পাতা বাহার পর্ব-২১+২২

0
749

#পাতা_বাহার
লেখনীতে: #বেলা_শেখ
#পর্ব- ২১ (প্রথম অংশ)
(কপি করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ)

বৃষ্টির দিন মানে ভরপুর খাওয়া দাওয়া, শান্তির ঘুম। খাওয়া দাওয়া বলতে ভাজিপুড়ি, খিচুড়ি, ছোলা বাদাম,মুড়িমাখা ইত্যাদি। আর ঘুম! ফুল স্পীডে বৈদ্যুতিক পাখা চালু করে কাঁথা মুড়ি। আহ পুরাই শান্তিময় জীবন। আর এই শান্তিময় জীবনে বিঘ্নিত ঘটায় প্রাকৃতিক কার্যক্রম। এই বৃষ্টির পানি দেখলেই যেন শরীর থেকে পানি বের হওয়ার জন্য ছটফট করে খানিক সময় পর পর। তখন ছুটতে হয় ওয়াশরুম। আজকের দিনটাও বৃষ্টিমুখর। এখনো বারিধারা বহমান ধরনীতে।

অরুণ ড্রেসিন টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে টাই বাঁধছে। চুলগুলো স্পাইক করে পরিপাটি হয়ে আছে। পরনে ফরমাল ড্রেস আপ। সাদা শার্টের উপর কালো কটি। তার উপর কালো ব্লেজার। অরুণ টাই লাগিয়ে পরিপাটি চুল গুলোয় হাত চালিয়ে নিজেকে আয়নায় দেখে নেয়। কালো চুল গুলো উঁকি দিচ্ছে। তাকে কি বেশিই বয়স্ক লাগে? চুলে কালার করলে পাকা চুল গুলো দেখা যাবে না। কিন্তু সে কালার করবে কেন? এগুলো কি লুকোনোর জিনিস নাকি। বয়স হচ্ছে চুল পাকবে না। আয়নার থেকে নজর সরিয়ে হেঁটে বিছানায় শুকনো মুখে বসা ছেলের কাছে যায়। কপালে হাত দিয়ে তাপমাত্রা পরখ করে চুমু খায়। জ্বর কমতে শুরু করেছে। ভোর বাবার গলা জড়িয়ে ধরলো। কাঁধে মুখ গুঁজে বলে,

-” আব্বু তুমি রাতে কোথায় গিয়েছিলে? আমি তোমার জন্য ওয়েট করছিলাম।”

অরুণ ছেলেকে কোলে তুলে অফিস ব্যাগটা হাতে নিয়ে বের হয়। চিরচেনা গম্ভীর মুখে বলে,

-” একটু কাজ ছিল বাবা। এসে দেখি তুমি ঘুমিয়ে!”

ভোর মাথা তুলে বাবার মুখোমুখি হয়ে গালে হাত রেখে বলে,

-” আব্বু কাল কি হয়েছিল? ওই পচা লোকগুলোকে মারছিলে কেন?”

অরুণ গাম্ভীর্যতা যেন একটু বেড়ে গেল।

-” ওসব তোমার জানতে হবে না। লোকগুলো ভিলেন ছিলো। তাই পানিশ্ড করেছি।”

ভোর মুখ খুলে আরো কিছু বলবে। অরুণ ছেলের ঠোঁটে চুমু খেয়ে বলে,

-” আর প্রশ্ন না বাবা।”

ভোর চুপ করে যায়। তার ফোলা ফোলা মুখশ্রী রক্তিম হয়ে আছে কান্না ও জ্বরের ফলে। নাকটা যেন রক্তিম কৃষ্ণচূড়ার ন্যায়। চোখ মৃদু লাল ও টলমলে। অরুণ ড্রয়িংরুম কাটিয়ে ডাইনিং প্লেসে যায়। ছেলেকে কোলে নিয়েই একটা চেয়ারে ব্যাগ রেখে অন্য চেয়ার টেনে বসে । সামনে আসমা বেগম আরিয়ান ব্রেকফাস্ট করছে। মিনু পরিবেশন করছে।আদুরি, রুবি, আনিকা এখনো উঠে নি হয়তোবা। বৃষ্টির দিনে তারা ঘুমবিলাসী বনে যায়। সে আসমা বেগম ও আরিয়ানের মুখশ্রী দেখে।কেমন যেন থমথমে। তার কপার কুঞ্চিত হয়। গতরাতের ব্যাপারে কিছু জেনে গেছে কি! সে কিছু বলবে এর আগে আরিয়ান মুখ খোলে,

-” ভাই ঘটনা কি সত্যি?”

অরুণের কুঞ্চিত কপাল শিথিল হয়। টেবিলে থাকা অরেঞ্জ জুস গ্লাসে ঢেলে ছেলের মুখে দেয়। ভোর একটু খানি খেয়ে মাথা নাড়ে আর খাবে না। অরুণ জোর করে না। বাকিটুকু নিজে শেষ করে। আরিয়ানের দিকে তাকিয়ে বলে,

-” এখন প্রশ্ন হলো তোরা ঘটনা টুকুর কতটুকু শুনেছিস?”

আরিয়ান ভাইয়ের হেঁয়ালিপূর্ণ কথায় বিরক্ত হয়।

-” ভাই বিয়ের ব্যাপারটা কি সত্যি?”

-” হুম।”

আসমা বেগম ও আরিয়ান অবাক হয় না। তারা সিওর ছিল। শুধু একটু বাজিয়ে নিল যে অরুণ স্বীকার করে কি না তাদের কাছে। ভোর কিছু বোঝে না। দূর্বল গলায় মিনমিন করে নাক টেনে বলে,

-” আব্বু কার বিয়ে?”

মিনু ততক্ষণে অরুণের প্লেটে খাবার দিয়েছে। ভুনা খিচুড়ি সাথে কষা মাংস ও চাটনি। অরুণ খিচুড়ি হাতে নিয়ে ফু দিয়ে ছেলের মুখের সামনে ধরে ভোর মুখ কুঁচকে মাথা নাড়ে খাবে না। অরুণ নিজের মুখে নিয়ে বলে,

-” আব্বু বড়দের আলোচনায় কান দিতে নেই।”

ভোর এবার গাল ফুলিয়ে ঘুরে বাবার বুকে মুখ লুকিয়ে চোখ বুজে নেয়। অরুণ বা হাতে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকে।
আসমা বেগম সেদিকে চেয়ে বলে,

-” ভোরের জ্বর এখন কেমন?”

-” ছেড়েছে। ওষুধ খাইয়ে দিয়েছিলাম।”

আসমা বেগম অরুণের গাম্ভীর্য ঘেরা চেহারার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে বলে,

-” কাল এতো কিছু ঘটে গেলো অথচ আমাদের জানানোর প্রয়োজন বোধ করলে না!”

আরিয়ান মায়ের কথা কেড়ে নিয়ে তাচ্ছিল্য ভরা কণ্ঠে বলে,

-” মা তুমিও না! আমাদের কেন বলবে? আমরা কি ভাইয়ের আপন কেউ নাকি! সৎ সম্পর্ক আমাদের। আপন সম্পর্কের লোক তো সাথেই ছিলো!”

অরুণ প্লেটে হাত থেমে যায়। ঢোক গিলে মুখের খাবার গলাধঃকরণ করে। আরিয়ানের দিকে তাকিয়ে বলে,

-” তোর সবসময় ছেলেমানুষী কথা বার্তা। এখানে সৎ আপনের কথা উঠছে কেন? পরিস্থিতি তেমন ছিল না। আর আমি নিজেও জানতাম না এমন কিছু করবো। যখন ভেবে সিদ্ধান্ত নিই তখন বলার মতো পরিস্থিতি ছিল না। আর রাতে এসেও দেখি সকলে ঘুমিয়ে। সকালে বলতে চেয়েছিলাম ছেলের জ্বরে ঘেটে ঘ হয়ে গেছে।”

আসমা বেগম আরিয়ানকে চোখ রাঙায়। ব্রেকফাস্টে মনোযোগ দিয়ে বলে,

-” আমাদের জানানোর পরিস্থিতি ছিলো না অথচ মেয়র সাহেব সেথায় পৌঁছে যায়।”

অরুণ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,

-” ছোট মা? ব্যাপারটা তেমন না। মামাকে নিয়ে গিয়েছিলাম দরবার সামলাতে। না সে জানতো এমন কিছু হবে আর নাই বা আমি।”

আসমা বেগম আর তর্কে গেলেন না।

-” হুম বুঝলাম। তা তাকে আনো নি কেন? বাচ্চাটাকে জানাবে না?”

-” গতরাতের ঘটনা ভুলে যাও। সব পারিবারিক ও আনুষ্ঠানিকভাবে হবে। তোমরা গিয়ে বালা রিং পড়িয়ে একটা ডেট দিয়ে এসো। আর কি কি করবে তোমরা জানো! আমি ওসবে নেই!”

আরিয়ান চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বলে,

-” মেয়েটা কেমন? শুনলাম কমবয়সী! ভোরকে..”

অরুণ তার দিকে চায়‌ শান্ত চোখে।

-” ভালো। ওকে খুব আদরে রাখবে ইনশাআল্লাহ। ওকে জানাস না। পরে সারপ্রাইজ দেব!”

আরিয়ান তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে ভাইয়ের দিকে বলে,

-” এই সত্যি করে বলতো ভাই আগে থেকে কোনো চক্কর টক্কর ছিলো নাকি? হঠাৎ করেই.”

অরুণ তাকে থামিয়ে দিয়ে বলে,

-” আমি অফিসে যাচ্ছি। আর যেমনটা ভাবছিস তেমন নয়। সবটা অনাকাঙ্ক্ষিত।”

অরুণ ছেলেকে চেয়ারে দাঁড় করিয়ে বেসিনে যায়।ভোর টেবিলে মাথা ঠেকিয়ে আরিয়ানের দিকে তাকিয়ে বলে,

-” তোমার পেটের হাতি এখনো নাচছে চাচ্চু?”

আরিয়ান হেসে মাথা নাড়ে। নাচছে না। উঠে এসে ভোরের কপালে হাত রেখে তাপমাত্রা পরখ করে।

-” তোমার জন্য ইয়া বড় সারপ্রাইজ আছে। জলদি সুস্থ হও তারপর দিবো!”

অন্যসময় হলে ভোর খুশিতে নেচে কুদে আরিয়ানের কোলে উঠে সারপ্রাইজ চাই চাই বলে কানের পোকা বের করে দিতো। জ্বরের শরীরে ভোর হেসে বলে,

-” সত্যি!”

