#পরীজান
#পর্ব ৫৩
#Ishita_Rahman_Sanjida(Simran)
❌কপি করা নিষিদ্ধ ❌
নারীর সৌন্দর্য থাকা যেন কোন পা*প। যেমনটা ফুলের থাকে। ফুলের অতিরিক্ত সৌন্দর্য আকর্ষণ করে মানবকে। কিন্ত তারা আকর্ষিত হলেও ফুলকে হৃদয়ে স্থান দিতে পারে না। যতক্ষণ ফুলটা সতেজ থাকে ততক্ষণ এটা হাতে শোভা পায় কিন্ত যখন ফুলের সতেজতা শেষ হয়ে যায় তখন তার স্থান হয় চরণ তলে। মেয়েদের সৌন্দর্যের পরিণতি টাও ঠিক পরিষ্ফুটিত পুষ্পের ন্যায়। সব পুরুষ সৌন্দর্য তেই বেশি আটকায়। মনটা সবাই দেখতে চায় না। আর না মায়ায় জড়ায়।
নাঈম সেই মায়ায় বোধহয় জড়াতে পারেনি। কারণ না দেখে কোন মেয়ের মায়ায় জড়ানো যায় কি না তা নাঈমের জানা নেই। আগে এই পরীকে স্বচোখে দেখার তীব্র আকাঙ্খা ছিল তার। কতই না ফন্দি এটেছিল সে। কিন্ত আজ সেই পরী তারই ঘরে অবস্থান করছে কিন্ত তার ইচ্ছা করছে না পরীর সামনে গিয়ে দাঁড়াতে। কারণ টা কি পরীর সৌন্দর্য? নাঈমের কেন জানি অস্বস্তিকর লাগছে সবকিছু। হাসপাতালেও পরীর পরীর সামনে সে যায়নি বাসায় আনার সময় ও থাকেনি। মোট কথা সে কিছুতেই পরীর সামনে যাবে না। অদৃশ্য এক দেওয়াল তাকে বাঁধা দিচ্ছে পরীর কাছে যেতে। তাই এই মুহূর্তে সে নিজ ঘরে অবস্থান করছে। একটা বুয়া রেখেছে সবসময় পরীকে দেখাশোনা করার জন্য।
নিজ ঘরে বসে ছটফট করছে পরী। শায়েরের জন্য তার চিন্তা হচ্ছে। নূরনগর গেলে আফতাব যদি শায়েরের কোন ক্ষতি করে দেয়? আফতাব তো চেয়েছিল শায়ের কে হ*ত্যা করতে। একথা ভেবে পরী অস্বস্তি অনুভব করছে।
বুয়া ঘরে আসতেই পাতলা কাপড় দিয়ে মুখটা আড়াল করে সে। তার বিভৎস চেহারা দেখলে এখন যে কেউ ভয় পাবে তাই এই চেহারা আড়াল করাই শ্রেয়। বুয়া পরীর এইরকম অবস্থা দেখে বলে,’কি হইছে আপা? আপনের কিছু লাগব?’
পরী বিড়বিড় করে বলতে লাগল,’আমি থাকব না এখানে। আমি নূরনগর যাব। মালি সাহেব কে বাঁচাতে হবে।’
বুয়া দ্রুত পদে গিয়ে খবরটা নাঈম কে জানাতেই সে ছুটে এল। নাঈম পরীর মুখোমুখি দাঁড়াতে সংকচ বোধ করছে তাই অন্যদিকে ফিরে দাঁড়াল বলল,’কেন এত উত্তেজিত হচ্ছেন পরী? আপনার শরীর এখন ভাল নয়।’
-‘আমি থাকব না এখানে। আমাকে যেতে হবে। ওনার খুব বিপদ।’
পরীর মুখে উনি শব্দ টা বেশ লাগল নাঈমের। সে হাসল,’কিছু হবে না। শায়ের খুব তাড়াতাড়ি চলে আসবে। আপনি কথা কম বলুন। নাহলে আপনারই ক্ষতি হবে।’
মৃদু চিৎকার করে পরী,’নাহ!! আমাকে যেতেই হবে। নাহলে আব্বা খুব বড় ক্ষতি করে দেবে ওনার। আপনি দয়া করে আমাকে নূরনগর নিয়ে চলুন।’
-‘পরী আপনি হয়ত ভুলে গেছেন এখন আপনি একা নন। আপনার শরীরে আরেকটি অস্তিত্ব আছে। তার দায়িত্ব শায়ের আমাকে দিয়ে গেছেন। আমাকে সেই দায়িত্ব পালন করতে হবে।’
