পাতা বাহার পর্ব-২৯+৩০

0
845

#পাতা_বাহার
লেখনীতে: #বেলা_শেখ
#পর্ব- ২৯

(কপি করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ)

প্রত্যুষের আবরণ ছেয়ে, বসুধায় যামিনীর অন্ধকারের আগমন। দ্যুলোকে বসবাসকারী শশধরের পূর্ণ আলোয় বসুধা ঝলমলিয়ে। সেথায় মেঘমালার অনুপস্থিতিতে তারকারাজির মিটমিট হাসি উপভোগ্য। গাছের পাতার নৃত্যের ছন্দপতনে স্নিগ্ধ পবনের আলতো গা ছুয়ে যাওয়া যেন তনুমন জুড়ালো। কৃত্রিম ক্ষণপ্রভার আলোকে আলোকিত অটবি। কাননে কুসুমকলি প্রসূণ শোভায় শোভিত। সেথা হতে মৃদু ঘ্রাণ নাসারন্ধ্রে প্রবেশ করছে বিনা অনুমতিতে। ব্যস্ত লোকালয় সেই ঘ্রাণ উপেক্ষিত করে আপনাতে মজে। কৃত্রিম বাদ্যযন্ত্রের তান তাদের মন টানছে । সেই তানে অটবিতে বসবারত বিহঙ্গ দলের আরাম বিঘ্নিত। প্রত্যুষেই বিহঙ্গের জোট আপন নীড়ে ফিরে। নিত্যদিনের শান্তি পরিবেশ ভঙ্গ হওয়ায় তাদের নিদ্রায় বিঘ্ন সৃষ্টি হচ্ছে। মা বাবুই নিচের হৈ হুল্লোড় কৃত্রিম বাদ্যযন্ত্রের আওয়াজ হতে ছোট বাচ্চাদের আগলে রেখেছে ডানা মেলে। অন্যান্য বিহঙ্গের দলও নিজের আপন নীড়ে ঘাপটি মেরে আছে।

ড্রেসিন টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে আয়নার দিকে বেশ খানিকটা এগিয়ে আঁখি বড় বড় করে কাজল পড়ছে নববধূ। কাজল লাগালেই তার সাজ সজ্জা সম্পূর্ণ হবে। কাজল বিনা কোনো রমনীর সাজ আদৌও সম্পূর্ণ হয়? কাজল লাগিয়ে নববধূয়া ঘুরে দাঁড়ায়। মাথায় ঘোমটা টেনে নিয়ে বিছানায় বসে থাকা ছোট শিশুটাকে ইশারায় সুধায় কেমন লাগছে? বাচ্চাটি নিত্যসময়ের মতো মিষ্টি হেসে অধরকোণের হাসি ও ছোট হস্ত যুগল প্রসারিত করে বলে,

-” এতো এতো মিষ্টি লাগছে আম্মু! পুরাই কুইন!!”

পাতা মুচকি হাসে প্রশংসায়। এগিয়ে ভোরের সামনে দাঁড়ায়। কৃত্রিম রাঙা অধরজোরা ললাটে ছোঁয়ায়। ভোরের গাল টেনে বলে,

-” আমার সোনা ছেলে!”

বলেই খিলখিলিয়ে হেসে দেয়। সাথে যোগ দেয় ভোর! তাদের হাসির ছন্দপতনে পুরো রুম মুখরিত। তন্মধ্যে রুমে প্রবেশ করে অরুণ সরকার। নববধূয়া ও প্রাণ ভোমরার প্রাণোচ্ছ্বল হাসি দেখে মনটা প্রফুল্লচন্দ্রে ছেয়ে যায়। মনে মনে উপর ওয়ালার কাছে ফরমাইশ জারি করে যেন, তার তিমিরাচ্ছন্ন ঘরে যেন সর্বক্ষণ এভাবেই আলোর দ্যুতি ছড়িয়ে পড়ে। অরুণ পকেট থেকে ফোনটা বের করে কিছু স্মৃতি লুকিয়ে রাখার প্রয়াসে। অরুণকে দেখে পাতা ও ভোরের হাসির ফোয়ারা থেমে যায়। রাগি শিক্ষককে দেখে ক্লাসের দুষ্টু ছেলে মেয়ে যেমন চুপটি করে ভদ্র চোখে চায় তেমনি দুজন অরুণের দিকে চেয়ে। অরুণ চোখ ছোট ছোট করে চায় তাদের দিকে। ভ্রু উঁচিয়ে জিজ্ঞেস করে,

-” হোয়াট হ্যাপেন্ড? হাসি থামালে কেন? ভালোই লাগছিলো দুজনের হাসিমাখা মুখশ্রী।”

ভোর ‘আব্বু’ বলে কাছে ডাকে। পাতা সরে দাঁড়ায়। আঁখি জোড়া তার অরুণের দিকে নিবদ্ধ। সাদা কালো ফর্মাল ড্রেসআপ। মনে হচ্ছে অফিসে যাবেন! কিন্তু দেখতে মন্দ লাগছে না। ক্রাশ ট্রাশ খাওয়াই যায় নাক উঁচু ম্যানারলেস লোকটার উপর। অরুণ এগিয়ে এসে ছেলেকে কোলে তুলে সারা মুখশ্রী জুড়ে আদরের ফোয়ারা বইয়ে দেয়। আদর পাগল ভোর আদর পেয়ে খুব খুশি! আদর ফিরিয়ে দিতেও ভুলে না। পাতা দুজনের মধ্যে দর্শক আয়ন। হঠাৎ ভোর বলে ওঠে,

-” আব্বু দেখ আম্মুকে কত্তো মিষ্টি লাগছে! সো মাচ প্রিটি!”

অরুণ পাতার দিকে চায়। আপাদমস্তক ভালোভাবে দেখে নেয়। অরুণের তীক্ষ্ণ নজরে পাতা জড়সড় হয়ে দাঁড়ায়। অরুণ তা দেখে মনে মনে হাসে। মেয়েটা রিসেপশনের জন্য চ্যুস করা লেহেঙ্গা পড়ে নি, পার্লার থেকে আগত মেয়েদেরকেও ভাগিয়ে দিয়েছে। নিজে নিজেই তৈরি হয়েছে। হালকা পিঙ্ক কালারের উপর গাড় পিঙ্ক কালারের কারুকাজ করা জামদানী শাড়ি, কুচি দিয়ে পড়েছে। মুখাবয়বে ফেস পাউডার দিয়েছে হয়তোবা, সেরকমই ঘ্রাণ আসছে। চোখে চিকন কাজল, আইলাইনার, আই স্যাডো! মাথায় ছোট্ট স্বর্ণের টিকলি! কানে নাকে আগের গয়নাই রয়েছে। গলায় ভারী সীতাহার! হাতে চিকন বালার সাথে আরো দুটো করে মোটা স্বর্ণের বালা। মোট মিলিয়ে পুরো বাঙালি নববধূ; শুধু শাড়িটা বাঙালি ভাবে পড়েনি! সে যাই হোক! দেখতে সত্যিই অসাধারণ লাগছে! ভোর সত্যিই ক্যাচ করতে পেরেছে, মিষ্টি লাগছে।অরুণ মনে মনে কয়েকবার ‘মাশাআল্লাহ আওড়ায়। তারপর পাতাকে বলে,

-” লেহেঙ্গা পড়ো নি কেন?”

পাতা অরুণের গম্ভীর মুখের তীক্ষ্ণ শাকুনি দৃষ্টিতে কাঁচুমাচু করলেও অরুণের কথায়‌ স্বাভাবিক হয়ে বলে,

-” ওসব লেহেঙ্গা টেহেঙ্গা আমার ভালো লাগে না। কতো ভারি আল্লাহ! আমার জন্য শাড়িই ঠিক আছে! আপনি কিন্তু একদম বকতে পারবেন না?”

অরুণ পাতার নাক টিপে এক হাতে তার গাল টেনে বলে,

-” আচ্ছা বকলাম না। শাড়িতেই মাশাআল্লাহ দারুণ লাগছে। আমাকে আগে জানালে ভালো কোনো গর্জিয়াস শাড়ি অর্ডার করতাম! এখন এই লেহেঙ্গার কি হবে?”

পাতা গালে হাত রাখে। এ লোক এমন কেন? সে কি ছোট্ট বাচ্চাটি নাকি যে নাক টিপে, গাল টিপে? তবে লোকটা তাঁর প্রশংসা করছে এতেই যেন বেহায়া মনটা বাক বাকুম করছে।

-” এই শাড়িটাও বেশ সুন্দর! ভোর পছন্দ করে দিল যে! আর ছেলে বড় হচ্ছে, কয়েকদিন পর বিয়ে করাতে হবে তাই না? লেহেঙ্গাটা ছেলের বউয়ের জন্য রাখলাম, তাকেই দিবো! আর কোনো কথা?”

অরুণ খানিক চকিত ভঙ্গিতে মাথা নাড়ে। ভোরের কপোল জোড়া লালিমায় ছেয়ে যায়। বাবার কাঁধে মুখ লুকায়। অরুণ একহাতে ছেলের মাথার চুল ঠিক করে বলে,
-” এখন চল! সবাই ওয়েট করছে আমাদের জন্য! তোমার বাড়ির লোক কতদূর পৌঁছালো?”

-” আসছে, রাস্তায়।জ্যামে পড়েছিল তাই দেড়ি হচ্ছে।”

-“ওহ্!”

বলেই পা বাড়াতে নিলে ভোর মন খারাপের সুরে বলে,

-‘ আব্বু পাতাবাহারকেও নিয়ে যাই না সাথে? ও ভয় পাবে তো একা একা!”

অরুণ ছেলের গালে আদর করে বলে,

-” খাঁচায় এতো এতো খাবার দিয়েছি। পাতাবাহার পেটপুরে খেয়ে আনন্দে ঘুমিয়ে পড়বে দেখে নিও!”

ভোর মাথা নাড়ায়। অরুণ হাঁটা দেয়, দরজা অবধি গিয়ে পিছন ফিরে বলে,

-” তোমাকে কি‌ নতুন করে আমন্ত্রণ পাঠাতে হবে?”

পাতা শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে কিছুপল। তারপর কুঁচি গুলো ধরে বড় বড় পা ফেলে অরুণের কাছে গিয়ে তার বাহু এক হাতে পেঁচিয়ে ধরে বলে,

-” চলুন?”

অরুণ বাহু আকরে ধরা পাতার হাতের দিকে চায় গম্ভীর মুখে। পাতা হাতটা সরিয়ে নিয়ে একাই সম্মুখে হাঁটা দেয় হনহনিয়ে। ওভাবে তাকানোর কি দরকার? সরাসরি বললেই হয় হাত ধরবে না।
______

রিসেপশন পার্টির পরিবেশ রমরমা। গার্ডেন এরিয়ার সম্পূর্ণ জায়গা জুড়েই বিভিন্ন গাছের সমাহার। একটু ফাকা জায়গায় ফুলে সজ্জিত ঢালু স্টেজ তৈরি করা হয়েছে। অনেকটা ফেয়ারওয়েলের মতো করে। আর গাছ গাছালি গুলোতে রঙ বেরঙের লাইটিং করে লাভ শেপের বেলুনে সজ্জিত করা হয়েছে। অরুণ রিসেপশনের জন্য হলরুম বুক করতে চেয়েছিল কিন্তু বাধ সাধে আরিয়ান। নিজের এতো বড় বাড়ি ও বাড়ির গার্ডেন এরিয়া থাকতে হলরুম কেন প্রয়োজন? প্রাকৃতিক পরিবেশের সহিত তাল রেখে এই সবুজে ঘেরা গাছ গাছালির ভিড়েই সব আয়োজন করা হবে। এবং এর দায়িত্বও নিজে কাঁধে তুলে নেয়। বিশাল আঙিনার একাংশ জুড়ে ডেকরেটরের সাহায্যে সুন্দর ভাবে সজ্জিত করেছে। আগত মেহমান ডেকরেশনের প্রশংসায় পঞ্চমুখ! গাছ গাছালির ছায়ায় পরিবেশ শীতল ও স্বস্তিদায়ক, মাথা উঁচিয়ে চাইলে গাছের পাতার ফাঁক ফোকরে চাঁদ মামার উঁকি ও তারকারাজির মিটমিট হাসি! সব মিলিয়ে অনন্য দৃশ্যবলি। আগত মেহমান পরিবেশটা বেশ এঞ্জয় করছে। স্বাধীন চৌধুরী ও সাবরিনা সাবিনা একসাথে দাঁড়িয়ে আলাপচারিতায় মগ্ন। অরুণের খালা সাবিনা গায়ে হলুদের দিন শুধু পাতাদের বাড়িতে গিয়েছিল। তারপর আজকের রিসেপশনে। বিয়ের দিনও তিনি ছিলেন না। অরুণের অফিস থেকেও অনেক লোক এসেছে রিসেপশনে। তন্মধ্যে অর্পনা, লাবিব, সুজন, মিসেস রুনা ও তার ছোট ছেলে উল্লেখযোগ্য। আরো অনেক চেনাজানা আত্মীয় স্বজনদের উপস্থিতি। আদুরি প্রিয়কে নিজের ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে। প্রিয় মেয়েটাকে তার দারুণ লেগেছে। আরিয়ান ডেকরেটরের লোকদের ও সব স্টাফদের কাজ বুঝিয়ে দিচ্ছে। রুবি ছেলেকে কোলে নিয়ে তার ভাই ভাবী ও মায়ের সাথে কথায় ব্যস্ত! আসমা বেগম তার বোন ও কিছু প্রতিবেশিদের সাথে আড্ডা মেতেছে। ছোট্ট আনিকা বাচ্চাদের সাথে খেলতে ব্যস্ত। অরুণের সব বন্ধুদের দল মিনুকে ঘিরে দাঁড়িয়ে এটা ওটা বলছে। আভারি একটু দূরত্বে দাঁড়িয়ে বউয়ের পিছনে ঘুর ঘুর করা মৌমাছির গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করছে। স্যারের সব বাদর বন্ধুগুলো নিজেদের বউ বাচ্চা রেখে তার বউয়ের পিছনে পরে। মুস্তাকিম গার্ডেন থেকে গোটা কয়েক গোলাপ ছিঁড়ে এনে মিনুর দিকে বাড়িয়ে বলে,

-” ওহে ভূবনময়ী শ্যামসুন্দরী! ফুলের জন্য এই ভুলের তরফ থেকে ফুল নিবেদন। কৃপা করিয়া আপনার ওই খোঁপায় গুঁজে ফুল গুলোকে ধন্য‌ করুণ?”

অরুণের বাকি সব বন্ধুগুলো স্বমস্বরে ‘ওহ্ হো’ বলে বাহবা দেয়। মিনু লজ্জায় আঁচলে মুখ লুকায়। এই স্যারের বন্ধুরাও না!! দূর থেকে আভারি ফোঁস ফোঁস করছে। নিক ওই ফুল গুলো আজ , তারপর শ্যামসুন্দরীর হচ্ছে! জীবন হাসি মুখে বলে,

-” আরে মিনু ! কি ভাবছো? নিয়ে নাও! লাল শাড়িতে অসম্ভব সুন্দর লাগছে! একদম আগুন সুন্দরী। খালি খোঁপাটায় এই গোলাপ গুজে নিলে সোনায় সোহাগা! আজকের পার্টির গ্ল্যামার আমাদের মিনু!”

মিনু পারে না লজ্জায় আইস্ক্রিমের মতো গলে জমিনে গলে পড়ে। রেডি হওয়ার পর আভারিও দুটো গোলাপ এনে দিয়েছিল খোঁপায় পড়ার জন্য।‌সে মানা করে দিয়েছে! এই বয়সে খোঁপায় ফুল!! ইয়া আল্লাহ্! সে না না করে বলে,

-” আরে আরে পাগল নাকি তোমরা! বুড়ো বয়সে কি সব! আমি যাচ্ছি!”