আরিয়ান তাকে কোলে তুলে আদর করে।

-” হ্যা সোনা।”

ততক্ষণে অরুণ এসে ব্যাগ কাঁধে নিয়ে ছেলেকে আরিয়ানের কাছ থেকে বুকে জড়িয়ে নিল। আরিয়ান ভোরের মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,

-” রেখে গেলেই পারিস।‌ সবাই বাড়িতেই। অসুস্থ ছেলেটাকে নিয়ে অফিসে গিয়ে আরো অসুস্থ বানানোর পাঁয়তারা!”

অরুণ ছেলের কপালে চুমু দিয়ে বলল,

-” অফিসে যাওয়া জরুরী। কিছু ক্লায়েন্টের সাথে মিটিং আছে। আর ফটোশুটের জন্য নিউ লুক লাগবে তার ইন্টারভিউ। নইলে যেতাম না। আর অসুস্থ ছেলেকে দূরে রেখে একটা কাজেও মন দিতে পারবো না। আসছি। আসছি ছোটমা ।”

বলেই ছেলেকে বুকে জড়িয়ে বেরিয়ে যায়। আরিয়ান, আসমা বেগম তার প্রস্থান‌ দেখে।
________

পাতা প্রিয়দের বাড়িতে এসেছে। এখানেই যে তার শৈশব কৈশোর কেটেছে। এই বাড়ির আঙিনায় হেসে খেলে বড় হয়েছে।এ বাড়ির প্রতিটা আনাচ কানাচ যে তার শৈশব কৈশোরের স্মৃতি বহন করে। এই বাড়িতেই জড়িয়ে আছে কিছু মিষ্টি মূহূর্ত আবার কিছু তিক্ত অভিজ্ঞতা। এ বাড়ি থেকে ভালোবাসা, অবহেলা, কথার বাণ অনেক কিছুই পেয়েছে। ছোট বেলায় হাসিমুখে যারা আপন মনে করে বুকে টেনে নিয়েছিল। তারাই যৌবনের পদার্পণের মুহূর্তে ব্যাগ প্যাক করে নির্বাসিত করেছিল। পাতা বাড়ির সম্মুখ দুয়ারে দাঁড়িয়ে। সাথে লুবমান। পাতা দুয়ারে দাঁড়িয়ে টলমলে চোখে। কেন জানিনা তার চোখ ভরে উঠছে।

রহিম মিয়া রা দুই ভাই তিন বোন। বাবা বেঁচে নেই তাদের তবে বৃদ্ধা মা আকলিমা খাতুন বেঁচে আছেন। রহিম মিয়ার ছোট ভাই করিম মিয়া একসাথেই মাকে নিয়ে থাকেন। যৌথ পরিবার যাকে বলে। করিম মিয়াও ভাইয়ের সাথে ধানের ব্যবসা সামলায়। সাথে বাজারের চালের বড় আড়তদার তারা দুই ভাই। করিম মিয়ার স্ত্রী ফাতেমা জোহরা। তাদের ঘরে দুই ছেলে এক মেয়ে। বড় ছেলে কাওসার পড়াশোনা শেষ করে ওষুধ কোম্পানিতে কাজ করে তিন বছর হলো। আর মেয়ে জুবাইদার বিয়ে হয়েছে।সে পাতার থেকে এক বছরের ছোট। আর সবার ছোট ফরহাদ ক্লাস সিক্সে পড়ে প্রিয়োর সাথে। তারা পিঠাপিঠি।
প্রিয়দের বাড়ি গ্রামে। রঙিন টিনের আধা পাকা বাড়ি। ওরা চাইলে দোতলা তিন চলা বিল্ডিং ও দিতে পারে। বর্তমানে তাদের আর্থিক অবস্থা বেশ সচ্ছল। চালের আরৎ ও ধানের ব্যবসা থেকে প্রচুর আয় করে। তাদের বাড়ি পাকা না করার কারণ কিপ্টেমি নয়। বরং আকলিমা খাতুনের ইচ্ছা। সে বিল্ডিং বা ছাদ ওয়ালা বাড়ি পছন্দ করে না। তার কাছে দম বন্ধ হয়ে আসে। এ কারণে তিনি মেয়েদের বাড়ি গিয়ে এক রাতও কাটায় না। তবে টিনসেটের এই আধা পাকা বাড়িটাও দেখতে বেশ। সৌখিনতায় ভরপুর। পাতা পা বাড়ায়। বাগানবিলাসে আচ্ছাদিত গেট খানি খুলে ভিতরে প্রবেশ করে। কোথা থেকে দুটো হাত তাকে জাপটে ধরে টাইট করে। চিল্লিয়ে বলতে থাকে,

-” পাতুপু পাতুপ!! তোমাকে আমি এতো এতো মিস করি।‌ আই লাভ ইউ পাতুপু। তুমি আসবে আমায় বলবে না!”

পাতা হেসে বোনের মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। প্রিয় পাতা বলতে অজ্ঞান। তাকে পাতার সঙ্গ দাও আর কিছুই চাই না। লুবমান এসে প্রিয়োর পিঠে টোকা মারে। প্রিয় পাতাকে ছেড়ে পিঠ ডলতে থাকে। লুবমান তার কাঁধে পাতার ব্যাগ দিয়ে হাত ঝাড়তে ঝাড়তে বলে,

-” শুধু পাতাকেই দেখতে পাস তোরা! আমাকে নজরে আসে না? বড় ভাই এসেছে পায়ে পড়ে সালাম করবি তা না! পাতুপু পাতুপু!! এই পাতুপু আবার কেমন ডাক শুনি? পাতু আপু বললেও ভালো শোনা যায় কিছুটা।”

চলবে….

#পাতা_বাহার
লেখনীতে: #বেলা_শেখ
#পর্ব- ২১ (শেষাংশ)

(কপি করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ)

-” শুধু পাতাকেই দেখতে পাস তোরা! আমাকে নজরে আসে না? বড় ভাই এসেছে পায়ে পড়ে সালাম করবি তা না! পাতুপু পাতুপু!! এই পাতুপু আবার কেমন ডাক শুনি? পাতু আপু বললেও ভালো শোনা যায় কিছুটা।”

আহ্লাদি প্রিয় লুবমানের বাহুতে কিল বসিয়ে ভেংচি কেটে বলে,

-” আমার পাতুপু কে আমি যা খুশি ডাকবো। এতে তোমার কিসের সমস্যা লুব ভাই! আর তুমি কেন এসেছো? জানো না বিনা দাওয়াতে মেহমানদের পিঠে ঝাটার বাড়ি!”

পাতা চোখ রাঙায় প্রিয়কে। প্রিয় হি হি করে হেসে উঠে। লুবমান মুখ খানা গম্ভীর বানিয়ে বলে,

-” দাওয়াত খেতে আসি নি। বোনকে রাখতে এসেছি। নইতো তোদের মতো ফকিন্নিদের বাড়ি আসার মতো মেহমান আমি না।”

পাতা লুবমানকেও চোখ রাঙায়।

-” লুব ভাই থামবি? বাচ্চাদের মতো ঝগড়া করছিস! আর প্রিয় সবাই বাড়িতে?”

প্রিয় লুবমানকে ভেঙ্গিয়ে পাতাকে টানতে টানতে বাড়ির ভিতরে নিয়ে যায়।

-” বাবা , চাচা নেই! তাছাড়া সবাই আছে। কাওছার ভাই, ফরহাদ, মা, ছোট মা , বুড়ি ।”

বলতে বলতেই ফরহাদ এসে দাঁড়ায় সামনে। চোখ বড় বড় করে চায়।

-” পাতা আপু! কেমন আছো তুমি কতদিন পরে এলে। আমাদের মনে পড়ে না, তাই না?”

পাতা প্রিয়র হাত ছাড়িয়ে ফরহাদের মাথার চুল এলোমেলো করে দিয়ে গাল টেনে বলে,

-” ভালোই আছি। আর মনে পড়ে তার জন্যই তো এলাম। আমি এলেই তোদের পাতা আপুর কথা মনে পড়ে। কই একবারও তো দেখতে যাস না? ফোন করারও নাম নেই । খালি মুখেই!”

ফরহাদ ঘোর বিরোধিতা করে।

-” আপু আর কারো কথা বলতে পারবো না কিন্তু আমি আর প্রিয় তোমায় সবসময় মিস করি। আর আমাদের তো ফোন নেই কল দিব কিভাবে?”

-“হয়েছে আর সাফাই গাইতে হবে না।”

লুবমান‌কে দেখে ফরহাদ মুচকি হেসে সালাম দিয়ে বলে,

-” ভালো আছেন ভাইয়া?”

লুবমান হেসে তার পিঠ চাপড়ে দিল।

-” ভালো আছি। তুমি কেমন আছো? বড় হয়ে গেছো দেখছি!”

ফরহাদ লজ্জা পেয়ে মাথা চুলকায়। পাতা এখন বাড়ির উঠানে দাঁড়িয়ে আছে। তন্মধ্যে বাড়ির বাকি সদস্যরা বেড়িয়ে আসে। পারুল পাতাকে দেখে বেশ খুশি হয়। এগিয়ে এসে জড়িয়ে ধরে। পাতা নাক টেনে ঘ্রাণ নেয়। মায়ের শরীরের নিজস্ব মা মা ঘ্রাণ। যেটা সে ও বাড়িতে সবচেয়ে বেশি স্মরণ করে।

-” কেমন আছিস?”

মায়ের কথায় পাতার চোখে নোনাজল ভিড় করে। মুচকি হেসে বলে,

-” ভালো আছি মা! তুমি কেমন আছো?”

পারুল পাতাকে ছেড়ে গালে হাত বুলিয়ে বলে,

-” আমিও ভালো আছি।‌ একটু গায়ে পায়ে হয়েছিস। সুন্দর হয়েছিস আরো। আমারই নজর না লাগে!লুব কেমন আছিস?”

পাতা মুচকি হাসে। লুবমান মাথা নাড়ে।আকলিমা খাতুন ও ফাতেমা জোহরাকে দেখে বলে,

-” তোমরা ভালো আছো দাদি, ছোট মা?”

আকলিমা গম্ভীর মুখে পাতাকে পর্যবেক্ষণ করে বলে,

-” আছি ভালোই। তা পোঁটলা নিয়ে আইসোস যে কতদিন থাকবি? একেবারে আসিস নি তো আবার?”

পাতার হাসিমুখ মলিন হয়। সাথে পারুলের মুখশ্রীতে আঁধার নামে।লুবমান গম্ভীর মুখে দাঁড়িয়ে পাতার পাশে। পাতা ঠোঁটে হাসি ঝুলিয়ে বলে,

-” না দাদি। কিছুদিন থাকবো।‌ বাবা বেশ কয়েকদিন হলো ফোন করছিল আসার জন্য। তাই আসা।”

-” ওহ! ভালো!”

পারুল শাশুড়ির মুখের উপর কখনো কথা বলে না। তবে এবার চুপ করে থাকলেন না।

-” আম্মা মেয়েটা আমার কতদিন পর এলো। এভাবে না বললে হয় না!..”

