন্দের। কিন্তু ইচ্ছে করেই ফুল গাছ লাগাইনি৷ নিজের বাড়ি হোক, তখন লাগাবো।’

ঢেঁকির শেষাংশের কাঠে পা দ্বারা শরীরের ভর দেওয়া থামিয়ে দিয়ে আদ্রিকা অবাক হয়ে তাকালো অধরার দিকে। সবিস্ময়ে বলল,

‘নিজের বাড়ি! এটা আপনাদের নিজের বাড়ি না?’

অধরা মিষ্টি হেসে বলল,

‘এটা আমাদের নিজের বাড়ি। কিন্তু আমার তো নিজের বাড়ি নয়৷ বিয়ে হয়ে গেলে সব ছেড়েছুড়ে চলে যেতে হবে৷ তখন আমার ফুল গাছগুলোর কী হবে? এর থেকে ভালো হয়, যখন স্বামীর বাড়িতে যাবো তখন সেখানেই গাছ লাগাবো৷ যদিও স্বামীর বাড়িকে নিজের বাড়ি দাবী করার মধ্যেও কিন্তু আছে। তবুও স্বামীর বাড়িটাই মেয়েদের আসল বাড়ি৷ স্থায়ী ঠিকানা।’

চাল থেকে আটা তৈরি হয়ে গেছে৷ রান্নাঘরের একপাশে ঢেঁকি রাখা ছিল৷ আদ্রিকা রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এসে ভাবতে লাগল,
পরখ চলে গেলে ও বাড়িটা ছেড়ে দিতে হবে। তখন আদ্রিকার গাছগুলোর কী হবে? বাবার বাড়িতে নার্সারি আছে৷ আদ্রিকা সেখানে শখ করে গাছও লাগিয়েছিল। যার পরিণতি সে নিজের চোখে দেখেছে। শখের বনসাইটি আজ আদ্রিকার কাছে নেই৷ উপযুক্ত দাম পাওয়া মাত্র আদ্রিকার শখকে বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে৷ অতএব আদ্রিকার গাছ বাবার বাড়িতে নিরাপদ নয়৷
একটা শ্বশুরবাড়ি আছে৷ সেখানে রাখা যায়। কিন্তু পর্তুলিকার এতো এতো গাছ যে ও বাড়িতে আর কোনো ফাঁকা জায়গা অবশিষ্ট নেই৷
বাকি রইলো স্বামীর বাড়ি, যা আদ্রিকার কপালে নেই৷

গাছগুলোর ভবিষ্যৎ ভাবতে গিয়ে আদ্রিকার আবার মন খারাপ হয়ে গেল৷

বারান্দায় বসে কয়েকজন মহিলার সাথে পিঠা বানাচ্ছিলেন পর্তুলিকা৷ আদ্রিকা গিয়ে পর্তুলিকার পাশে বসে আদুরে স্বরে ডাকল,

‘পিউ মা?’

গতকাল আদ্রিকার চুপ হয়ে যাওয়াতে সবাই ভয় পেয়ে গিয়েছিল। আজ খুব সকালে আদ্রিকাকে ঘুম থেকে উঠে আবারও চঞ্চল প্রজাপতির মতো ছুটতে দেখে স্বস্তি ফিরে পেয়েছেন পর্তুলিকা। মিষ্টি হেসে আদ্রিকার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,

‘কী হয়েছে?’

আদ্রিকা তার ডাগর ডাগর চোখে অপরিসীম মায়া নিয়ে পর্তুলিকার দিকে তাকিয়ে বলল,

‘ও বাড়িতে আমার অনেকগুলো ফুলগাছ আছে। পরখ চলে গেলে বাড়িটা তো আমাদের ছেড়ে দিতে হবে। আমার গাছগুলো তোমাদের বাড়িতে রাখতে দিবে?’

আদ্রিকার কথা বুঝতে না পেরে পর্তুলিকার ভ্রু কুঞ্চিত হলো৷ সন্দিহান গলায় বললেন,

‘পরখ চলে গেলে তুমি আমাদের সাথেই থাকবে৷ সেই সাথে তোমার জিনিসপত্রও থাকবে আমাদের বাড়িতে। তবে গাছগুলো নয় কেনো!’

‘ওতোগুলো গাছ রাখার জায়গা হবে?’

‘সে যখন গাছ আনা হবে তখন এমনিতেই জায়গা তৈরি করে নেওয়া যাবে। ওসব নিয়ে এখনি ভাবার দরকার নেই। মাসের অর্ধেক এখনো পরে আছে।’

গাছগুলোর একটা গতি হওয়ায় আদ্রিকার মন থেকে বিশাল ভার নেমে গেল৷ সে নিশ্চিত মনে আবার ফিরে গেলো রান্নাঘরে৷

*****

সারাদিন আদ্রিকার দেখা পায়নি পরখ। সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখেছে বিছানার অপরপাশ ফাঁকা। নাস্তা খেতে বসেও আদ্রিকার দেখা মিলেনি৷ মহিলারা আজ বোধহয় রান্নাঘরেই নাস্তা করেছে৷ দুপুরবেলাও বাবা, চাচার সাথে খেতে হলো পরখকে৷ রান্নাঘর থেকে খাবার নিয়ে এলো উর্মি, অধরা৷ আদ্রিকা একবারও বাইরে এলো না৷

