পরিযায়ী জীবন পর্ব-০৮

0
13

#পরিযায়ী_জীবন (পর্ব – ৮)

৩০ বছর পর ছেলেকে পেয়ে মেহেরুন্নেসা এক মুহুর্তের জন্য মেহরাবকে চোখের আড়াল করতে চায় না। মেহরাবও তার নতুন পরিবারকে ঘিরে নতুন জগতটাতে মানিয়ে যাবার চেষ্টা করে যাচ্ছে। তবে তার বুক পাঁজরে বাস করে তার প্রাণ শীতলকরা আরও একটি পরিবার। যাদের মুখ তার মুখে চেয়েই বেঁচে থাকে। সে তার দায়িত্ব আর ভালোবাসার জায়গা কোনটারই অবহেলা হতে দেয় না। এত কিছুর ভীড়ে সে বিজরীর কথা এক প্রকার ভুলেই গেল। এক সন্ধ্যায় মেহেরুন্নেসা মেহরাবকে জিজ্ঞেস করে- “তোর বয়স তো কম হল না, এখনো বিয়ে করিসনি কেন? তোর আম্মা কিছু বলে না?”

প্রশ্নটা শুনে মেহরাবের মনে বিজরীর মুখটা ভেসে উঠল। সে নিশ্চুপ বসে রইল। বিজরীর কারণে তার পৃথিবীর বড় একটা অংশ নির্বাক হয়ে গিয়েছে! বিজরীই পারে তার মনে শুকিয়ে যাওয়া সরোবরটা কানায় কানায় পূর্ণ করে দিতে।

মেহেরুন্নেসা ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। মেহরাবের নিরবতা থেকে তিনি হয়ত কিছু আন্দাজ করলেন। বললেন- পছন্দের কেউ আছে?

মেহরাব মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। কী বলবে সে? যার জন্য তার পৃথিবী নির্বাক সে নিজেই তো নিশ্চুপ প্রাণহীন!

-আমি কী তোর আম্মার সাথে কথা বলব?

মেহরাব কিছু না বলে উঠে গেল। বিজরীর মুখটা তার হৃদয়ে ক্ষরণ করে যাচ্ছে। যেটা সে কাউকে দেখাতে চায় না।

মেহেরুন্নেসা বুঝলেন ছেলের মনে কিছু কষ্ট চাপা আছে।

মায়ের কাছ থেকে উঠে মেহরাব ছাদে গিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইল… তার যত যন্ত্রণা সে ওই মহাকাশের বিশালতায় ছড়িয়ে দেয়। কিন্তু আজ কেন যেন কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। তার মনে হতে লাগল বিজরীকে তার চাই। যেকোনো মূল্যেই চাই। বিজরীকে ছাড়া তার চলবেই না। সে পকেট থেকে ফোন বের করে বিজরীর নাম্বারটা বের করে তাকিয়ে রইল… একটা কল দেবে কী? একটা সময় এই নাম্বারে তার কত কথা হত। আর আজ? কেবল দ্বিধা!!! সে ফোন রেখেই দিচ্ছিল কিন্তু চাপ লেগে কল চলে যায়। দ্রুত কল কেটে দিতে চাইল কিন্তু পারল না, ফোন হ্যাং হয়ে গেছে! মনের দুঃখে এটাকে দুবার ছুঁড়ে মেরেছিল সেই থেকে এর কিছু প্রবলেম হচ্ছে। হুটহাট হ্যাং হয়ে যায়। চাইলেই নতুন ফোন নিতে পারে কিন্তু ইচ্ছে করেই নিচ্ছে না। সে অপ্রস্তুত হয়ে গেল… কী করবে এখন? বিজরী ফোন ধরলে কী বলবে সে? ভাবতে ভাবতেই কলটা কেটে গেল। সে হাফ ছেড়ে বাঁচল যেন। বিজরী তার এই নাম্বারটা চেনে না তাই ব্যাক করার কোনো সম্ভাবনা নেই। সে ফোন পকেটে রেখে ছাদ থেকে নেমে যাবার জন্য পা বাড়াল আর তখনই ফোন বেজে উঠল। বিজরী কল ব্যাক করেছে! সে ভ্রুকুটি করে কিছু ভাবল তারপর কেটে দিয়ে নিজেই ফোন করল। বিজরী সালাম দিতেই মেহরাব বলল-

-তুমি আমার অপেক্ষা করছিলে?