-‘আপনি কি আমার স্বামী? তাহলে আপনি কেন আমার দায়িত্ব নিচ্ছেন? আমি আপনাকে আমার দায়িত্ব নিতে দেব না। আমাকে ফিরে যেতে দিন।’
নাঈম অপমানিত বোধ করল পরীর কথায়। কিন্ত পরী কথাটা তো ঠিকই বলেছে। সে তো পরীর স্বামী নয়। তাহলে এত দায়িত্ব সে কেন নিচ্ছে? শায়েরের কথায়? শায়ের তো ওর কেউ হয় না। তাহলে শায়েরের কথা শোনার কোন মানেই হয় না। নাঈম বলে উঠল,’আচ্ছা ঠিক আছে আমি নেব না আপনার দায়িত্ব। তবে আপনি এখন কোথাও যেতে পারবেন না। দরকার পড়লে আমি নিজে গিয়ে শায়ের কে নিয়ে আসব। কথা দিলাম শায়েরের কোন ক্ষতি আমি হতে দিব না।’
চাপা রাগ নিয়ে চলে গেল নাঈম। পরী খাটের উপর বসে পড়ল। শায়ের কে যাওয়ার সময় কেন বাঁধা দিল না! নাহলে এতোটা চিন্তা হতো না। আফতাব আখির ভ*য়া*নক। ওরা যেকোন সময় শায়ের কে হ*ত্যা করতে পারে। সারা শরীরে ব্যথা করছে কিন্ত মনের ব্যথাটা আরও তীব্র। নাঈম কি সত্যিই শায়ের কে আনতে গিয়েছে? পরী মুখটা ভাল করে ঢেকে আস্তে ধীরে ঘর থেকে বের হলো। বুয়াকে জিজ্ঞেস করতেই সে জানায় নাঈম নূরনগরের উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে গেছে।
শায়ের মাত্র জমিদার বাড়িতে পা রাখল। এদিক সেদিক তাকাতে তাকাতে বৈঠকে ঢোকে সে। আখির শায়ের কে দেখে চমকে গেল এবং প্রচন্ড রেগে গেল। সে শায়ের কে রাগন্বিত হয়ে বলে,’নবাবজাদা এসে গেছেন। ভাই আমি আগেই বলেছিলাম কুকুর কে মাথায় তুলবেন না। দেখছেন এখন হলো কি? এই কুকুরের বাচ্চা কুকুর আমাদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে।’
আখিরের কথায় শায়ের জবাব দিল না। সে এগিয়ে গেল আফতাবের কাছে। তারপর বলে,’অন্দরের সবাই ঠিক আছে তো? নাকি তাদের উপর অত্যাচার করেছেন আবারও?’
-‘পরীকে তুমি কোথায় লুকিয়ে রেখেছো?’
-‘পরীজান আমার কাছেই আছে। এতে লুকানোর কি আছে?’
-‘তুমি আর পরী মিলে সিরাজ কে মেরেছো তাই না?
এখন তোমাকে কি করা উচিত?’
-‘সিরাজ যদি বেঁচে থাকতো তাহলে ওকে নিঃসন্দেহে
ভ*য়ংক*র মৃ*ত্যু দিতাম আমি। কিন্ত সে তার আগেই ম*রে গেছে।’
-‘তুমি বিশ্বাস ঘাতক শায়ের। আর বিশ্বাস ঘাতকের মৃ*ত্যুই শ্রেয়।’
শায়ের শব্দ করে হেসে উঠল,’ঠিক আপনাদের মতো।আপনারা যেমন স্বার্থ হাসিল হওয়ার পর বিশ্বাস ঘাতকতা করেন তেমনি আমিও করলাম। পরীজান কে আপনাদের থেকে অনেক দূরে নিয়ে গেছি আমি। চাইলেও আর খুঁজে পাবেন না তাকে। আমি শেষ বারের মত বলছি এইসব র*ক্তা*র*ক্তির ইতি টানুন।
আমাকে আমার মতো করে থাকতে দিন।’
-‘কি ভেবেছ তুমি এত কিছুর পরও পরীকে ছেড়ে দেব আমরা?’