পাতা মায়ের হাত ধরে থামিয়ে দেয়,

-” মা হয়েছে। আমি কিছু মনে করি নি। ছোট মা কেমন আছো বললে না?”

ফাতেমা মিথ্যে হাসি ফুটিয়ে তোলে মুখশ্রীতে। পাতাকে তার পছন্দ না আগে থেকেই। এখন তো আরো না। ভাসুর যে কেন পাতাকে আনার জন্য লেগে পড়েছে জানে সে। কাওসারের বাবা কাওসারের জন্য পাতাকে ঘরে তুলতে চায়। এতে তার সাথে ফাতেমার অনেক বাক বিতণ্ড হয়। করিম মিয়া এতে যেন আরও জেদ করেই উঠে পড়ে লেগেছে।বড় ভাইকেও জানিয়েছে । কিন্তু সে এটা হতে দিবে না। ছেলে কাওসার এ সম্বন্ধে অবগত নয়। তবে বাবার কথায় অমত করবে না সেটাও জানে। তাই শাশুড়ির কানে কথা পাড়ে। তিনিও পাতাকে ছোট থেকেই সহ্য করতে পারে না। তবে সেটার ভয় এখন আর নেই। সে পাতার দিকে এগিয়ে এসে বলে,

-” ভালোই আছি। তুই? এই কিছু কিছু কথা কানে আসলো সত্যিই?”

পাতা লুবমানের দিকে চায়। এতোদূর পর্যন্ত কথা ছড়িয়েছে? পারুল ছোট জায়ের দিকে তাকিয়ে বলে,

-” ফাতেমা সকালে বললাম তো আমি সব। লাবনী আপা ফোন করে বলেছিল সকালে। এখন ওর থেকে আলাদা করে শুনতে হবে?”

ফাতেমার মুখটা চুপসে যায়। প্রিয়, ফরহাদ কিছু বোঝে না। কিসের ব্যাপারে কথা বলছে। তবে বড়দের মধ্যে জিজ্ঞেস করার সাহস হয় না। পরে পাতা আপুকে জিজ্ঞেস করে নিবে। পাতা বুঝতে পারে আম্মু সবাইকে জানিয়ে দিয়েছে। আকলিমা খাতুন পানের পিক ফেলে উঠানে। লুবমান তাকে সালাম দিয়ে ফাতেমার সাথেও কুশল বিনিময় করে। আকলিমা খাতুন লুবমানের উদ্দেশ্যে বলে,

-” তা বোনের বিয়া হইলো জামাই সাথে নিল না ক্যা?”

পাতা লুবমানের দিকে তাকিয়ে শান্ত হতে বলে। লুবমান দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করে। এই বুড়িটাকে তার একদম সহ্য হয় না।

-” দাদি বোন জামাই বিত্তশালী ব্যক্তি। বোনকে সাদামাটা ভাবে ঘরে তুলবে নাকি। ধুমধামের সাথে তুলে নেবে। আপনারাও দাওয়াত পাবেন।”

প্রিয় ,ফরহাদ অবাক হয়।আকলিমা মুখ মোচড়ায়।

-” বড়লোক হইলে কি হইবো।‌শুনলাম বুইড়া ব্যাটা। একটা বাচ্চাও আছে!”

পাতা শক্ত কণ্ঠে রসিকতার সুরে বলে,

-” দাদি বুড়োরা অল্পবয়সী বউকে ভালোবাসে বেশি। মাথায় তুলে রাখে। আর ওতটাও বুড়ো না সে। দেখতে কিন্তু হেব্বি । একদম হলিউডের হিরো। তুমি দেখলে ফিট খেয়ে যাবে। তোমার মরা জামাইরে ভুলে তার জন্য পাগল না হয়ে যাও। তবে সাবধান হ্যা পাতার জামাইয়ের দিকে নজর দিবা না!”

আকলিমা কটমট করে পাতার দিকে চেয়ে চলে যায় লাঠি হাতে। পাতা হেসে দিল শব্দ করে। ফাতেমা জোহরা তার দিকে তাকিয়ে হেসে বলে,

-” আমাদের পাতা দেখি জামাই পাগল বনে গেছে!”

-” ছোট মা একমাত্র জামাই আমার পাগল হবো না।”

পাতাও হেসে বলে। তবে ধুপধাপ শব্দে হাসি বন্ধ হয়ে যায়। ফরহাদ, প্রিয় চলে যাচ্ছে মাটিতে শব্দ করে পা ফেলে। তার মানে তারা বেশ রেগে আছে। আর থাকবে না? তাদের প্রিয় পাতা আপু তাদের না জানিয়ে বিয়ে করে নিল? এই দুঃখ তারা কোথায় রাখবে। পাতা ওদের ডাকতে নেয়।পারুল তার হাত ধরে বলে,

-” ওদের কথা বাদ দেতো! একটু পর পিছনে পিছনে ঘুর ঘুর করবে। তুই চল হাত মুখ ধুয়ে নে। এই লুব তুই ও আয়! তুই কাওসারের ঘরে যা। ও ঘুমিয়ে আছে দেখ। ডেকে দে!”

পাতা লুবমান সায় জানায়।
_______

ড্রয়িং রুমে গালে হাত দিয়ে বসে আছে রাতুল ভুঁইয়া। পাশে লাবিব বাবাকে অনুকরণ করে বসে আছে গালে হাত দিয়ে।‌ রুম্পা ফ্লোরে খেলনা সামগ্রী নিয়ে বসে খেলছে আর ফেকছে।‌ মাঝে মাঝে চিল্লাচিল্লি করছে। কিন্তু এতে লাবিব বা রাতুল কারো রি ভাবান্তর হচ্ছে না। রাতুল গভীর চিন্তায় ব্যস্ত। পাতা যাওয়ার পর লতাকে বলেছিল,

-” পাতা তো চলে গেল।আমরাও যাই ? দেখ অনেক দিন হলো এসেছো? এখন বাড়ি ফিরতে হবে না? ঈদের পরেই তো মনে হয় পাতাকে তুলে নিবে তখন আসবা তো!”

লতা সাফ সাফ মানা করে দেয় ।সে যাবে না। ঈদ এখানেই কাটাবে। রাতুল কয়েকবার অনুরোধ করে লতা শোনে না। তার কথায় সে অটল। রাতুলের রাগ হয় বেশ। রাগের বশে বলে ফেল,

-” ঈদ পর্যন্ত না সারাজীবন পড়ে থাকো। যেতে হবে না আর। আমি ছেলে মেয়ে নিয়ে চলে যাবো!”

ব্যস লতা রেগে ফায়ার। মেয়েকে রাতুলের কোলে দিয়ে বলে,

-” যাও মেয়ে ছেলেকে নিয়ে। এখনি বের হও আমাদের বাড়ি থেকে। আমি যাবো না কখনো। সারাজীবন এখানেই পড়ে থাকবো। আমার বাবা মার কাছে কখনোই বোঝা হবো না। গেট আউট?”

রাতুল বেচারা বউয়ের রাগ দেখে চুপসে গেছে। নিজের দোষ স্বীকার করেছে। লতা শোনার পাত্রী নয়। তার এক কথা! রাতুলের আর কি করার। বসে আছে ছেলে মেয়ে নিয়ে। লতা নিজের মতোই আছে। লাবিব বাবার বাহুতে মাথা ঠেকিয়ে বলে,

-” আব্বু চলো আমরা চলে যাই। দারাজ থেকে নতুন মা অর্ডার করে নিবো ভালো দেখে। যে বকবে না একদম পাতা খালা মুনির মতো!”

রাতুল ছেলেকে কোলে তুলে চুমু খেয়ে বলে,

-” আস্তে বল বাপ তোর মা শুনতে পেলে তৃতীয় বিশ্ব যুদ্ধ হয়ে যাবে। আর দারাজে বউ পাওয়া যায়? সত্যি?”

বলে ছেলের দিকে চায়। ছেলে চোখ বড় বড় করে সামনে চেয়ে। রাতুল ভ্রু কুঁচকে ছেলের চাহনি পরখ করে সেদিকে চায়। তার চোখ জোড়াও কপালে। ছেলেকে বসিয়ে হে হে করে হেসে বলে,

-” মজা করছিলাম তো। তুমি তো আমার সোনা কলিজার বউ।”

লতা কটমট করে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ।তারপর মেয়েকে কোলে তুলে নিয়ে চলে যায়।
লাবিব রাতুল মুখ গোমড়া করে তার চলে যাওয়া দেখে। তারপর একে অপরের দিকে তাকিয়ে ঠোঁট উল্টায়! ইয়া আল্লাহ একে কোন মাটি দিয়ে বানিয়েছো? তারা তো মাইনকার চিপায় পড়ে গেছে।
____

সরকার জুয়েলারি ফ্যাশন হাউজের সকল কর্মীরা গোমড়া মুখে কাজ করছে। এমন বৃষ্টির দিনে কার কাজ করতে ভালো লাগে? তার উপর ঈদেরও যে দেড়ি নেই। কেনাকাটা শপিং আছে না? ছুটি দেওয়ার নাম নেই শুধু বস্তা বস্তা কাজ। আর আজ যেন কাজের চাপ আরো বেশি। ভোর মিসেস রুণার ডেস্কটপের উপর পা ঝুলিয়ে বসে আছে। জ্বরের কারণে মুখটা শুকিয়ে আছে। তবে তার‌ হাসিমাখা সোনার মুখখানি যেন মায়া আরেকটু বাড়িয়ে দিয়েছে। জ্বরের সঙ্গে ফ্রিতে সর্দি। যার কারণে টিস্যু বক্স হাতে নিয়ে বসে। একটু পরপর নাক মুছতে। ফলে নাক টকটকে লাল একদম কৃষ্ণচূড়ার ন্যায়।এতে দেখতে আরো কিউট লাগছে। মিসেস রুণা অরুণের কপালে হাত দিয়ে একটু পর পর তাপমাত্রা পরখ করছে। বস বলে গেছে কি না! তার পাশের ডেস্কটপ থেকে লাবিব একটু পর পর উঁকি দিচ্ছে। সামনের ডেস্কটপ থেকে অপর্ণা হাই দিচ্ছে ভোরকে। ভোর হাসিমুখে তাদের সাথে হাই হ্যালো ও উঁকি দিচ্ছে।

-” পরনা আপু? লাবিব আংকেল? তোমরাও আসো না এখানে আমি বোর হচ্ছি!”

ব্যস ভোরের বলতে দেড়ি তাদের আসতে দেড়ি না। ছোট বস হুকুম করেছে মানতে বাধ্য কিনা! লাবিব কদমবুসি করে ভোরকে বলে,

-” বলুন ছোট বস কি করে আপনার মনোরঞ্জন করতে পারি?”

