#পাতা_বাহার
লেখনীতে: #বেলা_শেখ
#পর্ব- ৪১ ( প্রথম অংশ)
(প্রাপ্ত বয়স্কদের জন্য)
(কপি করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ)
ঝমঝম বৃষ্টি বর্ষণে ভিজতে থাকে মেদিনী! বৃষ্টির ফোঁটার ছন্দপতনের শ্রুতিমধুর আওয়াজ যেন বর্ষপ্রেমীদের তনুমন জুড়িয়ে দেয়। বৃষ্টির সাথে সাথে হালকা ঝড়ো হাওয়া বইছে এলোমেলো। দীগন্তের বুক চিড়ে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। মাঝে মাঝে মৃদু গর্জনের আওয়াজ শোনা যায়। অরুণ পাতা জলদি পা চালায়। কলিং বেলের বেজে ওঠার সাথে সাথেই দরজা খুলে দিল আভারি। অরুণ ভিতরে প্রবেশ করে বলে,
-” আভারি ভাই ভোর কোথায়?”
কন্ঠে উদ্বিগ্নতা। আভারি মুচকি হেসে বলে,
-” ঘুমুচ্ছে আপনাদের ঘরে!”
-” খেয়েছে কিছু?”
-” শুধু নুডুলস খেয়েছে। এতো ডাকলাম। সে আব্বু আম্মু এলেই খাবে!”
অরুণ রুমের উদ্দেশ্যে পা চালায়। পাতা তার পিছনে গুটি গুটি পায়ে হেঁটে যায়। ঘরে প্রবেশ করেই অরুণ জুতো খুলে বিছানায় বসে। উপুর হয়ে শুয়ে থাকা ছেলের গা থেকে কম্ফোর্ট সরিয়ে দেয়। ঘুমন্ত ছেলেকেই টেনে বুকের উপর তুলে চুমুতে চুমুতে ভরিয়ে দিল। ইশ বুকটার জ্বলুনিতে যেন ঠান্ডা মলমের প্রলেপ পড়লো। কলিজাটাকে রেখে যাওয়ায় তার বুকের ভিতর কেমন আনচান করছিল। এখন একটু ভালো লাগছে। চুমুর বর্ষন থামিয়ে অরুণ ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। কপালে ভাঁজ পড়ে মৃদু। ছেলের চোখের কিনারায় পানি। চোখের পাতাও ভেজা! তাদের প্রতিক্ষায় কেঁদেছিলো কি? অরুণ ডাকে ছেলেকে,
-” আব্বু? এই কলিজা? আমার মানিক সোনা? ”
ভোর হালকা নড়াচড়া করে বাবার বুকের মধ্যে সেঁটে যায়। ছোট্ট বাচ্চাদের মতো বাবার মুখ হাতরিয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমে তলে যায়!
পাতা হামি তুলে অরুণের ব্লেজার ও তার স্কার্ফ সোফায় রেখে বিছানায় ধপাস করে শুয়ে পড়ল।
-” ঘুমুচ্ছে ঘুমোক!
অরুণ পাতার দিকে তাকিয়ে বলে,
-” খায়নি ছেলেটা! রাতে না খেয়ে ঘুমোতে নেই!
পাতা কম্ফোর্টের ভিতরে ঢুকে বলে,
-” নুডুলস খেয়েছে তো। আর এভাবে কাঁচা ঘুম ভাঙলে খুব খারাপ লাগে! থাক না?”
বলে আবার হামি তোলে। অরুণের কপালে আবার ভাঁজ পড়ে। গম্ভীর গলায় বলে,
-” সে থাক। তুমি বিড়াল ছানার মতো কম্ফোর্টের ভিতর ঢুকছো কেন?”
পাতা আপাদমস্তক ঢেকে হেসে বলে,
-” ঘুমাবো তাই!”
অরুণ ছেলেকে শুইয়ে দিয়ে বলে,
-” হোয়াট? পাগল তুমি? ওঠো! পাতাবাহার? যাও কাপড় চেঞ্জ করে ফ্রেশ হয়ে এসো? এককাজ করো গোসল করে নাও। ফ্রেশ লাগবে!”
-” পাতাবাহার ঘুম!”
ভোরের মতো করে বলে পাতা। অরুণ মুচকি হাসলো। কম্ফোর্ট সরিয়ে টেনে আনে পাতাকে। পাজা কোলে নিয়ে ওয়াশ রুমের দিকে পা বাড়ায়,
-” ফ্রেশ হয়ে ঘুমিও!”
অরুণ ওয়াশরুমে পাতাকে রেখে আসে। আলমারি খুলে পাতা ও তার প্রয়োজনীয় কাপড় নিয়ে রেখে আসে ওয়াশরুমে। পুনরায় রুমে এসে পরনের শার্ট মুজো খুলে এসির পাওয়ার কমিয়ে দেয়।বিড়ালশাবটাকে খাঁচা থেকে বের করে। মহারানী বের হয়েই মিয়াও মিয়াও বলে শ খানিক অভিযোগ দায়ের করে। অরুণ তার কান টেনে মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। ব্যস পাতাবাহার নামক বিড়াল শাবকের অভিমান শেষ। অরুণ ক্যাট ফুড দেয় বাটিতে। বিড়াল মিও মিও করে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে ক্যাটফুড গলাধঃকরণ করে। অরুণ বেলকনিতে যায়। নিমিষেই ঝড়ো বাতাসে ভেসে আসা বৃষ্টির ফোঁটা ভিজিয়ে দেয়। অরুণ চোখ বুজে নেয়! কিছু সময় সেখানে দাঁড়িয়ে থেকে ভিতরে আসে সাথে বেলকনির দরজা লাগিয়ে দেয়। রুমে এসেই তার হৃদস্পন্দন বেড়ে যায় দ্বিগুণ। অশান্ত হৃদযন্ত্রের অস্বাভাবিক ক্রিয়ার দরুণ অরুণ এই ঠান্ডা শীতল তম পরিবেশেও ঘামতে থাকে। কিছু সময় স্ট্যাচুর মতো দাঁড়িয়ে থেকে ওয়াশ রুমে চলে যায় হন হন করে। পাতা লজ্জায় মরি মরি! পড়নে তাঁর প্লাজো ও অরুণের স্কাই ব্লু রঙের টিশার্ট! সে টিশার্টের কলার মুঠোয় নিয়ে তড়িঘড়ি কম্ফোর্টের ভিতরে অবস্থান নেয়। আক্কেল গুড়ুম হয়ে কেন যে সে লোকটার টি শার্ট পড়তে গেল। ধ্যাত লোকটা কি ভাবলো? এখন তোর কি হবে পাতু?
অরুণ অল্প সময়েই বেড়িয়ে আসে। পরনে শুধু ট্রাওজার। টি শার্ট তো মালকিনের দখলে। মাথায় তোয়ালে চালিয়ে ভেজা চুল মুছতে থাকে সে। পাতাবাহার খেয়ে দেয়ে পেট ফুলিয়ে অরুণ পা ঘেঁষে ঘুরঘুর করে। অরুণ সরিয়ে দিল। তোয়ালে সোফায় ঢিল ছুঁড়ে বিছানায় ছেলের পাশে শুয়ে পড়লো। লাইট অফ করে না। সময় পেরিয়ে যায়। ভোরের দু পাশে শুয়ে থাকা মানব মানবীর চোখে ঘুম ধরা দেয় না। পাতা মটকা মেরে শুয়ে থাকে। এরমধ্যে বিড়াল শাবকটি কম্ফোর্টের ভিতরে ঢুকে পাতার পেটের উপর উঠে। পাতা মৃদু স্বরে চেঁচিয়ে লাফ দিয়ে উঠলো। পেটে ওর হারালো নখের আঁচড় লেগেছে। অপরদিকে অরুণের অধরকোনে বাঁকা হাসির রেখা। পাতাবাহারকে তুলে নিয়ে খাঁচায় পুরে দেয়। পাতার সম্মুখে বসে মাথায় হাত রাখল। শান্ত গলায় বলে,
-” রিল্যাক্স পাতাবাহার! তোমার সখি ছিল!”
-” রাখুন আপনার সখি!”
বলে আবার শুয়ে পড়ল। অরুণ সেখানেই বসে থাকে। পাতা তার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে,
-” ঘুমোবেন না?”
অরুণ তার দিকে তাকিয়ে শান্ত দৃষ্টিতে।
-” বাহ্ ভালো তো! ঘুম হারাম করে ঘুমানোর আহ্বান? হুম?”
পাতার কান গরম হয়ে আসে। ঠান্ডা পরিবেশও গরম লাগতে শুরু করে কেমন যেন! পাতা ভেবে পায় না কি বলবে! সব লাজ এসে ভিড় করে তার চোখে মুখে। পাতা মুখ লুকায়।
-” ভোরকে ওই ঘরে রেখে আসি?”
অরুণের কথায় পাতার কপালে ভাঁজ পড়ে। অরুণের চোখে চোখ রেখে বলে,
-” কেন?”
অরুণ মুচকি হাসে। সাথে যেন তার মায়াময় ছোট চোখ দুটো হেসে উঠলো। পাতার গা শিরশিরিয়ে ওঠে তার হাসি আর ওই হাস্যোজ্জ্বল চোখের গভীরতা দেখে। অবুঝ পাতা কি বুঝলো কেন যানে! ধ্বক করে ওঠলো বক্ষস্থল। ঢোক গিলে নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে। অরুণ চোখ সরায় না। না পাতা! নয়নে নয়ন মিলে কথোপকথন হয়। পাতা যেন বশীভূত হয়ে যায় নিমিষেই। অরুণ ভোরকে কোলে তুলে নিয়ে যায়। পাতা কেমন নিস্তেজ হয়ে পড়ে। সর্বাঙ্গ কেমন কেঁপে কেঁপে উঠছে। ভয়ে, লজ্জা, অস্বস্তিতে পাতা ঘামতে শুরু করে। এরমধ্যে অরুণ প্রবেশ করে রুমে। পাতা সবটা দেখে। লোকটা আলমারি থেকে কম্ফোর্ট নিয়ে বের হয়। একটু পর আবার ফিরে আসে। বিছানায় এসে তাঁর পাশে শুয়ে পড়লো। সাথে সাথেই লাইট নিভে যায়। পাতা ঢোক গিলে চোখ মুখ খিঁচে নেয়।
_____
ঘরময় শুনশান নিরবতা। বাইরের বৃষ্টির বেগের সাথে ঝড়ো হাওয়া বয়ে যাচ্ছে অবিরাম। বৃষ্টির ফোঁটার ছিটা ভিজিয়ে দিচ্ছে বেলকনির পুরোটা জুড়ে। ভেজা পর্দা বাতাসে উড়ে এসে বারংবার আঘাত হানছে রেলিংয়ের গায়ে। বেলকনির দরজা বন্ধ থাকায় বৃষ্টির ফোঁটা ভিতরে প্রবেশ করতে পারছে না। ঘরের দেয়ালে অবিরাম ঘূর্ণায়মান ঘড়ির সেকেন্ডের কাটার খট খট শব্দ শোনা যায়। দোদুল্যমান ঘড়ির কাঁটা দুলছে অবিরাম।ঘরময় ঘন চাপা নিঃশ্বাসের আনাগোনা। মাঝে মাঝে চাঁপা স্বরে ক্ষীণ ক্রন্দনরত সুর ভেসে আসে। তীব্র প্রণয়ের জোয়ারে ভাসমান যুগ্ম কপোতি। হঠাৎ নিঃশ্বাসের শব্দের বেগ কমে এলো। ক্রন্দনরত সুর ভেসে আসে না; শুধু নাক টানার শব্দ আসে। এসি সংযুক্ত শীতল রুমে ফুল স্পীডে ঘূর্ণায়মান ফ্যানের দিকে আবছায়া আলোয় স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে কপোতি। একপল, দুই পল, বেশ সময় নিয়ে তাকিয়ে থাকে। দুজনের মধ্যকার দীর্ঘ নীরবতার সমাপ্তি ঘটিয়ে অবশেষে অরুণ সরকার নরম গলায় সুধায়,
-” আর ইউ ওকে?”
পাতার চোখের কার্ণিশ বেয়ে নোনাজল গড়িয়ে পড়ে। দুজনের গায়ে জড়িয়ে থাকা কম্ফোর্ট নিজের দিকে টেনে নেয় পাতা। গলা অবধি ঢেকে ছোট করে জবাব দেয়,
-” হুম!”
অরুণ বালিশ থেকে মাথা তোলে। পাতার দিকে ঝুঁকে কম্ফোর্ট গলা থেকে খানিকটা সরিয়ে সেথায় নাক ঠেকিয়ে লম্বা শ্বাস টেনে নেয়। গম্ভীর মোহনীয় গলায় ধীমে সুরে সুধায়,
-” দ্যাটস ভেরি গুড! আই এম নট ডান ইয়েট!”
বলেই মাথা উঁচিয়ে পাতার চোখে চোখ রাখে। পাতা অবুঝ চোখে চায়। নাক টেনে বলে,
-” মানে?”
-” আ’ম নট ডান!”
ঘুমে বুজে আসা পাতার চোক্ষুযুগলের আকাল বড় হয়। কিছু বলার জন্য মুখ খুলবে সেটাও সম্ভবপর হয় না। অরুণ সরকার নিজ কাজে অগ্রসর হয় পূর্বের চেয়েও বেশ অশান্ত, বেপরোয়া গতিতে। আস্তেধীরে কম্ফোর্টের অবস্থানের পরিবর্তন হয়। উন্মুক্ত বলিষ্ঠ পৃষ্ঠদেশ পাতা সর্বশক্তি দিয়ে আকরে ধরে। দেয়ালে ঝোলানো ঘড়ির সময় টিক টিক টিক চলে নিজ গতিতে। বাইরের বৃষ্টিও নিজ ছন্দপতনে ঝড়ে পড়ে ভিজিয়ে দেয় মেদিনীপুরের সর্বাঞ্চল। শান্ত ঝড়ো পবন অশান্ত হয়। মেঘের গর্জনে পরিবেশ থমথমে।
______
বৃষ্টিতে ভেজা ঘোর তমসার সমাপ্ত পাঠ করে ধরনী জুড়ে স্নিগ্ধ ভোরের আগমন। পূর্ব দীগন্তে অরুণ দেখা যায় তার চিরচেনা তেজি রূপে। ঝলমলিয়ে আলো ছড়িয়ে দিচ্ছে বসুন্ধরায়। ভেজা গাছ পালা রাস্তা ঘাট শুকোতে শুরু করেছে। গাছের ডাল পালা হালকা বাতাসে নড়ছে। সাথে গাছের পাতার উপর জমায়িত বৃষ্টির কনা পড়ছে বৃষ্টির ফোঁটার মতো। সরকার বাড়ির পুকুরে ব্যাঙের দল ডেকে চলেছে ঘ্যাঙর ঘ্যাঙ। আনিকা ড্রয়িং রুমের সোফায় বসে আইসক্রিম খাচ্ছে। রুপ তার পাশে বসে ‘দা দা’ বুলি আওড়াতে থাকে। আনিকা চামুচে অল্প করে আইসক্রিম নিয়ে তার মুখে দেয়। ছোট্ট রূপ হেসে সেটা চেটেপুটে খেয়ে নেয়। তার গাল নাক মুখ দিয়ে আইসক্রিম লেগে আছে। সে হাত নাড়িয়ে আরো চায়। আনিকা অল্প করে দিয়ে নিজে খায়। আসমা বেগম চা হাতে নাতনির পাশে বসে। রূপ এবার দাদিকে দেখে বু বু বলে হাত বাড়ায়! আসমা বেগম একহাতে কোলে টেনে নেয়। রূপ অপর হাতে থাকা চায়ের কাপ টেনে নিতে চায়। ‘দা দা’ বলে চিল্লাতে থাকে। আনিকা তার পিঠে একটা কিল বসিয়ে বলে,
-” পঁচা ভাই! যা দেখবে তাই দা দা!”
রূপ ঠোঁট উল্টিয়ে কেঁদে ওঠে। এরমধ্যে অরুণ আসে মেইন দরজা দিয়ে। পরনে স্কাই ব্লু টি শার্ট সাথে ট্রাওজার। মাথায় স্পোর্টস ক্যাপ আছে। সে এসে রূপকে কোলে তুলে নেয়। এটা ওটা আধো আধো বুলিতে তার কান্না থামায়! রূপ হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খাওয়ার অবস্থা। অরুণ তার গালে মুখে আদর করে আনিকার সম্মুখের সোফায় বসে বলে,
-” আনিবুড়ি সকাল সকাল আইসক্রিম খাচ্ছে? ঠান্ডা লাগবে না?”
আনিকা কিছু বলে না। বরং মুখ পুরো করে আইসক্রিম নেয়। অরুণ হেসে বলে,
-” আম্মু আস্তে খাও! গলায় আটকে যাবে তো!’
আনিকা আস্তে খায়! অরুণ ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বলে
,
-” কথা বলছো না কেন আমার সাথে? চাচ্চুর সাথে রেগে আছো?”
তাও কিছু বলে না। আইসক্রিম বক্স হাত নিয়ে উঠে চলে যায় সেখান থেকে অরুণ গলা উঁচিয়ে ডাকে,
-” আনিবুড়ি? কি হয়েছে সোনা? ভোর দুষ্টমি করেছে তোমার সাথে? বলো?”
আনিকা দাঁড়ায় না চলে যায়। অরুণ আসমা বেগমকে বলে,
-” কি হয়েছে ছোট মা? আনি গাল ফুলিয়ে রেখেছে কেন?”
আসমা বেগম চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বললেন,
-” ছাড়ো তো! বাচ্চামো সব! একটু পরেই ঠিক হয়ে যাবে! রাতে কখন ফিরলে?”
অরুণ স্বাভাবিক নেয় ব্যাপারটা!
-” এই তো! দশটার দিকে!”
-” ওহ্! বড় বউ উঠেছে?”
অরুণ রূপকে কোলে নিয়ে উঠে দাঁড়ালো।
-” ওঠে নি বোধহয়!”
আসমা বেগমের কপালে ভাঁজ পড়ে।
-” এটা কেমন অভ্যাস? বিয়ের পর একদিনও তাকে সকাল সকাল উঠতে দেখিনি! সে বাড়ির বড় বউ! তারও কিছু দায়িত্ব আছে সেটা মেয়েটা ভুলে যায়। রান্না বান্না পারে না। ইটস ওকে কিন্তু সকালে উঠে মিনুকে টুকিটাকি সাহায্য করতে পারে। বেচারি সন্তান সম্ভাবা! রুবি কিন্তু সকাল সকালই উঠে। রান্না না করলেও চা বানায়, মিনুকেও সাহায্য করে! তুমি একটু বড় বউকে বুঝিয়ে বলিও অরুণ!”
অরুণের মুখটা গম্ভীর হয়ে যায়।
-” ছোট মা! আমি নতুন সার্ভেন্টের ব্যবস্থা করেছি। সামনের সপ্তাহ থেকে কাজে আসবে। সেই আজ থেকে রান্না বান্নার কাজ করবে। মিনু আপা ছুটিতে থাকবেন।”
আসমা বেগম তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে অরুণের দিকে তাকিয়ে বলে,
-” তোমার বউকে কাজে বলেছি বলে..”
তাকে থামিয়ে দিয়ে অরুণ শান্ত স্বরে বলে,
-” ব্যাপারটা তেমন নয় ছোটমা!পাতা মেয়েটা সারাজীবন স্ট্রাগল করেই গেছে। তার পূর্ববর্তী জীবন মোটেই পুষ্পশয্যা ছিল না আদুরির মতো! থাক সে কথা। মেয়েটা এখন অরুণ সরকারের ওয়াইফ।সো রানির হালে থাকবে সে। আশা করি আমার কথায় কিছু মনে করবে না!”
আসমা বেগম অপমানিত বোধ করে বেশ! চোয়াল শক্ত করে বলে,
-” ভুল হয়ে গেছে আমার তোমার রানিকে কে কাজ করতে বলেছি! আইন্দা হবে না।”
-” ছোট মা..!”
-” থাক অরুণ! আর কিছু বলতে হবে না। তোমার মা হলে নিশ্চয়ই এভাবে বলতে পারতে না!”
অরুণ দীর্ঘশ্বাস ফেলল। কিছু না বলে রূপকে আসমা বেগমের কোলে দিয়ে পা বাড়ায়। হঠাৎ পিছনে ফিরে বলে,
-” আমার মা হলেও নিশ্চয়ই এভাবে রেগে যেতেন না! কান মুলে হেসে উড়িয়ে দিতেন!”
