পরীজান পর্ব-৩৬+৩৭

0
629

#পরীজান
#পর্ব ৩৬
#Ishita_Rahman_Sanjida(Simran)

❌কপি করা নিষিদ্ধ ❌

‘লোভ’ মানুষ কে ধ্বংস করে দেয়। সাম্রাজ্য থেকে অতি ক্ষুদ্র বিষয়ের লোভ তৈরি করে ধ্বংসলীলা।
লোভ কারী ব্যক্তিদের শাস্তিও ভয়ানক। আল্লাহ লোভীদের পছন্দ করেন না। তাইতো খোদা হওয়ার লোভ ফেরাউনকে বিশাল সমুদ্রে ডুবিয়ে দিয়েছিল। তবে অতি আশ্চর্য বিষয় হচ্ছে ফেরাউন তার নিজের শাস্তি নিজেই লিখে দিয়েছিল জিব্রাঈল (আঃ) এর কাছে। নীলনদে পানি আনার জন্য ফেরাউন যখন দোয়া করেন তখন আল্লাহ তার দোয়া কবুল করে নীলনদে পানি ফিরিয়ে দেন এবং জিব্রাঈল (আঃ) পাঠিয়ে দেন। তিনি ফেরাউন কে প্রশ্ন করেন,’যদি কোন মনিব তার ভৃত্য কে দুনিয়ার সমস্ত সুখ দেয়। তবুও সেই ভৃত্য তা উপেক্ষা করে নিজেই মনিব সাজতে চায় তাহলে তার কিরূপ শাস্তি হওয়া উচিত?’
উত্তরে ফেরাউন বলেছেন,’ওই অকৃতজ্ঞ কে এই নীল নদের পানিতে ডুবিয়ে মারা উচিত।’
ফেরাউনের উক্তিটি কাগজে লিখিয়ে নিয়ে চলে যান জিব্রাঈল (আঃ)। সেরকম মৃত্যু দেওয়া হয় ফেরাউন কে। সমুদ্রের গভীরে ডুবিয়ে আল্লাহ তাকে শাস্তি দেন।

লোভ কখনোই মানুষ কে শান্তিতে বাঁচতে দেয় না। হেরোনা যার কারণে সবসময়ই আতঙ্কে থাকে। শায়েরের ভাগে যেটুকু সম্পদ রয়েছে তা হাতিয়ে আনতে পারলে বেশ হবে। হেরোনার সাথে তার স্বামী আকবর ও আছেন। সাথে বাকি দুই ভাই আর তার বউয়েরাও। তাদের পরিকল্পনার প্রধান হাতিয়ার বানিয়েছে হেরোনার মেয়ে চম্পাকে। শায়ের বলতে পাগল সে এখনও। এখনও সে শায়েরের চরণ তলে একটু ঠাঁই চায়। যার দরুন মায়ের অন্যায় আবদার সে মেনে নিয়েছে। পরীর সাথে ভাব জমিয়েছে। কথা বলার ছলে এটা ওটা খাওয়ায়। যার সাথে এক বিশেষ ধরনের ওষুধ মেশানো থাকে যা দূর গ্রামের একজন কবিরাজের কাছ থেকে আনিয়েছেন হেরোনা। পরী যাতে সন্তান জন্ম দিতে না পারে এবং সেই সুযোগে চম্পাকে শায়েরের সাথে বিয়ে দিবেন হেরোনা। এই সামান্য সম্পদের জন্য এখন মেয়েকেও উৎসর্গ করেছেন তিনি। চম্পাকে বুঝিয়েছে শায়ের তো পুরুষের জাত। বাচ্চা না হলে মেয়ে মানুষের দাম থাকে না। সে যতোই রূপবতী হোক না কেন!! তেমন করে পরীকেও সে ছুড়ে ফেলে দিবে। তার পর চম্পার সাথে শায়েরের বিয়ে দেবেন। চম্পাও খুশি মনে তা মেনে নিয়েছে। মায়ের পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ করছে সে।
কিন্ত শায়েরের পরীজান সম্পর্কে অবগত নন বলেই এসব কাজ করছে হেরোনা। যদি জানতো তাহলে এরকম জঘন্য চিন্তা মাথায় আনতো না।

