পরীজান পর্ব-৪৭+৪৮

0
632

#পরীজান
#পর্ব ৪৭
#Ishita_Rahman_Sanjida(Simran)

❌কপি করা নিষিদ্ধ ❌

একজন নারী যোদ্ধার সাজ যেমন হয় ঠিক তেমনি করেই সেজেছে পরী। চোখ গাঢ় কাজলে ঢেকে ফেলেছে আর মুখটা কাপড় দিয়ে বেঁধে রেখেছে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে পরিপাটি করলো নিজেকে। তারপর পালঙ্কের নিচ থেকে ধারালো সেই ত*লো*য়া*র খানা বের করল। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে তা দেখতে লাগল বারংবার। ঠিক সেই মুহূর্তে কুসুম খবর দিলো শি*কার চলে এসেছে বাঘিনীর গুহায়। মুচকি হেসে পরী সোনালীর ঘরের দিকে পা বাড়াল। নওশাদ নিজের খোড়া পা নিয়ে আস্তে আস্তে সোনালীর ঘরে ঢুকে পড়ল। বিছানায় সে কাউকে শুয়ে থাকতে দেখে নিঃশব্দে হাসে। কন্ঠ খাদে নামিয়ে বলে,’বাঁচার জন্য মানুষ কত কিছুই না করে পরী। আমাকে বাঁচতে হলে তোমাকে যে ম*রতে হবে।’

ছু*রি*টা নিয়ে পালঙ্কের দিকে এগিয়ে গেল নওশাদ। ইচ্ছামতো ছু*রি চালালো শুয়ে থাকা ব্যক্তির শরীরে। নওশাদ ভাবছে নিশ্চয়ই পরীর শরীর এতক্ষণে ক্ষ*ত বি*ক্ষ*ত হয়ে গেছে। অন্ধকারে কিছুই দেখতে পারছে না। সে নিজে নিজেকে সুধালো,’র*ক্ত ছিটকে আসছে না কেন?’

-‘তুই র*ক্ত দেখতে চাস? আমি তোকে আজ র*ক্ত দেখাব। তোর শরীরের যত র*ক্ত আছে আজ তুই সব দেখবি।’

নওশাদ ফিরে তাকায়। কুসুম হারিকেনের আঁচটা বাড়িয়ে দিতেই পরীর বদনখানা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। রক্তিমা কালো অশ্রুতে টলমল চোখ দেখে নওশাদের আত্মা যেন বেরিয়ে গেল। সে চিৎকার দিতে চাইল মুহূর্তেই কিন্ত ভারি কিছু মাথায় পড়ায় চোখ বন্ধ হয়ে এলো যেন। তবে সম্পূর্ণ জ্ঞান সে হারালো না। মেঝেতে বসে পড়ল সে। আ*ঘাতটা পেছন থেকে রুপালি করেছে। সে এতক্ষণ এই ঘরেই লুকিয়ে ছিল। নওশাদ যাকে পরী ভেবে আঘাত করেছে তা বালিশ ছিল যা চাদরে ঢাকা ছিল।

রুপালি রুষ্ঠচিত্ত কন্ঠে বলল,’ওর গলার আওয়াজ বন্ধ কর কুসুম।’

তৎক্ষণাৎ শেফালির আগমন ঘটে সে বলে,’ওর আওয়াজ আমি বন্ধ করতাছি।’

নওশাদ অবাক হয়ে গেল কিন্ত কথা বলার আগেই কুসুম ওর হাত দুটো পিছমোড়া করে ধরে। নিজেকে ছাড়ানোর সেই শক্তিটুকু কেড়ে নিয়েছে রুপালি। তাই নড়তে পারছে না। শেফালি হাতের গামছা টা নওশাদের মুখে ঢো*কানোর চেষ্টা করছে কিন্ত নওশাদ মুখ খুলছে না। শেষে উপায়ন্তর না পেয়ে নাক টিপে ধরে। শ্বাস নিতে পারে না নওশাদ। তাই শ্বাস নেওয়ার জন্য মুখ খুলতেই শেফালি ওর মুখে গামছা ঢু*কিয়ে দেয়। নওশাদের লাঠি দিয়ে গুতো মেরে মেরে অর্ধেক গামছা গলা দিয়ে নামিয়ে দিলো সে। পরী এগিয়ে একটা চেয়ার আনলো। ওরা ধরে নওশাদ কে চেয়ারের সাথে হাত পা বেঁধে ফেলে। ছুটোছুটি করছে নওশাদ কিন্ত পারছে না। পরী ত*লো*য়াবর হাতে নিয়ে নওশাদের মুখোমুখি বসে।ত*লো*য়া*র দেখে ভয়ে নওশাদের আত্মা যেন বেরিয়ে আসছিল। পরী বলে,’তোর চোখে আমি ভয় দেখতে পাচ্ছি। আমার এতে খুব আনন্দ হচ্ছে।
আরো ভয় পাবি তুই।’