অপর্ণা তার কাঁধে ধাক্কা দিয়ে বলে,

-” ছোট বস গান গাইতে বলো!”

মিসেস রুণা নিজের কাজ করতে করতে তাদের দুজনকে বলে,

-” কাজ বাদ দিয়ে আড্ডা দাও বস এসে ঈদ বোনাস কাট করে দিবেনি!”

ভোর লাবিবের দিকে হাত বাড়িয়ে দেয়। লাবিব তাকে কোলে তুলে চুমু খায়। মিসেস রুণার কথার প্রেক্ষিতে বলে,

-” বোনাস দিয়ে কি করবো ম্যাম ! বউ তো দূর একটা গার্লফ্রেন্ডও নেই! বোনাস আমার লাগতো না! তবে বোনাস সরূপ একটা বউ দিলে ভাবা যেত!”

অপর্ণা তার দিকে তাকিয়ে বলে,

-” দাদা আপনার দুঃখ বুঝি আমি। আন্টির ফোন নাম্বার দিতে পারেন আমি কথা বলতে পারি যে আপনার ছেলে বিয়ের জন্য নাচছে।”

-” না ম্যাডাম তার দরকার নাই। সিঙ্গেল আছি বেশ আছি!”

ভোর দুজনের কথাবার্তায় বিরক্ত হয়। তার ছোট্ট মাথাটা এমনিতেই ব্যাথা করছে এদের বকবকানিতে সেটা বেড়ে যাচ্ছে।

-” তোমরা চুপ করবে একটু! আমার ভালো‌ লাগছে না।”
সবাই ব্যস্ত হয়। বস ছেলেকে দিয়ে বলে গেছে একটু খেয়াল রাখতে। সে ইন্টারভিউ নিচ্ছে। মিসেস রুণা এসে আবার ভোরের কপাল গলায় হাত রেখে বলে,

-” খারাপ লাগছে? শুয়ে পড়বে?”

ভোর তার‌ হাত সরিয়ে লাবিবের গলা জড়িয়ে বলে,

-” শুবো না। আমার ক্ষিধে পেয়েছে। আব্বুকে ডাকো!”

অপর্ণা হেসে বলে,

-” এই ব্যাপার? কি খাবে বলো ছোট বস?”

ভোর সেভাবেই লাবিবের গলা‌ জড়িয়ে বলে,

-” তোমরা মেনু বলো‌ আমি ডিসাইড করবো!”

মিসেস রুণা হেসে দেয়।

-” আমার লাঞ্চ বক্সে নুডুলস আছে। খাবে?”

-” না। ওটা খেতে ইচ্ছে করছে না!”

লাবিব বলে,

-” আমার মা ভুনা খিচুড়ি দিয়েছে। সাথে সর্ষে ইলিশ খাবে?”

ভোর লাবিবের মুখোমুখি চায়।

-” তোমার মা দিয়েছে? উনিই রেঁধেছে?”

লাবিব মাথা নাড়ল। ভোরের খাওয়ার লোভ হয়। রোহান বলে মায়ের রান্না টেস্টি টেস্টি হয়। ভোর শুষ্ক ঠোঁট নাড়িয়ে বলে,

-” খাবো!”

লাবিব তাকে মিসেস রুনার ডেস্কটপের উপর বসিয়ে লাঞ্চ বক্স আনতে যায়। অপর্ণা ভোরের মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,

-” তোমার তো এলার্জি আছে। ইলিশ মাছ খাওয়া যাবে না। আমার বক্সে চিকেন ফ্রাই আছে আনবো?”

ভোর ঠোঁট চৌখা করে বলে,

-” তোমারও মা রেঁধেছে পরনা আপু?”

অপর্ণা তার মাথায় হাত বুলিয়ে বলে ,

-” না! আমি নিজে রেধেছি!”

-” তোমার মা রেঁধে দিল না কেন?”

-” আমার মা তো নেই! ভগবান নিয়ে গেছে।”

ভোরের মুখ মলিন হয়ে যায়। চোখ ভিজে যায়। সে টিস্যু দিয়ে নাক মুছে কাঁপা গলায় বলে,

-” স্যরি পরনা আপু!”

অপর্ণা হেসে ভোরের কপালে চুমু খায়।

-” তুমি স্যরি কেন বলছো ছোট বস! স্যরি তো ভগবানের বলার কথা ! বাবা মা দুজনকেই নিয়ে গেল। তুমি বস আমি লাঞ্চ বক্স আনছি!”

বলেই চলে যায়। ভোরের মনটা খারাপ হয়ে যায়। পরনা আপুর বাবা মাকে তার ভগবান কেন নিয়ে গেল? সে একা কিভাবে থাকবে! মিসেস রুনা হাসে। মেয়েটা চঞ্চল ,হাসিখুশি থাকে সবসময়।দেখে বোঝার উপায় নেই বুকের গহীনে কতটা কষ্ট লুকিয়ে। এরমধ্যে লাবিব আসে পানির বোতল ও বক্স হাতে।

ভোর আবদার করে তাকে খাইয়ে দিতে হবে।মিসেস রুণা চামচ ধুয়ে বক্সের ঢাকনায় অল্প খিচুড়ি নিল। সবটুকু খেতে পারবে না শুধু এঁটো করার কি দরকার। সে মাছ নেয় না। অপর্ণার বক্স থেকে চিকেন ফ্রাই নিয়ে চামচ দিয়ে খাইয়ে দেয়। ভোর অল্প একটু খেয়ে আর খাবে না। মিসেস রুণা জোর করে না। পানি খাইয়ে মুখ মুছে দেয়। ভোর ডেস্ক থেকে নেমে লাবিবের কোলে উঠে। লাবিব তাকে কোলে নিয়ে ডেস্কে বসে কাজ করতে থাকে।

ভোর উশখুশ করতে থাকে একটু পর। লাবিব কি হয়েছে বলতেই লাবিবের কোল থেকে নেমে ফ্লোরে গরগর করে বমি করে দেয়। লাবিব ধরে তাকে। অপর্ণা,মিসেস রুণা , পিয়ন সহ বেশ কয়েকজন ছুটে আসে। ভোর বমি করে অস্থির হয়ে গেছে। লাবিব মুখে পানি দিলে ভোর কুলকুচি করে ফেলে কেঁদে বলে,

-” আব্বুর কাছে যাবো! আব্বু?”

লাবিব পানি তার মুখ ধুয়ে রুমাল দিয়ে মুছে দেয়। কোলে করে নিয়ে ইন্টারভিউ রুমের সামনে যায়। সেখানে মেয়েদের ভিড় গয়নার ফটোশুটের নতুন মুখের জন্য। দরজার সামনে এক কর্মী বসে। সে প্রার্থীদের ভিতরে যাওয়ার জন্য বলছে। তার কোলে ভোরকে দেখে দরজা খুলে দেয়। সে নক করে ভিতরে ঢোকে। ভোর বাবাকে দেখে আব্বু বলে কেঁদে দেয়। অরুণ ক্রন্দনরত ছেলেকে দেখে উঠে এসে বুকে টেনে নিল। গলায় কপালে হাত রাখে। লাবিব স্যারের অস্থিরতা দেখে বলে,

-” ক্ষিধে পেয়েছে বলছিল। অল্প খাওয়ার পর বমি করেছে। এখন কাঁদছে আপনার কাছে আসার জন্য! আমি যাচ্ছি স্যার!”

অরুণ মাথা নাড়ে। ছেলের কপালে চুমু দিয়ে বলে,

-” খারাপ লাগছে আব্বু? জ্বর আসছে আবার। আল্লাহ আমার ছেলেটাকে সুস্থ করে দাও!”

ভোর বাবার বুকে মাথা রেখে চোখ বুজে নেয় আরামে।

-“এখন ভালো লাগছে আব্বু!

ম্যানেজার সুজন উঠে আসে। একজন প্রার্থী বসে আছে।তার ইন্টারভিউ চলছিল। সুজন স্যারের কাছে গিয়ে বলে,

-” স্যার ইন্টারভিউ কি ওফ রাখবো?”

অরুণ ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,

-” না। কন্টিনিউ করো!”

বলে কেবিনের চেয়ারে বসে বুকে ছেলেকে নিয়ে। বাকি ইন্টারভিউ সে ছেলেকে বুকে নিয়েই করে। ইন্টারভিউ শেষ হলে সিদ্ধান্ত নেয় বাড়ি চলে যাবে। আর যাওয়ার আগে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবে ভোরকে। যেই ভাবা সেই কাজ। ব্যাগে কিছু ফাইল ভরে। বাড়ি গিয়ে দেখা যাবে। নিজের কেবিনের দরজা খুলার সাথে সাথেই হুড়মুড়িয়ে ঢোকে একদল লোক। অরুণের কপাল কুঞ্চিত হয়। বিরক্ত ভঙ্গিতে বলে,

-” তোরা এখানে?”

সবাই স্বমস্বরে বলে,

-” তোকে কনগ্রেটস করতে এলাম বি..”

অরুণের ইশারায় থেমে যায় সব। ভোর দূর্বল চোখে সবাইকে দেখে। হাসিমুখে বলে,

-” তোমরা সবাই ভালো আছো?”

ব্যস সবাই ভোরের উপর হামলে পড়ে। অরুণের কোল থেকে কেড়ে নিয়ে সবার কোলে ঘুরতে থাকে। একবার এ কোলে নিয়ে চুমুতে ভরিয়ে দেয় তো তার থেকে আরেকজন নিয়ে। ভোরের আদর খেয়ে ভালো লাগলেও শরীর চলছিল না। বাবার দিকে তাকিয়ে থাকে মলিন মুখে। অরুণ ছেলের চাহনি বুঝে ওদের কাছ থেকে নিল।

-” জ্বর ছেলেটার। নইলে শান্ত থাকে!”

শুভ এসে কপালে হাত রেখে বলে,

-” তাইতো! ওষুধ খাইয়েছিস? আর তোকেও বলিহারি অসুস্থ ছেলেকে টেনে আনতে হবে অফিসে?”

অরুণ কিছু বলে না। বন্ধুদের দিকে চায়। শুভ, রাসেল, জীবন, মুস্তাকিম, ফয়সাল ও দ্বীপ্ত! মোট সাত জনের বন্ধু মহল তাদের। আরো তিনজন ছিল পরশি, তমা ও দোয়েল। তারা স্বামী বাচ্চা সংসার নিয়ে ব্যস্ত থাকে। ওদের সাথে কথা কম হয় এই যা। অরুণ সকলের উদ্দেশ্যে বলে,

-” দেখ কথাবার্তা সাবধানে বলবি ওর সামনে। সময় হলে জানাবো আমি। তোরা নিজেদের মুখে ব্রেক লাগা!”

