#পাতা_বাহার
লেখনীতে: #বেলা_শেখ
#পর্ব- ৪০ (প্রথম অংশ)
(প্রাপ্ত বয়স্কদের জন্য)
(কপি করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ)
ভোর বাধ্য ছেলের মতো তার আম্মুর কথা মেনে নেয়। অরুণ এটা ওটা বলে ভোলানোর চেষ্টা করে ভোর ভোলে না। তার কাজে অটল সে। অরুণ হার মানে। শান্ত স্বরে বলে,
-” স্যরি পাতাবাহার! আর এমন হবে না। ভোরকে ছাড়তে বলো? ইটস হার্টিং!”
পাতার কর্ন গহ্বরে মনে হয় এক রাশ শান্তি বাক্য প্রবেশ করলো! হামি তুলে অরুণের উদ্দেশ্যে বলল,
-” কি বললেন ভোরের বাবা? শুনতে পাই নি! একটু জোড়ে বলুন? আর কণ্ঠে আরেকটু নমনীয়তা ঢেলে! ঠিকাছে?”
অরুণ চোখ রাঙায়। পাতা ভেংচি কাটলো তাকে। ভোর অরুণের চুল আরেকটু জোড়ে টেনে বলল,
-” আব্বু? মিষ্টি করে বলো? তুমি না গুড বয়?”
অরুণ শান্ত চোখে ছেলের দিকে তাকায়।
-” বলব না। তুমি বরং আরো জোড়ে টানো আব্বু! ভোরের আব্বু কি ব্যাথা পায় নাকি হুম?”
বলে নড়াচড়া বন্ধ করে দেয়। চুলের টান ধীরে ধীরে কমে আসে। একসময় ছেড়েই দেয় ভোর। এভাবে টানলে তো আব্বু অনেক ব্যথা পাবে। আব্বু ব্যাথা পেলে তার বুকটা কেমন করবে!পাতা ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে আছে। এই লোক তো মানুষ বশীভূত করতে ওস্তাদ। কিভাবে এক পলকেই পরিস্থিতি সামলে নিলো। পাতা হতাশ হয়ে পুনরায় বালিশে মাথা রাখলো। এ জম্মের ঠ্যাঠারু লোক। অরুণ ছাড়া পেয়ে পাতার দিকে একনজর তাকিয়ে ভোরকে আদর করে বুকে টেনে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। ভোর বাবার গলা জড়িয়ে আরাম পেয়ে অল্প সময়ের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়ে।অরুণ ছেলের মাথা বালিশে রেখে কপালে চুমু দিয়ে সরে আসবে কিন্তু ভোর বাবাকে ছাড়ে না। গলা মুখ হাতরিয়ে ‘আব্বু আব্বু’ বিড়বিড় করে। অরুণ সময় নেয়। ছেলের ঘুম গাঢ় হলে সরে আসে। ছেলেকে ডিঙিয়ে ওপাশে দুজনের মাঝে কম্ফোর্টে ঢুকে পড়ে। ডানপাশে ছেলের ঘুমন্ত মুখটা দেখে বামপাশ হয়। পেটে হাত রেখে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে পাতাকে। ঘুমে কাতর পাতা একটু কেঁপে উঠল। তবে ঘুম ভাঙ্গে না। অরুণ যেন সুযোগ পেলো। বিড়বিড় করে বলে,
-” ইউ উইল বি গন পাতাবাহার।”
সুযোগের সদ্ব্যবহার করে অরুণ অগ্রসর হয় তার কাজে। হালকা দুষ্টুমির জন্য এগোলেও অরুণ পিছিয়ে আসতে পারে না। হারিয়ে যায় স্বর্গীয় সুখ অনুভুতিতে। পাতার ঘুম ছুটে যায়। মস্তিষ্ক সচল হতেই হাত পা শিথিল হয়ে আসে। অজানা ভয়, আশংকা ও উত্তেজনায় পাতা শিউরে ওঠে বারংবার। বক্ষস্থল কেঁপে কেঁপে উঠছে; ধ্বক ধ্বক শব্দ যেন কানে বাজছে। মুখ দিয়ে মৃদু স্বরে ব্যাথাত্নক আওয়াজ বের হয়। এতেই যেন আগুনে ঘি ঢেলে দেয়। অরুণ সরকার আগ্রাসী হয়। পাতা ছটফটিয়ে ওঠে। হাত দিয়ে সরাতে চায়। অরুণ আঙুলের ভাঁজ আঙ্গুল দিয়ে শক্ত করে চেপে ধরে মাথা তোলে। চোখে চোখের মিলন হয়। অরুণ পাতার চোখের ভাষা নিমিষেই পড়ে নিল। কিন্তু সেটা আমলে নিল না। এমন একটা জায়গায় সে আছে সেখান থেকে বের হওয়া তার পক্ষে অসম্ভব বলা চলে। সে এগিয়ে আসে! পাতার গালে দাড়িযুক্ত গাল ঘষে। ছোট ছোট চুমু দেয়। কানের কাছে অধর বসিয়ে কামড় দেয় অল্প। অধরের কিনারায় গভীর ভাবে হারিয়ে যায়। থুতনি মুখে পুরে কামড় বসায়। চুমুতে ভরিয়ে তোলে মুখশ্রী। অধরে অধর বসিয়ে ছোট ছোট চুমু দেয়। গভীর চুম্বনে মত্ত হবে পাতা ঢোক গিলে মুখ সরিয়ে ডুকরে কেঁদে ওঠে নিমিষেই। অরুণের লালিমায় ছেয়ে যাওয়া চোখ জোড়া জ্বলে ওঠে নিমিষেই। গম্ভীর মুখে বলে,
-” আই এম ইয়্যর হাসবেন্ড পাতাবাহার!”
পাতা অরুণের হাতের মুঠো থেকে হাত ছাড়িয়ে নিয়ে চোখ মুছে নিল। নাক টেনে মাথা নাড়িয়ে ‘হুম’ বলে মাথা সোজা করে। অরুণ নিচু করে রাখা চোখের দিকে তাকিয়ে থেকে সরে যায়। বিছানা থেকে নেমে ওয়াশ রুমে গিয়ে ধরাম করে দরজা লাগায়। পাতা কেঁপে ওঠে সেই শব্দে। ভোর ঘুম থেকে লাফ দিয়ে ওঠে। পাশ হাতরিয়ে বাবাকে না পেয়ে ‘আব্বু আব্বু’ বলে জোড়ে জোড়ে ডাকে।পাতা নিজেকে সামলে ঠিকঠাক হয়ে ভোরকে শান্ত করায়।
_______
ভোরের অরুণ মেঘলা দীগন্তে উঁকি ঝুঁকি দিচ্ছে অল্প স্বল্প। গতরাতে মেঘের গর্জন শোনা গেলেও বর্ষিত হয় নি তেমন। শুধু ঝিরিঝিরি কয়েক ফোঁটা পড়েছে । সেই ফোঁটায় জমিনে শুয়ে থাকা তৃণ ভিজে আছে। রাস্তা ঘাটও কিছু কিছু জায়গায় ভিজে। সরকার বাড়ি সকাল ভোরে নিত্যদিনের মতোই পাখির কলতানে মুখর হয়ে আছে। পাখির দল ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে বেড়াচ্ছে এ গাছ ও গাছের ডালে।ফলে গাছের পাতার উপর জমে থাকা অল্প পানি ঝড়ে পড়ছে বৃষ্টির ফোঁটার মতো। আভারি বাগানের ভিতর দাঁড়িয়ে আছে। আজ মালি এসেছে বাগান পরিষ্কার করতে। আভারি তাকেই সাহায্য করছে। কিছু কিছু ফুল গাছের ডালপালা ছেঁটে দিচ্ছে । সাথে মালির সাথে এটা ওটা আলাপের ঝুড়ি খুলে বসেছে। হঠাৎ আদুরি আসে বাগানে। বয়স্ক গোছের মালি’কে দেখে মুচকি হেসে সালাম জানায়। মালি প্রতিত্তরে হেসে সালামের জবাব দিয়ে বলে,
-” ভালো আছো মামুনি? পড়াশোনা কেমন চলছে?”
আদুরি প্রতিত্তরে মুচকি হেসে বলে,
-” ভালো। আপনি কেমন আছেন কাকা?”
-” খুব ভালো। ফুল নিবে?”
-” আমি ফুল নিয়ে কি করবো? একটা বয়ফ্রেন্ডও নাই যে তাকে গিফট করবো।”
বলে গাল ফুলিয়ে নেয়। আভারি সহ মালি হেসে উঠলো। অরুণ কাছেই ছিল। হেঁটে এলো মাত্র। আদুরির কথা শুনে এগিয়ে আসে। গম্ভীর গলায় বলে,
-” বয়ফ্রেন্ড লাগবে? বিয়ের ব্যবস্থা করি?”
আদুরি চমকে পিছনে তাকায়। বড় ভাইকে দেখে জিভে কামড় দিলো। হে হে করে হেসে বলল,
-” মজা করছিলাম তো! আমার কি বয়ফ্রেন্ড পালার বয়স হয়েছে নাকি। আমি তো এখনো ছোট্টটি আছি!”
অরুণ চোখ রাঙায়। আদুরি হাসি থামিয়ে বলে,
-” আরে বড় ভাইয়া সব সময় সিরিয়াস মুডে থাকো কেন? একটু হাসিখুশি থাকলে কি তোমার দুই একটা সোনার হার গপচা যাবে? বিয়ে করেছো। নতুন সুন্দরী ছোট বউ আছে তোমার। একটু হাসিখুশি থাকবে তা না! এভাবে থাকলে এই বউও টিকবে না বলে..”
কথা শেষ করে না। অরুণের দিকে তাকায়। মুখের আদল বোঝা যাচ্ছে না। বড় ভাইয়া কি তার কথায় কষ্ট পেল নাকি? সে তো মজা করে বলছিল! সে তড়িঘড়ি করে সামলে বলল,
-“স্যরি ভাই। ওভাবে বলতে চাই নি!”
-” হুম”
বলে অরুণ পা চালায়। আদুরি ভাইয়ের হাত ধরে টেনে ধরে। সে বুঝতে পারে ভাই তার কথায় কষ্ট পেয়েছে।
-” ভাই স্যরি বললাম তো! কাকা ফুল দিন তো! ওই টকটকে লাল গোলাপ। একটা না অনেক গুলো দিন!”
অরুণকে ধরে রেখেই মালি’র উদ্দেশ্যে বলে। মালি’ আচ্ছা বলে লাল গোলাপ কাঁচি দিয়ে কেটে নিলো গোটা দশেক। একটা একটা করে গোলাপের কাটা ও পাতা কেটে নিল। গোলাপ গুলো আদুরির হাতে দিয়ে বলল,
-” আজই ফুটেছে এই গোলাপ। একদম সতেজ। সুন্দর লাগছে!”
