#পরিণয়ে_নোলককন্যা (কপি নিষেধ)
|৭|
কাছে কোথাও একটা নেড়ি কুকুর অনবরত করুণ সুরে আর্তনাদ করে যাচ্ছে। তীক্ষ্ণ শব্দের ঝংকার এতোক্ষণ এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেও সে সফল হতে পারল না। গায়ের উপর থেকে মোটা কম্বলটি সরিয়ে বিছানায় জবুথুবু হয়ে বসে রইল কিছুক্ষণ। অসভ্য কুকুরটিকে মনে মনে কিছু গালি দিল। সকালবেলা কোন যুক্তিতে সে এভাবে চিৎকার জুড়ে দিল? আরে বাপু, মানুষকে একটু ঘুমাতে দিবি না! সে তার জীবনকালে কখনও দেখেনি, সকালবেলা এভাবে কুকুরকে আর্তনাদ করতে। সচরাচর কুকুরের আর্তনাদ ভেসে আসে নিশিরাতে। তাই শুনে সে অভ্যস্ত। এতোসব ঝুটঝামেলায় বিরক্ত হয়ে বিছানা ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিল।
দু হাতে চোখ কচলে ফেলে ঘরের চারদিকে চোখ বুলিয়ে নিল বুকের ভেতর থেকে বেরিয়ে এল চাপা দীর্ঘশ্বাস। ছোট এই কামরাটি ছেড়ে চলে তাকে যেতে হবে। তিনটি বছর! কম সময় তো নয়। কতশত স্মৃতি জমা হয়েছে! বাড়ির প্রতিটি কোণায় পরেছে হাতের ছাপ। মায়া বড় ভয়াবহ জিনিস। কাটিয়ে উঠতে নিজের সর্বস্বটুকু খোয়াতে হয়। ইট সিমিন্টের তৈরি এই নির্জীব বাড়িটির প্রতি এতো মায়া জন্মাবে কে জানত! নাহ, নাহ। এমন ভাবুক হলে চলবে না। কোনো মায়া, পিছুটান তাকে দূর্বল করতে পারবে না।
বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে টেবিল হতে ফোনটি তুলে নিল। চমকে যেতে হল সময় দেখে। দ্রুততার সাথে ঘরের জানালা খুলে বাইরে তাকিয়ে দেখল আদুরে রোদ্দুরের তেজীয়ান রুপ। পরিণত বয়সে পৌঁছে গিয়ে দাপট ছড়াচ্ছে চারপাশে। ঠিক কতো মাস পর এত বেলা করে ঘুম থেকে উঠল সে জানে না। নিজের স্বপ্ন পূরণের পিছনে এতোটাই ব্যস্ত ছিল যে, এক মুহুর্ত অলসতায় ব্যয় করেনি।
আড়মোড়া ভেঙ্গে ওয়াশরুমে গিয়ে হাত মুখ ধুয়ে নিয়ে বেড়িয়ে আসতেই মোবাইল বেজে উঠল। মোবাইলের পর্দায় ভেসে উঠা ‘মা’ শব্দটির দিকে চেয়ে কপালে ভাঁজ পরল। দ্রুততার সাথে হাতে তুলে নিল মোবাইলটি। ওপাশ থেকে ভেসে এল উদ্বিগ্ন কণ্ঠস্বর।
– পরখ, পরখ?
পরখ বিচলিত হল না। মায়ের কন্ঠে এমন ছটফটানি শুনে সে অভ্যস্ত। শান্ত, ধীর কন্ঠে শুধাল,
– কেমন আছ, মা?
– আমি? আছি কোনোরকম। তুই কোথায় এখন?
– বাসায়।
– এক্ষুণি বাড়িতে আয়।
– এখন সম্ভব না, মা।
– এখনি আসতে হবে।
– জরুরি কিছু?
– অবশ্যই।
– কি হয়েছে?
– কি হয়েছে! সেটা তো তুই আমাকে বলবি। আমার ছেলে হয়ে এমন একটা কাজ তুই কী করে করলি আমি ভেবে পাচ্ছি না৷ তোর বাবা কতোটা ক্ষেপে গেছে জানিস? আমার সাথে কতোক্ষণ চিল্লাপাল্লা করল। তোর জন্য আমাকে মেজাজ দেখাল!
পরখের কপালের দুপাশের শিরাগুলো দপদপ করতে শুরু করল। মায়ের সাথে কেউ উচ্চস্বরে কথা বললেও পরখের সহ্য হয় না। তাছাড়া ইবনূল ইবতেহাজের কথার ধরণ পরখের জানা৷ প্রতিটি শব্দ তীরের মতো ছুটে গিয়ে বুকে বিঁধে যায়। সে গমগমে স্বরে বলল,
– তোমাকে মেজাজ দেখাল কেনো? আমার উপর রেগে থাকলে সেটা আমাকে দেখাতে বলবে।
– মেজাজ দেখাবে না? ছেলের এমন কাজকর্ম শুনলে কার মাথা ঠিক থাকে! ভাগ্যিস তুই সামনে ছিলি না। ঐ সময় তোকে সামনে পেলে ঠাটিয়ে কয়েকটা চড় বসিয়ে দিত। ইবনূল না দিলেও আমিই দিতাম।
পরখ হেসে বলল,
– সে চাইলে তুমি এখনও দিতে পারো।
– হেয়ালি নয় পরখ। আমি ভীষণ সিরিয়াস।
– আমি কি দোষ করেছি সেটাই তো বলছ না।
– দোষ নয়, অন্যায়। ভীষণ অন্যায় করেছিস। এখন বাড়িভর্তি কাজের লোক। ওদের সামনে এনিয়ে আলোচনা করা যাবে না৷ তুই বাড়ি আয়। সামনাসামনি কথা বলা দরকার।
– বিকালে যাই?
– এখনি আয়। এখানে লাঞ্চ করবি।
– নাহ, আমি লাঞ্চ করেই বের হব। তোমার স্বামী মহোদয় বোধহয় আজকে আমার মুখে অন্ন তুলে
দেওয়ার মুডে নেই।
– নিজের বাবাকে ভিলেন বানিয়ে কী যে মজা পাস আমি বুঝি না।
– ও তুমি বুঝবে না। বাবা-ছেলের নিজস্ব ব্যাপার। রাখছি আমি।
– আমি অপেক্ষা করবো।
কল কেটে দেওয়ার পর প্রশ্নটা মাথার মধ্যে তড়তড়িয়ে বংশবিস্তার করতে শুরু করে দিল। আবার কি অন্যায় করে বসল সে? যে খবর পাওয়া মাত্র ইবনূল ইবতেহাজের মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছে।
পরখ জানে, ওর গতিবিধির উপর প্রতিমূহুর্তে নজরদারি চলে। সত্যি বলতে এসব নিয়ে সে এখন আর বেশি ভাবে না৷ একসময় প্রচুর অস্বস্তি হত। কোথায় যাচ্ছে, কি করছে, কীভাবে করছে – সবকিছুর খবর থাকত বাবার নখদর্পনে। স্কুল ফাঁকি দিয়ে সাইকেল নিয়ে বন্ধুদের সাথে ঘুরতে চলে যাওয়ার পর বাড়ি ফিরে বাবার তোপের মুখে পরতে হত৷ সাময়িক মন খারাপ হলেও বাবার নজরদারির খুব একটা প্রভাব তখন পরেনি।
কিন্তু নবম শ্রেণিতে পড়াকালীন বন্ধুদের জোরাজোরিতে সেবার সাহস করে সিগারেটে প্রথম টান দিয়েছিল। কাশতে কাশতে অবস্থা খারাপ। বিশ্রী গন্ধে শ্বাস নেওয়া দায়।
পাশের শপিংমলে পারফিউম কেনার বাহানায় ঢুকে পরে গা ভর্তি সুগন্ধি ছড়িয়ে দিয়েছিল। পাছে সিগারেটের গন্ধ মায়ের নাকে না চলে যায়।
কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি৷ বাবার গুপ্তচর কীভাবে যেন খবর পেয়ে গিয়েছিল। ছেলের সিগারেট খাওয়ার খবরে ইবনূল ইবতেহাজের মাথায় হাত৷ পরখকে পাকড়াও করা হল খাবার টেবিলে। সবাই মিলে রাতের খাবার খেতে বসেছিল সেই মুহুর্তে ইবনূল ইবতেহাজ জানায় তার বার্তা।
– শুনলাম আজকে সিগারেট খেয়েছ। টেস্ট কেমন লেগেছে? শখের বশত খেয়েছ নাকি কনটিনিউ করার ইচ্ছে আছে?
বাবার কথায় নাকে খাবার উঠে গিয়েছিল পরখের। মায়ের অবাক দৃষ্টির সামনে চোখ তুলে তাকাতে পারেনি। লজ্জায় মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছে করেছিল। ওতোটুকু জীবনে এমন অপমানিতবোধ কখনও হয়নি৷ পরখ স্বভাবে মায়ের আদুরে বাচ্চা ছিল। তাই মায়ের সামনে নিজের এমন অপমান তাকে ভেঙে দিয়েছিল। বাবা তাকে নিজের স্টাডিরুমে ডেকেও এই আলোচনা করতে পারত। মায়ের সামনে এভাবে অপমান করে মোটেও ঠিক করেনি। ছেলের রক্তিম মুখের দিকে তাকিয়ে একটু মায়া বোধ হয় হয়েছিল পর্তুলিকার। তাই সে আলোচনার সমাপ্তি ঘটাতে বলেছিল,
– উঠতি বয়সে ভুল করে খেয়ে ফেলেছে। আর কখনও এমন করবে না। আমার ছেলে ভালো জানে, সিগারেট স্বাস্থ্যের জন্য কতোটা ক্ষতিকর। তাই না, পরখ?
মাথা নিচু করে ছলছল চোখের দৃষ্টি লুকিয়ে পরখ শুধু সম্মতি স্বরুপ মাথা দুলিয়েছিল।
সেই থেকে নজরদারির ব্যাপারটি পরখকে খুব বিব্রত করতে শুরু করল। কিন্তু নিজেকে ঘরবন্দী করে রাখা সম্ভব ছিল না। তাই বাধ্য হয়ে এই ব্যাপারটি নিয়ে চিন্তা করা বন্ধ করে দিল। এখন আর এসব গায়ের মাখে না।সাবালক হতেই বাবার তৈরি খাঁচা থেকে বেরিয়ে আসতে বিন্দুমাত্র অপেক্ষা করেনি। তাই নিয়ে অবশ্য বাবা ছেলের মধ্য দ্বন্দ হয়েছে, বেড়েছে দূরত্ব।
কিন্তু আজ এতোদিন পর আবারও কোন গুপ্তবার্তা পেল ইবনূল ইবতেহাজ?
