পরিণয় পর্ব-০৩

0
2

#পরিণয়
#তৃতীয়_পর্ব
#মৌসুমী_হাজরা

ঋষভের সাথে থাকাকালীন নয়না যেন কেমন স্বা’র্থপর হয়ে উঠেছিল। এর আগে কোনোদিন এতটা যত্ন আর সম্মান কোথাও সে পায়নি। সোমাশ্রীর ব্যাপারে সবটাই জানতো, বলা ভালো ঋষভই তখন জানিয়ে ছিল। প্রথম থেকেই ঋষভ ছিল খোলা বইয়ের মতো, নয়নার কাছে। এইরকম একটা ছেলেকে ভালো না বেসে থাকা যায় না। তাই সেইসময় আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে রাখতে চেয়েছিল ঋষভকে। কিন্তু নয়না বুঝেছিল ঋষভ তার নয়। সে শুধু সোমাশ্রীর।

আগে ঋষভের মুখে সোমাশ্রীর নাম শুনলেই জ্ব’লে উঠতো নয়না। এখন সেই সোমাশ্রীকে ঋষভের সাথে দেখলে ভালো লাগে তার। জীবনটা বড়ো অদ্ভুত! একটা সময় পর ভালোবাসার মানুষ ভালো থাকলে নিজেরই ভালো লাগে। নয়না চাইলে সোমাশ্রী আর ঋষভের সম্পর্কটা জটিল করতে পারতো। কিন্তু নয়না তা করে নি। আর করবেই বা কেন? ঋষভ যে তার নয়। তাই সরে এসেছে সব কিছু থেকে। এখন একটাই স্বপ্ন মা-বাবার স্বপ্ন পূরণ করার। সুজয়ের সাথে বিয়ে ভা ঙার আরও একটা কারণ হলো ঋষভ। নয়না চাইলেই সুজয়কে সবটা আগে বলতে পারতো। সুজয় ভালো ছেলে, নয়নার স্বপ্ন পূরণে বাধা হয়ে দাঁড়াতো না, বরং নয়নার পাশে থাকতো। কিন্তু নয়নার মনে হয়েছিল, ঋষভকে ভুলতে সুজয়কে ব্যবহার করবে না সে। কাউকে ভুলতে গিয়ে কাউকে কাছে টানা ঠিক নয়।
এটা সে ঋষভের কাছ থেকে শিখেছে। নয়নার চায় সময়। তবে সব থেকে ভালো হতো, বিয়ের মতো সিন্ধান্ত মামা-মামিমা এত তাড়াহুড়ো করে না নিয়ে, ধীরে সুস্থে হলে নয়না আর সুজয় একে অপরকে জানার সুযোগ পেত। হয়তো কোনো একদিন নয়না তার সব জমানো কথা সুজয়কে বলতে পারতো।

বাস এসে থামলো। নয়নার সম্বিৎ ফিরলো। এতক্ষণ ধরে এইসব কিছু ভাবছিল মনে মনে। এবার বাস থেকে নামলো। কিন্তু এখন ও যাবে কোথায়? গ্রামের বাড়ির ঠিকানা ওর কাছে আছে। এতদিন কেউ কারোর সাথে কোনো সম্পর্ক রাখে নি। আজ হঠাৎ ওর পরিচয় দিলে জ্যেঠু কাকুরা কি তাকে মেনে নেবে? মামা-মামিমার কাছে শুনেছে নয়নার বাড়ির লোকেরা কেউ নয়নাকে রাখতে চায় নি। তাই তাঁরা নয়নার দায়িত্ব নিয়ে ছিলেন। তবুও নয়নার র’ক্তের টানে আজ এখানে আসা। মনে কোথাও না কোথাও একটা আশা আছে।

বাড়ির ঠিকানায় এসে পৌঁছালো নয়না। খুব একটা মনে পড়ছে না কিছু। নয়নার বাবা, চার ভাই ছিলেন। এক জ্যেঠু আর দুই কাকুর বাড়ি পাশাপাশি বিশাল জায়গা জুড়ে। এছাড়াও গ্রামে আরও একটি জায়গা আছে শুধু নয়নার বাবার, যার কথা মামা-মামিমার মুখে শুনেছিলেন এমনকি বাবা-মায়ের স্বপ্নের কথা।

