পরিণয় পর্ব-০৭ এবং শেষ পর্ব

0
3

#পরিণয়
#অন্তিম_পর্ব
#মৌসুমী_হাজরা

সুজয় তুমি মেয়েটাকে যে ভাবেই হোক খুঁজে দাও, এত রাত তো মেয়েটা করে না। এমনিতেই ওর শ ত্রু কোথায় যে ঘাপটি মে’রে বসে আছে, জানি না। ফোনও বন্ধ। তুমি যেভাবেই হোক আমাদের মেয়েটাকে খুঁজে দাও।
কা’ন্নায় ভে ঙে পড়লেন জ্যেঠু। সুজয় তাঁকে কোনোরকমে শান্ত করে বললেন, চিন্তা করবেন না, ওর কিচ্ছু হবে না।
বাড়ির সকলের কপালে চিন্তার ভাঁজ। জেঠিমা, দুই কাকিমা আর কোয়েল সমানে কেঁ দে চলেছে।

সুজয় ওখানকার পুলিশের সাথে কথা বলে নিল। তারপর নয়নার ফোন লোকেশন ট্র‍্যাক করে জানতে পারলো, এই গ্রামে ঢোকার পরেই ফোন বন্ধ হয়েছে। ওখানকার পুলিশ গ্রাম থেকে বেরিয়ে শহরে যাওয়ার রাস্তার প্রতিটি চেকপোস্টে খবর দিলেন।

সুজয় কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলো। মাথা ঠাণ্ডা করে একটু ভেবে বললো, এই গ্রাম থেকে নয়নাকে বাইরে নিয়ে যাওয়া হয়নি। আগে এই গ্রামেই তন্নতন্ন করে খুঁজতে হবে।
সুজয় এবার কোয়েলকে জিজ্ঞাসা করলো, তোমার দিদিকে কেউ ফোন করে বির’ক্ত করতো? বা হু’মকি দিত?
কোয়েল বললো সেইসব কথা তো দিদি বলতো না। তবে সন্দীপ আমাকে বলেছিল, দিদিভাই যে ভাবে কাজ করছে গ্রামের জন্য, তাতে অনেক শ’ত্রু বাড়তে পারে।

সুজয় এবার পুলিশদের জিজ্ঞাসা করলো, নয়না স্কুল না গড়লে কাদের লাভ হবে? তাদেরকে আগে চিহ্নিত করে, তারপর আমাদের এগোতে হবে।
মোটামুটি একটা সন্দেহের লিস্ট তৈরি করে পুলিশ খুঁজতে শুরু করলো।

নয়নার জ্ঞান ফিরলো। তার মুখ আর হাত দুটো বাঁধা। চোখ খুলতেই তাকিয়ে কয়েকজন অপরিচিতদের দেখতে পেল। সবার মুখে ক্রুর হাসি। নয়ন খেয়াল করলো, সে একটা ঘরের মধ্যে আছে। চারিদিক অন্ধকার। তবে ঘরের উপর কোনো ছাদ নেই, আকাশের তারা দেখা যাচ্ছে। শুধু অপরিচিতদের মোবাইলের আলোতে বুঝতে পারলো, ওর সামনে এখন ৫/৬ জন পুরুষ দাঁড়িয়ে আছে। তারপর একজন নয়নার মুখটা খুলে দিল।
… কী বলেছিলেন নয়না ম্যাডাম, সাহস থাকলে, আপনার সামনে এসে দাঁড়াই যেন। নিন দাঁড়িয়ে আছি। কী করবেন?
… কে আপনি? আমাকে ধরে রেখেছেন কেন? আমাকে বাড়িতে যেতে দিন।
… অনেক বুঝিয়ে ছিলাম আপনাকে, শুনলেন না। নিজের জেদে স্কুল গড়া শুরু করে দিলেন, এই যে কতটা গড়ে উঠেছে স্কুল।

