#পরিযায়ী_জীবন (পর্ব – ৯)
মেহেরুন্নেসা প্রথমবার বাসায় এসেছে বলে সাজেদা আতিথিয়েতার কোন কমতি রাখছে না। ফাতেমা আর ফারজানা মিলে রাতের খাবারের আয়োজন করছে। কাজের ফাঁকেও ফাতেমা খেয়াল করেছে মেহেরুন্নেসার সাথে বিকেলে গল্প করার পর থেকে আম্মা কেমন চুপসে আছে। আবার সন্ধ্যারপর হুট করেই বিজরীদের বাড়ি গেল। সেখান থেকে এসে শুয়ে পড়েছে। শরীরটা তো ভালো না, প্রায় সারাক্ষণই জ্বর থাকে গায়ে। রাতে কাশির দমকে ঘুমাতে পারে না। কিছু খেতেও চায় না, অল্পতেই একেবারে ক্লান্ত হয়ে যায়। ফাতেমার চোখে পানি এসে গেল। চোখের সামনে কেমন করে আম্মা শেষ হয়ে যাচ্ছে অথচ কিছুই করতে পারছে না তারা! সে চোখ মুছে দ্রুত হাত চালাতে লাগল, মায়ের সাথে কথা বলা দরকার। কাজ শেষ করে মায়ের জন্য আনারের জুস করে নিল। মায়ের ঘরে যাবার আগে গেস্ট রুমে উঁকি দিয়ে দেখল মেহেরুন্নেসা তার ফারাবি আর ফাইয়াজের সাথে বসে খুব গল্প করছে। সে তখন সোজা মায়ের ঘরের দিকে এগিয়ে গেল। সাজেদা শুয়েই ছিল। ফাতেমাকে আসতে দেখে দ্রুত চোখ মুছে নেয়। ফাতেমা জুসটা মায়ের হাতে দিয়ে বলল-
-আম্মা, শরীর কী বেশি খারাপ লাগছে? সজীবকে বলব?
-না, শরীর ঠিক আছে। সজীবরে বইলা শুধু শুধু অস্থির করার দরকার নাই।
ফাতেমা মায়ের কপালে হাত রেখে বলল- তোমার শরীর ঠিক নাই জ্বর এসেছে আবার। শুধু শরীর খারাপ লাগছে এমন না। তোমার আরও কিছু হয়েছে… কী হয়েছে বলতো?
সাজেদা তখন মেহেরুন্নেসার সাথে বলা কথাগুলো ফাতেমাকে জানায়। ফাতেমা সব শুনে স্তব্ধ হয়ে যায়। সে হতাশ গলায় বলে-
-এখন কী হবে?
-আমার সজীব বিজরীর জন্য একবার দেশান্তরি হইছিল, এইবার কিছু হইলে ও সহ্য করতে পারব না। আর বিজরী এত ভালো, এইখানে ওর কোন দোষও নাই। বিনা দোষে সারাজীবন ও কেন কষ্ট পাইব? চোখের সামনে আমার বাচ্চা দুইটা শেষ হইয়া যাইব আমি কেমনে সহ্য করব?
-তুমি কী করতে চাও? সজীবের এখন নিজের পরিবার আছে আমরা কী তাদের উপর কিছু বলতে পারব?