বলে পা বাড়াতে নিলে ফয়সাল দু হাত মেলে সামনে দাঁড়িয়ে আটকায়। মুস্তাকিম দুটো ফুল খোঁপায় গুঁজে দেয়। শুভ ভদ্র ছেলের মতো বলে,

-” এখন লাগছে না পার্ফেক্ট!”

রাসেল শুভর পিঠ চাপড়ে বলে,

-” ঠিক বলছিস! সিঙ্গেল থাকলে একটা চান্স নেয়া যেতো! এখন কি আর করার বউ সাথে দুইটা টেও টেও!”

দীপ্ত ঠোঁটে হাত রেখে হেসে আভারির দিকে ইশারা করে বলে,

-” ওফ যা ভাই!! টাইম বোম্ব ফুটলো বলে। সাবধান হয়ে যা। হাতে ওটা কি দেখতে পাচ্ছিস!”

সবাই হাসিমুখে আভারির দিকে চায়। এদিকেই আসছে সে, হাতে স্ক্রুড্রাইভার। সবার হাসিমুখে আঁধার নামে। সিনা টান করে দাঁড়ায়। আভারি থমথমে মুখে এগিয়ে আসছে। মিনুও খানিকটা ঘাবড়ে যায়। ওভাবে আসছে কেন? আভারির থামার নাম নেই থমথমে গম্ভীর মুখে বড় বড় পা ফেলে আসছে স্ক্রুড্রাইভার শক্ত করে হাতের মুঠোয় পুরে। জীবন ঢোক গিলে রোবটের মতো করে গটগট করে কেটে পড়ে। রাসেল টাইয়ের নট ঠিক করতে করতে অন্য দিকে চলে যায়। দীপ্তও সুযোগ বুঝে কেটে পড়ে। বাকি শুভ ও মুস্তাকিম ! মুস্তাকিম চোখ বড় বড় চেয়ে। তাকে না এই ক্ষ্যাপা আভারি মায়ের ভোগে পাঠিয়ে দেয়। আভারি হন হন করে শুভ ও মুস্তাকিমের মাঝখান দিয়ে চলে যায়। যাওয়ার সময় মুস্তাকিমের সাথে ধাক্কা লাগে খানিকটা। আভারি পা থামায় না। আরিয়ান তাকে স্ক্রুড্রাইভার নিয়ে যেতে বলেছিল। যাওয়ার পথেই এসব রঙ তামাশা দেখতে পায়। বদমাইশগুলো স্যারের বন্ধু না হলে দেখে নিতো। আর মগার বিটি মিনুকে দেখে নেবে।
আভারি চলে যেতেই শুভ ও মুস্তাকিম হাঁফ ছেড়ে বাচে। এরপর একে অপরের দিকে তাকিয়ে উচ্চ স্বরে হাসিতে ফেটে পরে। শুভর মেয়ে শুহানি এসে বলে,

-” বাবা এভাবে হাসছো কেন?”

মুস্তাকিম তাকে কোলে তুলে বলে,

-” ভুতে ধরেছে তোমার বাবাকে বুঝলে!”

সবাই রিসেপশনের প্রবেশদ্বারে তাকায়। সেথায় বর কনে দাঁড়িয়ে। সকলে তাদের সম্ভর্ধনা জানিয়ে বরণ করে নিচ্ছে। ফুলের পাপড়ি ছিটিয়ে দিচ্ছে। বর কনে প্রবেশের সাথে সাথেই বেশ কিছু আতশবাজি সমস্বরে শাঁ শাঁ করে খোলা জায়গায় দিয়ে আকাশপানে উড়ে যায়। সেথায় উচ্চ শব্দ সৃষ্টি করে রঙ বেরঙের আলোর বিচ্ছুরণ কনা ছড়িয়ে পড়ে। সুউচ্চ গাছে অবস্থিত কিছু পাখির দল উড়ে বেড়ায় ভয়ে।
ভোর খুশি হয়ে হাততালি দেয়। বাবাকে দেখায় কি সুন্দর আলো ছড়াচ্ছে। সাথে আবদার করে,

-” আব্বু আমিও উড়াবো আতুশবাজি! প্লিজ আব্বু?”

অরুণ শান্ত গলায় বলে,

-” একদম না! এগুলো খুবই রিস্কি কলিজা! জেদ করবে না!”

ভোর গাল ফুলিয়ে অরুণের কোল থেকে নামার জন্য ছটফট করে। অরুণ ছাড়ে না। ধমকের সুরে বলে,

-” কি হচ্ছে টাকি ভোর?”

ভোর ধমক শুনে শান্ত হয়ে যায়, থমথমে গলায় বলে,

-” নামবো আমি। নামিয়ে দাও!”

অরুণ নামিয়ে দেয়। ভোর নেমেই দৌড়ে অন্যত্র চলে যায়। অরুণ ডাকে শোনে না। আরিয়ান ভাইকে বলে,

-” থাক অনেক বাচ্চা আছে তাদের দেখলেই সব ভুলে যাবে! তুই এখন এদিকে ধ্যান দে ভাই!”

অরুণ মাথা নাড়ে। পাতার পাশে চুপটি করে দাঁড়িয়ে থাকে। আর পাতা নীরব দর্শক। ক্যামেরাম্যান নিজের কাজে ব্যস্ত। আদুরি বন্ধুবান্ধব সহ প্রিয়কে নিয়ে এগিয়ে আসে। পাতার হাত ধরে বলে,

-” বড় ভাবি কি সুন্দর লাগছে তোমায় শাড়িতে। লেহেঙ্গা পড়নি কেন? পছন্দ হয় নি?”

পাতা কি বলবে ভেবে পায় না। অরুণের দিকে চায় আড়চোখে। অরুণ বুঝতে পেরে আদুরিকে বলে,

-” লেহেঙ্গার ফিটিংসে কিছু প্রবলেম ছিল তাই!”

রাসেল এগিয়ে এসে অরুণের পিঠ চাপড়ে বলে,

-” আমি তো ভেবেছি তুই লেহেঙ্গাটা ছেলের বউয়ের জন্য রেখে দিয়েছিস!”

পাতা মাথার ঘোমটা টানে। কেমন যেন অস্বস্তি হচ্ছে তার। বাড়ির লোকেরা এখনো আসে নি? সে প্রিয়কে ইশারা করে। প্রিয় তার ইশারার মানে বুঝে ঠোঁট উল্টিয়ে না বোঝায়। জীবন সেটা লক্ষ্য করে গুনগুন করে বলে,

-” চোখে চোখে এতো কথা মুখে কেন বলো না! আরে ভাবি আমার জান আইমিন ভাবিজান! কিসের ইশারা চলছে বেয়ানের সাথে হুম?”

ফয়সাল জীবনের কাঁধে মাথা রেখে আফসোস করে বলে,
-” অরুণ তুই কাজটা মোটেও ঠিক করিস নি! এইটুকুনি মেয়েকে ভাবি বলতে হচ্ছে! আর বেয়ানগুলো দেখ বাচ্চাদের বয়সী! মজা করে কিছু বলতেও পারি না।”

অরুণ চোখ রাঙিয়ে বলে,

-” অফ যা তোরা।

তন্মধ্যে সেখানে সাবিনা ও স্বাধীন চৌধুরীর আগমন ঘটে। পাতা তাদের দেখে সালাম দেয়। স্বাধীন চৌধুরী সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলে,

-” সবাই এখানে কি করছো? স্টেজে যাও! সবাই বর কনেকে দেখার জন্য অধীর আগ্রহে!”

উপস্থিত সবাই সায় জানায়। অরুণ পাতাকে আসতে বলে পা চালায়। শুভ অরুণের হাত ধরে আটকিয়ে বলে,

-” আরে ভাই এতো তারা কীসের? ভাবিকে সাথে নি? হাত ধরে নিয়ে যা। সি ডিজার্ভ আ ট্রিটমেন্ট লাইক কুইন!”

পাতা শুভ স্যারের দিকে চায়। সথে সাথেই নজর ঘুরায়। একটু লজ্জা পেল কি? পাওয়ারই কথা এক কালের ক্রাশ ছিল! ডিপার্টমেন্টের সবচেয়ে মিষ্টভাষি ও হ্যান্ডসাম স্যার ছিল, সাথে অমায়িক ব্যবহার।স্টুডেন্টস দের প্রিয় ও আধুনিক ভাষায় মেয়েদের ক্রাশ। অথচ তিনি বিবাহিত!পাতা তোর পোড়া কপাল ক্রাশ যখন দেবর।পাতা মনে মনে নিজের গালে কষে একটা থাপ্পড় লাগায়।জামাই থাকতে জামাইয়ের বন্ধুর দিকে নজর দিস!

অরুণ শুভর দিকে চায় কটমট করে। কিন্তু শুভ শান্ত ও সিরিয়াস মুখে। শুভর অভিজ্ঞ নজর আগেই বুঝতে পারে অরুণ আর পাতার বিয়েটা যেমন স্বাভাবিক হয়েও স্বাভাবিক নয়, তেমনি তাদের সম্পর্কের বাঁধনও ভঙ্গুর। সে অরুণকে চোখের ইশারায় হাত ধরতে বলে। অরুণ হাত ছাড়িয়ে নেয়। শুভ অনুরোধের সুরে ধীমে সুরে বলে,

-” প্লিজ ভাই?”

অরুণ মেনে নেয়। এগিয়ে এসে পাতার ডান হাত হাতের মুঠোয় পুরে নেয়। পাতা অনুভূতি হীন। সে বুঝতে পারে না লোকটাকে। এমনিতে হাত ধরে, কাঁধ জড়িয়ে ধরে একান্তে। কাল রাতেও..!! অথচ এখন এমন বিহেভ করছে কেন? লোক সমাগমে হাত ধরলে কি তার জাত চলে যাবে নাকি!

ক্যামেরার ফ্লাশ লাইট জ্বল জ্বল করছে সেকেন্ড অন্তর অন্তর। অরুণ পাতা অন্যসব কাপলদের মতো রোমান্টিক পোজ দিচ্ছে না। দু’জনই চুপচাপ দাঁড়িয়ে। মাঝখানে ভোর হাসিমুখে দাঁড়িয়ে। অরুণের গম্ভীর মুখশ্রীতে হাসির ছিটেফোঁটাও নেই। তবে পাতা হাসিমুখেই। তার মনটা ভালো ও ফুরফুরে হয়ে গেছে। মন ভালো হওয়ার কারণ বাড়ির লোকের আগমন ও তাদের সাথে কুশল বিনিময়। আর মন ফুরফুরে হওয়ার কারণ বাবা ওরফে রহিম মিয়ার উপস্থিতি। পাতা তাকে দেখে কেঁদেই দিয়েছিল। বাবা ব্যস্ততার মাঝেও যে তার রিসিপশনে এসে, তাকে বুকে জড়িয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দোয়া করে দেবে এটা সে ভাবেই নি।সব মিলিয়ে পাতা বেশ খুশি, চেহারার মলিনতা যেন উবে গেছে।
ভোর কিছু পল ছবি উঠিয়ে যেন হাঁপিয়ে গেছে। সে ছোট ছোট পা ফেলে স্টেজ থেকে নামতে নেয় পিছন থেকে অরুণ আটকে দেয়!

-” কোথায় যাওয়া হচ্ছে শুনি?কলিজা চুপচাপ আমার সাথেই থাকবে সর্বক্ষণ।”

অরুণের কথায় ভোর গাল ফুলিয়ে পাতার আঁচলে মুখ লুকিয়ে বলে,

-” আমি কারো কলিজা না। কেউ ভালোবাসে না আমায়!”

অরুণ কিছু বলে না। ঢের চেনা আছে তার নাট্যকার ছেলেকে। পাতা মুখ টিপে হাসে।

-” কেউ ভালোবাসে না ভোর সোনাকে? আমিও না?”

-” নাহ্। তুমি প্রমিজ ব্রেকাপ করেছ! ওই গাল ফুলো লাবিব, রুম্পা, শুনি সবাইকেই আদর করেছ!”

-” ওটা শুনি নয় শুহানি!”

ভুল ঠিক করে দেয় পাতা। এতে ভোরের ফুলো গালটা আরো ফুলে যায়। পাতার আঁচল ছেড়ে বাবার হাত ধরে সম্মুখে তাকায়। পাতা ভোরের মাথায় হাত রেখে কিছু বলবে এর পূর্বেই ভোর ‘মা’ বলে অরুণের হাত ছেড়ে দৌড়ে চলে যায়। পাতা অবাক হয় বেশ। মা কাকে ডাকলো? তার সামনে তাকানোর সাহস হয় না, সে অরুণের দিকে চায়। যে কিনা স্থীর নয়ন মেলে সম্মুখে চেয়ে পলকহীন। পাতা ঢোক গিলে সামনে ফিরে। তার শান্ত দৃষ্টি সামনের মানবীর দিকে, যার কোলে ভোর হাসিমুখে ভাব বিনিময়ে ব্যস্ত। বাকি উপস্থিত জনরা ও সরকার ফ্যামিলির মধ্যে চাপা গুঞ্জন শুরু হয় সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে তার পরিবারের দিকে তাকায়। সবার মুখেই অবাকতা ছেয়ে আছে। সে পুনরায় অরুণের দিকে চায়, অরুণ কিন্তু তার দিকে চায় না।
বর্ষা হাসিমুখে ভোরকে কোলে নিয়ে আদর করতে ভোলে না। এটা ওটা বলে স্টেজে উঠে আসে। অরুণ ও পাতার সামনে দাঁড়িয়ে হাত বাড়িয়ে হাসিমুখে অভিনন্দন জানায়,

-” কনগ্রেটস অরুণ। দোয়া করি তোমাদের ম্যারিড লাইফ ভালোবাসায় ভরপুর হোক!”

অরুণ হাত না বাড়ালেও পাতা ঝটপট হাত বাড়িয়ে বর্ষার হাত ধরে। কেন? জেলাসি, ভয় নাকি সংশয়!! হু নোস। অরুণ হাসে। বর্ষা হাসে পাতার রিয়েক্টে। ভোর বর্ষার কোল থেকে নেমে পাতার হাত ধরে বলে,

-” এই হলো আমার আম্মু! অনেক সুন্দর ও মিষ্টি, তাই না মা? আমাকে অনেক ভালোবাসে। তোমার মতো রেখে যাবে না হুম! আম্মু আমাকে ছেড়ে কখনো চলে যাবে?”

শেষ কথা পাতার বাহু ঝাঁকিয়ে বলে। অরুণের অধরকোণে হালকা বাঁকা হাসির রেশ। পাতা একনজর বর্ষার আঁধার নামা মুখশ্রী দেখে নিয়ে নিচু হয়ে ভোরের ললাটে চুমু দিয়ে বলে,

-” কখনো না সোনা!”

ভোর হাসিমুখ উজ্জ্বল নক্ষত্রের নেয় জ্বল জ্বল করে ওঠে। অরুণ ভোরের চুলের ভাঁজে হাত বুলায়।
স্টেজে আগমন ঘটে আরিয়ান, আসমা বেগম, শুভ সহ আরো কিছু জন। আরিয়ান অরুণের দিকে তাকিয়ে বলে,

-” ভাই আমি কিন্তু বিনা দাওয়াতে আগত কোনো মেহমান খাওয়াতে পারবো না। পোটলা পাঠলি নিয়ে আগেই বের করো!”

বর্ষার তিরষ্কার বুঝতে সময় লাগে না। মুখে হাসি ঝুলিয়ে বলে,

-” বিনা দাওয়াতে আসি নি আরিয়ান! অরুণ ফোন করেছিল!”

সবাই অবাক নেত্রে অরুণের দিকে চেয়ে। অরুণ স্বাভাবিক ভাবেই বলে,

-” তুমিই ফোন করেছিলে আমি না। আর দাওয়াত ভোরের তরফ থেকে ছিল!”

