#পরিযায়ী_জীবন (পর্ব – ৪)
পরদিন মেহরাব মাকে নিয়ে একটা প্রাইভেট হাসপাতালে যায়। সেখানে সে তার বন্ধুর সাথে আলাপ করে মায়ের আরও কিছু টেস্ট করতে দেয়। যদিও সাজেদা এসব কিছুই করাতে চাইছিল না, সে সুস্থ আছে সেটাই বোঝাতে চাইছিল কিন্তু মেহরাব সেসবে কান দেয়নি। সব কিছু সামলে বাড়ি ফিরতে রাত হয়ে গেল। বাসায় এসে রাতে খেতে বসলে ফারজানা বলল- আসরের নামাজের পর বিজরীর বাবা এসেছিল সজীবের সাথে দেখা করতে। সজীব বাড়িতে নেই শুনে বলে গেছে- “বাড়ি ফিরলে যেন আমার সাথে দেখা করে, ওর সাথে জরুরি কথা আছে।” মেহরাব এ কথার কোনো প্রতিউত্তর করল না। সে হয়ত অনুমান করতে পারছে কেন তিনি দেখা করতে চাইছেন। যে মানুষটাকে সব সময় দাম্ভিকতার চাদরে মুড়িয়ে থাকতে দেখেছে তাকে একজন ভেঙে পড়া মানুষ হিসেবে দেখাটা অপ্রীতিকর।
সেরাতে মেহরাব অনেক রাত অব্দি উঠানে পায়চারি করল। তার একটাই অপেক্ষা… বিজরীকে একটাবার দেখার অপেক্ষা। বারান্দাটা অন্ধকারে ডুবে আছে। মাধবীলতা ফুলগুলো কেবল তার অস্তিত্ব জানান দিয়ে যাচ্ছে। বিজরীর সবচেয়ে পছন্দের ছিল রাতের আকাশ। কই আজ তো সে একবারও এলো না! যে মুখের উপর অভিমানের ভারী পর্দা টেনে দিয়েছিল আজ সেই পর্দা উন্মোচনের তাগিদে সে নিভৃত নির্জনে অধীর অপেক্ষায়। শুক্লপক্ষের চাঁদ হেলে যাবারও অনেক পর পর্যন্ত মেহরাবের অপেক্ষা চলল… কিন্তু কোনো প্রাপ্তি যোগ হল না, ক্লান্ত পায়ে ঘরে চলে গেল সে। মেহরাব উঠোন ছাড়তেই মাধবীলতার আড়াল ছেড়ে ভেজা চোখে আরও একজন প্রস্থান নেয়। “ভালোবাসা” শব্দটা অদ্ভুত… নিরবে নিভৃতে হলেও বেঁচে থাকে মনের মণিকোঠায়।
পরের কয়েকদিন মেহরাব হাসপাতাল আর ব্যক্তিগত কিছু কাজে ব্যস্ত সময় পার করল। ৭দিন পর সব রিপোর্ট হাতে আসার পর সে প্রচন্ডরকম ধাক্কা খেল। সে যা আশঙ্কা করেছিল তাই হয়েছে। তার মায়ের ক্যান্সার ধরা পড়েছে তাও লাস্ট স্টেজ। চিকিৎসার কোনো সুযোগ নেই। যেকোনো সময় খারাপ কিছু হয়ে যেতে পারে! এই মুহূর্তে তিনি সকল চিকিৎসার উর্ধ্বে। মেহরাবের চোখ ঝাপসা হয়ে এলো। তার পুরো পৃথিবী ঝাপসা চোখে ক্ষুদ্র হয়ে দুলতে লাগল… নিজেকে অপরাধী মনে হতে লাগল। সে এভাবে মাকে ছেড়ে না গেলে হয়ত মায়ের শরীরটা এত খারাপ হত না। আরও কিছুদিন এই পৃথিবীর আলো হাওয়া তার জন্য বরাদ্দ থাকত। রিপোর্টগুলো হাতে নিয়ে মেহরাব স্তব্ধ হয়ে টলমল চোখে বসে রইল। জন্ম থেকেই তার শুধু হারিয়ে ফেলার ভাগ্য কেন?
রাতে বাড়ি ফেরার পর ফাতেমা এগিয়ে এসে বলল- কিরে সজীব, সারাদিন কোথায় ছিলি? এত দেরি হল যে?
-হাসপাতালে ছিলাম…
-এত সময় ধরে! আম্মার রিপোর্টগুলো সব পেয়েছিস?
