#পরিণয়
#দ্বিতীয়_পর্ব
#মৌসুমী_হাজরা
… আচ্ছা ঋষভ এখনই আমাদের ঘুরতে আসা টা কি ঠিক হলো? পরে হলেও তো হতো।
… পরে কিভাবে হতো শ্রী? আমার অ্যা ক্সি ডে ন্টের জন্য বেশ কয়েকদিন ছুটি, তারপর আমাদের বিয়ে, অফিস থেকে আর ছুটি পেতাম? তোরও তো একই অবস্থা। এবার তো কলকাতায় ফিরলে সেই একই জীবন।
… তা ঠিক বলেছিস। আর এত কিছুর পরে আমাদের দুজনের একটু আলাদা সময়ের দরকারও ছিল। মনে হলো এই কয়েকমাসে একটা ঝড় বয়ে গেল।
… সে আর বলতে। তবে ওইসব কথা থাক। এখন ঋষভ আর সোমাশ্রীকে কেউ আলাদা করতে পারবে না।
… একদমই তাই। তবে মাঝখান দিয়ে দুটো বিয়েবাড়ি মিস হয়ে গেল। নয়নার বিয়ে আর সুজয় বাবুর বিয়ে।
সুজয় বাবু কত সাহায্য করেছিলেন আমাদের। অথচ তাঁর বিয়েতে আমরা থাকতে পারলাম না। নয়নাও আমাদের কত ভালো বন্ধু, ওর বিয়েতেও থাকতে পারলাম না। ও আমাদের বিয়ের সময় অফিসের কাজে বাইরে ছিল, মনে করবে সেইজন্য আমরাও হয়তো ওর বিয়েতে থাকলাম না। কাল মেয়েটার বিয়ে হলো, বিয়ের সাজে কেমন লাগছিল কে জানে? সোশ্যাল মিডিয়াতেও কোনো ছবি পোস্ট করে নি। হ্যাঁ রে ঋষভ ওর হাজব্যান্ডকে তুই দেখেছিস আগে? সব কিছু এত তাড়াতাড়ি হলো যে সেভাবে কারোর সাথেই পরিচয় হলো না।
ঋষভ অন্যমনস্ক হয়ে জানালার দিকে তাকিয়ে আছে। সোমাশ্রী সেটা খেয়াল করার পর বললো,
… কি রে শুনছিস? কী ভাবছিস বলতো?
… কিছু একটা হয়েছে জানিস?
… কার?
… নয়নার।
সোমাশ্রী বিছানা থেকে তাড়াতাড়ি নেমে ঋষভের কাছে গিয়ে বললো, ঋষভ কী হয়েছে নয়নার?
ঋষভ সোমাশ্রীর হাতটা ধরে নিজের কাছে তাকে বসালো, তারপর বললো, কাল রাতে নয়না ফোন করে বললো, আজ আমরা ফিরলে, আমি যেন ওর মামার বাড়ি গিয়ে ওর ফোন আর এটিএম কার্ডটা নিয়ে আসি। আমি অনেকবার জিজ্ঞাসা করলাম কী হয়েছে? বললো, দেখা হলে সব বলবে।
সোমাশ্রী বললো, আদৌ বিয়েটা হয়েছে তো নয়নার? নাকি ও বিয়ে করে নি?
ঋষভ বললো, জানি না শ্রী। কিচ্ছু বুঝতে পারছি না, ও কী করছে। আজ দুপুরে ফ্লাইটে আমরা কলকাতা পৌঁছে, আগে নয়নার খোঁজ নেবো।
সোমাশ্রী বললো, ও যে নাম্বার থেকে কল করেছিল, সেই নাম্বারে একবার কল কর তো।
ঋষভ বললো, ঠিক বলেছিস। দাঁড়া করছি।
প্রথম বার ফুল রিং হলো, কেউ ফোন ধরলো না। তারপর আবার ট্রাই করার পর একজন মহিলা ফোন ধরতেই, সোমাশ্রী বললো, নমস্কার! আমার নাম সোমাশ্রী রায়। এই নাম্বার থেকে কাল ফোন এসেছিল। যে করেছিল তার নাম নয়না সেন। আপনি কি একবার তার সাথে কথা বলিয়ে দিতে পারবেন? খুব দরকার ছিল।
ওই-প্রান্তে বেশ গম্ভীর গলায় একজন ভদ্র মহিলা বললেন, আপনি তার কে হন?