-‘এতো কথা বলিস না পরী। ওকে শেষ করে দে।’

পরী ঘাড় কাত করে নওশাদের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘এতো সহজে?? তাহলে তো আসল মজাটাই মাটি হয়ে যাবে।’

পরী একটানে নওশাদের মুখ থেকে গামছা বের করে আনলো। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে নওশাদের। তৃষ্ণায় পানি পানি করতে লাগল। গামছা মুখে থাকায় দম প্রায় বেরিয়ে আসছিল। পরী জিজ্ঞেস করল, ‘পানি খাবি?’
মাথা নাড়ে নওশাদ। কুসুম কে ইশারা করতেই সে একটা ছোট বাটি নিয়ে আসে পরী বাটিটা দেখিয়ে বলে,’পানি তো নেই। তোর মতো পি*শাচের তৃষ্ণায় পানিও মুখ ফিরিয়ে নেয়। এখন কি করি?’

একটু ভাবল পরী। হাতের তলোয়ার মেঝেতে রেখে কোমড়ে গোঁজা ছোট্ট ছু*রিটা বের করে। পরপর তিন চারটা দা*গ কেটে দেয় নওশাদের হাতে। ব্যথায় নওশাদ আ*র্তনাদ করে উঠলেও মুখ দিয়ে শব্দ বের হলো না। ওর হাত দিয়ে চুইয়ে চুইয়ে র*ক্ত ঝরছে আর পরী তা বাটিতে সংগ্রহ করছে। কিছুটা র*ক্ত নিয়ে সে নওশাদের মুখের সামনে ধরে বলে,’নে তোর পিপাসা মেটা।’

এবার নওশাদ তার বাক শক্তি কিছুটা ফিরে পেল। র*ক্ত দেখে ঘেন্নায় মুখ ফিরিয়ে নিয়ে বলে,’আমাকে ছেড়ে দাও পরী। আমি অনেক দূরে চলে যাব।’

-‘আমার আপাকে ছেড়েছিস তোরা? আপাও তো অনেক দূরে যেতে চেয়েছিল ছেড়েছিস কি?’

নওশাদের গাল দুটো চেপে ধরে রক্ত ওর মুখে ঢেলে দিল পরী। সাথে সাথেই বমি করে দিল নওশাদ। এটা দেখে কুসুম আর শেফালির ও বমি পেল। মুখে কাপড় দিয়ে বমি আটকালো ওরা।পরী তাতেও ক্ষ্যান্ত হলো না। বাকি রক্ত টুকু আবারও মুখে ঢেলে দিলো। এবারও তা ফেলে দিল নওশাদ।

-‘এই হাত দিয়ে আমার আপাকে স্পর্শ করেছিলি তাই না?’
বলতে বলতেই নওশাদের তর্জনী আঙুল টা কে*টে নিলো পরী। এবার চিৎকার করে উঠলো নওশাদ কিন্ত ওর চিৎকার কারো কানে পৌঁছায় না তার আগেই পরী আবার ওর মুখে গামছা ঢুকিয়ে দিয়েছে।
কুসুম আ শেফালি মৃদু চিৎকার করে উঠল। ভয়ে কাঁপতে লাগল দুজনেই। পরী যে এতটা ভয়ানক হয়ে উঠবে তা ওরা চিন্তাও করেনি। ওরা দুজন বাইরে চলে যেতে চাইলে পরী বলে ওঠে,’কোথায় যাচ্ছিস তোরা? এখানেই থাক। ওর যন্ত্রণা তোদের দেখতে হবে।’

কুসুম ভয়ে ভয়ে বলে,’আমার ডর করতাছে আপা আমি যাই। আর এইহানে থাকতে পারমু না।’

বলতে বলতে কুসুম দৌড়ে চলে গেল। ওর দেখাদেখি শেফালিও পালালো। বাকি আছে রুপালি। ওর ভয় লাগলেও শক্ত চোখে সবটা দেখছে। ও বলল,’আমি দেখতে চাই পরী। আমার আপার হ*ত্যা*কারীদের শাস্তি কেমন তা আমি নিজ চোখে দেখতে চাই। ভয় আমি পাব না।’

