পাতা বাহার পর্ব-৪৮+৪৯

0
648

#পাতা_বাহার
লেখনীতে: #বেলা_শেখ
#পর্ব-৪৮ (প্রাপ্ত বয়স্কদের জন্য)

(কপি করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ)

এক বিলাসবহুল একতলা বিশিষ্ট বাড়িতে বেশ কয়েকজন মানুষ কথোপকথনে‌ ব্যস্ত। ড্রয়িং রুমের ফ্লোরে ম্যাট্রেস বিছানো। সেখানে হরেক ব্র্যান্ডের বিদেশি পানীয় সহ মাটন বিরিয়ানি উপস্থিত। সাথে সিগারেটের অ্যাশট্রে! সিগারেটের সাদা ধোঁয়ায় আড্ডা জমে ক্ষীর। একতলা বাড়ির দক্ষিণ দিকের রুম থেকে মেয়েলী শিৎকার ভেসে আসছে। সেই শব্দে আড্ডায় উপস্থিত নেশায় বুঁদ জনরার মুখে চাপা হাসির ছাপ। উপস্থিত জনরার মাঝে একজন আফসোস করে বলে ওঠে,

-” ফুপা তোমার জন্য আমার খুবই কষ্ট হচ্ছে। হর হামেশা নারী শরীরে মেতে থাকা তুমি শুকলা মন্ডল ছয় সাত মাসের বেশি হবে উপোষ করে!! এই কষ্ট কি মানা যায়?”

শুকলা মন্ডল নাক মুখ কুঁচকে বিদেশি লাল পানি গলাধঃকরণ করে। সিগারেট টেনে নাক মুখ দিয়ে ধোঁয়া ছেড়ে বিশ্রী ভঙ্গিতে বলে,

-” আমি চাইলে এখনি *** নিয়ে বিছানা গরম করতে পারমু! কিন্তু তোর ওই ভুরিওয়ালা বাপের কথা ভাব? বেচারা মনে হয় না এ জীবনে নারীর স্বাদের কথা চিন্তা করতে পারবো! তোর মায়ের কথা ভাইবা আমার কষ্ট হইতাছে!”

বলেই চুক চুক শব্দ করে শুকলা! আকাশের মুখটার আদল পরিবর্তন হয় নিমিত্তে। মদের গ্লাস ছুঁড়ে ফেলে রাগে গজগজ করতে করতে বলে,

-” মুখ সামলে কথা বলো! নইলে তোমার ওই চাঁদ সুরুজ মুখের আদল চেঞ্জ করতে এই আকাশের এক মিনিটও লাগবো না!”

শুকলা হেঁয়ালিপূর্ণ হেসে বলল,

-” শুধু আমাদের উপরেই রাগ দেখাইতে পারোস! আর ওই অরুণ সরকারের ভয়ে প্রায় তিনমাস হইলো পলাই বেড়াতেছোস! ত্যাজ শ্যাষ?”

আকাশের মুখে এবার শয়তানী হাসি ফুটে উঠলো।

-” এতো অধৈর্য হলে চলে? একটু তো সবুর করো! সবুরে মেওয়া ফলে! আর অরুণ সরকারের ভয়ে আমরা লুকাই নাই ফুপা! বরং একটু পেরেশানিতে রাখতে! শালা একটু তরপাক! তাঁর পর আসল খেল!”

শুকলা অসন্তোষ প্রকাশ করে বলে,

-” কম তো হইলো না। এখন আসল কামটা করো বাপু! ওর কচি বউটারে বিছানায় না নিতে পারলে এই শুকলা জীবনে **** ছুইবো না! শা*লির জন্য কতকিছু সহ্য করছি!”

-” আর দুই চারটা দিন সহ্য করো!”

এরমধ্যে শামিমের আগমন ঘটে। এলোমেলো অবস্থায়! আকাশ হাসি মুখে উঠে দাঁড়ালো।

-” ভাই ভালোই খেলতে পারিস! যাই আমিও একটু টেস্ট করে আসি!”

