পরিযায়ী জীবন পর্ব-১২

0
13

#পরিযায়ী_জীবন (পর্ব – ১২)

সারা রাত বিজরীর ঠিক মত ঘুম হল না। মেহরাব আর তার মা দুজনের কথাই তাকে আলাদাভাবে বিদ্ধ করতে লাগল। কী করবে সে? একই ভুল আবার করবে? মেহরাব তাকে সত্যিই ভীষণ ভালোবাসে। সে কী তার খারাপ হতে দেবে কখনো? কিন্তু সে তো তার মায়ের ব্যাপারেও ভীষণ possessive! তার মাথা কাজ করতে চায় না…

ভোরের দিকে এসে বিজরীর দুচোখের পাতা এক হয়। বিক্ষিপ্ত মনে ঘুমিয়েও সে খুব সুন্দর একটা স্বপ্ন দেখতে থাকে… দেখে- মেহরাব আর সে হাত-ধরাধরি করে হাঁটছে। রাস্তাটা এত সুন্দর! দুপাশে গোলাপি চেরিফুলের গাছের সারি। পুরো শহর চেরি ফুলে ঢাকা। হালকা বাতাসে ফুলের পাঁপড়ি উড়ে উড়ে ছড়িয়ে গিয়ে ঢেকে দিচ্ছে পায়ে চলা সমস্ত পথ। ফুলের উপর পা ফেলতে বিজরীর মনে কষ্ট হচ্ছে। তার ইচ্ছে হচ্ছে সমস্ত ফুল কুড়িয়ে কোলে নিয়ে বসে থাকে। সে না হেঁটে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। মেহরাব অবাক হয়ে বলল-

-কী হলো?

-হাঁটতে পারছি না।

-কেন? পায়ে ব্যথা লাগছে?

-না।

-তাহলে?

-ফুলের উপর পা ফেলতে ইচ্ছে হচ্ছে না।

মেহরাব মৃদু হেসে বলল- কোলে তুলে নেব?

-৫০ বছর পর যখন আবার আসব তখন নিয়ো। এখন কী করব?

-কিছু করার নেই, এর উপরই হাঁটতে হবে।

-বিজরী উপায় না পেয়ে পা বাড়ায়। ফুল থেকে খুব মৃদু স্মেল আসছে… কিন্তু কী আশ্চর্য, ফুলগুলোর স্মেলটা ঠিক রজনীগন্ধার মতো! এমন সময় মেহরাব বিজরীর কাঁধে হাত রেখে গুনগুন করে গান ধরল। কী গান যে ধরল বিজরী খুব চেষ্টা করেও বুঝতে পারছে না। সে খুব মন দিয়ে বোঝার চেষ্টা করে যাচ্ছে তবু বুঝতে পারছে না! অথচ গানের ভলিউম আস্তে আস্তে উচ্চস্বরে যাচ্ছে। এমন সময় তার ঘুম ভেঙে গেল। ঘুম ভাঙতেই শুনতে পেল গান বাজছে… “বধু কোন আলো লাগল চোখে…” বুঝতে পারল রাতের মত সকাল না হতেই গান বাজাতে শুরু করেছে। কী যে শুরু করেছে এরা? সে উঠবার জন্য ঘাড় ঘোরাতেই দেখে তার ঠিক মুখের কাছেই একগুচ্ছ রজনীগন্ধা ফুল রাখা! সে ভীষণভাবে অবাক হয়ে দ্রুত উঠে বসে ফুলগুলো হাতে নিয়ে দেখে তাতে ছোট্ট একটা চিরকুট বাঁধা। সেখানে লিখা- “আমার দুচোখের ঘুম হাওয়া করে দিয়ে নিজে আরামে ঘুমাচ্ছে, আর তারপরও আমি কিনা তার ভালো লাগার কথা ভেবে যাচ্ছি! এই ওঠোহ, একদম ঘুমাবানা আর।” লিখাটা পড়ে বিজরী হেসে ফেলল, তারপর আবার তার মন বিষণ্ণতায় আচ্ছন্ন হয়ে গেল। সে কাগজটা হাতের মুঠোয় রেখে ফুলগুলোর দিকে অলস চোখে তাকিয়ে রইল। স্মৃতিরা এসে তাকে ছুঁয়ে দিতে লাগল… স্মৃতিময় সময়টাকে স্থায়ী হতে দিল না। উঠে ফ্রেস হতে হতেই কলিংবেল বাজল। ভেতর থেকে ওর মা চেঁচিয়ে বলল-

-বিজরী, দরজাটা খোল।

বিজরী দরজা খুলে আগন্তুককে দেখে ভীষণ অবাক হল। বলল- তুমি ফারাবি নাকি ফাইয়াজ কোনটা?

-দেখা হলেই তুমি শুধু এইটা বলো। আজকে তোমাকে বলতে হবে আমি কে?

-তোমরা দুইটা দেখতে এক রকম কেন? সেজন্যই তো জিজ্ঞেস করতে হয়। এত সকালে কী করতে এসেছ? আর তোমার হাত পেছনে কেন?

-আগে বলতে হবে আমি কে?