পরী মুখোশের আড়ালে হাসে। তারপর ছু*রি দিয়ে নওশাদের পরনের শার্ট টা কেটে খুলে ফেলে। বুকে ছু*রি চালিয়ে শান্তির নিঃশ্বাস ফেলে। ওর কলিজাটা আজ কিছুটা ঠান্ডা হয়েছে। নওশাদের বুকের ক্ষ*তটা বেশ গাঢ় ফলে র*ক্তের বন্যা বয়ে গেল মুহূর্তেই। রুপালি খানিকটা শুকনো মরিচের গুড়া সেখানে লাগিয়ে দিতেই ছটফট শুরু করে নওশাদ। গ*লা কা*টা মুরগির মতো ছুটো ছুটি করছে সে। এর থেকে বুঝি আর কোন যন্ত্রণা হয় না। পরী প্রশান্তির স্বরে বলে,’সারা শরীরের যন্ত্রণা সহ্য করা যায় কিন্ত বুকের যন্ত্রণা সহ্য করা খুবই কঠিন নওশাদ। আজ তোকে আমি ভ*য়া*নক মৃ*ত্যু দেব। তুই হাত জোড় করে ক্ষমা চাওয়ার সময়ও পাবি না। তোকে আমি জীবিত দা*ফন করব। জানাযা ও হবে না তোর। শশীলের লা*শ তো তোরা পেয়েছিলি কিন্ত তোর লা*শ কেউ পাবে না।’

ব্যথায় ভয়ে কাঁপছে নওশাদ। শরীরে জ্বলন হলেও নড়ার শক্তি নেই। এরই মধ্যে পরী ওর আরেকটা আঙুল কে*টে নিল। এবার আর রুপালি থাকতে পারে না। অনেক সাহস দেখালেও আর সাহসে কুলায় না ওর। তাই ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। পরী রুপালিকে বাঁধা দিলো না। শুধু বলে কুসুম আর শেফালি যেন গরম পানি দিয়ে যায়।
পরী নওশাদের দিকে তাকিয়ে বলে,’দেখ মৃ*ত্যু যন্ত্রণা কতটা কষ্টের!! তুই চিন্তা করিস না! তোর দাফন খুব ভাল করেই হবে। তোকে গোসল করাব,আগরবাতি জ্বলবে,গোলাপ জল দেওয়া হবে,কবর খোড়া হবে।
কিন্ত তোকে সাড়ে তিন হাত জায়গা দেওয়া হবে না। তুই তো মানুষের মধ্যেই পড়স না। তাহলে তোকে মানুষের মতো দাফন করাটা উচিত হবে না।’

নওশাদ গোঙ্গাচ্ছে, দেখে মনে হচ্ছে সে কিছু বলছে।পরী নওশাদের আরেকটু কাছে এগিয়ে তা শোনার চেষ্টা করে,’আমাকে তাড়াতাড়ি মেরে ফেল। আমার আর সহ্য হচ্ছে না।’
ভাঙা ভাঙা গলায় নওশাদ বলছে। কুসুম আর শেফালি তখন গরম পানির পাতিল নিয়ে ঘরে এলো। পরী ওদের দেখে বলল,’তুই কি নওশাদের একটা আঙুল কা*টবি কুসুম?’
মুখে না বলে মাথা নেড়ে না বলে কুসুম। ভয়ে সে কাঁপছে এখনও। শেফালিকেও একই কথা জিজ্ঞেস করে পরী সেও না বলে দেয়। ওদের ভয় দেখাতে পরীর ভিশন ভাল লাগছে। সে বলে,’গোসল করানোর পর কিন্ত ওর গায়ে আর হাত দেওয়া যাবে না।’

-‘না আপা থাক। আমরা অহন কি করমু?’

-‘গোসল করা।’
কুসুম পাতিলের সব পানি নওশাদের গায়ে ঢেলে দিল। পানি এতটাই গরম ছিল যে সাথে সাথে ফোসকা পড়ে গেল নওশাদের শরীরে। শেফালি আগরবাতি জ্বালিয়ে ঘরে গোলাপ জল ছিটিয়ে দিল। পরী নাক টেনে গোলাপ জলের সুগন্ধিটা নিল। খুব ভাল লাগছে ওর। ওরা তিনজন ঘর ত্যাগ করে নওশাদ কে একা রেখে। উঠোনের এক কোণায় খড়ের গাদা সরিয়ে সেখানে গর্ত খুড়ছে। পরীও সাথে যোগ দিয়েছে। তিনজন নারী মিলে কবর খুড়ছে। কবর বললে ভুল হবে গর্ত খুঁড়ছে। রুপালি পাশে দাঁড়িয়ে আছে। এমন সময় সেখানে মালা চলে আসে। ওদের গর্ত খুঁড়তে দেখে বলেন,’কি করস পরী? সবাই এইহানে ক্যান?’