বলেই ঢুলতে ঢুলতে দক্ষিণ দিকে চলে যায়!
______

কুয়াশার চাদরে মোড়ানো শহর। যদিও এখন সকাল নয়। দুপুর গড়িয়ে বিকেল বলা চলে। তবুও কুয়াশায় ঢাকা। সারাটি দিন সূর্য মামার দেখা মেলে নি। কুয়াশার আড়ালে উঁকি দেয়ার প্রবণতা দেখা গেলেও উঁকি দেয়া বোধহয় হয়ে উঠে নি। জমকালো শীতে শীতকাল জমে উঠেছে ধরনী জুড়ে। ক্যালেন্ডারে পৌষ মাসের হাতছানি। পৌষ মাসের গোটা দশেক দিন চলে গেলেও আজকের মতো ঠান্ডা আবহাওয়ায় এখনো গাঁ কেঁপে ওঠে নি। আজকের ঠান্ডা আবহাওয়া দেখে যেন মনে হচ্ছে হ্যাঁ শীতের আবির্ভাব ঘটেছে। এরকম ঠান্ডা আবহাওয়ায় এক উনিশ বিশ বয়সী যুবক জ্যাকেট টুপি পরে একদম আপাদমস্তক ঢেকে রেখেছে। তাঁর শীত বোধহয় একটু বেশিই। যুবকটি হাসিমুখে একটা প্যাকেট হাতে নিয়ে হেঁটে যাচ্ছে আপন মনে। সামনে চেনা পরিচিত যার সাথে দেখা হচ্ছে তাঁর সাথেই এক দু মিনিট গল্প মেতেছে। এভাবে পাঁচ মিনিটের রাস্তায় সে আধা ঘন্টা সময় নিয়ে হাসিমুখে তাদের অ্যাপার্টমেন্টে প্রবেশ করে। প্রবেশদ্বারে সিকিউরিটি গার্ডেদের সাথেও দু দন্ড আলাপ করতে সে কুণ্ঠাবোধ করে নি। লিফট করে চার তলায় উঠে ডান পাশের ফ্ল্যাটে কলিংবেল বাজায় এক নাগাড়ে। দরজার ওপাশের ব্যাক্তি এতে বিরক্ত হলেও যুবকটির চোখে মুখে যেন আনন্দ উপচেপড়া। মিনিটের ব্যবধানে দরজা খুলে যেতেই যুবকটি হাতের প্যাকেট বাড়িয়ে চাঞ্চল্যকর কন্ঠে বলে,

-” আপুউ! এই নাও তোমার চটপটি উইথ বেশি করে টক! সাথে কলার চপ, ফুচকাও এনেছি। আমার একমাত্র ভাগ্নের জন্য পিৎজা ! মমোস আনলাম না। ওটা আমার একটুও পছন্দ না। লেট করে ফেলেছি বুঝি? ইশ স্যরি হ্যাঁ! আসলে রাস্তায় এতো চেনা পরিচিত! কথা না বললে ভালো দেখায় বলো? বায় দা ওয়ে আমার ওই খারুস দুলাভাই আছে?”

পাতা যুবকটির কথা শুনে মুচকি হেসে বলে,

-” তোমার দুলাভাই থাকলে এগুলোর জায়গা বিনে হবে। সাথে একশো একটা জ্ঞান! আসো ভিতরে আসো ইমন!”