আদুরি ফুলগুলো নিয়ে অরুণের দিকে বাড়িয়ে বলল,
-” স্যরি ভাই। প্লিজ আমার কথায় কষ্ট পেও না। ”
অরুণ ফুল গুলো হাতে নিয়ে মুচকি হাসলো। আদুরির মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
-” স্যরি বলতে হবে না। আমি কিছু মনে করি নি। ”
-” থ্যাংক ইয়ু ভাই!”
অরুণ তার গাল টিপে দিয়ে বাড়ির ভিতরে চলে গেল। মিষ্টি সকালের মুহুর্তটা যেন নিমিষেই বিষণ্নতার চাদরে ছেয়ে গেল। হয়তোবা তারই দোষ। অরুণ সরকার খোদ নিজেই দোষে ভরপুর মানুষ। ড্রয়িং রুমে বসে থাকা আরিয়ান অরুণের হাতে গোলাপ ফুল দেখে টিপ্পনী কাটলেও ফিরে তাকায় নি।অরুণ সোজা নিজের রুমে চলে যায়। রুমে প্রবেশ করতেই যেন বিষন্নতার রেশ কেটে যায়। পাতা ও ভোর বিছানায় বসে। দুই চড়ুই আজ ঘুম থেকে উঠে পড়েছে তাহলে!! অরুণকে আসতে দেখেও পাতা ভোর কারোর মধ্যেই কোনো ভাবান্তর দেখা যায় না। দুজনে নিজ কাজে গভীর মনোযোগী। পাতা ভোরকে পড়তে বসিয়েছে। ভোর বিড়বিড় করে পড়ছে ও খাতায় লিখছে। পাতা তাকে সাহায্য করছে। অরুণ ফুলগুলো টি টেবিল রেখে গলা খাঁকারি দিয়ে বলে,
-” বাহ্ আজ দুজনে জলদি উঠেছে! আমি তো ভেবেছিলাম এসে টেনে তুলবো!”
পাতা ভোর দু’জনেই মাথা তুলে অরুণের দিকে তাকিয়ে নিজ কাজ করতে থাকে। অরুণের ভ্রু কুঁচকে যায়। সে ওয়াশরুম থেকে একবার ঘুরে এসে সোফায় বসে। নাহ কেউ তাকে গ্রাহ্যই করছে না। অরুণ উঠে দাঁড়ালো। পকেটে হাত গুঁজে বিছানায় দাঁড়িয়ে ভোরের খাতায় উঁকি ঝুঁকি দিয়ে বাইরে চলে গেল।ভোর আড় চোখে সেটা দেখে লেখা বন্ধ করে পাতার দিকে তাকিয়ে বলে,
-” আমরা কথা বলি নি তাই আব্বু মনে হয় কষ্ট পেয়েছে আম্মু!”
পাতা ভোরের নাক টেনে বলে,
-” কথা বলো নি কেন? আমি তোমাকে মানা করেছি কথা বলতে?”
-” না! তুমি বলো নি তাই আমিও বলি নি।”
গাল ফুলিয়ে বলে ভোর। পাতা মুচকি হেসে তার গাল টেনে বলে,
-” ওলে আমার সোনা ছেলেটা!”
বলেই হাসে। কিন্তু ভোর হাসে না।
-” আমার আব্বু চুপচুপ থাকে বেশি সময়। আব্বুর মন খারাপ থাকলে একদমই কথা বলে না।আবার যখন মন খারাপ গায়েব হয়ে যায় নিজে এসে কথা বলে, অনেক আদর করে।”
বলে লেখায় মনোযোগ দেয়। পাতা খানিক ভাবনায় পড়ে। কাল কি তাহলে লোকটার মন খারাপ ছিল? সে যাই থাকুক হু হা ভদ্রতার খাতিরে বলাই যায়। ইগনোর করার মানেই হয় না। পাতার ভাবনার মাঝেই অরুণ আসে রুমে; হাতে ট্রে। ট্রেটা বিছানায় রেখে দেয়।
-” কলিজা এই গরম দুধ চকলেট হরলিক্স দিয়ে এনেছি। ঝটপট খেয়ে নাও তো?”
ভোর মিষ্টি হেসে বাবার হাতে পুরো হরলিক্স খেয়ে নেয় বিনা বাক্যে। অরুণ টিস্যু দিয়ে মুখ মুছে দেয়। ব্রেডে জেল মাখিয়ে দেয়। গরম ধোঁয়া ওটা দুধ চায়ের কাপ পাতার দিকে বাড়িয়ে বলে,
-” ধরো!”
পাতা নেয় না। চুপচাপ ভোরের বই উল্টে পাল্টে দেখে। অরুণ কতক্ষণ কাপটা ধরে রাখে পাতার সম্মুখে । পাতা আড়চোখে লক্ষ্য করে সব। একবার ভাবে নেবে পরক্ষনেই মন পাল্টায়। সে নেবে না। অরুণকে ওভাবে কাপ ধরে রাখতে দেখে জামাই পাগল পাতার মনটা নরম হয়ে আসে। সে ভাবে নেবে হাত বাড়াবে সেই মুহূর্তে অরুণ কাপটা নিয়ে সোফায় বসে পড়ে। পাতা ভেংচি কাটলো। ট্রেতে আরেকটা কাপ আছে। পাতা ভাবলো নিবে কিন্তু নেয় না। অরুণ চা’ য়ে চুমুক দিয়ে লক্ষ্য করে পাতাকে। গোমড়া মুখে বসে ভোরকে পড়া বুঝিয়ে দিচ্ছে। অরুণ চা রেখে গোলাপ ফুলগুলো নিয়ে পাতার কোলে রাখে। শান্ত গলায় বলে,
-” কাল রাতের জন্য আ’ম স্যরি পাতাবাহার! তোমাকে ইগনোর করার জন্য সাথে ওই ঘটনা! আই এম এক্সট্রিমলি স্যরি ফর মাই বিহেভিয়ার। আমি মানুষটা একটুও ভালো নই; দোষে ভরপুর। যখন আমার মুড ঠিক থাকে না আমি চুপ করে যাই। কারণ আমি জানি কথা বললে সেটা ধমক অথবা ঝাড়ি হবে। প্লিজ এক্সেপ্ট মাই এপোলোগাইজ?”
পাতা এমন ভান করে যেন সে শুনতেই পায় নি। ভোর খুশি হয়ে আম্মুর দিকে তাকিয়ে। আব্বু স্যরি বলেছে তাহলে আম্মু নিশ্চয়ই আর রেগে থাকবে না। কিছু পাতা নিরুত্তর। সে ভোরের বই খাতা পেন্সিল গুছিয়ে ব্যাগে ভরতে থাকে। অরুণের মেজাজ খারাপ হলো। তবুও শান্ত গলায় বলল,
-” আমি কিছু বলছি তোমায়! পাতাবাহার?”
পাতা ব্যাগ গুছিয়ে অরুণের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলে,
-” আমার নাম পাতা! পাতা! পাতাবাহার নয়! সেটা আপনার ওই ছা’পোষা বিড়ালের নাম। তাই ওই নামে ডাকবেন না। আর স্যরি? যখন আপনার মুড ভালো থাকবে আমার সাথে মজা করবেন মুড খারাপ থাকলেই ধমকের উপর রাখবেন। ইচ্ছে হলে কাছে টানবেন নয়তো ফিরেই তাকাবেন না! খুব বেশি যত্ন করে আবার অবহেলা করতেও ভুলবেন না। আমিও মানুষ আমারও মুড আছে। আমার আপনার কথা এখন শুনতেই ইচ্ছে করছে না। সো উইল ইউ প্লিজ সাট ইয়্যর মাউথ?”
অরুণের মুখ থমথমে। ভোরের মুখটাও সুবিধার নয়। পাতা অরুণের দেয়া গোলাপ ফুল পাশে রেখে উঠে ওয়াশরুমে চলে যায়।
ভোর গোমড়া মুখে বাবার দিকে চায়। অরুণ ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে মুচকি হাসার চেষ্টা করে। কিন্তু হাসিটাও যেন বেইমানি করে। বেরোতেই চায় না।ভোর বাবার গলা জড়িয়ে ঝুলে পড়ে।
-” আব্বু আমি আম্মুকে বুঝিয়ে বলবো হ্যাঁ? আম্মু তোমার সাথে কথা বলবে। তুমি একটুও কষ্ট পেও না।”
এবার অরুণের অধরকোনে হাসি ফুটতে সক্ষম হয়। ছেলেকে কোলে তুলে নিয়ে বেরিয়ে যেতে যেতে বলে,
-” আমার কলিজাটা এতো আদুরে কেন? মনে হয় বুকের ভিতর ঢুকিয়ে নিই।”
ওয়াশরুমে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আছে পাতা; মুখশ্রী গম্ভীর। আয়নায় নিজের গম্ভীর মুখশ্রী দেখে একটু আগে অরুণের উদ্দেশ্যে বলা কথাগুলো আওড়াতে থাকে। কথা শেষ করে কিছুপল নিজেকে দেখে। হঠাৎ ফিক করে হেসে দেয়। লোকটার মুখ দেখার মতো হয়েছিল। পেঁচা মুখো লোক! সবসময় শুধু ধমক আর ঝাড়ি দিবে এখন ঝাড়ি খেয়ে কেমন লাগে একটু বুঝুক। পাতা হাসি থামিয়ে শান্ত হয়ে বেসিনের কলের নব ঘোরায়। ঠোঁটের আগায় মুচকি হাসি এখনো সরে নি। লোকটা স্যরি বলেছে এটাই এনাফ ছিল তার কাছে। সেখানে এতো গুলো গোলাপ দিয়ে এতো মিষ্টি করে স্যরি বললে জামাই পাগল পাতা গলবে না? তবে একটু নাকানিচোবানি খাওয়ানোই যায়। এটা তার বউগত অধিকার হুম। তবে বেশি খাওয়াবে না। পাতা ওয়াশ রুম থেকে বেরিয়ে পুরো রুমে চোখ বুলায়। কেউ নেই। পাতা বিছানায় রাখা ফুলগুলো নিয়ে ফুলদানিতে রাখে। আলমারি থেকে সালোয়ার স্যুট বের করে বিছানায় রাখে। নিমিষেই চেঞ্জ করে। তবে পরনের লং ঘেরের স্যুটটার জিপ আটকাতে বেগ পোহাতে হয়। পাতা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আটকানোর চেষ্টা করে। হঠাৎ দরজার নব ঘোরার শব্দ কানে বাজে। পাতা সচকিত দৃষ্টিতে দরজায় চায়। অরুণ সরকারকে দেখে খানিকটা স্বস্তি পেলেও সেই স্বস্তি বোধ বেশি দের থাকে। গায়ে ওড়না নেই। তবে এটা বেশি ফ্যাক্ট না। এর আগেও লোকটার সামনে ওড়না ছাড়া ছিল সে। কিন্তু লোকটা কপালে ভাঁজ ফেলে এদিকেই এগিয়ে আসছে। তখন সে এতগুলো কথা শুনালো। ছেলে সামনে ছিল তাই হয়তোবা চুপ করে ছিল। এখন তো কেউ নেই। পাতা অরুণের দিকে মুখ করে দুহাত পিঠের দিকটায় নিয়ে জিপ লাগানোর চেষ্টা করে।
-” চেঞ্জ করছিলাম আমি নক করে ঢুকতে পারেন না?”