মেহরাবের গলা শুনে বিজরীর বুকটা ধক করে উঠল। সে প্রতি মুহূর্ত মেহরাবের ফোনের অপেক্ষায় থাকে। তাই অচেনা নাম্বার দেখেও মেহরাবকে ভেবেই কল ব্যাক করেছে। কিন্তু মেহরাব যে এত সহজে ব্যাপারটা ধরে ফেলবে বুঝে উঠতে পারেনি, বোকামি হয়ে গেল। কী করবে সে তো এই মানুষটার জন্য এখনও ভেতরে ভেতরে প্রতি মুহূর্ত মরে! এই যে মানুষটার গলার স্বর শোনা মত্রই তার মস্তিষ্কের প্রতিটি নিউরনে সুরের মূর্ছনা ছড়িয়ে গেল, বুকের মধ্যে ছলাৎ করে উঠল সেটা কী করে কাউকে বোঝাবে? সে খুব সন্তর্পণে মনের উত্তেজনাটা চেপে গিয়ে বলল- কে বলছেন?

-যার জন্য তোমার অপেক্ষা…

-আমি তো কারো অপেক্ষা করছিলাম না!

-আমি তোমাকে খোলা বইয়ের মত পড়তে পারি সেটা তুমি জানো।

ওপাশে নিরবতা… মেহরাব বলল- কেমন আছ?

-ফোন করেছেন যে?

-ফোন করা মানা?

-সেটা বললাম কী?

-কতদিন হয়ে গেল দেশে ফিরেছি একবারও দেখা হলো না… সেদিন বাড়ি গেলাম তাও সামনে এলে না, কেন?

-সামনে আসার কোনো কারণ ছিল কী?

-কারণ নেই!!! তুমি বলছ এটা?

বিজরী কিছু বলল না। মেহরাব বলল- বুবু তোমাকে কিছু দিয়ে এসেছিল সেটা নিয়েও তো কিছু বললে না? এত কিসের দূরত্ব?

-আমরা যে কাছের সেটাই বা কোথায় লেখা ছিল?

– আমার উপর এটা তোমার রাগ নাকি অভিমান বলতো?

-রাগ অভিমানের প্রশ্ন আসছে কেন?

মেহরাব নিজেকে শান্ত করে মৃদু হেসে বলল- আমরা প্রশ্নের উত্তর প্রশ্ন দিয়ে দিচ্ছি! বিজরী চুপ রইল। মেহরাব বলল- তোমার সাথে আমার “কারণ” দেখানো সম্পর্ক তো ছিল না?

-সময়ের চাপে কখনো সম্পর্ক বদলে যায়, কখনো বদলাতে হয়।

-তোমার কোনটা হয়েছে?

-যেটাই হোক, বদল তো বদলই।

-না, দুটো এক বিষয় নয়।

-বদলায় তো সব কিছুই। আমি তর্কে যেতে চাই না।

-তাহলে কী বোঝাতে চাইছ তুমি বদলে গেছ?