ইমন নামক ছেলেটি বিস্তর হেসে বলে,

-” না আপু! এখন যাবো না। তোমার ওই গোমড়া মুখো জামাই এলে আসবো। তার সাথে মধুর আলাপনে লিপ্ত না হলে আমার আবার পেটের ভাত হজম হয় না। হজম থেকে মনে পড়লো! ইয়া আল্লাহ্ আমার তিন মিনিটের ছোট বোন আমাকে গ্যাস্ট্রিকের ওষুধ নিতে বলেছিলো! দেখোতো আপু? আমি একলা মানুষ কতোদিকে যাই!! একটা বউ থাকলে তাঁও হতো! এখন নেই তো কি করার! আসছি আমি। ভাগ্নেকে একটুপরে ক্রিকেট খেলতে নিয়ে যাবো। তোমার বারণ কিন্তু শুনবো না…”

তাঁর কথা থামে নি;বলতে বলতেই চলে গেছে। পাতা হাসে। ছেলেটা তাঁর রাস্তাত ভাই! মানে ওই যে রাস্তায় সিগন্যালে দেখা হয়েছিলো! তাকে আপু ডেকেছিল বলে অরুণ সরকার অর্ধেক সম্পত্তি দাবি করেছিলো! সেই ছেলেটাই। নাম ইমন জুবায়ের! একেবারে বাঁচাল তবে মনটা ভালো! কি সুন্দর করে তাকে আপু বলে ডাকে। ভোরকে ভাগ্নে ডাকে। ভোরের আবার তাঁর সাথে বেশ ভাব। তবে অরুণ সরকারের ইমনের সঙ্গে আড়িবাদ। একটুও পড়ে না। নাক উঁচু লোকটা দেখতেই পারে না ছেলেটাকে। আর ইমন যেন লোকটার পিছনেই লেগে থাকে। দুলাভাই দুলাভাই বলে বিরক্ত করে! ইমন তার পরিবার সহ এই অ্যাপার্টমেন্টে তিন তলায় থাকে।

পাতা দরজা বন্ধ করে দেয়। কিচেনের কেবিনেটের উপর প্যাকেট রেখে সব আনপ্যাক করে। পিৎজা প্যাকেট খুলে দুটো স্লাইড একটা প্লেটে রেখে চা সহ ট্রে নিয়ে স্টাডি রুমের সামনে যায়। নক করে ঘরে প্রবেশ করে ট্রে রেখে আসে। ভোরের মাথায় বেঁকে যাওয়া টুপি ঠিক করে দিয়ে চুপটি করে বলে,

-” তোমার জন্যও আছে। এগুলো হুজুরের! ভালোভাবে পড়াশুনা কর!”

