পরিযায়ী জীবন পর্ব-১৩

0
15

#পরিযায়ী_জীবন (পর্ব – ১৩)

মেহরাব বের হবার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল। মাহাদী তাকে দাঁড়িয়ে থেকে সাজিয়ে দিচ্ছে। সেই সাথে তাকে সারাক্ষণ জ্ঞান দিয়ে যাচ্ছে কী করতে হবে না হবে। মেহরাবের বিরক্তও লাগছে আবার ভাইয়ের প্রতি ভাইয়ের এত যত্ন আর ডেডিকেশন দেখে ভালোও লাগছে। যদিও মাহাদী তাকে বলেছে সে কনফার্ম বিজরী আসবে তবু ভেতরে ভেতরে সে শঙ্কিত। এমন সময় মেহরাবের মায়ের ফোন আসে। এই সময়ে মায়ের ফোন আসায় মেহরাবের খুশিই লাগল। সে ফোন ধরে সালাম দিল। তার মা সালামের জবাব দিয়ে বলল-

-কী করছিলি?

-একটু বের হব তাই রেডি হচ্ছিলাম।

-এই দুপুরবেলা কোথায় যাবি?

-আমার এক বন্ধুর সাথে লাঞ্চ করব।

-ও… মাহাদী কী করছে?

-এই তো এখানেই আছে কিছু বলবে?

-না থাক। বিজরীর কী খবর? কিছু বলল?

মেহরাব হতাশ গলায় বলল- নাহ… এখনও কিছু বলেনি। বুঝতে পারছি না কী হবে…

-ও তো তোকে অনেক পছন্দ করত, সবাই চাচ্ছে তাও এমন শক্ত হয়ে আছে কেন?

-শক্ত হবার কারণ যে মা নিজেই সেটা মেহরাব কী করে বলবে? বলল- হয়ত কোন কারণে মনে আঘাত লেগে আছে তাই এমন করছে।

-মনে আঘাত লেগেছে! মেহেরুন্নেসা খুব দ্বিধা আর সংকোচ নিয়ে ধীরে বলল- একটা কথা বলব? একটা ব্যাপারে আমার সন্দেহ হচ্ছে…

-কী?

-ব্যাপারটা তুই কীভাবে নিবি…

-সন্দেহ থাকলে সেটা দূর করে দিতে হয়। বলো।

-তোর আম্মার সাথে বিজরীকে নিয়ে বলা কথাগুলো তিনি আবার ওকে বলে দেননি তো?

-মায়ের কথায় মেহরাব বিস্মিত হয়ে গেল। মা এভাবে ভাবতে পারল কীভাবে? মা নাহয় আম্মাকে জানে না তাই বলে কী উপলব্ধিও করতে পারে না কিছু? নিজে মা হয়ে অন্য একটা মা সম্পর্কে এভাবে ভাবতে পারে? সে একটু রুক্ষ গলায় বলল- আম্মা এধরণের কথা চিন্তাও করতে পারে না, বলা তো অনেক দূরের কথা। আমি আম্মাকে একশত ভাগ বিশ্বাস করি। আর সে যদি বলেও থাকে তাহলেও এর পিছনে অবশ্যই বিশেষ কিছু কারণ থাকবে আর সেই কারণটাও অবশ্যই আমার ভালোর জন্য। আমার মনেহয় এই ব্যাপারটা নিয়ে আর কথা বলা ঠিক হবে না। সেটা যার সাথেই হোক। আমি এখন বের হব মা, পরে কথা বলব। বলে মেহরাব ফোন রেখে দেয়।

মেহরুন্নেসা বুঝলেন তিনি খুব বড় ভুল করে বসলেন আবার! ওদের মা ছেলের বন্ডিংটা চমৎকার, ভোরের আলোর মতই শুভ্র আর বিশুদ্ধতায় ভরা। এমনটা বোধহয় তার নিজের ছেলেদের সাথেও তিনি তৈরি করতে পারেননি। মেহরাবের চোখে আবার সে নিচে নেমে গেল। তার চোখে পানি এসে গেল… সে তো খারাপ উদ্দেশ্যে কিছু বলতে চায়নি, শুধু একটা সম্ভাবনার কথা বলেছে…

ওদিকে ফোন রেখে মেহরাব চুপ করে বসে রইল। মাহাদী ওর দিকে তীক্ষ্ণভাবে তাকিয়ে থেকে বলল- কিরে মুখটা এমন কঠিন করে বসে পড়লি যে? কে ফোন করেছিল, মা? মেহরাব কিছু বলল না। মাহাদী ওর পাশে বসে বলল-

-কিরে কথা বলছিস না কেন? কি হলো?

