পাতা বাহার পর্ব-৩৮+৩৯

0
659

#পাতা_বাহার
লেখনীতে: #বেলা_শেখ
#পর্ব- ৩৮ ( প্রথম অংশ)
(প্রাপ্ত বয়স্কদের জন্য)

(কপি করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ)

জুম্মার দিন মুসলমানদের জন্য সাপ্তাহিক ঈদের দিন। এই দিন আমাদের দেশে ছুটির দিন! যোহর ওয়াক্তে অন্যান্য দিনের তুলনায় জুম্মার দিনে সকল মসজিদে জলদি অর্থাৎ সারে বারোটার তরি আজান হয়ে থাকে। সবাই আজানের আহ্বান শুনে গোসল সেরে পাক পবিত্র হয়ে, মাথায় টুপি পড়ে আতর মেখে দল বেঁধে মসজিদে যায় যতো দ্রুত সম্ভব! ওইদিন ইমাম সাহেব খুতবা পাঠ করে শোনান। বিভিন্ন হাদিস পাঠ করে শোনান। তারপর নির্দিষ্ট সময়ে জুম্মার নামাজ শুরু হয়! জুম্মা অর্থ জমায়েত হওয়া। সকল শ্রেণীর মুসলিম উম্মাহ একসাথে এক সারিতে সমবেত হয়ে এক আল্লাহ তায়ালার নিকট সিজদাহ করে। যেখানে জাত, বংশ, ধনী গরীব কোনো ভেদাভেদ নেই। সবাই সমান; এক আল্লাহ পাকের গোলাম! মাথা নিচু করে নিজেদের বশ্যতা স্বীকার করে। দু হাত তুলে দীর্ঘ মোনাজাতে কেঁদে বুক ভাসিয়ে ক্ষমা প্রার্থনা করে! আল্লাহ তায়ালার নিকট আর্জি পেশ করে! শোকর আদায় করে। জুম্মার নামাজ শেষে সবাই নিজ সামর্থ্য অনুযায়ী দান সদকা করে! অনেকে মানত স্বরূপ মসজিদে জিলিপি, মিষ্টি, তবারক বিলি করে! সেই জিলিপি, মিষ্টি, তবারক সবাই গ্রহণ করে। কেউ নিক সিঁটকায় না বরং খুশি মনে সেটা গ্রহণ করে দোয়া করে। আতিকুর ইসলাম, অরুণ, রাতুল, কাওছার,লুবমান লাবিব ,ভোর সবাই মসজিদ থেকে ফিরছে একসাথে। ভোর,লাবিবের হাতে আইসক্রিম! ভোর নামাজ শেষে যখন জিলিপি দিলো গোমড়া মুখে সেটা নিয়েছিল। সে তো মোনাজাতে আল্লাহর কাছে আইসক্রিম চেয়েছিল আল্লাহ দিল না কেন? আতিকুর ইসলাম হেসে তাকে ও লাবিবকে মসজিদ সংলগ্ন দোকানে নিয়ে গিয়ে আইসক্রিম কিনে দেয়। এবং বুঝিয়ে বলে যে জিলিপি কে দেয়, কেন দেয়! শুধু তাকে না লাবিবকেও কিনে দেয়। ভোর আইসক্রিম পেয়ে খুব খুশি। গপাগপ মুখে পুরে খেতে থাকে। অরুণ ভ্রু উঁচিয়ে তাকালে ভোর বাবার কাছে না গিয়ে আতিকুর ইসলামের হাত ধরে হাঁটতে থাকে। হাঁটতে হাঁটতে তাঁরা বাড়ির কাছে আসে। দেখতে পায় পাতা, প্রিয় ও লতা দাঁড়িয়ে আছে রাস্তার ধারে। লতার কোলে ছোট রুম্পা। তিনবোন হাসি ঠাট্টায় মেতে আছে। অরুণ আশেপাশে তাকায়। রাস্তায় অনেকেই আছে; মসজিদ থেকে বাড়ির উদ্দেশ্যে যাচ্ছে তাঁরা। অথচ এরা রাস্তায় দাঁড়িয়ে হি হি করছে। লতা, প্রিয় সালোয়ার কামিজের সাথে ওড়না দিয়ে ঘোমটা টানা থাকলেও পাতার পড়নে শাড়ি। যদিও মাথায় আঁচল দিয়ে ঘোমটা টেনেছে তবুও ব্যাপারটা মোটেও ভালো দেখাচ্ছে না। অনেক মুরুব্বি জোয়ান গোছের লোকজন যাচ্ছে। যাদের নজর ওদিকেই! অরুণের শান্ত মেজাজ বিগড়ে গেলো। তাদেরকে দেখে লতা, পাতা, প্রিয় হাত নাড়ে। ভোর লাবিব দৌড়ে যায়। কে আগে তার আম্মুকে ধরতে পারে। দুজন তীব্র গতিতে ছুটছে। লাবিব এগিয়ে আছে ভোরের থেকে। ভোর আরো জোরে দৌড়াতে থাকে কিন্তু লাবিবের আগে পৌঁছাতে পারে না। লাবিব লতাকে ধরে আনন্দে আত্মহারা হয়ে বলে,

-” ইয়ে আমি জিতে গেছি! ভোর তোমার আগে ধরেছি আম্মুকে!”

ভোর দৌড়ে এসে হাঁটুতে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে বললো,

-” আমি ইচ্ছে করেই হেরে গেছি লাব্বু ভাইয়া!”

লাবিব হেসে ব্যাঙ্গ করে বলে,

-” তাই না!”

ভোর ক্লোজ আপ হাসি দিয়ে সায় জানালো। পাতার কোমড় জড়িয়ে ধরে। পাতা সহ সবাই হেসে উঠলো। এরইমধ্যে বাকি সবাই এসে উপস্থিত হয়। আতিকুর ইসলাম গম্ভীর গলায় ধমকের সুরে বলল,

-” বাড়িতে জায়গার অভাব পড়েছিল? রাস্তায় দাঁড়িয়ে কিসের হাসাহাসি?”

লতা, পাতা, প্রিয়র মুখ খানি চুপসে যায়। তড়িঘড়ি পা চালায় বাড়ির উদ্দেশ্যে। বাকি সবাই তাদের পিছনে। পাতা হাঁটার গতি মন্থর করে অরুণের পাশাপাশি হাঁটে। অরুণ আড়চোখে পাশে তাকিয়ে দেখলো পাতাকে। তার মেজাজটা খানিক শীতল হবে হবে ভাব। সে গলা খাঁকারি দিয়ে প্রস্তুতি নেয় পাতাকে কিছু বলার জন্য কিন্তু তার আগেই পাতা গায়েব! পাতাকে আসতে দেখে কাওছার জিলিপির প্যাকেট লুকিয়ে ফেলল। পাতা হেসে বলল,

-” লুকিয়ে লাভ নেই! দাও বলছি কাওছার ভাই?”

কাওছার হার মানে। জিলিপির প্যাকেট দিয়ে দেয়! ছোট থেকেই প্রতি জুম্মার দিনে জিলিপি দিলে কাওছার আনবে। আর তার আনা জিলিপির একমাত্র ভাগিদার পাতা। কাওছারের বোন জুবাইদাকেও দিতনা‌ একটা! পাতা জিলিপির প্যাকেট ছিঁড়ে একটা মুখে পুড়ে। প্রিয় এগিয়ে এসে বলল,

-” পাতুপু একা খাবে নাকি! আমাদেরও হক আছে!”

-” একদম নেই! কাওছার ভাইয়ের বিয়ের আগ পর্যন্ত এটাতে শুধু আমার অধিকার! তাই না কাওছার ভাই?”

পাতার কথায় কাওছার মুচকি হেসে মাথা নাড়ে। পাতাও মুচকি হেসে জিলিপি খাওয়ায় মনোনিবেশ করে। তিরিক্ষি মেজাজের অরুণের চোয়াল শক্ত হয়ে গেল নিমিষেই। কথাগুলো খুবই কটু শোনালো তার কর্ণগহ্বরে। প্রিয়কে ডেকে জিলিপির দুটো প্যাকেট তার হাতে দিলো। প্রিয় খুশি হয়ে পাতাকে প্যাকেট জোড়া দেখিয়ে ভেংচি কাটলো। পাতার কপালে ভাঁজ পড়ে। লতা পিছনে তাকিয়ে অরুণের উদ্দেশ্যে হেসে বলল,

-” এটা কিন্তু না ইনসাফি ভাইয়া! আমারও হক আছে!”

প্রিয় একটা প্যাকেট তার দিকে বাড়িয়ে বলল,

-” ধরো নাও তোমার হক!”

লতা হাতে নেয়। মেয়েকে কার কাছে দেবে ভাবলো! ছোট্ট রুম্পা অরুণের দিকে হাত বাড়িয়ে আ আ বুলি আওড়ায়! অরুণ হাত বাড়িয়ে কোলে নেয় রুম্পাকে। ঠোঁট ডাবিয়ে গালে চুমু খায়। অপরদিকে ভোর আতিকুর ইসলামের পাশ থেকে গাল ফুলিয়ে আড় চোখে তাকায় বারংবার। অরুণও তাকায় ছেলের গোমড়া মুখের দিকে। ভোর ঘার ফেরায়; তাকায় না আর। ওই পঁচা মেয়ে বাবু কাল তার চুল টেনে ছিঁড়ে দিয়েছিল। আর আব্বু ওই পঁচা মেয়েকে আদর করছে। সে পাতার কাছ ঘেঁষে হাঁটতে লাগলো। তারা বাড়িতে প্রবেশ করবে তখনি বাড়ি সংলগ্ন সামনের রাস্তায় একটা গাড়ি এসে থামে। অরুণ রুম্পাকে কোলে নিয়েই গাড়ির পাশে দাঁড়ালো। গাড়ি থেকে একে একে নেমে আসে সবাই। আসমা বেগম,আদুরি, রুবি, আরিয়ান! আরিয়ানের কোলে আনিকা। আর আদুরির কোলে রূপ! পাতা এগিয়ে এসে সালাম জানায়। আদুরির কাছ থেকে রূপকে কোলে নেয়। আনিকার গাল টিপে দিল সাথে আরিয়ানকে ভেংচি কাটতে ভুলে না। আতিকুর ইসলাম সহ বাকি সবাই এগিয়ে আসে। আগত মেহমানদের সাথে হাসিমুখে কুশল বিনিময় করে সানন্দের সাথে স্বাগত জানিয়ে ভিতরে নিয়ে যায়।
______

সরকার বাড়ির সোফায় বসে কাঁদছে মিনু। এ কান্নার শেষ নেই। ঘন্টা দেড়েক হবে মিনু কান্না শুরু করেছে এখনো থামার নাম নেই। মাঝে মাঝে কান্নার গতি কমে আসে, আবার কখনো বেড়ে যায় হুট করে। আভারি দূর্বল কাঁপা কাঁপা গলায় কান্না করতে বারণ করে। মিনুর কান্না তখন থামার বদৌলতে বেড়ে যায় চক্রবৃদ্ধিহারে। আভারি হতাশ হয়। এই মেয়ে মানুষ এতো এতোটা আবেগী হয়? পাগলীর দল সব! আভারি আর কান্না থামানোর কথা বলে না। কিচেনে গিয়ে ফ্রিজ খুলে কয়েকটি কমলা বের করে ছিলে কোয়া ছাড়িয়ে জুস মেকারে দেয়। জুস বানিয়ে গ্লাসে ঢালে। কিচেনের কেবিনেটে থাকা কেকের স্লাইড, পাউরুটি, ক্যাচাপের বৈয়াম ও একটা চামচ একটা ট্রেতে করে নিয়ে সামনে টি টেবিলে রেখে মিনুর পাশে বসলো! টি টেবিলে থাকা সেন্ট্রাল হসপিটালের দেয়া মিনুর রিপোর্ট নাড়াচাড়া করে পাশে রাখে। মিনুর মাথায় হাত বুলিয়ে আদুরে গলায় বলল,

-” কাইন্দো না! আর কত কাইন্দবে? বাদ দেও তো! জলদি কইরে এসব খাইয়ে নেও! সকাল থেকে কিচ্ছুটি খাও নাই!”

মিনু আঁচলে চোখের জল মোছার বৃথা চেষ্টা করে ক্রন্দনরত সুরেই বলে,

-” আমার গলা দিয়ে এখন কিছু নাইমবে না! খাইবো না আমি! আপনি খান!”

আভারি শক্ত করে বলল,

-” যা বইলতেছি করো! খাও? ডাক্তার আপা কি বললো মনে নাই? বেশি বেশি খাইতে বলছে!”

বলেই মিনুর কপালে হাত রেখে জ্বর পরখ করে। না! জ্বর নেই বললেই চলে। আশ্চর্য এতো জলদি জ্বর নেমে গেল!! দুপুরের দিকে তো গায়ে হাত রাখাই যাচ্ছিল না তাপে। ওষুধ বিনা একটা রিপোর্টেই জ্বর গায়েব? আভারি জুসের গ্লাসটা মিনুর মুখে দেয়! মিনু পুনরায় আঁচলে চোখ মুছে এক চুমুক দিলো। এখন সন্ধ্যা বেলা! আজান দিবে। মিনু কোনো প্রকার ছুট বাহানা না দিয়ে সব খেয়ে নিলো!

-” আপনে একটু অরুণ স্যাররে কল করেন? জলদি আসতে বলেন না? ভোর বাবার জন্য পরানটা পুইড়তেছে!”

উদ্বিগ্ন স্বরে বলে মিনু। আভারি খানিক হেসে বলল ,

-” কাল রাইতে গেল শশুর বাড়ি আইজই আইসবে? কটা দিন থাইকবে না?”

মিনু মন খারাপ করে উঠে ঘরে গেল। আজান দিচ্ছে। আভারিকে মসজিদে যেতে বলে; সাথে ওযু করে নিজেও নামাজে দাঁড়ায়! উপর ওয়ালার কাছে দু হাত তুলেই ঝরঝর করে কেঁদে ওঠে মিনু। আল্লাহ তায়ালার লাখ কোটি শুকর আদায় করে বুক ভাসিয়ে দেয়।
নামাজ শেষ করে বাড়িতে এসে আভারি অরুণের কাছে কল লাগায়! টুকটাক কথা বলে কল কেটে মিনুকে ডেকে বলে সবাই আসছে। মিনু খুশি হয়! রান্না চড়াতে যায় । আভারি গিয়ে লাগায় ধমক অসুস্থ শরীর নিয়ে মহারানি রান্না করতে এসেছে। মিনু ধমক শুনে গাল ফুলিয়ে রাখে। তার গাল ফুলানো দেখে আভারি হাসে। এতো সেই কিশোরী মিনু। সদ্য বিয়ে করা নতুন লাজুক বউ। যাকে ধমক তো দূর একটু উঁচু শব্দে কথা বললে গাল ফুলিয়ে বসে থাকতো। কথা বলতো না‌, কাছেও ঘেঁষতে দিতো না। রাতে শাশুড়ির কাছে গিয়ে ঘাপটি মেরে শুয়ে থাকতো!

-” রান্না কইরতে হইবে না। সবাই রাইতের খাবার খাইয়ে আসবে!”

আভারির কথায় মিনু আশ্বস্ত হয় না। মিনমিনে সুরে বলে,

-” এতো দূরের রাস্তা! আসতে আসতে তো আবার খিদে লাইগে যাইবে! আমি বরং হালকা পাতলা কিছু রাঁনধি?”

আভারি শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে মিনুর দিকে।

-” আচ্ছা বানাও!”

মিনু খুশি হয় তার কথায়! খুশি মনে রান্না করে। ডাল, ভর্তা ভাত ও ডিম ভেজে নেয়। রান্না বান্না শেষ করে মিনু আভারি সকলের প্রতিক্ষার প্রহর গোনে। কিন্তু কারোর আসার নামধাম নেই। রাত দশ বাজতে চলল। বাড়িতে মানুষ বলতে তাঁরা দুজনই আর এক জন বোবা প্রাণী!সেও বসে আছে ব্যাথিত নয়নে মেইন ফটকের পানে তাকিয়ে। মাঝে মাঝে মৃদু স্বরে ‘মিও মিও’ ডাকছে। তাকে রেখেই সবাই বেড়াতে গেল!
ঘড়ির কাঁটা ঘুরতে ঘুরতে যখন বারোটার অতি নিকটে পৌঁছে যায় আভারি মিনু খেয়ে নেয় রাতের খাবার। বিড়াল শাবকটিকে ও ক্যাট ফুট দেয়। সে ফটাফট খাবার সাবার করে আভারির পা ঘেঁষে বসে থাকে। ঘড়ির কাঁটা সারে বারোটার ঘরে পৌছানো মাত্রই কলিং বেল বাজার শব্দ হয়। আভারি ধরফরিয়ে ওঠে। একটু চোখ লেগে গিয়েছিল তার! কলিং বেলের আওয়াজ শুনে ঘোর কেটে যায়। তড়িঘড়ি করে দরজার কাছে যায়। পিছু পিছু পাতাবাহার লেজ দোলাতে দোলাতে আঁকা বাঁকা পায়ে হেঁটে যায় ধীরে ধীরে। দরজা খুললে ভিতরে প্রবেশ করে সবাই! পাতাবাহার দৌড়ে গিয়ে তার মালিকের পা ঘেঁষে মিও মিও করে। আরিয়ান ঘুমন্ত মেয়েকে কোলে নিয়ে সোফায় বসে মিনুর পাশে! মিনু উঠে দাঁড়ালো।

-” আরে মিনু আপা উঠছো কেন? বসো বসো! এখন কেমন আছো? জ্বর কমেছে?”

আরিয়ানের কথায় মিনু মাথা নাড়িয়ে জবাব দিল জ্বর কমেছে। তবে বসে না, উঁকি ঝুঁকি দিয়ে ভোরকে খোঁজে। দেখতে পায় ভোর ঘুমুঘুমু চোখে ঢুলুঢুলু পায়ে পাতার হাত ধরে আসছে। পিছনে অরুণ সরকার ও বিড়ালছানা। মিনু এগিয়ে এসে ভোরকে কোলে তুলে নিয়ে মুখশ্রী জুড়ে আদরের বন্যায় ভাসিয়ে দিল। ভোর মিষ্টি হেসে মিনুর গলা জড়িয়ে ঘুম জড়ানো গলায় বলল,

-” মিনু খালা ভোর ঘুম!”

বলেই চোখ বুজে। মিনু তার চোখের পাতায় চুমু খেয়ে ঝরঝর করে কেঁদে ফেললো! ভোরের ঘুম ছুটে গেল নিমিষেই! মিনু খালাকে কাঁদতে দেখে তারও কান্না পাচ্ছে! মিনু খালা কাঁদছে কেন? সবার নজর মিনুর দিকে! হঠাৎ এভাবে কাঁদছে কেন? রুবি ঘুমন্ত ছেলেকে নিয়ে আরিয়ানের পাশে বসে। আদুরিও ভাইয়ের পাশে বসে উৎসুক মুখে মিনুর দিকে তাকিয়ে। আসমা বেগম বসেন না। মিনুর কাছে গিয়ে নরম গলায় সুধায়,

-” কি হয়েছে মিনু?”