মুস্তাকিম তাকে চোখ টিপে বলে,

-” মামা তুই তো গ্লো‌ করছিস! ফেয়ার এন্ড লাভলী মেখে নাকি কোনো ঔষধি পাতার রসটস খেয়ে? হুম হুম?”

অরুণ ছেলেকে নিয়েই এগিয়ে আসে । মুস্তাকিমের পিঠে এক ঘা লাগিয়ে বলে,

-” বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে কিন্তু?”

মুস্তাকিম থেমে যাওয়ার লোক নয়।

-” বুঝতে পারছি রস টস খেয়েই এমন হয়েছিস।”

অরুণ চোখ রাঙায়। মুস্তাকিম সহ সকলে হেসে ওঠে। শুভ হাসি থামিয়ে দুঃখি ভাব নিয়ে বলে,

-” ভাই এটা কিন্তু তুই ঠিক করিস নি। বিষধর রাসেলস ভাইপারকে সাথে নিয়ে গেলি অথচ আমরা সাধারণ জনগণ বঞ্চিত হলাম!”

রাসেল কটমট করে চেয়ে বলে,

-” শালার ঘরের সম্বন্ধি অশুভর বাচ্চা!”

শুভ বত্রিশ পাটি দেখায়। জীবন সবার মধ্যে শান্তশিষ্ট ও ভদ্রগোছের। সে অরুণকে সিরিয়াস গলায় জিজ্ঞেস করে,

-” রাসেলের থেকে শুনলাম হুট করে সিদ্ধান্ত নিলি ভেবে নিয়েছিস ভালোভাবে? পরে পস্তাতে না হয়!”

অরুণ গম্ভীর গলায় বলে,

-” ভেবেচিন্তেই নিয়েছি। কলিজার সাথে জড়িত কোনকিছুতেই হুট করে কিছু করি না। আর শুভ তো ব্যাপারটা নিয়ে উঠে পরে লেগেছিল তাই ওর কথা রাখতেই সব!আফটার ওল বন্ধু বলে কথা!”

সবাই শুভর দিকে চায়। শুভ চোখ বড় করে চায়।

-” শালা! তুই ঝোপ বুঝে কোপ মেরেছিস এখন আমার নাম গাইছিস? মিস পাতাবাহার মিস..”

ফয়সাল তার মুখ চেপে ধরে। অরুণ চোখ রাঙিয়ে চেয়ে। শালাদের মুখে ব্রেক কবে লাগাবে। কিন্তু ভোরের রেসপন্স নেই। সে ঘুমিয়ে গেছে। তাই সকলে স্বস্তির নিঃশ্বাস নেয়। তবে অরুণ উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে। কলিজাটা অসুস্থ কিনা!!

______

বর্ষাকাল ঋতুতে দ্বিতীয়। আষাঢ় শ্রাবণ মাস বর্ষা কাল। ক্যালেন্ডারে আষাঢ় মাস চলছে। চারদিকে বর্ষণের গুঞ্জন শোনা যায়।‌কখনো ঝিরিঝিরি তো কখনো মুষলধারায়। টিনের চালে মুষলধারে বৃষ্টির ফোঁটা ঝমঝমিয়ে পড়ায় যে শব্দের ঝংকার সৃষ্টি হয় তার কোনো তুলনা নেই। ভালো ভালো মিউজিকেও হার মানায়। এখন মুষলধারায় বর্ষণ হচ্ছে প্রিয়র ঘরের চালের উপর। পাতা চিৎ হয়ে শুয়ে পাশে প্রিয় বোনকে জড়িয়ে। গায়ে কাঁথা টানা। পাভেল ,ফরহাদ সোফায় বসে। কাওসার একটু আগেই চলে গেছে মা এর ডাকে। লুবমান পাতাকে রেখে খাওয়া দাওয়া করে চলে গেছে। সবাই থাকতে বললেও সে সরাসরি মানা করে দেয়।
ভর সন্ধ্যায় পাতা সব ভাইবোনদেরকে বিয়ের ঘটনাটা কাটছাঁট দিয়ে শোনায়। প্রিয়, ফরহাদের রাগ গলে পানি পানি হয়ে গেছে। তবে প্রিয় রেগে আছে অরুণ সরকার নামক লোকের উপর। তার পাতুপুকে নিয়ে যাবে!! পাবেল, ফরহাদ খুশি হয়েছে। ফয়সাল পাতাকে বলে,

-” পাতা আপু? তোমার কাছে দুলাভাইয়ের ছবি আছে? একটু দেখাবে? আচ্ছা বেশিই বুড়া?”

পাতা আড়চোখে ভাইদের দিকে আয়।

-” খবরদার বুড়ো বলবি না! আর ছবিটবি নেই!”

পাবেল আগ্রহ নিয়ে বলে,

-” আমি দেখেছি ওনাকে। বুড়ো নয় মোটেও। হ্যান্ডসাম আছে বেশ। পুরাই সুদর্শন পুরুষ গাম্ভীর্যে ঘেরা। কম কথা বলে হাসেও কম! আর এসব তার পারসোনালিটির সাথে বেশ যায়।”

প্রিয় বিরক্ত হয়। ফরহাদ আগ্রহের সাথে সব গলাধঃকরণ করছে। পাভেল আরো কতশত গল্প জুড়ে দেয় অরুণ সরকারকে ঘিরে। পাতা হাসে সেসব শুনে।‌ হঠাৎ মনে আসে ভোরটার জ্বর এসেছিল। কমেছে কি? ছেলেটার জন্য কেমন যেন উদ্বিগ্নতা মিড় করে মন‌কুঠিরে! আগে তো এমন হতো না! এখন কেন হচ্ছে? নতুন সম্পর্কে জুড়ে গেছে তাই কি? পাতা আসছি বলে ফোন হাতে নিয়ে বেড়িয়ে আসে ঘর থেকে। বৃষ্টি পড়ছে বাইরে ঝমঝমিয়ে। পাতা বারান্দার সিমেন্টের খুঁটির পাশে দাঁড়িয়ে কল লাগায় অরুণ সরকারের নাম্বারে। প্রথম বার রিসিভ হয় না। দ্বিতীয় বারের বেলায় কেটে দেয়। পাতার কপালে ভাঁজ পড়ে। কেটে দিল কেন? তার ভাবনার মাঝেই কল আসে অরুণের নাম্বার থেকে। পাতার ঠোঁটে হাসি ফুটে ওঠে। ওহ নাক উঁচু লোক কল দেওয়ার জন্য কাট করেছিল। নাহ কিছুটা হলেও ম্যানারস জানে। সে রিসিভ করে সালাম দেয়। অরুণ সালামের উত্তর মনে মনে নিয়ে গাম্ভীর্যের সঙ্গে প্রশ্ন করে,

-” পৌঁছে গেছেন?”

পাতা এক হাতে ফোন কানে ধরে অপর হাতে বৃষ্টির পানি মুঠোয় ভরে।

-” হুম। সেই বারোটায়। ছেলেটার জ্বর কেমন? কমেছে?”

অরুণ ঘুমন্ত ছেলের শিয়রে বসে জলপট্টি করছে। ফোন স্পিকারে দিয়ে বিছানায় ফেলে রেখেছে।আর পাতাবাহার ফোনে উঁকি ঝুঁকি দিচ্ছে। কোথা থেকে আওয়াজ আসছে বোঝার জন্য। সন্ধার আগ দিয়েই বাড়ি ফিরেছে বাবা ছেলে। ছেলেটাকে ডাক্তার দেখিয়ে এনেছে। জ্বর বেশ, একশ এক! ডাক্তার ওষুধ লিখে দিয়েছে। অরুণ বাড়ি এসেই ছেলেকে একগ্লাস দুধ খাইয়ে ওষুধ দিয়েছে। আর কিছুই খাওয়াতে পারে নি। ওষুধ খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। সে ছেলের কপালে চুমু খায়। গলায় হাত বুলাতে থাকে।মিস পাতাবাহার ফোন করে ছেলের খোঁজ নিচ্ছে। অধরকোনে হাসির ঝিলিক দেখা যায়। নাহ চিনতে ভুল করে নি!

-” কমেছিল! বিকেল থেকে আবার জ্বর এসেছে। বমি করেছিল! ডাক্তারের কাছে নিয়ে গিয়েছিলাম। এক গাদা ওষুধ দিল। শুধু দুধ খেয়েই ওষুধ খেল। আর কিছুই খাচ্ছে না!”

পাতা চিন্তিত হয়ে পড়ে।

-” জ্বরে মুখে ভালো লাগে না হয়তো! আপনি একটু জোর করে অল্প অল্প করে একটু পর পর খাইয়ে দেবেন বাবা সোনা বলে। আর জ্বর বেশি হলে জলপট্টি দিবেন! আর..”

থেমে যায় পাতা। অরুণ আগ্রহ নিয়ে শুনছিল। থেমে যাওয়ায় কপাল কুঁচকে যায়। গম্ভীর কণ্ঠ হালকা নরম করে বলে,

-” আর?”

পাতা মুঠো ভর্তি পানি শুন্যে ছুঁড়ে।

-” আর টেনশন করবেন না। ঠিক হয়ে যাবে। নরমাল জ্বর!”

অরুণের অধরকোনে পুনরায় হাসি ফুটে ওঠে।

-” হুম! কি করছেন?”

-” এই তো বৃষ্টি দেখছি! এখানে ভারি বৃষ্টি হচ্ছে।”

-” আমাদের এখানেও ।তবে হালকা! এই আপনি কোথায় আছেন? মানে আমি..”

পাতা হেসে বলে,

-” প্রিয়দের বাড়ি! লতা আপুর খালার বাড়ি!”

অরুণের ভ্রু যুগল কুঁচকে যায়,

-” আপনার খালার বাড়ি না?”
-” নাহ! আমার তো মায়ের বাড়ি?”
-” মানে?”
-” মানে কিছু না। অন্যসময় বলবো! ভোর কি করছে?”

অরুণ ছেলের গায়ের কম্ফোর্ট ঠিক করে দেয়। বিড়াল শাবকটি বারবার টেনে সরিয়ে দিচ্ছে।

-” ঘুমুচ্ছে

চলবে…..

#পাতা_বাহার
লেখনীতে: #বেলা_শেখ
#পর্ব- ২২
(কপি করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ)
অরুণ ছেলের গায়ের কম্ফোর্ট ঠিক করে দেয়। বিড়াল শাবকটি বারবার টেনে সরিয়ে দিচ্ছে।

-” ঘুমুচ্ছে!”