আসমা বেগম অরুণের দিকে তাকিয়ে থাকে। অরুণ চলে যায় হনহন করে। আসমা বেগমের চোখ ভরে যায় নিমিষেই। মা হওয়া কঠিন হলে সৎ মা হওয়া আরো কঠিন। যতোই ভালোবাসো ভালোবাসা নজরে আসে না। একটু ধমক দিয়ে শাসন করলেই আঙ্গুল উঠে যে সৎ মা তাই এভাবে বকছে। অরুণকেও সে ছেলের মতোই ভালোবাসে। আগেও বেসেছে। মাঝে মাঝে সম্পর্কে চড়াই উৎরাই হয়েছে সে মানে। আসমা বেগম আর অরুণের সম্পর্কের অবনতি ঘটে আরিয়ান আসার পর। এর আগে অরুণ তার পিছু পিছুই থাকতো। আরিয়ানকে অরুণ একটুও সহ্য করতে পারতো না। দেখলেই রেগে যেতো। তবুও অরুণ আসমা বেগমকে সমীহ করতো। কিন্তু সেবার অরুণ আরিয়ানকে করুণ ভাবে মেরেছিল। রক্তাক্ত অবস্থা। আসমা বেগম ছেলের এ অবস্থা দেখে পাগল প্রায়। অরুণকেও কথা শুনিয়েছে। ব্যস এরপর থেকে অরুণ তার থেকে অনেক দূরে চলে যায়। আসমা বেগম কাছে টানলেও জেদি অরুণ ফিরেও তাকাতো না। আসমা বেগমের মাঝে মাঝে রাগ হতো। অনিক সরকারের পরলোক গমনের পর অরুণ একটু একটু করে আবার তাদের সাথে জুড়ে যায়। আরিয়ানের সাথে সম্পর্কের উন্নতি হয়। তার সাথেও। তবে কোথাও কোনো খাদ ত্রুটি থেকেই যায়।
তিনি দীর্ঘশ্বাস ফেলে চায়ে চুমুক দেয়। দিয়েই মুখ কুঁচকে নেয়। ঠান্ডা শরবত বনে গেছে চা।
_____
অরুণ রুমে প্রবেশ করে। বিছানায় দুই পাতাবাহার ও তার কলিজা ঘুমে। তার প্রবেশে এক পাতাবাহার হামি তুলে উঠে আসে। পা দুটো টান টান করে হেলতে দুলতে এগিয়েছে এসে মিও মিও করে। অরুণ ঝুঁকে তাকে কোলে তুলে নেয়। গায়ে হাত বুলিয়ে বলে,
-” সুপ্রভাত পাতাবাহার! তুমি খুবই লক্ষীটি। ডাকার আগেই উঠে পড়লে। অথচ দেখো তোমার সখি নাকে তেল দিয়ে ঘুমুচ্ছে!”
বিড়াল শাবক প্রশংসায় বোধকরি খুব খুশি হলো অরুণের দিকে পিটপিট করে কিউট ভঙ্গিতে চাইলো। অরুণ তাকে নামিয়ে দিল। ওয়াশরুম হয়ে এসে বিছানায় বসে। কম্ফোর্ট সরিয়ে দেয় চড়ুই যুগলের উপর থেকে। দৃশ্যমান হয় তার হৃদয় কুঠিবাড়ির জোড়া চড়ুইয়ের মুখখানি। ভোর হা করে উবু হয়ে ঘুমুচ্ছে। পাতা ভোরের পাশ ঘেঁষে এলোমেলো হয়ে শুয়ে আছি। তার একটা পা ভোরের উপর উঠে আছে। মেয়েটার ঘুমের অভ্যাস একেবারে যাচ্ছেতাই। এই যে এখন তার কালো রঙের এক টিশার্ট পড়ে আছে সেটাও এলোমেলো! অরুণ হাত বাড়িয়ে ঠিক করে দেয়। গালে হাত রেখে ডাকে বেশকয়েকবার। পাতা মুখ কুঁচকে বিরক্তিকর ভঙ্গিতে ওপাশে ফিরে শুয়ে পড়ে। অরুণ এবার ছেলেকে ডাকে। ভোরও সেম ভঙ্গিতে গুটিসুটি মেরে মুখ লুকায়। অরুণ বিরক্ত হয়ে বলে,
-” রোজ রোজ তোমাদের এই এক কান্ড কাল থেকে সকাল বেলা আমার সাথে হাঁটতে বের হবে দুজন! এখন ওঠো? পাতাবাহার? ভোর?”
নাহ কারো কোনো রেসপন্স নেই। অরুণ পাতার দিকে এগিয়ে যায়। টি শার্ট গলিয়ে হাত গভীরে নেয়! কাজ হয়! পাতা হুড়মুড়িয়ে উঠে বসে। অরুণের হাত ঝটকা দিয়ে সরিয়ে বলে,
-” ভোরের বাবা আপনার নামে আমি কেস করবো! আমার শান্তির ঘুম আপনার সহ্য হয় না। ধ্যাত বা*ল ভাল্লাগে না। শালার জামাই!”
বলে আবার বালিশে মাথা রাখলো পাতা। চোখে তাঁর এক আকাশ সমান ঘুম! শালার জামাই সারারাত ঘুমোতে দেয় নি এখন কানের কাছে এসে প্যাক প্যাক করছে। সে কর কিন্তু এরকম অসভ্য কাজ করে তার আরামদায়ক ঘুম বাবাজির বারোটা বাজানোর কি দরকার ছিলো! লোকটা মোটেও সুবিধার না! এক নম্বরের আসভ্য লোক! অরুণ আহম্মকের মতো তাকিয়ে! এই মিষ্টি মেয়েটার মুখে এসব বস্তি মার্কা গালি! অরুণ গম্ভীর মুখে পুনরায় পাতাকে টেনে তুলে ঝাড়ি দেয়,
-” এসব বস্তি মার্কা ভাষা কোথায় শিখেছো? আর তোমার সাহস তো কম না আমাকেই বলছো এসব!”
ঝাড়িতে পাতা ভয় পায় না। চোখ বুজেই ভেংচি কেটে বলে,
-” ওসব বস্তি মার্কা ভাষা? তাহলে কাল বন্ধুদের সাথে কি আপনি চাইনিজ ভাষায় গালি দিচ্ছিলেন? আর আমার সাহস তো আপনে দেখেনই নাই! এই পাতার মতো সাহসী মেয়ে পৃথিবীতে দুটো নাই।”
অরুণের শান্ত চোখে তাকিয়ে থাকে পাতার দিকে। পাতা পিট পিট করে এক চোখ খুলে পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করে। অরুণ ছেড়ে দেয় পাতাকে। পাতা ধপাস করে বালিশে শুয়ে পরলো। অরুণ ঝুঁকে আসে ! পাতার উপর সমস্ত ভার ছেড়ে দিয়ে গলার ভাঁজে মুখ গুঁজে বলে,
-” খুব সাহসী তুমি তাই না? চলো একটা পরীক্ষা হয়ে যাক!”
পাতা ভয়ংকরভাবে কেঁপে উঠলো। কাল রাতের অতিশয় ভয়ংকর অভিজ্ঞতা চোখের পাতায় ভেসে ওঠে। সে ছটফট শুরু করে দেয় ছাড়া পাওয়ার জন্য। অরুণ সরকার মুচকি হেসে গলার ভাঁজে চুমুর বর্ষন শুরু করে। পাতা চমকে ওঠে। বক্ষস্থল কেঁপে ওঠে। সে চাপা স্বরে বলে,
-” কি হচ্ছে টাকি ভোরের বাবা! ছাড়ুন!”
অরুণ মাথা তুলে কপালে অধর ছোঁয়ায়।
-” হুম! ওঠো তাহলে?”
-” উঠছি আপনি সরুণ!”
অরুণ সরে আসে! পাতা নাক টেনে কম্ফোর্ট মুড়িয়ে পুনরায় ঘুমোনোর প্রস্তুতি নেয়।
-” আমি এখন ঘুমাবো ভোরের বাবা! সো ডোন্ট ডিস্টার্ব মি! প্লিজ!”
-” স্কুল..”
অরুণকে থামিয়ে পাতা কটমট করে বলে,
-” রাখুন আপনার স্কুল। ঘুমে আমি চোখে অন্ধকার দেখছি। উনি স্কুল নিয়ে পড়ে আছে। যাবো না।”
অরুণের কপালে ভাঁজ পড়ে। মেয়েটার সাহস বেড়ে যাচ্ছে? তাকে ঝাড়ি দিচ্ছে! তবে সে কিছু বলে না। ঘুমোক একটু! সে এসে ছেলেকে তুলে নিয়ে কোলে বসিয়ে ডাকে,
-” কলিজা? আব্বু? ওঠো?”
ভোর চোখ খুলে পিটপিট করে তাকিয়ে বলে,
-” ভোর ঘুম!”
বলে আবার চোখ বুজে। অরুণ ডাকে এতে ভাবান্তর হয় না। সে বাবার গলা জড়িয়ে ধরে ঘুমে কাতর! অরুণ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,
-” ভোর ওঠো? রাতে কিছু খাও নি। ব্রেকফাস্ট করে নাও? এই আনিকার সাথে কি হয়েছে? তুমি কোনো দুষ্টুমি করেছিলে?”
আনিকা নাম কর্ন গহ্বরে প্রবেশ করতেই ভোরের ঘুম ছুটে যায়। মস্তিষ্ক কার্যকর হয়! ভয় ভয় চোখে বাবার দিকে তাকালো। ছেলেকে অরুণ ছেলের থেকেও ভালো চিনে। সে শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করে,
-” কি করেছো?”
ভোর ঢোক গিলে বাবার গলা ছেড়ে সরে যায়।পাতার কম্ফোর্টে ঢুকে তাকে জড়িয়ে ধরে বলে,
-” কিছু করি নি আমি কিছু করি নি।”
পাতা চোখ খুলে ভোরকে বুকে জড়িয়ে ভাঙ্গা ভাঙ্গা গলায় সুধায় ‘কি হয়েছে?’ ভোর কিছু বলে না। অরুণ গম্ভীর স্বরে ডাকল,
-” ভোর ভালোয় ভালোয় বলো?”
-” ভোরের বাবা আমি সামলে নেব! আপনি বাচ্চাটাকে বকবেন না। ভয় পাচ্ছে।”
পাতার কথায় অরুণ আশ্বস্ত হয়। বিছানা থেকে নেমে বলে,
-” দশটা বাজতে চললো! আমি রেডি হয়ে অফিসে চলে গেলাম। আপনাদের নিদ্রা বিলাস হলে লাঞ্চ করে নেবেন!”
বলে প্রয়োজনীয় কাপড় বের করে চেঞ্জ করে আসে। রেডি হয়ে ব্যাগে ল্যাপটপ ফাইল ভরে বিছানায় বসে। ঝুঁকে ঘুমন্ত ছেলে ও ছেলের আম্মুর ললাটে ভালোবাসার পরশ বসিয়ে বেড়িয়ে যায়। তার দুঃখের রাজ্যের সমাপ্তি ঘটলো তবে? সুখ পাখি সুখের সাম্রাজ্যের প্রতিস্থাপন করলো তবে? কি জানি!
বাবা চলে যাওয়ার বেশ সময় পর ভোর চোখ খোলে। আম্মুর বুক থেকে মাথা তুলে উঁকি দেয়। কেউ নেই। সে আম্মুর গালে চুমু দিয়ে উঠে বসে। গুটি গুটি পায়ে নিঃশব্দে হেঁটে বেড়িয়ে যায়। ঘুমে কাতর পাতা টের পায় না। সবার আগে সে স্টাডি রুমে গিয়ে বইয়ের তাকে লুকিয়ে রাখা একটা রেপিং করা বক্স বের করে টি শার্টটায় লুকিয়ে নেয়।
ভোর ড্রয়িংরুমে এসে এদিকে ওদিকে তাকিয়ে কাউকে খুঁজে বেড়ায়। কিন্তু কাঙ্ক্ষিত মানুষকে পায় না। সে গুটি গুটি পায়ে হেঁটে দাদির ঘরের সামনে যায়। দরজা দিয়ে উঁকি দিয়ে দেখে কাঙ্ক্ষিত মানুষটাকে। মুখে হাসি ফুটে ওঠে। ধরাম করে দরজা খুলে ডাকে,
-” আনিবুড়ি?”
আনিকা চমকে উঠে। ভয় ভয় চোখে ভোরের দিকে তাকিয়ে থাকে। ভোর মুচকি হেসে এগিয়ে যায়। হাতে থাকা রেপিং এ মোড়ানো বক্সটি আনির সামনে রেখে কান ধরে বলে,
-” ভোর ভেরি ভেরি স্যরি আনি! এই দেখ আমি কান ধরছি আচ্ছা উঠবসও করছি!”
বলেই উঠবস শুরু করে দেয়। আনিকা ভেংচি কেটে গাল ফুলিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে থাকে। রাতে সে একটু মজা করেছিল। পঁচা ভোর কিভাবে মারলো তাকে! এখন স্যরি বললে হবে? ভোর উঠবস থামায় না।
-” আনি তুই না আমার বোন! ভালো বোন! প্লিজ রাগ করিস না। ওই বক্সে তোর ফেভারিট বারবি ডল আছে। গান গায় সাথে নাচেও! ওটা তোর জন্য এনেছি। রূপের মতো আমিও তোর ভাই হই তাই না? প্লিজ স্যরি!”
আনিকা পিট পিট করে চায়। ভোর প্রথমবার এভাবে তাকে স্যরি বলছে। সে বক্সটা হাতে নিয়ে খুলে। ভোর উৎসাহ নিয়ে তাকিয়ে আছে সাথে উঠবস করে। রাতে রাগে আনিকাকে মারলেও সকালে আনিকার কথা মনে পড়ায় তার কষ্ট হচ্ছিল। আনি তো তার বোন হয়। ছোট বোন! ছোট বোনকে কেউ মারে নাকি! আম্মু এই কথা শুনলে তো ভোরকে বকবে। তাকে পঁচা ভাববে। আদর করবে না। ভালোও বাসবে না। আর আব্বু রেগে যাবে অনেক। তাই সে বারবি ডল নিয়ে স্যরি বলে আনিকাকে। বারবি ডলটা আব্বু অনেক আগে এনেছিল আনিকাকে দেয়ার জন্য ভোর লুকিয়ে রেখে দিয়েছিল। তার আব্বু কেন আনিকাকে গিফট দিবে? এখন গিফটটা কাজে লাগে।
আনিকা বারবি ডল দেখে খুশি হয় বেশ। তার ফেভারিট বারবি। ভোরের উপর সব রাগ উবে যায়।সে মুচকি হেসে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা দাদির দিকে তাকায়। সেখানে দাদি দাঁড়িয়ে আছে ভোর খেয়ালই করে নি। আসমা বেগমের অধরকোনে হাসির ঝিলিক। সে এসে ভোরের মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। ভোর বেশ লজ্জায় পড়ে। মিনমিনে গলায় বলে,
-” দাদি আমি সত্যিই অনেক অনেক স্যরি! তোমাকেও স্যরি!”
বলে মাথা নিচু করে নেয়। আসমা বেগম ভোরকে কোলে তুলে নিয়ে আনিকার পাশে বসিয়ে দেয়। দু’জনের মাথায় হাত বুলিয়ে দোয়া করে। মুচকি হেসে বলে,
-” কখনো কারো সাথে মারামারি ঝগড়া করবে না। মিলেমিশে থাকবে। ভাই বোন তোমরা! ভোর আনি রূপ!”
ভোর মুচকি হেসে আনিকার যে গালে কাল মেরেছিল সেখানে ও মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। আনিকা ভোরের গাল টেনে দেয় শক্ত করে। ভোর রাগে না। মুচকি হাসলো। আসমা বেগম দুজনের কান্ড দেখে হেসে ফেললো শব্দ করে।
চলবে…..
#পাতা_বাহার
লেখনীতে: #বেলা_শেখ
#পর্ব- ৪১ (শেষ অংশ)
(কপি করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ)
সময় মানবজীবনের মুল্যবান সম্পদের মধ্যে একটি। সময় মানুষের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। এটা কারো পক্ষপাত করে না। আমাদের মানবসমাজের একটা প্রচলিত রীতি আছে। তেলা মাথায় তেল ঘষা! যার টাকা পয়সা প্রতিপত্তি ক্ষমতা আছে সমাজে মানুষ তাকে মুখ্য মনি মানিয়ে চলে। তার নিকট মাথা ঝুঁকিয়ে বশ্যতা স্বীকার করে জি হুজুর করে বেড়ায়। হাজার অন্যায় অবিচার করলেও তার বিরুদ্ধে কথা বলার সাহস রাখে না। তার পদতলে বসে বরং আজ্ঞাবহ হয়ে মেনে নেয়। তার বিরুদ্ধে হাজার অভিযোগ থাকলেও কেউ মুখ ফুটে বলতে পারে না। তারা তাদের ক্ষমতা, প্রভাব আর টাকা দিয়েই আইন কানুন কিনে নেন। সবাইকে নিজের গোলাম বানিয়ে ভালোমানুষী মুখোশ পড়ে থাকে। পার্থিব সব কিছুই তাঁরা টাকা যশ ক্ষমতা দ্বারা ক্রয় করলেও সময়ের কাছে তারা বশীভূত। সময় মানবজীবনের একটা অধ্যায়। সময় মানুষকে সঠিক পথ দেখাবে। সেই সঠিক পথে পরিচালিত না হতে পারলে বা ভুল রাস্তায় পর্যবসিত হলেও সময় থামাবে না। তাকে যেতে দিবে। তাকে স্মরণ করিয়ে দিবে যে, সে যে রাস্তায় যাচ্ছে সেটা ভূল। এখন ব্যাক্তি যদি তার ভূল বুঝতে পেরে ফিরে আসে তাহলে তো তুমি বুদ্ধিমান। আর তুমি ব্যাক্তি না ফিরে মোহমায়ায় ডুবে যাও তো তুমি প্রস্তাবে। সময় কিভাবে, কখন তোমাকে মুখ থুবড়ে রাস্তায় ফেলবে সেটা উপর ওয়ালাই ভালো জানেন। কেননা উপর ওয়ালা ছাড় দেন কিন্তু ছেড়ে দেন না। তাই সাবধান! মানবজীবনের প্রতিটি কদম গুরুত্বপূর্ণ! প্রতিটা ন্যানো সেকেন্ড অমূল্য!