-কিছু না। ভালো লাগছে না।

-ফোনটা তো মনেহয় মা করেছে, কি বলেছে যে হুট করে চুপ হয়ে গেলি?

মেহরাব তবু চুপ রইল। মাকে সে ভীষণ ভালোবাসে, যখন থেকে মা শুধু তার মস্তিষ্কের একটা কল্পনা মাত্র ছিল তখন থেকেই। কিন্তু এই মায়ের সাথে কী সেই মাকে মেলাতে পারছে?

মাহাদী মেহরাবকে আর কিছু বলল না। সে ফোন বের করে মাকে কল দিল। মেহেরুন্নেসা মাহাদীর ফোন দেখে দ্বিধায় পড়ে গেল… মেহরাব কিছু বলেছে কী? সে চোখ মুছে সংকোচ নিয়ে ফোন ধরল। মাহাদী সালাম দিয়ে বলল-

-মা কেমন আছ?

-হুম ভালো।

-কি করছিলে? বাবা কোথায়?

-কিছু না, নামাজ পড়ব। তোর বাবা মসজিদে গেছে।

-ও… তুমি তাহলে নামাজে বসে দোয়া করো মেহরাবকে যেন আজ দুপুরেই বিজরী বিয়ের জন্য “হ্যাঁ” বলে দেয়। ওর “হ্যাঁ” শোনার জন্যই যাচ্ছে এখন।

-মেহরাব যে বলল, ওর বন্ধুর সাথে লাঞ্চে যাচ্ছে?

-নাহ, বিজরীর সাথে যাচ্ছে। হয়ত তোমাকে বলতে লজ্জা পাচ্ছিল তাই বন্ধু বলেছে।

-আমার কাছে বলতে লজ্জা পেল!

-মেহরাব কি আর আমার মতো? আমার মতো হলে এতদিনে কাজী সমেত বরযাত্রী নিয়ে সোজা ওর বাসায় হাজির হয়ে বিয়ে করে বাসরঘরে ঢুকে পড়ত, কথাটা বলেই মাহাদী জিভ কাটল। বলতে বলতে এটা কী বলে ফেলল! মা কী ভাববে? কিন্তু মা কিছু বলল না। মায়ের নিরবতা দেখে বলল- মা কি হয়েছে? তুমি কী মেহরাবকে কিছু বলেছ? কত খুশি হয়ে তৈরি হচ্ছিল তোমার ফোন পেয়ে কেমন মনমরা হয়ে বসে আছে। জিজ্ঞেস করছি কিছু বলছেও না।

মেহেরুন্নেসা দীর্ঘশ্বাস ফেলল… কী করে বলবে এসব? ছেলেটা এত ভালো… ভুল চেপে রাখলে সেটা জমে থেকে পরিস্থিতি আরও ঘোলাটে করে ফেলে। তাই সে মাহাদীকে সবটা বলে ভুল স্বীকার করল। মাহাদী হতাশ হলো, কেন যে তার বোকাসোকা মা এত ভুল করে বসে… মাকে বোঝাল সে সব সামলে নেবে, চিন্তার কিছু নেই। তারপর ফোন রেখে মেহরাবের দিকে তাকায়, কেমন মায়া মায়া মুখ করে এখনও ওভাবেই বসে আছে গাছের মতন। ভাইয়ের পাশে বসে বলল- কিরে এত কী ভাবিস? মা বলেছে তোর জন্য স্পেশাল দোয়া করবে। বিজরী “হ্যাঁ” না বলে আর কোন কথাই বলতে পারবে না। মেহরাব তখনও কিছু বলল না। মাহাদী তখন বলল- মা’র কথায় মন খারাপ করিস না। মা আসলে অত কিছু ভেবে বলেনি, সে নিজেও তার ছেলের জন্য চিন্তিত। সন্তানের ভালো চাওয়া ছাড়া মায়েদের ২য় কোন অপশন থাকে না। মা নেগেটিভ সেন্স থেকে কিছু বলেনি, তবু তুই কষ্ট পেয়েছিস সেটা দেখে সে খুব লজ্জিত… কষ্টও পাচ্ছে। মেহরাব একটা দীর্ঘশ্বাস বের করে দিয়ে লম্বা দম নিল। তারপর মাকে ফোন দিয়ে বলল-

-মা, বিজরীর সাথে দেখা করতে যাচ্ছি। তুমি দোয়া করে দাও।

মেহেরুন্নেসা নিঃশব্দে কেঁদে ফেললেন। বললেন- “আল্লাহপাক আমার ছেলের সকল ইচ্ছা পূরণ করুক, আমার ছেলেকে বিজরীর সাথে এত সুখে রাখুক যেন তারা দুজনই তাদের অতীত কষ্ট ভুলে যায়। ওদের দুজনকে রহমত আর বরকতময় করুক। আমিন।”

মেহরাব মায়ের সাথে কথা বলে ফোন রাখতেই ফারজানা ঘরে ঢুকল। বলল- কিরে তোর হলো? আর কত সাজবি?