পরখের মনে হলো আদ্রিকা ইচ্ছে করেই ওকে এড়িয়ে চলছে৷ কিন্তু কেনো? হঠাৎ আবার কি হলো? উত্তর জানতে রাত পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে পরখকে৷

কাল সকালে ওরা বাড়ি ফিরে যাবে৷ তাই এ বাড়িতে উৎসব শুরু হয়ে গিয়েছে। কাজের লোকের সাথে যুক্ত হয়েছে পাশের বাড়ির মহিলারা৷ পিঠা, পায়েশের আসর বসেছে৷ মুড়ি, চিড়া, শাকসবজি, ফলমূল সবকিছু আলাদা করে বস্তায় ভরা হচ্ছে৷ এসব কিছু শহরে পাঠানো হবে৷ পরখ ভেবে পাচ্ছে না, এতো কিছুর জায়গা গাড়িতে কীভাবে হবে?

সারাটা দিন বাবা, চাচার সাথে কেটে গেল পরখের। অবশেষে রাতের খাবারের পর নিজের কক্ষে আদ্রিকার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে পরখ৷ রাত গভীর থেকে গভীরতম হচ্ছে৷ অথচ আদ্রিকার দেখা নেই। পরখ এবার নিশ্চিত হলো, আদ্রিকা তাকে এড়িয়ে চলছে।
নিশ্চিত হওয়া মাত্র বিছানা ছাড়লো পরখ। নাহ, এভাবে চলতে পারে না৷ আদ্রিকার মনে কী চলছে জানতে হবে৷

সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে রান্নাঘরে উঁকি দিল পরখ৷ বাড়ির মহিলাদের এতো রাত অব্দি জেগে থাকতে দেখে সে অবাক হলো৷

পর্তুলিকার দিকে তাকিয়ে হতভম্ব পরখ বলল,

‘এতো রাত অব্দি তোমরা রান্নাঘরে কী করছো?’

পর্তুলিকা বললেন,

‘পিঠা তৈরির কাজ গুছিয়ে রাখছি। যাতে সকালে উঠে দ্রুত পিঠা ভেজে ফেলা যায়।’

পরখ দু হাত বুকে ভাঁজ করে সবার ক্লান্তিহীন হাসি মুখ দেখল। বিশেষত সে তাকিয়ে রইলো আদ্রিকার দিকে৷ যে পরখের দিকে পিঠ করে বসে আছে জ্বলন্ত চুলার সামনে৷ একবারও পরখের দিকে ফিরে পর্যন্ত চাইছে না৷

পরখ ওভাবেই দাঁড়িয়ে থেকে প্রশ্ন করলো,

‘তোমাদের ঘুম পাচ্ছে না?’

জবাব দিলেন উর্মি। বললেন,

‘আমাদের এখনি ঘুম আসছে না৷ তোমার যদি বউ ছাড়া ঘুম না আসে, তবে এই যে তোমার বউ। যাও, নিয়ে যাও।’

উর্মির কথায় মহিলারা গা দুলিয়ে হেসে উঠলো। আদ্রিকাও ঘাড় ফিরিয়ে একনজর পরখের দিকে তাকিয়ে আবারও সামনে ফিরল। ভীষণ লজ্জা পেলো পরখ৷ মিনমিন করে বলল,

‘আমি এমনিতেই খোঁজ নিতে এসেছিলাম৷ এতো রাত পর্যন্ত কে রান্নাবান্না করে! তোমরা পারোও বটে। করো যা ইচ্ছে।’

পরখ ফিরে গিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লো। মহিলাদের আড্ডার মাঝখানে প্রবেশ করাটাই ভুল হয়েছে। এরা ভয়ংকর মশকরা করতে পারে।

দুধচিতই পিঠা তৈরি করা হচ্ছিল। দুটো চুলায় আ/গুন জ্ব/লছে৷ চুলার উপরে বসানো মাটির খোলা।একটি মাটির খোলায় পাঁচটি গর্ত৷ সেখানে আটার গোলা দিয়ে চিতই পিঠা তৈরি করছে আদ্রিকা এবং পর্তুলিকা। পাশে বসে নারকেল কুরনি করছিলেন উর্মি। শেষ হওয়া মাত্র বললেন,

‘ রাত অনেক হয়েছে। তোমরা ঘুমাতে যাও। অল্প একটু আছে। এগুলো আমি করে নিচ্ছি৷’

পর্তুলিকা হাঁপিয়ে উঠেছেন। সবার সাথে মিলেমিশে কাজ করার সময় এতোটাও বুঝতে পারেননি৷ কিন্তু এখন কোমরে খিল ধরে গেছে৷ তিনি উঠে আড়মোড়া ভেঙে বললেন,

‘কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে নেই৷ সকালে আবার জার্নি করা লাগবে। চলো আদ্রিকা।’

আদ্রিকা ঠোঁট ফুলিয়ে বলল,

‘আমার ঘুম কেটে গিয়েছে। আরেকটু থাকি৷ ঘুম আসলেই ঘুমাতে যাবো।’

