পরিণয় পর্ব-০৬

0
2

#পরিণয়
#ষষ্ঠ_পর্ব
#মৌসুমী_হাজরা

… নয়না সেন কথা বলছেন?
… হ্যাঁ। কিন্তু আপনি কে?
… আপনি আমাকে চিনবেন না। আর চেনার চেষ্টাও করবেন না।
… মানে? কী বলতে চান আপনি?
… যা বলতে চাই মন দিয়ে শুনুন। ভালোই তো শহরে ছিলেন মামার কাছে। এই গ্রামে আবার কীসের টানে ফিরলেন? যারা একবার গ্রাম ছেড়ে শহরে চলে যায়, তাদের তো এত টান থাকে না। এসেছেন যখন কদিন থাকুন, ঘোরাঘুরি করুন, গ্রামে এসে সেলফি নিন, তারপর চলে যান। স্কুল করার ভূত মাথায় চাপলো কেন?
… সাহস থাকলে নিজের নামটা বলুন। আমি আপনাকে ভ য় পাই না।
… আরে বোকা মেয়ে, আমি ভ য় কখন দেখালাম। আমি তো একটা কথা বোঝাচ্ছি আপনাকে। এত কম বয়স আপনার। এইরকম হুটহাট সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে দশবার ভাবুন।
… আমি অনেক ভাবনা-চিন্তা করেই ডিসিশন নিয়েছি। আপনাকে আমার এত কথা ভাবতে হবে না।
… সে নাহয় আরও একবার ভাবলেন। জমির দাম কিন্তু ভালোই পাবেন। স্কুলের ভূত মাথা থেকে নামিয়ে নিন। আর ছেলে-মেয়েরা এত শিক্ষিত হয়ে কী করবে?
… সেই… শিক্ষিত হলে তো আপনাদের মতো মানুষদের ক্ষ তি হয়ে যাবে। আপনারা আপনাদের ক্ষমতার জাহির দেখাচ্ছেন ওদের জন্য। ওরা যদি শিক্ষার আলোতে আসে, তাহলে কখনোই ওরা আপনাদের মতো মানুষের সাথ দেবে না।
… র’ক্ত গরম, তাই মাথা কাজ করছে না আপনার। ভাবুন ভাবুন। আর হ্যাঁ গ্রামের মেয়েদের নিয়ে কাজ করছেন করুন, তাতে আমার কোনো সমস্যা নেই। তবে ওদেরকে আবার বশ করবেন না। ভালো থাকবেন ম্যাডাম, পরে আবার ফোন করবো।

ফোনটা ডিসকানেক্ট হয়ে গেল। আজ সকালেই সুজয় এখান থেকে চলে গেছে কলকাতায়। সারাদিন একবারও ফোন করেনি। আর একটু দেখা যাক তারপর নাহয় নয়না নিজেই ফোন করবে।

… এই দিদিভাই কী ভাবছো?
কোয়েলের কথায় সম্বিৎ ফিরলো নয়নার। হাসিমুখে বললো, কই কিছু না তো।
মনে মনে ভাবলো, কোয়েলকে ফোনের ব্যাপারে কিছু বলা যাবে না, বাচ্চা মেয়ে ভ য় পাবে।
কোয়েল বললো,
… সুজয় দা ফোন করেছিল?
… না এখনও করেনি, বোধহয় ব্যস্ত আছে।
… তুমি একবার করো না।
… না থাক।
… আচ্ছা তোমাকে করতে হবে না। আমিই করছি। নাম্বারটা দাও।
… আরে পাগলামি করছিস কেন?
… ঠিক আছে দিতে হবে না, চলে যাচ্ছি আমি।
… আরে! কত রা গ মেয়ের। এই মেয়ে আবার শ্বশুর বাড়ি যাবে।
… কথা ঘুরিয়ে লাভ নেই।
… আচ্ছা ঠিক আছে, এই নে নাম্বার।