বলেই বেরিয়ে আসে। কিচেন থেকে আনপ্যাক করা খাবার গুলো টি টেবিলে রেখে পা তুলে বসে।হালকা গরম কলার চপ মুখে দিয়ে চোখ বুজে নেয়। আহ্! শীতের বিকেলে গরম গরম স্ট্রিট ফুডের মজাই অন্যরকম। পাতা একে একে কলার চপ গুলো শেষ করে। ভোর কলার চপ খায় না। ভোরের বাবাও না।তবে পাতার পছন্দের তালিকায় এটা আছে। পাতা চটপটির বাটি এগিয়ে এনে এক চামচ মুখে দেয়। ভালো খেতে! পাতা বাটিটা ঢেকে রাখে। ভোরের হুজুর কখন ছুটি দেবে? এভাবে একা বসতে ভালো লাগে না। পাতা গায়ের শালটা ভালোভাবে জড়িয়ে সোফায় পা তুলে বসে।আশেপাশে চোখ বুলিয়ে দেখে নেয় তাদের নতুন সংসার। ফ্ল্যাটের দু পাশে দুটো করে চারটা রুম! একপাশের দুটো বেডরুম। অপরপাশে একটা স্টাডি রুম। অন্যটা ফাঁকাই বলা চলে; জিম করার সব হাবিজাবি সরঞ্জামসহ ভোরের খেলনায় ভর্তি। একপাশে কিচেন ও ডাইনিং টেবিল। মাঝখানে সোফার সেট! যেখানে পাতা একা বসে আছে। নেই কোনো সঙ্গী। পাতার মনটা খারাপ হয়ে যায়। সরকার বাড়িতে থাকলে এই সময় শাশুড়ি মায়ের সাথে আড্ডা দেয়া যেতো। মিনু আপার ছোট বাবুর সাথে সময় কাটানো যেতো‌। আদুরির সাথে শপিং করে ফুচকা প্রতিযোগিতা করা যেতো। আরিয়ান ভাইয়ের সাথে তর্ক বিতর্ক প্রতিযোগিতায় হারানো যেতো। বিকেলে বাগান বিলাস; গোধূলি বেলায় ছাদ বিলাস! আরো কত কিছু! আর এখানে শুধু অলস বসে সোফাবিলাস, টিভিবিলাস, ফোনবিলাস ছাড়া কিছুই করার নেই। রান্নাঘরটাও নাক উঁচু ম্যানারলেস লোকটার দখলে। সেখানে রান্না করতে যাওয়া পাতার জন্য নিষিদ্ধ। এই বাড়িতে আসার আড়াইমাস গড়িয়েছে তাদের। এখনো পর পর লাগে বাড়িটা। আপন আপন ফিল আসে না। মনে হয় ছুটে যাক সেই সরকার বাড়িতে।
এখনো চোখের পাতায় ভেসে বেড়ায় সরকার বাড়ি ছেড়ে আসার দৃশ্য! ঘুম থেকে ওঠার পর ইয়া বড় বড় দুটো লাগেজ দেখে পাতার কপালে ভাঁজ পড়লেও লাগেজ দিয়ে কি হবে? এর উত্তরে যখন লোকটা জানায় তাঁরা বাড়ি ছাড়ছে; তখন পাতা বাকহারা। লোকটা বলে কি! নিশ্চয়ই মজা করছে! কিন্তু সত্যি সত্যিই যখন তাঁরা বাড়ি থেকে বের হলো তখন পাতার ভ্রম দূর হয়। আসমা বেগম, আরিয়ান হাত ধরে থামানোর চেষ্টা করায় জেদে ভরপুর লোকটার এক জবাব ‘এভাবে ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করলে সরকার বাড়ির চৌকাঠেও অরুণ সরকার পা দেবে না ভবিষ্যতে!’ ব্যস তারা আর কিছুই বলে নি। তাঁরা খুব ভালো করে চেনে অরুণকে‌। তার জেদ সম্পর্কেও অবগত। রুবি অনুতপ্ত হয়ে, নাকি মিছে মিছি পাতার জানা নেই; তবে সেও লোকটার হাত ধরে ভাইয়া ডেকে ক্ষমা চেয়েছে। এতেও কাজ হয় নি। অরুণ সরকার তার কথায় অনড়। ক্রন্দনরত ভোরের জেদও খাটে নি জেদে ভরপুর অরুণ সরকারের কাছে। শেষে আনিকা, রূপ ও ভোরের হাঁউমাঁউ কান্নাও গলাতে পারে নি কঠোর লোকটাকে।

পাতা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আনমনে চেয়ে থাকে। ভোরের আগমনে পাতা সোজা হয়ে বসে। ভোরের হুজুর মাথা নিচু করে পাতার সাথে টুকটাক কথা বলে চলে যায়। হুজুরের বিদায় পর্ব সমাপ্ত হতেই ভোর দরজা লাগিয়ে পাতার পাশে বসে। পাতা নিজ গায়ের শাল জড়িয়ে ভোরকে কোলে বসিয়ে দেয়। গালে টপাটপ কয়েকটি চুমু দিয়ে বলল,

-” আমার বাবার মন খারাপ? হুম?”

ভোর মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো।

-” ভোরের এই ছোট্ট বাড়ি একটুও ভালো লাগে না। ভোর ভোরের বাড়ি যাবে!”

-” তোমার এক্সাম শেষ হোক! আমরা যাবোতো ঘুরতে!”

-” ঘুরতে কেন? আমরা আমাদের বাড়িতে থাকবো। আগে যেমন থাকতাম।”

-” সে দেখা যাবে। আগে তোমার পিৎজা তো খেয়ে নাও! কখন থেকে অপেক্ষা করছে পিৎজাটা!”

