পাতা বাহার পর্ব-১৩+১৪+১৫

0
496

#পাতা_বাহার
লেখনীতে: #বেলা_শেখ
#পর্ব- ১৩
(কপি করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ)

সূর্য মামার অবস্থান পশ্চিম আকাশে। তপ্ত বিকেলে ভ্যাপসা গরমে অতিষ্ঠ নগরবাসী। ব্যস্ততায় ঘিরে রেখেছে তাদের। রাস্তায় বিরতিহীন গাড়িঘোড়া চলমান। ফুটপাতের ফাস্টফুড ও ভাজিপুড়ির দোকানে মানুষের অঢেল ভিড়। অভাব নেই সাহায্য চাওয়া মানুষের! সুস্থ সমেত মানুষ চাইলে কাজ করে খেতে পারেন অথচ রাস্তায় রাস্তায় লোকদের কাছে হাত পেতে সাহায্য চায়। অথচ অনেক অচল মানুষও নিজের দমে পরিশ্রমের কাজ করে পরিবারের ভরণপোষণের দায়িত্ব পালন করে। এখানে সম্পূর্ণটাই আত্মসম্মান কাজ করে। একজন আত্মসম্মানবোধ মানুষ সবসময় নিজের দমে, পরিশ্রমের প্রচেষ্টায় সম্মানের সাথে চলতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন।

পাতা ব্যস্ততায় ঘেরা রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে রাস্তা পার হওয়ার উদ্দেশ্যে। লুবমান লতা ভাজিপুরির দোকানে পিয়াজি, কলার চপ, হালিম ইত্যাদি কিনতে ব্যস্ত সেখানে ভিড় হওয়ার কারনে লুবমান বড় বোনের পাশে দাঁড়িয়ে। আজকাল ছেলে মানুষের ভরসা নেই। ভিড়ভাট্টায় মেয়েদের বাজে স্পর্শ দিয়ে মজা নেওয়া তাদের পছন্দের কাজ কিনা! তাই পাতা একাই এসেছে রাস্তার অপাশে স্টেশনারির বড় শপ আছে। তার কিছু কেনার আছে যেমন আর্ট পেপার, রং তুলি, কিছু পেন্সিল সহ হাবিজাবি জিনিস। তার আঁকাআঁকির শখ আছে টুকটাক। পাতা রাস্তার এপাশে ওপাশে তাকিয়ে পার হওয়ার চেষ্টায় কিন্তু পারছে না। গাড়ি, বাইক গুলো বেশ বেগে ছুটে চলেছে। সে দু পা এগোলে এক পা পিছিয়ে যায়। নাহ তার দ্বারা হবে না। আপু ভাই আসলে ওদের সাথে যাবে। তার ভাবনার মাঝেই এক ট্রাফিক পুলিশ আসে।তার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলে,

-” আমার সাথে আসুন আমি পার করে দিচ্ছি!”

পাতা হেসে মাথা নাড়ে। ট্রাফিক পুলিশ হাতের লাঠি দিয়ে গাড়ি গুলোকে সাবধান করে পাতাকে রাস্তা পার করিয়ে দেয়। পাতা মুচকি হেসে তার দিকে তাকায়। তার বয়সীই হবে লোকটা। দাঁড়িই ভালোমতো গজায় নি।

-” আপনাকে ধন্যবাদ স্যার। ভালো থাকবেন!”

লোকটি হেসে মাথা নেড়ে বলে,

-” এটা আমার ডিউটি মিস! আসি সাবধানে রাস্তা পার হবেন!”

বলে হাত নাড়িয়ে চলে যায়। পাতা তার দিকে তাকিয়ে রয় কিছু পল। ছেলেটা মিষ্ট ভাষী দেখে ভদ্রলোক মনে হয়। পাতা ভাবনা বাদ দিয়ে স্টেশনারীতে চলে যায়। শপে ভিড় আছে, কিছু কলেজপড়ুয়া মেয়ে ছেলে ও কিছু গার্জেন সহ বাচ্চা! পাতা শপ কিপারকে ডেকে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র দিতে বলে। পাতা সামনে কাচের ডেস্কের উপর রাখা ফাইল দেখছিল তখনি পরিচিত কণ্ঠে পাশে তাকায়।
এতো মি. অরুণ সরকার। পাতা হেসে অরুণের দিকে একটু এগিয়ে যায়। অরুণের পাশে কলেজ পড়ুয়া ছেলেমেয়ে, অরুণের দিকেই চেয়ে আছে। মেয়েগুলো চোখ দিয়েই গিলে খাচ্ছে মনে হচ্ছে। এ বয়সী মেয়েদের আবার ত্রিশ প্লাস হ্যান্ডসাম পুরুষদের প্রতি বেশিই আকর্ষণ থাকে। পাতা বাচ্চা মেয়ে গুলোর দিকে তাকিয়ে মুখ টিপে হাসে। অরুণকে উদ্দেশ্য করে বলে,

-” হ্যালো মি. আপনি এখানে?”

অরুণ একবার তার দিকে তাকিয়ে সামনের শপ কিপারকে গম্ভীর গলায় বলে,

-” আই এম গেটিং লেট! হারি আপ?”

দোকানি তার লিস্ট দেওয়া জিনিস গুলো দেয়। স্পাইডার ম্যান ছবি ওয়ালা ক্লিপ বোর্ড! ভোরের ফেভারিট সুপার হিরো স্পাইডারম্যান! কার্টুন শেপের ইরেজার, শার্পনার, পেন্সিল বক্স, অনেক গুলো পেন্সিল, স্কেল সহ আরো বেশ কিছু ।কাল কলিজার প্রথম এক্সাম বলে কথা!!

পাতা অরুণের দিকে চেয়ে! গম্ভীর্যে ঘেরা মুখশ্রী শপ কিপারের পানে চেয়ে। তার কথা কি শুনতে পায় নি? নাকি খেয়াল করে নি তাকে! মেয়েগুলো তার দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে। সে অরুণের নেওয়া জিনিস পত্রের দিকে চাইল। ভোরের জন্য সব! সে পুনরায় হেসে বলল

-” ভোরের জন্য সব? ভোরও এসেছে? কই দেখছি না যে মি. ভোরের আব্বু?”

অরুণ আবারো অগ্রাহ্য করে। বিল মিটিয়ে জিনিসপত্র নিয়ে হন হন করে চলে যায়। গাড়িতে উঠে বসে। পাতা সেদিকে তাকিয়ে দেখলো সব! এভাবে অগ্রাহ্য করে চলে গেল! এভাবে অপমান করল!! হাই হ্যালো টুকুও বলা তো দূরের কথা তাকায় নি পর্যন্ত!! অথচ কাল রাতে ছেলে কাঁদছিলো বলে ফোন করে কথা বলতে বলল! কতটা স্বার্থপর লোক! কথা বললে কি হতো? ইগো হার্ড হতো?

পাশের মেয়েগুলো হেসে উঠলো। গুসুর ফুসুর করছে। একটা মেয়ে তো বলেই দিলো,

-” আপু? কি এটিটিউড দেখেছেন? আপনাকে তো ভাও ই দিল না! সো স্যাড!”

বলেই হাসতে লাগল। পাতার রাগ হলো বেশ। দাঁত খিচে অরুণকে ভয়ংকর গালি দিয়ে ঠোঁটে হাসি ঝুলিয়ে মেয়েদের দিকে তাকিয়ে বলল,

-” দেখলাম তো! লোকটার একটা ছেলে আছে পাঁচ বছরের! আমি তার স্কুলের টিচার! চিনি তাকে! সেও চেনে। হঠাৎ দেখা হলো ভদ্রতার খাতিরে কথা বললাম! অথচ তিনি ফিরেও চাইলেন না! সব বড়লোকি উচ্চবিত্ত পরিবারের গরীমা! আমার মতো সামান্য স্কুল টিচারের সাথে রাস্তা ঘাটে কথা বললে কেমন দেখায় না?”

বলে শপ কিপারের থেকে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে টাকা মিটিয়ে মেয়েদের দিকে মুচকি হেসে চলে গেলো সেখান থেকে! ছেলেমেয়ে সহ সবাই তার যাওয়ার দিকে চেয়ে রইলো!
_______

অরুণ একটা রেস্টুরেন্টে বসে আছে। কর্ণারের টেবিল বুক করেছে।বিকেলের দিকে হওয়ায় ভিড় টা একটু বেশিই। অরুণ অর্ডারকৃত কোল্ড কফিতে চুমুক দিয়ে ঘড়ির দিকে চেয়ে সময় দেখে। নির্দিষ্ট সময়ের দশ মিনিট পেরিয়ে গেছে।সে আর পাঁচ মিনিট অপেক্ষা করবে আসলে তো হলোই না আসলে চলে যাবে। পাশে রাখা ছেলের জন্য কেনা জিনিসগুলোর দিকে নজর আসে। ছেলেটা আসার জন্য অনেক বায়না করছিল। সে বুঝিয়ে রেখে এসেছে। মেয়ে দেখতে এসেছে সে। ওই শ্রাবনী নামক মেয়েটির সাথে দেখা করতে। আসমা বেগম কাল বিকেলেই তার সাথে কথা বলে। সে জানায় আগে সে কথা বলবে জানবে তারপর কথাবার্তা এগোবে। আসমা বেগম ঘটকের সাথে কথা বলে। ঘটক মেয়ের পরিবারের সাথে কথা বলে। তারাও সায় জানায়। আজ ছুটির দিন হওয়ায় তারা দেখা করার সিদ্ধান্ত জানায়। ভোর এসবের কিছুই জানে না। অরুণ আগেই জানাতে নিষেধ করেছে। সে সময় বুঝে বলবে। সে সময় দেখে চার মিনিট পার হয়ে গেছে। সে সামনে তাকায়। একটা মেয়ে আসছে। লেগিংস আর কামিজ পড়নে। ওড়না নেই, কাঁধে ভ্যানিটি ব্যাগ। লম্বা চুল ছেঁড়ে দেওয়া। চোখে কালো সানগ্লাস! অরুণের টেবিলের সামনে এসে চশমা খুলে বলে,

-” অরুণ সরকার?”

অরুণ মাথা নাড়ে। মেয়েটি হেসে সামনের সিটে বসে।ব্যাগ টেবিলে রেখে বলে,

-” স্যরি ফর লেট! আমি শ্রাবণী আহসান! কেমন আছেন আপনি?”

অরুণ কোল্ড কফির লাস্ট সিপ নিয়ে চোখের কালো খয়েরি ফ্রেমের চশমাটা খুলে হাতে নেয়। শ্রাবনীর দিকে তাকিয়ে গাম্ভীর্যতা বজায় রেখে জবাব দেয়,

-” আলহামদুলিল্লাহ! আপনি?”

শ্রাবনী স্বভাবসুলভ হেসে বলে,

-” ভালো! আপনি অর্ডার করেছেন?”

-” না! আপনি‌ করুন। এক্সকিউজ মি?”

বলে পাশের টেবিলে অর্ডার সার্ভ করা অল্প বয়সী ছেলে ওয়েটারকে ডেকে নিলো। ছেলেটি অর্ডার সার্ভ করে অরুণদের টেবিলে এসে অর্ডার নিয়ে যায়। ওয়েটার যাওয়ার পর অরুণ শ্রাবনী চুপচাপ বসে। কি বলবে কেউ বুঝতে পারছে না। পর পর নিরবতা ভেঙ্গে শ্রাবনী হেসে বলে,

-” আপনি চুপ করে আছেন যে? কিছু বলুন?”

-” আপনি শুরু করুন!”

শ্রাবনী অরুণের দিকে চায়। সে শুনেছে ছেলের বয়স সাইত্রিশ একটা ছেলেও আছে পাঁচ বছরের। লোকটা নিশ্চয়ই বুড়ো গোছের হবে!!সে তো ছেলের ছবি না দেখেই ফ্যামিলিকে না করে দিয়েছিল। তার ওতটাও খারাপ দিন আসে নি যে এক বাচ্চার বাপকে বিয়ে করতে হবে!! কিন্তু বাবা ভাই মানে নি! অগত্যা আসতে হয়েছে! ভেবেছিল না করে দেবে! কিন্তু অরুণ সরকারকে দেখে মনটা খানিক পরিবর্তন হয়েছে! নাহ লোকটা স্বপুরুষ বটে! কানের পাশের চুল কিছু পাকলেও বুড়ো টাইপ নয়। সুঠাম দেহের গাম্ভীর্যে ভরপুর তাগড়া লোক! ফর্সা মুখশ্রীতে গালের একটু বড় বড় দাঁড়িতে বেশ লাগছে। চশমা পড়ে কেন লোকটা? চোখে কম টম দেখে নাকি! সে ভাবনা বাদ দিয়ে অরুণকে বলে,

-” আমি কি বলবো বুঝতে পারছি না! শুনেছি আপনার লাভ ম্যারেজ ছিল! তাহলে ডিভোর্স কেন হলো? কিছু মনে করবেন না! যেহেতু দুজনের বিয়ের ব্যাপারে কথা বার্তা চলছে! কোনো রাখ ঢাক রাখা উচিত না! আপনিও জিজ্ঞেস করতে পারেন আমায়!”