নয়না এবার বুঝতে পারলো সে কোথায় আছে। এটা তো স্কুল। আর কদিন পরই ছাদ ঢালাই হওয়ার কথা। এখানে ওকে কে খুঁজতে আসবে?
… কী ভাবছেন ম্যাডাম? এখানে আপনাকে কেউ খুঁজতে আসবে না। সারা গ্রাম সবাই তন্নতন্ন করে খুঁজেও আপনাকে পাবে না। এই মুহুর্তে এখানে যদি আপনাকে পুঁতে দেওয়া হয়, কেউ কিছু টের পাবে না।

নয়নার এবার বেশ ভ য় লাগলো। সুজয়কে কি আর ও দেখতে পাবে না? জ্যেঠু, জেঠিমা, কাকু-কামিমারা, কোয়েল কাউকে আর দেখতে পাবে না? তবে নয়না নিশ্চিত ওর কিছু হয়ে গেলেও, ওর স্বপ্ন ঠিক পূরণ হবে। সুজয় আর বাড়ির সকলে মিলে তা পূরণ করবে।

… দাদা বেশিক্ষণ তো আমরা এই ম্যাডামকে এখানে রাখতো পারবো না। এনার একজন আশিক আছে, তিনি পুলিশ। ঠিক খুঁজে বের করে নেবেন।
… ভ য় নেই তোদের, ওকে কেউ খুঁজে পাবে না। ওখানে কোদাল আছে, ভিজে মাটি, খুঁড়তে বেশিক্ষণ সময় লাগবে না। তাড়াতাড়ি কাজ শুরু কর।
… দাদা, সত্যি সত্যি মাটি চাপা দিয়ে দেবে?
… তা নয়তো কী? ম্যাডামকে পুজো করার জন্য এনেছি নাকি? তাড়াতাড়ি কর। আমার সাথে চ্যালেঞ্জ করা। স্কুল তো হবেই, সেটা আটকানো যাবে না। কিন্তু যার উদ্যোগে হচ্ছিল, সেই এই পৃথিবীতে থাকবে না। কেউ তার খোঁজ কোনোদিন পাবে না।
বাবার জায়গা, সেই জায়গাতেই মিলিয়ে যাক। ছেলে-মেয়েরা যখন ছোটাছুটি করবে। তখন ম্যাডাম মাটির ভিতর থেকে শান্তি পাবেন।

কথাটা বলেই ক্রুর হাসি হেসে উঠলো সবাই। ওইদিকে মাটি খননের কাজ শুরু করে দিল।
পাশ থেকে আবার একজন বললেন, এই বেশ গভীর ভাবে খনন করবি। কেউ যেন ম্যাডামের হাড়-গোড়ও খুঁজে না পায়।

নয়না জানে কেউ এখানে তার খোঁজ পাবে না। মনে মনে ভাবলো, এই স্কুল গড়ে ওঠা আর দেখতে পাবে না। বাচ্চাদের নিয়ে, গ্রামের মেয়েদের নিয়ে কত স্বপ্ন দেখেছিল সে। এতদিন পর নিজের পরিবারের সাথে দেখা হলো, কত ভালোবাসা পেয়েছে তাঁদের থেকে, আর সুজয় বাবু, তার কাছে তো ক্ষ মা চাওয়া হলো, কিন্তু মনের কথা আর বলা হলো না।

গ্রামের চারিদিক খোঁজার পরেও যখন নয়নাকে পাওয়া গেল না, তখন সবাই খুব চিন্তিত হয়ে পড়েছে। গ্রামের প্রায় সব মানুষ বাইরে বেরিয়ে এসেছে।
সুজয় বললো, আমাদের আরও ভাবতে হবে। যেখান থেকে সব শুরু হয়েছে। অর্থাৎ স্কুল…
কথাটা শেষ করতে না করতেই, একজন বয়ষ্ক ভদ্রলোক দৌড়াতে দৌড়াতে এলেন। তিনি হাঁফিয়ে গেছেন, চোখেমুখে ভ য়ে র ছাপ। তিনি একটু সামলে নিয়ে বললেন, যেদিন থেকে স্কুল গড়ার কাজ শুরু হয়েছে। আমরা গ্রামের কেউ না কেউ ওখানে রাতে একবার করে দেখে আসি। ম দ বা জু’য়ার আসর বসেছে কিনা!
আজ ওখানে একটা মেয়েকে নিয়ে আসা হয়েছে। সাথে অনেকজন আছে। খা’রাপ কিছু ঘটতে চলেছে।