মিনু বলতে পারে না কান্নার চোটে। ভোরের আঁখি যুগলও ভরে ওঠে। আরিয়ান মেয়েকে সোফায় শুইয়ে দিয়ে উঠে এসে আভারির কাঁধে হাত রেখে জিজ্ঞেস করে ‘কি হয়েছে’। আভারি টি টেবিলের উপরে থাকা রিপোর্ট তুলে এনে পাতার কাছে দেয়। পাতা কপালে ভাঁজ ফেলে রিপোর্ট খুলে। মিনু আপার মেডিক্যাল রিপোর্ট! কি হয়েছে মিনু আপার? সে পেজ উল্টিয়ে দেখে। কিন্তু কিছুই বুঝতে পারে না। কিসের রিপোর্ট এটা? পাতা রিপোর্ট থেকে নজর উঠিয়ে সবার দিকে তাকায়। সবার উৎসুক প্রশ্নাত্নক দৃষ্টিতে তার দিকেই তাকিয়ে। পাতা আমতা আমতা করে। সে তো কিছুই বুঝতে পারছে না। আশ্চর্য আভারি ভাই তার হাতে দিলো কেন? সে কাঁচুমাচু করে রিপোর্টটা পাশে দণ্ডায়মান অরুণের দিকে বাড়িয়ে দেয়। অরুণের ভ্রু কুটিতে ভাঁজ পড়ে। হাত বাড়িয়ে নেবে তার আগে আরিয়ান খপ করে নিয়ে রিপোর্ট পড়তে শুরু করে।

-” ভাই তোর আম পাতা জোড়া জোড়া সামান্য মেডিকেলের রিপোর্টই পড়তে পারে না! এ নাকি স্কুল টিচার! আমার তো ঘোর সন্দেহ হচ্ছে! সার্টিফিকেট, এন আই ডি কার্ড একটু পরখ করে নিস!”

পাতা কটমট করে চায়। দাঁতে দাঁত চেপে হিসহিসিয়ে বলে,

-” আমি কোনো ডাক্তার নই যে রিপোর্ট দেখবো আর গলগল করে বলে দেব!”

আরিয়ান বত্রিশ পাটি বের করে হেসে বলল,

-” অ আ, ক খ,এ বি সি ডি, রিডিং পড়তে পারো? রিপোর্ট পড়তে ডাক্তারি পড়তে হয় না!”

পাতা কিছু বলবে অরুণ চোখ রাঙায় তাকে। আরিয়ানকে ধমকের সুরে বলে,

-” ফালতু কথা বাদ দিয়ে বল রিপোর্টে কি লেখা আছে?”

আরিয়ান রিপোর্ট বন্ধ করে অরুণের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো।

-” বউয়ের প্রতি খুব দরদ দেখছি!”

অরুণ কিছু বলবে এর আগেই আসমা বেগমের ধমকে আরিয়ান চুপ করে যায়। রিপোর্ট হাতে নিয়ে আভারির সামনে দাঁড়িয়ে গম্ভীর সুরে বলল,

-” আমার দেয়া আয়ুর্বেদিক হারবাল ঔষধ পত্র কাজে লেগেছে আভারি ভাই! বলেছিলাম না? এখন আমার কমিশন কই?”

আভারি লজ্জা পায় সাথে মিনুও! ভোরকে নামিয়ে দেয় মিনু। অরুণ কোলে তুলে নেয় ছেলেকে। আদুরি ঘুম জড়ানো গলায় বলে,

-” এতো সাসপেন্স রাখছো কেন জলদি বলো না ?”

পাতার মুখশ্রীতে চিন্তার আভাস! আয়ুর্বেদিক হারবাল? সে তো কিছুই বুঝতে পারে নি!

-” আয়ুর্বেদিক হারবাল কিসের জন্য? কি হয়েছে ক্লিয়ার করে বলছেন না কেন?”

আরিয়ান পাতার দিকে আড়চোখে চেয়ে হেসে আভারিকে বলল,

-” সেটা আমাদের পার্সোনাল ব্যাপার। মিষ্টির হাঁড়ি আনো আম পাতা জোড়া জোড়া! আভারি ভাই বাবা হচ্ছে! মিনু আপা প্রেগন্যান্ট! থ্রি মান্থ রানিং!”

সবাই অবাক চোখে মিনুর দিকে তাকায়! মিনুর ক্রন্দনরত মুখের দিকে তাকিয়েই সব পরিষ্কার হয়ে যায়। অবশেষে এক অভাগীর শূন্য কোল পূর্ণ হতে চলেছে। পাতা, আদুরি, রুবি মিনুকে জড়িয়ে ধরে অভিনন্দন জানায়। আসমা বেগম তার মাথায় হাত বুলিয়ে দোয়া করে। অরুণ এগিয়ে আসে ছেলেকে নিয়ে। মিনুর মাথায় হাত রেখে বলল,

-” অনেক সুখি হও মিনু আপা! তোমার কোল জুড়ে খুশির চেরাগ আসুক! আল্লাহ তায়ালা তাকে সুস্থ সমেত পৃথিবীতে আসার তৌফিক দান করুক! সাবধানে থাকবে! আভারি ভাই দায়িত্ব বেড়ে গেল কিন্তু!”

মিনু মুচকি হেসে মাথা নাড়ল। অথচ আঁখি যুগল দিয়ে নোনাজল ভেসে আসে। ভোর কিছু বোঝে না।

-” আব্বু কি হয়েছে?”

অরুণ মুচকি হেসে বলল,

-” তোমার মিনু খালার আদরের ভাগ বসাতে আরেকজন আসছে!”

ভোর পিটপিট করে মিনুর দিকে চায়। তার আদরের ভাগ? এরমধ্যে পাতা মিষ্টির প্যাকেট নিয়ে আসে ফ্রিজ থেকে। তার পিছনে পাতাবাহার। পাতা একটা মিষ্টি থেকে অল্প মিষ্টির টুকরো ভেঙ্গে নিয়ে ভোরের মুখে দিয়ে বলে,

-” তোমার মিনু খালা মা হতে চলেছেন! ছোট বাবু হবে তার! রুপ আনির মতো আরেকটা ভাই অথবা বোন আসবে তোমার!”

মিষ্টির দরুণ ভোরের গাল ফুলে যায়। ফুলো গালে মিষ্টি হেসে মিনুকে বলে,

-” মিনু খালা আমার কিন্তু বোন চাই! মিষ্টি বোন!”

মিনু হেসে উঠলো। সাথে বাকি সবাই! পাতা মিনু আভারি সহ সবাইকে মিষ্টি খাওয়ায়। এরপর অরুণের সামনে এসে একটা মিষ্টি বাড়িয়ে দেয়। অরুণ নেয় না। পাতা কপালে ভাঁজ ফেলে মিষ্টি মুখের সামনে ধরলো। অরুণ ঝুঁকে একটু মিষ্টি মুখে নিয়ে সরে যায়। বাকি অংশ পাতা মুখে পুরে নেয়। ঘুরে দাঁড়াতেই আরিয়ানের সম্মুখ হয়। ত্যাছড়া দৃষ্টিতে তার দিকেই তাকিয়ে। পাতা মিষ্টি গলাধঃকরণ করে প্যাকেট থেকে আরেকটা মিষ্টি নিয়ে আরিয়ানের মুখে পুরে দেয় সব টুকুই! জয়ী হেসে কিচেনের দিকে অগ্রসর হয়। বিড়াল শাবকটি তার পায়ে পায়ে হাঁটছে শুরু থেকেই। পাতা একটা মিষ্টি তার সামনে দিয়ে বলে,

-” সবটুকু খাবি? তোকেও দিলাম! আর আমার পিছু আসবি না! খবরদার”

বিড়াল শাবকটি মিও মিও করে মিষ্টি শুঁকে চাটতে থাকলো!
______

আঁধার রজনী তে আঁধার ঘরে বসে আছে দুজন মানব মানবী। দুজনেই সদ্য নতুন অনুভূতির সাথে পরিচিত হয়েছে আজ! অচেনা উত্তেজনা, শিহরণে চোখে ঘুম ধরা দিচ্ছে না‌। মেলে রাখা চোখের তারায় আকাশসম স্বপ্ন ভেসে বেড়াচ্ছে! ছোট ছোট শখ, আশা মিলে বুনতে থাকে স্বপ্নের আর্শিমেলা! তাদেরই অস্তিত্ব জুড়ে আস্তে ধীরে বেড়ে উঠছে এক ছোট্ট প্রাণের অংশ! দীর্ঘ বছরের পর শূণ্য কোল পূর্ণ হয়ে একটা ছোট্ট প্রাণের কেঁদে ওঠার সুর ভেসে আসে সেই স্বপ্নের আর্শিতে! শিহরণ বয়ে বেড়ায় শিরায় উপশিরায়। কেঁপে ওঠে তনুমন! হাত পা শীতল হয়ে আসে। ছোট ছোট হাত পা নাড়িয়ে তাদের কোল আলো করবে। হেসে খেলে বেড়াবে। তাদের আঙ্গুল ধরে হাঁটতে শিখবে। অ আ বুলি‌ আওড়াবে! মা বাবা বলে ডাকবে। শতশত আবদার করবে। এতো বছরের স্বপ্ন, আশা, শখ সব পূরণ হবে ইনশাআল্লাহ। মিনু আভারির কাঁধে মাথা রাখলো। আভারি পিঠ গলিয়ে হাত রেখে জড়িয়ে ধরে। মিনু তার অপর হাত নিয়ে পেটের উপর রাখে।

-” অবশেষে খোদা আমাদের ঘরেও সুখপাখি পাঠিয়ে দিলো! আপনার আমার আমরা ব্যাতিত আপনজন আসছে!”

আভারি মিনুর ললাটে চুমু খায়। মিনু অনুভব করে লোকটা কাঁদছে। মিনু কিছু বলে না। কাঁদুক একটু। এ কান্নার মাঝেও যে এক সমুদ্র পানির পরিমাণ আনন্দানুভূতি লুকিয়ে আছে।
_____

গালে হাত দিয়ে বিছানায় বাবু হয়ে বসে আছে ভোর সরকার। গভীর চিন্তায় মগ্ন সে। একটু আগে ঘুমুঘুমু চোখে চিন্তার আবির্ভাব ঘটে ঘুম গায়েব হয়ে গেছে। পাতা ওয়াশরুম থেকে ড্রেস চেঞ্জ করে শর্ট কামিজ ও ঢোলা সালোয়ার পরে বেড়িয়ে আসে। বিছানা থেকে ওড়না নিয়ে গায়ে জড়ায়। বিছানায় চিন্তায় মগ্ন ভোরকে দেখে কপালে গাঢ় ভাঁজ পড়ে। তার পাশে বাবু হয়ে বসে নরম গলায় জিজ্ঞেস করে,

-” কি হয়েছে আমার বাবাটার? কি নিয়ে চিন্তা করছো?”

ভোর পাতার কোলে মাথা রাখলো। পাতা তার চুলের ভাঁজে হাত গলিয়ে দেয়। ভোর কিছু পল চুপ থেকে শান্ত, ঘুম জড়ানো গলায় বলে,

-” আচ্ছা আম্মু? মিনু খালার বাবু আসলে মিনু খালা তাকে অনেক ভালোবাসবে তাই না?”

-” হুম! বাসবেই তো!

পাতা মুচকি হেসে জবাব দেয়! ভোর মলিন মুখে পাতার দিকে তাকিয়ে বলে,

-” আমাকে আগের মতো ভালোবাসবে না,তাই না? ওই বাবুকেই বেশি ভালোবাসবে! ভোরকে অল্প অল্প ভালোবাসবে!”

পাতা ছোট ছোট করে চায় ভোরের মলিন মুখশ্রীর দিকে। ওহ্ এই কারণে চিন্তার অন্ত নেই ভোর সরকারের! পাতা ঝুঁকে ভোরের কপালে চুমু খেয়ে বলে,

-” কে বলেছে ভালোবাসবে না? অবশ্যই ভালোবাসবে। আগের মতোই!”

-” উঁহু। আমি জানি তো! দাদি, চাচ্চু চাচিমনি আমাকে আগে অনেক বেশি ভালোবাসতো!আদর করতো! এখনো করে তবে আগের মতো না। এখন রূপকে ভালোবাসে বেশি। আমাকে কম কম এই এইটুকু। তুমি যেন আব্বুকে বলিও না এ কথা!”

পাতা ভোরের দু গালে চুমু খেলো সশব্দে। ভোর পাতার পেটে মুখ গুঁজে কোমড় জড়িয়ে ধরে। পাতা মুচকি হেসে তার মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,

-” রূপকে অনেক বেশি ভালোবাসে এর মানে এই না যে তোমাকে কম কম ভালোবাসে। তোমাকেও অনেক ভালোবাসে। তোমার আব্বু তোমাকে অনেক অনেক ভালোবাসে! সে কি আনি, রূপকে ভালোবাসে না? বাসে তো! বেশিই বাসে। ভালোবাসা কম বেশি হয় নাকি আবার! ভালোবাসা তো ভালোবাসাই। ইকুয়াল ইকুয়াল। তবে হ্যাঁ ভালোবাসা প্রকাশ করার ব্যাপারটা আলাদা। কারো ক্ষেত্রে কম হয় তো কারো ক্ষেত্রে বেশি! ভোর শুনছো?”

না ভোর শুনছে না মোটেই। ভোর সরকার ঘুমে বিভোর হয়ে গেছে। পাতা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। ভোরকে নিয়ে বালিশে শুইয়ে দিয়ে বুকে জড়িয়ে নিল। ছোটরা তো এমনি! ছোট ছোট বিষয় নিয়েই অভিমান করে বসে থাকে। অথচ আমরা বড়রা সেদিকে ধ্যান দেই না।
একটু পর অরুণ প্রবেশ করে রুমে। পাতা তার দিকে তাকায়। অথচ অরুণ তাকায় না মোটেও! পাতার ভ্রু যুগল কুঁচকে যায়। এই লোকের আবার কি হলো? সে লক্ষ্য করেছে জুমার নামাজ থেকে ফেরার পর লোকটা তাকে এড়িয়ে চলছে। কথাই বলছে না। এমনটা কেন করছে? তাদের মধ্যে তো কোনো তর্ক বিতর্ক হয় নি! না কোনো নোকঝোঁক। তাহলে? হ্যাঁ নামাজের আগে পাতা লোকটার উপর অনেক হেসেছিল। লোকটা রাগি রাগি মুখে চোখ পাকালেও পাতা জানে সেটা মিছিমিছি রাগ ছিলো। কিন্তু এখনকার ভাবসাব দেখে তো সেটা মনে হচ্ছে না। কিছুতো গন্ডগোল আছে। পাতা ভোরকে ছাড়িয়ে বিছানা থেকে উঠে আসে। অরুণ হাতঘড়ি খুলে ড্রেসিন টেবিলে রাখে। পড়নের টি শার্ট খুলে ছুঁড়ে ফেলে নিত্যদিনের মতো! আলমারি থেকে ট্রাওজার নিয়ে ওয়াশরুমের উদ্দেশ্যে যাবে বাঁধ সাধলো পাতা। দুই হাত মেলে বেড়িবাঁধের মতো অরুণের সামনে দাঁড়িয়ে বলল,

-” অনেকক্ষণ হলো আপনার ভাবসাব দেখে যাচ্ছি। কিছু বলছি না। এখন ঝটপট বলে ফেলুন তো কাহিনী কি? আমাকে ইগনোর কেন করছেন? কথাও বলছেন না?”

অরুণ বিরক্তের সহিত পাতার দিকে তাকিয়ে পাশ কেটে চলে যেতে নেয় পাতা আটকে নেয়,

-” আরে ভাই বলুনতো মামলাটা কি? আমি কি কোনো ভুল কিছু করেছি? যদিও আমি হান্ড্রেড পার্সেন্ট সিওর আমি একদম ইনোসেন্ট!”

অরুণ বিরক্ত হয় বেশ। কটমট করে তাকালো পাতার দিকে। পাতা আমলে নেয় না। ভ্রু উঁচিয়ে ইশারায় সুধায় কি হয়েছে? অরুণ আবারো উপেক্ষা করে পাতার কাঁধ ধরে একপাশে নিয়ে সে ওয়াশ রুমে চলে যায়। পাতা আহম্মকের মতো দাঁড়িয়ে। পরে ধীরে সুস্থে ফ্লোরে পড়ে থাকা অরুণ সরকারের টি শার্ট তুলে নেয়। ঘাম ও পারফিউম মিশ্রিত কড়া ঘ্রাণ নাকে বাজে। পাতা নাক কুঁচকে নেয়। পাতার নিকট আকর্ষণীয় পুরুষালী মিষ্টি ঘ্রাণ নাকে না আসায় রেখে দেয় টি শার্ট। বিছানায় পা ঝুলিয়ে ভাবতে থাকে কি তার অপরাধ! না তার কোনো অপরাধ খেয়ালে আসে না। আচ্ছা সে ডাকাত বলেছিল লোকটাকে এইজন্যই কি? সে তো মজা করে বলেছিল! এর জন্য রাগবে না ,তাহলে? হঠাৎ খেয়াল আসে কাওছার ভাইয়ের কথা! লোকটাটি কাওছার ভাইয়ের সাথে তার মেলামেশা নিয়ে সামহাও জেলাসিতে ভুগেছে? ব্যাপারটা ইন্টারেস্টিং হলে পাতার কাছে ভালো লাগে না! লোকটা কি তাকে সন্দেহ করছে? পাতার উরু উরু মনটা মলিনতার মেঘে ঢাকা পড়ে। ওয়াশরুমের দরজার পানে তাকিয়ে থাকে। সময় নিয়ে অরুণ সরকার বেড়িয়ে আসে। উন্মুক্ত ভেজা শরীরে পানি চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়ছে। পরণে শুধু ট্রাওজার। তোয়ালে দিয়ে মাথা মুছতে মুছতে পাতার সামনে দিয়ে যায়। মেল শ্যাম্পুর কড়া ঘ্রাণ পাতার নাসা গহ্বরে প্রবেশ করে; মন মস্তিষ্কের ভিতর আইলা ঝড় তুফান বয়ে তছনছ করে দেয়। পাতা দিন কাল ভুলে অরুণের দিকে তাকিয়ে থাকে; অষ্ঠাধরের মাঝে বিস্তর ফারাক। সুঠাম বলিষ্ঠ দেহের সুদর্শন পুরুষ কায়া! ভেজা লোমশ বুকে লেপ্টে। প্যান্টটা নাভিকুন্ডের নিচে অবস্থান করছে। ফর্সা উন্মুক্ত পিঠ চেয়ে আছে পাতার দিকে। মাংশল বাহু, লোমে আবৃত নজরকাড়া হাত! পাতা ঢোক গিলে। লোকটা তাকে বশ করতে নিশ্চয়ই ওয়াশরুমের ভিতর কোনো মন্ত্র টন্ত্র পড়েছে। জাদুটোনা করছে‌। না হলে পাতা এভাবে বশিভূত হয় ? মনে মনে আয়াতুল কুরসি পাঠ করে পাতা বুকে ফুঁ দেয়। ড্রেসিন টেবিলের সামনে দন্ডায়মান অরুণের পাশে দাঁড়িয়ে নরম গলায় বলে,

-” আপনি আমার উপর রেগে আছেন? আমি কোন ভূল করেছি? করলে স্পষ্ট বলবেন। এভাবে মুখ ফিরিয়ে নেয়া খুবই অপমানজনক!”

কথায় কাজ হলো যেন। অরুণ পাতার চোখে চোখ রাখে। তোয়ালে ছুঁড়ে ফেলে সোফার উদ্দেশ্যে। সেটা সোফায় না পড়ে ফ্লোরে গড়াগড়ি খায়। অরুণ দরজার দিকে হনহন করে যায়। পাতার কপালে ভাঁজ পড়ে। এতো রাতে কোথায় যাচ্ছে লোকটা? অরুণ যায় না। দরজা বন্ধ করে ডাক দেয়,

-” পাতাবাহার?”