উর্মি হেসে বললেন,

‘এখন শখে শখে কাজ করছো৷ পরে মজা বুঝবে৷ সারা শরীরে ব্যথা ধরে যাবে।’

‘কিছু হবে না, কাকি। আমার ভীষণ মজা লাগছে।’

আদ্রিকার চোখে মুখে উচ্ছ্বাস দেখে পর্তুলিকা জেদ করলেন না৷ চলে গেলেন নিজের কক্ষে৷ পাশের বাড়ি মহিলারাও মাঝরাতে ফিরে গেছে৷ রান্নাঘরে আদ্রিকা, উর্মি একলা। অধরাও কোন ফাঁকে যেনো নিজের বিছানায় ঘুমিয়ে পড়েছে।

উর্মি বললেন,

‘শুধু শুধু কষ্ট করছো। ঘুমাতে গেলেই পারতে৷ সারারাত কেউ জাগে!’

আদ্রিকা বলল,

‘আপনিও তো জেগে আছেন।’

‘আমার অভ্যাস আছে।’

‘আমারও রাত জাগতে ভালো লাগছে। জাগলাম না হয় একটা রাত৷ আর কখনও এই সুযোগ কি পাবো? পাবো না। একটা দারুণ অভিজ্ঞতা হচ্ছে।’

রান্নাঘরের এলোমেলো আসবাবপত্র গুছিয়ে উর্মি বললেন,

‘দুধ দোয়াতে হবে৷ আমি গোয়ালঘরে যাচ্ছি৷ তুমি একা ভয় পাবে না তো?’

‘উহু। আপনি যান। আমি আছি।’

‘ভয় পেলে বলো। অধরাকে ডেকে দিচ্ছি।’

‘আপু ঘুমাচ্ছে, ঘুমাক। আমি পারবো।’

উর্মি চলে গেলে আদ্রিকা হাঁটুতে মুখ গুজে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। কক্ষে যেতে ইচ্ছে করছে না৷ নিজেকে সামলাতে আদ্রিকার কিছু সময় দরকার। এই ভীড়ের মাঝেও আদ্রিকা একাকীত্ব অনুভব করছে৷ যা নিজেকে সামলাতে, নিজের সাথে বোঝাপড়া করতে খুব দরকার ছিল।

জ্বলন্ত আগুনের শিখার দিকে তাকিয়ে আদ্রিকা নিজেকে নিয়ে ভাবতে শুরু করলো৷ একদম শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ভাবতে ভাবতে চোখজোড়া সিক্ত হয়ে এলো আদ্রিকার।
চোখ বেয়ে অনবরত ঝরতে থাকা অশ্রুকে সাথে নিয়ে আদ্রিকা খোলা থেকে পিঠা তুলল, আবার নতুন আটার গোলা দিল খোলায়।

ভোরের দিকে ঘুম ভাঙল পরখের। পাশের ফাঁকা স্থানটি দেখে সামান্য বিরক্ত হলো সে। আদ্রিকা এখনো কক্ষে আসেনি! কী আশ্চর্য! ঘুম ঘুম চোখে পরখ বিছানা ছেড়ে আবার রান্নাঘরের দুয়ারে এসে দাঁড়াল। চুলার সামনে মূর্তমান আদ্রিকাকে দেখে পরখ কিছুক্ষণ থমকে দাঁড়িয়ে রইলো৷ যে রাগ, ক্ষোভ নিয়ে সে এসেছিল তা ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেলে আলতোভাবে ডাকল,

‘আদ্রিকা?’

পরখের হঠাৎ আগমনে আদ্রিকা চমকে উঠল। দ্রুত হাতে চোখের জল মুছে পেছন না ফিরেই জবাব দিল,

‘হুম।’

পরখের কপালে ভাঁজ পড়ল সামান্য। এভাবে মুখ ঘুরিয়ে রেখে কথা বলছে কেনো? সবাই নিজের কক্ষে চলে গেছে আদ্রিকা একাই রান্নাঘরে বসে মহা ব্যস্ততা দেখাচ্ছে। জগতের সব পদ রান্না করে ইতিহাস গড়ে ফেলবে নাকি! পরখ বিরক্ত হয়ে বলল,

‘সারারাত ধরে রান্নাঘরে কী এতো রান্না করছো! আজকে আমাদের ফিরতে হবে। একটু রেস্টও নিলে না৷ তোমার ঘুম পাচ্ছে না? ঘুমাতে এসো।’

আদ্রিকা গলার স্বর স্বাভাবিক রাখার সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা করে বলল,

‘একটু পরেই আসছি।’

হুম বলে নাখোশ পরখ পা ঘুরিয়ে চলে যেতে গিয়েও থামল। ঘুরিয়ে দাঁড়িয়ে সন্দিহান গলায় প্রশ্ন করল,

‘তুমি কি কাঁদছ?’

আদ্রিকার ঘাড় ফিরিয়ে একটুখানি তাকালো। যদিও মুখের অর্ধেকটা হাতের বাহু দ্বারা ঢেকে আছে। শুধু টলটলে চোখ দুটো দেখতে পেলো পরখ৷ জোর করে সামান্য হেসে আদ্রিকা বলল,

‘না তো। কাঁদব কেনো?’