পরী কো*দাল ফেলে সোজা হয়ে দাঁড়াল। লাফ দিয়ে উপরে উঠে এসে বলে,’আপনি ঘরে যান আম্মা। পিকুলের কাছে যান।’

-‘নওশাদরে ধইরা আনছোস তাই না?’
-‘হুমম।’
-‘তোর বাপ জানি এইসব জানতে না পারে। তাইলে কিন্ত হেয় খারাপ কিছু করব।’
পরী অবাক হলো মায়ের কথায়। তবে সে বুঝতে পারল মালাও ওকে সমর্থন করছে। মালা এতদিনে এটা বেশ বুঝেছে যে সে যতই বলুক না কেন। পরী তার সিদ্ধান্ত বদলাবে না। এখন মালা সাবধান করা ছাড়া আর কিছুই করতে পারবে না। তাই মালা চলে গেল।
মাটি মেখে তিনজন বড় একটা গর্ত খোঁড়ে। তারপর সোনালীর ঘরে যায়। পরী নওশাদকে ভাল করে দেখে। এখনও বেঁচে আছে। শরীরের অনেক র*ক্ত বের হয়ে গেছে। যার ফলে নেতিয়ে পড়েছে। ওর প্রতিটি নিঃশ্বাস এখন শেষ নিঃশ্বাসের প্রহর গুণছে। বড় একটা চাদরে শুইয়ে সেটা ধরে চারজন মিলে নওশাদ কে গর্তের কাছে নিয়ে এল। নওশাদ তখনও নিভু নিভু দৃষ্টিতে ওদের দেখছে আর মনে মনে প্রাণ ভিক্ষা চাইছে। তারপর জীবিত পুঁতে ফেলে নওশাদ কে। মাটির নিচে শ্বাস নেওয়া যায় না। সেখানে অক্সিজেন ও পৌঁছায় না। কাজ শেষ করে পরী কলপাড়ের দিকে এগোয়।

মধ্য প্রহরের কিছুটা সময় পর যখন পুরো গ্রাম ঘুমানো। এমনকি ঝিঁ ঝিঁ পোকা গুলো ও ঘুমিয়ে পড়েছে। তখন শুধু আকাশের চাঁদ খানা জেগে আছে। পুরো গ্রামটাতে নজর বুলাচ্ছে। তবে কিছু না দেখলেও নওশাদের শেষ পরিণতি গাছের ফাঁক দিয়ে ঠিকই দেখেছে। সম্পূর্ণ কালো রঙের শাড়ি গায়ে জড়িয়েছে পরী। গোসল সেরে শরীর মুছেনি এমনকি মাথাও না। পরনের শাড়িটা অর্ধেক ভিজে আছে। সেই অবস্থাতেই ঘরে গেল পরী। সেখানে শায়ের ওর জন্য অপেক্ষা করছে। পরীই তাকে খবর পাঠিয়েছে।
এমতাবস্থায় পরীকে দেখে বেশ ঘাবড়ে গেল শায়ের। তবে কথা বলল না। পরীর এমন সৌন্দর্য শায়ের কে আটকে দিল। হাসল পরী যা শায়েরের কাছে ভয়ংকর লাগল। নিজের শীতল হাতটা শায়েরের গালে রাখে পরী। যার দরুন হালকা কেঁপে ওঠে সে।
তা দেখে আবারও হাসে পরী। দ্বিতীয় হাত অপর গালে রেখে টেনে তাকে নিচু করে। তারপর পায়ের পাতা উঁচু করে চুম্বন করে স্বামীর কপালে। আদুরে গলায় বলে,’আমি ছাড়া অন্য কোন নারীকে ছুঁয়েছেন কখনো?’

-‘জীবনে দুজন নারীকে আমি গভীর ভাবে ছুঁয়েছি। তার মধ্যে আপনি দ্বিতীয়। প্রথমত আমি আমার মা’কে ছুঁয়েছি আর দ্বিতীয়ত আপনাকে। আর কোন নারীকে চোখ দিয়েও স্পর্শ করিনি।’

-‘এজন্যই কি আপনার স্পর্শে জাদু আছে? যার জন্য আমি এত উতলা হয়ে উঠি?’

-‘আপনার শরীর ঠান্ডা অনেক। কাথাটা গায়ে জড়িয়ে বসুন। নাহলে জ্বর আসবে।’
পরীর হাত ধরে ওকে পালঙ্কে বসায় শায়ের। কাথাটা গায়ে জড়িয়ে দিয়ে বলে,’আপনি দিন দিন আরও অদ্ভুত আচরণ করছেন। এরকম করলে আপনার শরীর খারাপ করবে।’

জবাব না দিয়ে পরী শায়ের কেও টেনে নিলো কাথার ভেতরে। শায়েরের কাঁধে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করে।
ভিশন শান্তি লাগছে পরীর। শায়ের বলে উঠল, ‘আপনি ভালোবাসা বিশ্বাস করেন?’

