#পরীজান
#পর্ব ৪৪
#Ishita_Rahman_Sanjida(Simran)
❌কপি করা নিষিদ্ধ ❌
সারারাত বিনা নিদ্রায় পার করে ভোরের দিকে চোখ লেগে এসেছিল শায়েরের। পরী ঘর থেকে বের হতেই
ঘুম ভেঙে যায় ওর। তাই সে পরীর ফিরে আসার অপেক্ষায় ছিল। পরী ফেরামাত্রই সে সেদিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো। সেই দৃষ্টি উপেক্ষা করে ঘরে ঢুকলো পরী। শায়ের বাইরে দাঁড়ানো। পরীর অনুমতি ব্যতীত সে ঘরে প্রবেশ করবে না। পরীর কাছে ঘরে ঢোকার অনুমতি সে চাইলোও না। পরী সেটা খেয়াল করে। কিছুক্ষণ এভাবে কেটে যাওয়ার পর পরী অধৈর্য হলো। সে ভেবেছিল শায়ের তার সাথে কথা বলবে। কিন্ত তা যখন হলো না পরী নিজেই গেল শায়েরের কাছে। রাতে যেভাবে ওকে বের করে দিয়েছিল ঠিক সেভাবেই ভেতরে নিয়ে আসে। বলে,’আপনার সমস্যা কি?’
-‘আপনাকে একবার জড়িয়ে ধরবো?’
কন্ঠে এতোটাই মাদকতা ছিল যে পরীকে ভিশন টানছে। শায়েরের চোখে সে না তাকিয়ে পালঙ্কে বসে পড়ল। শায়ের পরীর পায়ের কাছে বসে পড়ল। হাঁটুর উপর হাত রেখে বলল,’চলুন না আমরা চলে যাই? আমি আপনাকে হারাতে চাই না। নিজেকে নিয়ে আমার ভয় কোন কালেই ছিল না। আমি শুধু আপনাকে চাই। দয়া করে ফিরে চলুন?’
-‘আমিও চেয়েছিলাম আপনার সাথে ছোট্ট সংসার সাজাতে। আপনি আমি একসাথে সুখে থাকতে। আপনার আলিঙ্গনে ঘুমাতে। সকালে আপনার উষ্ণ পরশে ঘুম থেকে উঠতে। আপনার ফেরার অপেক্ষা করতে। একটা মিষ্টি ভালোবাসায় জীবন কাটাতে। কিন্ত তা বোধহয় বাকি জীবনে আর হবে না।’
-‘আমাকে বেঁচে থাকতে একটু ভালোবাসা দিন পরীজান। মরার পর আল্লাহ আপনাকে আমার থেকে আলাদা করে দেবে।’
বিচ্ছেদের কথা শুনে পরী দৃষ্টি মিলায় শায়েরের সাথে। বুকে অদৃশ্য ব্যথা অনুভব করলো সে। এই খারাপ মানুষ টা তার থেকে দূরে থাকবে? পরী বলল,’পাপীরা আল্লাহ্র কাছ থেকে ক্ষমা পায়। আপনি কেন পাবেন না? পারবেন না তার কাছ থেকে ক্ষমা এনে আমার সাথে থাকতে?’
-‘আমি তো আপনার ক্ষমা পাচ্ছি না। আল্লাহ কি আদৌ ক্ষমা করবে?’
-‘আমার থেকে হাজার গুন বেশি দয়ালু তিনি। ক্ষমা তিনি অবশ্যই করবেন।’
শায়ের পরবর্তী কথা বলতে পারল না। তার আগেই কুসুমের গলার স্বর ভেসে আসে। আফতাব শায়ের কে ডেকে পাঠিয়েছেন। তাই শায়ের বৈঠকে গেলো। সেখানে শুধু আফতাব নয় আখির,নওশাদ ও আছে। শায়ের ঘরটাতে চোখ বুলিয়ে নিলো। তারপর নিজের চেয়ারে বসল। নিরবতা ভেঙে আফতাব বলে উঠল,’তুমি আমাদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছো শায়ের। আমাদের সাথে কাজ করে আমাদেরই বিরুদ্ধে গেছো। এখন তুমি বলো এটা কেন করলে?’
-‘আমি বিশ্বাসঘাতকতা করিনি। আপনারাই নিজেদের মুখোশ খুলে সামনে এসেছেন। কেন আমাকে না জানিয়ে পরীজান কে এখানে নিয়ে এসেছেন আপনারা? কেন সব সত্য জানিয়েছেন? এখানে আমার কোন হাত ছিলো না।’
-‘তার কারণ তুমি খুব ভাল করেই জানো।’
ভারি হয়ে উঠলো শায়েরের কন্ঠস্বর। মৃদু চেঁচিয়ে বলে উঠল,’আমি বলেছিলাম না যে আমার স্ত্রীর থেকে দূরে থাকবেন। তার কোন ক্ষতি করার চেষ্টা করবেন না। আমি তো তাকে নিয়ে ভালোই ছিলাম। তাহলে আপনাদের এতো সমস্যা কোথায়?’
শায়েরের কথায় নওশাদ ও চিৎকার করে,’গলা নামিয়ে শায়ের। তুমি নিজেই পরীকে মা*রার প্রতিশ্রুতি দিয়ে বিয়ে করেছিলে। তাহলে তুমি মা*রলে না কেন?’
-‘তুমি আমি কেউই ভাল মানুষ নই। তাই আমার প্রতিশ্রুতি সত্যি ভেবে তুমি ভুল করেছো। আমি নই।’
-‘তাহলে এখন কি হবে? পরী তো আমাদের মা*রতে মরিয়া হয়ে উঠবে।’
শায়ের হাসলো,’একটা মেয়ের ভয়ে এতো কাবু তুমি?’
-‘পরী কতোটা ভয়ানক তা তুমি জানো শায়ের। পরী চাইলে তোমাকেও মা*রতে পারে।’
-‘আমি সেই মৃত্যু হাসিমুখে বরণ করে নেবো।’
এবার আখির মুখ খুলল,’তুমি পারলেও আমরা পারবো না। তুমি যাই বলো না কেন নিজেকে বাঁচাতে যদি পরীকে শেষ করতে হয় তাহলে আমরা তাই করবো।’
-‘আমার পরীজানের গায়ে একটা টোকাও আমি পড়তে দিবো না। প্রয়োজনে শতশত লা*শ পড়বে।’
-‘তাহলে আমরা কি করব? কবিরের মতো জীবন দেব?’
-‘আপনাদের রক্ষা করার দায়িত্ব আমি নিলাম। আপনাদের কোন ক্ষতি আমি হতে দিব না। তারপরও পরীজানের কোন ক্ষতি আপনারা করবেন না।’
নওশাদ তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল,’বড়ই অদ্ভুত প্রেমিক তুমি শায়ের। তোমার স্ত্রী আমাদের মা*রতে
চায় আর আমারা তোমার স্ত্রীকে। মাঝে তুমি ঢাল হয়ে দাঁড়াবে। এর পরিণতি কি হতে পারে ভাবতে পারছো? পারবে পরীর সাথে লড়াই করতে?’