একটি বিষয় নিয়ে বেশিক্ষণ চিন্তাভাবনা করে নিজের মানসিক শান্তি নষ্ট করার পক্ষপাতী পরখ নয়। যা হবে দেখা যাবে, যখন হবে তখন মোকাবিলা করা যাবে। – উক্ত নীতিতে চলে ওর জীবন। তাই অহেতুক চিন্তাভাবনাকে দূরে ঠেলে চলে গেল কিচেনের দিকে।
ফ্রিজে গতরাতের বাসি ভাত আছে। সেটা দিয়ে ফ্রাইড রাইস করা যায়।
__________
রাতভর হালকা শীত, আবার সকাল হতেই হৈ হৈ রৈ রৈ করে ধেয়ে আসে কড়া রোদ্দুর। রাতে শীতকাল, দিনে গ্রীষ্মকাল।
প্রকৃতির এই অনবরত মানসিক ও বাহ্যিক পরিবর্তনের সাথে খাপ খেতে হিমশিম খাচ্ছে মানব শরীর। ঘরে ঘরে জ্বর, সর্দির রোগী বাড়ছে৷ সকাল থেকে আদ্রিকার ফ্যাকাশে মুখশ্রী দেখে নীহার চিন্তিত ছিল। তার চিন্তাকে সঠিক প্রমাণিত করে দুপুর গড়াতে গড়াতে হালকা জ্বর চলেই এল। মুখে তিতকুটে ভাব। খাবারে একদম রুচি নেই৷ আদ্রিকা একটুও ভাত খেতে চাইছিল না৷
তাই মাটির খোলায় কাঁচা মরিচ, রসুন ও শুটকি ভেজে কাচা পেয়াজ কেটে ভর্তা করে নীহার তাতে অনেকখানি খাঁটি সরষের তেল দিয়ে নিল। তেলের কড়া ঝাঁঝে মাথা ব্যথা অনেকটাই কমে যাবে৷ বারান্দায় বসে গরম ভাতের সাথে শুটকি ভর্তা মেখে আদ্রিকাকে ভাত খাইয়ে দিচ্ছিল নীহার। তখনি হেলেদুলে এলো মাহিন।
আজ-কাল মাহিনের সাজগোজে বেশ পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে৷ শার্ট প্যান্ট ছেড়ে পায়জামা পাঞ্জাবি পরছে৷ হড়বড় করে কথা বলে না। ধীরে সুস্থে হাঁটাচলা করে৷
মাহিনকে দেখে ভাতের প্লেট রেখে উঠতে যাচ্ছিল নীহার। তা দেখে মাহিন বলল,
– উঠতে হবে না চাচী। আমি চেয়ার এনে বসছি৷
বাড়ির ভেতরে ঢুকে একটি কাঠের চেয়ার নিয়ে এসে সামান্য একটু দুরত্ব বজায় রেখে মাহিন বসল। নীহার বলল,
– ভাত খাও মাহিন।
– আমি খেয়ে এসেছি চাচী৷ বাজারের দিকে যাব। একটু কাজ ছিল তাই আসলাম। একে এখনও ভাত খাইয়ে দিতে হয়?
– জ্বর আসছে তো। খাইতে চাইতেছে না৷
জ্বরের কথা শুনে মাহিন চট করে একটু এগিয়ে এসে আদ্রিকার কপালে হাত দিল। আদ্রিকা এতক্ষণ মাথা নিচু করে ভাত চিবিয়ে যাচ্ছিল। উত্তপ্ত কপালে মাহিনের শীতল হাতের ছোয়ায় গা কেঁপে উঠল। মুখ তুলে তাকাল মায়ের দিকে।
নীহার বিব্রত হয়ে বলল,
– তুমি কি যেনো দরকারের কথা বলছিলে?
মাহিন হাত সরিয়ে নিয়ে সোজা হয়ে বসে বলল,
– হালকা জ্বর আছে। আজকাল আবহাওয়া যা শুরু করেছে! একটা নাপা এক্সট্রা খাইয়ে দিয়েন। বাড়িতে ঔষধ আছে না? না থাকলে আমি পাঠিয়ে দিব এখন।
– তোমার কষ্ট করতে হবে না। বাড়িতে আছে। ভাতটুকু খাইয়ে তারপর ঔষধ দিব৷
– আচ্ছা ঠিক আছে। ওহ আমি যে কারনে আসলাম। আদ্রিকার জন্য একটা আংটি কিনবো ভাবতেছিলাম। আঙ্গুলের মাপ তো আমি জানি না৷
– ওহ। ঠিক আছে নেও।
মাহিন চেয়ার ছেড়ে পাটির উপর হাটু মুড়ে আদ্রিকার পাশে বসল। পকেট থেকে একটি সুতা বের করে আদ্রিকাকে বলল,
– বাম হাতটা এদিকে দে।
আদ্রিকা নিজের ডান হাতটি পেতে বলল,
– আমাকে দেন। আমি মাপ দিয়ে দিচ্ছি।
– তুই পারবি না।
– পারব। দেন আমাকে।
– আজব! আমি মাপ নিলে কী সমস্যা?
আদ্রিকা হতাশ হয়ে নীহারের দিকে তাকাল। ভাতের প্লেট হাতে নিয়ে নীহার নিরুপায় হয়ে বসে আছে।
ডান হাত এঁটো, অন্যদিকে বাম হাতে খাবার প্লেট৷ আদ্রিকার সাথে সাথে এবার মাহিনও তাকাল নীহারের দিকে। ওর কপালের ভাঁজে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে বিরক্তিভাব।
নীহার নিজের মেয়েকেই বলল,
– ও যখন বলছে, নিতে দে মাপটা।
আদ্রিকা বিনাবাক্যে বাম হাতটি এগিয়ে দিন। মাহিনের ছোয়ায় গা গুলিয়ে উঠলেও এবেলা মুখে কিছু বলল না।
সারাদিন প্রখর রোদে চারপাশ পুড়ে যাওয়ার দশা৷ কিন্তু আদ্রিকার মনের ভেতর মেঘ জমেছে। গুমোট আকাশে ভারী মেঘ জমে মনআকাশ আরও ভারী করে তুলছে। নীহারও মেয়ের আশেপাশে তেমন একটা আসছে না। কাজের বাহানায় কেমন পালিয়ে বেড়াচ্ছে৷ হয়তো নিজের অপারগতার মুখোমুখি হতে চাইছে না। অহেতুক ঘর গুছাচ্ছে, লাউয়ের মাচা ঠিক করছে, বাগানে গাছের মাটি ভেজা থাকা সত্ত্বেও আবার পানি দিচ্ছে৷ তবুও ঘরে বসে একদন্ড বিশ্রাম নেওয়ার কথা ভাবছে না৷ অলস মস্তিষ্কে দুশ্চিন্তা আসন পেতে বসে। এর থেকে কাজে ব্যস্ত থাকা ভালো।
কিন্তু রাত গড়ালে তাকে ফিরতেই হল মেয়ের কাছে৷ মোকাররম তখনও বাড়ি ফিরেনি। মা মেয়ে দুজনে বিছানার দু প্রান্তে শুয়ে আছে। কারো চোখে ঘুম নেই৷ সোজা হয়ে শুয়ে গতকালের চিন্তায় বিভোর সময় পাড়ি দিচ্ছে। একসময় আদ্রিকা অস্থির হয়ে উঠে৷ দ্রুত হয়ে আসতে চাইছে হৃদপিণ্ডের বেগ। লম্বা শ্বাস নিয়ে নিজেকে শান্ত করতে চাইল আদ্রিকা। বার কয়েক শ্বাস টেনে, নিঃশ্বাস ছেড়েও যখন কোনো লাভ হল না, তখন একটি হাত রাখল বুকের উপর৷ নিজেকে আশ্বস্ত করতে থাকল, যা হবে ভালো হবে৷
মেয়ের অস্থিরতা ঠিক বুঝতে পারছে নীহার৷ এক হাত বাড়িয়ে মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল,
– বিয়ের আগে সবারই এমন ভয় হয়৷ আমিও ভয় পেয়েছিলাম। কিন্তু বিয়েটা এতোটাও ভয়ংকর কিছু নয়। শ্বশুড় বাড়িতে সাহায্য পেলে দিনগুলো সুন্দর কেটে যায়৷ কিন্তু সাহায্যটা খুব কম মেয়ে পায়। বেশিরভাগ মেয়ের শ্বশুরবাড়ি হয় পরীক্ষা কেন্দ্রের মত। প্রতিটা সেকেন্ড নজরদারি আর ধমকি-ধামকির উপর দিয়ে কেটে যায়। পরীক্ষা কেন্দ্রে যেমন চোখ কান খোলা রেখে সতর্কতার সাথে লিখে যেতে না পারলে ফেল হওয়ার সম্ভাবনা থাকে, সংসার জীবনটাও তেমন।
সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে না পারলে কিছু উত্তর বাকি রয়ে যায়। সতর্ক না থাকলে অন্যের নকলের দায় এসে পরে বোকা পরীক্ষার্থীটির ঘাড়ে৷
একটু বেশি দুষ্টামি করলে এক্সফেলও করে দিতে পারে।
আদ্রিকা এগিয়ে এসে মায়ের বুকে গুটিশুটি হয়ে মুখ লুকালো। নীহার দু হাতে মেয়েকে আগলে নিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
– দুরুদুরু বুকে শ্বাস আটকে পরীক্ষা দিয়ে যেতে হয়। এরপর যখন সময় শেষ হয়ে ছুটির ঘন্টা বাজে তখন যে প্রশান্তি কাজ করে সেটা সংসার জীবনে পাওয়া যায় না। সংসার জীবনে পরীক্ষার সময় চলতেই থাকে যতদিন না নারী জীবনের মৃত্যু হয়।
– আমি কোনো কাজ পারি না। চাচী অনেক বকা দিবে।