অরুণ টেবিলের উপর এক হাত রেখে সিটে গা এলিয়ে বসে।

-” কিছু মনে করি নি! দুজনের মতের মিল ছিল না! ও ওর ক্যারিয়ার নিয়ে বেশ সিরিয়াস ছিল। এন্ড আয় এপ্রিসিয়েট দ্যাট। পি এইচ ডি করার জন্য ক্যালিফোর্নিয়ায় বেশ কয়েকবার এপ্লাই করেছিল। ও প্রেগন্যান্ট থাকা অবস্থায় গ্র্যান্টেড হয়। তখন ওর ফাইভ মান্থ রানিং! ও তবুও যেতে চেয়েছিল। আমি যেতে দেই নি। ও মনে রাগ পুষে রেখেছিল। মার্ক মায় ওয়ার্ড ভোর ইজ মায় চাইল্ড। ভোর হওয়ার পর ও আবার এপ্লাই করে বিভিন্ন জায়গায়। আমি বাঁধা দেই নি কখনো! বাট পারমিশন পায় না! ভোর ও আমাকে এ নিয়ে দোষী ভাবতে থাকে । মাঝে মাঝে এ নিয়ে বেশ ঝগড়া হতো! ভোরের দু’বছর বয়স হওয়ার পর কিরগিজস্তানের এক ভার্সিটি থেকে মেইল আসে সেখানে পি এইচ ডির জন্য এপ্লাই করেছিলো। তো সে যাবে আমি বললাম ওকে যাও! হঠাৎ সে ডিভোর্সের কথা বলে! আমি অবাক হয়ে ছিলাম অনেক। আমি তো তাকে মানা‌ করি নি! তাহলে! সে রিজন সরূপ জবাব দেয় আমার জন্য তার ক্যারিয়ারে একবার ইফেক্ট পড়েছে। ভবিষ্যতে পরবে না তার গ্যারান্টি কি? তাই! দেন ডিভোর্স!”

শ্রাবনী ভ্রুযুগল কুঁচকে যায়।

-” ছেলেকেও নিতে চায় নি?”

অরুণ না বোধক ইশারা করে। শ্রাবনী মাথা দুলায়।

-” আমার ডিভোর্সের কথা শুনবেন না?”

-” বলুন!”

শ্রাবনী মুচকি হেসে বলতে শুরু করে,

-” আমার এক্স হাজবেন্ড একটা জানোয়ার ছিলো। একজন মেয়েবাজ লোক সাথে মাতাল! আর্মি অফিসার ছিল! আমি জানতাম না প্রথমে। আমার এক ফ্রেন্ড আর্মিতে ছিলো। সে ইনফর্ম করে। সাথে কিছু ভিডিও। আমার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়লো। তবে নিজেকে বুঝিয়েছি। ওকেও বুঝিয়ে ছিলাম। ও বলেছিল সব ছেড়ে দিবে। কিন্তু সেটা মুখেই। কিচ্ছু ছাড়ে নি। একদিন ঝগড়াও হয় বেশ। সেদিন প্রথম হাত তুলেছিলো। ব্যস‌ চলে এসেছি! ওর লাথি গুতা সহ্য‌করে সংসার করার মেয়ে আমি না! তাই ডিভোর্স!”

এরমধ্যেই অর্ডার চলে আসে। ওয়েটার ছেলেটা সব দিয়ে চলে যায়। অরুণ দেখে সব ফাস্টফুড। পিৎজা, বার্গার, মোমোস ইত্যাদি। সে কিছু নিলো না। শ্রাবনীর দিকে তাকিয়ে বলল,

-” দেখুন মিস শ্রাবনী আহসান! আমি ক্লিয়ার কথা বলতে চাই! আমার কাছে আমার ছেলে সবার আগে। সে একজন আম্মু চায় তাই বিয়ে টা করা। তো আপনার শুনলে খারাপ লাগতে পারে বাট আমি এমন কাউকে চাই যে আগে ছেলের আম্মু হবে, পরে সে আমার অর্ধাঙ্গী। তবে এমন না যে তাকে মেনে নেবো না বা ভালোবাসবো না। ইন মায় অপিনিয়ন ভালোবাসা টা একদিনে হয় না। ধীরে ধীরে মন কুঠিরে পরিস্ফুটিত হয়। যেটা একদিনে হয় সেটা ইনফ্যাচুয়েশন/ক্ষনিকের ভালোলাগা !তাই যে আমার জীবনে‌ আসবে তাকে আগে আমার ছেলের আম্মু হতে হবে !পরে স্ত্রী !আমি আশা করছি আপনি বুঝতে পারছেন?”‘

শ্রাবনী হাসে মনে মনে। পিৎজার স্লাইডে কামড় বসিয়ে কোল্ড ড্রিঙ্কসে চুমুক দেয়।

-” ছেলেকে খুব ভালোবাসেন বুঝি? বুঝতে পারছি। তবে আমি শুনেছি মা মরলে বাপ তাওঈ! যদিও আপনার ছেলের মা মরেনি ডিভোর্স হয়েছে। আপনি ছেলের জন্য মা খুঁজছেন। ভালো কথা! বিয়ের পর এই আপনিই চেঞ্জ হয়ে যাবেন। আয় এম নাইন্টি নাইন পার্সেন্ট সিওর। নতুন বউ নিয়ে মেতে থাকবেন!ছেলের থেকে একটু একটু করে দূরত্ব বাড়বে। তারপর আবার নতুন ঘরে ছেলে মেয়ে আসবে! তাদের সাথে থাকতে থাকতে দূরত্ব এতো বেড়ে যাবে আপনার তার কথা খেয়ালই থাকবে না। হয়তো তার নিডস গুলো পূরণ করবেন কিন্তু..!”

অরুণ শান্ত দৃষ্টিতে শ্রাবনীর দিকে তাকিয়ে। শ্রাবনীর কথা গুলো খুব একটা মিথ্যা নয় বাস্তব জীবনে। তবে তার ক্ষেত্রে কথাগুলো একদমই প্রযোজ্য হবে না। তার ছেলে তার কলিজা। কিভাবে ভুলে যাবে সে? ছোট থেকেই তার কোলে কোলেই মানুষ হয়েছে। মায়ের কোল কমই পেয়েছে। মা ভার্সিটির বিজি লেকচারার ছিল কিনা! সে শ্রাবনীকে থামিয়ে বলে,

-” আপনি নাইন্টি নাইন পার্সেন্ট সিওর বললেন বাকি ওয়ান পার্সেন্ট ইজ মি! আমার ছেলে আমার অক্সিজেন! আমার কোলেই বড় হয়েছে। দু বছরের ছেলেকে সাথে নিয়েই পুরো অফিস সামলিয়েছি! বাড়িতে রেখে যায় নি কখনো! যত ইম্পর্ট্যান্ট মিটিংই হোক না কেন তাকে বুকে জড়িয়েই মিটিং করেছি! শত ব্যস্ততার মাঝেও ছেলের সব আবদার পূরণ করেছি। তার নতুন আবদার আম্মু চাই! তার জন্যই এসব। মনে রাখবেন সব বাবা কিংবা মা এক হয় না!”

শ্রাবনী সিরিয়াস হয়ে বসে। অরুণের দিকে তাকিয়ে বলে,

-” আমার কথায় রাগ করলে স্যরি বাট এসব বাস্তবতা! আমার এক ফ্রেন্ড নিজে এর ভুক্তভোগী! ”

অরুণ হাসে অল্প। ঘার পাশ ফিরাতেই দুই টেবিল দূরত্বে দেখতে পায় একটা মেয়ে হাই দিলো মুচকি হেসে। সেও প্রতিত্তরে হাই দিলো হাত নাড়িয়ে। মেয়েটা মিস পাতাবাহারের বোন লতা! তার সাথে লুবমান ও মিস পাতাবাহার! সে হাতের ইশারায় তাদের ডাকে। লতা লুবমান যেন এটারই অপেক্ষায় ছিল।

পাতা, লতা ,লুবমান কেনাকাটা শেষে রেস্টুরেন্টে আসে। ঢোকার সাথে সাথে অরুণের দিকে তাদের নজর পরে। পাশে আবার সুন্দরী মেয়ে। তাদের কৌতুহল আকাশচুম্বী। লুবমানের না হলেও লতার ‌। না জানা অবধি পেটের ভাত হজম হবে না। পাতা তো মুখ গম্ভীর করে রেখেছে স্টেশনারি থেকে আশার পর থেকেই।তারা ঝটপট উঠে অরুণদের টেবিলে বসে‌। চারটা আসন থাকায় প্রবলেম হয় না। অরুণ ভোরের জন্য কেনা জিনিস পত্র টেবিলে রাখে। সে চাইলে গাড়িতেই রেখে আসতে পারতো! কিন্তু তার হাতে নিয়ে ঘুরতেই ভালো লাগছিল কেমন যেন।

লতা বসে অরুণকে বলে,

-” আমি রেস্টুরেন্টে ঢোকার সময়ই আপনাদের দেখেছি ! ভাইয়া হু ইজ সি?”

শ্রাবনী এদের আগমনে ঢের বিরক্ত। অরুণকে কিছু বলতে না দিয়ে শ্রাবনী হেসে বলে,

-” ফিয়ন্সে বলতে পারেন! আসলে দুজনের ফ্যামিলি থেকে বিয়ের কথা চলছে। আর আপনারা?”

অরুণ তাদের পরিচয় করিয়ে দেয়,

-” ওনার নাম লতা। আমরা একই ভার্সিটিতে পড়েছি। আমার জুনিয়র আর ওনার হাসবেন্ডের সাথে চেনাজানা আছে আমার। আর উনি ওনার ভাই!”

লতা মাথা নাড়ে‌। শ্রাবনী লতাকে ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করে। প্রথম স্বামীর ধোঁকার পর সে ছেলেদের একটু কমই বিশ্বাস করে। আর লতা মেয়েটি দেখতে বেশ সুন্দরী। শ্রাবনী অরুণের দিকে তাকিয়ে বলে,

-” ওহ্।”

অরুণ সরকার শ্রাবনীর দিকে তাকিয়ে বললো,

-” তা আপনার কি মতামত এ বিয়েতে?”

শ্রাবনী লতা লুবমানের দিকে তাকিয়ে বলে,

-” আই থিংক আমাদের পার্সোনালি কথা বলা উচিত ছিলো! কোনো ব্যাপার না! অন্য সময়! আমি উঠছি!”

লতা তরিঘরি করে উঠে বলল,

-” ইশ আমরা ডিস্টার্ব করলাম আপনাদের। আপনারা কথা বলুন। আমরা যাচ্ছি! এই লুব ওঠ?”

শ্রাবনী হেসে বলে,

-” একদম না। আপনারা কথা বলুন আমার একজায়গায় যেতে হবে।ইটস ইমার্জেন্সি! আপনারা না এলেও যেতাম। মি. অরুণ আসি ?”

অরুণ মাথা নাড়ায়। শ্রাবনীর একটু রাগ হয়। মি. অরুণ তো একবার থেকে যাওয়ার অনুরোধ করতে পারতো! সে হন হন করে সেখান থেকে চলে যায়। লুবমান আফসোস করে বলে,

-” স্যরি ভাইয়া। আমাদের জন্য আপনাদের ডেটটা নষ্ট হয়ে গেল! ইশ উনি বোধহয় মাইন্ড করেছেন! উই আর রিয়েলি স্যরি! ”

অরুণ সামনে ঝুঁকে টেবিলে কনুই ঠেকিয়ে অধরকোনে হালকা হাসি ঝুলিয়ে বলে,

-” স্যরি বলতে হবে না। বরং তোমাদের ধন্যবাদ! আই এম ইরিটেটিং উইথ হার কম্পানি! তোমরা এসে উপকার করলে!”

লতা চোখ ছোট ছোট করে বলে,

-” পছন্দ হয় নি তাই না ভাইয়া?”

অরুণ মাথা নাড়ে। হয় নি! মেয়েটা মা ম্যাটেরিয়াল না! তবে হ্যা খারাপও নয়।
লুবমান কপালে ভাঁজ ফেলে বলে,

-” আপুটা কিন্তু দেখতে ভালোই ছিল! পছন্দ কেন‌ হলো না?”
অরুণ হেসে কাঁধ উঁচিয়ে পাশের দু টেবিল পরে পাতার দিকে একপল তাকিয়ে বলে,

-” কি জানি! তোমরা এখানে?”

-” কেন আসতে পারি না বুঝি? মধ্যবিত্তের আসতে নেই?”

লুবমানের কথায় অরুণের মুখশ্রী পুনরায় গম্ভীর হয়ে যায়।

-” আমি সেটা বলি নি! এখানে কারো সাথে এসেছো নাকি সেটা বলেছি!”

লুবমান অরুনের দিকে তাকিয়ে বলে,

-” আরে ভাই মজা করলাম তো! আপনার ছেলেকে আনেন নি?

অরুন মাথা নাড়ে আনে নি।লতা ভাইকে চোখ রাঙিয়ে অরুণকে বলে,

-” ওর কথায় কিছু মনে করবেন না ভাইয়া! এই কেনাকাটার পর এই দুই জনকে নিয়ে এলাম খাওয়াতে!”

-” তা আরেকজন কই?”

লতা খানিক দূরে বসা পাতার দিকে তাকিয়ে বলে,

-” ওই তো ! স্টেশনারি গিয়েছিল কিছু কিনতে। ওখান থেকে আসার পর থেকেই মুখ গম্ভীর বানিয়ে বসে আছে! ওর কথা বাদ দিন তো!”