-” হুম”

-‘ মিও মিও?”

দুই পাতাবাহার একসাথে জবাব দিলো। পাতা বিড়াল শাবকটির দিকে বিরক্তের নজরে চায়। এই শয়তানটা না ঘুমাচ্ছিল? কখন উঠলো? আর লোকটাইবা কাকে ডাকলো? তাকে নাকি বিড়ালটাকে! বিড়াল শাবকটি অরুণের পায়ের কাছে গিয়ে গলা উঁচিয়ে মিও মিও ডাকে। অরুণ তার দিকে তাকালো না বলে লেজ গুটিয়ে সোফায় বসে আড়চোখে তাকিয়ে থাকে। যেন সে অভিমান করেছে। কিন্তু তার অভিমানের তোয়াক্কাই করলো না কেউ। অরুণ পাতার দিকে তাকিয়ে শান্ত গলায় বলে,

-” কি যেন বলেছিলে? এক ডাকাত ডাকাতি করতে গিয়ে বিছানা থেকে পড়ে যায়। ধপাস!”

পাতা গোল গোল করে চায়। অরুণ এগিয়ে আসে। পাতার সম্মুখীন হয়ে সিনা টান টান করে দাঁড়িয়ে গম্ভীর ধীমে সুরে বলে,

-” সি পাতাবাহার ইউ আর ইন রবার’স বেডরুম! ডাকাতের ঘরে অবস্থান করছো তুমি! ভাবতে পারছো ডাকাত কি কি করতে পারে?”

পাতার চোখের আকার ক্রমান্বয়ে বড় হয়। ঢোক গিলে পরপর। এই লোক ভিলেন বনে গেল কেন? না সুবিধার ঠেকছে না। গতকালের ভয়ংকর অভিজ্ঞতা মস্তিষ্কের ভিতর কিলবিল করে। পাতা পালাতে চায়। দু এক কদম পিছিয়ে দৌড় লাগালো উদ্দেশ্য হীন! অরুণ তার গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করছিল! পাতার দৌড়ে মোটেও অবাক হয় না। বড় বড় পা ফেলে এক হাতে পাতার কোমড় জড়িয়ে শূন্যে তুলে আলমারির ঘেঁষে দাঁড় করায়। পাতা আলমারির সাথে লেগে যায়। অরুণ বাঁকা হেসে পাতার দুই হাতের আঙ্গুলের ভাঁজে ভাঁজে আঙ্গুল দিয়ে আলমারির সাথে আটকে বন্দিনী বানিয়ে ফেলে।ভয়ে পাতার মুখের রঙ বিবর্ণ হয়ে যায়। লোকটা কি করতে চলেছে! তার হাত পা ঝিমঝিম করছে। শক্তি ফুরিয়ে আসছে। মাথা ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। অক্সিজেনের অভাব বোধ করে। বুকটা ধ্বক ধ্বক করছে বিরামহীন! এ কেমন অসহ্যনীয় অনুভূতি। অরুণ পাতার দিকে ঝুঁকে সময় নিয়ে তাকিয়ে থাকে।একে অপরের নাক ছুঁই ছুঁই। নিঃশ্বাস আছরে পড়ছে একেঅপরের মুখশ্রীর দিকে। অরুণের বুকের ভিতরের হৃদযন্ত্রটা যেন ঢোল পিটিয়ে যাচ্ছে। সেই শব্দ পাতা নিজেও অনুভব করতে পাচ্ছে ক্ষীণ! আর ধারালো গভীর মায়াময় চোখের নিষিদ্ধ বাণ! অনভিজ্ঞ পাতাও বুঝতে পারে কিছুটা। এতেই যেন সকল জড়তা এসে ভিড় জমায়। দুজনেই একে অপরের চোখের দিকে তাকিয়ে। চোখে চোখে যেন কথা হয় দুজনের ভিতর! অরুণ নাকে নাক ঘষে। কপালে চুমু দেয়। পাতার নিঃশ্বাস আটকে যাবার যোগাড়। মুঠোয় বন্দি অরুণের হাত চেপে ধরে শক্ত করে। অরুণ থেমে নেই মোটেও; ললাটে, দু ভ্রুয়ের মাঝে, পরপর নাকে ছোট ছোট চুমু দেয়। অধর নামিয়ে নেয়! পাতার অধরের অতি ক্ষীণ দূরত্বে অধর রেখে শ্বাস ছাড়ে। পাতা এবার ভয়ংকরভাবে কেঁপে উঠলো। প্রতিটি শিরা উপশিরায় যেন বহ্নি শিখা জ্বলে উঠলো। শান্ত পাতা ছটফটিয়ে উঠলো নিমিষেই। অথচ অরুণ শান্ত! বধুয়ার অধর জোড়ার কিনারায় সশব্দে গভীর চুমু খায়! পাতা পুনরায় শান্ত হয়ে আসে। শরীর ছেড়ে দেয়। অরুণ আগলে নেয়। হাত ছেড়ে কোমড় জড়িয়ে বুকে তুলে নেয়। পাতা তার গলা জড়িয়ে কাঁধে মুখ লুকিয়ে নেয়। মিনিট খানেক ওভাবেই কেটে যায়। পাতার নড়চড় না দেখে অরুণ বিছানায় নিয়ে যায়। বালিশে শুইয়ে দেয় পাতাকে। পাতা অরুণের গলা ছেড়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়বে কিন্তু পুনরায় অস্বস্তির সাগরে ডুবে যায়। অরুণ সরকার ওড়না সরিয়ে দেয়। গলায় মুখ গুঁজে ঠোঁট বুলায় আদুরে ভঙ্গিতে। পরপর থুতনিতে, অধরের কিনারা ঘেঁষে অধর বুলিয়ে গালে গাল ঘষে। ছোট ছোট চুমু দিয়ে হঠাৎ কামড় বসায় শক্ত করে। ব্যাথায় পাতা ছটফট করে উঠলো। হাত দিয়ে সরিয়ে দিতে চায়। অরুণ সরে না। সময় নিয়ে দাঁত বসিয়ে রাখে। ব্যাথায় পাতার চোখ ভরে ওঠে। অরুণ ছেড়ে দেয়! পাশ ফিরে পাতার দিকে পিঠ করে শুয়ে রিমোট হাতরিয়ে লাইট অফ করে বলে,

-” বেঁচে গেলে পাতাবাহার!”

পাতার নিঃশ্বাস ভারী! গালে হাত বুলায়। রাক্ষস কোথাকার! তার গালটার কি হাল করে দিয়েছে। জ্বলছে অনেক। সে কম্ফোর্টের ভিতরে ঢুকে অরুণের দিকে পিঠ করে শোয়। কথা বলবে না লোকটার সাথে। সে রাগে ফোঁস ফোঁস করে ঘুমানোর চেষ্টা করে। ঘুম বাবাজি ধরা দিতে অনিচ্ছুক। মিনিট ত্রিশ পরেও ঘুম ধরা না দিলে পাতা পাশ ফেরে। তাক ঝাঁক কর বোঝার চেষ্টা করেে লোকটা ঘুমিয়েছে কি না। তবে বুঝতে পারলো না। সে চোখ বুজে একটা হাত কম্ফোর্টের ভিতর দিয়ে অরুণের পেট জড়িয়ে ধরে একটা পা তুলে দিলো কোলবালিশের ন্যায়! কিছু সময় পেরিয়ে যায়! পাতার চোখে ঘুম নামে। অথচ ঘুমে কাতর পাতা অনুভব করতে পারল না যে, তার আঙ্গুলের ভাঁজে আঙ্গুল ঢুকিয়ে শক্ত করে ধরে। হাত টেনে নিয়ে বুকের বা পাশে চেপে ধরে শান্তির শ্বাস ছাড়ে তার নাক উঁচু ম্যানারলেস লোক। মেয়েটা এতো আদুরে কেন? মেয়েটার জন্য মন কুঠিবাড়ির কর্তৃপক্ষ ব্যাকুল হয়ে ওঠে কেন? মেয়েটার সান্নিধ্য, তর্ক, শাসন, বারণ, যত্নের জন্য বেহায়া মনটা আকুতি করে কেন? অভিজ্ঞ অরুণ বুঝতে পারে মন প্রসুণে ভালোবাসা নামক রোপণ করা অঙ্কুর ধীরে ধীরে অঙ্কুরিত হয়ে বর্ধিত হচ্ছে। তবে সে সাবধানে কদম ফেলবে। একবার বিচ্ছেদ নামক আগুনে পুড়েছে তার হৃদয়খানি! যে দুঃখ নিজেই ডেকে এনেছিল সেই দুঃখ নিয়ে সে আফসোস করতে পারে নি আর না করবে।‌ তবে নিজ ও ছেলের ভবিষ্যত যেন একটু সুখের হাতছানি দিতে গিয়ে মুখ থুবড়ে না পড়ে সেই খেয়াল রাখবে শতভাগ।

চলবে…..

#পাতা_বাহার
লেখনীতে: #বেলা_শেখ
#পর্ব- ৩৮ ( শেষ অংশ)
(প্রাপ্ত বয়স্কদের জন্য)

(কপি করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ)

ঝলমলে ভোর বেলা! পূর্ব দীগন্তে অরুণ উঁকি দিচ্ছে। তার লালিমায় ছেয়ে আছে দীগন্তের বুক। কালো মেঘ হীন পরিষ্কার আকাশে সাদা মেঘমল্লার দল বেঁধে উড়ে বেড়াচ্ছে। এ যেন শরতের আহ্বান জানিয়ে দিচ্ছে। যদিও বর্ষাকাল চলছে ঋতুচক্রে। হালকা শিশিরে গাছের পাতা ঘাস ভিজে আছে অল্প। মুক্ত বিহঙ্গের দল নীড় থেকে বেরিয়ে এসেছে। দলবেঁধে উড়ছে এলোমেলো। কখনো‌ বাগানে তো কখনো ছাদের পেয়ারা গাছটাতে। তাদের কলতানে মুখরিত হয়ে উঠেছে পরিবেশ। অরুণ সরকারের বেলকনিতে কয়েকটি চড়ুই পাখির আগমন ঘটেছে। তারাই হইহুল্লোড় করছে। চি চি শব্দ পুরো রুম জুড়ে ধ্বনিত হচ্ছে। অরুণ বেলকনিতে এসে দেখে চড়ুই পাখি গুলো টবে দেয়া‌ পানিতে নেমে ঠোকাঠুকি করছে একে অপরের সাথে। অরুণ তাদের তাড়িয়ে দেয় না। ফিগ প্লান্টের চারার গোড়ায় পানি ঢেলে দেয়। এতে টব ভরে যায়। অরুণ সরে আসলে কিছু পাখি সেখানে গিয়ে পানি পান করছে নাকি আনন্দ করছে ঠাহর করতে পারল না। তাদের আনন্দ বোধহয় একজনের সহ্য হলো না। পাতাবাহার শিকারির মতো শব্দহীন পা ফেলে একটু একটু করে এগিয়ে খপ করে লাফ দিল পাখিগুলো ধরার উদ্দেশ্যে! কিন্তু পাখিগুলো বুঝতে পেরে কেটে পরে। বিড়াল শাবকটি টপ সমেত পড়ে যায়! টপ ভাঙে নি শুধু উল্টে গেছে। অরুণ বুকে হাত গুঁজে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তার দিকে তাকালে বিড়াল শাবক নিজেকে নিরপরাধ প্রমাণ করার জন্য সাফাই গায় কিউট ভঙ্গিতে মিঁয়াও মিঁয়াও! অরুণ চুপচাপ রুমে প্রবেশ করে; পাতাবাহার লেজ নাড়িয়ে তাঁর পিছু পিছু। তাদের বাড়ির আঙিনায় বসবাস করা সব পাখি উঠলেও তার ঘরে বাস করা দুটো পাখি এখনো গভীর নিদ্রায়। অরুণ সোফায় বসে থাকে। একা একা ভালো লাগছে না। সে চাইছে পাখি দুটো উঠুক আর তার কানের কাছে কিচিরমিচির করুক। অরুণ উঠে বিছানায় বসে। ভোর এপাশে শুয়ে আছে। অন্যপাশে পাতা গুটিসুটি মেরে কম্ফোর্টে আপাদমস্তক ঢেকে শুয়ে আছে। অরুণ ছেলেকে টেনে এনে বুকে জড়িয়ে ডাকে। ভোর পিটপিট করে চায়। ঘুম জড়ানো ভাঙ্গা ভাঙ্গা গলায় বলে,

-” আব্বু ভোর ঘুম'”

-” অনেক হয়েছে ঘুম এখন উঠো কলিজা!”

ভোর দু হাত তুলে হামি দেয়। বাবার দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। তারপর তার কাঁধে মুখ গুঁজে পুনরায় ঘুমের প্রস্তুতি দিবে অরুণ তা হতে দেয় না।

-” একদম ঘুমাবে না। অনেক বেলা হয়ে গেছে। একটু পরেই আমি অফিসে যাবো! তোমার আম্মুকে ডাকো?”

গম্ভীর গলা শুনে ভোরের ঘুম গায়েব হয়ে যায়। ঠোঁট উল্টে বাবাকে ছেড়ে বিছানায় বসে। কম্ফোর্ট টেনে আম্মুকে ডাকে। কোনো‌ প্রতিক্রিয়া না পেয়ে বাবার দিকে চায়!

-” কম্ফোর্ট সরিয়ে টেনে তোলো!”
বাবার কথায় ভোর গাল ফুলিয়ে কম্ফোর্ট সরিয়ে দেয়। বাহু ধরে টেনে চিৎ করে শুইয়ে দেয় আর ডাকে,

-” আম্মু? ও আম্মু? গুড মর্নিং হয়ে গেছে ওঠো না! আম্মু?”

পাতা আড়মোড়া ভেঙে পিটপিট করে এপাশে ফিরে । ভোরকে দেখে মুচকি হেসে গুড মর্নিং বলে। ভোর হাসে না। উদ্বিগ্ন হয়ে পাতার গালে হাত রেখে বলল,

-” আম্মু তোমার গালে কি হয়েছে? ফুলে গেছে?”

ব্যাথায় পাতার মুখ কুঁচকে যায়। ভোরের হাত সরিয়ে গালে হাত রাখে। অনুভব করতে পারে তার গাল সহ মুখশ্রী ফুলে কলা গাছ বনে গেছে। সব ওই নাক উঁচু ম্যানারলেস রাক্ষস লোকটার জন্য। অরুণ পাশেই ছিল ছেলের কথা শুনে এগিয়ে এসে পাতার কাছে বসে। থুতনি ধরে এপাশ ওপাশ করে। পুরো মুখশ্রীই ফুলে গেছে তবে ডান গালটা বেশি ফুলে গেছে। আর কামড়ের জায়গায় কালসিটে দাগ পড়েছে। বোঝাই যাচ্ছে কালকের কামড়ে কতটা প্রভাব ফেলেছে। অরুণ পাতার কপালে গলায় হাত রাখে! গা গরম, জ্বর এসেছে; তবে বেশি না। পাতা পিটপিট করে অরুণের কর্মকাণ্ড পর্যবেক্ষণ করে। এরপর উঠে বসে। ভোর দুঃখি গলায় বলে,

-” আম্মু ব্যাথা পেলে কিভাবে? গালে কি হয়েছে?”

পাতা রাগি রাগি চোখে অরুণের দিকে চেয়ে ঘুম জড়ানো মোটা ভাঙ্গা গলায় হিসহিসিয়ে বলে,

-” ডাকাত হামলা করেছিল! মানুষ খেকো রাক্ষস ডাকাত!”

ভোরের মুখশ্রী জুড়ে ভয়ের আবির্ভাব ঘটে। ডাকাত! রাক্ষস! মানুষ খায়! সে পাতাকে জড়িয়ে ধরল শক্ত করে। পাতা খানিকটা হাসে। ফুলো লাল মুখশ্রীতে তার হাসি মিষ্টি লাগছে। অরুণ শান্ত দৃষ্টিতে চেয়ে; নজর পাতার গালে নিবদ্ধ। ইশ্ গালটার সাথে মুখটার কি হাল হয়েছে। তবে মন্দ লাগছে না। রাগি রাগি চাহনি, ফুলো ফুলো গাল! তবে গালের লাল লাল কালসিটে দাগ দেখে খানিকটা মায়া হয়। সে হাত বাড়িয়ে গালে রাখে। পাতা ঝটকায় সরিয়ে দিলো। অরুণ মুচকি হেসে বললো,

-” আমাদের বাগানে পেঁপে গাছ আছে বেশ কয়েকটা। সেখানে পেঁপে ধরেছে বড় বড় ফুলো ফুলো! একদম তোমার গালের মতো পাতাবাহার!”

পাতা কটমট করে তাকালো। মজা উড়াচ্ছে লোকটা? তার কষ্ট হচ্ছে। ব্যাথায় কথা বলতে পারছে না ভালোকরে। আর লোকটা হাসছে। পাতা কিছু বলে না। তবে ভোর চুপ থাকে না। পাতাকে ছেড়ে অরুণের সামনে দাঁড়িয়ে মাথার চুল টেনে ধরে শক্ত করে।

-” আম্মু ব্যাথা পাচ্ছে আর তুমি হাসছো? মজা করছো? তুমি পঁচা!”

-” আরে বাবা! আচ্ছা হাসবো না মজাও করবো না। ছাড়ো ভোর?”

অরুণের কথায় ভোর ছাড়ে না বরং আরো শক্ত করে ধরে। পাতার গোমড়া মুখে হাসি ফুটে উঠলো। বিছানা থেকে নেমে ওয়াশ রুমে চলে গেল। অরুণ ছেলেকে কোলে নিয়ে তার পিছনে গেল। পাতা পিছনে মুড়ে প্রশ্নাত্মক চোখে চায়।

-” ব্রাশ করিয়ে ফ্রেশ করিয়ে দিবো ছেলেকে!”

পাতা অরুণের কোল থেকে ভোরকে নামায়! হাত ধরে নিয়ে ওয়াশ রুমে ঢুকে ধরাম করে দরজা বন্ধ করে। অরুণ ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। নিচে গিয়ে সরাসরি কিচেনে প্রবেশ করলো নক করে। কিচেনে আভারি ও মিনু! মিনু রুটি বেলছে আভারি চুলায় বসানো কড়াইয়ে ভাজি নাড়ছে। অরুণকে দেখে মিনু বলল,

-” কিছু লাইগবে স্যার? চা দিবো?”

অরুণ খানিক হেসে আটার বৈয়াম নিলো।

-” না! আমি করে নিচ্ছি। মিনু আপা আর কয়েকটা দিন কিচেন সামলান এরপর আপনার কিচেনে আসা বন্ধ!”

-” মানে স্যার বুঝলাম না?”

-” ডাক্তার আপনাকে পুরোপুরি রেস্টে থাকতে বলেছে না? সব কাজ বন্ধ। নতুন লোক আসবে। সেই রান্নার কাজ করবে। আপনার লং টাইম ছুটি!”

মিনু অবাক সুরে বলে,

-” স্যার আমি রান্না বান্না করতে পারবো! সমস্যা..”

-” কোনো কথা না‌। আপনার সাবধানে থাকতে হবে। কোনো কাজ না শুধু রেস্টে থাকবেন। আপনার ভাগের কাজ আভারি ভাইকে দিয়ে করিয়ে নিবো!”

