পরিযায়ী জীবন পর্ব-১৭ এবং শেষ পর্ব

0
20

#পরিযায়ী_জীবন (পর্ব -১৭/শেষ )

মেহরাব ঘরে ঢুকে দেখে বিজরী বিছানায় পা ঝুলিয়ে বসে আছে। তার চাহনি বলছে এই মুহূর্তে সে খুব আনন্দে আছে। মেয়েটা এমনিতেই চোখে লেগে থাকার মত মায়া সুন্দরী এখন বউ সাজে তাকে এমন লাগছে যে… নিজের ইমোশন কন্ট্রোল করা দায় হয়ে পড়ছে। এমন একটা মায়াবতী মেয়ে হয়েও ওর ভেতরটা কষ্টে কষ্টে কেমন ঝাঁজরা করে দিয়েছে! সে নিজেকে বোঝালো- “কন্ট্রোল ইউর সেল্ফ মেহরাব। একে কিছুক্ষণের জন্য হলেও বোঝাতে হবে নিজের মানুষটা দূরত্ব নিলে অন্তর কতটা দগ্ধ হয়!” সে দরজা বন্ধ করে মুখটা যথাসম্ভব গম্ভীর করে ঘরে ঢোকে। পরক্ষণেই বুঝতে পারে সে এখন কী করবে সেটাই বুঝতে পারছে না! কী করবে, কোথায় দাঁড়াবে, কোথায় বসবে, বসবে নাকি শুয়ে পড়বে, নাকি আগে ফ্রেস হতে যাবে কিছুই বুঝতে পারছে না। মনে হচ্ছে নিজের ঘরে নিজেই অতিথি। ধুর, সবার সাথে ছাদে কেন থাকল না? যাকগে… এটা তার নিজের ঘর, তার যা ইচ্ছে হবে করবে তাতে কারো কিছু বলার থাকবে কেন? তখন চোরাচোখে দেখল বিজরী ওর দিকেই তাকিয়ে আছে, তার দৃষ্টিতে কৌতুক ঠোঁটে দুষ্টু হাসি। মনে মনে বলল- দেখো, চিড়িয়াখানার গরিলা দেখার মতো কেমন ড্যাব ড্যাব করে দেখছে আমাকে! যেন এক কাঁধি কলা নিয়ে বসে আছে আমার জন্য এক্ষুণি ছুড়ে মারবে সেটা। দিব নাকি দুটো ধামকি মেরে?

বিজরী মেহরাবকে তীক্ষ্ণ চোখে খেয়াল করছিল। মেহরাবের হাবভাব দেখে বোঝাই যাচ্ছে সে কনফিউজড মুডে দোল খাচ্ছে। সবই জমানো অভিমানের কপট প্রতিচ্ছবি। মেহরাব কী করে বসে বসে সেটাই দেখবে নাকি সে নিজেই এগিয়ে যাবে ওর দিকে? এগিয়ে গেলে ও কী করবে তখন? ভাববে না মেয়েটার লজ্জা সংকোচ বলে কিছু নেই? ধুর… এ আমার ব্যক্তিগত পুরুষ, নিজের মানুষ এর কাছে আবার সংকোচ কিসের? তাছাড়া ওদের তো আর নিজেদের মধ্যে চেনা-জান নেই এমন নয় বরং চেনা-জানা, মন দেয়া-নেয়া, ঝগড়াঝাটি মারামারি, প্রেম ভালোবাসা সবই আছে শুধু মাঝখানে একটু গ্যাপ হয়ে গিয়েছিল এই যা। কিন্তু মনে মনে ভালোবাসার অভ্যাসটা ঠিকই ছিল তো। সে তখন উঠে মেহরাবের দিকে আগাতে লাগল…

বিজরীকে আগাতে দেখে মেহরাব আরও বেশি কনফিউজড হতে লাগল। শীট! কী করবে এখন ও? আবার এই অনুভূতির জন্য বিরক্তও লাগতে লাগল। সে একবার এদিকে যায় আবার ওদিকে যায়… নিজেকে মি. বিন মনে হতে লাগল, কী অসহ্য! বিজরী ততক্ষণে তার কাছে এসে রোমান্টিক গলায় বলল-

-আজ সারাদিনে একবারও ফোন করলে না কেন?