শায়ের দুপুরের খাবার খেতে এসেছে। উঠোনে পরীর পরনের শাড়ি দেখে দেখে অবাক হলো সে। কেননা শায়ের ফেরা না পর্যন্ত পরী গোসল করে না। শায়ের যেদিন তাকে বলেছিল তার সবচেয়ে মোহনীয় রূপ হচ্ছে যখন সে গোসল করে কাপড় মেলতে যায়। সেই দৃশ্যটা শায়ের কে উপভোগ করানোর জন্য দুপুরে শায়ের ফেরার পর পরী গোসলে যায়। তাহলে আজকে হলো কি পরীর?? ঘরে আসতেই দেখলো পরী নামাজ পড়ছে। শুক্রবার বিধায় আজ একটু তাড়াতাড়ি এসেছে শায়ের। সে ভাবছে এখনও তো নামাজের সময় হয়নি। পরক্ষণে ভাবলো হয়তো নফল নামাজ পড়ছে। তাই শায়ের ও চলে গেল গোসলে। তারপর সেও চলে গেল মসজিদে জুমার নামাজ পড়তে। শুক্রবারে দুপুরের পর বাড়িতেই থাকে শায়ের। নামাজ শেষে ফিরে এসে দেখে পরী অন্যমনস্ক হয়ে বসে আছে। শায়ের পরীর পাশে বসে বলে,’আপনার কি মন খারাপ পরীজান?’

হঠাৎ শায়েরের কথায় চমকে ওঠে পরী। কোন এক ধ্যানে মগ্ন ছিলো সে। শায়েরের কথাতে ধ্যান ভঙ্গ হলো তার।
-‘আপনি কি বাড়ির জন্য চিন্তিত?’
-‘নাহ তেমন কিছু না।’
-‘আপনার চোখ দেখে মনের ভাবনা কিছুটা বুঝতে পারছি। আপনি কি বাড়িতে যেতে চান? তাহলে নিয়ে যাবো।’
-‘নাহ!!বাড়িতে আমি যাবো না। ক’দিন হলো তো এসেছি। আমার কিছু হয়নি।’
-‘তাহলে আপনার মুখে হাসি নেই কেন পরীজান? আমি যেই হাসিটা দেখার জন্য ছুটে আসি সেই হাসিটা আজ কেন দেখতে পেলাম না? আপনি কি আমার কাছে সুখি নন পরীজান?’

পরী তৎক্ষণাৎ শায়েরের হাত মুঠোয় নিয়ে বলে, ‘আপনি ছাড়া আমি পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী ব্যক্তির কাছেও সুখি থাকতে পারবো না। তাই এই প্রশ্ন আপনি কখনোই করবেন না।’

পরম যত্নে স্ত্রীর গালে হাত রাখলো শায়ের। তারপর বলল,’তাহলে আমার থেকে কিছু লুকাবেন না। সব বলুন ভালো লাগবে।’
পরী শায়েরের হাত জড়িয়ে ধরে কাঁধে মাথা রাখে। বলে,’আপার বাচ্চাকে দেখেছেন??কি সুন্দর তাই না?’
পরীর মনোভাব সব বুঝে গেল শায়ের। সেও হাত ধরে পরীর তারপর বলল,’আপনার চাই তাই তো?’

-‘ফুপু বলেছিলেন একটা বাচ্চার কথা,কিন্ত??’

একটু চুপ থেকে পরী বলে,’আচ্ছা আমি কি মা হতে পারবো না?’
-‘আল্লাহ চাইলে সব পারেন পরীজান। আপনি ধৈর্য ধরুন। আল্লাহ আপনার সাথে আছেন। কখনো আর এই চিন্তা করবেন না।’

-‘অনেক দিন তো পার হয়ে গেল। আমার কিছু ভালো লাগছে না। আর ফুপু,,’
-‘বুঝেছি ফুপু আপনাকে চাপ দিচ্ছে তাই তো।’

-‘নাহ,ফুপুর ও তো মন চায় তাই না?তাছাড়া আমিও চাই।’
-‘এতো চিন্তা করবেন না। আপনাকে মনমরা হয়ে থাকতে দেখে ভালো লাগেনা আমার। আমার পরীজান কে সবসময়ই হাসিখুসি দেখতে চাই।’

পরীকে বুকে জড়িয়ে ধরে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল শায়ের। নাজানি এখন একটা বাচ্চার জন্য পরীকে কথা শুনতে হয়। ভাবনাটা সেটা নিয়ে নয়। ভাবনা হলো পরী তখন কীভাবে নেবে বিষয়টা? নিশ্চয়ই কঠিন ভাবে প্রতিবাদ করবে। তখন না অশান্তির সৃষ্টি হয়।
মন ভাল করার জন্য পরীকে নিয়ে ঘুরতে বের হলো শায়ের। গ্রামের পথে প্রায়শই যায় ওরা। তবে আজকে রাতে বের হয়েছে ওরা। সুধাকরের আলোতে তখন ঝলমল করছে ধরণী। রাস্তাঘাট স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। সেই সাথে হাতে হাত রেখে হেঁটে চলছে শায়ের পরী। আলতো করে পরীর বাহু ধরে জড়িয়ে ধরেছে পরীকে। রাতে তো কেউ রাস্তাঘাটে খুব একটা আসেনা। ফাঁকা রাস্তাটা দুজনে বেশ উপভোগ করছে। সাথে পরীর মনটাও ভালো হয়ে গেছে। শায়ের বলে,’কিছু ভালোবাসা আর কিছু অনুভূতি গোপনে সুন্দর জানেন কি?’