সাজেদা দৃঢ় স্বরে বলে- সজীব আমার ছেলে, ওর উপর আমার পুরা হক আছে। ওর যা ভালো হয় আমি তাই করব।
ফাতেমা মায়ের কঠিন দৃষ্টির দিকে তাকিয়ে থাকে। সেখানে একজন মায়ের অধিকারের পোক্ত ছাপ! তবে সাজেদা যতই নিজেকে শক্ত দেখাক তার মনের মধ্যে মেহেরুন্নেসার কথাগুলো কাঁটা হয়ে ঠিকই বিঁধে রইল।
রাতে সজীব ঘরে ফিরল প্রচন্ড বিষণ্নতা নিয়ে। খাবার টেবিলেও চুপচাপ রইল। ফাতেমা সবই খেয়াল করল। সে সজীবকে বলল-
-কিরে, কী হল? কিছুইত খাচ্ছিস না।
-কিছু না বুবু, খেতে ইচ্ছা করছে না।
-আচ্ছা, ইচ্ছে না করলে খেতে হবে না, উঠে যা। আম্মার কাছে গিয়ে বস একটু। সন্ধ্যা থেকে শরীরটা একেবারেই ভালো নেই।
-আগে বলিস নাই কেন? এইসব ব্যাপার নিয়ে চুপ থাকে কেউ? বলেই মেহরাব উঠে হাত ধুয়ে সাজেদার ঘরে চলে গেল।
মেহেরুন্নেসা ব্যাপারটা খেয়াল করলেন। তার চোখে মুখে স্পষ্টই বিরক্তির ছাপ। তিনি গম্ভীর গলায় বললেন-
-ছেলেটাকে এভাবে খাওয়া থেকে উঠিয়ে দেয়াটা ঠিক হল না।
ফাতেমা বলল- আন্টি আপনি চিন্তা করবেন না, আমি ওকে না খেয়ে ঘুমাতে দিব না।
মেহেরুন্নেসা আর কিছু না বলে প্রচন্ড অনীহার সাথে খেতে লাগলেন। এত বছর পর ছেলেটাকে পেয়েও যেন তিনি পাচ্ছেন না! আর এই ব্যাপারটাই তার ভেতরে ক্ষোভ তৈরি করে যাচ্ছে নিরবে!
মেহরাব মায়ের ঘরে গিয়ে দেখে আম্মা শুয়ে আছে। সে আস্তে করে আম্মার কপালে হাত রাখে। সাজেদা সাথে সাথে চোখ খুলে মেহরাবকে দেখে উঠে বসতে চায়। মেহরাব বাঁধা দিতে চাইলে সাজেদা বলে-
-আমারে বসায় দাও, আমি একটু কথা বলব তোমার সাথে।
মেহরাব মাকে উঠিয়ে বসিয়ে দিয়ে বলে- তোমার গায়ে তো অনেক জ্বর! দাঁড়াও আগে ঔষধ খাও তারপর তোমার কথা শুনছি।
সাজেদা ছেলের স্পর্শেই স্বস্তি পায়, তার কী ঔষধ লাগে? সে ঔষধটা খেয়ে ছেলের দিকে তাকায়। ছেলের মুখ শুকিয়ে এতটুকু হয়ে আছে। এই মুখটা দেখলেই তার কলিজায় মোচড় দিয়ে ওঠে। সে জিজ্ঞেস করে- ভাত খাইছ?
-হু।
-বিজরীর সাথে কী কথা হইল?
মেহরাব চুপ করে থাকে। সাজেদা আবার জিজ্ঞেস করে- কিছু বলে নাই তোমারে?
-হু…
– কী বলছে?
-বাদ দাও না আম্মা, ভালো লাগছে না।
-বাবা… বিজরী এখন যেই অবস্থায় আছে তাতে সে সহজে সহজ হইব না। তুমি যদি তারে এখন ভুল বুঝো তাইলেই সর্বনাশ। বিজরীর এখন আশ্রয় দরকার আর সেইটা সে তোমার কাছেই পাইব। সময় সব সময় পক্ষে থাকে না। সময়কে পক্ষে টেনে আনতে হয়। সেদিন দাওয়াতে খাওয়ার পর তুমি তো চইলা গেলা। তুমি যাবার পর বিজরীর বাবা মা তোমাদের বিয়ে নিয়ে ভাবা যায় কিনা আকারে ইঙ্গিতে সেই কথা বোঝাবার চেষ্টা করছে। আমি তখন তেমন কিছুই বলি নাই। তবে তারা আমার মনের কথাই বলছে। বিজরীর সাথে আমি কথা বলব। তোমাদের জন্য যা যা করা লাগে আমি করব তুমি চিন্তা করবা না। বিজরীকে মানানোর আগে তুমি শুধু নিশ্চিত হয়ে বলো যে, বিজরীর এখন একটা অতীত আছে সেইটা কোনদিনও তোমাকে কষ্ট দিবে কিনা? এই বিয়ে নিয়ে অনেকেই অনেক কথা বলবে, প্রশ্ন তুলবে সেগুলা শুনতে পারবা কিনা? তোমার মা, বাবা, ভাই, ভাবিরা যদি এই সম্পর্ক মানতে না চায় তাদের মানায় নিতে পারবা কিনা?
