পাতা বাহার পর্ব-১৮+১৯+২০

0
520

#পাতা_বাহার
লেখনীতে:#বেলা_শেখ
#পর্ব- ১৮
( প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য )
(কপি করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ)

জোৎস্না স্নাত রাত! ঘনঘটা অন্ধকার নেই। তবে জোৎস্না রাতে যেরকম আলো বিরাজমান থাকে তেমন নয়! মেঘাচ্ছন্ন আকাশ চাঁদের ম্লান আলো পুরোপুরি প্রকাশ করতে দিচ্ছে না! তবে মেঘাচ্ছন্ন আকাশে ম্লান চাঁদ দেখতে মন্দ লাগছে না! বরং মেঘমল্লার যেন সৌন্দর্য আরো একধাপ বাড়িয়ে দিয়েছে! দক্ষিণ পশ্চিম আকাশে অবস্থানরত চাঁদের আশে পাশে কালো মেঘও যেন চাঁদের আলো ধারণ করে উজ্জ্বীবিত হয়ে উঠেছে! সব মিলিয়ে যেন এক অপূর্ব স্বর্গীয় সৌন্দর্য একটু প্রতিচ্ছবি!
ধরনী জুরে মেঘে ঢাকা চাঁদের ক্ষিন আলোর বিচ্ছুরণ! সাথে তনুমন জুড়ানো মৃদু হাওয়া! গাছের পাতা গুলো দুলছে এলোমেলো! মজুমদার বাড়ির পরিবেশটা এই শীতল পরিবেশেও বেশ গরম! শমসের মজুমদার ওত্র এলাকার একজন স্বনামধন্য ব্যক্তি! প্রৌঢ় গোছের লোকটা এলাকার বড় মুরুব্বি! সবাই তার কথার উপর কথা বলার সাহস করে না। এমন কি বর্তমানের রক্ত গরম জোয়ান ছেলেপুলেও না! তার বাড়ির সামনের আঙিনায় এলাকার শালিশ বলো আর মিটিং সব হয়ে থাকে। পাতার ব্যাপারটা নিয়েও হারুণ মুন্সি, আজম, শুকলা, শরিফসহ সকলে শালিশ ডেকেছে। আর তাছাড়াও ঘটনাটা এলাকার সবার মুখে মুখে। শমসের মজুমদারের কানে পৌঁছাতেও সময় নেয় নি!
আঙিনা জুড়ে গোল বৈঠক! প্লাস্টিকের চেয়ার গোল করে পুরো আঙিনায় রাখা। সেখানে সব গন্যমান্য ব্যক্তিবর্গ বসে। সম্মানিত মুরুব্বিদের চেয়ার গুলোর সামনে একটা টেবিল যার উপর পানির বোতল সহ কোল্ডড্রিঙ্কস! আর সাধারণ জনগণ দাঁড়িয়ে আছে পেছনে। মহিলাদের দল একটু দূরে খেজুর গাছের তলায় শান বাঁধানো জায়গায় বসে গুসুর ফুসুর করতে ব্যস্ত। লতা, পাতা ও লাবনী আক্তার তাদের পাশেই দাঁড়িয়ে রুম্পাকে কোলে নিয়ে। পাতা কালো ওড়নায় মুড়ে শান্ত হয়ে সব অবলোকন করছে। সে ভেঙে পড়ে নি মোটেও! কেন ভেঙে পড়বে! সে তো কোনো অন্যায় করে নি! না তার মনে কোনো দোষ আছে! তাহলে কেন ভেঙে পড়বে! ভয় পাবে? ভেঙে না পড়ে, মনে সাহস রাখলেও তার ভয় করছে! ভয় করছে ভরা মঞ্জিলে হেনস্থা হওয়ার! সে জানে এখানে কেউ তার কথা শুনবে না! তাকে কোনো কথা বলার সুযোগ দেয়া হবে না! বরং তার উপর আরো আরোপ লেগে কলঙ্কিত করতে পিছপা হবে না নিশ্চয়ই! আর শুকলা তো ভরা সভায় উপস্থিত! নাকে ব্যান্ডেজসহ! কু”ত্তার বাচ্চা তো চুপ থাকার মানুষ না! তবে পাতার ভেঙে না পড়ার এবং এক বুক সাহসের সাথে ভরা সভায় উপস্থিত থাকার সাথে বাবা, মা, ভাই সহ সকলের পাশে থাকা ওতপ্রোতভাবে জড়িত। আজ এতো বাজে স্মৃতির সাথে বাবার কিছুটা ভরসা ও ভালোবাসা আজীবন স্মরণে থাকবে! সে চোখের কোনে জমা জল মুছে সভায় মনোযোগ দেয়।

আতিকুর ইসলাম ও রাতুল ভুঁইয়া বসে আছে সকলের সাথে। রাতুলের কোলে ছেলে লাবিব! ছোট বাচ্চাদের এসব দরবারে আনা অনুচিত তবে রেখে আসারও ওয়ে নেই ফাঁকা বাড়িতে!
লুবমান বাবার পাশে দাঁড়িয়ে আছে গম্ভীর মুখে। তার সম্মুখের চেয়ারে শুকলা বসে।
হারুণ মুন্সি শমসের মজুমদারের পাশে বসে। সে মজুমদারের কানে কানে কিছু বললে তিনি মুখ খোলেন। আতিকুর ইসলামের উদ্দেশ্যে বলেন,

-” দেখো আতিক তোমারে আমরা চিনি একজন সৎ ভদ্রলোক হিসেবে। কখনো কারো সাথে না ঝগড়া বিবাদ, না কোনো হিংসা বিদ্বেষ দেখেছি। তোমার ঘরনী তোমার বড় মেয়েও বেশ নম্র ভদ্র। তোমার ছোট মেয়ের নামেও কিছু শুনি নি। তবে বেশ কিছুদিন হলো তার কিছু কিছু কথা কানে আসছিল! আর আজ এতো কিছু ঘটে গেলো! তুমি কি বলবে এ বিষয়ে?”

আতিকুর ইসলাম গম্ভীর শান্ত লোক। সে ঠান্ডা মাথায় বলে,

-” চাচা আমি সহজ-সরল মানুষ।কাজে কথায় সর্বদা সৎ থাকার চেষ্টা করি! আমার ছেলে মেয়েদেরও সেই শিক্ষাই গড়ে তুলেছি! ওরা কোনো অন্যায় কাজ করতে পারে না। পাতা আমার কাছে ছোট থেকে না থাকলেও বাবা হয়ে তাকে চিনতে ভুল করি নি! সে আমার রক্তই বহন করে! এতো বাজে কাজ কখনোই করবে না! করবে দূরের কথা চিন্তাও করতে পারবে না! আপনাদের কোথাও ভুল হচ্ছে!”

পাশে দাঁড়িয়ে থাকা লুবমান জোর গলায় বলে,

-” ভূল না। এটা সরযন্ত্র! ওই শুকলা মন্ডলের! তার চরিত্রের বর্ণনা আশা করি দিতে হবে না!”

শুকলা জলন্ত চোখে চায় লুবমানের দিকে। লুবমানের কড়া চাহনি তার উপরেই ন্যস্ত। হারুণ মুন্সি চেয়ার ছেড়ে উঠে লুবমানকে ধমকে বলে,

-” তোমার বাপের বয়সী সে! মুখ সামলে কথা বলো চ্যাংড়া! আর আমরা বড়রা কথা‌ বলছিই তো! তুমি চুপ থাকো!”

আতিকুর ইসলাম ছেলেকে চুপ থাকতে বলে।‌ রাতুল ছেলেকে বসিয়ে লুবমানের পাশে দাঁড়ায়! হারুণ মুন্সি চেয়ারে বসে। শরিফ ঠোঁট বাঁকিয়ে আতিককে ব্যঙ্গ করে বলে,

-” কাকা আপনি কাজ নিয়া পড়ে থাকেন! মেয়ের খোঁজখবর কিছু রাখেন?মেইন শহরে চলাফেরা সে একলা করে না। আমরাও করি! প্রায়ই তাকে ওই লোকটার লগে দেখা যায়। কখনো হাত ধরে হাসতে হাসতে তো কখনো একেঅপরের সাথে লেপ্টে! গাড়িতে উঠতেও কতবার দেখলাম! আড়ালে আবডালে হোটেলে..”

আতিকুর ইসলাম তাকে থামিয়ে বলে,

-” শরিফ ভিত্তিহীন কথা বলবে না। এমনি এক কথা বলবে আর আমরা মেনে নেব? আছে তোমার কাছে এসব প্রমাণ? আর কে বলেছে আমি কাজ নিয়ে পড়ে থাকি মেয়ের খোঁজখবর রাখি না! আমি যথেষ্ট খবর রাখি! আর এসব কথা কখনো কারো মুখে না শুনেছি না নিজের চোখে দেখেছি। আজ হঠাৎ তোমরা বলবে আর বিশ্বাস করে নেব? আগে দেখেছো, বলছো? কই কখনো আমায় বলো নি তো!”

-” চাচা..”

আতিকুর আবার তাকে থামিয়ে দিল।

-” কার কথায় এসব কালকাঠি নরছে বুঝতে পারছি! তোমরা যার কথায় নাচছো একবার তার চরিত্র ঘেঁটে দেখো? সে দুধে ধোয়া তুলসী পাতা? তার চরিত্র সম্পর্কে তুমি না জানলে ভালো তোমার মা বোনকে সহ এলাকার সব মা বোনদের জিজ্ঞেস করতে পারো! আমার মেয়ে শান্ত শিষ্ঠ! কিন্তু আত্মসম্মানে কেউ আঘাত করলে ছেড়ে দেবে না। সে যথেষ্ঠ স্ট্রং! তাকে নিয়ে খারাপ মন্তব্য করবে আকারে ইঙ্গিতে বাজে প্রস্তাব করবে আর সে চুপচাপ সহ্য করবে ? কখনো না! উচিত জবাব দিয়ে প্রতিবাদ করবে। আর আমরা তার পাশে আছি!”

শুকলা সহ কারোরই বুঝতে অসুবিধা হয় না কার কথা বলছে আতিকুর! কিন্তু তাঁরা অন্যায় যেনেও দাপট দেখিয়ে যাবে। এটাই তাদের বৈশিষ্ট্য! শুকলা পয়সাওয়ালা লোক। এখানে আসার আগে পকেট ভারী করেছে সাথে আরো দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। তো তার পক্ষ ছেড়ে কথা বললে অন্যায় হবে না!!
শুকলার একমাত্র ছেলে উপস্থিত সভায়। সে আঙ্গুল তুলে বলে,

-” বাহ চাচা ভালো! নিজের মাইয়ার দোষ ঢাকতে অন্যের চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন! আমার তো সন্দেহ হচ্ছে আপনিই না আবার লোভে পড়ে মেয়েকে বড়লোক ছেলের পিছনে লেলিয়ে দিয়েছেন! মেয়ে নিয়ে ব্যবসা খুলে বসেছেন নাকি?”