সুজয় বুঝতে পারলো। তাড়াতাড়ি পু’লিশ ফোর্স নিয়ে চললো। ঠিক সেই সময় গ্রামের একজন বললেন, দাঁড়ান সুজয় বাবু। আমরাও যাবো। চারিদিক ঘিরে থাকবো। যাতে কেউ না পালিয়ে যেতে পারে। আপনারা গাড়ি নিয়ে সোজা স্কুলে চলে যাবেন।

মাটি গভীর ভাবে খনন করা হয়ে গেছে।
… ম্যাডাম শেষ ইচ্ছে কিছু আছে। বলে ফেলুন তাহলে।
নয়না ঠোঁটে বিদ্রুপের হাসি, তারপর বললো, সমস্ত প্রমাণ ভালো ভাবে লোপাট করে দেবেন, নয়তো সুজয় যদি জানতে পারে কোনোদিন, কাউকে ছাড়বে না।

পাশ থেকে একজন বললো, ওই যে দাদা বললাম না, ম্যাডামের আশিক। ওনার নামই সুজয়।

হঠাৎ গাড়ির আওয়াজ পেতেই সবাই চমকে উঠলো। তাড়াতাড়ি রুমালটা নিয়ে নয়নার মুখে চেপে ধরতেই, নয়না জ্ঞান হারালো। তারপর নয়নাকে ওই গভীর গর্তে ফেলে দিয়ে যে যেদিকে পারলো ছুটে গেল।
কিন্তু চারিদিকে আলো জ্বলে উঠলো। গ্রামের সকল মানুষ, বাচ্চা থেকে নারী, পুরুষ সকলে মশাল জ্বেলে এত বড় মাঠের চারিদিকে দাঁড়িয়ে আছে। এই আলো যেন শিক্ষার আলো, নতুন এক ভোরের আলো। যা এতদিন অন্ধকারে ডুবে ছিল। গ্রামের মানুষদের হাত থেকে রেহাই পেল না তারা। হাতেনাতে ধরা পড়লো।

এইদিকে আলো জ্বালিয়ে চারিদিক নয়নাকে খুঁজতে শুরু করলো সবাই। এতক্ষণ অব্দি সুজয় মাথা ঠাণ্ডা রাখলেও এরপর তার মন চঞ্চল হয়ে উঠেছে। সে গর্তের কাছে এসে, টর্চের আলো ফেলতেই, দেখলো, নয়না সেখানে পড়ে আছে।
নয়নাকে সেখান থেকে উদ্ধার করে তাড়াতাড়ি হসপিটালে নিয়ে যাওয়া হলো।

২/৩ দিন পর…
মাথায় আর হাতে পায়ে অল্প চো ট পেয়েছিল নয়না। তবে এখন আগের থেকে সুস্থ।
দোষীরা সব এক রাজনৈতিক দলের সাথে জড়িত, তারা সকলেই ধরা পড়েছে। গ্রামের মানুষ সেদিনই পি’টিয়ে মে রে ফেলতো। তবে পুলিশ তাদের ধরে থানাতে নিয়ে গেছে।

সুজয় নয়নার সামনে বসে আছে।
… কেমন আছো এখন?
… ভালো আছি। আমাকে এখান থেকে নিয়ে চলো। ভালো লাগছে না। আমি বাড়ি যাবো। সবাই অপেক্ষা করছে।
… যাবে। একটা কথা জিজ্ঞাসা করি?
… আমি জানি তুমি কী জিজ্ঞাসা করবে?
… কী বলো তো?
… এর আগে আমি কোনো হু’মকি পেয়েছিলাম কিনা!
… তারমানে আমাদের অনুমান সঠিক। তুমি এর আগে হু’মকি পেয়েছিলে?
… হ্যাঁ।
… একবারও বলবার প্রয়োজন মনে করো নি তুমি? তোমাকে বারবার বলেছিলাম আমি, এই থানার ইনস্পেকটরও বলেছিলেন সব কিছু জানাতে। তাও তুমি এত বড়ো একটা বিষয় চেপে গেলে আমাদের থেকে। এবার সব নিজেই করো। আমি আর আসবো না, চলে যাচ্ছি এখান থেকে। অতীতেও যে ভুল করেছিলে, আজও সেই ভুল করলে। আমি যখন দূরের মানুষ, দূরেই থাকবো।