পাতার কথায় ভোর মিষ্টি করে হেসে ওঠে। পাতা ভোরকে পাশে বসিয়ে পিৎজা দেয়। ভোর গপাগপ খেতে থাকে। গালে মুখে মাখিয়ে একাকার। পাতা তার গাল মুছে দিয়ে ফুচকা বানিয়ে প্লেটে সাজিয়ে রাখে। চটপটিতে ফুচকা ভেঙ্গে দেয়। ভোর পিৎজা সাবাড় করে পাতার সাথে ফুচকা খায়। একটা মুখে দিয়েই ঝালে হু হা করতে থাকে। পাতা হেসে মিষ্টি এনে দেয়। ভোর পুরোটা মুখে পুরে নিয়ে যেন স্বস্তি পায়,

-” ও আম্মু এই ঝাল ঝাল খাবার কেউ খায়? ভোরের তো ঝালে ঘুম পাচ্ছে!”

পাতা ফুচকা মুখে তুলে গলাধঃকরণ করে বলে,

-” এগুলো তো মেয়েদের ফেবারিট খাবারের মধ্যে পড়ে। ঝাল টক টক আরেকটু মিষ্টি! আহ্ খেয়ে যেন প্রাণ জুড়িয়ে যায়!”

ভোর গালে হাত দিয়ে তার আম্মুর দিকে তাকিয়ে থাকে। পাতা সব ফুচকা চটপটি চেটেপুটে খেয়ে এঁটো বাসন কিচেনে রেখে আসে। ফ্ল্যাক্সের গরম পানি জগে ঢেলে ঠান্ডা পানির সাথে মিশিয়ে ভোরকে পানি খাইয়ে দিল। মুখটা মুছে দিয়ে সেও হাত মুখ ধুয়ে নেয়। ড্রয়িং রুমে এসে দেখে ভোর সোফায় জড়সড় হয়ে শুয়ে আছে। পাতা ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করে,

-” ভোর? এখন ঘুমানোর সময়? যাও বই খাতা নিয়ে এসো! কাল এক্সাম আছে তোমার! কত পড়া বাকি!”

ভোর হামি তুলে অনুরোধের সুরে বলে,

-” ও আম্মু ভোরের অনেক ঘুম পাচ্ছে। একটু ঘুমিয়ে নিই? তারপর পড়বো তো! একটু আগেই না আরবি পড়লাম! এখন আবার পড়বো? একটু ঘুমাই না প্লিজ?”

পাতা অসম্মতি জানিয়ে স্টাডি রুম থেকে ভোরের বই খাতা পেন্সিল নিয়ে এসে দেখে ভোর নেই! পাতা বই খাতা টি টেবিলে রেখে ঘরে উঁকি দেয়। তার ধারনাই ঠিক কিউটের ডিব্বাটা আরামদায়ক কম্বলের নিচে লুকিয়ে।পাতা শব্দহীন পায়ে এগিয়ে যায়। ভোরের গা থেকে কম্বল সরিয়ে দিতেই ভোর খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে। পাতা বুকে হাত খুঁজে গম্ভীর মুখে ভোরের দিকে তাকালো। অরুণ সরকারের মতো রাশভারী গলায় বলল,

-” কলিজা? এ কেমন দুষ্টুমি? ভালোয় ভালোয় পড়তে বসো! নইলে থাপড়ে কানে তালা ঝুলিয়ে দিবো!”

ভোরের হাসির মাত্রা বেড়ে যায়। হাসতে হাসতে বিছানায় গড়াগড়ি খায় দু একবার। পাতা নিজেও গম্ভীর মুখ ধরে রাখতে পারে না। হেসে দেয় শব্দ করে। বিছানায় উঠে বসে ভোরের পেটে কাতুকুতু দেয়। ভোর হাসতে হাসতে বলে,

-” আম্মু এটা কিন্তু ঠিক হচ্ছে না! ভোরের কাতুকুতু লাগে তো!”

