#পরিযায়ী_জীবন (পর্ব – ১৫)
একটু ভালো লাগতেই সাজেদা বাড়ি ফিরতে অস্থির হয়ে গেল। তিনি আসলে বুঝে গেছেন হাতে একদমই সময় নেই। জীবন-মৃত্যুর খুব কাছাকাছি অবস্থান করছেন তিনি। শেষ মুহূর্তে ছেলে-মেয়েদের সব কিছু গুছিয়ে দিয়ে যেতে হবে। ডাক্তারও বলে দিল, ওনার এখন যেভাবে ভালো লাগে যা ভালো লাগে আপনারা তাই করুন। হাসপাতালের চাইতে বাড়িতেই সময় ভালো কাটবে। সেদিনই হাসপাতাল সাজেদাকে ছেড়ে দিল। বাড়ি এসে সাজেদা কিছুটা স্বস্তি পেলেন।
বিজরীকে দুটো দিন সময় দেয়া হয়েছিল সেই সময় শেষ হতে আর কয়েক মুহূর্তই বাকি কিন্তু এখনও সে কিছু জানাল না! অবশ্য পরিস্থিতিও অনেকটা বেসামাল ছিল। মেহরাবের বুকে কাঁপন ধরল… যদি সব কিছু এমন বেসামালই থেকে যায়? বিজরী যদি “হ্যাঁ” না বলে? না, এটা মেনে নেয়া সম্ভব নয়। নিয়তি তাদের ২য়বার সুযোগ দিয়েছে যা কেবল সৌভাগ্যক্রমেই পাওয়া যায় এ সুযোগ হারালে তাদের হয়ত বাকি জীবন দূর্ভাগার বেশে আফসোস করেই কাটাতে হবে কিন্তু তখন আর করার কিছুই থাকবে না। তাকে কিছু একটা করতে হবে এবং সেটা সিরিয়াস কিছু। সে সারা বিকেল একা কাটিয়ে সন্ধ্যায় বাড়ি এসে দেখে বিজরীর মা-বাবা এসেছে। বুঝতে পারল তারা আম্মাকে দেখতে এসেছেন। সে তাদের সালাম দিয়ে টুকটাক কথা বলে নিজের ঘরে চলে যায়। ঘরে ঢুকে কী মনে করে আবার বের হচ্ছিল। ফারজানা আয়রাকে খাওয়াচ্ছিল, ওকে বের হতে দেখে বলল-
-কিরে কোথায় যাচ্ছিস আবার?
-এইতো আসছি। বলেই সে না দাঁড়িয়ে বের হয়ে গেল। সে সোজা বিজরীদের বাসায় গিয়ে বেল চাপল। বিজরী দরজা খুলে ওকে দেখে অবাক হয়ে বলল- আপনি?
মেহরাব তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল- “আপনি?” ভেতরে যেতে দাও।
-বাসায় কেউ নেই।
-তো? ভয় পাচ্ছো? এতটা অবিশ্বাস এটাও দেখতে হবে?
-কী হচ্ছে এসব? আমি ওসব কিছু মিন করিনি।
-কীভাবে বুঝব মিন করোনি?
বিজরী দরজা ছেড়ে দেয়। মেহরাব ভেতরে ঢুকেই দরজা বন্ধ করে দিয়ে ওর সামনে একদম কাছে প্রায় গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে বলে- বাসায় কেউ নেই সেটা আমি জেনেই এসেছি। এবার?