সোমাশ্রী বললো, আমি নয়নার বান্ধবী।
ভদ্র মহিলা আবার বললেন, ঠিক আছে ধরুন, আমি ডেকে দিচ্ছি। আসলে সুজয় বাবু বারবার বলে গেছেন নয়নার খেয়াল রাখতে। তাই জিজ্ঞাসা করলাম।
সোমাশ্রী অবাক হয়ে ভাবলো, সুজয় বাবু কে?
নয়না ফোন ধরে বললো,
… হ্যাঁ আমি নয়না বলছি।
… নয়না, আমি সোমাশ্রী।
… হ্যাঁ সোমাশ্রী বলো। তোমাদের তো আজ ফেরার কথা। কেমন কা’টলো হানিমুন?
… সেইসব কথা পরে হবে। তুমি এখন কোথায়? আর এই সুজয় বাবু কে?
… আমার সাথে যার বিয়ের ঠিক হয়েছিল, তাঁর নাম সুজয়। তিনিই আমাকে গার্লস হোস্টেলে রেখে গেছেন।
… মানে? তোমাদের তো গতকাল বিয়ে ছিল?
… বিয়েটা হয়নি। আমি পারিনি করতে।
… কেন? কী হয়েছে নয়না। সব তো ঠিক ছিল।
… সব কথা দেখা হলে বলবো শ্রী। তোমরা দেখা করো আমার সাথে। ঋষভকে আমি কাল বলেছি আমার একটা কাজ করে দেওয়ার জন্য। আমি তোমাকেও বলছি, তুমি ঋষভের সাথে আমার মামার বাড়ি গিয়ে আমার ফোন আর এটিএম কার্ডটা নিয়ে আসবে। আর তাঁদের বলবে নয়না তার প্রেমিককে বিয়ে করেছে। আমি হোস্টেলের ঠিকানা দিচ্ছি, এখানে আমার সাথে দেখা করবে।
সোমাশ্রী ফোনটা রেখে দিয়ে ঋষভের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে রইলো।
… কী হলো বলবি? নয়না কী বললো?
… নয়না বিয়ে করেনি ঋষভ।
… আমি জানতাম কিছু একটা হয়েছে। কিছু মেয়ে আছে, তারা যে কী চায় আর কী করে তা শুধু তারাই জানে।
… কী বলতে চাইছিস তুই?
… তুই ঠিকই ভেবেছিস। সেই মেয়েদের মধ্যে আমি তোকেও ধরেছি। তুইও তাই।
… ওই, আমাদের বিয়ে হয়ে গেছে বলে তুই যা বলবি তাই আমি সহ্য করবো নাকি?
… না, তোকে সহ্য করতে হবে কেন? তুই আগেও কোনো কিছু সহ্য করতিস না। আমি একটা কিছু বললে তুই দশটা শোনাতিস। তোদের মনের কথা তোরা শুধু চেপে রাখতে জানিস।
… মানছি আমি মনের কথা চেপে রেখেছিলাম। তাই বলে তুই এত কথা শোনাবি? যা তোর সাথে আমার কথা নেই।
… হ্যাঁ রা গ দেখানো ছাড়া আর তো কিছু পারিস না।
… পারি না? কত ভালো ভালো রেসিপি তোর জন্য বানিয়েছি। সেই সব ভুলে গেছিস?
… আচ্ছা ঠিক আছে। সরি। কাছে আয়, এখন আমাদের ভাবতে হবে নয়নার ব্যাপারে।
… হুম ঠিক বলেছিস। মেয়েটা আমারও খুব ভালো বন্ধু হয়ে উঠেছে।
জানালার দিকে নয়না আনমনে তাকিয়ে আছে। অনেক আগেই খাবার খাওয়া হয়ে গেছে। ঋষভ বলেছিল, যেকোনো সমস্যায় ও পাশে থাকবে। তবে ওদের বেশি বির’ক্ত করা চলবে না। অনেক ঝড়ঝাপটা পেরিয়ে দুজনে এক হয়েছে।
একবার মোবাইল আর এটিএম কার্ডটা হাতে চলে এলে, আর ওদের বির’ক্ত করবে না নয়না। আজ আর সুজয় বাবু এখানে আসেন নি। কাল রাত থেকে আর কোনো খোঁজ নেননি তিনি। আর কত সাহায্য করবেন উনি? ওনার জায়গায় অন্য কেউ থাকলে ওই পরিস্থিতিতে অপমান করতো। কিন্তু ওই সময় উনি শুধু নয়নাকে সাহায্যই করেননি, মামিমার মা রের থেকে বাঁচিয়েছেন। সকলের মাঝখান থেকে হাত ধরে ঘর থেকে বের করে এনেছেন নয়নাকে।
নয়না যদি আগে বলতো, তাহলে অনেক ভালো হতো। মামা-মামিমার ভ য়ে কিছু বলতে পারেনি। আর সুজয় বাবুর সাথেও তো কথা বলার সুযোগ হয়নি। বিয়ের আগের দিন রাতেও ভেবেছিল যা হচ্ছে হোক। কিন্তু বিয়ের সময় সে আর পারেনি। মনে হয়েছিল বিয়ে হয়ে গেলে, আর তার স্বপ্ন পূরণ হবে না। মা-বাবার স্বপ্ন পূরণ হবে না। সুজয় বাবু জয়েন্ট ফ্যামেলিতে থাকে। এখন ওই বাড়ির কি অবস্থা কে জানে? নয়না এখন সবার কাছে অপরাধী হয়ে গেল।
সন্ধ্যে ৭ টা…
সোমাশ্রী আর ঋষভ এসেছে নয়নার দেওয়া ঠিকানায়। এখানে এসে নয়নার খোঁজ করতেই, নয়নাকে ডেকে দেওয়া হলো।
দুজনে বসে আছে। নয়না এসে বললো, ভাগ্যিস তাড়াতাড়ি এসেছো তোমরা। ৯ টার পর আর এখানে দেখা করার পারমিশন নেই।
ঋষভ বললো, এবার বলো তো, কী হয়েছে?