শ্রাবনের বর্ষণ শেষে ভাদ্রের চ্যাংটা গরমেও পুড়লো মানব! আশ্বিন মাসে গা’ শিন শিন না করলেও সে বিদায় নিয়েছে কিছু দিন পেরিয়ে গেছে। কার্তিকের সপ্তাহ খানিক চলে গেছে বর্ষপুঞ্জি থেকে। কাঁচা ধানে শীষের দেখা মিলছে। আকাশ চিরে নীলাভ মেঘের দেখা মিলে ক্ষণে ক্ষণে। কখনো তুফান ছোটা পবন তো কখনো কাঠফাঁটা স্তব্ধ রোদেলা দিন। তো কখনো ঝিরিঝিরি বর্ষন। সবেরই দেখা মিলছে এই শরতের কার্তিক মাসে। সরকার বাড়ির আঙিনায় আজ তুফান ছুটো পবনের ছোঁয়ায় পরিবেশ একদম ছটফটে। বাচ্চারা ক্রিকেট খেলছে। ভোর বল হাত বল ছুঁড়ছে ক্রিজে। আনিকা আনাড়ি হাতে ব্যাট ধরে। কখনো কখনো বল ব্যাটে লাগছে। কখনো সে পা দিয়ে সরিয়ে দিচ্ছে। কিন্তু স্ট্যাম্পে লাগছে না। এতেই ভোর তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে বল ছুঁড়ে মারে। কিন্তু বরাবর ব্যর্থ। আর এই ব্যর্থতার ছাপ তার ছোট্ট মুখে স্পষ্ট।তবে সে হার মোটেই মানে নি। আভারি এখানে বল বাহক হিসেবে কাজ করছে। দূরে বল চলে গেলে বাচ্চাদের কুড়িয়ে এনে দিচ্ছে। মিনু দূরে ছায়ায় বসে তাদের খেলা দেখছে। ভোর আজকাল তার আশেপাশে তেমন ঘেঁষে না। একটু দূরে দূরেই থাকে। আগের মতো আবদারও করে না। কোলে উঠে আদরের জন্য গাল বাড়িয়ে দেয় না। সে জিজ্ঞেসও করেছে ভোরের সাদাসিধে জবাব,
-” তুমি তোমার বাবুকে নিয়েই এখন ব্যস্ত থাকো। তাকেই আদর করো বেশি বেশি। ভোরকে তো ভুলেই গেছো! ভোর বাবা ডেকে কোলে নাও না! আদর করো না। খাইয়ে দাও না।”
মিনু ছুটিতেই আছে আজকাল। ছয়মাস পেরিয়ে গেছে তার। পেটটা বেশ উঁচু হয়ে আছে। হাঁটা চলা তেমন করে না। পা দুটো ফুলো হয়ে আছে। ডাক্তারের শরণাপন্ন হয়েছে তবুও ফলাফল মিলে নি। ডাক্তার বলেছে ইটস নরমাল। ঠিক হয়ে যাবে। পাতা বেলকনিতে বসে আছে চুপচাপ।তার নীরবতার সঙ্গী পাতাবাহার! সে পাতার পায়ের আছে চুপটি করে বসে। পাতার চেহারায় তার লাবণ্য ফিরেছে। আগের চেয়ে হালকা স্বাস্থ্য বেড়েছে যার দরূণ গায়ের রঙটা আরো ফুটেছে। সৌন্দর্য যেন ঠিকরে বেরিয়ে আসতে চায়! কাঁধ সমান চুল গুলোও বড় হয়েছে। পিঠের নিচে নেমে এসেছে। সে মোটেও চুল বড় করার পক্ষে না। তবে যেখানে স্বয়ং অরুণ সরকারের আদেশ সেখানে তার চলে না।
চার চারটা মাস পেরিয়ে গেল অথচ আজও সে লোকটাকে ভালো করে চিনতেই পারে নি। এ লোক যেন ক্ষণে ক্ষণে তার রূপটা চেঞ্জ করে। এই একজন আদর্শ স্বামী, তো এই এক কঠোর গার্ডিয়ান। আদর যত্নে ডুবিয়ে দিবে; অতিরিক্ত আদর যত্নে যেই না পাতা একটু আহ্লাদী হবে। অরুণ সরকার এক ধমকে বসিয়ে দিবে পূর্বের জায়গায়। পাতা ধমক শুনে শান্ত হয়ে যায়। তো কখনো কখনো কোমড়ে আঁচল বেঁধে ঝগড়া বাঁধিয়ে দেয়।
মাঝে মাঝে পাতা ঝাড়ি খেয়ে গাল ফুলিয়ে নেয়। অভিমান করে কথা বলে না। ভাবে লোকটা তার অভিমান ভাঙ্গাবে। কিন্তু না! অভিমান ভাঙ্গানো দূরের কথা! আরেকটা ঝাড়ি দিয়ে বসিয়ে রাখবে। পরে মহারাজের রাগ কমে গেলে মাথায় হাত বুলিয়ে বাচ্চাদের মতো বুঝ দিবে! কিসের যেন জাদু করে বশে আনে! অবুঝ পাতা বশীভূত হয়ে বুঝ মেনে নেয়। পাতা মাঝে মাঝে ভাবে সে আগের পাতু টি নেই। তার পরিবর্তনের সাধিত হয়েছে।সে তো এমন ছিল না! আগের পাতা শ খানেক অবহেলা, তাচ্ছিল্য, কটুক্তি র সামনে বুক ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতো। আবেগ ধরে রাখতে জানতো! লোকসম্মুখে তার দূর্বলতা লুকিয়ে নিতো হাসি মুখে। অথচ বর্তমান পাতা চিমটি পরিমাণ অবহেলার স্বীকার হলেও নিজেকে ধরে রাখতে পারে না। নেত্রযুগল আবেগে টইটুম্বুর হয়ে যায়। দূর্বলতা চোখে ভাসতে থাকে উজানের ঢেউয়ে। সামনের মানুষ টি খুব সহজেই বুঝে নেয় সেই দূর্বলতা! পাতা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। বর্তমান নিয়ে তার তিল পরিমাণ অভিযোগ নেই। সে বেশ আছে স্বামী সন্তান নিয়ে। এরকম হাসিখুশি আগের পাতু কখনোই ছিল না। তার জন্য এতো গুরুত্ব, এতো যত্ন ভালোবাসা সে যে কখনো কারো চোখেও দেখেনি। তবে মাঝেমধ্যে ভয় হয়! এসব সময়ের সাথে সাথে কর্পূরের মতো উবে না যায়। তার ভাগ্যটা খুবই প্রসন্ন কি না!! সুখপাখি তার মন প্রসূণে আসে, বসে! প্রয়াত কাল পর ঘটা করে বিদায় নিয়ে চলেও যায়। আজকাল পাতার কেমন অদ্ভুত ধরনের অনুভূতি হয়। কিছু একটা শূন্যতা অনুভব করে। কিন্তু সেই শূন্যতা কি ঠাহর করতে পারেনা। কিন্তু শূনতা’টা তাকে খুব পোড়ায়। সে লক্ষ্য করেছে যখন ওই নাক উঁচু ম্যানারলেস লোকটা তার আশেপাশে থাকে তখন অদ্ভুত ভালো লাগা কাজ করে। মনে হয় সর্বক্ষণ তার সাথেই লেগে থাকতে। লোকটার সাথে থাকলে সে সব কিছুই ভুলে যায়। মস্তিষ্কের ভিতরে লোকটাই কিলবিল করে। লোকটা দূরে গেলেই বুকটা হাহাকারে ভরে ওঠে। এই তিনমাসে পাতার সাথে আরেকটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটেছে। যে শাশুড়ির সামনে যেতে তার বুকটা দূরু দূরু করতো তার সাথেই তার সখ্যতা গড়ে উঠেছে। কাওছার ভাই ও পাবেল ব্যাতিত তার নতুন এক অসমবয়সী বন্ধুর আগমন ঘটেছে। অরুণের অনুপস্থিতিতে ভোর, আনি,রূপ ও আসমা বেগমের সাথেই তার সময় বেশি কাটে। বাচ্চারা খেলায় ব্যস্ত থাকে। সে আর তার শাশুড়ি টুকটাক কথা বলতে বলতে কিভাবে যেন তাদের মাঝে অনেক ভাব চলে আসে। হাসি ঠাট্টায় মেতে থাকে। পাতা খেয়াল করেছে আসমা বেগম মোটেও গম্ভীর নন। সে গাম্ভীর্যের ভান ধরে থাকে। সেও এক প্রাণোচ্ছ্বল ভালো মনের মানুষ। অনেকটাই নারকেলের মতো উপরে শক্ত হলেও ভিতরে নরম। সে আরেকটা বিষয় খেয়াল করেছে তার শাশুড়ি তাকে অনেক স্নেহ করে! রুবি আপুর থেকেও বেশি! কেন? সে উত্তর পায় না। তবে তার ভালো লাগে তার সাথে মিশতে। তার স্নেহ উপভোগ করতে। মাঝে মাঝে মা মা গন্ধ পায় তার থেকে। তাঁরা বউ শাশুড়ি বাচ্চা কাচ্চা সহ বেশ কয়েকবার ঘুরতে বেড়িয়েছে। সাফারি পার্ক, নদীর ঘাট, রেস্টুরেন্ট, শাপলা বিল সহ শহরের আনাচে কানাচে ঘুরে বেড়িয়েছে। বাড়ির আঙিনা থেকে ভেসে আসা তীব্র গাড়ির হর্নের শব্দে পাতা ভাবনাচ্ছেদ ঘটে। সে ভ্রু কুঁচকে চায়। কে এলো? আরিয়ান ভাই নাকি! নাহ্। সে না! পাতার অধর কোণে মিষ্টি হাসির রেখা ফুটে ওঠে। এই নাক উঁচু লোক আজ এতো জলদি? সবে তো চারটা বাজে। পাতার ইচ্ছে করে ভোরের মতো দৌড়ে গিয়ে লোকটাকে জড়িয়ে ধরতে। কিন্তু সে যায় না। গ্রিল ধরেই পলকহীন তাকিয়ে থাকে। কালো স্যুট বুট পড়ে লোকটা গম্ভীর মুখে ভোরের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। ভোর বাবাকে দেখে নিত্যদিনের মতো সব কাজ ফেলে দৌড়ে তার কোলে উঠে গলা জড়িয়ে ধরে।
অরুণ ছেলেকে কোলে তুলেই আদরে আদরে ভরিয়ে তোলে। কিন্তু ছেলের বিষন্ন মুখটা দেখে বলে,
-” কি হয়েছে আব্বু? মুখটা এমন দেখাচ্ছে কেন?”
-” কিছু না!”
বলে ভোর বাবার গলার ভাঁজে মুখ লুকায়। অরুণের কপালে চিন্তার রেখা ফুটে ওঠে। এরমধ্যে আনিকা ব্যাট হাতে এগিয়ে আসে। ছোট প্যান্ট আর টিশার্ট পরনে। মাথায় স্পোর্টস ক্যাপ! অরুণ ছেলেকে একহাতে সামলিয়ে অপর হাতে আনিকাকে টেনে কোলে তুলে আদর করে। ভোর মাথা তুলে গম্ভীর মুখে চায়। আব্বু আনি’কে আদর করবে কেন? আনিকা তার চাচ্চুর গলা জড়িয়ে বলে,
-” বড় চাচ্চু তুমি আজ এতো জলদি এলে কেন? এসেছো ভালো হয়েছে! চলো আমরা ক্রিকেট খেলি?”
-” উম্। খেলা যায়! দাঁড়াও আমি চেঞ্জ করে আসি। তোমরা ততক্ষণে খেলো! আচ্ছা?”
আনিকা খুশি হয়ে মাথা নাড়ে। কোল থেকে নেমে ব্যাট নিয়ে দৌড়াতে দৌড়াতে বলে,
-” চাচ্চু? আমি আর তুমি এক টিমে কিন্তু!”
অরুণ সায় জানিয়ে ভোরের দিকে তাকায়। ভোর গাল ফুলিয়ে তার গলা ছেড়ে দিয়ে বলে,
-” তোমরাই খেলিও! আমি খেলবো না।”
অরুণ ছেলেকে পাঁজা কোলে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বলে,
-” আমার কলিজাটা এতো হিংসুটে! আচ্ছা বাবা খেলবো না। এখন বলো তো আমার চড়ুই পাখিটা চুপ করে আছে কেন?”
ভোর পিটপিট করে তাকালো। অবাক সুরে বলল,
-” আব্বু তোমার চড়ুই পাখি আছে?”
অরুণ মুচকি হেসে ঝুঁকে আসে। ছেলের ঠোঁটে চুমু বসিয়ে বলে,
-” এই তো আমার ছোট্ট চড়ুই পাখি।”
ভোর হেসে উঠলো খিলখিলিয়ে। সে চড়ুই পাখি? কই তার তো ডানা নেই? সে তো উড়তেও পারে না! না তার পাখির মতো ঠোঁট! অরুণ চঞ্চল প্রাণোচ্ছ্বল ছেলেকে বুকে জড়িয়ে বলে,
-” এখন বলোতো কলিজা? কি হয়েছে আমার মানিকের?”
ভোরের হাসি থেমে যায়। পিটপিট করে বাবার দিকে তাকালো। চোখটা নিমিষেই নোনাজলে ভরে ওঠে। প্রতিবারের মতো আজও স্কুল ছুটির শেষে আম্মুর সাথেই ছিল। আম্মু তাকে টিচার্স রুমে বসিয়ে দিয়ে প্রতিবারের মতো ক্লাস নিতে চলে যায়। ভোরের একা বসে থাকতে মোটেও ভালো লাগছিল না। তার উপর সব টিচাররা কেমন করে তাকাচ্ছিল যেন সে চুরি করতে এসেছে। তাই সে ব্যাগ রেখে গুটি গুটি পায়ে বেড়িয়ে আসে। এদিকে ওদিকে হাঁটতে হাঁটতে আম্মুর ক্লাসরুমে গিয়েছিল। তখন ক্লাসের শিক্ষার্থীরা কিউট ভোরকে দেখে চিল্লিয়েই উঠেছিল একপ্রকার। তাকে টেনে এ কোলে ও কোলে নেয়ার জন্য হৈ হুল্লোড়ে মাতিয়ে দিয়েছিল! শান্ত পাতা তাদের ধমক দিয়ে থামিয়ে দিয়েছে। ভোরকে হালকা শক্ত গলায় বলেছিল,
-” ভোর যাও টিচার্স রুমে? এভাবে ক্লাসে ঢুকে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির করবে না।”
ভোর ‘স্যরি’ বলে টইটম্বুর চোখে বেড়িয়ে এসেছে। তার রাগ হয়েছিল বেশ। তবে আম্মু এলে আবার স্যরিও বলেছিল। পাতা অবশ্য আর কিছু বলে নি। বুঝিয়ে বলেছে এভাবে ক্লাসে এলে তো পড়ানোয় বিঘ্ন সৃষ্টি হয়। তাই যেন না আসে। ভোর বাধ্য ছেলের মতো মাথা নাড়িয়ে ছিল। পাতাও মুচকি হেসে তাকে আদর করেছিল। কিন্তু ভোরের মনে হচ্ছে আম্মু তাকে পঁচা দুষ্টু ছেলে ভাবছে। তাকে এড়িয়ে চলছে। তাঁর সাথে রাগ করেছে।তাই সেও মনে মনে রাগ করে। অরুণ গম্ভীর মুখে পুরো কাহিনী শোনে। তবে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে না। ভোর পুনরায় বলে,
-” আব্বু তুমি কিন্তু আম্মুকে বলবে না এসব?”
অরুণ তার কথার জবাব না দিয়ে বলে,
-” কাল থেকে তোমার স্কুল ছুটি হলেই তুমি বাড়ি ফিরবে। ইটস মাই অর্ডার। কোনো জেদ না! আমি আভারি ভাই ও ড্রাইভারকে পাঠাবো!”
-” আব্বু..”
-” নো মোর ওয়ার্ডস!”
ভোর চুপ হয়ে যায়। বুঝতে পারলো আব্বুকে বলা মোটেও উচিত হয় নি। তার ফুলো গাল আরো ফুলে ওঠে। অরুণ ছেলেকে কোলে নিয়েই রুমে প্রবেশ করে। তার আগমনের শব্দে পাতা ও বিড়ালটি এগিয়ে আসে। বিড়ালটিও তার সখির মতো গুলুমুলু হয়েছে বেশ। বড়ও হয়েছে কিছুটা। সে লেজ নাড়িয়ে পাতার আগেই অরুণ অবধি পৌঁছে যায়। মিও মিও করে খুশি প্রকাশ করে যে তার আগমনে সে কতটা খুশি। পাতা এসে হাসিমুখে সুধায়,
-” আজ জলদি এতো ফিরলেন যে?”
-” তো ফিরে যাবো পাতাবাহার?”
তীক্ষ্ণ কথার ধারে পাতার নাক মুখ কুঁচকে যায়। এই নিরস লোকটার মুখে রসের ছিটেফোঁটাও নেই।
-” রোজ দেড়ি করে আসেন। আটটার আগে দেখাই পাওয়া যায় না। আজ জলদি ফিরলেন তাই জিজ্ঞেস করলাম। ভুল হয়ে গেছে আমার কৃপা করে ক্ষমার চোখে দেখবেন!”
অরুণ ছেলেকে সোফায় বসিয়ে দিয়ে পাতা মাথায় গাট্টা মেরে বলে,
-” আলমারি থেকে জামা কাপড় বের করো। গোসল করবো!”
বলেই ব্লেজার, কটি, শার্ট একে একে খুলে ছুঁড়ে ফেলে। বিছানায় বসে শু মুজো খুলে গা এলিয়ে দেয়। পাতা হতাশ ভঙ্গিতে ফ্লোর থেকে সব তুলে ভোরের পাশে রাখে আলমারি থেকে কাপড়চোপড় বের করে ওয়াশ রুমে রেখে দেখে লোকটা ওভাবেই শুয়ে আছে। ভোর সোফায় বসে বিড়ালটিকে আদর করতে ব্যস্ত। পাতা বিছানায় পা তুলে বসে নির্দ্বিধায় অরুণের কপালে হাত রেখে সুধায়,
-” খারাপ লাগছে? মাথা ব্যাথা?”
অরুণ লম্বা শ্বাস টেনে কপালে রাখা পাতার হাত টেনে অধর ছোঁয়ায়। ইচ্ছে করে ছোট্ট কোলটায় মাথা রেখে বলতে ‘একটু মাথায় হাত বুলিয়ে চুলগুলো টেনে দাও পাতাবাহার!’ কিন্তু অরুণ করে না। যত্ন হীন বড় হওয়া অরুণের স্বভাব না বিগড়ে যায় আদরে। সে উঠে বসল।
-” না! একটু টায়ার্ড লাগছে। ফ্রেশ হলেই ঠিক হয়ে যাবে! ক্ষুধা লেগেছে আমার।”
বলেই ওয়াশ রুমে চলে যায় অলস পায়ে। পাতা তড়িঘড়ি করে নিচে চলে আসে। সুফিয়াকে ডাকে ব্যস্ত গলায়। অথচ সুফিয়ার সাড়া নেই। সুফিয়া এ বাড়িতে নতুন কাজের মেয়ে। সে বিরক্ত হয়। আসমা বেগম রূপের ছোট্ট হাত ধরে এগিয়ে আসেন। ছোট রূপ এখন হাঁটতে পারে টলোমলো পায়ে। পাতাকে দেখেই রূপ ‘আমা আমা’ বলে এগিয়ে আসে দাদির হাত ছেড়ে। পাতা কোলে তুলে নিয়ে ফুলো গালে চুমু খায়। আসমা বেগম হেসে বলে,
-” হয়েছে টাকি পাতু? সুফিয়াকে ডাকছো কেন?”
পাতা অসহায় ফেসে বানিয়ে বলে,
-” উনি এসেছে একটু আগে।গোসলে আছেন। ফ্রিজে ভাতের বোল ফাঁকা রুটিও দেখছি না।”
-” তাই সুফি সুফি ডাকছো! উনি টা তোমার। তার খাবার দাবারের দায়িত্ব কি সুফির? সুফি নেই!”
পাতার মুখখানি ফাটা বেলুনের মতো চুপসে যায়। আসমা বেগম কিচেনের দিকে যেতে যেতে বলে,
-” মহারানী পাতা! আপনি বোধহয় জানেন না পুরুষ মানুষকে হাতে রাখতে চান তো ভালোবেসে রান্না করে পেট পুরিয়ে খাওয়ান।”
পাতা রূপকে কোলে নিয়ে তার পিছু পিছু যেতে যেতে জবাব দেয়,
-” রান্নার প্রতি আমার ছিটেফোঁটা আগ্রহও কাজ করে না। রান্নাবাদে আমায় যে কাজ দাও আমি রাজি তবে রান্নার কথা বললেই অলসতা ঘিরে ধরে। রান্না করা এক আকাশ সাধনার ব্যাপার!”
আসমা বেগম আলু ও ডিম সিদ্ধ দেয় দুটো। ফ্রিজ থেকে দুপুরে রান্না করা কষা মাংস বের করে গরম করতে দেয়। আটার বড় বৈয়াম বের করে গুলে খামি বানায়। পাতা রূপকে নিচে নামিয়ে বলে,
-” আমিও সাহায্য করি! বলো কি করতে হবে?”
-” থাক! আপনার উনি দেখলে কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে। তার রাজ্যের রানিকে দিয়ে আমি রান্না করাচ্ছি!!”
পাতা মুচকি হেসে বললো,
-” বেশি বেশি বলো তুমি! আমি হেল্প করছি বলো?”
আসমা বেগম আলু সিদ্ধ দেয়া কড়াই থেকে আলু ও ডিম নামিয়ে বাটিতে রাখে।
-” এটা পানি ঢেলে ঠান্ডা করে ছিলে দাও!”
পাতা তার কথামতোই কাজ করে। আসমা বেগম আলু ছেনে নিয়ে বিভিন্ন মশলার গুঁড়োর সহীত ভর্তা বানিয়ে আটার সাথে মাখিয়ে বেলে নেয়। ঘিয়ে ভেজে বানিয়ে নেয় আলুর পরোটা। পাতা তার পাশে দাঁড়িয়ে সবটা ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করে। আসমা বেগম পাতাকে দিয়ে প্লেট আনিয়ে সাজিয়ে দেয় সব খাবার। দুটো সিদ্ধ ডিম, চারটা আলুর পরোটা, কষা মুরগির মাংস। ব্যস! পাতা শাশুড়ি নামক নতুন বান্ধবীকে জড়িয়ে ধরে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে খাবার নিয়ে রুমে যায়। দেখে বাবা ছেলে সোফায় বসে বিড়াল নামক জঞ্জালটিকে আদর করছে। পাতার গা টা জ্বলে উঠলো। কি দিনকাল পড়লো পাতু ওই বিড়ালের বাচ্চাকে দেখে হিংসায় জ্বলিস!