-বিজরী কিছু বলল না, ওর চোখের দিকে তাকিয়ে অসাড়ের মতো দাঁড়িয়ে রইল। এই মুহূর্তে মেহরাবের চোখে তীব্র জিঘাংসা দেখতে পাচ্ছে সে! অনেক প্রশ্ন তাকে বিদ্ধ করতে চাইছে যার কোনটারই জবাব দেবার সাধ্য তার নেই… সে ধীরে এক পা পিছিয়ে গেল। মেহরাব সাথে সাথে দৃঢ় পায়ে এগিয়ে গেল ওর দিকে। বিজরী এবার আর পেছাল না শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল। তার হৃদপিন্ডের গতি বেড়ে গেছে। কী চাইছে ও? মেহরাবের অন্তর্ভেদী দৃষ্টি তার অন্তরাত্মাকে কাঁপিয়ে দিচ্ছে ভীষণভাবে। মেহরাব তার এত কাছে দাঁড়িয়ে যে, ওর তপ্ত নিঃশ্বাস এসে মুখে বারি খাচ্ছে। একটু নড়লেই গায়ে গায়ে ধাক্কা লেগে যাবে। মেহরাব বিজরীর মুখের কাছে ঝুকে পড়ল… বিজরী তখন চোখ বন্ধ করে ফেলল।
১০ সেকেন্ড পর মেহরাব সরে গিয়ে ক্লান্ত গলায় বলল- তোমার এত কাছে যাবার পরও তুমি দৃঢ়ভাবে অনড় রইলে, যার প্রতি এত বিশ্বাস তাকেই তুমি ভরসা করতে পারো না! এই হিসেবটাই আমি মেলাতে পারি না। তোমাকে দুদিনের সময় দেয়া হয়েছিল, আমি আমার সাধ্যমতো তোমাকে বোঝাবার চেষ্টা করেছি। তুমি অনড় রইলে! আমি আশাই করিনি এমনটা হতে পারে। আমার কাছে সব কিছুই কেমন দুঃস্বপ্ন লাগে আজকাল। কোনো কিছুই যেন ভালো নেই, ভালো হচ্ছে না। আমার জীবন বোধহয় কেবলই অপ্রাপ্তি দিয়ে সাজানো হয়েছে! আমি মানুষটাই হয়ত ভালো না… ধরা গলায় কথাগুলো বলে মেহরাব চুপ হয়ে গেল। হয়ত নিজেকে শান্ত করতে চাইছে… বিজরী তখনও চুপ! মেহরাব তখন শান্ত গলায় বলল- যাই হোক তুমি তোমার মত ভালো থাকো। এই মেহরাব বা তার পরিবারের কেউ আর কখনও তোমাকে বিরক্ত করবে না, নিশ্চিন্ত থাকো। শেষ একটা কথা বলে যাই…
বিজরী তখনও চুপ। তবে তার ভেতরটা ভেঙে চুরমার হয়ে যাচ্ছে। মেহরাবকে এমন অসহায় সে কখনোই দেখতে চায়নি।
মেহরাব আচমকাই বিজরীর একটা হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে তার বুকের বা’পাশে চেপে ধরে। বিজরী ওর দিকে অসহায়ভাবে তাকিয়ে থাকে। মেহরাব চোখ ভর্তি পানি নিয়ে ধরা গলায় বলে- কিছু টের পাও? খুব যন্ত্রণা হয় এখানটায়… খুব…
পুরো এক মিনিট মেহরাব ওভাবেই দাঁড়িয়ে থেকে কাঁদে। তারপর চোখ মুছে দরজা খুলে বের হয়ে যায়। বিজরীর চোখ থেকে তখন শ্রাবণধারা নেমে আসে। সে আকুল হয়ে চিৎকার করে কাঁদতে থাকে। সে নিজেও তো ভেতরে ভেতরে পুড়ে অঙ্গার হয়ে যাচ্ছে। মেহরাব তার অর্ধ জীবন পার করে এসে নিজের পরিবার পেয়েছে। এই আনন্দময় অধ্যায়ে সে চায় না মেহরাবের জীবনে নিজেকে ঝামেলা হিসেবে যুক্ত করতে। জোর করে সম্পর্ক গড়ার ভয়াবহতা সে জানে। মেহরাবের সাথে জড়ালে মেহরুন্নেসার কারণে হয়ত আবার সেই ভয়াবহতা তাকে দেখতে হবে। এই ভয়টাই তাকে সারাক্ষণ কুরে কুরে