নয়না বললো, তোমার মনে আছে, তোমাকে আমি একবার বলেছিলাম আমার গ্রামের বাড়ির কথা। সোমাশ্রী জানে না। তাই আরও একবার বলছি শোনো। খুব ছোটবেলায় মা-বাবা মা রা যাওয়ার পর আমাকে মামা-মামিমা নিজেদের কাছে নিয়ে আসেন। ওনারা আমায় সব দিয়েছেন। আমাকে ভালোবেসে মানুষ করেছেন। কিন্তু যে মা-বাবা আমাকে জন্ম দিল, তাদের জন্য তো একটা কর্তব্য থেকেই যায়। মা-বাবা সবসময় চেয়েছিল, গ্রামে একটা ভালো স্কুল হোক। আমাদের অনেক সম্পত্তি। আমি এখন কাকুদের কাছে আমার ভাগটা নিয়ে স্কুল গড়তে চায়। জানি কাজটা সহজ হবে না। কিন্তু আমাকে তা করতেই হবে।
সোমাশ্রী বললো, খুবই ভালো উদ্যোগ। কিন্তু তুমি তো এটা তোমার হবুবরকে আগে বলতে পারতে। এইভাবে বিয়ের মণ্ডপে বিয়ে ভে ঙে দিলে? আর কিভাবে ভা ঙলে শুনি?
নয়না না চাইতেও একটু হেসে বললো, সোজা কথা বললে কেউ পাত্তা দিত না, তাই বিয়ের মণ্ডপে সুজয় বাবুকে বললাম, আমি অন্য একজনকে ভালোবাসি। আমি আপনাকে বিয়ে করতে পারবো না। এই মিথ্যে কথাটা বলা ছাড়া আমার আর কোনো উপায় ছিল না। বিয়ের আগের দিন অব্দি আমি সব মেনে নিয়েছিলাম। বিয়ের দিনে আমার মনে হলো, আমার সব স্বপ্ন হারিয়ে যাচ্ছে। তখন মন বড়ো চঞ্চল হয়ে গেল। তাই বাধ্য হয়ে মিথ্যে কথা বলে বিয়েটা ভা ঙলাম।
ঋষভ এবার রা গ করে বললো, বিয়ের দিনেই কেন বেশিরভাগ মেয়েদের চোখ খুলে যায়? তার আগে অব্দি তারা সব মেনে নেয়, অন্ধের মতো বাড়ির সকলের কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করে। আর মাঝখান দিয়ে আমাদের মতো ছেলেদের সাফার করতে হয়।
সোমাশ্রী রে গে বললো, এই তোর যা বলার আছে আমাকে বল। আমি জানি, তুই কথাটা আমাকে বলছিস। তুই কী জানবি রে আমাদের মেয়েদের মনের খবর?