সুজয়ের ফোন নাম্বার পেয়ে কোয়েল ফোন করলো সুজয়কে…. সুজয় ফোন ধরতেই…
… হ্যালো সুজয়দা, আমি নয়নাদির বোন কোয়েল।
… দিদির নাম না বললেও বোনের নাম শুনলে চিনতে পারবো। বলো কী করছো?
… আগে তুমি বলো, ফোন করোনি কেন?
… আমার কাছে তো তোমার নাম্বার ছিল না।
… আরে আমার কথা বলিনি। দিদিকে ফোন করো নি কেন? ও তো রা গ করে মুখ ফুলিয়ে বসে আছে।

নয়না সাথে সাথে হাত থেকে ফোনটা নিয়ে বললো, মোটেও না। ও মিথ্যে কথা বলছে। আমি কেন মুখ ফুলিয়ে বসে থাকবো?
সুজয় বললো, হুম সেই তো, কেন মুখ ফুলিয়ে বসে থাকবে? আমি কে এমন? যে আমার ফোনের অপেক্ষা করে কেউ বসে থাকবে।

নয়না চুপ করে গেল।
… কী হলো? চুপ করে গেল কেন? এই তো কিছুক্ষণ আগে বেশ উত্তেজিত হয়ে কথা বলছিলে।
… আপনি আপনার কাজ করুন পরে কথা হবে।
… আমার কাজ এখন নেই।
… তাহলে ফোন করেন নি কেন?
কথাটা যেন অনেক অভিমান করে জিজ্ঞাসা করলো নয়না।
… করতাম একটু পরেই। বাড়ি ফিরে।
… ওহ।
… সব ঠিক আছে তো? মেয়েরা আজ এসেছিল?
… হুম সব ঠিক আছে। মেয়েরাও এসেছিল।
… কী কথা হলো?
… এমনি ব্যবসা সংক্রান্ত। এছাড়াও আজ জেঠিমা আর কাকিমারা মিলে ওদের অক্ষর পরিচয় করিয়ে দিয়েছে। কাল আমি আর কোয়েল মিলে শুরু করবো।
… এত ব্যস্ততার মাঝে আমাকে মনে পড়বে?
… মনে কেন পড়বে না?
… সে না মনে পড়লে আমিই মনে করিয়ে দেবো। ফোন তো আছেই। আর সময় পেলেই হুটহাট ওখানে গিয়ে উপস্থিত হয়ে যাবো।

কথাটা শুনেই নয়না মুচকি হাসলো। পরক্ষণেই কোয়েলকে দেখে হাসি থেমে গেল। তারপর বললো, ঠিক আছে পরে কথা হবে। ফোনটা এবার কোয়েলকে দিতে হবে।

… আমি তোমার কাছে কখন ফোনটা চাইলাম দিভাই?
… না চাস নি। তবে হাঁ করে এমন তাকিয়ে ছিলি কেন?
… বলতেই পারতে আমি সরে যেতাম।
… না, আমাদের এমন কিছু কথা নেই যে তোর সামনে বলা যাবে না।
… সে ঠিক আছে। তবে একটা কথা বলবো দিভাই?
… বলতে না বললে, শুনবি যেন। বল কী বলার আছে, শুনি।
… তুমি যখন সুজয়দার সাথে কথা বলো, তখন নিজেকে একবার আয়নাতে দেখবে।
… কেন?
… আরে দেখবে না একবার।

ফোনের কথাটা সুজয়কে বলা কি ঠিক হবে? নাকি এইসব এখন না বলা ভালো? দেখা যাক সেরকম বাড়াবাড়ি কিছু হলে তখন জানাবে সে।