শায়ের জবাব দিল না। বের হয়ে গেল সেখান থেকে।
নওশাদ বলল,’দেখছেন কেমন দাম্ভীকতা দেখালো? ইচ্ছা করছে ওকেও শেষ করে দেই।’
-‘নাহ,তা করা যাবে না। শায়েরের কাছে এমন প্রমাণ আছে যা আমাদের পতনের একমাত্র উপায়।’
আফতাবের কথায় বিরক্ত হলো নওশাদ বলল,’ও জীবিত থাকলে তো আমাদের ফাসাবে।’
-‘এমনি এমনি তোমাকে মূর্খ বলি না আমি। তোমার থেকে দ্বিগুণ বুদ্ধি শায়েরের। শায়ের খুব ভাল করেই জানে আমাদের কার্যসিদ্ধি হলেই আমরা লোকদের মে*রে ফেলি। শায়ের ও নিস্তার পেতো না। তাই সব কিছু তৈরি রেখেছে সে। ওর মৃত্যু হলেও সব প্রমাণ প্রকাশ্যে আসবে।’
নওশাদ চুপ করে গেল। আখির বলল,’পরীকে ছাড়লে চলবে না। আমি জানি পরী থেমে থাকবে না। শায়েরের উপর আমার এতটুকুও বিশ্বাস নেই।’
-‘তাহলে আমাদের পরিকল্পনা সাজিয়ে পরীকে মা*রতে হবে। শায়ের যেন টের না পায়। যদি শায়ের জানতে পারে তাহলে সে আমাদের ছাড়বে না।’
নওশাদ আখির আর আফতাব নিজেদের মধ্যে আলোচনা করতে লাগল।
শায়ের ঘরে ঢুকতেই পরীকে দেখতে পেলো। হাতে তার একটা ছু*রি। সেটাকেই পরী গভীর ভাবে দেখছে। হাত ঘুরিয়ে পরিচর্যা করছে কীভাবে এটা চালাবে সে। শায়ের কে দেখে হাত থেমে গেল ওর। এগিয়ে এসে শায়েরের সামনে দাঁড়িয়ে বলে,’কি কাজ করে এলেন? আমাকে মা*রার নতুন কোন পরিকল্পনা করেছেন কি?’
মৃদু হাসে শায়ের,’আপনি তো সব শুনেছেন তাহলে আবার জিজ্ঞেস করছেন কেন?’
কথা বলল না পরী। ভাবলো শায়ের কি কোনভাবে ওকে দেখে ফেলেছিল? পরী ওদের কথা লুকিয়ে শুনছিল। শায়ের দেখলো কীভাবে?
-‘আপনার উপস্থিতি আমি চোখ বন্ধ করে বুঝতে পারি। আপনার শরীরের প্রতিটা লোমের সাথে আমি পরিচিত। কখনোই আমার থেকে নিজেকে লুকাতে পারবেন না।’
-‘আমার বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়,যে মানুষ টা এতো ভালোবাসতে পারে সে কি করে প্রাণ নিতে পারে?’
-‘ভালোবাসা মানুষ কে সব করাতে পারে।’
কথাটার বলে আরেকটু কাছে এলো শায়ের। পরীর যে হাতে ছু*রি সে হাতটা উঁচু করে ধরে বলে,’আপনি ঠিক এই ছুরির মতো ধারালো পরীজান। আমার হৃদয়ে গেঁথে আছেন। সেই ধারালো ছু*রির ফাঁক গলিয়ে চুয়ে পড়ছে আমার ভালোবাসা। যা শুধু আপনার জন্য বরাদ্দ। না পারছি আপনি নামক ছু*রিটা বের করতে আর না পারছি ধরে রাখতে। বুকে থাকলে ব্যথা হয় আর বের করে দিলেই মৃ*ত্যু।
এখন আমার করণীয় কি পরীজান? আমার যে খুব কষ্ট হচ্ছে।’
হাত থেকে ছুরিটা আপনাআপনিই পরে গেল। উৎকন্ঠা হয়ে পরী বলে,’আমাকে দূর্বল করার চেষ্টা করবেন না। আমি কঠোর হতে চাই। আমি তাদের শেষ করতে চাই যারা আমার শ*ত্রু। আমি জানি আপনি এর মাঝে আসবেন। তবে একটু সাবধানে থাকবেন।’
-‘আপনি তো বললেন আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইলে তিনি ক্ষমা করবেন। আমরা দূরে কোথাও গিয়ে আল্লাহর কাছে আর্জি জানাই?’
-‘বারবার একই কথা বলছেন কেন? আমি তো আপনাকে বলেই দিয়েছি আমি কোথাও যাবো না। প্রতিশোধ না নিয়ে আমি যাবো না।’
শায়ের থামলো। এসব নিয়ে আর কথা বলল না। সে কিছুক্ষণ পর বলে উঠল,’আপনাকে একবার জড়িয়ে ধরব পরীজান? অনেক তৃষ্ণা পেয়েছে আপনাকে আলিঙ্গন করার।’
পরী শায়েরের বুকে মাথা রাখে। আর শায়ের স্ত্রীকে জড়িয়ে ধরে নিজের তৃষ্ণা মেটায়। এ যেন বহুক্ষণের পিপাসা।
-‘আমার হাতে যদি ছুরি থাকতো আর সেটা যদি আপনার বুকে গেঁথে দিতাম তাহলে কেমন হতো মালি সাহেব?’
-‘সেটা আমার পরম সৌভাগ্য হতো পরীজান। আপনাকে বুকে নিয়েই দুনিয়া ত্যাগ করতে চাই আমি।’
-‘আর আমি আপনাকে এই দুনিয়া আরও দেখাতে চাই।’
আর কেউ কোন কথা বলল না। অনুভূতির সাথে মিশে গেল দুজনে। একদিকে ভালোবাসা আরেক দিকে প্রতিশোধ! কীভাবে সামলাবে পরী? আর শায়ের!! খারাপ মানুষ গুলোকে বাঁচাতে গিয়ে ওর কি হবে? পরী যদি নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে না পারে? যদি সে শায়ের কে আঘাত করে? যতোই সে শায়ের কে দূরে সরিয়ে দিক না কেন,শায়ের ছাড়া পরী অচল।
নিষ্ঠুর এই নিয়তি ওদের জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিলো। আলাদা করে দিলো দুজনকে। সময় কাকে কোথায় নিয়ে দাঁড় করাবে তা কেউই জানে না। কার ভাগ্যে কি আছে তাও জানে না। তবে শুধুমাত্র প্রার্থনার মাধ্যমেই মানুষ নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তন করতে পারে।
রুপালি পিকুলকে কোলে নিয়ে উঠোনের এক কোণে বসে আছে। খুশি গ্রাস করে নিয়েছে এক অজানা কালো মেঘ। যার দরুন হাসি নেই কারো মুখে। তখনই অন্দরের দরজা পেরিয়ে একজন যুবক প্রবেশ করল। তাকে দেখেই কেঁপে উঠল রুপালির সর্বাঙ্গ। পিকুলকে শক্ত করে ধরে সেই পুরুষের দিকে তাকিয়ে রইল সে। পুরুষটি রুপালির নিকটে এসে বলল,’কেমন আছো রুপালি?’