বিজরী নিরব রইল… কী করে বলবে এই মানুষটার জন্য তার চারপাশটা কেমন শুনশান অসহ্য নিরবতায় আটকে থাকে! এই যে সে ফোন করল যেন শান্ত পুকুরে কেউ প্রকান্ড ঢিল ছুঁড়ে মারল। একঝাঁক চড়ুই এসে হাট বসাল, কত কথা জমা তাদের! তারও তো কত কথা এই মানুষটার জন্য জমাতে ইচ্ছে করে, কিন্তু সাধ্য কোথায়? তার ভাবনায় বাঁধা দিয়ে মেহরাব বলল-

-কিছুই বদলায়নি। যেটুকু বদল হয়েছে তা কেবলই তোমার মনের শঙ্কা। শঙ্কা নামক পর্দাটা সরিয়ে দিলেই দেখতে পাবে, কেবল ভালোবাসাই অপেক্ষমান।

-“ভালোবাসা”! ওটা ছুঁয়ে দেখার জন্য যে শক্ত হৃদয়ের দরকার হয় সেটা সবার বেঁচে থাকে না।

মেহরাব এক মুহূর্ত সময় নিয়ে বলল- আমি তোমার পাশে কিছুক্ষণ বসে থাকতে চাই। যে কথাগুলো আমার জন্য জমে জমে পাহাড় হয়ে আকাশ ছুঁতে চাইছে তার সবটা শুনতে চাই।

বিজরীর বুকের মধ্যে মোচড় দিয়ে উঠল। বহু কষ্টে সে কান্নাটা গিলে নিয়ে স্বাভাবিক গলায় বলল- আপনি কী আর কিছু বলবেন?

-হুম… বলব।

-কী?

– “কী করিলে বলো পাইব তোমারে? রাখিব আঁখিতে আঁখিতে?”

বিজরীর পক্ষে আর সম্ভব হল না… সে আস্তে করে ফোন রেখে দিয়ে অঝোরে কাঁদতে লাগল। মেহরাব জানে বিজরী এখন কাঁদছে। তারপর সে বারান্দায় বসে আকাশ দেখবে। যে আকাশে সে তাকিয়ে আছে। সৃষ্টিকর্তা কী সহায় হবেন এই দুটি মানুষের প্রতি? তার ইচ্ছে হল এই মুহূর্তে বিজরীর কাছে ছুটে যায়। তার চোখে চোখ রেখে জিজ্ঞেস করে “কেন লুকাও ভালোবাসা? কেন আড়াল হও? কেন একটাবার আঁকড়ে ধরে বলতে পারো না যে, আমার কেবল তোমাকেই চাই?”

মেহরাব অল্প কিছুদিনের ছুটিতে এসেছে। সে কী করে তার আম্মা আর পরিবার দুটো ফেলে যাবে বুঝে উঠতে পারছে না। এই মুহূর্তে দুটো পরিবারেরই তাকে প্রয়োজন। আম্মাকে ছেড়ে যাওয়া সম্ভব নয় আর এত বছরের অপেক্ষার পর নিজের পরিবারকে পেয়েছে তাদেরকেও চোখের আড়াল করতে মন চায় না। কী করবে সে?

পরদিন মেহরাব সকাল সকাল আম্মার কাছে যেতে চাইলে মেহেরুন্নেসাও তার সাথে যেতে চাইল। মেহরাব খুশি মনেই রাজি হয়ে গেল। ওদিকে সময় যত যাচ্ছে সাজেদার শরীর তত খারাপ হচ্ছে। মেহরাবকে কাছে পেলে তার সময়টা ভালো যায়। মেহরাব সারাদিন মায়ের সাথে থাকলেও তার মনের ভেতর কেমন অস্থিরতা বাস করে সেটা সাজেদা টের পায়। ছেলেটা নিজে কিছু বলবে না, যা করার তাকেই করতে হবে। সে সিদ্ধান্ত নেয় ওর মায়ের সাথে কথা বলবে বিজরীর ব্যাপারটা নিয়ে। এ ব্যাপারে মেয়েদের জানালে তারাও একই কথা বলে। সজীব তো আর তাদের একার নয় এখন। ওর ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে গেলে এখন ওর পরিবারের সম্মতিটা আগে দরকার। তাই সজীব যখন তার মাকে নিয়ে এখানে আসল সাজেদা ভীষণ খুশি হয়। সে এক ফাঁকে ছেলেকে জিজ্ঞেস করে-

-বিজরীর সাথে তোর কথা হয়?