-‘না তো!!আপনার কাছে প্রথম শুনলাম।’

-‘আপনার প্রতি আমার সকল অনুভূতি ভালোবাসা সবই ছিলো গোপন। কখনোই ভাবিনি আপনি আমার ভাগ্যে আছেন। আমি চাঁদের আশা করিনি,চাঁদের আলোতেই খুশি ছিলাম। কিন্ত বিধাতা যে আকাশসহ চাঁদটাকেই আমাকে দিয়ে দিলেন।’

চাঁদের থেকে চোখ সরিয়ে পরীর দিকে তাকিয়ে শায়ের বলে,’যে রাতে আপনাকে প্রথম দেখেছিলাম খুব দীর্ঘ একটা রাত ছিলো। আপনাকে দেখার পর কাকভেজা চোখ নিয়ে শুধু অস্থিরতায় ছটফট করেছিলাম বাকি রাতটুকু। আপনাকে আরেকটিবার দেখার জন্য ব্যাকুল হয়েছিলাম কিন্ত সেই দেখা দিলেন বিয়ের রাতে। কত অপেক্ষা করিয়েছেন আমাকে ভাবতে পারছেন?’

-‘কিন্ত আপনার চোখে কখনোই সেই অনুভূতি দেখিনি মালি সাহেব। কীভাবে এতোসব গোপন রাখেন আপনি?’
-‘আমার সবচেয়ে গোপন জিনিস টা কি জানেন?’

মাথা নেড়ে না বুঝায় পরী। শায়ের তখন পকেট থেকে কিছু একটা বের করে। চাঁদের রুপালি আলোতে চিকচিক করে উঠলো নূপুর টা। পরী এবার ভিশন অবাক হলো!!এই সেই হারিয়ে যাওয়া নূপুর। যেটা পাগলের মতো খুজেছে পরী। আর সেটা কি না শায়েরের কাছে ছিলো!!সে বুঝতেই পারেনি। পরী জিজ্ঞেস করে,’এটা আপনার কাছে ছিলো? তবে আপনি তখন বলেননি কেন?’

-‘তখন তো জানতাম না যে এই নূপুরের মালিক আমার হবে। তাই যত্নে লুকিয়ে রেখেছিলাম। এখন বুঝতে পারছেন তো আমার ভালোবাসা কতটা গোপন ছিলো!!’
বিনিময়ে হাসলো পরী। শায়ের হাটুমুড়ে বসে নূপুরটা পরিয়ে দিলো পরীকে। শায়ের উঠে দাঁড়ানোর আগেই কারো সাথে ধাক্কা লাগে পরীর। ধাক্কাটা খুব জোরে লাগতে সরে আসে সে। পেছন ফিরে কাউকে দ্রুত পদে চলে যেতে দেখলো পরী। শায়ের উঠে দাঁড়াল পরীকে ধরে বলল,’আপনার লাগেনি তো?’
পরী আগন্তুকের দিকে তাকিয়ে ছিলো তখনো। শায়ের বলল,’এই যে দাঁড়ান? চোখে দেখেন না? এভাবে ধাক্কা দিলেন!!’

-‘মেজো কাকি।’
শায়ের অবাক হলো বলল,’মেজো কাকি!! আপনি চিনলেন কীভাবে?’