সে এগিয়ে এসে বলে,
-” ওটাকে সরান? খাবার এনেছি! ওর লোম উড়ে এসে পড়বে।”
ভোর কিছু না বলে বিড়ালটিকে বাবার কোল থেকে নামিয়ে দেয়। বিড়ালটি মিও মিও করে সরে গিয়ে বিছানায় বসে আড়চোখে চায়। পাতা টি টেবিলে খাবার রেখে বিছানায় থেকে ভেজা তোয়ালে নিয়ে অরুণের সামনে দাঁড়ায়। অরুণ ভ্রু কুঁচকে কিছু বলবে পাতা তোয়ালে তার মাথায় রেখে সযত্নে মুছে দেয়।
-” ভালোভাবে মুছেন নি! ঠান্ডা লেগে যেতো!”
অরুণের অধরে হাসি ফুটে উঠতে চায় গম্ভীর অরুণ অগোচরে লুকিয়ে রাখে। পাতা তোয়ালে বেলকনিতে মেলে দিয়ে আসে। দেখে অরুণ খাবারে হাত দেবে।
-” আরে আরে ভোরের বাবা করছেন টাকি! বিড়াল ধরে ছিলেন। হাত না ধুয়েই..”
অরুণ উঠে দাঁড়াবে পাতা তাকে থামিয়ে দিয়ে ওয়াশ রুমে গিয়ে নিজে হাত ধুয়ে এসে প্লেট হাতে তুলে নেয়। অরুণের কপালে ভাঁজ পড়ে। মুখ খুলে কিছু বলবে এর আগে পাতা তাঁর মুখে খাবার পুরে দেয়। অরুণ খাবার চিবানো ভুলে যায়। ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। পাতার ওসবে ভাবান্তর নেই। সে এবার ভোরের মুখে দেয় পরোটা। ভোর মিষ্টি হেসে চিবোতে থাকে। অরুণ নিজেকে ধাতস্থ করে খাবার গলাধঃকরণ করে তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে পাতার দিকে তাকিয়ে বলে,
-” বাহ্ পাতাবাহার! আজ এতো যত্ন আত্তি।ব্যাপারখানা কি?”
পাতা তার মুখে পুনরায় খাবার পুরে দিয়ে বলে,
-” বিশটা সিতাহার! পনেরো জোড়া বালা! পাঁচ জোড়া ঝুমকা আবদার করবো! তাই একটু আকটু.. নিন ভালো করে খান তো?”
অরুণ সোফায় গা এলিয়ে দেয়। ভোর চিন্তা ভাবনার পর বলে,
-“ও আম্মু এতো কিছু দিয়ে তুমি কি করবে?”
পাতা মুচকি হেসে সিরিয়াস গলায় বলল,
-” ছেলের বউ পছন্দ করে রেখেছি! তাকে আনতে হবে না? তার জন্যই এতোসব। এই ভোর কম হবে গয়না?”
ছোট্ট ভোরের ফর্সা মুখশ্রী নিমিষেই লাজে রাঙা হয়ে যায়। সে কাঁদো কাঁদো মুখ বানিয়ে বলে,
-” তোমরা একটুও ভালো না। বলেছি না? করবো না আমি বিয়ে। আব্বুকে করাও বিয়ে!”
বলেই দৌড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। অরুণ হেসে উঠলো শব্দ করে। পাতা ভোরকে পিছু ডাকে খাওয়ার জন্য ভোর শুনলে তো! পাতা অরুণের দিকে তাকালো। অরুণ হাসি থামিয়ে গম্ভীর মুখে বলো,
-” খাবার নিয়ে বসে থাকবে?”
পাতা ভেংচি কেটে খাবার মুখে দেয়। অরুণ আস্তে ধীরে সবটুকু খাবার শেষ করে। পাতা গ্লাসে পানি ভরে গ্লাস দেয়। সব গুছিয়ে রুম থেকে বেড়োবে অরুণের কথায় কদম থেমে যায় তাঁর।
-” স্কুলে কি হয়েছিল আজ? ভোরকে বকেছিলে কেন?”
পাতার বুকটা কেমন যেন করে উঠলো। অজানা অনুভূতি টগবগিয়ে বেড়ে গেল। সে নিজেকে শান্ত করে। অরুণ আবার বলে,
-” বাচ্চা ছেলে! তখনই ভালোভাবে বুঝিয়ে বললেই হতো! ক্লাসের সকলের সামনে শক্ত করে কথা না বললেও পারতে পাতাবাহার!ছেলেটা কষ্ট পেয়েছে!”
পাতার নিঃশ্বাস যেন আটকে গেলো। সে বকেছিল? শক্ত গলায় কথা বলেছে? অথচ লোকটা সর্বক্ষণ ছেলেটাকে ধমকাবে , শাসন করবে। বেশি জেদ করলে গায়ে হাত অবধি তোলে। পাতা একটু শাসন করেছে। সেই হক কি তার নেই? কৈফিয়ত দিতে হবে! পাতা পলক ঝাপটে নিজেকে ধাতস্থ করে। ঢোক গিলে পিছনে ঘুরে শান্ত চোখে অরুণের দিকে তাকিয়ে বলে,
-” আই এম স্যরি! আর কখনোই হবে না!”
অরুণ দীর্ঘশ্বাস ফেলে সোফা থেকে উঠে আসে। পাতার সম্মুখে দাঁড়িয়ে তাঁর মাথায় হাত রেখে নম্র কন্ঠে বলে,
-” ডোন্ট মাইন্ড বাট প্লিজ ওর সাথে রূড বিহেভ করবে না। ও খুবই সেনসিটিভ! ভাববে যে আমি বকি, শাসন করি, মারি! তাহলে তুমি কেন করতে পারবে না! ইটস আ ফ্যাক্ট। ও ছোট থেকেই আমার কোলে পিঠেই বড় হয়েছে। ও শাসন, বকাঝকা, মার যেটা বলো আমার কাছ থেকেই পেয়েছে। আমি ব্যতিত মনে হয় না খুব কেউ ওকে বকেছে বা শাসিয়েছে! মারা তো দূরের কথা! আর কেউ যদিও বকা দিয়ে থাকে ও খুব রিয়েক্ট করে বসে। রিয়েক্ট বলতে চিল্লাচিল্লি না। ও ব্যাপারটা নিয়ে মনে মনে ভেবে অনেক কষ্ট পাবে। লোক সম্মুখে হাসলেও মনটা তার বিষন্নতায় ভরে থাকবে। একা একা কাঁদবে কাউকে বুঝতে দিবে না! ও তোমার থেকে সবসময় আদর ভালোবাসাই পেয়েছে। মনে হয় না কখনো মিছেমিছিও বকেছো! হুট করে এভাবে বিহেভ করেছো তাই কষ্ট পেয়েছে বেশ! ওকে আবার বলো না যে আমি বলেছি তোমাকে! আর হ্যাঁ কাল থেকে ও ছুটি হলেই বাড়ি ফিরবে। ডিস্টার্ব করবে না তোমায়! ”
-” মনে থাকবে!”
বলে পাতা পা বাড়ায়। ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। সে রূঢ় আচরণ করেছে ভোরের সাথে? করেছেই তো! ওভাবে শক্ত করে কথা বলা ঠিক হয় নি। ভোর কষ্ট পেয়েছে অনেক। বাবার কাছে নালিশ করেছে! পাতা কিচেনে সব রেখে আসে। ভোরকে খুঁজতে থাকে। বাইরে গিয়ে দেখে মিনু আপার কাছে বসে আছে চুপচাপ। সে এগিয়ে যায়। পথিমধ্যে আসমা বেগম এগিয়ে আসে রূপকে পাতার কাছে দিয়ে বলে,
-” মুখটা মলিন হয়ে আছে কেন? কি হয়েছে?”
পাতা হালকা হেসে বলে,
-” কিছু না!”
আসমা বেগমের সন্দেহ হয় তবে গুরুত্ব দেয় না। রূপকে রেখে আনিকার কাছে যায়। নাতনি আবদার করেছে তার সাথে ব্যাট বল খেলতে! পাতা রূপকে নিয়ে ভোরের কাছে যায়। ছোট রূপ পাতাকে পেয়ে খুব খুশি। পাতাকে পেলে তার চোখে মুখে আলাদা দ্যুতি ছড়িয়ে পড়ে যেন! রূপকে পাতার কোলে দেখে ভোরের চোখে মুখে আঁধার নামলো যেন! নাকের পাটা ফুলিয়ে চুপচাপ বসে থাকে। পাতা ভোরের পাশ ঘেঁষে বসে রূপকে নামিয়ে দিল! রূপ একটু হেঁটে গিয়ে আবার ফিরে আসে ‘আ’মা আ’মা’ বুলি আওড়িয়ে। ব্যস! ভোরের সহ্যের সীমা লঙ্ঘন করলো। তার আম্মুকে কেন মা বলবে? সে তড়িৎ বেগে পাতার কোলে বসে গলা জড়িয়ে তার জায়গা দখলে নিলো! পাতা প্রথমে ঘাবড়ে গেলেও ব্যাপারটা বুঝতে পেরে হাসে! রূপ সেটা দেখে আর এগোয় না! ধপ করে মাটিতে বসে ‘আ’মা আ’মা’ বলে চিল্লিতে থাকে। ভোর ঘার ফিরিয়ে তাকে জিভ উল্টিয়ে ভেঙায়। ব্যস রূপের চিল্লানো বেড়ে যায়! পাতা ভোরকে কোলে রেখেই উঠে দাঁড়ালো। ছেলেটা সাপের মতো পেঁচিয়ে ধরেছে। যেন রূপ তাকে নিয়ে পালিয়ে যাবে! সে রূপের সামনে দাঁড়াতেই রূপের কান্না থেমে যায়! সে কুটুর মুটুর পাতার দিকে তাকিয়ে ফোকলা দাঁতে হেসে আ’ মা ডাকে।
-” পঁচা রূপ! তোর মা অফিসে। তার কাছে গিয়ে ডাক! খবরদার আমার আম্মুকে আ’মা’ ডাকলে তোর ওই তিনটে দাঁত আমি ভেঙ্গে ফেলবো!”
ভোরের ভর্ৎসনা শুনে রূপ খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো। হাসতে হাসতে ঘাসে আচ্ছাদিত জমিনে গড়াগড়ি খাচ্ছে। পাতা হেসে বলল,
-” ভোর দেখো কি সুন্দর করে হাসছে? একদম তোমার মতো লাগছে!”
ভোর তাকালো না।
-” ও আম্মু বাড়ি চলো!”
রূপ হাসি থামিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে পাতার পা জড়িয়ে ধরে। মানে সেও যাবে! কোলে নাও! পাতা নেয় না। মিনুর দিকে তাকিয়ে বলে,
-” মিনু আপা? রূপকে দেখো একটু! আমি আসছি!”
বলে হাঁটা শুরু করে। রূপ আ’মা আ’মা বলে পাতার পিছনে হাঁটতে থাকে। মিনু আস্তে আস্তে উঠে রূপকে কোলে তুলে নেয়।
পাতা ভোরকে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে নরম গলায় ডাকে,
-” ভোর?”
-” হুম?”
-” স্কুলে আমি তোমাকে বকে ছিলাম?”
ভোরের ছোট্ট বুকটা কেঁপে উঠলো। পাতা আবার বলে,
-” আমার কথায় কষ্ট পেয়েছে ভোর সোনা?”
-” আম্মু আমি একটুও কষ্ট পাই নি। আব্বু এমনি এমনি বলেছে! আব্বু আব্বু..”
কথা জড়িয়ে আসে ভোরের। ফোঁস ফোঁস করে শ্বাস টানছে। পাতা ভোরকে নামিয়ে দিয়ে তার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে। ভোর নাক ডলে বলে,
-” আম্মু আমি একটুও কষ্ট পাই নি!”
বলে দৌড় লাগালো বাড়ির দিকে। পাতা ডাকে শোনে না। ভোর এক দৌড়ে সিঁড়ি বেয়ে উপড়ে ওঠে রুমে গিয়ে বাবাকে খোঁজে ,পায় না। স্টাডি রুমের দরজা ধরাম করে খুলতেই দেখতে পায় বাবাকে। অরুণ ফোনে কথা বলছে ডিভানে বসে! ভোরের ক্রন্দনরত ফোঁস ফোঁস করে করা আদুরে মুখটা দেখে কপালে ভাঁজ পড়ে। ফোন কেটে দিয়ে বলে,
-” ভোর কি হয়েছে? ওভাবে শ্বাস টানছো কেন?”
ভোর দৌড়ে এসে অরুণকে এলোপাথাড়ি কিল থাপ্পড় লাগাতে থাকে। অরুণ উদ্বেগ প্রকাশ করে জিজ্ঞেস করে ‘কি হয়েছে ?’ ভোর মারের গতি বাড়িয়ে দিল। ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল,
-” মানা করেছিলাম না আমি? বলেছিলাম না আম্মুকে না বলতে! তুমি পঁচা আব্বু! আম্মুকে বকেছো তুমি? আম্মু কষ্ট পেয়েছে! তুমি একটুও ভালো না আব্বু!”
অরুণ বুঝতে পারলো ব্যাপারটা। পাতাবাহার নিশ্চয়ই ছেলেটাকে বলেছে। সে ভোরকে কোলে তুলে নেয় জোড় করে। ভোর হাত পা ছুড়তে থাকে। কামড় বসিয়ে দেয় অরুণের বুকে। অরুণ কিছু বলে না। এরমধ্যে পাতা আসে। ভোরকে ডাকতেই ভোর বাবাকে ছেড়ে সোজা হয়ে বসে। অরুণ পাতার দিকে তাকায়। যার অর্থ মানা করেছিলাম আমি! পাতা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভোরকে কোলে তুলে টেবিলের উপর বসিয়ে দেয়। ছোট্ট মুখটা আঁজলায় ভরে ছোট ছোট চুমু দিয়ে আদরে ভরিয়ে দিল।
-” এটা ওটা সব বলো!রোহানের আম্মুর কথায় কষ্ট পেয়েছিলে! রোহান কথা বলে না কষ্ট পেয়েছিলে! মিনু আপা কোলে নেয় না কষ্ট পাও। আব্বু বকলে মারলে কষ্ট পাও! সব কষ্টের কথা আম্মুকে বলো আর আম্মুর কথায় কষ্ট পেয়েছো সেটা কেন বলোনি আম্মুকে? হুম?”
ভোর ছলছল চোখে বলে,
-” আম্মু বিশ্বাস করো আমি একটুও কষ্ট পাই নি!”
-” পাও নি?”
-” না!”
-” সত্যিই পাওনি বাবা?”
ভোর মাথা নিচু করে নেয়। পাতা হাসে। ভোরকে বুকে জড়িয়ে আদুরে গলায় বলে,
-” আই এম রিয়েলি স্যরি বাবা! আমার ওভাবে বলা মোটেই ঠিক হয়নি! আমার সোনা বাবাটা কষ্ট পেয়েছে! আম্মু অনেক স্যরি!আর কখনো হবে না বাবা!”
ভোর পাতাকে জড়িয়ে কেঁদে ওঠে শব্দ করে। কাঁদতে কাঁদতে বলে,
-” আম্মু আমি পঁচা ছেলে নই! আমি একটু একটু কষ্ট পেয়েছিলাম!”
পাতা তাকে শক্ত করে বুকের সাথে মিশিয়ে নেয়। পিঠে হাত বুলিয়ে শান্ত হতে বলে।
-” আমি জানি তো! ভোর সবচেয়ে গুড বয়! একটুও পঁচা না। পঁচা তো ভোরের আম্মু! ভোরকে বকে..”
-” আমার আম্মু একটুও পঁচা না। খুব খুব খুব ভালো!”
পাতাকে বলতে না দিয়ে ভোর ফ্যাসফ্যাসে গলায় বলে। পাতা হেসে ওঠে। অরুণ হামি তুলে ঘার এদিকে ওদিকে ঘুরিয়ে বলে,
-” হ্যাঁ হ্যাঁ বুঝতে পেরেছি! ভোর আর ভোরের আম্মু খুউব ভালো! শুধু ভোরের আব্বুটা পঁচে গেছে!”
ভোর মাথা তুলে উঁকি দিয়ে একবার বাবাকে দেখে নেয়। নাক টেনে কান্নার মাঝেই হেসে দেয়।অরুণ এগিয়ে এসে টিস্যু দিয়ে নাক পরিষ্কার করে দেয়। পাতার দিকে টিস্যু বাড়িয়ে মিছে বিরক্তের শ্বাস নিয়ে বিড় বিড় করে,
-” ছিঁচকাদুনে পরিবার আমার!”
ছেলেকে কোলে নিয়ে রুমে চলে যায়। পাতা টিস্যু দিয়ে ভিজে যাওয়া চোখ মুখ মুছে নিলো। নাক টেনে সর্দি মুছে বিনে ছুঁড়ে ফেলে সেও ঘরে চলে যায়!
____
নিস্তব্ধ রজনী। আকাশের ক্ষীণ চাঁদের আলো ছড়িয়ে পড়েছে। জোনাকির দল পুকুরের চারপাশে জ্বল জ্বল করছে। মিটমিটে আলোয় পরিবেশ আলোকিত না হলেও বেশ আকর্ষণীয় দেখতে। পুকুরে প্রতিফলিত হয়েছে ক্ষীণ চাঁদ! সব মিলিয়ে যেন এক অতুলনীয় সৌন্দর্য বিরাজ করছে এই নীরব পুকুর ঘাটে। পাতা ভোরকে নিয়ে শুয়ে আছে বিছানায়। ভোর পাতাকে জড়িয়ে গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন। পাতার চোখেও ঘুম টইটুম্বুর। চোখ ছোট ছোট হয়ে এসেছে। হামি তুলছে বারংবার কিন্তু ঘুমোচ্ছে না। সে কারো অপেক্ষায়! আশ্চর্য লোকটা আসছে না কেন? পাতা ভোরের কপালে গালে চুমু দিয়ে আস্তে ধীরে ভোরের বাঁধন থেকে মুক্ত হয়ে বিছানা থেকে নামলো। এসি বন্ধ করে গায়ে ভালোভাবে কম্বল জড়িয়ে দিল। কার্তিক মাস চলছে। দিনের বেলায় শীতের ছিটেফোঁটা না থাকলেও রাতে তার প্রকোপ কিছুটা ঠাহর করা যায়। পাতা গুটি গুটি পায়ে বেরিয়ে আসে। দূরু দূরু বুকে স্টাডি রুমে উঁকি দেয়।না এখানেও নেই। পাতা উপর থেকেই ড্রয়িং রুমে উঁকি দেয়। লাইট জ্বলছে কিন্তু কেউ নেই। পাতার গা ছমছম করে কিন্তু তবুও সে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামে। এদিকে ওদিকে মাথা ঘুরিয়ে খুঁজতে থাকে। হঠাৎ কিচেন থেকে টুংটাং আওয়াজ ভেসে আসে। পাতা ভয় পায়। দৌড়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে শুরু করে। অর্ধেক যাওয়ার পর ভাবে লোকটা কিচেনে নয়তো? ভিতু পাতা আবার নেমে আসে । উঁকি ঝুঁকি দিয়ে দেখে স্বস্তির শ্বাস ছাড়লো। লোকটা তবে কিচেনে! কিন্তু এতো রাতে কিচেনেই বা কি করছে? সে নক করে। অরুণ ঘার ফিরিয়ে তাকে দেখে পুনরায় নিজের কাজ করতে করতে বলে,
-” ভোর ঘুমিয়েছে?”
-” হুম!
পাতা এগিয়ে আসে। পুরো কিচেনে নজর বুলিয়ে বুঝতে চেষ্টা করে কি রান্না করছে! তবে জিজ্ঞেস করলো না। অরুণ আবার প্রশ্ন করে,
-” তুমিও ঘুমিয়ে যেতে?”
-” আপনি আসছিলেন না! তাই!”
-” ওহ্। আমার জন্য ওয়েট করছিল মহারানী?”
পাতা মাথা নাড়ল ছোট করে।
-” কি রান্না করছেন?”
অরুণ পাতার দিকে তাকালো। চোখে মুখে তার প্রফুল্লচন্দ্র ছেয়ে আছে।
-” কেক বানাচ্ছি! চকলেট ফেবারের! কাল ভোরের বার্থডে। এখন দশটা বাজে, বানিয়ে ফ্রিজে রাখবো। ঠিক বারোটায় ডেকে সারপ্রাইজ দিবো! আইডিয়া কেমন?”
পাতা অবাক হয়। কাল ভোরের বার্থডে? হ্যাঁ তাইতো! টুয়েন্টি থার্ড অক্টোবর তো কালই! ইশ্ সে তো ভুলেই গেছে। লোকটা বলতে পারতো তাকে! সেও হেল্প করতো!
-” তারজন্য আজ জলদি ফিরলেন!”
-” হুম! সবাইকে ইনভাইটও করেছি!”
-” ওহ্!”
