পরিণয় পর্ব-০১

0
1

#পরিণয়
#প্রথম_পর্ব
#মৌসুমী_হাজরা

… আমি আপনাকে বিয়ে করতে পারবো না সুজয় বাবু।
… তুমি কি মজা করছো নয়না?
… একদমই না। আমি সত্যি বলছি।
… আর এই সত্যিটা তোমার এখন মনে পড়লো, বিয়ের মণ্ডপে, শুভদৃষ্টির সময়?
… আমি নিরুপায়। আমি অনেকবার আপনাকে বলবার চেষ্টা করেছি, কিন্তু সবকিছু এত তাড়াতাড়ি ঘটে যাবে বুঝতে পারি নি। আমাকে ক্ষ মা করুন আপনি। আমি বিয়ে করতে পারবো না।

পাশ থেকে একজন বললেন, কি এত কথা হচ্ছে বর আর কনের মধ্যে? এবার তো সারাজীবন যত পারো কথা বলবে। এখন তো বিয়েটা হোক। শুভদৃষ্টির পর থেকেই কথা চলেই যাচ্ছে। তা মালাবদল টা কখন হবে? পুরোহিত মশাই মালাবদল করতে বলুন ওদের।

সুজয় থামিয়ে বললো, একটু দাঁড়ান। আমার নয়নার সাথে কিছু জরুরী কথা আছে। এত তাড়াহুড়োর কিছু নেই। আর আমি যখন নয়নার সাথে কথা বলবো, কেউ এর মাঝে আসবেন না।

সুজয় নয়নার দিকে তাকিয়ে বললো, বলো নয়না, তোমার কী বলার আছে?
নয়না ভ য়ে জড়োসড়ো হয়ে গেছে। মুখ নামিয়ে, বিয়ের শাড়িটি খামচে ধরে আছে।
সুজয় এবার গলার স্বর আরও নরম করে বললো, এই সুযোগ চলে গেলে আর পাওয়া যাবে না। তুমি যদি সত্যিটা সবাইকে না বলো, তাহলে পরে আফসোস করতে হবে।

চারিদিক নিস্তব্ধ হয়ে গেল। সবাই বুঝতে পারলো, কিছু একটা হয়েছে। কৌতূহল নিয়ে সবাই তাকিয়ে রইলো নয়না আর সুজয়ের দিকে।
সুজয় আবার বললো, তাকাও আমার দিকে নয়না। তোমার কোনো ভ য় নেই। আমি তোমাকে সাহায্য করবো। তুমি নির্ভয়ে সব বলতে পারো।

নয়না ধীরে ধীরে মুখ তুলে তাকালো সুজয়ের দিকে।
এইভাবেই তো আর শুভদৃষ্টি হওয়ার কথা ছিল দুজনের। কিন্তু নয়নার চোখে আজ শুধু ক ষ্ট, তা অবাধ্য চোখের জল বারেবারে ঢাকতে চাইছে।
নয়না সাহস সঞ্চার করে বললো, আমি এই বিয়েটা করতে পারবো না। আমি অন্য একজনকে ভালোবাসি।

নিমিষের মধ্যে হুলুস্থুল পড়ে গেল সারা বাড়ির মধ্যে। চারিদিকে সবাই কথা বলতে শুরু করলো। ঠিক সেই সময় নয়নার মামিমা এসে নয়নাকে এক চড় মা র লে ন। সকলে চুপ হয়ে গেল। আবার সেই নিস্তব্ধতা।
মামিমা বললেন, এইজন্য তোকে বড়ো করেছিলাম, আমাদের অপমান করার জন্য? ছোটবেলায় যখন তোর মা আর বাবা ম র লো। তখন তুইও ম রে গেলি না কেন? আমাদের এই দিন দেখাবি বলে? ছোট থেকে মানুষ করলাম, পড়ালেখা শেখালাম, আর আজ তুই এই প্রতিদান দিলি।
মামিমা আবার যেই হাত ওঠালেন, সুজয় তাড়াতাড়ি নয়নাকে নিজের কাছে টেনে নিল।
নয়না ভ য়ে চোখ বন্ধ করে সুজয়ের বুকের মধ্যে মুখ লুকালো।

সুজয় বললো, দাঁড়ান আপনি। উত্তেজিত হবেন না। এইভাবে জোর করে কিছু হয় না। তাছাড়া সত্যিই সব কিছু তাড়াতাড়ির মধ্যে হয়েছে। আমি নাহয় রেডি ছিলাম বিয়ের জন্য। নয়নাকে কি জিজ্ঞাসা করেছিলেন আপনারা? আমি যতবার নয়নার সাথে দেখা করে কথা বলার চেষ্টা করেছি, আমাকে আপনারা নানারকম বাহানা দিয়েছেন, নয়না ব্যস্ত, নয়তো অসুস্থ, নয়তো অফিসের কাজে বাইরে। দু-তিনবার দুই পরিবারের দেখা হয়েছিল, তখনই নয়নার চোখ দেখে বুঝেছিলাম ও কিছু বলতে চায়। কিন্তু আপনারা তা বলতে দেন নি। আমার মনে হয় আপনারা সব জানতেন। তাই আপনারা ওর সাথে আমাকে একা দেখা করতে দেন নি।