শান্ত লুবমান উপস্থিত মুরুব্বিদের তোয়াক্কা না করে তেড়ে গিয়ে কলার ধরে একটা ঘুষি মারে!

-” শালা নিজেদের মতো ভাবিস সবাইকে?”

রাতুল ,আতিকুর এগিয়ে এসে ছেলেকে ধরে। শুকলার ছেলে শামিম মার খেয়ে চুপ থাকে নি। সেও দ্বিগুণ তেড়ে এসে লুবমানকে দুই তিনটা ঘুষি দেয়। আতিকুর, রাতুল থামাতে পারে না। বিশাল দেহি ত্রিশোর্ধ শামিমের কাছে ছাব্বিশ বছরের হ্যাংলা লাবিব যেন চুনোপুঁটি! উপস্থিত বাকি মুরুব্বিরা এসে থামায়। রাতুল লুবমানকে টেনে নিয়ে যায়। শুকলা দাত কিড়মিড় করে বলে,

-” জাওড়া পোলাপাইন সব! আমারে না*গর দিয়া মাইর খাওয়াইলো! পোলাডারেও ছাড়লো না! মজুমদার সাব আপনি বিচার করেন! এই নেশারু আমার ছেলেরে জখম কইরা দিলো! কয়েকদিন আগে না জেল খাইটা আইলো! বোনটা হইছে বে*শ্যা আর ভাইয়ে খাজাখোর নেশাখোর!”

আতিকুর ইসলামও জোর গলায় বলে,

-” ভদ্র ভাষায় কথা বলবেন! সবাই আপনার মতো নোংরা স্বভাবের না! আপনার ছেলেকে আগে ঠিক করেন। আমার ছেলে কোনো নেশাখোর গাজাখোর না! উঠতি বয়সে এই এলাকার বাজে ছেলেদের প্ররোচনায় পড়ে দু একবার ছুঁইয়ে দেখেছিল। আমি রিহ্যাবে পাঠিয়েছিলাম। সে তার ভুল বুঝতে সময় নেয় নি! আর বাজে ছেলেগুলো কারা আমি আপনি ভালো করেই জানি! আর মেয়েকে নিয়ে কোনো বাজে কথা সহ্য করবো না। আমি ভালোর ক্ষেত্রে ভালো খারাপের বেলায় খুব কঠোর! বে*শ্যাগিরি কারা করে বেড়ায় আপনার থেকে ভালো কে জানবে?”

শুকলা তেড়ে আসে,

-” বাহ সবাই দেহি সাধু! তুমি লোক ভালোমানুষীর মুখোশ পরে থাকো! এই পাতা মেয়ে ডা তোমার তো? নাকি ভাইরারে বউয়ের ঘরে ঢুকাইছিলা! তার জন্যই..”

আতিকুর ইসলাম আশ্চর্যের শেষ সীমানায়! এ কি লোক? এর ধর্ম কর্ম দেখে শয়তানও দৌড়ে পালাবে! ওপর দিকে হারুণ মুন্সি সহ শমসের মজুমদারের ঠোঁটের কোনায় শয়তানি হাসির ঝিলিক।

লুবমানকে রাতুল জাপ্টে ধরে। লুবমান‌ তেড়ে যেতে নেয় শুকলার দিকে। রাতুল আটকায়। এই ছেলে মারতে পারবে না একটা! শুধু খেয়েই আসবে! আর তাছাড়াও মারামারি করা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। আতিকুর ইসলাম কিছু বলবেন এর আগে রাতুল মুখ খোলে।

-” এসব কেমন চিপ মেন্টালিটির কথা? এসব বলে আপনারা নিজেদের জঘন্য মন মানসিকতার পরিচয় দিচ্ছেন! আপনি বয়স্ক মানুষ! এক পা কবরে অলরেডি চলে গেছে! এবার তো পরপারের চিন্তা করবেন? নাকি আল্লাহকে ভয় পান না? আপনার কথাবার্তা শুনেও‌ মনে হয় না! আমি জামাই এ এলাকার! আমার শশুরকে এক যুগ হলো চিনি! তার মতো সচ্চরিত্রবান লোক কমই দেখেছি! আপনারা তো আমার আগে থেকেই দেখে এসেছেন। এখন তার নামে কুৎসা রটাচ্ছেন? আর আমার শ্যালিকা পাতার কথা! আসছি! আপনাদের সামনে উপস্থিত এই শুকলা মন্ডল লোকের চরিত্র সম্পর্কে আপনারা সবই জানেন বলে আমি মনে করি! এখন আপনারা এটা কেন স্বিকার করবেন না সেটা জানি না! হয়তো টাকা ওয়ালা লোক তাই! তবে টাকাই কিন্তু সব না! মজুমদার সাহেব আশা করি ন্যায় বিচার করবেন! এই লোকটা পাতার পিছনে পড়ে ছিল বেশ সময় ধরে। রাস্তা ঘাটে বাজে প্রস্তাবও দিতো! পাতা থাপ্পড় লাগায় জনসম্মুখে! এতেই ওনার মেল ইগোয় আঘাত হানে! রাস্তা ঘাটে হুমকি দিতে থাকে। মেয়ে মানুষ সে সম্মানের ভয় থাকবে না? আর তাছাড়া এসব বিষয় মেয়েরা কাউকে জানায় না ভয়ে! পাতার ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে! কাউকে জানায় নি। একাই প্রতিবাদ করে গেছে। উনার সাজানো নাটক বলা চলে আজ দুপুরের ঘটনা..”

রাতুলকে থামিয়ে দেয় হারুণ মুন্সি। রেগে গলা চড়িয়ে বলে,

-” তুমি জামাই মানুষ বেশি কথা বলিও না! আমি ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলাম। সচক্ষে দেখছি ওদের রঙ লীলা। আর ওই মাইয়া সাধু তো ওই পোলার লগে হাত ধইরা জরাজরি কইরা ঘুরাফেরা এগুলা বানোয়াট কথা? আমাদের আবাল পাইছো? মজুমদার ওই মাইয়ারে ডাকো? আজ ন্যাড়া করাইয়া মুখে চুনকালি লাগাবো!”

শমসের পানের পিক ফেলে সবার দিকে তাকিয়ে বলে,

-” আহ সবাই শান্ত হও তো! আমি সব শুনলাম! আতিক শুকলা সবার কথাই! জামাই বাবাজি তোমার সাথে কথা বলি! তুমি সত্যিই বলতাছো মাইনা নিলাম! বাকি সবাই কি তাইলে মিথ্যা বলতেছে? শুকলা খারাপ খুব খারাপ! একেবারে জঘন্য! পাতা মেয়েডা খুব ভালো! তয় তার নামেই এতোসব রটলো কেন? গ্রামে খারাপ মাইয়া আর নাই? কই তাদের কথা তো উঠলো না? শোন যা রটে তা কিছুটা হইলেও ঘটে! ওই মাইডাও সাধু না আবার শুকলাও সাধু না! আমি কি খারাপ কিছু বললাম?”

রাতুল কিছু বলবে কিন্তু সে বলতে দেয় না। এ লোক গভীর জলের মাছ! শমসের হেসে বলে,

-” তোমার থাইকা বেশি দুনিয়া দেখছি বুঝলা? এখন মাইয়াডারে ডাকো? তার কথা শুনি? দেখি কি বলে?”

রাতুল বুঝতে পারে এদের সাথে কথায় পারা যাবে না। এরা কোমড়ে গামছা বেঁধে নেমেছে! মুরুব্বি সবাই তাদের বিপক্ষে কথা বলছে! নিশ্চয়ই পকেট গরম করেছে। এখন আল্লাহ তুমি সহায় হও! আতিকুর ইসলাম ভিড় ঠেলে বেরিয়ে মেয়ের কাছে যায়। পাতা মাকে আকরে ধরে কাঁপছে। চোখ মুখ বিবর্ণ হয়ে আছে। সে এগিয়ে এসে মেয়ের কাছে দাঁড়ায়। বাকি মহিলা গুসুর ফুসুর করে কথা বলছে সেদিকে তাকিয়ে। আতিকুর মেয়ের মাথায় হাত রেখে বলে,

-” তোমার আব্বু, ভাই সাথে আছে। কিচ্ছু হতে দেব না!মনে সাহস রেখ! আসো?”

পাতা মাথা নাড়ে। আতিকুর মেয়ের কাঁধ জড়িয়ে নিয়ে আসে ভরা দরবারে। পাতা মাথা নিচু করে বাবার পায়ের সাথে পা মেলায়।

জনসম্মুখে দাঁড়িয়ে সে! সকলের দৃষ্টি তার দিকে নিবদ্ধ! পাতা চোখ বুজে দীর্ঘ শ্বাস ফেলে। চোখ খুলে ভাইয়ের জখম হওয়া মুখ দেখে। বাবার হাত জোড়া শক্ত করে চেপে ধরে নিজেকেও শক্ত করে। নাহ পাতা! তোকে দূর্বল হলে চলবে না! সাহস রাখতে হবে!পাতা বিড়বিড় করে পরম করুণাময় আল্লাহ তায়ালার কাছে প্রার্থনা করে ‘ইয়া রহমান! ইয়া রাহিম তুমি তোমার এই পাপি বান্দার সহায় হও! সাহায্য করো! সকল বালা মুসিবত থেকে মুক্ত করো!’

হারুণ মুন্সি পাতাকে কিছু বলবে শমসের থামিয়ে গলায় ঝুলানো একটা কাটার মতো তামার চিকন সুইয়ের মতো দন্ড দিয়ে দাঁত খিচে বলে,

-” পাতা! তুমিই পাতা! দেখতে শুনতে ভালোই তো! তোমার নামে তো বেশ অভিযোগ জমা হয়েছে! এখন তুমি কি বলতে চাও? দেখো সত্যিটা বলবে! এতে শাস্তির ভার কমে আসবে! আর …”

আর বলতে পারে না। তীব্র ধ্বনিতে বেজে ওঠা হর্ণের শব্দে থেমে যায়। হর্ণের আওয়াজ থামে না। বেজেই চলেছে। সবার নজর রাস্তায় দাঁড়ানো বি এম ডাবলিও গাড়ির দিকে। গাড়ির হেড লাইট জ্বালানো! সবাই তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সেদিকেই চায়। পাতাও ঘার ঘুরিয়ে চায় চোখ ছোট করে। দেখতে পায় গাড়ি থেকে নামে দুজন লোক। দূর থেকে মানুষের ভিড়ে চিনতে পারে না। লোক দুটো বাড়ির আঙিনায় আসে। লাল নিয়নবাতির আলোয় দৃশ্যমান হয় তাদের মুখশ্রী। সবাই সরে গিয়ে সভার ভিতরে প্রবেশ করতে সাহায্য করে। পাতা পাশের জন কে চিনতে পারে না। তবে অরুণ সরকারকে চিনতে ভুল হয় না। শার্ট প্যান্ট পড়নে সাধারণ বেশে। চোখে চশমা পড়া! গম্ভীর মুখটা যেন আরেকটু গম্ভীর হয়ে আছে। তাদের একটু দূরে দাঁড়িয়ে পকেটে হাত গুজে সম্মুখ পানে চেয়ে বলে,

-” মাই সেল্ফ অরুণ সরকার!”