এতো কিছু প্ল্যান করেছে লোকটা অথচ তাকে জানায় নি। সে আর কিছু না বলে চুপচাপ দাঁড়িয়ে দেখতে থাকে। অরুণ নিজ মনে কাজ করতে থাকে। তবে আড়চোখে পাতার বিষন্ন মুখটা নজর এড়ায় না। সে সব কাজ সম্পন্ন করে কেকের ফর্মা ওভেনে দেয়। গ্লাফস খুলে শেফদের এপ্রোনটাও খুলে রাখে। বেসিন থেকে হাত ধুয়ে পাতার শাড়ির আঁচলটায় মুছতে মুছতে বলে,
-” আবার কি হলো? গাল ফুলিয়ে রেখেছো কেন?”
পাতা হাসার চেষ্টা করে বলে,
-” গাল ফুলাই নি মোটেও! ঘুম পাচ্ছে আমার। আমি যাই আপনি কাজ শেষ করুন!”
বলে পা বাড়ায়। অরুণ যেতে দেয় না। কাঁধ জড়িয়ে বাহু বন্ধনে আটকে নেয়।
-” বিকেলের কথায় কষ্ট পেয়েছো? আমি কিন্তু ওভাবে বলি নি। আর এক্সপ্লেইনও করেছি!”
পাতা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,
-” না কষ্ট পাই নি। তবে ভালো লাগছে না। ছেলেটা আমার কথায় কষ্ট পাবে আমি একটুও ভাবি নি। আমি ক্লাস শেষেই তাকে আদর করে বুঝিয়েছি। তখনও হাসিমুখেই ছিল। কিন্তু তার হাসিমুখের আড়ালের মন খারাপি দেখতে পাই নি। এটাই পোড়াচ্ছে আমাকে। আমি কেন তার বিষন্নতা উপলব্ধি করতে পারলাম না। ছেলেটা শুধু কষ্ট পায় নি বরং তার ছোট মনে অনেক দাগ কেটেছে আমার ওই আচরণ। আমি..”
বলতে বলতে পাতা যেন হাঁপিয়ে ওঠে। গলা কেঁপে ওঠে। অরুণ তাকে শক্ত করে নিজের সাথে চেপে নিয়ে আশ্বস্ত করে বলে,
-” আরে পাগল! ইটস ওকে।ও সব ভুলে গেছে। তুমি আদর করে বুকে টেনে নিয়েছো ব্যস ওর বিষন্নতা সেখানেই সমাপ্ত হয়ে গেছে। এখন এসব ভেবে কষ্ট পেও না তো!”
পাতা নাক টেনে হুম বলে। আঁচলে চোখের পানি মুছে নেয়। অরুণ তার মাথায় হাত বুলিয়ে বুকে জড়িয়ে রাখে। পাতার বুকটা একটু হালকা হয়। অরুণের বুকটায় আরেকটু সেটে গিয়ে নাক মুখ ঘষে। অরুণ হাসে অল্প। তাদের এই মিষ্টি মধুর আলিঙ্গন বোধহয় একজনের সহ্য হয় না। অরুণের ট্রাওজার নখ দিয়ে টেনে ধরে মিও মিও করতে থাকে। অরুণ নিচে তাকিয়ে পাতাকে বলে,
-” দেখো তোমার সখি ডাকছে তোমায়!”
পাতা অরুণকে ছেড়ে সরে দাঁড়ালো। বিড়ালটির চৌদ্দ গুষ্টির পিন্ডি চটকিয়ে বিরস মুখে দাঁড়িয়ে বলল,
-” এটাকেও সাথে এনেছেন তবে। তাই তো বলি আপনার ছা’ পোষা বিড়ালের খোঁজ নেই কেন!”
-” আমি আনি নি! ও নিজেই পিছু পিছু এসেছে।”
-” আসবে না! পারলে আপনার সাথে চুইংগামের মতো লেগে থাকে!”
অরুণ বোঝে না পাতার বিড়বিড় করে বলা কথা! ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করে,
-” কিছু বললে?”
পাতা মাথা নেড়ে বিড়ালটির দিকে একবার তাকিয়ে বলে,
-” না! কাল ভোরের বার্থডে। আপনি তো সব কাজ সেরেই ফেলেছেন। আমাকে একবার জানাতেও পারতেন?”
অরুণ কেকটা বেক হয়েছে কি না চেক করে। না এখনো হয় নি! সে আবার ওভেনে দিয়ে আটকে দেয়। পাতার দিকে তাকিয়ে বলে,
-” ভেবেছিলাম দুজনকে একসাথে সারপ্রাইজ দিবো! কিন্তু আপনি জেনে গেলেন রানিসাহেবান!”
পাতার কপালে ভাঁজ পড়ে । অরুণ হঠাৎ করে এগিয়ে আসে। পাতার কোমড়ে হাত রেখে কেবিনেটের উপর বসিয়ে দেয়। এখন দুজনের উচ্চতা ঠিক ঠিক। অরুণ দূরত্ব ঘুচিয়ে দেয় নিমিষেই। মিলিত হয় অধরযুগল। বেপরোয়া অরুণের হাত থেমে নেই। ছুঁয়ে দেয় যত্রতত্র। বিড়াল শাবক পিটপিট করে তাকিয়ে অবলোকনে করে সব। মিয়াও মিয়াও বলে কেবিনেটের উপরে উঠে গা ছড়িয়ে বসে চেয়ে থাকে পলকহীন। অরুণ অধর ছেড়ে গলায় মুখ গুঁজে দেয়। আলতো কামড়ে চুমুতে ভরিয়ে দিতে থাকে। পাতা চোখ বুজে নিয়েছে আদিতেই। লোকটার স্পর্শ তার কাছে নতুন নয়। তবে প্রতিবার যেন তনমন জুড়ে শিহরণ জাগিয়ে দেয়। মাতাল মাতাল লাগে নিজেকে। অরুণ যেন ভুলে যায় তাদের অবস্থান। মেতে ওঠে উন্মাদনায়। আঁচল খসে পড়ে। পাতা এবার ছটফট করে ওঠে। লোকটা কি শুরু করে দিয়েছে কিচেনে। সে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। অরুণ বিরক্ত হয়ে শক্ত কামড় বসিয়ে দেয়। ব্যাথায় পাতা মুখ কুঁচকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিল।
-” রাক্ষুসে লোক!”
অরুণের চোখে মুখে আকাশসমান বিরক্ত এসে ভিড় করে নিমিষেই। আচ্ছা খাচ্ছা মুডের বারোটা বাজিয়ে দিল মেয়েটা! অরুণ ঘারে হাত রেখে মাথা বাকায়। এগিয়ে আসবে; পাতা কেবিনেট থেকে নেমে দৌড়ে কিচেন থেকে চলে যায়। এই লোক মহা অসভ্য। সভ্যতার লেশটুকুও নেই এর মাঝে। নাক উঁচু অসভ্য ম্যানারলেস লোক!
চলবে…..
#পাতা_বাহার
লেখনীতে: #বেলা_শেখ
#পর্ব- ৪২
(কপি করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ)
নিস্তব্দ রজনী। ঘড়িতে এগারোটা বেজে পঁয়ত্রিশ মিনিট। অরুণ সরকার সোফায় বসে আছে গালে হাত দিয়ে। উত্তেজনায় চোখে ঘুম এখনো ধরা দেয় নি। দিবে কিভাবে? তার কলিজার বার্থডে! ছেলেটা পাঁচ পেড়িয়ে ছয়ে পা দিবে। ভাবতেই অবাক লাগে তার ছেলেটা দেখতে দেখতে ছয় বছরের হয়ে গেল! কদিন আগে না নার্স সাদা তোয়ালে মোড়ানো এক পিচ্চি বাচ্চা তার হাতে দিলো! সে কি কান্না জুড়ে দিয়েছিল তার কাছে এসে। থামার নামই নেই। সে তো ঘাবড়ে গিয়েছিলো। বুকটা ধ্বক ধ্বক করছিল! বাচ্চাটার কিছু না হয়ে যায়। অনেক বছর পর অরুণ সেদিন ছেলের কান্নায় কেঁদেছিল! তারপর থেকে ছেলে কাঁদলে তার চোখটাও জ্বলে ওঠে। ঠিকরে বেড়িয়ে আসতে চায় নোনাজল। বুক ভারি হয়ে ওঠে নিমিষেই। ধীরে ধীরে ছেলে বড় হলো। অ আ বুলি শিখলো! অরুণের তখন মনে হতো সারাক্ষণ ছেলেটার সামনে বসে তার বুলি শুনতে। তখন সে প্রায়ই অফিস ম্যানেজারের কাছে সপে বাড়িতে আস্তানা গড়ে নিতো। কখনো ল্যাপটপ নিয়ে ছেলের সামনে বসেই সব কাজ সেরে ফেলতো। চাঁপা স্বভাবের গম্ভীর অরুণ ছেলের সাথে আধো আধো বুলি আওড়িয়ে হাসাতো, খেলতো।ছেলেটা বাবা অন্ত প্রাণ হলেও প্রথমবার কিন্তু মা’ কেই ডাকতে শিখেছে। এ নিয়ে অরুণ পুরো দুদিন ছেলেকে কোলে নেয় নি আর না কথা বলেছে। পরে নিজের বোকামিতে নিজেকে শাসিয়ে তার কলিজাকে কোলে তুলে নিয়ে আদরে আদরে ভরিয়ে দেয় তখনই ভোর ছোট্ট হাতে অরুণের নাকে একটা থাপ্পড় লাগিয়ে ‘বা বা’ বলে। অরুণ প্রথমে ফ্যালফ্যাল করে চেয়েছিল। ভোর শরীর দুলিয়ে হেসে আবার ‘বা বা’ বলতেই অরুণের শরীর জুড়ে আলাদা শিহরণ বইয়ে বেড়ায়। প্রথম প্রথম ভোর যতবারই ‘বা বা’ বলেছে অরুণ মনে হয় নতুন করে নিজেকে চিনেছে। সে এখন কারো বাবা! ভোর হাঁটতে শিখে খুবই ধীর গতিতে। দেড় বছরে হাঁটতে শিখেছে। প্রথম একটু হেঁটেই বসে পড়ে কাঁদো কাঁদো গলায় বলতো,
-” বা বা পা তায়াড! কুলে?”
হাত বাড়িয়ে দিতো কোলে নেয়ার জন্য। তখন ছেলেকে কোলে তুলে ঘারে বসিয়ে নিয়ে নিজে ঘুরে বেড়াতো এদিকে ওদিকে। ছোট ভোর লাল টকটকে অধর নাড়িয়ে ভাঙ্গা ভাঙ্গা শব্দে অনেক কথাই বলতো। একদন্ড সে চুপ থাকতো না। ছটফটে চঞ্চলতায় ভরপুর ছিলো। সবসময় হাসবে খেলবে। ছোট্ট আনিকাকে দেখে বলতো,
-” চোত বুন? আনি!
যার মুখে যেটা শুনবে সেটাই তার বুলি! একটা হাসিখুশি বাচ্চা। এই হাসিখুশি বাচ্চাটা হাসির প্রদীপ নিস্প্রভ হয়ে যায় যখন তার মা চলে যায়। কেউ সামলাতে পারতো না তাকে। শুধু এক নাগাড়ে হাঁউমাঁউ করে কেঁদেই যেতো! ‘মা মা’ বলে গলা ফেটে কাঁদতো। তখন সে বাবা কেও তোয়াক্কা করতো না। তার মা চাই! মা আনো! মা আনো! বলে কাঁদতো। ছেলেটার তখনও দু বছর পড়ে নি। মায়ের বুকের দুধ ছাড়ে নি। মা যাওয়ার পর জোর করেও তাকে খাওয়ানো যেতো না। কাঁদতে কাঁদতেই ঘুমিয়ে পড়তো। ঘুমের ঘোরে মুখে ফিটার দিলে চুক চুক করে খেতো! ঘুম ভাঙলে আবার কান্না! ধীরে ধীরে তার কান্না থেমে যায়। সাথে ছটফটে চঞ্চলে স্বভাবের ভোর একদম শান্ত ছেলে। কারো সাথেই কথা বলবে না। চুপটি করে যে কোলে নেবে তার গলা জড়িয়ে নিস্প্রভ চোখে চেয়ে থাকবে। যেন সে প্রাণহীন এক জড় পদার্থ। অরুণ ভোরকে অফিসে নিয়ে যাওয়া শুরু করলে ছেলেটা ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়। অপর্না, লাবিব, মিসেস রুনা সহ আরো কয়েকজন স্টাফদের সাথে তার বেশ ভাব হয় ধীরে ধীরে। হয়ে ওঠে সেই আগের ছটফটে ভোর। তবে খুবই সেনসিটিভ। কখনো সে বুঝদার ছেলে;তো কিছু কিছু বিষয়ে সে বড্ডো অবুঝ ও নাছোড়বান্দা! সবার সাথেই মিশে যাবে নিমিষেই। ছোট ,বড়, বুড়ো আর জোয়ান সবার সাথেই অল্প সময়েই মিশে যাবে। যাকে ভালো লাগবে তাঁর কাছে ঘুরে ফিরে যাবে। যে আদর করবে তার কোলে উঠে বসে থাকবে। তার আদুরে চঞ্চল ছেলেটা তাঁর প্রাণভোমরা। ছেলেটা হাসলে তার মনটা হাসে। কাঁদলে তাঁর বুকটা কাঁদে। মলিন মুখ দেখলে তার হৃদয়টা পুড়ে যায়।অরুণের ভাবনার সমাপ্তি ঘটে কোলে কারো জায়গা দখল নেয়ায়। পাতাবাহার মিও মিও করে ডেকে অরুণের কোলে শুয়ে পড়ে। অরুণ ছোট ছোট করে তাকিয়ে তার গায়ে হাত বুলিয়ে বলে,
-” সবসময় আমার পিছনে পড়ে থাকো কেন পাতাবাহার? তোমার ভাবসাব তো সুবিধের না! আমার কিন্তু তোমার চেয়েও কিউট আদুরে একটা বউ আছে!”
বিড়াল শাবকটি মিও মিও করে। অরুণ গম্ভীর ভঙ্গিতে তার কান টেনে দেয়। এই বিড়ালটা একদম গা ঘেঁষে থাকে তার। সে বাড়িতে থাকলে আর কারো কাছেই যাবে না। তার পিছু পিছু আঠার মতো লেগে থাকবে।প্রথম প্রথম একটু বিরক্ত হলেও এখন ভালোই লাগে। অরুণ ভেবে পায় না সে বিড়ালছানাকে সেভাবে কখনো কাছে টানে নি তবুও কেন তার সঙ্গ এর পছন্দ। মাঝে মাঝে দু একটা কথা বলতো, কান টেনে দিয়ে গা বুলিয়ে দিতো এই যা!
অরুণ উঠে বিছানায় ছেলের শিয়রে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। আদর করে। তাঁর বুকটা কেমন চিন চিন করছে। কেমন একটা অদ্ভুত অনুভুতি হচ্ছে। বুকটা কাঁপছে অনবরত। ভয় ভয় লাগছে। মনে হচ্ছে কিছু একটা হবে। কিছুদিন হলোই তার এমন মনে হচ্ছে। চিন্তায় মাথা ঘুরপাক খায়। অরুণ আবার ঝুঁকে ছেলের গালে মুখে চুমু দেয়। ভোর নড়াচড়া করে পাশ ফিরে শোয়। অরুণ সরে আসে। পাতাকে ওঠায় ঘুম থেকে। পাতা ঘুম ঘুম চোখে অরুণের দিকে তাকিয়ে।
-” আমার ঘুমের সাথে আপনার কিসের শত্রুতা ভোরের বাবা?”
অরুণ ছোট ছোট করে চেয়ে পাতার এলোমেলো চুল হাত বাড়িয়ে গুছিয়ে দেয়। পরনের লং শার্টটার উপরের বোতাম আটকে দিয়ে শান্ত গলায় বলে,
-” উঠো! বারোটা বাজতে চলল! ভোরকে উইশ করবে না?”
পাতার ঘুম ছুটে যায় নিমিষেই। ঘুমন্ত ভোরের দিকে একপলক তাকিয়ে বলে,
-” হুম! তাই বলে এভাবে ওঠাবেন?”
-” কিভাবে উঠিয়েছি?”
অরুণের গম্ভীর গলা শুনে পাতা কটমট করে চায়। মনে মনে ভেঙায় ‘কিভাবে উঠিয়েছি?’ এ মুখে বলা যায়! অসভ্য লোক! পাতা রিমোট হাতরে লাইট অন করে। এতক্ষণ ড্রিম লাইট জ্বলছিল! সাদা ঝলমলে আলোয় পুরো রুমের ডেকরেশন দেখে সে অবাক!লাল গোলাপ আর বেলুনে সজ্জিত ঘর। এসব কখন করলো?
-” এসব আপনি করেছেন?”
-” না! আরিয়ান আর আদুরি এসে সাজিয়ে দিয়ে গেছে!”
পাতা খানিকটা আতংকে চায় অরুণের কথায়। আরিয়ান ভাই ছিল ঘরে? তার ঘুমানোর কোনো ছিড়ি নেই। অরুণ হয়তো তার মুখের আদল দেখে বুঝতে পারলো। বিছানা থেকে উঠে বলল,
-” কম্বলে আপাদমস্তক ঢেকে ছিলে দুজন!”
পাতা স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লো। বিছানা থেকে নেমে বলে,
-” ওনারা কোথায়? আমাকে ডাকেন নি কেন?”
অরুণ ঘড়িতে সময় দেখে! পঁয়তাল্লিশ বাজে। আর মাত্র পনেরো মিনিট। সে পাতার কথার জবাবে দেয়,
-” ঘুম পাগল তুমি। তাই ডিস্টার্ব করি নি। আর ঘর ডেকোরেশনের কোনো প্ল্যান ছিল না। আরিয়ান আদুরি এসে সাজিয়ে দিয়ে গেলো। ওরা সবাই এলো বলে। ওড়না নাও?”
পাতা ওড়না পেঁচিয়ে নেয় গলায়। সোফায় অরুণের পাশে পা তুলে বসে বলে,
-” কত বাজে?
-” ফোরটি সিক্স!”
-” কেক দেখি কেমন বেক করেছেন?”
অরুণ টি টেবিলে রাখা কেকের ঢাকনা তুলে দেখায়। পাতার চোখে মুখে অবাকতার রেশ! এই কেক উনি বানিয়েছে? একদম পারফেক্ট! মনে হচ্ছে অর্ডার করে এনেছে। ছোট সাইজের চকলেট কেক! সুন্দর ডিজাইন করা! উপরে হ্যাপি বার্থডে লেখা। ভোরের নাম উল্লেখ করে নি। ছয়টা ছোট মোমবাতি দাঁড়িয়ে আছে কেকের উপর। পাতা অরুণের এক বাহু জড়িয়ে সেখানে মাথা ঠেকিয়ে বলে,
-” আপনি তো পুরোই অলরাউন্ডার! অফিস সামলান! রান্না বান্নায় এক্সপার্ট! বেকিংও করতে পারেন।”
-” হুম সাথে আরো দুটো বাচ্চা সামলাই!”
ভোর ও পাতাকে ইশারা করে গম্ভীর মুখে বলে। পাতা ছোট ছোট করে তাকিয়ে হেসে ওঠে খিলখিলিয়ে। অরুণের মুখে হাসির ছিটেফোঁটাও নেই। কেমন গম্ভীর ও থমথমে। পাতা খেয়াল করে হাসি থামায়। মাথা উঁচিয়ে জিজ্ঞেস করে,
-” কি হয়েছে আপনার? চিন্তিত লাগছে!”
-” কিছু না!”
পাতা তার বাহু ছেড়ে দিয়ে সোজা হয়ে বসে। হাঁটু ভাঁজ করে সেথায় থুতনি ঠেকিয়ে বসে থাকে। শুনেছে স্বামীরা ঘরে বাইরের টুকটাক সব কথাই বউয়ের সাথে শেয়ার করে। কিন্তু এই লোকটা সব নিজের ভিতরেই পুষিয়ে রাখবে। কখনো কিছুই বলবে না। সে জিজ্ঞেস করলে বলবে কিছুই হয় নি। এরপরও যদি জোর করা হয় ব্যস! মহারাজ বিরক্ত হয়ে মেজাজ হারিয়ে ফেলেন। তাদের মাঝে শুধু ভোরের ও তার বিষয়ে কথা হয়। পাতার ভাবনার মাঝেই নক করে প্রবেশ করে আরিয়ান, আনিকা, রুবি, রূপ, আসমা বেগম, আনিকা ও আভারি! সবার হাতেই কিছু না কিছু গিফট আছে। পাতা অস্বস্তিতে পড়ে। তাঁর কাছে তো কোনো গিফট নেই। সে কি দেবে ভোরকে? আনিকা ঘুমে ঢুলু ঢুলু পায়ে এগিয়ে এসে দাঁড়িয়ে থেকে বিছানায় মাথা রাখে। আরিয়ান হেসে বলে,
-” ভোরকে উইশ করবে বলে ঘুমাবে না। ফোন দেখতে দেখতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছে। ডেকে তুলে এনেছি। নইলে সকালে চিল্লাচিল্লি শুরু করবে।”
বলে মেয়েকে বিছানায় বসিয়ে দেয়। আদুরি অনেকগুলো বেলুন হাতে দাঁড়িয়ে বলে,
-” আর মাত্র পাঁচ মিনিট ভাই! ওর মাথায় বেলুন ফাটিয়ে জাগাবো কিন্তু?”
