পাতা বাহার পর্ব-২৩+২৪

0
821

#পাতা_বাহার
লেখনীতে: #বেলা_শেখ
#পর্ব- ২৩
(কপি করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ)

চারদিক ঝলমল করছে কৃত্রিম আলোর প্রভাবে। রাত হলেও এমন ভাবে আলো ছড়াচ্ছে মনে হচ্ছে দিনের বেলা। সুন্দর ডেকোরেশন করেছে গার্ডেন এরিয়ায়। কৃত্রিম ফুলে সজ্জিত বিভিন্ন পিলার , গাছ! হরেক রঙের বেলুন ঝুলছে। অনেক দুষ্টু বাচ্চারা সেগুলো ফাটিয়ে শব্দ সৃষ্টি করছে। গার্ডেনের লাস্ট মাথায় বিভিন্ন কার্টুন যেমন: মটু-পাতলু, ডরিমন, ওগি, শিভা ইত্যাদির পাপেট দাঁড়িয়ে হাসিমুখে। বাচ্চাদের দল তাদের সাথে সেলফি তুলছে। মটুর পেটে গুঁতো মারছে তো ওগির লেজ ধরে টানছে। সেখানে পার্টি লাইট জ্বলছে সাথে মিউজিক। অনেক বাচ্চা গানের তালে নাচছে। পাতা তাদের নাচ দেখে মুখে হাত দিয়ে হাসে। সেখান থেকে নজর ঘুরাতেই অরুণ সরকারকে দেখতে পায়। তার নেত্রযুগল আপনা আপনি বড় হয়ে যায়। এই লোক এখানে? কিভাবে সম্ভব! আবার তার দিকেই তাকিয়ে আছে যেন চোখ পাকিয়ে শাসাচ্ছে! আচ্ছা তাকে দেখছে নাকি আশেপাশের কেউ? নাহ তার দিকেই তো তাকিয়ে। পাতা হাত নাড়িয়ে হায় জানায়। অরুণ নজর ফিরায়। পাতার ভ্রু যুগল কুঁচকে যায়। সত্যিই লোকটা অরুণ সরকার ওরফে নাক উঁচু ম্যানারলেস লোক তো? নাকি তার মতোই দেখতে অন্যকেউ? ভাই টাই ও হতে পারে! নাক উঁচু লোক হলে তো তাকে দেখে কোনো প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতো! আর আশেপাশে ভোরকেও দেখছে না‌। নিজের ভাবনায় নিজেই অবাক হয় পাতা! সে পাগল হয়ে যায় নিতো! কি সব ভাবছে। ওটা নাক উঁচু লোকই। তার ষাঁড়ের মতো মুখশ্রী দেখেই চেনা যায়। পাতা হালকা ইতস্তত বোধ করে এগিয়ে যায়। লোকটা কিছু লোকদের সাথে দাঁড়িয়ে কথা বলছে হয়তো! সবাই সুট বুট পরা ধনীর দুলাল কি না! পাতা অস্বস্তি নিয়ে এগিয়ে যায় ধীর পায়ে। হাতের পার্সটা ওড়নার আড়ালে নেয় কৌশলে। পার্সটা একটু পুরনো। পাতা অরুণের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। গলা কাঁপছে কেমন যেন! কথার খেই হারিয়ে ফেলেছে।এসেছে তো কিন্তু কি বলবে ভেবে পাচ্ছেনা। আবার লোকটাও তার দিকে তাকাচ্ছে না। অথচ উপস্থিত সকলে তার দিকে চেয়ে আছে, একজন মহিলাও আছে। সে ভাবে চলে যাবে। কিন্তু যায় না। ঠোঁটে হালকা হাসি ঝুলিয়ে অরুণকে উদ্দেশ্য করে বলে,

-” আপনি এখানে? ভোর এসেছে?”

বলেই ঢোক গিলে পাতা। অরুণ একপল তার দিকে তাকিয়ে আসলাম কে বলে,

-” আসলাম মেহমান আসা শেষ? কেক কখন কাটবে ?”

স্পষ্টতই ইগনোর। পাতা সেদিনের স্টেশনারির কথা মনে পড়ে। এভাবেই ইগনোর করে চলে গিয়েছিল লোকটা। সে আর কিছু বলে না। পা ফিরিয়ে চলে আসে হনহন করে। লজ্জা অপমানে কপোলদ্বয় রক্তিম।

পাতা যাওয়ার দিকে সকলে চেয়ে। অরুণ নির্বিকার। আসলাম বলে,

-” অরুণ ভাই চেনেন নাকি?”

অরুণ তার দিকে তাকিয়ে গম্ভীর গলায় বলে,

-” হুম!”

উপস্থিত লোকের মধ্যে একজন বলে,

-” তাহলে কথা বললেন না কেন? মেয়েটা কিভাবে চলে গেলো?”

অরুণ জবাব দেয় না। আসলাম হেসে বলে,

-” ভাইয়ের এক্স নাকি? হুম?”

-” ওয়াইফ!”

সবাই অবাক হয়। আসলাম অবাক সুরে বলে,

-” এটা তো বর্ষা ভাবি নয়! আমি চিনি তাকে!”

অরুণ পকেটে হাত ঢুকিয়ে বলে,

-” ইটস কমপ্লিকেটেড! সময় হোক জানতে পারবে! বাট সি ইজ মায় ওয়াইফ! আসছি!”

বলে চলে যায়! সবাই অবাক হয়! আরে বেটা বউ হয় তো কথা‌ বললি না কেন?
____

পাতা থমথমে মুখে হাঁটতে থাকে। কোথায় যাচ্ছে ধ্যান নেই। শুধু হাঁটতেই থাকে। লোকটা এভাবে ইগনোর করে সবার সামনে অপমান করতে পারলো! এর আগেও করেছে। তখন তো তাদের মধ্যে সম্পর্ক ছিল না তাই মানা যায়।কিন্তু এখন আছে! ধর্মীয় মোতাবেক তার স্ত্রী সে। হ্যা লোকে জানে না। তাই বলে সৌজন্যের খাতিরেও কথা বলা যাবে না? পাতা তুই এই লোকের সাথে সারাজীবন কাটাবি কি করে! আচ্ছা এমন করার কারণ কি! পাতার মাথা ঝুঁকিয়ে নিজের দিকে চায়। হাতের পার্স , পরণের জামা, জুতা সব দেখে। এসবের জন্য কি? কমদামি সাজসজ্জার জন্য!! পাতা পাশে দাঁড়িয়ে থাকা দুজন মহিলার দিকে তাকায়। দামি পাতলা সিল্কের শাড়ি গায়ে জড়িয়ে অপরজন ওয়েস্টার্ণ পড়ে। হাতে দামি পার্স, ঘড়ি! মুখে ভারি মেকাপ! বেশ ভালো লাগছে দেখতে। পাতা মলিন হাসে! ওদের সামনে সে কেউ না। তাই হয়তো লোকটা সবার সামনে ইগনোর করলো। পাতা সবসময় কোনো অনুষ্ঠানে গেলে অন্যের সাজসজ্জা ও পোষাক দেখে হিনমন্যতায় ভোগে।এটা তার একটা সমস্যা বলা যায়। পাতা নিজেও জানে এটা ঠিক না। মানুষের পোষাক কখনো তার যোগ্যতার পরিচয় দেয় না। মানুষের আচরণ কথাবার্তায় ফুটে ওঠে তার ব্যক্তিত্ব। পাতা অন্যমনষ্ক হয়ে হাঁটতে হাঁটতে একজনের সাথে ধাক্কা লাগে। পাতা সরি বলবে কিন্তু তার মুখশ্রী দেখে খানিকটা ভাবনায় পড়ে। মুখের আদলটা চেনা চেনা! হ্যা অরুণ সরকারের মতোই।

আরিয়ান আইসক্রিম লেগে যাওয়া শার্টের দিকে তাকিয়ে রাগি মুখে সামনের রমনীর দিকে চায়। সে ভোরের জন্য আইসক্রিম নিয়ে যাচ্ছিলো। একটু মেল্ট হয়ে গেছে। এটা ওতটাও ঠান্ডা হয় না। কিন্তু এই মেয়েটা! সে কড়া সুরে বলে,

-” এই মেয়ে দেখে চলতে পারো না। চোখ আসমানে রেখে হাঁটো? স্টুপিড কোথাকার!”

পাতা শান্ত চোখে চায়। মানছে তার দোষ আছে তাই বলে এভাবে বলবে।

-” দেখুন আমার দোষ আছে মানছি। তার জন্য দুঃখিত।তাই বলে এভাবে বলতে পারেন না। দোষ আপনারও আছে।”

আরিয়ান ফুঁসে ওঠে।একে তো তার পার্টির ড্রেস নষ্ট করে দিল তার উপর এটিটিউড দেখাচ্ছে।

-” আমি চোখ কান খোলা রেখেই হাঁটছিলাম। তুমি হুট করে সামনে এসে ধাক্কা দিলে।আবার সাফাই গাইছো যে আমার দোষ আছে!”

পাতা বিরক্ত হয়ে বলে,

-” হয়েছে সব দোষ আমার খুশি? ছেলেমানুষ এতো ঝগরুটে হয় জানতাম না!”

আরিয়ান তেড়ে আসে।রুবি তার বাহু ধরে থামায়। আরিয়ান পাতার দিকে আঙুল তুলে শাষানো ভঙ্গিতে বলে,

-” তোমার সাহস কি করে হয় আরিয়ান সরকারকে ঝগরুটে বলার। এইটুকু মেয়ে আবার বড় বড় কথা! ভারি বেয়াদব তো তুমি। তোমার গার্ডিয়ান ডাকো ?”

পাতা চোখ বড়বড় হয়ে যায়। কি নাম বললো? আরিয়ান সরকার! ওই নাক উঁচু লোকটার আত্মীয় হবে! স্বভাব চেহারা দুটোতেই মিল আছে। পাতা ক্লোজ আপ হাসি দেয়।

-” দেখুন মি. আমি স্কুল পড়ুয়া বাচ্চা নই যে গার্ডিয়ান নিয়ে ঘুরব। আমি এক স্বনামধন্য স্কুলের শিক্ষিকা! আর হ্যা কখন থেকে তুমি তুমি করছেন? অপরিচিত কাউকে প্রথম দেখায় তুমি বলা কেমন ভদ্রতা?”

বলে আর দাঁড়িয়ে থাকে না। হালকা এটিটিউডের সাথে মাথা উঁচু করে চলে যায়। আরিয়ানের চোয়াল ঝুলে যায়। সে রাগে কটমট করে রুবির দিকে চায়।

-” এইটুকুনই মেয়ে! কলেজই পার করে নি বোধহয় বলে কি না স্কুলের শিক্ষিকা! এই আজকালকার মেয়েরা এতো বেয়াদব যা বলার বাহিরে। এই তুমি হাসছো কেন?”

রুবির হাসি দীর্ঘ হয়। হাসতে হাসতে আরিয়ানের বাহু জড়িয়ে বলে,

-” তুমি আসলেই একটু ঝগরুটে বুঝলে সরকার!মেয়েটা ঠিক বলেছে”

আরিয়ান ঝটকা মেরে তার হাত সরিয়ে হনহনিয়ে চলে যায়। রুবির হাসি কমে না।

পাতা রাগে গজগজ করতে করতে আইসক্রিম স্টলের দিকে আসে। শালার সরকার গুষ্টি সুদ্ধই অহংকারী। অহংকারে পা যেন মাটিতে পড়ে না। অরুণ সরকার গোমড়া মুখো ক্ষ্যাপা ষাঁড়। আর এটা ঝগরুটে বলদ! লাফায় বেশি শালা! বাকি নমুনা গুলো না জানি কোন গোয়ালের! হাঁটতে হাঁটতে সে আবার ধাক্কা খায়। দাঁতে দাঁত চেপে কিছু বলবে কিন্তু তার আগে ঝাড়ি পড়ে।

-” এই তোকে না বললাম ওখানেই দাঁড়িয়ে থাকবি এক পাও নড়বি না। অথচ তুই ড্যাং ড্যাং করে ঘুরে বেড়াচ্ছিস! এক চটকানা লাগাবো!”

পাতার গাল ফুলায়। সামনে একটা বাচ্চাকে দেখতে পায়। ফরমাল পোষাকে ভোর সরকার! কালো প্যান্ট,ব্লেজার, টাই ও ভিতরে সাদা শার্ট। পকেটে হাত ঢুকিয়ে গম্ভীর মুখে হাঁটছে। একদম বাবার মতো, পুরাই জেরক্স কপি। যেন ছোট্ট অরুণ সরকার। পাতা ডাকে না শুধু তাকিয়ে দেখে তার গতিবিধি। এদিকে ওদিকে ঘুর ঘুর করছে। বারবার আইসক্রিম স্টলের সামনে বাচ্চাদের দিকে তাকাচ্ছে।
কাওছার পাতার বাহু ধরে ঝাকুনি দেয়।

-” কি রে কোথায় হারিয়ে গেলি। আমি বকছি কানে ঢুকছে না?

পাতা নজর হাটায় না। ভোরের দিকে ইশারা করে। কাওসার সেদিকে চায়। পাতা মুচকি হেসে বলে,

-“কাওসার ভাই ওই বাচ্চাটা কালো সুট বুট পরে পকেটে হাত গুজে আছে। দেখেছো?”

কাওসার দেখে বলে,

-” হুম! চিনিস?নাকি পছন্দ হলো?”

পাতা তার বাহু জড়িয়ে বলে,

-” আমার ছেলে বুঝলে!”

কাওছার তাকে ছাড়িয়ে মাথায় গাট্টা মেরে বলে,

-” হ্যা। তোর ছেলে ! আল্লাহ পাক মাত্রই আকাশ থেকে ঢিল দি..”