… কে মা তুমি? কাউকে খুঁজছো?
… আমি কলকাতা থেকে এসেছি। আমার নাম নয়না।

এটা শোনার পরই ভদ্রমহিলার চোখ দুটো আনন্দে জ্বলজ্বল করে উঠলো। তিনি নয়নার মাথায় গায়ে হাত বুলিয়ে বললেন, তুমি নয়না? আমাদের নয়ন আর আনন্দির মেয়ে?
নয়না নিজের মা বাবার নাম ওই ভদ্রমহিলার মুখে শুনে বুঝলো, নিশ্চয় তিনি এই পরিবারের কেউ হবেন।
নয়না ঘাড় নাড়লো। এবার ওই ভদ্র মহিলা নয়নাকে জড়িয়ে ধরলেন। নয়নাও একটু শান্তি পেল। এই কয়েকদিনে তার মনে অনেক ঝড় বয়ে গেছে।
ভদ্রমহিলা বললেন, আমি তোমার নিজের জেঠিমা। তোমার বাবার বৌদি। আমি জানতাম, তুমি একদিন এই গ্রামে ঠিক আসবে। নাড়ির টান, র’ক্তের টান একদিন ঠিক তোমায় এখানে নিয়ে আসবে। এসো মা বাড়িতে এসো। তোমার জ্যেঠু তোমায় দেখলে ভীষণ খুশি হবে।

নয়না যেন একটু প্রাণ ফিরে পেল। জ্যেঠু নয়নার পরিচয় পেয়ে খুব খুশি হলেন। দুই কাকিমা আর দুই কাকুও বেশ খুশি হলেন। নয়না এবার জানতে পারলো, এখানে তার বাবার যে ভাগটি ছিল সেটি দুই কাকু নিয়ে বাড়ি বানিয়েছেন। তবে তার দরুণ নয়নার মামা-মামিমাকে বেশ মোটা অঙ্কের টাকা তাঁরা দিয়েছিলেন। যা নয়নার ভবিষ্যতে কাজে লাগতে পারে সেই মনে করে। সেই ব্যাপারে নয়না কিছু জানতো না যদিও। গ্রামের বাইরে নয়নার বাবার বেশ এলাকা জুড়ে জায়গা আছে, সেটা শুধু নয়নার বাবার। সেখানে স্কুল তৈরি করতে চেয়েছিলেন তিনি। তবে এখন সেই জায়গায় স্কুল তৈরি করাটা মোটেও সহজ ব্যাপার নয়। বহু প্রমোটার আর রাজনৈতিক দলের কিছু মানুষ সেই জায়গাটি কবজা করতে চান। সেখানে নয়না কীভাবে একা ল’ড়বে?

জ্যেঠু নয়নার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, ভাই আর বৌমার স্বপ্ন পূরণ করতে পারবো কিনা জানি না, তবে তোর সাথে আছি মা। এই বাড়ি তোরও। তুই এখানে নিজের মতো করে থাক। নিজের পরিবার পেয়ে নয়না বেশ খুশি হয়েছিল। একেই বলে র’ক্তের টান। তবুও মনে অনেক কিছু চলছিল, কীভাবে স্কুল তৈরি হবে? আর সুজয় বাবু…. তিনি কি তাকে কোনোদিন ক্ষ মা করবেন? যদি কোনোদিন দেখা হয় নয়না তাঁকে সব সত্যিটা বলবে।
ফোনটা বেজে উঠলো নয়নার, ফোনের স্ক্রিনে ঋষভের নাম্বার। কিন্তু রিসিভ করলো না সে। ঋষভ আর সোমাশ্রীর থেকে এখন কদিন দূরত্ব থাক। ওরা একটু নিজেদের মতো করে থাকুক। নয়না আর কোনো ভাবে ওদের মাঝে আসবে না। পরে সব যদি ভালো ভাবে মিটে যায়, নয়না নিজেই ফোন করে জানাবে।

