#পরিযায়ী_জীবন (পর্ব – ৭)
সাজেদা বেশ বুঝতে পারছে, এখানে যে উদ্দেশ্যে এসেছে তা যদি আজ সফল করতে না পারে তাহলে আর কখনোই হয়ত তার পক্ষে সম্ভব হবে না। তিনি সজীবের কথা উপেক্ষা করে সজীবের বাবা মাকে সম্পূর্ণ ঘটনা খুলে বললেন। তবে খুব কৌশলে সজীবকে যারা চুরি করে এনেছিল তাদের পরিচয়টা গোপন করে যায়। কারণ সে চায় না এত বছর পরে এসেও কোনোভাবে এই ঘটনা নিয়ে ঝামেলা তৈরি হোক। তাছাড়া তিনি তাদের কথা দিয়েছিলেন এসব নিয়ে কোনো রকম ঝামেলা করবেন না। কথার বরখেলাপও তিনি চান না।
সাজেদার মুখে সব শুনে কামরুল সাহেব স্তব্ধ হয়ে বসে রইলেন আর মেহরুন্নেসা কান্নায় ভেঙে পড়লেন। সজীবও চোখের পানিতে ভাসতে লাগল।
কামরুল সাহেব নিরবতা ভেঙে জিজ্ঞেস করলেন- আপনার কথার সত্যতা কী?
সাজেদা চোখ মুছে বললেন- আমি যা বলছি তার কোথাও যে মিথ্যা নাই সেটা আপনে বুঝতেই পারতেছেন। ভয় আর মায়ায় পইড়া এত বছর বলার সাহস হয় নাই। ছেলে এখন বড় হয়ে গেছে, সে আপনা বুঝ বুঝতে পারে। অনেক বছর অনেক যন্ত্রণা চাইপা রাখছি। শরীরটাও ভালো না। কখন আল্লাহপাকের ডাক আইসা যায়… এখন না বললে ছেলেটার আর জানা হবে না। আমিও মরে শান্তি পাব না। ভাইসাব আপনে আপনার ছেলের দিকে একবার ভালো করে তাকায় দেখেন তাইলেই বুঝবেন আমার কথার সত্যতা আছে না কি নাই? তারপরেও যদি আমাদের ভুল মনে হয় তাইলে ডাক্তারি কত পরীক্ষা নীরিক্ষা আছে সেগুলাও কইরা দেখবেন কোনো অসুবিধা নাই।
কামরুল সাহেব সজীবের দিকে তাকায় ছেলেটা দেখতে একেবারেই তার স্ত্রীর মত! এত মিল তার বাকি ছেলেদের সাথেও নেই। আর ভদ্রমহিলা যে বর্ণনা দিলেন তাতে হাসপাতালের নাম, দিন তারিখ সব কিছুই ঠিক আছে। সব কিছু সাজানো গেলেও ছেলেটার চেহারা? চেহারা তো সাজানো যায় না। তাছাড়া ছেলেটা বড় ডাক্তার। একজন প্রতিষ্ঠিত ডাক্তার তার মত সামান্য স্কুল মাস্টারের কাছে এত বছর পর এত সব মিথ্যে নিয়ে আসবেই বা কী উদ্দেশ্যে? তাহলে কী ভদ্রমহিলা যা বলছেন তার সবটাই সত্য! এটাই কী তার হারিয়ে যাওয়া সন্তান? তার শরীর খারাপ লাগতে লাগল…
সেই মুহূর্তে পাশ থেকে চোখে মুখে রাজ্যের বিস্ময় নিয়ে অস্ফুটস্বরে “তুমি আমার ছেলে? তুমি তো আমারই ছেলে” বলে মেহেরুন্নেসা কেঁদে ফেললেন। কান্না বিজড়িত গলায় বলতে লাগলেন- আমি তোমাকে চিনতে পেরেছি। তুমি একদিন আগে এসেছিলে আমার কাছে, পার্সেল দেবার জন্য। এখন বুঝতে পারছি ডায়েরি দুটো তুমিই দিয়েছিলে। ডায়েরি গুলো খুলে আমি হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলাম। দুটো ডায়েরির প্রতিটি পাতা জুড়ে কেবল একটাই শব্দ! “মা মা মা মা মা…” শত শত, হাজার হাজার, লক্ষ লক্ষবার কেবল “মা” শব্দটাই লিখা। এটা তো মাহাবুব মাহাদী কারো পাঠানো নয়। তাহলে আমার নামে কেন? আমার বুকের মধ্যে মুচড়ে উঠল, কার সন্তান এমন আকুল হয়ে তার মাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে? তখন থেকেই মনের মধ্যে শুধু আমার হারিয়ে ফেলা বাচ্চাটার কথা মনে পড়ছিল। সেই বাচ্চাটাই কী আমাকে এভাবে খুঁজে বেড়াচ্ছে?