চলবে….

#পাতা_বাহার
লেখনীতে: #বেলা_শেখ
#পর্ব- ১৯
( প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য )
(কপি করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ)

সবাই তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সেদিকেই চায়। পাতাও ঘার ঘুরিয়ে চায় চোখ ছোট করে। দেখতে পায় গাড়ি থেকে নামে দুজন লোক। দূর থেকে মানুষের ভিড়ে চিনতে পারে না। লোক দুটো বাড়ির আঙিনায় আসে। লাল নিয়নবাতির আলোয় দৃশ্যমান হয় তাদের মুখশ্রী। সবাই সরে গিয়ে সভার ভিতরে প্রবেশ করতে সাহায্য করে।পাতা পাশের জন কে চিনতে পারে না। তবে অরুণ সরকারকে চিনতে ভুল হয় না। শার্ট প্যান্ট পড়নে সাধারণ বেশে। চোখে চশমা পড়া! গম্ভীর মুখটা যেন আরেকটু গম্ভীর হয়ে আছে। তাদের একটু দূরে পকেটে হাত গুজে সম্মুখ পানে চেয়ে বলে,

-” মাই সেল্ফ অরুণ সরকার!”

পাতা এমন পরিস্থিতিতেও মনে মনে ভেংচি কাটে। নাক উঁচু লোক!‌ ‘মাইতেল্ফ অলুন তলকাল’ হুহ।

অরুণ বলেই পাশে বসা শুকলার দিকে চায়। শুকলার হাত নাকের ব্যান্ডেজে ওঠে। খানিকটা ভীত হয়ে ছেলের দিকে তাকিয়ে বোঝায় এই সে! শামিম অরুণের দিকে চায় শানিত দৃষ্টিতে। হালকা পাতলা চেনে একে। কিন্তু ওসবে সে ভয় পায় নাকি! অরুণ শামিমের নজরের তোয়াক্কা করে না। ঘার ঘুরিয়ে সামনে চায়! সামনে বসা হারুণ মুন্সির দিকে খানিক চেয়ে মজুমদারের দিকে চায় তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে!মজুমদার ভারি ক্ষুব্ধ হয়! মুরুব্বিরা সব বসে; সালাম কালাম নেই! অভদ্র! সে ঝুঁকে পাশে থুতু ফেলে বলে,

-” ওহ তুমিই সেই পোলা! যদিও পোলা লাগতেছে না! বেশ হাট্টাখাট্টা তাগড়া জোয়ান! মাইয়াটার থাইকা বয়সেও বেশি! তাতে কি পোলা হোক বা বুড়া আজকালকার মাইয়াদের টাকা হইলেই হইবো! তা বাবা তুমি কেন এদের..”

তাকে থামিয়ে অরুণ চশমা খুলে বুক পকেটে ঝুলিয়ে বলে,

-” সোনা, রুপা, হিরক সব ধাতু নিয়েই কাজ করি আমি! তাই কোনটা আসল নকল দেখলেই বুঝতে পারি।‌ আপনাকে দেখে ও আপনার কথা শুনেই বুঝতে পেরেছি আপনি কোন ধাতুর তৈরি! ভেজাল মেশানো নেই! বরং পুরোটাই ভেজাল মা*ল! এখানে আসার আগে যদিও কিছু লোকের কুন্ডুলি জানলাম গাড়িতে বসে! আমার বন্ধু বললো। ওর পরিচয়.. না থাক আপনারা ভয় না পেয়ে যান!”

হারুণ মুন্সি উঠে আসে চেয়ার থেকে। অরুণের সামনে দাঁড়িয়ে আঙ্গুল তুলে শাসিয়ে বলে,

-” তোমারে না সাবধান করলাম এসব থেকে দূরে থাকবে? শুকলাকে মেরেছো কিছু বলি নি! মানে এই না যে তোমারে ডরাই! ভালো সমস্যায় পড়বা..”

-” আমিও তো বলেছি দেখি আপনারা আমার কি করতে পারেন! আপনাদের হাত কতদূর। আর যেখানে ঘটনার মুখ্য চরিত্রে আমি সেখানে আমাকে ছাড়া আপনারা কিভাবে দরবার ডাকেন? ব্যাপারটা কেমন হয়ে গেল না?”

হারুণ মুন্সির মুখে কথা নেই। মজুমদার দাড়িতে হাত বুলাতে থাকে। লোকটা তাকে সবার সম্মুখে অপমান করলো? সেও ছেড়ে দেওয়ার পাত্র নয়!

পাতার ঠোঁটের কোণে অল্প হাসির ঝিলিক দেখা দেয়! সে তখন দূর থেকে সবার কথা মনোযোগ সহকারে শুনছিল! সবাই তাদের বিপক্ষে! সে তবুও চুপ ছিল। কিন্তু যখন ভাইকে শুকলার ছেলে শামীম মারলো! শুকলা বাবাকে যাতা বলে অপমান করলো সে বুঝে যায় সব! পরিস্থিতি খুবই জটিল। এখান থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার রাস্তা হিসেবে অরুণ সরকারের নাম মাথায় আসে। লোকটি তো বলে গিয়েছিল কেউ টু কথা বললেও যেন তাকে জানায়। অথচ পুরো গ্রাম জুড়ে এ বিষয়ে চর্চা হচ্ছিল। দরবার ডাকা হলো। সে দেড়ি করে না। অরুণ সরকারের নাম্বারে ডায়েল করে দেয়। তবে সে শঙ্কায় ছিল নাক উঁচু লোকটি আসবে কি না!

রাতুল লুবমানকে ছেড়ে অরুণের পাশে দাঁড়িয়ে বলে,

-” বড় ভাই?আমি রাতুল ভুঁইয়া।আপনি ব্যবসায়ী মানুষ। শুনেছি ব্যস্ত থাকেন! তবে এতো এতো ব্যস্ততার ভিড়ে পাতাকে নিয়ে রাস্তায় পার্কে হাত ধরে জরাজরি করে ঘুরা ঘুরি করেন! মাঝে মাঝে আড়ালে আবডালে হোটেলেও যান! এসব তো কখনো জানতামই না। এই দরবারে জানতে পারলাম।”

অরুণ ভ্রু যুগল কুঁচকে চায় তার দিকে। কি বললো? সে রাতুলকে চিনতে পেরেছে। ভার্সিটিতে পরিচয় তাদের। একসাথে অনেক কাজও করেছে, যদিও জুনিয়র। তাঁর রাতুলের ইশারা বুঝতে কষ্ট হয় না। তার চোয়াল শক্ত হয়। সে একনজর পাতার দিকে চায়। বড় কালো ওড়নায় মুখশ্রী ঢেকে আছে। তারপর গলা উঁচিয়ে বলে,

-” হোয়াট আ ইন্টারেস্টিং স্টোরি! রাইটার কে? শুয়ার না কি যেন নাম! শুকলা! গুড! আপনাদের এলাকার গুপ্তচর গুলো দেখছি খুবই কাজের। না হওয়া সিন গুলোও সুন্দর ভাবে বর্ণনা করেছে। আর আপনারাও শালিসি ডেকেছেন। আপনারা এলাকার খুবই দায়িত্ববান লোক দেখছি! অন্যায় একদম সহ্য করতে পারেন না। বিকেলে ঘটনা ঘটলো আর সন্ধ্যার পরেই বৈঠক। ইম্প্রেসিভ! অথচ একজন রেপিস্ট এলাকায় গলা উঁচিয়ে চলে। তাদের ব্যবস্থা কেন করেন নি?”

থামে অরুণ। সবাই তার দিকে উৎসুক হয়ে চেয়ে। শুকলার মুখ বিবর্ণ হয়ে যায়। মুরুব্বিরা নজর এদিক ওদিক করে মুখ লুকানোর চেষ্টায়। মজুমদার কিছু বলবে এর পূর্বে অরুণ দ্বিগুণ জোর গলায় শুকলার দিকে আঙুল তুলে বলে,

-” এই‌ জানোয়ার চার বছর আগে একটা সিক্সে পড়ুয়া বাচ্চা মেয়েকে ধর্ষণের চেষ্টা করে। যোদ্ধা বাচ্চা মেয়েটা নিজেকে বাঁচিয়ে নেয়। মেয়ের বাবা মা থানায় কেসফাইল করতে চাইলে আপনারা সাহায্য না করে ভুজুং ভাজুং বুঝিয়ে গোল বৈঠক বসিয়ে মেয়েটার বিয়ের ব্যবস্থা করে মামলা ডিসমিস করে দেন। কি অভিনব বুদ্ধি আপনাদের! প্রশংসার যোগ্য! এই মানুষ রুপি পশুর নামে তো আরো অনেক মেয়ে ঘটিত ব্যাপার আছে। ওর ছেলের মাদক ব্যবসায়ীর সাথে লিঙ্ক আছে। শুধু সে না এখানে উপস্থিত আরো অনেকের!
কই সেসব বিষয়ে আপনাদের গুপ্তচর খবর পায় না? এলাকায় শালিস বসে না? নাকি পকেট ভর্তি করিয়ে দিলেই খালাস?”

শুকলার ছেলে সহ বেশ কয়েকজন তেড়ে আসতে নেয় অরুণের দিকে। আতিকুর, রাতুল, লুবমান পাশে দাঁড়ায় তার। পাতা ভয় পেয়ে যায়। অরুণ ওদের দিকে আঙুল তুলে হুঙ্কার দিয়ে বলে,

-” খবরদার! এক পা এগোলে দাঁড়িয়ে থাকার জো রাখবো না! চুপচাপ ওখানেই দাঁড়িয়ে থাক!”

অরুণের সাথে আশা লোকটি শার্টের নিচে কোমড় থেকে কিছু বের করে। ব্যস! সবাই পিছু হটে! অরুণ হালকা হেসে হারুণের দিকে তাকিয়ে বলে,

-” পাতি গুন্ডা নয়! আর্মির মেজর। আমার বন্ধু! সেই সব ইনফরমেশন দিলো।‌আরো অনেক ইনফরমেশন দিয়েছে।কোনটা রেখে কোনটা বলবো বলুনতো? সে যাই হোক আসল কথায় আসি!”

অরুণ পাতার দিকে এগিয়ে যায় কিছু বলবে তখনি বেশ কিছু বাইক, পুলিশের গাড়ি, দুটো গাড়ি এসে থামে রাস্তর পাশে। সেই শব্দে সবাই উৎসুক হয়ে চায়। শুকলা সহ বেশ কয়েকজনের কপালের ঘাম ঝড়ে পড়ে। পুলিশ ফোর্স নিয়ে আসলো এই লোক?