সুজয় রাগ করে বেরিয়ে যাওয়ার মুহুর্তে…
… সুজয় একটু দাঁড়াও।
… আর কিছু শোনার নেই আমার।
… সেদিন ওই রাতে, আমাকে যখন মে রে ফেলার কথা তারা বলছিল। আমি তখন বলেছিলাম, কোনো প্রমাণ না রাখতে। কারণ আমি জানতাম, তুমি জানতে পারলে, একটাকেও ছাড়তে না। আরও অনেক কিছু বলার আছে।
আমার যদি সেদিন কিছু হয়ে যেত, তাহলে একটা আফসোস সারাজীবন থেকে যেত।
… কী?
… একজনকে প্রত্যাখ্যান করে, তার কাছেই আবার ফিরতে না পারার।
… কেন ফিরবে আমার কাছে? আমাকে তো কোনোকথা তুমি বলো না।
… কোয়েল বলেছিল, তোমার মতো মানুষকে ফিরিয়ে দিতে নেই। আর আমি তো সত্যিই তোমায় ভালোবেসে ফেলেছি।

ঠিক তখনই কোয়েল আর সন্দীপ ঢুকলো। কোয়েল বললো, অনেক হয়েছে রাগ-অভিমান। এবার সব ভুলে যাও দুজনে।
সন্দীপ বললো, সুজয় বাবু আমি কোয়েলের মুখে সব শুনেছি। এবার আপনি দিভায়ের হাতটা শক্ত করে ধরে রাখুন একদম ছাড়বেন না।

ঋষভ আর সোমাশ্রী উপস্থিত হলো। নয়না ওদের দেখে অবাক হলো।
সোমাশ্রী বললো, অবাক হওয়ার কিছু নেই, আমরা বরপক্ষ।
কনে তো আমাদের বন্ধু মনেই করে না। তাই আমরা কনেপক্ষ নই।
নয়নাকে সুজয় প্রথম থেকে সবটা জানালো।
নয়না সব শুনে ঋষভের দিকে তাকিয়ে বললো, তুমি আর সোমাশ্রী আজীবন আমার বন্ধু থাকবে। আমি জানি, আমি ভুল করেছি।
ঋষভ বললো, ওই সব কথা থাক। এখন তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে যাও, অনেক কাজ বাকি।

দুই বছর পর…
আজ নয়না সুজয়ের বিয়ে গ্রামেরই বাড়িতে। এক সপ্তাহ আগেই স্কুলের সব কাজ শেষ হয়েছে। খুব তাড়াতাড়ি স্কুল খুলে যাবে। নয়নার স্বপ্ন পূরণ হয়েছে।
আবার নয়না সুজয় বিয়ের মণ্ডপে। আবার সেই শুভদৃষ্টির সময়। নয়না বললো, একটা কথা বলবো? সুজয় বললো, বিয়ে ভা ঙার কথা বললে, এখান থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে কলকাতায় বিয়ে করবো।
নয়না হেসে বললো, আজীবন এইভাবে থেকে যাবে আমার সাথে।
সুজয় চোখে চোখ রেখে বললো, তোমাকে ছেড়ে কোথাও যাবো না আমি।

ঋষভ আর সোমাশ্রী ভীষণ খুশি…

কোয়েল আর সন্দীপ একে অপরের দিকে তাকিয়ে আছে, আর কয়েকমাস পর তাদের বিয়ে।

সমাপ্ত…

ভুল ত্রুটি মার্জনীয়। 🙏