অরুণ পাতার দিকে চায়। বাহ এই টুকুনি বিড়াল শাবকের আবার মুড! শপে সে পাতাকে দেখেছে! তার কথাও শুনেছে। তবে জবাব দিতে মন চায় নি! সে মিস পাতাবাহারকে আগেই দেখেছে! রাস্তা পার হতে পারছিলো না। সে শপ কিপারের কাছে লিস্ট দিয়ে এগিয়েও যায় হেল্প করতে। কিন্তু তার আগেই ট্রাফিক পুলিশ পার করে দেয়। তার সাথে হেসে হেসে কথাও বলছিলো আবার। সেটা দেখে তার রাগ হওয়ার কথা মোটেই না কিন্তু হয়েছিল! এর কারণ কি দাঁড়ালো! না এই মিস পাতাবাহারের থেকে দূরত্ব বজায় রেখে চলতে হবে। মেয়েরা হলো চলতি ফিরতি মায়াবী নাগিন! কখন জালে ফেঁসে যায় কে জানে! লোকে জানলে ছিঃ ছিঃ করবে শুনলে যে হাঁটুর বয়সী মেয়ের জালে আটকা পড়েছে অরুণ সরকার!!
_______

গোধূলি বেলা। চিলের দল উড়ে বেড়াচ্ছে নিচু দিগন্তে! সাথে রঙ বেরঙের ঘুড়িও দেখা যাচ্ছে। লতারা ওটোতে বসে আছে। গন্তব্য বাড়ি! লুবমান লতা টুকিটাকি কথা বললেও পাতা চুপ করেই আছে। চুপ কথা ভেঙে পাতা কৌতুহল মনে জিজ্ঞেস করে,

-” ওই নাক উঁচু ম্যানারলেস লোক কি বলছিলো তখন?”

লতা লুবমান তার দিকে তাকিয়ে তীক্ষ্ণ নজর ফেলে বলে,

-” কার কথা বলছিস?”

-” তোমার সিনিয়র ভাইয়াআআ ওরফে অরুণ সরকার!”

লতা কটমট করে চেয়ে বলে,

-” বাজে কথা বলবি না!”

-” বাহ রে বাজে কথা কি বললাম?”

-” তোর সিনিয়র ভাইয়াআআ বলার টোন বাজে ছিল!”

পাতা ভেংচি কেটে বলে,

-” তোমার মাইন্ড বাজে ছিলো! তা কি বললেন উনি? পাশের মেয়েটাই বা কে ছিলো?”

-” মেয়েটার সাথে তার বিয়ের কথা চলছিল বোধহয়। বাট ওনার পছন্দ হয়নি!”

পাতার কপাল কুঁচকে যায়।

-” ওনার পছন্দ হয়নি নাকি মেয়েটা রিজেক্ট করে দিয়েছে হু নোস! এই ওনার এক্স ওয়াইফকে চিনো? সেম ভার্সিটিতেই ছিলো শুনেছি!”

লতা মাথা নাড়ে।

-” হুম চিনি। মেয়েটার নাম বর্ষা। আমাদের দুই ব্যাচ সিনিয়র।দেখতে শুনতে অতটাও ভালো নয়! আবার খারাপও নয়। ঠিকঠাক আছে। অরুণ ভাইয়া তাকে বেশ ভালোবাসতো! তাদের প্রেমের গুঞ্জন তো পুরো ভার্সিটি ছড়িয়ে ছিল। দুজনকে একসঙ্গে প্রায়সই দেখা যেত। বেশ ভালো জুটি ছিল! ”

-” এতো ভালোবাসা তাহলে ডিভোর্স কেন হলো?”

-” সেটা জানি না! হয়েছে হয়তো কিছু সিরিয়াস! এই তোর এতো ইন্টারেস্ট কেন? ক্রাশ টাশ খেয়েছিস নাকি? খেলে ভুলে যা! বান্দা সলিড তবে খুব ঝাঁঝালো!”

বলে হাসতে থাকে।লুবমান বোনকে কঠিন সুরে বলে,

-” আপু? এসব কি কথা! কোথায় পাতা আর সে! এক বাচ্চার বাপ বয়সও অনেক। তুই আমাদের পাতার সাথে তুলনা করছিস?”

-” আরে আমি তো মজা করছিলাম! তুই ও না! আর পাতা তুই তখন আসলি না কেন? অরুণ ভাইয়া তোর কথা জিজ্ঞেস করেছিলো!”

পাতা নাকের পাটা ফুলিয়ে বলে,

-” আমি তোমাদের মতো ছোচা না বুঝলে! এক দিনের পরিচয়! রেস্টুরেন্টে দেখা হলো ওমনি চলে গেলাম! কি ভাববে? যে খাওয়ার জন্য এসেছে ছোট লোক ভাববে না!”

-” যে যেমন ধারার সে তেমনি ভাববে!”

পাতা শান্ত দৃষ্টিতে বোনের দিকে চায়। লতা মিষ্টি করে বলে,

-” পাতু তুই এমন অসামাজিক কেন? বাচ্চা ছাড়া কারো সাথেই মিশতে পারিস না! একটা বন্ধুও নেই তোর!”

-” মিশে কি হবে! সবাই স্বার্থপর!দুনিয়ায় কেউ স্বার্থ ছাড়া কাজ করে না! সবাই স্বার্থপর বুঝলে আপু! স্বার্থ ফুরিয়ে গেলে মানুষকেও ভুলে যেতে দুদন্ড ভাবে না। আর বাচ্চারা ওরা তো স্বার্থ চেনে না! ওদের মন নিষ্পাপ হয়!
________

স্নিগ্ধ সকাল। সূর্য উঠেছে দূর নীলিমায়। তার আলোর ঝলকানিতে আজকের পরিবেশ যেন বেশ ঝলমলিয়ে আছে। সাথে গরম ফ্রি! অরুণ আজ সকাল সকাল উঠে গোসল সেরে তার ঘরে বেলকনিতে অবস্থানরত সব গাছে পানি দেয়।আজ আর মর্নিং ওয়াকে যায় নি। ছেলেটার এক্সাম কত ব্যস্ততা তার! তার উপর ছেলের আবদার তাকে সাথে যেতে হবে। শুধু তাই না এক্সাম শেষ হওয়ার অবধি সেখানে থেকে তাকে নিয়ে ফিরতে হবে। অরুণ বিনা বাক্যব্যয়ে মেনে নেয়। ভোরকে ডেকে তুলে কোলে করে ওয়াশ রুমে নিয়ে ফ্রেশ করিয়ে ব্রাশ করে দিলো। গোসল করিয়ে কোমড়ে তোয়ালে ঝুলিয়ে রুমে এনে বিছানায় দাঁড় করিয়ে চুল মুছে দিতে থাকে। ভোর মুখ ফুলিয়ে নিয়েছে।

-” আব্বু এখনো অনেক সময় বাকি আরেকটু ঘুমিয়ে নিতে পারতাম আমি!”

অরুণ হেসে ছেলের গালে চুমু দিয়ে তোয়ালে বেলকনিতে রেখে এসে আলমারি থেকে থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট বের করে বলে,

-” আব্বু আজ তোমার পরীক্ষা আছে। সব পড়াগুলো রিভাইস দিতে হবে না?

-” কতবার পড়লাম তো! আরো? আমি আর পড়বো না!”

-” শুধু একবার কলিজা?”

ভোর কিছু বলে না। অরুণ তার তোয়ালে খুলে প্যান্ট পড়িয়ে দিলো। ছেলেকে বুকে নিয়ে রুম থেকে বেরোতে বেরোতে বলে,

-” আনি বুড়ি সেই কখন উঠে পড়া শুরু করে দিয়েছে! দুই তিনবার রিভাইস দেয়া হয়েছেই বোধহয়!”

ভোর কিছু বলে না। অরুণ ছেলেকে নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নামে। কিচেনে গিয়ে দেখে মিনু রান্না করছে সকালের। ভোর তাকে দেখে অরুণের কোল থেকে নেমে দৌড়ে তার কাছে গিয়ে জড়িয়ে ধরে।

-” মিনু খালা কি রান্না করছো তুমি?”

মিনু হেসে তাকে তুলে কেবিনেটের উপর বসিয়ে কপালে চুমু দেয়।

-” এই তো! ফিরনি বসিয়েছি। চা বানাবো, রুটি, অমলেট, ভাজি!”

-” আমি কি খাবো?”

-” তুমি আমার হাতে মার খাবে ভোর!”

ভোর বাবার দিকে চায় ঠোঁট উল্টে।আভারি এসে ভোরের মাথায় হাত বুলিয়ে অরুণকে বলে,

-” কি কইরেছে স্যার ?”

ভোর আভারির কোলে উঠে বলে,

-” কিছুই করি নি আমি! তোমার স্যার এমনিতেই বকে আমায়!”

আভারি স্যারের দিকে চায়। অরুণ চোখ ছোট ছোট করে বলে,

-” আচ্ছা তাই না? কেন বকি? একটু পরে এক্সাম না তোমার? পড়তে হবে না?”

-” সব পড়া কমপ্লিট আমার! আর পড়তে হবে না! আমি পড়বোও না। না মানে না!

চিল্লিয়ে বলে ভোর। অরুণ চোখ রাঙায়। ব্যস ভোরের চোখে অশ্রু ভরে ওঠে। অরুণ দেখে বলে,

-” একদম কাঁদবে না!”

ভোর আভারিকে জড়িয়ে কান্না শুরু করে দেয়। অরুণ এগিয়ে এসে আভারির কোল থেকে ভোরকে নিলো ।মিনুকে উদ্দেশ্য করে বলে,

-” একগ্লাস গরম দুধ হরলিক্স মিশিয়ে আনো।”

মিনু মাথা নাড়ায়। অরুণ ভোরকে কোলে নিয়ে রুমে যায়‌। বিছানায় বসিয়ে বই খাতা এনে ভোরের সামনে দিয়ে পাশে বসে। পাতা বাহার কম্ফোর্টের ভিতর থেকে বেরিয়ে ভোরের কোলে বসে মিও মিও করে। ভোর মুখ ফুলিয়ে নাক টেনে তাকে সরিয়ে দেয়। অরুণ উঠে টিস্যু বক্স এনে ছেলের নাক পরিষ্কার করে বলে,

-” যতই বাহানা কর রিভাইস তোমাকে দিতেই হবে! নইলে সারপ্রাইজ পাবে না!”

ভোর বাবার দিকে তাকিয়ে গাল ফুলিয়ে বলে,

-” আগে বলো কি সারপ্রাইজ তবেই পড়বো!”

-” না পড়লে বলবো না!

-” না বললে পড়বো না!”

-” তোমার কথা না আমার কথা?”

-” আমার কথা!”

অরুণ জেদি ভোরের সামনে নত হয়।

-” আব্বু বাইক কিনেছি! আজ আমরা বাইকে চড়ে স্কুলে যাবো”

ভোর চোখ বড় বড় করে বাবার দিকে চায়। হেসে বাবার গলা জড়িয়ে ধরে।

-” আব্বু বাইক আমি চালাবো?”

অরুণ ভোরকে কোলে বসিয়ে খাতা বের করে লিখতে দেয়।

-” অবশ্যই! তবে আগে তোমার লাইসেন্স দরকার হবে। সেটার জন্য আগে পড়াশোনা করে বড় হতে হবে! বুঝলে সোনা?”

চলবে…..

#পাতা_বাহার
লেখনীতে: #বেলা_শেখ
#পর্ব- ১৪
(কপি করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ)

তীব্র গরমের মাঝে স্বস্তিদায়ক সকাল। রোদ তেজ দেখিয়ে উঠলেও এলোমেলো বাতাসের দাপটে রোদের আলো তেমন গায়ে লাগছে না। তবে বাতাস ক্ষণিকের ব্যবধানে স্থির থাকলে যেন গরমে প্রাণ যায় যায় অবস্থা। সরকার বাড়ির পরিবেশটা সবসময় শীতল। বড় ছোট গাছপালায় ঘেরা সবুজ শ্যামল নীড়। দেখলেই যেন চোখ তনুমন শীতলতায় ছেয়ে যায়। অরুণ সরকার ছেলেকে পড়া কমপ্লিট করিয়ে, খাইয়ে দাইয়ে স্কুলের জন্য রেডি করাচ্ছে। প্যান্ট পরিয়ে শার্ট গায়ে চড়িয়ে বোতাম লাগাচ্ছে। চঞ্চল ভোর মোটেও চুপ করে নেই। তার কত শত বুলি। একটার পর একটা গল্পের জুড়ি খুলে‌ বসেছে। তবে তার বেশিরভাগ কথাই নতুন বাইককে ঘিরে। অরুণ মোটেও বিরক্ত হচ্ছে না। বরং ছেলের প্রত্যেকটা কথা মনোযোগ দিয়ে শুনছে। মাঝে মাঝে ছেলের গালে চুমু দিয়ে সায় জানায়। পাতাবাহার বাবা ছেলের দিকে কুটুর কুটুর করে চেয়ে আছে। বিছানায় রাখা ভোরের মুজোটা চুপি চুপি নিয়ে বিছানার তলে রাখে। তারপর আবার দেখায় মনোযোগ দেয়। অরুণ ছেলেকে শার্ট পরিয়ে টাই বেঁধে দিল। ভোর পাশে বিড়ালের দিকে তাকাতেই বিড়াল চোখ পিট পিট করে। ভোর হেসে বলে,

-” আব্বু দেখ পাতাবাহার কিউট কিউট করে তাকাচ্ছে? একদম মিস পাতার মতো!”