… কী হলো ঋষভ? নয়না ফোন ধরলো না?
… না রে শ্রী। তিনবার ফোন করলাম ধরলো না।
… কোনো বিপদে পড়লো না তো মেয়েটা?
… কী করে বুঝবো বল। ফোনই তো ধরছে না।
… আচ্ছা বেশ একটু পরে আবার ট্রাই করবি না হলে।
… হুম সেই ভালো। জানিস শ্রী, নয়নার মধ্যে একধরনের জেদ আছে, কোনো কিছুকে ভেবে নিলে সেটা সে করবেই।
… এই জেদই তো ওকে, অনেক দূর নিয়ে যাবে।
… আমি নয়নাকে কোনোদিন ভালোবাসতে পারিনি ঠিকই, তবে ও একটা সময় আমার ভীষণ কাছের একজন মানুষ ছিল। আমাকে ভীষণ সাপোর্ট করেছিল।
… জানি রে ঋষভ। আমি মেয়েটার সাথে কথা বলে বুঝেছি। তবে আমার একটা বিষয়ে খটকা লাগছে জানিস।
… কী বল তো?
… নয়নার সাথে সুজয় নামের একজনের বিয়ের কথা ছিল। এই সুজয় আমাদের সুজয় বাবু নয় তো? না মানে তুই একবার বিষয়টা ভেবে দেখ, নয়না বিয়ের মণ্ডপে বললো, ও অন্য একজনকে ভালোবাসে, তাই বিয়ে করতে পারবে না, অন্য ছেলে হলে তখন বাড়ির সকলকে অপমান করতো। কিন্তু ওই ছেলেটি নয়নাকে ঘর থেকে বের করে নিয়ে এসে একটি সেফ জায়গায় রাখে। বিশাল বড়ো মন না হলে সচরাচর এই কাজ কেউ করতে পারবে না। আমাদের সুজয় বাবুও তো ভীষণ ভালো মানুষ। আমাদের কত সাহায্য করেছিল বল। ওই সুজয় আর এই সুজয় যদি এক মানুষ হয়, তাহলে আমি নয়নাকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে বিয়ের জন্য রাজি করাবো।
… তুই কত কী ভাবিস রে? তোর এই বোকা মাথাতে এইসবও ভাবনাও আসে? তবে এটা কোনোভাবেই সম্ভব নয়।
… তুই কী করে বুঝলি এটা সম্ভব নয়? সুজয় বাবু তাঁর হবু স্ত্রীর ছবি তোকে দেখিয়েছিল? না নয়না তার হবু বরের ছবি তোকে দেখিয়েছিল? নাকি আমরা ছিলাম ওই বিয়েতে?
… না তা নয়, তবে….

ঋষভের মা বললেন, তোরা এত তর্ক-বিতর্ক না করে একবার সুজয়কে ফোন কর না। ওর বিয়েতে তো আমিও যেতে পারিনি, হাঁটুর ব্য থার জন্য। আমি গেলেও বা জানতে পারতাম।
ঋষভ তার মা আর সোমাশ্রীর জোর করাতে, ফোন করলো সুজয়কে।
… কী ব্যাপার হিরো? হানিমুন থেকে ঘুরে চলে এলেন?
… হ্যাঁ চলে এসেছি। তাই ভাবলাম একবার আপনার সাথে দেখা করি। আপনি আমাদের বিয়ে দিলেন। অথচ আপনার বিয়েতেই আমরা থাকতে পারলাম না।
… ভালোই হয়েছে থাকেন নি।
… কেন?
… আরে মশাই বিয়েটাই তো হয়নি।
… কেন কী হয়েছে? ( ঋষভ অনেক কৌতূহল নিয়ে জিজ্ঞাসা করলো)
… সে অনেক কথা ঋষভ। দেখা হলে বলবো। এখন একটু ব্যস্ত আছি, পরে কথা বলবো।

নয়নার ব্যাপারে কারোর সাথে কথা বলতে ভালো লাগে না সুজয়ের। সবাই দোষারোপ করে, জাজ করে নয়নাকে। কিন্তু এত বড়ো একটা অন্যা’য়ের পরেও নয়নাকে দো’ষী ভাবতে নারাজ সুজয়। চোখ বন্ধ করলেই প্রথম দিনের দেখা করার কথা মনে পড়ে যায়।