পাতা সোফা থেকে উঠে আসে। আদুরির পাশে দাঁড়িয়ে বলে,
-” ভয় পাবে! নরমালি ডেকে তোলার পর ফাটিও বেলুন!”
আদুরি সায় জানালো। অরুণ কেকটা নিয়ে উঠে আসে। পাতা পিছিয়ে যায়। আসমা বেগমের কাছে গিয়ে ফিসফিস করে বলে,
-” আমাকে আগে জানাতে পারতে মা! আমি রাতে জেনেছি!”
-” ইশ্! আমি ভেবেছিলাম তুমি জানো!”
পাতা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। রুবির কোল থেকে ছোট রূপ পাতাকে দেখে মুচকি হাসে। হাত বাড়িয়ে ‘আ মা’ ডাকে। পাতা তার নাক টেনে কোলে নেয়।
অরুণ কেকেটা রূবির কাছে দিয়ে ভোরের পাশে বসে গালে হাত রেখে মৃদু চাপড় মেরে ডাকে,
-” আব্বু? এই ভোর? কলিজা? ওঠো!”
ভোর চোখ পিটপিট করে তবে ওঠে না। অরুণ আরো কয়েকবার ডাকে কাঁধ ঝাঁকিয়ে। ভোর লাফ দিয়ে ওঠে। অরুণ ছেলেকে বুকে জড়িয়ে কপালে চুমু দিয়ে বলল,
-” হ্যাপি বার্থডে কলিজা!”
ভোর বুক থেকে মাথা তুলে ফ্যাল ফ্যাল করে চায়! তখনই আদুরি এগিয়ে এসে ভোরের মাথার উপর বেলুন ফাটায় গোটা চারেক। সকলে সমস্বরে বলে,
-” হ্যাপি বার্থডে ভোর!”
বিড়াল শাবটিও মিও মিও করে। ভোর পলক ঝাপটায় ঘন ঘন। সে কি কোনো স্বপ্ন দেখছে? ভোর বাবার গালে মুখে হাত রাখল বোঝার জন্য। হ্যাঁ সত্যিই তো বাবা! ভোরের মুখে মিষ্টি হাসি ফুটে উঠলো। আজ তার হ্যাপি বার্থডে? তাঁর তো একটুও মনে ছিল না। তার ঘুম ছুটে পালায়। বাবার কাছে থেকে সরে গিয়ে হাসিমুখে বলে,
-” আজ আমার বার্থডে! আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম! থ্যাংক ইয়ু সবাইকে!”
রুবি একটা ছোট টেবিল এনে বিছানায় রাখে। কেকটা সেখানে সাজিয়ে দিয়ে বলে,
-” নাও কেকটা কাটো! তোমার আব্বু নিজের হাতে বানিয়েছে! তোমার ফেবারিট চকলেট কেক!”
ভোর বাবার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসি দিয়ে গলা জড়িয়ে ধরে।গালে টপাটপ কয়েকটা চুমু বসিয়ে বলে,
-” ভোর লাভস ইয়ু সো মাচ আব্বু কলিজা!”
অরুণ প্রতিত্তরে ছেলের গালে মুখে আদরের বন্যা বইয়ে দেয়।
-” আব্বু ওলসো লাভস ইয়ু ঠ্যু মাচ কলিজা!”
অরুণের বলা শেষ হতেই সবাই সমস্বরে চেঁচিয়ে বলে,
-” উই ওলসো লাভ ইয়ু ভোর!”
আনিকা কানে হাত দেয়। বিরক্ত হয়ে ভোরকে বলে,
-” এই কেক কাটতো? ঘুম পাচ্ছে আমার!”
বলেই হামি তুলে। সবাই হেসে ওঠে। আরিয়ান ছুরি এগিয়ে দেয়। ভোর হাতে নিলো! অরুণ দিয়াশলাই জ্বালিয়ে মোমবাতি গুলো জ্বালিয়ে দেয়। ছেলেকে কোলে বসিয়ে মোমবাতিতে ফুঁ দিতে বলে। ভোর অতি উৎসাহের সাথে এক ফুঁ দিয়েই সব নিভিয়ে দিলো। সবাই হাততালি দিয়ে উইশ করে। আদুরি পার্টি স্প্রে করে অরুণ ভোর ও আনিকার মাথায়। অরুণ ছেলের হাত ধরে কেক কেটে ছেলের মুখে পুরে দেয়। ভোরও বাবার মুখে দিলো। তারপর একে একে সবার। পাতা রূপকে কোলে নিয়ে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে। পাশে আসমা বেগম খানিকটা গম্ভীর মুখে। কেক কাটার সময় পাতার উপস্থিতি তার পাশে নয় বরং ভোরের পাশে হওয়া উচিত ছিল! অথচ বাপ ছেলে ভুলেই গেছে বেচারিকে। ভোর দাদিকে কেক খাইয়ে আম্মুর দিকে তাকায়। রূপকে তার কোলে দেখে গালটা ফুলে যায়! কেক খাইয়ে না দিয়ে হাতে দিয়ে বাবার কাছে আসে। পাতার মুখটা মলিন হয়ে আসতে চায়; তা লুকিয়ে হাসি ফুটে তোলে। রূপকে আসমা বেগমের কোলে দিয়ে হাতের কেকটা নিয়ে ভোরের মুখের সামনে ধরে বলে,
-” জন্মদিনের অনেক শুভেচ্ছা ভোর! দোয়া করি অনেক বড় হও। এই অধর জুড়ে সর্বদা মিষ্টি হাসি বিরাজমান থাকুক!”
ভোর অল্প কেক মুখে নিয়ে পাতাকেও খাইয়ে দেয়। অরুণের টি শার্টে হাত মুছে পাতার গলা জড়িয়ে বলে,
-” আই লাভ ইয়ু আম্মু!”
-” মি ঠ্যু!”
ভোর পাতাকে আর ছাড়ে না। সে ছেড়ে দেবে আর ওই রূপ আবার তার আম্মুর কোলে উঠবে? আ মা ডাকবে? সেটা তো হবেনা। অরুণ সরে বিছানার মাঝখানে বসে পাতাকে জায়গা করে দেয়। পাতা সেখানে বসলে ভোর তার কোলে বসে। রূপ আসমা বেগমের কোল থেকে ‘আ মা, আ মা’ করে হাত বাড়িয়ে ডাকে। ভোর কপাল কুঁচকে পাতার হাত জোড়া আটকে নেয়। পাতা হাসে। অরুণ হাত বাড়িয়ে ইশারায় ডাকে। রূপ হেসে ঝুঁকে আসে। আসমা বেগম অরুণের কোলে দেয়। ভোর নাখশ চোখে চায়। আম্মুকে ছেড়ে এখন তাঁর আব্বুকে ধরেছে পঁচা রূপ! অরুণ রূপের মুখে ক্রিম দেয়। সে সেটা গলাধঃকরণ করে সামনে রাখা বাকি কেকে থাবা মেরে হাতে মাখিয়ে মুখে দেয়। গাল মুখে ক্রিম লেগে যায়। সবাই হেসে উঠল তবে ভোর গাল ফুলিয়ে কাঁদো কাঁদো হয়ে বলে,
-” আমার কেক!!”
অরুণ টিস্যু দিয়ে রূপের মুখটা মুছে বলে,
-” কলিজা আবার বানিয়ে দেবো তো!”
ভোর আর কিছু বলে না। সবাই একে একে তাকে গিফট দিয়ে দোয়া করে। সাথে আদর করতে ভোলে না। গিফটের থেকে ভোর আদর পেয়ে মনে হয় বেশি খুশি হয়েছে।হালকা আড্ডা দিয়ে সবাই বিদায় নিয়ে বেড়িয়ে যায়! বাকি কেক টুকু পাতাবাহার চেটেপুটে খেতে থাকে! অরুণ উঠে দরজা লাগিয়ে সব গুছিয়ে নেয়। বিছানায় শুয়ে লাইট অফ করে ড্রিম লাইট জ্বালিয়ে দেয়। ভোর মাঝখানে পাতা অরুণ দু পাশে। ভোরের চোখে মুখে উৎফুল্ল! ঘুমের অবকাশ নেই।
-” ও আব্বু? আমার না আইসক্রিম খেতে ইচ্ছে করছে! একটু খাই?”
ভোর বলেই আড়চোখে বাবার দিকে তাকালো। সে জানে বাবা এখন একটু মানা করবে না। অরুণ পুনরায় লাইট জ্বালিয়ে মিনি ফ্রিজটা থেকে একটা বড় ভ্যানিলা আইসক্রিমের বাটি নিয়ে আসে। সাথে একটা চামচ।ভোর আইসক্রিম দেখে উঠে বাবু হয়ে বসল।অরুণ বাটি খুলে তার হাতে দেয়। ভোর গপাগপ মুখে পুরে দুই চামচ। পরপরই আরেক চামচ তুলে পাতার মুখে ধরে বলে,
-” আম্মু খাও?”
পাতা উঠে বসে মুখে নেয়। ভোর এবার চামচে ভরে বাবার মুখে দেয়। অরুণ আইস্ক্রিম মুখে নিয়ে ভোরের হাত থেকে চামচ সহ আইসক্রিমের বাটি নিয়ে বলল,
-” আমি খাইয়ে দিচ্ছি!”
-” আব্বু! আমার না অনেক হ্যাপি হ্যাপি লাগছে! আজ আমার বার্থডে। আমি যা বলব তাই হবে! আব্বু তুমি কিন্তু একটুও মানা করবে না। আর বকবেও না।”
-” ওকে কলিজা!”
-” আম্মু? তুমি আমাকে অনেক অনেক আদর করবে! আমি তুমি আব্বু অনেক মজা করবো! কিন্তু রূপকে একটুও কোলে নিবে না। একটুও না। তাহলে ভোর রাগ করবে! হুম! ”
পাতা তার গাল টিপে দিয়ে চুমু দিয়ে বলে,
-” যো হুকুম মেরে আজ্ঞা!”
ভোর হেসে উঠলো।
-” আব্বু কাল কিন্তু আমি আম্মু স্কুলে যাবো না। তুমিও অফিস যাবে না।ঠিকাছে?”
-” ঠিকাছে!”
বিড়াল শাবকটি বিছানায় উঠে আসে। অরুণের কাছে গিয়ে মিও মিও করে ডেকে লেজ নাড়ে। ভোর কাছে ডাকে পাতা নাক ছিটকে বলে,
-” এটাকে এখন একদমই কোলে নেবে না। দাঁড়াও আমি খাঁচায় পুরে দিই!”
বিড়াল শাবকটি যেন এর ঘোর বিরোধীতা করে।ভলিউম বাড়িয়ে মিও মিও করে অভিযোগ করে অরুণের কাছে। অরুণের মায়া হয়। পাতার মুখে আইসক্রিম পুরে থামিয়ে দিল।
-” খাঁচায় ভরতে হবে না। সি ইজ আ গুড গার্ল! তাই না পাতাবাহার?”
বিড়াল শাবকটি মিও মিও করে সায় জানালো। পাতা ভেংচি কাটলো মনে মনে। আহা! কি দরদ! অরুণ উঠে বিড়ালের দুধের বাটি আনে। সেখানে আইসক্রিম দেয় দুই চামচ! বিড়াল শাবক লেজ নাড়িয়ে খুশি প্রকাশ করে। অরুণের পায়ে গা ঘেঁষে আইসক্রিম চাটতে শুরু করে। অরুণ পুনরায় বিছানায় বসে। পাতা হামি তুলে ভোরকে বলে,
-” তো বার্থডে বয়? কি গিফট চাই তোমার বলো? যা চাইবে তাই পাবে?”
ভোর গোল গোল করে তাকালো আম্মুর দিকে।
-“যা চাই তাই দিবে আম্মু?”
পাতা তার গালে চুমু দিয়ে বলে,
-” হ্যাঁ! বলো! সবাই গিফট দিলো! তোমার আব্বু, চাচ্চু, চাচি, ফুপ্পি, দাদি, আভারি কাক্কু! শুধু আমিই বাকি আছি, তাই না? এখন বলো?”
ভোর ভাবে সময় নিয়ে। তারপর পাতাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলে,
-” আম্মু তুমি কখনো আমাকে ছেড়ে যেও না। আমাকে সবসময় ভালোবেসো! সবসময়!”
কেঁপে কেঁপে ওঠে ভোরের ছোট শরীর। পাতা ঠাহর করতে পারে। বুকে জড়িয়ে নিয়ে আদুরে গলায় বলে,
-” আমি সবসময় তোমার পাশে থাকবো ভোর! সবসময়! ভোরের আম্মু হয়ে। আর ভালো কিভাবে বাসে? সেটা তুমিই শিখিয়ে দিও! আর ছেড়ে যাওয়ার প্রশ্নই আসেনা।”
ভোর অধর কোনে হাসি ফুটে উঠলো। আম্মুকে ছেড়ে দিয়ে দাঁড়ায়। পাতার মুখটা ছোট দু হাতের আঁজলায় ভরে কপালে, গালে, নাকে চুমু দিয়ে বলে,
-” আম্মু তুমি অনেক ভালো!”
পাতার চোখ ভরে গেল নিমিষেই। এতোটা ভালোবাসা! এতোটা বিশ্বাস! এতোটা যত্ন! সে এসবের মূল্য দিতে পারবে আদৌও? এক নিষ্পাপ শিশু কে অজান্তেই না দুঃখ দেয়। যেমনটা আজ দিয়েছিল! ভোর পাতার চোখের পানি মুছে দিয়ে কাঁদো কাঁদো গলায় বলে,
-” আম্মু তুমি কাঁদছো? আমিও কিন্তু কেঁদে দেবো?”
পাতা ভোরকে বুকে জড়িয়ে চুমুতে ভরিয়ে দেয়। এই ছেলেটা এতো ভালো? এতো মিষ্টি? অরুণ চুপচাপ গম্ভীর মুখে আইসক্রিম খাচ্ছে। আইসক্রিম তারও খুব ফেভারিট। সে একের পর এক চামচ ভরে আইসক্রিম মুখে পুরছে আর পাতা ভোরকে দেখছে।
-” ছিচকাদুনের দল! তোমাদের কান্না জলদি শেষ করো! নইলে এদিকে আইসক্রিম শেষ হয়ে যাবে!”
ভোর আম্মুকে ছেড়ে বাবার হাত থেকে বাটি কেড়ে নিয়ে বলে,
-” আব্বু? তুমি তো শেষ করে দিচ্ছো! বাকিটুকু আমার আর আম্মুর!”
-” তাই?”
-” হুম! দাও চামচ?”
অরুণ দেয়। তিনজনের হাসি খুনসুটিতে সময় পেরিয়ে যায়। পাতার চোখ ঘুমে ঢুলুঢুলু। বারংবার হামি তোলে। তবে ভোরের চোখে ঘুম নেই। সে বাবার সাথে কথা বলছে। এটা ওটা টুকটাক সব বিষয়েই।
‘রূপ কেন তার আম্মুকে মা বলবে? আব্বু যেন রূপকে বকে বারণ করে দেয়।’
আনিকা কেন সবসময় ব্যাট করবে? আউট হলেও ব্যাটই করবে নইলে খেলবে না। কেন? এটাতো রুলস নয়!
মিনু খালার পেটের বাবু কবে হবে? আচ্ছা পেটের ভিতর থেকে বাবু কিভাবে শ্বাস নেয়? কি খায়? এরকম হাবিজাবি অনেক কথা! তার কথা, প্রশ্ন ও অভিযোগের ঝুড়ি ফুরায় না। অরুণ অতি ধৈর্য্যের সাথে ছেলের সব কথা শুনছে; মাঝে মাঝে ব্যাখাও দিচ্ছে। পাতার পক্ষে আর চোখ খুলে রাখা সম্ভবপর হয় না তাই সে ঘুমে কাত! এদিকে বাবা ছেলের আলাপচারিতা ফুরোয় না। ভোর এটা ওটা বলে লাল টুকটুকে অধর নাড়িয়ে। অধরকোনে মিষ্টি হাসি। অরুণ পলকহীন তাকিয়ে থাকে ছেলের মুখের দিকে। ভোর কথা বলতে বলতে খেয়াল করে বাবাকে। সে বাবার গালে হাত রেখে বলে,
-” ও আব্বু ঘুম পাচ্ছে তোমার?”
অরুণ ছেলেকে টেনে বুকের উপর তুলে চিৎ হয়ে শোয়। কম্বলে ঢেকে নিয়ে পিঠে, চুলের ভাঁজে ভাঁজে হাত বুলিয়ে বলে,
-” কলিজা? অনেক রাত হয়েছে ঘুমাও মানিক!”
ভোর মাথা তুলে বাবার বুকে কুনুই ঠেকিয়ে গালে হাত রেখে ঠোঁট উল্টিয়ে বলে,
-” কিন্তু আমার তো একটুও ঘুম পাচ্ছে না!”
অরুণ শান্ত চোখে ছেলের দিকে চায়,
-” আব্বুর বুকে মাথা রাখো! ঘুম পাড়িয়ে দিচ্ছি!”
ভোর রাখে না। এগিয়ে এসে বাবার কপালে চুমু দেয়। নাকে কামড় দিয়ে খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো। অরুণ নাক কুঁচকে বলে,
-” আমার দুষ্টু আব্বু!”
-” আমার নাক উঁচু আব্বু!”
বলেই ভোর হাসিতে ফেটে পড়ে। অরুণের কপালে ভাঁজ পড়ে। ওহ্ আম্মুর ছেলে আম্মুকে কপি করছে!
-” ভোর এভাবে বলতে পারলে?”
শান্ত গলায় বলে অরুণ। ভোরের হাঁসি থেমে যায়। ভাবে আব্বু হয়তো কষ্ট পেয়েছে তাঁর কথায়। সে পিটপিট করে তাকিয়ে বাবার নাকে পরপর তিনটে চুমু দিয়ে বলে,
-” আমার আব্বুর নাক একটুও উঁচু না। সবথেকে পার্ফেক্ট। আমি তো মজা করে বলছিলাম!”
অরুণ হেসে ছেলের গালে মুখে চুমু দেয়। পরপর ঠোঁটে চুমু খেয়ে বলে,
-” আব্বু আমার মানিক! অনেক হয়েছে। এখন ঘুমাও! রাত দুটো বাজতে চললো!”
ভোর পিটপিট করে বাবার দিকে তাকিয়ে বলল,
-” আব্বু তুমি তো আমাকে গিফট দিলে না?”
-” কাল দেব!”
ভোর খুশি হয়ে বাবার বুকের উপর উঠে বসে। কৌতূহল মনে জিজ্ঞেস করে,
-” কি গিফট দেবে?”
