#পরিযায়ী_জীবন (পর্ব – ১৬)
সন্ধ্যায় সবাই তৈরি হয়ে বরযাত্রার উদ্দেশ্যে যখন বের হচ্ছিল তখন মাহাদী বলল-
-আমরা কী হেঁটে হেঁটেই বরযাত্রী যাব?
মাহাবুব বলল- তো কীভাবে যাবি, ট্রেনে চড়ে?
মাহাদী হেসে বলল- নাহ্, ওটা এখানে এক্সপেক্ট করছি না। তারপর মেহরাবের দিকে তাকিয়ে বলল- তুই এমন জায়গায় বিয়ে করছিস যে গাড়িতে চড়ে বরযাত্রী নিয়ে হৈ হৈ করতে করতে যাব সে সুযোগ নেই। মিরাজ ভাই আপনি এক কাজ করুন, আপনার বাইকে কয়েকটা বেলুন লাগিয়ে নিয়ে আসুন। মেহরাব উঠুক আমরা ৪জন ঠেলে ঠেলে নিয়ে যাই?
মাহাদীর কথায় সবাই হেসে উঠল। মিরাজ বলল- আমার বাইক লাগবে কেন, মেহরাবের সখের গাড়িটা নিলেই তো পারি?
-ভাই, বাইক যত সহজে ঠেলা যায় গাড়ি কী তত সহজে ঠেলা যাবে? তাছাড়া এমন সেজেগুজে গাড়ি ঠেলাঠেলির বিষয়টা দৃষ্টিকটু লাগবে না?
সাগর বলল- মেহরাব তোমার কী ইচ্ছে?
মেহরাব নির্বিকার গলায় বলল- বজরায় চড়ে যাওয়ার ইচ্ছে।
মাহাদী চোখেমুখে বিস্ময়ভাব ফুটিয়ে বলল- এর উপর তো রবীন্দ্রনাথের আত্মা ভর করেছেরে! বিয়ের আগেই রবীন্দ্রনাথ ভর করেছে বিয়ে হয়ে গেলে তো- সক্রেটিস, মাইকেল মধুসূদন, কাজী নজরুল, পল্লী কবি জসিম উদ্দিন, গাব্বার সিং সবাই ভর করবে!
পাশ থেকে কেয়া বিরক্ত গলায় বলল- কবি সাহিত্যিকের মধ্যে গাব্বার সিং আসল কীভাবে? আর গাব্বার সিং এর আত্মা ভর করলে সবার আগে তোমার বকবক করতে থাকা মুখটা চিরতরে শাট ডাউন করে দিবে। চলো এবার দেরি হয়ে যাচ্ছে।
মাহাদী বিড়বিড় করে বলল- ভালো কথাও আজকাল বলা দোষের! হায়রে দুনিয়া…
সবাই বিজরীদের বাড়িতে ঢুকে সিঁড়ির কাছে আসতেই দেখল সেখানে কোনে পক্ষের বাচ্চা বাহিনী দাঁড়িয়ে আছে ফিতা ধরে। ফিতা আবার দুইটা বাঁধতে হয়েছে একটা তাদের সাইজ অনুযায়ী আর একটা বরযাত্রীর সাইজ অনুযায়ী। মাহাদী ওদের দেখেই বলল- হাই লিলিপুট কোনে পক্ষ।
টুসী বলল- হ্যালো গালিভার বরপক্ষ।
মাহাদী বলল- ফিতা কাটার কাঁচি কোথায়?
ফারাবি বলল- আছে। আগে টাকা দিতে হবে।
-এহ টাকা দিতে হবে। কোনো মিষ্টি নাই, শরবত নাই কিসের টাকা?
টুসী তখন চেঁচিয়ে চোখমুখ গোল করে বলল- সব আছে। আগে টাকা দাও।
-টাকা নিয়ে যদি পালিয়ে যাস তখন? হবে না হবে না, আগে আপ্যায়ন চাই।
-বললাম তো সব আছে কিন্তু লুকিয়ে রেখেছি। এই ফারাবি ফাইয়াজের জন্য কিছুই রাখতে পারি না। ওরা শুধু খেয়ে ফেলে।
ফারাবিও সমান তেজে বলল- আমি কখন খেলাম ফাইয়াজই তো মিষ্টি খাচ্ছিল।
ফাইয়াজ আর চুপ থাকবে কেন? সেও সপাটে জবাব দিল আর তুমি যে শরবত খাচ্ছিলে সেটা আমি দেখিনি ভেবেছ?