আসমা বেগম গম্ভীর গলায় অরুণকে উদ্দেশ্য করে বলে,

-” ভোর ছোট, কারো ভালোমানুষীর নাটক বোঝে না। তুমি তো বোঝ অরুণ! তোমার থেকে এটা আশা করি নি।”

বলেই স্টেজ থেকে নেমে যায়। বর্ষা ও পাতা থমথমে মুখে দাঁড়িয়ে।ভোর বর্ষার হাত ধরে নিয়ে যায় অপর্ণা,লাবিবদের দিকে; তাদের সাথে মায়ের আলাপ করিয়ে দিবে।
শুভ এসে অরুণকে এক প্রকার টেনেই নিয়ে যায়। পাতা ভরাট চোখে সেদিকে তাকিয়ে। চোখ বেয়ে বারিধারা বইলো বলে , পাতা পলক ঝাপটিয়ে সেগুলো লুকোনোর বৃথা চেষ্টা করে। আদুরি তার কাঁধে হাত রেখে বলে,

-” বড় ভাবি তুমি ঠিক আছো?”

পাতা মুচকি হেসে জবাব দেয়,

-” হুম! চলো ওদিকটায় যাই!”

আদুরি সায় জানিয়ে পাতার হাত ধরে নিয়ে যায় সেদিকে।

শুভ অরুণকে টেনে ফাঁকা নিরিবিলি জায়গায় নিয়ে আসে, রিসেপশনের বাইরে। অন্ধকার না হলেও মানুষ জন নেই। শুভ রাগে ক্ষোভে অরুণকে বলে,

-” তোর থেকে স্বার্থপর মানুষ হয়? অথচ তুই বর্ষাকে স্বার্থপর বলিস!”

অরুণ ঝটকায় শুভর হাত ছেড়ে দিয়ে বলে,

-” কি স্বার্থ হাসিল করলাম শুনি?”

শুভ চোখ রাঙিয়ে বলে,

-” চিল্লাচিল্লি করবি না খবরদার! বর্ষা এখানে কি করছে? ওকে এখানে আনার কিসের দরকার? একবার ভেবেছিস পাতা মেয়েটার কথা? বিয়ের রিসেপসনে বরের প্রাক্তন স্ত্রী হাজির! ওর মনের ভিতর কি চলছে এখন? ওর কথা বাদই দিলাম ওর পরিবার?”

অরুণ খানিক নিরব থেকে বলে,

-” বর্ষা এখানে কি করছে আমি কিভাবে বলব? মার্ক মায় ওয়ার্ড ওকে আমি ইনভাইট করি নি! ভোরের জেদে এসেছে। আর কেউ কিছুই ভাববে না। ভাবলে আমার কিছু করার নেই!”

শুভ হাসে।

-” তোর কিছু করার নেই তাই না? ভালো! বিয়ে করে মেয়েটার জীবন নষ্ট করলি কেন অরুণ? তুই এখনো বর্ষার ঘোর থেকে বের হতেই পারিস নি আমার মনে হয়! ভোর তো কথায় কথায় জেদ ধরে। আতশবাজি ফোটানোর জন্যও তো জেদ করলো তুই মানা করে দিলি সাফ সাফ। তাহলে বর্ষাকে আনার জেদে মানা করিস নি কেন? নাকি বর্ষাকে ডেকে এনে জেলাস ফিল করাতে চেয়েছিলি? যে দেখ বর্ষা তোমার থেকে সুন্দর ও ভালো মেয়ে এনেছি যে ভোরকে সর্বদা ভালোবাসবে!”

ইতিমধ্যে অরুণ শুভর আলোচনায় উপস্থিত হয় বাকি সব বন্ধুরা। রাসেল শুভর কথার পিঠে বলে,

-” শুভ এ কেমন ছেলেমানুষী কথাবার্তা! ছোট্ট একটা ব্যাপার নিয়ে এতো কথাকাটাকাটির কি দরকার। আর এখানে অরুণের কি দোষ?”

-” ওর আবার কি দোষ! ও তো সাধু পুরুষ! সব দোষ ওই পাতা মেয়েটার।”

বলেই চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়ায়। এরমধ্যে জীবন টিপ্পনি কেটে বলে,

-” অশুভ! তোর দেখছি পাতা ভাবিইইজানের প্রতি খুউব দরদ! অরুণ ওর থেকে সাবধানে হ্যাঁ?”

শুভ তেড়ে আসার আগে অরুণ জীবনের পশ্চাতে লাথি লাগায়। জীবন সেথায় হাত বুলিয়ে আফসোস করে বলে,

-” ভালো মানুষের ভাত নেই! হুহ।”

শুভ কটমট করে বলে,

-” মেয়েটা স্টুডেন্ট আমার! মজাতেও আজেবাজে কথা বলবি না।”

-” আমি তো থমথমে মহলটাকে স্বাভাবিকে আনতে মজা করে বলেছিলাম ভাই! তোরা সব কয়টা হারামী! যা সর!”

বলেই জীবন চলে যায়। অরুণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে। শুভ তার দিকে তাকিয়ে হনহনিয়ে চলে যায়। বাকি সবাই অরুণের সহযোগী!

দুই বোনের মাঝে থমথমে ভাব বিরাজমান। লতা পাতাকে প্রশ্ন বাণে জর্জরিত করছে। পাতা নীরব, কখনো হু হা করছে। লতা অবশ্য এতে থামেনি। লতা ধীমে গলায় হিসহিসিয়ে বলে,

-” অনেক সুখের সংসার তোর। দেখতেই পেলাম! আহা চক্ষু জুরাইয়া গেলো! জামাই বাড়ি জামাই বাড়ি বলে লাফাচ্ছিলি, না? এখন লাফা! আহাম্মক, গর্দভ!”

পাতা চুপচাপ সব হজম করছে। এখানে তার কি দোষ, তারই বা কি করার আছে। তাদের দুজনের মধ্যে কথোপকথনের মাঝে বর্ষার আগমন ঘটে। পাতা লতার হাত শক্ত করে ধরে। লতা তার হাত ছাড়িয়ে নিয়ে ফিসফিস করে বলে,

-” তোর ঝামেলা তুই ই ম্যানেজ কর ! আমি টা টা বাই বাই!”

বলে চলে যায়। বর্ষা ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করে,

-” চলে গেল কেন?”

পাতা ঠোঁট উল্টিয়ে কাঁধ ঝাঁকায়। কি জানি! বর্ষা ঠোঁট গোল করে ‘ওহ্’ বলে। পাতা প্রতিত্তরে কিছু বলে না। কি বলবে? স্বামীর প্রাক্তন স্ত্রীর সাথে নিশ্চয়ই রসের আলাপ জুড়ে দেবে না। ওতটাও ভদ্রমহিলা পাতা না। বর্ষাই নিরবতা ভেঙ্গে বলে,

-” কি দিনকাল এলো বলো? মানুষ টাকার পাগল! টাকা দেখলে কিছুই বাছে না। সৎ অসৎ, বুড়ো বা এক বাচ্চার বাপ!”

বলে চুক চুক শব্দ করে আফসোস করে। পাতা বত্রিশ পাটি বের করে হাসি দেয়

-” ঠিক বলেছেন! টাকা দেখলে কাঠের পুতুলও হা করে শুনেছি। টাকার পিছনে ছুটতে গিয়ে মানুষ নিজের দুধের বাচ্চাকে পর্যন্ত ভুলে যায়! তাদের কাছে টাকাই সব।”

বর্ষা ঢের বুঝতে পারে এ মেয়ে পুরাই ধানি লঙ্কা। দেখতে নরম শোভা, ইনোসেন্ট ফেস হলেও মোটেও সেরকম নয়। পাতা বর্ষার কথার পৃষ্ঠে জবাব দিতে পেরে যেন আকাশে ওড়ে। আহ্ এতো শান্তি শান্তি লাগছে কেন? ব্যাপারটা আসলেই অনেক আনন্দের। কেউ তোমাকে অপমান করার জন্য ইট হাতে মুখিয়ে আছে আর তুমি তার অপমানের পৃষ্ঠে অপমানের পাটকেল ছুড়ে জবান বন্ধ করে দাও এর যে শান্তিময় অনুভূতি তা বলে বোঝানো যায় না। বর্ষাও থেমে যাওয়ার পাত্রী নয়। মুখে প্লাস্টিকের হাসি ঝুলিয়ে বলে,

-” তুমি খুব মিষ্টি। আশা করি অরুণ খুব শিঘ্রই মেনে নেবে সব! একচুয়ালি হি ম্যাডলি লাভস মি..”

-” মেনে নেওয়ার প্রশ্ন আসছে কোথা থেকে! উই আর হাসবেন্ড ওয়াইফ! এন্ড ইটস নট অ্যারেঞ্জ ম্যারেজ ইটস সাম কাইন্ড ওফ লাভ ম্যারেজ। এভরিথিং ইজ ফাইন বিটউইন আস লাইক এভরি ম্যারিড কাপল!আই থিংক ইউ আন্ডারস্ট্যান্ড হোয়াট আই মিন?”

বর্ষা শান্ত চোখে চায় পাতার দিকে।অরুণ নিঃসন্দেহে হাসবেন্ড ম্যাটেরিয়াল।এরকম ওয়াইফ ম্যাটেরিয়াল বউ পেলে তো সোনায় সোহাগা জুড়ি।সে হাসে,নকল হাসি নয়!মন থেকেই।পাতার থুতনিতে হাত রেখে শান্ত গলায় বলে,

-“স্বামী সোহাগী হও! মন খারাপ কোরোনা আমার কথায়।অরুণ খুব হাসবেন্ড ম্যাটেরিয়াল!তোমায় আদরে মাথায় তুলে রাখবে মিলিয়ে নিও। আমি খুবই বাজে মা আমি নিজেও স্বীকার করি! তবে আমি বরুণকে ভালোবাসি। তোমার হাসবেন্ডের সাথে আমার ছেলেটাকেও ভালোবেসো! আমি তো ভালো মা না, তুমি ওর ভালো আম্মু হয়ে উঠো। দোয়া করি অনেক অনেক সুখী হও!”

পাতা সন্দেহ নজরে তাকিয়ে আছে। পাশা পাল্টিয়ে দিল কেন? সে তো কোমড় বেঁধে নেমেছে। তার রিসেপশনে এসে বাগড়া দেয়া!কিছু সময় থেমে বর্ষা আবার বলে,

-” রাগ হচ্ছে আমার উপর তাই না? হওয়াটাই স্বাভাবিক! তোমাদের ইম্পর্ট্যান্ট একটা দিনে ঝামেলা সৃষ্টি করলাম। স্যরি! আসলে তোমাকে দেখার খুব ইচ্ছে ছিল, দেখলাম। আমাকে নিয়ে সংশয় রেখ না মনে। আমি তোমাদের সংসার থেকে অনেক দূরে। তবে মাঝে মাঝে বরুণকে দেখতে আসবো। ভালো থেকো আসছি! ভোরের মিষ্টি আম্মু মিষ্টি ভোরকে মন থেকে ভালোবেসো!”

বলে চলে যায়। পাতার কাছ থেকে না রিসেপশনের প্রবেশদ্বার দিয়ে বাইরে চলে যায়। পাতা অবাক লেচনে চেয়ে। কি হয়ে গেল, কি বলে গেল? যাক গে তার কি! পাতা ইউ সুড বি ফোকাস ওন ইউর শালার জামাই! দ্যাটস ইট।
___

-” দেখলি তো! একেবারে ভাগিয়ে দিল। এই মেয়ে দেখতে সাদাসিধা হলে কি হবে, গভীর জলের মাছ। তোর দিন ফুরিয়ে আসছে রুবি!”

মায়ের কথায় রুবি খানিকটা বিরক্ত হয়। কিছু না শুনে বুঝে এমনি একটা বললে তো হবে না। তারা পাতার থেকে খানিকটা দূরে দাঁড়িয়ে তাদেরকেই লক্ষ্য করছিল। শুধু তারা না সকলেই। প্রাক্তন ও বর্তমান মুখোমুখি, এরকম এন্টারটেইনমেন্ট কেই বা মিস করতে চায়। বর্ষা ও পাতার কথাবার্তা কানে না আসলেও তাদের সর্বোচ্চ ধ্যান ওদিকেই ছিল। রুবি মায়ের কথার প্রেক্ষিতে বলে,

-” মা বাদ দাও এসব কথা। পাতা মেয়েটাকে শান্ত শিষ্ঠই মনে হয়। না হলে আমার কি! অরুণ ভাইয়া সংসার করবে আমি না!”

রুবির ভাবি হেসে রুবির কাঁধে হাত রেখে গলার স্বর নামিয়ে বলে,

-” একই বাড়ি, একই রান্নাঘর সবকিছুই একসাথে তো সংসার কি আলাদা নাকি? তোমার বড় জা! ভালো হলে তো ভালোই। আর শেয়ানা হলে তো তুমি গেলে ননদিনী! তোমায় আঙ্গুলের ইশারায় নাচাবে বুঝতেও পারবে না। আজকাল আপন ভাইদের মধ্যেই পড়ে না মারামারি কলহ লেগেই থাকে। সেখানে অরুণ ভাইয়া তো সৎ, তোমার শশুরও বেঁচে নেই। এক সংসারে কলহ লাগতে কতক্ষন! নতুন বউ এলো সে যদি মাথা খায় তাহলে তো হলোই। মেয়ে মানুষ কঠোর সন্ন্যাসে ব্রতচারীদের ব্রতও ভেঙ্গে দিতে পারে এক চুটকিতে। আরিয়ানকে একটু বুঝিয়ে বলো!”

রুবি খানিকটা ভাবনায় পড়ে যায়। কথাগুলো বাস্তবিক দিয়ে যথার্থই মনে হচ্ছে। অরুণ ভাইয়াকে সে চেনে, ভালো মানুষ। কিন্তু পাতা ভাবি? তাকে তো সে চেনে না। ভাবীর কথা গুলোই কি ঠিক বর্তাবে? রুবির মা রুবির ভাবনা গুলোকে আরেকটু রঙিন করতে রঙ মিশিয়ে বলে,

-” শোন অরুণটাও কিন্তু কম শেয়ানা না। তোর শশুর সব প্রপার্টি ভাগ করে দিয়েছে। আরিয়ানের থার্টি, অরুণের থার্টি, তোর শাশুড়ি ও ননদের টোয়েন্টি পার্সেন্ট করে। অফিসের ভাগ কিন্তু করে যায় নি। আর এখন অফিস কার দখলে? কত বড় ব্যবসা! মোটা অংকের আয় হয় সেখানে; সংসারে কত দেয়? দেখ হয়তো এখানে ওখানে ফ্ল্যাট, প্রপার্টি কিনে জমা করছে। আরিয়ান কি পায় সেখানে থেকে? কচু পায় আর ভবিষ্যতেও তাই পাবে। ওকালতি করে কি করবে ভবিষ্যতে?”

রুবি এবার সত্যিই ভাবনায় পড়ে। এ যে আধুনিক অ-কাল। আপন ভাই, ভাইয়ের হক মেরে খায়, ভাইয়ের সাথে দাঙ্গা লাগায়। সেখানে এরা তো সৎ। এখন মিল আছে কাল কলহ সৃষ্টি হতে কতক্ষণ। আর তাছাড়াও অরুণ ভাই ভোরকে নিয়ে তাদের থেকে একটু দূরে দূরেই থাকে। এসব খুঁটিনাটি বিষয় নিয়ে আরো আলোচনা চলতে থাকে তিনজনের মধ্যে। তবে সেটা ফিসফিস শব্দের। তবে তিনজনের এ খেয়াল নেই যে তাদের ফিসফিসানি শব্দও কারো কর্ণ গহ্বরে পৌঁছে গেছে। অরুণ দীর্ঘশ্বাস ফেলে। এসব তার কাছে নতুন নয়। পারা প্রতিবেশি নিকটাত্মীয় যারাই বাড়ি আসে আড্ডা অনুষ্ঠানে তাদের মুখে এইসব কথায় শোনা যায়। অরুণ আর দাঁড়ায় না। পা বাড়ায়, ছেলেকে খোঁজার জন্য। পথিমধ্যে লতার ডাকে দাঁড়িয়ে পড়ে। লতা একা নয় সাথে লাবিব ও কাওছার। অরুণ পকেটে হাত ঢুকিয়ে বলে,

-” কিছু বলবে লতা? আসলে ভোরকে খুঁজছিলাম!”