-” একটা লাল টুকটুকে বউ এনে দেবো তোমায়। খুব মিষ্টি দেখতে হবে।”
ভোরের মুখমানি চুপসে যায়। সে বউ দিয়ে কি করবে? সে আর একটা কথাও বলে না। গাল ফুলিয়ে বাবার গলায় মুখ গুঁজে চোখ বন্ধ করে। অরুণ হাসে এই টুকু ছেলের এতো লজ্জা! সে ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকে। ভোরের চোখে সহজে ঘুম নামে না। বাবার কাঁধ থেকে মুখ সরিয়ে নিয়ে বুকে মাথা রাখে। উশখুশ করে বাবার বুক থেকে নেমে বাহুতে মাথা ঠেকিয়ে শোয়। কখনো পেটের উপর মাথা রাখে। আবার ওদিকে ঘুরে বালিশে মাথা রাখে। অরুণ কাত হয়ে ছেলেকে টেনে পিঠটা বুকের সাথে লেপ্টে নেয়। গলায় বুকে হাত বুলিয়ে দোয়া পড়ে চোখের পাতায় ফুঁ দেয়। ভোর কিছু সময় পর ঘুমিয়ে পড়ে।
_______
সরকার বাড়ির পরিবেশ রমরমা! অতিথিদের আগমন চোখে পরার মতো। মেয়র স্বাধীন চৌধুরী, সাবিনা চৌধুরী, অরুণের সব বন্ধুরা তার পরিবার সহ। রুবির বাবার বাড়ির আত্নীয় স্বজন। আসমা বেগমের বোন আসমানী বেগমও এসেছে দুই নাতি নাতনি সমেত। বাড়িতে এখন সকলের হৈ হুল্লোড়ে মুখরিত পরিবেশ। ডেকোরেটরের জন্য কিছু লোক এসেছে। তারা ড্রয়িং রুমের একপাশ ডেকোরেট করছে। আরিয়ান তাদের ইন্সট্রাকশন দিচ্ছে। অরুণ বন্ধুদের সাথে বসেছে পুকুর ঘাটের শান বাঁধানো জায়গায়। অরুণ বন্ধু পেয়ে কিশোর বনে যায়। বন্ধুদের সাথে মেতে থাকে আড্ডায়। পাতাও অতিথি আপ্যায়নে ব্যস্ত সময় পার করছে। সকলের সব সুবিধা অসুবিধা নিজেই দেখছে। লোক সমাগম ভালো না লাগায় মিনু ঘরে শুয়ে আছে। আভারি বাজার করতে বেরিয়েছে। ভোর তার সমবয়সী খেলার সাথী পেয়ে যেন সব ভুলে গেছে। এদিকে ওদিকে ছুটে খেলতে ব্যস্ত। সারে এগারোটা বাজতে চলল এখনো সকালের নাস্তা পেটে নেয় নি। শুধু মিনি সাইজের বার্গার খেয়েছে একটা। পাতা গরম ভাত ও মাছ ভাজা নেয় একটা বাটিতে। ভোরের কাছে গিয়ে বলে,
-” ভোর সোনা? অনেক খেলেছো! খেয়ে নাও। দুপুর হতে চলল এখনো সকালের নাস্তাই করো নি!”
ভোর কালো শার্ট ও ফুল প্যান্ট পড়েছে। কোমড়ে বেল্ট; শার্ট ইন করা! চোখে কালো সানগ্লাস! পুরোই ড্যাসিং লুক! এ ছেলে বড় হলে মেয়েদের লাইন লাগবে পিছনে। পাতার ইচ্ছে করে বাচ্চাদের মতো করে ভোরের কপালের একপাশে কালো টিকা দিয়ে দিতে।ভোর বড় খেলনা বন্দুকটা আনিকার দিকে তাক করে; এক আঙুলে চশমা খানিক নিচে নামিয়ে চশমার উপর দিয়ে তাকিয়ে বলে,
-” ইয়ু আর আন্ডার অ্যারেস্ট আনি! ভোরের খপ্পর থেকে বাঁচা একেবারে ইয়ামপচিবল! বোলে তো?”
সব বাচ্চারাই সমস্বরে চিৎকার করে ‘ইয়ামপুচিবল’ বলে! ভোর হু হা হেসে উঠলো। আনিকার হাতে খেলনা হ্যান্ডকাফ পড়িয়ে দিলো। তারপর পাতার দিকে বন্দুক তাক করে বলে,
-” আম্মু আমি এখন খাবো না। আমার একটুও ক্ষিধে নেই। যখন লাগবে আমি খেয়ে নেবো। আমি এখন খেলছি!”
পাতা ছোট ছোট তাকিয়ে ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বলে,
-” এজ ইয়ুর উইশ! আমি রূপকে কোলে নিয়ে খাইয়ে দিই যাই! রূপতো কখন থেকে আমা আমা করছে!”
বলে পা বাড়ায় দুই কদম। ভোর নাকের পাটা ফুলিয়ে হনহন করে পাতার সামনে দাঁড়িয়ে বন্দুক পেটে তাক করে বলে,
-” আম্মু? ইন্সপেক্টর ভোর কিন্তু রেগে যাচ্ছে!”
পাতা বন্দুকটা সরিয়ে দিয়ে বলে,
-” আমার তাতে কি?”
ভোর গাল ফুলিয়ে চায় পাতার দিকে। বন্দুকটা ছুঁড়ে ফেলে বলে,
-” ঠিকাছে! খাবো আমি! তবে অল্প কিন্তু? আর তোমাকে খাইয়ে দিতে হবে!”
পাতা বিজয়ী হাসে। ভোরের ফুলো গাল টিপে মুখে খাবার তুলে বলে,
-” তুমি সবার সাথে খেলো! আমি খাইয়ে দিচ্ছি! ”
ভোর খুশি হয়ে মাথা নাড়িয়ে খাবার চিবোতে চিবোতে বন্দুকটা আবার হাতে তুলে নেয়। আর সব বাচ্চাদের সাথে খেলতে থাকে। পাতা একটু পর পর তার মুখে খাবার দেয়। পানি খাওয়ায়। হঠাৎ নজরে পড়ল সোফার দিকে। রূবি তার মা ও ভাবির সাথে কথা বলছে। পাতার মনটা খারাপ হয়। পুরো বাড়ি মেহমানে ভরপুর। সকাল থেকেই তাদের আগমন ঘটে। প্রায় অনেকেই এসেছে। শুধু তার সম্পর্কীয় কোনো আত্মীয় আসেনি। লোকটা কি কাউকে বলে নি? আবার ভাবে এখানে সব উচ্চ বিত্তশালীদের ভিড়ে তার মধ্যবিত্ত ঘরের লোকজন হয়তো বেমানান লাগবে তাই বলে নি। পাতা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভোরকে খাইয়ে মুখ মুছে দিয়ে বাটি গ্লাস রেখে বেসিনে হাত ধুয়ে নেয়। ড্রয়িং রুমে আসতেই রুবির মা পাতাকে বলে,
-” বউমা তোমার বাড়ি থেকে কেও আসে নি?”
পাতা কি জবাব দিবে? বুকটা ভারী হয়ে আসে। হাসিমুখে মাথা নাড়িয়ে উপরে চলে যায়। চোখের পানি বাঁধ ভেঙে পড়ে। পাতা মুছে নেয়। হা করে শ্বাস নিয়ে কান্না গিলে নিল। রুমে গিয়ে দেখল আদুরি আর শুভ স্যারের মেয়ে শুহানি বসে আছে সোফায়।পাতাকে দেখে আদুরি বলে,
-” বড় ভাবী? এখানে বসো!”
পাতা শুহানির পাশে বসে। শুহানি মেয়েটা ভোরের চেয়ে বছর তিনেকের বড় হবে। বেশ মিষ্টি দেখতে। একদম স্যারের মতোই ভদ্র, শান্ত শিষ্ঠ মিষ্টভাষী মেয়ে। সবসময় ঠোঁটের আগায় মিষ্টি হাসি লেপ্টে থাকে। আদুরি শুনানির গাল টিপে দিয়ে পাতার উদ্দেশ্যে বলল,
-” মেয়েটা কতো আদুরে আর মিষ্টি তাই না বড় ভাবী? একদম বাপের মতো!”
-” হুম!”
ছোট জবাব পাতার। আদুরি আরো বলে,
-” শুভ ভাইয়াও কিন্তু বেশ হ্যান্ডসাম! বড় ভাইয়ার বন্ধুদের মধ্যে শুভ ভাইয়া সবচেয়ে নজরকাড়া। সব দিক দিয়েই পারফেক্ট! আর আমার চাইল্ডহুড ক্রাশ!”
বলেই পাতাকে চোখ টিপে হাসে। পাতাও হাসে তার কথায়। আদুরি আবার বলে,
-” বড় ভাইয়াও কিন্তু কম হ্যান্ডসাম নয়! আসলে সে গোমড়া মুখে থাকে। কালে ভাদ্রে একটু আকটু হাসে। আর মেজাজের কোনো ঠিকঠিকানা নেই। কোনো মেয়ে লাভ লেটার বা প্রপোজ করলে কি করে জানো ভাবী?”
পাতার আগ্রহ প্রকাশ করে আকাশ সমান। মেয়ে! লাভ লেটার! প্রপোজ! আদুরি হেসে বলে,
-” কিছু বলবে না। মেয়েটার বাবার নম্বরটা নিয়ে সরাসরি কল করে বলবে আপনার মেয়ে দিন দিন উচ্ছন্নে যাচ্ছে। জলদি ভালো একটা ছেলে দেখে বিয়ে দিয়ে দিন! ব্যস মেয়েরা আর এ মুখো হয় না।”
বলে খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো। সাথে শুহানি ও পাতাও যোগ দেয়। হঠাৎ আদুরি হাসি থামিয়ে কাঁদো কাঁদো গলায় শুনানিকে বলে,
-” তোমার আব্বু একটা মিথ্যুক শুহানি! ছোট বেলায় বলেছিল আমাকে বউ বানাবে। অথচ হঠাৎ একদিন শুনি সে বিয়ে করে নিয়েছে। সেদিন আমি অনেক কেঁদেছিলাম। এই শুভ ভাইয়ার প্রমিজ! শুভ ভাইয়া তার কথা রাখলে আজ তুমি আমার বাচ্চা হতে!”
পাতা খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে তার কথা শুনে। শুহানিও তার সাথে যোগ দিল। পাতা হাসি থামিয়ে বলে,
-” খুব মানাতো কিন্তু আদু! শুভ স্যারের অনেক ডিমান্ড দেখছি! ভার্সিটিতেও সব মেয়েরা তার উপর ফিদা ছিল! একেবারে ডাই হার্ট ফ্যান যাকে বলে!”
আদুরি সন্দেহ চোখে পাতার দিকে তাকিয়ে বলে,
-” তুমিও খেয়েছিলে নাকি ক্রাশ নামক বাঁশ?”
পাতা আমতা আমতা করে। খেয়েছিলো তো। আদুরি তার আমতা আমতা দেখে বলে,
-” তার মানে খেয়েছিলে! আরে চিল ভাবী! হ্যান্ডসাম ড্যাসিং টিচার্সদের উপর ক্রাশ খাওয়া ছাত্রীদের শিক্ষাগত অধিকার!”
পাতা লজ্জা পেয়ে বলে,
-” বেশি না। ওই একটু আকটু! আর তখন তো ছোট ছিলাম। সবে ভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছিলাম! কিন্তু যখন জানতে পারলাম স্যার ম্যারিড আর সাথে বাচ্চাও আছে ছ্যাকা খেয়েছিলাম!”
আদুরি শুহানি উচ্চস্বরে হেসে উঠলো।
__
-” ভাই শুনলি? তোর ছোট কিউট আদুরে বউয়ের কথা!”
ফিসফিস করে বলে ফয়সাল। অরুণ তার পাশে দাঁড়িয়ে। বর্তমানে তাঁরা অরুণের রুমের দরজার কাছে দাঁড়িয়ে। দরজাটা বন্ধ না, আধ খোলা। তাঁরা নক করে ভিতরে ঢুকবে কিন্তু ভিতরের আলোচনার কিছু উচ্ছিষ্ট কানে ঠেকায় দাঁড়িয়ে থাকতে বাধ্য হয়। ফয়সাল অরুণের দিকে তাকায়। শালা সবসময়ের মতো ষাঁড়ের মতো মুখ বানিয়ে রেখেছে। ঠাহর করা মুশকিল রেগে আছে নাকি স্বাভাবিক। সে অরুণের পেটে গুঁতো দিয়ে বলে,
-” দেখলি বলেছিলাম না ঘাপলা আছে? এই আমাদের শুভর ভিতর কি এমন আছে বলতো? মোমাছিরা শুধু তার দিকেই ঝুঁকে আসে। আমাদের কি চোখে পড়ে না? আসলে বন্ধু হয়েছে কি! মেয়েদের চোখে সমস্যা, ছানি পড়েছে!”
অরুণ চোখে শাসিয়ে নক করে রুমে প্রবেশ করে। সাথে ফয়সাল হাসিমুখে। পাতা খানিক ঘাবড়ে যায় অরুণকে দেখে; লোকটা শোনে নি তো আবার? পাতার ঘাবড়ানোকে দ্বিগুণ বাড়িয়ে দিতে ফয়সাল হাসিমুখে বলে,
-” পিচ্চি ভাবী? এতো সুদর্শন হাট্টাকাট্টা জামাই থাকতে জামাইয়ের বন্ধুর উপর ক্রাশ খান? দ্যাটস ভেরি ব্যাড! বেচারা অরুণ শুনে ফিট খাওয়ার মতো অবস্থায়!”
পাতার চোখের আকার বড় হয়। আদুরি পাতার পক্ষ নিয়ে কথা বলে,
-” ভাইয়া খায় নি, খেয়েছিল! সেই বাচ্চা কালে! আর খেতেই পারে। ক্রাশ একটা জাতীয় ফল বুঝলে? ছোট বড় সবাই খায়। এতে কোনো দোষ নেই। আমিও খেয়েছিলাম শুভ ভাইয়ার উপর ক্রাশ!”
-” শুহানি? তোমার মা তোমাকে ডাকছে! আদু ওকে নিয়ে যা?”
অরুণ গম্ভীর গলায় আদেশ করে! আদুরি ভাবীর দিকে অসহায় চোখে চেয়ে শুহানিকে নিয়ে বেড়িয়ে যায়। ফয়সাল মিটমিট হেসে গুনগুনিয়ে গান গায়। অরুণ তাকে চোখ রাঙিয়ে রুমের মিনি ফ্রিজ থেকে কোকের ক্যান বের করে দেয় গোটা দশেক! সে সেগুলো নিয়ে বেড়িয়ে যায় হাসতে হাসতে। অরুণ গিয়ে ধরাম করে দরজা লাগায়। পাতা অসহায় প্রানীর মতো দাঁড়িয়ে থাকে। লোকটার মুখের দিকে তাকানো যাচ্ছে না। রাগ চোখে মুখে স্পষ্ট। এখানে পাতার কি দোষ? ক্রাশ খাওয়া একটা মনস্তাত্ত্বিক ব্যাপার স্যাপার। যে কেউ যাকে দেখে খেতেই পারে। এখন মনকে তো আর ধরে বেঁধে রাখা যায় না। আর তখন সে অষ্টাদশী ছিল; মনটা এমনিতেই আবেগে বাকবাকুম ছিল। সুদর্শন হ্যান্ডসাম ব্যাক্তিত্বে ভরপুর লোক দেখে একটু আকটু ক্রাশ খেয়েছিলে । তখন তো সে জানতো না যে যার উপর ক্রাশ খেয়েছে তারই বন্ধুর সাথে তার নিকাহ্ হবে!
অরুণ এগিয়ে এসে বেলকনির দরজা বন্ধ করে। পাতার ভ্রু যুগলে ভাঁজ পড়ে। অরুণ পাতার বাহু ধরে একপ্রকার ছুঁড়ে ফেলে বিছানায়। পাতা অবাকের চূড়ান্ত সীমায়। পাতা রুক্ষ স্বরে বলে,
-” এটা কেমন আচরণ?”
অরুণ স্যান্ডেল জোড়া খুলে পাতার উপর চড়াও হয়। গলা থেকে ওড়না সরিয়ে নিতেই পাতা একপ্রকার চিল্লিয়ে বলে,
-” হয়েছে টা কি বলবেন? এরকম অভদ্রের মতো আচরণের মানে কি?”
অরুণ তার দুহাতের আঙ্গুলের ভাঁজে আঙ্গুল দিয়ে আটকে নেয়। গালে দাঁত বসিয়ে বলে,
-” ক্রাশ কিভাবে খায়? এভাবে?”
পাতা বিরক্তিকর শ্বাস ছাড়ে। অসভ্য অভদ্র লোক!
-” এ কেমন ছেলেমানুষী?”
অরুণ অপর গালে দাঁত বসিয়ে বলে,
-” না একটু শিখে নিতে চাই কিভাবে খায় ক্রাশ!”
পাতা কিছু বলে না। না ছড়ানোর চেষ্টা করে, না ছটফট করে। চুপচাপ সেভাবেই পড়ে থাকে। অরুণ থুতনি মুখে পুরে কামড় বসিয়ে অধরে অধর ছোঁয়ায় আলতোভাবে পরপর কামড়ে ধরে অধর জোড়া। পাতার বাধা না পেয়ে যেন সুযোগ পায়! হিংস্রতা ভুলে নিবিড়ভাবে হারিয়ে যায়। মধ্যাহ্নের এই অবেলায় খেই হারিয়ে বসে।
যোহরের আযানের সুমধুর ডাক ভেসে আসতেই হুঁশ ফিরে কপোতির।বড় শ্বাস ফেলে সরে আসে অরুণ সরকার। ফ্লোর থেকে শার্ট তুলে পুনরায় গায়ে জড়িয়ে বোতাম লাগাতে লাগাতে বলে,
-” ক্রাশ নামক আবর্জনার উচ্ছিষ্টও যদি অবশিষ্ট থাকে উগড়ে নাও পাতাবাহার! মনে রাখবে তোমার সাথে তোমার মনটাও আমার নামে লিখিত সংবিধান!”
পাতা রেগে বালিশ ছুঁড়ে মারে তার মুখে। অরুণ হেসে সেটা ধরে। মুচকি হেসে বলে,
-” আরে রেগে যাচ্ছো কেন? এতো আদর করলাম একটু হাসো? তোমার বাবার বাড়ির লোকজন এসেছে তোমার গোমড়া মুখ দেখলে কি ভাববে?”
পাতা অরুণের চোখে চোখ রাখে। সত্যিই? পাতা বিছানা থেকে উঠে ওড়না গলায় পেঁচিয়ে দৌড় লাগায়। কতদিন হলো বাড়ির সবাইকে দেখে না! আব্বু, আম্মু, লুব ভাই, লতাপু! অরুণের কপালে ভাঁজ পড়ে। একদম ছেলেমানুষী কান্ড। এভাবে দৌড়ে যেতে হবে? সে পিছন থেকে গলা উঁচিয়ে গম্ভীর গলায় হুকুম ছাড়ে,
-” এই বেয়াদব? আস্তে যাও? পড়ে যাবে তো!”