বলতে বলতে থেমে যায়। পাতার দিকে তাকায় প্রশ্নাত্মক চাহনিতে। সে যা ভাবছে তাই কি? পাতা মুচকি মাথা নাড়ে। যার অর্থ তাই! কাওছার বাচ্চাটার দিকে চায়। বেশ দেখতে! কিউট বিড়াল ছানার মত! দেখলেই আদর করতে মন চাইবে। পাতা হেসে বুকে হাত গুটিয়ে ভোরের দিকে চায়।

ভোর পকেট থেকে হাত বের করে ব্লেজার খোলার চেষ্টা করে। গরম লাগছে তার। কিন্তু খুলতে পারছে না। তার রাগ লাগছে সাথে কান্নাও পাচ্ছে। চাচ্চু বলেছিল আইসক্রিম আনবে। কিন্তু কই আইসক্রিম!! সে মুখ ফুলিয়ে আইসক্রিম স্টলের দিক এগোতে থাকে। সেই চেয়ে নেবে ওই আঙ্কেলের থেকে। বাবা দেখবে দেখুক! সে টুপ করে মুখে পুরে নিবে, ব্যস হয়ে গেল। সে হনহন করে হাঁটতে গিয়ে থেমে যায়। সামনে মিস পাতা দাঁড়িয়ে! সে চোখ ডলে সত্যি দেখছে নাকি স্বপ্ন! না স্বপ্ন না। ওটা পাতা মিসই। মুচকি হাসছে তার দিকে তাকিয়ে। পাশে কেউ আছে কিন্তু সেটা দেখার সময় নেই তার সে দৌড়ে যায়। পাতা হেসে দু হাত বাড়িয়ে দেয়। ভোর দৌড়ে তার কোলে ওঠে,

-” আসসালামুয়ালাইকুম মিস!কেমন আছো? তুমি এখানে? আমার জন্য এসেছো? আব্বু ডেকে এনেছে তোমায়? কথা বলছো না কেন?”

পাতা হেসে ওঠে।এতো চঞ্চল এই বাচ্চাটা! তার তো সন্দেহ হয় এতো মিষ্টি বাচ্চা কিনা ওই গম্ভীর মুখো নাক উঁচু ম্যানারলেস লোকটার। নিশ্চয়ই কোনো ভদ্রলোকের থেকে বাচ্চা চুরি করে এনেছে। চেহারায় মিল না থাকলে সে বাচ্চা চুরির কেস ঠুকে দিত কনফার্ম।

-” আরে বাবা আস্তে! কোনটা রেখে কোনটার উত্তর দেব! আচ্ছা তুমি বলো আগে? এখানে কেন তুমি?”

ভোর হেসে বলে,

-” আনিকার কাজিনদের হ্যাপি বার্থডে! তাই এসেছি! আব্বু,চাচ্চু, চাচিমনি, আনিবুড়ি, রুপও এসেছে!”

-” তাই?”

-” হুম। তুমি চলো ওদের সাথে দেখা করিয়ে দেই?”

-” নাহ! অন্যসময়। এখানে একা একা ঘুর ঘুর করছিলে কেন?”

ভোর এবার গাল ফুলায়। আনিকাদের দেখিয়ে অভিযোগের সুরে বলে,

-” মিস দেখো? সবাই আইসক্রিম খাচ্ছে! আব্বুকে বলেছিলাম আব্বু ধমক দিয়ে বলে ঘার ধরে বাড়ি নিয়ে যাবে। তাই রাগ করে চলে এসেছি! আড়ি তার সাথে!”

পাতা হেসে তার গালে চুমু খায়। ভোর অপর গাল এগিয়ে দেয়। পাতা সেখানেও দেয়। ভোর কপাল থুতনিতেও আদর আদায় করে নেয়। পাতা তাকে কোল থেকে নামিয়ে দিলো। চুলের মাঝে হাত বুলিয়ে বলে,

-” জ্বর থেকে মাত্রই সেরে উঠলে।এখন আইসক্রিম খেলে জ্বর বাবাজি আবার হাজির হবে। তাই আইসক্রিম খাওয়া তো ঠিক হবে না ভোর!”

ভোর দু আঙ্গুল দেখিয়ে কাঁদো কাঁদো গলায় বলল,

-” এইটুকুনই খেলেও কি জ্বর আসবে?”

পাতা মুচকি হাসে। আরে এতো সুইট করে বললে তো খুবই মুশকিল! ওর বাবা ধমক দেয় কিভাবে? সে কিছু বলবে তার আগে কাওছার ভোরের গাল টিপে বলে,

-” নাতো কিচ্ছু হবে না। তবে এইটুকুই কিন্তু হ্যা?”

ভোর চেনে না তাকে। সে প্রশ্নাত্নক চাহনিতে পাতার দিকে চায়। পাতা তার চাহনি বুঝতে পেরে বলে,

-” আমার ভাই! তোমার মামা হয়!”

-” তোমার কতগুলো ভাই মিস?”

কাওছার ভোরকে কোলে নিয়ে স্টলের দিকে যেতে যেতে বলে,

-” অনেক গুলো!”
______

পার্টিতে মানুষের ঢল। বিশেষ করে বাচ্চাদের। তারা এদিকে ওদিকে দৌড়াদৌড়ি করছে। বেলুন ফাটাচ্ছে। অরুণ তাদের মাঝে ছেলেকে খুঁজে। সেই যে পালালো আর দেখা নেই। আরিয়ান রুবির কাছেও নেই। আইসক্রিম স্টলের আশেপাশেও খুঁজে পায় নি। অরুণ গার্ডেনের শেষ মাথায় যায়। সেখানে আনিকা, প্রীতি প্রেমাসহ তাদের বন্ধুরা নাচছে। সবার মাঝে আনিকাই ছোট্ট। প্রীতি প্রেমা ক্লাস ফাইভে। তাই তাদের বাচ্চাও বলা যায়। অরুণ তাদের ডেকে হাত নাড়িয়ে জিজ্ঞেস করে,

-” বাচ্চারা? আনিবুড়ি ভোরকে কোথাও দেখেছো?”
লাউড মিউজিকের আওয়াজে কেউ শুনতে পায় না। অরুণ ভিতরে যায়। বাচ্চাদের হইহুল্লোড়ে একেবারে যাচ্ছেতাই অবস্থা। অরুণ গলা উঁচিয়ে জিজ্ঞেস করে কিন্তু কেউ শুনতে পায় না। পাবে কি তাদের নজরেই আসে নি বিশাল দেহি অরুণ সরকার। অরুণ গিয়ে মিউজিক ওফ করে দেয়। এবার বাচ্চারা চিল্লিয়ে ওঠে। অরুণ কানে হাত দেয়। প্রীতি এগিয়ে আসে। অরুণকে দেখে বলে,

-” কি হয়েছে আঙ্কেল?”

অরুণ প্রীতিকে জিজ্ঞেস করে,

-” ভোরকে দেখেছো তোমরা?”

প্রীতি খানিক ভেবে বলে,

-” ওকে তো আইস্ক্রিম স্টলের পিছনে দেখেছিলাম! ওখানেই আছে হয়তো!”

-” থ্যাংক ইয়ু প্রীতি!”

বলে তার মাথায় হাত বুলিয়ে চলে যায় অরুণ। সাথে সাথে মিউজিক অন হয়, বাচ্চারা পুনরায় ‘ইয়ে’ বলে চিল্লিয়ে ওঠে। অরুণ বেরিয়ে এসে সোজা আইসক্রিম স্টলে যায়। একবার খুঁজে পাক কলিজাকে! একদম হাতছাড়া করবে না। সে এগিয়ে যায়। সেখানে গিয়ে দেখতে পায় নবাব কোন আইসক্রিম খাচ্ছে মজা করে। সে একা নয় পাশে আরো দুজন হাসি ঠাট্টায় আইসক্রিমে মজে আছে।

অরুণ সেখানে গিয়ে বুকে হাত গুজে দাঁড়ায়। তিনজনেরই নজর আকর্ষণ করতে সফল হয়। পাতা তাকে দেখেও চুপচাপ আইসক্রিম মুখে পুরে। ফ্রি আইসক্রিম কার না ভালো লাগে! আহা! কাওছার প্রথমে চিনতে না পারলেও ভোরের ড্রেসাপের সাথে মিল দেখে বুঝতে পারে ইনি কে! সে পাতার দিকে চায়। ভোরের চোখ জোড়া রসগোল্লার ন্যায়। সে একবার আইসক্রিম তো আরেকবার বাবার দিকে চায়। তারপর বাকি থাকা অল্প আইসক্রিম গপ করে মুখে পুরে নেয়। গালদ্বয় ফুলে ঢোল!

অরুণ ভোরকে ডাকে,

-” কাম টু মি ভোর!”

শক্ত কঠিন গলা শুনে দ্বিরুক্ত না করে ভোর পাতার দিকে একবার তাকিয়ে অরুণের কাছে যায়। অরুণ কিছু বলে না। রুমাল বের করে ছেলের মুখ মুছে দিয়ে কোলে তুলে নেয়। ভোরের মুখে হাসি ফুটে ওঠে। বাবা বকে নি! সে বাবার গালে চুমু দিয়ে কানে কানে ফিসফিস করে বলে,

-” আব্বু তুমি যে কাল রাতে বড় সারপ্রাইজের কথা বললে সেটা কি সত্যিই? দেখ মজা করবে না!”

অরুণ পাতার দিকে তাকিয়ে জবাব দেয়,

-” হুম!”

ভোর খুশি হয়ে আরেকটা চুমু দেয়। মিটমিট হেসে পাতার দিকে চায়।পাতার ভ্রু দ্বয় কুঁচকে যায় বাপ ছেলে কি গুসুর ফুসুর করছে। এই না বলছিল আড়ি তার সাথে!!

কাওছার এগিয়ে এসে হাত বাড়িয়ে বলে,

-” আপনিই অরুণ সরকার? পাতা বলেছিল! আমি ওর কাজিন কাওছার হাবিব!”

অরুণ গম্ভীর মুখে বাড়ানো হাতের দিকে চেয়ে। পাতা ভিত হয় খানিক। লোকটা কি হাত মেলাবে না? না মেলালে কাওছার ভাইয়ের অপমান হবে। সে নাক উঁচু লোকটাকে ছাড়বে না। অরুণ হাত বাড়িয়ে হ্যান্ডশেক করে। কাওছার হেসে বলে,

-” প্রীতি প্রেমার কি হন আপনি? না মানে..”

-” আমার ভাই জামাই এ বাড়ির! তার শ্যালকের মেয়ে হয় দুজন!”

-” ওহ্!”

অরুণ পাতার দিকে চায় পুনরায়। সেদিকে দৃষ্টি স্থির রেখে কাওছারকে বলে,

-” আপনারা?”

কাওছার হেসে বলে,

-” স্টুডেন্টস ছিল আমার! আর তাছাড়া রমজান দাদু আমার দাদুর খালাতো ভাই ছিল। অনেক দূরের সম্পর্ক!”

-” ওহ আর উনি কি বিনা দাওয়াতে এসেছে নাকি?”

পাতাকে ইশারা করে বলে অরুণ। পাতার চোখ মুখ শক্ত হয়। কাওছার হেসে বলে,

-” কিছুটা তেমনই!”

পাতা কটমট করে বলে,

-” কাওছার ভাই!!”

কাওছার পাতার গাল টিপে বলে,

-” আরে রাগিস ক্যান! জামাইয়ের সামনে হাসি মুখে থাকবি, বুঝলি?”

পাতা চোখ রাঙায়। অরুণের চোয়াল শক্ত হয়। ভোরকে পাতার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলে,

-” ওকে নিন!”

পাতা কাওছারের সামনে কিছু বলে না। কোলে নেয়। পাঁচ বছরের ছেলে ওতটাও ছোট নয়। কোলে নিয়ে থাকা অনেকটা কষ্টকর! আর পাতার মতো চেঙ্গিস খানের পক্ষে আরো কষ্টকর। কাওছার বুঝতে পেরে কোলে নিতে চাইলে অরুণ বলে,

-” ওনার কাছেই থাক! তুমি আসো আমার সাথে? আর মিস পাতাবাহার নামিয়ে দিন। তবে হাত ছাড়বেন না মোটেও!আর এখান থেকে কোথাও যাবেন না”

বলেই পা বাড়ায় অরুণ।‌ কাওছার পাতার দিকে তাকিয়ে ঠোঁট উল্টিয়ে অরুণের পিছু পিছু চলে যায়। পাতা ভোরকে নামিয়ে দিল। হাতটা শক্ত করে ধরে বলে,

-” তোমার আব্বু কোথায় গেল?”

-” কি জানি!”

পাতা ভোরের হাত ধরে অপেক্ষা করতে থাকে। ভোর আইসক্রিম এর দিকে তাকিয়ে বলে,

-” দেখ আইসক্রিম গুলো ডাকছে আমায়। বলছে ভোর এসো আমাদের খাও!”

পাতা ভোরের বলার ভঙ্গি দেখে হেসে দেয় খিলখিলিয়ে। সাথে যোগ দেয় ভোরও। দুজনের হাসিতে মুখরিত পরিবেশ। আশেপাশের অনেকে তাদের দিকে তাকিয়ে । কেউ বাঁকা নজরে তো কেউ বিরক্ত হয়ে। পাতা ভোরের সেদিকে খেয়াল নেই তারা হাসি বিলাস করতে ব্যস্ত।
বেশ সময় নিয়ে অরুণ আসে। ভোরকে কোলে নিয়ে পাতার উদ্দেশ্যে বলে ,

-” ফলো মি!”

বলেই হাঁটা দেয়। পাতার কপাল কুঞ্চিত হয়। কাওছার ভাই কোথায়?ভেবেছিল এই নাক উঁচু লোকটার সাথে কথা বলবে না। কিন্তু কথা না বলার স্কোপ রাখে নি! সে অরুণের সাথে পা মিলিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বলে,

-” ফলো মি মানে? কাওছার ভাই কোথায়?”

অরুণ হাঁটতে হাঁটতে ছোট্ট করে জবাব দেয়,

-” মেরে দিয়েছি!”

পাতার পদযুগল থেমে যায়। চোখ বড় বড় করে জিজ্ঞেস করে,

-” মেরে দিয়েছি মানে? দেখুন একদম ফাজলামি করবেন না। কাওছার ভাইকে ডাকুন?”

অরুণ পিছিয়ে এসে পাতার হাত ধরে একপ্রকার টেনে নিয়ে যায়। পাতা আশ্চর্য হয়ে তার হাতের দিকে তাকিয়ে। যা অরুণ সরকারের শক্ত খসখসে উষ্ণ হাতের মুঠোয় বন্দি! ভাবতেই গা শিরশির করে উঠে। কিন্তু মস্তিষ্কে ভেসে ওঠে কিছুক্ষণ আগের দৃশ্য। সে হাত ছুটাতে চায়। মোচরাতে শুরু করে। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয় না বরং। আরেকটু শক্ত করে চেপে ধরেছে। পাতা দাঁতে দাঁত চেপে বলে,

-” কি হচ্ছে টা কি ছাড়ুন! একটু আগে তো আমায় চিনতেই পারছিলেন না! সকলের সামনে ইগনোর করলেন! আমার মধ্যবিত্ত বেশভূষা দেখে সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে কুণ্ঠাবোধ হচ্ছিলো?”

অরুণ হাঁটা থামায় না। পাতাকে টেনে নিয়ে যেতে যেতে জবাব দেয়,

-” বেশি বোঝেন আপনি!”