-” ইটস মায় রুম, মায় ওমেন!”
বলে অরুণ গম্ভীর মুখে এগিয়ে আসে। কথাটা যেন পাতার বুকে লাগলো! আহ্! মাই ওমেন! কথাটায় কতটা অধিকারবোধ! অরুণ কাঁধে দুহাত রেখে পাতাকে ঘুরিয়ে দেয় আয়নার সম্মুখে। নিজে পেছনে দাঁড়িয়ে জিপে হাত রাখে। পিঠে আলতো হাত ছুঁয়ে একটানে জিপ আটকে দিল। পাতার শ্বাস আটকে যাবার যোগাড়। এই লোক ভয়ংকর পাতু! তুই কি নাকানিচোবানি খাওয়াবি! এই লোক তোকে মাঝসমুদ্রে ফেলে হাবুডুবু খাওয়াচ্ছে। অরুণ পাতার পিঠ নিজের বলিষ্ঠ পিঠের সাথে মিশিয়ে আয়নায় পাতার প্রতিবিম্বের সাথে নজর মিলায়! অরুণের নয়নে নয়ন পড়তেই পাতা শান্ত হয়ে যায়। তাকিয়ে থাকে অবিকল ওই মায়ায় ভরপুর ছোট ছোট চোখের গভীর সমুদ্রে। ডুবে যায় ঘোরে। যেন বশীভূত হয়ে যায়। এ কেমন মায়ায় ঘেরা লোকটা? অরুণ পলক ঝাপটিয়ে শান্ত স্বরে গলায় খানিক নমনীয়তা ঢেলে বলে,
-” মিসেস পাতা অরুণ সরকার! আমি আগেই সাবধান করেছিলাম যে আমি লোকটা মোটেও ভালো নই। মেজাজের ঠিকঠিকানা নেই। আমাদের মাঝে পুরো জেনারেশন গ্যাপ আছে। আমাদের চিন্তা ধারনা অন্যরকম। তবুও আমি সর্বদা চেষ্টা করছি একসাথে পথ চলার।”
থামে অল্প। পরপরই গম্ভীর মুখে বলে,
-” আপনার অভিযোগ শুনলাম! এখন আমার কথা মনোযোগ দিয়ে শুনবেন! আপনি অভিযোগ করেছেন আমি আমার জবানবন্দি দিচ্ছি। আমি বিনা কারণে ঝাড়ি ধমক দিই না; অতি আপনজন ব্যাতিত কাউকেই ধমক দিই না। আমার কাছে যখন কোনো ব্যাপার ভালো লাগে না ,আমি ধমক দেই শাসন করি ভবিষ্যতেও করবো। আর হ্যাঁ কাছে টানি কিন্তু কখনো দূরে ঠেলে দিই নি। মিথ্যা অভিযোগ মানবো না। দিয়েছি কখনো দূরে ঠেলে?বরং আমি অভিযোগ করতে পারি যে আপনি কখনও আমাকে কাছে টানেন নি।খুব যত্নে না রাখলেও কখনো অবহেলা করি নি। সর্বোচ্চ প্রায়োরিটি, এফোর্ড দিয়েছি। কিন্তু আমার মনে হয় সর্বচ্চটা আপনি দেন নি! কাল দিনটা খুবই বাজে গিয়েছিল আমার। মেজাজটা খুব একটা সুবিধার ছিল না। সেবারের মতো গ্লাস ভেঙ্গে কোনো সিনক্রিয়েট সৃষ্টি না করি তাই চুপ ছিলাম। ভোরের সাথেও একটা কথা বলি নি। ও কিন্তু কোনো অভিযোগ করে নি! কারণ সে জানে কিছু সময় দিলে সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু সেই ধৈর্য্য টুকু আপনার ছিল না।”
কথাগুলো কতটুকু সত্য ছিল বা সঠিক পাতা জানে না। তবে লোকটার কথা শুনে মনে হলো লোকটার দোষ নেই। একটু গম্ভীর, মেজাজি কিন্তু তার সর্বোচ্চ খেয়াল রাখে যত্ন করে, আদর করে; মাঝে মাঝে মনে হয় তাকে ভালোও বাসে। সেই হয়তো একটু বেশি বেশি করে মাঝেমধ্যে। পাতা নজর নামিয়ে নেয়। অরুণ বলে,
-” শেষ হয় নি কথা? শুনুন পাতা?”
পাতা মাথা তুলে চায়। পাতাবাহার নামটা তার খুব একটা পছন্দ না হলেও লোকটার মুখে শুনতে শুনতে ভালোলাগা কাজ করে। সেই মুখে পাতা বড্ড বেমানান লাগছে। অরুণ বলে,
-” মন খারাপ করবেন না পাতা। আপনার অভিযোগ ভালো লেগেছে আমার। ভবিষ্যতে কখনো অভিযোগ জমা হলে শুনাবেন কিন্তু? মনে মনে পুষিয়ে রাখবেন না।”
পাতা ঘুরে দাঁড়ায়। অরুণের পিঠে হাত গলিয়ে জড়িয়ে ধরে বুকটায় মাথা গুঁজে দিলো।
-” হয়েছে! ওত ফুটেজ খেতে হবে না। সব দোষ আমার হ্যাঁপি? আপনার মেজাজকে বলে দিবেন পাতার উপর তার মেজাজ চলবে না একদম!”
অরুণ দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। পাতার মাথায় হাত বুলিয়ে বলে
,
-” হয়েছে চলুন খেয়ে নিবেন? স্কুলে যেতে হবে!”
পাতা মাথা তুলে তবে ছাড়ে না। কপালে ভাঁজ ফেলে বলে,
-” কি আপনি আপনি শুরু করেছেন?”
-” আচ্ছা তুমি তুমি শুরু করলাম! চলো?”
-” পাতাবাহার বলুন?”
-” না!”
-” কেন?”
-” মানা করেছিলেন আপনি!”
পাতা ছোট ছোট করে চায়। অরুণকে ছেড়ে সরে দাঁড়ায়। আঙুল উঁচিয়ে বলে,
-” খুব বাধ্য স্বামী আপনি? দেখি চোখ বন্ধ করুন একটু?”
অরুণের কপালে ভাঁজ পড়ে। পাতা আবার বলে। অরুণ বিরক্ত মুখে বন্ধ করে চোখ। পাতা এগিয়ে যায়। পায়ের আঙুলে ভর দিয়ে উঁচু হয় কিন্তু নাগাল পায় না। এই লোকটা এতো লম্বা! মনে হয় তাল গাছ। পাতা যত টুকু নাগাল পায় তাতেই কাজ চালিয়ে নেয়। ঘন জঙ্গলে লুকিয়ে থাকা থুতনিতে চুমু বসিয়ে দৌড় লাগায় ঘরের বাইরে। অরুণ তড়িৎ গতিতে চোখ খুলে। পাতাকে না দেখতে পেয়ে পুনরায় চোখ বুজে। থুতনিতে হাত রেখে খানিকটা মুচকি হাসলো। তবে বিছানায় ওড়না দেখে ভ্রু কুঁচকে যায়। ওড়নাটা হাতে নিয়ে বেরিয়ে আসে। পাতা কাঁচুমাচু করে দরজায় লুকিয়ে আছে। অরুণ পাতাকে অস্বস্তিতে না ফেলে ওড়না দিয়ে জড়িয়ে দেয়। হাত ধরে ড্রয়িং রুমের উদ্দেশ্যে হাঁটা দেয়।
চলবে….
#পাতা_বাহার
লেখনীতে: #বেলা_শেখ
#পর্ব- ৪০ (শেষ অংশ)
(কপি করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ)
গোধূলি বেলা। মেঘলা আকাশে সূর্য অস্তগামী হব হব ভাব বিরাজ করছে। লাল কমলা মিশেল রঙের সূর্য মহাশয় থেকে বিচ্ছুরিত লাল আভা সাদা কালো মেঘমল্লার উপর পড়ে এক অনন্য রঙিন দীগন্তের উদ্ভাবন করেছে। পশ্চিমা দীগন্তের বুক চিরে যেন তাজা রক্ত গলগলিয়ে পড়ে ছড়িয়ে পড়েছে তার দেহ জুড়ে। সেই দীগন্তের বুকের ছায়ায় উড়ে বেড়ায় বিহঙ্গের দল। চিল ডানা মেলে এলোমেলো উড়ছে। কখনো ধরনীর বুক ঘেঁষে তো কানো ট্রপোস্ফেয়ার অঞ্চল জুড়ে। অন্যান্য বিহঙ্গ তার আপন নীড়ের খোঁজে। বাবুই তার বাসায় বসে আছে। তার ছোট ছোট বাচ্চাদের কিচিরমিচির চলছে বিরতিহীন। শালিক, সারস, বুলবুলি, ময়না, ধনেশ শঙ্খচিল উড়ে বেড়ায় এলোমেলো। তবে কাঠঠোকরা তার কাজে এখনো মশগুল। সে নারিকেল গাছে ঠোকরে ঠোকরে গর্তের সৃষ্টি করতে ব্যস্ত। কিছু কাকের দল কা কা করছে মেহগনি গাছের উঁচুতে বসে। টুনটুনি ও চড়ুইয়ের দল গ্যারেজের দেয়ালে ফাঁকফোকরে অল্প আগাছা দিয়ে নিজের আবাসস্থল বানিয়েছে। সরকার বাড়িতে সাজবেলায় নিত্যদিনের মতো আজকেও পাখির মেলা বসেছে।এ বাড়িতে আগমন হওয়ার পর প্রায়শই পাতা গোধূলি লগনে ছাদে প্রকৃতির মাঝে ভেসে বেড়াতো। বাড়ির আঙিনায় এলোমেলো ঘুরে বেড়াতো। কখনো তার সঙ্গী ভোর ,আনিকা তো কখনো মিনু। দুই দিন শাশুড়িকে সঙ্গে নিয়েই বেড়িয়েছে। তবে আজ পাতা গোধূলি বেলায় ব্যস্ত সময় পার করছে। সে ড্রেসিন টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে শাড়ির কুচি দিচ্ছে। একা হওয়ার দরুণ বেশ বেগ পোহাতে হচ্ছে। আর এই শাড়িটাও একটুও সুবিধার নয়। শুধু হাত থেকে পিছলে যাচ্ছে কুচির ভাঁজ! পাতা বিরক্তের সাথে কুঁচি দিয়ে যাচ্ছে আবার খুলছে। অরুণ বিছানায় বসে তার কার্যকলাপ পর্যবেক্ষণ করছে। মেয়েটার শাড়ির ফাঁকফোকরে দিয়ে বেড়িয়ে আসা আকর্ষণীয় উদরে চোখ পড়ছে বারংবার। অরুণ সরিয়ে নিচ্ছে কিন্তু বেহায়া চোখ বারংবার সেখানেই আড়চোখে চায়। ভোর গালে হাত দিয়ে টি টেবিলের উপর বাবু হয়ে বসে আছে। অরুণ বিছানা থেকে উঠে এসে সোফায় বসে। ছেলেকে টেনে কোলে বসিয়ে বলে,
-” আব্বু এখনও সময় আছে। তুমি বললে যাবো না আমরা। বলো?”