ঈষৎ কেঁপে উঠল রুপালি। কতদিন পর এই কন্ঠস্বর সে শুনতে পেলো! সিরাজের চোখে চোখ রেখে দাঁড়াল রুপালি। কম্পিত কন্ঠে বলল,’ভাল। আপনি কেমন আছেন?’
সিরাজ হেসে বলে,’ভাল। তোমার ছেলে?’
পিকুলের দিকে তাকিয়ে রুপালি বলে,’হুম।’
-‘দেখতে তোমার মতোই হয়েছে। গায়ের রঙ ও তোমার মতোই সুন্দর।’
-‘এতোদিন পর কি মনে করে এলেন? সেই যে গেলেন তারপর আর তো দেখা দিলেন না।’
-‘জীবনের সবকিছু চলে যাওয়া মানেই তো জীবন যাওয়া। তাহলে দেখা দেই কীভাবে বলো?’
-‘তাহলে আজ দেখা দিলেন যে?’
-‘জানি না কেন এসেছি!! তবুও এসেছি।’
দোতলায় দাঁড়িয়ে পরী রুপালি আর সিরাজকে দেখছে। ভাবছে ওদের মিল হলে কত না সুন্দর হতো।
কবির নামক খারাপ মানুষের সাথে জীবন জড়াতো না রুপালির। এখন রুপালি সম্পূর্ণ একা। সবাই থেকেও নেই।
সেই মুহূর্তে শায়ের ওর পেছনে এসে দাঁড়াল। সিরাজ কে দেখে খানিকটা অবাক হয়ে বলে উঠল,’সিরাজ!
এখানে কেন?’
পরী পেছন ফিরে তাকালো বলল,’মনে হয় আপার সাথে দেখা করতে এসেছে।’
-‘ভুল ভাবছেন আপনি পরীজান।’
ভ্রু কুঁচকালো পরী,’ভুল ভাবছি মানে?’
-‘সব যখন জেনেছেন তাহলে এটুকু অজানা থাকবে কেন? সিরাজের থেকে আপনার বোনকে দূরে রাখুন।
এখন আপনার সাথে বিপদ অন্দরের সবার। তাই যথাসম্ভব অন্দরে থাকার চেষ্টা করুন সবাই।’
-‘কি বলতে চাইছেন আপনি? সিরাজ ভাইও!!’
-‘সেও আমার মতোই আপনার বাবার সাথে কাজ করত। বাকিটা আপনি বুঝে নিন।’
পরী ঘাড় ঘুরিয়ে সিরাজের দিকে তাকালো। বিশ্বাস হলো না ওর। কিন্ত শায়ের তাকে মিথ্যা বলেনি। সিরাজ ও ছলনার আশ্রয় নিলো! পরী এতে খুব বেশি অবাক হলো না। তবে ওর ভয় হলো রুপালিকে নিয়ে।
#চলবে,,,,
#পরীজান
#পর্ব ৪৫
#Ishita_Rahman_Sanjida(Simran)
❌কপি করা নিষিদ্ধ ❌
কুসুম আর শেফালি মিলে কিছু একটা নিয়ে আলোচনা করছে। দুজনেই ভয়ে জীর্ণশীর্ণ হয়ে আছে। কথা বলতেও তাদের গলা কাঁপছে। ওরাও জমিদার বাড়ির এই পরিণতি মানতে পারছে না। কখনও ভাবেও নি এসব ব্যাপারে। যেদিন আফতাব জেসমিনের গায়ে হাত তোলে ওইদিনই সব পরিষ্কার হয় ওদের কাছে। আফতাবের মুখোশ উন্মোচন হয় সকলের সামনে। কিন্ত ওদের তো করার কিছু নেই। ওদেরও প্রাণ সং*শয়ে। কখন জানি আবার মৃ*ত্যুর খেলা শুরু হয়ে যায়!
পরী জেসমিনের ঘর থেকে বের হয়ে নিজ ঘরে যাচ্ছিল। পথে কুসুম আর শেফালির কথোপকথনে থেমে যায়। এগিয়ে যায় ওদের কাছে,’কি হয়েছে কুসুম?’
কুসুম চট করেই জবাব দিলো,’কিছুনা আপা।’
-‘আমার থেকে কিছু লুকাবি না। তাহলে তোদেরই বিপদ। এই বাড়িতে একমাত্র আমিই তোদের সুরক্ষা দিতে পারব। বল কি হয়েছে?’
শেফালি বলা শুরু করে,’সবাই সবার আসল রূপ দেখাইছে আপা। ওই নচ্ছার বেটা এহন সুযোগ লইয়া আমার গায়ে হাত দেয়। আমি ডরে কিছু কইতে পারিনা আপা।’
-‘কে নওশাদ?’
-‘হ আপা।’
রাগ হওয়ার পরিবর্তে পরীর মুখে হাসি ফুটল। মাথায় যেন মুহূর্তেই বুদ্ধি খেলে গেল। পরীকে এভাবে হাসতে
দেখে চমকে গেল ওরা দুজনে। কুসুম জিজ্ঞেস করে, ‘কি হইলো আপা আপনের?’
-‘তোরা দুজনেই পারবি আমার উদ্দেশ্য সফল করতে। পারবি তো?’
দুজনের একজনও কিছু বলে না এমনকি কিছু বোঝেও নি পরীর কথা। পরী আবার বলে,’কুসুম শেফালি তোদের যা বলব তোরা তাই করবি। ওই নর*পিশাচদের দুনিয়া থেকে বিদায় করার জন্য তোরা থাকবি না আমার সাথে?’