পাতা আরো রেগে যায়।

-” হ্যা বেশি বুঝি! কাওছার ভাই কোথায় সেটা বলুন? আশ্চর্য টানাটানি করছেন কেন? লোকে দেখছে!! কি ভাববে?”

-” ওহ্ এখন লোকে দেখছে। তখন বাহু জড়িয়ে হি হি করে হাসছিলেন তখন লোকে দেখছিলো না?”

শক্ত গমগমে আওয়াজ। পাতার ছোটাছুটির প্রচেষ্টা থেমে যায়। লোকটা তাকে দেখেছিল! অরুণের কথাগুলো পুনরায় আওড়িয়ে ভাবে। লোকটা কি কাওছার ভাই ও তাকে দেখে সামহাও জেলাস? কথার টোনে তো সেটাই বোঝা যাচ্ছে, কেমন রাগি রাগি আভাস! তখনও কিভাবে তাকিয়ে ছিল! পাতা অরুণের গম্ভীর মুখশ্রীর দিকে চায়। গোঁফ দাড়িতে ঢাকা চোয়ালদ্বয় শক্ত। তার গলা জড়িয়ে ভোর তার দিকেই তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে। পাতা তার দিকে ছোট ছোট করে চায়। ভোরের প্রতিক্রিয়া সেম। পাতা অরুণকে বাজিয়ে দেখতে বলে,

-” আমার ভাই হয় সে! লোকে দেখলে কি?”

-” কেমন ভাই? আপন তো নয়! ওভাবে ঘোরাঘুরি করলে যে কেউ যা কিছু ভাবতে পারে!”

ফটাফট জবাব অরুণের। পাতা সন্তুষ্ট হয় না।

-” লোকের ভাবাভাবিতে আমার যায় আসে না! আমি ঘুরবো তাতে কার কি হুঁ?”

অরুণ থেমে যায়। পাতার হাত ছেড়ে দিয়ে পাতার কাঁধ জড়িয়ে নেয় নিজের সাথে।

-” অনেকের অনেক কিছু! যা আমার তা পুরোপুরিই আমার! সেখানে অন্যকারো হস্তক্ষেপ সহ্য করবো না! ”

পাতা অবাকের চুড়ান্ত পর্যায়ে। তার ছোট্ট শরীর কেঁপে উঠলো যেন। সবকিছু এতো জলদি ঘটলো যে তার মস্তিষ্ক কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে। তার কথা কিছুই মাথায় ঢোকে নি। শুধু এটুকু বুঝতে পারছে সে লোকটার বাহুতে বন্দি!

অরুণ ছেলেকে একহাতে বুকে জড়িয়ে অপরহাতে পাতাকে বন্দি করেছে। পা চালিয়ে চলতে থাকে গন্তব্যের উদ্দেশ্যে। পাতা চুপটি মেরে অরুণের বাহুতে আবদ্ধ হয়ে রোবটের মতো হাঁটছে। আপাদত সে মনের আঙ্গিনায় সৃষ্ট হওয়া সদ্য অনুভূতির সাথে পরিচিত হচ্ছে।
অরুণ পাতাকে নিয়ে গেটের কাছে চলে আসে। সেখানে এখন মানুষের উপস্থিতি কম। দারোয়ান সহ আরো কিছু গেস্ট দাঁড়িয়ে। বাকি সবাই অনুষ্ঠানে। একটু পরেই কেক কাটা হবে কি না! অরুণ গাড়ির সামনে আসে। তাকে দেখে ড্রাইভার রঞ্জু সালাম দিয়ে ড্রাইভিং সিটে বসে। অরুণ পাতাকে ছেড়ে ছেলেকে নামায়। পাতা যেন জানে প্রাণ ফিরে পায়। তার গলা‌ শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে।একটু পানি পেলে ভালো হতো! অরুণ গাড়ির দরজা খুলে পাতাকে উদ্দেশ্য করে বলে,

-” গাড়িতে উঠুন!”

পাতা নিজেকে স্বাভাবিক করে। কোমড়ে হাত দিয়ে অরুণের দিকে কটমট করে বলে,

-” উঠবো না! কি করবেন আপনি?”

অরুণ দরজা বন্ধ করে দেয়।

-” ভালোয় ভালোয় উঠুন! নইলে?”

-” নইলে কি?”

অরুণ গাড়িতে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে বলে,

-” ভাববেন না কোলে নিয়ে বসাব! ঘার ধরে নিয়ে বসাবো! উঠুন?”

শেষে ধমকেই বলে! পাতা ভয় পায় খানিকটা। স্মরণ হয় শুকলাকে পেটানোর দৃশ্য। তার শুকনো গলা যেন মরুভূমির ন্যায় রুপ ধারণ করে। সে আমতা আমতা করে বলে,

-” দেখুন?”

-” এখন দেখবো না! জলদি উঠুন?”

পাতার চোখ কপালে।এই লোক নাক উঁচু, ম্যানার তো জানেই না। সাথে অসভ্যও! সে ভয় গিলে খায়। আঙ্গুল তুলে শাসিয়ে বলে,

-” অসভ্য বর্বর লোক! বাচ্চার সামনে বাজে কথা হচ্ছে! যাবো না আমি? কি করবেন? জোর করবেন? এমন চিল্লানি দিব পুরো পার্টির মানুষ দু মিনিটে এখানে হাজির হবে! বিশ্বাস হচ্ছে না?”

অরুণ বিরক্ত হয়। যা তার চেহারায় স্পষ্ট। পাতা ভেংচি কাটে। অরুণ চোখ রাঙায়। ভোরকে বলে,

-” উঠতে বলো ওনাকে?”

ভোর বুকে হাত গুজে পাতার মতো ভেংচি কেটে বড়দের মতো বলে,

-” আমি কেন বলবো? তুমিই বলো! আর একটু মিষ্টি করে অনুরোধ করে বলবে।”

অরুণ ভোরের দিকে চায় শান্ত ভাবে। পাতা গালে জিভ ঠেকিয়ে মুচকি মুচকি হাসে। আব আয়া না উঠ পাহাড় কা নিচে!! অরুণ পাতার দিকে তাকিয়ে দরজা খুলে। পাতা ঠোঁটে বিজয়ী হাসি। অরুণ ভোরকে শূন্যে তুলে গাড়িতে বসিয়ে দেয়। তারপর সময় ব্যয় না করে পাতার দিকে খানিকটা এগিয়ে আসে ! পাতার চোখের আকার বড় হয়। অরুণ হাত বাড়িয়ে তার গাল টিপে বাহু ধরে তাকেও বসিয়ে দেয়। তারপর দরজা লাগিয়ে গাড়ির অপর দরজা দিয়ে নিজে প্রবেশ করে ড্রাইভারকে হুকুম দেয়,

-” স্টার্ট দা কার!”

পাতা ভোর হা করে চেয়ে। অরুণ তাদের দিকে তাকিয়ে বাঁকা হেসে সিটে গা এলিয়ে দেয়। ভোর বাবার বাহুতে মারতে মারতে বলে,

-” আব্বু এটা চিটিং! তুমি চিটিং করেছো!”

অরুণ কিছু বলে না। ছেলের ছোট্ট দু হাত নিজের এক হাতের মুঠোয় বন্দি করে। ভোর ছাড়িয়ে গাল ফুলিয়ে বসে। পাতাও গাল ফুলিয়ে অন্যদিকে চায়।

_____

জোৎস্না রাত। গতদিনের তুমুল বর্ষপাতের পর আজ আকাশ পরিষ্কার। তারকারাজি মিটমিটিয়ে হাসছে। শশীরাজ তার ম্লান আলোয় ধরনীকে আলোকিত করার চেষ্টায়। এমন পরিবেশে গ্রামীণ পিচঢালা রাস্তা দিয়ে একটি গাড়ি ধীর গতিতে ছুটে চলছে। গাড়িতে চারজন লোকের উপস্থিতি। ড্রাইভার মঞ্জু যে গাড়ি চালাচ্ছে। ফ্রন্ট সিট ফাঁকা। পিছনের ড্রাইভারের সাইডের জানালার পাশে বসে অরুণ সরকার। ওপাশে পাতা বসে। মাঝখানে ভোর সরকার। পিনপিন নিরবতা বিরাজমান। গাড়ির ইঞ্জিনের শব্দ ব্যাতিত আর কোনো আওয়াজ শোনা যাচ্ছে না। নাহ শোনা যাচ্ছে রাতের পোকার ঝিঁঝিঁ ডাক। অরুণ গম্ভীর মুখে বাইরের দিকে তাকিয়ে। একহাত খোলা জানার গ্লাসে। ভোর চুপচাপ বসে। ঠোঁটে হাসি নেই। পাতা আড়চোখে বাপ বেটাকে পর্যবেক্ষণে ব্যস্ত। চুপচাপ কেন? ওই নাক উঁচু লোক ষাঁড়ের মত মুখ বানিয়ে রাখবে তার জানা!তাই তাকে নিয়ে মাথাব্যথা নেই কিন্তু এই ছোট্ট সাহেবের কি হলো? মুখে হাসি নেই কেন ? আবার দুঃখি ভাবও লাগছে না!সে ভোরের পিঠ পিছন দিয়ে হাত এগিয়ে অরুণের শক্তপোক্ত পিঠে খোঁচা মারে। অরুণ সোজা হয়ে বসে কুঞ্চিত কপালে একবার ভোরের দিকে চায়। ভোরকে চুপ দেখে পাতার দিকে চায়। পাতা ইশারায় ভোরকে দেখিয়ে বোঝায় ‘কি হয়েছে’ অরুণ বিরক্তিকর চাহনি নিক্ষেপ করে পুনরায় বাইরে মনোযোগ দেয়। পাতা কটমট করে চায়! শালা নাক উঁচু ম্যানারলেস লোক! তোর গালে ইয়া বড় পিম্পল হবে দেখেনিস! তারপর ভোরের দিকে অসহায় চোখে চেয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকে। কিছু বলবে এর আগে ভোর পাতার কোলে বসে গলা জড়িয়ে ধরে। পাতা চোখ পিটপিট করে চায়। ভোর মুচকি হেসে পাতার মুখোমুখি হয়ে পলকহীন তাকিয়ে থাকে।কিছু বলে না। পাতা ভ্রু উঁচিয়ে বলে কি? ভোর কিছু বলে না, তাকিয়েই থাকে। পাতা ভোরের গালে চুমু দিয়ে বলে,

-” কি হয়েছে..”

আর বলতে পারে না পাতা। ভোর পাতার গালে হাত বুলিয়ে কপালে চুমু খেয়ে উজ্জ্বল নেত্রদ্বয় স্থির রেখে এক বুক ভালোবাসা নিয়ে ডাকে,

-” আম্মু!”

ডাকটা পাতার কলিজায় লাগে। সে তো কখনো মা হয় নি! মা হওয়ার অনুভূতির সাথে বড্ড অপরিচিত!

চলবে…..

#পাতা_বাহার
লেখনীতে: #বেলা_শেখ
#পর্ব- ২৪

(কপি করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ)

আর বলতে পারে না পাতা। ভোর পাতার গালে হাত বুলিয়ে কপালে চুমু খেয়ে উজ্জ্বল নেত্রদ্বয় স্থির রেখে এক বুক ভালোবাসা নিয়ে ডাকে,

-” আম্মু!”

ডাকটা পাতার কলিজায় লাগে। সে তো কখনো মা হয় নি! মা হওয়ার অনুভূতির সাথে বড্ড অপরিচিত! মা কেমন হয়? লাবনী আম্মুর মতো? যে কিনা বাচ্চা জন্মের আগেই অন্য কাউকে দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়?একমাসের দুধের বাচ্চাকে অন্যের হাতে তুলে দেয়। নাকি পারুল মায়ের মতো? প্রথমে সন্তানের মতো ভালোবাসে! তারপর নিজের সন্তান এলেই ভালোবাসা ফুরিয়ে যেতে শুরু করে তার মাতৃ হৃদয় থেকে। তার মন কুঠুরিতে মা সুন্দর একটি শব্দ উৎকণ্ঠিত হলেই সে ভাবনায় পড়ে মা আসলে কেমন হয়? মায়েদের নিয়ে তার অভিজ্ঞতা খুবই নড়বড়ে। সে কি ভোরের মা, না আম্মু হতে পারবে? বাচ্চাটা কতটা আবেগ ঢেলে তো ডেকে দিল! সে কি তার মর্যাদা রাখতে পারবে? পারুল মায়ের মতো নিজ সন্তান এলে ভালোবাসা কি ফুরিয়ে যাবে না? পাতার মেরুদন্ড বেয়ে এক শীতল স্রোত বইয়ে গেল। নিজের শৈশবের বাজে স্মৃতি স্মরণে আসে। তবে সে নিজের কাছেই প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয় আজকের এই আম্মু ডাকের মর্যাদা সে রাখবে। সাথে সাথে উপর ওয়ালার কাছে আর্জি খারিজ করে, এই ‘আম্মু’ ডাকের মর্যাদা ক্ষুন্ন হয় এমন কাজ যেন তার দ্বারা না হয়।
সে ভাবনা থেকে বেরিয়ে অরুণে দিকে চায়। লোকটা এতো জলদি বলে দিল বাচ্চাটাকে? সে তো ভয়ে ছিল! ভোর বাচ্চা ছেলে। মায়ের কথা মনে আছে, এমনকি দেখাও করে, ভালোবাসে! নিজ চোখে দেখা তার। সেখানে তাকে মায়ের দরজা দিতে পারবে? তাকে এজ আ টিচার পছন্দ করলেও মা হিসেবে নিশ্চয়ই পছন্দ করবে না। রেগে যাবে নিশ্চয়ই? তাকে ছেলেটার মন জয় করতে হবে মা হিসেবে। কিন্তু এখানে সবকিছু অন্যরকম হলো!

অরুণ ভ্রুযুগল কুঁচকে যায়। ভোর পাতার দিকে মুচকি হেসে তাকিয়ে প্রতিক্রিয়ার আসায়! আর এই মেয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে হা করে! আবার পলক ফেলছে না। আম্মু ডাক শুনে ফিট খেয়ে যায় নি তো আবার! সে পাতার দিকে চেপে এসে বসে। নাহ তাও এই মেয়ের হেলদোল নেই। ড্রাইভার মঞ্জু আড়চোখে কয়েকবার তাকিয়েওছে। অরুণ এবার বিরক্ত হয়। আঙ্গুল দিয়ে পাতার নাক চেপে ধরে। সেকেন্ড পঁচিশ বাদে পাতা ঝাঁকুনি দিয়ে উঠে। চোখ পিটপিট করে। অরুণের দিকে চোখ বড় বড় করে চায়। অরুণ ভোরের দিকে ইশারা করে। পাতা ভোরের দিকে চায়। তার কোলে বসে গলা জড়িয়ে তার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসছে। পাতার অধরকোণে হাসি ফুটে ওঠে। ভোরের ছোট্ট আদুরে মুখ খানা আঁজলায় ভরে। ভোরের চোখ উজ্জ্বল হয় সাথে অধরকোণের হাসি ছড়িয়ে পড়ে। পাতা লক্ষ্য করে। ভোরের কপালে অধর ছুঁয়ে চুমু দেয় সময় নিয়ে। ভোর হাসি মুখে পুনরায় ডাকে,

-” আম্মু?”