-” ওহ্। আচ্ছা রাখছি! ছেলের খেয়াল রাখবেন।”

বলেই কেটে দেয়। অরুণ ফোনের দিকে তাকিয়ে থাকে। কেটে দিলো? এর প্রশ্নের উত্তর অরুনের মন থেকে আসে; তো কি তোর সাথে প্রেমালাপ করবে? অরুণ জলপট্টি দেয়া বন্ধ করে দেয়। আর দেবে না। পাছে না ঠান্ডা লেগে যায়। এমনিতেই ঠান্ডা লেগেই আছে। সর্দিতে নাক বন্ধ থাকায় হা করে ঘুমুচ্ছেন নবাব! অরুণ সব সরিয়ে রেখে ছেলের কম্ফোর্টের ভিতরে ঢুকে জড়িয়ে নেয় ছেলেকে। কপালে চুমু খেয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকে। বিড়াল শাবক অরুণের পিঠ ঘেঁষে শুয়ে এক পা দিয়ে অরুণকে খোঁচায়। অরুণ বিরক্ত হয় ঘার ঘুরিয়ে পিছনে তাকায়। পাতাবাহার পিটপিট করে চেয়ে মিও মিও ডাকে। যার অর্থ আমাকেও একটু আদর করো!! অরুণ তার পা সরিয়ে দিয়ে বলে,

-” দেখ পাতাবাহার খোঁচা দিবে না। আঁচড় লাগবে। তখন তোমার না দেখা সখি সন্দেহ করবে আমায়!”

পাতা ফোন কেটে পরনের লং টি শার্টের পকেটে রাখে। গলায় ছোট ওড়না ঝুলছে।পাতা চুলের ঝুটি খুলে দেয়। কাঁধ থেকে সামান্য নিচে ঝরঝরে সিল্কি কালো চুল ছড়িয়ে পড়ে। কপালে কাটা ছোট ছোট চুল বড় হয়েছে কিছুটা কানের পাশে গুজে সম্মুখ পানে চায় সে। ঠোঁটে মুচকি হাসি রেখে উঠোনে বর্ষণের পতন দেখে। অন্ধকার হলেও আবছা আবছা দেখা যাচ্ছে। কি অপরূপ দৃশ্য। ঝমঝমিয়ে বৃষ্টির ফোঁটা পড়ছে উঠোনে জমায়িত পানির উপর। টিনের চালের উপর পড়ে সেটা গড়িয়ে উঠোনে পড়ছে কলাম হয়ে। পাতা শ্বাস টানে। ঠোঁট যুগল কম্পমান, উল্টে ওঠে। নাকের পাটা ফুলে উঠছে মৃদু। নেত্রযুগল রঞ্জিত! সেথায় মেঘ জমেছে। যেকোনো মুহূর্তে বর্ষণে ঝড়ে পড়বে। পাতা ঢোক গিলে! সাথে সাথে একফোঁটা বৃষ্টি সেই মেঘ হতে কপোল বেয়ে গড়িয়ে পড়ে।তারপর এক ফোঁটা দু ফোঁটা থামার নাম নেই। পাতা পা ভাঁজ করে বারান্দার সিমেন্টের খুঁটি ঘেঁষে বসে । বৃষ্টির পানি চাল বেয়ে গড়িয়ে মাটিতে পড়ছে সেখান থেকে ছিটকে তার গায়ে লাগছে। কখনো হালকা বাতাসের সাথে বৃষ্টির পানি ছিটেফোঁটা এসে ভিজিয়ে দিচ্ছে। পাতা স্থির নয়নে শূন্যে চেয়ে। চোখ যুগল থেমে নেই, বর্ষিত হচ্ছে। তার কেন কান্না পাচ্ছে সে জানে না। শুধু কান্না পাচ্ছে ব্যস! কান্নার সাথে অতিতের স্মৃতি ভেসে আসে। এমনই বৃষ্টিমুখর পরিবেশে পাবেলের জন্ম হয়।ওর জন্মের দিন অনেক বৃষ্টি ছিল। সেই বৃষ্টির স্থায়িত্ব কাল ছিল পরবর্তী তিন দিন; মাঝে মাঝে থেমেছিলো। তারপর পাভেল দেড় বছরের হলো। সেদিন এমন সন্ধ্যা ছিল বোধহয় এমনকি সেদিনও বৃষ্টি ছিল। তার খুব একটা মনে নেই‌ ।সে পাঁচ বছরের ছিল বোধহয়। পারুল, ফাতেমা ও আকলিমা খাতুন বসে ছিল কুপির আলোয় পাভেলকে কোলে নিয়ে! পাতা কাপড়ে বানানো পুতুল হাতে সেই ঘরে যাচ্ছিল ভাইয়ের সাথে খেলতে। দরজার কাছে যেতেই মা দাদি চাচির কণ্ঠস্বর ভেসে আসে। দাদির মুখে নিজের নাম শুনায় থেমে যায় কি মনে করে।
আকলিমা খাতুন নাতিনকে পায়ের উপর বসিয়ে সরিষার তেল মেখে বলছিল,

-” শোন পারুল তোমায় বলছিলাম আর কয়েকবছর অপেক্ষা করো! বাচ্চা হইবো। তোমাগোরে তো কোনো সমেস্যা ছিল না। কিন্তু তোমরা শুনলে না। বোনের কাছ থেকে চেয়ে আনলে ওই পাতাকে। এখন হলো তো নিজের পেট থেকে!!”

ছোট্ট পাতার মন ভিত হয় কি বলছে দাদি? এমনিতেই জুবাইদা ও কাওসার ভাই সবসময় বলে পাতাকে কুড়িয়ে এনেছে! ছোট্ট পাতা সেসব শুনে কষ্ট পেলেও হেসে উড়িয়ে দিত। ভাবতো মজা করে বলছে। কিন্তু দাদি কি বললো এখন?
পারুল হেসে বলে,

-” তখন কি জানতাম নাকি আল্লাহর রহমত আমাদের উপরও বর্তাবে।”

আকলিমা খাতুন নাতির মালিশ শেষ করে কোলে নিয়ে বলে,

-” এখন কি করবা? দেখ পাতা এখন ছোডই আছে। তোমার বোনরে ফিরাইয়া দিয়া আসো! তোমার একটা আছে আবার হইবো! তয় ক্যান অন্যেরটা পাইলবা? ছেলে হইলে তাও কথা ছিল। মাইয়া ! পড়াইয়া খিলাইয়া এতটাকা খরচ কইরা আমাগোরেই বিয়া দিতে হইবো। শোন পারুল আমার পোলার ওত ত্যাল হয় নাই! লাবনীরে দিয়া দেওগা তার মাইয়া পাতারে!”

পাতা আর ঘরে ঢোকে না। কাঁদতে কাঁদতে নিজের ঘরে যায়। ছোট্ট পাতার পাবেল হওয়ার পর আলাদা ঘর হয়! মাঝে মাঝে জুবাইদাও সঙ্গি হয়। পাতা চৌকির তলায় লুকিয়ে সেদিন অনেক কেঁদেছিল। তার ছোট মন মানতে নারাজ ছিল দাদির কথা। কারণ দাদি তাকে ভালোবাসে না। কখনো কোলে নেয় না, আদর করে না। কিছু হলেই খ্যাক করে ওঠে। থাপ্পড় লাগাতে ভুলে না। বাবা তার জন্য সদাই আনলে কেড়ে নিয়ে জুবাইদাকে দিত। এভাবে চলতে থাকে। পাতা ধীরে ধীরে বড় হয়। আরো বুঝতে শেখে। বাবার ভালোবাসা কমে যাওয়া দেখে। প্রিয় সংসারে আসলে মায়ের তার জন্য আর সময় হয় না। দাদি মারলে আগের মতো কোলে নিয়ে আদর করে না কেউ। ছোট প্রিয় সহ সকল বাচ্চার জন্য সদাই, কাপড় চোপড়, খেলনা এলেও তার জন্য আসে না। তাকে তার চেয়ে ছোট্ট জুবাইদার পুরনো জামা কাপড়, খেলনা নিয়ে খুশি থাকতে হতো। আর পাতা ছোট মোট হওয়ায় লেগেও যেত! তবে কাওসার ভাই তাকে লুকিয়ে চুরিয়ে অনেক কিছু দিত।ফলে কাওসার ভাইয়ের সাথে তার বেশ ভাব।দুই ঈদ ও হালখাতার সময় নতুন জামা আসত তারজন্য। আর মামার বাড়ি ও খালার বাড়ি গেলে পেত দুই এক সেট। বাবা কাজে যাওয়ার সময় পাভেল , প্রিয়কে আদর করে চুমু দিত। সে সামনে দাঁড়িয়ে সব দেখতো! তার মাথায় শুধু হাত রাখতো। পাতা এতেই খুশি। সে যতো বড় হয় বুঝতে পারে দাদির সেদিনের সন্ধ্যার কথা ঠিক ছিল। তবে সে চাইতো না তাকে রেখে আসুক ও বাড়ি। সে এখানেই থাকতে চায়। ও বাড়িতে আতিকুর ইসলামকে সে অনেক ভয় পায়। লুব ভাইকে কিভাবে সবার সামনে চর মেরেছিল সেবার! তাকে সেখানে রেখে আসলে তো অনেক মারবে! পাতাকে দিয়ে সংসারের কাজ করাতো না কেউ। তার দায়িত্ব ছিল প্রিয়, ফরহাদের দেখাশোনা! বলা চলে পাতার কোলে পিঠেই বড় হয়েছে দুজন। তাই তো তার নেওটা। তাকে ভালোবাসে। সে যেদিন বাড়ি ছেড়ে আসে সেদিন অনেক কেঁদেছিল দুজন। পাতা কান্নার মাঝেও হাসি পায়। হেসেও দেয়। ও বাড়িতে গিয়ে প্রথম প্রথম কষ্ট লাগলেও ধীরে ধীরে ভালো লাগতে শুরু করে। লতা আপু, লুব ভাই তাকে অনেক ভালোবাসে। লাবনী আক্তারের টা বোঝা মুশকিল। বকবে শাসন করবে! হুট করে কেয়ার করবে। আতিকুর ইসলাম নীরব থাকতো। ও বাড়িতে খাওয়া দাওয়া, পোষাক-আষাকে কমতি ছিল না। উপরন্তু হাত খরচও পেত অনেক । সব মিলিয়ে ভালোই কেটেছে। মাঝে মাঝে পাতা ভাবে ভালোই হয়েছে ও বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছে। পাতা মানিয়ে নিয়েছিল দুই বাড়িতেই। কিন্তু খুব করে চাইতো! রুপকথার মতো তার জন্যও কোনো রাজপুত্র আসুক। তাকে নিয়ে যাক দায়িত্ব নামক বেড়াজাল থেকে এক ভালোবাসার রাজপ্রাসাদে। তার নিজস্ব ব্যাক্তি। যার সবটা জুড়ে শুধুই পাতার অস্তিত্ব থাকবে। তাকে খুব ভালোবাসবে। কিন্তু সেসব হবার ছিল না। তাকে আবার মানিয়ে নিতে হবে। সে মানিয়েও নিবে কিন্তু মানুষটা যেন তার হয়। তাকে বুঝতে চেষ্টা করে।

হঠাৎ কারো পায়ের আওয়াজে সয়ংবৎ ফিরে। ঝটপট বৃষ্টির পানি আঁজলায় ভরে মুখে ঝাপটা দেয়। একাকার হয় দুই বর্ষণের জল।
কাওসার লুঙ্গি হাতে এগিয়ে আসে। পাতার ছোট চুল গুলো টেনে বলে,

-” কি রে এই রোমান্টিক মৌসুমে জামাইকে নিয়ে স্বপ্ন বুনছিস?”