নয়না এবার মুখ তুলে তাকালো সুজয়ের দিকে।
সুজয় বললো, ভ য় নেই তোমার। আমি একজন পুলিশ। আমার প্রথম ডিউটি হলো, কারোর সাথে অ’ন্যায় যাতে না হয়। চলো তুমি আমার সাথে।

কথাটা বলেই, সুজয় নয়নার হাতটা ধরে ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়ে গাড়িতে চাপলো। সকলে বাধা দিতে গেলেও সুজয় শক্ত হাতে নয়নাকে ধরে রইলো, কারোর কোনো কথা শুনলো না।

গাড়ি নিয়ে সোজা চলে গেল। নয়না চুপ, সুজয়ও চুপ। সুজয়ের মনে পড়ছিল নয়নাকে প্রথম দেখার কথা।
বাড়ি থেকে তখন জোরকদমে মেয়ে দেখা শুরু হয়েছে। সেইসময় নয়নার খোঁজ পেয়েছিল সুজয়ের পরিবার। ঠিক হলো দুই পরিবার একসাথে বাইরে কোথাও দেখা করবে। সেই মতো সুজয়ের পরিবার আগেই সেখানে পৌঁছে গেল। তার কিছুক্ষণ পর নয়না, নয়নার মামা আর মামিমা পৌঁছালেন। সেই তাদের প্রথম দেখা। নয়নার পরনে সবুজ রঙের চুড়িদার। অল্প সাজ। কি যে মিষ্টি দেখতে লাগছিল। প্রথম দেখাতেই সুজয় যেন হারিয়ে গিয়েছিল সেই মুহুর্তে। পাশ থেকে সুজয়ের দিদি বলেছিল, ভাই এমন হাঁ করে দেখিস না, মেয়ে ভ য় পেয়ে পালিয়ে যাবে।
সুজয় সাথে সাথে মুখ নামিয়ে নিয়েছিল। এরপর দুই পরিবারের মধ্যে কথা, হাসাহাসি চলতে থাকলো। সুজয়ের চোখ তখন বারবার নয়নার দিকে, এই নজরে শুধু মুগ্ধতা। প্রথমদিনেই দুই পরিবার খুব সুন্দর ভাবে মিলেমিশে গেল।
পরেরদিনই সুজয়ের পরিবার সুজয়ের মত নিয়ে ফোন করে জানালো, তাদের মেয়ে পছন্দ। একইসাথে নয়নার মামা মামিমাও জানিয়ে দিলেন নয়না আর তাদেরও পছন্দ হয়েছে। এরপর আরও ২ বার দেখা হয়েছিল দুই পরিবারের। কিন্তু সেভাবে আলাদা করে কথা হয়নি সুজয় আর নয়নার। ফোন নাম্বার দেওয়া-নেওয়া হয়েছিল যদিও। কিন্তু সুজর আর নয়নার কাজ ভিন্ন, তাই একজন ফ্রি হলে আরেকজন হয়তো ফ্রি থাকতো না। তাই ফোনেও কথা বলা সম্ভব হয় নি। তবে হোয়াটসঅ্যাপে কয়েকবার মেসেজ আদান-প্রদান হয়েছিল। কিন্তু সেটা কয়েকবার মাত্র। কিন্তু এই কয়েকবার দেখাতে সুজয়ের কেন জানি মনে হয়েছিল, নয়নার চোখে দেখে, অনেক কথা জমিয়ে রেখেছে। দেখাশোনার ৩ মাসের মধ্যেই বিয়ের কথা হয়েছিল। আর আজ তাদের বিয়ে ছিল।

সামনেই একটা কুকুর ছুটে আসতেই, সজোরে ব্রেক কষলো সুজয়। ভাবনার জগৎ থেকে যেন ছিঁটকে বেরিয়ে এলো সে।
… তুমি ঠিক আছো নয়না?
… হ্যাঁ আমি ঠিক আছি।
… আচ্ছা ঠিক আছে, গাড়ি থেকে নামো।