-হুম।
-তোর চোখ মুখ এমন দেখাচ্ছে কেন? কী হয়েছে?
মেহরাব শক্ত হতে চেষ্টা করল কিন্তু পারছে না। তার চোখ ভিজে উঠল…
মেহরাবের মুখ দেখে ফাতেমার বুকের ভেতর অজানা আশঙ্কায় ধক করে উঠল। সে আতঙ্কিত গলায় জিজ্ঞেস করল- আম্মার খারাপ কিছু হয়নি তো!
প্রাণপণে চেপে রাখতে চাওয়া কান্নাটা আর চেপে রাখতে পারল না। ভাঙা গলায় বলল- বুবু…
ফাতেমা শঙ্কিত হয়ে উঠল। সজীবকে প্রশ্ন করবার সাহসও পাচ্ছে না!
মেহরাব জানে না এত বড় দু:সংবাদ কী করে দিতে হয়? ওরা সবাই মাকে ভীষণ রকম ভালোবাসে। এই ভয়াবহতা কী করে মেনে নেবে ওরা? ফাতেমা সজীবকে টেনে বাইরে উঠোনে নিয়ে এলো। বলল- কী হয়েছে আম্মার?
মেহরাব তার হাতে থাকা রিপোর্টগুলো ওর হাতে দিয়ে বলল- বুবু, আম্মাকে আমরা আর ধরে রাখতে পারবনারে… ফাতেমা বুঝতে পারল না সজীব কী বলতে চাইছে? সে মোবাইলের টর্চ জ্বেলে অপ্রকৃতস্থের মত রিপোর্টগুলো দেখতে লাগল। তারপর “ক্যান্সার” শব্দটাতে তার চোখ আটকে গেল। সে শব্দটার উপর আঙুল রেখে সজীবের দিকে তাকিয়ে শুকনো ঢোক গিলে বলল- এটা কী সজীব?
-মায়ের ফুসফুসে ক্যান্সার ধরা পড়েছে… একেবারে লাস্ট স্টেইজ। যেকোনো মুহূর্তে যা কিছু হয়ে যেতে পারে। ফাতেমার শরীর অসাড় হয়ে এলো… মেহরাব তাকে বোঝাতে গেল বাড়ির কাউকে এসব কিচ্ছু বুঝতে দেওয়া যাবে না। তাকে এখন ভালো রাখার চেষ্টা করতে হবে। বলতে বলতেই দেখল ফাতেমা টলে উঠে জ্ঞান হারিয়ে পড়ে যাচ্ছে! মেহরাব দ্রুত ফাতেমাকে ধরে ফেলে ফারজানাকে ডাকতে লাগল। ফারজানা এসে বুবুকে এই অবস্থায় দেখে ঘাবড়ে গেল। সে চিৎকার করে উঠল তারপর দ্রুত পানি এনে বুবুর মুখে ছিটিয়ে দিল। সজীব ওকে ধরে ঘরে নিয়ে এলো। ফারজানা ক্রমাগত জিজ্ঞেস করে যাচ্ছে “কী হয়েছে? কী হয়েছে বুবুর? এতক্ষণ তো ভালো ছিল!” ততক্ষণে আম্মাও চলে এসেছে। সে নিজেও আতঙ্কিত হয়ে গেল। মেহরাব সবাইকে শান্ত হতে বলল। একটু পরেই ফাতেমার জ্ঞান ফিরলে সে মায়ের দিকে তাকিয়ে তাকে আঁকড়ে ধরে কেঁদে ফেলল। এত শক্ত করে ধরল যেন ছেড়ে দিলেই হারিয়ে যাবে। সাজেদা আর ফারজানা কিছুই বুঝতে পারছে না। মেহরাব বুঝতে পারছে কিছু একটা করতে হবে নয়ত পরিস্থিতি খারাপ হয়ে যাবে। সে দ্রুত বলতে লাগল-
-বুবু তুই এত অস্থির হচ্ছিস কেন? আমি আছি তো, তোদের সবার সাথেই আছি। কী একটা বললাম আর বিশ্বাস করে নিলি! আমাকে চিনিস না তোরা?
সাজেদা ছেলের দিকে তাকিয়ে বলল- কী বলেছিস তুই ওকে?