– পারিস না, শিখে নিবি। এক মিনিট দুরত্বেই তো যাচ্ছিস। ওরা শিখিয়ে না দিলে আমি শিখিয়ে দিব। প্রতিদিন আমার এখানে চলে আসবি৷ ভালো হয়, যদি তোকে কিছুদিন বাড়িতে এনে রাখতে পারি। বিয়েটা হয়ে যাক, তারপর তোর বাবার মাথা ঠান্ডা হবে। আদ্রতা পালিয়ে যাওয়ায় মানুষটা খুব কষ্ট পেয়েছে। এমনিতেই ঘর সংসারে কখনো মন বসেনি। এই ঘটনার পর এবার অভিমানও জমেছে। তোর বিয়েটা হয়ে গেলে দেখবি রাগ পরে গেছে৷ তখন তোর বাবাকে বুঝিয়ে তোকে এখানে এনে রাখব। অন্তত তোর অনার্সটা শেষ হওয়া পর্যন্ত সময় পেলে ভালো হয়।
– বাবা মানবে না।
– আমি মানিয়ে নিব। ঠান্ডা মাথায় বুঝিয়ে বললে ঠিকই বুঝবে। তুই চিন্তা করিস না। বিয়ের প্রথম কয়েকটা দিন শ্বশুরবাড়িতে যে যা কিছু বলুক, একদম গায়ে মাখবি না। দেখবি ধীরে ধীরে সব সহজ মনে হবে।
__________
ইবনূল ইবতেহাজের স্টাডি রুমে আজকে পর্তুলিকারও ঠাঁই হয়েছে। যা মোটেও কোনো সুখকর বিষয় নয়। শিরদাঁড়া সোজা করে তিনি চেয়ারে বসে আছেন। চোখে মুখে উদ্বিগ্নতা স্পষ্ট৷ অথচ যাকে নিয়ে উনার এতো চিন্তা সেই পরখ নিশ্চিন্তে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে আছে।
পরখ বাড়ি আসার আগে ইবনূল ইবতেহাজ ফিরে এসেছিল। স্টাডিরুমের দিকে যেতে যেতে থমথমে গলায় বলেছিলেন,
– পিউ, তোমার ছেলে এলে ওকে নিয়ে স্টাডিরুমে চলে এসো।
পরখ এসে হলরুমে দাঁড়ানো মাত্র পর্তুলিকা ওকে বগলদাবা করে ধরে নিয়ে এসেছেন এখানে। কাজের লোক তিন কাপ চা দিয়ে গেল।
চায়ের কাপ হাতে নিয়ে তাতে চুমুক দিয়ে ইবনূল
ইবতেহাজ সোজা হয়ে বসে পরখের উদ্দেশ্যে বললেন,
– চা নেও।
চড় খাওয়ার জায়গায় চা খেতে পেয়ে পরখ তাকাল পর্তুলিকার দিকে। সে ইশারায় চা নিতে বলায়, পরখ বিনাবাক্যে চায়ের কাপ হাতে তুলে নিল।
দীর্ঘ বক্তব্যের সূচনা করে ইবনূল ইবতেহাজ বলতে শুরু করলেন,
– সম্মান অর্জন করতে দীর্ঘ সময় লেগে যায়৷ কিন্তু অর্জিত সম্মান নষ্ট হতে এক সেকেন্ড যথেষ্ট। একটা কাজ একজন মানুষের সারাজীবনের অর্জিত সম্মান ধূলিসাৎ করে দিতে পারে। দুঃখজনক বিষয় কি জানো, যে সন্তানকে বাবা মা এত কষ্ট করে, এতো শ্রম দিয়ে একটু একটু করে বড় করে তোলে সেই সন্তানই বড় হয়ে বাবা মায়ের অসম্মানের কারন হয়। তাদের সারা জীবনের অর্জিত সম্মানকে মাটির সাথে মিশিয়ে দেয়। এমন সন্তানকে কি শাস্তি দেওয়া উচিত বলে তোমার মনে হয়?
চায়ের কাপে আর চুমুক দেওয়া হলো না৷ টেবিলের উপর নামিয়ে রেখে পরখ স্পষ্ট ভাবে উচ্চারণ করল,
– অনেকদিন ধরে আমার কারনে একটু একটু করে তোমার সম্মান নষ্ট হয়ে আসছে। তাই এ অভিযোগগুলোর মাঝে নতুনত্ব খুঁজে পেলাম না৷
ইবনূল ইবতেহাজ ক্রুদ্ধ চোখে তাকিয়ে গর্জে উঠলেন,
– এতোদিন যা করেছ তা ক্ষমা করে দিয়েছি কিন্তু এবার তুমি যে দুঃসাহস দেখিয়েছ তা ক্ষমার অযোগ্য। তোমার ছোটখাটো সকল অন্যায় আমি পিউয়ের দিকে চেয়ে এড়িয়ে গেছি। কিন্তু এবার? পিউ, তুমি বলো। নিজের ছেলের এমন অন্যায় কি তুমি ক্ষমাদৃষ্টিতে দেখতে পারছ? যদি তুমি পারো তবে আমি এ বিষয় নিয়ে আর একটি কথা বলব না।
স্বামীর এমন প্রশ্নে পর্তুলিকা ছলছল চোখে ছেলের দিকে তাকিয়ে ভগ্ন কন্ঠে বললেন,
– নিজে একজন মেয়ে হয়ে, কীভাবে ক্ষমা করে দিব? আমি অন্তত তোর থেকে এটা আশা করিনি পরখ৷ তোর বাবার কড়া শাসন থেকে তোকে এজন্য আগলে রাখিনি যে তুই একদিন আমার মাথাটাই নিচু করে দিবি।
পরখ বিরক্ত হয়ে মায়ে দিকে ঘুরে প্রশ্ন করল,
– কী এমন অন্যায় করেছি আমি? কীসের কথা বলছ? খুন করেছি, চুরি করেছি, ডাকাতি করেছি? কি এমন করেছি যার কারনে তোমার মাথা নিচু হয়েছে?
পর্তুলিকা নিরুপায় হয়ে স্বামীর দিকে তাকালেন৷ ছেলের অন্যায়ের কথা নিজের মুখে উচ্চারণ করতে বড় লজ্জা লাগছে। স্ত্রীর দু চোখের বেদনা ইবনূল ইবতেহাজ কখনো সহ্য করতে পারেননি৷ আজও পারলেন না।
পরখের প্রশ্নের উত্তর তিনিই দিলেন।
– তুমি কী ভেবেছিলে, আমার থেকে দূরে থাকলে আমি তোমার কর্মকান্ড কিছু জানতে পারব না?
– আপনার পোষা প্রাণীগুলো যে সারাক্ষণ আমার উপর নজর রাখে সেটা আমি জানি৷
– তবুও কোন সাহসে তুমি এমন কাজ করলে? আমার অধীনস্ত লোকজন এসে যখন আমার সামনে দাঁড়িয়ে বলে আমার ছেলেকে একটি মেয়ের সাথে ঘুরতে দেখা গেছে, একই বাড়িতে তারা সময় কাটাচ্ছে। তখন আমার সম্মানটা কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়? এইটুকু জ্ঞান তোমার নেই?
পরখ অবাক হয়ে নিজের সম্পর্কে আনা অহেতুক অপবাদের কথা শুনল। হতবাক হয়ে ব্যাখ্যা জানতে মায়ের দিকে তাকাল। কিন্তু পর্তুলিকা মাথা নিচু করে ঠোঁট চেপে ধরে কান্না আটকাতে ব্যস্ত। রাগে কাপতে কাপতে কথা জড়িয়ে যেতে লাগল পরখের।
– আ….আমি? আমি মেয়ের সাথে ঘুরেছি? কে বলেছে এমন কথা?
– শুধু ঘুরাফেরা করোনি। একান্তে ঘনিষ্ট সময়ও কাটিয়েছ। ছিঃ! ছিঃ! আমার ভাবতেও গা গুলিয়ে উঠছে৷ আমার ছেলে হয়ে এমন কাজ কি করে করতে পারলে? বিয়ের কথা বললে আমি কি বাঁধা দিতাম? বিবাহবহির্ভূত এমন কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হয় নিম্ন মানসিকতা সম্পন্ন ব্যক্তিরা৷ তোমাকে নিশ্চয়ই তোমার মা এমন শিক্ষা দিয়ে বড় করেনি?
– এর মধ্যে মাকে টানছো কেনো?
– সন্তানের অপকর্মের দায় বাবা-মায়ের উপর বর্তায়। এখন আমি বলছি, দুদিন পরে লোকে বলবে। পর্তুলিকা-ইবনূল সন্তানকে ঠিকঠাক মানুষ করতে পারেনি।
পর্তুলিকা নাক টেনে হাতে উল্টোপিঠে চোখের পানি মুছে নিলেন। যা দেখে স্তব্ধ হয়ে বসে রইল পরখ৷ তার ব্যাখ্যার অপেক্ষা না করে মা মেনেই নিয়েছে পরখ এমন কাজ করেছে। এখানে আর সাফাই গেয়ে কি লাভ?
তবুও ইবনূল ইবতেহাজকে বলল,
– এটা অপবাদও হতে পারে। আপনার লোকজন ভুল তথ্য যে দেয়নি তার প্রমাণ কি?
পাশের ড্রয়ার থেকে কিছু ছবি বের করে পরখের সামনে রেখে দিলেন ইবনূল। বললেন,
– মেয়েটিকে কয়েকবার তোমার বাড়িতে তোমার সঙ্গে দেখা গিয়েছে। তোমার যে এমন বাজে নেশা হয়েছে তা জেনে খুবই আহত হয়েছি। এতোটা আহত, লজ্জিত আমি সেদিনও হয়নি যেদিন তুমি প্রথমবার সিগারেট হাতে তুলে নিয়েছিলে।
পরখ হতবাক হয়ে দেখল তার সামনে পরে থাকা ছবিগুলোকে। ওর বাড়ির আম গাছের নিচে দাঁড়িয়ে আছে আদ্রিকা। আরেকটায় খোলা ছাদে স্লাইডিং ডোরের সামনে সে আদ্রিকার খুব নিকটে দাঁড়িয়ে। ওর হাত আদ্রিকার ঠোঁটে। এই ছবিগুলো মা দেখেছে নিশ্চয়ই। লজ্জায় মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছে করল পরখের। এরপর সে মায়ের দিকে কীভাবে তাকাবে?