-‘আপনে সাহসি আপা। ত*লো*য়া*র চালাইতে আপনে পারবেন কিন্ত আমরা তো পারমু না। ওগো সামনে গেলেই ডর করে।’
পরী কুসুমের বাহু ধরে বলে,’মৃ*ত্যু*র ভয় করলে ওরা বারবার মৃ*ত্যু*র ভয় দেখাবে। তোকে দূর্বল করে দেবে। সাহস রাখতে হবে কুসুম। তোকে ত*লো*য়া*র
চালাতে হবে না। শুধু আমার কথামতো কাজ করবি।’
দুজনেই রাজি হলো পরীর কথায়। পরীও খুশি হলো। দৌড়ে চলে গেল নিজ ঘরে। সোনালীর ঘরের চাবি নিয়ে সেদিকে ছুটলো। বহুদিন পর সোনালীর ঘরের তালা খুলল পরী। ঘরের আনাচে কানাচে মাকড়সার জালে ভর্তি হয়ে গেছে। বন্ধ থাকার কারণে ভ্যাপসা গন্ধ বের হচ্ছে। পুরো ঘরে চোখ বুলায় পরী। বিশাল বড় পালঙ্ক ঘরের অর্ধেক দখল করে আছে। আলমারি,টেবিল চেয়ার একপাশে পড়ে আছে। ধুলো
জমে আছে প্রতিটা আসবাবপত্রে। নিজের ঘরটা বেশ সুন্দর করে সাজিয়ে রাখতো সোনালী। ব্যক্তিগত কিছুতেই কাউকে হাত দিতে দিতো না সে। আজ সেই ঘরটার এই অবস্থা। পরী আলমারি খুলে দেখলো বোনের পোশাক গুলোতে ইঁদুরের বাচ্চারা ছুটোছুটি করছে। ওরা যেন উঠে পড়ে লেগেছে সোনালীর স্মৃতি নিশ্চিহ্ন করতে। পরী বন্ধ করে দিলো আলমারি। তারপর উঁকি দিলো পালঙ্কের নিচে। বড় একটা টিনের বাক্স বের করলো। ঢাকনা খুলতেই বাতাসে তার ভেতরের কাগজগুলো চারপাশে ছড়িয়ে পড়ল। লেখাগুলো সোনালীর নয় রাখালের। তার দেওয়া চিঠিগুলো যত্ন করে রেখেছে সোনালী। কিন্ত চিঠির প্রায় জায়গা কেটে ফেলেছে ইঁদুরগুলো। পরী বাক্স হাতড়ে কাপড় পেচানো একটা বস্তু বেরে করলো। সপ্তবর্ণে কাপড় সরাতেই সেটি মৃদু আলোয় চকচক করে ওঠে। হাতের ত*লো*য়া*র খানা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ভাল করে দেখে। বহুদিনের পুরনো ত*লো*য়া*রে থেকে থেকে মরিচা ধরেছে। তাই পরী তাতে শান দিতে নিচে নিয়ে গেল। পাথরে ঘষে ঘষে ত*লো*য়া*রে ধার দিচ্ছে পরী। সেই শব্দে মালা আর রুপালি ঘর থেকে বের হয়ে এলো। এমতাবস্থায় মেয়েকে দেখে মালা এগিয়ে গিয়ে বললেন,’কি করস পরী তুই?’
-‘শত্রু থেকে রক্ষা পেতে হলে অ*স্ত্র প্রয়োজন।’
মালা বসে পড়ল মেয়ের পাশে। আতঙ্কিত হয়ে বলে, ‘আমি বড় মাইয়াডারে হারাইছি। তুই কি চাস তোরেও হারাই আমি?’
পরীর হাত থেমে গেল,চোখ তুলে সে মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল,’আপনার মেয়ে শহীদ হলে আপনার মাথা সবার সামনে উঁচু হবে আম্মা। এতে কষ্ট পাওয়ার কিছু নেই।’
-‘তুই একটু থাম পরী।’
-‘ভয় পাবেন না আম্মা। শয়তানের শাস্তি না দিয়ে আমি মরব না।’
মালা চোখের জল ফেলেন। অন্দরের দরজা খোলার আওয়াজে পরীসহ সবাই সেদিকে তাকায়। আফতাব কে ভেতরে আসতে দেখে উঠে দাঁড়ায় পরী। পা চালিয়ে উঠোনে এসে বলে,’কোন সাহসে অন্দরে এসেছেন?’
-‘সাহস আছে বলেই এসেছি। আমার বাড়ি আমি যখন খুশি তখন আসবো।’
পরী হাসল বলল,’ভেতরে আসলে প্রাণ নিয়ে ফেরা মুশকিল হবে আপনার পক্ষে। তাই যেভাবে এসেছেন ঠিক সেভাবেই ফিরে যান।’
আফতাব গর্জন করে বলে,’এতো সাহস আসে কোথা থেকে তোর? আমার মুখের উপর কথা বলিস? মালা!!’
কেঁপে উঠলেন মালা। আফতাব এবার তার উপর অত্যাচার করবেন নিশ্চিত হলো মালা। আঁচলে মুখ ঢেকে কাঁদতে লাগলেন তিনি। আফতাব বলল,’তোমার মেয়ের সাহস বেড়েছে বুঝলাম। ওর কি জানের মায়া নাই? না নিজের মায়ের প্রতি ভালবাসা নাই?’
-‘খবরদার আমার আম্মার গায়ে হাত দিবেন না। এক আম্মাকে ঘরে ফেলে রেখেছেন কিছু বলিনি। এবার চুপ থাকব না। আপনার হাত হাতের জায়গাতে থাকবে না বলে দিলাম। ত*লো*য়া*র চালাতে আমি জানি!!’
-‘চুপ থাক পরী। অনেক হয়েছে,শুধু শায়েরের জন্য তোকে বাঁচিয়ে রেখেছি। তোকে তো তাড়াতাড়ি শেষ করে দেব।’
পরী গলা উচিয়ে বলে,’বের হন অন্দর থেকে নয়তো লা*শ পড়ে যাবে।’
পরীর চিৎকারে শায়ের সেখানে উপস্থিত হয়েছে। তবে পরীকে সে থামালো না। আফতাব শায়ের কে বকতে লাগল। কারণ শায়েরের জন্যই পরী বেঁচে আছে। আর এখন বাঘিনী হয়ে উঠেছে পরী। যখন তখন থাবা মারতে পারে। পরী বলল,’সবাই শুনে রাখো আজকের পর থেকে আমার অনুমতি ব্যতীত অন্দরে পুরুষ প্রবেশ নিষেধ। কোন পুরুষ আসতে পারবে না। সে যদি আমার স্বামীও হয় তাও না।’
কথাটা বলে আফতাবের দিকে কঠোর দৃষ্টিতে তাকালো পরী। সে দৃষ্টি এতোটাই ধারালো ছিল যে আফতাবের সর্বাঙ্গে অদৃশ্য ক্ষতের দেখা দিলো। কিছু না বলে সে অন্দর থেকে প্রস্থান করে। শায়ের কিছু পল পরীকে দেখে চলে গেল। পরীর হুকুমে কুসুম দরজা বন্ধ করে দিলো।
প্রথম পরিকল্পনা সম্পন্ন হলো। পরী এটাই চেয়েছিল।পরীর আসল উদ্দেশ্য শায়ের কে অন্দর থেকে সরানো। অতি চতুর শায়ের পরীর পরিকল্পনা বুঝতে সময় নেবে না। তাই আফতাবের সাথে সাথে শায়েরের আসাও বন্ধ করে দিয়েছে। পরী শেফালিকে ডাকল। শেফালি আসতেই সে বলল,’যা বলেছি মনে আছে তো?’