-‘শুধু আপনার ভালোবাসা বিশ্বাস করি। বাকি সব মিথ্যা।’

-‘সম্পানের ভালোবাসা কিন্ত মিথ্যা ছিল না পরীজান। ও সত্যিই বিন্দুকে ভালোবাসতো। শুধু আপনাকে মারতে চেয়েছিল বলে কি ওর ভালোবাসা মিথ্যা?’

পরী মাথা তুলে শান্ত চাহনিতে শায়েরের দিকে তাকালো। শায়ের নিজেও পরীর দিকে তাকিয়ে আছে। স্বামীর চোখের দিকে তাকিয়ে তার মনের অভিব্যক্ত পড়ার বৃথা চেষ্টা করছে পরী। তা উপলব্ধি করতে পারে শায়ের। সে বলে,’সম্পান কিন্ত খারাপ হয়ে জন্ম নেয়নি পরীজান। তাকে খারাপ বানানো হয়েছে। টাকা এমন একটা বস্তু যার নেশায় ধনী গরীব সবাই পড়ে। এবং এই নেশাই সম্পান আর আমার মতো শত পুরুষ খারাপ কাজে লিপ্ত হয় আর ধনীরা পাপ করেও সকলের আড়ালে থেকে যায়।’

#চলবে,,,,,

#পরীজান
#পর্ব ৪৮
#Ishita_Rahman_Sanjida(Simran)

❌কপি করা নিষিদ্ধ ❌

‘আপনার বাবা বেছে বেছে তাদেরই নিজের দলে টানে যাদের পরিবারে খুবই অভাব। খেয়ে পড়ে বাচাঁ মুশকিল। কেননা একমাত্র তারাই বোঝে টাকার কতটা মূল্য! তারা পরিবারের সবাইকে সুখি রাখতে সবকিছু করতে রাজি থাকে। সম্পান, সিরাজ আর আমি!! এই তিনজনই আপনার বাবার শিকার মাত্র। কিন্ত আমার বুদ্ধিমত্তা সম্পর্কে আপনার বাবার বিন্দুমাত্র ধারণা নেই। নিজেকে অনেক চতুর মনে করে আপনার বাবা। কিন্ত শেষে সে নিজের জালে নিজেই ফেসেছে। যারা যারা আপনার বাবার কর্মচারী ছিলো তাদের কোন না কোনভাবে হ*ত্যা করেছেন আপনার বাবা। কারণ আপনার বাবার সব অ*প*কর্মের স্বাক্ষী ছিল তারা। আমাকেও এতদিনে মে*রে ফেলতেন কিন্ত পারেনি। কেন জানেন? কারণ আপনার বাবার কু*কৃ*র্তির সব প্রমাণ আমার কাছে আছে। আমি যদি মা*রা যাই তাহলে সব প্রমাণ পুলিশের হাতে চলে যাবে এজন্যই আপনার বাবা আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছেন আর সম্পান কে মে*রে ফেলেছেন। সিরাজ কে বাঁচিয়ে রেখেছেন কারণ ও আপনার বাবার মতোই নির্দয়। টাকার বিনিময়ে ও সব করতে পারে। এজন্য আপনার বোনকেও ফা*সিয়েছে। শুধুমাত্র টাকার জন্য মানুষ ভুলে যায় সে একজন মানুষ।’

শায়ের দম ফেলে পরীর দিকে তাকাল। পরী এখনও শায়েরের বুকে মাথা রেখে আছে। শায়ের বলল, ‘আপনি কি শুনছেন পরীজান?’
‘হুম শুনছি। আপনিও তো টাকার জন্য খু*ন করেছেন।’

‘ভুল পরীজান। টাকার জন্য আমি সব করলেও খু*ন করিনি। আমি প্রথম খু*ন করি পালককে।’

পরী মাথা তুলে শায়েরের দিকে তাকালো,’কেন খু*ন করলেন তা সম্পূর্ণটা এখনও আপনি আমাকে বললেন না। আজ অন্তত বলুন!!’