আরও কিছু ছবি আছে যা দেখার রুচি হল না। শুধু একবার ঘাড় ঘুরিয়ে মায়ের লজ্জিত মুখটি দেখে চুপচাপ উঠে দরজার দিকে এগিয়ে গেল।
বেরিয়ে আসার আগে ইবনূল ইবতেহাজ বললেন,
– আমি মেয়েটির সম্পর্কে খোঁজ খবর নিয়েছি৷ বড় বোন বিয়ের আসর থেকে পালিয়ে যাওয়ায় ওর বাবা মা ওকে জোরপূর্বক সেই পাত্রের সাথে বিয়ে দিচ্ছে। এমন মুহুর্তে তুমি নিশ্চয়ই মেয়েটিকে সাপোর্ট দেওনি৷ কাপুরুষের মত হাত গুটিয়ে নিয়েছ। এখন আবার নিজের স্বপ্ন পূরণ করতে পালিয়ে যাচ্ছ। অথচ সেদিন তুমি আমাকে স্বার্থপর বলেছিলে।
ব্যাপারটা যে এতোদূর গড়াবে এবং আদ্রিকার সাথে তার সম্পর্কের ব্যাখ্যা এভাবে শুনতে হবে সেটা পরখের কল্পনাতীত ছিল। সে নিজে কখনও বাবার মতো আত্মকেন্দ্রিক, স্বার্থান্বেষী হতে চায়নি। অথচ আজকে সে বাবার থেকেও নিম্নমানের মানুষ প্রমাণিত হল। আরও কিছু শোনা বাকি আছে কিনা জানার জন্য ঘাড় ঘুরিয়ে বাবার দিকে তাকাল।
ইবনূল ইবতেহাজ বললেন,
– তোমার জন্মদাতা হিসেবে তোমার অন্যায়ের দায় আমার উপরেও বর্তায়। পাপের ভাগীদার হতে চাই না৷ আমি আজকেই মেয়েটির বাবার সাথে কথা বলব এবং তুমিও আমার সাথে সেই আলোচনায় উপস্থিত থাকবে। এখন নিজের রুমে গিয়ে মানসিক প্রস্তুতি নেও।
__________
আড়তের পাশেই একটি চায়ের দোকানে চা খাচ্ছিল মোকাররম। সাথে আছে কিছু কাছের মানুষজন। ব্যবসায়িক সূত্রে এদের সাথে পরিচয় এবং সেখান থেকেই ঘনিষ্ঠতা। ওরা রাজনৈতিক আলোচনা করছে৷ মোকাররম এসবে আগ্রহ খুঁজে পায় না। তবুও শুনতে হচ্ছে৷ তখনি রাস্তার পাশে একটি গাড়ি থামল। বেশ দামি একটি কার। বাজারের ভেতরের দিকে এমন দামী কার সচরাচর দেখা যায় না। বাজারের মধ্যকার রাস্তা সংকীর্ণ হওয়ায় এদিকে রিক্সায় যাতায়াত করত হয়। বাস, ট্রাক, কার, অটো সব কিছু চলে বাজারের পাশ দিয়ে চলে যাওয়া মহাসড়কের উপর দিয়ে। তাই এই রাতের প্রথম প্রহরে একটি দামী কারটিকে টং এর দোকানের সামনে থামতে দেখে স্বভাবতই সকলে অবাক হল। আশেপাশের সবাই আগ্রহভরে গাড়িটির দিকে তাকাচ্ছে। মোকাররম নিজেও একবার তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে নিয়েছে। বিলাসবহুল জীবনে তার আগ্রহ নেই।
কিন্তু সবার আগ্রহকে আরেকটু বাড়িয়ে দিয়ে গাড়ির পেছনের সীট থেকে একজন মধ্যবয়স্ক ব্যক্তি এবং একজন যুবক বেরিয়ে এল। কোনোদিকে না চেয়ে সোজা চলে গেল টং এর দোকানের বাইরের বেঞ্চিতে বসে থাকা মোকাররমের দিকে।
অপরিচিত মানুষকে নিজের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মোকাররম বিস্মিত। সাদা পায়জামা, সাদা পাঞ্জাবি পরনে ব্যক্তিটি মোকাররমকে উদ্দেশ্য করে বলল,
– আমি আপনার সাথে কিছু কথা বলতে চাইছি। আপনার কি একটু সময় হবে?
মোকাররম অবাক হয়ে নিজের দিকে আঙ্গুল ঘুরিয়ে বলল,
– আমার সাথে?
– জ্বী।
– ঠিক আছে বলুন।
– ব্যক্তিগত বিষয়। অন্য কোথাও বসি?
চায়ের কাপ রেখে মোকাররম উঠে দাঁড়ালো। আশেপাশের সবাই সন্দিহান চোখে তাকাচ্ছে। এমনিতেও আদ্রতার কল্যাণে মোকাররম এখন আলোচনার মূখ্য বিষয়ে পরিণত হয়েছে। যে সেভাবে পাচ্ছে কথা শুনিয়ে যাচ্ছে। এখানে কথা বলার থেকে নিজের আড়তে গিয়ে বসাই ভাল।
– আসুন আমার সাথে।
বলে মোকাররম সামনের দিকে এগিয়ে গেল। গাড়ির কাছে গিয়ে পরখ ড্রাইভারকে বলল,
– ফাঁকা জায়গা দেখে গাড়িটা পার্ক করো।
দুটো ফাঁকা চেয়ার এগিয়ে দিয়ে মোকাররম একটি টুল টেনে নিয়ে বসে বলল,
– এখন বলুন।
আসন গ্রহণ করে ব্যক্তিটি বিনয়ের সাথে বলল,
– নিজের পরিচয় দিয়ে নেই। আমার নাম ইবনূল ইবতেহাজ। এ আমার ছেলে পরখ৷ আমার ছোটো খাটো একটা ব্যবসা আছে। বাজারের শেষের দিকে ছয় কিলো মিটার দূরে একটা বাড়ি আছে৷ ছেলে এবছর অনার্স শেষ করে দেশে বাইরে যাওয়ার পায়তারা করছে। ইতিমধ্যে পাসপোর্ট ভিসা হয়ে গেছে। কিছুদিনের মধ্যেই রওনা দিবে।
মোকাররম বুঝতে পারল না, ইবনূল ইবতেহাজ কেন নিজের আদ্যোপান্ত তাকে শোনাচ্ছে। তবুও ভদ্রতা বজায় রাখতে হাসি মুখে সেসব কথা শুনল। ইবনূল ইবতেহাজ থেমে গেলে সে বলল,
– কিন্তু আমার সাথে আপনার কি দরকার বুঝতে পারছি না।
– আসলে দরকার আপনার মেয়ে।
– আমার মেয়ে?
– জ্বী। আপনার ছোট মেয়ে আদ্রিকাকে আমার ছেলে পরখ পছন্দ করে। কিন্তু ভাগ্যের কি পরিহাস দেখুন, ছেলে নিজের পছন্দের কথা নিজের মধ্যে সীমাবদ্ধ রেখেছে৷ আমি আজকেই জানতে পারলাম। এদিকে শুনলাম আপনি মেয়ের বিয়ে দিতে চাইছেন। তাই এভাব ছুটে আসা। পরখ আমার একমাত্র ছেলে। তার জন্য বাবা হিসেবে এইটুকু আমার করনীয়।
এমন আকস্মিক বার্তায় মোকাররম হতবিহ্বল হয়ে পরল। বড় মেয়ে আদ্রতা মতোই তাহলে ছোট মেয়েটাও হলো। বাবার মুখে চুনকালি মাখিয়ে দিতে কেউ একটূও কার্পণ্য করছে না। রাগে মস্তিষ্ক এলোমেলো হয়ে যেতে লাগল। প্রখর দৃষ্টি মেলে পরখের দিকে চেয়ে বলল,
– আমার মেয়ের সাথে তোমার সম্পর্ক আছে?
এই আলোচনায় পরখ একটি শো-পিচ মাত্র। বাবার সাথে লেজ দুলিয়ে নাটকে নিজের চরিত্রের স্থান রক্ষা করতে এসেছে। মোকাররমের কথায় শক্ত করে চোয়াল চেপে ধরে রাগ নিয়ন্ত্রণ করে উচ্চারণ করল,
– নাহ।
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে ইবনূল ইবতেহাজ হালকা হেসে বললেন,
– এক তরফা ভালোবাসা। পরখ আদ্রিকার কলেজে পড়ত। এরপর ওখানেই ভার্সিটিতে চান্স পেল। একই ক্যাম্পাসে যাওয়া আসার ফলে দূর থেকে দেখেই পছন্দ করে ফেলে। জানানোর সু্যোগ পেল কই? তার আগেই আপনি আদ্রিকার বিয়ে ঠিক করে ফেললেন।
মেয়ে কোনো ছেলের সাথে সম্পর্কে আছে জানার পর অভিভাবকদের প্রতিক্রিয়া কেমন হয় সেটা ইবনূল ভালো করে জানেন। মানসম্মান নিয়ে ছিনিমিনি খেলার অপরাধে মেয়ের উপর চড়াও হতে মোকাররমের সময় লাগবে না। খোঁজ খবর নিয়ে মোকাররমের বদমেজাজের অনেক সংবাদ তিনি পেয়েছেন। তাছাড়া মেয়ের পছন্দের ছেলে যদি স্বয়ং রাষ্ট্রপতির ছেলেও হয় তবুও মেয়ের পরিবার বলে বসবে, রাজনীতির পরিবারে আমি মেয়ে দিব না।
প্রত্যেক মেয়ের পরিবারের একটি অন্ধবিশ্বাস থাকে, মেয়ের জামাই নির্ধারণ করতে তাদের জুড়ি মেলা ভার। তারা যে ছেলে নির্ধারণ করবে সে রাজপুত্তুর আর মেয়ের পছন্দের ছেলেটি কুপুত্তুর।
তাই আদ্রিকা ও পরখের সম্পর্কের বিষয়টি তিনি চেপে গেলেন। কিন্তু মোকাররমের মুখমণ্ডল শিথীল হল না। সে গোমড়া মুখ করে বলল,
– দেখুন, মেয়ের বিয়ে আমি ঠিক করে ফেলেছি৷ আগামীকালকে বিয়ে৷ এই মুহুর্তে এসব কথা বলে আমাকে বিব্রত করবেন না। এখানে আমার কিছুই করার নেই।
ইবনূল ইবতেহাজ হতাশ মুখে আরেকবার অনুরোধ করলেন,
– বিয়ে তো এখনো হয়ে যায়নি। আপনি আরেকবার ভেবে দেখুন। আদ্রিকার সাথে না হয় আলোচনা করে তারপর সিদ্ধান্ত নিলেন।
– আমার মেয়ে আমার পছন্দেই বিয়ে করবে। এই নিয়ে তার নিজস্ব কোনো মতামত নেই। তাছাড়া সম্পর্ক আমাদের পরিবারের নিজেদের মধ্যে হচ্ছে। এখানে ভাবাভাবির কোনো অবকাশ নেই। শুধু শুধু নিজেদের মধ্যে বিবাদ বাড়বে। আপনার ছেলে দেখতে ভালো, পড়াশোনা করেছে, বাবার যথেষ্ট আছে। চাইলেই অনেক ভালো ঘরে ছেলের বিয়ে দিতে পারবেন। অন্য কোথাও খোঁজ করুন।
মোকাররম টুল থেকে উঠে দাঁড়িয়ে আলোচনার ইতি টানল। বাধ্য হয়ে ইবনূল ইবতেহাজ ও পরখও চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বিদায় নিয়ে চলে এল।
সারাটা পথ বাবা-ছেলে দুজনে কেউ কোনো কথা বলল না।
চলবে…
#অক্ষরময়ী
#পরিণয়ে_নোলককন্যা (কপি নিষেধ)
[৮]
বৃহস্পতিবার মানেই চাকরিজীবী মানুষের খুশির দিন। ঈদের আগের দিন চাঁদ দেখার আগে যেমন উত্তেজনা অনুভব হয়, শুক্রবারের ছুটির আগে বৃহস্পতিবার ঠিক তেমনি উত্তেজনায় ভাসবে থাকে একটি বিশাল গোষ্ঠী। হাতের কাজগুলো গুছিয়ে সমস্ত হিসাব নিকাশ বুঝিয়ে দিয়ে শপিংমল থেকে একটি রিক্সা নিল বিকল্প। যদিও হেঁটে যাওয়া যায়। কিন্তু যতদ্রুত সম্ভব সে বাড়ি পৌঁছাতে চায়।
ড্রয়িং রুমে বসে থাকা প্রতিটি ব্যক্তিকে উপেক্ষা করে নিজের কক্ষের দরজার কড়া নাড়ল। দরজা খুলে আদ্রতা হেসে স্বাগত জানল। কক্ষে প্রবেশ করে দরজা চাপিয়ে দিয়ে ওর গালে হাতে রেখে বিকল্প শুধাল,
– জ্বর আছে এখনও?