মাথা নাড়ে শেফালি। পরী আবারও নিজের কাজে মন দেয়। ঘষে ঘষে চকচকে করে ত*লো*য়া*র টা।
যেটা সূর্যের আলোতে চিকচিক করে ওঠে। এটাই পরীর শেষ হাতিয়ার যেটা দিয়ে পরী শত্রুদের দমন করতে পারবে।
সিরাজ আর নওশাদ বসে আছে বৈঠকে। আফতাব রেগে আখিরের সাথে বের হয়ে গেছে। শায়েরের দেখাও নেই। আপাতত ওরা দুজন বসে আছে। নওশাদ বলে উঠল,’অনেক দিনের সফর শেষে আসলে। তা ব্যবসা কতদূর?’
সিরাজ আড়মোড়া ভেঙে বলে,’আরে ভাই কত কিছু দেখলাম কিন্ত সোনালীর মতো কাউকেই পেলাম না।’
দুজনে একসাথেই হাসলো। নওশাদ বলল,’আমি কিন্ত ভাই তোমার নাম পরীকে বলিনি। সব চেপে গেছি। যাতে তোমার উপর পরীর একটু বিশ্বাস থাকে।’
-‘আরে আস্তে বলো। পরীর কানে গেলে সব শেষ। যাই হোক আমার এখানে বেশিক্ষণ থাকা চলবে না। পরীর সন্দেহ হবে।’
ওদের কথার মাঝখানে শেফালির আগমন ঘটলো। সিরাজের জন্য নাস্তা এনেছে সে। শেফালিকে দেখে ওরা চুপ করে যায়। চোখের ইশারায় একে অপরকে সতর্ক করে। শেফালি চলে যেতে গিয়েও থেমে যায়। নওশাদ কে দেখে ঘৃণা হচ্ছে ওর। আজ সকালেই কু প্রস্তাব রাখে নওশাদ। শেফালি পরিমরি করে নওশাদের থেকে পালায়। ভয় করছে শেফালির কিন্ত পরীর কথা মনে আসতেই সাহস পেল সে। হঠাৎই নওশাদের পা ধরে বসে পড়ল শেফালি। কাঁদতে কাঁদতে বলল,’আমারে মারবেন না ভাই!! আমি আপনের সব কথা শুনব। দরকার পড়লে অন্দরের সব খবর দিমু। তাও আমারে মারবেন না। আমার ডর
করে অনেক। মারবেন না আমারে!’
শেফালির কান্না দেখে ভড়কে গেল নওশাদ। বোঝার চেষ্টা করল শেফালির মতলব। নওশাদ পা ঝারা দিয়ে বলে,’পা ছাড় আমার। তোর মতলব আমি বুঝি না ভেবেছিস? আমি জানি এসব পরী তোকে শিখিয়ে পাঠিয়েছে।’
-‘আল্লাহ গো ভাই কন কি?? আমার কি পরী আপার মতো সাহস আছে? জানের মায়া হের না থাকলেও আমার আছে। আমি বাঁচতে চাই ভাই। আপনে বড় কর্তারে কইলেই হেয় হুনব। ভাই আমারে রক্ষা করেন। তার লাইগা আমারে যা কইবেন তাই করমু।’
নওশাদ সন্দেহের দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ শেফালির দিকে তাকিয়ে রইল তার পর বলল,’আচ্ছা তুই এখন যা। যখন বলব তখন আসবি। পরী কি করে না করে সব বলবি এসে!!’
শেফালি দৌড়ে চলে গেল। নওশাদ বিশ্রী গালি দিলো শেফালিকে। সে বিশ্বাস করেনি শেফালির কথা। সে সিরাজ কে উদ্দেশ্য করে বলে,’মা** ঢেমনা আছে। ভেবেছে ওর কথা বিশ্বাস করে বসে আছি। যতসব ফকিরের দল।’
সিরাজ মাথা ঝুকে আস্তে করে বলে,’ওদের থেকেও সাবধান থেকো। কখন কি করে বসে কে জানে? আমি আসি আজ। সময় হলে ঠিকই আসব।’
সিরাজ চলে গেল। নওশাদ রয়ে গেল। এখানে পরী ওকে কিছু করতে আসবে না। বৈঠকে কয়েক জন রক্ষি আছে। পরী এখানে আ*ক্র*ম*ণ করতে পারবে না। তবুও আতঙ্কে থাকে নওশাদ। ভয়ে ঘুমাতে পারে না। কবিরকে সে বারবার স্বপ্নে দেখে। বিভৎস সেই চেহারাটা চোখের সামনে ভাসে ওর। এতদিন কোন ভয় ছিল না ওর। সেদিন পরীর হ*ত্যা*কাণ্ড দেখে ভয়ে আছে সে। তাই সবসময় সতর্কতা অবলম্বন করে। এমনিতেই সে পঙ্গু। ওকে মা*রতে পরীর এতটুকু শক্তির প্রয়োজন হবে না। তাই সর্বদা রক্ষী দের সাথে রাখে সে।
শেফালি অন্দরে ফিরে গিয়ে সব বলে দিল পরীকে। পরী জানতো নওশাদ এতো সহজে শেফালির কথা বিশ্বাস করবে না। তাই কীভাবে নওশাদ কে সব বিশ্বাস করাবে তাও ভেবে নিয়েছে পরী। এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা। এমন সময় রুপালির কন্ঠস্বর ভেসে আসে। সে ডাকছে পরীকে। তাই শেফালির সাথে দ্রুত কথা শেষ করে পরী রুপালির কাছে গেল।
বিধ্বস্ত অবস্থায় বসে আছে রুপালি। দেখে মনে হচ্ছে বহুক্ষণ অশ্রু বিসর্জন দেওয়ার জন্যই এই অবস্থা হয়েছে মেয়েটার। পরী নিঃশব্দে বোনের পাশে বসে বলল,’কি হয়েছে আপা?’
মুহূর্তেই চোখমুখ শক্ত করে নিল রুপালি। রাগে লাল হয়ে এলো ফর্সা চেহারাখানা। বোনের হঠাৎ রেগে যাওয়ার কারণ বুঝতে পারে না পরী। তবে কিছু জিজ্ঞেস ও করে না। যা বলার রুপালি নিজ থেকেই বলবে। নিজেকে যথাসম্ভব ধাতস্থ করে রুপালি বলে,’অনেক হয়েছে পরী আর না। আমি একজনকে নিজ হাতে খু*ন করতে চাই। তুই দিবি তোর ত*লো*য়া*র টা? আমি তাকে মে*রে আবার তোকে ফিরিয়ে দেব!’
-‘কাকে মা*র*বে আপা? কি হয়েছে তোমার?’
-‘বড় আপার আরেক খু*নি যার নাম তোর অজানা পরী।’
-‘কে সে?’