আমি বুবুকে বলেছিলাম- আমি যখন আমার পরিবারের সন্ধান পেয়ে গেছি শীঘ্রই তাদের সাথে দেখা করতে যাব। তোদের আর জ্বালাব না। এখন থেকে নিজের পরিবারের সাথে থাকব। তোরা অনেক করলি আমার জন্য, আর কত? বাকি জীবন নিজের পরিবারকে দিব। এগুলো শুনেই বুবু জ্ঞান হারিয়ে ফেলল। জন্ম থেকে দেখছে আমাকে আর আমাকে এতটুকু বোঝে না! কেমন মেয়ে তোমার? বুবু কেন বুঝল না তোমাদের ছাড়া আমি কিছুই না? যাদের এখনো দেখিনি চিনিনি তাদের প্রতি আমার মনে এত বড় জায়গা কী করে হবে? বুবু তুই তোর ভাইকে চিনলি না! টানা এতগুলো মিথ্যে বলে হাপিয়ে উঠল মেহরাব। ফাতেমা ভাইয়ের দিকে অবাক হয়ে তাকাল… তার ভাইটা অসহায় বোধ করছে। যতই সে দায়িত্ববান হয়ে উঠুক সে তো আমাদের সবার ছোট। তার উচিত ভাইকে, পুরো পরিবারকে সামলে নেওয়া… কিন্তু কীভাবে??? সে আবার ডুকরে কেঁদে উঠল। পাশ থেকে ফারজানা মায়ের চেহারায় চিন্তার ভাঁজ দেখে পরিবেশ হালকা করবার চেষ্টা করল। বলল-
বুবুকে সরল পেয়ে তুই এসব বলেছিস! আমাকে বলতি? তাহলে দেখতি কানের নিচে শক্ত করে দুটো চড় মারতাম তারপর বাড়ি থেকে বের করে দিতাম। তোর সাহস হয় কী করে বুবুকে এসব বলার? আম্মা তুমি তোমার ছেলেকে শাসন করো না কেন? কত বড় সাহস ওর এসব বলতে আসে! আমাদের ছেড়ে যাবে? যাক না, কতদূর যেতে পারে আমিও দেখতে চাই।
সাজেদা ফাতেমাকে বললেন- তুই কীরে? এইটুক মজাও বুঝোস না? এত্তটুক পেন্দি ছেলেটারে পাইলা পুইষা তোরাই তো বড় করলি আর ওরে চিনলি না! ওঠ যা। ও সারাদিন বাইরে বাইরে ছিল, মুখটা কেমন শুকায় গেছে। খাইতে দে। পাশ থেকে ফারজানা বলে উঠল-
-দেখলি বুবু? আম্মা এখনও তার ছেলের পক্ষ নিতেছে! ছেলে সারাদিন না খেয়ে আছে আর তুই যে ওর জন্য জ্ঞান হারায় ফেললি তার কিছু না। সারাটা জীবন তুই একাই মায়ের ভাগ নিয়ে গেলিরে সজীব।
ফাতেমার কানে এসব কিছুই ঢুকছিল না তার চোখে শুধু একটা শব্দই ভেসে আছে “ক্যান্সার”!!! মেহরাব নিজেও নিশ্চুপ হয়ে রইল।
রাতে ফাতেমা কিছুই খেল না। ফারজানা সবাইকে খেতে দিল। মেহরাব কোনো রকম কিছু খেয়ে উঠে গেল। সাজেদা ছেলেকে দেখে বুঝতে পারছে তার কিছু একটা হয়েছে। ছেলে ঘরে যেতেই তিনিও পেছন পেছন গেলেন। বললেন-
-কী হইছে সজীব বলতো আমারে?
-কী হবে? কিছুই হয়নি। বুবুর সাথে এমন করাটা ঠিক হয়নি সেটা ভেবেই খারাপ লাগছে।
-অন্য কিছু না তাইলে?
-না।
-তোর চেহারা তো অন্য কিছু বলে?
-আমার চেহারা আবার কী বলবে? বিদেশে আরামে নবাব হয়ে ছিলাম তাই দেশের গরম, জ্যাম এসব আর সহ্য হচ্ছে না তার উপর হাসপাতালের ঝামেলা তাই একটু এমন দেখাচ্ছে। ও ঠিক হয়ে যাবে দুদিন গেলেই।
সাজেদা বুঝলেন ছেলে কিছু লুকাচ্ছে কিন্তু আর কোনো প্রশ্ন করলেন না। জিজ্ঞেস করলেন- আচ্ছা তুই তো এখন পর্যন্ত তোর নিজের মা বাপের খোঁজ করলি না?