-‘আপনার মত পিতা হাজারে একটা হয় জমিদার সাহেব। আর আপনি পিতা নামের ক*ল*ঙ্ক।’
শায়ের অন্দরে চলে গেল। আফতাব রাগে গজগজ করতে করতে বললেন,’শায়ের যেন জীবন্ত বের হতে না পারে। সেই ব্যবস্থা কর আখির।’
বারান্দায় উদাস হয়ে বসে আছে রুপালি। সেদিনের পর থেকে পিকুল আর জুম্মানের কোন খবর নেই। রুপালি চেয়েও পারেনি ওদের সাথে যোগাযোগ করতে। পরী শায়ের কে বিদায় জানিয়ে ওই রাতেই ফিরে আসে রুপালি। তার কিছুক্ষণ বাদে আফতাব তার দলসহ হাজির হয় অন্দরে। রুপালিকে জিজ্ঞেস করে পরী কোথায়? রুপালি চতুরতার সাথে নিজেকে আড়াল করে। এমন ভাব করে যেন সে কিছুই জানে না। সবাই সারা অন্দর খুঁজে কোথাও শায়ের পরীকে পায় না। রুপালিকে তেমন সন্দেহ কেউ করে না। কারণ সবাই তাকে ভিতু মনে করে।
তারপর থেকে পিকুলের জন্য ওর মন আকুপাকু করে। ওইটুকু ছেলেকে নিয়ে কোথায় গেছে জুম্মান কেমন আছে কে জানে?
শায়ের কে অন্দরে দেখে খুশিতে দৌড়ে গেল সে। পরীর জন্যও ভিশন চিন্তিত সে। তাই শায়ের কে দেখা মাত্রই জিজ্ঞেস করে,’পরী কেমন আছে? ও সুস্থ আছে তো? ভাল আছে পরী?’
-‘হ্যা ভাল আছে। আপনারা কি ঠিক আছেন? আপনার বাবা কি কোন প্রকার জুলুম করেছে আপনাদের উপর?’
-‘নাহ। আব্বা জানে এর পিছনে শুধু পরীর হাত রয়েছে কিন্ত সে এটা জানে না আমিও আছি।’
-‘আপনার বাবা যেন জানতে না পারে। সাবধান থাকবেন।’
-‘কিন্তু শায়ের আমার পিকুল? কতদিন ধরে ওকে দেখি না।’
রুপালির চোখে জল দেখা দিল ছেলের কথা আনতেই। শায়ের বলল,’চিন্তা করবেন না আপনার ছেলে ভাল আছে। আপনি চিঠি লিখে দেন আমি পৌঁছে দেব।’
জেসমিন সুস্থ হয়ে উঠেছেন। মালার সাথে সে উঠোনে আসতেই শায়ের কে দেখতে পেল। দুজনেই ছুটে গেল শায়েরের কাছে। মালা কেঁদে কেঁদে জিজ্ঞেস করে,’আমার মাইয়াডা কেমন আছে শায়ের?’
-‘ভাল আছে।’
-‘ওরে তুমি আর এইহানে আইতে দিও না। তাইলে ওর বাপে ওরে বাঁচতে দিব না। তুমি ওরে তোমার কাছেই রাইখা দিও।’
জেসমিন বললেন,’আমার একটা কথা রাখো শায়ের। জুম্মান রে ও কোনদিন জমিদার বাড়িতে আইনো না। ওরে ভুইলা যাইতে কইবা ও একজন জমিদারদের পোলা। ওরে সব ভুলাইয়া দিবা তুমি।’
শায়ের কথা বলে না। এত কিছুর পরেও পরীর মত ওনারা শায়ের কে চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করছে। শায়ের আশ্চর্য হয়ে সবার দিকে তাকিয়ে আছে। রুপালি নিজ ঘর থেকে বের হয়ে এলো হাতে তার একটা কাপড়ের ব্যাগ। সেটা শায়েরের হাতে দিয়ে বলে,’এতে আমার সমস্ত গয়না আছে। এগুলো দিয়ে ওরা অনেক দিন ভাল ভাবে চলতে পারবে।’
শায়ের বিনয়ের সুরে বলে,’আপনিও চলুন আমার সাথে। আপনাকে আপনার ছেলের কাছে রেখে আসব। মা ছাড়া অতটুকু বাচ্চা থাকবে কীভাবে?’
রুপালি সাথে সাথেই রাজী হয়ে গেল। মালাও তাতে সায় দিলেন এবং তার সব গয়না শায়েরের হাতে তুলে দিলেন। ছেলের ভালোর জন্য জেসমিন ও নিজের জমানো সবকিছু দিয়ে দিলেন। শায়ের মনে মনে হাসল। সুখে থাকার জন্য অর্থের প্রয়োজন তা আজ আবারও প্রমাণ হয়ে গেল। ওর কাছে এখন যত গয়না আছে তা দিয়ে জুম্মান সারাজীবন ভাল ভাবে কাটাতে পারবে। রুপালির ছেলেও ভাল ভাবে বড় হতে পারবে।
রুপালি নিজের ব্যাগ পত্র গুছিয়ে নিল শায়েরের সাথে যাবে বলে। বৈঠকে আসতেই আফতাবের লোকেরা ওদের আটকে দিল। আফতাব বললেন, ‘তোমাকে আর বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব নয় শায়ের। অনেক করেছো তুমি আমাদের জন্য এবার নাহয় তোমার জন্য আমরা কিছু করি।’
আফতাব ইশারা করে শায়ের কে বেঁধে ফেলার জন্য। শায়ের সবাইকে থামিয়ে বলে,’আচ্ছা মানলাম আজকে আপনারা আমাকে মেরে ফেললেন। তারপর কি হবে? আপনাদের সব সত্য সবার সামনে চলে আসবে। সেই ব্যবস্থা তো আমি করেই রেখেছি। জমিদার এবং তার ভাই অর্থের জোরে ছাড়া পেয়ে যাবে। কিন্ত বাকি সবাই? আপনাদের কি হবে? আর জমিদার আফতাব কতটা স্বার্থ পাগল সেটা তো কারো অজানা নয় তাই না?’