বরপক্ষের সবাই হেসে অস্থির হচ্ছে। মাহাদী বলল- এই তোরা তোদের ঝগড়া তোদের ঘরে গিয়ে কর। আমাদের আগে যেতে দে। জামাই পাগল হয়ে যাচ্ছে কিন্তু বিয়ের জন্য।
কেয়া পাশ থেকে ওকে চিমটি কেটে বলল- বাচ্চাদের সামনে কী হচ্ছে এসব?
মিরাজ তখন পেছন থেকে বলল- কিন্তু কোনে পক্ষের কনিষ্ঠ সদস্য আমার আয়রা মা কোথায়?
টুসী বলল- ওকে ফুল ছেঁড়ার কাজ দিয়েছি। দুহাতে কী সুন্দর করে ফুল ছেঁড়ে! না দেখলে বুঝতেই পারবে না। শুধু একটাই সমস্যা ফুল ছিঁড়েই মুখে দিয়ে ফেলে! বোঝাতেই পারি না ওটা খাওয়া যাবে না। ছেঁড়া হলেই নানু ওকে নিচে নিয়ে আসবে।
মাহাবুব তখন বলল- আচ্ছা ঠিক আছে আমরা বুঝতে পেরেছি তোমরা অনেক কিছু করেছ এখন আমাদের ভেতরে যাবার জন্য কী করতে হবে সেটা বলো?
ওরা ৩জন একসাথে বুকে হাত বেঁধে বলল- টাকা লাগবে।
মাহাদী ওদের জনপ্রতি ১টা করে ১০টাকার নোট দিয়ে বলল- এইবার কাঁচি দাও?
ফারাবি বলল- কিন্তু আয়রা বুড়িরটা কোথায়?
সাগর হেসে বলল- সাবাস ব্যাটা। মাহাদী তখন আরেকটা নোট বের করে ওদের হাতে দিয়ে বলল- নে ধর, এখনই হিসেব শিখে সেয়ানা হয়ে গেছিস একেবারে।
বাচ্চা মানুষ কেউই টাকা চেনে না তাই ১০টাকা পেয়েই ৩জন লাফাতে লাগল- “ইয়ে… পেয়ে গেছি পেয়ে গেছি” বলে। তখন উপর থেকে জাকারিয়া সাহেব আয়রাকে কোলে নিয়ে নিচে এসে বলল-
-কী পেয়ে গেছে আমার নানা ভাইয়েরা?
ওরা ৩জন তখন একসাথে চেঁচিয়ে বলল- টাকা পেয়ে গেছি নানু ভাই। আয়রারটাও নিয়েছি এই যে।
জাকারিয়া সাহেব টাকা দেখে বলল- এসব কী! আমার নাতি নাতনিদের সঙ্গে এত বড় জোচ্চুরি! বাচ্চারা অবাক হয়ে বলল- কী হয়েছে নানাভাই?
-ওরা তোদের ঠকিয়েছে। ছোট ছোট টাকা দিয়েছে। তোরা বড় হয়েছিস না? কোনে পক্ষ হয়েছিস এইসব ছোট টাকায় কাজ হবে?
ফাইয়াজ নিজের নোট উল্টে পাল্টে দেখে বলল- সত্যি?
জাকারিয়া সাহেব ওদের পাশে দাঁড়িয়ে বলল- বরপক্ষকে বলে দাও এসব চিটিং চলবে না। ১০ হাজার না হলে এই গেট খুলবে না। বাচ্চারা সাথে সাথে সেটা বলে চেঁচাতে লাগল।
মাহাদী ধমকের সুরে বলল- এই লিলিপুটের দল একদম চুপ। তোরা নিজেরা পারিস না কিছুনা আবার নানাভাইকে ভাড়া করে এনেছিস। এখানে কোনো নানা এলাউ না। চিটিংবাজের দল।
জাকারিয়া সাহেব বললেন- কিসের এলাউ না? আমিও ওদের দলের। এদের বাচ্চা পেয়ে ঠকাবে তা হবে না। এই তোরা কেউ এক টাকা কমেও গেট ছাড়বি না।
মেহরাবের বাবা মুচকি হেসে বলল- কোনের বাবা এসে গেটের টাকা চাইছে এমন অভাবনীয় ঘটনা এই প্রথম দেখলাম!