আদ্রতা ম্লান হেসে বলল,
– বেশি না। একটুও।
– শুয়ে রেস্ট নেও।
আদ্রতাকে বিছানায় বসিয়ে দিয়ে সে চলে এল বাইরের ওয়াশরুমে। চট জলদি গোসল সেরে কক্ষে ফিরে গিয়ে দেখল আদ্রতা বিছানায় নেই। বারান্দায় কিছু একটা করছে। ভেজা তোয়ালাটি হাতে নিয়ে সেখানে গিয়ে দেখে আদ্রতা পট থেকে চাল বের করে ধুতে যাচ্ছে। ওর হাত থেকে বাটিটি নিয়ে বিকল্প বলল,
– পানি ছুঁতে বারণ করেছিলাম না? তুমি কিন্তু কথা শুনছ না।
লাজুক হেসে আদ্রতা বলল,
– এইটুকুতে কিছু হবে না।
– সর্দি বেড়ে যাবে।
– তোমার কথা শুনে আমি কিন্তু রান্নাবান্না কিছু করিনি।
– রান্না করব বলে অফিস থেকে ছুটে এলাম।
– তুমি পারবে?
– তা আর বলতে! তুমি যাও। বিছানায় শুয়ে থাক।
– সারাদিন শুয়ে থেকেছি। আর ইচ্ছে করছে না। এখানেই থাকি।
ভেতর থেকে প্লাস্টিকের চেয়ার নিয়ে এসে সেখানে ওকে বসিয়ে দিয়ে বিকল্প রান্নার প্রস্তুতি নিতে থাকল। চাল ধুয়ে পানি দিয়ে হাড়িটি চুলায় বসিয়ে দিয়ে দক্ষ হাতে খচখচ করে পেঁয়াজ কাটতে কাটতে বলল,
– অভাগীর স্বর্গ গল্পটি পড়েছ না, আদ্রতা?
– হ্যাঁ।
– আমার দিনগুলো কেটেছে কাঙালীর মতো। মা অসুস্থ অবস্থায় আমাকে হাতে ধরে সব কিছু শিখিয়েছেন। এমন কতদিন গেছে যে স্কুল থেকে ফিরে আমি চাল আলু ধুয়ে চুলায় বসিয়ে দিয়েছি। শুকনা পাতা দিয়ে চুলা জ্বাল দিতে গিয়ে ধোঁয়ায় প্রায় অন্ধ হওয়ার দশা। কাশতে কাশতে চুলার মুখে ফু দিয়ে আবারও আগুন জ্বালাতাম।
বিকল্প হঠাট অনুভব করল দুটো হাত ওকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরেছে। পিঠে মুখ গুঁজে চুপটি করে রইল আদ্রতা। চোখ থেকে জল গড়িয়ে পরছে কিন্তু সে কোনো শব্দ করল না। কিন্তু ওর নিঃশ্বাসের গাঢ়ত্বও চিনতে শিখে গেছে বিকল্প। পেঁয়াজ কাটা রাখা দু হাতে ওকে সরানোর চেষ্টা করে বলল,
– আরে বোকা মেয়ে, কাঁদছ কেনো? ওসব দিন চলে গেছে। কষ্ট করেছি কিন্তু সুখ ছিল। হয়তো কিছু দুঃখ ছিল কিন্তু মাথায় হাত রাখার জন্য পাশে মা ছিল।
আদ্রতা বলল,
– মা নেই তো কি হয়েছে? আমি আছি। তুমি কোনো কষ্ট পেলে আমার কাছে চলে আসবে। আমি মাথায় হাত বুলিয়ে দিব।
– সে দেখা যাবে। এখন আমার জীবনে কোনো দুঃখ নেই। শুধু সুখ, আর সুখ।
– ইশ! যেন সুখের রাজার সে।
– রাজাই তো। সাথে রানীও আছে।
ওকে ছেড়ে দিয়ে সামনে এসে আদ্রতা ওর কপালে আলতো চুমু খেয়ে বলল,
– কি রাঁধবে?
– গরম ভাতের সাথে ডিম ভাজি, আলু ভর্তা। হবে না?
– হবে না আবার! তোমার হাতের রান্না অসাধারণ।
বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যে নামার মুখে আদ্রতা বলল,
– চলো না বাইরে থেকে একটু হেঁটে আসি। ঘরে বসে থেকে মাথা ধরে গেছে।
ব্যস্ত নগরীতে যেদিকে চোখ যায় সেদিকে শুধুই কোলাহল। প্রশান্তি খুঁজতে কোথায় যাবে? তবুও আদ্রতার অনুরোধে গলির রাস্তা ধরে হাঁটতে হাটতে ওরা পৌছে গেল স্থানীয় একটি হাইস্কুলের সামনে। বেশ কিছু ফুডকার্ড দেখা যাচ্ছে। চিকেন ফ্রাই, কাবাব এর গন্ধ চারপাশে ছড়িয়েছে। দোকানগুলোতে উপচে পরা ভীড়। বিকল্প বলল,
– চিকেন ফ্রাই খাবে?
– উহু। খেতে ইচ্ছে করছে না।
– কিছু খাও। এভাবেই ফিরে যাবে?
– ঝাল কিছু খাওয়া যায়।
– ফুচকা খাবে?
– দই ফুচকা!
আরেকটু এগিয়ে যেতেই ফুচকার স্টল নজরে এল। এক প্লেট ফুচকা হাতে বসে আছে আদ্রতা। আনন্দে ওর চোখ চিকচিক করছে। পাশের টুলে পানির বোতল হাতে বসে আছে বিকল্প। দোকানীকে বলে বেশী করে মরিচ দিয়ে ফুচকা বানিয়ে নিয়েছে। এগুলোকে খেয়ে আদ্রতা যে ঝালে লাফালাফি করবে সে ব্যাপারে বিকল্প নিশ্চিত। তাই আগে থেকে প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে। দোকানীর থেকে একটি বাটিতে মিষ্টি দইও এনে রাখা আছে।
একে একে আটটি ফুচকা খেয়ে আদ্রতার শ্যামলা মুখ পর্যন্ত লাল হয়ে গেছে। এ পর্যন্ত দু বোতল পানি শেষ করে ফেলেছে। আরেক বোতল পানি হাতে নিয়ে খেতে খেতে বাড়ি ফিরেছে। এই মুহুর্তে বিছানায় বসে নাক টানছে। বিকল্প বলল,
– ঘুমানোর চেষ্টা করো।
– এতো তাড়াতাড়ি! সবে আটটা বাজে।
– ঘুমিয়ে পরলে পেটের জ্বলুনি কমে যাবে। যতই জেগে থাকবে ততই কষ্ট বাড়বে।
ঝোঁকের বসে ঝাল খেয়ে সত্যি বেশ ঝামেলায় পরে গেছে। এতোগুলো পানি খেয়ে পেট ফুলে আছে। এপাশওপাশ করলে পেটের ভেতর খলখল শব্দ হচ্ছে। বাধ্য হয়ে আদ্রতা ঘুমের প্রস্তুতি নিল।
ওর পাশে বিছানায় হেলান দিয়ে বই পড়ছিল বিকল্প। ভার্সিটি যেতে না পারলেও বন্ধুদের সহায়তা নোটস সংগ্রহ করে ওদের লেখাপড়া এখনও চলছে। হঠাৎ ভোঁ ভোঁ শব্দ করে ফোন বেজে উঠল। পাশে শুয়ে আদ্রতা ভারী নিঃশ্বাসে শব্দে ওর ঘুমের গাঢ়তবের সাক্ষী দিচ্ছি। এলাকার বন্ধুর নামটি দেখে দ্রুত কল রিভিস করল বিকল্প। পাছে আদ্রতার ঘুম ভেঙ্গে যায়। কিন্তু বন্ধু যে সংবাদ দিল তা শোনার পর আদ্রতার ঘুম না ভাঙ্গিয়ে কোনো উপায় রইল না।
মাথায় আলতো স্পর্শ আদ্রতার ঘুম হালকা হয়ে এল। পিটপিট করে চেয়ে দেখল বিকল্প ওর দিকে ঝুঁকে আছে। কিছু বুঝতে উঠতে না পেরে প্রশ্ন করল,
কি হয়েছে?