সেই মুহূর্তে মেহরাবের চোখের কোল ভিজে উঠল। সে শিশুর মতো দুহাতে চোখ মুছতে লাগল। মেহেরুন্নেসা এগিয়ে এসে ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দু’হাতে ছেলের মুখ স্পর্শ করল। মুহুর্তেই মেহরাবের সমস্ত শরীরে শীতল পরশ ছড়িয়ে পড়ল। কেমন অসাড় হয়ে এলো তার সমস্ত শরীর, মন, মগজ… এটা তার মায়ের স্পর্শ! আহ কী শান্তি… কী কোমল… কত মায়া! এই তো, সে তার মায়ের গায়ের মিষ্টি মা মা ঘ্রাণটা পাচ্ছে! সে যেমন যেমন ভেবেছিল ঠিক তেমন। তার তীব্র ইচ্ছে হল মাকে জড়িয়ে ধরে জমিয়ে রাখা সবটুকু হাহাকার এক মুহূর্তে কর্পূরের মত উড়িয়ে দেয়। কিন্তু আড়ষ্টতায় আটকে রইল। মেহেরুন্নেসা তখন ছেলেকে আঁকড়ে ধরে ঘরের নৈশব্দতাকে ভেঙে দিয়ে আকুল হয়ে কাঁদতে লাগল। কতকাল ধরে তিনি প্রতিটা মুহূর্ত, দিন, মাস, বছর ছেলে হারাবার যন্ত্রণা পুষে এসেছেন। যাকে ফিরে পাবার আশাটুকুও নিভে গিয়েছিল বহু আগে, যে কেবল কল্পনার জগতে “কোথায় আছে? কেমন আছে? কত বড় হয়েছে? কী করছে? আদৌ বেঁচে আছে কিনা?” প্রশ্ন হয়ে বেঁচেছিল, বেড়ে উঠেছিল মন মানসে আজ সে তার সামনে বসে, কোলের কাছে! কী আশ্চর্য এক বর্ণনাতীত অনুভূতি… তার জীবনের থইথই বিষাদের একমাত্র অন্ধাকারটুকু হুট করে প্রচন্ড আলোয় ঝলমলিয়ে উঠল। তার শূন্য কোলখানা আজ পূর্ণ করে দিল তারই হারিয়ে যাওয়া অংশ।
সাজেদা আজ নির্ভার হলো। আজ তার জীবনের কঠিন দায়িত্বটা পালন করা হয়ে গেছে। তার বুকের উপর চেপে বসে থাকা পাহাড় আজ নেমে গেল। কিন্তু সেখানে নতুন করে যুক্ত হলো শঙ্কা আর হারাবার ভয়। কী হবে এরপর? সব কিছু স্বাভাবিক থাকবে তো?
হাসপাতাল থেকে শ্বাশুড়ির সন্তান হারাবার ঘটনাটা কেয়া জানত। সেই ঘটনা আজ এত বড় সত্য হয়ে ফিরে এসেছে! সে দ্রুত তার হাজবেন্ড মাহাদীকে ফোন করে সব জানায়।
রাত ৮টা বাজে, বাড়ির সবাই ড্রইং রুমে বসেছে। সন্তান এবং ভাই ফিরে পাবার আনন্দ, উচ্ছ্বাস একই সাথে এত বছর ধরে তাকে বিচ্ছিন্ন করে দেবার যন্ত্রণা ফিরে আসা উভয় অনুভূতিই তাদের চোখে মুখে স্পষ্ট। এ এক অভাবনীয় মিলনমেলার দিন, অভাবনীয় মুহূর্ত। আজ তাদের পরিবার পূর্ণ। যে পরিবারের এক কোণে সাজেদা যেন অপ্রয়োজনীয় এক অংশ! সে চুপচাপ তাদের দেখে যাচ্ছে। মেহরাবের মনে কী অনুভূতি তা সে ব্যক্ত করতে পারে না। তবে সব কিছু ছাপিয়ে সে সাজেদার দিকেও খেয়াল রাখছে। তার ভেতর কী অনুভূতি হচ্ছে সেটা সে ঠিকই টের পাচ্ছে। আম্মার শরীরটা ভালো নেই কখন আবার খারাপ করে কে জানে! মেহরাবের মেজো ভাই মাহাদী হঠাৎ তার বাবাকে বলে উঠল-
-বাবা, আমাদের কী উচিত না কিছু একটা ব্যবস্থা নেওয়া?