নয়না ওদের থামিয়ে বললো, তোমরা আবার আমার জন্য ঝ’গড়া শুরু করো না। অনেক ল’ড়াইয়ের পর একে অপরকে পেয়েছো। বাকি জীবনটা একে অপরের হাত ধরে পার করো।
সুজয় খুব ভালো ছেলে। হয়তো আমার কথা শুনে আমার স্বপ্ন পূরণে তিনিও থাকতেন। কিন্তু এই কাজটা এত সহজ নয়, তাই আমি কারোর কাছে বোঝা হতে চাই না। উনি জানেন আমি অন্য একজনকে ভালোবাসি। এই মিথ্যেটা সত্যি মনে করেই উনি একদিন আমাকে ভুলে যাবেন। হয়তো কালকের পর থেকে উনি আমাকে অলরেডি ঘৃণা করতে শুরু করে দিয়েছেন। শুধুমাত্র মানবিকতার খাতিরে উনি আমাকে সাহায্য করলেন।
ঋষভ বললো, তবে নয়না আমার মনে হয় উনি সত্যিই একজন ভালো মানুষ, তুমি যদি আগে ওনাকে সবটা বলতে, তাহলে হয়তো এত কিছু করতেই হতো না তোমাকে। তুমি যথেষ্ট বুদ্ধিমতী, তুমি এমন কাজ করবে আমি ভাবিনি। তুমি অন্য কোনো রাস্তা ঠিক বের করতে পারতে। নয়তো তুমি আমাকে একবার জানাতে। আমি তোমাকে কী বলেছিলাম মনে আছে তো? যেকোনো সমস্যায় তুমি আমাকে পাবে। এই নাও তোমার ফোন আর এটিএম কার্ড। তোমার মামা-মামিমা সহজে দিতে চায় নি। অনেক ক ষ্টে আমরা নিয়ে এসেছি। আচ্ছা এবার তুমি কী করবে বলো তো? তুমি এক কাজ করো তুমি আমাদের সাথে চলো।
নয়না সাথে সাথে বললো, না না আমি এখন এখানেই থাকবো। তারপর ভেবে দেখবো। তোমরা তো আছোই। আমি জানি আমার যেকোনো সাহায্যে তোমাদের আমি পাবো।
আর একটা কাজ আমার করবে ঋষভ? আমার এটিএম থেকে কিছু টাকা তুলে নিয়ে এসো, আমার খুব দরকার।
সোমাশ্রী বললো, তুমি বলো কত দরকার? আমরা দিচ্ছি। তোমার টাকা এখন তুলতে হবে না।
নয়না বাধা দিয়ে বললো, না না আমার বেশ ভালোই জমানো আছে। এখান থেকে যদি তুলে দিতে পারো তো ভালো। নয়তো আমার দরকার নেই।
ঋষভ নয়নাকে ভালো করেই চেনে। নয়নার এটিএম নিয়ে টাকা তুলে নিয়ে এসে নয়নাকে দিল। এরপর আরও কিছু কথা বলে সোমাশ্রী আর ঋষভ চলে গেল। যাওয়ার আগে দুজনে বারবার বললো যেকোনো সমস্যায় ওদের ফোন করতে।
রাত বাড়লো। নয়না ঠিক করলো, যা করার এবার ওকে একাই করতে হবে। হোস্টেলের সুপারের কাছে গেল নয়না। ভদ্র মহিলাকে দেখে রাগী মনে হলেও তিনি মনের দিক থেকে ভীষণ ভালো।
একটা চিঠি লিখে তাতে সুজয় বাবুর দেওয়া টাকাটা রেখে হোস্টেল সুপারের কাছে দিয়ে বললো, এটা যেন সুজয় বাবুর কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়। নয়না কাল সকালেই এখান থেকে চলে যাবে।
পরের দিন সুজয় বাবু যখন হোস্টেলে এসে নয়নার সাথে দেখা করতে এলো, তখন হোস্টেল সুপার, সেই চিঠি আর টাকা তুলে দিলেন সুজয় বাবুর হাতে।
চিঠিতে লেখা ছিল,
“আপনি সত্যিই একজন ভালো মানুষ। আপনার জীবনে সব কিছু ভালো হোক। আমি জানি, আমার জন্য অনেকের কাছে কথা শুনতে হচ্ছে আপনাকে। তার জন্য আমি বারবার ক্ষ মা চাইছি। আমার প্রেমিক ফিরে এসেছে, আমি তার কাছে ফিরে যাচ্ছি। আপনার টাকাটা দিয়ে গেলাম। অনেক অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। আপনার আগামী সুন্দর হোক”
নয়না…
নয়না বাসে করে অনেকটা পৌঁছে গেছে। যাচ্ছে সে গ্রামের বাড়ি। সিটে বসে চোখ বন্ধ করে ভাবছে, আমি জানি সুজয় বাবু, আপনি আমাকে ভীষণ পছন্দ করতেন। আপনার মতো সুপুরুষকে কোনো মেয়ে পছন্দ না করে থাকতে পারবে না। তবে এটাই আমাদের ভবিতব্য। আপনি একটা মিথ্যেকে সত্যি ভেবে আমাকে ভুলে যাবেন।
চলবে….