পাতা অরুণের দিকে চায় বড় বড় চোখে। এই লোক আর কি কি দেখাবে? সে ঢোক গিলে। অরুণ পাতার ভয়ার্ত মুখশ্রী দেখে মৃদু হেসে ভ্রু নাচিয়ে ইশারা করে ওদিকে তাকাতে। পাতা চায় সেদিকেই।

গাড়ি থেকে বেরিয়ে আসে বন্দুক হাতে কালো পোশাক ধারি গোটাকয়েক গার্ডস। কিছু পুলিশ সহ আরো কিছু লোক। একজন গার্ড মাঝখানে অবস্থান রত গাড়ির দরজা খুলে দিলে গাড়ি থেকে বের হয় বয়স্ক লোকটি। পরনে পাঞ্জাবীর উপর মুজিব কোট।

আস্তে ধীরে এগিয়ে এসে বৈঠকে উপস্থিত অরুণের সামনে দাঁড়ায়। অরুণের দিকে তাকিয়ে হাত বাড়িয়ে বলে,

-” অনেক দিন পরে দেখা অরু! ভুলেই গেছো?”

অরুণ হ্যান্ডশেক করে না। দু হাত বাড়িয়ে জড়িয়ে ধরে।

-” তুমি ব্যস্ত মেয়র! তোমার প্রত্যেকটা সময় মূল্যবান! তাই অপচয় করিয়ে কি লাভ! ভালো আছো?”

মেয়র স্বাধীন চৌধুরী হেসে অরুণের পিঠ চাপড়িয়ে বলে,

-” তোর সাথে কথায় পারা যাবে না! ভালো আছি! তোর কি খবর? আমার ছোট্ট নাতির?”

-” আলহামদুলিল্লাহ! তোমার ব্যস্ততম সময়ের মধ্যে আমার কথা শুনে এখানে এসেছো! কি বলে ধন্যবাদ দিবো?”

-” আরে রাখ তোর ধন্যবাদ! আগে মামলা সেট করি। কি অবস্থা এখানের?”

সবাই অবাক হয়ে দেখছে মেয়েরকে! তাদের এলাকার মেয়র! সবাই কথা বলার ভাষা হারিয়ে ফেলেছে। শমসের মজুমদার গ্লাসে পানি ঢেলে ঢক ঢক করে পানি পান করে। আজ তার কি হবে? সে কটমট চোখে হারুণের দিকে চায়। সব দোষ এই মুন্সির! তার পকেটে মালপানি ঢুকিয়ে বলে ‘সেই রকম বেইজ্জতি করবেন ‘ আরে এখন তার নিজের মান ইজ্জত নিয়ে টানাটানি! সে চেয়ার ছেড়ে উঠে আসে। হারুণ মুন্সিও বাদ যায় না!

অরুণ তাদের উঠে আসতে দেখে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে। শুকলা ও তার ছেলে কি করবে ভেবে পায় না।‌ বসে থাকা সকল মানুষ দাঁড়িয়েছে অনেক আগেই। কতবড় মানুষ এসেছে।

মজুমদার হারুণ সহ অনেকে এসে সালাম জানায় মেয়রকে। হাত মেলায়! স্বাধীন চৌধুরী হেসে সকলের সাথে কুশল বিনিময় করে। অরুণ পাশেই দাঁড়িয়ে তীক্ষ্ণ চোখে। হারুণ মুন্সির সাথে চোখাচোখি হয়। হারুণ মুন্সি কাঁচুমাচু মুখে নজর ফিরিয়ে নেয়। মজুমদার মেয়রকে অনুরোধ করে,

-” আমাদের কত সৌভাগ্য আপনি এসেছেন আমাদের দুয়ারে। আসুন বসুন স্যার?”

-” না! বসার সময় নেই! অরু একটু জলদি ফিরতে হবে।‌ কিছু মনে করিস না।”

অরুণ হেঁসে বলল,

-” না মামা! এদের জন্য আমি একাই যথেষ্ট! আর সেফটি সরূপ রাসেল আছে না।”

পাতা ঠোঁট উল্টায়! পুরো পল্টন সমেত এসে বলছে আমি একাই যথেষ্ট!!
অরুণ বাকি সবার দিকে তাকিয়ে বলে,

-“তোমাকে এখানে আনার উদ্দেশ্য ভিন্ন! এলাকার পরিস্থিতি স্বাভাবিক না! তোমার আন্ডারের এলাকায় রেপিস্ট গলা উঁচিয়ে ঘুরে বেড়ায়! আড়ালে মাদকচক্র চালিয়ে যাচ্ছে। এলাকার ছেলেমেয়ে তো নেশায় মেতে উঠছে অজান্তেই! বিভিন্ন গ্যাং তৈরি হচ্ছে। আরো কতশত! রাসেল খবর দিলো আমায়। এখন তুমি কি বলতে চাও?”

স্বাধীণ চৌধুরী অরুণের দিকে শান্ত চোখে চায়।

-” আমি ব্যাপারটা খতিয়ে দেখবো। প্রমিস করছি! এখন এই ব্যাপারটা দেখি?”

মজুমদার চট করে বলে,

-” স্যার! বসুন আপনি। আমি জানতাম না এ আপনার ভাগ্নে। সবাই বললো মেয়েটার সাথে ওনাকে বেশ কয়েকবার দেখা গেছে। তারপর বিকেলের মারামারি তাই..”

স্বাধীন চৌধুরী তাকে থামিয়ে বলে,

-” আমার ভাগ্নে বলে কোনো কথা না। ন্যায় টাই আসল। আমি সব শুনলাম তার কাছ থেকে। আপনাদের মানসিকতা দেখে আমি অবাক! সে যাই হোক অরু এখন কি করতে বলছো?”

অরুণ সরকার পকেটে হাত ঢুকিয়ে এগিয়ে আসে। পাতার দিকে তাকিয়ে বলে,

-” আগে তো ভিক্টিমের কাছ থেকে শুনি! তার মতামত জানতে হবে না? মিস পাতাবাহার আপনি বলুন? আসল ঘটনা কি? আমি শুরু থেকে জানতে চাই?”

পাতা অবাক হয় খানিকটা। এতো মানুষের ভিড়ে সে কথা বলবে? লুবমান এসে বোনের কাঁধে হাত রেখে বলে,

-” আমি বলছি আসল ঘটনা! এতো মানুষের ভিড়ে পাতা বলতে পারবে না আমি জানি!ওই কু*ত্তার বাচ্চাকে দেখছেন?আমার বোনকে হ্যারাস করতো।রাস্তাঘাটে দেখা হলে মামুনি মামুনি বলে গায়ে হাত দেয়ার চেষ্টা করতো। কিছুদিন আগে বৃষ্টির দিন ভরা রাস্তায় নোংরা প্রস্তাব দেয়। পাতা তাকে থাপ্পড় মেরে জবাব দিয়ে দেয়‌। এতেই জানোয়ারটা ক্ষেপে গেছে। এরপর থেকে হুমকি ধামকি দেওয়া শুরু। আজ সকালেও স্কুলে যাওয়ার সময় হুমকি দিয়েছে ‘মুখ দেখানোর জো রাখবে না! তার পরের ঘটনা তো আপনি জানেনই। এলাকার আরো কয়েকটা কুত্তার সহায়তায় হাবিজাবি করে কত বড় বদনাম বের করলো!”

অরুণের চোয়াল শক্ত হয়। বড় পা ফেলে শুকলা মন্ডলের কলার টেনে সামনে আনে। শুকলার ছেলে বাঁধা দিলে তাকে এক থাপ্পড়ে শান্ত করিয়ে দেয়। শুকলাকে পাতার সামনে ধাক্কা দিয়ে মাটিতে ফেলে পাতার উদ্দেশ্যে বলে,

-” মিস পাতাবাহার মেয়েরা নরম মনেরই মানানসই। তবে সব ক্ষেত্রে নয়। আপনি বিকেলে ওদের নোংরা কথার জবাব পায়ের জুতো খুলে বুঝিয়ে দিলেন না? ট্রাস্ট মি আমি অবাক হয়েছি! সাথে অনেক খুশি। এখন পুনরায় পায়ের জুতো খুলে ওদের বুঝিয়ে দিন মেয়েদের সম্মান তাদের অহংকার। আর সেই অহংকারে হাত দেয়ার পরিণতি কি! জুতো খুলুন? খুলছেন না কেন?”

শেষের হুংকারে পাতা কেঁপে ওঠে। তার হাত পা কাঁপছে। তার পক্ষে এখন টু শব্দটি করার শক্তি নেই অথচ লোকটা জানোয়ার পেটাতে বলছে?

শুকলা দাঁতে দাঁত চেপে মাথানিচু করে পড়ে থাকে। তার ভিতরে দাও দাও করে আগুন জ্বলছে। পাতাকে নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে অরুণ দন্ডায়মান পুলিশের হাত থেকে লাঠি নিয়ে পাতার হাতে দিয়ে বলে,

-” নিজের জুতো কেন নোংরা করবেন এটা নিন? নিন বলছি? দয়া হচ্ছে নাকি?”

পাতা লাঠি ধরে রাখতে পারে না। পরে যায়। নিজেও টলতে থাকে। শক্তি হারিয়ে ফেলেছে যেন। পরে যেতে নিলে আতিকুর ইসলাম ধরে তাকে। পাতা বাবার বুকে চুপটি মেরে থাকে। দৃষ্টি অরুণের দিকে স্থির। লোকটা বেশ রেগে। মুখশ্রী লাল হয়ে আছে। ভয়ংকর লাগছে দেখতে। লুবমান তুলে নেয় লাঠিঠা। আতিকুর ইসলাম মানা করে ছেলেকে। লতা কোথা থেকে তেড়ে এসে লুবমানের থেকে লাঠি কেড়ে নিয়ে শুকলাকে এলোপাথাড়ি মারতে থাকে। শুকলা ব্যাথায় আর্তনাদ করতে থাকে। লুবমান, রাতুলের মুখের হাসি ফুটে ওঠে। অরুণ সরকার আরেকটা লাঠি নিয়ে সাথে যোগ দিল। শুকলার ছেলে করুণ চোখে চেয়ে। কিন্তু এগোনোর সাহস পায় না। হারুণ মুন্সি সুযোগ বুঝে কেটে পরে ফাঁক ফোকড় দিয়ে। অনেকেই সেটা দেখে হাসে। মজুমদার ফ্যাকাশে মুখে মেয়রের সাথে দাঁড়িয়ে দেখছে। সে মোটেও শুকলার চিন্তায় না। বরং আগে তার কি হবে সে চিন্তায়। শরীফ, আজম সহ এলাকার আরো দাপট দেখানো লোকজন চুপটি করে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের মুখেরও রঙ পাল্টে গেছে। তবে সাধারণ লোকজন বেশ খুশি মনেই সবটা ইনজয় করছে। ফ্রিতে এন্টারটেইনমেন্ট কেই বা মিস করতে চায়।
লাবনী আক্তার এসে লতাকে আটকায়। মরে টরে না যায় আবার।‌ স্বাধীন চৌধুরী রাসেলকে ইশারা করে অরুণকে থামাতে। রাসেল অরুণের হাত থেকে লাঠি কেড়ে নেয়। শুকলা মন্ডল রক্তাক্ত হয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে।শামিম এসে তাকে ধরে অরুণের উদ্দেশ্যে বলে,

-” কাজ টা ভালো করলেন না মোটেও? আর মজুমদার সাব আপনেও?”