-না।

-বলস না কেন? আমি তারে ডাইকা আনাই?

-না। কেউ না চাইলে তাকে জোর করা যায় না।

-জোর কইরা কাউরে কিছু বলা যায় না সত্য কিন্তু মানুষটা যদি কাছের হয় আর ইচ্ছা যদি নেক হয় তাইলে অবশ্যই জোর করা যায়। তাছাড়া এইটা জোরের বিষয় না, এইটা হইল অধিকার। বিজরী মনের মধ্যে অনেক বড় চোট পাইছে। তারে সহজেই সেইখান থিকা বাহির করা যাবে না। তার মনের জোর ফিরায় আনতে তোমার হতাশ হওয়া চলবে না। তুমি একটু ভরসা দিলেই সে সাহস ফিরা পাইব।

আম্মা যা বলছে তা হয়ত ঠিকই কিন্তু বিজরীর উপর মেহরাবের জোর করবার অধিকার আছে কী? সে আম্মাকে কিছু বলল না। ছোট্ট করে “হুম” বলে উঠে যায়। বাইরে গিয়ে রাস্তায় কিছুক্ষণ এলোমেলো হাঁটতে থাকে। এত প্রশ্ন কেন তার জীবনে? আর ১০টা সাধারণ মানুষের মত তার জীবন প্রশ্নবিহীন হতে পারত না?

মেহরাব বাইরে চলে গেলে সাজেদা সময় বুঝে মেহেরুন্নেসার সাথে বিজরীর বিষয়টা নিয়ে আলাপ করে। সব শুনে মেহেরুন্নেসা যে উত্তর দেয় তাতে সাজেদার পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যেতে চায়। মেহেরুন্নেসা স্পষ্টই বলে দেন, যে মেয়ের বাবা তার ছেলেকে এভাবে অপমান করেছে তার মেয়ের সাথে মেহরাবের বিয়ের প্রশ্নই ওঠে না। তাও আবার মেয়েটা ডিভোর্সি! তিনি আরও অনেক কথাই বললেন যা সাজেদাকে স্তব্ধ করে দিল। তার কেবলই মনে হতে লাগল, এই কথাগুলো সজীবের কানে গেলে সে কী করবে? সজীবের ভালো থাকার সীমানা কেবল বিজরীকে ঘিরে। মেহেরুন্নেসাকে কী করে বোঝাবে এটা??? সাজেদার দম বন্ধ লাগে… সে যেকোনো মূল্যে তার ছেলের ভালো থাকা দেখতে চায়। ঐ মুহূর্তেই সে মনে মনে ঠিক করে ফেলে মেহেরুন্নেসা পেটে ধরলেও সজীবের মা সে নিজে। তাই ছেলের ভালো তাকেই দেখতে হবে।

মেহরাব সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে উঠান থেকে বিজরীদের বারান্দায় তাকায়। তারপর তার কী যে হলো সে বের হয়ে সোজা বিজরীদের বাড়ি চলে যায়। বেল চাপতেই বিজরী দরজা খুলে দেয়। মেহরাবকে দেখে বিজরী থমকে যায়। কতকাল পর এত কাছ থেকে এই মুখ দেখতে পেল!!! মেহরাব কিছু না বলে বিজরীর হাত ধরে টেনে নিয়ে ছাদে চলে যায়। ঘটনার আকস্মিকতায় বিজরী ঘাবড়ে যায়। ভীত গলায় বলে-

-কী করছেন আপনি?

মেহরাব শক্ত করে বিজরীর দুই বাহু ধরে বলে-

-কী করব? কী করতে বলো তুমি আমায়? তুমি বুঝতে পারো না আমি কী চাই? বুঝতে পারো না কী চলে আমার ভিতরে বাহিরে?