-ব্যস্ত ছিলাম।

-সারাদিনে আমার জন্য দুমিনিট সময় বের করতে পারোনি এটা মানি না।

-এত বেশি প্রয়োজন থাকলে নিজেও তো কল দিতে পারতে?

বিজরী আরও একটু কাছে এসে বলল- প্রয়োজন তো ছিলই তুমি বোঝ না?

বিজরী এভাবে কাছে আসায় মেহরাবের অস্বস্তি বাড়তে লাগল। বিজরী খেয়াল করল মেহরাবের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমতে শুরু করেছে। তার হাসি পেয়ে গেল সেই সাথে মাথায় দুষ্টুমী এসে ভীড় করতে লাগল একে একে। সে মেহরাবের গালে আলতো করে হাত রেখে মৃদুস্বরে বলল- “আমি হৃদয়ের কথা বলিতে ব্যাকুল শুধাইল না কেউ আমারে…”

বিজরীর গাঢ় চাহনিতে মেহরাবের ভেতরের সমস্তটা ঝড়ের গতিতে এলোমেলো হয়ে যেতে লাগল। উড়ে যেতে চাইছে সবটুকু অভিমান… সে মোহাচ্ছন্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল বিজরীর দিকে। বিজরী তখন হাতটা গাল থেকে নামিয়ে এনে ওর বুকের বা’পাশে রেখে বলল- এই যে আমি আছি, আজীবন থাকব। এইখানটায় আর কোনো যন্ত্রণা জমা হতে দিব না, কক্ষনও না। তারপর ফিসফিস করে বলল- ভালোবাসি।

মেহরাব তার দুই হাত প্রসারিত করল ওকে জড়িয়ে ধরতে কিন্তু পরক্ষণেই মনে পড়ল ওর তো ভালোবাসা দেখানোর কথা নয়! ও দেখাবে রাগ আর বদমাইশ জামাইর চরিত্র। অথচ বলে ফেলল-

-কাচ্চি বিরিয়ানি।

-কাচ্চি বিরিয়ানি!!!

মেহরাব চোখ বন্ধ করে নিজেকে “ওহ শীট” বলে গালি দিল তারপর বলল- লাল বেনারসিতে তোমাকে দেখতে কাচ্চি বিরিয়ানির মত লাগছে। বলে মেহরাব সরে যেতে নিলে বিজরী ওর হাত ধরে ফেলে বলে-

-কী হলো, বিরিয়ানি ফেলে কোথায় যাচ্ছ?

-বিরিয়ানির মুড নেই এখন। আমি টায়ার্ড, ঘুমও পাচ্ছে খুব… বলে মেহরাব আর দাঁড়াল না। বিজরী যেভাবে তাকাচ্ছে আর এত কাছে আসছে তাতে খুব দ্রুতই সব গড়মিল হয়ে যাবে। সে তো মানুষ তাই না? তাও আবার পুরুষ মানুষ। এসব পাগল করা রোমান্টিকতা হাত গুটিয়ে সহ্য করার শক্তি আল্লাহ পুরুষকে দিয়েছে নাকি? সে ড্রেস চেঞ্জ করে বলল- আমি শুয়ে পড়ব। তোমার ইচ্ছে হলে বাতি নিভিয়ে দিও, বলে সে বিছানায় উঠে কোন পাশে ঘুমাবে সেটা নিয়ে আবার ঝামেলায় পড়ল। শেষমেশ দেয়ালের দিকে পাশ ফিরে শুয়ে পড়ল। বিজরী হাসি চাপল মেহরাবের কান্ড দেখে। বলল-

-তুমি এভাবে শুয়ে পড়লে যে? তোমার কিন্তু মোটেও ঘুম পায়নি, উঠবে তুমি?

-উঠব না।

-টেনে কিন্তু নিচে ফেলে দিব?