মজুমদার কলার ঠিক করে। অরুণ তেড়ে আসতে নিলে রাসেল আটকায়। শামিমের উদ্দেশ্যে বলে,

-” হসপিটাল নিয়ে যাও! পরে কথা হবে!”

শরিফ আজম সহ কিছু লোক এসে ধরাধরি করে তাকে নিয়ে যায়। রাসেল অরুণের কাঁধে হাত রাখল। অরুণ ঘেমে নেয়ে একাকার।শার্ট গায়ে লেপ্টে। চশমাটা ভেঙে পায়ের তলায় গড়াগড়ি খাচ্ছে।

-” কুল ম্যান!”

অরুণ নিজেকে শান্ত করে। স্বাধীন চৌধুরী তার দিকে টিস্যু বাড়িয়ে হেসে বলে,

-” একদম বদলাস নি! শুধু ছেলের সামনে ভদ্রলোক সেজে থাকার নাটক!!”

অরুণ হেসে টিস্যু নিয়ে মুখ মুছে। ছেলেটা ঘুমিয়ে পড়েছে কি? নাকি তার অপেক্ষায়?
মেয়র স্বাধীন আতিকুর ইসলামের সামনে যায়।

-” হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছে। শাস্তি এখনো শেষ হয়নি। ওর বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে আপনি চিন্তা করবেন না!”

পাতা বাবার বুক থেকে মাথা তুলে সোজা হয়। আতিকুর হেসে বলে,

-” ধন্যবাদ আপনাদের। আপনারা না থাকলে কি যে হতো! দোষ না করেও মেয়েটা কাঠগড়ায় দাঁড়ালো! অন্যের কটুক্তি সহ্য করলো। ভবিষ্যতেও করতে হবে। কারণ ঘটনা এখানেই শেষ নয়। এই যে এলাকাবাসী দেখছেন এরা স্বচক্ষে দেখলো অপরাধী কে! তবুও পিঠ পিছে সমালোচনা করে বেড়াবে ‘মেয়েটা খারাপ। ভালো না। বাজে কাজ করে বেড়ায়’ এটাই মানুষের স্বভাব। এখন এদের মুখ তো বন্ধ করতে পারবো না। তবে আমি ওই শুকলা মন্ডলের শাস্তি চাই! কঠোর শাস্তি!”

মেয়র তার কাঁধে হাত রেখে স্বান্তনা দেয়। কথাগুলো মিথ্যে নয়। দুঃখজনক বাস্তবতা। এখন মানুষের ধারণা তো বদলাতে পারবে না। অরুণ কথা গুলো মনোযোগ সহকারে কর্ণপাত করে। কথাগুলো চরম বাস্তব। সমাজে একজন বিয়ের বয়সী কন্যার নামে কোনো কিছু রটে গেলে সেটা খুবই বাজে ভাবে এফেক্ট করে তার জীবনে। সে অল্প সময়ে অনেক কিছুই ভেবে নেয়। নিজেকে পড়ে নেয়। মনকে প্রশ্ন করে, সাথে সাথে উত্তরও পেয়ে যায়। অরুণ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ছেলের আদুরে মুখ খানি স্মরণ করে আতিকুর ইসলামের সামনে দাঁড়িয়ে সিনা টান টান করে কথা পাড়ে।

-” আঙ্কেল? আমার কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে শুনবেন। আন্টি,মিস পাতাবাহার, রাতুল সবাই! আমার আর মিস পাতাবাহারকে জড়িয়ে যে কথাগুলো উঠেছে সব মনগড়া কাল্পনিক কাহিনী। মিস পাতাবাহার আমার বাচ্চার টিচার।দ্যাটস ইট! আঙ্কেল আপনার কথাগুলো হান্ড্রেড পার্সেন্ট সত্য। আমাদের সমাজে নিন্দুকের অভাব নেই। তারা এসব কল্পকাহিনীকে আরো মসলা মাখিয়ে রোস্ট করবে। এতে পাতাবাহারের লাইফে বাজে এফেক্ট পড়বে। আমি ব্যবসায়ী মানুষ। আমার নামেও বলবে অনেক কথা। কিন্তু আমার বেলা বলাই শেষ। আমার কিচ্ছুটি করতে পারবে না। কারণ আমার নাম, জস, টাকা, পাওয়ার। সব চেয়ে বড় কথা আমি ছেলেমানুষ।এটা দূর্ভাগ্যবশত সত্যকথা!
কিন্তু মিস পাতাবাহার?”

পিন পিন নিরবতা। পাতা স্থির দৃষ্টিতে অরুণের দিকে তাকিয়ে। তার বুকটা ধ্বক ধ্বক করছে।অরুণের কথা গুলো কানে বাজছে। অরুণের দৃষ্টি আতিকুর ইসলামের দিকে স্থির। সে পুনরায় বলতে শুরু করে,

-” দেখুন আমি সরাসরি কথা বলতে পছন্দ করি। আমি ভেবেচিন্তে আপনার কাছে বিয়ের প্রস্তাব রাখছি আমি মিস পাতাবাহারকে মিসেস পাতাবাহার বানাতে চাই! আপনি বলবেন এমনটা হলে লোকে কথা বলার সুযোগ পেয়ে যাবে! হ্যা পাবে, কিন্তু লোকে এমনটা না হলেও কথা বলা বাদ দেবে না। তবে হ্যা অরুণ সরকারের স্ত্রীর ব্যাপারে কথা বলতে লোকে একশবার ভাববে!”

পাতার চক্ষুদ্বয় কোটর থেকে বেরিয়ে আসার উপক্রম। এই লোকের মাথা টাথা গেছে নাকি!! আতিকুর ইসলায় সহ বাকি সকলেরও সেম অবস্থা। মেয়র সাহেব অবাক হন। তবে পরিস্থিতি বিবেচনা করে অরুণের গার্ডিয়ান হিসেবে আতিকুর ইসলামের হাত ধরে একপ্রকার অনুরোধের সুরেই বলে,

-” দেখুন ভাই? আমার ছেলে লাখে একটা। আপনারা চেনেনই নিশ্চয়ই। আমার বোনটা ওকে ছোট রেখেই গত হয়েছে। ওর বাপটাও বেঁচে নেই। আমি অভিভাবক হয়ে আপনার মেয়ের হাত চাইছি! খুব আদর যত্ন করে রাখবে দেখবেন! ভালোবাসার কাঙাল ও! ভালোবাসতে জানে খুব করে। ভাই?”

আতিকুর ইসলাম বিপাকে পড়ে যান। কি বলবেন? একজন সম্মনীয় মেয়র হাত ধরে অনুরোধ করছে? একছেলের বাবার সাথে কি করে অবিবাহিত মেয়ের বিয়ে দিবেন? তার সাথে বয়সের পার্থক্যও তো অনেক। প্রায় এক যুগের মতো! সে পাতার দিকে চায়। পাতা বেশ অস্বস্তিতে পড়ে এবার। বাবা কি রাজি হবে? সে বোনের দিকে চায়। লতা বোনের চাহনি দেখে আর চুপ থাকে না। এগিয়ে এসে বলে,

-” আঙ্কেল আমার কথায় কিছু মনে করবেন না। অরুণ ভাইয়াকে আমি চিনি। তিনি নিঃসন্দেহে একজন ভালো মানুষ। একজন সুপাত্র। আমার বোনটা নরম মনের। বাবা রাজি হলে তার উপর কথা বলবে না। তবে আমি রাজি না। স্যরি বাট অরুণ ভাইয়া একজন ডিভোর্সি সাথে একটা ছেলের বাবা। তাছাড়া বোনের থেকে বয়সেও অনেকটা বড়। আমার বোনটা ছোট থেকে অনেক সহ্য করেছে। ছোট্ট জীবনে শুধু মানিয়েই গেছে। আমি চাই না ভবিষ্যতেও এমন হোক! আপনারা আজ অনেক করেছেন আমাদের জন্য তার জন্য আন্তরিক ধন্যবাদ।”

স্বাধীন চৌধুরী ভাগ্নের পানে চায়। গম্ভীর মুখশ্রীতে আতিকুর ইসলামের পানে চেয়ে। সেও চায়। আতিকুর ইসলামের হাত এখনো তার মুঠোয়। অরুণ পকেটে হাত গুজে গম্ভীর মুখে একনজর পাতার দিকে চায় যে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে। সে কাঁধ উঁচিয়ে বলে,

-” আমি প্রস্তাব রেখেছি। এখন বাকিটা আপনাদের ব্যাপার। মামা চলো?”

স্বাধীন চৌধুরী মাথা নাড়ে। মজুমদার সহ বাকি গ্রামবাসীর মধ্যে বিরাট কৌতুহল। জন সাধারণের মাঝে তো গুসুর ফুসুর চলছে। এতো ভালো প্রস্তাব কেন নাকচ করল? হ্যান ত্যান! রাসেল এখনো শকে আছে। ডিভোর্সের পর যে বন্ধু পুনরায় বিয়ের কথা উঠলে চেতে উঠতো! আজ হঠাৎ কি হলো? এই হাঁটুর বয়সী মেয়েকে বিয়ের প্রস্তাব দিলো! আবার রিজেক্টও হলো! আহ তার বন্ধুর জন্য বেজায় কষ্ট হচ্ছে। লাবনী আক্তার এগিয়ে এসে স্বামীর কাছে নিচু গলায় ফিসফিসিয়ে বলে,

-” ভেবে দেখুন একবার। প্রস্তাবটা মন্দ নয়। এমনিতেই এই ঘটনার পরে মনে হয় না পাতার জন্য ভালো প্রস্তাব আসবে!”

খুবই ধীর গলায় বলেছে লাবনী আক্তার। যেন শুধু আতিকুর ইসলামের কানেই যায়। তবে আতিকুর ইসলামের পাশে নিচু হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা পাতা সোজা হয়। কথাটা তার কানেও পৌঁছেছে। তার বুকটা যেন চৌচির হয়ে গেছে।সে আতিকুর রহমানের উত্তরের আশায়। আতিকুর ইসলাম গম্ভীর মুখে স্ত্রীর কথায় জবাব দিলো,

-“ওর লাইফ ওর ডিসিশন। আমি দায়িত্ব পালনে কখনো পিছপা হবো না।”

পাতা শ্রবণ ইন্দ্রিয়ে ‘দায়িত্ব’ কথাটা ঘুরপাক খায়। তার চোখ ভরে ওঠে। সে পলক ঝাপটিয়ে লুকানোর চেষ্টায়। একটু আগেও বাবার আচরণে বুক ফুলে উঠলেও এখন ভারী হয়ে উঠেছে। পিছন ফিরে লোকের ভিড়ে অরুণ সরকারকে খোঁজে। সবাই রাস্তার দিকে অগ্রসর হচ্ছে। লম্বাচওড়া অরুণ সরকারকে সকলের ভিড়ে খুঁজে পেতে কষ্ট হয় না। সে আশে পাশে চায়। সবাই যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। কেউ কেউ চলেও গেছে। মজুমদার সহ কিছু মুরুব্বি এখনো দাঁড়িয়ে। সেও বৈঠক থেকে বেরিয়ে গলা পরিষ্কার করে ডাক দেয়,

-” মি. অরুণ সরকার?”