পাতা হেসে বলে,

-” কি যে বল না তুমি!!”

বলে উঠে দাঁড়ায়। কাওছার তাকে ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করে। চোখ লাল হয়ে আছে। কাঁদছিল কি? তবে সেটা জিজ্ঞেস করে না।

-” পাতু তুই কিন্তু এটা মোটেও ঠিক করিস নি। জামাই জামাই বলে ঘুরতি আমার পিছনে অথচ আরেক বুড়ো বেডার গলায় ঝুলে পড়লি? ধরনী সইবে না রে!”

পাতা হেসে তার বাহুতে কয়েকটা আলতো চর মেরে বলে,

-” ওসব বলবে না। আমি তখন ছোট ছিলাম! ওয়ানে পড়তাম।‌ বুঝতাম নাকি। বর বউ খেলায় তুমি আমার বর হয়েছিলে তাই বলতাম এমনি এমনি!”

কাওসার দুঃখি মুখ বানিয়ে বলে,

-” কিন্তু আমি তো সত্যি ধরে নিয়ে সপনে স্মরনে শুধু তোমাই বুনেছি বনপাতা!”

পাতা খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে।

-” হ্যা তোমার গার্লফ্রেন্ড ঝুমুরের কানে যাক! তোমার মাথায় আর চুল থাকবে না।”

-” হয়েছে এমন ভালো ওয়েদারে ওই পেত্নির কথা মনে করিয়ে দিস না।”

বলার সাথে সাথে কাওসারের ফোন বেজে ওঠে। কাওসার ফোন বের করলেই ঝুমু নাম স্ক্রিনে ভেসে ওঠে। কাওসার বড় বড় করে চায়।

-” এই পেত্নির নাম নিলি না? তার কল হাজির! আমি যাই হ্যা! এই রোমান্টিক মৌসুমে একটু প্রেমালাপ করি। তুই ও জামাইকে নিয়ে স্বপ্ন বুনতে থাক”

পাতা হেসে ওঠে। কাওছার কল রিসিভ করে হ্যালো বলতে বলতে চলে যায়। পাতার মুখটা পুনরায় মলিন হয়ে যায়। স্মৃতির পাতায় ভেসে ওঠে পুরনো স্মৃতি। কাওসার ভাইকে জামাই ডাকার জন্য ফাতেমা চাচির কথার বাণ! দাদির হাতে কাঁচা কুঞ্চির আদর। নাহ আর মনে করতে চায় না সে। ওড়না দিয়ে ভেজা মুখ মুছে নেয়। পা বাড়াবে তখনই গেট খুলে কেউ ভিতরে ঢুকে ছাতা হাতে। পাতা দেখে তিনজন লোক। রহিম মিয়া ও করিম মিয়া। অপর জনকে চেনে না। তারা বারান্দায় আসে চটজলদি। ছাতা পাশে রাখে। করিম আগে পাতাকে দেখে বলে,

-” আরে পাতা যে! কখন এসেছিস? ভালো আছিস?”

পাতা হেসে বলে,

-” এই তো দুপুরের দিকে এসেছি। ভালো আছি। তুমি ভালো আছো ছোট আব্বা?”

করিমা মাথা নাড়ে। ভালো আছে সে। পাতা রহিমের দিকে তাকিয়ে বলে,

-” বাবা তুমি কেমন আছো?”

রহিম মিয়া মাথা নাড়িয়ে বলে,

-” ভালোই। তুই?”

-” ভালো!”

পাশের লোকটি পাতাকে ভালো করে দেখে রহিম মিয়াকে উদ্দেশ্য করে বলে,

-” এটা তোমার মাইয়া? তোমার মাইয়া তো প্রিয়! এইডা কিভাবে?”

রহিম মিয়া ইতস্তত বোধ করে। মাথা চুলকিয়ে বলে,

-” মনসুর ভাই আমার না। আমার ভাইরার মাইয়া। পাতা নাম। প্রিয়োর মতো বাবা বলে ডাকে মাঝে মধ্যে।”

পাতা মুচকি হেসে বাবার দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়ে। তার হাসির মাঝে লুকায়িত বেদনা নজরে আসে না রহিম মিয়ার। মনসুর লোকটি পাতাকে আরেকবার দেখে নেয়। বেশ দেখতে মেয়েটি। সে পাতাকে জিজ্ঞেস করে,

-” কোন কেলাসে পড় তুমি?”

পাতা চোখ উল্টিয়ে বিরক্ত প্রকাশ করে।

-” আমি একজন শিক্ষক। স্নাতক শেষ করেছি প্রায় দুই বছর হবে!”

লোকটি চোখ যেন উজ্জীবিত হয়। রহিমের দিকে তাকিয়ে বলে,

-” বিয়ে টিয়ে হইছে নি? আমার হাতে ভালো প্রস্তাব আছে!”

রহিম তার কাঁধে হাত রেখে বলে,

-” বিয়ে হইছে।”

লোকটির উজ্জীবিত চোখ মুখ চুপসে যায়। পাতা হন হন করে চলে যায় তাদের তোয়াক্কা না করেই। ঘরে গিয়ে দেখে পাভেল এখনো অরুণ সরকারের গল্প শোনাচ্ছে ফরহাদকে। সব আজগুবি গল্প যার কোনো অস্তিত্বই নেই।অথচ ফরহাদ হা করে গিলছে। প্রিয় তার ব্যাগ থেকে জামাকাপড় বের করে ওয়্যাড্রবে রাখছে। পাতা তার কাছে এগিয়ে গিয়ে বলে,

-” কাপড়চোপড় রাখছিস কেন ভিতরে?”

প্রিয় কপালে ভাঁজ ফেলে বলে,

-” বাহ রে! থাকবে না এখানে কয় দিন! শোন পাতুপু এবারের ঈদ এখানেই কাটিয়ে যাবে বলেদিলাম। তোমার কোনো ভংচং শুনবো না।”

পাতা শান্ত চোখ চায়। সে কিছুদিন থাকার ভাগ করেই এসেছিল। কিন্তু থাকবে না আর। কেন থাকবে? বাবা এতবার কল করে ডেকে আনলো এখন লোকের সামনে বলে কিনা ভাইরার মেয়ে!! দাদির কথা তো বাদই দিল!

-” শুনতে হবে! আমি কালই চলে যাবো!”

প্রিয়ো বড়বড় করে চায়।

-” একদম না। আমি জানি তুমি কিছুদিন থাকবে বলেই এসেছো! জামাকাপড়ও এনেছো। আর কাল গেলে লুব ভাই আজ যেত না! এই সত্যি করে বলো দাদি কিছু বলেছে? বুড়িটার চুল টেনে ছিড়বো!”

পাতা অস্থির প্রিয়কে থামায়। মেয়েটা এতো চঞ্চল। ফরহাদ, পাভেল এদিকে চেয়ে আছে। কিছু বলবে তার আগেই পাতা বলে,

-” এই চুপ! কেউ কিছু বলে নি। দাদিও না। উনি কল করেছিল। জলদি যেতে বলেছে। কালই যত শিঘ্র সম্ভব। তাই থাকা সম্ভব না!”

পাভেল রসিকতার সুরে ভ্রু নাচিয়ে বলে,

-” উনি টা কে পাতা আপু?”

পাতা কাপড় গুলো পুনরায় ব্যাগে ভরে বলে,

-” তোদের দুলাভাই বুঝলি!”

ফরহাদ,পাবেল ‘ওহ হো’ বলে চিল্লিয়ে ওঠে।
প্রিয়র রাগ উঠে লোকটার উপর। লোকটা পাতা আপুকে তাদের সাথে থাকতে দিবে না! সে হন হন করে বেড়িয়ে যায় ঘর থেকে। পাতা ডাকে শোনে না।
_________

পেরিয়ে গেছে দুদিকে। এই দুদিন টানা বর্ষণের পর স্বস্তি মিলেছে। বৃষ্টি ভালো লাগলেও টানা‌ দু একদিনের বর্ষণ অনেকের পছন্দ নয়। অনেকের জীবিকা নির্বাহের পথ বন্ধ হয়ে যায় বিশেষ করে যারা দিন আনে দিন খায় তাদের। কেননা কাজে না গেলে তাদের পেটেও কিছু পড়ে না। তাদের জন্য এমন সময় খুবই কষ্টকর। আজ আর বৃষ্টির দেখা মিলে নি। আকাশও পরিষ্কার,মেঘের ছিটেফোঁটাও নেই। সূর্য মামার উপস্থিতিতে রৌদ্রোজ্জ্বল দিন কেটে এখন সাঁঝ বেলা। আবছা আবছা অন্ধকার বিরাজমান ধরনীতে। অরুণ ছেলের হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে আইসক্রিম স্টলের সামনে একটু দূরে। দুজনেই একই ড্রেসআপে। সাদা শার্টের উপর কালো কোট! টাই বেঁধে একই সুট বুটে বাপ ছেলে! ভোরের জ্বর সেদিন রাতেই ছেড়েছে আর আসেনি। এখন পুরোপুরি সুস্থ, তবে ঠান্ডা আছে। সেটা ওর পুরনো বন্ধু। তারা এখন উপস্থিত আছে এক আত্মীয় বাড়িতে। রুবির দাদুর বাড়ি। রুবির একমাত্র ভাইয়ের দুইমাত্র জমজ মেয়ে আছে। তাদের জন্মদিন উপলক্ষে। সে মোটেও আসতে চায় নি। কিন্তু রুবি এখানে একটু চালাকি করেছে! ভোরকে ফুঁসলিয়ে ফাসলিয়ে রাজি করিয়েছে। এখন জেদি ভোরের আবদারে সে রাজি হতে বাধ্য! ফলাফল সরূপ বাপ বেটা এখানে। রুবি , আরিয়ান, আনিকা ও রুপক এসেছে। আসমা বেগম ও আদুরি আসতে পারে নি দরকারি কাজে। অরুণ ছেলেকে নিয়ে এদিক সেদিক হাঁটছে। অনুষ্ঠান এখনো পুরোপুরি শুরু হয় নি। এখনো অনেক গেস্ট আসা বাকি! ভোর অরুণের সাথে পা মিলিয়ে চলছে আর এটা ওটা জিজ্ঞেস করছে!