-আমাকে এখন ক্রেন দিয়েও টেনে তুলতে পারবে না। বলে মেহরাব চোখ বন্ধ রেখে মটকা মেরে পড়ে রইল বিছানায়। মনে মনে বলল- এহ এতটুকু ঢেঁড়সের মতো মেয়ে আসছে আমাকে টেনে ফেলে দিবে! পারলে ফেলে দেখা না? নিজেই আমার নিচে চাপা পড়ে চ্যাপ্টা হয়ে যাবি। ওফ আবার রোমান্টিক মোমেন্ট চলে আসতেছে! ধুর কিছুই তো চিন্তা করা যাচ্ছে না!

বিজরী বুঝল এভাবে কাজ হবে না। সে হুট করে “আ…” করে চিৎকার দিয়ে লাফ দিয়ে বিছানায় উঠে বসল। মেহরাব ধরফরিয়ে উঠে বলল-

-কী হয়েছে? এভাবে চিৎকার করছ কেন?

-যন্ত্রণা…

-মানে?

বিজরী চূড়ান্ত আহ্লাদী গলায় বলল- মানে সামনে একটা ডাক্তার দেখে ব্যথা বেদনা গুলো জেগে উঠতে চাইছে আপন শক্তিতে।

-কোথায় ব্যথা? কিসের ব্যথা?

বিজরী তখন মেহরাবের একেবারে গাঘেঁষা হয়ে বুকে হাত রেখে বলল- মনে ব্যথা, হার্টে ব্যথা, কলিজায় ব্যথা, অন্তরে ব্যথা, হৃদয়ে ব্যথা, দিলে ব্যথা… এই পর্যায়ে এসে মেহরাব ওকে থামিয়ে দিয়ে বলল-

-বুঝেছি বুঝেছি, আর বলতে হবে না। ওই যে ওখানে টেবিলের উপর নাপা রাখা আছে দুটো খেয়ে শুয়ে পড়ো সেরে যাবে সব ব্যথা।

-হার্টের সমস্যায় নাপা!! সিরিয়াসলি?

-হ্যাঁ! আশা তো করছি এতেই কাজ হয়ে যাবে না হলে রাতটা দেখো আগামীকাল চুলকানির মলম এনে দিব, ওটায় তো ডেফিনেটলি সেরে যাবে।

বিজরী দাঁত কিড়মিড় করে বলল- চুলকানির মলম?

-অবশ্যই। রাত-বিরেতে এসব কথা তো চুলকানিরই লক্ষ্মণ তাই না? এখন ঘরে নেই বলে নাপা খেয়ে নিতে বললাম এই আরকি… মেডিসিন পেয়েছ এবার ঘমাতে দাও বলে সে শুয়ে পড়ল। তারপর উদাস গলায় বলল- “বাতি নিভিয়ে শুয়ে পড়ো। এত রাতে এসব ভূত পেত্নীর চিৎকার চেঁচামেচি শোনার জন্য কেউ পপকর্ণ হাতে নিয়ে বসে নেই।” মেহরাবের আসলে ভয় হচ্ছে কখন যেন ঠাস করে ফাটা বেলুনের মত তার মুখের উপর জোর করে ঝুলিয়ে রাখা অভিমানটা ফট করে ফেটে উবে যায়।

বিজরী এবার ওর পেছনে শুয়ে পড়ল। তাকে তো হাল ছেড়ে দিলে চলবে না। তাই সে গুনগুন করে গান ধরল- “পুছো যারা পুছো কেয়া হাল হ্যায়… হাল মেরা বেহাল হ্যায়… কোয়ি সামাঝ না পায়ে কেয়া রোগ সাতায়ে কোয়ি যায় যারা ঢুন্ডকে লায়ে, না জানি কাহা দিল খোগেয়া… না জানি কাহা দিল খোগেয়া…”

বিজরীর গান শুনে মেহরাবের হাসি পেয়ে গেল আর মনে মনে ভাবল- এইরকম হাল এতদিন আমার করে রেখেছিলে তখন তো খুব মজা লাগত আমার হালত দেখে। এবার দেখো কেমন লাগে? আমি কিচ্ছু বলব না।