নয়না অবাক হলো, গাড়ি বাইপাসে আসা – যাওয়া করছে। এখানে নামিয়ে দিলে ও এখন যাবে কোথায়? ঋষভও তো এই শহরে নেই। কার কাছে যাবে ও?
সুজয় গাড়ি থেকে নেমে, নয়নার কাছে এসে গাড়ির দরজা খুলে নামতে বললো। নয়না চুপচাপ নামলো। ফুটপাতের ধারে দুজনে দাঁড়িয়ে আছে।
নয়না ধীরে ধীরে বললো,
… আপনি চলে যান। আমি ঠিক চলে যাবো।
… কোথায় যাবে?
… আমার ঠিকানায়।
… বাড়িতে তো যেতে পারবে না, মামা-মামির কাছে। তাহলে যাবে কোথায়?
… আছে এক জায়গা?
… ও আচ্ছা বুঝলাম। প্রেমিকের কাছে। এক কাজ করো নয়না, তুমি আমার ফোন থেকে প্রেমিককে ফোন করে এখানে আসতে বলো।
… তা হয় না।
… কেন?
… আমি ফোন নিয়ে আসিনি। ওর নাম্বার আমার মনে নেই।
… স্ট্রেঞ্জ! প্রেমিকের নাম্বার মনে নেই? তাহলে এক কাজ করো, তুমি ঠিকানা বলো, আমি তোমাকে সেখানে দিয়ে যাচ্ছি।
… না না আমি চলে যাবো।
… আমি তোমাকে একলা ছাড়তে পারি না। সঠিক জায়গায় তোমাকে না পৌঁছে আমি কোথাও যাবো না।
… আসলে ও এখন এই শহরে নেই। আমার বিয়ের কথা শুনে ক ষ্ট পেয়ে এই শহর থেকে দূরে কোথাও চলে গেছে।
… তুমি খোঁজ পাবে কী করে?
… বন্ধুদের থেকে জানতে পেরে যাবো।
… আমিও তোমাকে হেল্প করতে পারি। আমি একজন পুলিশ, সেটা ভুলে যেও না।

নয়না ভয়ে ঢোঁক গিলে বললো, আমি জানি, আপনি পুলিশ। তাই তো সাহস করে বিয়ের মণ্ডপে কথা গুলো বললাম।
সুজয় মেকি হাসি হেসে বললো, হ্যাঁ অনেক তাড়াতাড়ি বলেছো।
নয়না মুখ নামিয়ে বললো, আমি দুঃখিত। আপনার জীবনে একজন ভালো মানুষ আসবে। আপনি তাকে জীবন সঙ্গী পেয়ে ভীষণ সুখী হবেন।
সুজয় আবার হেসে বললো, সান্ত্বনা দিচ্ছ?
নয়না চুপ করে যায়। সুজয় বললো, থাকার ব্যবস্থা পরে ভাবছি। আগে চলো এক জায়গায়।

নয়নাকে নিয়ে গেল শপিং মলে। সকলেই বর-বধূকে এখানে দেখে বেশ অবাক হলো। নয়নাকে পছন্দ মতো কয়েকটা পোশাক কিনে দিল। তারপর একটা পোশাক দিয়ে বললো চেঞ্জ করে নিতে। নয়নাও সুজয়ের কথা মতো তাই করলো।

এরপর দুজনে মিলে সেখান থেকে বেরিয়ে এলো। সুজয় নিয়ে গেল নয়নাকে একটি গার্লস হোস্টেলে। সেখানে নিজের পরিচয় দিয়ে নয়নাকে রাখলো। কিছু খাবারও কিনে দিয়ে এলো।
এরপর নয়নাকে রেখে আসার সময় সুজয় একটু দাঁড়ালো।
নয়না তখনও দাঁড়িয়ে আছে। সুজয় আবার ফিরে গেল নয়নার কাছে। পকেট থেকে বের করলো টাকা, তারপর নয়নার হাতটা ধরে, হাতের উপর টাকা গুলো দিয়ে বললো, এটা রাখো, তোমার কাজে লাগবে।
নয়না নিতে চাইলো না। বারবার ফিরিয়ে দিল।
শেষে সুজয় বললো, এখন রাখো, পরে আমাকে দিয়ে দেবে। আর এখানে যতদিন পারো থাকো। কোনো সমস্যা নেই। এটা আমার ফোন নাম্বার এই কার্ডটা রেখে দাও। কোনো দরকার হলে ফোন করে নিও।

সুজয় চলে গেল।

নয়না হোস্টেলের ফোন থেকে ঋষভকে ফোন করলো। ঋষভ ফোন ধরতেই,
… হ্যালো, আমি নয়না।
… তুমি? এটা কোথাকার নাম্বার?
… সে অনেক কথা। পরে তোমাকে জানাবো।
… তোমার তো আজ বিয়ে? কী ব্যাপার আমি বুঝতে পারছি না।
… কবে ফিরবে?
… কাল কলকাতায় ফিরবো।
… একটা কাজ করতে হবে আমার?
… কী?
… তুমি ফেরার পর, আমার মামা-মামিমার কাছে গিয়ে আমার ফোন আর এটিএম সব নিয়ে আসবে।
… কী বলছো? আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।
… বললাম তো দেখা হলে বলবো।

চলবে…

ভুল ত্রুটি মার্জনীয় 🙏