-‘সিরাজ!! আমাকে ঠকিয়েছে সিরাজ। ভালোবাসার ছলনায় আমাকে ফেলেছে পরী। সেইদিন কাকার সাথে হাত মিলিয়ে সিরাজই আমাকে শশীলের হাতে তুলে দিয়েছিল। সিরাজ বড় আপাকে পছন্দ করতো। তাই আপা মরার পর নওশাদ আর কবিরের সাথে সেও,,,’
কথা শেষ না করে ফুপিয়ে কেঁদে ওঠে রুপালি। ঘৃণায় গা গুলিয়ে আসছে ওর। পরী অবাক হলো। তাহলে নওশাদ ওকে একটা মিথ্যা কথা বলেছে। ওদের সাথে সিরাজ ও ছিলো। সে বোনকে বলে,’কেঁদো না আপা শক্ত হও। আমার ভালো লাগছে তোমার কথা শুনে। সিরাজ কে আমি তোমার হাতে ছেড়ে দিলাম। নিজের ক্ষোভ মেটাও। তবে আমি ঠিক যেভাবে বলব সেভাবেই করবে সব।’
-‘কিন্তু পরী আমার পিকুলের কি হবে? এতটুকু বাচ্চা!
আমার যদি কিছু হয়ে যায় তাহলে ওকে কে দেখবে?’
-‘সেই চিন্তা তুমি করো না। আমি শীঘ্রই ওর একটা ব্যবস্থা করব। তুমি শুধু তোমার ভেতরে রাগ জন্ম দাও। দেখবে শত্রুদের প্রতিহত করতে পারবে। আর ভয় পাবে না।’
রুপালির ঘর ত্যাগ করে পরী। ওর ভিশন খুশি লাগছে আজ। পরী ভেবেছিল সিরাজের আসল চেহারা সামনে এলে রুপালি নিজেকে সামলে নিতে পারবে না। কিন্ত রুপালি যে এভাবে নিজেকে সামলে নিবে তা পরী কল্পনাও করেনি। সবাই মিলে একসাথে কাজ করলে সফল হওয়া সম্ভব।
পরেরদিন সকাল বেলা। কুসুম ভয়ে ভয়ে পা রাখে বৈঠকে। পিঠা আর শরবত দিয়ে আসে সবাইকে। ওই
খারাপ লোকগুলোর সামনে গেলে মনে হয় এই বুঝি ঝাঁপিয়ে পড়বে ওদের উপর। তাই সে দৌড়ে পালিয়েছে। শায়ের বাদে সকলেই উপস্থিত সেখানে। নওশাদ যেই না শরবত খেতে যাবে তখনই শেফালি চিৎকার করে বলে,’শরবতে বিষ মেশানো আছে কেউ খাইয়েন না!!’
#চলবে,,,,
#পরীজান
#পর্ব ৪৬
#Ishita_Rahman_Sanjida(Simran)
❌কপি করা নিষিদ্ধ ❌
স্টিলের গ্লাসটা সশব্দে পড়ে গেল হাত থেকে। নড়েচড়ে ভিত চোখে তাকালো শেফালির পানে। তারপর পড়ে যাওয়া গ্লাসের দিকে তাকালো। তখনই একটা বিড়াল মিঁয়াও বলে সামনে দিয়ে দৌড় দিলো। ভয়ে আত্মা কেঁপে উঠল নওশাদের। সে খেয়াল করলো তার গলা শুকিয়ে এসেছে আর ঘামছে। শেফালি ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে আছে। উপস্থিত সবাই তার দিকে তাকিয়ে। আফতাব বললেন,’শরবতে বিষ!! কে বলল তোকে?’
শেফালি কাচুমাচু করে সামনে এসে দাঁড়াল,’বড় কর্তা আমি কুসুম রে দেখছি বিষ মিশাইতে।’
-‘দেখছেন ভাই আপনার মেয়ে এখনই আমাদের মা*রার পরিকল্পনা সেরে ফেলছে। শেফালি না বললে তো আমরা শরবত খেয়েই ম*রে যেতাম।’
আখির কথাটা আফতাব কে উদ্দেশ্য করে বলে। এতে চুপ থাকে আফতাব। কিছুক্ষণ ভেবে বলে,’সত্যি তো শরবতে বিষ মেশানো আছে?’
শেফালি চটপচ উত্তর দিলো,’হ,আমি নিজের চোক্ষে দেখছি। পরী আপার কথায় তো কুসুম এই কাম করছে। আপার যেই রাগ। কথা না হুনলে আমাগো মা*ইরা ফালাইতে পারে। কি করমু কন?’
-‘তুই এখন যা।’
-‘বড় কর্তা আমি আপনাগো কইছি আপা যেন না জানে। তাইলে আমারে জানে মাইরা ফালাইব।’
-‘আচ্ছা বলব না। তুই যা,আর পরী যা করে সব এসে আমাদের বলবি।’
শেফালি মাথা নেড়ে চলে গেল। আফতাবের মুখ গম্ভীর। সে একজন রক্ষিকে দিয়ে শায়েরের কাছে খবর পাঠালো।
-‘ভাই তাড়াতাড়ি পরীর একটা ব্যবস্থা না করলে হবে না।’
-‘ভুলটা আমারই হয়েছে। সেদিন সোনালীকে না মা*রলে এসব হতো না। পরীও এত ভয়ানক হয়ে উঠতো না।’
-‘কিন্ত ভাই সোনালী তো আপনাকেও মারতে চাইতো।
তাহলে আজ পরী আর সোনালী এক হয়ে আমাদের আ*ক্র*ম*ণ করতো।’
আফতাবের মাথা কাজ করছে না। সত্য লুকানো খুবই কঠিন। দশ হাত মাটির নিচেও যদি সত্য কে লুকিয়ে রাখা হয় একদিন না একদিন সবার সামনে আসবেই। সে চেয়েছিল নিজের সব অপকর্ম লুকিয়ে রাখতে। কিন্ত লুকাতে পারে না। সর্বপ্রথম জানতে পারে মালা। তখন সোনালী দুই বছরের শিশু। স্বামীর অপকর্মের কথা জানতে পেরে ভেঙে পড়েন তিনি। অনুরোধ করে আফতাব যেন এই অপকর্ম থেকে ফিরে আসে। কিন্ত খারাপ মানুষের ভালো হওয়া কি সহজ? যেখানে আফতাবের পূর্ব পুরুষদের রক্তে মিশে আছে খা*রাপ কাজ। আফতাব ও পারেনি ফিরে আসতে। তাকে কালো ব্যবসা শিখিয়েছিলেন তার দাদা। ছোট থেকেই হাতে ধরে ধরে সব শেখাতেন। ছোট বয়সেই নর্তকিদের সামনে হাজির করাতো। তখন থেকেই লালসা আফতাবের রন্ধ্রে রন্ধ্রে মিশে আছে। তবে পরিবার পরিচালনার জন্য বিয়ে করতে হয় তাকে। মালার সৌন্দর্য দেখেই আফতাব মুগ্ধ হয়েছিল। তারপর বিয়ে। ভালোই কাটছিল সব, কিন্ত যখন মালা সব জেনে গেল তখনই আফতাবের অবহেলা দেখতে পেল মালা। একে একে মুখোশ উন্মোচন হলো সবার। তখন মালার পাশে দাঁড়িয়েছিল আবেরজান। তিনি মালাকে সব বিপদ থেকে রক্ষা করেছেন।
কিন্ত কেউই প্রতিবাদ করেনি। বহুবছর পর সোনালী বাবার করা অ*ন্যায়ের প্রতিবাদ করে। বাবা হলেও সে অ*প*রা*ধী। শাস্তি তার প্রাপ্য। তবুও সে বাবাকে বারণ করে। ফিরে আসতে বলে এসব অপকর্ম থেকে।
আফতাবের কোন হেলদোল নেই। তবুও সোনালী চুপ ছিল। কিন্ত আফতাব যখন রাখালের সাথে তার সম্পর্ক জানতে পেরে রাখালের দিকে হাত বাড়ায়। তখন সোনালী হুমকি দেয় আফতাব কে,যে সে সব সত্য সবাইকে বলে দেবে। মূলত সোনালী রাখালের সাথে আগে পুলিশের কাছে যেতে চেয়েছিল তারপর ওরা পালিয়ে যেতো। কিন্ত বিপত্তি ঘটে যায় পথেই।
এখন আবার সেই ঘটনার পুনরাবৃত্তি করছে পরী। কিন্ত পরী সোনালীর থেকেও ভয়ানক। র*ক্ত যেন ওর নেশা। শায়ের আসতেই সবার দৃষ্টি সেদিকে গেল। আফতাব বললেন,’তোমার কথা রাখা কঠিন শায়ের। পরী আজ আমাদের মারতে চেয়েছিল। এখন তুমিই বলো কি করবে?’