পরী তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে রিনার দিকে তাকিয়ে বলে,’তার চাল চলন আমি খুব ভাল করে চিনি। সে যেই সুগন্ধি তেল মাখে তার গন্ধটাও পেয়েছি। কিন্ত মেজো কাকি এতো রাতে কোথায় গিয়েছিলেন?’
শায়ের নিজেও তা খেয়াল করে। সত্যিই তো কোথায় যেতে পারে সে? এসব চিন্তা করতে করতে বাড়িতে চলে আসে ওরা। শায়ের কিছু না ভাবলেও পরী ভাবছে। কেননা ইদানীং পরী শায়েরের মেজ কাকি রিনা আর হেরোনাকে কথা বলতে দেখে। কিন্ত বিষয়টা এখন বেশ বুঝেছে সে। সাথে খুসিনাকে ঘরে ডেকে নিয়ে কিছু বলে। পরী এতদিন এসবে পাত্তা দিতো না। ওরা যা বলে বলুক ওর কি তাতে। কিন্ত যখন বিষয়টা খুসিনা পর্যন্ত গিয়েছে তখন পরী ভেবেছে কিছু তো ঘাপলা আছে। পরীর ধারণা সঠিক হলো যখন খুসিনা পরেরদিন এসে শায়ের কে ডাকলো।
কাজে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছে শায়ের। খুসিনা তখন শায়ের কে ডাকতে ডাকতে ঘরে ডুকলো,’কামে যাস তুই?’
-‘হুমম কিছু বলবে তুমি??’
-‘হ কইতাম। কি কমু? তুই আমার পোলা, তোর ভালার লাইগা কইতে হইবো। তোর বউয়ের তো পোলাপান হইবো না। বংশধর তো আনোন লাগবো। নাইলে তোর হইবো কি? তাই কইছিলাম তোর বউও থাক। তুই চম্পারে বিয়া কর।’

পরী যেন স্তব্ধ হয়ে গেল। ফুপু যে এতো সহজে কথাটা বলে ফেলবেন তা জানা ছিলো না পরীর। এতোদিন কতই না ভালোভাবে দিন কাটছিল এই ফুপুর সাথে। আর আজকে এই মানুষ টা এতো সহজ ভাবে কথাগুলো বলে দিলো? পরী কিছু বলল না। শুধু শায়েরের জবাবের আশাতে চেয়ে রইল। শায়ের শান্ত স্বরেই বলে,’আজ বলেছো,তবে দ্বিতীয়বার যেন তোমার মুখে একথা না শুনি ফুপু।’

-‘ক্যান কমু না সেহরান। তোর কি বাপ হবার ইচ্ছা করে না? দেখ সব ভাইবা দেখছি আমি। তাই তোর বউর সামনেই কইলাম। তুই বিয়া কর। দেখবি সব ঠিক হইয়া যাইবো।’

শায়ের এবার খুব রেগে গেলো। রাগন্বিত কন্ঠে বলল, ‘পরীজান থাকলেই চলবে আমার। চাই না আমার বাচ্চা। আর তোমাকে কে বলল আমার বউয়ের বাচ্চা হবে না?’

খুসিনা জবাব দিলেন না। জবাব দিলো পরী,’বড় কাকি বলেছে তাই না ফুপু?’

এবার ও জবাব দিলেন না তিনি। কথাটা তো হেরোনা বলেছে খুসিনাকে। খুসিনা আগেও চেয়েছিল চম্পা শায়েরের বউ হোক। এখন যখন পরী মা হতে পারবে না জেনেছে তখন চম্পার সাথে শায়েরের বিয়ে হলেই ভাল হবে। এই ভেবে খুসিনা রাজি হয়েছেন।

-‘বড় কাকি কিভাবে জানলো আমি মা হতে অক্ষম? তিনি এতোটা নিশ্চিত হলেন কীভাবে?’

খুসিনা এবার মুখ খুললেন,’চম্পা তোমাগো কইতে হুনছে।’
শায়ের পরী একে অপরের দিকে তাকালো। ওরা কবে এসব নিয়ে আলোচনা করলো?আর চম্পা শুনলোই বা কীভাবে? পরীর মাথাটা ঘুরে গেল। ভালো ব্যবহার করাটা কি তাহলে চম্পার নাটক ছিলো? রাগে পরীর চেহারাটা লাল বর্ণ ধারণ করলো। ওর জীবনে বিশ্বাসঘাতকের জায়গা এক চুল ও নেই।

#চলবে,,,,

#পরীজান
#পর্ব ৩৭
#Ishita_Rahman_Sanjida(Simran)

❌কপি করা নিষিদ্ধ ❌

অন্যায় কারী কেই পরী কখনোই ক্ষমা করেনি আজও করবে না। দোষীদের সে শাস্তি দেবেই। শায়ের কিছু বলুক বা না বলুক পরী বলবেই। এতদিন চুপচাপ থাকা পরীকে দূর্বল ভেবে তারা যে ভুল করেছে তার মাশুল এবার পাবে তারা। তার আগে সবকথা জানতে হবে। তাই পরী খুসিনাকে আবারও জিজ্ঞেস করে, ‘চম্পা আর কি কি বলেছে ফুপু? আপনি সব বলুন। সব সত্য বলবেন।’