পাতার চোখ ভরে ওঠে। কেন? জানা নেই। সে ভোরের কপাল হতে অধর সরিয়ে গালে চুমু খেয়ে ভোরকে বুকে জড়িয়ে ধরে। চোখে পানি অন্যপাশে ফিরে মুছে নেয়।
অরুণের বুকটা যেন ভরে উঠলো। তনুমন জুড়ে ভালোলাগার রেশ ছড়িয়ে পড়লো কি?পাতার লুকিয়ে চোখ মোছা দেখে অধরকোণে ফুটে ওঠা হাসি লুকিয়ে গমগমে গলায় বলে,

-” ছিঁচকাদুনে!”

পাতার রাগ হওয়ার বদলে হাসি পায়।

-” মোটেও না!”

-” হ্যা দেখতেই পাচ্ছি!”

পাতা বিরক্ত হয়ে অরুণের দিকে তাকায়।

-” আপনি আমার সাথে ঝগড়া করতে চাচ্ছেন?”

অরুণ পাতার দিকে দৃষ্টি স্থির রেখে জবাব দেয়,

-” না!”

পাতা অরুণের চোখে চোখ রাখে শান্ত ভঙ্গিতে। তাকিয়েই থাকে সরায় না নজর। না পলক ফেলে। অরুণ মৃদু হেসে চোখ সরিয়ে বাইরে তাকায়। পাতা পলক ঝাপটায়।

-” ভোরকে কখন জানিয়েছেন?”

ভোর মাথা তুলে পাতার দিকে হাসিমুখে বলে,

-” কাল রাতে বলেছে আম্মু! আমি প্রথমে একটুও বিশ্বাস করিনি! আব্বু বলে অনেক বড় সারপ্রাইজ দিবে ওষুধ খাওয়ার পর। তাই আমি ওই পঁচা তেতো ওষুধ খেয়ে ছিলাম। তারপর যখন বলল এখন থেকে তুমি আমার আম্মু! আমি একটুও বিশ্বাস করি নি! আব্বু আই লাভ ইওর সারপ্রাইজ! থ্যাংক ইয়ু!”

পাতা তার খুশি দেখে হতভম্ব। এতোটা খুশি? সে ভোরের গালে ঠোঁট ডাবিয়ে চুমু খায়।

-“তাই?”

ভোর মাথা নাড়ে কিউট ভঙ্গিতে। অরুণ তার গাল টিপে বলে,

-” শুধু পাকা পাকা কথা!”

ভোর জিভ বের করে ভেটকায় । পাতা হেসে ওঠে। ভোর পাতার গলা জড়িয়ে বলে,

-” আম্মু এখন তুমি আমাদের সাথে থাকবে! তাই না? আমরা অনেক মজা করবো? তুমি কিন্তু আমার সাথে খেলবে? আম্মু তুমি সাইকেল চালাতে পারো?”

-” হুম । পারি তো!”

-” তাহলে আমাকেও শিখিয়ে দিবে! ঠিকাছে?”

পাতা তার চুল গুলো এলোমেলো করে বলে,

-” তোমার সাইকেল আছে?”

-” নেই! তবে চাচ্চু বলেছে এবার ঈদে আমায় ও আনিকে সাইকেল কিনে দেবে! তুমি বলো শিখিয়ে দিবে?”

-” আচ্ছা বাবা দেব!”

বলে আড়চোখে অরুণের দিকে চায়। নাক উঁচু লোকটা তাদের দিকেই চেয়ে। পাতা চোখ সরিয়ে নিয়ে ভোরকে বলে,

-” তোমার চাচ্চুর নাম কি ভোর?”

ভোর পাতার কোল থেকে নেমে অরুণের কোলে পা তুলে দিয়ে পাতার কোলে মাথা রেখে শুয়ে পাতার দিকে তাকিয়ে বলে,

-” আরিয়ান সরকার। চাচিমনির নাম রুবি! দাদির নাম আসমা বেগম। দাদার নাম অনিক সরকার!”

ভোরের মুখে আরিয়ান নাম শুনে পাতার মুখটা চুপসে যায়। এই আরিয়ান সরকারের সাথে তো সে কোমড় বেঁধে ঝগড়া করে এলো।
অরুণ ছেলের পায়ের শু ,মুজো জোড়া খুলে দিয়ে ছেলের পায়ে চুমু খায়। ভোর পা সরিয়ে নিয়ে হাসতে হাসতে বলে,

-” আব্বু সুরসুরি লাগে তো!”

অরুণ তার পা জোড়া পুনরায় কোলে নিয়ে পায়ের আঙ্গুল টেনে দেয়। পাতা ভোরের চুলের মাঝে হাত গলিয়ে দেখতে থাকে এক যত্নশীল বাবাকে। কতটা ভালোবাসা ও যত্নে মুড়িয়ে রাখে ছেলেকে। সে গোপনে দীর্ঘশ্বাস ফেলে অরুণকে বলে,

-” এখন বলুনতো কাওছার ভাই কোথায়? অনুষ্ঠানে খুঁজছে নিশ্চয়ই আমাকে! ইয়া আল্লাহ!”

অরুণের আচ্ছাখাচ্ছা মেজাজটা বিগড়ে যায়। পাতার দিকে তাকিয়ে বলে,

-” বললাম না মেরে দিয়েছি!”

-” দেখুন ফাজলামি বাদ দিন! ভালোয় ভ..! এক মিনিট কল করলেই তো ল্যাটা চুকে যায়!”

বলেই উইন্ডোজের পাশে পার্স থেকে ফোন বের করে। ভোর দ্বিধা যুক্ত গলায় বলে,

– “আম্মু ল্যাটা চুকে যাওয়া কি?”

-” ও ওহ্। দ্যাট মিনস প্রবলেম সলভড!”

বলেই ফোন অন করে। কিন্তু কল করতে পারে না। অরুণ হাত বাড়িয়ে ফোনটা কেড়ে নেয়। ফোন এপিঠ ওপিঠ করে দেখে! কমদামি একটা ফোন! উর্ধ্বে দশহাজার হবে! পাতা অরুণের হাত থেকে ফোন নেওয়ার চেষ্টায়।

-‘ আশ্চর্য ফোন নিলেন কেন? দিন বলছি! ভালো হবে না কিন্তু?”

ভোর উঠে এসে পাতাকে সাহায্য করার উদ্দেশ্যে বাবার হাত থেকে ফোন কেড়ে নিতে চায়। পাতা আবার বলে,

-” দিন বলছি? আমি কিন্তু রেগে যাবো?”

-” আমি তো ভয় পেয়ে গেলাম! কলিজা আমার ভয় করছে!”

ভোর খিলখিলিয়ে হেসে দেয়। পাতা অরুণের দিকে এগিয়ে আসে। তার উঁচিয়ে রাখা হাত থেকে ফোন নেওয়ার জন্য বাহু ধরে টান দেয়। ভোর সিটের উপর দাঁড়িয়ে বাবার হাত থেকে ফোন ছিনিয়ে নিয়ে আম্মুকে দিবে, তার আগে অরুণ কৌশলে ভোরের হাত থেকে ফোন নিয়ে পকেটে পুরে। পাতা কটমট করে চায়।

-” শালার জামাই!”

বলেই জিভে কামড় লাগায়। শালার মুখ! এখনি ফসকে যেতে হলো? অরুণ চোখ রাঙ্গায়। পাতা বোকা হেসে বলে,

-” স্লিফ ওফ টাং! ভোর কিছু শুনো নি তাই না?”

ভোর বাধ্য ছেলের মতো মাথা নাড়ায় শোনে নি। অরুণ ভোরকে সিটে বসিয়ে দিল। ভোর তার ছোট্ট হাত বাড়িয়ে পাতাকে জড়িয়ে ধরে। পাতা তার পিঠে হাত বুলিয়ে দেয়। আড়চোখে অরুণের দিকে তাকিয়ে বাইরে নজর দেয়। অরুণ কিছু বলে না।

পিনপিন নিরবতা বিরাজ করছে গাড়িতে। ভোর ঘুমিয়ে পড়েছে পাতার কোলে মাথা রেখে। পাতা তার চুলের ভিতরে হাত গলিয়ে আদুরে ভঙ্গিতে বুলিয়ে দিচ্ছে। অরুণ পাতার দিকে তাকিয়ে বলে,

-” ওবাড়ি কবে ফিরবেন?”

পাতা অরুনের দিকে চায়।

-” কাল ভোরেই রওনা দেব! কেন?”

অরুণ সিটে গা এলিয়ে বলে,

-” আমার ফ্যামিলি যাবে আপনাদের বাড়ি! ডেইট ঠিক করতে! ঈদের দু দিন পরে! আপনার কোন সমস্যা ?”

পাতা মলিন হাসে। তার কি সমস্যা? সে তো চায় দ্রুত ওবাড়ির দায়িত্বের বেড়াজাল থেকে বেরিয়ে আসতে। সে তো সেদিন রাতেই নাক উঁচু লোকটার সাথে চলে যাবে ভেবেছিল। কিন্তু লোকটা সরাসরি বলে ‘ সে ধুমধামের সাথে নিয়ে যাবে।’ পাতা অরুনের কথার জবাব দেয়,

-” না সমস্যা নেই। তবে একটা অনুরোধ! আমরা মধ্যবিত্ত আপনাদের মতো লাক্সারিয়াস আয়োজ..’

পাতাকে থামিয়ে অরুণ গম্ভীর গলায় বলে,

-” সে বিষয়ে আপনাকে ভাবতে হবে না। আমি আছি তো!”

‘আমি আছি তো’ কথাটা পাতার কানে বাজে। লোকটা আছে তো। নাক উঁচু ম্যানারলেস লোকটাকে সে চেনেই না ভালোভাবে অথচ লোকটার সাথে তার ভবিষ্যৎ আস্টেপিষ্টে জড়িয়ে। তার সাথে থাকতে হবে বাকিটা জীবন! কেমন হবে তাদের সংসার? আদৌ হবে তো!
পাতাকে চুপ থাকতে দেখে অরুণ বলে,

-” মিস পাতাবাহার?”

পাতা চমকে পাশে চায়। অরুণ তার মাথায় হাত রেখে বলে,

-” আপনি আমার থেকে বয়সে অনেকটা ছোট! পুরো এক যুগেরও বেশি গ্যাপ আছে। আমরা একে অপরকে ভালোকরে জানিও না। আমাদের পথচলা খুব একটা সহজ হবে না বোধকরি! আপনি খুবই ভালো একটা মেয়ে। কিন্তু আমি লোকটা ওতটা ভালো নই। আপনার ধারনায় অহংকারী! হয়তো তাই।কিন্তু আমার ছেলেটা খুবই নরম মনের। ভালোবাসা, আদরের কাঙাল। ওকে কেউ আদর করলেই ,একটু ভালোবাসা জাহির করলেই তার আগেপিছে ঘুরঘুর করবে আরো আদরের আশায়। আমার কলিজা ও। একদন্ড না দেখলেই দমবন্ধ বন্ধ লাগে। আপনার কাছে একটাই চাওয়া আমার ছেলেটাকে একটু ভালোবাসবেন। কখনো অবহেলা করবেন না প্লিজ। আমি আমার ছেলের দায়িত্ব কাউকেই দিইনি। নিজেই সব পালন করার চেষ্টা করেছি! বর্ষার সাথে ডিভোর্স হওয়ার পর নিজের হাতে বড় করেছি। ছোট্ট ছেলেকে বগলদাবা করেই অফিস সামলিয়েছি! বাড়ির কারো কাছে একদিনের জন্যও রেখে যায় নি। এমন না যে ওরা অযত্ন করবে! তবে আমি চাইনি আমার ছেলেকে সবাই মা নেই বলে এক ফোঁটাও করুণা করে দায়িত্ব নিক! সেই আমি আমার কলিজাটাকে দিচ্ছি আপনাকে। অনুরোধ কখনো অবহেলা করবেন না। একটু আদর, যত্ন, ভালোবাসা দিয়ে বুকে আগলে নিবেন। তবে করুণা করে নয়‌।”

বলে থামে। পাতার চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ে। তড়িৎ বেগে মুছে নেয়। ড্রাইভার রঞ্জুর চোখেও অশ্রুর আভাস‌। অরুণ পাতার ক্রন্দনরত মুখশ্রী দেখে বলে,

-” আরে কাঁদবেন না! আপনি দেখছি ভোরের চেয়েও বেশি ছিঁচকাদুনে!”

পাতা হেসে বলে,

-” আমি ছিঁচকাদুনে নই!”

-” হ্যা তাই তো!”

-” আপনি মজা নিচ্ছেন?”

অরুণ মাথা নাড়ায়, নাতো! পাতা তার দিকে তাকিয়ে হেসে ফেলে। অরুণ তার হাসি দেখে। পাতা হাসি থামিয়ে বলে,

-” আমারো কিছু বলার আছে আপনাকে?”

অরুণের কপালে ভাঁজ পড়ে।

-” এটা বলবেন না যে আপনার বয়ফ্রেন্ড আছে। তাকে ছাড়া বাঁচবেন না ব্লা ব্লা! একবার যখন অরুণ সরকারের সাথে জুড়ে গেছেন আর নিস্তার নেই।”

পাতার অধরকোনের হাসি বিস্তার লাভ করে!
নজর ফিরিয়ে জানালার বাইরে দৃষ্টি ফেলে বলে,

-” আমার কিছু বলার আছে। আমি আগেই জানিয়ে রাখতে চাই!”

-“বলুন?”

পাতা সামনে ড্রাইভারের দিকে চায়। অরুণ পাতার মনোভাব বুঝতে পেরে রঞ্জুকে বলে,

-” রঞ্জু ভাই? সামনে কোনো সেফ জায়গায় গাড়ি দাঁড় করাও!”

রঞ্জু সায় জানায়। একটু এগিয়ে গিয়ে গাড়িটা থামায়। অরুণ নেমে জায়গাটা পর্যবেক্ষণ করে রঞ্জুকে বলে ,

-” তুমি আশপাশ দিয়ে ঘুরে এসো। লোকালয়ের ভিতরে যেও না। চোর ভেবে গনধোলাই খাবে। কাছাকাছিই থেকো!”