ভোর মিষ্টি হাসি দিয়ে বাবার গাল টানতে টানতে বলে,
-” তোমরা যাও! আমি থাকতে পারবো! তবে জলদি আসবে কিন্তু?”
অরুণ মুচকি হেসে মাথা নাড়ল। ছেলেটা তার এতো বুঝদার। তবে মাঝে মাঝে এমন কান্ড করবে মনে হবে এর চেয়ে অবুঝ বাচ্চা দুটো নেই। পার্টিতে যাওয়ার জন্য রেডি হয়েছে সে। শুভ ফোন করে করে কানের পোকা বের করে দিচ্ছে। তার যাওয়ার মুড মোটেই নেই কিন্তু বন্ধুরা এমনভাবে চেপে ধরেছে না করতে পারে নি। সে ভেবেছিল ভোর মানবে না কখনো কিন্তু অবাক করার বিষয় একবার বলাতেই ভোর রাজি হয়ে যায়। পাতাকে বললে উশখুশ করে সে যাবে না। অরুণ একটু ত্যাড়া নজরে চেয়েছিল ব্যস মানা করার সাহস পায়ই নি। এখন রেডি হচ্ছেন মহারানী। বলা চলে শাড়ির সাথে যুদ্ধে মেতেছে।
অনেক সাধনার পর পাতা এই অসভ্য শাড়ির কুচি দিতছ সক্ষম হয়েছে। সে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লো তবে এখনো অনেক কাজ বাকি। এই কুচি গুলো ঠিক করতে হবে। কিন্তু কে ধরবে? সে মাথা তুলে অরুণ সরকারের দিকে চায়।
-” ভোরের বাবা? একটু হেল্প করুণ না? কুঁচি গুলো একটু ঠিক করে দিন!”
অরুণ ফোন থেকে চোখ তুলে পাতার দিকে চায়। পাতা কুচির দিকে ইশারা করে। অরুণ হামি তুলে বলে,
-” পাতা! আমি হেল্প করতে গেলে সর্বনাশ হয়ে যাবে। কাল রাতের মতো কেঁদে কুল কিনারা পাবে না!”
পাতার কান গরম হয়ে আসে। কপোল জোড়ায় লাল আভা ছড়িয়ে পড়ে। সে ঘুরে দাঁড়িয়ে নিজেই কুচি ঠিক করতে লাগলো। ভোর বাবার কোল থেকে নেমে গুটি গুটি পায়ে পাতার সামনে দাঁড়িয়ে বলে,
-” আম্মু কি হেল্প লাগবে বলো? আমি করে দিচ্ছি!”
পাতা মিষ্টি হাসে। ডেসিন টেবিলের উপর রাখা সেফটিপিন দেখিয়ে বলে,
-” বাবা ওটা দাও? সাবধানে হাতে না লাগে।”
ভোর সেফটিপিন দেয় একটা একটা করে। পাতা সময় নিয়ে কুঁচি গুজে নেয়। সেফটিপিন লাগিয়ে আঁচল ঠিক করে। ঝুঁকে ভোর গালে চুমু বসিয়ে বলে,
-” ধন্যবাদ সোনা!”
ভোর মিষ্টি হেসে অপর গাল এগিয়ে দেয় পাতা সেখানে চুমু দিলে ভোর কপাল থুতনিতেও আদর আদায় করে বাবার কোলে গিয়ে বসে। পাতা হালকা সেজে নেয়। প্রথমবারের মতো কোনো পার্টিতে যাবে একটু আকটু না সাজলে হয়?
ভোর বাবার কোলে বসে লক্ষ্য করে যে তার বাবার গোটা কয়েক দাঁড়ি সাদা দেখা যাচ্ছে। ভোর সেখানে হাত বুলিয়ে বলে,
-” আব্বু চুলের মতো তোমার দাঁড়ি তো পেকে যাচ্ছে।”
অরুণ গালে থুতনিতে হাত বুলিয়ে বলে,
-” তাই কলিজা?”
-” হুম!”
বাবা ছেলের কথোপকথন পাতার কানে যায়। সে হেসে বলে,
-” ভোর তোমার বাবা তো বুড়ো হয়ে যাচ্ছে!”
ভোর কাঁদো কাঁদো মুখ বানিয়ে বাবাকে সুধায়,
-” ও আব্বু? তুমি বুড়ো হয়ে যাচ্ছো?”
অরুণ হেসে ছেলের গালে শব্দ করে চুম্বন বসিয়ে বলে,
-” তা একটু আকটু। ছেলে বিয়ে করাবো দু দিন বাদে! বুড়ো না হলে তো তোমার ভবিষ্যৎ শাশুড়ি আম্মা, তোমার হ্যান্ডসাম ইয়াং আব্বুকে দেখে পিছলে পড়বে। হাবুডুবু খাবে।”
বলার সময় অরুণ আড়চোখে পাতার দিকে তাকাতে ভোলে না। পাতা ভেংচি কেটে নিজের কাজে ব্যস্ত হয়। বললেই হলো হাবুডুবু খাবে? পানিতে ঠেসে ধরে পরপারে পাঠিয়ে দেবে না পাতা? পাতার জামাইকে দেখে পিছলে পড়া! হাবুডুবু খাওয়া! চুটকি বাজিয়ে খতম করে দেবে। ভোর পিছলে পড়া, হাবুডুবু খাওয়া না বুঝলেও তার শাশুড়ি কথা শুনে লজ্জা পেয়ে যায়।
-” পঁচা কথা বলো কেন? আমি বিয়েই করবো না শাশুড়ি কোত্থেকে আসবে শুনি?”
-” আকাশ থেকে!”
হেসে বলে অরুণ! ভোর বাবার কোল থেকে নেমে দুই একটা কিল বসিয়ে দিয়ে গাল ফুলিয়ে সরে আসে। পাতা রেডি হয়ে স্কার্ফ বেঁধে নেয়। আয়নাতে নিজেকে দেখে নেয় আপাদমস্তক। নিজেকে দেখে নিজেই ক্রাশ খায় জামাই তো ফিট খেয়ে চিৎপটাং হয়ে যাবে। সে ঘুরে দাঁড়িয়ে হাসিমুখে বললো,
-” কেমন লাগছে আমাকে?”
-” অনেক সুন্দর লাগছে আম্মু! একদম কুইনের মতো!”
ফটাফট উত্তর ভোরের। পাতা মুচকি হেঁসে অরুণের দিকে চায় তার জবাবের আশায়। অরুণ পাতার আপাদমস্তক দেখে বলে,
-” রানবির সিং-এর মতো লাগছে!”
পাতা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়। তাকে রানবির সিং-এর মতো লাগছে? ওই জোকারটার মতো! সিরিয়াসলি? সে আয়নায় নিজেকে দেখে! না ঠিক ঠাকই লাগছে তো। সে কটমট করে অরুণের দিকে তাকিয়ে আঙ্গুল উঁচিয়ে বলে,
-” ওটা আপনার চোখ না চমচম? কোন দিক দিয়ে আমাকে ওই জোকারটার মতো লাগছে শুনি? আরে সিদ্ধার্থ, কার্তিক আরিয়ান এমনকি হৃত্বিক রোশন লাগছে বললেও খুশি হতাম একটু আকটু। আপনি একটা যা তা! যাবোই না আমি!”
-” ওকে যেতে হবে না।”
পাতা গাল ফুলিয়ে কানের দুল খুলতে উদ্ধৃত হয়। যাবে না ওই ম্যানারলেস লোকটার সাথে। বউয়ের প্রশংসা করতে জানে না। বউয়ের সাথে মিষ্টি মিষ্টি কথা বলতে জানে না। রসকষহীন লোক! অরুণ সোফা থেকে উঠে আসে। পাতার নাকটা টেনে দিয়ে বলে,
-” সরকার মহলের বড় বেগম মাশাআল্লাহ আপনাকে অনেক সুন্দর লাগছে। এবার কৃপা করে চলুন দেড়ি হয়ে যাচ্ছে তো!”
পাতার মুখের আদল পরিবর্তন হয়। অধরকোনে ফুটে ওঠে মিষ্টি হাসির রেখা।লাল টুকটুকে অধর জোড়ায় মিষ্টি হাসির রেশ! এ যেন আল্পনা আঁকা কল্পনার এক মধুর সাম্রাজ্য। অরুণ পাতার গালে হাত রেখে ঝুঁকে আসে। পাতা ঘাবড়ে যায়। অরুণ মুচকি হেসে তার ললাটে অধর ছুঁয়ে দেয়। বিছানায় গাল ফুলিয়ে বসা ছেলেকে কোলে তুলে তাড়া দেয় বের হওয়ার জন্য। পাতা ঝটপট জুতো পড়ে নেয়। পার্সে মোবাইল ঢুকিয়ে এগোয়। একটু বেশি উঁচু জুতো পড়ার দরুণ হাঁটতে অসুবিধা হয়। টলতে থাকে এলোমেলো। উচ্চতায় সে মাত্র পাঁচ ফুট তাই উঁচু জুতো তার উচ্চতায় খানিক সহায়তা করে। তবে এই বটগাছের মতো লোকটার সামনে দাঁড়ালে সে কাঁধ অবধিও পৌঁছাতে পারে না। তাই এই হাই হিল! কিন্তু এটাতে অভ্যস্ত না হওয়ায় সে ভুমিকম্পের মতো টলছে এদিকে ওদিকে। অরুণ ব্যাপারটা লক্ষ্য করে ভ্রু কুঁচকে বলে,
-” এটা পড়ে তুমি এক পাও হাঁটতে পারবে না। আর শাড়ির সঙ্গে বেজে পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। যাও পাল্টে নাও পাতা!”
পাতা অসহায় চোখে চায়। অরুণ শান্ত গলায় ধমকের সুরে বলে,
-” যাও?”