পরী অসহায়ের মতো তাকিয়ে আছে। শায়ের আবার বলতে শুরু করে,’পালকের কোন দো*ষ নেই অন্তত আপনার দৃষ্টি থেকে। পালকের ধর্ম ভিন্ন তা কি আপনি জানেন? তবুও সে আমাকে পেতে চেয়েছিল। এতে আমি ওর কোন দো*ষ দেখি না। মানুষ জাতি বড়ই অদ্ভুত পরীজান। কখন কার দৃষ্টিতে কে আটকে যায় তা বলা মুশকিল। সেজন্যই পালক আমাতে আটকে ছিল। আমি পালককে হ*ত্যা করতাম না। কিন্ত শেষে সে সবকিছু জেনে গেল। শুধু তাই নয় সে আমাকে হু*মকি দিল যে সে আপনাকে সব বলে দিবে। যদি আমি তাকে বিয়ে করি তাহলে সে চুপ থাকবে। সুযোগের সদ্যব্যবহার,তবে তার দো*ষ আমি দেখি না। ভালোবাসা পেতে আমি নিজেই খু*ন করেছি আর সে তো হু*মকি দিয়েছে মাত্র। তখন কানাইকে নিয়ে ঝা*মেলা চলছিল তার মধ্যে পালক চলে আসে। মাথা কাজ করছিল না তাই ওর মুখ বন্ধ করার জন্য মে*রে দিয়েছি।
তারপর আরো পাঁচজন কে মে*রেছি আমি। চারজন ছিল বিন্দুর ধ*র্ষ*ণ*কা*রী। মেয়েদের সম্মান না করলেও অসম্মান করি না আমি। সম্পান ও। ওইদিন বিন্দুকে মা*রা*র কোন পরিকল্পনা ছিল না। সম্পান কে প্রথমে আপনার বি*রুদ্ধে নেওয়া হয়েছিল। কিন্ত সে আপনার আর বিন্দুর ভালোবাসা দেখে মুগ্ধ। এ থেকে আমি বুঝতে পারলাম নারীর ভালোবাসা হিং*স্র মানবকে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনতে পারে।
সম্পান নিজে থেকে আপনার বাবার কাজ ছাড়তে চেয়েছিল কিন্ত আপনার বাবা আপনাকে মা*রার পর তাকে যেতে বলেছিল। কিন্ত সম্পান তা নাকচ করে দেয়। তারপর বিন্দুকে মা*রার হুমকি দেন আপনার বাবা। নিজের ভালোবাসা বাঁচাতে সম্পান আমার ভালোবাসা কেড়ে নিতে চাইল। কিন্ত সে জানতো আমি আপনাকে ভালোবাসি। আমাকে পরিকল্পনা করেই যাত্রা দেখতে পাঠানো হয় যাতে আমি কিছু জানতে না পারি। তবে সেদিন সম্পান ওখানে গিয়ে আমাকে খবরটা দেয়। আমাদের আসতে অনেক দেরি হয়ে গিয়েছিল। ততক্ষণে সব শেষ। সম্পান নিজের ভালোবাসাকে ওইভাবে দেখতে পারেনি তাই ছয় জনের মধ্যে দুজনকে ওখানেই মে*রে দেয়। আর বাকি চারজনকে আমি মা*রি। বিন্দু যদি বেঁচে থাকতো তাহলে সম্পানের বধূ হয়ে আজ ওর ঘরে থাকতো। কিন্ত বিধাতার কি লিখন। দুজনকেই তিনি টেনে নিয়েছেন। আমি আর সম্পান হিং*স্র*তাকে জিততে দেইনি পরীজান। ভালোবাসাকে জয়ী করেছি। ভালোবেসে ওরা দুজন প্রা*ণ দিয়েছে আর আমরা দুজন একসাথে রয়েছি।’

-‘আর নাঈমকে কেন মিথ্যা আ*সামী বানালেন?’

-‘মিথ্যা আ*সামী তাকে বানিয়েছে নওশাদ। আপনার বিয়ে ভাঙার সব পরিকল্পনা নওশাদের ছিল। আমি জানতাম আপনাকে আমি শেখরের মতো করে সুখি রাখতে পারব না। তাই আপনার আশা ছেড়ে দিয়েছিলাম কিন্ত মাঝপথে জানতে পারলাম যে বিয়েটা ভেঙে দেওয়া হয়েছিল। তারপর আপনার বাবা পরিকল্পনা করে আপনাকে মে*রে গাছের সাথে ঝুলিয়ে দেবে আর গ্রামের লোকেরা ভাববে বিয়ে ভাঙার কষ্টে আপনি আ*ত্ম*হ*ত্যা করেছেন। আমি তা হতে দেইনি। আপনার বাবাকে বলেছি আমি আপনাকে বিয়ে করব এবং আমার গ্রামে নিয়ে গিয়ে হ*ত্যা করব। কিন্ত বিশ্বাস করুন পরীজান আমি আপনার সাথে সুখে থাকতে চেয়েছি শুধু। কিন্ত সেই সুখটাও ওরা কেড়ে নিল। আমি মানছি আমি পাপ করেছি।’