ড্রাইভার সায় জানিয়ে চলে যায়। অরুণ পাতাকে বেরিয়ে আসতে বলে ভোরকে সিটে শুইয়ে দিয়ে। পাতা বেরিয়ে আশে। আশপাশ দেখে গা ছমছম করে ওঠে। এটা তো তেঁতুল তলা। ছোটবেলায় কতো তেঁতুল পেরে নিয়ে গেছে এখান থেকে। শুনেছে ভুত আছে এখানে। সে মিনমিন করে অরুণকে বলে,

-” গাড়িতে বসেই কথা বলি! বাইরে কেমন গা ছমছমে পরিবেশ!”

অরুণ আবছা আলোয় পাতার দিকে চায়। মেয়েটাকি ভয় পাচ্ছে। কিন্তু কিসে? তাকে নাকি অন্ধকার ছমেছমে পরিবেশ কে?

-” তুমি কি.. স্যরি আপনি কি ভয় পাচ্ছেন?”

পাতা দরজা লাগিয়ে অরুণের কাছে যায়। ভয় তো তার করছেই। তবে বললে এ লোক মজা উড়াবে!

-” তুমি বলতে পারেন! আর ভয় করছে না আমার। এমনি বললাম অন্ধকার তো!”

-” অন্ধকার ওতটাও খারাপ নয়! অন্ধকার আছে বলেই আলোর এত কদর। আপনি অন্ধকারে ভয় পান অনেকে অন্ধকারকেই জীবন বানিয়ে বেঁচে থাকার স্বপ্ন বুনে!”

পাতা কিছু বলে না। অন্ধকারে তার ফোবিয়া আছে বলা যায়! অরুণ খেয়াল করে পাতা কেমন গুটিয়ে আছে। ভয় কি বেশি পাচ্ছে? ভয় কিসের সে আছে তো!

-” কি যেন বলতে চেয়েছিলেন?”

পাতা মাথা নাড়ায়। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলতে শুরু করে,

-” মধ্যবিত্ত ফ্যামিলি আমাদের। আগে অবস্থাটা আরো নিচু ছিল। নিম্ন মধ্যবিত্ত যাকে বলে। আব্বুর অল্প বেতনের সরকারি চাকরি। একটা মেয়ে ও একটা ছেলে ভালোই চলছিল। কিন্তু তাদের সুখের সংসারে আগাছার সরূপ আমার আগমনের বার্তা আসে যেটা অনাকাঙ্ক্ষিত। আব্বু আম্মু রাখবে না। অভাবের সংসারে দুজন বাচ্চার খাওয়া পড়ালেখার খরচ চালাতেই হিমশিম। সেখানে আরেকজন! তো কথাটা কোনো ভাবে সম্পর্কে আমার খালার, মা বলে ডাকি তার কানে যায়। সে নিসন্তান ছিল তখন! শতচেষ্টা করেও বাচ্চা হচ্ছিলো না। সে খালুকে বাবা বলে ডাকি চলে আসে আমাদের বাড়ি‌। আব্বু আম্মুকে অনুরোধ করে বাচ্চাটা যেন তাকে দিয়ে দেয়। অনেক অনুরোধ অনুনয় করার পর সিদ্ধান্ত হয় বাচ্চা জন্মের একমাস পর বাচ্চার সকল দায়িত্ব তারা কাঁধে তুলে নিবে। তো একমাসের বাচ্চা মেয়েটা জন্মদাত্রী ছেড়ে অন্য নিসন্তান মায়ের কোলে যায়। আদর যত্নে বড় হয়। তার তিন চার বছর পর নিসন্তান দম্পতির কোল আলো করে পুত্র সন্তান হয় নাম পাবেল। সবাই খুশি। ছোট্ট মেয়েটাও খুশি ভাই হয়েছে। দিন যায় বছর পেরিয়ে ‌। এক বৃষ্টি মুখর সন্ধ্যায় সে জানতে পারে সে যাকে মা বাবা বলে ডাকে তারা আসল বাবা মা নয়। তাকে পালক এনেছে বোনের কাছ থেকে। তবে সে জানতে পারে এটা কেউ জানে না‌। বছর যায় দম্পতির কোলে আরেকটা মেয়েকে হয় নাম প্রিয়। তো সব মিলিয়ে চলতে থাকে জীবনের নৌকা। সেই মেয়েটা বড় হয় তেরো চৌদ্দ পেরিয়ে পনেরো। বাবার ব্যবসায় ব্যাপক লস হয়। সংসারে অভাব অনটন আসে। যৌথ সংসার কতগুলো পেট! বাচ্চাদের পড়াশোনা! সবাই ঠিক করে পালিত মেয়েটিকে রেখে আসবে। এখানে অভাবের সংসারে কষ্ট করে থাকার চেয়ে ওখানে ভালো ভাবে থাকতে পারবে। তো একদিন মেয়েটি স্কুল থেকে ফিরে দেখে তার জামাকাপড় নেই। সব ব্যাগে ভরে রেখেছে।‌ সে কারণ জিজ্ঞাসা করলে তাকে আদর করে খাইয়ে নাইয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে সত্যিটা জানায়। মেয়েটা খুব ভয় পায় যেতে চায় না। কান্না জুড়ে দেয় মায়ের পা জড়িয়ে। তার কান্নায় কেউ গলে না। ব্যাগপত্র নিয়ে পাঠিয়ে দেয়। তারপর তার নতুন জীবন শুরু হয়।‌ নিজের আসল বাবা মায়ের ঘরে বড় হয়। তারা খুব দায়িত্বের সাথে তাকে লালণ পালন করে। ভাগ্যিস সেদিন রেখে গিয়েছিল। নইলে জীবনে অনেক আফসোস থেকে যেত। সে যাইহোক! আমি আপনাকে সব জানিয়ে রাখলাম! পরে কারো থেকে শুনে বলতে পারবেন না।”

একনাগাড়ে কথা গুলো বলে পাতা খানিকটা হাঁপিয়ে যায়। অরুণ গম্ভীর মুখে বুকে হাত গুটিয়ে সবটা শোনে।‌ পাতার কথা শেষ হলেই বলে,

-” হয়েছে বলা? এসব জানি! নতুন কিছু বলার থাকলে বলুন!”

পাতার কপালে ভাঁজ পড়ে।

-” জানেন মানে? কিভাবে জানেন? কে বলেছে?”

-” বলেছে কেউ।”

-” কে বলেছে?”

-” আপনাকে জানতে হবে না!”

পাতা সন্দেহ নজরে চায়। লোকটা তার ব্যাপারে খোঁজ খবর নিয়েছে কি? অরুণ পাতার সামনে দাঁড়ায়। খানিকটা ঝুকে বলে,

-” মিস পাতাবাহার! আপনি ভুতে বিশ্বাস করেন?”

পাতার চোক্ষুযুগল বড় বড় হয়ে যায়। সে ভুতে দিনের বেলায় বিশ্বাস না করলেও রাতে ষোলো আনা বিশ্বাস করে! সে ঢোক গিলে। এখানকার পরিবেশ গা ছমছম ভুতুড়ে! তেঁতুল তলা! শুনেছে তেঁতুল গাছ ভুতের বাসস্থান! চারদিকে অন্ধকার। আশেপাশে কোনো বসতি নেই! কিছু বাঁশঝাড় আছে। সেখানে জোনাকির দল উড়ে বেড়াতে দেখা যাচ্ছে।দাদির মুখে শুনেছে জোনাকি পোকার সাথেও ভুত প্রেত থাকে। কিছু বাদুড় তেতুল গাছের ডালে ঝুলছে সাথে অদ্ভুত শব্দ তৈরি করছে। চাঁদের ম্লান আলোয় সব স্পষ্ট! পাতার ভয়টা দ্বিগুণ হারে বেড়ে যায়। তবে অরুণকে বুঝতে না দিয়ে বলে,

-” নাহ্ ভুত বলতে কিছু হয় নাকি! সব ভুয়া! জলদি চলুন! রাত অনেক হয়েছে!”

বলে গাড়ির দিকে পা বাড়ালে অরুণ তার হাত টেনে ধরে। পাতা ঘার ঘুরিয়ে অরুণের দিকে চায়। তার দিকে তাকিয়ে কেমন করে যেন হাসছে! কি হয়েছে এর? ভুতে টুতে ধরে নি তো! ওহ্ আল্লাহ! সে অরুণের হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করে বলে,

-” এই এই ছাড়ুন! দেখুন ভোরের বাবা ভালো হচ্ছে না কিন্তু?”

অরুণ পাতাকে টেনে কাছে আনে।‌ কাঁধ জড়িয়ে তার বুকের নিচে পড়ে থাকা পাতাকে শক্ত করে ধরে,

-” আরে পালাচ্ছেন কেন? আপনি বললেন না ভুত প্রেত কিছু হয় না? শুনুন হয়! আজ আপনাকে প্রমাণ দেখাবো! সরাসরি ভুতের সাথে সাক্ষাৎ করাবো মিস পাতাবাহার?”

পাতা ভয় পেয়ে যায় খুব। একে অন্ধকার তার উপর তেঁতুল গাছ। সেখানে আবার বাদুড় ঝুলছে! তার উপর নাক উঁচু ম্যানারলেস লোকের বিহেভিয়ার চেঞ্জ! ভুত ধরেছি কিনা আল্লাহ জানে! নাকি তার সাথে মজা করছে! সে মজা হোক বা সত্যি সে ঘাবড়ে গেছে পুরো! শরীর ও কপাল বেয়ে শ্বেদ জল গড়িয়ে পড়ছে। পাতা ভয়ে মুখ উঁচিয়ে অরুণের বুকে লুকাল। অরুণ ঢোক গিলে! এই মেয়ে তো দেখি সাংঘাতিক! সে সরানোর চেষ্টা করে পারে না। পাতা যেন আরো চিপকে যায় ভয়ে। খামচে ধরে পেটের কাছের শার্ট! অরুণের হৃদযন্ত্রটা ধুকপুক করে। নিজেকে সামলে পাতাকে নিয়ে এগিয়ে যায়। তেঁতুল গাছের গোড়ায় গিয়ে বলে,

-” মিস পাতাবাহার! সামনে তাকান?”

পাতা তাকায় না। অরুণের বুকে মুখ লুকিয়ে বিড়বিড় করে বলে,

-” প্লিজ প্লিজ চলুন এখান থেকে আমার ভয় করছে! অন্ধকার ভয় পাই আমি! প্লিজ?”

অরুণ আশ্বাসের সুরে বলে,

-” আরে চোখ খুলুন তো ভুত বাবাজিও অপেক্ষায় আছে আপনার সাথে সাক্ষাৎকার করার জন্য! আরে?”

পুরনো বাজে স্মৃতি মাথার ভিতর কিলবিল করে। অন্ধকার! ভয়ানক আওয়াজ! ঠক ঠক আওয়াজ! কান্নার সুর!পাতা রেগে মেগে কেঁদেই দেয়,

-” রাখ বেটা তোর সাক্ষাৎকার! বা*লের ভুত টুতরে যেতে বল এখান থেকে! আমি ভয় পাই! আম্মুওও”

অরুণ চোখ বুজে! এই সুন্দর শান্ত শিষ্ট আদুরে মেয়ের মুখের ভাষা এতো জঘন্য! সে পাতাকে ধমক দিয়ে বলে,

-” এক থাপ্পড় লাগাবো! মুখের কি ভাষা! কোথা থেকে শিখেছেন এসব? আমার কানে আরেকবার গেলে আমার হাত আপনার গাল!”

পাতা রাগে দুঃখে ভয়ে বাকহারা। একবার নিস্তার পাক এই লোকের গুষ্টি তুষ্টি করে দেবে। অরুণ হতাশ হয় এই মেয়ে এখনো মুখ লুকিয়ে। সে নিজেকে শান্ত করে। সামনের বাঁশঝাড়ের দিকে তাকায়। বেশকিছু জোনাক পোকার দল আলো জ্বালিয়ে উড়ে বেড়াচ্ছে। অন্ধকারে বেশ লাগছে দেখতে।সেটাই দেখাতে এনেছিল। কিন্তু এই ভিতু মেয়ে!!

-” মিস পাতাবাহার ভুত নেই কোনো! মজা করেছি! চোখ খুলে দেখুন?”

পাতা মাথা ঝাঁকিয়ে না করে। অরুণের এবার রাগ হয়। পাতাকে ছাড়িয়ে হনহন করে হাঁটা দেয়। পাতা চোখ খুলে ‘আম্মু’ বলে গাড়ির দিকে ছুটে যায়। অরুণ দরজা খুললে সে তড়িৎ বেগে ভিতরে ঢুকে আয়াতুল কুরসি পাঠ করে। তখন মনে না পড়লেও এখন পড়ছে। ভোরের মাথা পুনরায় কোলে তুলে নেয়। অরুণ চুপচাপ বাইরে দাঁড়িয়ে ড্রাইভারকে কল করে। ড্রাইভার সাথে সাথেই আসে। অরুণ ভিতরে ঢুকে। পাতা জানালার দিকে সেটে যায়। অরুণ বিরক্ত হয়ে বলে,

-” ভুত ভর করেছে আমার উপর! আপনার ঘার মটকাতে মন চাইছে! ইডিয়েট কোথাকার!!”

পাতার চেহারা কাঁদো কাঁদো হয়ে যায়। আবারো পুরনো বাজে স্মৃতি মাথার ভিতর কিলবিল করে। অন্ধকার! ভয়ানক আওয়াজ! ঠক ঠক আওয়াজ! কান্নার সুর! পাতা জোরে জোরে শ্বাস টানে। ড্রাইভার গাড়ি স্টার্ট দেয়। অরুণ বিরক্ত ভঙ্গিতে পাতাকে বলে,

-” আপনার বাড়ি কোন দিকে? ইন্স্ট্রাকশন দিন ওনাকে!”

পাতা নিজেকে শান্ত করে কিছু সময় নিয়ে তারপর বলে,

-” এই রাস্তাদিয়েই! আরেকটু এগিয়ে বামে মোড়! তারপর একটু সোজা গেলেই পৌঁছে যাবো!”

ড্রাইভার সেই মোতাবেক স্টিয়ারিং ঘুরিয়ে দক্ষ হাতে গাড়ি চালিয়ে অল্প সময়ের ব্যবধানে পৌঁছে যায়। পাতা দরজা খুলে দিল। অরুণ ভোরকে তার কোল থেকে নিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরে। ঘুমে আচ্ছন্ন ভোরের ঘুম কেটে যায়। পিটপিট করে চোখ খুলে আশেপাশে চায়।অরুণ নেমে দাঁড়ায় ভোরকে কোলে নিয়ে। পাতা গাড়ি থেকে নেমে পা উঁচিয়ে ভোরের গালে হাত বুলিয়ে অরুণকে বলে,

-” ভেতরে চলুন?”