শায়েরের কথায় সব রক্ষিরা থেমে গেল। সবার মাঝেই ভয় দেখা দিলো। এটা সত্য যে আফতাব স্বার্থ পাগল। সেটা সবাই জানে। কারণ যে রক্ষিরা পরীর কাছে পরাজিত হয়েছিল, যাদের পরী বাগান বাড়িতে বেঁধে রেখেছিল তাদের আফতাব হ*ত্যা করেছে। এখন বাকিদের মধ্যে কেউ ভুল করলে তাদের পরিণাম ও ওদের মতোই হবে। হিং*স্র পশুদের মিত্ররাও তাদের অবিশ্বাস করে। আফতাবের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। কোন রক্ষিরা শায়েরের কাছে আসতে সাহস পেল না। সবাই আফতাবের দিকে তাকিয়ে রইল। আফতাব নিজেও কোন কথা বলছে না। শায়ের বলল,’অন্দরের কোন মহিলার উপর যেন ফুলের টোকাও না পড়ে।’
এক প্রকার শাসিয়ে গেল সে। রুপালিকে সাথে নিয়ে শায়ের জমিদার বাড়ি ত্যাগ করে। গায়ের মেঠো পথ ধরে হাঁটতে থাকে দুজনে। পথেই নাঈমের সাথে দেখা হয় ওদের। শায়ের বিচলিত হয়ে বলে,’আপনি এখানে?’
-‘কি করব বলুন? আপনার স্ত্রী আপনার জন্য পাগল হয়ে গেছে। আমাকে সে বিশ্বাস করছে না। তাই আপনাকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে আসলাম।’
-‘পরীজান এখন একা আছে? আপনি শুধু শুধু কেন আসতে গেলেন?’
-‘আপনার স্ত্রী নিজেই চলে আসতো আপনার কাছে। তাকে আটকাতেই আমার আসা। ভালোই হলো আপনাকে পেয়ে গেলাম। চলুন যাওয়া যাক?’
-‘আমাকে আগে নবীনগর যেতে হবে। আপনি ফিরে যান আমি রাতের মধ্যেই চলে আসব।’
-‘আপনাকে সঙ্গে করে না নিয়ে গেলে আপনার স্ত্রী আমাকে ছাড়বে না। চলুন আমিও আপনার সাথে যাব।’
শায়ের আর দ্বিমত করে না। নাঈম কে সাথে নিয়েই নবীনগর যায়। সেখানে জুম্মান পিকুল কে নিয়ে খুসিনার কাছে ছিল। ছেলেকে কাছে পেয়ে তখনি তাকে বুকে জড়িয়ে নিল রুপালি। অজস্র চুমুতে ভরিয়ে দিল ছেলেকে। পিকুল যে ওর প্রাণ। এই প্রাণকে বাঁচাতে সে সবকিছুই করতে পারে। শায়ের খুসিনার হাতে তুলে দিল রুপালি আর জুম্মান কে। সাথে ওর সব গয়না গুলো দিয়ে দিল। কিন্ত রুপালি কিছু গয়না শায়ের কে দিয়ে বলে,’এগুলো নিয়ে যাও তোমার কাজে লাগবে।’
-‘আমি এসব নেব না। যার জন্য জীবন দিতে আমি সর্বদা প্রস্তুত তার ভাল থাকার জন্য আমি সবকিছু করতে রাজী আছি। এসব আমার লাগবে না। পরীজানের জন্য আমি আছি আর আপনাদের জন্য এই গয়না গুলো। তাই এগুলো আপনার থাক।’
নাঈম কে সঙ্গে করে শহরের উদ্দেশ্যে রওনা হয় শায়ের। নাঈমের মনে হচ্ছে কিছু একটা হয়েছে। নাহলে সবাই এমন আলাদা কেন হচ্ছে? তবে ওর মনে জমে থাকা প্রশ্ন গুলো বাসায় ফিরে গিয়ে করবে বলে ভেবে নিয়েছে। তবে সেই সুযোগ সে পেল না। শায়ের ফিরে গিয়েই পরীর ঘরে চলে গেল। পরী তখনও শায়েরের জন্য ছটফট করছিল। শায়ের কে দেখা মাত্রই তাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে। কিন্ত শায়ের আলতো করে ধরে। শরীরে ব্যথা থাকা সত্ত্বেও পরী শান্তি অনুভব করছে এখন।
সে রুঢ় কন্ঠে বলে,’আপনি কেন গেলেন? যদি আপনার কোন ক্ষতি হয়ে যেতো?’