কথাগুলো শেষ করে পরীর দিকে তাকালো শায়ের। চোখ দিয়ে পানি ঝরছে পরীর। সে মুচকি হেসে বলে,’আমি জীবনে অনেক পা*প করেছি কিন্ত পূণ্য করেছি আপনাকে ভালোবেসে। এর চেয়ে পবিত্রতা বুঝি দুনিয়াতে নেই।’

-‘এজন্যই তো এতো ভালোবাসা আমার কপালে সইলো না মালি সাহেব। যু*দ্ধে নামতে হয়েছে আমাদের। সেখানে আপনি আমার শ*ত্রু*পক্ষ।’

-‘শত্রুপক্ষ যে আপনাকে ভিশন ভালোবাসে। ত*লো*য়া*রের আঘাতে নয় শ*ত্রু*র ভালোবাসায় আপনার দম বন্ধ হয়ে আসবে পরীজান।’

-‘আমি যে এই যুদ্ধে প্রাণ হারাব মালি সাহেব। তখন আপনি কি করবেন?’
-‘আপনাকে রক্ষা করার সর্বোচ্চ চেষ্টা আমি করব।’

-‘আমি মারা গেলে আমার কবরের পাশে একটা বেলি ফুল গাছ লাগাবেন মালি সাহেব!! আমার দেহটা পঁচে সার হয়ে মিশে যাবে ওই গাছে। আর প্রতিটি ফুলের ঘ্রাণে আপনি আমাকে পাবেন।’

এই প্রথম শায়ের পরীর কথার জবাব দিতে পারল না। সে তার দৃষ্টি নিবদ্ধ করে রাখল পরীজানের পানে। পরী দেখতে পেল ক্ষত বিক্ষত চোখদুটো। ওই চোখে কত ভালোবাসা দেখেছে সে। আর আজ ওই চোখজোড়া সে নিমিষেই রক্তাক্ত করে দিয়েছে। আচমকা পরীকে শক্ত বাঁধনে আবদ্ধ করে শায়ের। বলে ওঠে,’আপনাকে এভাবেই ধরে রাখব আমি পরীজান। আপনি আর কোথাও যেতে পারবেন না। আচ্ছা,চলুন না আমরা ফিরে যাই আমাদের গ্রামে? আমরা ভাল থাকব।’

-‘কিন্তু আমার মা বোন ভাল থাকবে না। ওদের শেষ করে দেবে ওই জঘন্য লোকগুলো।’

-‘সবাইকে নিয়ে যাব আমরা। তাহলেই তো হবে।’

-‘এসব বাদ দিন। আমি আপনাকে একটু কাছে পেতে চাই। এই মুহূর্তটা স্মরণীয় করে রাখতে চাই।’

পরী আঁকড়ে ধরে স্বামীকে। শায়ের আজ নিজে থেকে সব সত্য স্বীকার করেছে অথচ পরীর রাগ হচ্ছে না। কারণ সে নওশাদের বিনাশ করতে পেরেছে তাই আজকে সে খুশি থাকবে। এই মধুরতম রাতটা শায়ের কে দিবে। ভালোবাসার স্নিগ্ধ পরশ এঁকে দিবে। তাইতো সে এতো রাতে স্বামীকে তলব করে এনেছে।

সকাল হতেই ঘুম ভাঙে শায়েরের কিন্ত তার এই মুহূর্তে উঠতে একদম ইচ্ছে করছে না। পরীর উষ্ণ আলিঙ্গনে তার আরো থাকতে ইচ্ছা করছে। কিন্ত সে ইচ্ছা ভঙ্গ করে পরীই উঠে দাঁড়াল। আলমারি থেকে একটা শাড়ি বের করে কলপাড়ের দিকে এগোলো। কিছুক্ষণ বাদে শায়ের নিজেও গেল কিন্ত উঠোনে আসতেই সে দেখতে পেল শেফালি আর কুসুম গোবর দিয়ে উঠোন লেপছে। বিষয়টা শায়েরের সন্দেহজনক মনে হল কিন্ত সে কিছু জিজ্ঞেস করল না। কারণ আর কিছুক্ষণ বাদে তাকে অন্দর ত্যাগ করতে হবে। এটা পরীর হুকুম। তাই সে বিনা বাক্যে প্রস্থান করে।
বেলা দশটা বাজতেই ডাক পড়ল নওশাদের। তাকে বৈঠক ঘরের কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। অন্দরে নওশাদ যাবে না এটা সবাই শতভাগ নিশ্চিত। তবে গেল কোথায়। সবাইকে খুঁজতে পাঠালো আফতাব। কিন্ত নওশাদের হদিস পাওয়া গেল না। আখির তাতে ক্ষেপে গিয়ে বলে,’নিশ্চয়ই পরী কিছু করেছে ভাই। সে’ই নওশাদ কে গুম করেছে। নাহলে রাতারাতি ছেলেটা উধাও হয় কীভাবে?’