বিজরী আরও কিছু রোমান্টিক গান গাইল আর যখন দেখল মেহরাব কোনো সাড়াশব্দ করছে না অথচ জেগেই আছে তখন সে শব্দ করে দুটো হাই তুলে মেহরাবের দিকে ফিরে চুপ করে শুয়ে রইল। এভাবে ৫মিনিট যেতেই মেহরাব ভাবল বিজরী বোধহয় ঘুমিয়ে গেছে তাই সে পেছন ফিরল। পেছন ফিরেই বিজরীর সাথে চোখাচোখি হয়ে গেল। বিজরী চোখ নাচিয়ে হাসি দিতেই মেহরাব মুখ ফসকে বলে ফেলল-

-Sorry…

-sorry কেন?

-sorry বলার মুড হয়েছে তাই। বলেই মেহরাব উল্টো দিকে ঘুরে যায়। বিজরী সাথে সাথে ওকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিয়ে বলে-

-“I love you” বলার মুড কখন হবে?

-ওসব মুড খুন হয়ে গেছে।

-এখন না বললে আমি তোমাকে খুন করে ফেলব।

-আর কতবার খুন করবে?

বিজরী মুচকি হেসে বলল- আমার যতবার ইচ্ছে হবে। “I love you…”

মেহরাব মুখ বেকিয়ে বলল- উহ, কচি খুকি সাজছে এখন আবার! আমি কোনো গেন্দা খোকা নই।

-সে তো দেখতেই পাচ্ছি। একেবারে ছেলে-মেয়ে, নাতি-নাতনী লালন পালন করে জীবনের রস-কষ আনন্দ শেষ করে ফেলা প্রৌঢ়বয়সী এক দাদা!

-আমি মোটেও রস-কষ বিহীন মানুষ নই।

-নমুনা তো দেখতেই পাচ্ছি।

মেহরাব চোখ পাকিয়ে বলল- এই নমুনা দেখেই কারো হাল বেহাল হয়ে যাচ্ছে।

-হু ভালো কিছু তো আর পারবে না।

– তোমার জন্য একটা গিফট এনেছিলাম। বুবু তোমাকে যেটা দিয়ে এসেছে। আমি ভেবেছিলাম আজ অন্তত পরবে ওটা। কই?

-এইজন্য এত রাগ? ওয়েট… বিজরী উঠে গিয়ে তার লাগেজ থেকে সেই বক্সটা নিয়ে এসে বলে- এটা পরতে চেয়েছিলাম আজ কিন্তু পরতে গিয়ে মনে পড়ল, এত দূর থেকে আমাকে মনে করে এনেছ তোমার হাতেই পরা উচিত। তাই সাথে করে নিয়ে এসেছি। তারপর সেটা বক্স থেকে বের করে মেহরাবের সামনে ধরে…

মেহরাব সেটা হাতে নিয়ে ওকে পরিয়ে দেয়। লকেটটা বেশ বড়সড় নীল পাথরের। বোঝাই যাচ্ছে বেশ দামী! বিজরী লকেটটার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল- অসম্ভব সুন্দর এটা… ভীষণ পছন্দ হয়েছে আমার। একটা কথা বলব?

-কী?

-তুমি তো জানতে আমার বিয়ে হয়ে গেছে তাহলে শুধুমাত্র আমার কথা মনে করে এমন দামী জিনিস কিনে ফেললে?

-ওটা দেখে তোমার কথা মনে পড়ছিল এতটুকুই যথেষ্ট। তুমি আমার জন্য কতটা মূল্যবান সে হয়ত বুঝবে না।

বিজরী মেহরাবের আরও একটু ঘনিষ্ঠ হয়ে বলল- আমাকে কখনো ভুল বুঝবে না তো?

মেহরাব মুখ ঘুরিয়ে বলল- ভুল করে কে আর বলে কাকে?

-মেয়েদের কখনও ভুল ধরতে নেই।

-মামাবাড়ির আবদার, না?

-হ্যাঁ। আবদার কোন বাড়ির সেটা কোনো বিষয় নয়, বিষয় হলো- আবদার ইজ আবদার। তারপর মৃদুস্বরে বলল- তুমি পাশে থাকলে আমি আর কখনো ভুল করব না।

-এটাও কী মামাবাড়ির আবদার?