শায়ের জবাব দেয় না পরীর কথায়। পুড়ে যাওয়া মুখটার দিকে তাকিয়ে রইল শুধু। পরী শায়েরের চাহনিতে কোন বিরক্ততা দেখে না। দেখে একরাশ মুগ্ধতা যা সে আগেও দেখেছিল। তবে সে মুখে বলে উঠল,’এখন আর সুন্দর লাগে না আমাকে তাই না? এই ঝলসে যাওয়া মুখটা দেখতে খুবই বিরক্তিকর?’
ঠোঁটে চওড়া হাসি টানে শায়ের,’আপনার ভালোবাসায় আমি বহুবার ঝলসেছি। ছাই হয়ে গিয়েছি তবুও আপনি এই ছাই কে ভালোবেসে বুকে টেনেছেন। তাহলে আমি কেন পারব না? আমি এখনও ঝলসে যাচ্ছি আপনার ভালোবাসাতে। এই জ্বলন বুঝি থামার নয়।’
চলবে,,,
#পরীজান
#পর্ব ৫৪
#Ishita_Rahman_Sanjida(Simran)
❌কপি করা নিষিদ্ধ ❌
স্বামী স্ত্রীর একান্ত সময়ে তৃতীয় ব্যক্তির প্রবেশ নিষেধ। সেকথা ভেবে নাঈম ও গেল না। তবে সে খুব করে চাইছে সত্য জানতে। পরী আর শায়েরের তো সুখে সংসার করার কথা তাহলে ওদের পরিণতি এমন কেন হলো? প্রশ্নগুলো মাথায় জট পাকিয়ে দিচ্ছে যার ফলে অস্থির লাগছে নাঈমের। পরী আর শায়েরের ঘরের কাছে গিয়েও সে ফিরে আসে। তার কোন অধিকার নেই। তবুও একটা টান অনুভব করছে সে।
পরী শায়েরের থেকে দূরত্ব বজায় রেখে বসে আছে। শায়ের চুপচাপ জানালার বাইরের দিকে তাকিয়ে ব্যস্ত শহরটাকে দেখে যাচ্ছে এক মনে। বাইরের মানুষ গুলোর কত ব্যস্ততা!! বহু লোকজনের সমাগম রাস্তায়। জীবিকা নির্বাহের জন্য একেকজন একেক দিকে ছুটছে। শায়ের ভাবছে তারও তো কিছু করতে হবে তার পরীজানের জন্য। শহরে তার বেশ পরিচিত লোক আছে। তাদের সাথে যোগাযোগ করলে সে ভাল একটা কাজ পেয়ে যাবে। এসব চিন্তাই করছে সে।
-‘আপনি কি এতো চিন্তা করছেন?’