-মেহরাব অবাক হয়, সে তো এই বিষয়গুলো ভাবেইনি! ইনফ্যাক্ট এগুলো যে ভাববার বিষয় সেটাই তো তার মাথায় আসেনি।
মেহরাবের চোখের দিকে তাকিয়ে সাজেদা বলে- কোন কিছুই এত সহজ না বাবা। এই প্রশ্নগুলা তোমার সামনে আসবেই। তখন যদি সবার কথায় তোমার মন ছোট হয়, প্রশ্ন আসে তাইলেই সব শ্যাষ। বিজরী অনেক বড় একটা ধাক্কা খাইছে। যেইটা সে সামলায় উঠতে পারতেছে না। এখন সে যদি এইসব আবার দেখে তারে কিন্তু বাঁচান যাইব না। আমরা তোমার পরিবার, আবার পরিবার না। সব মানুষই আলাদা তাই আমাদের চিন্তাধারা, মতামত আর মূল্যবোধ অন্যদের সাথে মিলবে এমন না। তারা তোমারে বিজরীরে কাউরেই এত ভালো কইরা জানেও না। তাই তাদের মতামতের সাথে আমাদের মতামত মিলবে এমনটা আশা করাও যায় না। এখন এই সব কিছু ভাইবা, বুইঝা তোমারেই সিদ্ধান্ত নিতে হইব। সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় মনে রাইখো, এইখানে বিজরী আর তোমার ভালো থাকাটা সবার আগে। আর এইটাও মনে রাখবা যে, আমি আমার ছেলে-মেয়েদের সাথে আছি। ভালো থাকার জন্য নিজেরে শক্ত রাখতে হয়।
মেহরাব বুঝতে পারে তার আম্মার বলা প্রতিটি কথা গুরুত্বপূর্ণ। এগুলো তার নিজেরই ভাবা উচিত ছিল। সে বিজরীকে ভালোবেসেছিল এবং সেটা প্রচন্ডভাবেই। মাঝখানে এত কিছু ঘটে যাবার পেছনে নিশ্চই সৃষ্টিকর্তার কোন উদ্দেশ্য ছিল। এত কিছুর পরও তো বিজরীর প্রতি তার ভালোবাসা কমেনি। ওকে সুস্থ স্বাভাবিক জীবন কেবল মেহরাবই দিতে পারবে ব্যাপারটা হয়ত এমন নয়। কিন্তু এটাও ঠিক যে তারা একে অপরকে ভীষণভাবে চায়, ভালোবাসে এবং বুঝতেও পারে। এই ব্যাপারগুলো অন্য কারো সাথে কী একই রকম হবে? ভালো থাকা আর ভালো রাখার ভাবনাগুলো তো সবার এক রকম নয়। প্রার্থনার মানুষটাকে রেখে কী অন্য কারো সাথে ভালো থাকা যায়? এমন সময় ফাতেমা ঘরে আসে খাবার নিয়ে। মেহরাবের ভাবনায় ছেদ পড়ে। ফাতেমা দুজনকে চুপচাপ দেখে বলে-
-তোমরা কী এত জরুরি কথা বলতেছ? কথা পরে বইল। তোমার ছেলে কিন্তু না খেয়ে উঠে আসছে। আমি ভাত নিয়া আসছি খেতে বলো।
সাজেদা ছেলের দিকে তাকিয়ে বলল- না খায়া সমস্যার সমাধান হইব না। খালি পেটে মাথাও ঠান্ডা থাকে না। খায়া নাও।
ফাতেমা ভাত মেখে মেহরাবের মুখের সামনে ধরে বলে- তোর পছন্দের খাবার রান্না করেছি না খেলে আমরা কেউ খেতে পারব?