তাই তো। আদ্রিকা কাঁদবে কেনো? কাঁদার জন্য কোনো কারণ খুঁজে পেল না পরখ। আরও কিছুক্ষণ আদ্রিকার চোখের দিকে তাকিয়ে থেকে পরখ ফিরে গেল নিজের কক্ষে। আদ্রিকার অপেক্ষায় থাকতে থাকতে একসময় আবার ঘুমিয়ে পড়লো।

*****

সকালে নাস্তার কিছুক্ষণ পরেই গ্রাম থেকে বিদায় নিতে হয়েছে পরখদের৷ বিদায়কালে জয়নব বারবার বলেছে,

‘আবার আসিও, নাতবউ। পরীক্ষার পর বেশি সময় নিয়ে আসিও। আমি বুড়ি মানুষ। আমাকে কেউ দেখতে আসে না। তুমি আসিও।’

আদ্রিকা অবশ্য ভেবেছে, সে মাঝেমধ্যেই গ্রামে এসে ঘুরে যাবে। পরখ চলে গেলে এমনিতেও শহরে আদ্রিকার তেমন কোনো প্রয়োজন নেই। ওই রেস্তোরায় কাজটুকু ছাড়া আদ্রিকার কিইবা করার আছে। ওসব লেখাপড়া আদ্রিকার ভালো লাগে না। একবার পরীক্ষার ঝামেলা মিটে গেলে সে মুক্ত পাখির মতো উড়ে বেড়াবে।

বাড়ি ফিরে পর্তুলিকার লেজ ধরে ঘুরে বেড়াচ্ছে আদ্রিকা। অন্তত পরখের তাই মনে হলো। আদতে এমন কিছুই আদ্রিকা করেনি৷ গ্রাম থেকে আনা জিনিসপত্র গুছিয়ে রাখতে পর্তুলিকাকে সাহায্য করছে মাত্র। কিন্তু পরখের সেসব সহ্য হলো না। সে বিকালের দিকে ঘোষণা করলো, সে বাড়ি ফিরবে৷ ও বাড়িতে তার গোছগাছ এখনো বাকি৷ পরশু ফ্লাইট। লাগেজও গুছাতে হবে।

পর্তুলিকা ভাবলেন, লম্বা সময়ের জন্য পরখ বিদেশে পাড়ি জমাবে। পরখ-আদ্রিকার কিছু একান্ত মুহূর্তের প্রয়োজন আছে৷ তাই রাজি হয়ে গেলেন।

আদ্রিকার সাথে আলাপ আলোচনার প্রস্তুতি নিয়ে পরখ বাড়ি ফিরল। কিন্তু ভাগ্য বোধহয় সুপ্রসন্ন ছিল না৷ রুমি কল দিয়ে জরুরি তলব করল। রেস্তোরাঁর শেয়ারের কিছু আইনি জটিলতা তখনো বাকি৷ প্রয়োজনটা যেহেতু পরখের বেশি, তাই আদ্রিকাকে বাড়িতে নামিয়ে দিয়ে পরখ চলে গেল রেস্তোরাঁয়।

উকিল, কোর্ট দৌড়াদৌড়ি করে বাড়ি ফিরতে ফিরতে রাত গড়িয়ে গেল। কিন্তু এই রাত পরখের জন্য নতুন চমক নিয়ে অপেক্ষা করছিল, পরখ তা জানত না।

আকাশে আজ পূর্ণিমার সম্পূর্ণ চাঁদ৷ উজ্জ্বল আলোর নিচে ছাদে শীতলপাটি বিছিয়ে আসন পেতে বসে আছে আদ্রিকা৷ মুখ উঁচু করে তাকিয়ে আছে আকাশের দিকে৷ আদ্রিকার গায়ে হালকা মিষ্টি রঙের একটা শাড়ি। এই আদুরে রঙের বদৌলতেই বুঝি আদ্রিকাকে ভীষণ মিষ্টি দেখাচ্ছে।

পরখ আর ঘরের দিকে গেল না। বাইকের চাবিটা হাতের মুঠোয় চেপে ধরে আদ্রিকার দিকে এগিয়ে গেল৷ শীতলপাটির এককোণায় বসে আদ্রিকার উদ্দেশ্যে বলল,

‘ছিমছাম চমৎকার আয়োজন করেছো দেখছি। আমি তো ভাবলাম, চলে যাওয়ার আগপর্যন্ত আমাকে বুঝি এড়িয়ে চলবে।’

আকাশ হতে দৃষ্টি ফিরিয়ে আদ্রিকা পরখের দিকে চেয়ে ঠোঁট চেপে চমৎকার হাসি হেসে বলল,

‘কী আজব! আপনাকে এড়িয়ে চলবো কেনো? গল্প করবো বলেই শীতলপাটি বিছালাম।’

পরখের মনে হলো, এই মিষ্টি হাসিতে আনন্দের থেকেও বেশি দুঃখ মেশানো।

পরখের অনুসন্ধানী সূক্ষ্ণ দৃষ্টির সামনে আদ্রিকা মিইয়ে গেল না। উলটো ভীষণ আগ্রহ নিয়ে শুধালো,

‘একটু আগে স্বপ্নীল চক্রবর্তীর একটি চমৎকার কবিতা পড়লাম৷ আমার অবস্থানের সাথে খাপে খাপ মিলে গেছে। যেনো তিনি আমাকে নিয়েই কবিতাটি লিখেছেন। আপনাকে আবৃত্তি করে শোনাই?’