শায়ের ফিরে তাকাল পরীর দিকে,’আমার সব চিন্তাতে শুধু আপনি পরীজান। কীভাবে আপনার সাথে আমি থাকতে পারব এসব নিয়েই আমার সব ভাবনা।’
পরী হাসল ওর এই হাসিটা দেখতে কুৎসিত হলেও শায়েরের মন প্রাণ জুড়িয়ে গেল যেন,’আমাদের দূরত্ব বোধহয় খুব শীঘ্রই বাড়বে মালি সাহেব। আল্লাহ আপনাকে আমাকে তাড়াতাড়ি আলাদা করে দেবেন।’
শায়ের পরীর পাশে গিয়ে বসল,’আল্লাহ শরীর আলাদা করতে পারলেও আমাদের মন আলাদা করতে পারবে না পরীজান। রাখাল পাগল কিন্তু হয়েও তার ভালোবাসা ভোলেনি। আর আমি তো সুস্থ মানুষ।’
একটু চুপ থেকে কিছু ভেবে শায়ের বলল,’যারা আল্লাহ্র প্রিয় থাকে তাদের পরকাল সুন্দর হয়। আপনার পরকাল ও সুন্দর হবে। কিন্ত আমার পরকাল সুন্দর হবে না পরীজান। সেখানেও তিনি আমাদের আলাদা করে রাখবেন।’
পরী শায়েরের চোখে চোখ রাখে। পরীর সান্নিধ্য চায় শায়ের তা ওই চোখে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে সে। শায়ের শুধুমাত্র একটা জিনিস চায় কিন্তু মনে হয় সে সারা দুনিয়ার থেকেও বেশি কিছু চাইছে যা পাওয়া দুষ্কর।
পরী কিছু বলছে না। তাই শায়ের বলে উঠল,’আমি এখনও বলছি আমি আপনার যোগ্য নই তবুও আমি বিনা আপনি কারো নন। আপনার শেষ ঠিকানা আমার বক্ষস্থল।’
-‘আমার জন্য আপনি তো কত কিছুই করলেন। শেষ একটা কাজ করবেন। যেটা করলে স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা আমাকে আপনার হাতে তুলে দিবেন।’
শায়ের চমকালো,’শত যুগ অপেক্ষার বিনিময়ে আল্লাহ যদি আপনাকে আমাকে দিয়ে দেন তো আমি আপনার জন্য শত যুগ অপেক্ষা করতে রাজি আছি।’
-‘শত যুগ অপেক্ষা করতে হবে না আপনাকে। আল্লাহ্র নিকট ক্ষমা চান। আল্লাহ বলেছেন তার বান্দা তার কাছে চোখের জল ফেলে ক্ষমা চাইলে তিনি কাউকে ফিরিয়ে দেন না। খারাপ মানুষদেরও ক্ষমা করে দেন। আমার জন্য আপনি ক্ষমা চাইতে পারবেন না?’
জবাব না দিয়ে হাসল শায়ের। সে তার পরীজান কে পাওয়ার উপায় পেয়ে গেছে। এখন সে আর পিছু ফিরে তাকাবে না। শায়ের ভেবে নিয়েছে সে আর নূরনগর কিছুতেই ফিরে যাবে না। সেখানে পরীর জীবন সংকট রয়েছে। বাকি জীবনটুকু সন্তান আর স্ত্রীকে নিয়ে থাকবে।
শায়ের তার এক বন্ধুর কাছে কাজের উদ্দেশ্যে গেছে। আর নাঈম বাসায় রয়েছে। সে জানে শায়ের তাকে কিছুই বলবে নাহ। তাই নাঈম পরীকেই সব জিজ্ঞেস করবে। দ্বিধাবোধ হলেও পরীর ঘরের দরজার কড়া নাড়ে নাঈম,’আমি কি আসতে পারি?’
অপ্রস্তুত ছিল পরী। ওড়া দ্বারা মুখ মণ্ডল ঢেকে প্রস্তুত হয়ে নাঈম কে ভেতরে আসতে দিল সে। নাঈম চেয়ার টেনে বেশ দূরত্বে বসে। পরীকে বলে,’এখন কেমন লাগছে আপনার? খুব বেশি খারাপ লাগলে বলবেন।’
-‘আমি ঠিক আছি। একটুও খারাপ লাগছে না আমার।’
-‘আপনার এরকম অবস্থা হল কি করে? কোন মিথ্যা আমি শুনতে চাই না। আশা করি সত্য টাই বলবেন।’
-‘আমি নিজ হাতে তিনটা খু*ন করেছি ডাক্তারবাবু। আরও দুটো খু*ন আমি করব। ওদেরকে আমি কিছুতেই ছাড়ব না। সব বলব আপনাকে। তার আগে আপনি বলুন আপনি জেল থেকে ছাড়ার পেলেন কীভাবে?’
কিছুক্ষণের জন্য বাক শক্তি লোপ পেল নাঈমের। পরীর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল সে। তিনটা খু*ন
করেছে পরী! আর তা এত স্থির ভাবে বলছে যেন হ*ত্যা করা পুতুল খেলার মত! নাঈম কে চুপ থাকতে দেখে পরী বলে,’আমি সব বলব তার আগে আপনি বলুন আপনি কীভাবে ছাড়া পেলেন?’
-‘আমাকে শেখর ছাড়িয়ে ছিল। পুলিশ ধরে নিয়ে যাওয়ার পর শেখর আমার সাথে দেখা করতে যায়। আমি ওকে সব বুঝিয়ে বলি। বন্ধু তো,বিশ্বাস আমাকে করতেই হবে ওকে। শেখর ই সব বলে আমাকে ছাড়ায়।’
-‘তাহলে সে যখন আমাদের গ্রামে গেল তখন আপনার নাম বলল কেন?’