খায়। সে এতটাই ভীত থাকে যে মেহরাবের তীব্র ভালোবাসাও একে উতরে যেতে পারে না। কিন্তু এভাবে ভেঙেচুরে বেঁচে থাকাটাও তার পক্ষে আর সম্ভব হচ্ছে না। তার চেয়েও বড় কথা- ওই মানুষটাকেও সে এভাবে আর সহ্য করতে পারবে না। যে যা খুশি ভাবুক আর বলুক তার কিচ্ছু যায় আসে না। সে শুধু এখন এই মানুষটার কথাই ভাববে। কষ্ট যদি পেতেও হয় তার পাশে থেকেই পাবে। তবু দিন শেষে মানুষটা তো তার থাকবে।
বিজরী বিয়েতে রাজি হয়েছে শুনেই সবাই বিয়ের আয়োজন করতে শুরু করে দেয়। প্রস্তুতির জন্য মাঝে একটা দিন হাতে নিতে চাইলে সাজেদা মানা করেন। তার হাতে সময় নেই, যত দ্রুত সম্ভব তিনি বিয়েটা দেখতে চান। ছেলে আর ছেলের বউ নিয়ে যদি এক মুহুর্ত সময়ও বেশি কাটানো যায় তিনি সেটাই চান। তার কথা ভেবে পরদিন রাতে বিয়ে ঠিক করা হয়। হাসান সাহেব পুরো পরিবার নিয়ে বিয়ের দিন সকাল সকাল চলে এসেছেন। খুব ছোট পরিসরে বিয়ের আয়োজন হচ্ছে। শুধু ৩পরিবারের উপস্থিতিতে কাজী ডেকে একেবারেই ঘরোয়া ভাবে বিয়ে পড়ানো হবে। সাজেদা সুস্থ থাকলে কখনোই এভাবে ছেলের বিয়ে দিতেন না। ছেলের বিয়ের আয়োজন নিয়ে তিনি কত স্বপ্ন দেখেছেন… সেগুলো কেমন স্বপ্নই রয়ে গেল! ছেলেটা তার জীবনকে পূর্ণ করেছে অথচ তার নিজের অসুস্থতার কারণে ছেলের বিয়েটা এমন সাদামাটা করে দিতে হচ্ছে। বিয়ের ভাবনা ছেড়ে সারাক্ষণ মায়ের কী লাগবে, কেমন লাগছে সেই ভাবনায় ছেলে অস্থির। সারাক্ষণ মায়ের সাথে আঠার মত লেগে থাকছে। তার কষ্ট হয়, ছেলেটা এত ভালো… তিনি মন ভরে ছেলের জন্য দোয়া করেন।
ছেলের এমন সাদামাটা বিয়ে নিয়ে মেহেরুন্নেসারও আক্ষেপের শেষ নেই। তার উপর তার নিজের ছেলের বিয়ে অথচ সব কিছু হচ্ছে সাজেদার কথা ভেবে! এটা তাকে ভেতরে ভেতরে খুব যন্ত্রণা দিচ্ছিল। কিন্তু কাউকে কিছু বলতেও পারছিলেন না। পরিস্থিতি এখন সাজেদার অনুকূলে, এ বিষয়ে কিছু বললে তিনি নিজেই খারাপ হয়ে যাবেন। তাই চুপচাপ বিয়ের আয়োজনে সংযুক্ত হলেন। তিনি চেয়েছিলেন খুব আয়োজন করে সকলকে জানিয়ে ছেলের বিয়ে দেবেন। কিন্তু সেটা সম্ভব না হলেও তিনি যথাসাধ্য চেষ্টা করলেন। তার বড় ছেলে কে কী করবে সেই সব কাজ গুছিয়ে বুঝিয়ে দিল সবাইকে। দুই ছেলের বউকে কেনাকাটার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। ছেলেরা বাকিটা সামলে নিচ্ছে। অবশ্য মেহরাবের দুই দুলাভাইও যথেষ্ট করছেন। এতগুলো মানুষের খাবারের দায়িত্ব ফাতেমা আর ফারজানা নিয়ে নিয়েছে। মেহেরুন্নেসা তাদের সাথে হাত লাগাচ্ছেন, যদিও দুই বোন তাকে কিছুই করতে দিতে চাইছে না তবু তিনি করছেন। ৩ বেলা এত মানুষের খাবারের আয়োজন করা তো আর চাট্টিখানি কথা নয়। তাছাড়া তার নিজের ছেলের বিয়ে হাত পা গুটিয়ে বসে