কথা ছিল। একটু উঠবে।
অচেনা শহরে শান্তি থাকলেও স্বস্তি নেই। সারাক্ষণ একটা ভয় তাড়া করে বেড়ায়। নিজেকে ধাতস্ত করে ঝটপট উঠে বসল আদ্রতা। বিকল্পের চিন্তিত মুখের দিকে তাকিয়ে বলল,
– কি হয়েছে? বাড়িতে সবাই ঠিক আছে?
– কারো কিছু হয়নি। সবাই ঠিক আছে।
– তাহলে ?
– তীর্থ কল করেছিল।
– কি বলল?
– তোমার বাবা আদ্রিকার বিয়ে ঠিক করেছে?
– কিহ? কার সাথে?
– মাহিনের সাথে।
– তোমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে। কি বলছ এসব! এখুনি আদ্রিকার বিয়ে দিবে কেনো? তাও আবার মাহিনের সাথে।
– আদ্রতা, কালকে মাহিনের সাথে আদ্রিকার বিয়ে।
আদ্রতা হতভম্ব হয়ে বিকল্পের চোখে সত্যতা খুঁজে ফিরল। যখন নিশ্চিত হলো তখন দু হাতে নিজের মাথার চুল টেনে ধরে বলল,
– আমি নিজে ওই গোলকধাঁধা থেকে এজন্য বেরিয়ে আসেনি, যাতে আমার পরিবর্তে আমার বোনকে ওরা বেঁধে ফেলে। এ আমি কিছুতেই হতে দিব না। আমি বাড়ি যাব বিকল্প।
– এই মুহুর্তে সেখানে গেলে পরিস্থিতি আরও বিগড়ে যাবে। তোমাকে দেখে তোমার বাবার রাগ বাড়বে। জেদ করে আদ্রিকার বিয়ে উনি দিবেনই। তুমি আটকাতে পারবে না।
– তাহলে আমি কি করবো? নিজের বোনের সর্বনাশ হতে দেখব?
– তা কেনো? একটু ভাবতে দেও।
– বিয়ে কখন?
– কালকে রাতে।
– তীর্থ কোথায় শুনল।
– আসার সময় ওকে বলে এসেছিলাম তোমাদের বাড়ির দিকে নজর রাখতে। সেই থেকে ও মাহিনের সাথে একটু খাতির জমিয়েছিল। আজকে চায়ের আড্ডায় মাহিন নিজেই ওকে বলেছে।
– তাহলে সঠিক খবরই দিয়েছে।
বিছানায় বসে থাকা সম্ভব হল না আদ্রতার। ঘরময় অস্থির পায়েচারী করছে। পানি ভর্তি পেটে আবারও পানি খেতে থাকল। বিছানায় বসে অসহায় চোখে ওর দিকে তাকিয়ে আছে বিকল্প। কি করবে বুঝতে পারছে না।
হঠাট আদ্রতা বলল,
– ওই মেয়েটা। আলপনা না কি নাম যেন? ওর খোঁজ করো বিকল্প। যেভাবেই হোক বাবাকে ওই ছবিগুলো দেখাতে হবে। জেনেশুনে বাবা নিশ্চয়ই আদ্রিকাকে ওখানে বিয়ে দিবে না। আমাদের দুবোনের মধ্যে আদ্রিকাকে বাবা বেশি ভালোবাসে। মুখে স্বীকার না করলেও আমি জানি। আদ্রিকার প্রতি উনি দূর্বল।
– কিন্তু আমার কাছে ওর ফোন নাম্বার নেই।
– একটু খোঁজ করো না। তীর্থকে বলো।
– তুমি একটু শান্ত হয়ে বসো। আমি দেখছি।
________
ইবনূল ইবতেহাজ চলে যাওয়ার পর পরিচিত অপরিচিত সবাই মোকাররম এর আড়তের দিকে উঁকি মেরে দেখতে শুরু করল। এমন একজন ব্যক্তি মোকাররমের সাথে কি কথা বলে গেল? অনেকে তো এসে সরাসরি জানতে চেয়েছে৷ মোকাররম কোনোভাবে কথা কাটিয়ে দিয়ে বলেছে,
– উনার বাড়িতে বড় আয়োজন হবে সেজন্য ভালো মানের চালের খোঁজ করছিল।
সবাই বুঝল এ বাহানা মাত্র। তবুও মুখের উপর কিছু বলতে পারল না। কিন্তু পেছনে আলোচনা শুরু করে দিল। আলাপ আচারিতায় অতিষ্ঠ হয়ে মোকাররম ঠিক করল, তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে যাবে৷ আড়ত বন্ধ করে তালা দিয়ে হেটেই বাড়ি ফিরছিল। বাড়ির কাছাকাছি আসতেই একটি মেয়ে এসে পথ কাটকাল।
মাথায় লম্বা ঘোমটা দেওয়া অল্পবয়সী মেয়েটির দিকে তাকিয়ে মোকাররম বলল,
– কিছু বলবে?
মেয়েটি ভীষণ ইতস্তত করে চারদিকে চোখ বুলিয়ে নিল। ওর ভীত মুখমন্ডল দেখে মোকাররম আবার জিজ্ঞাসা করল,
– মা, কোনো সমস্যা? বিপদে পরেছ?
মেয়েটি ম্লান হেসে বলল,
– না আংকেল। আপনার সাথে দেখা করতে এলাম৷ কিছু দেখানোর ছিল।
আজকের দিনটি বোধহয় মোকাররমের অবাক হওয়ার দিন। একের পর এক অপরিচিত মানুষ এসে হাজির হচ্ছে ওর সামনে। সবারই কিছু না কিছু বলার আছে। সে বলল,
– হ্যাঁ বলো।
– মাহিনের ব্যাপারে। শুনেছি ওর সাথে আপনার ছোট মেয়ের বিয়ে হচ্ছে৷
– তুমি মাহিনকে চিনো?
– হ্যাঁ। আমি ওর গার্লফ্রেন্ড ছিলাম। এক্স গার্লফ্রেন্ড। এখন নেই।
মোকাররম আধুনিক যুগের নয়, তবুও মেয়েটির কথা শুনে পুরোপুরি না পারলেও সারমর্ম বুঝতে সক্ষম হল। উনার মনে মাহিনের একটি স্বচ্ছ ধারণা আছে। তাই এমন সংবাদে হকচকিয়ে গেল। কিন্তু ভীত, সংকিত মেয়েটিকে ভড়কে দিতে ইচ্ছে করল না। বলল,
– তোমার নাম কি?
– আলপনা।
– মাহিনের সাথে তোমার সম্পর্ক কতদিনের?
– অল্প দিনের কিন্তু খুব গভীর সম্পর্ক ছিল।
– তাহলে ছাড়লে কেন?
– আমি ছাড়িনি৷ ও আমাকে ছেড়েছে৷ আদ্রতার সাথে ওর বিয়ে আগে থেকেই ঠিক ছিল। আমার সাথে শুধু টাইমপাস করেছে।
– তুমি আদ্রতাকে চিনো?
– হ্যাঁ। ওর বিয়ের সময় ওকেও সতর্ক করেছিলাম।
মোকাররম আরেকদফা অবাক হলো। ধাক্কা খেল মস্তিষ্ক৷ তার আড়ালে এতকিছু ঘটে অথচ সে একটুও আভাস পেল না! নীহার কি কিছু জানত? নাহ, নাহ৷ নীহার জানলে ওকে অবশ্যই বলত।
– কি বলেছিলে ওকে?
আলপনা ইতস্তত বোধ করলেও শেষ পর্যন্ত মোবাইলটি এগিয়ে দিল। মোকাররম অবাক হলেও তা প্রকাশ না করে মোবাইলটি হাতে নিয়ে তাতে যে স্থির চিত্রটি দেখল, তা দেখে স্তব্ধ হয়ে গেল। আল্পনার সাথে খুবই ঘনিষ্ঠভাবে বসে আছে মাহিন। বেশিক্ষণ যে দৃশ্যের দিকে তাকিয়ে থাকা যায় না৷ মোবাইলটি ফেরত দিয়ে বলল,
– তুমি মাহিনের বাবা মায়ের সাথে একবার দেখা করো।
– নাহ আংকেল।
– আমি কথা বলব?
– নাহ।
– তাহলে কি করবে?
– আমি তো মাহিনকে বিয়ে করার জন্য আপনাকে এসব দেখাইনি৷ মাহিন চাইলেও আমি কখনও ওর কাছে ফিরব না।
– কেনো?
– ওর মতো ধোঁকাবাজকে বিয়ে করে নিজের আরও ক্ষতি করার মতো বোকা আমি নেই। সব জেনেও ওকে বিয়ে করলে আগুনে ঝা/প দেওয়ার মত ঘটনা হয়ে যাবে।
আলপনা চলে গেল কিন্তু পেছনে ফেলে গেল মোকাররমকে। সে কি করবে বুঝতে পারছে না৷ বাড়ি ফিরে যাবে? কিন্তু বাড়ি ফিরে কি করবে?
মাহিনের সত্যতা জানার পর তার কি করার আছে? সে তো বিয়ে বন্ধ করতে পারবে না। এই মুহুর্তে নিজের থেকে আলপনা নামক স্বল্প বয়সী মেয়েটিকে সাহসী মনে হল।
আদ্রতার সাথে বিয়ে ভেঙ্গে যাওয়ার পর মোজাম্মেল এর পরিবার ভীষণ অপদস্ত হয়েছে। তবুও ভাই হিসেবে সামান্য দয়া দেখিয়েছে মোজাম্মেল। না হলে সম্মানহানীর মামলায় মোকাররমের পুরো পরিবারকে জেলে পাঠাতে পারত। কিন্তু মোজাম্মেল তেমন কিছু করে নি। মোকাররমকে আরেকটি সুযোগ দিয়েছে৷ এবারের বিয়েতে বাইরের কাউকে নিমন্ত্রণ করা হয়নি ঠিকই। বিয়ে বন্ধ করে দিলে খুব একটা জানাজানি হবে না। কিন্তু মোজাম্মেলের পরিবারের অপমান হবে৷ মাহিন মানসিক আঘাত পাবে।
মোকাররম যদি সন্তান প্রেমে অন্ধ হয়ে বিয়েটা বাতিল করে দেয় তবে? মোজাম্মেল এর তোপের মুখে পরতে হবে৷ ভয়াল প্রকোপ নেমে আসবে মোকাররমের পরিবারের উপর। বারংবার নিজের অপমান মেনে নিবে না মোজাম্মেল পরিবার।
দরকার হলে ধরে বেধে আদ্রিকার সাথে মাহিনের বিয়ে দিতেও পিছপা হবে না মোজাম্মেল। নিজের ভাইকে মোকাররম ভালো মতোই চিনে।
এ শহরে মোজাম্মেল এর প্রতিপত্তি সুদূরপ্রসারী। উপরমহল পর্যন্ত তার যোগাযোগ আছে। ওদের সাথে সামনাসামনি লড়াইয়ে মোকাররম জিততে পারবে না। কিন্তু সব জেনেশুনে মেয়েকে ওখানে বিয়ে দেওয়া সম্ভব নয়। এতোকিছুর পরেও আলপনা মেয়েটি সুযোগ পেয়েও মাহিনের কাছে ফিরতে চাইছে না। মাহিনের কাছে ফিরে যাওয়া মানে আগুনে ঝাপ দেওয়া৷ সেখানে মোকাররম কীভাবে নিজের হাতে মেয়েকে আগুনে ছুড়ে ফেলবে। কিন্তু কীভাবে রক্ষা করবে মেয়েকে?