-করব, এত তাড়া নেই। “মা” বলতে আমার কাছে তুমিই। আগে তোমাকে ভালো করে ডাক্তার দেখাই, তুমি একটু সুস্থ হও। যারা এত বছর আমার জীবনে ছিল না তারা আর ক’টা দিন পরে আসলেও কিছু অসুবিধা নেই।
সাজেদা ছেলের ভালোবাসায় মুগ্ধ হয়ে যায়। বলে- আমি তো সুস্থই আছি। শরীর একটু খারাপ হইছিল কিন্তু তুমি আসায় সব ঠিক হয়ে গেছে। এখন আর ডাক্তার লাগব না। তুমি আমারে নিয়ে এত ভাইবো না, আমি ভালো আছি। তুমি তোমার মারে দেইখা আসো?
-যাব, দুটো দিন যাক। তুমি যাবে আমার সাথে সেখানে?
-আমি যায়া কী করব?
-তুমি আমার সাথে থাকবে। তুমি থাকলে আমি শক্তি পাই।
সাজেদা কিছু বলতে পারে না। সে কেমন করে দেখবে তার ছেলে অন্য কারো সন্তান হয়ে যাচ্ছে? অন্য কাউকে “মা” বলছে?
মেহরাব মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারে সে কী ভাবছে? সে মায়ের হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বলল- আম্মা, আমি এই জীবনে তোমাকেই “মা” জেনেছি, সেই জায়গাটা চাইলেই কেউ নিতে পারবে না, নেওয়া সম্ভব না।
সাজেদার মন ভরে যায় ছেলের কথায়। বলে- ঠিক আছে যাব।
সেরাতে মেহরাব আর ফাতেমা কারোই ঘুম হল না। ফাতেমা কেঁদে একাকার হচ্ছে। সাগর তাকে সান্ত্বনা দিয়েও কিছু করতে পারছে না। মেহরাব নিজের ঘরে বোবা যন্ত্রণায় নিজেকে আড়াল করার চেষ্টা করছে। একবার উঠে গিয়ে মায়ের ঘরের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। পর্দা সরিয়ে দেখে আম্মা ঘুমাচ্ছে। তার পাশে গাঘেঁষে ফারাবি আর ফাইয়াজ নিশ্চিন্তে জড়াজড়ি করে ঘুমাচ্ছে। কী সুন্দর দৃশ্য… হঠাৎই আম্মা কেশে ওঠে। মেহরাব দ্রুত ঘর থেকে বের হয়ে আসে। ডাইনিং এ এসে জগ থেকে পানি ঢেলে খেয়ে ঘরে যেতেই ফারজানা আসে। বলে-
-সজীব কী হয়েছে বল তো?
মেহরাব চমকে ওঠে, বলে- তুই ঘুমাসনি এখনো?
-ঘুম আসছে না। তোকে অন্যরকম লাগছে। তুই আম্মার ব্যাপারে কিছু লুকাচ্ছিস যেটা বুবু জানে। আমাকে বল?
-আম্মার শরীরটা খুব খারাপের দিকে। আমাদের সবাইকে এখন শক্ত হতে হবে। আম্মাকে মানসিকভাবে ভালো রাখতে হবে। বুবু তো ভেঙে পড়েছে… আমি যে কী করি… কীভাবে সব সামলাব কিছুই বুঝতে পারছি না!
ফারজানা চাপা আতঙ্ক নিয়ে বলল- কী হয়েছে আম্মার সোজাসাপ্টা বল? এসব ঘোরপ্যাঁচ আমি আর নিতে পারছি না।
সজীব দীর্ঘশ্বাস ফেলে পুরো ব্যাপারটা ফারজানাকে জানায়। ফারজানা মুখ চেপে ধরে কেঁদে ওঠে। এমন সময় ফাতেমা আসে। এসেই ফারজানাকে কাঁদতে দেখে সেও বোবা কান্নায় ভেঙে পড়ে।
মেহরাব চুপ করে করে থাকে। এই কষ্টের সমবেদনা জানাবার কোনো ভাষা আছে কী? মেহরাবের তা জানা নেই। অনেকক্ষণ পর সে বলতে শুরু করে- আম্মা আমাকে নিয়ে বহুকাল মনের মধ্যে যন্ত্রণা পুষে রেখেছিল। যা তাকে ভেতরে ভেতরে প্রতিনিয়ত ভেঙে গেছে। একটু একটু করে শরীরে নানান রোগ বাসা বেঁধেছে। নিরবে তা ক্যান্সারে রূপ নিয়ে ফেলেছে যা কেউ টের পাইনি। এমন একটা সময়ে এসে এসব টের পেলাম যখন আর কিছুই করার নেই। যে আম্মা আমাকে এত সুন্দর জীবন দিয়েছে আজ তার জন্য কিছুই করতে পারছি না! নিজেকে নিতান্তই অক্ষম মনে হচ্ছে। জীবনের শেষ দিনগুলো আম্মা যেন আনন্দে কাটাতে পারেন আমাদের এখন সেই চেষ্টা করতে হবে। তোরা দুইজন যদি ভেঙে পরিস আমি সাহস পাব কোথায়?