পাতার মুখ থমথমে হয়ে যায়। লোকটা আবারো ধমক দিচ্ছে। পাতা কিছু না বলে ফ্ল্যাট জুতো পড়ে নেয়। অরুণ ছেলেকে নিয়ে বেড়িয়ে আসে রুম থেকে। পাতা তার পিছনে হাঁটতে থাকে। নাক উঁচু ম্যানারলেস লোক!
ড্রয়িং রুমে এসে অরুণ দেখে সোফায় আসমা বেগম ও আদুরি বসে। আনিকা, রূপ ফ্লোরে বসে পুতুল খেলছে। আদুরি ভাইকে দেখে হেসে বলে,
-” তোমরা বেরোচ্ছো তাহলে? বড় ভাবী লুকিং সো মাচ বিউটিফুল! একদম কিলার লুক!”
পাতা মুচকি হাসলো। অরুণ আসমা বেগমকে উদ্দেশ্য করে বলে,
-” ছোটমা কলিজাকে রেখে যাচ্ছি। একটু খেয়াল রেখো! আদু ছেলেটাকে চোখে চোখে রাখিস!”
-” তুমি চিন্তা করো না। আমি আছি তো। ভোর কাম?”
অরুণ ছেলের গালে মুখে ছোট ছোট চুমু দেয়। বুকের সাথে চেপে আদুরে গলায় বলে,
-” আব্বু? একটুও দুষ্টুমি করবে না। ফুপ্পি ও দাদির সাথে থাকবে। দৌড়ঝাঁপ মোটেই করবে না। মিনুর আপার কাছে যেতে পারো। আভারি ভাইকে ফোন করে বলে দিয়েছি আসার সময় তোমার আর আনিকার জন্য পিৎজা আনবে। দুষ্টুমি করবে না। গুড বয়ের মতো থাকবে। আমরা জলদি চলে আসবো।”
ভোর মাথা নাড়ে।
-” হুম। তোমরা কিন্তু ফাস্ট ফাস্ট আসবে। যাবে আর আসবে। কেমন?”
-” আচ্ছা মানিক!”
বলে ভোরকে নামিয়ে দিল। ভোর পাতার কাছে গেলে পাতা তাকে আদর করে সাবধান বানী শোনায়। সকলের থেকে বিদায় নিয়ে বের হয় বাড়ি থেকে। অরুণ পাতাকে দাঁড় করিয়ে গ্যারেজ থেকে গাড়ি নিয়ে আসে। ফ্রন্ট সিটের দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করতে বলে পাতা বাধ্য মেয়ের মতো বসে।
-” আপনি গাড়ি চালাবেন?”
-” হুম!”
-” সবসময় ড্রাইভার গাড়ি চলায় তাই আমি ভেবেছিলাম আপনি ড্রাইভিং পারেন না!”
-” সাউন্ড ফানি পাতা! সিট বেল্ট বেঁধে নাও!”
পাতা সিটবেল্ট হাতে নিয়ে ঠোঁট উল্টিয়ে বলে,
-” আই কান্ট!”
অরুণ নিজ সিটবেল্ট খুলে ঝুঁকে এসে সিটবেল্ট লাগায়। পাতা সিটের সাথে লেপ্টে যায়। লোকটা তার দিকে ঝুঁকে আছে। মুখটা অতি সন্নিকটে। গাম্ভীর্যে ঠাসা মায়াময় ওই ছোট ছোট নেত্রযুগল পাতাকে বশীভূত করে। বোচা উঁচু নাকটা টিপে দিতে ইচ্ছে করে। অধরজোড়ে নজর পড়তেই পাতার বুকটা কেঁপে ওঠে ধ্বক করে। নজর সরিয়ে নেয়। অরুণ সরকারও সরে আসে। নিজ সিটবেল্ট বেঁধে দক্ষ হাতে স্টিয়ারিং ঘুরায়।
-” আস্তে চালাবেন কিন্তু!”
-” হুম!”
বলেই ড্রাইভিংয়ে মনোযোগ দেয়। পিনপিন নীরবতা। কেউ কোনো কথা বলা তো দূরের কথা টু শব্দ করে না। শুধু গাড়ির হর্নের আওয়াজ। পাতা উশখুশ করে। চুপচাপ থাকতে মোটেও ভালো লাগছে না তার। দম বন্ধ বন্ধ লাগছে এভাবে থাকতে। সে গলা ঠিক করে বলে,
-“ওই পার্টিতে সবাই আপনার বন্ধু?”
-” ক্লাসমেট! শুভরাও থাকবে!”
শুভ স্যারের নাম শুনে পাতা ঠোঁট বাকায়। স্যারকে দেখলেই তার মনে পড়ে স্যার এককালে তার ক্রাশ ছিল। ভালোলাগা কাজ করতো। ক্লাসে হা করে তাকিয়ে থাকতো। লুকিয়ে চুরিয়ে দুই একটা ছবিও তুলেছিল। রাতে দেখতো আর মুচকি মুচকি হাসতো। সেসব ভেবেই পাতার গা কাঁটা দেয়।ভাগ্য তাকে কোথায় এনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। ক্রাশ স্যার থেকে জামাইয়ের বন্ধু। তার দেবর/ ভাসুর লাগে। ছিঃ! কতটা ওকোয়ার্ড সিচুয়েশন। যদিও এসব পাতা ব্যাতিত পাতার ছায়াও জানে না। তবে নিজের কাছেই কেমন যেন লাগে। সে শুভ স্যারের ভাবনা ছেড়ে তার জামাইয়ের ভাবনায় পড়ে। লোকটা চুপ করে আছে কেন? একটু কথা বললে কি মুখ ব্যাথা করবে?
-” আপনার বন্ধুদের বউও আসবে?”
-” হুম!”
আবার চুপচাপ। পাতা বুঝতে পারে না কথা কিভাবে বাড়াবে! কি টপিকসে কথা বলবে?
-” সকাল থেকেই দেখছি পাতা পাতা জপছেন? মানে পাতা ডাকছেন? কেন?”
অরুণ পাতার দিকে একনজর তাকিয়ে সম্মুখে ফিরে বলে,
-” তুমিই বলে ছিলে পাতা ডাকতে! পাতাবাহার তো আমার ছা’ পোষা বিড়ালের নাম!”
পাতা কপালে ভাঁজ ফেলে বলে,
-” সেটা তো তখন রেগে ছিলাম তাই বলেছি! আর আপনি সেটা ধরে বসে থাকবেন?”
-” এই জন্যই বুঝে শুনে কথা বলতে হয়! কথাটায় আমি অপমানিত বোধ করেছি!”
গম্ভীর সুরে বলে অরুণ। পাতা হেসে বলে,
-” বাহ্। খুব ভালো! এই কথাতেই অপমানিত বোধ করেছেন! আপনি যে আমাকে ধমকে ধামকে কত কিছু বলেন আমার তো অপমানিত বোধ আসে না! আসবেই বা কি করে পরগাছার আবার অপমান বোধ!”
অধর জুড়ে হাসি খেলা করলেও চোখ ভরে আছে পাতার। অরুণ লক্ষ্য করে। টিস্যু পেপার বাড়িয়ে বলে,
-” হয়েছে কাঁদতে হবেনা! ছিঁচকাদুনে একটা!”
পাতা টিস্যু নিয়ে মুছে নেয় আলতো করে। সাজ নষ্ট হয়ে পেত্নি বনে না যায়। অরুণ সামনে দৃষ্টি স্থির রেখে একহাত বাড়িয়ে মাথায় রাখে।
-” পরগাছা নও! তুমি আমার মন প্রসুণের জুঁই! হৃদ কুঠিরে কলতানে মাতোয়ারা আরেকটা চড়ুই ! ”
পাতা আড়চোখে অরুণের দিকে তাকিয়ে বলে,
-” আরেকটা? আরো আছে নাকি?”
অরুণ হেসে ওঠে শব্দ করে। পাতাও হেসে দিল। দুজনের হাসিতে যেন গোধূলি বেলায় দ্যুতি জ্বালিয়ে দিলো মন কাননের আনাচে কানাচে। মেঘলা দীগন্তে ক্ষীণ উঁকি দেয়া শশধর যেন হেসে উঠলো আলো ছড়িয়ে। বর্ষার সাঁঝে স্নিগ্ধ শীতল পবনে যেন বসন্তের হাতছানি দোলা দিচ্ছে। দ্যুলোকে বসন্তের কোকিল কুহ্ কুহ্ ডেকে জানিয়ে দিচ্ছে যে, ‘শোন তোমরা? দেখে যাও ধরনীতে শ্রাবণে ফাল্গুনী দেখা যায়। এক কপোত যুগল তাদের হাসিতেই রামধনু ছড়ায়।’
______
ভোর সোফায় হাত পা ছড়িয়ে তার ফুপ্পি আদুরির ফোনে ক্যান্ডি ক্র্যাশ গেম খেলছে। আনিকা এখনো রূপকে নিয়ে পুতুল খেলছে। ভোর গিয়েছিল কয়েকবার। আনিকাকে বলেছিল তার সাথে চোর পুলিশ খেলতে! আনিকা মানা করে দেয়। সে এখন পুতুল খেলবে আর কিছুই না। ভোর রূপকে টেনে নিয়ে আসতে চায় রূপ আসবে না। কেঁদে দেয়। সে ও তার বোনের সাথে খেলবে। ভোর রেগে পুতুলকে এক লাথি মেরে বলে এসেছে,
-” আমারও ভাই/বোন আসবে। ওকে নিয়েই আমি খেলবো! তোদের সাথে আর খেলবো না।”
গেম খেলতে খেলতে হঠাৎ ভোরের কিছু মনে পড়ে।সে উঠে বসল। ফোনে কিছু খোঁজে কিন্তু পায় না। পাবে কিভাবে সে তো চেনেই না। তাই সে আদুরি ফুপ্পির ঘরে যায়। গিয়ে দেখে সে পড়ছে। সে গুটি গুটি পায়ে আদুরির পাশে দাঁড়ায় তবে কিছু বলে না। আদুরি বই বন্ধ করে ভোরকে কোলে তুলে নেয়। গালে ঠোঁট চেপে চুমু দিয়ে বলে,
-” আমার ছোট্ট রাজকুমার বাবা কি বলবে? হুম?”
ভোর আদুরির ফোনটা বাড়িয়ে বলে,
-” বকবে না তো?”
আদুরি হেসে বলে,
-” রাজকুমারকে বকবো এতোটা স্পর্ধা আমার নেই বাবা! বলো?”
ভোর মিনমিন করে বলে,
-” মা কে একটু কল দিবে? বেশি না একটু কথা বলবো?”
আদুরি ভাবে পাতার কথা বলছে। তাই সে ফোনে পাতার নম্বর বের করে বলে,
-” একটু আগেই তো গেলো ভাইয়া, বড় ভাবী! এখনি পরান পুরছে ভাইয়ের কলিজার?”