লতা অরুণের থেকে যথারীতি দূরত্বে দাঁড়িয়ে মাথা উঁচু করে স্পষ্টতই বলে,

-” কিছু জরুরী কথা আছে। আর ভোর আপনার অফিসের লোক পরনা না কি যেন নাম তাদের কাছে আছে।”

লতার কথায় অরুণের কপালে ভাঁজ পড়ে। এ কি বলবে আবার।

-” ওহ্। কি বলবে বলো?”

লতা নির্দ্বিধায় বলতে শুরু করে,

-” আমি ভনিতা ভুজুং ভাজুং পছন্দ করি না। স্ট্রেটকার্ট কথা বলতে পছন্দ করি।কাল আপনার ও পাতার প্রথম রাত ছিল। ফাস্ট নাইট নিয়ে সকলের মনেই ফ্যান্টাসি থাকে। পাতারও ছিল। ও স্বামী সংসার নিয়ে অনেক স্বপ্ন বুনতো। এমনকি আমাদের বলতেও জড়তা করতো না। জানি আপনাদের বিয়েটি হয়তো ওতটাও স্বাভাবিক নয়। কিন্তু প্রস্তাব টা কিন্তু আপনি দিয়েছিলেন, পাতা মেনে নিল। তাহলে অস্বাভাবিক কিছু আসবে কিভাবে? কাল রাত আপনার আর পাতার ছিল। দুজনে একাকি গল্প করেই কাটাতে পারতেন, নিজেদের মধ্যে কথা বলে সম্পর্কটাকে একটু এগিয়ে নিতে পারতেন। কিন্তু আপনি দেয়াল স্বরূপ ভোরকে মাঝে আনলেন। আমার কথায় কিছু মনে করবেন না। ভোর এখানে থার্ড পারসন নয় বরং আপনাদের দুজনের মধ্যে সেতুবন্ধন হবে হয়তোবা। বাট কাল রাতটা আপনাদের দুজনের ছিল।”

লতা বলতেই থাকে কিন্তু তার কথা শোনার জন্য অরুণ দাঁড়ায় না গট গট করে চলে যায়। এদিকে ওদিকে তাকিয়ে পাতাকে খুঁজতে থাকে। পেয়েও যায়। তার বন্ধুদের ওয়াইফদের সাথে কথা বলছে। অরুণ তোয়াক্কা না করে পাতার হাত ধরে একপ্রকার টেনেই নিয়ে আসে। বন্ধুর বউয়েরা টিপ্পনী কাটে, অরুণ কানে নেয় না। পাতার শাড়ি সামলিয়ে হাঁটতে বেগ পোহাতে হয়। কুঁচি বাম হাত দিয়ে ধরে কোনো মতে পা চালায়।

-” কি হচ্ছে টাকি ভোরের বাবা? আমি গরু নাকি যে টেনে নিয়ে যাচ্ছেন! বললেই তো সাথে যেতাম! হয়েছে টা কি?”

অরুণ একেবারে কোনায় নিরিবিলি জায়গায় গিয়ে থামে। পাতার দিকে ক্ষুব্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে গম্ভীর গলায় সুধায়,

-” কাল রাতে আমি ভোরকে আমাদের সাথে রাখার জন্য আপনার থেকে পারমিশন নিয়ে ছিলাম কি না?”

পাতা মনে করার চেষ্টা করে কখন পারমিশন নিয়েছিল! শুধু বলেছিল ভোর আমাদের সাথেই থাকবে আপনার কোনো সমস্যা? পারমিশন তো চায় নি। তবুও পাতা মাথা নেড়ে হ্যাঁ বোঝায়। অরুণ এক হাতে পাতার কাঁধ ঝাঁকিয়ে কণ্ঠ খাদে নামিয়ে ধমকের সুরে বলে,

-” ভোর কাল রাতে আমাদের সাথে ছিল সেটা বোনের কাছে বলে নালিশ জানানোর কিসের প্রয়োজন পড়লো? আমায় অপমানিত হতে হলো কেন? কাল যা হয়েছে সেটা আমাদের পার্সোনাল বিষয় ছিল। অন্যকেউ কেন জানবে? আপনার প্রবলেম হলে আমাকে বলতে পারতেন তখন? ভোরকে আমাদের মধ্যে দেয়াল হিসেবে রেখেছিলাম কাল? স্পিক আউট!”

ধমকে পাতার অন্তর আত্মা কেঁপে ওঠে। আপু ওনাকে অপমান করেছে? সে তো নালিশ জানায় নি। আপু জিজ্ঞেস করেছিল ভোর তোদের সাথে ছিল কি না? সে শুধু মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মতি জানিয়েছে। এই আপুটাও না। পাতা ঢোক গিলে অস্পষ্ট সুরে ‘আপু’ বলে। অরুণ পাতাকে ছেড়ে দেয়। খানিক দূরে দাঁড়িয়ে বলে,

-” আমি আগেই বলেছি আমার কাছে পার্থিব জীবনে আমার ছেলে সবার আগে, তারপর বাকি সবাই। তাকে ছাড়া এই অরুণ সরকার শ্বাস পর্যন্ত নিতে পারে না। ওর হৃদস্পন্দনের জন্যই আমার হৃৎপিণ্ড স্পন্দিত হয়। আমার ভোর আমার কলিজা। আপনার বোনকে বলে দেবেন।”

চলবে…

#পাতা_বাহার
লেখনীতে: #বেলা_শেখ
#পর্ব- ৩০ (প্রথমাংশ)

(কপি করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ)

হৈ চৈ হুল্লোড় মুখর পরিবেশ এখন শান্ত পরিবেশে বদলে গেছে। গাছে গাছে বিদ্যমান নিশাচর ভবঘুরে বিহঙ্গের দল যেন জানে প্রাণ ফিরে পেয়েছে। মা বাবুই তার বাচ্চাগুলো নিয়ে সংশয়ে জেগে আছে। তবে বাচ্চার দল নিশ্চিত মনে মায়ের ডানার ছায়ায় মুড়ে।
আভারি নিজ ঘরে নিজ বিছানায় হাত পা ছড়িয়ে ঘুমিয়ে আছে। ঘুমিয়ে আছে বলতে শুধু নেত্রযুগল বন্ধ করে ঘুমের অভিনয় করার প্রয়াসে। বন্ধ নেত্রযুগল পিট পিট করা তার মোক্ষম প্রমাণ। মিনু তার পায়ের কাছে বসে পা গুলো টিপে দিচ্ছে আস্তে আস্তে। মাঝে মাঝে ডাকছেও। কিন্তু আভারি মটকা মেরে শুয়ে দাঁত কটমট করছে জবাব দিচ্ছে না। মিনু বেশ কয়েকবার ডাক দিয়েও সারা না পেয়ে বিরক্ত হয়। পা টিপা বন্ধ করে শিরদাঁড়া সোজা হয়ে বসে বলে,

-” আপনে কিন্তু এবার বাড়াবাড়ি কইরতেছেন! ভোর বাবার মতো জেদ ধইরে বসে আছেন। আরে বাবা অরুণ স্যারের বন্ধুরা মজা করে আমার আপনের লগে। আপনি বুঝেন না খালি চ্যাতেন!”

এবার কাজ হয়। আভারি উঠে বসে, পা দুটো টেনে নেয় নিজের কাছে। দাঁত কপাটি কটমট করে বলে,

-” আমি তো বাড়াবাড়িই করি! ওই পোলারা কমকম করে। আমি ফুল দিলাম, ‘বুইড়া কালে এইসব খোঁপায় দিলে লোকে কি কইবে’ আর ওই ছোকরা গুলো দিলো তহন বুইড়া ছিলে না? কুড়ি বছরের ছুরি ছিলা? আবার খোঁপায় গুঁইজে দিল! সে কি লজ্জা ! বাহ্ কি রোমান্টিক দিশশো!”

মিনু মুখ টিপে হাসে। এই লোক তো ভোরের থেকেও বেশি ছেলেমানুষী করে। সে হাই তুলে বলে,

-” আপনের জ্বলে?”

আভারি যেন জ্বলন্ত চোখে চায়। মিনু তার চাহনিকে থোরাই ভয় করে। সে বালিশ ঠিক করে শুয়ে পড়ে। আভারিকেও টেনে শুয়ে দেয়। স্বামীর মাথায় হাত বুলিয়ে হেসে বলে,

-” আপনে একটা পাগল!”

আভারির অভিমান অভিযোগ গলে পড়ে যায়। মুখশ্রী জুড়ে হাসির রেখা ফুটে ওঠে।

-” তুমি পাগলের বউ পাগলি! বুঝলে?”

‘হুম’ বলে মিনু হাসে। হাসতে হাসতেই খেয়ালে ডুবে অন্যমনস্ক হয়ে যায়।

-” স্যারের নতুন বউ পাতা মাইয়াটা ভালোই, তাই না? ভোর বাবারে কত্তো আদর করে। ভোর বাবার এহন এই মিনু খালার দরকার পইড়বে না, তাই না?”

আভারির হাসিমুখেও বিষাদ নামে। ছোট্ট ছেলেটা তাদের নিঃসন্তান দম্পতির সন্তানের অনুভূতি কিছুটা হলেও অনুভব করিয়েছে। ছোট্ট ভোর স্কুলে যাওয়া শুরু করার পর অরুণের সাথে অফিসে যেতো না। স্কুল থেকে ফিরে তাদের সাথেই থাকতো বেশিরভাগ সময়। ছোট খাট আবদারের ঝুলি নিয়ে আসতো মিনুর কাছে। ‘মিনু খালা নুডুলস বানিয়ে দাও!’ নুডুলস খাইয়ে দাও’ ভারি কাক্কুকে বলে চুপিচুপি আইসক্রিম আনিয়ে দাও? আমার সাথে ক্রিকেট, ফুটবল খেলো!’ রাজকন্যার গল্প শুনাও? মাথায় হাত বুলিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দাও? আরো কতশত আবদার। নতুন আম্মু আসায় আর কি সেসব আবদার নিয়ে আসবে তাদের দুয়ারে? কি জানি! সে মিনুকে জড়িয়ে বলে,

-” ভোর বাবার আম্মু, আম্মুর জায়গায়। মিনু খালা, মিনু খালার জায়গায়। কেন দরকার পইড়বে না তোমারে? দেইখো সকাল হলেই ছুটে এসে বলবে ‘মিনু খালা আমাকে আলুর পরোটা বানিয়ে দাও সবার আগে। শুধু আমাকেই দিবে অন্য কাউকে দিলে তোমার সাথে কথা নেই বুঝলে!”

মিনু হেসে ওঠে আভারির বলার ভঙ্গিমা দেখে। আভারি তাঁর মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়।

-” ঘুমাও মিনু!”

মিনু আভারির বুকে মাথা রেখে শান্ত মলিন কণ্ঠে সুধায়,

-” আল্লাহ আমার ঘরে কেন ওমন একটা রাজপুত্তুর দিলো না বলেনতো?”

_______

অরুণ সরকার বিছানায় শুয়ে আছে চিৎ হয়ে। আর ভোর নরম বিছানা ছেড়ে শক্ত বিছানায় বালিশ বিহীন শুয়ে আছে। সেই শক্ত বিছানা তার বাবা আর বালিশ বাবার বুক।এর থেকে শান্তিময় আরামদায়ক বিছানা বালিশ কখনো হয়? ভোরের নয়ন জোড়া নিদ্রায় আচ্ছন্ন থাকলেও অরুণের চোখে ঘুমের রেশ মাত্র নেই। সে তো থমথমে মুখে ঘূর্ণায়মান তার ঘরের ঘূর্ণিঝড়ের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করতে ব্যস্ত। আর ঘুর্ণিঝড়ের নাম পাতাবাহার! এক পাতাবাহার থমথমে মুখে কাপড়চোপড়ে এলোমেলো ঘর গোছাচ্ছেন। আরেক পাতাবাহার চার হাতপায়ে তার সখির পিছু পিছু ঘুরে সাহায্য করার চেষ্টায়। কিন্তু সখি তাহার সাহায্য নিচ্ছেন না বরং দূরছাই বকাবকি করে সরিয়ে দিচ্ছে। ইতিমধ্যে এক পাতাবাহার লেজ নাড়িয়ে গুটি গুটি পায়ে মিও মিও করে সখির নামে নালিশ জানিয়ে তার পা ঘেঁষে শুয়ে পড়ল। অরুণ হামি তুলে পাতাকে উদ্দেশ্য করে বলে,

-” ঘুম পাচ্ছে আমার।”

-” মানা করেছে কে!”

ত্যাড়া তীক্ষ্ণ জবাব যেন ঠোঁটের আগায় ছিল। বলার সাথে সাথে উত্তর। অরুণ গলা খাঁকারি দিয়ে থমথমে গলায় বলে,

-” লাইট জ্বললে ঘুম আসে না আমার।”

পাতা শব্দ করে আলমারি লাগায়, যার দ্বারা বোঝাই যাচ্ছে মহারানী রেগে বোম! অরুণ পাতার আপাদমস্তক দেখে। এইটুকুনি মেয়ে সালোয়ার টপসে আরো কমবয়সী লাগছে।ফু দিলেই উড়ে যাবে সে অরুণ সরকারের সামনে রাগ দেখায়। এক চটকানা পড়লে রাগ বাপ বাপ করে পালাবে। পাতা আলমারি বন্ধ করে ওয়াশ রুম থেকে ঘুরে আসে। তারপর বিছানা থেকে একটা বালিশ ও কম্ফোর্ট টা টেনে নিয়ে সোফায় বসে। অরুণের কপালে ভাঁজ পড়ে। ধমকের সুরে বলে,

-” কি হয়েছে? আবার কোন নাটক শুরু করলে?”

পাতা নীরব রিসেপশন শেষ হওয়ার পর থেকেই। সেই নীরবতা ভেঙ্গে এবার শান্ত ভঙ্গিতে বলে,

-” কিছুই হয় নি। ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম!”

অরুণ ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে বলে,

-” বাপের বাড়ি যেতে পারোনি বলে জেদ দেখাচ্ছো? চুপচাপ বিছানায় শুয়ে পড়ো!”

পাতা যায় না বিছানায়। জেদ করে বসেই থাকে। চোখের কোটরে নোনাজলের আভাস দেখা দিচ্ছে। পাতা ঘন ঘন চোখের পলক ফেলে বাঁধা দেয়।

-” আমি তো স্যরি বলেছিলাম আপুর হয়ে। আমি আপুকে সেভাবে বলি নি! আপু জিজ্ঞেস করেছির আমি শুধু মাথা নেড়েছিলাম! আমার মাথায় ওতশত খেয়াল আসে নি।”

অরুণ শান্ত চোখে পাতার দিকে চায়।

-” যা হওয়ার হয়েছে। বাদ দাও! ঘুমিয়ে পড়। রাত অনেক হলো!”

-” রিসিপশনের পর ওবাড়ি যাওয়া একটা কনভেনশন ছিল। আপনাকে কত অনুরোধ করলাম ক্ষমাও চাইলাম। আপনি গেলেন না। আব্বু আম্মু বাকি সবাই কি ভাবলো? আপুর কথায় খারাপ লেগেছে মানলাম কিন্তু বাকি সবাই? ওদের সম্মানের খাতিরেও যেতে পারতেন। কিন্তু না আপনি তো নাক উঁচু দাম্ভিকতায় ভরপুর ম্যানারল্যাস লোক।”

রাগি সুরে ঠেকে ঠেকে বলে পাতা। কান্নায় গলা জড়িয়ে আসতে চাইছে। অরুণ চোখ বুজে বলে,

-” জানোই তো আমি এমন। তারপরও.”

-” হ্যাঁ জানি তো! বিশিষ্ট ব্যবসায়ী স্বনামধন্য ব্যাক্তি আপনি। আপনার মতো ধন্যমান্য লোক কি আর মধ্যবিত্তের ঘরে রাত কাটাবেন? ক্যাটাগরি মেইনটেইন করে চলতে হবে না?”