-‘সত্যিই যদি পরী কিছু করে থাকে তাহলে ওর আজকেই শেষ দিন। শায়েরের কোন কথাই আমি শুনব না। এতে যা হয় হোক।’

আফতাব তার দলবল নিয়ে অন্দরের দিকে পা বাড়ায়। কিন্ত দরজা পর্যন্ত যেতেই শায়ের বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়। আফতাব বিক্ষিপ্ত কন্ঠে বলে,’সামনে থেকে সরে যাও শায়ের। আজ পরী বাঁচবে না। তুমি যা ইচ্ছা করতে পারো।’
-‘পরীজান কিছু করেনি। সে জানে না নওশাদ কোথায়!’
-‘তুমি এতটা নিশ্চিত হলে কীভাবে?’
-‘কাল সারাদিন নওশাদ আমাদের চোখের সামনেই ছিল। এমনকি রাতে আমার সামনে দিয়েই নিজের ঘরে গেল।’
-‘ঘুমানোর পর হয়তো পরী ওকে ধরে নিয়ে গেছে।’

-‘নাহ! কারণ কাল রাতে আমি পরীজানের সাথে ছিলাম।’

-‘তুমি ছিলে পরীর কাছে! কেন গিয়েছিলে?’

সবার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসে শায়ের। রাগন্বিত হয়ে বোকা একটা প্রশ্ন করে ফেলেছে সে। শায়ের আবারও সবার দিকে চোখ বুলিয়ে বলে,’আপনি বড়ই নির্লজ্জ। একজন স্বামী তার স্ত্রীর কাছে কেন যায় সেটা কি আপনাকে বুঝিয়ে বলতে হবে জমিদার মশাই? আচ্ছা বাদ দিলাম আমার কথা। আপনি নিজ স্ত্রীকে ফেলে পর নারীর কাছে কেন যেতেন? সেটা কি আমি একবারও জিজ্ঞেস করেছি?’

শায়েরের কথা পুরোপুরি না শুনে রক্ষিরা সব চলে গেছে। এই মুহূর্তে শুধু আখির আর আফতাব দাঁড়িয়ে। শায়েরের কথা শুনে বিড়ম্বনায় পড়ল আফতাব। ভাইকে কিছু বলতে না দেখে আখির বলে উঠল,’তুমি মুখে মুখে তর্ক করো খুব। তুমি জানো কাদের সামনে দাঁড়িয়ে আছো তুমি?’

-‘হুম! আমি মস্তিষ্কহীনদের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। কেন একথা বলছি জানেন? কারণ আপনাদের কৃতজ্ঞতাবোধ নেই। যারা আপনাদের সাহায্য করে তাদের কেই মে*রে ফেলেন আপনারা। তাহলে আপনাদের তো মস্তিষ্কহীন বলা উচিত তাই না?’

বিপরীতে আখির পাল্টা জবাব দিলো না। শায়ের আবার বলল,’পরীজানের দিকে নজর বুলাবেন না বলে দিলাম। নাহলে ফল খারাপ হবে।’

চলে গেল শায়ের। ক্ষোভে ফেটে পড়ে দুই ভাই। তাদের সমস্ত পরিকল্পনা সব শায়ের নষ্ট করে দিচ্ছে বারবার। আফতাব নিচুস্বরে বলে,’সিরাজ কে খবর দে। শায়ের কে আগে সরাতে হবে তারপর পরীকে সরাব। পুলিশ কে হাতের মুঠোয় নিতে আমার সময় লাগবে না। আগে একটা আপদ সরাই তারপর আরেকটাকে সরাব।’

কথাটা শেফালির কর্ণগোচর হয়ে গেল। সে দৌড়ে পরীকে গিয়ে খবর দিল। ওর বাবার সব পরিকল্পনা জানিয়ে দিলো। পরী চুপ থেকে সব শুনল। তারপর বেশ শান্ত ভাবেই নিজ ঘরে চলে গেল। শেফালি বুঝল যে ঝড় আসতে চলেছে। পরীর চুপ থাকা মানেই ঝড়ের পূর্বাভাস। কিছুক্ষণ বাদে পরী ঘর থেকে বের হয়ে আসে। শেফালিকে বলে,’তোরা তৈরি থাক পরবর্তী শিকার সিরাজ।’

#চলবে,,,