মেহরাব চুপচাপ খাবার মুখে নেয়। ফাতেমা বলতে থাকে- এক সময় তোকে হারায় ফেলব কিনা সেই ভয়ে অস্থির থাকতাম এখন সেখানে জায়গা দখল করেছে- “তুই আমাদের থেকে দূরে সরে যাবি নাতো?” এই ভয়টা অনেক বেশি… এই আতঙ্ক নিয়ে একেকটা মুহূর্ত কী যন্ত্রণায় কাটে সেটা বোঝানো সম্ভবনারে।
-তোদের তাই মনেহয়?
-তাই মনে করতে চাই না… কিন্তু পরিস্থিতি আর পরিবেশের চাপ অনেক কিছুই বদলে দেয়। ভয়টা সেখানেই।
-পরিস্থি আর পরিবেশ যেটাই হোক তোরা আমার পাশে থাকলে কোন কিছুই বদলাবে না।
ফাতেমা ভাইয়ের কথায় খুশি হল। তার চোখে পানি এসে গেল। কপাল গুনে ভাই পেয়েছে তারা একটা। সে মনে মনে দোয়া করল- “পৃথিবীর সকল বোনের ভাগ্য আল্লাহপাক এমন চমৎকার করে লিখুক।”
মেহরাবের সেরাতে ভালো ঘুম হল না। সে এটা ভালো করেই জানে বিজরী তার জীবনের এমন একটা অংশ যেটাকে পাশ কাটিয়েও বেঁচে থাকা সম্ভব নয়। তাছাড়া এর সাথে বিজরীর স্বাভাবিক ভাবে বেঁচে থাকাটাও জড়িয়ে আছে। সে সিদ্ধান্ত নেয় তার মায়ের সাথে এ বিষয়ে কথা বলবে যত দ্রুত সম্ভব।
ওদিকে আরও দুজন মানুষের ঘুম হল না, সাজেদা আর মেহেরুন্নেসার। সাজেদা ভাবছে কীভাবে ছেলেটার জীবন সুন্দরভাবে গুছিয়ে আনা যাবে আর মেহেরুন্নেসা ভাবছে- তিনি ছেলেটাকে পেয়েও যেন পাচ্ছেন না! ছেলে এখনও সারাক্ষণ পালিত মায়ের কথাই ভেবে যায়। নিজের মায়ের কাছে এখনও তার এত জড়তা এত সংকোচ! যতটা সহজে পালিত মাকে সব বলতে পারে নিজের মাকে কেন পারে না? ছেলের পছন্দে বিয়ে দিতে তার আপত্তি নেই কিন্তু যাচাই বাছাই বলে তো কিছু ব্যাপার আছে? যে মেয়ের বাবা এত অপমান করে, যে মেয়ের ক্যারিয়ার বলে কিছু নেই বরং পঁচা শামুকে পা কেটে জীবন অন্ধকার অতীতে ঢাকা, তাকে কেন তার ছেলের বিয়ে করতে হবে? তার ছেলে সমাজে প্রতিষ্ঠিত একজন সুপুরুষ। তার জন্য তেমন যোগ্যতাসম্পন্ন মেয়েই তো চাই? ওর পালিত মা আসলে কী চাইছে? তিনি যাই চাক তার চাওয়াই সব কিছু নয়। মেহরাব আমার ছেলে তাই আমার চাওয়াটাই শেষ কথা হওয়া উচিত।
চলবে…