পাতার কানে পৌঁছালেও তোয়াক্কা করে না।
______
বাড়ির ও আগত সকল পুরুষ মসজিদে গিয়েছে নামাজের উদ্দেশ্যে। শুধু বাচ্চারা ও মেয়েরা বাড়িতে অবস্থান করছে। বাচ্চারা সব ড্রয়িংরুমে বসে ওয়ার্ড পাজল দিয়ে খেলছে। লতা পাতা তাদের সঙ্গী। পাতার মা লাবনী আক্তার রুবির মা, আসমা বেগম, আসমানী বেগম সবাই আড্ডা দিচ্ছে ছাদে বসে। আদুরি আর সাবরিনা সাবিনা মার্কেটে গেছে ভোরের জন্য গিফট কিনতে। পাতা চুপচাপ বসে মনোযোগ সহকারে বোনের কথা শুনছে। কিন্তু তার নজর ভোরের দিকে। বাচ্চাটা মসজিদে যায় নি সাথীদের পেয়ে। সবার সাথে খেলায় সে এতো মশগুল যে মসজিদে যাবে না। অরুণ বুঝালেও কাজ হয় না। নামাজ শেষে অরুণ কিছু দান সদকা করবে। গরীব দুঃস্থ মানুষের হাতে কিছু খাবার তুলে দিবে। ভেবেছে ভোরের হাতে দিয়ে দেবে কিন্তু ছেলে যাবে না। জোর করলেও কাজ না হওয়ায় অরুণ তাকে রেখে যায়। তবে পাতাকে সাবধান করে ছেলের সর্বোচ্চ খেয়াল রাখতে। একনজরও যেন চোখের দূর না রাখে। তার মনটা কু ডাকছে। পাতা আশ্বস্ত করেছে খেয়াল রাখবে তারপরও অরুণ বারবার বলেছে ছেলেটাকে চোখে চোখে রাখতে। ভোর আর সব বাচ্চাদের সাথে খেলার মাঝেই আবদার করে আইসক্রিম খাবে। পাতা তাদের একটু অপেক্ষা করতে বলে রুমে যায় আইসক্রিম আনতে। পাতা লতাকে তাদের খেয়াল রাখতে বলে উঠে যায়। একটু পর রুম্পা কেঁদে উঠলে লতা তাকে নিয়ে একটু দূরে যায়। এই সুযোগে বাচ্চারা সব বেড়িয়ে যায় মেইন ফটক পেরিয়ে। পাতাবাহার নামক বিড়াল ছানা তাদের পিছু পিছু। গেইট থেকে একটু ভিতরে একটা কামরাঙা গাছের নিচে দাঁড়িয়ে কামরাঙা পাড়ার উদ্দেশ্য ঢিল ছুড়ে। কিন্তু পড়ে না। লাবিব বড় একটা মাটির দলা এনে ঢিল ছুড়লে দুটো পড়ে ।
____
সরকার বাড়ির সামনের রাস্তায় বেশ কিছুদিন হলো তিন চারজন লোকের বেশ আনাগোনা শুরু হয়। তিনজনেরই ক্যাপ, মাস্ক পড়ে ঘুর ঘুর করে আশেপাশে। কখনো বাড়ির দাড়োয়ানের সাথে সুখ দুঃখের আলাপ জুড়িয়ে চায়ের অফার করে; তো কখনো দুপুরে এসে ভরপেট কাচ্চি খাওয়ায় পাশের রেস্তোরাঁ থেকে। কখনো পান বিড়ি সিগারেটের ধোঁয়ায় তাদের আড্ডা চলে। দাড়োয়ান বাঁচাল গোছের হওয়ায় সঙ্গী পেয়ে দিনকাল ভুলে যায়। আর তাদের সাথে এক জোড়া চতুষ্পদ জন্তু কুকুর থাকে। গলায় ডগ লেস লাগিয়ে হাতে দড়ি নিয়ে সাথে সাথেই নিয়ে ঘুরে ফিরে। আজকেও তাঁদের দেখা যাচ্ছে। রাস্তার ধারে একটা কালো রঙের গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। গাড়িতে বসে এক লোক ল্যাপটপে সব পর্যবেক্ষণ করছে। তাঁর ল্যাপটপ স্ক্রিনে ভেসে চলছে ছোট ছোট বাচ্চাদের কামরাঙা গাছে ঢিল ছোড়ার দৃশ্য। তার পাশে আরেকজন বসে যার হাতে রিমোট। যার দরূণ সে সরকার বাড়ির আঙিনায় ড্রোন ক্যামেরা কন্ট্রোল করছে। তাঁরা প্রায়ই এসে সব পর্যবেক্ষণ করে। তবে সুযোগ পায় না কোনো কিছু করার। তবে আজ ভাগ্য বোধহয় তাদের ফেবারে। আজ শুধু বাচ্চাদের দেখা যাচ্ছে। গাড়িতে বসা দুই লোক কুটিল হেসে কানে রাখা ব্লু টুথ ডিভাইসের সাহায্যে কাউকে কিছু বলে। অপর পাশের লোকটা তার ইন্সট্রাকশন মোতাবেক কুকুর জোড়া নিয়ে একটু স্পেসে দাঁড়ায়। আরেক লোক দাড়োয়ানের কাছে গিয়ে তার সাথে আলাপ চারিতায় মেতে থাকে। বাঁচাল টাইপের দাড়োয়ান কথা বলার সঙ্গী পেয়ে দিন কাল ভুলে যায়! বাচাল লোক কথা বলতে খুব পরিমাণে সাচ্ছন্দ্য করে তবে তাদের কথা শোনার মতো ধৈর্যশীল ব্যক্তির বড়ই অভাব। এখন বাঁচাল লোক তার বাঁচাল আলাপচারিতার জন্য ভালো শ্রোতা পেলে আর কি চাই। দাড়োয়ানকে কথার জালে ভুলিয়ে রেখে অপর লোক খোলা ছোট গেইট দিয়ে কুকুর দুটোকে ভিতরে ঢুকিয়ে দেয়। ঢুকানোর আগে ফোনে একটা বাচ্চা ছেলের হাস্যোজ্জ্বল মুখটা ভালোভাবে দেখিয়ে বিড়বিড় করে কিছু বলে। কুকুর গুলো জিভ দিয়ে লালা ফেলে হু হু শব্দ সৃষ্টি করে ভিতরে প্রবেশ করে ধীরে ধীরে হেঁটে যায়। শুঁকে শুঁকে এগিয়ে যায়। এতদিন ছবিতে দেখা বাচ্চাকে সম্মুখে দেখে কুকুর জোড়া ঘেউ ঘেউ করে দৌড় লাগায় ঝড়ের বেগে।
হঠাৎ কুকুরের ডাক শুনে সব বাচ্চারা ঘাবড়ে যায়। সামনে তাকাতেই দুটো কুকুরকে ছুটে তাদের দিকে আসতে দেখে সবাই দৌড় দেয় বাড়ির উদ্দেশ্যে। পাতাবাহার গাছের ডালে উঠে পরে ঝটপট। লাবিব সবার মধ্যে বড় হওয়ায় আগেই পৌঁছে যায়। ভোরও কুকুরের ডাকে ভয় পেয়ে দৌড় লাগালো কিন্তু আনিকার সাথে ধাক্কা লাগার দরূণ দু’জনেই ছিটকে পড়ে যায় মাটিতে। আনিকা ভয়ে কেঁদে ফেলে। কুকুর দুটো তাদের খুব কাছে এসেছে। আনিকা অনেক কষ্টে উঠে আবার দৌড় লাগালো। কিন্তু ভোর উঠতে পারে না। হয়তো আজ ভাগ্যও তার সহায় নেই। ইটের সাথে বেজে তার হাঁটু ছিলে গেছে। অনেক ব্যথা পেয়েছে; পা সোজাই করতে পারছে না উঠবে কি করে? সে জোড়ে গলা ফাটিয়ে আম্মুকে ডাকে। একবার ডেকেই ঠোঁট ভেঙে কেঁদে দেয় ব্যাথায় । অন্যদিকে কুকুর দুটো তার কাছে পৌঁছে যায়। ভোর অনেক কষ্টে উঠে দাঁড়াতেই কুকুরের আকস্মিক আক্রমণ ভয় পায়! কুকুর গুলো খুবই হিংস্র। জিভ দিয়ে টপাটপ লালা পড়ছে। ভয়ংকর শব্দে ঘেউ ঘেউ করে। কুকুর দুটো ভোরের উপর চড়াও হয়। নখ দিয়ে আঁচড় কেটে প্যান্টের উপর দিয়েই কামড় বসায়। ভোর চিল্লিয়ে কেঁদে কেটে আম্মু বলে ডাকে আর কুকুর গুলোকে হাত দিয়ে সরিয়ে দিতে চেষ্টা করে। কুকুর তার হাতেও কামড় বসায়। ভোর হাঁউমাঁউ করে ব্যাথা ও ভয়ে কাঁদতে থাকে।
-” আম্মু?ও আব্বু? বাঁচাও! যা! ও আম্মু?”
পাতাবাহার গাছে বসে সব দেখে ব্যাথিত নয়নে। অলস অবুঝ বিড়ালটি কি বুঝলো কে জানে। গাছ থেকে নেমে দৌড়ে যায় মালিকের কাছে। কিসের টানে? এতোদিনের আশ্রয় ও ভালোবাসার টানে? অবুঝ বোবা প্রানী! সে জানে ওখানে গেলে হয়তোবা আর রক্ষে নেই তার! তবুও যায়। তার ছোট পায়ের নখ দিয়ে আঁচড় কেটে মিও মিও করে। হয়তোবা ছাড়তে বলে তার মালিককে। হিংস্র কুকুর ছোট বিড়ালটিকে মুখে তুলে নেয় ঘার কামড়ে। ছিটকে ঠাস করে ফেলে দেয় মাটিতে। বিড়ালটি মিও মিও করে তবে ওঠে না। একটু পরে চোখ বুজে নেয়।
লাবিব ফিরে আসে পুনরায়। বাগান থেকে সে বড় লাঠি এনেছে। সেটা দিয়ে কুকুর দুটোকে আঘাত করে। একটা কুকুর ভোরকে ছেড়ে লাবিবের দিকে তেড়ে আসে। লাবিব একটু সরে এসে জোড়ে বারি দেয় কুকুর টিকে। ভোর কুকুরকে ছাড়িয়ে দৌড় লাগায়। কুকুরটি ভোরের কোমড়ে খামচি কাটে। ভোর চিল্লিয়ে ওঠে সর্ব শক্তি দিয়ে। এরমধ্যে লতা ও পাতা দৌড়ে এগিয়ে আসে। ছাদে থেকে আসমা বেগম সহ সবাই দেখে; তারাও এগিয়ে আসে। দাড়োয়ান আলাপ বাদ দিয়ে লাঠি নিয়ে দৌড়ে আসে। আর মাস্ক পড়া লোকটি বাঁকা হেসে কেটে পড়ে।
পাতা ঝড়ের বেগে দৌড়ে এসে কুকুরটিকে লাত্থি দিয়ে সরিয়ে ভোরকে কোলে তুলে নেয়। ভোর আম্মুর কোলে উঠে শক্ত করে গলা জড়িয়ে হাঁউমাঁউ করে কাঁদতে কাঁদতে বলে,
-” ও আম্মু পঁচা কুকুর! আমি অনেক ব্যাথা পেয়েছি!”
-” আম্মু এসে গেছে কিছু হবে না কলিজা!”
ভোর মোটেও শান্ত হয় না। হাঁউমাঁউ করে কাঁদতে থাকে পাতার গলা জড়িয়ে ধরে। শরীর তার ভয়ংকর ভাবে কেঁপে উঠছে ক্ষণে ক্ষণে। শরীরে আঘাতের চিহ্ন। ছেঁড়া কালো শার্টের ভিতর দিয়েই উকি দিচ্ছে আঁচড়। ছোপ ছোপ লাল রক্ত । হাতে পায়ে কামড় ও আঁচড়ের বেশ কয়েকটি দাগ। মাংস তুলে নিয়েছে মনে হয়। গলগলিয়ে তাজা রক্ত বের হচ্ছে। বাচ্চাটা চিল্লিয়ে কাঁদছে বসে যাওয়া ফ্যাসফ্যাসে গলায়। মুখ দিয়ে লালা গড়িয়ে পড়ছে।
কুকুর গুলো যেন আরো আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠে। পাতার উপর ঘেউ ঘেউ করে করে এসে হামলে পড়ে। ওড়না টেনে ধরে। পাতা আবার লাথি লাগালে পায়ে আঁচড় কেটে কামড় বসায়। সম্মুখ দুই পা তুলে কাপড় টেনে ছিঁড়ে ফেলে। পাতা বাঁধা যতো দেয় ওরা ততই হিংস্র হয়। লতা লাবিবের হাত থেকে বাঁশের ফালিটা নিয়ে কুকুরের পিঠে এলোপাথাড়ি শক্ত করে মারতে থাকে। কুকুর দুটো পাতাকে ছেড়ে লতার দিকে তেড়ে আসে। লতা তাদের মুখে ও মাথায় আঘাত করে। এরমধ্যে দাড়োয়ান এসে তার হাতের মোটা বাঁশ দিয়ে বারি লাগায় কুকুর টিকে। আসমা বেগম সহ অনেকেই বাগান থেকে বাঁশের ফালি এনে কুকুর গুলোকে পিটাতে থাকে। কুকুর দুটো যেন ভয় পেল এবার। ঘেউ ঘেউ করে লেজ গুটিয়ে পালিয়ে গেলো!
কুকুর পালিয়ে গেলেও কেউ স্বস্তির শ্বাস নিতে পারে না। ভোরের অবস্থা খুবই নাজুক। সাথে পাতাও জখম হয়েছে। পাতা ভোরের মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,
-” কলিজা আমি আছি তো! ভয় পায় না। কুকুর চলে গেছে। দেখি দেখি?”
ভোর ছাড়ে না শক্ত করে হাত পা দিয়ে পেঁচিয়ে পাতাকে জাপটে ধরে কাঁদতে থাকে। আসমা বেগম এগিয়ে এসে বলে,
-” আমি অরুণকে ফোন করছি! ডাক্তারের কাছে যেতে হবে ইমার্জেন্সি!”
পাতা কেঁদে দিল শব্দ করে। ইশ্ ছেলেটার কি হাল হয়েছে। লোকটা চোখে চোখে রাখতে বলেছিল। একটু খেয়াল রাখতে বলেছিল! সে পারলো না খেয়াল রাখতে। ছেলেটা তাকে আম্মু বলে। সে পারলো না তার মর্যাদা দিতে। পাতাকে কাঁদতে দেখে লতা ধমক দেয়,
-” চুপ! কাঁদছিস কেন? ভয় পাচ্ছে ছেলেটা!”
পাতার কান্না থামার বদলে বেড়ে যায়।
-” আপু আমার ছেলেটা..”
বলেই ভোরের মতো সেও হাঁউমাঁউ করে কান্না শুরু করে। দু’জনের কান্নায় পরিবেশ থমথমে। উপস্থিত সকলের চোখে মুখে বেদনার ছাপ! আনিকা দৌড়ে এসে পাতার পা জড়িয়ে হাঁউমাঁউ করে কান্না করে। আসমা বেগম অরুণের নম্বরে ডায়েল করে দাড়োয়ানের উপর গর্জে ওঠে,
-” এই কুকুর ঢুকলো কি করে? হুম? মাসে মাসে বেতন নাও ঘুমানোর জন্যে? যাও ঘুমিও সারাজীবনের জন্য!”
দাড়োয়ান মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে। এরমধ্যে সবার নজর যায় গেটের দিকে। সবাই হন্তদন্ত হয়ে আসছে। আর অরুণ সরকার? সে দৌড়ে আসে। পাতার সামনে দাঁড়িয়ে হাপায় না। দম বন্ধ করে দাঁড়িয়ে থাকে। চোখ মুখ তার রক্ত হী;ন বিবর্ন রঙ ধারন করেছে। জখমি আহত ব্যাথায় হাঁউমাঁউ করে ক্রন্দনরত ছেলেকে দেখে যেন শ্বাস নিতেও ভুলে গেছে। বুকের ভিতর কেউ যেন ছুড়ি দিয়ে খোঁচা দিচ্ছে অনবরত। সে তড়িৎ বেগে পাতার কোল থেকে ছেলেকে নেয়। পাতার গালে সপাটে একটা চড় বসিয়ে চিল্লিয়ে বলে,
-” আমার কলিজার এই অবস্থা কি করে হলো? হুম জবাব দাও?”
এ যেন বাঘের হুঙ্কার! পাতার হাঁউমাঁউ কান্নার কথা ভুলে যায়! ভয়ে দুই পা পিছিয়ে যায়। ভোর বাবার কোলে গিয়ে কান্নার গতি কমিয়ে দিয়ে ‘আব্বু ব্যাথা’ বলে বিড়বিড় করে কাঁদে!অরুণ আবার গলা ফাটিয়ে বলে,
-” স্পিক আউট? বলেছিলাম না চোখে চোখে রাখতে? খেয়াল রাখতে? এই অবস্থা কেন? বাড়িতে এতো এতো তো মানুষ থাকতে আমার ছেলের এই হাল হবে কেন? ছোট মা? রুবি? এই কেউ কিছু বলছো না কেন?”
লতা গম্ভীর মুখে এগিয়ে আসে। বোনকে সবার সামনে চড় মারায় তাঁর মেজাজ মোটেও ঠিক নেই তবে লোকটার মনের অবস্থা বুঝতে পেরে বলল,
-” কোথা থেকে যেন কুকুর এসে হামলা করলো! সব বাচ্চারা এখানেই খেলাধুলা করছিল আর..”
আর কি বলবে লতা! অরুণ আর শোনেও না। হাঁটু গেড়ে বসে পড়লো মাটিতে। আঘাতপ্রাপ্ত ছেলের গালে মুখে আদর করে। ভোরের কান্নার গতি বাবাকে পেয়ে কমে এলেও সময়ে সময়ে তা ঠিকরে বেড়িয়ে আসতে চায়। ব্যাথায় কাতরাতে কাতরাতে বলে,
-” আব্বু আমার না অনেক কষ্ট হচ্ছে! অনেক ব্যাথা করছে। ওই কুকুর?”
-” এই তো বাবা এসে গেল মানিক! সব ব্যাথা গায়েব করে দেবে! কলিজা এখুনি ঠিক করে দেবো!”
জখমি হাতে গলায় পেটে হাত বুলিয়ে বলে। ভোর কাঁদতে কাঁদতে আবার বলে,
-” ও আব্বু অনেক অনেক কষ্ট হচ্ছে! ভোর মরে যাচ্ছে আব্বু!”
অরুণ অদ্ভুত শব্দ করে কেঁদে ওঠে নিমিষেই। ছেলেকে বুকে জড়িয়ে নেয় শক্ত করে। অরুণের কান্নায় পাতা এগিয়ে এসে তাদের সামনে হাঁটু গেড়ে বসে কেঁদে দেয়। জড়িয়ে ধরবে অরুণ ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিল। পাতা মাটিতে পড়ে যায়। ডুকরে কেঁদে ওঠে। লতা এসে তাকে ধরে। শুভ ফয়সাল অরুণের কাঁধে হাত রেখে বলে,
-” জলদি হসপিটালে চল! সব ঠিক হয়ে যাবে অরুণ!”
অরুণ মাথা নাড়ে বাচ্চাদের মতো। ভোরকে কোলে নিয়ে দৌড় লাগায়! রাসেল গাড়ি এনে তার সামনে দাঁড় করালে অরুণ উঠে পড়ে। ছেলেকে বুকে জড়িয়ে বিড়বিড় করে বলে,
-” কলিজা কিছু হবে না। সব ঠিক হয়ে যাবে! ইয়া আল্লাহ আমার কলিজার সব ব্যাথা আমায় দিয়ে দাও! তার ব্যাথা কমিয়ে দাও! হে রহিম রহমান তোমার এই ছোট বান্দার উপর একটু রহম করো!”
ভোর গুনগুন করে কাঁদতে থাকে। অরুণ বিড়বিড় করে দোয়া পড়ে। আল্লাহর কাছে আর্জি জানায়। ভিক্ষা চায়, আকুতি মিনতি করে বারংবার। ছেলেটার কিছু হলে সে মরে যাবে।
পাতা লতাকে জড়িয়ে হাঁউমাঁউ করে কাঁদছে। ‘আমার ছেলেটা’ বলে শিউরে উঠছে। হাত পা অবশ হয়ে আসে। লতা আসমা বেগম শান্ত করে। লাবনী আক্তার বোঝায়। পাতা অবুঝের মতো আমার ছেলেটা বলেই কান্নায় ভেঙে পড়ে। এরমধ্যে শুভ আসে দৌড়ে। পাতাকে উদ্দেশ্য করে বলে,
-” পাতা? কাম! হারি আপ? গাড়ি অপেক্ষা করছে!”
পাতা কাঁদতে কাঁদতেই মাথা নাড়িয়ে দৌড় দেয়। পড়নে ছেঁড়া জামা, ওড়না! পেছনের দরজা খুলে অরুণের পাশে বসে। অরুণ ছেলেকে আরেকটু বুকে জড়িয়ে লুকিয়ে নেয়। পাতার কান্না দেখে বিরক্ত হয়ে বলে,
-” শুভ? চুপ থাকতে বল!”
পাতা মুখে ওড়না গুঁজে নিয়ে ফোপাতে থাকে। এ কোন বিপদের সম্মুখীন করলো উপর ওয়ালা তাদের! পাতা ঢোক গিলে অনেক কষ্টে কান্না আটকে আটকে রাখে। ভোরের গুনগুন কান্নার শব্দে তার বুকটায় যেন আগুন জ্বলতে শুরু করে। শ্বাস আটকে যায়। ইয়া পরম করুণাময় রহিম রহমান একটু রহম কর এই নিষ্পাপ শিশুর উপর!
__
তাদের গাড়ি ছুটে চলে তীব্র গতিতে। তাদের গাড়ির পেছনে আরেকটা কালো গাড়ি যায় আপন গতিতে। গাড়িতে উপস্থিত সকলের মুখেই চাপা হাসি। শামীম হেসে ফ্রন্ট সিটে বসা আকাশকে বলে,
-” খুব হাসি পাচ্ছে! কিন্তু এই টুকুতে তো আমার মন ভরলো না আকাশ!”
আকাশ উচ্চ স্বরে হেসে বলে,
-” আমার ভরেছে। ওই অরুণ সরকারের করুণ মুখটা দেখে বুকটা যেন প্রশান্তিতে ভরে গেছে। আমার বাড়িতে ঢুকে আমার বাবার উপর হামলা চালিয়েছে। এখন ওর বাড়িতেই ওর কলিজাকে ছিন্নভিন্ন করেছে ওই কুত্তা গুলো! ব্যাথায় জর্জরিত ছটফটে ছেলেকে দেখে অরুণ সরকার তার থেকেও বেশি ছটফট করবে!”
পাশ থেকে শুকলা মন্ডল হেসে বলে,
-” তা ঠিক বলেছিস! তবে এই টুকুই? ওর ওই টসটসে কচি বউ? হু হু ?”
আকাশ হাসে শব্দ করে।
-” একটু সবুর করো ফুপা মশাই! পিকচার আভি বি বাকি হে! এই ধকলটাকে একটু সামলে উঠতে দাও! নইলে বেচারা অরুণ সরকার হার্ট অ্যাটাক করে বসবে!”
উপস্থিত সকলে হেসে ওঠে হো হো করে। তাদের বিশ্রী ভয়ানক হাসি শুনে পেছনে বসা ট্রেনিং প্রাপ্ত কুকুর দুটো ঘেউ ঘেউ করে ওঠে।
চলবে…..