শক্ত কন্ঠে শায়ের জবাব দিলো,’আমার পরীজানের কিছু করতে আপনারা পারবেন না। যতক্ষণ আমার দেহে প্রাণ আছে।’
-‘তাহলে আমরা মরব নাকি?’
-‘আল্লাহ যেভাবে যার মৃ*ত্যু লিখেছেন তার মৃ*ত্যু সেভাবেই হবে। এতে ঘাবড়ানোর কি আছে? নিজেদের রক্ষা করতে শিখুন।’
-‘তোমার যুক্তি তোমার কাছেই রাখ শায়ের। আমরা আর বসে থাকব না। দেখি পরীকে তুমি কীভাবে বাঁচাও?’
আফতাব উঠে চলে গেল। শায়ের কিছু না বলে বৈঠকে নিজের বরাদ্দ ঘরটাতে চলে গেল। তার একটুও ভাল লাগছে না। কাল সারারাত সে ঘুমাতে পারেনি। পরীকে ছাড়া এই প্রথম রাত তার। শ্বাস রুদ্ধকর লাগছে ওর। কারো সাথে কথা বলতেও ইচ্ছা করে না। সকাল থেকে তাই শায়ের চুপচাপ ছিল। বুকের তৃষ্ণা বাড়ছে,পরীকে একবার সে চোখভরে দেখতে চায়। খোদা যেন ওর কথা শুনেছে। শেফালি এসে বলে গেছে পরী তাকে অন্দরে যেতে বলেছে।
দেরি করে না শায়ের। বহুক্ষণের তৃষ্ণা মেটাতে ছুটে যায় অন্দরে। পরীর ঘরে গিয়ে হাপাতে লাগলো সে। শায়ের কে দেখে পরী পালঙ্ক থেকে নেমে পড়ল। সম্মুখীন হলো স্বামীর। এক রাতেই কেমন শুকিয়ে গেছে শায়ের। পরী এটা হঠাৎই আবিষ্কার করে। আলতো করে গালে হাত বুলায় শায়েরের। চোখের পলক ফেলে না শায়ের। পরী বলল,’আমার খুব ঘুম পাচ্ছে মালি সাহেব আপনার বুকে একটু জায়গা দিবেন? কাল রাতে ঘুমাতে পারিনি।’
করুন কন্ঠ পরীর। শায়ের আরও কাছে এগিয়ে আসে পরীর,’আপনি চোখ বন্ধ রাখবেন পরীজান? আপনাকে মন ভরে দেখব। কেন জানি আপনার চোখের দিকে তাকালে নিজেকে আরো বড় অ*পরাধী মনে হয়।’
তাই করে পরী। আর শায়ের তার পরীজান কে চোখ ভরে দেখে। তার এ দেখার শেষ নেই। চক্ষু মুদন করার ইচ্ছা নেই শায়েরের। পরীর কপালে গাঢ় চুম্বন করে সে। পরী চোখ মেলে তাকায়,’আপনি কেন এতো নিষ্ঠুর হলেন? কেন এতো পাপ করলেন? কি দরকার ছিলো? একটু ভালো হলে কি হতো? যুদ্ধ তো হতো না!! র*ক্তা*র*ক্তি ও হতো না। তাহলে আপনি এমন হলেন কেন? আর যদি খারাপই হতেন তাহলে আমাকে কেন এতো ভালোবাসলেন?’
-‘আমি কি আপনাকে কলঙ্কিত করলাম পরীজান?’
কথা বলে না পরী। শায়ের আবার বলে,’আপনি চাঁদ আর আমি কলঙ্ক। কলঙ্ক ছাড়া চাঁদ যেমন অসুন্দর তেমনি আমি ছাড়া আপনিও বেমানান। সেহরান নামক কলঙ্ক পরীজানের গায়ে আজীবন থাকবে।’
শায়েরের বুকে মাথা রাখে পরী। কালবিলম্ব না করে শক্ত করে পরীকে জড়িয়ে ধরে সে। বলে,’আপনার আমার ভালোবাসা হয়তো কোন ইতিহাস গড়বে না পরীজান। পৃথিবীর কেউ জানবে না আমি আপনাকে কতটা ভালোবাসি। তবে এই ভালোবাসা এক মুহূর্তের জন্যও ভুলতে পারবেন না।’
-‘আমি কেন আপনাকে চেয়েও শাস্তি দিতে পারছি না? কেন বারবার আপনার কাছে আসতে ইচ্ছা করে?’
এর জবাব শায়ের ও জানে না। সে গভীর আলিঙ্গনে ব্যস্ত তার পরীজান কে। সারা রাত্রি দুজনেই বিনা নিদ্রায় পার করেছে। এখন কাছাকাছি হয়ে দুজনেই একটুখানি শান্তির নিদ্রায় যেতে চায়। তাই শায়ের পরীকে নিজ বক্ষে নিয়ে শুয়ে পড়ল।
রুপালি রন্ধনশালায় গিয়ে দেখল মালা খাবার বাড়ছে জেসমিনের জন্য। আজ কতদিন হলো সে বিছানায় পড়ে আছে। নড়াচড়া করতে পারে না। পুরো শরীর প্রচন্ড ব্যথা। একটু নড়লেই ব্যথায় কাতরায়। এই কষ্ট দেখতে পারে না রুপালি তাই জেসমিনের ঘরে সে যায় না। মালা খাবার নিয়ে চলে যেতেই রুপালি কুসুম কে বলে,’আজকের কাজটা ঠিকমতো করেছিস কুসুম?’