পাতার উপহাসের গলা। অরুণের চোয়াল শক্ত হলেও নম্র গলায় বলে,

-” বেশি বোঝো তুমি।এখন মাথা গরম আছে তোমার। ঘুমিয়ে পড়ো এখানে এসে। পরে কথা হবে!”

পাতা শোনে না তার কথা। বালিশ ফিক্কে সোফার কিনারায় রেখে শুয়ে পড়ে। কম্ফোর্ট দিয়ে নিজেকে মুড়িয়ে নেয়। তার সখি পাতাবাহার বিছানার কিনারায় এসে মিও মিও করে বকছে নাকি এখানে আসতে বলছে কে জানে! অরুণ দীর্ঘশ্বাস ফেলে। লাইট ওফ করে দেয়। হঠাৎ মাথায় কিছু আসে। সে গলা খাঁকারি দিয়ে পাতার উদ্দেশ্যে বলে,

-” মিসেস পাতাবাহার? গুড নাইট। হ্যাভ আ সুইট ড্রিম। বাট সাবধানে হ্যাঁ? আমার বেলকনিতে তিনটা ভূতের বাচ্চা আছে, একদম আপনার মতোই কিউট দেখতে। এমনিতে ভদ্র বাচ্চা তবে মাঝেমধ্যে একটু আকটু দুষ্টুমি করে।”

বলে ছেলেকে বুকে নিয়েই পাশ ফিরে শুয়ে পড়ে। পাতা চোখ বড় বড় করে উঠে বসে। ভূত!! সত্যি আছে নাকি? থাকুক না থাকুক সে তো শেষ! পাতা ঢোক গিলে বলে,

-” নাক উঁচু ম্যানারলেস বাজে লোক একটা। মিথ্যে বলে আমার দূর্বলতায় আঘাত হানেন? আপনি একটা যা তা! আমি ভোরকে সব বলে দেব!”

অরুণ চুপচাপ শুয়ে থাকে। বড়শিতে ফাঁদ পেতে জলে ফেলেছে এখন মাছের রানি ফাঁদে পা দিল বলে‌। ‘শালার জামাই! তোর বউ তোর মাথায় উঠে সালসা ড্যান্স করবে, দেখে নিস।’ পাতা আড়চোখে বেলকনির দিকে চায়। লাইট জ্বলছে. ভূত টুত কিছু দেখা যাচ্ছে না তবুও পাতার মনে হচ্ছে এখনি বড় বড় চোখ করে হি হি করে হেসে ভেটকাবে। ওই তো দিলো বলে? পাতা ব্যাগপত্র সমেত নিজ স্টেশনে হাজির হয়। ধপাস করে বিছানায় বসে। অরুণ এবার হেসে ওঠে খুব ধীর আওয়াজে। তার ক্ষীণ কণ্ঠের হাসি পাতার কানে আসা মোটেও উচিত ছিল না। হাসির আওয়াজে পাতা সর্বাঙ্গ যেন রাগে গড়াগড়ি খায়। ওপাশ ফিরে শুয়ে থাকা অরুণের উপর হামলে‌ পড়ে। বাহুতে কিল বসিয়ে দেয় গোটা তিনেক।

-” শালার জামাই! খুব হাসি পাচ্ছে। দাঁত গুলো খুলে নিয়ে ভূতের মায়েদের কাছে দিয়ে আসবো!”

অরুণের উপর হামলে পড়ার দরূণ বিড়াল শাবকটি লাফিয়ে উঠে পাতার সামনে হাজির হয়ে মিও মিও বলে চেঁচাতে লাগলো। পাতা তাকেও হাত দিয়ে সরিয়ে দেয় ঝটকা মেরে, এসেছে কর্তার রক্ষা কর্তী। বিড়ালটা আবার তেড়ে আসে। অরুণ হতবাক। এই মেয়ে তাকে মারছে? অরুণ সরকারকে! এ আদৌ ঘটছে নাকি তার ভ্রম মাত্র! এইটুকুনই মেয়ে গায়ে নেই দেড় কেজি মাংস, সে কিনা তাকে মারে। তার বন্ধুরা জানলে রাসেলের কাছে থাকা সরকারী বস্তুটা নিজের মাথায় ঠুকে গুড বায় জিন্দেগি বলে পটল তুলতো। সে পাশ ফিরে পাতার দিকে চায়। আবছা আলোয় চোখাচোখি হতেই পাতার হাত থেমে যায়। অরুণ ধমকে বলে,

-” এক থাপ্পড়ে চাপার সবকটি দাঁত খুলে ফেলবো বেয়াদব। হাত বেশি লম্বা হয়েছে?চুপচাপ ঘুমাও?”

ধমকে বিড়ালছানার মিও মিও বন্ধ হয়। লেজ নাড়িয়ে দৌড়ে ভোরের হাঁটুর ভাঁজ ঘেঁষে শুয়ে পড়ে। আর পাতা চুপচাপ কম্ফোর্ট মুড়িয়ে শুয়ে পড়ে। লোকটার ধমকে তার ছোট্ট হৃদয়খানি এখনো কম্পমান অবস্থায়। নাক ভরে ওঠে, চোখের পানি বাঁধনছাড়া হয়ে পড়ে। ভূত, অন্ধকারে ভয় তার কিশোরী বয়স থেকে।‌ ভয়ের শুরু হয় এক বাদলা নির্জন রাতে। সেদিন দুপুরেই বাবা মা সহ সকলে ফুপুর বাড়িতে বিয়ের দাওয়াতে গিয়েছিল। পাতাও যাওয়ার জন্য রেডি হয়েছিল কিন্তু যাওয়া হয় নি। বাবা বলেছিল,

-” মা একলা বাড়িতে থাইকবো নাকি?পাতা থাইক বাড়িতে। আর তাছাড়াও ওখানে ওরে নিয়ে গেলে নানান জন নানা কথা কইবো! পালক বাচ্চা হাবিজাবি ওর কানে গেলে ওই কষ্ট পাইবো! তার চেয়ে ভালো এখানেই থাক!”

পাতার আর যাওয়া হয় না। একলা বাড়িতে দাদি আর সে অবস্থান করে। সন্ধ্যার পরেই ঝুম বৃষ্টি শুরু হয়। পাতা নিজের ঘরেই বসেছিল, শুনশান নীরবতায় ভয় লাগতে শুরু করে। সে দৌড়ে দাদির ঘরে গিয়ে তার পাশে শুয়ে পড়ে। আকলিমা বেগম বুঝতে পেরে পিঠে এক ঘা বসিয়ে পান খাওয়া টকটকে ঠোঁট নাড়িয়ে বলে,

-” দূর হো ছেমড়ি! যা আমার ঘর থাইকা। তোরে দেখলেই আমার গা জ্বলে। আমার পোলার অন্ন ধ্বংস করে ফুর্তি করস!”

পাতা আর থাকে না। ভয় মনেই নিজের ঘরে আসে। দরজা শক্ত করে লাগিয়ে মোমবাতি খুঁজে বের করে। দেয়াশলাই খুঁজতে নিলেই কারেন্ট চলে যায়। পাতা হাতরিয়ে হাতরিয়ে খোঁজার প্রচেষ্টায়। কিন্তু পায় না‌। এদিকে কালো ঘনঘটা অন্ধকার। বৃষ্টির এলোমেলো শব্দ পাতার কানে কেমন যেন ভয়ংকর শোনায়। পাতা গলা উঁচিয়ে দাদিকে ডাকে অনেকবার, সারা পায় না‌। পাতা অন্ধকার হাতরে বিছানায় শুয়ে চাদর টেনে ঢেকে নেয় আপাদমস্তক। চিল্লিয়ে ‘দাদি দাদি’ ডাকতে থাকে। কিন্তু কেউ আসে না। পাতা ভয়ে কেঁদে দেয় শব্দ করে। ফোঁপাতে ফোঁপাতে কিছু আওয়াজ কানে আসতেই শরীর যেন হিম হয়ে ওঠে। কেমন বিদঘুটে হাসির আওয়াজ! পাতা ভয়ে কেঁদে কেঁদে বলে,

-” দাদি তুমি হাসছো? দেখ আমি ভয় পাচ্ছি অনেক! দাদি কথা বলছো না কেন?”

হাসি থেমে যায় হঠাৎ করে। কিছু পল নীরবতা ভেঙে আবার ক্রন্দনরত সুর ভেসে আসে, সাথে ঠক ঠক ভুতুড়ে আওয়াজ । পাতা চিল্লিয়ে কাঁদে। দাদি আসে না। কাঁদতে কাঁদতে পাতার গলার স্বর ভেঙে আসে তবুও চিল্লাতে থাকে। প্রকৃতি যেন সেদিন ভয়ংকর রূপ ধারণ করেছিল। ঝড়ো বাতাসে শম শম আওয়াজ, গাছের ডালের মট মট করে ভেঙ্গে পড়ার শব্দ! সব পাতার কাছে ভূতুড়ে কারবার মনে হয়। সে দাদি দাদি বলে কাঁদতে কাঁদতে কখন ঘুমিয়ে পড়ে জানে না। সকাল ভোরে বিদঘুটে গন্ধ নাকে আসলে ঘুম ভাঙ্গে। পাতার মস্তিষ্ক সচল হয় রাতের ভয় ঘিরে ধরে। কিন্তু সব সূর্যের আলোয় আলোকিত দেখায় তনুমন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। বিছানা ছাড়ার সময় ভেজা অনুভব করে, বুঝতে অসুবিধা হয় না বিদঘুটে ঝাঁঝালো গন্ধটা কিসের! পাতা ঠোঁট উল্টিয়ে কেঁদে ওঠে মৃদু স্বরে। তারপর চুপ হয়ে যায়। তারপর টানা নয়দিন সে জ্বরে ভুগে ছিল।

-” আবার কি শুরু করলে? কাঁদছো কেন?”

অরুণের বিরক্তিকর স্বর কানে বাজতেই পাতার ভাবনাচ্ছেদ হয়। দুহাতে চোখ ডলে বলে,

-” শখে কাঁদছি! আপনি কাঁদবেন? আসুন গলা জড়িয়ে কাঁদি দুজন মিলে!”

-” ফাজলামি হচ্ছে আমার সাথে?”

-” আমার ঘাড়ে ক’টা মাথা!”

এই মেয়ে নাকি শান্ত শিষ্ঠ নরম! প্রত্যেকটা কথার জবাব দিতে হবে, তাও ত্যাড়াবাঁকা! একদম ঝগরুটে। অরুণ ছেলেকে ছাড়িয়ে উঠে পড়ে। পাতার দিকে তাকিয়ে বলে,

-” ছিঁচকাদুনে মেয়ের আমার ঘরে জায়গা নেই! বাইরে গিয়ে কাঁদো, যাও?”

পাতা সরাসরি অরুণের দিকে চায়। তাকে ঘর থেকে বের করে দিচ্ছে লোকটা? পাতা মনে মনে কষ্ট পায়, ইচ্ছে করে বেড়িয়ে যেতে। কিন্তু যাবে কোথায় এই রাত্রি বেলায়! সে নাক ডলে বলে,

-” যাবো না‌। মনে রাখবেন ঘরটা আপনার একার না, আমারো। এখন আপনার সমস্যা হলে আপনি যেতে পারেন।”

অরুণ চোখ উল্টিয়ে মুচকি হাসে। এই মেয়েটাও না! সে রিমোট হাতরিয়ে খুঁজে লাইট জ্বালিয়ে দেয়। বিছানা থেকে নেমে ড্রেসিন টেবিলের সামনে যায়। পাতা বিছানায় হাত ঠেকিয়ে আধশোয়া হয়। লোকটা কি তাকে জোড় করে বের করে দেবে? অরুণ টিস্যু বক্স এনে কিছু টিস্যু বের করে পাতার নাকে চেপে ধরে। পরিষ্কার করে ব্যবহারকৃত টিস্যু বিণে ঢিল ছুড়ে। আবার টিস্যু বের করে ভালোভাবে মুছে দেয় চোখ, গাল, নাক।

-” ছেলেও ছিঁচকাদুনে ছেলের আম্মুও ছিঁচকাদুনে! মনে হচ্ছে বাকি সারাটা জীবন ছেলের ও তার আম্মুর নাক মুছতে মুছতেই কেটে যাবে!”

পাতা হা করে চেয়ে আছে অরুণের দিকে। ব্যপারটা ভালো লাগে বেশ। কান্না সে ভূলে গেছে। এরকম যত্ন করলে কান্না করা যায়? যায়, সুখের কান্না। পাতার কাছে সর্দি খুবই বাজে একটা জিনিস; নিজের সর্দি তার নিজের কাছেই ঘৃণা লাগে। অথচ লোকটা!!! পাতার অন্তঃপুরে অসংখ্য ভালোলাগার প্রজাপতি ডানা মেলে উড়তে থাকে এলোমেলো কিন্তু সব গুলো বেরঙিন, কেন? অরুণ ততক্ষণে লাইট ওফ করে বালিশে মাথা রেখেছে। পাতাকে স্টেচু হয়ে আধশোয়া অবস্থায় দেখে টেনে শুইয়ে দিয়ে বাহুডোরে আবদ্ধ করে নেয়। তৃতীয় বারের মতো নববধূয়ার ললাটে অধর স্পর্শ করে বলে,

-” সব রাগ অভিমান ছুড়ে ফেলো হুম? আর মনে রেখ স্বামী স্ত্রী একে অপরের পোষাক স্বরূপ। আমার দিকে কাঁদা ছুঁড়লে সেটা তোমার গায়েও লাগবে তেমনি তোমার দিকে ছুঁড়লেও আমার গায়ে লাগবে। তাই ভেবেচিন্তে কদম ফেলবে। আমাদের মধ্যে ঝগড়া, কলহ, মান অভিমান, রাগ, ভালোবাসা যাই থাক সেগুলো শুধু আমাদের একান্তের। সেগুলো কেন অন্যের কানে যাবে? ভোরের আমাদের সাথে থাকা না থাকা সেটাও আমাদের একান্তের ব্যাপার অন্যরা কেন নাক গলাবে? একটু রেগে ছিলাম প্রথমে। এখন নেই তো। তুমিও রেগে থেকো না। ঘুমাও!”

পাতার অন্তঃপুরে ডানা মেলে উড়তে থাকা বেরঙ প্রজাপতি গুলোর মধ্যে রামধনুর রঙে রঙিন হয়। মনের খুশিতে উড়ে আনন্দ প্রকাশ করতে থাকে। পাতা অরুণের কটি সংযোগে হাত গলিয়ে দিয়ে উন্মুক্ত পিঠ আকরে ধরে। বুকে মাথা গুঁজে পরম আরামে চোখ বুজে। তীব্র পুরুষালী গন্ধ নাকে টেনে নেয়, হাতের বাঁধন আরেকটু শক্ত হয়। পঁচিশ বছরের জীবনে কারো উপরে মান অভিমান করে ছিল কি? এতো এতো নাটকীয়তা ঘেরা জীবনে সকলের নিষ্ঠুর কঠোর অবদান পাতা খুব অল্প সংখ্যক মানব মানবীর উপরেই মান অভিমান করেছে তবে কখনো মুখ ফুটিয়ে বলে নি আর না কোনো প্রকার আচরণে বুঝিয়েছে যে, সে অভিমান করেছে তার উপর। অথচ এই লোকটার উপর সে অভিমান করেছিল, ঝগরা করে সেটা বুঝিয়েও দিয়েছে। আর লোকটা তার অভিমান ভেঙেছে। পাতা পণ করে সে ভবিষ্যতে আরো অনেক অভিমান করবে! মিছিমিছি তো কখনো সত্যি। পাতার অধরকোণে হাসি ফুটে উঠল। তার লজ্জা পাচ্ছে না এমন না! তার লজ্জাও লাগছে বেশ, তবে তার থেকে বেশি ভালো লাগছে। আর লজ্জা লাগলেও বা কি? লোকটা তো তারই একান্ত ব্যক্তি! তাহলে লজ্জাকে একটু সাইডে রেখে ভালো লাগাকে প্রশ্রয় দিলে কি সে জামাই পাগলি বনে গেছে নাকি??