ভোর কিছুসময় চুপ থেকে বলে,
-” মা’য়ের সাথে কথা বলবো! পাতা আম্মুর সাথে না।”
আদুরির কপালে ভাঁজ পড়ে। ভোরকে টেবিলে বসিয়ে দিয়ে বলে,
-” পাগল তুমি? ওই মহিলার সাথে কথা বলবে?”
-” ওই মহিলা না! মা হয় আমার!”
গোমড়া মুখে বলে ভোর। আদুরি শান্ত হয়ে বলে,
-” ভোর সোনা? বড় ভাবীই এখন তোমার মা, আম্মু! উনি তোমার কিছুই না!”
ভোরের মুখ গম্ভীর হয়ে আসে।
-” উনি আমার মা ফুপ্পি! আর আম্মু আমার আম্মু!”
-” তুমি যাকে মা বলছো সে তোমায় এইটুকুনি রেখে চলে গিয়েছিল।আর..”
-” ফুপ্পি কল দিবে? আমি শুধু একটু কথা বলবো! প্লিজ ফুপ্পি?”
আদুরি অসহায় চোখে চায় ভোরের দিকে।
-” আমি কল করবো না। তুমি যাও?”
ভোর কিছু বলে না আর। টেবিল থেকে নেমে চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়ায়। আজ আরবি পড়াকালে হুজুর তাকে নতুন হাদিস শিখিয়েছে যে মায়ের পদতলে সন্তানের বেহেশত। এছাড়াও মায়ের মর্যাদা নিয়ে আরো অনেক তাফশির শুনিয়েছে। তখন তার মায়ের কথা মনে পড়ে। মায়ের সাথে কথা বলতে মন টানে। ভোর রুম থেকে বেড়িয়ে যাবে তখন আদুরি ডাক দেয়। বর্ষার নম্বর আছে তার কাছে। মাঝে মাঝেই ভোর তার বাবার অনুপস্থিতিতে আবদার করে কথা বলবে বলে। মানা করলে এভাবেই গাল ফুলিয়ে চলে যাবে আর কথা বলবে না। বর্ষা অনলাইনে থাকায় ভিডিও কল করে বর্ষাকে। ভোর মিষ্টি হেসে ‘থ্যাংক ইয়ু’ বলে ফোনটা নিয়ে বেলকনিতে চলে যায়। বর্ষা রিসিভ করতেই স্ক্রিনে তাকে দেখে ভোর মুচকি হেসে বলে,
-” মা? কেমন আছো?”
বর্ষা অবাক হয়ে হেসে দেয়।
-” বরুণ! তুমি! আমি ভালো আছি! তুমি কেমন আছো সোনা?”
-” ভালো! কি করছো তুমি? ওই বাবুটা কে?”
বর্ষা তার ছেলেকে বাদলকে দেখিয়ে বলে,
-” ভুলে গেলে? এটা তোমার ভাই বাদল!”
ভোর গম্ভীর মুখে বলে,
-” ও আমার ভাই নয়!”
বর্ষা এ নিয়ে আর কিছু বলে না। প্রসঙ্গ পাল্টে বলে,
-” এতদিন পরে মনে পড়লো মা কে? হুম? নতুন আম্মুকে পেয়ে ভুলে গেছো!”
ভোর মুচকি হেসে বলে,
-” তুমিও তো ভুলে গেছো নতুন ছেলে পেয়ে। আমি তাও কল করি তুমি তো একটুও কল করো না!”
বর্ষার মুখখানি মলিন হয়ে যায়।
-” আমি কার কাছে কল করবো? তোমার আব্বুর কাছে কল করলে ধরেই না।সে বাদ দাও! তোমার নতুন আম্মু কেমন? ভালোবাসে তোমাকে? আদর করে?”
-” তোমার থেকেও অনেক বেশি মা! তুমি তো আমাকে ভালোবাসো না।”
-” কে বলেছে বাসি না?”
-” বাহ্ রে! ভালো বাসলে কি এই ছোট্ট আমাকে রেখে চলে যেতে পারতে? মা ওই বাবুটাকেও কি রেখে চলে যাবে কখনো?”
বর্ষার মলিন মুখ যেন থমকে যায়। কোলের আট মাসের ছোট্ট বাদল কেঁদে ওঠে শব্দ করে। বর্ষা ছেলেকে দুলিয়ে শান্ত করানোর চেষ্টা করে। ভোর ফোনের স্ক্রিনে তাকিয়ে অপলক। তার মুখে মলিনতার রেশটুকুও নেই। হাস্যোজ্জ্বল মুখ!
-” ও কাঁদছে কেন?”
-” কি যে হলো! বরুণ তুমি একটু ওয়েট করো! আমি বাদলকে ওর বাবার কাছে দিয়ে আসি। কল কাটবে না কিন্তু? আমরা অনেকটা সময় কথা বলবো!”
ভোর মাথা নাড়ে। বর্ষা ফোনটা রেখে ছেলেকে নিয়ে চলে যায়। সে চলে গেলে ভোর কল কেটে দেয়। রুমে এসে আদুরির কাছে ফোন দিল! সাথে ধন্যবাদ দিতে ভুলে না। আদুরি শান্ত স্বরে বলল,
-” কথা হলো তোমার বর্ষা মায়ের সাথে?”
-” হুম। ফুপ্পি তুমি কিন্তু আব্বুকে বলবে না। আম্মুকেও না। প্লিজ বলো বলবে না?
-” কি কথা হলো? কি বললে? আর সেই বা কি বলল?”
ভোর কিছু বলবে এর আগে আনিকা চিল্লিয়ে বলে,
-” তুই ওই পঁচা চাচি মনির সাথে কথা বলেছিস ভোর?”
ভোর, আদুরি দরজায় দাঁড়ানো আনিকার দিকে তাকায়। আদুরি দাঁত বের করে হেসে বলে,
-” আমি বড়চাচ্চু, চাচিমনিকে বলে দিবো! তখন তোকে বকবে। তোকে আর ভালবাসবে না, আদর করবে না। তোকে ওই পঁচা চাচি মনির কাছে রেখে আসবে!”
ভোরের মুখে ভয়ের আবির্ভাব ঘটে। মুখটা বিবর্ণ হয়ে যায়। ঢোক গিলে আদুরির দিকে তাকিয়ে বলে,
-” ফুপ্পি প্লিজ ওকে বারণ করো? আম্মু জানলে কষ্ট পাবে। আমাকে আব্বু যদি বকে? মায়ের কাছে রেখে আসে?”
আদুরি ঠোঁট চেপে হাসি আটকিয়ে বলে,
-” রেখে আসলে ভালো হবে। তুমি তোমার মায়ের কাছে থাকতে পারবে। তোমার নতুন বাবা হবে। আর তোমার আব্বু আম্মুর জন্য চিন্তা করিও না তারাও নতুন আরেকটা ভোর আনবে!”
আনিকা হেসে বলে,
-” ভালো হবে! এই ভোর পঁচা! আমি চাচি মনিরা আসলেই বলে দিবো!”
ভোরের মুখশ্রী লাল টুকটুকে বনে গেছে। নাকের পাটা ফুলে উঠছে। চোখ ভরে উঠছে। অষ্ঠাধর কাঁপছে। ভোর দৌড়ে যায় আনিকার দিকে। আনিকা দৌড় লাগালো হেসে। ভোর যেন লাগামহীন হয়ে গেছে। আনিকার পিছনে দ্রুত দৌড়ে ধরে ফেলল। ধাক্কা দিয়ে ফেলে গালে চর লাগায় দুইটা। আনিকা চিল্লিয়ে কেঁদে দেয়। ভোর তার চুল টেনে ধরে শক্ত করে,
-” আমি কোথাও যাবো না। আম্মু আব্বুকে বলবি? তোকে আজ মেরেই ফেলবো যদি বলিস! বল বলবি?”
আনিকা কাঁদতে কাঁদতে মানা করে সে বলবে না। আদুরি দৌড়ে আসে। ভোরের হাত থেকে আনিকার ছোট চুল ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে পারে না। ভোরকে ধমক লাগালো। ছাড়তে বলে। ভোর ছাড়ে না। এরমধ্যে আসমা বেগম আসে। আনিকার অবস্থা দেখে ভোরের হাত ধরে ঝটকায় ছাড়িয়ে নেয় কৌশলে। কষে ধমক লাগাতে ভোলে না।
-” এসব কি ধরনের বেয়াদবি ভোর? আনিকে মারছো কেন? বোন হয় না তোমার?”
ভোর চিল্লিয়ে বলে,
-” না! ও আমার বোন না! পঁচা আনি!”
মিনু দৌড়ে এসে ভোরকে টেনে নিয়ে যায়। ভোর তাঁর হাত ছাড়িয়ে দিয়ে দৌড়ে সিঁড়ি বেয়ে নিজের ঘরে চলে যায়। বিছানায় লাফ দিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে।
আসমা বেগম রূপকে মিনুর কাছে দিয়ে আনিকাকে কোলে নেয়। আদর করে ভোলানোর চেষ্টা করে। আদুরিকে জিজ্ঞেস করলো কি হয়েছে? আদুরি মিনমিনে গলায় সব খুলে বলে। আসমা বেগম সব শুনে গম্ভীর। আদুরি আরো বলে,
-” ভোরেরও তেমন কোন দোষ নেই! আমরা মজা করে ওকে উস্কে দিয়েছি অজান্তেই। ও সত্যিই মনে করেছে।”
-” যা হবার তা হয়েছে! আরিয়ান, অরুণ, রুবি, পাতা কারো কানেই যেন না যায়। মিনু কারো কানেই না।”
-” মা আনিকা যদি..”
আদুরিকে থামিয়ে আসয়া বেগম বলেন,
-” আমার নাতনিকে আমি সামলে নেব!”
বলেই চলে যান। সরকার বংশের রক্তই যেন জেদে রাগে ভরপুর। এক ছিল অনিক সরকার। আরেক অরুণ! তার ছেলে আরিয়ানও কোন অংশে কম না। আনিকা ভোর দু’জনেই সরকার বংশের ঐতিহ্য ধরে রেখেছে। তাদেরও জেদ কম না। আসমা বেগম দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। এখন ছোট রূপ যে কেমন হবে?