কিছু একটা ষড়যন্ত্র আছে তা বুঝতে পারে খুসিনা। তাই তিনি বলতে লাগলেন,’চম্পা কইলো তুমি নাকি পোলাপান হওয়াইতে পারবা না। কোন ফকিররে দেখাইছো। চম্পা সব হুনছে,হের লাইগা হেরোনা কইলো বউর যহন পোলাপান হইবো না তাইলে চম্পার লগে বিয়া দিলেই ভালো হইবো। পোলাপানের সুখ পাইবো সেহরান।’

-‘আপনাকে সাদাসিধে পেয়ে যা বুঝিয়েছে তাই বুঝেছেন ফুপু কিন্ত আমি সঠিক টাই বুঝেছি। চম্পা অনেক বড় চাল চেলেছে ফুপু যা আপনি টের পাননি।’

ক্রমাগত রাগ বেড়ে চলছে পরীর। শায়ের বুঝলো এবার পরী নিজেও নিজেকে থামাতে পারবে না। পরী পালঙ্কে গিয়ে বসে। মাটির দিকে তাকিয়ে কিছু ভাবতে লাগল সে। খুসিনা নিঃশব্দে প্রস্থান করে। পরীকে এমন শান্ত হতে দেখে শায়ের ওর পাশে গিয়ে বসে। নিমজ্জিত কন্ঠে সুধায়,’চম্পা আর চামেলিকে আমি সবসময় নিজের বোনের চোখে দেখতাম। কখনোই অন্য চিন্তা ওদের নিয়ে মাথাতে আসতো না। কিন্ত চম্পার মনে যে অন্য কিছু থাকবে তা আমি জানতাম না। শুধু এই জেদ ধরে এতবড় মিথ্যা ও বলল কেন??’

পরী চোখ তুলে তাকালো শায়েরের দিকে। মুখটা কেমন মলিন হয়ে গেছে।
-‘চম্পা শুধু এই কাজটাই করেনি। আরো একটা জঘন্য কাজ করেছে জানেন কি?’

শায়ের মুখে কিছু না বললেও চোখের মাধ্যমে বোঝালো সে জানতে চায়। পরী বলল,’কাল রাতে ওটা মেজ কাকিই ছিলো। আমার সাথে ধাক্কা লাগতে তিনি অনেকটা ভয় পান। সেটা আমি তখনই বুঝেছি। কিন্ত কারণটা আমি আজ সকালে বুঝলাম।’

বালিশের তল থেকে একটা কাচের শিশি বের করে পরী। সেটা শায়েরের দিকে তুলে ধরে বলে,’মেজ কাকি কাল এটা ফেলে গিয়েছিল। আপনি খেয়াল না করলেও আমি করেছি। এটার মধ্যে একটা ওষুধ আছে,কিন্ত তা কিসের সেটা জানতাম না। তাই চামেলিকে দিয়ে উসমান ফকিরের কাছে পাঠিয়ে জানতে পারি সব। আমি যাতে মা না হতে পারি সেজন্য একটু একটু করে আমাকে খাইয়েছে চম্পা। আমি অনেক আগেই খেয়াল করেছি সব কাকিরা আমাকে নিয়ে কিছু বলেন। আমার ক্ষতি করতে চান। কিন্ত এসবে যে চম্পারও হাত আছে তা জানতাম না। ফুপু যখন এলো আমি কিছুটা আন্দাজ করেছি তিনি কি বলতে এসেছেন।’

-‘কেয়ামত হলেও আমি আপনার হাত ছাড়বো না পরীজান। কিন্ত তার আগে চম্পাকে ওর কাজের হিসাব দিতে হবে।’
শায়ের উঠতে নিলে পরী হাত ধরে থামিয়ে দেয় বলে,’হিসেব টা আমি নিজেই নেবো মালি সাহেব। পরীর কাজ পরীকে করতে দিন। আরেকটা কথা শুনে রাখুন। বিশ্বাস ঘাতকের বুকে ছুরি চালাতে আমার বুক কাঁপবে না। আপনি চেয়েও আমার থেকে দূরে যেতে পারবেন না। আপনাকে আমার হয়ে থাকতে হবে ইহকাল এবং পরকাল। ভালোবাসা সহজ নয়।’

-‘সত্যিকারের ভালোবাসাকে কোন ঝড় আলাদা করতে পারেনা পরীজান। দেহ আলাদা করলেও মনকে আলাদা করা যাবে না। আমি আপনার সব বিপদের ঢাল হয়ে দাঁড়াবো কথা দিলাম। বিপদকে আপনাকে ছোঁয়ার আগে আমাকে ছুঁতে হবে।’