অরুণ চোখ ছোট ছোট করে ভোরের দিকে চায়। কাল সারাদিন থেকে একবারো মিস পাতাবাহারের নাম নেয় নি ভোর। ভোরের কিছু মনে পড়ায় ভোর বাবার গালে হাত বুলিয়ে বলে,

-” আব্বু আমার বাইকে কিন্তু মিস পাতাকে তুলবো!”

-“কেন?”

-” বাহ রে আমি তার বাইকে উঠে ছিলাম আর এখন আমার বাইকে তাকে নেবো না?”

অরুণ মাথা নাড়ে।

-” না নেব না! সি ইজ ডেঞ্জারাস ফর মি!”

-” আব্বু কেন নিবে না? আমি তাকে বলেছি আব্বু বাইক নিলে আপনাকে নিয়ে অনেক ঘুরবো!”

অরুণ ছেলের চুল ব্রাশ করে বিছানায় মুজো খুঁজতে খুঁজতে বলে,

-” আমার বাইকে শুধু আমি আর তুমি!”

-” আব্বু তুমি বলেছিলে ওটা আমার বাইক।”

-” হুম তোমারি তো কলিজা!”

-” তাহলে মিসকে তুলতে হবে! হবে মানে হবে!”

অরুণ ছেলের দিকে চায়। তবে কিছু বলে না। মুজো জোড়া না পেয়ে নতুন একজোড়া মুজো আলমারি থেকে বের করে বলে,
-” আশ্চর্য মুজো এখানেই তো রেখেছিলাম। গেলো টা কোথায়?”

বিড়াল শাবক ফট করে বিছানা থেকে নেমে বিছানার তল থেকে একটা মুজো পা দিয়ে ঠেলতে ঠেলতে বের করে। ভোর বাবাকে সেদিকে তাকাতে ইশারা করে। অরুণ পাতাবাহারের কাছে মুজো দেখে চোখ পাকিয়ে বিড়ালকে ধরতে গেলেই সে রুম থেকে পগারপার।

-” এই পাতাবাহারটা এতো দুষ্টু না!”

বলে ভোরকে মুজো শু পড়িয়ে গলায় আইডি কার্ড ঝুলিয়ে দিলো। নিজে আলমারি থেকে নরমাল টি শার্ট জিন্স পড়ে রেডি হয়ে সানগ্লাস টি শার্টের গলায় ঝুলিয়ে দিলো। বাইরে অনেক রোদ কি না! ভোর বাবাকে দেখে হেসে বলে,

-” আব্বু তোমাকে সেই লাগছে! একদম হিরো হিরো!”

অরুণ মুচকি হেসে চুলে হাত বুলিয়ে বলে,

-” দেখতে হবে না আব্বু টা কার?”

ভোর হেসে বাবার গলা জড়িয়ে ধরে।অরুণ ছেলেকে কোলে নিয়ে ফাইল হাতে নিলো যাতে ক্লিপ বোর্ড ও পেন্সিল বক্স রাখা। রুম থেকে বেরিয়ে ড্রয়িং রুমে আসতেই দেখে সবাই এখানেই উপস্থিত। আনিকাও রেডি! অরুণ ছেলেকে ধীমে সুরে বলে,

-” আব্বু আজ তোমার প্রথম এক্সাম! সবার থেকে দোয়া চাইবে! বুঝলে?”

ভোর মাথা নাড়ে।অরুণ ছেলেকে নামিয়ে দিল।

ড্রয়িং রুমে আসমা বেগম বসে চা খাচ্ছেন। আরিয়ান নিউজ পেপার পড়ছে। আদুরি কাল বিকেলেই ট্রিপে চলে গেছে। রুবি রুপমকে কোলে নিয়ে আনিকাকে এটা ওটা বলছে। আনিকা প্লেতে পড়ে । দুজনকে একি স্কুলে দিতে চেয়েছিল সবাই। কিন্তু অরুণ সেটা চাই নি। এমনিতেই ভোর প্লে পড়ে নি। অরুণ ভর্তি করিয়েছিল। ভোর না ক্লাসে গিয়েছে না এক্সাম দিয়েছে। শুধু মিস টুম্পার কাছে সকাল বেলা টিউশনি করেছে। তারপর বাবার সাথে অফিস‌। অরুণ তো টেনশনে ছিল নার্সারিতেও না এমন করে! প্রথম প্রথম যেতে চাইতো না। কান্না কাটি করতো! তারপর রোহানের সাথে বন্ধুত্ব হওয়ার পর আর বাহানা দেখায় না।
ভোর টা জেদি। আনিকার সাথে খুব একটা ভাব নেই ওর। ঝগড়া লেগেই থাকে। আর তাছাড়া রুবি আরিয়ান মেয়েকে যে স্কুলে ভর্তি করার কথা বলেছিল সেটা অরুণের অফিসের উল্টো দিকে। আর সানশাইন স্কুল তার অফিসে যাওয়ার রাস্তায়ই পড়ে। আর সেখানকার প্রিন্সিপাল ম্যাম তার আপন খালা। তাকে বেশ স্নেহ করে তাই সেখানেই দিয়েছে। আসমা বেগম ভোরকে দেখে হেসে বলে,

-” আরে আরে ভোর সরকার।একদম রেডি ! প্রিপারেশন কেমন রিভাইস দিয়েছো?”

ভোর হেসে দাদির কোলে বসে। আসমা বেগম তাকে আদর করে অরুণের দিকে চায়। আরিয়ান ভাই ও মাকে পর্যবেক্ষণ করতে ব্যস্ত। অরুণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে। ভোর হাসিমুখে বলে,

-” রিভাইস ডিভাইস সব দিয়েছি দাদি! তুমি শুধু দোয়া করবে কেমন?”

আসমা বেগম হেসে ভোরের হাতে পাঁচশ টাকার একটা নোট দিয়ে তার কপালে চুমু খায়।

-” অবশ্যই দোয়া করবো। ভালোভাবে এক্সাম দেবে। একটুও ঘাবড়াবে না!”

ভোর টাকা পেয়ে খুব খুশি। তবে বাবার দিকে আড়চোখে চাইলে খুশি উড়ে যায়। অরুণ শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে। আসমা বেগমকে উদ্দেশ্য করে বলে,

-“ছোট মা শুধু দোয়া করে দাও! ও ছোট বাচ্চা টাকা দিয়ে কি করবে? ভোর দাদিকে দিয়ে দাও?”

ভোর মন খারাপ করে দাদিকে টাকা দিল। আসমা বেগমের মুখের হাসি নিভে যায়।অরুনের দিকে তাকিয়ে টাকাটা নিয়ে হাতের মুঠোয় রেখে দিলো।অপর হাতে ভোরের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো। অরুণ দেখলো তবে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করলো না। আরিয়ানের মুখশ্রী গম্ভীর তার দৃষ্টি মায়ের মলিন মুখে স্থির। সে ভোরকে কাছে ডাকে ভোর আসমা বেগমের কোল থেকে নেমে আরিয়ানের কাছে যায়। আরিয়ান তার গাল টিপে বলে,

-” ভালোভাবে এক্সাম দিবে। ভয় পাবে না ঠিকাছে?”

ভোর মাথা নাড়ে। আরিয়ান পাশ থেকে একটা ব্যাগ নিয়ে সেটা খুলে কিছু পেন্সিল আর একটা চকলেট বক্স বের করে হেসে অরুণের দিকে তাকিয়ে বলে,

-” ভোর? তোমার আব্বুকে জিজ্ঞেস কর তো এটা নিতে দিবে নাকি তোমায়?”

ভোর বাবার দিকে চায়। অরুণ গম্ভীর মুখে তাদের দিকেই চেয়ে।

-” এটা কেমন কথা? আমি ওকে কখনো মানা করি নি তোদের থেকে কিছু নিতে! ছোটমা টাকা দিচ্ছিল তুই বল ও টাকা দিয়ে কি করবে?”

আরিয়ান হাসিমুখে বলে,

-” কি করবে সেটা বিষয় না! ভালোবেসে দিয়েছিলো সেটাই মুখ্য! কিন্তু তোর চোখে তো আমাদের ভালোবাসা নজরে আসে না! মা শুধু ভোরকে না আনিকাকেও টাকাই দিয়েছে! আনিকা নিলো আমি তো মানা করি নি। এখন বল এগুলো কি ও নিতে পারবে?”

শক্ত মুখে ‘না’ বলে ড্রয়িং রুম পেরিয়ে মেইন দরজা দিয়ে বেরিয়ে যায়। ভোর উঁকি দিয়ে বাবার প্রস্থান দেখে আরিয়ানের থেকে চকলেট পেন্সিল নিয়ে দাদির কাছে যায়। হাত পেতে মুচকি হেসে বলে,

-” দাও টাকা আমি নিবো তো!দাদি তুমি ভালোবেসে দিয়েছো আর আমি নেবো না ?”

আসমা বেগম হেসে টাকাটা তার হাতে দিলো। ভোর সেটা পকেটে পুরে রুবির কাছে যায়। ছোট রূপের গালে চুমু দিয়ে বলে,

-” স্মল ব্রো আমি এক্সাম দিতে যাচ্ছি আমার জন্য দোয়া করবে ঠিকাছে? চাচিমনি তুমিও দোয়া করবে কিন্তু সব দোয়া আনিকাকে দিয়ে দিও না যেন! আসি?”

দৌড়ে আরিয়ানের কাছে গিয়ে তার গালে টুপ করে চুমু দিলো।

-” চাচ্চু আব্বুর উপর রাগ কোরো না কেমন? আমি তো সব নিয়েইছি! আসছি?”

আনিকার দিকে তাকিয়ে বলে,

-” আনি ভালো করে এক্সাম দিবি? আমার জন্য দোয়া করবি তবেই তোকে দোয়া করবো আমি হুম!

বলে রান্নাঘরের দিকে যায়। আনিকা ভেংচি কাটলো ‌। আসমা বেগম ছেলের দিকে তাকিয়ে শান্ত কণ্ঠে বলে,

-” ওসব না বললে হতো না? ছেলেটা রেগে চলে গেল!”

আরিয়ান আনিকার জন্য আনা চকলেট বক্স আনিকাকে দিয়ে রূপকে কোলে নিলো। রুবি আজ ছুটি নিয়েছে। মেয়েকে নিয়ে স্কুলে যাবে।

-” মা! না বললে হতো না! ভাই সবসময় এমন করে! আমাদের আপন ভাবতে তার অনেক দায়!”

রুবি মেয়েকে বলল,

-” আনি যাও বড় চাচ্চুকে বলে এসো !”

-” চাচ্চু তো চলে গেল আম্মু?”

আরিয়ান মেয়ের কথায় হেসে বলে,

-” কলিজাকে রেখে যাবে নাকি! বাইরেই আছে! বাইকের কাছে হয়তো!”

আনিকা দৌড়ে চলে যায় সেখানে। আরিয়ান মেয়ের যাওয়ার দিকে চেয়ে রয়।
আনিকা মেইন দরজা পেরিয়ে বাইরে চলছে আসে। আশেপাশের চাচ্চুকে খুঁজতে থাকে। গেইটের কাছেও তো নেই কোথায় গেল? সে বামদিকে ফিরতেই নজরে আসে চাচ্চু ব্রেঞ্চে বসে আছে। অন্যদিকে ফিরে থাকায় তাকে দেখতে পাচ্ছে না। আনিকা চুপি চুপি তার পিছনে গিয়ে ভাও দেয়। অরুণ পিছনে ফিরে আনিকাকে দেখে অল্প হাসে। হাত বাড়িয়ে কোলে তুলে চুমু এঁকে দেয় কপালে। আনিকা হেসে বলে,

-” তুমি চলে এলে কেন?”

অরুণ আনিকার মাথায় ছোট ঝুটি ঠিক করে দিয়ে বলে,

-” এমনি!”

-” আমিও এক্সাম দিবো আজ! আমার জন্য দোয়া করবে না?”

অরুণ তার গালে আদর করে বলে,

-” অবশ্যই আনি বুড়ি! ভালোভাবে পরীক্ষা দেবে কেমন? দেখেশুনে এনসার করবে। কোশশেন না বুঝলে টিচারকে জিজ্ঞেস করবে !”

আনিকা মাথা নেড়ে হাত পেতে বলে,

-” সবাই আমাকে গিফট দিয়েছে তুমি দিবে না?”

অরুণ চিন্তায় পড়ে যায়। কি দেবে? তার কাছে তো এখন কিছুই নেই দেওয়ার মতো!রুমে যেতে হবে!

-” আনি বুড়ি এক্সাম দিয়ে এসো তারপর গিফট দিবো কেমন?”

-” না না আমার এখনি চাই! তোমার কাছে গিফট নেই?”

অরুণ মাথা নাড়ে নেই তো! আনিকা হেসে একটু দূরে স্ট্যান্ড করে রাখা নতুন বাইক ইশারা করে বলে,

-” তাহলে আমায় বাইকে চড়িয়ে ঘুরাবে?”

-“কেন নয় মামনি? অবশ্যই। বিকেলে নিয়ে যাবো ওকে?”

-” না! এখনি ঘুরিয়ে আনো একটু বেশি না! এক্সাম শুরু হতে ঢের বাকি!”