পরখ ভেবেছিল, সে চলে যাচ্ছে বলে অতি শোকে আদ্রিকার মাথার কোনো একটি নার্ভ বোধহয় দূর্বল হয়ে পড়েছে। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, নাহ। সবই ঠিক আছে। পরখ শুধু শুধু চিন্তা করছিল।

ছাদে ফুরফুরে হাওয়া বইছে। ক্লান্ত, ঘর্মাক্ত শরীরে শীতলতা ছড়াচ্ছে স্নিগ্ধ বাতাস। শার্টের উপরের দুটো বোতাম খুলে দিয়ে এক কনুইয়ে ভর দিয়ে শুলো পরখ৷ আদ্রিকার মুখের দিকে চেয়ে নির্বিকার গলায় বলল,

‘কোন কবিতা? শোনাও দেখি।’

পরখের চোখে চোখ রেখে আদ্রিকা আবৃত্তি করল,

“তোমাকে অন্য কারো সাথে হাঁটতে দেখার মতো বিরক্তিকর এইসব দিন-
ঘামের স্রোতে ভিজে গেছে অজস্র স্মৃতিকথা
প্রাণের সাথে প্রাণ জুড়োনো দুতিনশো কবিতার লাইন।

যেভাবে থাকো, সেভাবেই ভালোবাসি
যেভাবে যাও- সেভাবেই মেনে নিই।

তবুও বৃষ্টি আসে, একসাথে মাথাব্যথা হয়।”

আদ্রিকার অশ্রুসিক্ত ডাগর আঁখি, কণ্ঠের সীমাহীন বেদনা, ঠোঁটের কোণে হৃদয় নিংড়ানো একচিলতে হাসি দেখে পরখের মুখের রঙ উড়ে গেলো৷ ফ্যাকাসে চেহারায় সে তাকিয়ে রইলো আদ্রিকার দিকে৷

একটা মেয়েকে এভাবে ভেঙেচূড়ে দেওয়ার মতো এমন কী জঘন্য অপরাধ পরখ করেছে? মনে পড়ছে না কেনো?

পরখ দ্রুত ভাবতে লাগল। সে চলে যাবে বলে আদ্রিকা এতো কষ্ট পাচ্ছে? নাহ। তা হবে কেনো? আদ্রিকা আগে থেকে জানতো, এমন দিন আসবে। পরখ বারবার সতর্ক করেছিল। আদ্রিকাও মেনে নিয়েছিল৷

তবে আজ আদ্রিকার চোখে মুখে এ কোন বেদনার ছাপ?

পরখ কিছু বলতে যাচ্ছিল তার আগেই আদ্রিকা খানিকটা এগিয়ে এসে পরখের মাথাটা নিজের কোলে রেখে নিচে ঝুঁকে পরখের কপালে ছোট্ট একটি চুমু দিয়ে পরখকে আরও ভড়কে দিল।

পরখ দ্রুত উঠে বসতে চাইল। কিন্তু আদ্রিকা দু হাতে পরখের গলা জড়িয়ে রেখে পরখকে আটকে দিল। দ্বিধান্বিত পরখ নিজের বুকের উপর ছড়ানো আদ্রিকার হাত দুটো জড়িয়ে ধরে এমন অদ্ভুত আচরণের কারণ জানতে চাইল।

‘হেই আদ্রিকা, হোয়াট হ্যাপেন্ড? ডিড আই ডু সামথিং রং? ইউ আর স্কেয়ারিং মি।’

*****

জীবনে এমন কিছু মুহূর্ত আসে যখন মন, মস্তিষ্ক কোনোটাই আমাদের নিয়ন্ত্রণে থাকে না। হুটহাট কিছু অযাচিত কাজকর্ম করে ফেলে আমরা নিজেই লজ্জায় পড়ে যাই৷ উত্তপ্ত মস্তিষ্কের দপদপানি থেমে গেলে নিজেই নিজেকে শুধাই, এই কাজটি আমি কেনো করলাম? ছি! ছি! কী লজ্জা!

আদ্রিকার এই মুহূর্তে তেমনি অনুভব হচ্ছে। সে আকাশের দিকে তাকিয়ে বুক ভরে শ্বাস নিল। দীর্ঘসময় ধরে সেই শ্বাস ছেড়ে নিজেকে সামলে নিল। পরখের দিকে তাকিয়ে বলল,

‘স্যরি। এই কিস করার প্ল্যান ছিল না। অটোমেটিক হয়ে গেছে৷’

পরখ পুরোটা সময় আদ্রিকাকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছিল। এতো সময়ের মাঝে টালমাটাল মেয়েটির এই অদ্ভুত কথাটি পরখের পরিচিত মনে হলো। সে হেসে বলল,

‘তুমি একটা চুমু খাওয়ার জন্য স্যরি বলছো! লাইক সিরিয়াসলি!’