সাজেদার বুকে মোচড় দিয়ে উঠল! এই ভয়টা… এই ভয়টাই তো তাকে মেরে ফেলতে চায় সারাক্ষণ। কী করবে ওরা?
কামরুল সাহেব বললেন- কী করতে চাও?
-আইনি ব্যবস্থা নিতে চাই।
মাহাদীর সাথে তার বড় ভাই মাহাবুবও একমত প্রকাশ করল। এত বড় একটা অন্যায় আমলে না নেয়াটা কোনো ভাবেই ঠিক হবে না। কামরুল সাহেব কিছু বললেন না। কী করা উচিত এই মুহুর্তে তা তিনি সত্যিই বুঝতে পারছেন না। আসলে এই মুহূর্তে তিনি এসব নিয়ে ভাবতেও চাইছেন না। আগে ছেলেটাকে প্রাণভরে দেখে তো নিক? এমন সময় মেহরাব বলল-
-আমি কিছু কথা বলতে চাই… আপনাদের সবার মনের অবস্থা আমি বুঝতে পারছি। যেটা চাইছেন সেটাও সঠিক। তারপরও আসলে কিছু রয়ে যায়… আমার আম্মা যখন প্রথম আপনাদের কথা আমাকে জানায় তখন আমারও ঠিক এই কথাগুলোই মনে হয়েছিল। নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছিলাম না। পরিবারের সবার সাথেই আমার চূড়ান্ত রকমের দূরত্ব তৈরি হয়ে গেল। ওই সময়টাতেও আমার পরিবার আমাকে সাপোর্ট দিল। ভালোবাসা দিয়ে বুঝিয়ে বলল। পুরো ব্যাপারটা ঠান্ডা মাথায় ভাবার সময় দিল। আমি তখন অনেক ভেবে দেখলাম- এত বছর পর আসলে আর কিছু করার নেই। সৃষ্টিকর্তা যা চেয়েছেন তার বাইরে তো কিছুই হবার নেই। তাছাড়া আমি এমন একটা সুন্দর পরিবারে বেড়ে উঠেছি যে, সেখানে ভয়ানক রকম অর্থনৈতিক কষ্ট করতে হয়েছে। তারপরও সেখানে ভালোবাসার কখনোই অভাব ছিল না। আমি যখন মেডিকেলের স্টুডেন্ট তখন আমার পড়ার খরচ চালাতে মা হিমশিম খেয়ে যাচ্ছিল। যেখানে ৩বেলা পেট ভরে ভালো খাবার জোটে না সেখানে তারা আমার পড়ার খরচ কীভাবে চালাত সে এক বিস্ময়! একবার না পেরে আম্মা তার গলার স্বর্ণের চেইনটা বিক্রি করে দেয়। অথচ তখন গহনা বলতে বাবার দেওয়া ওই একটা চেইন-ই ছিল। আমার জন্য এত মূল্যবান জিনিসটা হাতছাড়া করতে আম্মা ২য়বার ভাবেনি। পরিবার কী, পারিবারিক মূল্যবোধ কী তা আমি এদের থেকে শিখেছি। আমার দুই বোন তাদের এই ভাই ছাড়া কিছুই বোঝে না। ছোটবেলায় স্কুলে টিফিন খাবার জন্য যদি কখনও সামান্য কিছুও টাকা পেত তারা সেই টাকায় টিফিন না খেয়ে আমার জন্য কিছু কিনে আনতো। বাবা মারা যাবার পর এরা অভিভাবক হিসেবে আমার উপরই নির্ভর করেছে। মাথার উপর ছাদ আর ছায়া হিসেবে খুব আলগোছে ওরা আমাকেই মেনে নিয়েছে। এদের জগতটা খুব ছোট্ট। সেই ছোট্ট জগতে তারা আমাকে রাজা বানিয়ে রেখেছে। আম্মার শরীরটা একদমই ভালো নেই। এই শরীরে সামান্যতম ধকলও সে নিতে পারবে না। আমি নিজেও সেটা বরদাস্ত করতে পারব না। যাদের পুরো পৃথিবী আমাকে ঘিরে শ্বাস নেয় তাদের এতটুকু কষ্ট হোক, ঝামেলা হোক সেটা আমি চাই না। যে দিন গেছে তা কখনও ফিরে পাওয়া সম্ভব নয়। শুধু শুধু কেন ঝামেলা টেনে এনে বর্তমানকে নষ্ট করতে চাওয়া? এতগুলো বছর যে সত্যকে আমি অন্বেষণ করে গিয়েছি আজ তাকে শান্তিতে আলিঙ্গন করতে চাই আর কিছুই ভাবতে চাই না।
মেহরাবের কথায় ঘরভর্তি মানুষের ভেতর পিনপতন নিরবতা নেমে এলো। হাসান সাহেব হয়ত এই কথাগুলোই শুনতে চাচ্ছিলেন। তিনি বললেন-
-আমার মনেহয় এখানে মেহরাবের মতামতটাই গুরুত্বপূর্ণ। সে যা বলেছে তার প্রতিটি কথাই যুক্তিসঙ্গত। আমি ওর চাওয়ার বাইরে যেতে চাই না।
মাহাবুব বলল- মেহরাবের মতামত যেমন গুরুত্বপূর্ণ তেমন এই ধরনের অপরাধীর শাস্তি হওয়াটাও গুরুত্বপূর্ণ। জেনে বুঝে এত বড় অপরাধ ইগনোর করতে পারি না বাবা? আমাদের নিরব থাকাটা কী অপরাধের শামিল নয়?