জাকারিয়া সাহেব বললেন- আর বিশাল এক গালিভার বাহিনী ৪জন লিলিপুটের সাথে যে চিটিং করে জিততে চায় সেটাও আমি প্রথম দেখলাম। আর কোনের বাবা বাবার জায়গায় আছে, কিন্তু এই লিলিপুট বাহিনীর সাথেও আমি আছি। আমরা ভাই বোনেরা সব এক গোত্র।
মাহবুব বলল- ঠিক আছে আংকেল ৫০০০ দিচ্ছি।
-এহ, ডাক্তার জামাই আবার বিয়ে করতে এসে আমার নাতি নাতনিদের ৫০০০ টাকা দিতে চায়। ১০ হাজারের এক পয়সাও কম হবে না।
মাহাদীর বড় ভাবি তখন ব্যাগ থেকে এক বক্স চকলেট বের করে বাচ্চাদের সামনে ধরে শুনিয়ে শুনিয়ে মাহাদীকে বলল- এই মাহাদী আমি তো ভেবেছিলাম ৫ হাজারেই ওরা ঢুকতে দিবে তখন এই চকলেট গুলো ওদের দিব। কিন্তু ওরা যেহেতু ১০ হাজার চাচ্ছে আমরাই তাহলে এগুলো খেয়ে ফেলি?
বাচ্চারা চেঁচিয়ে বলল- নাআয়ায়া… আমরা খাবো। আমরা ৫ হাজারেই রাজি, রাজি।
ফারজানা বলল- বাহ্, দারুণ দেখালেন ভাবি।
ওদিকে জাকারিয়া সাহেব বাচ্চাগুলোকে ধমকাতে লাগলেন- যাহ ছোচার দল, দিলি তো সব নষ্ট করে। এরপরে আমি আর তোদের কোনো সাহায্য করব না। মাহাদী মেহরাবকে কানে কানে বলল- তোর কপাল ভালো যে কোনো শালা-শালী নাই। তাহলে ৫০ হাজারেও গেট পার হতে পারতি কিনা কে জানে! বাচ্চাগুলাকে কোনে পক্ষ বানিয়েছিলাম যাতে ১০/২০ টাকায় সব কিছুতে পার পেয়ে যাই কিন্তু যা একটা শ্বশুর হয়েছে তোর! দেখ এরপর কী করে?
অতঃপর জামাই বরণ করে উপরে নিয়ে যাওয়া হলো। যথা স্থানে মেহরাব বসার সাথে সাথেই বাচ্চারা দৌড়ে এসে বলল- মামা তোমার জুতো কোথায়?
-কেন?
-চুরি করব।
-বলে বলে কেউ চুরি করে?
টুসী বলল- মা বলেছে, না বলে কারো জিনিস ধরতে হয় না নিতেও হয় না। ফারাবি ফাইয়াজও সেইম কথা বলল। তখন পেছন থেকে জাকারিয়া সাহেব দেখলেন অবস্থা তো বেগতিক! তার এই ভদ্র কোনে পক্ষ দিয়ে কোন কিছুই করানো যাবে না, তাকেই যুদ্ধময়দানে নেমে বসে থাকতে হবে। তিনি তখন টুসীকে ডেকে কী যেন কানে কানে বলল- টুসী তখন ফারাবির কাছে সেটা শেয়ার করল। এর একটু পরে ফাইয়াজ এসে মাহাদীকে বলল- মামা, তোমাকে ডাকছে?
-কে ডাকছে?
-মামী। তুমি নাকি কী এনে দাওনি মামী খুব রাগ করছে।
-কী এনে দেইনি?
-কী যেন বলল… ওই যে… আছে না…
-আরে কী?
-আরে মনে করে নেই দাঁড়াও। ওই যে… ও মনে পড়েছে, এইত্তেরি… কী জানি সেটা…
-ধ্যাৎ, আমিই দেখে আসছি। এখানকার কিছু ধরবি না কিন্তু আমি যাব আর আসব।
মাহাদী উঠে যেতেই জাকারিয়া সাহেব বাচ্চাদের নিয়ে মাহাদীর রেখে যাওয়া একটা ব্যাগ হাতিয়ে নিল যেটায় মেহরাবের জুতা রাখা। জুতা পেয়ে তারা আবার হৈ হৈ করতে লাগল। মাহাদী ফিরে এসে এসব দেখে করুণ মুখে মেহরাবকে বলল- তোর জন্য আমার খুব মায়া হচ্ছেরে… এ কেমন শ্বশুর তোর? মেহরাব মুচকি হেসে বলে- ভালোই তো, শালা-শালীর অভাব পূরণ করে দিচ্ছে।