-” নো! থ্যাংকস!”

গম্ভীর গলায় বলে অরুণ। পাতা ভোরকে বলে,

-” তাহলে আসছি আমি! সাবধানে যাবে?”

বলে পা বাড়িয়ে সামনে আগায়।
ভোর ঘুম জড়ানো গলায় বলে,

-” আব্বু আম্মু চলে যাচ্ছে কেন? আমাদের সাথে থাকবে না?”

অরুণ ছেলের গালে চুমু দিয়ে বলে,

-” কিছু দিন পর থেকে থাকবে!”

-” আমি আম্মুর সাথে যাই?”

অরুণ ছেলের দিকে চায়।

-” তোমার আম্মু তো তোমায় রেখেই চলে গে..”

বলে শেষ করতে পারে না অরুণ সরকার। সম্মুখে পাতা দাঁড়িয়ে। একটু এগিয়ে গিয়েছিল। আবার এভাবে দৌড়ে এলো কেন? ভয় পাচ্ছে নাকি আবার।
পাতা লম্বা শ্বাস টেনে অরুণকে বলে,

-” ভোরকে আমার সাথে নিয়ে যাই? আজ আমার সাথে থাকুক? প্লিজ?”

ভোরের মুখে হাসি ফুটে ওঠে। হাত বাড়িয়ে দিল পাতার দিকে। পাতা কোলে তুলে নিয়ে চুমু খায়। অরুণ কিছু বলবে পাতা অরুণকে উদ্দেশ্য করে বলে,

-” আমি খেয়াল রাখবো আমার ছেলের। আপনার চিন্তা করতে হবে না।”

অরুণের গম্ভীর মুখে হাসি ফুটে ওঠে। ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,

-” কিছু খাইয়ে দিবেন। আসি আব্বু? দুষ্টুমি করবে না কলিজা! আর কাল ভোরে রেডি থাকবেন। আপনাকে সহ পিক‌ করে নেব!”

সম্মতি পেয়ে পাতা ও ভোর দুজনের মুখই উজ্জ্বল হয়। একসাথে মাথা নাড়ে দুজন। পাতা বলে,

-“সাবধানে যাবেন? পৌঁছে ফোন করবেন!”

কথায় স্পষ্ট অধিকারের ছাপ। অরুণ মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানায়।

-” আপনারা ভেতরে যান?”

পাতা অসম্মতি প্রকাশ করে বলে,

-” আপনি যান! আমরা এখানে দাঁড়িয়ে!”

-” ভয় পাচ্ছে না এখন?”

পাতা হেঁসে না বোঝায়। অরুণ তার নাকে টোকা দিয়ে গাড়ির দরজা খুলে ভিতরে প্রবেশ করে। ড্রাইভার গাড়ি স্টার্ট দেয়। অরুণ খোলা জানালা দিয়ে মাথা বের করে ডাকে,

-” পাতাবাহার?”

পাতা প্রশ্নাত্মক চাহনিতে চায়। অরুণ শান্ত দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে পুরু ঠোঁট নাড়িয়ে আওড়ায়,

-“সুখ পাখি হয়ে এসে আমাদের বিষাদে ঘেরা জীবনকে সুখের রাজ্যে প্রতিস্থাপিত করো! রাজত্ব সপে রানির হালে রাখবো!”

চলবে…..

#পাতা_বাহার
লেখনীতে: #বেলা_শেখ
#পর্ব- ২৪ (বর্ধিতাংশ)

(কপি করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ)

খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে পাতা। কোলে ভোর। রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে আছে তারা। অরুণ মাত্রই চলে গেল। ভোর এখনো হাত নাড়ছে। পাতা শান্ত চোখে গাড়ির প্রস্থাণ দেখছে। লোকটা‌ কি বলে গেল? এর অনুধাবন কি? পাতা কথাগুলোর মর্মার্থ পুরোটা বুঝতে পারে না। তার ভাবনার মাঝেই কেউ কাঁধে হাত রাখে। পাতা চমকে পিছন ফিরে। কাওসার হাত সামনে দু হাত তুলে বলে,

-” আরে বইন ভয় পাচ্ছিস কেন আমি!”

পাতা স্বস্তির নিশ্বাস নেয়। ভোর পাতার গলা জড়িয়ে। কাওছার আশেপাশে ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করে বলে,

-” কই তোর বুইরা জামাই? শালার আজ তার এক দিন কি আমার তিন দিন।”

বলেই শার্টের হাতা গোটায়। পাতা চোখ ছোট ছোট করে চায়। ভোরকে কোল থেকে নামিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে হাঁটতে হাঁটতে বলে,

-” বলেছি না বুইড়া বলবা না? না মজায় না সিরিয়াসলি ! আর কি হয়েছে টাকি? তুমি কোথায় গিয়েছিলে তখন? উনিও বলল না!”

কাওছার কটমট করে বলে,

-” জামাইয়ের প্রতি খুব দরদ দেখছি? এই তোদের মধ্যে সত্যিই কিছু ছিল না তো?”

মজা করে বললেও কথাটা পাতার কানে বাজে। সে হাটা থামিয়ে ভোরের হাত ধরে শক্ত কন্ঠে কাওছারের উদ্দেশ্যে বলে,

-” যেটা মনে করো! তোমার ভাবনা তো বদলাতে পারবো না। আর দরদ থাকবে না কেন? এখন আমার গোটা জীবনটাই তাকে ঘিরে। যার সাথে সারাটা জীবন থাকবো বলে বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছি তার প্রতি দরদ থাকবে না! ভাই আল্লাহর রহমতে আমি সব পরিস্থিতিতে খুব জলদি মানিয়ে নিতে পারি।
এবারও আমি মন থেকেই সবটা মেনে নেব। কি দরকার ছোট্ট এই জীবনে আফসোস নিয়ে পড়ে থেকে। যা হয় নি , হয় নি! ভাগ্যে ছিল না। যা হওয়ার তা হয়েছে। ভাগ্যকে মেনে নিতে হবে। নিশ্চয়ই ভাগ্যের নির্ধারণ আমি তুমি করি না!”

ছোট্ট ভোরের মাথায় উপর দিয়ে যায় বড় বড় কথা! তবে এটুকু বুঝতে পেরেছে আম্মুর জামাই তো আব্বু! আর আব্বুকে এই আঙ্কেলটা বুড়ো বলেছে। আর আম্মু তাকে বকা ঝকা করছে। তার ছোট্ট মনটা পুলকিত হয়‌। কাওছার গিল্টি ফিল করে। মজা করে বলেছিল কিন্তু পাতা কথাটাকে সিরিয়াসলি নিবে ভাবে নি।

-” হয়েছে আর সেন্টি খাস না। এখন বিচার কর! আমি তোর আদরের জামাইয়ের নামে কেস ফাইল করছি!”

পাতার মুখের আদল এখনো সিরিয়াস। কাওছার তার মাথায় চাটি মেরে বলে,

-” হয়েছে বইনা আর ফিট খাইস না। তোর জামাইয়ের কান্ড শোন! আমাকে ডেকে নিয়ে প্রীতি প্রেমাদের বাড়ির স্টোর রুমে নিয়ে যায়। আমি জিজ্ঞেস করলে কিছু বলে না।‌ অনেক সময় পর মুখ খোলে। বলে কিনা দরকারি কাজ আছে। সিরিয়াস মুখে বলল দেখে আমি সত্যিই ভাবলাম। কিন্তু ধুরন্ধর লোকটা স্টোর রুমে নিয়ে গিয়ে বলে তুমি দাঁড়াও আমি আসছি! বলেই চলে যায়। আমি ওয়েট করি লোকটা আসে না। এদিকে গরমে নাজেহাল অবস্থা। মিনিট দশ পেরিয়ে যায় তবুও আসে না। আমি সেখান থেকে বেড়োনোর জন্য দরজা ধাক্কাই। ওমা ! দরজা বন্ধ বাইরে থেকে। অনেক ডেকেছি কেউ শোনেনি।‌ ভাবলাম তোকে কল করি ! বা*ল নেটওয়ার্কও ছিল না‌ সেখানে। এদিকে পার্টি শুরু হওয়ার ফলে লোকজনের উপস্থিতি নেই। পুরো ঘন্টা খানিক পর একটা স্টাফ এসে দরজা খুলে।‌ আমি কৃতজ্ঞতায় পারি না জড়িয়ে চুমু খাই। কিন্তু ওই শা*লা স্টাফ কি বলে জানিস?”

পাতা ভোর দুজনেই আগ্রহ ভরা দৃষ্টিতে মাথা ঝাঁকায়।

-” গাধাটা বলে আমি নাকি তাদের স্পেশাল গেস্ট! টেনে নিয়ে গিয়ে একদম জামাই আদর করলো! দেখ পেটটা এখনো ফুলে ঢোল।‌ সেভেন আপ খেয়ে মাত্রই ঢেকুর তুললাম! এখন‌ তুই বিচার কর তোর জামাই আমায় ওইখানে আটকে রাখলো কেন?”

পাতা অধরকোণে ক্ষিণ হাসির আভাস। বাব্বাহ নাক উঁচু লোকটা তাহলে সত্যিই জেলাস! ভোর ভ্রু যুগল কুচকে কাওছারের পেটে আঙ্গুল দিয়ে টোকা দেয়। পেট ফুলে ঢোলও হয়? কাওছার হাত বাড়িয়ে ভোরকে কোলে তুলে নিয়ে বলে,

-” ঢোল হয়েছে কি না পরীক্ষা করছো? হয়েছে বেটা! আর পাতা বিচার চাই বিচার চাই!”

পাতা গলা খাঁকারি দিয়ে বলে,

-” তোমার কেস গ্র্যান্টেড হয় নি। সম্পর্কে উনি তোমার দুলাভাই! তাই একটু মজা করেছে!”

কাওছার ভোরকে কোলে নিয়ে গেট পেরিয়ে বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করতে করতে বলে,

-” তোকে আর কি বলবো! তুই তো বিয়ের আগে থেকেই জামাই জামাই করতিস!এখন জামাই পেয়েছিস, ভাইকে যে চোখে দেখবি না সেটা জানি!”

পাতা হেসে তার পেটে চিমটি কেটে বলে,

-” কাওছার ভাই!”

কাওছার পেট ডলে। ভোর খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে। তার হাসির ঝংকার, যেন পরিবেশ গুনগুনিয়ে গান গাইছে। কাওছার তার গাল টিপে দেয়।

-” এতো রাতে ভুতের লাহান হাসে! এই পোলাডা কেডা কাওছার?”

আকলিমা খাতুনের কথায় ভোরের হাসি থেমে যায়। ভোর সহ পাতা, কাওছার তার দিকে চায়। তার পিছনে প্রিয়। বাকি সবাই ঘুমিয়ে হয়তো। রাত কম হয়নি তো। বারোটা বাজে, গ্রামের সকলের এক ঘুম হয়েছে বোধকরি। কাওছার হেসে বলে,

-” তোমাদের না বললাম ঘুমিয়ে পড়তে। কিরে প্রিয় ঘুমাস নি?”

প্রিয় পাতার দিকে চায়। তারপর কাওছারের কোলে বাচ্চা ছেলেটার দিকে চায়।

-” পাতুপুর জন্য‌ ওয়েট করছিলাম। একসাথে ঘুমাবো বলে!”

আকলিমা খাতুন উঠোনে পানের পিক ফেলে বলে,

-” আমি যেইটা বলছি সেইটার উত্তর দে আগে? আর ওই মা*গির জামাই কই? সত্যিই জামাইয়ের লগে গেছিলো নাকি অন্য না…”

পাতা তাকে থামিয়ে দিয়ে বলে,

-” জামাইয়ের সাথেই গিয়েছিলাম। এখানে নামিয়ে দিয়ে চলে গেছে উনি। আর এই যে বাচ্চা দেখছো আমার ছেলে!”

আকলিমা খাতুন পান খাওয়া টকটকে ঠোঁট নাড়িয়ে ব্যঙ্গ করে বলে,

-” আহা! আমার বাচ্চা! মনে হচ্ছে তুই ই জন্ম দিছোস! এসব আগলা পিরিত সময় হইলি উইড়া যাইবো! ঢংয়ের কথা হুহ!”

পাতা কিছু বলে না। কথা বললে কথা বাড়বে। আর এই বুড়ি সেটাই চাইছে বোধকরি। প্রিয় হনহন করে নিজের ঘরে চলে যায়। পাতা কাওছারকে বলে,

-” ওকে প্রিয়র ঘরে নিয়ে যাও। আমি কিছু খাবার নিয়ে আসি! ছেলেটা খাবে! ভোর মামুর সাথে যাও?”

ভোর লক্ষি ছেলের মতো মাথা নাড়ে। কাওছার তাকে নিয়ে চলে যায়। আকলিমা খাতুন মুখ মোচরায়!পাতা খাবার ঘরের দিকে যেতে নিলে আকলিমা খাতুন আটকায়। পাতাকে আগা গোড়া পর্যবেক্ষণ করে বলে,

-” এই মা*গি কই যাস? গোসল কইরা খাওয়ার ঘরে ঢুকবি!”

পাতার কপালে ভাঁজ পড়ে। সে বুঝতে পারে না বুড়ি গোসলের কথা কেন বলছে? আকলিমা খাতুন পাতার পিঠে আস্তে কিল বসিয়ে বলে,

-” গাঁধার বাচ্চা! জামাইয়ের লগে ইটিশ পিটিশ কইরা আইলা রাইতের বেলা! নাপাক শরীরে ওই ঘরে যাওয়া যাইতো না। এই সবও কইয়া দিতে হইবো?”

পাতার কান যেন গরম হয়ে যায়। এই বুড়ির কি অশ্লীল ভাবনা। সে অবাকের সুরে বলে,

-” দাদি কিসব কথা বলছো! ওসব কিছু হয় নি আমারা যাস্ট কথা বলতে গিয়েছিলাম! বাচ্চা..”

আকলিমা খাতুন তাকে থামিয়ে দিয়ে বলে,

-” হইছে আর বুঝাইতে হইবো না! ওসব রঙ ঢং আমরাও বুঝি! নতুন নতুন বিয়া হইছে। একলা নির্জনে ওতোসব না হইলেও চুম্মা চাটি, গায়ে হাত তো দিছেই! পুরুষ মানুষ বউ পাইলে হুঁশ থাকে না।”

বলেই দন্তহীন খ্যাক খ্যাক করে হেসে দেয়। পাতা কান ধরে খাওয়ার ঘরের দিকে যায়। এই বুড়ির অশ্লীল কথাবার্তায় আজ রাত মনে হয় না তার ঘুম হবে।

-” কি সব ছিঃ মার্কা কথাবার্তা! ধ্যাত!”