-” দেন লেটস গো মামনি?”

মিনু নিজের রুমে বসে পান বানাচ্ছে। রান্না বান্না ও সকলকে খাওয়ানো শেষ। তাদের খাওয়াও সম্পূর্ণ। আভারি বাজারে গিয়েছে। আজ ভোরের সাথে অরুণ যাবে তাই তার ছুটি। মিনুর পান খাওয়ার অভ্যাস বেশ পুরনো। পান না খেলে তার চলে না। তবে ভোরের নজর বাঁচিয়ে খেতে হয়। সে দেখলে খাওয়ার জন্য বায়না ধরে। বুঝিয়েও কাজ হয় না। সে পান বানিয়ে মুখে পুরে চিবোতে থাকে।
তখনই ভোর মিনু খালা মিনু খালা বলে দৌড়ে আসে। হাতে চকলেট ,পেন্সিল। মিনু চোখ বড় বড় করে একপ্রকার দৌড়েই ওয়াশ রুম গিয়ে পিক ফেলে কুলকুচি করে আসে। ভোর তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তার দিকে চেয়ে।

-” মিনু খালা সত্যি করে বলো তো! তুমি কি লুকাচ্ছো?”

মিনূ হে হে করে হেসে বলে

-” কই কিছুই না!”

ভোর সন্দেহি নজরে চেয়েই থাকে।

-” আমায় দেখে দৌড়ে ওয়াশ রুমে চলে গেলে? ”

-” ওই এমনি মুখ ধুইতে গেছিলাম! হলুদ গুড়া ভইরেছিল !”

-” ওহ। ভারি কাক্কু কোথায়?”

-” সে তো বাজারে!”

ভোর মুখ ফুলিয়ে বলে,

-” আমার এক্সাম দোয়া করে গেলো না?”

মিনু হেসে ভোরকে আদর করে বলে,

-” কইরেছে অনেক দোয়া! আব্বাজান ভালো কইরে পরীক্ষা দিয়ো!”

ভোর হেসে বলে,

-” আচ্ছা।আমি যাই হ্যা আব্বু দাঁড়িয়ে আছে বাইরে! আর এই চকলেট বক্স আর পেন্সিল আমার রুমে রেখে এসো!”

বলে বেরিয়ে যায়। আরিয়ান আসমা বেগম রুবিকে টাটা দিয়ে বাইরে আসে। বাবাকে খুঁজে পায় না। গেইটে দারোয়ানকে দেখে এগিয়ে এসে বলে,

-” ও মামা মামা? কেমন আছো তুমি?”

মধ্যবয়স্ক দারোয়ান গোছের লোকটি হেসে চেয়ার থেকে উঠে বলে,

-” ভালো আছি স্যার তুমি কেমন আছো?”

ভোর তার হাত থাকা লাঠিটা নিয়ে নেড়েচেড়ে বলে,

-” ভালোই আছি! আজ না আমার পরীক্ষা বুঝলে! এই এতটুকু আমি এত বড় বড় পরীক্ষা কিভাবে দিবো বলো তো? তুমি একটু দোয়া কোরো বেশি করে ।”

লোকটি হাসে! মালিকের ছেলে তার মতো সামান্য দারোয়ানকে কি সুন্দর মামা বলে ডাকে। মনটাই জুড়িয়ে যায়। আবার তার থেকে দোয়াও চাইছে । সে ভোরের মাথায় হাত বুলিয়ে দিল।

-” অবশ্যই স্যার! ভালোভাবে পরীক্ষা দেও! অনেক অনেক বড় হও!”

ভোর হেসে তার লাঠি তাকে দিয়ে বলে,

-” আব্বুকে দেখেছো?”

দারোয়ান কিছু বলবে এর পূর্বেই গেইটের বাইরে থেকে বাইকের হর্ণের আওয়াজ আসে। সে গিয়ে গেট খুলে দিলো। বাইক নিয়ে প্রবেশ করে অরুণ। আনিকা তার সামনে বসে হাসি মুখে। ভোরের দিকে তাকিয়ে জোরে বলে,

-” ভোর দেখ চাচ্চু আমাকে সবার আগে বাইকে চড়িয়েছে! আমরা অনেক মজা করেছি!”

ভোর দুজনের দিকে তাকিয়ে মুখ ফুলিয়ে সরে যায়। অরুণ বাইক স্ট্যান্ড করে আনিকাকে নামিয়ে দিলো। ভোরকে ডেকে বলে,

-” জলদি এসো দেড়ি হয়ে যাচ্ছে! আর ওই বেঞ্চে তোমার ফাইল আছে নিয়ে আসো! আর মামনি ভেতরে যাও তোমারও দেড়ি হচ্ছে।”

আনিকা চলে যায়। যাওয়ার আগে ভোরের দিকে তাকাতে ভোলে না। ভোর বাবার দিকে চেয়ে বলে,

-” আনতে হবে না। আমি এক্সাম দেবো না!”

বলে গলার আইডি কার্ড ছুড়ে ফেলে দিলো। অরুণ চোখ রাঙায় ভোর তোয়াক্কা করে না। হন হন করে হাঁটা দেয়। দেবে না এক্সাম সে। অরুণ বাইক থেকে নেমে আইডি কার্ড তুলে নেয়। বড় বড় পা ফেলে ভোরকে কোলে তুলে নিল।

-” সব সময় বাড়াবাড়ি করবে না ভোর! এক্সাম তুমি দিবে তোমার বাপও দিবে!”

ভোর হাত পা ছোড়াছুড়ি করতে করতে বলে,

-” তাহলে তুমিই দাও এক্সাম! আমায় ছাড়ো! আনি কে বাইকে করে স্কুলে নিয়ে যাও! আমি তো কেউ না!”

অরুণ ছেলেকে কোলে নিয়ে ফাইল ও হেলমেট নিয়ে আসে।

-” ইশ এতো জেদ! আনি আবদার করল না করতাম কি করে? ওর মন খারাপ হতো না?’

-” হ্যা শুধু ওর ই মন খারাপ হয়! বাইকে সবার আগে আমি চড়তে চেয়েছিলাম। ওকে চড়ালে। আমার মন খারাপ হয় না তো! সব তোমার মামনির! আমি কেউ না!”

অরুণ ছেলেকে বাইকে সামনে বসিয়ে নিজেও বসে। ছেলের গালে চুমু দিয়ে হেলমেট বাঁধে। টি শার্টে ঝুলে থাকা সানগ্লাস ছেলেকে পড়িয়ে দেয়।

-” তুমি তো আমার কলিজা সোনা! এই বাইক তো তোমারই। যখন খুশি চড়বে। আব্বু মন খারাপ করে না তো!”

ভোর কিছু বলে না মুখ ফুলিয়ে রাখে। অরুণ ছেলের পিঠ বুকের সাথে মিলিয়ে বাইক স্টার্ট দেয়।

-” আব্বু শক্ত করে ধরবে। ভয় লাগলে বলবে আমায়!”

ভোর মাথা নাড়ে। অরুণ খানিকটা হেসে বলে,

-” আমার কলিজাটা! আব্বু লাভস ইউ ভেরি মাচ!”
_______

পুরো রুম জুরে নিস্তব্ধতা বিরাজমান। ফুল পাওয়ারে তিনটা ফ্যান ঘুরছে সিলিং এ। দরজা জানালা খুলে রাখা। বাচ্চারা বেঞ্চে বসে এক্সাম পেপারে আনসার লিখতে ব্যস্ত। প্রতি বেঞ্চের এ মাথায় ও মাথায় দুজন করে বসেছে। কেউ লিখছে তো কেউ পেন্সিল কামড়ে মনে করার চেষ্টায় তো কেউ ইরেজার দিয়ে পেপারে ঘষামাজা করতে ব্যস্ত। পাতা ও আরেক টিচার নাম সৈয়দ। দুজন পরিদর্শক হিসেবে উপস্থিত আছে ক্লাস রুমে। পাতা সৈয়দ রুম জুড়ে হাঁটছে। কোনো বাচ্চার প্রশ্ন বুঝতে প্রবলেম হলে হাসিমুখে বুঝিয়ে দিচ্ছে। এমন সময় একটি বাচ্চার দিকে নজর যায় সৈয়দের। বাচ্চাটি কাঁদছে। চোখের পানি নাকের পানি একাকার। সে পাতাকে ইশারা করে। পাতা বাচ্চাদের সামলাতে এক্সপার্ট কি না! পাতা এগিয়ে যায়। বাচ্চাটির মাথায় হাত বুলাতেই ঝড়ঝড় করে কেঁদে দেয়। পাতা তার চোখের পানি মুছে দিয়ে কপালে চুমু খায়।

-” মৃদুল কাঁদছো কেন? কি হয়েছে বলো মিসকে?”

সব বাচ্চা মৃদুলের দিকে তাকিয়ে। ভোর ও চায়! কাঁদছে কেন মৃদুল? আর মিস পাতা আদরও করলো তাকে?
মৃদুল নামক বাচ্চা ঠোঁট উল্টিয়ে বলে,

-” আমার কিছু মনে পড়ছে না মিস! সব পড়েছিলাম! লিখেওছি অনেক বার কিন্তু এখন কিছুই মনে পড়ছে না!”

পাতা বেঞ্চে বসে মৃদুলের মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,

-” তাই কাঁদতে হবে? মিস কে বললেই হতো! আর মনে পড়বে সব! তুমি তো পড়েছো। আসলো তুমি ভয় পাচ্ছ তাই গুলিয়ে যাচ্ছে। পানি খাও মাথা ঠান্ডা করে ধীরে ধীরে লিখো কেমন? না পারলেও সমস্যা নেই! এটা তো ফাস্ট টার্মিনাল মাত্র!”

মৃদুল চোখ মুখ মুছে বলে,

-” আম্মু যদি বকে?”

পাতা হেসে বলে,

-” বকবে না। আর তুমি তো গুড স্টুডেন্ট তুমি সব পারবে! একটু চেষ্টা করলেই! এখন লিখো!”

মৃদুল পানি পান করে পেন্সিল হাতে নিয়ে আঁকিবুঁকি করতে থাকে। পাতা সবাইকে লিখতে বলে,ঠান্ডা মাথায়। ভয় না করতে! সবাই লেখায় মনোযোগ দেয়। ভোর হা করে তাকিয়ে পাতার দিকে। পাতা ইশারায় লিখতে বলে। ভোর পলক ফেলে না তাকিয়েই থাকে। পাতা তার বেঞ্চে গিয়ে মৃদু থাপ্পড় লাগায় বেঞ্চে।

-” হা করে তাকিয়ে আছো কেন? লিখো?”

ভোর পলক ফেলে লেখায় মনোযোগী দেয়। পাতা ঘুরে ফিরে সব বাচ্চার দিকে নজর দেয়। হঠাৎ জানালা দিয়ে বাইরে তাকাতেই দেখতে পায় কেউ উঁকি ঝুঁকি দিচ্ছে দূর থেকে। সে বেরিয়ে এসে বারান্দায় দাঁড়ায়। মি. অরুণ সরকারকে দেখে একটু অবাকই হয়। ফরমাল ড্রেস আপেই দেখে এসেছে এতদিন। আজ টি শার্ট জিন্স! চোখে সানগ্লাসও ঝুলছে। ঘেমে নেয়ে একাকার। টি শার্ট সুঠাম দেহের সাথে লেগে আছে। ভিজে কপালের উপরে চুল লেপ্টে আছে। হাতে পানির বোতল। কিন্তু উঁকি ঝুঁকি দিচ্ছে কেন? পাতা কিছু বলে না। গম্ভীর মুখ পর্যবেক্ষণ করতে থাকে।
অরুণ নিজেই এগিয়ে আসে। বেশ গরম পড়েছে। সে মাঠেই ছিল। ছেলেটার নিশ্চয়ই গরম লাগছে। বাপ ছেলে একদমই গরম সহ্য করতে পারে না। কলিজাটার তৃষ্ণা পায় যদি! আজ পানির বোতলও তো কাছে নেই। তাই বোতল কিনে এনেছে।এখন কিভাবে দেবে? ভিতরে প্রবেশ নিষেধ। পাতাকে দেখে সে এগিয়ে আসে। পানির বোতল এগিয়ে দিয়ে বলে,

-” মিস পাতাবাহার ভোরকে বোতলটা দিবেন! নিশ্চয়ই তৃষ্ণা পেয়েছে। ছেলেটা গরম সহ্য করতে পারে না!”

পাতা অরুণের হাতের দিকে চায়। ফর্সা লোমশ হাত। লোমগুলো কালো কুচকুচে আর বেশ বড় । দামি ঘড়িতে বেশ লাগছে। সে পানির বোতল নিলো না। হা হু কিছুই না বলে রুমের দিকে চলে যায়। অরুণ শান্ত দৃষ্টিতে তার যাওয়া দেখলো। বাড়ানো পানির বোতল গুটিয়ে নিল। এই টুকুনই মেয়ের আবার ইগো! অরুণ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চায়।

পাতা সৈয়দের সাথে টুকটাক কথা বলছে। মাঝে মাঝে হাসছেও। সৈয়দ পাতার একবছরের জুনিয়র! সানশাইন স্কুলে অধিকাংশ টিচারই ইয়াং। হাতে গোনা কয়েকজনের মধ্যবয়স্ক। সৈয়দ বলে,

-” লোকটা ভোর সরকারের বাবা না?”