-‘এরপর বোধহয় সেখান থেকে এসে ও আমার সাথে দেখা করে।’
-‘ভুল শেখর সেদিন জীবিত ফেরেনি নূরনগর থেকে।
তার মানে শেখর আগেই আপনাকে ছাড়িয়েছে। সত্যি বলুন।’
-‘আপনি কীভাবে জানলেন শেখর মা*রা গেছে?’
-‘তাকে হ*ত্যা করা হয়েছে।’
নাঈম আরও চমকালো,’কি বলছেন আপনি এসব? শেখর তো এক্সিডেন্ট করে মা*রা গেছে।’
-‘ভুল! আপনার কথা শুনে এটা বুঝলাম যে শেখর আগেই জানত আপনি নির্দোষ তবুও সে নূরনগর গিয়ে মিথ্যা বলেছিল। কারণ টা হলো সে আগেই আন্দাজ করেছিল যে আমার আব্বাই কিছু করেছে। কিন্ত তাতেও কোন লাভ হলো না।’
-‘শেখর কে আপনার বাবা হ*ত্যা করেছিল! কিন্ত কেন?’
-‘জমিদার বাড়ি সম্পর্কে আপনি কতটুকু সত্য জানেন? যা দেখেছেন তা আপনার চোখের ভ্রম মাত্র। আপনি কি জানেন পালক কেও হত্যা করা হয়েছে!’
নাঈম এবার অস্থির হয়ে গেল। পরীর মাথা ঠিক আছে তো? শেখর কে হ*ত্যা করা হয়েছে এটা মানা যায় কিন্ত পালককে হ*ত্যা!! এটা সে মানতে পারছে না। কৌতুহল হয়ে পরীর ঢেকে রাখা মুখের পানে তাকিয়ে রইল সে। পরী এখনও স্থির হয়ে বসে আছে।
তবে পরী শায়েরের কথাটা গোপন রেখেছে। পালক আর শেখর কে যে শায়ের মে*রেছে সেটা জানতে পারলে নাঈম চুপ করে বসে থাকবে না তাই পরী সেসব তথ্য গোপন রেখেছে।
শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সব কথাই নাঈম কে পরী বলে দিল। ওর জীবনে ঘটে যাওয়া সব ঘটনার স্বাক্ষী হিসেবে সে নাঈম কে রাখতে চায়। তাই সব সত্য একমাত্র নাঈম কে জানিয়ে দিল পরী। সব শুনে নাঈম বলল,’শায়ের আপনাকে অনেক ভালোবাসে তাই না?’
-‘তার ভালোবাসার গভীরতা আজও আমি মাপতে পারিনি।’
-‘আমি আপনাদের সাথে থাকব সবসময়। আমাকে বন্ধু ভাবতে পারেন।’
-‘আমার একটা কথা রাখবেন?’
-‘বলুন।’
-‘আমার সন্তান কে আমি আপনার হাতে তুলে দিতে চাই। আমার কাজ শেষ হওয়ার পর আমি ফিরে আসব। ততদিন আপনি ওকে মানুষ করবেন।’
-‘শায়ের কি আপনাকে আবার নূরনগর যেতে দিবে? আমার মনে হয় না?’
-‘আমার সোনা আপা আর বিন্দুর হ*ত্যা*কারীদের শাস্তি আমি দেবোই। ওরা শুধু মানুষ হ*ত্যা করেনি হ*ত্যা করেছে আমার সুন্দর জীবন,আমার আম্মার মন। তাহলে ওদের ছাড়ি কীভাবে?’
-‘পুলিশ কে সব বলি আমি? আইন ওদের শা*স্তি দেবে।’
-‘তাতে আমার মন ভরবে না। আপনি সাহায্য না করলে কোন সমস্যা নেই। আমি অন্য পথ খুঁজে নেব।’
নাঈম ওখানে আর বসল না। বাইরে বের হয়ে এলো।
অবিশ্বাস্য লাগছে ওর কাছে সব!! তাহলে তো খুবই খারাপ লোক পরীর বাবা। কিন্ত পরীকে একবার যখন নূরনগর থেকে এখানে আনা হয়েছে তাই পরীকে আটকে রাখতে হবে। নাহলে বিপদ শুধু পরীর নয়। রুপালি,পিকুল আর জুম্মানের ও ঘোর বিপদ।
নাঈম পায়চারি করছে। সে শায়েরের অপেক্ষা করছে। পরীর বিষয়ে কথা শায়েরের সাথে বলতে হবে। শায়েরের ফিরতে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। দরজা নাঈম ই খুলে দিল। শায়ের কে দেখে স্বস্তির নিশ্বাস নিলো সে। শায়ের জিজ্ঞেস করে, ‘আপনি কি আমার জন্যই অপেক্ষা করছিলেন?’