বিজরীর হার্টবিট বেড়ে গেল। তার ডাগর দুচোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ল কিন্তু কিছুই বলল না। মেহরাব তার মুখে ভেসে থাকা কষ্টটা ঠিকই দেখতে পেল। সে বিজরীকে ছেড়ে দিয়ে কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। তারপর পকেট থেকে ফোন বের করে সাজেদাকে ফোন দিয়ে বলে-

-আম্মা একটু বিজরীদের বাড়ি এসো তো।

-তুই কোথায় এখন?

-ওদের বাড়ির ছাদে। তুমি এক্ষুণি আসবে। আমি বিজরীকে নিয়ে বের হব এখন।

সাজেদা কী বুঝল কে জানে কিন্তু সে ব্যস্ত হয়ে বলল- আমি আসতেছি কিন্তু তোরা কই যাবি?

-এইতো… তুমি এসে আন্টিকে বলে দিও বিজরী আমার সাথে আছে। বলে সে দেরি না করে ফোন কেটে দিয়ে বিজরীর হাত ধরে বলল- “চলো”

বিজরী স্থির থেকে বলল- কী করতে চাইছেন আপনি?

মেহরাব বিজরীর মুখের দিকে ফিরে তাকায় একবার তারপর কোনো জবাব না দিয়ে হাত টেনে নিয়ে যেতে থাকে। বিজরীর কেন যেন বাঁধা দিতে মনে চাইল না!

মেহরাব বিজরীকে নিয়ে হাইওয়ের রাস্তা ধরল। যদিও এই মানুষটার সাথে মরে যেতেও বিজরীর কোনো দ্বিধা নেই তবু সে আস্তে করে বলল- “গাড়ি আস্তে চালান। বহু বছরের অপেক্ষার পর জীবনে অনেক কিছু ফিরে পেয়েছেন, অপ্রয়োজনীয় কারো জন্য সেটা ভুলে যাবেন না”।

-কে প্রয়োজনীয় আর কে অপ্রয়োজনীয় সেটা কী তুমি ডিসাইড করে দেবে?

বিজরী আর কিছু বলল না, চুপ করে গাড়ির উইন্ডোতে চোখ রাখল। মেহরাব গাড়ির গতি কিছুটা বাড়িয়ে দিল যেন সমস্ত দোষ গাড়ি আর রাস্তাটার। প্রায় ঘন্টাখানেক পর একটা ব্রিজের উপর গাড়ি থামায়। বিজরী দেখল আশেপাশে আরও কিছু গাড়ি থেমে আছে। আজকাল মানুষের অবসর কাটাবার জায়গার বড়ো অভাব। তাই রাস্তার ধারেও তারা একটু শ্বাস নেবার জন্য দাঁড়িয়ে যায়। মেহরাব তখন বিজরীর দিকে রূঢ়ভাবে তাকিয়ে বলল-

-এই আমাকে দেখতে তোমার ভালো লাগছে, না?

বিজরী নিস্পৃহ গলায় বলল- আমাকে নিয়ে এখানে এলেন কেন?

মেহরাব বিজরীর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। এক সময়ের দারুণ চঞ্চল আর নরম মেয়েটা এত নিস্পৃহ কী করে হয়ে গেল? সে বিজরীকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে দিয়ে বলল-

-আমার দোষটা কোথায় বলবে? আমাকে ” আপনি” বলে কেন যোজন যোজন দূরের মানুষ দেখাতে চাইছ?

-আমারা কী কাছের কেউ? যেখানে অধিকার দেখাবার ক্ষমতা নেই সেখানে সম্বোধনে কী এসে যায়?

মেহরাব বিজরীর দিকে তাকিয়ে থাকে। সে আলতো স্বরে বলল- তোমাদের বাপ-বেটির অভিমানে শাস্তিটা আল্টিমেটলি কেবল আমারই হচ্ছে!