আকলিমা খাতুন শুনতে পায়। তিনি পাতাকে ভর্ৎসনা করে বলে,

-” ও এহন ছিঃ মার্কা কথা!! কয়েকদিন পর যহন জামাই লইয়া..”

পাতা আর শুনতে পায় না। খাওয়ার ঘরে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দেয়। তার গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। গ্লাসে পানি ঢেলে ঢক ঢক করে পান করে বুড়ির চৌদ্দ গুষ্টির ভবলিলা সাঙ্গ করে।
______

বার্থডে পার্টি শেষ কিন্তু হইহুল্লোড় এখনো কমেনি। বাচ্চারা সব ঘুমে বিভোর। এখন‌ পার্টি চলছে বড়দের। সব ছেলেরা মিলে পার্টি জমিয়ে দিয়েছে। মেয়েদের উপস্থিতি নেই। আসলাম অতি গোপনতার সাথে বাড়ির লেডিস ও তার বাবার চোখ লুকিয়ে বিয়ার এনেছে। বন্ধুরা ও কিছু কাজিন মিলে সেটাই গিলছে । অরুণ নিজের জন্য বরাদ্দকৃত রুমে। মাত্রই গোসল সেরে এসেছে। ড্রেসিন টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে মাথায় অলস ভঙ্গিতে তোয়ালে চালাচ্ছে। ছেলেকে ছাড়া ভালো লাগছে না তার। বুকটা খালি খালি লাগছে। তোয়ালে বিছানায় ছুড়ে ভাবে নিচে গিয়ে একটা বিয়ারের বোতল আনবে। বেশ সময় ধরে খাওয়া হয় না। আগে বন্ধুদের সাথে আড্ডায় নিত্যসঙ্গী ছিল। ছেলে হওয়ার পর তেমন খাওয়া হয় নি। স্বাদটা ভুলতে বসেছে বলা চলে। যাবে কি? পরে ভাবে নিচে আড্ডায় উপস্থিত সকলেই তার চেয়ে ছোট। তার উপর ভাইয়ের শশুর বাড়ির আত্মীয়। তাদের থেকে বিয়ার চাওয়াটা কেমন লাগবে? আর ছোটমা বা আরিয়ানের কানে গেলে? আরিয়ান তো কোমড়ে হাত দিয়ে বকে বকে কানের পোকা তুলে ফেলবে। আগেও বকতো! তার এসব নেশা দ্রব্যে এলার্জি। আজ পর্যন্ত সিগারেটও ছুঁয়ে দেখেনি। অরুণ হাসে! ছোট ভাইটা নিতান্তই ভদ্র ছেলে। ভোরের সাথে জড়িয়ে ইমোশনাল কথাবার্তায় পেঁচিয়ে তাকেও দূরে রেখেছে। তবে আজ ছেলেটা দূরে থাকায় , আর বিয়ারের বোতল নজরে আসায় কেমন যেন টানছে। ভোরকে যেভাবে আইসক্রিম ডাকে সেরকম তাকেও ডাকছিল! লোভী মনটাকে অনেক কষ্টে দমিয়েছে। সে ভাবে যাবে? অল্প একটু খেলে কিছুই হবে না। পা বাড়ায় তখনি বিছানায় ফেলে রাখা ফোনটা বেজে ওঠে। তবে তার ফোন নয়। মিস পাতাবাহারের, তার কাছেই ছিল। দেওয়ার কথা মনে ছিল না। সে ফোনটা হাতে নেয়। স্কিনে একটা ছেলের হাস্যোজ্জ্বল ছবি! অরুণের ঠান্ডা মেজাজ যেন একটু হলেও খারাপ হয়। চিনতে অসুবিধা হয় না, কাওছার ভাই নাম জ্বল জ্বল করছে। অরুণ রিসিভ করে কানে ঠেকায়। ওমনি মিষ্টি কণ্ঠের সালামে যেন মেজাজটা ঠান্ডা হলো। সালামের জবাব নিয়ে বলে,

-” পাতাবাহার?”

পাতার মুখ কুঁচকে যায়। পাতা ঠিক আছে বাহার কেন যোগ করতে হবে। বাহার তার প্রাইমারি স্কুলের এক স্যারের নাম। একদম কাঠখড়ি। যেমন লম্বা তেমন চিকন। আর খিটখিটে।‌

-” আশ্চর্য পাতাবাহার কে? আমার নাম পাতা। শুধু পাতা। সেই নামেই ডাকবেন বলে দিলাম!”

অরুণ যেন মজা পেল।

-” তো শুধু পাতা? কলিজা কোথায়?”

পাতা চোখ উল্টিয়ে বিরক্ত প্রকাশ করে এই লোক শুধরানোর নয়। ব্যাটা ষাঁড়। সে ঘার মুড়ে ভোরের দিকে চায়। ভোর তার দিকেই তাকিয়ে। তার পাশে শুয়ে তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরেছে।

-” কাছেই আছে! শুয়ে আছে। আপনি পৌঁছে গেছেন?”

-” হুম। খেয়েছে কিছু?”

-” হুম। রুটি খেয়েছে একটা ডিম দিয়ে।”

অরুণ বিছানায় গা এলিয়ে দেয়। তার পেটের ভিতরও গুডুর গুডুর করছে ক্ষিদের তাড়নায়। সেই দুপুরে খেয়েছিল।

-” ঘুমিয়ে পড়েছে?”

পাতা হাসিমুখে ভোরের নাক টিপে বলে,

-” না! কথা বলবেন?”

অরুণ কিছু বলবে এর আগে আরিয়ানের শোরগোল শুনতে পায়। ভাই ভাই বলে ভিতরে প্রবেশ করে। হাতে খাবারের ট্রে। পিছনে আনিকা পুতুল কাঁধে ঘুমে ঢুলু ঢুলু করে হাঁটছে। আরিয়ান খাবারের ট্রে টি টেবিলে রাখে।

-” নে তোর খাবার। এখানেই নিয়ে এলাম। নিচে মানুষের ভিড়ে অস্বস্তি হতে পারে। জলদি করে খেয়ে নি। তারপর তোকে দেখছি!”

অরুণ বালিশে ফোন রেখে অপর হাতে আনিকাকে কোলে তুলে চুমু খায়।আনিকা পাশ ফিরে বালিশে মাথা রেখে শুয়ে চোখ বুজে। অরুণ ফোনের ওপাশে পাতাকে উদ্দেশ্য করে বলে,

-” এক মিনিট হোল্ড করুণ!”

বলে আরিয়ানের দিকে তাকিয়ে বলে,

-” কি হয়েছে?”

আরিয়ান কোমড়ে হাত রেখে বিছানায় শোয়া অরুণের দিকে হালকা ঝুঁকে বলে,

-” আমরা তো তোর ছেলেকে ভালোবাসি না। যত্ন করি না। তাই কখনো আমাদের কাছে একবেলা রেখে অফিসেও যাস নি! অথচ তোর দুদিনের বউয়ের কাছে কলিজাকে রেখে এলি! বাহ্ খুব ভালো! আমরা তো স..”

অরুণ গম্ভীর মুখে বলে,

-” ডোন্ট সে দ্যাট। তুই আমার ভাই। আপন ভাই ! বুঝলি? আর রেখে আসতাম না জেদ করছিল। আর তার জেদের কাছে আমার মাথাটা সর্বদা ঝুঁকে যায়।”

আরিয়ান চুপ করে তবে এখনো রেগে আছে।

-” হ্যা ভালো করেছো! তোমার ছেলে তোমারি সব। আমরা তো কেউই না।”

অরুণ বিছানা থেকে উঠে আসে ফোনটা হাতে নিয়ে।

-” বাচ্চাদের মতো গাল ফুলাস না তো! আর দিন দিন কেমন ঝগরুটে হয়ে যাচ্ছিস!”

আরিয়ান ভাইয়ের দিকে চায় শান্ত চোখে। মনে পড়ে পার্টিতে ধাক্কা দেয়া মেয়েটার কথা। মেয়েটাও তাকে ঝগরুটে বলেছিল। আবার ভাই ও বললো । সে কি সত্যিই ঝগরুটে হচ্ছে? নাকি ওকালতির ফল এসব! সব সময় আর্গিউ! সে খেয়াল করে অরুণের হাতে ফোন। কমদামি এন্ড্রোয়েড। তার ভ্রু কুঁচকে যায়,

-” এটা কার ফোন তোর হাতে?”

অরুণ ফোন উল্টে পাল্টে দেখে বলে,

-” পাতার! ভুলে আমার কাছে রয়ে গেছে।”

আরিয়ানের ভ্রু কুঁচকে যায়,

-” পাতা! গাছের পাতাদের কাছে ফোনও থাকে নাকি? কিসের পাতা? আম পাতা জোড়া জোড়া!”

ফোনের ওপাশে ভোর খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে। পাতা বিরক্তিকর শ্বাস ছাড়ে। সে ফোন হোল্ড করে নি। দু ভাইয়ের সকল কথায় শুনেছে।
আরিয়ান কানটা খাড়া করে। হাসির আওয়াজ শোনা গেল না?

অরুণ এসে আরিয়ানের কাঁধ চাপড়ে বলে,

-” ভোরের আম্মুর নাম পাতা!”

আরিয়ানের এক ভ্রু উঁচিয়ে আচ্ছা বলে অরুণের হাত থেকে ফোনটা নিয়ে বলে,

-” লাইনে কে এটা? হাসির আওয়াজ শোনা গেল?”

-“ভোরের আম্মু!”

আরিয়ান বত্রিশ পাটি বের করে বলে,

-” বাহ্। প্রেমালাপ চলছিল নাকি হুম?”

-” বড় ভাই হই তোর!”

আরিয়ান থোরাই কেয়ার করল। সে ফোন কানে ঠেকিয়ে লম্বা সালাম দেয়,

-” আসসালামুয়ালাইকুম ভাবিজান! ভালো আছেন? ডিস্টার্ব করলাম বুঝি?”

পাতা চোখ রসগোল্লার ন্যায় হয়ে যায়। গলা খাঁকারি দিয়ে মিনমিনে গলায় বলে,

-” ওয়ালাইকুমুস সালাম। ভালো? আপনি? ভোরের সাথে কথা বলবেন? এই নিন?”

বলেই ফোন ভোরের কানে ঠেকায়। ভোর ফোন কানে ধরে উঠে বসে,

-” হ্যালো চাচ্চু?”

আরিয়ান চোখ ছোট ছোট করে চায় অরুণের দিকে।

-” তোর বউ লজ্জা পাচ্ছে!”

অরুণ চোখ রাঙায়। আরিয়ান ভেংচি কেটে ভোরের কথার জবাব দেয়,

-” হ্যা বাবা বলো? আম্মুকে পেয়ে আমাদের ভুলে গেলে?”

ভোর মাথা নাড়িয়ে বলে,

-” ভুলি নি তো! চাচ্চু আমি না আম্মুর সাথে ঘুমাবো! আনি ও রুপের মতো! আব্বু থাকলে আরো ভালো হতো!”

আরিয়ানের বুকটা ভরে ওঠে।

-” তাই বাবা! আম্মুকে তোমার ভালো লেগেছে?”

ভোর হেসে পাতার গালে চট করে চুমু দিয়ে বলে,

-” অনেক।”

পাতা হেসে তাকে বুকে টেনে নিল। ভোর পাতার বুকে মাথা রেখে ফোনে মনোযোগ দেয়‌। আরিয়ান মুচকি হাসে। ভোর খুশি হলেই হলো। আর কি চাই! সে অরুণের দিকে ফোন দিয়ে বলে,

-” তোর কলিজার সাথে কথা বল?”

অরুণ ফোন কানে ধরে আদুরে গলায় বলে,

-” কলিজা? আব্বুকে মনে পড়ছে না?”

ভোরের হাসি হাসি মুখটা মলিন হয়ে আসে।

-” আব্বু অনেক মনে পড়ছে। তুমি থাকলে অনেক ভালো হতো! তোমার আমাকে মনে পড়ছে?”

অরুণ মুচকি হেসে বলে,

-” বুকটা পুড়ছে কলিজা! ঘুমিয়ে পড়। সকাল ভোরে আমার ভোরকে নিয়ে আসবো!”

ভোর মাথা নেড়ে কল কাটে। পাতাকে জড়িয়ে ধরে চোখ বুজে।
অরুণ ফোনটা পকেটে পুরে। আরেকটু হলে ছেলেটা কেঁদে দিত!
আরিয়ান বিছানায় উঠে মেয়ের পাশে গা এলিয়ে দিল।

-” তা তোমার গাছের পাতার ছবি টবি কিছু আছে? একটু দেখতাম?”

অরুণ হাত ধুয়ে খাবারের প্লেটে হাত দেয়।

-” বড় ভাবি তোর। সম্মান দিয়ে কথা বল! আর ছবি নেই। সরাসরি দেখিস।”

আরিয়ান হামি তুলে বলে,

-” সে দেখা যাবে। গুড নাইট!”

-” এখানেই ঘুমাবি?”

আরিয়ান সন্দেহ নজরে অরুণের দিকে চায়।

-” কেন কোন সমস্যা? সমস্যাকে টা টা বায় বায় বলো। আমি এখান থেকে নড়ছি না। নরলেই নিচে বিয়ার পার্টিতে যেতে পারো তাই না?”

অরুণ অধরকোণে হাসি ফুটে ওঠে। তার ধারনাই ঠিক।

-” আমি ভালো হয়ে গেছি!”

-” হ্যা! তবে ওতটাও না। মাতালদের বিশ্বাস নেই!”