পাতা অরুণের দিকে চায়। এখনো সেখানেই দাঁড়িয়ে।

-” হুম! অরুণ সরকার।”

-” কি বললো?”

-” কিছু না! তুমি একটু যাও দেখো কি বলে?”

সৈয়দ চেয়ারে বসে বলে,

-” লেডিস হলে যেতাম! ইউ নো হোয়াট আই লাভ ওমেন!”

বলেই চোখ টিপে। পাতা হেসে উঠলো।

-” হুম। তাই তো আজও সিঙ্গেল তুমি!”

-” ওহ মিস রাজি হয়ে যাও! মিঙ্গেল হয়ে যাই !”

পাতা হাই তুলে বলে,

-” ভাই জুনিয়র চলবে না! সিনিয়র হলে ভেবে দেখতাম!”

-” তাই না? ইয়াং ছেলে পছন্দ না?তোমার কপালে বুইড়া জুটবে দেখে নিও!”

পাতা অরুনের দিকে চায় পুনরায়। এই লোক এখনো দাঁড়িয়ে! সে এগিয়ে যায়। সিরিয়াস কিছু হবে হয়তোবা! আর তাছাড়াও প্রিন্সিপালের পরিচিত।তার নামে না আবার কমপ্লেইন করে বসে। সে অরুণের সামনে দাঁড়িয়ে হাত বাড়িয়ে বলে,

-” বোতল?”

অরুণ দেয় না। পাতা কটমট করে চাইলো। উফ্ তার আসাই ভুল হয়েছে। শালা ম্যানারলেস নাক উঁচু!

-” শুনুন মি. ভোরের বাবা? রাত দিন চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে আধা ঘন্টা করে হলেও একটু ম্যানারস শিখবেন! আপনাকে দেখে দেখে ভোরও না এমন হয়ে যায়! রাস্তাঘাটে পরিচিত কাউকে দেখলে ভদ্রতার খাতিরেও হাই হ্যালো বললে নাক ছোট হয়ে যায় না! নাক উঁচু কোথাকার!”

পাতা দাঁতে দাঁত চেপে ধীরে হিসহিসিয়ে বলে।অরুণ পকেটে হাত ঢুকিয়ে শান্ত ভাবে চায় তার দিকে।

-” মিস পাতাবাহার? আজ পর্যন্ত কেউ ম্যানারস শেখায় নি আমাকে। আপনি শেখাবেন? আমি খুবই ওয়াচফুল স্টুডেন্ট!”

পাতা অরুণের হাতে থাকা বোতল ছিনিয়ে নিয়ে যেতে যেতে বলে,

-” আমি বাচ্চাদের পড়াই! বাচ্চাদের বাপকে না! আর আমি আপনার বেয়ান লাগি না যে মজা করবেন আমার সাথে!”

অরুণ চোখ ছোট ছোট করে তার প্রস্থাণ দেখে। দেখতে ছোট হলে কি হবে ঝাঁঝ আছে।

এক্সাম শেষ হলে ভোর পেন্সিল ইরেজার সব গুছিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসে, সাথে রোহান। এক হাতে ফাইল অপর হাতে আধ খাওয়া পানির বোতল। মাঠে সব গার্ডিয়ানস অপেক্ষা করছে। আজ স্কুলে স্টুডেন্ট অপেক্ষা গার্ডিয়ান বেশি। এক্সাম চলছে কিনা। ভোর সবার ভিড়ে বাবাকে খোঁজে। অরুণ এগিয়ে আসে। হাতে তার দুটো চকবার। ছেলের ঠান্ডার ধাত আছে তবুও কিনেছে। যে গরম পড়েছে একটা খেলে কিছুই হবে না।অরুণ ছেলেকে একহাতে কোলে তুলে নিলো।

-” কেমন হয়েছে এক্সাম? রোহান তোমার কেমন হলো?”

রোহান হেসে বলে,

-” অনেক ভালো হয়েছে আঙ্কেল। সব আনসার করেছি। তবে ভোর একটা বাদ দিয়েছে!”

ভোর রোহানকে চোখ রাঙায়। আব্বুকে কেন বলতে হবে? অরুণ একটা চকবার রোহানের দিকে বাড়িয়ে বলে,

-” নাও! গরমে চকবার খাও! আর ভোর বাদ দিয়েছো কেন?”

-” একদম বকবে না আব্বু! আমি দিতে চেয়েছিলাম তো! কিন্তু সময় ফুরিয়ে গেলে আমি কি করবো? সব দোষ সময়ের!”

অরুণ চকবার ছিঁড়ে ভোরের মুখে দিলো।

-” তোমার লেখা চালু করতে হবে আব্বু! বেশি বেশি লিখতে হবে। অথচ লিখতে তোমার যত বাহানা!”

ভোর হেসে আইসক্রিমে বাইট দেয়। নিজের হাতে নিয়ে বাবার মুখে ধরতে ভুলে না। অরুণ বাইট নিলো। ইতিমধ্যে রোহানের মা এসে তাকে নিয়ে যায়। অরুণ ছেলের হাত থেকে ফাইল বোতল নিলো। ছেলের গালে চুমু দিয়ে বাইকের কাছে যায়।

চলবে……

#পাতা_বাহার
#বেলা_শেখ
লেখনীতে: #পর্ব- ১৫
( প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য )

(কপি করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ)

রৌদ্র উজ্জ্বল তপ্ত বিকেল। অরুণ বাড়িতেই আজ। ছেলের সাথে স্কুল থেকে ফিরে আর অফিসে যায় নি।‌ বাড়িতে বসেই টুকটাক কাজ করেছে।‌ ভোর হুজুরের কাছে আরবি পড়ছে স্টাডি রুমে। অরুণ নিজ হাতে হুজুরের জন্য নাস্তা নিয়ে গেল। তার সাথে কুশল বিনিময় করে চলে আসে। রুমে বসে ভালো না লাগায় বাইরে বাগানে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়‌। পকেটে হাত দিয়ে ক্যাপ মাথায় ড্রয়িং রুম পেরিয়ে যেতে নিলে আসমা বেগম ডাক দেয়। ড্রয়িংরুমে আসমা বেগম আর মিনু। মিনু তার মাথায় তেল দিয়ে দিচ্ছে। অরুণ এগিয়ে আসে।

-” কিছু বলবে ছোটমা?”

আসমা বেগমের দৃষ্টি অরুনের দিকে স্থির।

-” হুম বলবো! তখন আরিয়ানের কথায় কিছু মনে কোরো না।”

অরুণ স্যরি বলতে চায় তাকে। কিন্তু কেমন যেন গলায় আটকে গেছে। বলতে পারছে না‌ ; ঢের জড়তা কাজ করছে কণ্ঠনালীতে।সে ছোট করে শান্ত গলায় বলে,

-” হুম!”

-” কাল বিকেলে তো কথাই হলো না আদুর ট্রিপের চক্করে! তা কি সিদ্ধান্ত নিলে? না মানে শ্রাবনীর সাথে কথা হলো? ঠিক মনে হয়?”

অরুণ একটু ভাবনায় পড়ে যায়। শ্রাবণী মেয়েটাকে ভালোই মনে হলো। স্ট্রেট ফরয়ার্ড কথাবার্তায়। লুকোচুরি নেই একটু কঠোর মনোভাব এবং সেটা একটা ভালো দিক। দেখে মনে হলো স্ট্রং পারসোনালিটির। কিন্তু তার সাথে যায় না। তার একজন নরম মনের কাউকে চাই। সে তাদের বাবা-ছেলেকে বুঝতে চেষ্টা করবে! আগলে নেবে।

-” ছোটমা সি ইজ গুড! বাট সি ইজ নট রাইট ফর মি এন্ড .. অলসো আই এম নট রাইট ফর হার! তুমি আর এগিয়ো না।”

আসমা বেগমের কপালে ভাঁজ পড়ে। মিনু স্থির হয়ে বসে। অজানা আশঙ্কায় মনটা খারাপ হয়ে গেল। স্যারের নতুন বউ ভোরকে মেনে নেবে তো! সৎ মা ভালো হয় এটা খুবই কমই দেখা যায়। সে মনে মনে দোয়া করে যে আসবে সে যেন একজন ভালো মনের মানুষ হয়। ভোরকে সৎ ছেলে না নিজের ছেলের মতোই ভালোবাসে। আচ্ছা নতুন মা আসলে কি ভোর তাদের থেকে দূরে চলে যাবে? মিনু খালা বলে আর আবদার করবে না? কোলে উঠে চুমু খেয়ে তার ভাঙ্গাচোড়া হৃদয়টাকে আর জুড়িয়ে দেবে না?

আসমা বেগম বোঝানোর সুরে বললেন,

-” তোমার মতামতটাই আসল। তুমি যা বলবে তাই হবে। তবে শ্রাবণী মেয়েটা ভালোই কিন্তু! আমি ওদের বাড়িতে , কর্মস্থলে,আবার ওর আগের শশুর বাড়িতেও লোক পাঠিয়ে খোঁজ খবর নিয়েছি। কেউ খারাপ মন্তব্য করে নি। সবাই ভালোই বলেছে!”

অরুণ তার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলে,

-” আমিও খারাপ বলছি না। সি ইজ আ গুড পারসন। বাট.. তুমি না করে দাও!”

______

পেরিয়ে গেছে কিছুদিন। আষাঢ় মাসের মধ্যবর্তী সময়। কখনো ঝিরিঝিরি বৃষ্টি তো কখনো মুষলধারে। কখনো সারাদিন সারা বেলা পেরিয়ে যায় থামার অবকাশ নেই। আকাশ এই রৌদ্রজ্জ্বল তো এই মেঘলা। ক্ষেতখামার পুকুর ডোবা সব ভরাডুবি!‌ সেখানে সোনা ব্যাঙের আনাগোনা ঢের! তাদের ঘ্যাঙর ঘ্যাঙর ডাকের ধ্বনি ও মেঘাচ্ছন্ন আকাশ দেখেই অনুভূত হচ্ছে এটা বর্ষা মৌসুম। ধানক্ষেতের উপর দিয়ে বক উড়ে বেড়াচ্ছে। বৃষ্টির কারণে পুকুরের মাছ ফসলি জমিতে উঠে এসেছে।সেটাই গপাগপ পেটে চালান করতে বক মহাশয় ওৎ পেতে আছে। অনেকেই ক্ষেতের আইল দিয়ে জাল, ধিয়াল( মাছ ধরার সরঞ্জাম ) পেতে রেখেছে। অনেকে রাতে টর্চলাইট সহ পোলো, ফলা/ফোচকা (মাছ ধরার সরঞ্জাম) নিয়ে বের হয় মাছ ধরতে। মাছ ধরা একটা অন্যরকম নেশা। এ নেশায় আসক্ত ব্যক্তিজনই এর আনন্দ উপভোগ করতে সক্ষম।
পাতা ওদের একতলা বাড়ির ছাদে চেয়ার পেতে বসে আছে। একা নয় সেখানে উপস্থিত লুবমান, লাবিব, রুম্পা আর লতার স্বামী রাতুল ভুঁইয়া । ভদ্রলোকটি গতকাল সকালে এসেছে। শশুর, শাশুড়ি, শ্যালক, শালিকা,বউ বাচ্চাদের জন্য ঈদের মার্কেট করে এনেছে। ঈদুল আজহার যে বেশি দেরি নেই; এই হাতেগোনা দশদিন! ভেবেছিল দুপুরের খাওয়া দাওয়া করে বিকেলেই রওনা হবে কিন্তু তার দজ্জাল বউটা হতে দিলে তো! এতো দিন থাকলো তাতেও মন ভরে নি। আরো কটাদিন থাকবে! অগত্যা তাকেও থাকতে হবে। রাতুল ভুঁইয়া পাশে তাকায়। পাতা বাচ্চাদের এক্সামের খাতা দেখছে। লুবমান বাদামের খোসা ছাড়িয়ে পাতা ও ভাগ্নেকে দিচ্ছে। রুম্পা তার কোলে বসে। সে লুবমানের ছাড়ানো বাদাম মুখে পুরে বলল,

-” শালাবাবু তোমরা কিন্তু আমার সাথে অন্যায় করেছো?”

পাতা, লাবিব তার দিক তাকায়। লুবমান ভ্রু কুঁচকে চায়।

-” কিভাবে দুলাভাই?”

রাতুল পাতার দিকে তাকিয়ে বলে,

-” এতো মিষ্টি শান্ত মেয়ে থাকতে আমাকে ঝড় তুফান প্যাক করে দিলে?”

লুবমান হেসে বলে,

-” দুলাভাই ঝড় তুফান কিন্তু আপনিই বয়ে এনেছিলেন!”

-” জেনে গেছো?”

লুবমান হেসে বলে,

-” প্রথম থেকেই। এমনকি আপনাদের লাভ অ্যারেঞ্জ ম্যারেজের কথা আপনার শাশুড়ি আম্মাও জানে!”

-” হায় আল্লাহ! বলো কি!”

পাতা হাসে। রাতুল সেদিকে চেয়ে বুকে হাত রেখে বলে,

-” এভাবে হেসো না মেয়ে বুকে লাগে তো!”

পাতা চোখ ছোট ছোট করে চায়।

-” আপু এসে খাঞ্জার দিয়ে আপনার বুক ঝাঁঝরা না করে দেয় সাবধান!”