-‘হ আপা। পরী আপা যা কইছে তাই করছি।’
-‘ঠিক আছে। অন্দর থেকে তুই বের হবি না। শেফালি কোথায়?’
-‘পরের কাম করতে গেছে।’
-‘আমার মনে হয় ওরা শেফালিকে বিশ্বাস করেছে। তবে এই বিশ্বাস আরো জোরালো করতে হবে। পরী কি নিজের ঘরে?’
কুসুম মাথা নাড়ে। রুপালি পরীর ঘরে যায় কিন্ত ওদের দুজনকে একসাথে ঘুমাতে থেকে বের হয়ে আসে। মনে মনে হাসে রুপালি। পরী শায়ের কে অনেক বেশি ভালোবাসে। কিন্ত ওর জীবনটা ভিন্ন পর্যায়ে দাঁড়িয়েছে। সিরাজ ওর সাথে বেঈমানি করেছে। তা সে মালার কাছ থেকেই জেনেছে। সব জানার পর চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে গেছে মনটা। তবে রুপালি নিজেকে সামলে নিয়েছে। পরীকে দেখে শক্ত হতে শিখেছে সে।
অনেক ধোঁকা খেয়েছে। আর পারছে না। এবার সময় এসেছে রুখে দাঁড়ানোর। এবার চুপ থাকলে অন্যায় হবে ভেবেই রুপালি রুখে দাঁড়িয়েছে। ওদের প্রথম পরিকল্পনা হলো সবার বিশ্বাস অর্জন করবে শেফালি। তারপর পরবর্তী পরিকল্পনা করবে।
সেই অনুযায়ী শেফালি ওদের গিয়ে বলেছে যে রুপালি সিরাজের সম্পর্কে সব জেনে গেছে। আর সিরাজকে সে শীঘ্রই হ*ত্যা করবে। এবং সেটা খুব তাড়াতাড়ি করবে। ওনারা সবাই যেন সতর্ক হয়ে যায়। এই কথা শুনে সিরাজ সহ সবাই সতর্ক হয়ে গেল। পরীর জন্য অন্দরে ঢুকতে পারছে না কেউ। শুধু শায়ের কেই পরী ঢুকতে দিচ্ছে। কিন্ত শায়ের তো
ওদের কথা শুনবে না। এজন্য আফতাব বেশ চিন্তায় আছে। শায়ের ওনার কথা শুনলে এতদিনে পরীকে শেষ করে দিতো। কিন্ত এখন সব উল্টো হয়ে গেল।
নওশাদ ভয়ে জড়সড় হয়ে বসে আছে। কাউকে সে বিশ্বাস করতে পারছে না। কারণ টা তার পঙ্গুত্ব। এর আগে যখন সে সুস্থ ছিল তখন এতো ভয় ওর করেনি। এখন অনেক বেশিই ভয় করছে ওর। এমন সময় শেফালি ওর সামনে এলো। এক গ্লাস পানি ওর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,’পানি নেন ভাই! দেইখা মনে হইতাছে আপনে ভয় পাইতাছেন।’
নওশাদ ছোঁ মেরে পানির গ্লাসটা নিয়ে এক নিঃশ্বাসে শেষ করে দিল। সত্যিই তার খুব ভয় লাগছে।
-‘আমি একখান কথা কই ভাই। পরী আপা আপনেরে আগে মারব কইছে।’
কথাটা নওশাদের ভয় দ্বিগুণ বাড়িয়ে দিলো। সে কপালের ঘাম মুছতে লাগল।
-‘আপনে যদি বাঁচতে চান তো পরী আপারে আগে মা*রেন। তাইলেই হইব। আমি আপনেরে সাহায্য করমু আপারে মা*রার।’
বাঁচার তাড়নায় সে হিতাহিত জ্ঞান শূন্য হয়ে পড়েছে।সে বলল,’তুই কীভাবে সাহায্য করবি?’
-‘আমি কমু না। আগে আপনে কন আমারে মা*রবেন না তাইলে কমু।’
রাগন্বিত হলো নওশাদ,’তুই বল,আমি তোকে বাঁচাব।শুধু তাই না অনেক টাকাও দেব।’
শেফালি এমন ভান করলো যেন সে ভিশন খুশি, ‘তাইলে তো তো আরও ভালা। হুনেন তাইলে,আপনে আমারে ঘুমের ওষুধ আইনা দেন। পরী আপারে খাওয়াই দিমুনে। আপা আমারে মেলা বিশ্বাস করে। তারপর রাইতে আপনে অন্দরে যাইয়া আপারে মা*ইরা ফালাবেন। তয় একটা কথা কই,আপনের আমার কথা কাউরে কইবেন না। তাইলে এক কান দুই কান কইরা পরী আপার কানে চইলা যাইবো। আর আপনে যদি কাজটা করতে পারেন তাইলে বড় কর্তা খুব খুশি হইব।’
-‘ঠিক বলেছিস তুই। কাউকে বলা যাবে না। তাহলে শায়েরের কানেও কথাটা চলে যেতে পারে। আচ্ছা তোকে আমি ঘুমের ওষুধ এনে দেব।’
নিজের কথা শেষ করে চলে গেল শেফালি। মনে মনে হাসল ও। কারণ নওশাদ ওর জালে ফেসে গেছে। এখন শুধু অন্দরে আসার পালা। সে দৌড়ে গিয়ে পরীকে সব বলে দিল। পরী হেসে বলে,’শিকার ফাঁদের দিকে এগোচ্ছে এখন শুধু ফাঁদে পড়ার পালা।’
নওশাদ শেফালিকে ঘুমের ওষুধ এনে দিলো। সন্ধ্যার পর শেফালি নওশাদ কে জানালো যে সে পরীকে ওষুধ খাইয়ে দিয়েছে। রুপালিকেও খাইয়ে দিয়েছে যাতে সে টের না পায়। শেফালির বুদ্ধির তারিফ করলো নওশাদ। রাত যখন গভীর হয় তখন সবার চোখের আড়ালে নওশাদ টোকা দিল অন্দরের দরজায়। শেফালি যেন ওর অপেক্ষাতেই ছিল। দরজা খুলে তাড়াতাড়ি নওশাদ কে ভেতরে ঢোকালো। নওশাদ তার লাঠির সাহায্য দোতলায় উঠতে লাগল। শেফালি সোনালীর ঘরটা দেখিয়ে বলেছে ওখানেই পরী থাকে। তাই নওশাদ সেদিকেই যাচ্ছে। শেফালি নওশাদের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে বলে,’আইজ তোর এমন মরণ হইব যা তুই চিন্তাও করস নাই।’
#চলবে,,,,