তার ডাকে অনেকেই তার দিকে তাকিয়ে। আতিকুর ইসলাম,লাবনী ,লতা, রাতুল , লুবমান পাতার পাশে এগিয়ে আসে চিন্তিত মুখে। তবে কাঙ্ক্ষিত ব্যাক্তির কর্ণগহ্বরে পৌঁছায় নি সেই ডাক। সে তো মামা ও বন্ধুর সাথে পা মিলিয়ে রাস্তায় উঠে কথা বলছে টুকিটাকি বিষয়ে। পাতা তার ব্যাকসাইড দেখতে পায় শুধু। সে আবারও গলা উঁচিয়ে ডাক দেয়,

-” মি. অরুণ সরকার? এই নাক উঁচু ম্যানারলেস লোক?”

রাতুল স্বাধীন চৌধুরীকে এলাকার লোকের বিভিন্ন কার্যক্রমের কথা বলছিল সংক্ষেপে। অরুণ নীরব স্রোতা। তবে হঠাৎ কিছু শ্রুতিমধুর কন্ঠে ভর্ৎসনা কানে বাজায় ভ্রু যুগল কুঁচকে পিছে মোড়ে। পাতাকে দেখে রাসেল ও মামার উদ্দেশ্যে বলে,

-” আমি আসছি তোমরা কথো বলো!”

বলে এগিয়ে আসে। পাতার সন্নিকটে দাঁড়িয়ে দুহাত বুকে গুঁজে প্রশ্নবিদ্ধ চাহনি নিক্ষেপ করে। পাতা নাক টানে। এক বুক সাহস নিয়ে অরুনের চোখে চোখ রাখে ঘার উঁচিয়ে। আর বিনা দ্বিধায় বিনা সংকোচে প্রশ্ন করে,

-” আপনি প্রস্তাব টা ভেবে চিন্তে দিয়েছেন? মন থেকে বলবেন!”

অরুণ পাতার চোখে চায়। আঁখি জোড়া টলমল করছে। শ্বেত জলে ভাসমান কালো কর্ণিয়া যেন কিছু খোঁজার প্রচেষ্টায়।

-” জি!”

পাতা বৃদ্ধাঙ্গুল দ্বারা আঁখি জোড়ার নোনাজল মুছে। পুনরায় নাক টানে। ঠোঁটে হাসি ফুটে ওঠে। সে আত্নবিশ্বাসের সাথে স্পষ্ট সুরে আওড়ায়,

-” আমি আপনার প্রস্তাব মেনে নিচ্ছি।”

লাবনী আক্তারের মুখশ্রী উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। আতিকুর ইসলাম শান্ত চোখে পাতার দিকে চায়। লতা এগিয়ে এসে পাতার বাহু ধরে বলে,

-” পাগল হয়ে গেছিস?”

পাতা মাথা নাড়ে। না হয় নি সে পাগল! সে তো শুধু দায়িত্ব হতে নিস্তার পেতে চায়‌। চায় না কারো দায়িত্ব হয়ে থাকতে। অরুণ শান্ত চোখে পাতার দিকে চেয়ে।পাতা অরুণের চোখ থেকে চোখ সরায় না। অরুণ দৃষ্টি স্থির রেখে বলে,

-” আপনি ভেবেচিন্তে বলছেন তো? পরে পস্তাবেন না?”

-” না। আমি পাতা স্বজ্ঞানে ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত জানাচ্ছি!”

অরুণের অধরকোনে ক্ষীণ হাসির ঝিলিক দেখা যায়। সে পাতার দিকে তাকিয়েই গলা উঁচিয়ে স্বাধীন চৌধুরীর উদ্দেশ্যে বলে,

-” মামা কাজি মৌলভি যেটা পাও হাজির করো। এক্ষুনি মানে এক্ষুনি। এই মুহূর্তে বিয়ে হবে। আপনার কোনো সমস্যা?”

শেষের কথাটা পাতাকে জিজ্ঞেস করে। পাতা না করে সমস্যা নেই। বরং সে যতো তাড়াতাড়ি দায়িত্ব নামক সম্পর্ক থেকে মুক্তি পাবে তত তাড়াতাড়ি স্বস্তিদায়ক শ্বাস টানতে পারবে। কারো দায়িত্ব নামক বোঝা নামিয়ে নিজ ঠিকানায় চলে যাবে। অরুণ দেড়ি করতে চায় না। বলা তো যায় না কখন না করে দেয়! আর একবার যেহেতু রাজি হয়েছে আর কোনো কথাই শুনবে না।

আতিকুর ইসলাম,লতা, রাতুল, লুবমান সহ এলাকাবাসী সব নীরব দর্শক। স্বাধীন চৌধুরী হেসে এগিয়ে আসেন , সাথে রাসেল। রাসেল এসেই বন্ধুর কাঁধ জড়িয়ে কানে কানে কিছু বলে। অরুণ তাকে ইশারায় শান্ত করে। স্বাধীন চৌধুরী মজুমদারের কাছে যায় মৌলভি বা কাজির খোঁজে। শমসের মজুমদার এলাকার ইমাম সাহেবকে ডাকে। সাথে অনুরোধ করে,

-” স্যার? বিয়েটা আমার বাড়িতে গিয়ে পড়াবেন? স্যার প্লিজ? আমি নিজেকে ধন্য মনে করবো! আর ওদের থেকে ক্ষমাও চাইছি!”

অরুণ না করে দেয় সরাসরি। এই বৈঠকেই পড়ানো হবে বিয়ে। মৌলভি সাহেব বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন। তাই দেড়ি হয় না। ওযু সেরে এসে সব কার্যক্রম শুরু করে।

মেঘাচ্ছন্ন চাঁদনী রাতে পবিত্র বন্ধনে আবদ্ধ হয় পাতা ও অরুণ। উপর ওয়ালাকে সাক্ষী রেখে তিন কবুল বলে একে অপরের সাথে জুড়ে যায় এক পলকে। একে অপরের অর্ধাঙ্গ হয়ে কালেমা পাঠ করে দুজনে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয় একে অপরের ঢাল হয়ে থাকার। পাতা পুরোটা সময় নিশ্চুপ ছিল। কবুল বলার সময়ও তার কন্ঠ কম্পিত হয় নি। সে অরুনের দিকে একপল চেয়ে বিনা দ্বিধায় তার জীবনে অরুণ সরকারকে স্বাগতম করেছে।

অরুণ সরকারও চুপচাপ ছিল। কবুল বলার আগ মুহূর্তে তার প্রাক্তন স্ত্রী বর্ষার কথা স্মরণে আসে। এভাবে পূর্বেও একজনকে কবুল বলে নিজের সাথে জড়িয়ে ছিল। সে সম্পর্ক ছিন্ন করে চলে গিয়েছে। সে চোখ বুজে ছেলের কথা স্মরণ করে। একবার বলেছিল ‘আব্বু মিস পাতা আমার আম্মু হলে খুব ভালো হবে তাই না?’ সে কবুল বলতে আর সময় নেয় না।
পাতার প্রতি ভালোবাসা নেই হয়তোবা। কিন্তু সে সর্বোচ্চ চেষ্টা করবে তাকে ভালোবাসার চাদড়ে মুড়িয়ে নেয়ার। তবে তার শুধু একটাই কামনা তার কলিজাটাকে যেন আগলে নেয়।

চলবে…..

#পাতা_বাহার
লেখনীতে: #বেলা_শেখ
#পর্ব- ২০
(কপি করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ)

জোৎস্না রাতে মেঘাচ্ছন্ন আকাশ। চাঁদের ম্লান আলো পুরোপুরি ছড়াতে না পারলেও ঘনঘটা অন্ধকার দূর করেছে। কালো মেঘলা আকাশ চাঁদের আলোয় মৃদু আলোকিত। দেখা নেই তারকারাজির। ধরনীতে মৃদু এলোমেলো হাওয়া। রাস্তার দু’পাশে ধানক্ষেতে শূন্যতায় ভরপুর। ধান নেই তাতে। মাটি ঘেঁষে সবুজ ঘাসের সমাহার তাতে হাঁটুর নিচ অবধি বৃষ্টির পানি জমে। আবাদি জমির শেষ সীমান্তে বসতি গড়ে উঠেছে। সেখানে থেকে আলো এসে পড়েছে জমিতে। এছাড়াও জমিতে আলো নিয়ে অনেকেই মাছ ধরতে নেমেছে। পানির ভিতরে থাকা সোনা ব্যাঙ গুলো ডাকছে অনবরত! ফাঁকা পিচঢালা রাস্তার হাত ধরে হাঁটছে দুই বন্ধু। অরুণ ও রাসেল। পিছনে ড্রাইভার হেড লাইট বন্ধ করে গাড়ি চালিয়ে আসছে খুবই ধীর গতিতে। রাস্তার দু ধারে বিভিন্ন গাছের সারি। বিভিন্ন আগাছাও জড়িয়ে আছে। সেখানে দুই তিনটি জোনাকি পোকা উড়ছে। অরুণ একটা ধরে এনে হাতের মুঠোয় পুরে। ভিতরে জ্বল জ্বল করে জ্বলছে জোনাক পোকা! হাতের আঙ্গুলের ফাঁকা স্থান দিয়ে সেই আলো বিচ্ছুরিত হচ্ছে। অরুণ হেসে বলে,

-” ভোর এটা দেখলে অনেক খুশি হতো!”

রাসেল বন্ধুর দিকে অন্ধকারে চোখ ছোট ছোট করে চায়। খুব হাসছে এই বেডা!

-” বাহ বিয়ে করে দেখছি অরুর মুখ থেকে হাসিই সরছে না। মনে লাড্ডু ফুটছে তাই না?”

অরুণ হাসিমাখা মুখ বিরক্তিকর চাহনিতে পরিণত হয়।

-” হ্যা‌ সরছে না। লাড্ডুও ফুটছে। তোর কোনো সমস্যা রাসেলস ভাইপার?”

রাসেল সাপের মতোই ফুঁসে উঠে।

-” খবরদার ওই নামে ডাকবি না। আমি মেজর রাসেল রানা তোকে বৃষ্টির জলে চুবিয়ে মারবো!’