আদ্রিকার মুখে আঁধার নামলো হুট করে। এক চিলতে মেঘে ঢেকে গেল রোদ্দুর। পরখের এলোমেলো চুলে হাত বুলিয়ে আদ্রিকা বেশ গম্ভীর স্বরে বলল,

‘আপনার সাথে আমার কিছু কথা ছিল, পরখ।’

এটারই অপেক্ষা করছিল পরখ। উঠে বসতে চাইলে আদ্রিকা দু হাতে পরখের মাথা ঠেসে ধরে বলল,

‘এতো নড়াচড়া না করে চুপচাপ শুয়ে থাকুন।’

আদ্রিকার ধমকে পরখ থমথমে খেয়ে গেল। হতবুদ্ধি হয়ে শুধাল,

‘কথা বলবো কীভাবে?’

‘আপনাকে কিছু বলতে হবে না। আপনি শুধু আমার কথা শুনুন।’

সুবোধ বালকের মতোন পরখ মাথা দুলালো। পরখের চুলে বিলি কাটতে কাটতে আদ্রিকা বলল,

‘আপনার সাথে পরিচয় হওয়ার আগে আমার দুনিয়াটা খুব ছোট ছিল। ছোটবেলা থেকে মা, চাচিকে দেখে এসেছি একনিষ্ঠভাবে সংসার করে আসছেন। একসময় আমার জীবনের লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ালো সংসারী হবো। পড়ালেখা, ক্যারিয়ার এসব আমাকে কখনো টানেনি। আদ্রতা আপুকে টেনেছিল। একই বাড়ির দুজন সদস্য। স্রোতের একদিকে গেছে আদ্রতা, অন্যদিকে আদ্রিকা।
আদ্রতা আপুর সাথে মাহিন ভাইয়ার বিয়ে হবে, তারপর আমিও বিয়েশাদি করে জমিয়ে সংসার করবো। শুনতে হাস্যকর হলেও বিয়ে ব্যাপারটা বুঝার পর থেকেই আমি বিয়ে করতে চাইতাম। সংসার করবো বলে।’

নিজের কথায় আদ্রিকা নিজেই বিদ্রুপের হাসি হাসল। চাঁদের মায়াবী আলো এবং ছাদের কিনারায় বৈদ্যুতিক বাতির হালকা আলোতে সে হাসি বড্ড মলিন ঠেকল পরখের নিকট। একটু থেমে আদ্রিকা আবারও বলল,

‘একসময় বিস্ময় এলো আমার জীবনে। আমি ভাবলাম বিয়ে তো একসময় করবোই, তবে যে আমাকে চাইছে তাকেই নয় কেনো? বিস্ময় আমাকে কতো ভালোবাসে! আমার আগে পিছে ঘুরে, আমার ইনসিকিউরিটি সলভ করতে সাহায্য করে, আমাকে বাড়ি পৌঁছে দেয়, রেস্টুরেন্টে নিয়ে যায়, ঘুরতে নিয়ে যায়। আমি তো এমনি একটা সাধারণ জীবন চেয়েছিলাম।’

বিস্ময়কে নিয়ে কিছু শুনতে ইচ্ছে করছিল না পরখের। মুখ তেতো হয়ে আসছিল। বিরক্ত হয়ে বলল,

‘তুমি এখনো আগ্রহ নিয়ে বিস্ময়ের ব্যাপারে কথা বলতে পারছ! তুমি বলতে পারলেও আমি শুনতে পারছি না।’

পরখের ঠোঁটের উপর তর্জনী চেপে ধরে মুখ হুশ শব্দ করলো আদ্রিকা। হতবাক পরখ অবাক চোখে দেখল আদ্রিকার কর্মকাণ্ড। কী করতে চাইছে মেয়েটা? আদ্রিকা অবশ্য থেমে রইলো না। ক্রমাগত বলে গেল।

‘জীবনের কঠিন অধ্যায় সম্পর্কে আমার তখনো অতো ধারণা ছিল না৷ কতোটুকুই বা দেখেছি আমি! বিশাল সমুদ্রের এক ফোটা জলের মতো ছিল আমার অভিজ্ঞতার ঝুলি৷ এরপর বিস্ময় সেখানে নর্দমার ময়লা ছিটিয়ে দিয়ে গেল। ভেতরে ভেতরে প্রচন্ড ভেঙে পড়েছিলাম। কিন্তু নিজের দুঃখ, কষ্ট নিয়ে যে একটু শোক করবো সেই সুযোগ আমার ছিল না। আপু পালিয়ে গেল, মা ভেঙে পড়লো, বাড়িতে অরাজকতা – সব মিলিয়ে আমি নিজেকে নিয়ে ভাবার খুব একটা সময় পাইনি৷ এখন মনে হয়, বাড়িতে ওমন ঝামেলা হয়ে ভালোই হয়েছিল। না হলে আমি শোক সামলে উঠতাম কী করে!’