আব্বু ওটা কি? আব্বু ওটা এমন কেন? আব্বু ওনার পেট ওতো মোটা কেন? পেটে কি বাবু আছে? ছেলেদের পেটেও বাবু হয়? আব্বু ওই আন্টিটাকে ভুত ভুত লাগছে, মুখে কি দিয়েছে?

আরো কতশত। অরুণ কখনো জবাব দেয় কখনো না। ভোরের এতে হেলদোল নেই সে প্রশ্ন করতে আগ্রহী। হাঁটার মধ্যে হঠাৎ ভোরের নজর যায় আইস্ক্রিম স্টলের দিকে। যেহেতু এটা‌ বাচ্চাদের পার্টি তাই আইসক্রিম স্টল থাকবে না এটা মেনে নেওয়া যায়? ভোর দেখে স্টলের সামনে আনিকা , বার্থডে গার্লস প্রীতি প্রেমা সহ আরো অনেক বাচ্চা আইসক্রিম খাওয়ার প্রতিযোগিতায়। ভোর বাবার হাত ঝাঁকিয়ে আবদার করে,

-” আব্বু ওই দেখ সবাই আইসক্রিম খাচ্ছে। আমিও খেতে চাই! ওখানে চলো না আব্বু?”

অরুণ আইস্ক্রিম স্টলের দিকে একনজর চেয়ে ভোরকে নিয়ে অন্যদিকে হাটা দেয়। ভোর চিল্লাচিল্লি করতে শুরু করে আইসক্রিম খাবে বলে। অরুণ গম্ভীর শান্ত কণ্ঠে ধমক দেয়,

-” এই চুপ!কাল জ্বর সারলো, সর্দি নাকের ভিতর নিয়ে ঘুরছে আর উনি আইসক্রিম খাবে! সব সময় জেদ করবে না। আমি কিন্তু বকবো?”

ভোরের মুখ কাঁদো কাঁদো হয়ে যায়।

-” আব্বু একটা খাবো বেশি না। প্লিজ? ও আব্বু?”

অরুণ চোখ রাঙায়। ভোর চুপ করে। ঘার ঘুরিয়ে আনিকাদের দিকে চায়। কি মজা করে আইসক্রিম খাচ্ছে ওরা। সে মুখ ফুলিয়ে বাবার হাত ছেড়ে হাঁটতে থাকে। অরুণ হাত পকেটে পুরে বলে,

-” গাল ফুলিয়ে লাভ নেই। আমি এলাও করবো না!”

ভোর কিছু বলে না। অরুণ ভোরের পিছু পিছু হাঁটতে থাকে। ভোর সামনে একটা চেয়ারে উঠে গালে হাত দিয়ে ছলছল চোখে বসে থাকে। অরুণ কিছু বলে না। তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকে। ভোর ঘার ফিরিয়ে বার বার আনিকাদের দিকে তাকায়। অরুণ দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। এই ছেলেটাও না!

-” ওদিকে বার বার তাকাচ্ছো কেন?

ভোর আবার সেদিকে তাকিয়ে বলে,

-” আমার চোখ আমি তাকাবো!”

-” আবার তাকাচ্ছে! লোকে কি বলবে? ছোঁচা ছেলে!”

-” তুমি ছোঁচার আব্বু!”

বলে ভেংচি কাটে। অরুণ শান্ত দৃষ্টিতে চায় অভিমানী ছেলের দিকে। যতই অভিমান করুক এই আবদার মানবে না। হেলথের সাথে কোনো আপোস নয়।

-” কাল রাতে তোমাকে কত বড় সারপ্রাইজ দিলাম! তারপরও কিভাবে আবদার করো?”

ভোর বাবার দিকে চায় ঘার উঁচিয়ে। তারপর চেয়ারে পা তুলে দাঁড়ায়। তবুও নাগাল পায়না অরুণের। ইশ আব্বুটা এতো লম্বা! সে কবে এতো বড়‌ হবে! সে অরুণের দিকে আঙ্গুল তুলে বড়দের মতো করে বলে,

-” আমি তোমার সারপ্রাইজের কথা বিশ্বাস করি না আব্বু! তুমি আমায় বাচ্চা ছেলে পেয়ে বোকা বানিয়েছো! তেতো ওষুধ খাইয়েছো! এখন আমার আইসক্রিম চাই! চাই চাই চাই!”

শেষে এক প্রকার চিল্লিয়ে বলে। আশেপাশের লোক এদিকেই তাকিয়ে অদ্ভুত চাহনিতে। অরুণ তাদের চাহনি লক্ষ্য করে ভোরকে চোখ রাঙানি দেয়। আঙুল নামিয়ে দিয়ে কড়া সুরে বলে,

-” এই চুপ! বেয়াদবি করবে না। না বলেছি না? আর কথা নয়। আরেকবার আইস্ক্রিমের কথা বললে ঘার ধরে বাড়ি নিয়ে যাবো!”

ভোরের গোল গোল আঁখি যুগল ভরে ওঠে। নাকের পাটা ফুলে ওঠে।চেয়ার থেকে নেমে দৌড়ে চলে যায়। অরুণ তার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রয়। এই ছেলে এতো ছিঁচকাদুনে!! কিচ্ছু বলাও যাবে না। সে পিছন পিছন যায়। কিন্তু ভোরের নাগাল পায় না। গম্ভীর মুখে আশেপাশে খুঁজতে থাকে। ফুলের বাগানের ওদিকে যেতেই হাসির শব্দ শুনতে পায়। তার পদযুগল থেমে যায়। একটু বেঁকে পাশে তাকাতেই কারো ব্যাক সাইড দেখতে পায়। কোনো মেয়েলি কায়া। অরুণ নজর সরায়। সামনে হাঁটতে শুরু করলেই কিছু স্মরণে আসায় থেমে যায়। পিছু এসে আবার সেখানে দাঁড়ায়। মেয়েলি কায়ার দিকে আবার চায়। চেনা চেনা লাগছে। তার কপাল কুঞ্চিত হয়।

অরুণ খানিকটা এগিয়ে যায়। মেয়েটির এক সাইড দৃশ্যমান হয়। অরুণের কুঞ্চিত কপাল শিথিল হয়। এ যে মিস পাতাবাহার! কিন্তু এখানে? সে পাতার দিকে খেয়াল করে। লং গাউন পড়ে ওড়না একপাশ দিয়ে নিয়েছে। মাথায় হিজাব। মুখশ্রী পুরো দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু একটু লম্বা লাগছে। সে পায়ের দিকে চায়। ওহ্ ! উঁচু জুতোর কামাল! সে এগিয়ে যেতে নেয় কিন্তু সামনের দৃশ্য দেখে পা থেমে যায়। চোয়াল শক্ত হয়। পকেটে হাত পুরে সেখানেই দাড়ায়। মিস পাতাবাহার একা নয়। সাথে আরেকজন আছে। সাতাশ আটাশ বছরের যুবক। যার বাহু ধরে পাতা দাঁড়িয়ে। ঠোঁটে মুচকি হাসি। অরুণ হনহন করে চলে আসে সেখান থেকে। মেজাজটা বিগড়ে আছে তার। সে ভোরকে দেখতে পায়। ওইতো ওখানে। পকেটে হাত দিয়ে হাঁটছে গম্ভীর মুখে। সে এগিয়ে যাবে তখন রুবির ভাই আসলাম ডাক দেয়,

-” আরে ভাই। কোথায় থাকেন? এদিকে আসুন।”

অরুণ বিরক্ত হলেও এগিয়ে যায় ভদ্রতার খাতিরে। লোকটি তাকে পরিচয় করিয়ে দেয় সামনে উপস্থিত ব্যাক্তিদের সাথে। তারপর গল্প জুড়ে দেয়।
_____

-” আরে ইয়ার! তোর এতো সুন্দর সুইট কিউট কাজিন আছে আগে বলিস নি? বললে কবে পটিয়ে নিতাম!”

পাতা অস্বস্তিতে পড়ে। কাওসার বন্ধু বাদলের পেটে আস্তে ঘুষি দেয়।

-“শালা ফ্লার্ট বন্ধ কর! ও মিঙ্গেল! জামাই আছে!”

বাদল বুকে হাত দিয়ে কাঁদো কাঁদো গলায় বলে,

-” ইশ! দিল টুট গায়া! ক্রাশ খাওয়ার সাথে সাথেই ছ্যাঁকা খেলাম!”

পাতা মুচকি হাসে। কাওসার ভাইয়ের সাথে এসেছে এখানে। কাওসার ভাইয়ের দুঃসম্পর্কের কি যেন হয় তার নাতনিদের জন্মদিনে। তার সাথে কাওসার ভাই তাদের গৃহ শিক্ষক ছিল । সেই সুবাদে জন্মদিনের দাওয়াত পায়। আত্নীয় মানুষ, হোক দুঃসম্পর্কের! দাওয়াত দিয়েছে, না আসলে কেমন দেখায় তাই আসা। পাতাকেও বগলদাবা করে এনেছে।আর কাওসারের বন্ধু বাদল বার্থডে গার্লসদের মামা হয়। পাতা গতকাল বাড়ি ফিরে যেতে চেয়েছিল কিন্তু প্রিয়র জেদের কারণে যেতে পারে নি। থাকতে হয়েছে। কিন্তু কাল তার যাওয়া কনফার্ম। আর থাকবে না। সে কাওসারের বাহু টেনে একটু দূরে যায় ফাঁকা জায়গায়। মিনমিন করে বলে,

-” ভাই চলো এখান থেকে। এতো বড়লোক দের ভিড়ে অস্বস্তি হচ্ছে।”

কাওসার তার মাথায় গাট্টা মেরে বলে,

-” বড়লোকের বউ হয়েছিস। কয়েকদিন পর তাদের ভিড়েই থাকবি এখন থেকেই শিখে নে!”

পাতা কটমট করে চায়। কাওছার হেসে বলে,

-” কেক কাটলেই চলে যাবো। একটু অপেক্ষা কর মেরে বেহনা!”

পাতা হেসে দিল। কাওছার তাকে নিয়ে আবার আড্ডায় যোগ দিল।দূর থেকে যে একজোড়া চোখ তাদের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে পর্যবেক্ষণ করছিল সেদিকে ধ্যান নেই তাদের। কিছুক্ষণ আড্ডা দিয়ে আড্ডা থেকে বেরিয়ে তারা হাঁটতে থাকে চারিপাশ। রাতের অন্ধকারেও চারপাশ ঝলমলে করছে । সব ডেকরেশনের কামাল! হঠাৎ একজন মহিলা ডাক দেয় কাওসারকে। কাওসার পাতাকে বলে,

-” আমি আসছি। দাঁড়া তুই এখানে। এক পাও নড়বি না।।”

চলবে…..