থাকলে তো চলবে না। তবে রান্নার কাজে সাহায্যের জন্য মেহেরুন্নেসা ফাতেমাকে বলে একজন লোক ঠিক করিয়ে নিলেন। হাসান সাহেব এই ছোট্ট আয়োজনটা স্মরণীয় করতে খরচের ব্যাপারে কোনো কার্পণ্য করছেন না। যদিও খরচের তেমন বিষয় নেই তবু যেখানে খরচ হবার সেখানে ভালো ভাবেই করছেন। অবশ্য তাকে বিশেষ কিছু করতেও হচ্ছে না। তার দুই ছেলে মেহরাবের দুই বোন সবাই মিলে মেহরাবের জন্য সাধ্যের সবটুকু করছে। সবাইকে একসাথে এত স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে কাজ করতে দেখে হাসান সাহেবের আনন্দে মন ভরে যাচ্ছে, চোখ ভিজে যাচ্ছে। নিশ্চই তিনি আল্লাহপাকের অতি পছন্দের বান্দা নয়ত এত ভালোবাসাময় পরিবার তার জন্য কেন থাকবে? তিনি চোখ বন্ধ করে শুকরিয়া আদায় করেন।
ওদিকে বিজরীর ভাই দেশের বাহিরে। তার পক্ষে তো এভাবে বিয়েতে আসা সম্ভব নয়। অবশ্য সময় থাকলেও সে আসত কিনা কে জানে! জাকারিয়া সাহেব ছেলেকে বিজরীর বিয়ের কথা ফোনে জানালেন। শত হোক একটা মাত্র বোন তাই বিয়েতে উপস্থিত হতে না পারলেও বোনের জন্য গিফট হিসেবে কিছু টাকা পাঠিয়ে দিয়েছে বিজরী যেন নিজের পছন্দমতো কিছু কিনে নেয়। সাথে বিয়েতে খরচের জন্যও আলাদা করে কিছু টাকা দিয়েছে। জাকারিয়া সাহেব একা হওয়ায় সাগর আর মিরাজ মিলে তার দিকটা সামাল দিচ্ছে। মাহাদী বলে গেছে, দুই পক্ষেরই তো বাড়ির ছোট সন্তানের বিয়ে, তাই বিয়ে বাড়িতে যে আলাদা একটু আনন্দ হবে সেই সুযোগ তো এখানে দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু একটা বিয়ে হবে আর সেখানে কোনো আনন্দ থাকবে না তাই হয় নাকি? তাই সে বাড়ির সকল বাচ্চা ভয়ংকরকে কোনে পক্ষের বানিয়ে দিল। ফারাবি, ফাইয়াজ, আয়রা সেই সাথে মেহরাবের বড় ভাইয়ের ৭ বছর বয়সী মেয়ে টুসী হয়ে গেল কোনে পক্ষ। কোনে পক্ষ হিসেবে বাচ্চাদের কী কী করতে হবে তা মাহাদী আর কেয়া মিলে শিখিয়ে দিল। তারা ভীষণ রকম এক্সাইটেড কারণ তারা আজ কোনে পক্ষ তাদের উপর অনেক বড় বড় দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তাদের চলনে আর কথাবার্তায় এখন ভারিক্কি ভাব স্পষ্ট!
গত সন্ধ্যায় বিজরীর সাথে কথা বলে আসার পর মেহরাব আর যোগাযোগ করেনি ওর সাথে। বিজরী খুব চেয়েছিল মেহরাব অন্তত একটা ফোন করুক একটু কথা বলে মনটাকে শান্ত করে নেবে, কিন্তু করেনি। বিজরী নিজে লজ্জা আর সংকোচের কারণে ফোন দিতে পারছে না। অথচ মেহরাবের সাথে কথা বলার জন্য সে ভেতরে ভেতরে মরমে মরে যাচ্ছে। সারাক্ষণ ফোন হাতে নিয়ে থাকছে। তার ইচ্ছে হচ্ছে সেই আগের বিজরী হয়ে যেতে, দুষ্টু, চঞ্চল আর সাহসী বিজরী, মেহরাবের প্রজাপতি বিজরী। কিন্তু দিন পেরিয়ে সন্ধ্যা নেমে এলেও মেহরাবের কোনো ফোন এলো না! কী হলো তার?
চলবে…