হুট করেই জড়িয়ে ধরে শায়ের কে। শায়ের নিজেও বক্ষে ঠাই দিলো পরীকে। পরীর এতো বড় ক্ষতি হয়ে গেল অথচ পরী শান্ত। ভিশন শান্ত,এরমানে পরী ভয়ানক কিছু করবে। শায়ের পরীকে আজ একা ছাড়লো না। কাজে না গিয়ে পরীর কাছেই থেকে গেল। কিন্ত দুপুরের পর পরীকে ফেলে যেতে হলো। ইলিয়াস লোক পাঠিয়েছিল। জরুরি তলবে শায়ের কে যেতেই হলো।
পরী তখন ঘরে একা। সারাদিন কোন কথা সে মুখ থেকে বের করেনি। এমনকি শায়েরের সাথেও কথা বলেনি। রাগটা একটু কমে এলেও বিকেলে তা দ্বিগুণ বাড়লো। চামেলি চম্পা দুজনেই এসেছে। এবারও খালি হাতে আসেনি ওরা। পায়েশ হাতে চামেলির। পরী বসা থেকে দাঁড়িয়ে গেলো। পায়েশের বাটিটি হাতে নিয়ে চম্পার দিকে তাকিয়ে বলল,’আমাকে তো অনেক খাইয়েছো চম্পা আজকে তুমি একটু খাও।’

চম্পার ভয় লাগলো একটু। সে চামেলির দিকে তাকালো। চামেলি বোকাসোকা হলেও আজ সে পরীর পক্ষে। পরীর এতোই ভক্ত সে, যে পরী যা বলবে সে তাই করবে। তবে পুরো বিষয়টা চামেলি নিজেও জানে না। পরী এগিয়ে গেলো চম্পার দিকে বলল,’একটু খাও চম্পা!!’
-‘না ভাবি,আপনের লাইগা আনছি আপনে খান।’

-‘আমার জন্য এতো দরদ কেন তোমাদের? এতো খাওয়াচ্ছো কেন আমাকে? কি মিশিয়েছো পায়েশে?’

চম্পা ঘামতে শুরু করেছে। পরী জানলো কিভাবে?পরী চম্পার গাল চেপে ধরে বাটি সুদ্ধ মুখে ঢেলে দিলো চম্পার। চম্পা পরীর থেকে ছিটকে সরে গেলো। দৌড়ে বাইরে এসে সঙ্গে সঙ্গেই বমি করে দিলো। পরী নিজেও বাইরে চলে এসেছে। চম্পা পিছনে ফিরতেই একহাতে গলা টিপে ধরে চম্পার। পরীর শক্ত হাতের বাঁধন শত চেষ্টা করেও পরীর থেকে ছাড়াতে পারলো না। পরীর চোখে রাগ দেখে ভিশন ভয় পাচ্ছে চম্পা। হিংস্র মানবীর ন্যায় চোখ দিয়ে ভষ্ম করে দিচ্ছে চম্পাকে।
-‘আমার হিংস্রতা দেখোনি তুমি চম্পা। আজ দেখবে, এই হাতে অনেক পুরুষদের কাবু করেছি। আর তুমি তো একজন নারী মাত্র।’

চম্পা মুখ দিয়ে কথা বের করতে পারলো না। শ্বাস আটকে আসছে ওর। চোখে ঝাপসা দেখছে। সে হাত নাড়িয়ে চামেলিকে বলছে তাকে বাঁচাতে কিন্ত চামেলি নিজেই ভয় পেয়েছে। হঠাত করে পরীর হলো কি তা সে নিজেও জানে না। পরী আবারো বলল, ‘আমার স্বামী একান্তই আমার। তুমি কি ভেবেছো বাচ্চা জন্ম না দিতে পারলে আমি তার সাথে তোমার বিয়ে দেবো? এতোই সহজ? আমার স্বামী আমার ভালোবাসা। কষ্ট পেলে দুজনে একসাথে পাবো আর হাসলে একসাথে হাসবো। আমাদের দেহ আলাদা হলেও আত্মা কিন্ত এক। পারলে আমাদের আলাদা করে দেখাও।’

ঝটকা মেরে চম্পাকে ফেলে দিলো পরী। মাটিতে শুয়ে কাশতে লাগল সে। চামেলি দ্রুত বোনকে ধরে ওঠায় বলে,’কি হইছে ভাবি? তুমি এমন করতাছো ক্যান? আপা কি করছে?’
-‘তুমি বুঝবে না। কিন্ত এটা জেনে রাখো তোমার মা এবং বোন জঘন্য অপরাধ করেছে।’