-” তুই কেন অরু ডাকিস শালা?”

রাসেল হো হো করে হেসে উঠে। অরুণে কপোল জোড়া টেনে বলে,

-” ও কিউটি পাই! অরু ইজ আ সুইট নেম!”

-” রাসেল ভাইপার ওলসো আ সুইট নেম! এই এই রাসেল দেখ ওই ওইটা কি সাপের মতো দেখা যাচ্ছে!”

অরুণ জঙ্গলের দিকে আঙুল তুলে ইশারা করে খানিক সতর্কতার সুরে বলে। এমনিতে বর্ষাকাল। চারদিকে পানি থৈ থৈ করছে। সাপ বের হওয়া সিমপেল ব্যাপার। রাসেল অরুণকে জাপটে ধরে ‘সাপ সাপ’ বলে চিল্লাতে থাকে। সে সাপে খুব ভয় পায় কি না। অরুণ চুপ হয়ে যায়। রাসেলের চিল্লানো থেমে যায়। ফিসফিসিয়ে ধীরে খানিক ভিতু গলায় বলে,

-” এই অরু অরু? মটকা মেরে গেলি কেন? কোথায় সাপ?”

অরুণ গম্ভীর মুখে বলে,

-” আমাকে জাপটে ধরে আছে। রাসেলস ভাইপার। তাইতো শান্ত হয়ে আছি!”

রাসেল চোখ বুজে নেয়। বুঝতে অসুবিধা হয় না শালা মজা করছে। এই যবে থেকে রাসেলস ভাইপার সাপ ভাইরাল হয়েছে সাথে তার নামটারো পিন্ডি চটকে গেছে। ইয়ার শালার ছেলে মেয়েরাও আজকাল আব্বু বলে ডাকে না! রাসেলস ভাইপার বলে ডেকে হাসিতে ফেটে পড়ে! ইয়া আল্লাহ তুমি সহায় হও। সে অরুণকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে বলে,

-” শালা তুই জীবনেও ভালো হবি না। তোর ফোন পেয়ে আসাও ভুল হয়েছে।মিরজাফর!”

অরুণ তার মাথায় চাটি মেরে হাঁটা শুরু দেয়। রাসেল সেথায় দাঁড়িয়ে থেকে অরুণের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে কিছু পল। তারপর দৌড়ে বন্ধুর কাঁধ জড়িয়ে বলে,

-” এই অরুণ সিরিয়াসলি বলতো এই বিয়ের চক্কর টা কি? হ্যা শুভ বললো বিয়ের জন্য রাজি হয়েছিস! তাই বলে এভাবে? মেয়েটা বয়সেও ছোট! অবিবাহিত। ভোরকে মেনে নেবে তো?”

অরুণও এক হাত পিছনে দিয়ে বন্ধুকে আকড়ে ধরে। দুজন গলাগাটি ধরে হাঁটতে থাকো পথ ধরে।

-” আমি ভেবেচিন্তেই এগিয়েছি। পাতা মেয়েটা কাইন্ড হার্টেট। সি উইল নেভার হার্টস মায় চাইল্ড। সে ভালোবাসবে আমার কলিজাটাকে।”

-” আর সেটা কিভাবে বুঝলি?”

অরুণ হাসে।

-” কিভাবে? দেখ জীবনের সাইত্রিশটা বছর পার করে এসেছি। এখনো মানুষ চিনতে ভুল করবো? মানুষের ধোঁকা ছলচাতুরীতে পা দিয়ে দিয়ে এখন শিখে গেছি মানুষ চেনা।”

রাসেল অধরকোনে হাসি ফুটে ওঠে। সে বন্ধুর পিঠ চাপড়ে বলে,

-” তো বর বাবু বলো? বুড়ো বয়সে কচি বউ পেয়ে ফিলিংস কেমন?”

অরুণ বন্ধুর পেটে গুতো মারে। রাসেল পেট ধরে। মুখ দিয়ে বের হয় ব্যথাতুর ধ্বনি।

-” শা*লা! মারলি ক্যান?”

অরুণ গম্ভীর গলায় বলে,

-” রেসপেক্ট হার! সি ইজ নাও মিসেস অরুণ সরকার!”

রাসেল ব্যাথা ভুলে যায়।

-” ও হো হো হো! মিসেস অরুণ সরকার! এই শালা সত্যি করে বলতো? ঘটনা কি ? আগে থেকেই লাড্ডু ছিলিস নাতো?”

অরুণ তার কথার উত্তর দেয় না। হাঁটতে হাঁটতে বলে,

-” আর হ্যা! আমি ওতটাও বুড়িয়ে যায় নি। স্টিল গার্লস ক্রাশড অন মি।”

রাসেল তার সাথে পা মিলিয়ে অরুণের কানের পিঠের চুল টেনে বলে,

-” কচি খোকা তুই!! বা*ল পেকে সাদা হয়ে গেছে। ছেলে বিয়ে দিতে হবে ক’দিন পর! গার্লস ক্রাশড অন মি!!”

শেষের কথাটা ভেঙ্গিয়ে বলে। অরুণ চুলে হাত চালিয়ে খানিকটা হাসে। রাসেল হঠাৎ অরুণের সামনে দাঁড়িয়ে দু হাত বাড়িয়ে থামায়। অরুণ ভ্রু কুঁচকে চায়। রাসেল হেসে ফিসফিসিয়ে বলে,

-” এই বিয়ে করলি অথচ বাসর না করে বউ শশুরবাড়ি রেখে আসলি! কাজটা কি ঠিক হলো?”

অরুণ লম্বায় রাসেলের থেকে দু ইঞ্চি ছোট। সে বন্ধুর ঘারে হাত গলিয়ে বলে,

-” একদম না। তবে রেখে আসতে হলো! অরুণ সরকারের বউকে এই রাতের অন্ধকারে লুকিয়ে চুরিয়ে ঘরে তুলবো নাকি? ধুমধামের সাথে ঘরে তুলবো। সাথে বাসরটাও সেরে নেবো!”

রাসেল মেয়েদের মতো ভেংচি কেটে ভঙ্গিমা করে বলে,

-” আমি কি বুঝিনা! তুই শালা মুখিয়ে ছিলি। যে কেউ বলুক অরুণ সরকার তুমি আজ রাতটা থেকে যাও? তুই সাথে সাথে পাতাকে নিয়ে ঘরে খিল দিতি! তোকে আমি চিনি না ভেবেছিস? শালা পিপাসায় কাতার রসিক ভোঁমড়া! ফুলের মধু খাওয়ার জন্য পাগল পাড়া!”

অরুণ ছেড়ে দেয় তাকে। গাড়ির দিকে যেতে যেতে বলে,

-” আমার কলিজা অপেক্ষা করছে আমার জন্য। তোর ফালতু কথা শোনার সময় মুড কোনোটাই নেই। তুই রাসেলস ভাইপার আপন প্রজাতির সাথে দেখা সাক্ষাৎ কর! পিছনেই ওৎ পেতে আছে!”

রাসেল চোখ বড় বড় করে দৌড় লাগায়।

-” শালা তোর বাসর ঘরে মনষা না এসে রাসেল ভাইপার আক্রমণ করবে। আমি নিজে সাপের লিডারের সাথে ডিল ফাইনাল করবো!”

__________

এক বৃষ্টিস্নাত ভোর। শেষ রাতের বেলায় বেশ সময় নিয়ে ভারি বর্ষণ বর্ষিত হয়েছে ধরনীতে। গর্ত ডোবা পানিতে টইটুম্বর। একে বারে কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে গেছে যেন। এখনো ঝিরিঝিরি বারিধারা বহমান। পাতা নিজের ঘরে বসে কাপড়চোপড় ব্যাগে ভরছে। বিছানা ঘেঁষে জানালা খোলা।সেখান থেকে আগত হালকা বাতাস রুমটা শীতল করে রেখেছে। জানালার পানে দেখা মিলে পানিতে ভরা জমি। যেন কোনো শান্ত তটিনী। যার বুকে আছড়ে পড়ছে শিশির কনা। অন্যসময় হলে পাতা জানালায় মাথা ঠেকিয়ে এমন সৌন্দর্য ঘেরা দৃশ্য অনুভব করতো। কিন্তু আজকের ব্যাপারটা ভিন্ন। সে ব্যাগ গোছাতে খুবই মনোযোগী। সে গুনগুন করতে করতে কাপড় সহ প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ভড়তে থাকে। এমন সময় লতা গম্ভীর মুখে ভেতরে প্রবেশ করে মেয়েকে কোলে নিয়ে, পিছনে লাবিব। পাতাকে গোছগাছ করতে দেখে বলে,

-” জামাইয়ের বাড়িতে যাওয়ার খুব তাড়া দেখছি! একেবারে কাপড়চোপড় গুছিয়ে রেডি!”

পাতা বোনের পানে চায়‌। লতাপু রাত থেকেই বেশ গম্ভীর। সে নারাজ আছে তার উপর অরুণ সরকারকে বিয়ে করার জন্য। পাতা হেসে বলে,

-” বাহ রে! নিজের বাড়ি দেখার জন্য এক্সাইটেড হবো না!”

লতা কটমট করে চায়।

-” মনে রাখিস! সেটা তোর নিজের বাড়ি না। শশুর বাড়ি! আর সংসার! সেটার ভাগ তো আগেই হয়ে গেছে। তোর স্বামীটাই একসময় অন্যকারো ছিল! অথচ তুই একান্ত নিজ মানুষের স্বপ্ন দেখছিলি।”

পাতার হাস্যোজ্জ্বল মুখ মলিন হয়ে আসে। তবুও ঠোঁটে হাসি ঝুলিয়ে বলে,

-” ওটা পাতার জামাই বাড়ি নট শশুড় বাড়ি!আর তুমিই তো বললে ছিলো! এখন তো নেই। এখন সে একান্তই আমার বনে গেছে। আর পাতা অনেক সহ্য করেছে‌। দেখ ইনশাআল্লাহ আর করবে না। যা পাতার তা পাতারই। এক আনাও অন্য কারো নয়।”

-” আর অন্যের ছেলেকে পালবি? সৎ মা হয়ে থাকতে পারবি সারাজীবন?”

পাতা বোনের দিকে চায়।

-” আপু অন্যের না। যেই মুহুর্ত থেকে লোকটা আমার হয়েছে সেই মুহূর্ত থেকেই তার সকল কিছুই আমার। অন্যের ছেলে নয় সে আমার ছেলে। আর মা সৎ হয় না। মা তো মা’ ই। দেখো না, তোমার খালাকে সবাই বলে পাতার পালিত মা। কিন্তু আমার কাছে তা না। আম্মুর মতো সেও আমার মা। আমি তাকে মায়ের মতোই ভালোবাসি। আমার ছেলেও আমাকে ভালোবাসবে। আমিও বাসবো।”

লতা রাগে গজরাতে গজরাতে বেড়িয়ে যায় মেয়েকে বিছানায় বসিয়ে রেখে। পাতা শুনতে পায় লতা চিল্লিয়ে বলছে,

-” এসেছে জনদরদী! আপডেট যুগের শাবানা! ইশ যন্ত্রণায় আমার মাথা ফেটে গেল!”