অরুণ চোখ রাঙায়।

-” আমি মাতাল নই! উঠতি বয়সে বন্ধুদের সাথে সবাই খায় একটু আকটু। এখন তুই সাধু পুরুষ তাই!!”
_______

স্নিগ্ধ শোভন ভোর বেলা। নীল দিগন্তের প্রান্তে অরুণ উঁকি দিচ্ছে ঝলমলিয়ে। তার তীব্রতা দেখে বোঝা যাচ্ছে আজ চরম তেজে দেখা দেবে ধরনী জুড়ে। মৃদুমন্দ হালকা বাতাসে গাছের পাতা দুলছে। পাখির কিচিরমিচির কলতানে মুখরিত পরিবেশ। বিভিন্ন পাখির কলতানের মধ্যে একটি পাখি চিকন গলায় ডাকছে ‘ফুটিক জল’! ডাকের সাথে মিল রেখে পাখিটির নামও ফটিক জল। গ্রামের মানুষের ধারনা এই পাখি ডাকলে আকাশ ভেঙ্গে জল নামে অর্থাৎ বৃষ্টি পাত হয়। এখন কথাটা সত্য নাকি মিথ্যা উপর ওয়ালাই জানে। শহরের বুকে এখন ঘুম থাকলেও গ্রামীণ জীবন শুরু হয়ে গেছে। গ্ৰামের মানুষ সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে। ব্যতিক্রম নয় মিঁঞা বাড়ি! পারুল ও ফাতেমা জোহরা সকাল সকাল উঠে সকল বাসি কাজ ছেড়ে রান্না করতে বসেছে। পাতার জামাই আসবে আবার বিকেলে জুবাইদা আসবে বাচ্চা সহ! তাই রান্নার তোরজোর। আকলিমা খাতুন ভোর বেলায় পাশের গ্ৰামে গেছে পানি পড়া আনতে। কয়েকদিন হলো গুঞ্জন ছড়িয়েছে যে পাশের গ্ৰামের এক ছয় বছরের ছেলের ভিতর অলৌকিক কিছু দেখা গেছে। মানুষের মনের কথা জানতে পারে। অসুখ বিসুখ ঝাড়া ফুক দিয়ে ছাড়াতে পারে। ব্যস হুজুগে বাঙ্গালীর ঢল সেখানে। দলে দলে চলে যায় পানি পড়া তেল পড়া আনতে। ছোট বাচ্চা বিড়বিড় করে ফু ফু দেয়। তাতেই বাঙালি ভিড় ঠেলে নিয়ে আসে। আর তাদের ছোট্ট কবিরাজ বাবা টাকা পয়সা নেন না তবে খুশি হয়ে হাদিয়া দিলে দোয়া জলদি কবুল হয়।অসুখ সাড়ে। সহজ সরল চালাক উদার বাঙালি বিশ, চল্লিশ, পঞ্চাশ যে যেরকম পারে দিয়ে দেয় হাদিয়া। মানুষের ঢলও পড়ে অনেক। কবিরাজ বাবা এতো জনকে তো একে একে ফু দিতে পারে না তাই সকলকে একটা মাঠে সমাবেত করে মাইকের সাহায্যে জোড়ে একটা ফু দিয়ে সবাইকেই খুশি করে। সবাই খুশি হয়ে গামছা পেতে হাদিয়া তুলতে আসা লোকদের মন প্রাণ উজার করে টাকা পয়সা দেয়। অথচ রাস্তায় অসহায় অচল ভিক্ষুক যারা তিলওয়াত, হাদিস পড়ে সকলকে দোয়া করে সাহায্য চায় তাদেরকে দিতে অনিহা! মুখ বাঁকিয়ে বলি ভন্ডামি!

ফাতেমা জোহরা রান্না ঘরে রান্না করছে। পারুল উঠোনের একপাল বসানো মাটির চুলোয় পিঠা ভাজছে। তালের পিঠা, বড়া, ঝালের পিঠা, ঝাল চিতই ইত্যাদি। বর্ষাকালে তালের রস দিয়ে বানানো তালের পিঠা ও বড়া বেশ খেতে। কাওছার, ফরহাদ, পাবেল, প্রিয়, পাতা চুলোর সামনে চেয়ার পেতে বসে গরম গরম পিঠার স্বাদ উপভোগ করছে। ভোর পাতার পাশে বসে অল্প ঝালের পিঠা খাচ্ছে মজা করে। পরণে সেই পার্টির সাদা শার্ট ও কালো প্যান্ট। কোর্ট গাড়িতেই খুলে দিয়েছিল অরুণ। গরমে ঘেমে গেছে ছেলেটা। পাতা হাতপাখা দিয়ে বাতাস করছে‌। ভোর মুচকি হেসে পিঠা ছিঁড়ে পাতার মুখে দেয়। পাতা হেসে বলে,

-” খেতে মজা লাগছে?”

ভোর মাথা নাড়িয়ে বলে,

-” খুব! আম্মু আব্বু কখন আসবে?”

-” আসবে বাবা এই আরেকটু পরেই!”

বলে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। ছেলেটা মধ্যরাতে ঘুমের ঘোরে বাবাকে খুঁজছিল তার মুখ হাতরিয়ে। তারপর চোখ খুলে আব্বু বলে কেঁদে দেয়। তার আব্বুর কথা মনে পড়ছে। আব্বুর জন্য বুক কাঁদছে। পাতা অনেক বুঝিয়ে আদর করে ঘুম পাড়িয়েছিল! সকালে উঠে না হলেও একশবার বলেছে আব্বু কখন আসবে! পারুল গরম তেলের কড়াইয়ে তালের রস, চিনি, নারিকেল কোড়া,চালের গুঁড়া ইত্যাদি দিয়ে নরম করে বানানো খামি অল্প করে হাতে তুলে তেলের ভিতর ছেড়ে দিয়ে বলে,

-” বাব্বাহ্! এ দেখি বাপ পাগল ছেলে! স্কুলে যাও তুমি?”

ভোর মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়। মুখে দেয়া পিঠা চিবিয়ে গলাধঃকরণ করে বলে,

-” আম্মু যে স্কুলে পড়ায় সেখানেই পড়ি! আন্টি আপনি কোথায় পড়েন?”

পাবেল হেসে উঠলো শব্দ করে। সাথে বাকি সবাই যোগ দিল।

-” পাতা আপু দেখ ছেলের কথা! তোকে আম্মু ডাকছে আর তোর মাকে আন্টি!”

ভোর কাঁচুমাচু মুখে পাতার দিকে চায়। পাতা ভোরের গাল টিপে বলে,

-” নানিমা বলবে। আর পাবু ছোট বাচ্চা বুঝে নাকি!”

পারুল হেসে বলে,

-” ছেলে মেয়ে বিয়েই দিলাম না নানি হয়ে গেলাম! ”

খেয়াল করে না তার কথায় পাতার মুখটা মলিন হয়ে যায়। সে কি তার মেয়ে না? আগে তো বলতো আমার দুটো মেয়ে পাতা প্রিয়! প্রিয় মায়ের কথার বিরোধীতা করে বলে,

-” পাতুপুর তো বিয়ে হয়েই গেছে। সে কি তোমার মেয়ে নয়? টান আসে না আর?”

রান্নাঘর থেকে ফাতেমা সব শুনছিল। সে এবার প্রিয়কে উদ্দেশ্য করে গলা উঁচিয়ে বলে,

-” সে তো পালক মেয়ে! তার উপর পালক মেয়ের সৎ ছেলে! টান টা আসবে কিভাবে?”

প্রিয়র রাগ হয়। গলা ফাটিয়ে বলে,

-” তো পালক এনেছো কেন? স্বার্থপর মানুষ!”

ভোর ভয় পায় এভাবে চিল্লানোতে। পাতা প্রিয়কে ধমক দিয়ে বলে,

-” চুপ! বেয়াদবি না! ঠিক কথাই তো বলেছে! তুই চুপ থাক!”

কাওছার পানি খেয়ে শান্ত গলায় বলে,

-” মা একটু বেশি হয়ে যাচ্ছে না? একটু পরেই চলে যাবে তোমাদের পালক মেয়ে! একটু ভালোবেসে বিদায় দাও! কি কপাল রে তোর পাতা!”

পাতার চোখ ভরে উঠে। ভোর গাল ফুলিয়ে সবাইকেই দেখছে। সবাই ঝগড়া করছে কেন?
ভোর কাঁচুমাচু মুখে পুনরায় পাতার দিকে চায়। ফাতেমা জোহরা বেরিয়ে আসে। ছেলেকে কিছু বলবে এর আগে বাইরে থেকে গাড়ির হর্নের আওয়াজ আসে। কাওছার ফরহাদ বেরিয়ে যায়। পাতার বুঝতে বাকি থাকে না কে এসেছে। তবে এতো ভোরে আসবে ভাবে নি। সে কান্না গিলে অনুরোধের সুরে বলে,

-” চাচি প্লিজ কিছু বলো না ওনার সামনে! হাত ধরি তোমার প্লিজ? মা ?”

ফাতেমা জোহরা থমথমে মুখে রান্নাঘরে যায়। পারুল কপালে ভাঁজ ফেলে পিঠা ভাজায় মন দেয়। প্রিয় চেয়ার ফেলে দিয়ে নিজের ঘরে যায়। ভোর পাতার সাহায্যে চেয়ার থেকে নেমে দাঁড়ায়। গেটের দিকে তাকাতেই বাবাকে দেখতে পেয়ে দৌড়ে যায়। অরুণ কোলে তুলে নেয় ছেলেকে। ভোর বাবার গালে চুমু দেয়। প্রতিত্তরে অরুণ তার গালে মুখে চুমুতে ভরিয়ে দেয়। কেউ কিছু বলে না। পাতা এগিয়ে আসে। অরুণের পিছনে ফরহাদ ও কাওছার। তাদের হাতে অনেকগুলো মিষ্টির প্যাকেট ফলফলাদির সমাহার। অরুণ এগিয়ে আসে পাতার কাছে। পারুল মাথার কাপড় ঠিক করে ফাতেমা জোহরা ঘোমটা টেনে বেরিয়ে আসে। তারা শুনেছে জামাইয়ের বয়সটা বেশি। কিন্তু কই দেখে তো বুড়ো মনে হচ্ছে না? পুরোই রাজপুত্র। হ্যা একেবারে জোয়ান ছেলে লাগছে না! কিন্তু বুড়োও নয়। পাতার সাথে যেন জমে ক্ষীর! শুধু পাতা ছেলের তুলনায় খাট।

অরুণ পাতার পাশে দাঁড়ায় চুপটি করে। পাতা অরুণকে চোখ রাঙায়। পারুল ও ফাতেমা জোহরাকে দেখিয়ে বলে,

-” আমার মা! আর উনি আমার ছোট মা। এটা পাভেল আমার ভাই!”

এই লোক তো সত্যিই ম্যানারলেস! চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে! সালাম দিয়ে কুশল বিনিময় করবে না? সে অরুণের কাছ ঘেঁষে আস্তে ধীরে বলে,

-” সালাম দিন!”

অরুণ বেশ অবাক হয় এইটুকুনই মেয়ে তাকে চোখ রাঙায়। তবে কিছু বলে না। সবার উদ্দেশ্যে সালাম দেয়,

-” আসসালামুয়ালাইকুম!”

ব্যস! ভালোমন্দ জিজ্ঞেস করবি না শালা! পাতা তার হাতে চিমটি কাটে। ম্যানারলেস!
পারুল ফাতেমা সালামের জবাব দিল। পারুল হাসিমুখে বলে,

-” ভালো আছো?”

অরুণ ছোট্ট করে উত্তর দেয়,

-” হুম!”

কাওছার হাতের মিষ্টি দেখিয়ে বলে,

-” পাবেল দেখ পাতার আদরের জামাই ওরফে আমাদের দুলাভাই কতকিছু এনেছে! শিখে রাখ বিয়ে করলে তোরও নিতে হবে।”

পাবেল ফরহাদের ব্যাগ থেকে একটা আপেল মুখে দিয়ে বলে,

-” ভাই আগে তুমি শিখে নাও! সবার বড় তুমি?”

কাওছার মাথা নাড়িয়ে হাসে। ফাতেমা জোহরা ছেলেদের হাতে ফল মিষ্টি দেখে বলে,

-” ওসব আনতে গেছো কেন? পাতা যা জামাইকে নিয়ে ঘরে যা। বাইরে গরম!”

-” আসুন?”

বলে পাতা গটগট করে হেঁটে ঘরের ভিতরে ঢুকে। অরুণ লম্বা পা ফেলে তার পিছু যায়। ঘরে দুজনের উপস্থিতিতে। অরুণ প্রিয়কে দেখে পাতার দিকে চায়। পাতা থমথমে মুখে উত্তর দেয়,

-” প্রিয়! আমার ছোট বোন!আর প্রিয় উনি ভোরের বাবা!”

প্রিয়োর এই লোককে পছন্দ হলো না। কেন? জানে না। তবুও ভদ্রতার খাতিরে সালাম দিল। অরুণ গম্ভীর গলায় জবাব দিয়ে বলে,

-” তুমিই প্রিয়?”

প্রিয় পাতার দিকে চায়। এই লোক তার নাম জানে? আপু বলেছে নিশ্চয়ই। প্রিয়র মনটা ভালো হয় খানিক। হাসিমুখে মাথা নাড়িয়ে বলে,

-” হুম! আপনি বসুন? আমি আসছি!”

বলেই ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। অরুণ ছেলেকে বিছানায় বসিয়ে দিয়ে নিজেও বসে। বেশ গরম এখানে। পাতা দরজা বন্ধ করে অরুণের দিকে কটমট করে চেয়ে বলে,

-” ম্যানারস জানেন না?”

-” আপনিই তো বলেন ম্যানারলেস! তাহলে ম্যানারস আশা করেন কিভাবে?”

স্পষ্ট জবাব। পাতা চোখ বুজে শান্ত হওয়ার চেষ্টা করে,পারে না। অরুণের মুখের সামনে আঙ্গুল তুলে রাগে গজগজ করে বলে,

-” নাক উঁচু ম্যানারলেস লোক। সামাজিকতা জানেন না? ভালোমন্দ জিজ্ঞেস করলে কি হতো? মা, ছোটমা কি ভাবলো? ভাজ্ঞিস বাবা চাচা ছিল না! আপনি ..!”

আর বলতে পারে না। অরুণ তার বাড়িয়ে দেয়া আঙ্গুলের ডগা মুখে পুরে আলতো কামড়‌ বসায়।

-” নিন হয়েছে এখন।‌ আর হবে না। ভালোভাবে ম্যানারস, সামাজিকতা শিখিয়ে দিবেন। আই এম ভেরি ওয়াচফুল স্টুডেন্ট!”

ভোরের মুখে হাসি ফুটে ওঠে। পাতা অরুণকে বকছিল দেখে তার হাসি গায়েব হয়ে গিয়েছিল। এখন ফিরে এসেছে। আর পাতা! সে ঢোক গিলে। আঙুল টেনে নিয়েছে শুরুতেই। কি ছিল ওটা? কারেন্ট? তা নয়তো কি? পুরো শরীর ঝাঁকুনি দিল কেন! বুকটা ধরফর ধরফর করছে। হৃদযন্ত্রটা মনে হয় ছিটকে বেরিয়ে আসবে। আচ্ছা এ কেমন অদ্ভুত অনুভূতি! না ভালো না খারাপ!! হৃদয় কুঠিরে হালকা নাড়িয়ে পালিয়ে গেল যেন!

চলবে …..