বিজরী এবার গাঢ় চোখে মেহরাবের দিকে তাকায়। ওর চোখে চোখ রেখে বলে- যা কিছু হচ্ছে তা কেবল আমাকেই ক্ষয় করছে আর শাস্তি আপনার হচ্ছে?

মেহরাব কাতর কন্ঠে বলল- প্রতিটি মানুষই তার আশপাশের কিছু মানুষকে কেন্দ্র করে বাঁচে, বৃত্তের মাঝখানে বিন্দুর মতো। বিন্দুর যদি ক্ষয় হয় সেই আঁচ কিন্তু বৃত্তকেও পোড়ায়।

-আগুনে পুড়ে যাওয়া আর তার আঁচ গায়ে লাগা দুটোর তফাতটাও জানে মানুষ। আমি চাইলেই কী পারব আমার গায়ে লেপ্টে থাকা সেই বিভীষিকার দাগ মুছে ফেলতে? আমার গায়ে “ডিভোর্স” নামক যে ট্যাগ ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে সেটা কেউ খুলে দিতে পারবে?

-তুমি এভাবে কেন ভাবো? জীবন এমন অনেক অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা বহন করেই চলমান। ওসব সামলে নিয়ে এগিয়ে যেতে হয়। আমরা সবাই সত্যটা জানি, বুঝি। তুমি এসব কেন গায়ে মাখবে?

-“গা” টা তো আমার তাই আমাকেই গায়ে মাখতে হয়। আমি মুছতে চাইলেও সমাজ আমাকে চোখে আঙুল দিয়ে মনে করিয়ে দেয় “তুমি সমাজের উচ্ছিষ্ট! স্বাভাবিক জীবন চাওয়াটা তোমার অপরাধ”।

মেহরাব অসহায় গলায় বলল- তুমি অযথাই এমন কঠিন করে ভাবছ।

-অযথা সমাজের কঠিন দৃষ্টিটা আমাকেই দেখতে হয় কিনা তাই না চাইলেও ভাবনাগুলো আপনা আপনিই এসে যায়।

মেহরাব কাতর গলায় বলল- চলোনা সব ভুলে গিয়ে নতুন করে বাঁচি? এইভাবে প্রতিদিন আর মৃত হয়ে থাকতে পারছি না। তোমাকেও এভাবে দেখতে পারছি না…

-বেঁচে থাকার সাধটাই তো আর বেঁচে নেই! আমাকে আর এসবে টানবেন না প্লিজ।

মেহরাব একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল- আমি তোমাকে চেয়েছিলাম কিন্তু তুমি সমাজের সংঘাতে নিজেকে বেঁধে রাখলে! আমি কিছুদিনের মধ্যেই কানাডা ফিরে যাচ্ছি। হয়ত আর ফিরব না। যদি না ফিরি তবে মনে রেখ এর কারণ শুধুই তুমি।

-বিজরীর হৃদপিন্ড ধরাস করে উঠল। মেহরাব চলে যাক এটা সে চায় না। তার কী ভীষণ ইচ্ছে করে মেহরাবের বুকে গুটিসুটি মেরে লেপ্টে থেকে সমস্ত পৃথিবী থেকে আড়াল নিয়ে নেয়। কিন্তু তার সে সাধ্য কই? কী করে বলবে আজ সে নতুন করে ভেঙেচুরে গেছে! বিকেলে সে মেহরাবের মাকে দেখতে ওবাড়ি গিয়েছিল। দরজায় দাঁড়িয়ে তার মায়ের বলা কথাগুলো সে শুনে ফেলেছে। যে সমাজকে মেহরাব উপেক্ষা করতে বলছে মেহরাবের মা যে সেই সমাজেরই বাসিন্দা! বিজরীর তীব্রভাবে অসহায় লাগতে লাগল।

মেহরাব আর কিছু না বলে চুপচাপ গাড়ি ঘুরিয়ে নিল।

চলবে…