অরুণ পাতার চুপ করে যাওয়া দেখে চোখে হাসে। মেয়েটাও তার কলিজার মতোই আদর, ভালোবাসার কাঙালীনি! একটু আদর করে বুকে টেনে নিয়েছে ব্যস, রাগ গোস্বা গায়েব মুড অন। অরুণ পাতার চুলের রেবন খুলে দেয়। চুলের মাঝে হাত গলিয়ে বুলিয়ে দিতে থাকে। পাতা এক পা অরুণের উপর তুলে দিয়ে বিড়ালছানার মতো বুকটায় আরেকটু সেঁটে যায়। অরুণের ভ্রু কুটিতে ভাঁজ পড়ে। তন্মধ্যে আরেকটি ছোট্ট হাত পেছন থেকে তার পেটে জড়িয়ে, ছোট পা তুলে দেয়। অরুণ একহাত বাড়িয়ে ছেলেকেও কাছে টেনে কম্ফোর্ট দিয়ে ঢেকে দেয়। বিড়ালছানা পাতার ঘুমিয়ে পড়ার সুযোগ নিয়ে পাতার পাশে ঘেঁষে মিও মিও করে গা এলিয়ে দেয়। অরুণ চোখে মুখে হাসে; তার ছোট্ট সংসার!

মাঝরাতে শীতের দরূণ পাতার ঘুম ছুটে যায়। বেশ ঠান্ডা লাগছে তার। সে পিট পিট চোখ খুলে। গায়ে কম্ফোর্ট নেই! কোথায় গেল? ম্যানারল্যাস লোকটার বুকটা থেকেও উষ্ণতা আসছে না! কোথায় গেল?পাতার মস্তিষ্ক সচল হয় পুরোপুরি। তার ডান হাতের উপর একটা পা তুলে দিয়ে হা করে নিদ্রায় মশগুল বিড়ালশাবক। পাতা নাক মুখ বিবৃতি করে সেই পা ছাড়িয়ে নেয়। পাশ ফিরতেই দেখতে পায় বাবা ছেলে একেঅপরকে জড়িয়ে শান্তির ঘুমে। কম্ফোর্টা গায়ে জড়িয়ে। পাতার মুখটা মলিন হয়ে আসে। বুকটাতে তো সে ছিল! ভোরকে কখন জড়িয়ে নিল? সে ঘুমিয়ে পড়তেই হয়তো লোকটা তাকে সরিয়ে ভোরকে নিয়েছে। পাতার মনটা খানিক বিষিয়ে ওঠে যেন! লোকটাকে সবসময় ভোরের সাথে ভাগ করে নিতে হবে। ভাগ করে কি? লোকটা তো সরাসরি বলেই দিয়েছে পার্থিব জীবনে সবার আগে ভোর! বাকি সবাই পড়ে। সবার ভিড়ে পাতা কি আছে? আছে হয়তোবা কোনো কোণে। পাতা তার দ্রোহী ভাবনাকে নিয়ন্ত্রণে আনে। এসব ভাবনা মাথায় আনলে ভোরের প্রতি তার মনটা বিষিয়ে উঠবে হয়তোবা। আর পাতা এটা কখনো চায় না। সেদিন রাতে গাড়ির ভেতরে ভোরের আম্মু ডাকার মর্যাদা রাখবে সে। মায়ের আদর ভালোবাসার কাঙাল ছোট্ট ভোরকে সে সাধ্যমত আদর ভালোবাসায় ভরিয়ে তুলবে ইনশাআল্লাহ। আর স্বামী নামক লোকটাকে আগলে সারাটা জীবন যেন কাটিয়ে দিতে পারে সাধ্যমতো সেই চেষ্টাতেও ত্রুটি রাখবে না ইনশাআল্লাহ। পাতা নিজেকে খুব ভালো ভাবে চেনে। সে লোকটার উপর ক্ষণে ক্ষণেই দূর্বল হচ্ছে। সেই দূর্বলতা কোথায় গিয়ে পড়ে দেখা যাক!
_______

চলবে…..

#পাতা_বাহার
লেখনীতে: #বেলা_শেখ
#পর্ব- ৩০ (শেষাংশ)

(কপি করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ)

মেঘলা আকাশ। হালকা বাতাসে পরিবেশ শীতলতম। লাবনী আক্তার টি টেবিলে চায়ের ট্রে রেখে স্বামী, ছেলেকে উদ্দেশ্য করে বলে,

-” বাড়িটা কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে, তাই না? কেমন গুমোট ভাব এসে গেছে। লতাটাও ছেলে মেয়ে নিয়ে চলে গেল! পাতা তো তার সংসারে!”

আতিকুর ইসলাম সায় জানালো।

-” ঠিক বলেছো!

-” পাতাটার কথা মনে পড়ছে বেশ! বিদায়ের ছয়দিন হয়ে গেছে! মনে হচ্ছে কতদিন হলো দেখি না! বুকটাও ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। বাড়িতে থাকলে পিছু পিছু ঘুরঘুর করতো! কিন্তু কিছু বলতো না। কতো বকতাম তবুও আম্মু আম্মু বলে মিনমিন করতো! তবে আপনি বাসায় এলে ও ঘর থেকেই বের হতো না তেমন!”

আতিকুর ইসলাম স্ত্রীর দিকে চায়। তারও কিছুটা মনে পড়ছে মেয়েটার কথা। কেমন আছে সে?
লুবমান চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বলে,

-” রত্ন কাছে থাকতে তো কদর করো নি তাহলে এখন দূরে পাঠিয়ে কেন আফসোস করছো? যতদিন তোমাদের কাছে ছিল দূরছাই না করলেও বুকেও টেনে নাও নি ভালোভাবে! লতার মতো পাতারও যদি যত্ন নিতে!!”

লাবনী আক্তারের মুখ মলিনতায় ছেয়ে যায়! ছেলের পাশে বসে যায়। অনুতাপে পোড়া মাতৃমন ছল ছল করে ওঠে।

-” ঠিক বলেছিস লুব! ভুল গুলো তো আমাদেরই! ভালো পাতাকেও বাসি! মেয়েকে ভালোবাসবো না? তবে হ্যা দূরে ছিল পনেরো ষোলোটা বছর! হয়তো জড়তার কারণেই ভালোভাবে বুকে নিতে পারি নি সেভাবে! সেই জড়তা বোধকরি কেটে যাচ্ছে! মেয়েটা..”

বলেই কেঁদে ওঠেন তিনি। আতিকুর ইসলামের কঠোর মনটাও মলিন হয়ে যায় অনুতাপের রেষে! ইশ মেয়েটার সাথে যদি একটু পিতৃসুলভ আচরণ করতো!! লুবমান মা’ কে একহাতে জড়িয়ে নিয়ে বলল,

-” আম্মু? কেঁদো না তো! কাঁদলে সব ঠিক হবে? আর এই কান্নার কোনো ওয়ে আছে? যা হয়েছে হয়েছে! এখন ভবিষ্যতে পাতুটাকে একটু বেশিমাত্রায় ভালোবেসে পুষিয়ে দেয়ার চেষ্টা করো! আর আব্বুকেও একটু বোলো! পাতা তারই রক্ত। ভালোবাসে সেটা দেখালে জাত চলে যাবে না! আর যদি না বাসে তাহলে একটু অভিনয়ই করলো না হয়!”
____

দুপুর গড়িয়ে বিকেল বেলা। সরকারবাড়ির প্রায় সকলেই বাগানের পাশে দাঁড়িয়ে বাচ্চাদের উৎসাহ প্রদান করছে। ভোর ও আনিকার জন্য সাইকেল এনেছে আরিয়ান। তারা দুজনেই সাইকেল চালানো শিখছে। সাথে সাইকেল নিয়ে যোগ দিয়েছে আদুরি, আরিয়ান ও রুবি। ওরা তিনজনও সাইকেল চালাচ্ছে। আনিকার ছোট্ট সাইকেলে চার চাকা হওয়ার দরুণ সে প্যাডেল ঘুরিয়ে অল্প অল্প করে এগিয়ে যেতে পারছে। কিন্তু ভোর পারছে না। তার সাইকেলে তিন চাকা! মানে বাম পাশে এক্সট্রা ছোট চাকা আছে যেটা ইউজ করাও যায় আবার তুলে রাখাও যায়। ভোর ভয়ে ভয়ে সাইকেলে বসে চালানোর চেষ্টা করছে। মিনু ও পাতা তাকে সাহায্য করছে । ভোর সাইকেলে প্যাডেল ঘুরিয়ে একটু যাওয়ার পর পাতা ও মিনু ছেড়ে দেয়! ভোর চোখ বড় বড় করে সাইকেল ছেড়ে দিয়ে বলল,

-” আব্বু গো! ও মিনু খালা ! ও আম্মু! পড়ে গেলাম! ধরো আমাকে! এই?”

পাতা, মিনু গিয়ে ধরে সাইকেল ও ভোরকে। আভারিসহ উপস্থিত সকলে হেসে উঠলো জোড়ে। ভোর গাল ফুলিয়ে তাদের দিকে তাকিয়ে বলল,

-” ভারি কাক্কু তুমি হাসছো? তোমার সাথে কথা নেই বলে দিলাম!”

আভারি হাসি থামিয়ে কান ধরে স্যরি বলে। ভোর মুখ ফিরিয়ে নেয়। তন্মধ্যে আরিয়ান আসে সাইকেল নিয়ে। ভোরকে বলে,

-” ভোর? এভাবে সাইকেল চালানো শিখতে পারবে তুমি? কখনো না! আরে তোমার ট্রেইনার দুটোই সাইকেল চালাতে পারে না তোমাকে কি শেখাবে!”

ভোর চাচ্চুর কথা শুনে মুখ গোমড়া করে পাতা ও মিনুর দিকে চায়। মিনু সায় জানিয়ে বলল,

-” ছোট স্যার ঠিক কইছে ভোর বাবা! তুমি বরং তার কাছেই শিইখে নাও?”

ভোর খুশি হয়ে কিছু বলবে এর আগে আনিকা উপস্থিত হয় সাইকেল নিয়ে।

-” আব্বু তুমি এই পঁচা ভোরকে একটুও শিখাবে না! ওর আব্বুর কাছে থেকেই শিখুক না! তুমি শুধু আমাকে শিখাবে। সকালে বড় চাচিমনি একটু আদর করলো বলে আমার গালে চিমটি কেটেছে! ব্যাথাও পেয়েছি!”

কাঁদো কাঁদো গলায় বলল আনিকা। ভোর কাঁচুমাচু করে চায়। সত্যিই সে চিমটি জোরে কেটেছিল। এখন তো চাচ্চু তাকে শেখাবে না!
আরিয়ান আনিকার গালে হাত বুলিয়ে ভোরকে বলে,

-” সত্যিই ভোর? ও তো তোমার ছোট বোন হয়! বোনকে কেও মারে?”

ভোর মাথা নাড়ে! মারে না। আরিয়ান তার মাথার চুল এলোমেলো করে বলে,

-” ভোর আর মারবে না মামনি!”

-” নাহ্। ও আবার মারবে। আমি জানি তো। ভোর পঁচা দুষ্টু ছেলে!”

পাতা এতক্ষণ নীরব দর্শক হয়ে থাকলেও এবার ভোরকে বলে,

-” ভোর সোনা স্যরি বলো আনিকাকে? আর এসব কি শুনছি আমি? আমি তো জানতাম ভোর গুড বয়! গুড বয়েস’ কখনো ঝগড়া মারামারি করে? সে স্যরি ট্যু হার?”

ভোর গাল ফুলিয়ে অন্যদিকে চেয়ে স্যরি বলে আনিকাকে। আনিকাও অন্যদিকে চেয়ে ভেংচি কাটলো। আরিয়ান পাতার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে বলে,

-” ভোর! গুড বয়েস, গার্লস কখনো ঝগড়া করে না। ঝগড়াতো করে কিছু কুটনি কুচুটি মহিলা! শুনেছি তাদের চুল ছোট ছোট হয়! হাইটেও ছোট হয়! এইরকম বড় বড় করে সাপের মতো ফোঁস ফোঁস করে! বুঝলে?”

পাতা মাথায় ওড়না টানে। সদ্য রসগোল্লার মতো চক্ষু যুগল স্বাভাবিক করে। ভোর পাতার দিকে একবার চেয়ে আরিয়ানকে জিজ্ঞেস করল,

-” সত্যিই?”

পাতা বিরোধীতা করে বলে,

-” একদম না ভোর! উনি বোকা বানাচ্ছে!”

-” এই মেয়ে বোকা বানাচ্ছি না সত্যিটা দেখাচ্ছি! ভোর ঝগরুটে মানুষ এভাবেই ঝগড়া করে!”

পাতা বিরক্তিকর শ্বাস ফেলে একবার পিছনে মুড়ে নিজ শাশুড়ি ও রুবির মায়ের দিকে চায়। তাদের অবস্থান দূরে হওয়ায় আঙ্গুল তাক করে বলে,

-” এই মেয়ে কাকে বলছেন? বড় ভাবী হই আপনার! সম্মান দিয়ে কথা বলবেন!”

-” ওরে আমার বড় ভাবী! এই আভারি ভাই? গেটের সামনের দোকান থেকে এক প্যাকেট সম্মান কিনে আনো তো!”

পাতা কটমট করে চায়। কিছু বলবে কিন্তু বলা হয় না। ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি শুরু হয় হুট করে। আরিয়ান তড়িঘড়ি করে মেয়েকে নিয়ে চলে যায় বাড়ির ভিতরে। ভোর পাতার হাত ধরে। মিনু টানে যায় না। অগত্যা মিনু সাইকেল নিয়ে ভিতরে যায়।‌ সবাই চলে গেছে কিন্তু রয়ে যায় ভোর,পাতা, আদুরি ও রুবি! ওপাশ থেকে মিনু গলা উঁচিয়ে ডাকছে সবাইকে। কিন্তু তাদের ধ্যান নেই! বৃষ্টির বড় বড় ফোটা তাদের ভিজিয়ে দেয় মুহূর্তেই! ভোর নেচে ওঠে পাতার হাত ঝাঁকিয়ে। পাতাসহ আদুরি, রুবি হাসে। মেতে ওঠে সবাই বৃষ্টি বিলাসে!

মিনুর উঁচু গলা শুনে অরুণ সরকার ল্যাপটপ সাইডে রেখে উঠে বেলকনিতে যায়। তার পিছনে পাতাবাহার। লেজ নাড়িয়ে সেও চলল তার সাথে। অরুণ বেলকনিতে গিয়ে আশেপাশে তাকায়! বৃষ্টির মধ্যে আবছায়ায় দৃশ্যমান হয় বৃষ্টিবিলাসে আচ্ছন্ন রমনীদের। সাথে তার ভোর! পাশেই মিনু ডাকতে ডাকতে আসছে ছাতা হাতে। অরুণ গলা উঁচিয়ে ভোরকে ডাকে কয়েকবার। আনন্দে মাতোয়ারা ভোর শুনতে পায় না। কেউই শুনতে পায় না বৃষ্টির ঝমঝম শব্দে। পাতাও না! তবে কেমন একটা অনুভুতি হওয়ায় সে আশেপাশে চায়। ঘার উঁচু করতেই বেলকনিতে অরুণকে দেখতে পায়। কিছু বলছে তাদের দিকে তাকিয়েই! চোখও রাঙালো। পাতা ইশারা করে বোঝায় শোনা যায় না! অরুণ হতাশ হয়ে বেলকনি ত্যাগ করে।

মিনুকে ছাতা হাতে দেখে ভোর বলে,

-” মিনু খালা একটু ভিজি প্লীজ? ও মিনু খালা প্লীজ?”

মিনু সাথে সাথে সাবধানী গীত গায়।

-” একদম না! সবসময় নাকে সর্দি নিইয়ে ঘোরেন! আবার বৃষ্টিতে ভেজা হইতেছে? এখুনি ওঠো ভোর বাবা! বড় স্যার খবর পাইলে তোমার খবর হইয়ে যাইবে! ওঠো?”