রাতুল ভুঁইয়া মুখ কুঁচকে বলে,

-” ধ্যাত দিলে তো মুড টা নষ্ট করে! আচ্ছা আমাদের পাতা এতো শান্ত শিষ্ঠ নরম স্বভাবের আর পাতার বোন লতা এতো মেজাজি , খিটখিটে কেন? বিয়ের আগে কি সুন্দর মিষ্টি মিষ্টি কথা বলতো! বাচ্চা আসার আগ পর্যন্তও ঠিকঠাক ছিল! ”

পাতা মুচকি হেসে রুম্পার গাল টিপে বলে,

-” দুলাভাই এতে দোষ নাইন্টি পার্সেন্ট আপনার। লাভ ম্যারেজে সচরাচর বিয়ের আগে ভালোবাসা টইটম্বুর থাকলেও বিয়ের পর তেমন থাকে না। আর বাচ্চা হওয়ার পর আপনারা বাচ্চাদেরকে প্রায়োরিটি দেন বেশি। স্ত্রী কে ভালোবাসলেও বাচ্চাদের ভালোবাসার ভিড়ে তার ভালোবাসা প্রকাশ করেন না। অফিস থেকে বাড়ি এলে বাচ্চাদের নিয়েই পড়ে থাকেন। তাদের খুনসুটিতে মেতে থেকে আবদার পূরণ করতে করতে ভূলেই যান বাচ্চাদের মায়ের সাথে দুদণ্ড বসে আড্ডা দেয়ার কথা! নিজেদের মধ্যকার সম্পর্কটা আরো একটু গাঢ় করার বদলে একটু করে দূরে ঠেলে দেন! আপুও চাকরিজীবী। চাকরি শেষে বাড়ি ফিরে রান্না বান্না, বাচ্চাদের সামলানো সহ সকল কাজ নিজ হাতে করে। তো মেজাজ আপ থাকবে না? আপনিও কাজে হাত…”

পাতাকে থামিয়ে দেয় রাতুল মুখে বাদাম পুরে বলে,

-” তোমার আপুকে জিজ্ঞেস করো? তার সকল কাজেই আমি সাহায্য করি। রান্না,কাপড় কাঁচা, ঘর মোছা! সব কাজেই! তবে হ্যাঁ বাচ্চাদের সময় দেওয়ার পর ওর দিকে ধ্যান দেয়া একটু কমই হয়!”

পাতা হেসে বলে,

-” এটাই তো! আর আপনি জানেন না? লেডিস এমনিতেই এটেনশনের পাগল! তো আপনার সব এটেনশন বাচ্চারা পেলে বাচ্চার মায়ের মেজাজ কেমন থাকবে? ভালোবাসেন অনেক বেশি তো প্রকাশ করতে কেন‌ কুণ্ঠাবোধ? একে অপরকে সময় দিন । সব ঠিকঠাক তো আছেই সম্পর্ক আরো রঙিন হবে।”

রাতুল মাথা নাড়ে। নাহ পাতার কথা সত্যি! বউটাকে বেশি বেশি সময় দিতে হবে! লুবমান পাতার দিকে তাকিয়ে বলে,

-” এই পাতু তোর তো ভালোই জ্ঞান আছে দেখছি এসব বিষয়ে?”

রাতুল লুবমানের কাঁধ চাপড়ে বলে,

-” থাকবে না? নতুন সংসারে পা রাখতে তো আর বেশি দিন বাকি নেই! ভালো কথা মনে পড়লো! পাতা আব্দুল করিমকে তো দেখলে ছবিতে! কেমন লাগলো?”

লাবিব বুঝতে পারে না কার কথা বলছে। সে প্রশ্ন করে,

-” আব্বু আব্দুল করিম কে?”

রাতুল ভুঁইয়া ছেলের গাল টিপে উত্তর দেয়,

-” তোমার খালা মুনি চাইলে তোমার খালু হলেও হতে পারে! কি বলো পাতা?”

পাতা লজ্জা লুকাতে চোখের পলক ঝাপটায় অনবরত। আশ্চর্য তার লজ্জা লাগছে কেন? বিয়ের কথা যেহেতু উঠছে তার মনে মনে বেশ খুশি হওয়ার কথা‌ ইভেন লুঙ্গি ডান্স দেওয়ার কথা। অথচ আজ লজ্জা এসে ভিড় করছে। সে কাজের বাহানায় খাতার বান্ডিল সহ নিজের ঘরে চলে আসে ছাদ থেকে। উফ্!

গোধূলি পেরিয়ে ধরণীতে আঁধার ঘনিয়ে এসেছে।‌ চারপাশ ঘুটঘুটে অন্ধকারে ঢাকা। শেয়ালের হাঁক ভেসে আসছে দূর থেকে। সাথে কুকুরের ঘেউ ঘেউ। আতিকুর ইসলাম বাড়ি এসেছে মাত্রই। হাতে বেশ কিছু শপিং ব্যাগ।ব্যাগ গুলো লতার কাছে দিল প্রথমেই। রাতুলের সাথে টুকটাক কথা বলে লতাকে শপিং ব্যাগ খুলতে বললেন। লতা সব প্যাকেট খুলে দেখতে পায় দুটো শাড়ি ভিন্ন ডিজাইনের। একটা থ্রি পিস, চারটা পাঙাবির সেট। সাথে ছোট একটা ফ্রক। লতা বাবার দিকে চাইতেই আতিকুর ইসলাম বলেন,

-” ঈদের বেশি দিন বাকি নেই। সবার জন্যই এনেছি।”

-” দাঁড়াও লুব ,পাতুকে ডেকে আনছি!”

বলেই ওদের ডাকতে যায়! পাতা, লুবমান, লাবনী আক্তার এলে সবাই শপিং দেখে যার যার টা নিয়ে আড্ডায় জমে গেল।

______

রাতে পাতা আর লাবিব ঘরে বসে ড্রয়িং করছে। পাতা ড্রয়িং করছে আর লাবিব কালার করছে । পাতা সুন্দর করে হাঁসের দল আঁকলো যেগুলো‌ পানিতে ভাসমান। লাবিব আর এটা রঙ করতে পারলো না। পাতা নিজেই রঙ করলো। হাঁসগুলো সব সাদা শুধু দুটো চেক চেক কালারের। পাতার রঙ করার মাঝেই লাবিব হাই তুলে বিছানায় শুয়ে পড়ে। পাতা সেদিকে একনজর চেয়ে রঙ করায় মনোযোগ দিল। রঙ করা শেষ করে লাবিব কে ভালো করে শুইয়ে দিয়ে নিজে বালিশে হেলান দিয়ে বসলো। ফোনের লক খুলে গ্যালারিতে ঢুকল। আব্দুল করিম নামক লোকটার ছবি দেখা যাক! দুলাভাই কাল ছবিটা তার ফোনে দিয়েছে। সে শুধু একবার দেখেছে । অতটা ভালোকরে দেখতে পারে নি সবার ভিড়ে । এখন নিস্তব্ধতায় ঘেরা নির্জনে একটু তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ফেলে দেখা যাক লোকটা দেখতে কেমন? কিন্তু তার দেখা বোধহয় হলো না । ছবিটা গ্যালারি থেকে ওপেন করার আগেই ফোনটা বেজে ওঠে। পাতা খানিকটা বিরক্ত হয়। আরে ভাই কল আসার আর সময় পেল না! সেভ না! আননোন নাম্বার বাট নাম্বারের লাস্ট ডিজিট দেখে চিনতে অসুবিধা হয় না কে কল করেছে। পাতা দাঁতে দাঁত চেপে ‘শালা’ বলে গালি দিয়ে রিসিভ করে। ওপাশ থেকে অরুণ সরকারের গম্ভীর গলা ভেসে আসে। পাতা চোখ উল্টিয়ে ভেংচি কাটলো।

-” জলদি বলুন আমার সময় নেই। ভিষণ ব্যস্ত আমি!”

অরুণের ভ্রু যুগল কুঁচকে যায়। এতো রাতে কিসের ব্যস্ততা তার! নিশ্চয়ই বয়ফ্রেন্ড টয়ফ্রেন্ডের সাথে লেইট নাইট চ্যাটিং-এ প্রেমালাপে ব্যস্ত আছে। তার গম্ভীর মুখটায় আরেকটু গাম্ভীর্য ভিড় করে।

-” কাল ভোরের লাস্ট এক্সাম! শুধু ড্রয়িং করবে?”

-” জি!”

-” তো কি কি ড্রয়িং করতে হবে?”

-” বলে দিয়েছিলাম তো! ন্যাশনাল ফ্ল্যাগ, ফ্লাওয়ার আর ফিস!”

অরুণ পাশে ড্রয়িং করা ভোরের মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,

-” হুম! বাট ওর ফিস টা ইলিশ ইলিশ লাগছে না! এটা আদৌ মাছ হয়েছে কি না আই কনফিউজড!”

পাতার ইচ্ছে করে অরুণ সরকারের মাথার সব চুল টেনে ছিঁড়তে! শালা আহম্মক! ছোট বাচ্চা ভোর! কোনো আর্টিস্ট না!

-” মি. ভোরের বাবা ভোর ছোট ! ও কি ইলিশের কার্বন কপি আঁকতে পারবে নাকি? শুধু মাছের মতো দেখতে হলেই হবে!আপনি সেটাই ট্রাই করুন। ”

-” ওহ্ রাখছি তাহলে!”

বলেই কল কেটে দেয়। পাতা ফোনটা বিছানায় রেখে দেয়। ঘুমে চোখ বুজে আসছে। এতো ঘুম কেন পায় তার?
______

স্নিগ্ধ সকাল! হালকা রোদ্দুরের সাথে এলোমেলো বাতাস। আকাশ মেঘাচ্ছন্ন না হলেও কেমন যেন গুমট পরিবেশ বিরাজমান। পাতা স্কুলের উদ্দেশ্যে বেড়িয়েছে। আজই লাস্ট স্কুল।কাল থেকে ঈদের ছুটি পড়বে। পরীক্ষা পর যে ছুটি দেয়া হয় সেটা ঈদের ছুটির সাথে যোগ হওয়ায় বেশ লম্বা ছুটি পড়বে। পাতা ভেবে নিয়েছে ছুটি পড়লে প্রিয় দের বাড়িতে যাবে। ঈদটা ওখানেই কাটিয়ে দেবে। ঈদের দুদিন পর আসবে এবাড়িতে! দু দিন? না! আরো কয়েকদিন থেকে আসবে। ভাবতে ভাবতেই পাতা বেশ খানিকটা এগিয়ে যায়। তার স্কুটিটা নষ্ট হয়েছে দুদিন হলো। লুবমানকে বলেছে ঠিক করে এনে দিতে! লুবমান আজ না কাল! কাল না পরশু বলে বাহানা দিচ্ছে। নাহ , তাকেই নিয়ে যেতে হবে গ্যারেজে। সে পায়ে হেঁটে বেশ খানিকটা পথ পেড়িয়ে যায়। এই অটোওয়ালাদের খবর নেই কেন? বেলা তো আটটা বেজে সাত মিনিট! তাদের ঘুম ছাড়ে নি নাকি! পাতা চা স্টলের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় শুকলা মন্ডলকে দেখতে পায় সেখানে। বিড়ি ফুকছে। পাতা পায়ের গতি বাড়িয়ে দিল। সেদিন চায়ের দোকানে দেখার পর আর নজরে আসে নি। আজ দেখতে পেল লুচ্চাটাকে।
পাতার পায়ের গতি বাড়িয়ে কাজ হয় না। শুকলা দেখতে পায় পাতাকে। বিড়ি টানতে টানতে বড় বড় পা ফেলে পাতার সাথে হাঁটতে থাকে। পাতা কাঁধের ব্যাগ শক্ত করে ধরে চুপচাপ হাঁটতে থাকে। শুকলা বিড়িটা ফেলে পাতার দিকে লালসা ভরা দৃষ্টিতে তাকায়। জিভ দিয়ে চুক চুক শব্দ করে বলে,

-” ভালোই আছোস দেখছি? শরীরে তেল ভালোই জমছে দেখছি! মোটা হইছোস খানিকটা! ব্যাপারটা কি? কেউ শরীর হা*তরাইছে নাকি?”

কি জঘন্য অশ্লীল কথা! পাতা রাগে শরীর জ্বলছে। তবে কিছু বলে না । শুকলা হেসে গালে হাত বুলিয়ে আবার বলতে শুরু করে,

-” সেদিনের চর ভুলি নাই বুঝলি? সব সুদে আসলে সোধ দিমু! তোরে একবার হাতের নাগালে পাই? এমন শিক্ষা দিমু কাউরে মুখ দেখাইতে পারবি না মা*গি!'”

পাতার পা থেমে যায়। সে শুকলার দিকে ভয়ংকর চোখে তাকিয়ে বলে,

-” শালা বারো**রি! এমন জায়গায় লাত্থি দিব না? একেবারে বাতি নিভে যাবে আজীবনের জন্য! সব কুরকুরানি বেড়িয়ে যাবে *** ফাটিয়ে দিলে! শালা আমাকে হুমকি দিস? এক কোপে মাথা আলাদা করে দিব! সর সামনে থেকে?”