মাহিনের সাথে আদ্রিকার বিয়ে হয়ে গেলে সে কখনোও বড় মুখ করে আদ্রিকার সামনে দাঁড়াতে পারবে না।
নিরুপায়, দিশেহারা মোকাররম রাস্তার মাঝখানে ডিভাইডারের উপর বসে পরল। এই রাতটি কোনোভাবে আরও দীর্ঘ করা যায় না? মোকাররম মনেপ্রাণে দোয়া করতে লাগল, এই রাতের ভোর যেন না আসে। কিন্তু সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে দ্বিগুণ বেগে ছুটতে থাকল ঘড়ির কাঁটা। বাড়তে থাকল রাত৷ অনেকদিন পর কিশোর বয়সে পথহারা বালকের মতো রাস্তার ধারে বসে নিঃশব্দে কাদতে শুরু করল মোকাররম। একটুখানি সাহসী, অনেকখানি স্পষ্টভাষী হওয়ার প্রয়োজনীয়তা অনুভূতি করল। আজ সে যদি অর্থ-সম্পদে ভাইয়ের সমানে সমান হত, তবে সমাজের তারও সম্মানিত স্থান তৈরি হত৷ নিজের মেয়ের স্বার্থে সেও নির্ভীক চিত্তে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে এই বিয়ে বাতিলের ঘোষণা করে দিত।
_________
আকাশে এক ফালি চাঁদ উঁকি দিচ্ছে। যা দেখে রওশন আলী অনুমান করল, ঘড়ির কাটা এতোক্ষণে বারোটার ঘর পেরিয়েছে। ইংরেজি ক্যালেন্ডারের পাতায় নতুন দিনের সূচনা হয়ে গেছে। দশ পেরিয়ে আজ এগারোই ফেব্রুয়ারী। এতো রাতে বাড়ি ফেরার জন্য বউয়ের কাছে নিশ্চিত বকা খেতে হবে। সারাদিনের আয় বউয়ের হাতে তুলে দিয়েও সে তার বকা থেকে আজ নিস্তার নেই৷ রওশন আলী নিজের আধাপাকা দাড়িতে হাত বুলিয়ে হাসলেন। গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে পাড়ি দিচ্ছেন রাতের নিস্তব্ধতা সড়ক।
বাড়ির প্রায় কাছাকাছি পৌছে গেছে সে। ডানদিকের গলি দিয়ে একটু ভেতরে গেলেই ওর বাড়ি। এ রাস্তাটা কাচা। মাটির এবড়োখেবড়ো পথে ট্রাক চালাতে একটু ঝামেলা হয়। সতর্ক না থাকলে কোন গর্তে চাকা আটকে যায় বলা মুশকিল। স্টিয়ারিংটা ঘুরিয়ে ডানদিকে গলিতে ঢুকেই পরতে যাচ্ছিল তখনি ডানদিকের আয়নায় একটি অদ্ভুত দৃশ্য ভেসে উঠল। এতো রাতে মাঝরাস্তায় কে বসে আছে?
অন্য কেউ হলে ভয় পেয়ে এড়িয়ে যেত। এতরাতে কোনো ভালো ভদ্র লোক এভাবে রাস্তায় বসে থাকে না। কিন্তু রওশন আলী সাহসী ব্যক্তি৷ সে গাড়ি ঘুরিয়ে আরেকটু এগিয়ে এল। ক্রমে স্পষ্ট হতে থাকল পরিচিত অবয়ব।
ভ্রু কুচকে গাড়ি থেকে নেমে মোকাররমের সামনে দাঁড়িয়ে বললেন,
– ভাই, এইখানে বসে আছেন কেনো?
মোকাররম মাথা উচু করে চাইল। ওর ফোলা মুখের দিকে তাকিয়ে রওশন আলী বলল,
– কি হইছে? জ্বর-টর ধরাইছেন নাকি?
– নাহ। এমনিতেই শরীরটা ভালো লাগতেছিল না।
কাপড়ে ঝেড়ে উঠে দাড়ালো মোকাররম। রওশনা আলীর সন্দিহান দৃষ্টি এড়িয়ে দ্রুত প্রস্থানের উদ্দেশ্যে বলল,
– বাড়ির দিকে যাচ্ছিলে নাকি?
– হ্যাঁ।
– এতো রাত করে বাড়ি ফিরা ঠিক না। যাও, বাড়ি যাও। আমিও চলি।
সামনের দিকে এক কদম ফেলতেই রওশান আলী বলল,
– ভাই, কোনো সমস্যা?
মোকাররম ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল। কয়েক পল অপেক্ষা করে বলল,
– কিছুক্ষণ সময় হবে তোমার? বসবা এখানে?
রওশন আলী বিনাবাক্য ব্যয় করে ডিভাইডারে বসে পরল। মোকাররম ওর পাশে বসে আল্পনার সাথে দেখা হওয়ার পুরো ঘটনাটি বর্ণনা করল। সব শুনে রওশন আলী বুদ্ধিহারা হয়ে চেয়ে রইল।
– আপনার ভাই যে ঝামেলাবাজ মানুষ। বিয়ে বাতিলের প্রস্তাব কিছুতেই মানবে না। উঠতি বয়সের ছেলে প্রেম করছে তো কি হইছে? ওমন দু একটা প্রেম ওদের কাছে কিছু না।
– পুরুষ মানুষ গরীব হলে, অশিক্ষিত হলে, অসুন্দর হলেও মানা যায়। কিন্তু দুশ্চরিত্র পুরুষ কখনো শুধরায় না। এমন পুরুষের সাথে কখনো সুখের সংসার হয় না। আমার মেয়েটা সারাজীবন অশান্তিতে কাটাবে।
– এখন কি করবেন?
– বুঝতেছি না। চাদের মতো সুন্দর, শান্ত নদীর মতো মেয়ে আমার। তারে কিনা আমি আগুনে ঠেলে দিচ্ছি। ইয়া খোদা! মাহিনের সাথে বিয়ের প্রস্তাবে হ্যাঁ না বললে ওরে আমি কতো ভালো জায়গায় বিয়ে দিতে পারতাম। আজকেই একটা ভালো ঘর আসছিল আদ্রিকার জন্য। ছেলের বাবা নিজে এসে আমার সাথে কথা বলে গেল। আমি নিরুপায় হয়ে না করে দিলাম।
রওশন আলী চতুর ব্যক্তি৷ অশিক্ষিত হলেও দশ গ্রাম ঘুরে, শত লোকের সাথে মিশে অভিজ্ঞ হয়েছে। মোকাররমের কথা শুনে আশার আলো দেখতে পেল। বলল,
– ছেলে কেমন? কই থাকে?
মোকাররম পুরো ঘটনাটি বিবৃতি করল। সব শুনে রওশন আলী বললো,
– ভাই, চলেন। শেষ চেষ্টা করে দেখি। এখনো সুযোগ আছে৷
– কি করতে চাও রওশন।
– ওই ছেলের পরিবারের সাথে কথা বলে আসি৷ ওদের সবকিছু জানাই৷ ওরা যদি সাহায্য করে তাহলে আদ্রিকা বিয়ে মাহিনের সাথে দিতে হবে না।
মোকাররম বেশিকিছু ভাবার সময় পেল না। রওশন আলী ওকে জোর করে ট্রাকে উঠাল। তারপর ছুটে চলল বাড়ির উল্টোদিকের রাস্তায়। মোকাররম শক্ত হয়ে বসে বলল,
– আমি বাড়ি চিনি না রওশন।
– নাম তো জানেন। ওইটূকুতেই হবে। নাম জানলে ঠিকানা খুঁজে পাওয়া কোনো কঠিন কাজ না।
_________
সারারাত বাড়ি ফিরেনি মোকাররম। দুশ্চিন্তা ও উৎকন্ঠায় নীহারের ঘুম এলো না সারারাত। আদ্রিকাও মায়ের সাথে জেগে রাত কাটিয়ে দিল। মা-মেয়ে নিজেদের চিন্তা ভুলে দরজার দিকে কান পেতে উত্তেজনায় বিমূঢ় হয়ে রইল। রাতে পেরিয়ে যখন দিনের আলো আগমনের সমস্ত প্রস্তুতি নিচ্ছিল তখন সেই ঘোলাটে আলো মাড়িয়ে বাড়ি ফিরল মোকাররম। দরজায় শব্দ হওয়া মাত্র বিছানা ছেড়ে বাইরে ছুটে এল নীহার। মোকাররমের সারা মুখ জুড়ে ক্লান্তি, উসকোখুসকো চুল। ধীর গতিতে পা ফেলে এগিয়ে আসছে৷ নীহার বলল,
– কইছিলা সারারাত? বাড়ি না ফিরলে জানিয়ে তো দিবা। নানান চিন্তায় চোখের পাতা এক করতে পারি না।
মোকাররমের পিছু পিছু রওশন আলীও বাড়ির ভেতরে এল। ওকে দেখে নীহার অবাক হয়ে বলল,
– রওশন ভাই, আপনিও বাড়ি যান নাই! এতো রাতে দুজনে কই কই ঘুরতেছিলেন? চারা আনতে কোথাও গিয়েছিলেন?