ভোর গিয়ে আদুরির পিছনে লুকিয়ে পরে। পাতার টনক নড়ে। সত্যি কথাই তো বলেছে মিনু আপা! তার তো এ কথা মাথায়’ই আসে নি। মিনু পাতার দিকে চেয়ে বলে,

-” বড় ম্যাডাম আপনে একটু বলেন ভোর বাবারে! স্যার জানলে রাইগে যাবে বাচ্চাটার উপর!”

-” তুমি চিন্তা কোরো না আপা! আমি নিয়ে যাচ্ছি!”

আদুরি ভোরের হাত ধরে পালিয়ে যেতে যেতে বলে,

-” বড় ভাইয়ার একটু বাড়াবাড়ি! এইটুকু বৃষ্টিতে ভিজলে কিচ্ছু হবে না বড় ভাবী। গরম পানি দিয়ে গোসল করে নিলেই হবে!”

পাতা ভোরকে ডাকে। ভোর আসে না।

-” ভোর সোনা? আসো? অনেক ভিজেছি তো! আমি কিন্তু রাগ করবো তোমার সাথে। কথাও বলবো না, আদর তো দূরে থাক!”

এবার কাজ হয়। ভোর থেমে যায়। আদুরির দিকে অসহায় চোখে চেয়ে পাতার কাছে ফিরে আসে। পাতা খুশি হয়। ভোরকে কোলে নিয়ে বাড়ির ভিতরে যেতে যেতে আদুরি ও রুবির উদ্দেশ্যে বলল,

-” তোমরাও জলদি ওঠো! মেঘের ডাক শোনা যাচ্ছে। ভয় পেয়ে যাবে!”

পাতা গোমড়া মুখো ভোরকে কোলে নিয়ে বাড়িতে প্রবেশ করে দেখে আনিকা কাঁদছে বৃষ্টিতে ভেজার জন্য, আরিয়ান তাকে সামলাচ্ছেন। আসমা বেগম বকছে তাদের সবাইকে, তার নাম উল্লেখ করে নি যদিও! তাকে আসতে দেখে কেমন করে যেন চায়। পাতা মাথা নিচু করে নেয়। সিঁড়ির কাছে আসতেই অরুণের সামনাসামনি হয়! গম্ভীর মুখে এগিয়ে এসে ভোরকে কোলে তুলে নিয়ে তোয়ালে এগিয়ে দেয়। পাতা কাঁচুমাচু মুখে সেটা নিয়ে নিজেকে আবৃত করে রুমের দিকে পা বাড়ায়। অরুণ তার পিছু পিছু যায়।

ঘরে প্রবেশ করতেই কোথা থেকে বিড়াল ছানাটি ছুটে এসে সামনে দাঁড়ায়। মিও মিও করে লেজ নাড়লো। যেন বকছে! পাতা ছোট ছোট করে চায়। অরুণ ছেলেকে নিয়ে ওয়াশ রুমে প্রবেশ করে। পাতা তার অনুসারী। অরুণ ছেলেকে গোসল করিয়ে দেয় হালকা গরম পানিতে। ভোরকে তোয়ালে পেঁচিয়ে পাতার উদ্দেশ্যে বলে,

-” পাঁচ মিনিটের ভিতর এই গরম পানিতে গোসল করে বেরোবে! যাস্ট ফাইভ মিনিটস! ফাস্ট !”

বলেই বেড়িয়ে যায়। ভোরকে বিছানায় দাঁড় করিয়ে আলমারি খুলে শাড়ি সহ প্রয়োজনীয় কাপড় নিয়ে ওয়াশ রুমে রেখে আসে। ভোরকে প্যান্ট শার্ট পরিয়ে তোয়ালে দিয়ে মাথা মুছে দিতে থাকে। ভোর অরুণের শার্টের বোতাম খোঁচাতে খোঁচাতে মিষ্টি করে আবদার করে,

-” আব্বু তুমি আমায় সাইকেল চালানো শিখাবে না? ও আব্বু?”

-” যে আমার কথা শুনে না আমি কেন তার কথা শুনবো?”

ভোর অসহায় গলায় বলল,

-” ও আব্বু? তুমি না আমার সোনা আব্বু! কলিজা আব্বু! আমি তো তোমার সব কথাই শুনি!

অরুণ ছেলের দিকে শান্ত চোখে চায়!

-” আমি কারো কলিজার আব্বু টাব্বু না। তুমি আমার একটা কথাও শোনো না!”

-” ও আব্বু? টাব্বু কি? আর আমি তোমার সব কথাই শুনি! তুমিই আমার একটা কথাও শুনো না!”

গাল ফুলিয়ে বলে ভোর! অরুণ কিছু বলে না। চুপ থাকে।‌

একটু পরেই তড়িঘড়ি করে পাতা বেরিয়ে আসে। এলোমেলো ভাবে শাড়ি পড়েছে। চুল বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে! যার দরুন ব্লাউজের অনেকাংশই ভিজে।

-” পাঁচ মিনিট পেরিয়ে গেছে কি?”

ভোর মাথা নাড়িয়ে না বোঝায়। পাতা স্বস্তির শ্বাস ছাড়ে। অরুণের থমথমে মুখশ্রী দেখে ভোরকে ইশারা করে আবহাওয়া কেমন? ছোট্ট ভোর তার ইশারা বুঝতে অক্ষম।

অরুণ পাতাকে পর্যবেক্ষণ করে বলল,

-” পাতাবাহার এখানে বসো ফাস্ট!”

পাতা অরুণের ইশারাকৃত জায়গায় বসে বাধ্য মেয়ের মতো। অরুণ পাতার সম্মুখীন দাঁড়িয়ে তোয়ালে দিয়ে পাতার চুল মুছতে শুরু করে যত্ন সহকারে। পাতা থমকে যায়! অনুভূতিহীন চেয়ে রয় শূন্যে। আবেগে আপ্লুত হয়ে ওঠে নেত্রযুগল! জমতে শুরু করে নোনা জল! পাতা সেগুলো লুকিয়ে নেয় কৌশলে। কিন্তু !!অধরকোণে দখল নেয়া মিষ্টি হাসি সম্মুখে। লোকটা তার যত্ন নিচ্ছে! অবশ্য আরো অনেক ছোট খাটো যত্নের সম্মুখীন সে হয়েছে। লোকটা তাকে ছোট বাচ্চার মতোই ট্রিট করে যেন সেও ভোরের মতো কোনো বাচ্চা! পাতা ভোরের দিকে চায়। ভোরও তার দিকে তাকিয়ে। পাতা অরুণকে উদ্দেশ্য করে বলল,

-” ছেলেটাকে বকেছেন আপনি? ওর কোনো দোষ নেই। ও তো আবদারও করে নি! ভোর বকেছে তোমায়?”

ভোর মাথা নাড়ে। বকেছে! অরুণ ভোরের দিকে চায়। ভোর পাতার গলা জড়িয়ে পিঠে মুখ লুকায়। অরুণ তোয়ালে দিয়ে পাতার চুল মুড়ে দেয়।

-“ভোরের বাবা! বকেছেন কেন ভোরকে? মুখটা শুকিয়ে গেছে ছেলেটার! বকা ছাড়া আর কিছু পারেন আপনি?”

পাতার কথায় অরুণ বুকে হাত গুঁজে খানিকটা ঝুঁকলো।

-” পারি তো! অনেক কঠোর পানিশমেন্ট দিতে পারি! দেখতে চাও মিসেস পাতাবাহার?”

পাতা অরুণের কপালে হাত রেখে সরিয়ে দিয়ে বলে,

-” ভয় দেখাচ্ছেন? কিন্তু আপনাকে বলে রাখি এই পাতা আপনাদের মতো ম্যানারল্যাস লোকদের ভয় করে না। বরং ভয় দেখায়!”

অরুণ ভ্রু উঁচিয়ে বলল,

-” তা পাবে কেন? তুমি তো ব্রেভ ওমেন! শুধু রাতের অন্ধকারে ভুত টুতকে একটু ভয় পাও! জানি আমি! আর ভয় পাও না আমায়? দেখাবে? ভয়?”

পাতা গম্ভীর মুখে চায়। কিছু বলে না। অরুণ মুচকি হেসে পাতার গাল টিপে দিয়ে সোফায় ল্যাপটপ নিয়ে বসে। ভোর উঁকি দিয়ে দেখে বাবাকে। তখনই ঘরে প্রবেশ করে ছোট্ট আনিকা। পরণের ফ্রক মাথায় দুটো ঝুটি! পাতার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলে,

-” চাচিমনি দাদি ডাকে তোমাকে! এখুনি যেতে বলল!”

পাতার পিছনে ভোরকে দেখে পাতার কাছে আর যায় না। ফিরতি পথ ধরে বলে,

-” ফাস্ট ফাস্ট এসো কিন্তু?”

পাতা বিছানা থেকে নেমে মাথার তোয়ালে খুলে চুলে চিরুনি করে। ভোরকে বগলদাবা করে ঘর থেকে বেরোতে নিলে অরুণ পিছু ডাকে।

-” পাতাবাহার! শাড়ি ঠিকঠাক করে যাও!”

পাতা জিভে কামড়ে ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে শাড়ির কুঁচি ঠিক করে মাথায় ঘোমটা টেনে বলে,

-” এখন ঠিক আছে?”

ভোর সামনে দাঁড়িয়ে হাসিমুখে জবাব দেয়,

-” একদম আম্মু!”

অরুণ ল্যাপটপ থেকে মাথা তুলে পাতার আপাদমস্তক পরখ করে পাতাকে তার সামনে আসতে বলে। পাতা ভ্রু কুঁচকে তার সামনে দাঁড়ায়। অরুণ হাত বাড়িয়ে পাতার পেটের কাছটার আঁচল ঠিক করে ঢেকে দিয়ে বলে,

-” ছোটমা আর ওই আন্টি যতই ত্যাড়া বাঁকা কথা বলুক মন খারাপ করবে না। সকলের সাথে ভদ্র ভাবে কথা বলবে। আরিয়ান ভাইয়ের মতো তোমার। তাকে সম্মান দিবে, ঝগড়া মোটেও করবে না। যাও?”

পাতা ভদ্র মেয়ের মতো মাথা নেড়ে ভোরকে নিয়ে চলে যায়। অরুণ সেদিকে তাকিয়ে থাকে অপলক।

পাতা ভোরের এক হাত ধরে সিঁড়ি বেয়ে নামে। নজর ড্রয়িং রুমে। আদুরি বাদে সবাই উপস্থিত। আরিয়ান ও রুবি ছেলে নিয়ে বসে আছে। রুবির মা সুরুভি বেগম নাতিকে কোলে নিয়ে বসে। আসমা বেগম সোফায় বসে চশমা চোখে একটা বই পড়ছেন। আভারি দাঁড়িয়ে আছে পাশে। মিনু সবাইকে চা-টোস্ট দিলো! ভোর পাতার হাত ছেড়ে দৌড়ে গিয়ে মিনুর হাত ধরেই আবদার করে,

-” ও মিনু খালা! আমায় নুডুলস বানিয়ে দাও না?”

মিনু প্রাণখোলা হাসে।

-” আমি এখনি দিতেছি ভোর বাবা!”

ভোর মিষ্টি হাসে। পাতা এগিয়ে এসে আসমা বেগমের পাশে দাঁড়িয়ে বলল,

-” মা ডেকেছিলেন?”

সবাই পাতার দিকে চায়। আসমা বেগমও বই থেকে মুখ তুলে পাতার দিকে চায়। বই টি বন্ধ করে পাশে রেখে বলে,

-” হুম! না ডাকলে তোমায় পাওয়া যায়? আমাকে দেখলেই এমনভাব ধরো যেন আমি বাঘ না ভাল্লুক! কেটে পরেই নিস্তার পাও! সৎ শাশুড়ি তাই গ্রাহ্য করো না।”

-” মা কি সব বলছেন!”

অসহায় গলা পাতার। এই শাশুড়ি মা’ কে তার ভয় লাগে। কেমন যেন গম্ভীর মহিলাটি! অরুণ সরকারের থেকেও গম্ভীর গলায় কথা বলে তার সাথে। এটা করবে না!ওটা করবে না! ওরকম করছো কেন? ওভাবে হাঁটে কেও? মনে হয় তার সব কাজেই শাশুড়ি মায়ের এলার্জি। সবকিছুতেই দোষ ত্রুটি খুঁজে বের করবে আর শাসন করবে। অথচ রুবির সাথে তার ভিন্ন আচরণ। পাতার মন খারাপ হয়। তাই পারত পক্ষে শাশুড়ি মায়ের থেকে গা ঢাকা দিয়েই থাকে।
আসমা বেগম তীক্ষ্ণ গলায় বলে,

-” কি সব বলছি আমি? তোমার আচরণে তো সেটাই মনে হয়! থাক বাদ দাও! আমার পাশে বসো? চা নাও?”

পাতা তার পাশে বসে চুপটি করে। চা নেয়, চায়ে চুমুক বসাতেই জিভ পুড়িয়ে হালকা স্বরে আর্তনাদ করে উঠলো। চা গরম ছিল খুব! ভোর এগিয়ে এসে উদ্বিগ্ন গলায় বলল,

-” আম্মু কি হলো?”

আরিয়ান ও আনিকা ফিক করে হেসে উঠে।

-” মা! তোমার বড় বউমা দেখি চা’ ও খেতে যানে না!”

সবার মুখেই চাপা হাসি! পাতা মুখশ্রী কাঁদো কাঁদো হয়ে এলো। আসমা বেগম গম্ভীর গলায় ঝাড়ি দিয়ে বলে,

-” ছোট বাচ্চা তুমি? চা গরম কিনা পরখ করে খাবে না? শুধু হাতে পায়েই বড় হয়েছো দেখছি!”

পাতা মাথা নিচু করে নেয়। ভোর পাতার কোলে বসে কোমল গলায় সুধায়,

-” ও আম্মু! জ্বলছে?”

পাতা মাথা নেড়ে না বোঝায়। সুরুভি বেগম আসমা বেগমের দিকে তাকিয়ে হেসে বলে,

-” থাক আপা আর বকিয়েন না! আপনার বউমা চা খেতে পারে না ! অভ্যাস নেই হয়তোবা!”

আসমা বেগম বাদে সবার মুখেই চাপা হাসি বিদ্যমান। মিনু আভারিও বাদ যায় নি! পাতার চোখ ভরে উঠতে চায়! আশ্চর্য কথায় কথায় কান্না আসে কেন? আগে তো কখনো আসতো না! পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে আগমন ঘটে আদুরির! এসেই কথার ফুলঝুড়ি শুরু করে দেয়।‌ হাসি তামাশায় মেতে ওঠে ড্রয়িং রুম। তবে চুপচাপ ভোর ও পাতা। পাতার মন খারাপ আর তার মুখশ্রীর আঁধার বুঝতে পেরে ভোরের মুখশ্রীতেও আঁধার নামতে চায়! দাদি আম্মুকে বকলো!সবাই মজা উড়ালো!
আড্ডার মাঝেই আদুরি মিনুকে উদ্দেশ্য করে বলে,

-” মিনু আপা? এরকম বৃষ্টির মৌসুমে মন সব সময় খাই খাই করে! কিছু বানিয়ে দাও না? বিরিয়ানি রান্না করতে পারো!”

-” আচ্ছা ম্যাডাম!”

-” উফ মিনু আপা! ম্যাডাম ম্যাডাম না বললে হয় না?”

মিনু হাসে। যার অর্থ ‘হয় না’। সুরুভি বেগম নাতির গালে চুমু দিয়ে পাতার দিকে একনজর দেখে আদুরিকে বলে,

-” আদুরি! মিনুর হাতের রান্না তো সবসময়ই খাও! আজ ভিন্ন হাতের রান্না খেলে কেমন হয় ?”