ওই মুহুর্তে সাজেদার গলা শুকিয়ে কাঠ। সে ছেলের দিকে তাকিয়ে আছে। তার চোখে ভর করেছে আতঙ্ক আর অনুনয়। মায়ের চোখে চোখ পড়তেই মেহরাব তাকে চোখের ভাষায় আশ্বস্থ করে। সে মাহাবুবকে উদ্দেশ্য করে বলে-
-আপনি যেটা বলছেন সেটা অবশ্যই ঠিক। কিন্তু তাদের পাবেন কোথায়? ৩০ বছর আগের ঘটনা এটা। তারা এখন কোথায় আছে, আদৌ বেঁচে আছে কিনা তার কোনো হদিস নেই। কার বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেবেন?
মেহরাবের এই প্রশ্নে মাহাবুব চুপ হয়ে যায় কিছুক্ষণের জন্য। তারপর বলে- হাসপাতালের বিরুদ্ধে অন্তত একশনে যেতে পারি? বলা তো যায় না যে, কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে অন্য কিছুও বের হতে পারে?
মাহাবুবের এই কথা কিসের ইঙ্গিত দিচ্ছে সেটা সাজেদা আর মেহরাব দুজনেই বুঝতে পারল। মেহরাব সে কথার তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ জানিয়ে বলে- আমার পরিবার শুধুমাত্র মায়ার বাঁধনে পড়ে তীব্র ভালোবাসায় আটকে গিয়ে আমার জন্য কী না করেছে! তার সবটাই তাহলে মিথ্যা হয়ে যাবে?
মাহাবুব আর কিছু বলতে পারল না। হাসান সাহেব বললেন- হাসপাতালের সাথে আমরা তখনই পেরে উঠিনি আজ ৩০ বছর পর এসে পারব? এসব আলোচনা আর বাড়াতে চাই না। ৩০ বছরের না পাওয়াকে আর দীর্ঘায়িত করার কোনো মানে হয় না। মেহরাবের মাকে দোষারোপ করছিস সে যদি সবটা চেপেই রেখে দিত তখন কী হত? মেহরাব তো বলল, ওর মায়ের শরীর ভালো নেই তিনি কোনো ধকল নিতে পারবেন না তাই আমার মনেহয় এই আলোচনা এখানেই শেষ করে আমাদের শান্তিতে এগিয়ে যাওয়াটাই উত্তম।
হাসান সাহেবের এই কথার পর কেউ আর কিছু বলল না। সাজেদা তখন নিরবতা ভাঙলেন, বললেন-
সজীব রাত তো অনেক হইল। ফাতেমা, ফারজানা এর মধ্যে অনেকবার ফোন করছে। তারা অনেক চিন্তায় আছে। বাড়ি যাওয়া লাগে যে…
মেহরাব ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল ১০ টা বেজে গেছে। বলল- বুবুর সাথে আমার কথা হয়েছে। তুমি চিন্তা করো না। তারপর সে মেহেরুন্নেসার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায়। মেহেরুন্নেসা ছেলের চোখের ভাষা পড়ে ফেললেন। বললেন-
-আজ তো আপনাদের যাওয়া হবে না। মেহরাব তুমি তোমার বুবুকে জানিয়ে দাও তোমার আম্মা আজ রাতটা এখানেই থাকবে। বাকিটা কাল দেখা যাবে। সাজেদা সেটা শুনতে চাইলেন না কিন্তু সকলের কথায় আর ফেলতেও পারলেন না। কাল নাহয় সে চলে যাবে কিন্তু মেহরাব? সে কী এখন থেকে এখানেই থাকবে? তার বুকটা শূন্য হয়ে উঠল… সজীবকে ছাড়া শূন্য পাজরে তারা কী করে বাঁচবে?
চলবে…