রওশন আলী সামান্য হেসে বলল,
– চারা আনতে যাই নাই ভাবী। তবে একটু দূরেই গেছিলাম।
– আসেন, ভেতরে এসে বসেন।
– নাহ। আপনি ভাইয়ের সাথে একটু ভেতরে গিয়ে কথা সেড়ে নেন। আমি বাইরেই আছি।
এতো রাতে মোকাররমের কি এমন জরুরি কথা আছে ভেবে পেল না নীহার। ওর পিছু পিছু ঘরের ভেতর প্রবেশ করল। মোকাররম ফিসফিস করে বলল,
– তোমার কাছে নতুন শাড়ি আছে নীহার?
নীহার অবাক হয়ে বলল,
– এতো রাতে শাড়ি দিয়ে কি করবা?
– থাকলে তাড়াতাড়ি বের করো। আদ্রিকাও ঘুম থেকে তুলো।
– আদ্রিকা জেগেই আছে।
– কোথায় ও?
– ওর ঘরে।
– শাড়ি নিয়ে গিয়ে ওকে পরিয়ে দেও।
নীহার হতভম্ব হয়ে মোকাররমের দিকে চেয়ে রইল। এই ভোর বেলায় মেয়েকে শাড়ি পরাতে হবে কেনো?
– কি বলতেছেন আপনি?
– নীহার, ফজরের নামাজের পরপরই আমি মেয়ের বিয়ে দিব। যাও ওকে তৈরি করাও।
– আপনি পাগল হয়ে গেছেন?
– যা বলতেছি করো গিয়ে৷ বোকা মহিলা। যাও এখান থেকে।
মোকাররমের ধমকে নীহার কেঁপে উঠল। আর কিছু প্রশ্ন না করে শাড়ি বের করে আদ্রিকার হাতে দিয়ে বলল,
– শাড়ি পরে নে।
রানী গোলাপী রঙের জামদানীটি হাতে নিয়ে হতভম্ব আদ্রিকা মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল,
– এই রাতে বেলা শাড়ি পরব?
– হ্যাঁ পরবি।
– কেনো?
– কেনোর কোনো মানেই নাই। তোর বাপ পরতে বলছে পরবি। এরপর সে কুয়ায় ঝাপ দিতে বললে দিবি। দুজনে মিলে ঝাপ দিব।।
রাগে গজগজ করতে করতে নীহার চলে গেল।
আদ্রিকার মাথার ভেতর ফাকা লাগছে৷ ঝি ঝি শব্দ হচ্ছে অনবরত। গায়ের উপর থেকে কম্বল সরিয়ে সে চুপচাপ বিছানা থেকে নেমে ঘুমকাতুর চোখে শাড়ি পরতে লাগল।
সারারাত জেগে থাকলেও ফজরের আগমুহূর্তে রাজ্যের ঘুম এসে জড়ো হয় চোখের পাতায়। ঘুমে আদ্রিকা প্রায় ঢলে পরছে। তবুও গুটি গুটি পায়ে বাইরে এল। মোকাররমের আদেশে বোরকা গায়ে দিয়ে নীহারও বাইরের এসে দাড়িয়ে আছে৷ ওদিকে মোকাররম খুবই সতর্কতার সাথে দরজায় তালা দিচ্ছে। দেখে মনে হচ্ছে, সে কোথায় চুরি করতে যাচ্ছে।
নীহারের সামনে দাঁড়িয়ে আবারও ফিসফিসিয়ে বলল,
– চলো, চলো। দাড়িয়ে আছো কেনো? কোনো শব্দ করবা না। আস্তে পা ফেলে হাটো।
মায়ের হাত ধরে আদ্রিকা চুপচাপ হাটতে থাকল। নার্সারি পেরিয়ে আরেকটু দূরে রওশন আলীর ট্রাক দাড় করিয়ে রাখা আছে। সামনের ড্রাইভার সীটে ওরা চারজন কীভাবে গাদাগাদি হয়ে বসেছে, সে এক দেখার দৃশ্য। তবুও মোকাররম বিরক্ত হচ্ছে না। হালকা শীতেও সে কলকল করে ঘামছে।
ফাকা রাস্তার নির্মল বাতাস ভেদ করে ওরা এসে পৌছাল একটি মসজিদের সামনে।
বাজার পেরিয়ে এতোটা দূরে আদ্রিকা আগে কখনও আসেনি। মসজিদের দরজা পার হতেই ডানদিকে একটি লম্বা ঘর। তারপর অনেকটা অংশ জুড়ে ফুলের গাছ। এরপর মসজিদের মূল ভবন। নীহার ও আদ্রিকাকে লম্বা ঘরটির দিকে নিয়ে গেল রওশন আলী। অন্যদিকে মোকাররম চলে গেল মসজিদের ভেতর। ঘরটির ভেতর আদতে কিচ্ছু নেই। শুধু মেঝের উপর দামী কার্পেট বিছানো। কার্পেট বিছানো মেঝের উপরে ওদের বসতে বলে রওশন আলীও চলে গেল। আদ্রিকা মায়ের গা ঘেষে বলল,
– আমরা এখানে এলাম কেনো?
– কারন এখানে তোর বিয়ে পরানো হবে।
নীহারের থমথমে মুখের দিকে হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইল আদ্রিকা। কাপা কাপা হাতটি দিয়ে মায়ের বাহু চেপে ধরে আদ্রিকা বলল,
– ও মা?
নীহার দীর্ঘশ্বাস ফেলে মেয়ের হাত আকড়ে ধরে নিজের হতাশা দূরে রেখে বলল,
– কি হচ্ছে, কেনো হচ্ছে আমি নিজেও জানি না। তোর বাপকে ভূতে ধরছে। একেক সময় একেক কান্ড করতেছে। চুপচাপ বসে থেকে নাটক দেখ। এছাড়া কিছু করার নাই।
মায়ের কথার সূত্র ধরে আদ্রিকা সত্যিই চুপ হয়ে গেল। কিন্তু গায়ের কাপুনি থামল না। ছাড়ল না মায়ের হাত। মাথার ভেতর একটা ঝি পোকা থেকে অনেকগুলো ঝি পোকা জন্ম নিয়েছে। সকলে সমোস্বরে চিৎকার করছে, ঝি ঝি ঝিঝি….
এরপর কিছুক্ষণ পর মোকাররম এল। মাথায় সাদা টুপি পরেছে একটা। এসেই হড়বড়িয়ে ঘরের শেষ দিকে নির্দেশ করে বলল,
– ওখানে অযুর ব্যবস্থা আছে। অযু করে নামাজ পরে নেও।
ওরা আসার পথেই ফজরের আযান দিয়ে দিয়েছিল। নীহার শুনতে পায়নি। ক্রুদ্ধ চোখে মতো মোকাররমের দিকে তাকিয়ে নীহার উঠে দাড়ালো। সে দৃষ্টিকে পাত্তা না দিয়ে মোকাররম আবার ফিরে গেল মসজিদের ভেতরে।
দুজনে নামাজ পরে সবে মাত্র বসেছে। অনুমতি নিয়ে ঘরের ভেতর প্রবেশ করল কয়েকজন ব্যক্তি। শাড়ির আঁচল টেনে আদ্রিকার মাথায় ঘোমটা দিয়ে দিল নীহার। আদ্রিকা মুখ তুলে প্রশ্নোত্তর দৃষ্টিতে মাকে দেখল। কিন্তু নীহার প্রতিক্রিয়াহীন।
এরপর যা যা হলো, তা আদ্রিকার সাথে এর আগেও হয়েছিল। সেই স্মৃতি কোনো সুখকর স্মৃতি নয়। ওরা এই মুহুর্তে আদ্রিকার মন মস্তিষ্ক দখল করে নিল। ওদের দাপাদাপিতে আদ্রিকার কর্ণ হল বধির, চক্ষু হল অন্ধ। সে শুধু মায়ের ওড়না শক্ত করে চেপে ধরে নিজের পতন ঠেকালো। সাইন করার সময় অস্বাভাবিক ভাবে হাত কাপছিল। নীহার হাত বাড়িয়ে মেয়ের হাত ধরে সাইন করিয়ে দিল।
সবাইক ফিরে গেল। আবার কেউ এল, আবার কেউ চলে গেল। আশেপাশে হরেকরকম কথা। আদ্রিকার সেসব শুনতে পাচ্ছে না। ওর কানে একবার বেজে উঠছে, তালাক, তালাক, তালাক।
পরমুহূর্তে সে শুনতে পাচ্ছে একটু আগেই নিজের কন্ঠ নিঃসৃত ধ্বনি, আলহামদুলিল্লাহ, কবুল।
দুইয়ের মাঝে দোদুল্যমান আদ্রিকাকে হাত ধরে নীহার বাইরে নিয়ে এল। বাইরে তখন আলো ফুটেছে। সূর্যের প্রথম কিরণে স্নান করছে প্রকৃতি। যা আদ্রিকার দেহ ছুয়ে গেল। চোখে তীক্ষ্ণ আলোর ছটা এসে লাগতেই সে হাত দিয়ে চোখ ঢেকে ফেলল। ধীরে ধীরে স্পষ্ট হচ্ছে দৃষ্টি। শাড়ি সামলে বাগানের মাঝখানে এসে দাঁড়াল। পাশ থেকে নীহার বলল,
– ওরা তোর শ্বশুর শাশুড়ি। সালাম দে।
কলের পুতুলের মতো আদ্রিকা সালাম দিল। একটি নারী কন্ঠে সালামের উত্তর শুনে মুখ উঁচু করে তাকিয়ে সামনে যাকে দেখল, তাতে আদ্রিকার মাথা ঘুরে উঠল। দুজন অপরিচিত নারী পুরুষের মাঝে বুক টানটান করে দাঁড়িয়ে আছে পরখ। পরনে সাদা পাঞ্জাবি, পায়জামা। তীক্ষ্ণ দৃষ্টি তারই দিকে।
গোল গোল চোখে সে দৃষ্টিতে হারিয়ে গিয়ে আদ্রিকার মস্তিষ্কে কিছু শব্দ এলোমেলো ঘুরতে লাগল,
… দেনমোহর ধার্য করিয়া ইবনূল ইবতেহাজ এর একমাত্র পুত্র ইবতেহাজ পরখ এর সাথে আপনার বিবাহ…
আর কিছু শোনা ও বুঝার আগেই ঝাপসা হয়ে এলো সবকিছু। সবাইকে অবাক করে দিয়ে ঘাসের গালিচায় লুটিয়ে পরল আদ্রিকা।
চলবে….
#অক্ষরময়ী