আদ্রিকা আবারও একটুখানি হাসল। কোলের উপর রাখা পরখের মাথার চুলগুলো দুহাতে এলোমেলো করে দিয়ে মিষ্টি হেসে বলল,

‘এরপর আপনি এলেন আমার জীবনে। হুট করে আপনার সাথে বাবা আমার বিয়ে দিয়ে দিলেন। আমার বাবা এই একটা ভালো কাজ করেছেন জীবনে। প্রথমে আমার খুব ভয় লেগেছিল। বিস্ময়ের সাথে আমার রিলেশনশিপের ব্যাপারটা আপনি জানেন৷ এরপর আপনি কীভাবে রিয়েক্ট করবেন কে জানে! আমার বাড়িতে যদি বলে দেন! এই ভয়ে সবসময় তটস্থ থাকতাম। কিন্তু ধীরে ধীরে কীভাবে যেনো মানিয়ে নিলাম। শুরুটা অবশ্য এই সংসারে থিতু হওয়া দিয়ে হয়েছিল। ওই যে আজন্ম আমার একটা সংসারের লোভ ছিল। সংসার পেয়ে আমি সব ভুলে গেলাম। স্বামীর থেকেও বেশি স্বামীর সংসার আমার পছন্দ হয়ে গেল। তবে আপনি মানুষটা ততোটাও খারাপ নন, পরখ। আমাকে এতোদিন সহ্য করাটা কী কম ভালো মানুষি!’

পরখ ভীষণ অবাক হলো। বলল,

‘তোমার আমাকে ভালো মানুষ মনে হচ্ছে? কোন উপকারের প্রতিদান স্বরূপ যাওয়ার আগে এতো প্রশংসা করছো?’

পরখের মুখ এক হাতে চেপে ধরে আদ্রিকা বলল,

‘একদম চুপ করে থাকুন৷ কোনো কথা বলবেন না। ঝগড়া বাধানোর চেষ্টাও করবেন না৷ আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি, এই বিদায়লগ্নে আপনার সাথে আমি আর কোনোপ্রকার ঝগড়া করবো না৷’

মুখ বন্ধ থাকায় হাত দ্বারা পরখ ইশারায় জানালো, উত্তম সিদ্ধান্ত। পরখের মুখ থেকে হাত সরিয়ে আদ্রিকা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। কেমন অন্যমনষ্ক হয়ে দূর অন্ধকারে তাকিয়ে থেকে বলল,

‘মাঝেমধ্যে আপনার মহত্ববোধ আমি রিয়েলাইজ করতে পারলেও, আমি নিজে কতোটা স্বার্থপর সেটা আগে কখনো ফিল করেনি। কী অদ্ভুত না? নিজের দোষটা আমরা সহজে চিহ্নিত করতে পারি না।’

বারকয়েক চোখের পলক ফেলে পরখ আদ্রিকাকে দেখল। উল্টোদিক থেকে দেখতে একটু নয়, অনেকটাই অসুবিধা হচ্ছে। ঠিকঠাক চেহারা পড়া যাচ্ছে না। এজন্যই বোধহয় আদ্রিকা পরখকে সোজা হয়ে বসতে দিচ্ছে না।

এলোমেলো চেয়ে চোখের জলকে বাঁধা প্রদান করে আদ্রিকা মুখ ফেরালো। তবে ভুল করেও পরখের চোখের দিকে তাকালো না। পরখের কুচকুচে কালো চুলে সমস্ত মনোযোগ একাগ্র করে আদ্রিকা বলল,

‘সেদিন আমি বারান্দা ধরে ছুটে যাচ্ছিলাম পিউ মায়ের ঘরে। অধরা আপুর সাথে আপনি বাগান থেকে ফিরছিলেন। হাতে পাকা বেল। আমি একনজর তাকালাম আপনাদের দিকে৷ দাদীর কথাটা মনে পড়লো। অধরা আপুর সাথে আপনার বিয়ে ঠিক করা ছিল। কী সুন্দর জুটি হতো আপনাদের!’

‘ওটা দাদীর ইচ্ছে ছিল। আমাদের নয়। আমরা কখনো সিরিয়াসলি নেইনি।’

অত্যন্ত রূঢ় কণ্ঠে তৎক্ষণাৎ জবাব দিল পরখ। এই বিষয়ে কথা বলতে প্রচন্ড বিরক্তবোধ করে সে। বিষয়টি খুবই বিব্রতকর। অধরাকে সে কখনো ওমন চোখে দেখেনি। সবসময় কাজিন হিসেবেই স্নেহ করে এসেছে।

পরখের বিরক্তিতে আদ্রিকা নিজেও সম্মতি জানিয়ে বলল,

‘আমিও সেটাই ভাবলাম। দাদী বললেই হলো নাকি! আপনি তো কখনো চাননি৷ অধরা আপু খানিকটা চেয়েছিল বোধহয়। কিন্তু আমাদের বিয়ের সমাচারে নিজেকে সুন্দরভাবে সামলে নিয়েছে। নিজের দুঃখকে আড়াল করে আমাকে কাছে টেনে নিয়েছে৷ চমৎকার একজন মানুষ উনি।’

‘তবে তোমার চেহারায় এই দুঃখের ছাপ কীসের?’