পাতা কাতুকুতু দেয়া বন্ধ করে ভোরকে বালিশে শুইয়ে দেয়। গালে ঠোঁট ডাবিয়ে শক্ত করে চুমু বসিয়ে বলে,

-” আমার বাবাটা পুরো রসগোল্লা। এতো আদুরে মনে হয় আঁচলে লুকিয়ে রাখি!”

থেমে কপালে চুমু দিয়ে আবার বলে,

-” দিয়ে দিলাম নজর কাড়া চুমু। কোনো পঁচা মেয়েরা আমার সোনা ছেলের দিকে নজর দিলে তাদের সামনের দাঁত পোকা খাবে!”

ভোর এবার লজ্জা পায় একটু আকটু; দুই হাতে মুখ ঢেকে মিনমিনে গলায় বলে,

-” ভোরের বুঝি লজ্জা করে না!”

পাতা হেসে ভোরের পাশে শুয়ে কম্বলে ঢেকে নেয় ভোরকে।

-” দুই ঘণ্টা ঘুমোবে। মাগরিবের আজান শুরুর আগেই উঠে গুড বয়ের মতো পড়তে বসবে ঠিকাছে?”

ভোর মিষ্টি হেসে মাথা কাত করে সায় জানায়। গুটিসুটি মেরে পাতার বুকে মুখ গুঁজে চোখ বুজে বলে,

-” আই লাভ ইয়ু আম্মু!”

-” হয়েছে পাম দিতে হবে না আমার পড়া চোর আব্বাজান! পড়তে বসলে আব্বাজানের ঘুম পায়, ক্ষিধে লাগে শত বাহানা!”

ভোর পাতার গায়ে পা তুলে কোল বালিশের ন্যায় জড়িয়ে ধরে বলে,

-” আম্মু শীত লাগে তো!”

পাতা মুচকি হেসে ভালোভাবে কম্বলসহ ভোরকে জড়িয়ে রাখে। কিছু সময় অতিবাহিত হওয়ার পর ভোর ঘুমিয়ে পড়ে। পাতারও চোখে ঘুম নামে। ইদানিং ঘুম যেন কাবু করে রেখেছে তাকে। অলস বসে থাকলেই ঘুমে তলিয়ে যাবে নিমিত্তে। তবে দুদিন হলো ঘুম হাওয়া হয়ে গেছে টেনশনে। কিসের চিন্তা? ভাবতেই পাতার গাঁয়ে কাঁটা দেয়!একটা হাত অজান্তেই পেটে চলে যায়। সত্যিই কি কেউ আসতে চলেছে? দেড়মাস হলো পিরিয়ড মিস। লতাপু কে জানাতেই প্রেগন্যান্সি কিটের কথা বলে। পাতা কিট ব্যবহার করে পজিটিভ সাইন পায়। ব্যপারটায় খুশির হলেও পাতার বুকটা ধ্বক করে ওঠে। খুশি হতে পারে না। লতাপুকে মিথ্যে বলে নেগেটিভ এসেছে। ভয়ে হাত পা শিথিল হয়ে আসে পাতার। ভয়টা তার অজানা নয়। এই সংবাদটা যদি সত্যি হয় তাহলে লোকটার রিয়্যাকশন কি হবে? নিশ্চয়ই পাতার উপর অনেক চিল্লাচিল্লি করবে; রাগ দেখাবে; কথা শোনাবে! বাড়াবাড়ি পর্যায়েও যেতে পারে। আর ভোর? সেও কি বাবার মতোই পাতাকে ভুল বুঝবে? বুঝতেই পারে; ছোট বাচ্চা! পাতা ভোর, ভোরের বাবার কথা একপাশে রাখে। নিজের সাথে কীভাবে লড়বে সে? সে পণ করেছিলো ভোরকে তার সর্বোচ্চ প্রায়োরিটির সাথে ভালোবাসা দিবে। কিন্তু আগত অতিথি যদিও সে এখনো বিশ্বাস করে না তবুও যদি তাঁর আগমন ঘটে পাতা কি সত্যিই চেঞ্জ যাবে? নিজ গর্ভের সন্তান পেয়ে ছোট ভোরের প্রতি সামান্য বিতৃষ্ণা জাগবে না তো বিশ্বাসঘাতক মনটাতে? সে চায় না ভোরের প্রতি কখনো সামান্য পরিমাণেও, ক্ষণিকের জন্যও বিতৃষ্ণা জাগুক। সে চায় ছোট আদুরে ভোর’টায় তার তৃষ্ণা প্রতি ক্ষণে ক্ষণে বাড়ুক!