পরী নিজের ঘরে চলে গেল। যতক্ষণ চম্পার সামনে থাকবে ততক্ষণ ও নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না। চামেলি তার বোনকে ঘরে নিয়ে গেল। এবং সাথে সাথেই সব বলে দিলো। হেরোনা কিছুটা বিচলিত হলেও তেমনভাবে নিলেননা বিষয়টা। পরী আর কিইবা করতে পারবে। আর সেহরান তো তার সাথে কথাই বলে না। তবুও রাতে তিনি দুই জা কে ঘরে ডাকলেন গভীর পরামর্শ করতে। হেরোনা বললেন, ‘সেহরান তো সব জাইনা গেলো। এহন তো সবদিক গেলো। কি করি এহন?’

ছোট জা কনক বললেন,’ভাবি আমি কই বাদ দেন এইসব। ওই জমি আমরা পামু না।’
কনককে ধমক দিলেন হেরোনা,’তুই চুপ থাক। এতোদিন জমি আমরা খাইলাম অহন তো আমাগো হইয়া গেছে। আমরা দিমু না জমি। তোর ভাইয়ের লগে এই নিয়া কথা কইতে হইবো। কোন ঝামেলায় পড়লাম রে।’

দরজার ঠকঠক আওয়াজে চম্পা গিয়ে দরজা খুলে দিলো। কিন্ত সে অবাক হলো পরীকে এসময় দেখে। শান্ত চোখে চম্পাকে দেখে নিলো পরী। আজ যেন পরীকে ভয়ানক সুন্দর লাগছে পরীকে। লাল শাড়িতে পরীর মতো লাগছে। স্মিত হাসলো পরী। পরীর সবকিছুই আজকে ভয়ানক মনে হচ্ছে চম্পার কাছে।
পরী বলল,’ভেতরের আসতে দিবে না?’

চম্পা দ্রুত দরজা হতে সরে দাঁড়ালো। সবাইকে অবাক করে দিয়ে দরজাটা আটকে দিলো পরী। হেরোনা বলল,’দরজা আটকাও ক্যান তুমি?’

জবাব না দিয়ে পরী চম্পাকে বলে,’আমাকে বসতে দাও। সবকথা দাঁড়িয়ে বলবো নাকি?’
জলচৌকি এনে বসতে দিলো পরীকে। পরী শান্ত স্বরেই বলল,’আমাকে ওই ওষুধ খাওয়ানোর পিছনের কারণটা কি শুধুই চম্পা নাকি আরো অন্য কারণ আছে?’
কথাটা বলে হেরোনার চোখে চোখ রাখে পরী। হেরোনা জবাব দিল,’তোমারে এতো কথা কমু না। ঘরে যাও। রূপ দিয়া সেহরান রে বশ করলেও আমাগো পারবা না।’
পরী হাসলো বলল,’নারীর রূপে পুরুষ বশ হয় আর নারীরা ঈর্ষান্বিত হয়। আমি সত্য জানতে চাই বলে ফেলুন। নাহলে,,,’

-‘এই মাইয়া কি করবা তুমি? মারবা নাকি? সাহস তো কম না।’

পরী সোজা হয়ে বসে। তারপর বলে,’আমি যখন খুন করি তখন আমার বয়স তেরো বছর। তাহলে ভেবে দেখুন তের বছরে একটা খুন করেছি আর এখন চারটা খুন করার সাহস আছে আমার মধ্যে।’

হেরোনা নড়েচড়ে বসলো। পরী কি সত্যি বলছে নাকি ভয় দেখাচ্ছে। অতটুকু মেয়ে মানুষ মারবে কীভাবে? সে বলে,’মশকরা করতাছো আমাগো লগে?’

-‘আমি কি আপনার বেয়াই লাগি যে মজা করবো। এই হাতে দা তুলে নিয়েছিলাম সেদিন। শুয়ো*র বাচ্চাটার ঘাড়ে এক কোপ মারতেই সে শেষ। ওর রক্তে ভিজেছি সেদিন।’
পরীর কথা শেষ করার আগেই বজ্রপাতের শব্দ এলো। পরী বাদে কেঁপে উঠল সবাই। বিকাল থেকেই আকাশে মেঘ ছিলো। এখন হয়তো বৃষ্টি হবে। সেই আভাস দিচ্ছে প্রকৃতি। পরী আবারো বলতে লাগল, ‘তবে আমার সবচেয়ে খারাপ লেগেছিল কেন জানেন? ওর ঘাড় থেকে মাথাটা আলাদা করতে পারিনি বলে। মেজাজ টাই খারাপ হয়ে গেলো।’