মিনু আর কথা বলার পথ খুঁজে পায় না। আভারি কৃতজ্ঞ দৃষ্টিতে অরুণের দিকে চায়‌। ডাক্তার আপা বলেছে যে খুব সাবধানে থাকতে হবে; প্রপার যত্ন নিতে হবে। ভারি কাজ তো দূর অতি দরকার ব্যাতিত কোন কাজ যেন না করে। বাচ্চা মিসক্যারেজ হতে পারে। খুবই নাজুক অবস্থায় আছে।
অরুণ আর কিছু বলে না। চুপচাপ নিজের কাজ করতে থাকে। নরম করে পরোটা বানিয়ে অমলেট ভেজে নেয়। সাথে দুটো গ্লাসে গরম দুধ ঢেলে নিল। একটা ট্রেতে সব গুছিয়ে জগ ভরে পানি নিল। ফ্রিজ থেকে কিছু বরফের টুকরো ছোট বাটিতে নিয়ে ট্রেটে রেখে নিজের রুমের উদ্দেশ্যে রওনা হয়!

পাতা ভোরকে ফ্রেশ করিয়ে দিয়ে নিজেও ফ্রেশ হয়ে নেয়। পড়নের জামাকাপড় চেঞ্জ করে শাড়ি পড়ে বিছানায় বসে থাকে। ভোর এটা ওটা জিজ্ঞেস করছে। ডাকাত কোথা থেকে এলো? তাকে বা আব্বুকে কেন ডাকলো না আম্মু? ডাকাতটা কি রাক্ষস ছিল? বড় বড় দাঁত ছিলো ভ্যাম্পায়ার দের মতো? আম্মু ভয় পেয়েছে কি না! পাতা কি উত্তর দিবে ভেবে পায় না। আরে এ রাক্ষস ডাকাত সেই রাক্ষস ডাকাত না। এতো মানুষ রুপি ভদ্র ভেসে ঘুরে বেড়ানো ভোরের কলিজার আব্বু! যে কিনা তার ওই কিউট পরিপাটি দাঁত বসিয়ে তার নরম গালটার তেরোটা বাজিয়ে দিয়েছে। কিন্তু সেটা তো বলা যায় না। তাই ভুজুং ভাজুং বুঝিয়ে দিয়েছে। কিন্তু এতেও ছেলেটা চুপ করে নেই এটা ওটা বলেই যাচ্ছে। পাতা শুধু হু হা করছে। গালে ব্যাথা বেড়ে যাচ্ছে সাথে চোখ ও মাথা ব্যথা করছে। জ্বর জ্বর লাগছে। চোখ ভরে উঠছে বারংবার। এরই মধ্যে অরুণ সরকারের আগমন ঘটে রুমে। পাতা মাথা উঁচু করে তাকালো। লোকটার হাতে খাবারের ট্রে! অরুণ ট্রে টি টেবিলের উপর রেখে পাতার দিকে চায়। ভিজে ওঠা চোখের পানি নজর এড়ায়নি। অরুণ বরফের টুকরো গুলো একটা মসলিন সুতি কাপড়ে পেঁচিয়ে পাতার সামনে দাঁড়ায়। থুতনি ধরে মাথা উঁচু করে গালে বরফ ছোঁয়ায়। পাতা চোখ মুখ কুঁচকে নেয় ব্যাথায়। ভোর এগিয়ে এসে পাতার পাশে বিছানায় দাঁড়িয়ে গালে ফুঁ দিয়ে আদুরে গলায় বলে,

-” আম্মু? ব্যাথা করছে? বরফ দিলে একদম ঠিক হয়ে যাবে দেখে নিও!”

অরুণ মুচকি হাসলো।

-” এটুকুতেই এই অবস্থা পাতাবাহার? ভবিষ্যত তো পড়েই আছে!”

কি সব ছিঃ মার্কা কথাবার্তা! পাতার ইচ্ছে হয় লোকটার দাড়িযুক্ত গালে কামড়ে শোধ বোধ করতে। শালার জামাই! শুনেছে জামাই মানুষ বউকে আদর করে সোহাগে ভরিয়ে রাখে। কই তার জামাই তো আদর সোহাগ করে না। করে না তেমন না! একটু একটু যত্ন করে আদরও করে মাঝেমধ্যে তবে আদরের সাথে কামড় ফ্রি! তার ভাবনার মাঝেই অরুণ পাতার হাতে বরফে মোড়ানো কাপড় দিয়ে বলে,

-” গালে ঘঁষে দাও!”

পাতা বাধ্য মেয়ের মতো গালে বরফ ঘষতে থাকে। অরুণ হাত ধুয়ে রুটির প্লেটটা হাতে তুলে নিয়ে গম্ভীর গলায় আদেশের সুরে বলে,

-” ভোর! চুপচাপ বিনা বাক্যব্যয়ে সবটুকু খাবার শেষ করবে দুজনেই! কোন কথা যেন না হয়! ”

ভোরের মুখে খাবার দেয়। ভোর খাবার চিবিয়ে উজ্জ্বল মুখে সুধায়,

-” তুমি বনিয়েছো?”

অরুণ মাথা নাড়িয়ে সায় জানালো। পাতা ফ্যালফ্যাল করে চায়। লোকটা নিজে রান্না করে এনেছে? এইরকম জামাই ই তো সব মেয়েরা চায়; যে রান্না করে নিজ হাতে খাওয়াবে। পাতার মন পুলকিত হয় তবে সেটা প্রকাশ করে না। গোমড়া মুখেই অরুণের হাতের খাবার খাওয়ায় মনোনিবেশ করে। হঠাৎ মনের ভিতর শয়তানী শখ জাগে। অরুণ মুখে খাবার দিলে পাতা তার আঙ্গুলসহ মুখে পুরে কামড় বসায়। জোরে না তেমন, আস্তেই দেয়। সে আবার দয়ালু কি না! ব্যাথা তো তার জামাইটাই পাবে। অরুণ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে না। স্বাভাবিকভাবেই ন্যায় ব্যাপারটা। পাতা তার দিকে ছোট ছোট চোখে চায়। অরুণ মুচকি হেসে তার মুখে আবার খাবার দিয়ে বলে,

-” পাতাবাহার তোমার ওইটুকুনি দাঁত আমার কিছুই করতে পারবে না!”

ভোর বাবার কথা বুঝতে না পেরে বলে,

-” আব্বু কি হয়েছে?”

পাতার গলায় খাবার আটকে যায়। অরুণ প্লেট রেখে পানির গ্লাস এগিয়ে দেয়। পাতা পানি পান করে। অরুণ তার মাথায় আলতো চর দিয়ে বুলিয়ে দিতে থাকল। পাতা স্বাভাবিক হয়।

-” ঠিক আছি আমি!”

অরুণ আবার প্লেট হাতে নিলে পাতা মুখ কুঁচকে বলে,

-” আমি আর খাবো না। পেট ভরে গেছে আমার!”

অরুণ চোখ রাঙিয়ে মুখের সামনে খাবার ধরে।পাতা মুখে না নিয়ে আঙ্গুল উঁচিয়ে বলে,

-” একদম চোখ রাঙাবেন না! একটু কিছু হলেই চোখ গরম করে তাকাবে। আর খাবো না আমি।”

অরুণ শান্ত দৃষ্টিতে পাতার দিকে তাকায়। পাতা মুখ ঘুরিয়ে নেয়। চোখে অল্প নোনা জলের আভাস! অরুণ আর জোর করে না। ছেলের মুখে খাবার দেয়। ভোর মুখে পুরে বলে,

-‘ আব্বু আমিও আর খাবো না। আমার পেটও ভরে গেছে। সত্যিই বলছি!”

-” ঠিকাছে।”

বলে অরুণ সোফায় বসে বাকি খাবার শেষ করে। পাতা বসে থাকে না। তার মাথা ভোঁ ভোঁ করে ঘুরছে। বমি বমি ফিল হচ্ছে। পাতা কম্ফোর্টের ভিতরে ঢুকে শুয়ে পড়ে। ভোর পাতার গালে চুমু দিয়ে বাবার ফোনটা নিয়ে সোফায় বসে গেম খেলতে থাকে। বেলকনি থেকে পাতাবাহার দৌড়ে এসে অরুণের পায়ের কাছে বসে মিয়াও মিয়াও করতে থাকে। এতক্ষণ সে বেলকনিতেই ছিল! ছোট ছোট পাখিকে ধরবে বলে ঘাপটি মেরে বসেছিল। কিন্তু বজ্জাত পাখি গুলো ধরাই দিল না। কাছে যাওয়ার আগেই ফুরুৎ!
অরুণ অল্প রুটি ডিম বিড়াল ছানার সামনে দেয়। সে কৃতজ্ঞতা সরূপ মিয়াও বলে চাটতে লাগলো। অরুণ খাওয়া শেষ করে হাত ধুয়ে নেয়। তার ব্যাক্তিগত ওষুধের বাক্স পেইন কিলার ও জ্বরের ওষুধ বের করে। এক গ্লাস দুধ ভোরকে খাইয়ে দিল। অপর গ্লাস দুধ, ওষুধ সমেত নিয়ে বিছানায় বসে। নরম সুরে পাতাকে ডেকে বলে,

-” দুধটুকু দিয়ে ওষুধ খেয়ে নাও। জ্বর ব্যাথা দুটোই কমে যাবে!”

পাতা বেরোয় না কম্ফোর্টের ভিতর থেকে। জিদ ধরে শুয়ে থাকে। ইচ্ছে করে ব্যাথা দিয়ে এখন দরদ দেখাচ্ছে। অরুণ এক হাতে কম্ফোর্ট সরিয়ে দিয়ে ধমকের সুরে বলে,

-” ভালোভাবে বললে কথা কানে ঢোকে না, না?”

পাতার চোখ ভরে ওঠে। ধমকাচ্ছে তাকে! সে চুপচাপ উঠে বসে হাত পাতে ওষুধের জন্য। অরুণ হাতে দেয় না হা করতে বলে! পাতা ফোঁস ফোঁস করে তাকিয়ে হা করে। অরুণ ওষুধ দিয়ে দুধের গ্লাস মুখে দেয়।

-” সব টুকু শেষ করবে!”

পাতা শেষ করে মুখ মুছে পুনরায় বিছানায় শুয়ে পড়লো। অরুণ দীর্ঘশ্বাস ফেলে ট্রে নিয়ে বেরিয়ে যায় রুম থেকে। পাতা উঁকি দিয়ে দেখে সবটা। খানিকটা হেসে ভোরের দিকে তাকিয়ে বলল,

-” তোমার বাবা কি আজ অফিসে যাবেন?”

ভোর মোবাইল থেকে মুখ তুলে মুচকি হেসে জবাব দিল,

-” বলল তো যাবে!”

আর কিছু বলে না পাতা। মন টা আবার খারাপ হয়ে যায়। লোকটা অফিসে যাবে। বাড়িতে একা একা ভালো‌ লাগবে না তার! ভোর তো খেলা ধুলা নিয়েই ব্যস্ত থাকবে। এই ট্যাটু ওয়ালা গাল নিয়ে ঘর থেকেই তো বের হতে পারবে না। শাশুড়ি সহ বাকি সবাই কি ভাববে?
তার ভাবনার মাঝেই অরুণের আগমন ঘটে। আলমারি থেকে স্যুট বের করে নিয়ে ওয়াশ রুম যায়! শুয়ে থাকতে ভালো না লাগায় পাতা বিছানা থেকে নেমে বারান্দায় যায়। অরুণ ওয়াশরুম থেকে এসেই বিছানায় তাকায়। পাতাকে না দেখে কপালে ভাঁজ পড়ে। ভোরের দিকে তাকাতেই ভোর ইশারায় বেলকনি দেখিয়ে বলে,

-” আম্মু ওখানে!”

ওহ্ বলে অরুণ ড্রেসিন টেবিলের সামনে যায়। চুল পরিপাটি করে পারফিউম লাগায়। টাই বাঁধার পর সাদা শার্টের উপর কালো কটি পড়ে নেয়। গলা উঁচিয়ে ডাকে,

-” পাতাবাহার?”

পাতা এগিয়ে আসে। প্রশ্নাত্মক চাহনিতে তাকায় অরুণের দিকে। অরুণ ভোরকে বলে,

-” আব্বু ফোনটা দাও?”

ভোর ফোন দিয়ে বলল,

-” আব্বু আম্মু অসুস্থ তুমি আজ অফিস থেকে ছুটি নাও না?”

অরুণ ফোন পকেটে পুরে ছেলেকে কোলে তুলে নেয়। গালে মুখে চুমু দিয়ে বলে,

-” ইম্পর্ট্যান্ট কাজ আছে আব্বু! জলদি আসার চেষ্টা করবো! তুমি নিজের খেয়াল রাখবে সাথে তোমার আম্মুরও!”

ভোর মাথা নেড়ে সায় জানালো। বাবার কপালে গালে চুমু দিয়ে আবদার করে,

-” আসার সময় আমার জন্য নতুন ব্যাট বল নিয়ে আসবে কিন্তু?”

-” ওকে কলিজা। পাতাবাহার সাবধানে থাকবে। ঘরে বসেই রেস্ট নাও! ফোন কাছেই রেখো আমি ফোন করবো! হুম?”

অরুণের কথায় বাধ্য মেয়ের মতো মাথা নাড়ল পাতা। অরুণ ছেলেকে নামিয়ে দিয়ে হাত ঘড়ি বাঁধতে বাঁধতে ব্যস্ততার সুরে বলল,

-” কলিজা? স্টাডি রুমে আমার ল্যাপটপ আছে একটু এনে দিবে প্লিজ?”

-” এখুনি আনছি!”

মুচকি হেসে বলে ভোর দৌড়ে বেড়িয়ে আসে ঘর থেকে। স্টাডি রুমের দরজা ধরাম করে খুলে ল্যাপটপ খোঁজে, কিন্তু পায় না। পুরো ঘরের আনাচ কানাচে খুঁজে হয়রান সে। তার স্কুল ব্যাগ অবধি বাদ রাখে না। কিন্তু ল্যাপটপ কোথাও নেই। ভোর চিন্তিত ভঙ্গিতে বেড়িয়ে আসে। রুমে ঢুকে বলে,

-” আব্বু পেলাম না ল্যাপটপ!”

অরুণ পাতাকে ছেঁড়ে সোজা হয়ে দাঁড়ায়। ঘুরে ছেলের দিকে ফিরে হেসে বলে,

-” স্যরি আব্বু! ল্যাপটপ এখানেই আছে। ওই ব্যাগে খেয়াল ছিল না!”

ভোর গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে আসে। অরুণ ছেলেকে কোলে তুলে বিছানায় দাঁড় করিয়ে কপালে চুমু দিয়ে বলে,

-” সাবধানে থাকবে। তোমার আম্মুর সাথে সাথেই থাকবে। কোন প্রবলেম হলে কল করবে আমায়!”

ভোর বাধ্য ছেলের মতো মাথা নাড়ে। অরুণ হেসে ছেলের ঠোঁটে চুমু খায়। ব্যাগটা কাঁধে চাপিয়ে ব্লেজার হাতে নিয়ে পাতার গালে হাত রেখে কপালে ও গালে ছোট চুমু দেয়।

-” আসছি পাতাবাহার!”

বলে দাঁড়ালো না। হনহনিয়ে চলে যায়। পাতা আটকে রাখা শ্বাস ছাড়লো। শরীরটা কেমন দুলছে। বুকটা কেঁপে উঠছে ক্ষণে ক্ষণে। এ কেমন মরণ যন্ত্রণা! সে ভোরের দিকে একপল তাকিয়ে বিছানায় ধপাস করে শুয়ে পড়ে। আপাদমস্তক কম্ফোর্টে ঢেকে নিয়ে বালিশে মুখ লুকায়। ভোর উদ্বিগ্ন হয়ে জিজ্ঞেস করে,

-” আম্মু কি হয়েছে?”

-” ইটেরর ভাটায় কয়লা দিয়া আগুন
জ্বালাইছে(২)
দেওয়ানা বানাইছে
কি জাদু করিয়া বন্দে মায়া লাগাইছে!”

সুর দিয়ে বলে পাতা। ভোরের কপালে চিন্তার রেখা। আম্মু গান গাইছে কেন? সে গলা উঁচিয়ে আব্বু বলে ডাক দেয়। পাতা উঠে বসে চোখ বড় বড় করে ভোরের দিকে তাকিয়ে বলে,

-” কিছু হয় নি আমার! আই এম ফাইন!”

-” সত্যিই?”

পাতা দাঁত বের করে হেসে ভোরকে টেনে শুইয়ে দেয়। নিজেও শুইয়ে পড়ে পাশে। মুচকি মুচকি হেসে ভোরকে বলে,

-” ভোর তোমার আব্বু এতো ভালো কেন?”

-” কি জানি!”

ঠোঁট উল্টিয়ে বলে ভোর! পাতা হাসে। তার খুব হাসি পাচ্ছে। এতোগুলো ভালো লাগছে। মন প্রসুণে পায়রা ডাকছে বাকবাকুম! মনে হচ্ছে সে মেঘের মতো করে আকাশে ভাসছে।
_______

সরকার জুয়েলারি ফ্যাশন হাউসে প্রবেশ করে রাসেল, শুভ, জীবন, দীপ্ত, ফয়সাল। অফিসের প্রায় সকলেই চেনে তাদের। বসের বন্ধু হওয়ার সুবাদে প্রায়ই আসে তারা। এসেই হইহুল্লোড় বাজিয়ে ফেলে‌। যেন সব কটা তরুণ ছেলেপেলে। মারামারি, দৌড়াদৌড়ি, কাড়াকাড়ি সব চলে। তাদের বসও বন্ধু পেলে মাতিয়ে আড্ডা দেয়। গম্ভীর মুখে থাকা অরুণ সরকারকে হাসতে দেখা যায়। বন্ধু এমনি একটা জিনিস যারা সিরিয়াস মুহূর্তেও সিরিয়াস থাকতে দিবে না। ইমোশনাল কথাবার্তাকে গুলি মেরে ফানি আলাপে কনভার্ট করবে। শত ফ্রাস্ট্রেশনের মাঝে থেকেও বন্ধুদের সাথে প্রাণখোলা হাসি আটকানো দায় হয়ে পড়ে। দুঃখের কথা বললে স্বান্তনা না দিয়ে পঁচাবে; কখনো সিরিয়াসলি নিবে না।হেসেই উড়িয়ে দিবে। অথচ বিপদে পড়লে তারাই আগে ঝাঁপিয়ে পড়বে। বুকে জড়িয়ে সাহস দিবে না বরং পিঠ চাপড়ে বলবে এতেই কুপোকাত? আমরা আছি না? বসের বন্ধুদের আসতে দেখে সুজন এগিয়ে আসে। হাসিমুখে বলে,

-” ভালো আছেন সবাই?”

রাসেল গম্ভীর মুখে পকেটে হাত ঢুকিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বলে,

-” সালাম কালাম দিতে জানো না?”

সুজন ঝটপট সালাম দিয়ে জিজ্ঞেস করে ভালো আছে কিনা! শুভ মুচকি হেসে বলল,

-” আর ভালো থাকা! ষাঁড়টা কোথায়?”

সুজনের বুঝতে অসুবিধা হয় না যে ষাঁড় বলতে এরা কাকে বুঝিয়েছে! বসের বন্ধুরা বসকে ষাঁড় বলেই ডাকে মাঝে মাঝে।

-” স্যার একটু গ্রাউন্ড ফ্লোরে আছে। আমি ডেকে দিচ্ছি। আপনারা কেবিনে গিয়ে বসুন!”