পাতা ঘুমন্ত ভোরের মুখটায় একবুক স্নেহ উজাড় করে চুমু দেয়। সময় নিয়ে পলকহীন তাকিয়ে থাকে মায়াভরা চোখে। নোনাজল গড়িয়ে পড়ে কার্নিশ বেয়ে। পাতা ছোট ভোরের ছোট্ট বুকটায় মাথা রেখে বিড়বিড় করে বলে,

-” আম্মু ভোরকে অনেক ভালোবাসে। কতটা ভালোবাসে? এক বুক? এক আকাশ? এক সমুদ্র? নাহ্!”

থেমে যায় পাতা! পূর্বের চেয়েও ধীমে সুরে ভালোবাসা ঢেলে ফিসফিসিয়ে বলে,

-” এক মা যতটুকু ভালোবাসতে পারে ঠিক ততটুকুই ভালোবাসি তোমায় ভোর! এক মেয়ে বাবাকে যতটুকু ভালোবাসে ঠিক ততটুকুই ভালোবাসি ভোর!”

উঠে পড়ে পাতা। বিছানা থেকে নেমে আলমারি খুলে কাপড়ের ভাঁজে লুকিয়ে রাখা দুটো কিট বের করে দেখে প্রাণ ভরে। আঁখি যুগল ঝাপসা হয়ে আসে। হঠাৎ কলিং বেলের শব্দে পাতার হাত থেকে কিট দুটো পড়ে যায়। ভয়ে কেঁপে ওঠে। তড়িঘড়ি করে নিচে ঝুঁকে কিট দুটো তোলার জন্য। একটা পেলেও আরেকটা পায় না। পাতা ভয়ে ঢোক গিলে আশেপাশে খোঁজ চালায়; পায় না। ওদিকে কলিংবেল একনাগাড়ে বেজেই চলেছে। পাতা নিজেকে শান্ত করে এদিকে ওদিকে তাকাতেই দেখতে পায় বেড সাইড টেবিলের নিচে কিটটা। পাতা তুলে কাপড়ের ভাঁজে রেখে দেয়। বড় বড় পা ফেলে গিয়ে দরজা খোলে। দরজার ওপাশের ব্যাক্তিকে দেখে হাসিমুখে বলে,

-” আরে আন্টি! আসুন ভেতরে আসুন!”

ইমনের মা ইরাবতীর আগমন ঘটে পাতার ছোট সংসারে। মহিলাটি বেশ সুন্দর দেখতে। বয়সের ছাপ বোঝা মুশকিল। এখনো যথেষ্ট ইয়াং অথচ ইমনের বাবা কেমন বুড়িয়ে গেছে। ইমনের মা মহিলা পুরো ছেলের কার্বন কপি! একেবারে বাঁচাল! কথা বলতে বলতে কানের পোকা বের করে দেয়। যতক্ষণ থাকবে তার মুখে খই ফুটতেই থাকবে। এখনো বলেই যাচ্ছে। পাতা হু হা করে তাকে সোফায় বসিয়ে দিয়ে ফ্লাক্স থেকে চা ঢেলে বিস্কুট এনে টি টেবিলে রাখে। মহিলাটি বিস্তর হেসে বলে,

-” তোমার হাতের চায়ের তুলনা হয় না। এতো ভালো চা কিভাবে বানাও বলোতো? মনে হয় চা নয় এ যেন অমৃত সুধা। আহ্ খেয়েই আমার প্রাণটা জুড়িয়ে যায়! তাই বারবার তোমার চায়ের টানে ছুটে আসি! তুমি রাগ করো নাতো?”