-না। এটা তোমার প্রতি জনম জনমের ভালোবাসা।

মেহরাব বিজরীর গালে হাত রেখে বলল- আছি তো। যেমন চাইবে সারাজীবন তেমনই পাবে।

***
মেহরাব বিজরীর বিয়ের ৫ দিনের মাথায় সাজেদা মারা যায়। মেহরাব সেদিন ওর মায়ের বাসায় ছিল। সকাল থেকেই তার তীব্রভাবে মন কেমন করছিল। বার বার সাজেদাকে ফোন করছিল। শেষমেশ বাসায় চলে এসেছে বিজরীকে নিয়ে। দুপুর হতেই সাজেদার অবস্থা খারাপ হয়ে গেল। হাসপাতালে নেবার ঘন্টাখানিক পর তিনি মারা যান। সাজেদার মৃত্যু সন্নিকটে জেনেও তার সন্তানেরা কেউ মায়ের মৃত্যু মানতে পারল না। ৩ভাই-বোন জড়াজড়ি করে কান্নায় ভেঙে পড়ল…

সাজেদার মৃত্যুর ৪দিন পর বাড়িতে এক ল’ইয়ার আসেন। তার মাধ্যমে সবাই জানতে পারল সাজেদা তার সামান্য যা গহনা ছিল তার সবটাসহ এই বাড়িটা মেহরাবের নামে লিখে দিয়ে গেছে! এটা শুনে সবাই যারপরনাই অবাক হলো। নিজের সন্তান রেখে কেউ কখনো পালিত সন্তানের জন্য এতটা করে??? এমন নিঃসার্থ ভালোবাসার নজির আছে কোথাও? আরও জানা গেল সাজেদা তার ছেলের প্রতি এতটা আবেগী দেখে তার স্বামী সাজেদাকে না জানিয়ে গ্রামে তার সামর্থ্য অনুযায়ী অল্প কিছু জমি কিনেছিলেন। সেই জমি আর সাথে তার বাবার থেকে পাওয়া খুবই সামান্য কিছু জমি মিলিয়ে সাজেদা দুই মেয়েকে দিয়ে গেছেন। উইল শুনে মেহরাব অঝোরে কাঁদতে লাগল… আম্মা তাকে এতটা ভালো কেন বাসত??? সে তো আম্মার জন্য কিছুই করতে পারেনি… তার চিকিৎসাটাও না! সে জানে আম্মা শুধু তাকে এই বাড়িটা না সাথে বোন দুটোও দিয়ে গেছে। তারা এখন সম্পূর্ণ তার দায়িত্ব। যদিও তাদের দায়িত্ব নেবার কিছু নেই তবুও। এই বাড়ি মেহরাবকে দিলেও এখানে তার দুই বোনের অধিকার বেশি ছিল আর এখন সেই অধিকার আরও বেড়ে গেল।

সাজেদার এমন উইলে সবচেয়ে বেশি অবাক হলো মেহেরুন্নেসা। তার কাছে পুরো বিষয়টা এখনও অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে। তিনি আরও অবাক হচ্ছেন এটা দেখে যে, এই উইলে মেহরাবের দুই বোনের কোনো রকম আপত্তি তো দূরে থাক বরং এরাই বেশি খুশি! মেহেরুন্নেসার নিজের প্রতি করুণা হলো… সাজেদা যেখানে এতটা উদার তিনি সেখানে ঠিক ততটাই সংকীর্ণতা দেখিয়েছেন! মানুষ এত উদার কী করে হতে পারে?