সবাই অরুণের কেবিনের উদ্দেশ্যে পা বাড়ায়। জীবন হঠাৎ থেমে সুজনের উদ্দেশ্যে বলে,

-” ওয়েটার থুরি ম্যানেজার! ছয় প্লেট ফ্রাইড রাইস, ব্রিফ কাবাব! সাথে চাটনি যেকোনো একটা হলেই হবে! ফাস্ট ফাস্ট হ্যাঁ?”

সুজন মাথা নাড়ায়। জীবন হেসে হাঁটা দেয়। শুভ ধমকের সুরে বলে,

-” শালা তোরা ভালো হলি না। এটা রেস্টুরেন্ট লাগে? তোর বাপের?”

-” দেখ বাপ তুলে কথা বলবি না অশুভ! লাঞ্চের টাইম। পেটে ইঁদুর লুঙ্গি ডান্স করছে। না খেয়ে যাবো না।”

সবাই হেসে উঠল জীবনর কথায়। শুভ জীবনের পিঠে চাপড় মেরে বলল,

-” শালা খাই খাই কম্পানি!”

জীবন টিপ্পনী শুনেও দাঁত কেলায়!

অরুণ কেবিনে প্রবেশ করে বেশ সময় পড়ে। ঢুকেই অবাক এটা তার কেবিন নাকি কোনো খাবার হোটেল! খাবারের গন্ধে পুরো রুম জুড়ে মো মো করছে। তার অতি ভদ্র লোক বন্ধুরা খাচ্ছে অতি আনন্দে। যেন কত দিনের অভুক্ত। সে যে এসে দাঁড়িয়েছে সেটা খেয়ালই করে নি। সে দরজা বন্ধ খরে গলা খাঁকারি দিলো। সবাই অরুণের দিকে তাকিয়ে হাসে। রাসেল খাবার গলাধঃকরণ করে বলে,

-” শালা কখন থেকে বসে আছি তোর খবর নেই! এপয়েন্টমেন্ট নিয়ে আসতে হবে নাকি!”

অরুণ দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফয়সালকে ঠেলে তার পাশে বসে বলে,

-” নিলে ভালো হয়। তা কি মনে করে উদয় হলি?”

দীপ্ত অরুণের দিকে একটা প্লেট বাড়িয়ে দিয়ে ইশারায় খেতে বলে। অরুণ প্লেট নেয়। চামচ থাকায় হাত ধুতে হয় না। মুখে পুরে খাবার। শুভ বলে,

-” তুই তো খোঁজ খবর নিবি না তাই ভাবলাম আমরাই একটু দেখা করে আসি! বেঁচে আছিস নাকি টপকে গেছিস!”

ফয়সাল মুখে খাবার তুলে অরুণের দিকে আড়চোখে চেয়ে বলে,

-” কি যে বলিস না শুভ! আমাদের অরু এক সুন্দরী রমণী বিয়ে করে এতো জলদি টপকে যাবে? এখন তো তার মধুমাস চলে! নতুন বউ নিয়ে মজে আছে তাই বন্ধুদের ভুলে গেছে!”

রাসেল টিপ্পনী কেটে ফিসফিস করে বলে,

-” তা কেমন চলছে মধুমাস? মধু সংগ্রহ টংগ্রহ করেছিস? এক্সপেরিয়েন্স বল শালা!”

দীপ্তও রাসেলের মতো করে ফিসফিসিয়ে বলে,

-” সংগ্রহ করা বাদ রাখবে? অরুণ সরকার? আমি জীবনেও বিশ্বাস করি না! শালা তো মনে হয় রাতভর মধু..”

আর বলতে পারে না। অরুণ তার মুখে চাটনি পুরে দেয়। কটমট করে বলে,

-” শালারা এসব কি শুরু করেছিস? মুখে লাগাম টান! বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে কিন্তু!”

-” আচ্ছা টানলাম এখন বল কেমন চলছে মধুমাস মানে বিবাহিত পরবর্তী জীবন?”

ফয়সালের কথায় অরুণ ছোট জবাব দিল,

-” আলহামদুলিল্লাহ ভালো! এখন টপিক চেঞ্জ কর!”

শুভ শান্ত চোখে অরুনের দিকে তাকিয়ে বলে,

-” পাতাকে কেমন পর্যবেক্ষণ করলি? ভোরের যত্ন নেয় ? আগলে রাখে?”

এবার অরুণের ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটে উঠলো।

-” যথেষ্ট পরিমাণে!”

শুভও হাসে। জীবন টিপ্পনী কেটে বলে,

-” দেখছিস অরু ব্লাস করছে! এই ভালোটালো বেসে ফেলিস নি তো আবার?”

-” সুন্দর কিউট আদরের বউ আমার! ভালোবাসবো না?”

‘ওহ হোওও’ ধ্বনিতে সবাই চিল্লিয়ে ওঠে সমস্বরে। অরুণ কানে হাত দেয়। ফয়সাল কানে থেকে হাত সরিয়ে দিয়ে কিছু বলে ফিসফিসিয়ে। অরুণ খাওয়া বাদ রেখে তার পিঠে গোটাকয়েক আদর বসিয়ে দেয়। ফয়সাল পিঠ বাঁকিয়ে বলে,

-” বদ দোয়া দিলাম! তোর আদরের বউ তোরে নাকানিচোবানি খাওয়াবে!”

অরুণ হাসে তবে কিছু বলে না। বন্ধুদের মাঝে খুনসুটি বাড়তে থাকে যত সময় অতিবাহিত হয়। অরুণ সরকারের কেবিন যেন আজ কর্মস্থল থেকে আড্ডাস্থলে রূপান্তরিত হয়েছে। সময়ের পর সময় গড়িয়ে যায় তাদের আড্ডা শেষ হয় না। চলতেই থাকে। বন্ধুরা সবাই মেতে ওঠে পুরনো স্মৃতি চারণে। হয়ে ওঠে সেই কিশোর বয়সের অরুণ, শুভ, দীপ্ত, ফয়সাল,রাসেল, জীবন। আবার সদ্য আঠারোয় পা দেয় তো কখনো ত্রিশের তাগড়া পুরুষ। আড্ডার এক পর্যায়ে রাসেল বলে,

-” অরুণ আমাদের ব্যাচের সবাই একটা পার্টি অর্গানাইজড করেছে!তোকেও ইমেইল পাঠানো হয়েছে চেক করেছিস কি?”

-” না ইয়ার। ব্যস্ত ছিলাম খুব। রি ইউনিয়ন? তাহলে তো ভালোই হয়!”

অরুণের কথায় জীবন হেসে বলে,

-” সেটা তো দু বছর আগে হলোই! কাপল পার্টি হবে! যে যার স্পাউস নিয়ে যাবে। কোনো বাচ্চা কাচ্চা না। যাস্ট হি এন্ড সি! তুই তো আর সিঙ্গেল নস সুন্দরী কিউট আদরের বউ আছে!”

অরুণ হেসে তার মাথায় টোকা দিয়ে বলে,

-” উম বাচ্চা এলাও না! তাহলে যাওয়া হবে না। তোরা সবাই যাবি?”

শুভ বিরক্ত হয়ে বলে,

-” অরু তোর নাটক বাদ দে! সারাজীবনের জন্য যাচ্ছিস না। মাত্র এক বেলা। ভোর বাড়িতেই থাকতে পারবে। আমরা সবাই যাবো তুই ও যাচ্ছিস!”

অরুণ হামি তুলে বলে,

-” সে দেখা যাবে! কবে হবে পার্টি?”

-” পরশু সন্ধ্যা থেকে। ইমেইল চেক করিস সব ডিটেইলস পেয়ে যাবি!”

-” ওকে! তোরা কি এখানেই থাকবি? আমার আজ জলদি ফিরতে হবে! মেয়েটা অসুস্থ!”

জীবন কপালে ভাঁজ ফেলে সুধায়,

-” তোর আবার মেয়ে কবে হলো?”

ফয়সাল হেসে চোখ টিপে বলল,

-” আরে এই মেয়ে সেই মেয়ে না। এতো ওর আদরের বউ!”

-” ফাজিলের দল!”

বলে অরুণ সরকার উঠে আসে। এদের সাথে থাকলে সময় কখন চলে যাবে বোঝাই যায় না। সে সুজনের কাছে সব কিছু বুঝিয়ে দিয়ে বন্ধুদের সমেত অফিস থেকে বেড়িয়ে আসে। গন্তব্যস্থল পাতাবাহার ও কলিজা! যাওয়ার আগে ছেলের জন্য ব্যাটবল কিনে নেয় শপিং মল থেকে। বেড়িয়ে আসার সময় শাড়ির দোকানের দিকে নজর পড়লো। একটা সুন্দর সিম্পলের মধ্যে গর্জিয়াস কালো শাড়ি। ভালোই লাগছে। আর কিছু না ভেবে প্যাক করে নেয়।
____

সারাবেলা শুয়ে বসেই কেটেছে পাতার। ঘর থেকে বেরই হয় নি। ভোর, আনিকা ও রূপের সাথে ঘরে ও বেলকনিতে সময় পার করেছে। কখনো বাচ্চাদের সাথে লুডু খেলেছে তো কখনো কার্টুন দেখেছে; বন্দুক নিয়ে চোর পুলিশ খেলেছে। সবমিলিয়ে সুন্দর একটা সময় কেটেছে তার। এমনিতেই তার মনটা আজ অনেক অনেক ভালো,ফুরফুরে, সতেজ। তার মন কাননে অসংখ্য ফুল ফুটেছে। অসংখ্য রঙ বেরঙের প্রজাপতি তাদের ডানা মেলে উড়ে বেড়াচ্ছে। তার সাদাকালো আকাশে এখন রামধনুর খোঁজ পাওয়া যায়। মনটা অকারণেই নেচে গেয়ে বেড়াচ্ছে। অধরকোন থেকে হাসি যেন সরছেই না। এমনকি সে এখনো হাসছে। তাও একা একা। সে এখন একটা সিক্রেট রুমে বসে আছে। যার খোঁজ ভোর আজকে তাকে দিয়েছে। সে প্রায় মাস হবে এ বাড়িতে থাকছে। তাঁদেরই ঘর থেকে আরেকটা সিক্রেট রুমে যাওয়া যায় সে জানতোই না। এ ঘরের বেলকনির দেয়ালে একটা দরজা আছে। যেটা সে কখনো খেয়ালই করে নি। সেই দরজা খুললেই এই সিক্রেট ঘর। অবশ্য স্টাডি রুম থেকেও আসা যায় এখানে। সে আজ প্রথম বার প্রবেশ করে ভোরের সাথে। ঘরটা তার বেশ পছন্দ হয়েছে। ছোট একটা রুম। রুমের ফ্লোরে শুধু ম্যাট্রেস বিছানো বিছানা আর বেশ কিছু টব। একপাশের দেয়াল পুরোই গ্লাস লাগানো। সেখানে পর্দা ঝুলছে। যদিও পর্দা পাতা একপাশে সরিয়ে রেখেছে। বাবু হয়ে বসে প্রকৃতি বিলাস করছে। বাইরের সবুজ গাছ গাছালির মেলা এখান থেকেই দৃশ্যমান। পাতা হা করে সেগুলো দেখতে ব্যস্ত। এরইমধ্যে এ ঘরের দরজা খুলে কেউ প্রবেশ করে ভিতরে। পাতা ভাবে ভোর হয়তোবা। হুজুর পড়ানো শেষ করে দিয়েছে বোধহয়। কিন্তু দরজার দিকে তাকিয়ে সে অবাক হয় বেশ। এ কখন এলো?

অরুণ সরকার ভিতরে প্রবেশ করে। পাতার পাশ ঘেঁষে পা ছড়িয়ে বসে। সে এসেছে কিছু সময় হলো। এসে পাতাকে পায় না। স্টাডি রুমে উঁকি দিয়ে দেখে ছেলে পড়ছে তাই ডিস্টার্ব না করে ঘরে আসে। ফ্রেশ হয়ে চেঞ্জ করে। পাতাকে খুঁজে না পেয়ে হঠাৎ এই রুমের খেয়াল আসে। বেলকনির দরজা খুলতেই দেখতে পায় মহারানী এখানে বসে।

-” আজ এতো জলদি এলেন?”

-” একমাত্র ছোট বউটি জ্বরে ভুগছে! তার চিন্তায় অফিসে মনোযোগ বসছিল না তাই চলে এলাম!”

অরুণের কথায় পাতা খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো। অরুণের বাহুতে মাথা ঠেকিয়ে হাসতে হাসতেই বলে,

-” হয়েছে পাম দিতে হবে না। এমনিতেই গাল মুখ ফুলে আছে। এখন ফেটে না যায়!”

অরুণ মুচকি হাসলো। হাত বাড়িয়ে পাতার কপালে রেখে তাপ পরখ করে। না স্বাভাবিকই আছে। মুখের ফুলোভাবটাও কমে গেছে। বরফ ঘষাঘষিতে গালের কালসিটে দাগেরও ক্ষীণ পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। অরুণ স্বস্তির শ্বাস ফেলে বলে,

-” জ্বর কি এসেছিল আবার? দুপুরে ওষুধ খেয়েছিলে?”

-” আর আসে নি জ্বর! ওই ওষুধেই জ্বর ব্যাথা ভ্যানিশ।”

-” কোন ওষুধে?”

ভ্রু নাড়িয়ে বলল অরুণ। স্পষ্টতই ফাজলামির সুর! অস্বস্তি ভর করে। কপোলজোড়া লালিমায় ছেয়ে যায়। কান গরম হয়ে আসে। চোখের তারায় ভেসে ওঠে সকালের সেই মিষ্টি মুহূর্ত। বুকটার ধুকপুক বেড়ে যায়। অরুণের বাহু থেকে মাথা সরিয়ে সোজা হয়ে বসে। এদিকে ওদিকে তাকিয়ে নজর লুকিয়ে প্রসঙ্গ পাল্টে বলে,

-” ভোরের পড়া শেষ হয় নি এখনো?”

অরুণ হাসে শব্দ করে। পাতা বিরক্তের সহিত চায়। লোকটাকে উচ্চস্বরে হাসলে একটুও ভালো লাগে না। খুবই বাজে লাগে। ভিলেন ভিলেন ফিল আসে। কিন্তু মুচকি হাসলে সুন্দর লাগে বেশ। নাইস এন্ড অ্যাট্রাকটিভ!

-” ষাঁড়ের মতো হাসছেন কেন? আশ্চর্য!”

অরুণ হাসি থামিয়ে ছোট ছোট করে তাকালো। মুখের আদল চেঞ্জ করে গম্ভীর গলায় বলে,

-” তোমার সাহস তো কম না? ভেবেচিন্তে কথা বলবে পাতাবাহার। আমি তোমার বড় মজা করেও বেয়াদবি কথাবার্তা বলবে না।আর ষাঁড়কে কখনো হাসতে দেখেছো?”

পাতার হাসিখুশি মুখ খানি চুপসে যায়।‌ লোকটা একেবারে নিরস! হাসি মজা বোঝে না। পাতা ছোট্ট করে ‘স্যরি’ বলে। অরুণ হাত বাড়িয়ে তার গালে হাত বুলিয়ে বলে,

-” ব্যাথা করছে এখনো?”

পাতার চুপসে যাওয়া মুখ স্বাভাবিক হয়। মাথা নেড়ে না বোঝায়। একটা কুশন এনে অরুণের কোলে রাখে। তারপর সেখানে মাথা রেখে শুয়ে পড়ে সাথে অরুণের একটা হাত টেনে মাথায় রাখে যার অর্থ হাত বুলিয়ে দিন! অরুণ মুচকি হাসে। চুলের রেবন খুলে দিয়ে চুলের মাঝে হাত গলিয়ে দেয়। পরপর ঝুঁকে ললাটে চুম্বন বসায়। পাতার কোনো প্রকার অস্বস্তি হয় না। বরং ভালোলাগে বেশ সাথে একটু লজ্জাও পায়।

-” কেমন কাটলো সারাদিন?”

পাতা চোখ উঠিয়ে অরুণের চোখে চোখ রাখে। সম্মোহনী চোখের মায়ায় যেন সম্মোহিত হয়ে পড়ে। মিষ্টি হেসে জবাব দেয়,

-” আলহামদুলিল্লাহ অনেক ভালো কেটেছে। আপনার?”
অরুণ মুচকি হেসে বলে,

-” ভালো!”

-” আপনার অফিসের ঝামেলা মিটেছে?”

-” হুম!”

-” কি নিয়ে প্রবলেম হয়েছিল?”

-” সেটা তোমাকে জানতে হবে না। জেনে কি করবে?”

-” বলবেন না সরাসরি বললেই হয়!”

অরুণ শান্ত চোখে চায়। কিছু বলে না। পাতাও চুপ করে থাকে। তবে তার চোখের আকার বড় হয় নিমিষেই। লজ্জা ভিড় করে সর্বাঙ্গে। গুটিয়ে যায়। সরানোর চেষ্টা করে তার উদরে অবস্থিত বলিষ্ঠ হাত। অরুণ সরায় না।

-“আমি নিরপরাধ! তোমার কিউট টাম্মি আবার উঁকি ঝুঁকি দিচ্ছিল আমায়!”

পাতার মুখ থেকে ভয়ংকর গালি বের হতে চায়। কিন্তু আটকে নেয়। হাত সরানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। উঠতেও পারছে না; লোকটা চুলের ভাঁজে হাত গলিয়ে আটকে রেখেছে। সে মিনমিনে গলায় বলে,

-” প্লিজ ছাড়ুন না?”

অরুণ ঝুঁকে আসে। পাতার নাকে নাক ঘঁষে ফিসফিসিয়ে বলে,

-” ইটস ট্যু মাচ সফট!! ছাড়তেই ইচ্ছে করছে না!”

পাতা চোখ বুজে নেয়। কি অশ্লীল কথাবার্তা!! অসভ্য লোক! মুখের কোনো ব্রেক নেই। পাতা অরুণের হাতের লোম ধরে টান দেয়। ব্যাথা লাগে বেশ! অরুণ হাত সরিয়ে নেয় মুহূর্তেই! পাতা ছাড়া পেতেই লাফ দিয়ে ওঠে। দৌড়ে দরজার দিকে যেতে বলে,

-” নাক উঁচু ম্যানারলেস অসভ্য লোক কোথাকার!”

অরুণের কানে যায়। সে হেসে বলে,

-” এক মাঘে শীত যায় না কিন্তু!”

পাতা রুমে চলে আসে অরুণের গুষ্টি তুষ্টি করতে করতে। এসে দেখে ছোট ভোর টুপি মাথায় কিছু বলতে বলতে আসছে। তাকে দেখে মিষ্টি হেসে বলে,

-” •রাব্বির হামহুমা কামা রাব্বায়ানি সাগিরা• আম্মু আমি নতুন দোয়া শিখেছি! এর অর্থ হলো
°হে আমার প্রতিপালক, তাদের উভয়ের (বাবা-মা) প্রতি রহম করুন! যেমনটি তারা আমাকে শৈশব কালে লালন পালন করেছেন°”

বলেই মিষ্টি করে হাসলো। পাতা তাকে কোলে তুলে বিছানায় বসিয়ে গালে চুমু খায়।

-” বাবাটা দেখছি অনেক বড় হয়ে গেছে। বাবা মায়ের জন্য দোয়া করা শিখেছে!”

-” থ্যাংক ইয়ু আম্মু!”