ফারজানা নিজেকে কিছুটা ধাতস্থ করার চেষ্টা করে। তারপর জিজ্ঞেস করে- তুই তোর পরিবার পেয়ে ওদের কাছে চলে যাবি এটা তো সত্যি না?
-সেটা সত্যি হবে বলে বিশ্বাস করিস?
-করতে চাই না। কিন্তু… তুই চাইলেও আমাদের কিছু করার নেই! নাড়ীর টান তো, কেউ কখনো উপেক্ষা করতে পারে না।
-যাদের কখনও দেখিনি তারা এক মুহূর্তে আমার নাড়ীর টান হয়ে যাবে আর জন্মের পর থেকে আজকের অবস্থান পর্যন্ত যারা আমার সব কিছু ছিল তারা এক মুহূর্তে পর হয়ে যাবে!!! এটা ভাবাও মায়ের প্রতি জুলুম করা। নিজের উপর, তোদের উপরও জুলুম করা। আমার পরিবার আমাকে ভালোবাসার যে দৃষ্টান্তমূলক শিক্ষা দিয়েছে তা ভুলে যাব কী করে?
ফারজানা আর কোন কথা বলল না। তারা ভাই-বোন এক প্রাণ। সেই প্রাণ টুকরো হবে সেটা তারা কেউ নিতে পারবে না। সে আবার কেঁদে উঠল।
-আম্মা যেন কিছুই টের না পায়। তোদের যত কান্না আছে এখন কেঁদে ফেল। সকাল থেকে আমি তোদের স্বাভাবিক মুখ দেখতে চাই। আমাদের একসাথে আনন্দে থাকতে, ভালো থাকতে দেখলে আম্মার ভালো লাগবে। মানসকি শান্তি মানুষের বেঁচে থাকার আকাঙ্খা বাড়ায়। তোরা মাকে আরও কয়েকটা দিন বাঁচতে সাহায্য কর।
ফারজানা আরও কিছুক্ষণ কাঁদল। মেহরাব দুজনকে বুঝিয়ে শুনিয়ে যার যার ঘরে পাঠিয়ে দিল। বাকি রাতটা তার কিছুক্ষণ পায়চারি আর কিছুক্ষণ বিছানায় এপাশ-ওপাশ করে নির্ঘুম কেটে গেল। ভোরের দিকে ফজরের আজান হলে দেখল আম্মা ঘুম থেকে উঠে গেছে। সে নিজেও অযু করে মসজিদের উদ্দেশ্যে বের হয়ে গেল। তার একটু স্বস্তি চাই যেটা এই মুহূর্তে আল্লাহর দরবারেই পাওয়া সম্ভব।
মেহরাব নামাজ পড়ে বেশ কিছুক্ষণ মসজিদেই বসে রইল। সে খেয়ালই করেনি তার সামনের সারিতে বিজরীর বাবা বসে আছেন। যখন দেখল দ্রুত উঠে বের হয়ে আসতে চাইল কিন্তু জাকারিয়া সাহেব তাকে দেখে ফেললেন। দেখেই বলে উঠলেন- সজীব?
মেহরাব দাঁড়িয়ে গেল। আংকেলের সামনে পড়ে যাবার কোনো ইচ্ছেই তার ছিল না কিন্তু… সে ঘুরে দাঁড়িয়ে সালাম দিয়ে বলল- কেমন আছেন আংকেল?
জাকারিয়া সাহেব সালামের জবাব দিয়ে বললেন- কাছে এসে একটু বসো।
মেহরাব তার কাছে এসে বসল। জাকারিয়া সাহেব বললেন-
-তুমি দেশে এসেছ শুনে দেখা করতে গিয়েছিলাম কিন্তু বাসায় ছিলে না। কেমন আছ বাবা?
-আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি।
-তোমাকে এখানে পেয়ে গিয়ে খুব ভালো হল… আমার শরীর ইদানীং ভালো যাচ্ছে না। আসলে মেয়েটাকে নিয়ে নানান দুঃশ্চিন্তায় থাকি তো। আমার জন্য মেয়েটার জীবন এলোমেলো হয়ে গেল, বাবা হিসেবে নিজেকে…
জাকারিয়া সাহেব থেমে গেলেন। হয়ত কষ্ট লুকাবার চেষ্টা করছেন। ৩বছর আগের দেখা মানুষটা আর আজকের মানুষটায় বিস্তর ফারাক! যে চোখে বংশের গৌরব, দাম্ভিকতা আর অহংকারের আগুন জ্বলে থাকত আজ সেই চোখে নোনা সমুদ্র আর আত্মসমর্পণ বাসা বেঁধেছে। আচমকাই তিনি মেহরাবের হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বললেন-
-আমি অনেক বড় ভুল করেছি বাবা। শুধুমাত্র আমার কারণে আজ কতগুলো জীবন এলোমেলো! জীবনে অনেক পাপ জমা হয়ে গেছে… আল্লাহপাক আমাকে মাফ করবে কিনা জানি না… তুমি আমাকে…
মেহরাব তার হাত ধরে ফেলে বলল- আংকেল এভাবে বলবেন না। আপনি ভুল বুঝতে পেরেছেন আলহামদুলিল্লাহ। আমি আপনার ছেলের মত, আপনার উপর আমার কোন রাগ অভিমান কিছুই নেই। আপনারা বড়রা আমাদের স্নেহ দিবেন, সঠিক শিক্ষা দিবেন, প্রয়োজনে কড়া শাসন করবেন। ভুল হলে জানিয়ে দেবেন কিন্তু এভাবে বলে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলে দেবেন না। আপনি ভুল বুঝতে পেরেছেন এরচেয়ে বড় আর কী হতে পারে?
জাকারিয়া সাহেব খুব খুশি হলেন। বললেন- তুমি আসলে খুব ভালো ছেলে, তোমার পারিবারিক শিক্ষা এত চমৎকার বলেই হয়ত তুমি এভাবে বলতে পারলে। শুধু বড়রা শেখাবে এমন নয়, ছোটদের কাছ থেকেও শেখার আছে অনেক। পরিবারের সকলের মতামতকেই মূল্যায়ন করতে হয়। আমি সেটা পারিনি বলেই আজ এই দিন দেখতে হচ্ছে। আমার অপরাধের মাশুল আমার বিজরীকে দিতে হচ্ছে!
-যা হওয়ার ছিল তা হয়ে গিয়েছে। এখন আর পেছনে তাকিয়ে কষ্ট পাবেন না। আপনি কী আরও কিছুক্ষণ থাকবেন এখানে?
-যেতে চাইছ? আচ্ছা চলো বাড়ি যাই।
-আমি একটু হাঁটাহাঁটি করব বাইরে। অনেকদিন পর এসেছি… বাইরে বের হবার সুযোগ হয়নি।
-ওহ… আচ্ছা যাও।
দুজন একসাথেই বের হল। মেহরাব উল্টো পথ ধরতেই জাকারিয়া সাহেব বললেন- সজীব, তুমি বাসায় এসো, আজ দুপুরে একসাথে খাব?
-দুপুরে তো পারব না আংকেল। বাইরে কাজ আছে আমার।
-তাহলে রাতে এসো?
-রাতেও সম্ভব হবে কিনা…
জাকারিয়া সাহেব বুঝলেন মেহরাব আসলে চাইছে না। এত সহজেই কী সেই রূঢ়তা ভোলা যায়? তিনি কোমল গলায় বললেন- “এলে বুঝব তুমি সত্যিই আমাকে ক্ষমা করেছ।” তারপর আর দাঁড়ালেন না তিনি।
জাকারিয়া সাহেব চলে গেলেন। মেহরাব কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে হাঁটতে শুরু করে। কী করবে বুঝতে পারছে না। বিজরীর সামনে দাঁড়াবার সাহস তার নেই। ভালোবাসার মানুষটার এমন করুণ পরিনতি তাকে নতুন করে ভেঙে দিচ্ছে। আজ কতদিন হয়ে গেছে সে দেশে এসেছে অথচ এত কাছে থেকেও সেই মাধবীলতার আড়ালে একবার মাত্র অস্পষ্ট দেখেছিল। এরপর এখনও তাকে ভালোভাবে একটাবার দেখতে পেল না! সে হাঁটতে শুরু করল… হাঁটতে হাঁটতে আগের স্মৃতিগুলো এসে ভীড় করতে লাগল তার মানসপটে…
চলবে…