_______
নানা রঙের আলোক সজ্জায় সজ্জিত হল রুম! গোলাপ ফুলের সমারোহ পার্টি জুড়ে। সৌন্দর্য ও ভালোবাসার প্রকাশের অন্যতম মাধ্যম গোলাপ ফুলে সেজে উঠেছে হল রুমের প্রত্যেকটা দেয়াল। লাল রঙের লাভ শেপের বেলুন ফ্লোরে গড়াগড়ি খাচ্ছে, ঝুলছে সাথে উড়ছেও। সহ্যনীয় পর্যায়ের মিউজিক বেজে চলেছে। একটার পর একটা গান চলছে অনবরত। সব গুলো গানই বাঙালি। এখন বেজে চলেছে ‘ ভালোবাসবো বাসবো রে বন্ধু’
সবাই এনজয় করছে গানটা। গানটার সুর ও লিরিক্সে যেন আলাদা জাদু আছে। কেউ কেউ তার পার্টনারের সাথে গানের তালে তাল মিলিয়ে গাইছে, নাচছে। পাতা চুপচাপ অরুণ সরকারের পাশে দাঁড়িয়ে আছে। তারা পার্টিতে এসেছে বেশ সময় হলো। লোকটার সব বন্ধুরা ও তাদের সহধর্মিণীরাও এসেছে। পাতা তাদের সবাইকেই চেনে। রিসেপশনে কথা হয়েছিলো। তাদের সাথে কুশল বিনিময় ও হালকা হাসি ঠাট্টা বেশ চলছিল। ধীরে ধীরে সময় বাড়তে থাকে সাথে পার্টিতে কপোত কপোতিদের আনাগোনা। অনেকেই এসেছে। লোকটা তাকে পরিচয় করিয়েছে সবার সাথে। অরুণের দুই বান্ধবীর সাথেও পরিচয় হয়েছে পাতার। তারা তাদের হাসবেন্ডকে নিয়ে এসেছে।পাতা তাদের হাসবেন্ড দেখে অবাক হয়েছিল প্রথমে।পরে ভাবে যে অরুণ সরকারের যেখানে আটত্রিশ/ঊনচল্লিশ চলমান সেখানে তার মেয়ে ব্যাচমেটদেরও তেমনি বয়স হবে। তো চল্লিশের কাছাকাছি কোনো মেয়ের হাসবেন্ড নিশ্চয়ই কচি খোকা হবে না। বয়স্কই হবে। পার্টিতে বয়স্কদের সংখ্যাই বেশি বলা চলে। সবাই আনন্দ উল্লাসে মেতে উঠেছে। নিজেদের বয়সটাকে ভুলে সেই ভার্সিটিতে পদার্পণ করা তারুণ্যে পদার্পণ করেছে যেন। সময় যায় পাতার চোখ খুলে যায়। কিছু কিছু মেয়ে বলবে না মহিলা? যাইহোক খুবই উশৃঙ্খল পোষাকে। পাতা তাদের দেখে মনে নাউজুবিল্লাহ আওড়িয়েছে। তবে অধিকাংশই মার্জিত পোষাকে। অনেকেই বোরকা হিজাবেও আছে। পুরো পার্টিতে চোখ বুলিয়ে পাতা বেশ লজ্জায় পড়ে এখানে উপস্থিত সকলের চেয়ে সেই বোধহয় ছোট। উচ্চতায় সাথে বয়সেও। এ নিয়ে হাসি ঠাট্টাও কম হয় নি পার্টি জুড়ে। তবে হাসি ঠাট্টা সহনশীল। শুধু মজার উদ্দেশ্যে বলা,পাতার বুঝতে একটুও সময় লাগে নি। উপস্থিত অধিকাংশই মার্জিত ও ভদ্রগোছের। পার্টিতে এসে পাতা আরেকটা জিনিস লক্ষ্য করেছে। তার দেখা চুপচাপ নাক উঁচু ম্যানারলেস লোকটা এ যেন অন্যরূপে। সকলের সাথেই কথা বলছে। হাসিঠাট্টা করছে। একে অপরকে পঁচাচ্ছে। কখনো কখনো তাদের মুখ দিয়ে মধুর বাক্য নিঃসৃত হচ্ছে। সেটা শুনে পাতা ভাবে, নাহ্! তার শালা ডাকটা এখানে দুধভাতের মতোন! সে অসহায় ফেস বানিয়ে অরুণের স্যুট হাতের বোতাম মুঠোয় পুরে টানতে থাকে। অরুণ বন্ধুদের সাথে কথায় ব্যস্ত। পাতার কাজে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে ইশারা করে কি হয়েছে? পাতা মিনমিনে গলায় বলে,
-” খিদে পেয়েছে আমার। এখানে খেতে দেবে না?”
তার সহজ সরল প্রশ্ন! একদমই ধীরে গলায় বলেছে। তবে অরুণের অপর পাশে দাঁড়ানো জীবনের কানেও যায়। সে অরুণকে বলার সুযোগই দেয় না। গলা খাঁকারি দিয়ে মুচকি হেসে বলে,
-” পিচ্চি ভাবীর খিদে পেয়েছে অরুণ যা খাইয়ে নিয়ে আয় মেয়েটাকে?”
অরুণ তার পেটে গুঁতো দেয়। চোখে শাসিয়ে কিছু বলবে রাসেল বলে,
-” আরে ভাবী খিদে পেয়েছে আগে বলবেন না? চলুন আমার সাথে?”
শুভ ধমক দিয়ে থামায় সবাইকে। অরুণকে উদ্দেশ্য করে বলে,
-” ওদিকে খাওয়ার আয়োজন করা হয়েছে। চল আমারাও যাই! সবারই পেটে ইঁদুর দৌড়াচ্ছে!”
অরুণ পাতার হাত ধরে হাঁটতে থাকে। বাকি সবাইও তাদের সাথে। হঠাৎ বাজতে থাকা মিউজিক বন্ধ হয়ে যায়। সবাই হইহুল্লোড় বাজিয়ে দেয় কে বন্ধ করলো? ডি জে কে ডেকে হয়রান। হঠাৎ পার্টির মাঝখানে আলো জ্বলে উঠলো। সেই ফ্রন্ট লাইটের আলোয় উজ্জ্বল হয়ে উঠল এক নারী। সে মাইক হাতে হেসে বলল,
-” হ্যালো গাইস!আমাকে ছাড়াই পার্টি চলছে দ্যাটস নট ফেয়ার!”
উপস্থিত জনরার একজন হেসে বলে,
-” কে তুমি হে রমনী নিজের পরিচয় তো দাও?”
মেয়েটি মুচকি হাসে। পরনে পাতলা জর্জেটের শাড়িটার আঁচল ঠিক করে; যেটা পরতে পরতে বেঁচেছে। সে মুচকি হেসে বলল,
-“তমাল আমাকে ভুলে গেলে এতো জলদি ? সত্যিই আমাকে চিনতে পারছো না?”
ন্যাকা স্বরের কথায় তমাল লোকটা অবাক হয়। তাকে চিনলো কিভাবে? সে বলল,
-” কে তুমি? চিনতে পারছিনা সত্যিই? পরিচয় দাও?”
মেয়েটি হেসে এগিয়ে আসে মাইক হাতে। মোটা কোমর দুলিয়ে বিশ্রী ভাবে হেঁটে যায়। যাওয়ার সময় কিছু কিছু লোকের গালে গলায় হাত রাখে। যেন সে কল গার্ল! সকলের উৎসুক দৃষ্টি তার উপর নিবদ্ধ। এমনকি অরুণ সরকার খোদ ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে। পাতা তার হাতে চিমটি কেটে বলে,
-” ওভাবে তাকিয়ে কি দেখছেন? পছন্দ হয়েছে নাকি? একদম চোখ তুলে নেবো বলে দিলাম!”
অরুণ বিরক্তিকর শ্বাস ছাড়লো। ওমেন আর মোস্ট ডেঞ্জারাস এনিম্যাল ইন দিস ওয়ার্ল্ড। সেই মোটা সোটা বলিষ্ঠ দেহি মেয়েটা মাইক নিয়ে ঘুরতে থাকে। সাথে চোখে পড়া সব লোকের নাম বলে যায় গাল ছুঁয়ে । এমনকি শুভ, রাসেলের গাল ছুঁয়েও তাদের নাম বলে। অরুণের কাছে এসে পাতার দিকে একপল চেয়ে অরুণকে জড়িয়ে ধরে বলে,
-” অরু? তুমিও আমাকে চিনতে পারলে না ডার্লিং? স্টুডেন্ট লাইফে আমরা কত ঘুরেছি! বাইকে চড়ে লং ড্রাইভে গেছি। সিনেমা দেখতে গিয়েছি!”
অরুণ সরানোর চেষ্টা করে কিন্তু পারে না। মহিলাটার এতো শক্তি? আর এরকম হাট্টকাট্টা শরীর? তার সন্দেহ হয়! তবে সে আমলে নেয় না। পাতার দিকে তাকালো। মেয়েটা কেমন করে তাকিয়ে আছে যেন ক্ষ্যাপা বাঘিনী! সে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয় মেয়েটাকে। পাতা গাল ফুলিয়ে ফোঁস ফোঁস করতে থাকে। তার সব বন্ধুরা হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খাওয়ার উপক্রম। ফয়সাল বলে,
-” ভাই এটা তোর এক্স ছিল?”
-” আমি তাকে চিনিই না। ফালতু কথা বলবি না!”
হিসহিসিয়ে বলে অরুণ। পাতা শক্ত কঠিন গলায় সিরিয়াস মুখে বলে,
-” সে যে বললো আপনি তাকে চেনেন। একসাথে লং ড্রাইভে গিয়েছেন! রোমান্টিক সিনেমাও দেখতে গিয়েছিলেন?”
অরুণ আশ্চর্যের সহিত তাকায়। মেয়েটা এগিয়ে এসে পাতার হাত ধরে বলে,
-” ছোট বইনা বিশ্বাস কর? আমরা চিনি একে অপরকে!”
বলে চলে যায়। পাতার মুখটা দেখার মতো হয়েছে। সামনে দন্ডায়মান আরেকটা ছেলেকেও জড়িয়ে ধরে এটা ওটা বলতে থাকে মেয়েটা। সবাই এবার অবাকের চুড়ান্ত পর্যায়ে। সবাই গুসুর ফাসুর আলাপ সেরে সিদ্ধান্ত নেয় মেয়েটাকে পাকরাও করে কয়েকটা থাপ্পড় লাগিয়ে সত্য বের করে আনবে! তখনই একটা কষ্টের গান বেজে উঠলো। মেয়েটা ফ্লোরে বসে দু হাত ফ্লোরে নাটকীয় ভঙ্গিতে বারি দিতে দিতে ন্যাকা সুরে কাঁদতে লাগলো। তখনই কিছু লোক এসে তাকে ঘিরে ধরে। মিউজিক চেঞ্জ হয়। বেজে ওঠে বর্তমানের এক জনপ্রিয় গান ‘তুমি কোন শহরের মাইয়াগো লাগে উড়াধুড়া’ লোক গুলো গানের তালে নাচতে থাকে। হঠাৎ মেয়েটাও উঠে দাঁড়ালো। সেও তাদের সঙ্গে নাচে যোগ দেয়। এখন আর তালে তালে না। উড়াধুড়া গানে উড়াধুড়াই নাচছে। মেয়েটার আঁচল খুলে পড়ে। পাতা চোখ বড় বড় করে অরুণের দিকে চায়। অরুণ শান্ত দৃষ্টিতে সামনের দৃশ্যে মনোযোগী। পাতা গাল ফুলিয়ে নেয়। মেয়েটা আঁচলের সাথে অনেক কিছুই খুলে যায়। মাথার নকল চুলটাও! উপস্থিত জনরা চিল্লিয়ে ওঠে। একে একে তারাও যোগ দেয় তাদের সাথে। মেয়েরূপী আগমন ঘটা লোকটাকে উত্তম মধ্যম দিয়ে পুরো যাচ্ছে তাই অবস্থা করে দেয়। সবাই হাসতে হাসতে ফেটে পড়ে। লোকটা হাসতে হাসতে বলে,
-” কেমন লাগলো আমার এন্টারটেইনমেন্ট গাইজ?”