সবাই অবুঝ চোখে চায়! সুরুভি বেগম রান্না করবে কি? সুরুভি বেগম হেসে পাতাকে ইশারা করে বললো,

-” তোমার বড় ভাবীর হাতের রান্না চেখে দেখতে হবে না? তার হাতের গুনাগুণও জানা যাবে সাথে তোমার আবদারও পূরণ হবে!”

পাতার মুখ ফাটা বেলুনের মতো চুপসে যায়। সে আর রান্না দু মেরুর বাসিন্দা। সে রান্নার র’টাও জানে না। শুধু ঠিকঠাক চা বানাতে পারে এই যা!
আদুরি খুশি হয়ে বলে,

-” ঠিক বলেছেন আন্টি! এতো খুশি ডাবল হয়ে যাবে। বড় ভাবী তুমি কি বলো?”

পাতা আমতা আমতা করে! কি বলবে? সুরুভি বেগম ও রুবি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে পাতার দিকে চেয়ে। আরিয়ান হেঁয়ালি করে বলে,

-” আদু খুশি ডাবল হবে নাকি মাইনাস তা তোর বড় ভাবীর চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছে!”

আসমা বেগম পাতাকে পর্যবেক্ষণ করে সন্দেহ গলায় জিজ্ঞেস করে,

-” রান্না বান্না পারো তুমি?”

পাতা মাথা নিচু করে নেয়। ঢোক গিলে মাথা নেড়ে বলল,

-” না!”

আসমা বেগম হতাশ ভঙ্গিতে চায়। সুরুভি বেগমের অধরে খেলা করে শয়তানী হাসি।

-” আপা এতো দেখছি আলালের ঘরের দুলালী! রান্না পারে না। মেয়ে মানুষ হয়ে রান্না পারে না এটা তো লজ্জার বিষয়। আমার রুবিকে রাজকন্যার মতো বড় করেছি তবে রান্না বান্না শেখানো বাদ রাখি নি! রান্না করতে পারা সেকেলে কিছু না। বউমা রান্না জানো না স্বামীকে রেঁধে খাওয়াবে কি?”

লজ্জায় পাতার মাথা কাটা যাবার উপক্রম। সত্যিই তো কথাগুলো! কেন রান্না শিখলো না! বাড়িতে বড় বোন থাকলে ছোট বোনের রান্না শেখা হয়? আর ও বাড়ি প্রিয় ও ফয়সালকে সামলানোর দরুণ রান্নার বোঝা তার কাঁধে চাপে নি!

ইতিমধ্যে সবার নজরে আসে অরুণ! পকেটে হাত গুটিয়ে স্বাভাবিক ভাবেই ড্রয়িং রুমে উপস্থিত হয়। সোফায় জায়গা থাকায় পাতার পাশেই বসে পড়লো। পাতা আড়চোখে একবার দেখে শাশুড়ি মায়ের দিকে চেপে বসলো।
অরুণ সকলের দিকে তাকিয়ে স্বাভাবিকভাবেই বলল,

-” আমি আসাতে সবাই চুপটি করে গেলে কেন?”

আদুরি হেসে ভাইকে বলে,

-” বড় ভাবীর হাতের বিরিয়ানী খেতে চাইলাম! কিন্তু সে ছ্যাঁকা দিলো তো! রান্নাই করতে পারে না সে!”

-” ওহ্। এখন সবাই সব কাজে পারদর্শী হবে এরকম তো কথা নেই, তাই না? কথা হলো আমাকে দেখে সবাই চুপ করে গেল কেন?”

সুরুভি বেগম বলে,

-” অরুণ বাবা কটুক্তি করি নি তোমার বউকে! আজকালকার মেয়েরা রান্না জানাকে সেকেলে মনে করে। তাই রান্না শেখে না। আরে বাবা রান্না না জানলে ভালোমন্দ রেঁধে বেড়ে স্বামীর মন জয় করবে কিভাবে? তাই তোমার বউকে বলছিলাম!”

অরুণ পাতার দিকে একপলক তাকায়। একটু আগের সব কথাই সে শুনেছে। সুরুভি বেগমের কথার প্রেক্ষিতে বলে,

-” এখন রান্না পারে না এতে তো কিছু করার নেই তাই না? আর এমনিতেই আমি তো আমার বউকে মাস্টার শেপ বানাবো না। আর আদু কিসের বিরিয়ানী খাবি বল?”

-” মাটন বিরিয়ানি! তুমি রাঁধবে ভাই?”

অরুণ সোফা থেকে উঠে বলে,

-” হুম! মিনু আপা আজ আপনার কিচেনের দখল আমি নিলাম!আর কারো কোনো আবদার? বলে ফেলো?”

আনিকা হাত তুলে বলে,

-” চাচ্চু নুডুলস খাবো আমি!”

অরুণ সায় জানালো। পাতা অবাক লেচনে অরুণের দিকে চেয়ে। এই লোক রান্না করতে পারে? আসমা বেগম বরাবরের মতো গম্ভীর মুখেই। আরিয়ান ও রুবি চুপচাপ বসে। সুরুভি বেগমও খানিকটা অবাক হয়।

-” তুমি পুরুষ মানুষ হয়ে রান্না করবে? রান্না করতে পারো?”

অরুণ মুচকি হেসে বলে,

-” না পারার কি আছে? আর কোথায় লেখা আছে পুরুষ মানুষের রান্না করতে নেই? বড় বড় রেস্টুরেন্টের শেফ, বিয়ে অনুষ্ঠানে বাবুর্চি,বিভিন্ন ক্যান্টিনেও কিন্তু ছেলেরাই রান্না করে। তো বাড়িতে করলে সমস্যাটা কি? আদু তার ভাবীর কাছে বিরিয়ানীর আবদার করেছে! তার ভাবী না পারুক ভাই তো পারে। আমিই পূরণ করলাম। আশা করি এতে আর পাতাকে কথা শুনতে হবে না।”

বলেই পাতাকে উদ্দেশ্য করে বললো,

-” এই আলালের ঘরের দুলালী? কিচেনে চলো! রান্না না পারো হেল্প তো করবে?”

বলে রান্নাঘরে চলে যায় অরুণ! ভোর খুশি হয়ে পাতাকে টেনে নিয়ে যায় কিচেনের দিকে।

ওরা চলে যেতেই রুবি উঠে দাঁড়িয়ে শাশুড়ি ও স্বামীকে উদ্দেশ্য করে বলে,

-” মা, আরিয়ান? অরুণ ভাইয়া‌ কেমন করে কথা বললো? মা বড় ভাবীকে কি এমনটা বলল যে এভাবে কথা বলতে হবে? ওনাকে কি অপমান করেছে আমার মা? মা আপনিই বলুন মার কথাগুলো কি বাজে টোনে ছিল?”

আসমা বেগম রুবির দিকে চায় শান্ত ভাবে। কি বলবে? আরিয়ান আনিকাকে সোফায় বসিয়ে রুবির কাঁধে হাত রেখে বলে,

-” ভাইও ওমন টোনে কথা বলে নি রুবি! হেসেই বলেছে! তুমি কথা বাড়াচ্ছো..

আর বলতে পারে না। রুবি কাঁধ থেকে আরিয়ানের হাত ঝটকায় সরিয়ে বলল,

-” আমারও কান আছে আরিয়ান! ঠিকই বলেছো, কথা বাড়িয়েছি! আম্মু? তোমাকেও বলিহারি বাইরের মানুষের ব্যাপারে তোমার কেন কথা বলতে হবে? অপমান হতে ভালো লাগলো?”

সুরুভি বেগম গোমড়া মুখে বসে থাকে। আসমা বেগম উঠে এসে রুবির মাথায় হাত রেখে বলে,

-” শান্ত হও! সুরুভি আপা? অরুণের কথায় কষ্ট পেলে অরুণের হয়ে আমি ক্ষমা চাইছি! যদিও ছেলেটা ওভাবে বলে নি আপনাকে তবুও ক্ষমা চাইছি! মনে কিছু নেবেন না।”

_____

কিচেনে ঢুকেই অরুণ ফ্রিজ খুলে গরু ও মুরগির মাংস বের করে ভিজিয়ে রাখে। চারটা ডিম বের করে। চুলায় গরম পানি বসায়। এরপর পেঁয়াজ ছিলে কুঁচি কুঁচি করে মরিচ কাটতে থাকে। ভোর কেবিনেটের উপর বসে পেঁয়াজ ছিলে বাবাকে সাহায্য করছে। পাতা হা করে চেয়ে আছে বাবা ছেলের দিকে। সাদা শার্ট ও কালো ট্রাওজারে অরুণ সরকার কিচেনে রান্না করতে ব্যস্ত। এটা তার ধারনার বাইরে ছিল। অরুণ গরম পানিতে কতকগুলো ম্যাগি নুডুলসের প্যাকেট ছিঁড়ে ছেড়ে দিল। ভোর কিছু টমেটো ধুয়ে দিলে অরুণ সেগুলোও কেটে নেয়। নুডুলস ছেঁকে চুলায় কড়াই বসিয়ে পেঁয়াজ, মরিচ, ও টমেটো কুচি ছেড়ে দেয়। অল্প সময়ের মধ্যেই নুডুলস রান্না শেষ হলে অরুণ চুলায় আবার গরম পানি বসিয়ে দেয়। অরুণ এক বাটি নুডুলস রেখে বাকি টুকু মিনুকে ডেকে সবাইকেই দিতে বলে। মিনু ও আভারির জন্যও এক বাটি দেয়। মিনু মুচকি হেসে নিয়ে যায়। অরুণ একটা কাঁটা চামিচ বাটিতে দিয়ে বলে,

-” দুজন খেয়ে নাও!”

পাতা চামিচে নুডুলস তুলে ফু দিয়ে ভোরের মুখে দেয়! ভোর মজা করে চিবোতে থাকে। পাতা আবার চামিচে তুলে একটু উঁচু হয়ে অরুণের মুখের সামনে ধরল। অরুণ ভ্রু কুঁচকে চায়। পাতা ইশারায় খেতে বলে। অরুণ ভ্রু যুগল শিথিল হয়। মুখশ্রী একটু প্রফুল্লচন্দ্র হলো কি? মুখে পুরে নেয়। পাতা মুচকি হেসে নিজেও মুখে নেয়। একদম পাক্কা হাতের রান্না।

-” ইশ! অসাধারণ! একদম পার্ফেক্ট! আপনার রান্নার হাত নিপুণ! ”

পাতার প্রশংসায় অরুণ আড়চোখে পাতার দিকে তাকিয়ে বলে,

-” হয়েছে! পাম দিতে হবে না।”

পাতা হেসে বলে,

-” পাম দিচ্ছি না! সত্যি বলছি! কোথা থেকে শিখেছেন?”

অরুণ মুচকি হেসে পেঁয়াজ কুচি করতে করতে বলল,

-” শিখেছি কখনো ইউটিউব থেকে তো কখনো মেসের বুয়ার থেকে।”

-” আপনি মেসে থাকতেন?”

অবাক স্বরে সুধায় পাতা। অরুণ মাথা নাড়িয়ে সায় জানায়। বাবার মৃত্যুর আগে সে মেসেই থাকতো বন্ধুদের সাথে। সপ্তাহ, মাস অন্তর অন্তর বাড়িও আসতো। তার মেসে থাকার কারণও ছিল। অরুণ আর আরিয়ানের মধ্যকার সম্পর্ক এখন মিষ্ট হলেও অতিতে খুবই তিক্ত স্বাদের ছিল। দুজনের মাঝে একটুও পড়তো না। যেন তারা সাপ বেজি যুগল। একে অপরকে দেখতেই পারতো না। আসমা বেগমের বিয়ের দু বছর পরই আরিয়ানের জন্ম হয়। অরুণের আট বছরের ছোট আরিয়ান।অরুণের ভাগের আদর ভালোবাসা কমতে শুরু করে আসমা বেগমের কাছ থেকে। এরজন্য অরুণ আরিয়ানকেই দায়ী মনে করে। আরিয়ানকে আদর করে কোলে নেয়া তো দূর, কাছেই ঘেঁষতে দিতো না অরুণ। দুজন বড় হতে থাকে, তাদের মধ্যকার রেষারেষিও বাড়তে থাকে।অরুণ সতেরো কি আঠারো বছরের ছিল আরিয়ান নয়/ দশ! দুজনের ঝগড়ার মাঝে আরিয়ান অরুণকে ‘কুত্তার বাচ্চা’ বলে গালি দিয়েছিল। অরুণ রেগে গিয়ে প্রথমবারের মতো আরিয়ানকে অনেক মেরেছিল। ছোট আরিয়ান কেঁদে ওঠে তবুও ছাড়ে নি।পড়ে আর কি? আসমা বেগম এসে অরুণের থেকে ছাড়িয়ে নেয় আরিয়ানকে। ধমক দেয় অরুণকে। রাতে অনিক সরকার এলে নালিশ জানায় অরুণের নামে। আসমা বেগম জখমি ছেলেকে দেখিয়ে কেঁদে কেটে বিচার চায় অনিকের কাছে। গুন্ডা মাস্তান, বদমাইশ, বেয়াদব যা তা বলে গালি দেয় অরুণকে। অরুণ দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে সব শোনে। একটু পরেই তার ডাক আসে। অনিক সরকার অরুণকে জিজ্ঞেস করে কি হয়েছে? অরুণ জবাব না দিয়ে মনব্রত পালণ করে । ফলাফল অনেক বকা ও একটা ডাবাং মার্কা চড় পড়ে। এর একমাস হওয়ার পর অরুণ জেদ করে মেসে উঠবে। অনিক সরকার জেদ ধরল পাঠাবেন না মেসে। দুই জেদি মানব জেদে অনড়। শেষমেষ অরুণ আসমা বেগমের কাছে সাহায্য চায়। আসমা বেগম অনিক সরকারকে বুঝায়। তারপর অরুণ মেসে। আরিয়ানের সাথে তার সম্পর্ক ঠিক হয় অনিক সরকারের পরলোক গমনের পর! কিভাবে হয় উপর ওয়ালাই জানে।

বাটির সবটুকু নুডুলস তিনজনের ভাগাভাগিতে শেষ হয়। পাতা ভোরকে পানি খাইয়ে অরুণকেও দেয়। নিজে পান করে গ্লাস রেখে এসে দেখে বাবা ছেলের চোখে জল। পাতার কপালে ভাঁজ পড়ে। পরে খেয়াল হয় নাক উঁচু ম্যানারলেস লোকটা পেঁয়াজ কাটছে, ভোর তার পাশেই বসে। পাতা হেসে বলে,

-” আপনারা কাঁদছেন? থাক কাঁদবেন না। আমি এসে গেছি ভয় নেই।”

অরুণ পাশে তাকিয়ে নাক টানে। পকেট হাতরিয়ে রুমাল খোঁজে পায় না। তাই হাতের ইশারায় পাতাকে কাছে আসতে বলে। পাতা কাছে এলেই তার বাড়তি আঁচল টেনে চোখ মুখ ও নাকের পানি মুছে বলে,

-” পাতাবাহার তুমি এক নম্বরের কাজ চোর! হাতে হাতে টুকটাক কাজ করে দেবে তা না! ভোরকে দেখেও তো শিখতে পারো?”

পাতার মন টা ‘তা তা থৈ থৈ করে নাচলেও অভিনয় সরূপ গোমড়া মুখে ভোরের চোখ মুখটাও মুছে দিয়ে বলে,

-” কি করতে হবে বলুন আমি করে দিচ্ছি!”

-” থাক আমিই করছি! আপনি কাজ করতে গিয়ে অকাজ না করে বসেন!”

বলেই মাংস ধুয়ে নিয়ে তাতে ময় মসল্লা দিতে থাকে। আর পাতা চুপ নেই কাজে অষ্টরম্ভা হলেও তর্কে সে নোবেলজয়ী! ভোরও চুপ করে নেই! কখনো সে আম্মুর পক্ষে তো কখনো রদবদল করে অরুণের পক্ষে। তাদের মিষ্টি খুনসুটিতে মুখরিত রান্নাঘর।

চলবে….