পাতা তার গাল টিপে দেয়। এরমধ্যে অরুণ বেড়িয়ে আসে। বাবাকে দেখে ভোর লাফিয়ে উঠলো। খুশিতে আত্মহারা হয়ে বলে,

-” আব্বু তুমি কখন এসেছো? আমাকে ডাকো নি কেন?”

অরুণ এগিয়ে এসে ছেলেকে কোলে তুলে নিয়ে আদরে আদরে ভরিয়ে দেয়। নরম গলায় সুধায়,

-” আমার কলিজা কি দোয়া শিখেছে বলো দেখি আব্বু?”

ভোর টকটকে ঠোঁট দুটো নেড়ে পুরো দোয়া অর্থ সহকারে বলে। অরুণ ছেলের প্রশংসায় মাশাআল্লাহ আওড়াতে থাকে। ছেলের গালে মুখে চুমুতে ভরিয়ে দেয়। ভোর আদর পেয়ে হেসে কুটিকুটি। আদর খেতে তার খুব ভালো লাগে।

চলবে…..

#পাতা_বাহার
লেখনীতে: #বেলা_শেখ
#পর্ব- ৩৯

(কপি করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ)

-” জলদি আসো পাতাবাহার। উই আর গেটিং লেট!”

-” আম্মু? ফাস্ট ফাস্ট!

-” আসছি তো!”

পাতা ব্যাগ হাতে জলদি পা চালায়। বাড়ির মেইন ফটক থেকে গ্যারেজের সামনে দাঁড়ানো বাইকের সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই অরুণ সরকার বসার জন্য তাড়া দেয়‌। পাতা পিছনে বসে অরুণের কাঁধে হাত রাখলো। ভোর বাবার সানগ্লাস চোখে দিয়ে সামনে বসেছে। অরুণ হেলমেটের ফিতা বেঁধে বাইক স্টার্ট দিয়ে বলে,

-” শক্ত করে ধরে বসবে!”

-” সেটা বলতে হবে না। আপনি শুধু তুফানের বেগে বাইক চালাবেন না!”

বাইক চলতে শুরু করে। পাতার কথার প্রেক্ষিতে অরুণ বলে,

-” স্বাভাবিক গতিতেই চালাবো!”

-” আপনাদের মানে ছেলেদের স্বাভাবিক গতি রকেটের গতির থেকে কম না। মনে হয় গাঁজা সেবন করে বাইক চালায়।”

-” হোয়াট ড্যু ইয়ু মিন?”

-” মানে এটাই কিছু কিছু লোক রাস্তায় এমন ভাবে বাইক চালায় মনে হয় রাস্তাটা তাদের বাপের! আর কিছু ইয়াং বাচ্চা ছেলে এমন তিড়িং বিড়িং করে বাইক চালায়; বলা চলে জান হাতে নিয়ে। ভয়ডড় কিছুই নেই। একবার আমার স্কুটির সাথে লাগিয়ে ছিল। অল্পের জন্য বেঁচে গেছি!”

ভোর বলে,

-” আম্মু ব্যাথা পেয়েছিল?”

-” তা একটু আকটু। হাত পা ছিলে গিয়েছিল।”

অরুণ গম্ভীর গলায় বলে,

-” ওই বয়সে সবারই একটু আকটু রক্ত গরম থাকে। বয়সের একটা ফ্যাক্ট আছে! আমরাও ছিলাম! আমরা সব বন্ধুরা মিলে বাইক রেসিং করতাম। কতবার মরতে মরতে বেঁচেছি তবুও রেস করতাম! একটা আলাদা সাহসিকতা কাজ করতো।”

পাতা হেসে বলে,

-” আপনিও তাহলে একি গোয়ালের গরু!”

অরুণ হাসে না। পূর্বের ন্যায় গম্ভীর সুরে বলল,

-” ল্যাঙ্গুয়েজ!”

এখানে ভাষা সংযত করার কি আছে। সে তো কথার কথা বলল। এই লোকটার এতেও এলার্জি। এরকম আজব কিসিমের জীব সে আগে দেখেনি। নিজে ম্যানারসের এম জানে না; অথচ গলাবাজি! পাতা চুপ বনে যায়। একটা কথাও বলে না।ভোর টুকটাক জিজ্ঞেস করলে উত্তর দেয়। অরুণ সরকারও চুপচাপ বাইক চালানোতে মনোযোগী হয়। শা শা করে অন্য গাড়ির সাথে‌ পাল্লা দিয়ে বাইক ছুটে চলেছে বিরতিহীন। ভোর কখনো উল্লাসে চিল্লিয়ে উঠছে। অরুণ ধমকে ধমকে তাকে চুপ করিয়ে দিচ্ছে। পাতা হতাশ, চরম হতাশ। এই লোক ধমকা ধমকি ছাড়া কথাই বলতে পারে না। বিরতিহীন বাইক হঠাৎ থেমে যায় সিগন্যালের দরূণ। রেড লাইড জ্বলছে সিগন্যালে। অরুণ বিরক্ত হয় বেশ। সকাল হলেও বেশ কড়া রোদ উঠেছে; সাথে গরম ও হর্ণের বিরক্তিকর আওয়াজ বোনাস। টানা রোদের ভিতর বাইক দাঁড়িয়ে আছে। ভোরকে সে বুকের সাথে লেপ্টে নিয়ে রোদ থেকে আড়াল করে। পাতা মুচকি হাসলো। এই লোক যেমন কথায় কথায় ধমকায় আবার খুব বেশি যত্নও করে; আগলে রাখে। হয়তোবা তার ভালোবাসা কেয়ারের আরেকটা মাধ্যম ধমক! পাতা হেসে ফেললো। অরুণ লুকিং গ্লাসে পাতার দিকে তাকায়। মেয়েটা পাগলের মতো বিনা কারণে হাসছে কেন? পাতা হাসি থামিয়ে নেয়। সামনে তাকাতেই দেখতে পায় একটা ছেলে হাত নাড়িয়ে হাই বলছে। পাতার ভ্রু কুঁচকে যায়। সামনের রিকশার পরে একা বাইকে দুটো ছেলে আছে। পেছনে বসা ছেলেটা দাঁত বের করে হেসে উঁচু স্বরে বলল,

-” আপু? আপনার হাসিটা সুন্দর ছিল! ন্যাচরাল!”

আশেপাশের সবাই তাকায় পাতার দিকে পাতা খানিকটা অস্বস্তিতে পড়ে। ছেলেটা হাসছে। মেয়েদের একটা অদ্ভুত ব্যাপার আছে তাঁরা ছেলের কথা, হাসি, আচার ভঙ্গ দেখে বুঝতে পারে ছেলেটা ভালো নাকি খারাপ দিকে ইঙ্গিত করছে। পাতার কাছে ছেলেটাকে খারাপ মনে হলো না ; দেখতে ভদ্রই। কমবয়সী ছেলে সবে কলেজ শেষ করে অনার্সে ভর্তি হয়েছে বোধকরি। দাঁড়ি গোঁফ মাত্র উঁকি দিচ্ছে। পাতা মুচকি হেসে ধীমে সুরে ‘থ্যাক ইয়ু’ বলে। যদিও ছেলেটা শুনতে পায় না তবে ঠোঁট নাড়ানো দেখে বুঝতে পারলো ধন্যবাদ দিচ্ছে। ওদিকে হেলমেটের ভিতরে কারো চোয়াল দ্বয় শক্ত হয়ে গেছে। অরুণ হেলমেটের গ্লাস উপরে তুলে ছেলেটাকে চোখে শাসায়। পাতার ‘থ্যাংক ইয়ু’ বলা ওই ছেলেটা না শুনতে পেলেও কাছ ঘেঁষে বসা অরুণের কানে পৌঁছে গেছে। পাতার উদ্দেশ্যে হিসহিসিয়ে বলে,

-” খুব হাসি পাচ্ছে পাতাবাহার? ভরা রাস্তায় দাঁত গুলো হারাতে চাও?”

পাতা গালে জিভ ঠেকায়। সে ভুলেই বসেছিল ক্ষ্যাপা ষাঁড় সম্মুখে। সে কিছু বলবে এর পূর্বে বাইকের সেই ছেলেটি আবার বলে,

-” আপু ওইটা কি আমাদের দুলাভাই নাকি?”

অরুণের দিকে হাত বাড়িয়ে ইশারা করে বলে। পাতা ছোট করে মাথা নেড়ে সায় জানাতেই ছেলেটি হেসে বলল,

-” দুলাভাই? জিতেছেন আপনি! আপু কিন্তু খুব মিষ্টি ও কিউট। একদম আমার ছোট বোনের মতো! বকবেন না তাকে?”

পাতার হাসি পায়। ঠোঁট চেপে হাসতে থাকে। বাইকের মিররে চোখ পড়তেই হাসি থেমে যায়।লোকটা রেগে আছে। অরুণ চোখ রাঙিয়ে চেয়ে আছে। ওদিকে ছেলেটাও থেমে নেই ভোরকে ইশারা করে বলে,

-” ওটা বুঝি ভাগ্নে আমার? হাই! নাম কি তোমার?”

-” ভোর সরকার!”

মিষ্টি হেসে বলে ভোর।আশেপাশের অনেকেই হাসছে মিটিমিটি। অরুণ হেলমেট খুলে ছেলেটাকে জোড়ে ধমক লাগিয়ে বলে,

-” এক থাপ্পড়ে কানে তালা ঝুলিয়ে দিব বেয়াদব ছেলে! রাস্তায় যাকে তাকে দেখেই আপু ডেকে কথা বলার পাঁয়তারা খোঁজো? এই আপু ডেকেছিস না? তোর বাড়ির অর্ধেক সম্পত্তি লিখে দিবি! আর তোর বাবার ফোন নম্বরটা দে? কথা বলি শশুর মশাইয়ের সাথে!”

ছেলেটার মুখ দেখার মতো হয়েছিল। আশেপাশের লোকগুলো মজা নিতে ব্যাস্ত। সাথে দু একজন ফোন বের করে ভিডিও করতে ব্যস্ত। অরুণ সরকার তাদেরকেও ঝাড়ি দিতে ভোলে নি। পাতার মুখখানি ফাটা বেলুনের মতো চুপসে আছে। এরপরের ঝাড়ি যে তার উপরেই বর্তাবে। তাছাড়া তার সদ্য ভূমিষ্ট হওয়া ভাইটার জন্যও দুঃখ হচ্ছে। এই লোকটা হাসি মজাও বোঝে না।
অরুণের মুখশ্রী লাল হয়ে আছে।রোদের তাপের গরমে নাকি রাগে কি জানি! অরুণ সবাইকে ঝেড়ে হেলমেট পড়ে নেয়। সে পাবলিক প্লেসে মোটেই তামাশা করতে চায় নি। তবে মেজাজটাও ধরে রাখতে পারে নি। অরুণ বাইক স্টার্ট করে চিপার মধ্যে দিয়েই খানিকটা এগিয়ে যায়। তবে ভুল স্বরুপে একটা গাড়ির পেছনে ধাক্কা লাগে। অরুণ ছেলেকে শক্ত করে ধরে। পাতা অরুণের পিঠে ধাক্কা খায়। অরুণ ক্ষীপ্ত মেজাজকে ঠান্ডা করে ‘স্যরি’ বলে ড্রাইভারকে।‌ ড্রাইভার অবশ্য কিছু বলে না। তবে পেছনের জানালার গ্লাস নেমে যায়। বের হয়ে আসে অরুণের চেনা পরিচিত এক মুখ। লোকটা হেসে চোখের সানগ্লাস খুলে বলে,

-” অরুণ সরকার যে? কেমন আছিস? লং টাইম হ্যাঁ?”

সদ্য ঠান্ডা হওয়া মেজাজটা আবার বিশ্রী ভাবে বিগড়ে গেলো। অরুণ কিছু বলে না। পাতা অরুণের পিছন থেকে উঁকি দিয়ে লোকটাকে দেখে। ভোর পিটপিট করে চায় লোকটার দিকে। সে চেনে উনাকে। ওই মেয়র নানুর ছেলে। লোকটা হেসে ভোরকে দেখে বলে,

-” আরে ব্যাটা তুই তো দেখছি তোর বাপের কার্বন কপি! সাথে নসিব টাও মিলে গেছে। তোর মা ডিভোর্স নিয়ে অন্যত্র বাসা বেঁধেছে। আর তোর বাপের মা অবশ্য..”

-” সাদমান ভাই! বেশি কথা বলবে না।”

লোকটাকে থামিয়ে দিয়ে অরুণ গম্ভীর সুরে বলে। ভোরের মুখটা মলিন হয়ে গেছে। চোখটাও ভরে উঠলো। পাতা অবাক! এই লোক আবার কে? সাদমান চোধুরী হাসে উচ্চ স্বরে।

-” অরু দেখ তোর ছেলে তোর মতোই ন্যাকা কান্না করছে।”

অরুণ ছেলের গালে হাত রাখল। সাদমানের উদ্দেশ্যে বলে,

-” তুমি ভালো হলে না। সিগন্যাল ছেড়ে দিয়েছে। গাড়ি টানো?”

সাদমান ড্রাইভারকে ইশারায় না করে। জানালা থেকে মাথা সম্পুর্ন বের করে অরুণের ঘারের দিকটা দিয়ে উঁকি দেয়া পাতার দিকে তাকিয়ে বলে,

-” বাবা বলল বিয়ে করেছিস? ওইটা তোর বউ বুঝি? আগেরটা থেকে ট্যু মাচ বেটার! তবে ছোট ছোট লাগছে। সেটা ব্যাপার না। এন্ড ইয়ু? অরুণের বড় ভাই, তোমার ভাসুর লাগি।”

অরুণ পাশের রাস্তা ক্লিয়ার হওয়ায় সেখান দিয়ে বাইক নিয়ে বেড়িয়ে যায়। ওদিকে সাদমান গাড়িতে বসে হাসতে লাগলো।

থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে। ভোর ও অরুণের দুজনের মুখশ্রী থমথমে। ভোরের নাকটা লাল হয়ে আছে। চোখের পাপড়ি ভেজা। বাইকের হ্যান্ডেলে রাখা অরুণের হাতের রগ ফুলে উঠেছে। পুরনো কিছু বাজে স্মৃতি মাথার ভিতর কিল বিল করে। কপালের জেগে ওঠা নীল শিরা হেলমেটের কারণে অলক্ষ্যে। পরনের শার্টটা ঘামে ভিজে লেপ্টে আছে বলিষ্ঠ শরীরের সাথে। পাতা চুপচাপ আছে। কি বলবে বুঝতে পারছে না। লোকটা কে ছিল? বড় ভাই! কেমন বড় ভাই! পাতার মনে অসংখ্য প্রশ্ন ঘুরপাক খায়। কিন্তু জিজ্ঞেস করার সাহস পায় না। এতদিনে এতটুকু চিনেছে অরুণ সরকার কে যে এখন প্রশ্ন করা মানে সেধে ঝাড়ি খাওয়া। তবুও দ্বিধায় ভুগে আমতা আমতা করে বলে,

-” কে ছিল লোকটা? আপনার পরিচিত?”

-” উইল ইউ প্লিজ সাট ইউর মাউথ পাতাবাহার!”

পাতার জবান বন্ধ হয়ে যায়। লোকটা এভাবে ধমক দিয়ে বলল যেন এখানে সব দোষ তারই।

-” নো! আপনি বলুন উনি কে? একদমই ধমক দিবেন না। উত্তর দিন?”

-” থাপ্পড় খাওয়ার শখ জেগেছে! ধাক্কা দিয়ে বাইক থেকে ফেলে দিব বেয়াদব!”

ধমকে পাতা ভয় পায় বেশ। তবে ভয় পেলে চলবে না। এভাবে ভয় পেয়ে দমে গেলে লোকটা আরো মাথায় চড়ে বসবে। সেও দ্বিগুণ তেজের সাথে বলে,

-” হ্যাঁ জেগেছে শখ। দিন ধাক্কা! অন্যের রাগ আমার উপর দেখাচ্ছেন কেন? যেখানের রাগ সেখানে দেখাতে পারেননি! তখন কোথায় ছিল রাগ?”

অরুণ পাশের ফুটপাতে বাইক থামায়। বাইক থেকে নেমে পাতাকেও টেনে নামিয়ে দিল।

-” কি হচ্ছে টাকি ভোরের বাবা?”

অরুণ জবাব দেয় না। তার মেজাজ মোটেও ঠিক নেই। সে বাইকে চড়ে বাইক স্টার্ট দিয়ে চলে গেল শা শা করে‌। ভোর ঢোক গিলে জড়িয়ে আসা গলায় বলল,

-” আব্বু! আম্মু?..”

আর বলতে পারে না। ডুকরে কেঁদে ওঠে। অরুণ একহাতে ছেলেকে ঘুরিয়ে বুকে টেনে নেয়। গম্ভীর গলায় বলে,

-” আব্বু কাঁদে না। আম্মু এসে যাবে!”

ভোর কান্না থামায় না। বাবাকে জড়িয়ে ধরে নাক টেনে বলে,

-” ওই নানুর ছেলে একটুও ভালো না। মা’কে নিয়ে পঁচা কথা কেন বলল? আমি মেয়র নানুর কাছে বলে দেবো!”

অরুণের চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। সে বাইকের গতি কমিয়ে দেয়। সামনে দৃষ্টি রেখে ছেলের কপালে চুমু দিয়ে বলে,

-” কিছু অভিযোগ কারো কাছেই করতে নেই! কিছু কিছু কথা, দুঃখ, সুখ নিজের ভিতরেই গচ্ছিত রাখতে হয় মানিক সোনা!”

পাতা আহম্মকের মতো দাঁড়িয়ে আছে। লোকটা সত্যিই সত্যিই চলে গেল? আশেপাশের অনেকে তার দিকে তাকিয়ে আছে উৎসুক হয়ে। এভাবে একটা মেয়েকে বাইক থেকে টেনে নামিয়ে দিয়ে চলে গেল? তাদের সকলের মনেই কৌতূহল কাজ করছে। একটা দোকানি পাতার কাছে এসে জিজ্ঞেস করলো,

-” কি হয়েছে খালা? কুনো সমস্যা? কেডা ছিল?”

পাতা স্বয়ংবৎ ফিরে। নিজেকে স্বাভাবিক রেখে দীর্ঘ শ্বাস ফেলে জবাব দেয়,

-” মামা সমস্যা অনেক বড়। ওই লোকটা আপনার খালু। কথা হলো তার মাথা সবসময় গরম থাকে। কিছু বললেই ছ্যাত করে ওঠে। সে ধমক দিলো আমায় ।পাল্টা আমিও একটু মেজাজ দেখিয়েছি। ব্যস রেখে চলে গেলো! কোথাও একটু শান্তি নেই!”