সবাই চিল্লিয়ে ‘ওওসাম’ বলে ওঠে। শুভ বলতে থাকে লোকটা তাদের ব্যাচের সবচেয়ে ফানি ক্যারেক্টার। নাম আলি খান। তার অভিনয় নিখুঁত। এখনো অভিনয়ের সাথেই জুড়ে আছে। এসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর হিসেবে! অরুণের সাথেও তার ভাব ছিল বেশ। একসাথে সিনেমা দেখতে গিয়েছে কতবার! অরুণ পাতার দিকে চায় ;পাতা বেশ লজ্জায় পড়ে। আমতা আমতা করে বলে,
-” ওভাবে তাকাচ্ছেন কেন? দেখতে কিন্তু মেয়েদের মতোই লাগছিল!”
তার কথায় সবাই হেসে উঠলো সমস্বরে। পাতা লজ্জায় অরুণের বাহুতে মুখ লুকায়। পার্টি যেন তীব্র গতিতে মেতে ওঠে। সবাই এনজয় করতে থাকে। একপর্যায়ে একটা লোক নাম শফি। সে একটা ছোট গোল এক্যুরিয়ামে কিছু চিরকুট নিয়ে আসে। একটা টেবিল সেন্টারে রেখে একটা করে দম্পতিদের ডাকে আর চিরকুট তুলতে বলে। চিরকুটে যা লেখা থাকবে তাদের সেটা করতে হবে। আর সেটা না করলে মেল পার্টনারকে পার্টি স্প্রেতে গোসল করাচ্ছে। পাতার ভালো লেগেছে গেমটা। সে উৎসাহ নিয়ে অরুণের বাহু আকরে ধরে দেখছে সব। ফয়সাল ও তার স্ত্রী যায় চিরকুট তুলতে। তাদের চিরকুটে লেখা রোমান্টিক গান গাইতে হবে! ফয়সাল মাইক হাতে গুনগুনিয়ে গানের সুর তুলে দুই লাইন গায়। এরপর আরেক দম্পতি চিরকুট তুলে তাতে লিপকিস লেখা। পাতার চোক্ষুযুগলের আকার বড় হয়। দম্পতি সত্যিই সত্যিই চুম্বনে লিপ্ত হয়েছে। আর বাকি সবাই ‘ওহ হো’ বলে চিল্লিয়ে ওঠে। পাতা ভাবে ওদের কি লাজ লজ্জা কিছুই নেই? তারই তো লজ্জায় কান দিয়ে ধোঁয়া বেরোচ্ছে। সে অরুণের দিকে চায়। লোকটার কোনো ভাবান্তর নেই। এরপর বেশ কিছু দম্পতির এই একই চিরকুট আসে। রাসেলও যায় তার স্ত্রীকে নিয়ে। এমনকি শুভও যায়। এবার সবাই অরুণ ও পাতাকে ফোর্স করে। পাতা তো যাবেই না। যদি আজেবাজে কিছু ওঠে? সে তো সেখানেই জ্ঞান হারাবে! সে অরুণকে মানা করে কিন্তু অরুণের বন্ধুগন তাদের ঠেলে পাঠায়। মাইক হাতে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটার নাম শফি! সে পাতাকে দেখে হেসে বলে,
-” আরে আমাদের পিচ্চি ভাবী! আপনিই তুলুন!”
পাতা অসহায় চোখে অরুণের দিকে তাকায়। অরুণ তার হাত ধরে চোখে আশ্বস্ত করে। পাতা দোয়া দরূদ পাঠ করে চিরকুট তুলে। শফি পাতার হাত থেকে সেটা নিয়ে পড়ে। অরুণের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলে,
-” যাস্ট অন ওয়ার্ড ফর ইউর কিউটি ওয়াইফ?”
বলেই মাইক বাড়িয়ে দেয়। পাতার অস্বস্তি কমে কৌতূহল বেড়ে যায়। লোকটা কি বলবে? তখন কেমন লাগছে জিজ্ঞেস করেছিল! বলে কিনা রানবির সিং এর মতো লাগছে। এখন একটা শব্দ বলতে হবে লোকটা ‘দিলদার’ না বলে দেয়! অরুণ মাইক হাতে নিয়ে পাতাকে টেনে কাঁধ জড়িয়ে ধরে বলে,
-” মাই কুইন!”
পাতার অধরকোনে ভিড় করে লজ্জালু হাসি। উপস্থিত জনরা প্রতিবারের মতো উৎসাহ নিয়ে চিল্লিয়ে ওঠে। অরুণ পাতাকে আগলে নিয়ে ভিড় ঠেলে সরে আসে।
_______
মেঘলা আকাশ বর্ষিত হচ্ছে অনবরত। বৃষ্টির ছন্দপতনে এক আকর্ষণীয় ঝংকার বেজে উঠছে। সেই ঝংকার বাজছে কপোতিদের কর্নগহ্বরে। শুধু বেজেই ক্ষান্ত হয় নি! এক নাম হীন তুফানের সৃষ্টি করেছে অন্তঃপুর! সাথে শীতল পরিবেশ যেন সেই তুফানের বেগ বাড়িয়ে দিচ্ছে। অরুণ দক্ষ হাতে ড্রাইভিং করছে। পাতা চুপচাপ বসে আছে। দুজনের মধ্যে কোনো কথা হয়নি গাড়িতে ওঠার পর। দুজনের মাঝেই নীরবতার বেড়াজাল। সেই বেড়াজাল ভেঙ্গে অরুণ ডাকে,
-” পাতাবাহার?”
পাতার অধরকোনে হাসি ছড়িয়ে পড়ে। লোকটা অবশেষে পাতাবাহার ডাকলো। পাতার কানটা যেন শীতলতম হলো। পাতাকে চুপ থাকতে দেখে অরুণ আবার ডাকে! পাতা তার দিকে তাকিয়ে বলে,
-” হুম?”
অরুণ কিছু বলে না। স্টিয়ারিংয় ঘুরিয়ে এক নির্জন জায়গায় গাড়ি থামায়। পাতার কপালে ভাঁজ পড়ে,
-” থামালেন কেন? রাত সাড়ে দশটা বাজে ভোর নিশ্চয়ই অপেক্ষা করছে! জলদি চলুন!”
অরুণ প্রতিত্তর করেনা। সিটবেল্ট খুলে নেয়। পড়নের ব্লেজার খুলে পেছনে ঢিল ছুড়ে। টাইয়ের নট ঢিলে করে তড়িৎ বেগে পাতার দিকে ঝুঁকে আসে। পাতা চোখ বড় বড় করে চায়। অরুণ তারও সিটবেল্ট খুলে দেয়। কোমড় পেঁচিয়ে তুলে এনে নিজ কোলে বসিয়ে দেয়। পাতা অস্বস্তিতে এদিকে ওদিকে তাকিয়ে বলে,
-” কি হচ্ছে টা কি ভোরের বাবা?”
অরুণ কিছু বলে না। তবে চুপচাপ বসেও থাকে না। পাতার চোখের আকার বড় হয়। অরুণের শার্টের কলার মুঠোয় পুরে নেয়। অরুণ হঠাৎ থেমে যায়। পাতার গাল থেকে হাতজোড়া সরিয়ে স্কার্ফ টেনে ধরে,
-” ব্লাডি স্কার্ফ!”
বলেই পিন খুলে ফেলে তড়িঘড়ি করে,ফলে হাতে পিন ফুটে যায়। অরুণের ওতে ভাবান্তর নেই। স্কার্ফ ঢিল ছুড়ে পাতার চুলের রেবন খুলে। এলোমেলো চুল গুছিয়ে দেয় যত্ন সহকারে। এক হাত চোখের উপর রেখে বন্ধ করে দেয় চোখের পাতা! নাকে নাক আলতো ছুঁয়ে দিয়ে পুনরায় আকরে নেয় অধরযুগল। অশান্ত সমুদ্রের ন্যায় আছড়ে পড়ে সমুদ্র কিনারায়। সমুদ্রের একেকটা বিশাল ঢেউ এসে ঝংকার তোলে। পাতা শ্বাস নেওয়ার জন্য ছটফট করতে থাকে। অরুণ সরকার ছাড়ে না। কানের নিচে দিয়ে হাত গলিয়ে ঘার শক্ত করে চেপে ধরে। সময় যায় বেশ। খেয়াল হারা কপোত যুগল। রাস্তা দিয়ে পার হওয়া মালবাহী ট্রাকের হর্ণের আওয়াজে বিঘ্ন ঘটে মিষ্টি মধুর মুহুর্তের। অরুণ সরকার হুঁশে ফিরে। বধুয়ার ললাটে চুমু বসিয়ে বুকে টেনে নেয় শক্ত করে। চুলের ভাঁজে হাত গলিয়ে শান্ত করে। পাতা কোমড়ের কাছটার টি শার্ট মুঠোয় পুরে শান্ত হয়ে যায়। তবে মাথা তোলে না ব্যক্তিগত জায়গায় থেকে ওভাবেই বুকটায় দখল নেয়। অরুণ গাড়ি স্টার্ট করে। চলতে থাকে গাড়ি স্বাভাবিক গতিতে। একসময় পাতা নীরবতা ভেঙে বলে,
-” ভোরের বাবা আপনি কার?”
অরুণ প্রশ্ন শুনে চুপ থাকে কিছু পল। পাতার মাথা বুকের বা পাশটায় চেপে বলে,
-” শুনতে পাও?”
পাতা শুনতে পায় তবে বুঝতে পারে না। লোকটার হৃদযন্ত্রের ধ্বক ধ্বক শব্দ মনোযোগ দিয়ে শুনে পুনরায় সুধায়,
-” আপনি কার?”
এবার অরুণ চুপ থাকে না।
-” ভোরের আর তার আম্মুর!”
পাতা মাথা তুলে অরুণের চোখে চোখ রাখে। চোখে চোখে কি কথা হয় কে জানে! লজ্জা পেয়ে পাতা অরুণের গলায় মুখ গুঁজে দেয়! শক্ত করে জড়িয়ে ধরে তার ব্যাক্তিগত লোকটাকে।
______
চলবে…….