লাবিব পাতার দিকে জহুরি নজরে চেয়ে থাকে কিছুক্ষণ।পাতা ওড়না ভাঁজ করতে করতে ভ্রু নাচিয়ে বলে,

-” কি বোনের ছেলে? ওভাবে কি দেখো?”

লাবিব বড়দের মতো ভাব নিয়ে দু হাত পিছনে রেখে বলে,

-” মায়ের বোন? তুমি এখন ওই বুড়ো লোকটার বাড়ি যাবে?”

পাতা চোখ রাঙিয়ে আঙ্গুল তুলে শাসিয়ে বলে,

-” বুড়ো কাকে বলছো? খালুজান হয় তোমার! সম্মান দিয়ে কথা বলো! পাতার জামাইকে নিয়ে কোনো ঠাট্টা চলবে না। রেসপেক্ট হিম!”
________

সরকার বাড়ির পরিবেশ রমরমা সাথে বেশ গরম। গতরাতের ভারি বর্ষণ বাইরে চলমান বারিধারার সাথে শীতল বাতাস কিছুই যেন পরিবেশ ঠান্ডা করতে পারছে না। অরুণ ছেলের শিয়রে বসে। ভোর কম্ফোর্ট জরিয়ে শুয়ে চিল্লিয়ে কাঁদছে। অরুণ করুণ চোখে ছেলের দিকে চেয়ে। তাকে ধরতেই দিচ্ছে না। ছুলেই গলা ফাটিয়ে কাঁদে। এদিকে গায়ে ভিষণ জ্বর।‌ গতরাত বাড়ি ফিরে দেখে ছেলে ঘুমোচ্ছে পাশে আদুরি জলপট্টি দিচ্ছে। সে অস্থির হয়ে পড়েছিল। আদুরি সান্ত্বনা দিয়ে বলে,

-” বড়ভাই সিরিয়াস কিছু না। অল্প জ্বর। ওষুধ খাইয়ে দিয়েছি। কয়েকবার জলপট্টি দিলাম। ঠিক হয়ে যাবে।টেনশনের কিছু নেই। তুমি বসো আমি খাবার আনছি তোমার জন্য।তখন না খেয়েই বেরোলে!”

সে মানা করে দেয়। তার কলিজা জ্বরে পুড়ছে আর সে খাবে? খাবার গলা দিয়ে নামবে!! সে ছেলেকে বুকে জড়িয়ে জলপট্টি দিয়েছে। অল্পসময়ের মধ্যেই জ্বর কমে আসলে তবেই দু’চোখ জুড়ে ঘুম নামে।
ভোরের দিকেও ভোরের জ্বর ছিল না। সে মর্নিং ওয়াক থেকে এসে দেখে গা গরম অল্প। নাস্তা ওষুধ নিয়ে আসে তুলে খাইয়ে দিবে। ওঠে ভালো ছেলে হয়ে। কিছু কিছু সময় পিটপিট করে চেয়ে তাকে দূরে সরিয়ে কান্না জুড়ে দেয়। তাকে ধরতেই দেবে না। ধরলেই কান্নার গতি বেড়ে যায়। অরুণ দীর্ঘশ্বাস ফেলে ছেলের গা থেকে কম্ফোর্ট সরিয়ে বুকে টেনে নেয়। ভোর আরো জোরে চিল্লাতে থাকে। হাত পা ছুঁড়তে থাকে।অরুতের বেড়ে যাওয়া দাঁড়ি ধরে টান মারে। বুকে কিল ঘুষি মারতে থাকে। অরুণ ছাড়ে না। বেশকয়েকটি চুমু খায়। ভোর অরুণের গালে দাঁত বসায় জোরে। ছাড়ে না। ব্যাথায় অরুণের চোখে পানি চলে আসে তবুও ছাড়ে না। ভোর মুখে নোনতা স্বাদ পেলে তবেই ছেড়ে দিয়ে বিছানায় শুইয়ে কম্ফোর্টে মুখ লুকিয়ে কাঁদতে থাকে। বাড়ির সবাই উপস্থিত হয় অরুণের রুমে। ভোরকে ডাকে আদর করে শোনে না। কাছেই ঘেঁষতে দেয় না। না মিনু না আভারি! কাউকেই না। সকলে অরুণের গালে রক্ত ঝরতে দেখে ঘাবড়ে যায়। স্যাভলন তুলা দিয়ে আরিয়ান রক্ত পরিষ্কার করে। অরুণ প্রতিক্রিয়াহীন।ছেলেটার কি‌ হলো? এমন করছে কেন? সে উঠে দাঁড়ায়। ব্যস্ত ভঙ্গিতে পায়চারি করতে করতে ফোন বের করে। আরিয়ান বিরক্ত হয়ে বলে,

-” ভাই? তুই পাগল হয়ে গেলি নাকি। ক্ষতস্থান পরিষ্কার করতে দে না?”

অরুণ তোয়াক্কা করে না। কল করে কানে ঠেকিয়ে রাখে। একটু পর রিসিভ হলে অরুণ উদ্বিগ্ন স্বরে বলে,

-” মিস পাতাবাহার?”

পাতা ফোন রিসিভ করে লাউডে দিয়ে বিছানায় রাখে। পাশে লাবিব টুম্পা বসে খেলছে। ব্যাগের চেন আটকাতে আটকাতে জবাব দেয়,

-” বলে ফেলুন!”

অরুণ নিজেকে শান্ত করে শান্ত ভাবেই বলে,

-” ছেলেটা ঘুম থেকে উঠেই কাঁদছে। থামছেই না। কেন কাঁদছে সেটাও বলছে না। আমাকে কাছেই ঘেঁষতে দিচ্ছে না। গেলেই গলা ফাটিয়ে কাঁদে। গায়ে অনেক জ্বর। ওর কি হয়েছে বলুনতো?”

পাতার কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ে। এমন করে কাঁদছে কেন? হঠাৎ মনে পড়ে বাপ বেটার মধ্যে মান অভিমান চলছে। গাড়িতেও তো একে অপরের সাথে কথা বলছিল না।

-” আপনি কালকে ওই আইসক্রিম পার্লারের ইন্সিডেন্সের পর ছেলেটার সাথে কথা বলেছিলেন?”

অরুণ ছেলের দিকে তাকিয়ে গাল ফুলায়।

-” নাহ!”

পাতা ব্যস্ত ভঙ্গিতে কাজ করতে করতে বলে,

-” তাহলে আগে ছেলের সাথে কথা বলুন। সব ঠিক হয়ে যাবে।”

-” ওকে রাখছি!”

-” শুনুন ভোরের বাবা?”

অরুণ চোখ তুলে চায়। কি সুন্দর সম্বোধন! তার কানটা যেন জুড়িয়ে গেল।

-” জি বলুন?”

পাতা ইতস্তত করে খানিকটা। ফোন নরমাল করে কানে তুলে বাচ্চাদের থেকে একটু দূরে গিয়ে দাঁড়ায়।

-” আমি প্রিয় দের বাড়িতে যাবো কিছুদিনের জন্য। ভাবলাম আপনাকে জানিয়ে দিই!”

অরুণের ভ্রু কুঁচকে যায়। সে কোন প্রিয় টিয় কে চেনে না। তবে প্রশ্ন করে না। আগে ছেলেকে ঠিক করে নিক।

-” আচ্ছা। যান! আমি কল করবো! সাবধানে যাবেন”

পাতা ফোনটা বুকের মধ্যখানে চেপে ধরে। ‘সাবধানে যাবেন’ কথাটাতে তার মনটা ভালো হয়ে যায়। লোকটার সাথে আগেও কথা বলেছে। তবে সেটা স্টুডেন্টের গার্ডিয়ান হিসেবে। কিন্তু আজকের কথা বলাটা আলাদা।

অরুণ ফোন রেখে ছেলের কাছে যায়। কম্ফোর্ট সরিয়ে ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে ডাকে,

-” আব্বু? কলিজা? মানিক আমার?”

এবার আর ভোর সরিয়ে দেয় না। তবে কান্না থামায় নি। অরুণ বুঝতে পারে ওষুধে কাজ হচ্ছে। সে ছেলেকে আস্তে ধীরে তুলে যে গালে কাল মেরেছিল সেখানে চুমুতে ভরিয়ে দিল। আবেগ জড়িয়ে ডাকে,

-” আব্বু কলিজাটা! অনেক অনেক স্যরি। আমার সোনাটাকে মেরে আমি অনেক ভুল করেছি। আর হবে না কলিজা। আর রাগ করে থেকো না। আমার সব অভিমান ভেঙে গেছে। তোমার টাও ভাঙিয়ে দিলাম। কলিজা‌ আমার !”

ভোর বাবার গলা‌ জড়িয়ে ফুঁপিয়ে কাদে।ঘারে নাক মুছে কাঁদতে কাঁদতে বলে,

-” আব্বু তুমি পঁচা। আমার সাথে কথা বলো নি! আমার অনেক কষ্ট হচ্ছিল!”

অরুণ ছেলেকে আদরে আদরে ভরিয়ে তোলে। ইশ ছেলেটাকে কষ্ট দিলো ছেলেমানুষী অভিমানের জন্য।

-” আব্বু। কলিজা আমার। আব্বু অনেক পঁচা। আর হবে না মানিক সোনা। হয়েছে আর কাঁদে না। গলা বসে গেছে তো! আর মাথা ব্যাথা করবে! চুপ করো কলিজা!”

ভোর বাবার জখম হয়ে যাওয়া গালে চুমু দেয় আর বিড় বিড় করে ‘আব্বু আব্বু’ বলতে থাকে। অরুণ ছেলের মুখ আজলায় ভরে কপালে চুমু দিয়ে চোখের পানি মুছে দেয়।

-” আর কাঁদবে না। জ্বর ডেকে এনেছো! খেয়ে ওষুধ খাবে। জ্বর‌ বাপ বাপ বলে পালাবে।”

ভোর বাবার টি শার্ট হাতে নিয়ে নাক ঝাড়ে।

-” ভোর লাভস ইউ ভেরি মাচ আব্বু কলিজা।”

অরুণ হাসে। এতো আদুরে কেন তার কলিজাটা! আদুরি এগিয়ে এসে তার মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,

-” উই ওল নো দ্যাট ভাইয়ের কলিজা! আমার
ভাইয়ের শার্টে কি ভরিয়ে দিলেন রাজকুমার?”

ভোর চোখ ডলে হেসে দেয়।

-” ভালোবাসা!”

আরিয়ান হামি তুলতে তুলতে বলে,

-” তোমাদের বাপ ছেলের হয়েছে? জলদি করো ক্ষুধায় পেটের ইঁদুর হাতি হয়ে নাচছে যে!”

ভোর এবার খিলখিল করে হেসে দিল।

চলবে……