-উমম… তুমি ফাইয়াজ?

ফারাবি হা হা করে হেসে বলল- হয়নি হয়নি, আমি ফারাবি। বলেই তার পেছন থেকে বাম হাতটা বের করে একগুচ্ছ হলুদ গোলাপের তোড়া বাড়িয়ে দিয়ে বলল- তুমি বলতে পারোনি তাই তোমার জন্য এটা।

বিজরী এটা দেখার জন্য প্রস্তুত ছিল না সে ভীষণ ভাবে অবাক হল। ফুলগুলো নিয়ে বলল- যদি বলতে পারতাম তাহলে কী দিতে?

-তাহলে এই ফুলগুলোই ডান হাতে দিতাম তখন, বলেই সে হা হা করে হাসতে লাগল।

ফারাবির কথা শুনে বিজরী হেসে ফেলল। বলল- এগুলো কে শিখিয়ে দিয়েছে তোমাকে?

-মামাই তো শিখিয়ে দিয়েছে। মামা নাম্বার টু।

-মামা নাম্বার টু আবার কে?

-ওই যে মাহাদী মামা কাল থাকল না আমাদের বাসায়? খুব পাজি। জানো কী করেছে? সকালে আমার মুখে পানি ছিটিয়ে দিয়ে পা ধরে টেনে ঘুম থেকে তুলেছে! আমি তখন আম্মুকে ডাকতে গেছি তখন বলেছে- ডাকলে কিন্তু এক্ষুনি পানি ঢেলে গোসল করিয়ে দিব, একদম চুপ। আমি তো আর কিছুই বলতে পারলাম না!

বিজরী ওর কথায় খুব হাসল। বলল- আহারে… তোমার মামা নাম্বার টু তো আসলেই খুব পাজি! ফুলগুলো কী মামা নাম্বার টু পাঠিয়েছে?

-আরে না। ফুল তো আমার মামা দিল। বলে সে পকেট থেকে একটা কাগজ বের করে বলল- মামা বলেছে এটা পড়লেই বুঝতে পারবে। বলেই সে দৌড়ে চলে গেল।

বিজরী জানে এগুলো মেহরাব পাঠিয়েছে। তার কী পছন্দ, না পছন্দ সেটা মেহরাব খুব ভালো জানে। সে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফুলের ঘ্রাণ নিয়ে ভেতরে গেল। সাথে থাকা চিরকুট খুলে দেখল এটায় লিখা-

“পুড়িয়ে আমার মন আর দেহ
উড়িয়ে উড়িয়ে দেখছ ছাই
সত্যি করে বলতো সখী
আসলে তোমার কী যে চাই?”

বিজরী একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল… তারপর ফুলগুলো টেবিলে নামিয়ে রাখল। রাখতেই আবার কলিংবেল বাজল। সে দরজা খুলে দেখল, ফারাবি দাঁড়িয়ে। বলল- আবার কী?

-আবার? আমি তো এখনই এলাম! মামা ঠিকই বলেছে তুমি ভুল করবে, তুমি একটা ভুলাক্কার। বলেই খুব হাসতে লাগল। বিজরী তখন বলল- হাসি থামাও, কেন এসেছ এখানে?

ফাইয়াজ পেছন থেকে ওর ডান হাতটা বের করে একগুচ্ছ জারবেরা এগিয়ে দিয়ে বলল- এইটা দিতে।

-তোমার মামা এগুলো কী শুরু করেছে? ফুল নিব না, চলে যা নয়ত মার খাবি।

-আউ… মামা তো ঠিকই বলেছে! কিন্তু মামা এসব ঠিক ঠিক কী করে বুঝল?

-মামা কী বলেছে?

-বলেছে, দেখিস তোর বিজরী আন্টি কিন্তু পাগল হয়ে গেছে তুই গেলেই তোকে মারতে চাইবে, তুই কিন্তু সাবধান!