বলে পাতা ব্যাগ কাঁধে ফেলে পা চালায়। আশেপাশের লোক গুলোর কৌতূহল মিটে যায়।এটাতো প্রত্যকেটা বিবাহিত কপোতীদের সমস্যা থুরি মান অভিমান। মিষ্টি খুনসুটি। তার সবাই নিজ কার্যালয়ে ব্যস্ততা হয়ে পড়ে। পাতা একটু হেঁটে রিকশা ডেকে নেয়। আর বেশি দূরে না এই পাঁচ মিনিটের রাস্তা তাই স্কুল। সে রিকশা ওয়ালাকে জলদি চালাতে বলে। গন্তব্যে পৌঁছানোর পর পাতা রিকশা থেকে নেমে একটা স্প্রাইট কিনে নেয়। গরমে মাথা একটু ঠান্ডা করা দরকার। নাক উঁচু ম্যানারলেস রাগি লোকটাকে আজ হাতের সামনে পাক! পিটিয়ে তক্তা বানিয়ে দেবে। শালার জামাই এভাবে রাস্তায় কেউ টেনে ফেলে দেয়। এটাতো রীতিমতো বউ নির্যাতন। নেহাতই সে তার জামাইটাকে একটু আকটু ভালোবাসে। চোখে হারায়! তাই থানায় কেস টেস করলো না। আর গতকাল সকালে লোকটা এক অভাবনীয় কাজ করে পাতাকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিল। জখম গালে আদুরে চুমু খেয়ে অধরে অধর ছুঁয়েছে আলতো ভাবে। এক বার না বেশ কয়েকবার। পাতা বোধহয় তখন বোধগম্য হারিয়ে রোবট বনে গিয়েছিল। ভাবতেই অধরকোনে লজ্জালু হাসির আবির্ভাব ঘটে। কপোলজোড় লালিমায় ছেয়ে যায়।

পাতা গেইট দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করে। টিচার্স আইডি কার্ড দেখে দাড়োয়ান লম্বা সালাম জানায়। পাতা খানিক হেসে মাঠ বরাবর হাঁটতে থাকে। টিচার্সরুম একেবারে স্কুলের মাথায়। বড় মাঠ পেরিয়ে যেতে হয়‌। পাতা একটু হাঁটার পর দেখতে পায় অরুণ সরকার হনহন করে হেঁটে আসছে। ঘেমে নেয়ে একাকার। মুখটা টমেটোর ন্যায় লাল হয়ে আছে। পাতার বেশ মায়া হয়। সমস্ত রাগ উবে যায় ওই মায়াময় আদুরে গম্ভীর মুখটা দেখে। ইশ লোকটার কি হাল হয়েছে গরমে। সাথে তো তার মেজাজটাও গরম আছে। হবে না? ওই সাদিক না সাদমান কি যেন নাম! যে কথাগুলো বলল মা, প্রাক্তন স্ত্রী/প্রেমিকা কে নিয়ে। একজন শান্ত মানুষেরই মেজাজ ঠিক থাকবে না! সেখানে এ তো অরুণ সরকার! পাতাকে দেখেও অরুণ প্রতিক্রিয়া দেখায় না। অপরিচিত লোকের মতো হেঁটে যেতে থাকে বড় বড় পা ফেলে। পাতা দৌড়ে তার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। অরুণ থেমে যায়। পাতা কাঁধে ঝুলানো ওড়না হাতের মুঠোয় পুরে উঁচু হয়ে অরুণের কপাল সহ মুখের ঘাম মুছে দেয় যত্ন করে। কপালে ভাঁজ ফেলে গম্ভীর মুখে বলে,

-” শুনুন ভোরের বাবা? ওত রাগ স্বাস্থ্যের জন্য হানিকারক। রাস্তায় কত কুকুরই তো ঘেউ ঘেউ করে! সেসব কানে নিলে চলে? যাস্ট ইগনোর ম্যান!”

অরুণ এখনো থমথমে মুখে। কপালে গাঁঢ় ভাঁজ ফেলে পাতার দিকে তাকিয়ে আছে। পাতা স্প্রাইটের বোতলটা অরুণের দিকে বাড়িয়ে বলে,

-” ধরুণ? এটা খেয়ে মাথা শরীর দুটোই ঠান্ডা করুণ! রাগ দেখালেই তো সব ঠিক হয়ে যাবে না! লোকের কথা বাদ দিয়ে নিজের কথা ভাবুন। আপনার কলিজার কথা ভাবুন! তারপরও ভাবনা বাদ পড়লে আমার কথাও ভাবতে পারেন! আমি মাইন্ড করবো না। আসছি!”

পাতা মুচকি হেসে অরুণের হাতে বোতল ধরিয়ে দিয়ে চলে যায়। অরুণ ছোট ছোট করে চেয়ে তার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে। হাতে থাকা স্প্রাইটের বোতলটা দেখে অজান্তেই অধর কোনে হাসির ডালপালা ছড়িয়ে পড়ে। নিমিষেই মন খারাপি দূর হয়ে যায়। গরমটাও কমে গেল যেন!

পাতা খানিকটা ফুরফুরে মেজাজে টিচার্স রুমে প্রবেশ করে। ক্লাস শুরুর দেড়ি আছে বেশ। গরমের জন্য আর সপ্তাহে একদিন পি টি হয় শুধু বুধবার। পাতা নিজের টেবিলে ব্যাগ রেখে চেয়ারে আরাম করে বসে। এসি যুক্ত রুম একটু স্বস্তি মিলছে। এই লোকটার সাথে জুড়ে যাওয়ার পর থেকে কেমন যেন বড়লোকি স্বভাব হচ্ছে তোর পাতু!!
তার আরামকে ব্যারামে পরিণত করতে আগমন ঘটে তার আরেক কলিগ রুপালি হোসাইন। পাতার থেকে বছর চারেক বড় হবে। বিবাহিত! একটা বাচ্চাও আছে। সে পাতার পাশে এসে থুতনি ধরে মুচকি হেসে বলে,

-” পাতা তোমার বুড়ো জামাই দেখছি বেশ রোমান্টিক হু? কামড়ে গালে দাগ বসিয়ে দিয়েছে।”

পাতার মেজাজ খারাপ হয়। আশ্চর্য সঙ্গ দোষে সত্যিই লোহা ভাসে। তাই তো লোকটার সাথে থাকতে থাকতে তারও মেজাজ বিগড়ে যাবার রোগ হয়ে গেছে। পাতা কিছু বলবে এর আগে আরো একটা কলিগ এসে বলে,

-” শুনেছি বুড়োরা রোমান্টিক হয় আজ দেখলামও। তোমার ভাগ্য ভালো পাতা!”

রুপালি হেসে বলে,

-” তোমার জামাই তোমাকে খুব আদরে রাখে দেখছি! রাখবে না? আমাদের পাতা এতো কিউট। বুড়ো কালে এরকম সুন্দর কচি বউ পেয়েছে বলে কথা!

পাতা দাঁতে দাঁত চাপে। এখন এসব সয়ে গেছে। এসব শুনে আর চোখ ছলছল করে না।বরং জিভ লকলক করে কড়া কথা শুনিয়ে দেয়ার জন্য। এই দুদিন ভদ্রতা ও সিনিয়রের খাতিরে চুপ থাকলেও আজ চুপ থাকে না। ক্লোজআপ হেসে বলল,

-” আমার হাসব্যান্ড মোটেও বুড়ো নয় আপু! এখানে আসে, দেখো না? কোন দিক দিয়ে বুড়ো লাগে? সে যথেষ্ট হ্যান্ডসাম। আর হ্যাঁ সত্যিই আমাকে ভালোবাসে। আদর করে, বলা চলে মাথায় তুলে রাখে। আমি যা বলবো তাই! এর বাইরে একটা কথাও বলবে না। এতো কেয়ার করে!! মাঝে মাঝে হাঁপিয়ে যাই। রান্না করে খাওয়াবে এ বেলা ও বেলা! ধমক দেয়া তো দূর! পাতু পাতু বলে পিছু পিছু ঘুরে। যখন যেটা চাইবো তার ডাবল এনে দিবে। এতো এতো শপিং করিয়ে দিয়েছে তারপরও রোজ শাড়ি, গয়না কসমেটিকস ব্লা ব্লা আনবে! গয়নার কথা নাই বলি! আমার বাইকে চড়তে ভালো লাগে তাই বাইক কিনেছে। গাড়ি ছেড়ে আজ বাইক নিয়ে পৌঁছে দিয়ে গেছে।”

বলেই লজ্জার ভান করে। সাথে মনে মনে শ খানিক তওবা কাটে। এগুলো যদি ওই লোকটা শুনতে পেত পাতার গর্দান কাটা পড়তো। অন্যদিকে পাতার কলিগদের মুখ খানা দেখার মতো হয়েছে। হবে না? ওমেন!! দেখবে, শুনবে সাথে আফসোস করবে। পাতা তাদের আফসোস বাড়িয়ে দিতে নিজের গলায় অরুণের দেয়া পেনডেন্ট দেখিয়ে বলে,

-” এটা উনি বিয়ের আগে দিয়েছিল! ডায়মন্ডের! আরো দিয়েছে। মাঝে মাঝেই দেয়। গোল্ড প্লাটিনাম কত কিছু!!

রুপালির চোখে অবাকতা। তার স্বামীও যথেষ্ট বিত্তশালী। তাদের লাভ ম্যারেজ কই তাকে তো এতো কিছু গিফট করে না। শপিং মলের কথা শুনলেই না না করে কেটে পড়ে। পাতা এবার মজা পাচ্ছে। সে আরেকটু মশলা মাখিয়ে বলে,

-” আপু কি হলো? আপনাদের স্বামী ভালো বাসে না ? যত্ন আত্তি করে না, নাকি? তাহলে আই হ্যাভ আ সল্যুশন। ওই বেডারে ছেড়ে দিয়ে একটা বড়লোক বুড়ো জুটিয়ে নিন। দেখবেন মাথায় তুলে রাখবে। ”

বলে হেসে উঠলো উচ্চ স্বরে। হাসি থামিয়ে বললো,

-” মজা করছি আপু কিছু মনে করবেন না কিন্তু হ্যাঁ? যাস্ট ফান।
____

চুপচাপ গম্ভীর মুখে বসে আছে ভোর সরকার। ক্লাসের একেবারে শেষ ব্রেঞ্চে। পাশে টুটুল নামক তার এক সহপাঠী বসে আছে। অরুণ এখানেই বসিয়ে দিয়ে গেছে। তারা যখন ক্লাসে ঢুকে ভোরের চোখ সর্বপ্রথম কোনের ফাস্ট ব্রেঞ্চে পড়ে। যেখানে রোজ সে আর রোহান বসতো। ওই ব্রেঞ্চে রোহান তো বসে আছে কিন্তু ভোরের জায়গায় তাসকিন বসে আছে। ভোরের মুখটা আবার মলিন হয়ে যায়। মনে পড়ে যায় রোহানের মায়ের কথা। রোহান কি সত্যিই তার সাথে আর মিশবে না? এখন তো ওর মা নেই চুপি চুপি কি ভোরের সাথে কথা বললে ক্ষতি হবে? অরুণ ভোরের মলিন মুখ দেখে বলে,

-” জায়গা নেই অন্যত্র বসো?”

অন্য সময় হলে ভোর জেদ করতো যে সে রোহানের‌ পাশেই বসবে। তা নাহলে ক্লাসই করবে না। কিন্তু এবার ভোর সায় জানালো। অরুণ ছেলের গোমড়া মুখ দেখে তাসকিন নামক বাচ্চাটার মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,

-” আংকেল তুমি একটু এই পাশে বসবে? ও রোহানকে ছাড়া..”

ভোর টেনে নিয়ে আসে বাবাকে। সে বসবে না রোহানের কাছে। কখনোই না। দরকার নেই তার রোহানের।

-” আব্বু আমি টুটুলের কাছে বসবো। তুমি যাও? যাও?”

অরুণ বুঝতে পারলো কিছু একটা হয়েছে দুজনের মধ্যে। সে ছেলেকে কোলে নিয়ে রোহানের কাছে গিয়ে বলে,

-” রোহান দুজনের ঝগড়া হয়েছে?”

রোহান মাথা নিচু করে না বলে।

-” তাহলে কি হয়েছে আঙ্কেল? বলো আমাকে ভোর দুষ্টুমি করেছে আবার? মেরেছে তোমায়?”

অরুণ নরম গলায় বলে রোহানকে। রোহান ভোরের দিকে আড়চোখে চেয়ে চুপ করে থাকে। আশেপাশের সব বাচ্চারাই গোল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ভোরের এবার অভিমান হয় বাবার উপর। সে রাগে দুঃখে বলে,

-” মারিনি আমি! না দুষ্টুমি করেছি! ও সেকেন্ড হয়েছে তাই ওর মা বকেছে! আমার সাথে মিশতে মানা করে দিয়েছে!”

অরুণ শান্ত চোখে ছেলের দিকে তাকালো। ছেলেটার চোখে পানি টলমল করছে। রোহান মাথা নিচু করে বসে আছে। তার চোখেও পানি টলমল করছে। অরুণ রোহানের মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,

-” ইটস ওকে আঙ্কেল! তুমি তোমার মতো থেকো!”

বলে লাস্ট ব্রেঞ্চে টুটুলের পাশে বসিয়ে সেও পাশে বসে। কিছু বলে না। সে জানে এখন কিছু বললেই কেঁদে দেবে ছেলেটা। সে ভোরের ব্যাগ থেকে রুমাল টিস্যু বের করে নাম মুখ মুছে দিল। ছেলের গালে মুখে আদর করে। পাশের টুটুলের মাথায় হাত বুলিয়ে ভোরের ব্যাগ থেকে একটা ডেইরি মিল্ক সিল্ক চকলেট তার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল,

-” এটা তোমার! আমার ছেলেটাকে একটু দেখিও কেমন?”

টুটুল চকলেট নিবে না। অরুণ তার হাতে দিয়ে গাল টিপে দিল। টুটুল মুচকি হেসে মাথা চুলকায়। অরুণ ছেলের থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেল।

-” এই ভোর কোথায় হারিয়ে গেলি? টিচার এসেছে! দাঁড়া না?”

ভোর মাথা তুলে দাঁড়ায়। টুটুল হেসে বলে,

-” তুই ঘুমাচ্ছিলি ভোর? রাতে ঘুমাস নি?”

ভোরও মুচকি হাসে।

-” ঘুমাচ্ছিলাম না।”

ক্লাস শুরু হয়। ভোর চুপচাপ ক্লাসে মনোযোগী হয়। পরের এক্সামে সেও ভালো করবে। তখন রোহানের আম্মু খুশি হয়ে বলবে ‘রোহান তুই আজ থেকে ভোরের সাথে মিশবি।’ তখন সে আব্বুর মতো করে বলবে ‘ভোরের কোনো বন্ধুর দরকার নেই। দরকার থাকলেও রোহানের দরকার নেই হুম!’
পরপর তিনটা ক্লাস শেষ হয়ে লাস্ট ক্লাসে পাতার আগমন ঘটে। ভোর খুশিতে পারেনা চিল্লিয়ে ওঠে‌। সে মুচকি মুচকি হাসে পাতার দিকে তাকিয়ে। পাতা ক্লাসে প্রবেশ করেই ভোরকে খোঁজে। রোজ তো সামনেই বসে রোহানের পাশে। আজ নেই কেন? পিছনের দিকে নজর যেতেই ভোরকে দেখতে পায়। তার দিকে তাকিয়েই মিষ্টি মিষ্টি হাসছে। পাতা ক্লাস শুরু করে।
টুটুল ভোরের পাশ ঘেঁষে বসে বলে,

-” ভোর মিস তোর আম্মু হয়?”

-” হুম!”

-” মিস তো অনেক ভালো! আমাকেও অনেক আদর করে। আমাকে কেন সবাইকেই!”

ভোরের ভালো লাগে না তার কথা। আগে মিস ছিল তাই আদর করেছে। এখন ভোরের আম্মু! তাই শুধু ভোরকে আদর করবে! পাতা বাচ্চাদের পড়িয়ে সবার হোম ওয়ার্ক চেক করে সাথে নতুন করে হোম ওয়ার্ক দিয়ে দেয়। এরমধ্যেই টিফিনের ঘন্টা বাজে। সাথে প্লে, নার্সারি, ওয়ান ও ট্যুয়ের বাচ্চাদের ছুটি। সবাই সমস্বরে চিল্লিয়ে উঠে ঘন্টার আওয়াজ শুনে। ভোর চটজলদি ব্যাগ পত্র গুছিয়ে পাতার কাছে গিয়ে তার হাত ধরে। পাতা মুচকি হেসে ভোরকে নিয়ে হাঁটা দেয়। এই ছেলেটা এতো আদুরে!
পাতা ভোরকে নিয়ে টিচার্স রুমে যায়। সব টিচার ভোরের দিকে তাকিয়ে টুকটাক মজা করে। ভোর লজ্জা পায়। পাতার ওড়নায় মুখ লুকিয়ে থাকে। একে একে সব টিচার লাঞ্চ বক্স নিয়ে ক্যান্টিনের উদ্দেশ্যে চলে গেলে ভোর তবেই স্বস্তির শ্বাস ছাড়ে। পাতা ভোরকে টেবিলের উপর বসিয়ে দিয়ে ওয়াশরুমে যায়। একটু পর ফিরে এসে ব্যাগ থেকে লাঞ্চ বক্স বের করে। তিন বাটির বক্স; একটাতে মিনি সাইজের দুটো বার্গার। যেটা অরুণ সরকার নিজ হাতে বানিয়ে দিয়েছে। অপরটাতে পোলাও ও মুরগির মাংস। পাতা প্লেটে খাবার বেড়ে নেয়। ভোরকে পানি খাইয়ে দিয়ে মুখে খাবার দেয়। ভোর মুখে পুরে চিবোতে চিবোতে বলে,
-” আম্মু টুটুল আমার নতুন ফ্রেন্ড। ও না অনেক মজার মজার কথা বলে। ও খুব ভালো!”
-” তাই?”
-” হুম! আম্মু তুমিও খাও না?”
পাতা নিজেও খাওয়া শুরু করে। ভোর তার নতুন বন্ধুর গল্প জুড়ে দিলো। একটার পর একটা। পাতা রোহানের কথা বলে না। ভোরের বাবা ম্যাসেজের মাধ্যমে জানিয়েছে তাকে। সে অবাক হয়েছিল! ফাস্ট সেকেন্ড তো যাস্ট একটা নাম্বার। একজন ফাস্ট, সেকেন্ড হয়েছে এর মানে এই না যে তারা মেধাবী আর যারা আসে নি তাঁরা কম মেধাবী। সবাই মেধাবী। ফ্যাক্ট হলো কেউ কম চর্চা করে তো কেউ বেশি। কেউ সারাবছর ক্লাসে ভালো ভাবে পড়া না দিতে পারলেও এক্সামে ভালো নাম্বার পায়। আবার অনেকে সারাবছর ভালো পড়া দিতে পারলেও এক্সামে ভালো নাম্বার তুলতে পারে না। এখানে ভাগ্য কাজ করে অনেকাংশেই। পাতা ভোরকে বলে,

-” আমার ক্লাস শেষ হতে সেই দুটো আড়াইটা বাজবে! তুমি বাড়ি চলে যাও তোমার ড্রাইভার আঙ্কেলের সাথে?”

ভোর তৎক্ষণাৎ মানা করে বলে,

-” আমি তোমার সাথেই যাবো আম্মু!”