পরখের প্রশ্নের জবাবে আদ্রিকার দুপাশে মাথা দুলালো। আগের মতোই দৃষ্টি লুকিয়ে বলল,

‘আপনাদের জন্য আমার কোনো দুঃখ নেই। দুঃখ আমার নিজেকে নিয়ে৷ ওই যে আপনার ঠোঁটের কোণে একটুখানি বেলের আঁশ লাগল, অধরা আপু সযত্নে মুছে দিলেন শাড়ির আঁচলে। আমি অনেকখানি দুরত্বে দাঁড়িয়েও স্পষ্ট দেখলাম। আমার কেমন দম বন্ধ হয়ে এলো। আপনাকে অন্য কেউ ছুঁয়ে দিলো, এটা আমি মানতেই পারলাম না। হোক একটুখানি ছোঁয়া। তবুও ছুঁয়েছে তো। কেনো ছুঁবে? আমার মনে হলো সারা গা জ্ব/লে পু/ড়ে যাচ্ছে। আমি স্থির থাকতে পারছিলাম না। থেকে থেকে রাগ ভেসে উঠছিল। মনে হচ্ছিল, সবকিছু তছনছ করে দেই৷ কখনো রাগ লাগছিল, কখনো উদাস লাগছিল। কী অদ্ভুত সে অনুভূতি! স্থির থাকতে না পেরে আমি হাঁটতে শুরু করলাম। হাঁটতে হাঁটতে কতোদূর চলে গিয়েছি!

সবুজ ঘাসের উপর বসে আমার হঠাৎ মনে হলো, আমি এমন করছি কেনো? যে আমার তাকে অন্য কেউ ছুঁয়েছে বলে আমার এমন অস্থির লাগছে, রাগ হচ্ছে? ওইটুকু ছোঁয়াতে কী হয়ে যায়? খানিক পরেই তো সব চিহ্ন মুছে যায়।

কিন্তু মুছলো না। সারারাত আমি জেগে জেগে আপনাকে দেখলাম৷ ওই তো ঠোঁটের কোণে লেগে আছে হাতের ছোঁয়া৷ আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি।

তারপর আমি রিয়েলাইজ করলাম, আপনার কষ্টটা৷ ওই মধ্যরাতে আমি নিজেকে দাঁড় করালাম আপনার জায়গায়। আপনাকে কেউ একটুখানি ছুঁয়েছে বলে আমার যদি এতোটা কষ্ট হয় তবে আমার অতীত জানার পর আপনার কতোটা কষ্ট হয়েছে! আমার অতীত জেনেও দিনের দিনের পর আমার সাথে একই বাড়িতে থাকতে আপনার কতোটা কষ্ট হয়েছে! আমি যখন জোরজবরদস্তি করে আমার কাছে গিয়েছি তখন আপনার কতোটা যন্ত্রণা হয়েছে। সেদিন আপনি ছিলেন এই বাড়িতে, আপনি সব জানতেন। সব জেনেবুঝে আমার কাছাকাছি আসতে আপনার…’

আর উচ্চারণ করতে পারলো না আদ্রিকা। কান্নার দমকে কথা আটকে গেল। শব্দরা হারিয়ে গিয়ে স্পষ্ট হলো হিঁচকি। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকল সে।

পরখ হকচকিয়ে গিয়ে মুখ উঁচু করে আদ্রিকার দিকে তাকাতে চাইলে আদ্রিকা দু হাতে ঢেকে ফেলল পরখের চোখ৷ ক্রন্দনরত অবস্থায় অস্পষ্ট স্বরে বলল,

‘আপনি তাকাবেন না প্লিজ। আমার একদম কান্না করার প্ল্যান ছিল না। একদম ছিল না।’

পরখ কী বলবে, কীভাবে সান্ত্বনা দিবে ভেবে পাচ্ছিল না। শুধু নিজের চোখের উপর রাখা আদ্রিকার হাত দুটোর উপর নিজের হাত রেখে ডাকল,

‘আদ্রিকা, হেই স্টপ ক্রায়িং।’

আদ্রিকার কান্না থামলো না। বরং বাড়লো। কাঁদতে কাঁদতে বলতে থাকল,

‘আ’ম স্যরি, পরখ। আমি একদম বুঝতে পারিনি। আপনার এতো কষ্ট হয়েছে আমি একদম রিয়েলাইজ করিনি। আগে বুঝতে পারলে আমি কখনো আপনার কাছে যেতাম না। কখনো আপনাকে ছুঁতাম না। কখনো নিজেকে আপনার সাথে জড়াতাম না। আপনার জন্য আমার খুব খারাপ লাগছে৷ কিন্তু বিশ্বাস করুন, আমি ইচ্ছে করে আপনাকে এতো কষ্ট, এতো যন্ত্রণা দেইনি। তখন আমি আপনার দিকটা একদমই ভেবে দেখিনি। স্বার্থপরের মতো নিজেরটাই ভেবে গিয়েছি। আমি আর নিজেকে আপনার সাথে জড়াবো না। আপনি নিশ্চিন্তে চলে যান। আমার অতীতের কারণে আপনাকে আর সাফার করতে হবে না। আপনি আমার জন্য অনেক সয়েছেন। আর নয়, প্লিজ।’

চলবে…
#অক্ষরময়ী