-‘কিছু বলার ছিল আপনাকে।’
-‘বলুন!!’
-‘পরীকে যথাসম্ভব আটকে রাখুন। ওকে নূরনগর যেতে দিয়েন না।’
-‘পরীজান আপনাকে সব বলেছে তাই না?’
নাঈম মাথা নিচু করে সায় দিল,’হুম বলেছে।’
-‘আমাদের এখন এসব বলার সময় নয়। আমি জানি পরীজান আপনাকে সমস্ত সত্য বলেনি। নাহলে এতক্ষণ আপনি স্বাভাবিক ভাবে আমার সাথে কথা বলতেন না। এসব ব্যাপারে পরে কথা বলব।’
শায়েরের কথায় নাঈম ও সায় দিল। শায়ের চলে গেল নিজ ঘরে। পরী তখন ঘুমাচ্ছিল। বেশ দূর্বল এখন পরীর শরীর। তার উপর এখন বমি হয়। তবে খুব বেশি বমি হয় না। অসুস্থ শরীরে সামান্য বমি হতেই পরী আরও দূর্বল হয়ে পড়ে। তাই শায়ের চায় পরীকে একটু বেশি সময় দিতে। পরীকে ঘুমাতে দেখে শায়ের নিঃশব্দে পরীর পাশে গিয়ে বসে। হাত,পা, গলার ক্ষতগুলো কালচে বর্ণ ধারণ করেছে। ফর্সা শরীরে চন্দ্রকলঙ্কের ন্যায় ফুটে উঠেছে দাগ গুলো। শায়ের হাত বুলায় পরীর গলায়।
-‘আমি ভাগ্যবান আপনাকে পেয়ে। আপনার ভালোবাসা পেয়ে।’
-‘আপনি ভালোবাসেন বলেই আমি ভাগ্যবতী।’
পরী জেগে গেছে। পূর্ণ দৃষ্টিতে সে শায়েরের দিকে তাকিয়ে আছে,’আপনি যদি ভাল কাজ করতেন তাহলে আমাদের জীবনটা অন্যরকম হতো।’
পরীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিল শায়ের,’এরপর থেকে আমাদের জীবন সুন্দর করে গড়ার চেষ্টা করব। আপনি শুধু কথা দিন,নূরনগরে যাওয়ার চেষ্টা কখনোই করবেন না?’
কিছুক্ষণ শায়েরের দিকে চেয়ে থাকে পরী। তবে জবাব টা সে দিল না। পরীকে খাবার খাইয়ে দিলো শায়ের। গর্ভবতী থাকায় ওষুধ খেতে পারবে না পরী। যে ওষুধ গুলো খেতে পারবে সেগুলোই খেলো সে। এজন্য সেরে উঠতে বেশ দেরি হচ্ছে। তবে শায়েরের ধৈর্য দেখে নাঈম বিষ্মিত। ইশশ সে যদি এভাবে কাউকে ভালোবাসতে পারত কতই না ভাল হতো! প্রতিনিয়ত সে পরী আর শায়েরের ভালোবাসার সম্মুখীন হয়। নাঈমের তখন মনে হয় শায়েরের জন্যই বুঝি পরীর জন্ম। ভালোবাসতে অট্টলিকার প্রয়োজন হয়না তার প্রমাণ একমাত্র শায়ের। বাইরের দিক সামলে কীভাবে পরীকে সময় দেওয়া যায় সেটাই সবসময় শায়ের ভেবে চলে।
পাঁচমাস পার হয়ে গেছে। তবুও শায়ের একটুও ধৈর্যহীন হয়ে পড়েনি। সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে পরীকে সুস্থ করার। শায়েরের প্রতিটি মোনাজাতে কেবল পরী ছিল। আল্লাহ বোধহয় ওর কথা শুনেছে। আগের থেকে অনেক সুস্থ পরী। মুখের পোড়া চামড়া উঠে গেছে সব। কিন্ত ওর চেহারায় আগের মত মাধুর্য নেই। শায়ের বিনা আর কেউ বোধহয় কেউ পরীর দিকে মুগ্ধ নয়নে তাকাবে না।
তবে এতদিনে পরীকে নূরনগরের কথা ভুলিয়ে দিয়েছিল। প্রথম কয়েকদিন পরী শায়ের কে মালা, রুপালি,জুম্মানের কথা জিজ্ঞেস করলেও এখন আর করে না। নিজের শরীর আর অনাগত সন্তানের কথা ভেবেই দিন পার করেছে সে। কিন্ত এতদিন পর একটা চিঠিই পরীকে অস্থির করে তুলল। চিঠিটা হাতে নিয়ে স্তব্ধ হয়ে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে রইল পরী।
#চলবে,,,