বলেই পা চালায়। একটা অটোরিকশাকে আসতে দেখে সেটায় চড়ে বসে। পাতার শরীর এখনো কাঁপছে। ভয়ে নাকি রাগে সেটা বোঝা মুশকিল! মেয়ে মানুষ সে! রাস্তায় একা চলাফেরা করে। যদি কোন বিপদে আপদে পড়ে? সম্মানের ভয় আছে না? নাহ্। পাতা সিদ্ধান্ত নেয় বাড়ি ফিরেই লুবমানের সাথে কথা বলবে এই‌ শুকলার ব্যাপারে।

শুকলা মুখ বুজে অপমান গিলে নেয়। তবে শোধ তো সে নেবেই! যেকোনো ভাবে! শুকলাকে তো চেনে না মা*গি।
______

তপ্ত দুপুর বেলা। হালকা রোদ্দুর সেন তীব্র হয়েছে। বেশ গরম ছড়িয়েছে। হালকা বাতাস থাকলেও তীব্র গরমে সেটা গা জুড়িয়ে দিতে‌ পারছে না। স্কুল গেটের আশেপাশে রিকশার ঢল। সাথে ঝালমুড়ি বিক্রির প্রতিযোগিতায় নেমেছে কয়েকজন। শরবতের দোকানিও বসে নেই একদন্ড। গরমে ক্রেতাদের চাহিদা বেশ। গার্জেনসহ বাচ্চারা যেন উপচে পড়ছে সেখানে। অরুণ সরকারের গাড়ি এসে থামে স্কুল গেট থেকে একটু আগে পার্কিং জোনে। ড্রাইভার গাড়ি পার্ক করলেই অরুণ বেরিয়ে আসে ফ্রন্ট সিট থেকে। চোখে কালো খয়েরি ফ্রেমের চশমা। আজ আর ফরমাল ড্রেস আপে নেই। ব্লু হোয়াইট চেক শার্ট কালো জিন্স পরনে। মুখে বিরাজমান চিরচেনা গাম্ভীর্যতা! অরুণ গাড়ি থেকে বেরিয়ে গেট পেরিয়ে ভিতরে যায়।‌ ছেলেকে নিতে এসেছে সে। ছেলেটা রোজ আবদার করতো এক্সামের দিনগুলোতে যেন‌ সে স্কুলে আসে তার সাথে। এক্সাম শেষ না হওয়া অবধি অপেক্ষা করতে। তার পর ছুটি হলে তাকে নিয়ে বাড়ি ফিরতে। অরুণ প্রথম এক্সামের দিন থাকতে পারলেও পরের দিনগুলোতে থাকা হয় নি। আজকে লাস্ট এক্সাম, ড্রয়িং শুধু। থাকার চেষ্টা করেছিল; পারে নি কাজের চাপ থাকায়। তবে শিডিউল চেঞ্জ করে ছেলেকে নিতে এসেছে।ছেলেটা তাকে দেখে খুশি হবে নিশ্চয়ই!

সে ভোরের ক্লাসরুমের সামনে যায়।‌ সেখানে আভারি দাঁড়িয়ে এদিকে ওদিকে তাকাচ্ছে। অরুণ তার কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করে,

-” আভারি ভাই? কি খুজছো? ভোর কোথায়? এক্সাম শেষ হয় নি?”

আভারি চমকে চায় তার দিকে। সে ভোরের জন্যই দাঁড়িয়ে ছিল বটতলায়। বাচ্চাদের বেরোতে দেখে সে ক্লাসরুমের এদিকে আসে। ভোরও বের হবে এখন। কিন্তু এসে আর ভোরকে পায়নি। রুমের ভিতরেও গিয়েছিল ক্লাস টিচার বাদে কেউ ছিল না। তাকে জিজ্ঞেস করলে বলে কিছুক্ষণ আগেই বের হয়ে গেছে! তাহলে ভোর কোথায়? এমন তো কখনো হয় নি! ভোর বেরিয়েই তাকে খুঁজে নিত! আর সেও প্রতিদিন এক জায়গায়ই দাঁড়িয়ে থাকে তো!

-” স্যার বেরোতে দেখিনাই আমি! ক্লাসরুমেও নাই। স্যার বলল বেরিয়ে গেছে অথচ আমি দেখতে পাই নাই! কোথায় যে গেলো?”

অরুণ আশ্চর্য বনে যায়।

-” কি বলছো তুমি? দেখো নাই মানে কি? কোথায় যাবে? আশ্চর্য! একটা বাচ্চা ছেলের খেয়াল রাখতে পারো না! রুমে দেখেছো ভালো করে? ওয়াশ রুমে?”

অরুণ যেন অস্থির হয়ে পরে। রুমে, ওয়াশ রুমে, বারান্দায়,দোতলা তিনতলা সব জায়গাতেই গিয়ে খোঁজ করে। রোহানের মায়ের কাছে কল করে জিজ্ঞেস করে ওদের সাথেও নেই। মাঠে বাচ্চাদের ভিড়ে, আইসক্রিমের দোকানে, ঝালমুড়ি ওয়ালার কাছেও জিজ্ঞেস করতে ভুলে না। ভোর কোথাও নেই। অরুণের হঠাৎ পাতার কথা মনে পড়ায় দৌড়ে টিচার্স রুমের দিকে যায়। তাকে কষ্ট করে ভিতরে যেতে হয় নি। পাতা বাড়ি যাওয়ার জন্য বেড়িয়ে আসছিল।‌হাতে খাতার বান্ডিল! অরুণকে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসতে দেখে চমকায় খানিকটা। একি হাল অরুণ সরকারের? অরুণ পাতার সামনে দাঁড়িয়ে কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করে,

-” মিস পাতাবাহার?”

কি ছিলো কণ্ঠে? পাতার হৃদয় ছুঁয়ে গেল যেন। অরুণ নিজেকে ধাতস্থ করে একটা লম্বা শ্বাস নিয়ে বলে,

-” ভোর আপনার কাছে? দেখেছেন?”

পাতার কপালে গাড় ভাঁজ পড়ে।

-” না! আজকে ওদের রুমের ডিউটি আমার ছিল না‌। সি সেকশনে ছিল। ভোরের সাথে দেখাই হয় নি! কেন কি হয়েছে?”

অরুণ দু হাতে মুখের ঘাম মুছে ছুড়ে ফেলে। চুল গুলো টেনে বলে,

-” পাচ্ছি না ওকে। সব রুম ,প্রত্যেক ফ্লোরের ওয়াশরুম , মাঠেও চেক করেছি কোথাও নেই। ক্লাস থেকে বেড়িয়েছে অথচ আভারি দেখে নি! কোথায় গেল আমার কলিজাটা?”

বলেই প্রিন্সিপাল ম্যামের রুমের দিকে ছুটে যায়। পাতা সেদিকে চিন্তিত ভঙ্গিতে চেয়ে রয়। কই গেলো ছেলেটা? তখনই আভারি আসে সেখানে। পাতা তাকে ভোরের কথা জিজ্ঞেস করলে সে সব খুলে বলে। বলতে বলতে কেঁদেই দেয়। পাতার তাকে স্বান্তনা দেয়ার সময় নেই। সে ভোরদের ক্লাস রুমে গিয়ে খোঁজ করে। নিচের ফ্লোরের ওয়াশরুম একেবারে কর্ণারে। সে মেয়েদের ওয়াশ রুম চেক করে ছেলেদের ওয়াশ রুমে ঢোকে। সেখানে এক আয়া সব টয়লেটে পানি ঢেলে দরজা বন্ধ করতে ব্যাস্ত। পাতাকে দেখে আয়াটি পান খাওয়া দাঁত বের করে হেসে বলে,

-” আপনে এইহানে ম্যাডাম ? কোনো দরকার?”

পাতা খাতার বান্ডিল ব্যাগে ভরে নিল। ফোন বের করে গ্যালারি থেকে একটা পিক বের করে সামনে ধরল।

-” তা একটু ! এই বাচ্চাটাকে দেখেছো? নার্সারির! নাম ভোর সরকার!”

আয়া’টি পানের পিক ডাস্টবিনে ফেলে ফোনের দিকে তাকিয়ে ভালোভাবে দেখে বলল,

-” হুম। চিনি তো এইডারে। ভালোই বাচ্চাটা। হাসিখুশি একটু পাজিও। একটু আগেও দেখলাম।”

পাতা ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করে,

-” কোথায় দেখেছো? জলদি বলো?”

-” এই তো ওদের ক্লাসের পরের ক্লাসের বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিল।”

-” সাথে কেউ ছিল?’

মহিলাটি ভেবে বলল,

-” ছিল তো! ওর মা! আমাকে ডেকেও বলল ‘ আন্টি দেখ আমার মা!'”

পাতা ভাবনায় পড়ে যায়। মা? ভোরের মা এসেছিল?

-” কোথায় গেল তারা?”

-” তা জানি না! আপনি এত কিছু জিজ্ঞেস করতাছেন‌ ক্যান‌ ম্যাডাম? কিছু হইছে?

-” ছেলেটাকে পাওয়া যাচ্ছে না বলল ওর বাবা! তুমি আমার সাথে আসো জলদি!”

বলে পাতা বেরিয়ে আসে সাথে মহিলা আয়া।
প্রিন্সিপাল রুমের সামনে গিয়ে দেখতে পায় দরজা খোলা। ভিতরে অরুণ সরকার,ম্যাম ও স্কুলের কম্পিউটার অপারেটর। তারা তিনজনই কম্পিউটারের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে। সে পারমিশন চায় ভিতরে ঢুকার। পাতা ভিতরে ঢুকে সাথে মহিলাটিও। অরুণ তাদের দিকে একবার তাকিয়ে স্ক্রিনে নজর দেয়। তারা , ক্লাসরুমের ও বাইরের গেইটের সিসিটিভি ফুটেজ দেখছে। পাতা তাদের মনোযোগ আকর্ষণের জন্য গলা খাঁকারি দিয়ে বলে,

-” ভোর ওর মায়ের সাথে বোধহয়!”

অরুণ চকিত পাতার দিকে চায়। প্রিন্সিপাল ম্যাম অরুনের দিকে চেয়ে। বলে,

-” বর্ষার সাথে? অরুণ ও বাংলাদেশে?”

অরুণ মাথা নাড়ল। তার ঘামে ভেজা মুখশ্রী কঠিন হয়ে ওঠে। পাতার দিকে তাকিয়ে বলে,

-” কিভাবে জানলেন?”

পাতা আয়াকে দেখিয়ে বলে,

-” উনি দেখেছে বারান্দায়। ভোর মা বলেই পরিচয় করিয়ে দিয়েছে ওনার সাথে! আপনি কথা বলুন?”

অরুণ আয়া’র দিকে চায়। আয়া মহিলাটি ঘাবড়ে যায় খানিক। সে শুনেছে আসামি ও বিপক্ষ বাদি ফুরুত! সাক্ষি থাকো গারত! সে না ফেসে যায় এখন। সে আমতা আমতা করে বলে,

-” হ দেখছি‌ । বাচ্চাডারে চিনি তো আমি! বড়ই আদুরে। একটা মহিলার সাথে কথা বলছিল। আমায় দেইখা বলল তো মা ওর”

পাতা অরুণের দিকে চায়। ফর্সা মুখশ্রী লাল হয়ে আছে।যেন টোকা দিলেই ফেটে রক্ত বের হবে। একদম ভোরের মতোই ত্বক!

কম্পিউটার অপারেটর সেক্টরে কাজ করে যে লোকটি সে শুধু হা করে সবাইকে পর্যবেক্ষণে ব্যস্ত!
অরুণ ফোন বের করে বর্ষার নাম্বারে ডায়াল করে। একটু পরেই রিসিভ হয়। অরুণ নিজেকে শান্ত করে । ওপাশ থেকে আওয়াজ ভেসে আসতেই বলে,

-” তুমি কোথায়? ভোর তোমার সাথে?”
ওখানেই থাকো আমি আসছি !”

বলেই কল কাট করে। প্রিন্সিপাল মিস অরুণের কাঁধে হাত রেখে বলে,

-” শান্ত হও! ভোর ঠিক আছে! ওখানে গিয়ে রেগে হাত উঠিও না যেন! আমি তোমার সাথেই যাচ্ছি! চলো?”

অরুণ টেবিলে থাকা টিস্যু বক্স থেকে টিস্যু নিয়ে কপাল ও মুখের ঘাম মুছে। এসি রুমের ভিতরেও তার ঘাম ছুটছে!

-” আপনাকে যেতে হবে না ম্যাম! আপনি থাকুন। আমি যাচ্ছি। আর মিস পাতাবাহার? আপনি চলুন আমার সাথে!”

বলেই গটগট পায়ে বেরিয়ে যায়! পাতা ফ্যালফ্যাল করে চায় সেদিকে! আশ্চর্য তাকে কেন যেতে হবে?মামা বাড়ির আবদার নাকি!সে গিয়ে করবে? ছেলেকে পেয়েছে নিয়ে আসুক ! সে গিয়ে দুজন প্রাক্তনের মধ্যে সারসা ডান্স করবে নাকি! উফ্। প্রিন্সিপাল ম্যাম পাতাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বলে,

-” যাচ্ছো না কেন? যাও পাতা! আর শোন! অরুণের মাথা এমনিতেই গরম! ওর আবার হাত বেশি চলে! ভোরকে যেন না মারে। আর বর্ষাকে মারলে মারুক ! আই ডোন্ট কেয়ার!”

পাতা নাখোশ মনে যায় অরুনের পিছু। এদের বাপ ছেলের চক্করে সে না চাটনি হয়ে যায়!

চলবে…..