পরীর কথাগুলো সবাইকে ভয় পাইয়ে দিলো। তবে কেউ কোন কথা বলল না দেখে পরী আবারও বলে, ‘আপনাদের এসব কেন বলছি তার কারণ জানতে চাইবেন না? কারণ হলো এবারের মতো আপনাদের ক্ষমা করলাম। কিন্ত পরের বার কিছু করার আগে নিজের ঘাড়ের কথা চিন্তা করবেন। এখন বাকি কারণটা কি ভালোভাবে বলবেন নাকি শ্বাসনালী চেপে ধরে কথা বের করতে হবে।’

কনক খুনখারাবি ভয় পায় খুব। পরীর কথাটা সে বিশ্বাস করে ফেলেছে সে। তাই সব সত্য গড়গড় করে বলে দেয়। হেরোনা চেয়েও আটকাতে পারে না। হেরোনা এখনও পরীর কথা পুরোপুরিই বিশ্বাস করতে পারেনি। কিন্ত চম্পার কেন জানি মনে হচ্ছে পরী সত্যি বলছে। পরী আজ যেভাবে ওর গলা চেপে ধরেছিল মনে হচ্ছে আজ সে মরেই যাবে। ওই হাতে নিশ্চিত কাউকে মেরেছে পরী। কনকের কথা শুনে পরী বলে,’এটুকু সম্পদের জন্য আপনারা একটা মেয়ের মাতৃত্ব কেড়ে নিলেন। বাহ খুব ভালো। এর থেকে আরো বেশি সম্পদ পাবেন আপনারা। আমি দেবো,তবে তার সাথে আমার মাতৃত্ব ফিরিয়ে দিতে পারবেন?’

ইতিমধ্যে বৃষ্টি শুরু হয়ে গিয়েছে। সবাই চুপ করে আছে। শুধু বৃষ্টি পড়ার শো শো শব্দ ভাসছে চারিদিকে। পরী সবার দিকে তাকিয়ে আছে। এবার সে দরজার শব্দে সেদিকে তাকায়। দরজা খোলে চম্পা। বাইরে থেকে শায়েরের কন্ঠস্বর শোনা গেল,’ঘরে চলুন পরীজান।’

পরী কথা না বলে ঘর থেকে বের হয়ে গেল। ঘরে যেতে যেতে অনেকটাই ভিজে গেল পরী। শায়ের আরও বেশি ভিজে গেছে। আড়ত থেকে ফিরতে ফিরতে ভিজে জুবুথুবু সে। পরীকে ঘরে না দেখে শায়ের বুঝে গেছে সে কোথায় থাকতে পারে। ঘরে
আসতেই শায়ের বলল,’আপনি ওই ঘরে কেন গিয়েছিলেন? আর কখনোই যাবেন না।’

পরী কথা বলল না। চুপচাপ গামছা এনে শায়েরের মাথা মুছতে লাগল সে। শায়ের নিজেও চুপ রইল। একটু পরে বলে উঠল,’আপনি কাকে খুন করেছেন পরীজান?’
-‘আপনি সব শুনেছেন দেখছি।’
-‘এটা বলবেন না যে আপনি ভয় দেখানোর জন্য বলেছেন। আমি আপনার কথাতে বুঝেছি আপনি সত্য বলছেন।’

প্রসঙ্গ পাল্টে ফেলে পরী। বলে,’সুরমা পড়লে আপনাকে এতো ভালো লাগে কেন মালি সাহেব?? আপনার সব সৌন্দর্য কেন ওই চোখে ঢেলে দিয়েছেন বিধাতা? আমার যে নেশা ধরে যায়।’

-‘আমি আপনাকে কিছু জিজ্ঞেস করেছি।’

-‘আমাকে আজ ভালোবাসা দিবেন মালি সাহেব!! আগের থেকে আরো বেশি ভালোবাসা চাই আমার।’

পরীকে কেমন যেন উন্মাদ মনে হচ্ছে শায়েরের। আজকের ঘটনাটা ওকে কেমন যেন ঘোরে ফেলে দিয়েছে। শায়ের বলল,’আপনার কি হয়েছে পরীজান? শরীর খারাপ করেছে?’

-‘আপনার ভালোবাসার অসুখ আজীবন থাকবে আমার। আমাকে সুস্থ করতে কোনদিন পারবেন না আপনি।’
কথা শেষ করতেই শায়েরের বুকে ঢলে পড়ে পরী। শায়ের পরীকে কোলে তুলে নিলো সাথে সাথেই। এইবার সে খেয়াল করলো পরীর সম্পূর্ণ চুল ভেজা। শরীর জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে।

#চলবে,,,