জুতার জন্য মেহরাবকে আরও দুই হাজার খরচ করতে হলো। সে গজগজ করে বলল- এটা নাকি আবার ঘরোয়া বিয়ে! তবে মজার ব্যাপার হলো, বাচ্চারা টাকা পেলেই বড় ভাবি সেগুলো নিয়ে নিজের বাটুয়ায় জমা করছে। সেটা দেখে মাহাদী বর পক্ষের কাছে টাকা গচ্ছিত রাখার দায়ে ওদের কাছ থেকে প্রতিবার ২০০ করে টাকা কাটছে। সেটা দেখে কেয়া ওকে চাপা গলায় মুখ ঝামটা দিয়ে যাচ্ছে কিন্তু তাতে কোনো লাভ হচ্ছে না।
রাত ১২টা নাগাদ বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা সেরে সবাই বউ নিয়ে বাসায় ফিরল। সাজেদা আর মেহেরুন্নেসা দুজন মিলেই পুত্রবধূ বরণ করে নেন। বধূবরণ আর ছোটখাটো রিচ্যুয়াল পালনে ঘন্টাখানেক সময় চলে যায়। মেহরাবদের বাড়িটা খুব বেশি বড় নয়। এত লোকের ঘুমোবার জন্য এত ঘর নেই। জাকারিয়া সাহেব বার বার বলে দিয়েছেন তার বাসায় অনেকগুলো ঘর ফাঁকা রয়েছে তারা যেন কষ্ট না করে এখানে এসে ঘুমায়। ফাতেমা বলে এসেছে প্রয়োজন হলে অবশ্যই আসবে। কিন্তু মাহাদী ঘোষণা করেছে আজ রাতে কেউ ঘুমাবে না। রাতের যেহেতু খুব বেশি বাকিও নেই তাই সবাই মিলে ছাদে বিছানা পেতে আড্ডা দেবে। আর ছাদে এত সুন্দর বাতাস যে কারো ঘুম পেলে ওখানেই ঘুমিয়ে নেবে। অবশেষে তাই হলো। বাচ্চাদের সাজেদার সাথে তার ঘরে ঘুম পাড়িয়ে দেয়া হলো। গেস্ট রুমে ফারজানা থাকত সেখানে হাসান সাহেব আর মেহেরুন্নেসার ঘুমানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। মেহরাব আর বিজরীকে মেহরাবের ঘরে পাঠিয়ে দিয়ে সবাই ছাদে চলে গেল। সবাই মিলে আড্ডা শুরু করতেই হাসান সাহেব বললেন-
-মাহাদী তুই বেয়ান সাহেবকে একটা ফোন দে। তারা দুজন বাসায় একা আছে মেয়েকে বিদায় নিয়ে নিশ্চই খারাপ লাগছে। আমরা যেহেতু পাশেই আছি আসতে বল তারাও আড্ডা দিক আমাদের সাথে।
-দুজন আবার একা হয় কীভাবে?
মাহাবুব ওর মাথায় একটা চাটি মেরে বলল- বেশি কথা না বলে ফোন দে।
-আরে কী ফোন দিব আমি? ওই যে আংকেল মনেহয় বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে আমি এখান থেকেই ডেকে নিচ্ছি। বলেই সে এগিয়ে গিয়ে চেঁচিয়ে বলল- আংকেল… কোথায় আপনি?
৩বার ডাকার পর জাকারিয়া সাহেব ভেতর থেকে বের হয়ে বারান্দায় এসে জবাব দিল- কী হলো?
-আমরা সবাই ছাদে আছি আপনারাও চলে আসুন, গল্প করব।
-না থাক বাবা, তোমরা গল্প করো। আমার খুব টায়ার্ড লাগছে।
-ঠিক আছে। কিন্তু ঘুম না এলে চলে আসবেন কোনো সমস্যা নেই। আমরা জেগেই আছি।
-ঠিক আছে। বলে জাকারিয়া সাহেব ভেতরে চলে গেলেন। ভেতরে গিয়ে তার স্ত্রীর পাশে বসলেন। বললেন-
-মেয়েটা এবার খুব ভালো থাকবে। ওদের সবাই অনেক আন্তরিক তাই না?
-হুম… কিন্তু এত বড় পরিবারে সবাই কী একসাথে আন্তরিক হয়? মেহরাবের মাকে আন্তরিক দেখালেও সেটাকে কেমন গায়ে চড়ানো আলগা লেবাস বলে মনে হলো!
-ও তোমার মনের ভুল। আগের ভয় থেকে মেয়েকে নিয়ে বেশি ভাবছ তো তাই এমন মনে হচ্ছে। এবার বিজরী অনেক ভালো থাকবে দেখো।
-ভালোই যেন হয় সব। ও ভালো থাকুক সেই দোয়াই তো করি।
এরপর দুজনের মধ্যে আর কথা হলো না তবে কেউ ঘুমালোও না। স্ত্রীর কথায় জাকারিয়া সাহেব ভেতরে ভেতরে চিন্তিত হয়ে পড়লেন। আবারও কী তিনি ভুল করলেন?
চলবে…