মেহরাব কানাডার পার্ট চুকিয়ে ফেলল। এই দেশ সে আর ছাড়তে পারল না। তার মনপুরে যাদের বসবাস তাদের রেখে দূরে থাকার মনোবল তার আর নেই। সে তার মায়ের বাড়িতে থাকলেও তার মন পড়ে থাকে আম্মার রেখে যাওয়া বাড়িতে। তাই সেখানেও সে সমান তালে থাকে। হাসপাতাল আর নিজের চেম্বার নিয়ে নিজেকে ভীষণ রকম ব্যস্ত রেখে সে দিন-রাত পরিশ্রম করতে লাগল। সেটা আম্মাকে ভুলে থাকতে নাকি অন্য কিছু কে জানে! এর মাঝে তার এক কন্যা সন্তান হয়েছে। কন্যার দিকে তাকালেই মনেহয় সে তার আম্মাকে দেখছে। এই কারণেই হয়ত তার আস্তে আস্তে ঘরে সময় দেওয়া বাড়তে থাকে এক সময়। আম্মা মারা যাবার ৫ বছর পর সে বাড়ির খালি অংশে ৬তলা ফাউন্ডেশন দিয়ে দুই ইউনিটের ৩তলা বাড়ি তৈরি করেছে যার পুরোটা দুই বোনকে দিয়ে দিয়েছে। বাকি ৩তলাও সে এক সময় করে দেবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। এটা তাকে মায়ের দেওয়া বোনের প্রতি তার উপর ভরসার প্রতিদান।

বিজরী মেহরুন্নেসাকে নিয়ে যে ভয়ে কাবু হয়ে ছিল সেই ভয় কখন কীভাবে পালিয়ে হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে বিজরী টেরও পায়নি! হয়ত সবটাই মেহরাবের আশ্চর্য ভালোবাসার যাদুবলে সম্ভব হয়েছিল। কী করে হয়েছিল সে জানে না, সে শুধু উপলব্ধি করেছিল এবাড়ির সবাই তাকে প্রচন্ডরকম ভালোবাসে। যে ভালোবাসা শতগুণে ফিরিয়ে দিতে সেও প্রতি মুহূর্ত ব্যস্ত থাকে।

মেহরাব তার আম্মার রেখে যাওয়া বাড়িটার কোনো পরিবর্তন করেনি। এখানে তার আম্মার স্মৃতি, স্পর্শ লেগে আছে… এর পরিবর্তন কী করে করবে সে? এখানে তার পরিযায়ী জীবনের দীর্ঘ আর শ্রেষ্ঠ সময় কেটেছে সেসব মুছে ফেলা সম্ভব নয়। বোনেরা মাঝে মাঝে এখানে আসে তাদেরও তো মায়ের বাড়ি লাগে। মেহেরুন্নেসা অনেক চেষ্টা করেছিল মেহরাবকে পুরোপুরি নিজের কাছে রাখতে কিন্তু পারেনি। আসলে সে এখানে কাটানো তার পরিযায়ী জীবনটাতে এমনভাবে অভ্যস্ত হয়ে গেছে যে নিজের বাড়িও তাকে তেমন করে টানে না। মেহরাবের মনেহয় এই বাড়িতে তার আম্মা ছিল বিশাল এক বৃক্ষ। যে বৃক্ষের কান্ড সে নিজেই আর তার বোনেরা সেই বৃক্ষের ডালপালা। গাছটা না থাকলেও গাছের শেকড়-বাকড় মাটির তলায় এখনো বিছিয়ে আছে। এ বাড়ির পুরোটা সে জড়িয়ে রেখেছে পরম স্নেহ, মায়া, মমতায়… যা উপেক্ষা করে চলে যাওয়া সম্ভব নয়। তাছাড়া কান্ড না থাকলে ডালপালাগুলোও যে বাঁচে না। একবার সে ভুল করেছিল আর করবে না। এই জায়গা মেহরাব কিছুতেই ছাড়তে পারবে না। মেহেরুন্নেসার যথেষ্ট টান অনুভব করলেও সে এখানকার শেকড় উপরে ফেলতে পারে না। তবে মায়ের প্রতি ভালোবাসার কোনো খামতিও সে রাখে না। তার ইচ্ছে এখানে আলাদা একটা বাড়ি করে মা-বাবাকে নিয়ে আসবে। সেই চেষ্টাতেই সে ব্যস্ত। সকলকে ঘিরে সে আলাদা এক জগৎ তৈরি করবে এখানে। যে জগতটা তার বেঁচে থাকার রসদ।

সমাপ্ত।।