আরও কয়েকমাস পার হলো, এর মাঝে সুজয়ের সহযোগিতায় নয়না সব রকম পারমিশন পেয়ে গেছে স্কুল তৈরির জন্য।
অবশেষে স্কুলের কাজ শুরু হলো। এর মাঝে আর কোনো হুমকি ফোনে সে পায় নি। গ্রামের মানুষের সহযোগিতা অনেক পেয়েছে সে। সকলে মিলে এই কাজে হাত মিলিয়েছে। নয়না খুশি। সুজয়ের সাথে সম্পর্ক আরও ভালো হয়েছে। আপনি থেকে তুমি হয়েছে। এই সম্পর্কের নাম বন্ধুত্বের হলেও, দুজন দুজনের খুব কাছের।
সারাদিনে দুজনেই কাজের ফাঁকে ফাঁকে একবার করে ফোনে কথা বলে। দুজনের মধ্যে একে অপরের প্রতি এই টান দুজনেই বেশ অনুভব করে। সুজয় মনের কথা প্রকাশ করেনি ঠিকই, তবে সাথে থেকে বুঝিয়ে দেয়। নয়না নিজের অতীতের কাজের জন্য মাঝেমধ্যে নিজেকে অপরাধী ভাবে। কিন্তু সুজয়ের ব্যবহার তাকে ভুলিয়ে দেয় সব।

আজ অনেকদিন পর সুজয় আসবে, ঘন্টাখানেকের জন্য। জ্যেঠুকে বলে বেরিয়ে গেল নয়না। বারবার নিজেকে আয়নায় দেখেছে সে। আজ কপালে ছোট্ট কালো টিপ পরেছে।

… আচ্ছা ঋষভ, কোনো খবর পেয়েছিস নয়নার?
… নয়নার সাথে তো কথা হয়নি৷ তবে সুজয় বাবুর সাথে কথা হয়েছে।
… হ্যাঁ রে, কতদূর এগিয়েছে সম্পর্কটা ওদের?
… ওই আমরা যতদূর এগিয়ে ছিলাম।
… সে আবার কী?
… এত তাড়াহুড়োর তো দরকার নেই শ্রী। নয়না তো সময়ই চেয়েছিল।
… হুম তা ঠিক বলেছিস।
… দুজন দুজনকে বেশ পছন্দ করে, বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছে ওদের মধ্যে। একে অপরকে বারেবারে ফোন করে।
… সুজয় বাবু তোকে এইসব বলেছে?
… হুম। সবই বলে আমাকে। আমি ভীষণ খুশি নয়নার জন্য। ওরা দুজনে খুব ভালো থাকুক।

নয়না এগিয়ে যাচ্ছে সুজয়ের দিকে। রাস্তার ওইপাশে সুজয়। আজ নয়না শাড়ি পরেছে। কেন পরেছে সে নিজেও জানে না। সুজয় মুগ্ধ হয়ে দেখছে। পৃথিবীর সব থেকে সুন্দর মুহুর্তের মধ্যে এটা একটা, কাউকে মুগ্ধ হয়ে দেখা।
… আমি কী খুব বেশি দেরি করে ফেললাম সুজয়?
… না, আর এমনিতেও আমি অপেক্ষা করতে জানি।

কথাটার মানে ভালো করেই জানে নয়না। তাই আর মুখে কিছু বললো না। মনে মনে ভাবলো, আর বেশিদিন অপেক্ষা করতে হবে না তোমায়, আমি নিজেই এবার মনের কথা তোমায় বলবো।