পাতা বুঝিয়ে মানানোর চেষ্টা করে। জিদ্দি ভোর তার কথায় অটল। সে আম্মুকে ছাড়া যাবে না মানে যাবে না। পাতা হার মানে তার জেদের কাছে। পরবর্তী ক্লাস ভোরকে বগলদাবা করেই শেষ করে।
____

অফিসে ব্যস্ত সময় পার করছে অরুণ সরকার। এমনিতেই কাল জলদি অফিস যাওয়ার জন্য কিছু কাজ পেন্ডিং পরে আছে। সেগুলো শেষ করতে না করতেই নতুন এক ক্লায়েন্টের আগমন ঘটে। সাথে ফটোশুট ছিলো মডেলের। তার উপর আজ অফিসে রুবির আগমন ঘটেছে। হুট করেই। সে জানতোই না রুবি আজ অফিসে আসবে আর জয়েন করবে। জানলে অয়েল কামের একটা ব্যবস্থা করা যেতো। তবুও দু তিনটা ফুলের বুকেয় দিয়েছে। রুবিকে মিসেস রুনার আন্ডারে দিয়েছে। মাঝে মাঝে সে গিয়ে খোঁজ খবর নিয়েছে। অরুণ পিয়নকে ডেকে এক কাপ কড়া লিকারের চা বানাতে বলে নিজ কেবিনে রিল্যাক্সড হয়ে বসে। নাও অরুণ নিডস আ টাইনি রেস্ট। হঠাৎ ফোনটাতে নোটিফিকেশন আসে। অরুণ চেক করে। শুভ ম্যাসেজ পাঠিয়েছে, কালকের পার্টির ভেন্যু। অরুণ চিন্তায় পড়ে যাবে কি যাবে না। হঠাৎ আরেকটা মেসেজে অরুণের চোখ পড়ে ‌। মেসেজ ওপেন করতেই তার অধরকোনে হাসি ফুটে ওঠে। পাঁচটা দুই মিনিটে ম্যাসেজ এসেছে। সে খেয়ালই করে নি।

~সম্মানীয় নাক উঁচু ম্যানারলেস লোক,
আসসালামুয়ালাইকুম! শুনুন প্রিয় লিখলাম না বলে আবার ধমকাবেন না কিন্তু। আমি ভেবেচিন্তেই লিখেছি। প্রিয় লিখলে আপনি আবার ধমক দিতেন যে ‘বেয়াদব মেয়ে কত বড় আমি তোমার। সম্মান দিয়ে কথা বলবে তা না প্রিয় লিখে ছ্যাবলামি করছো?’
মূল কথায় আসি! আপনার রাগ পড়েছে কি? নাকি মাথাটা এখনো গরম? যদি মাথা এখনো গরম থাকে জলদি বাড়ি ফিরুণ! আর যদি ঠান্ডা থাকে তাহলে আরো জলদি বাড়ি ফিরুণ। ভোরের এখনই ইমার্জেন্সি বাবা চাই! জলদি আসবেন কিন্তু নইলে দারাজ থেকে নতুন বাবা অর্ডার করে দিবো!
ইতি
ভোরের আম্মু!

অরুণ পুরোটুকু পড়ে ফোন পকেটে পুরে নেয়। ঘড়িতে রাত সাতটা বেজে বিশ মিনিট। এখন বাড়ি ফেরা জরুরি। ছেলের বাবা চাই ইমার্জেন্সি। ছেলের আম্মু হুমকি দিয়েছে। সে সুজনকে ডেকে রুবির কাছে যায়। রুবি অরুণকে দেখে মুচকি হাসলো। অরুণ তাকে বলল,

-” বাড়ি ফিরবে না? লেডিসদের সাতটা বাজেই অফিস ছুটি ঘোষণা করা আছে।”

-” হ্যাঁ যাবো ভাইয়া! আপনি কখন ফিরবেন একসাথেই ফিরি?”

-” হুম! মিসেস রুণা? অফিস বাস এখনো ছাড়ে নি। আপনার অপেক্ষায়! টেনশনের কিছু নেই। আর হ্যাঁ ধন্যবাদ!”

-” থ্যাংকস বস!”

বলে মিসেস রুণা কেবিন ছাড়ে। অরুণ হাঁটা দেয়। রুবি তাদের পিছু পিছু। সুজন নিজ কেবিনে যায়। তার এখনো ছুটি হয় নি। সব কাজ খতম করেই তাঁর নীড়ে ফেরার পালা।
___

-“কেমন লাগলো অফিস? কোনো প্রবলেম হয়েছিল?”

অরুণের কথায় রুবি মুচকি হেসে বললো,

-” কোনো প্রবলেম হয় নি ভাইয়া। অনেক ভালোও লেগেছে।”

-” প্রবলেম হলে বলবে বিনা দ্বিধায়। আর রূপকেও সাথে আনতে পারো!”

-” মায়ের কাছেই থাকে এখন। কাঁদে না। আর তাছাড়াও অফিসে ওকে টানা ঝামেলা লাগে!”

অরুণ হেসে গাড়ির জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকে। পাশে ড্রাইভিং সিটে রঞ্জু ড্রাইভ করছে। রুবি একা পেছনে বসে ফোন টিপছে। অরুণ পাতাকে কল করবে ভেবে পকেট থেকে ফোনটা বের করে। কিন্তু ফোন বের করে না। গ্যালারিতে ঢুকে পাতা ও ভোরের ছবি দেখতে থাকে। এই কয়েকদিনে তার গ্যালারির এক ফোল্ডার ছেলের আম্মু ও ছেলের ছবিতে ভরে গেছে। নানা ভঙ্গিতে ওঠা দুজনের কাপল ছবি। অরুণের অধর কোণে আবার হাসির বিস্তার ঘটে। তার মন প্রসূণে আগে একটা ছোট্ট চড়ুই পাখির কিচিরমিচির শোনা যেত। এখন সেই ছোট্ট চড়ুইয়ের আরেকটা সঙ্গী এসেছে। এখন জোড়া চড়ুইয়ের কলতানে মুখরিত তার প্রসুণ। সেথায় আর দুঃখ, মলিনতার আভাস খুব একটা পাওয়া যায় না ইদানিং। সে দোয়া করে তার চড়ুই জোড়া যেন সর্বদাই প্রাণোচ্ছ্বল হাসিখুশিতে থাকে।
______

গোধূলির বিদেয় শেষে তিমিরের হাতছানি। সকালে কালো মেঘের ছিটেফোঁটা না থাকলেও বিকেল থেকেই ধীরে ধীরে কালো মেঘের আবির্ভাব ঘটে। সন্ধ্যা হওয়ার সাথে সাথেই বাতাস বইছে এলোমেলো। মৃদু বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে সাথে দীগন্তের বুক চিড়ে ভয়ানক গর্জন। সন্ধ্যা অবদি পাতা, ভোর, আনিকা, মিনু, আভারি আর ছোট্ট রূপ বাড়ির ছাদে বসে ছিলো।আনিকা, ভোর খেলছিল। রূপ হাম্পুরা দিয়ে এদিকে ওদিকে যাচ্ছিলো আনন্দের সহিত। বিদ্যুৎ চমকানোর শব্দে তারা নেমে আসে। বর্তমানে ভোর গালে হাত দিয়ে বাবু হয়ে বসে আছে সোফায়। দৃষ্টি তার মেইন দরজায় নিবদ্ধ। আনিকা পাশে বসে হোমওয়ার্ক করতে ব্যস্ত। ভোরের হোমওয়ার্ক পড়াশোনা শেষ। সে শুধু বাবার অধীর অপেক্ষায়। পাতা তার পাশে বসে আরিয়ানের সাথে তর্ক করতে ব্যস্ত। তর্কের বিষয় মিনিট অন্তর চেঞ্জ হয় কিন্তু তাদের তর্ক ফুরায় না। পাতাবাহার নামক বিড়াল ছানা ভোরের কোলে বসে ভোরের মতই অরুণের অপেক্ষায় আছে। আসমা বেগম রুপকে ঘুম পাড়ানোর চেষ্টা করছেন। মিনু আভারি রান্না শেষ করে, টেবিলে খাবার পরিবেশন করে নিজ ঘরে বসে রেস্ট করছে ‌। এমন সময় কলিংবেল বেজে উঠলো। ভোর খুশিতে লাফ দিয়ে উঠলো। বিড়াল শাবকটি বেশ ভয় পায় এতে। সে পাতার পা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে মিও মিও করে। ভোরের সেদিকে খেয়াল নেই‌ সে দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলে। বাবাকে দেখেই দৌড়ে কোলে উঠে। অরুণ ছেলেকে কোলে নিয়ে আদর করতে করতে ভিতরে প্রবেশ করে। রুবি তার পিছনে। আনিকা মাকে দেখে এগিয়ে আসে। রুবি তাকে কোলে নিয়ে চুমু খায়‌।

-” তোমার ভাই কোথায়?”

-” ঘরে দাদির কাছে! ঘুমিয়ে পড়েছে বোধহয়।”

রুবি আনিকাকে নামিয়ে দিয়ে ঘরে দিকে হাঁটা দেয়। আগে ছেলেটাকে কোলে নিয়ে মাতৃ মনটাকে তৃপ্ত করুক। আরিয়ান আনিকাকে টেনে নিয়ে কোলে বসায়। অরুণ ছেলেকে কোলে নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে থাকে। ভোর বাবার গলা জড়িয়ে। পাতা তাদের পিছু পিছু আর পাতাবাহার সবার পিছু পিছু।

অরুণ রুমে প্রবেশ করে ছেলেকে বিছানায় বসিয়ে ব্লেজার খুলে। পাতা চটজলদি আলমারি খুলে অরুণের টি শার্ট ট্রাওজার বের করে । অরুণ সেগুলো খপ করে টেনে নিয়ে ওয়াশরুম চলে যায়। পাতার কপালে ভাঁজ পড়ে। সে ভোরকে ইশারায় জিজ্ঞেস করে কি হলো? ভোর ঠোঁট উল্টিয়ে কাঁধ ঝাঁকিয়ে বোঝায় কি জানি! পাতা ভোরের মতো করে গালে হাত দিয়ে বিছানায় বসে। অরুণ সরকার সময় নিয়ে গোসল করে বের হয়। তবে নিত্যদিনের মতো খালি গায়ে মেল শ্যাম্পুর কড়া স্মেলে পাতার বশীভূত করার লুকে নয়। টি শার্ট পড়েই এসেছে। এতে পাতার চোখে মুখে খানিক নাখোশতা দেখা মিলে। অরুণ সেসবের তোয়াক্কাই করলো না। পাতাকে উপেক্ষা করে ভোরকে কোলে নিয়ে বের হয়ে গেল। পাতা চোখ পিটপিট করে সোফায় বসা পাতাবাহারের দিকে চায়। বিড়ালটিও পাতার দিকেই তাকিয়ে আছে। ক্ষণিক সময় অতিবাহিত হওয়ার পর হঠাৎ পাতা বিছানা থেকে নামে। দৌড়ে বেড়িয়ে যায় ঘর থেকে। ড্রয়িং রুমে গিয়ে দেখল সবাই ডাইনিংএ বসে। মিনু খাবার বাড়ছে। পাতা গিয়ে মিনুকে সাহায্য করে। সবাইকে খাবার বেড়ে দেয়। অরুণের পাতে ভাত,সবজি দিয়ে আড়চোখে লক্ষ্য করে তার গতিবিধি। লোকটার কি হলো? তাকে ইগনোর করছে এমনকি তাকাচ্ছেও না। খাওয়া দাওয়া শেষ করে অরুণ ভোর রুমে যায়। পাতা সবার খাওয়া শেষে মিনু, আভারির সাথে খাবার খেয়ে নেয়। সাথে থালাবাটি ধুয়ে মুছে কিচেনে রেখে তবেই নিজ ঘরে যায়। ভেজানো দরজা খুলতে সে অবাক! নাহ্ কেউ সারপ্রাইজ দেয় নি। বরং ঘর অন্ধকার বানিয়ে বাবা ছেলে শুয়ে আছে। অরুণ সরকার ধীমে সুরে গল্প শোনাচ্ছেন ভোর সরকারকে! পাতা আবছা অন্ধকারেই শব্দ করে দরজা লাগায়। অরুণের গল্পে বিঘ্নিত ঘটে। ড্রিম লাইট জ্বালিয়ে দিয়ে বিরক্তিকর চাহনিতে পাতাকে একনজর দেখে গল্প বলায় মনোযোগ দেয়। পাতা হতাশ ভঙ্গিতে আলমারি খুলে সালোয়ার স্যুট নিয়ে গেল ওয়াশ রুমে যায়। শাড়ি চেঞ্জ করে বেরিয়ে আসে। বিছানায় ঝপাস করে বসে। ভোর হেসে বলে,

-” আম্মু? এখানে এসো! আমার পাশে?”

পাতা ভোরের ওপাশে গিয়ে শুয়ে কম্ফোর্ট দিয়ে আপাদমস্তক ঢেকে নেয়। ভোর বলে,

-” আম্মু কি হয়েছে?”

পাতা যেন কথা বলার ওয়ে খুঁজে পেল। কম্ফোর্ট সরিয়ে উঠে বসে শান্ত ভঙ্গিতে বসে। ড্রিম লাইটের আবছা আলোয় অরুণের দিকে তাকিয়ে শান্ত স্বরে বলে,

-” ভোর! কি হবে আমার? কিছুই হয়নি। হয়েছে তোমার বাবার! সকালে ধমক দিল আমায়! ঝাড়ির উপর ঝাড়ি খেয়েছি! রেগে থাকার কথা কার?”

ভোর খানিক সময় ভেবে উত্তর দেয়,

-” তোমার!”

-” আমার তাই না? কিন্তু গাল ফুলিয়ে রেখেছে কে? রেগে আছে টা কে?”

ভোর এবার না ভেবেই চট করে উত্তর দেয়,

-” আব্বু!”

পাতা ভোরের গাল টিপে দিয়ে বলে,

-” তোমার বাবার মুড আমি বুঝতে পারি না। উপর ওয়ালা ওনাকে কি দিয়ে বানিয়েছেন উনিই ভালো‌ জানেন। হুট করে রেগে যাবে, ঝাড়ি দিবে। আবার এই হাসি ঠাট্টা করবে। হঠাৎ সায়লেন্ট মুডে চলে যাবেন। তাকাবেন না পর্যন্ত। ওনার মুড সুইং তো গিরগিটির থেকেও ভয়ংকর। ক্ষণে ক্ষণে চেঞ্জ হয়। এই দেখো কিভাবে তাকাচ্ছে? আমি কি ওনাকে গিরগিটি বলেছি নাকি? কথার কথা বলেছি! কিন্তু উনি আমায় বেয়াদব ট্যাগ দিবেন নিমিষেই। আচ্ছা আমার দোষ টা কি ক্লিয়ার বলবে কেউ? বললে আমি সুধরে নেবো। কথায় কথায় সায়লেন্ট হয়ে গিয়ে অপমান করার দরকার নেই।”

শেষের দিকে গলা কেঁপে উঠলো যেন! চোখটা দুশমনি করে বসলো বলে। পাতা সামলে নেয় নিজেকে! ভোরের দিকে তাকিয়ে আবার বলে,

-” তাহলে তুমিই বিচার করো ভোর! আমি আমার অভিযোগ দায়ের করছি!”

অরুণ মাথার নিচে এক হাত রেখে শুয়ে আছে। দৃষ্টি পাতার দিকে নিবদ্ধ। তার মুখের আদল স্বাভাবিক। ভোর গম্ভীর মুখে গভীর ভাবনায় পড়ে। সে কি বিচার করবে?সে কি অর্ডার অর্ডার বলা জর্জ সাহেব নাকি যে বিচার করবে? তবুও সে বিচার করবে বলে সিদ্ধান্তে উপনীত হয়। বাবা ও আম্মুকে পর্যবেক্ষণ করে বেশ সময় নিয়ে। সে বাবাকে পানিশমেন্টও দিতে পারবে না। আবার আম্মুকেও দুঃখি দেখতে পারবে না। হঠাৎ তার মাথায় আইডিয়া আসে। পাতার কোলে বসে মুচকি হেসে বলে,

-” ও আম্মু? তুমি বলেছিলে না যে আব্বু যখন রাগ করবে, কথা বলবে না! তখন যেন আমি তাকে জড়িয়ে ধরে চুমু খাই। আদর করি?”

পাতার কপালে ভাঁজ পড়ে। গম্ভীর স্বরে ‘হুম’ বলে। অরুণ কান খাঁড়া করে রাখে। ছেলের পরবর্তী কথা কি হবে কিছুটা আন্দাজ করতে পারে। ভোর মিষ্টি করে বড়দের মতো বুঝানোর সুরে বলে,

-” আব্বু বোধহয় তোমার উপর একটু একটু রেগে আছে। তুমি বরং আব্বুকে একটু আদর করে দাও আব্বুর রাগ গলে পানি হয়ে যাবে! তোমার সাথে এতো এতো কথা বলবে। দেখে নিও?”

অরুণের অধরকোণে হাসির দেখা মিলল। পাতা খেয়াল করে সেটা। বিড়বিড় করে কয়েকটা ভদ্র গালি দিতে ভুলে না। ভোরকে কোল থেকে নামিয়ে দিয়ে কম্ফোর্টে নিজেকে পুনরায় মুড়ে বলল,

-” বাবার জন্য খুব দরদ তাই না ভোর? আমি তো কেউ না। থাক সে কথা! দরকার নেই ওনার কথা বলার। উনি আমার সাথে কথা না বললে যেন আমি কেঁদে গঙ্গা যমুনা ভাসিয়ে দিবো!”

ভোর কাঁদো কাঁদো মুখে অরুণের দিকে তাকালো। অরুণ ছেলেকে আশ্বস্থ করে শুইয়ে দিল বালিশে। পাতার গায়ে দেয়া কম্বোর্ট টেনে ছেলে সহ নিজের শরীরেও দিলো। ভোরকে একহাতে বুকে জড়িয়ে আরেক হাত আরেক হাত বাড়িয়ে দিয়ে পাতার পেটে রাখে। পাতা ঝটকা দিয়ে সরিয়ে দিবে কিন্তু অরুণ তার আগেই সরিয়ে কৌশলে কামিজের ভিতরে নেয়। পাতা রেগে যায়। লোকটা মোটেও ভালো না।দু হাতে সর্বশক্তি দিয়ে সরানোর চেষ্টা করে বলিষ্ঠ হাত। কিন্তু ব্যর্থ হয়। অরুণ সরায় না বরং শক্ত করে ধরে রাখে।

-” আমি এমনিই। আর এই এমন লোকটাকেই সহ্য করতে হবে তোমাকে। কোনো অভিযোগ শোনার সময় আমার নেই।”

-” সব সময় আপনার মন মর্জি চলবে না। দাসি না আপনার!”

-” থাপরে গাল ফাটিয়ে দিবো বেয়াদব! দাসি কেমন ভাষা? বউ তুমি আমার! একটামাত্র আদুরে বউ!”

পাতা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়। এই লোক মানুষ না মোটেও! এ লোক পাগলা ক্ষ্যাপা ষাঁড়। শালার জামাই! ভোর বাবার বুক থেকে মাথা তুলে উঠে বসে। অরুণের চুলের গোছা টেনে ধরে চিল্লিয়ে বলে,

-” আমার আম্মুকে বকলে কেন তুমি? পচা আব্বু?”

অরুণ পাতাকে ছেড়ে ছেলের হাত ধরে। পাতা উঠে বসে গোল গোল করে তাকায়। পরক্ষণেই হেসে বলে,

-” ভোর আরো জোড়ে টানো! একেবারে টাক বানিয়ে দাও। নাক উঁচু ম্যানারলেস অসভ্য লোক কোথাকার।”

ভোর বাধ্য ছেলের মতো তার আম্মুর কথা মেনে নেয়। অরুণ এটা ওটা বলে ভোলানোর চেষ্টা করে ভোর ভোলে না। তার কাজে অটল সে। অরুণ হার মানে। শান্ত স্বরে বলে,

-” স্যরি পাতাবাহার! আর এমন হবে না। ভোরকে ছাড়তে বলো? ইটস হার্টিং!”

চলবে….