-তোর মামা তাই বলেছে? আমি পাগল? তবেরে…

বিজরী তেড়ে আসতেই ফাইয়াজ দ্রুত ফুলগুলো ওর হাতে গুঁজে দিয়ে বলল- মামা বলেছে তুমি মারতে চাইলেও আমি যেন তোমার হাতে এগুলো ধরিয়ে দিয়ে দৌড়ে পালিয়ে আসি। বলেই সে একছুট লাগাল! বিজরী ডেকেও তাকে ফেরাতে পারল না। তখন কপাল কুচকে ভাবল- এরপর আবার এলে দেখিস কী হয়… কত বড় সাহস আমাকে পাগল বলে! আসিস, যদি কামড়ে না দিয়েছি… তারপর সশব্দে দরজা বন্ধ করে ফুলগুলোর দিকে তাকিয়ে দেখল তাতে চিরকুট আটকানো। খুলে পড়ল- “এত অল্পতেই মেজাজ হারিয়ে লাভ নেই। ভালোবাসা নিতে জানে না আবার মেজাজ দেখাচ্ছে, হুহ!” “হুহ” টাও আবার লিখতে হয়? বিজরীর মেজাজ আরও খারাপ হলো। এরা তো তাকে একদন্ডও শান্তিমতো কিছু ভাবতে দিচ্ছে না! আর তখনই মেহরাবদের ছাদ থেকে গান ভেসে আসতে শুরু হলো- “চুমকি চলেছে একা পথে… সঙ্গী হলে দোষ কী তাতে… রাগ করো না সুন্দরীগো, রাগলে তোমায় লাগে আরও ভালো…” গান শুনে বিজরীর সন্দেহ হলো মেহরাবের বোধহয় মাথার তার আর একটাও অবশিষ্ট নেই। সব ছিঁড়ে ছুঁড়ে ঝড়ে পড়ে গেছে। নয়ত এসব কান্ড ও ঘটাতে পারে? সে বারান্দায় গিয়ে উঁকি দিয়ে দেখতে গেল মেহরাব কি করছে ওখানে। মেহরাব আর মাহাদী ছাদেই ছিল বিজরী উঁকি দিতেই সরাসরি ওদের সাথে চোখাচোখি হয়ে গেল! বিজরী “ইসসস…” বলে জিভে কামড় দিয়ে এক মুহূর্ত দেরি না করে ভেতরে চলে এলো। আর তখনই গান শুরু হলো- “দাগাবাজরে, হায় দাগাবাজরে… তেরে ন্যায়না বাড়ে দাগাবাজরে…” গান শুনে বিজরী মুখটা গোলাপি আভায় মাখামাখি হয়ে গেল। তার মনেও বেজে উঠল- “তুনে প্যাহলি নাজারমে সানাম মেরা দিলকো চুরায়া…” বিজরীর মন কেমন প্রফুল্ল হয়ে গেল। কতকাল পার হয়ে গেছে সে এভাবে হাসতে পারে না, তার মন আনন্দে উদ্বেলিত হয় না। কী আশ্চর্য, তার ঘুমিয়ে থাকা মনের অনুভূতিরা আজ শত দ্বিধা, সংশয়, সংকোচ ছেড়ে সশব্দে জেগে উঠতে চাইছে! নিরবতা আজ ভাষা খুঁজে নিতে ব্যাকুল। বিজরী তার বিছানায় বসে ফুলগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকল… সারা ঘর জুড়ে ফুলের মিষ্টি সুবাস ছড়িয়ে আছে। কী আশ্চর্য এক মেহরাব মেহরাব ঘোর তাকে আচ্ছন্ন করে তুলল… ক্রমশই মেহরাবময় সেই পুরনো নেশা তাকে মাতাল করে দিতে চাইছে… এর ১০ মিনিট পর কলিং বেলের শব্দে বিজরীর ধ্যান ভাঙে। নিশ্চই ফারাবি ফাইয়াজ এসেছে আবার? এবার দুটোর কান মলে দিতে হবে দাঁড়া… সে উঠে গিয়ে দরজা খুলেই তীব্রভাবে বলল-

-আবার এসেছিস? কিন্তু বলার পরই দেখল আগন্তুক অন্য কেউ। সে বিব্রত বোধ করে চুপ করে গেল।

আগন্তুক মুখে বিস্ময়ভাব নিয়ে বলল -মেডাম আমি তো প্রথমবারই এলাম!

-না আসলে, স্যরি… আমি অন্য কাউকে ভেবেছিলাম। আপনি কার কাছে এসেছেন?

-বিজরী খন্দকারের নামে একটা পার্সেল ছিল। এই এ্যাড্ড্রেসই লিখা।

বিজরী খেয়াল করল ছেলেটার হাতে একটা বক্স। সে কপাল কুঁচকে বলল- আমিই বিজরী খন্দকার, দিন। বক্সটা নিয়ে সে ঘরে এসে বক্স খুলতেই বেলিফুলের কড়া সুবাস তার নাকে এসে ঝাপটা মারল। ১০টা বেলিফুলের মালা! আর একটা শাড়ি। বেবি পিংক রঙের জমিনের উপর হলুদ, আকাশি আর হালকা সবুজের ফুল পাতার ছাপা। এত চমৎকার একটা শাড়ি! তার কী পছন্দ অপছন্দ তা কোন এক অদ্ভুত উপায়ে মেহরাব সব কিছু জেনে যায়। শাড়িটা মেলে ধরতেই একটা চিরকুট বের হয়। সেখানে লিখা আছে, “আজ একসাথে লাঞ্চ করছি। ঠিক ২টায় চলে আসবে। কী পরে আসবে নিশ্চই বুঝতে পারছ?” কাগজের উল্টো পিঠেই একটা রেস্টুরেন্টের নাম লিখা দেখতে পেল। বিজরী কপাল কুঁচকে বিড়বিড় করে বলল- বলার ছিড়ি দেখেছ? হুকুম দিচ্ছে একেবারে। লোকের হুকুম শোনার জন্য বসে আছি আমি? হুহ। তারপর কী করবে সেই সিদ্ধান্তহীনতায় ভূগতে লাগল। কী অদ্ভুত, সময় যত যেতে লাগল যাবার ইচ্ছেটাই তার প্রবল হতে লাগল!

চলবে…