… আচ্ছা নয়না একটা কথা জিজ্ঞাসা করবো?
… হুম বলো।
… প্রথম দিন যেদিন আমি এই গ্রামে এসেছিলাম তোমার সাথে দেখা করতে, তুমি সেদিন একটা কথা বলেছিলে, তুমি হারাতে ভ য় পাও। সেই ভয় আজ আর আছে?
… এখন ভ য় টা আরও বেশি হয়।
… কেন?
… এত এত সুখ, আমার পোড়া কপালে সইলে হয়।
… এইসব কী কথা?
… (নয়না হেসে বললো) হ্যাঁ সত্যিই তো। আমার কপালে এত সুখ নেই।
… তুমি ভবিষ্যৎ দেখতে পাও নাকি?
… না তা পাই না।
… তাহলে? এইসব ফালতু কথা ভাবার দরকার নেই। নিজের কাজে মন দাও। যা করতে চাইছো সেটা মন দিয়ে করো। ব্যস! বাকি এত ভাবার দরকার নেই।
… আরে এত সিরিয়াস হওয়ার কী আছে? আমি তো এমনিই বললাম।
… বাদ দাও এইসব। ওহ বলা হয় নি।
… কী?
… তোমাকে অনেক সুন্দর লাগছে আজ। শাড়ি পরার বিশেষ কোনো কারণ ছিল আজ?
… না, কোয়েল জোর করলো।
… কোয়েলকে থ্যাঙ্কিউ বলে দিয়ো, আমার হয়ে।
… কেন?
… সে তোমার বোকা মাথাতে ঢুকবে না। কোয়েল বুদ্ধিমতী, ও বুঝে যাবে।
… কী বললে আমাকে?

এইভাবে খুনসুটিতে বিকেলটা পার হলো।
… নয়না, এবার তোমাকে বাড়ি ফিরতে হবে।
… আর একটু থাকি।
সুজয় একটু অবাক হয়ে তাকালো নয়নার দিকে। মনে মনে ভাবলো, আমি তো তোমাকে সারাজীবন নিজের কাছে রেখে দিতে চাই।

… সুজয়
… হুম বলো।
… আমাকে ক্ষ মা করে দিয়ো।
… কেন? এইসব কথা কেন?
… আমি তোমার সাথে অ’ন্যায় করেছিলাম।
… সেইসব আমি কিছুই মনে রাখি নি। তাছাড়া সত্যিটা জানার পরে তোমার প্রতি কোনো অভিমান আমার নেই।
… আরও কিছুক্ষণ থাকি।
… থাকো, তবে আমি বাড়ি পৌঁছে দেবো। তোমাকে একা একা যেতে দেবো না।
… না না, তোমাকে যেতে হবে না। আমি চলে যাচ্ছি।
… আরে কী হবে? আমি পৌঁছে দিলে?
… না, তুমি সাবধানে বাড়ি পৌঁছে যাবে। আমি চলে যাবো।

সুজয় আর কিছু বললো না। নয়না কিছুটা এগিয়ে গিয়ে আবার পিছন ফিরে তাকালো, তারপর বললো, আমার কেন মনে হচ্ছে আমাদের এটাই শেষ দেখা।
সুজয় বললো, তোমার মনে হওয়া সঠিক আমি হতে দেবো না। তুমি পৃথিবীর যে প্রান্তে থাকো না কেন, আমি ঠিক তোমার কাছে পৌঁছে যাবো।
নয়না হাসলো, তারপর চলে গেল।

নয়নার সাথে দেখা করার পর সুজয় গাড়ি নিয়ে কলকাতা ফিরছে। মাঝ রাস্তায় একবার নয়নাকে ফোন করলো, কেন জানি মনটা আনচান করছে তার। কেমন যেন চঞ্চল হয়ে আছে। নয়নার ফোন বন্ধ।
ফোন তো বন্ধ রাখে না নয়না। ভাবতে ভাবতেই কোয়েল ফোন করলো।
… হ্যালো সুজয়দা। দিদিভাই তোমার সাথে আছে?
… না তো কোয়েল। এক ঘন্টা আগে আমাদের দেখা হয়েছিল। আমি এখন মাঝ রাস্তায়।
… কিন্তু দিদিভাই তো বাড়ি ফেরেনি। ও তো এত রাত করে না।

সুজয় গাড়ি ঘুরিয়ে আবার গ্রামের দিকে রওনা দিল। মনে মনে তখন একটাই কথা ভেবে যাচ্ছে, কিচ্ছু হবে না নয়নার। আমি ওকে আর হারাতে দেবো না।

পরের পর্বে সমাপ্তি।

ভুল ত্রুটি মার্জনীয় 🙏