মাহাদী বলল- বলে কী! আমরা ছেলেরা তৈরি হতে ম্যাগী নুডুলসের মতো মাত্র দুই মিনিট সময় নেই। হাতের কাছে যা পাই পরে বের হয়ে যাই। তরকারির ঝোলের হলুদ দাগওয়ালা পাঞ্জাবী পর্যন্ত কোনো সমস্যা করে না। আর মেয়েরা? মাই গড, তাদের তো একটা ড্রেস সিলেক্ট করতেই কয়েক দিন চলে যায়। কোনো পার্টির বিষয় থাকলে তার প্রিপারেশন কতকাল ধরে চলতে থাকে তার কোন হদিসই থাকে না।

ফারজানা হেসে বলল- আমরা মেয়েরা জান্নাতের সৌন্দর্য আর নেয়ামত ভোগ করা লোক, তাই আমাদের এত অল্পতে চলে না ভাই সেটা বুঝতে হবে।

-হুম, আর আমরা ছেলেরা পয়দা হই আফ্রিকার জঙ্গলে, জিঙ্গালালা কিংচুক কিংচুক পরিবারে। আমাদের তো সারা গায়ে চুন কালির রূপ সজ্জা করাই থাকে। তৈরি হবার দরকার কী?

ফারজানা হেসে বলল- হুম সে তো বটেই। এমন সময় ফাতেমা এসে বলল- মেহরাব আম্মা তোকে ডাকছে, শুনে আয়।

সাজেদা মাত্র নামাজ শেষ করেছে, এখনও জায়নামাজেই বসা। মেহরাব বলল-

-আম্মা ডেকেছ?

সাজেদা দোয়া পড়ছিল তাই ইশারায় কাছে এসে বসতে বলল। মেহরাব মায়ের পাশে গিয়ে বসলে সাজেদা তার মাথায় হাত রেখে দোয়া পড়ে ফু দিয়ে মাথা থেকে সারা গায়ে হাত বুলিয়ে দেন। আম্মা সব সময় এই কাজটা করে। আর বিশেষ সময়ে আলাদা করে দোয়া দিয়ে দেন। মেহরাবের তখন খুব শান্তি লাগে, নির্ভার হয়ে সেই কাজে যেতে পারে।

দোয়া শেষে সাজেদা বলল- বিজরীর সাথে মন খুইলা কথা বইল। তারে রাজি কইরা তাড়াতাড়ি ফিরবা। আমি আজকেই তোমার বিয়ের দিন তারিখ পাকা করার ব্যবস্থা করব, ইনশাআল্লাহ। যাও, এইবার আল্লাহর নাম নিয়া বাইর হউ।

মেহরাব খেয়াল করল এইটুকু কথা বলেই মা কেমন হাপিয়ে যাচ্ছে! আম্মার শরীর কী ভয়াবহ দুর্বল হয়ে গেছে… সে অস্থির গলায় বলল- মা তোমার কী শরীর বেশি খারাপ লাগছে?

-শরীর তো এই ভালো এই খারাপ লাগে।

-তোমাকে ভালো দেখাচ্ছে না, শরীর বেশি খারাপ লাগছে মনে হচ্ছে। চলো ডাক্তারের কাছে যাই?

-আরে বাবারে এত চিন্তা করো কেন? আমি ভালোই আছি। আচ্ছা বেশি খারাপ লাগলে সন্ধ্যায় নিয়া যাইয়ো ডাক্তারের কাছে। এখন যাও আর দেরি কইরো না।

-ঠিক আছে, বেশি খারাপ লাগলে ফোন দিও আমি চলে আসব। বলে মেহরাব বের হয়ে ফাতেমার ঘরে গিয়ে বলল- বুবু আম্মার শরীরটা মনে হলো ভালো না?

-আজ সকাল থেকেই কেমন যেন একটু অস্থির অস্থির দেখাচ্ছে।

-আগে বলিসনি কেন?

-আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম বলল, এমনি কিছু না। খারাপ লাগলে বলবে ডাক্তারের কাছে নিতে।

-আমি তাহলে আম্মাকে নিয়ে যাই আর বিজরীকে বলে দেই আগামীকাল দেখা করতে।

-কী বলিস এসব? তুই যা, এদিকে আমরা সবাই আছি। আম্মাকে আমি দেখে রাখব তেমন হলে তোকে খবর দিব। এত টেনশন নিস না। তোর ব্যাপারটাও তো সিরিয়াস তাই না?

মেহরাবের মন সায় দিচ্ছিল না কেন যেন.. তবু বুবুর কথায় সে পা বাড়ালো। যখন বের হচ্ছিল তখন তার বড় দুলাভাই সাগর এসে বলল-

-বের হচ্ছ নাকি? পকেটে করে এটা নিয়ে যাও।

-কী এটা?

-ব্লেড, সোয়ান ব্র‍্যান্ডের ব্লেড। খুব ভালো কাজ করে।

-এটা দিয়ে কী হবে?

-বিজরী রাজি না হলে এটা বের করে হাতের কব্জি কেটে ফেলবে, ব্যাস… বিজরী তখন শাবানার মত শাড়ির আঁচল ছিঁড়ে নাকের পানি চোখের পানিতে একাকার হয়ে তোমার হাত বেঁধে দিতে দিতে বলবে, “নাটক বন্ধ করো। কাজী ডাকো, এক্ষুণি বিয়ে হবে, কুইক।”

মেহরাব বিস্ময়ের সাথে বলল- মানে কী?

তখন পাশ থেকে মিরাজ বলল- তুমি একদম টেনশন নেবে না। আমরা রেস্টুরেন্টের বাইরেই থাকব। বিজরী রাজি না হলে জাস্ট আমাদের একটা ম্যাসেজ করে দিবে। মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে রাজি করিয়ে নিয়ে আসব। অল প্রিপারেশনস ডান। বলে সে পকেট থেকে পিস্তল বের করে দেখাল।

-এটা যে ফারাবি ফাইয়াজের খেলনা পিস্তল সেটা তো বিজরী জানেই না, তাই না?

-সমস্যা নেই ফারজানার নেইল পলিশ দিয়ে এটার কালার চেঞ্জ করে নেব।

মেহরাব হতাশ গলায় বলল- নেইল পলিশ! সিরিয়াসলি? প্লিজ, আপনারা কেউ আমার সাথে যাবেন না। রেস্টুরেন্টের বাইরেও না। আমি একা যাব, ওকে?

মাহাদী বিমর্ষ গলায় বলল- সব এগিয়ে গুছিয়ে দিব আমরা আর ফাইনাল লুক শুধু চান্দু তুমি একা দেখবা? যাও দেখো, আমাদের আর কী…

-তোমার আবার হঠাৎ কী হলো? এমন মুষড়ে পড়া চেহারা দেখাচ্ছে কেন?

-মুষড়ে পড়া চেহারা হুহ, আরে এখনও যে বেঁচে বর্তে দাঁড়িয়ে আছি সেটার শোকর কর।

-নাটক না করে কী হয়েছে সেটা বলো?

-তোর ভাবি আমার সাথে ব্রেকাপ করেছে।

-ব্রেকাপ! মানে কী?

-মানে আবার কী? বিয়ে তো করিসনি তাই জানিস না কিছু। আজ সকাল থেকে একবারও ফোন দেইনি তাই একটু আগে ফোন দিতেই শীতল গলায় বলল- “তুমি তোমার সুখের জীবন যাপন করো। অযথা আমাকে মনে করার ঝামেলা করতে হবে না।”

মেহরাব হেসে বলল- এবার বুঝলাম রাগ ভাঙাবার এত আইডিয়া তুমি কোথায় পাও? ঠিক আছে তুমি আপাতত কিছুক্ষণ সুখের সিঙ্গেল লাইফ যাপন করো। আমি ঘুরে আসি।

সাগর বলল- তুমি একা যাবে এটা অন্যায়। আর মিরাজ বলল- উহু, এটা মহা অন্যায়। মাহাদী তখন দুই ভায়রা ভাইকে বলল-

-ডোন্ট ওয়ারি ব্রাদার্স, আমরা অবশ্যই যাব। পৃথিবীর কোনো শক্তি আমাদের আটকাতে পারবে না। মিরাজ ভাই আপনার বাইকটা বের করুন।

চলবে…