… কী হলো? হাঁ করে কী দেখছিস। মুখে কথা বল।
… সুজয় বাবুর বিয়ে হয়নি।
… কেন?
… কারণ টা বললো না। এখন তিনি ব্যস্ত আছেন।
… রাখ তো ব্যস্ততা। আমাকে ফোনটা দে।

সোমাশ্রী এবার নিজে ফোন করলো। সুজয় ফোনটা রিসিভ করে বললো,
… হ্যাঁ বলুন ঋষভ।
… সুজয় বাবু আমি সোমাশ্রী।
… হ্যাঁ সোমাশ্রী বলুন। কেমন আছেন?
… সেই সব কথা পরে হবে। আমি একটা কথা জানতে চাই।
… হ্যাঁ বলুন।
… আপনার সাথে যার বিয়ের কথা ছিল। তার নাম কি নয়না?
… আপনি জানলেন কী করে? আপনাদের তো বিয়ের কার্ড দেওয়া হয় নি। মুখে বলে ইনভাইট করেছিলাম, নিজের মানুষ ভেবে।
… আমি ঠিকই ভেবেছিলাম। আপনিই সেই ব্যক্তি।
… আমি কিছু বুঝতে পারছি না সোমাশ্রী।
… দেখা করুন আজ। সব বলবো। শুধু এইটুকু জেনে রাখুন, নয়না আপনাকে মিথ্যে বলেছে ওর কোনো প্রেমিক নেই।

সুজয় ফোনটা রাখার পর কেমন অস্থির হয়ে উঠলো। নয়না এমন কেন করলো তাহলে?

রেস্টুরেন্টে তিনজন বসে আছে। ঋষভ আর সোমাশ্রীর মুখে সবটা শুনলো সুজয়। মনের মধ্যে হালকা যে অভিমানের মেঘ ছেয়ে ছিল, তা সরে গেছে সুজয়ের।
ঋষভ বললো, আপনাদের বিয়ে হোক বা না হোক। আপনার কাছে এইটুকুই অনুরোধ ওকে ভু ল বুঝবেন না। হ্যাঁ, ও যেটা করেছে সেটা অ’ন্যায়। কিন্তু ওর মনে কোনো পাপ নেই। ও যে পথটা অবলম্বন করেছে সেটা ভু ল। তবে একদিক দিয়ে দেখুন, কিছু মেয়ে থাকে, যারা নিজেদের স্বপ্নগুলো
কারোর উপর চাপিয়ে দেয় না। বরং নিজে বাস্তবায়িত করে। নয়নাও সেইরকমই একজন মেয়ে।

সুজয় বাবু দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন। না, তার উপর আমার কোনো রা গ নেই। তবে এইসব শোনার পর শ্রদ্ধা আরও বেড়ে গেল। তার সাথে ওর প্রতি ভালোবাসা। ওর স্বপ্নপূরণে, ও না চাইলেও আমি ওর সাথে থাকবো। আচ্ছা ওর গ্রামের বাড়ির ঠিকানা টা দিন তো।
ঋষভ বললো, আমি ঠিকানাটা তো জানি না। তাছাড়া ও ফোনও ধরছে না।
সোমাশ্রী বললো, কেন তুই আগে জিজ্ঞাসা করিস নি?
ঋষভ ঘাড় নেড়ে না জানালো।
সোমাশ্রী রে গে বললো, একটা কাজও তোর দ্বারা ঠিক মতো হয় না।
সুজয় বাবু বললেন, আহা আপনারা ঝ’গড়া করবেন না। আমি ওর মামা-মামিমাকে ফোন করে গ্রামের বাড়ির ঠিকানা নিয়ে নিচ্ছি।

অবশেষে নয়নার ঠিকানা পাওয়া গেল। সুজয় কালই যাবে।
সুজয়ের সামনাসামনি হলে নয়না কী করবে? আর কী বাহানা দেবে নয়না?
তবে সুজয়ের মনে বেশ আনন্দ আর ভালোলাগার শীতল বাতাস বইছে। নয়নার প্রতি তার অনুভূতি সাময়িক নয়, তা যে অনেক গভীর।

চলবে…

ভুল ত্রুটি মার্জনীয়।