-” কি যে বলেন না আন্টি! ভালো লাগে আমার আপনি আসলে!”

মুচকি হেসে বলে পাতা। সত্যিই মহিলার সঙ্গ খারাপ লাগে না। পাতা চায়ের কাপ তুলে নিজেও চুমুক বসায়। আহ্! সত্যি এই চায়ের তুলনা হয় না। হবে কেন? তার একটামাত্র জামাইয়ের হাতে বানানো চা! অসাধারণ হতেই হবে। পাতা কথার ফাঁকে মহিলাটির কাছে আবদার করে তাকে যেন মুরগির মালাই কোফতা ও পোলাও রান্না করা শেখায়। ব্যস মহিলাটি পাতার হাত ধরে কিচেনে নিয়ে যায়। নিজেই ফ্রিজ খুলে সব সরঞ্জাম বের করে। পাতাকে দেখিয়ে দেয় কিভাবে কি করতে হবে। পাতা বাধ্য স্টুডেন্টের ন্যায় তার দেখানো দিক নির্দেশনা মোতাবেক কাজ করতে থাকে। অনভিজ্ঞ পাতা সময় নিয়ে আস্তে ধীরে সব করতে থাকে। ইমনের মা তার আলাপ চারিতা বন্ধ করে নি। গড়গড় করে বলছে ইমন ও ইশার বাচ্চাকালের দুষ্টু মিষ্টি কান্ডকারখানা। হঠাৎ ইমনের মা‌ কথা বলা বন্ধ করে পাতার দিকে তাকিয়ে থাকে। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে পাতার আপাদমস্তক। পাতা অস্বস্তিতে পড়ে বোকা বোকা হেসে বলে,

-” ওভাবে কি দেখছেন আন্টি?”

মহিলাটি মাথাটা এগিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে,

-” একটা কথা বলি? সত্যি করে বলবে কিন্তু?”

পাতা ঢোক গিলে। কি না কি বলবে এই মহিলা আল্লাহ জানে! তবুও বলে,

-” বলুন আন্টি!”

-” তোমার ছেলের তো ছয় বছর হয়েই গেল। পরবর্তী বাচ্চা নেয়ার এখনি উপযুক্ত সময়! ছেলে বড় হয়ে গেলে আবার সমস্যা!”

পাতা খানিকটা ঘাবড়ে যায়। আমতা আমতা করে লজ্জার ভান করে বলে,

-” কি যে বলেন না আন্টি!”

মহিলাটি সন্দেহের নজরে তাকিয়ে বলে,

-” আমার না কেমন যেন সন্দেহ হচ্ছে যে তুমি সন্তান সম্ভাবা! না মানে রাগ করিও না। আমি না কিছু কিছু ক্ষেত্রে ধরতে পারি! এই যে তোমার স্বাস্থ্যের উন্নতি হয়েছে দুই মাসে। বেশ সুন্দরী হয়েছো। চেহারায় এক ধরনের আলাদা দ্যুতি ছড়িয়ে পড়েছে! তাছাড়া টক খেতে ভালোবাসা। এই সত্যিই নাকি?”

পাতার চোখে মুখে নিমিষেই ভয়ের ছাপ ফুটে ওঠে। সে ঘন ঘন মাথা নেড়ে বলে,

-” আপনার ভুল হচ্ছে আন্টি! পিরিয়ড শেষ হলো কিছুদিন হলো!”

মিথ্যা বলে পাতা মনে মনে বেশ কয়েকবার তওবা কাটে। সাথে অনুশোচনায় ভোগে। মহিলাটি হেসে বলল,

-” ওহ্ আমি ভাবলাম কেউ আসছে। তবে আনতে পারো! নাকি আর বাচ্চা চাই না? রাজপুত্তুর আছে তো!”

পাতার মুখ মলিনতায় ছেয়ে গেলেও কৃত্রিম হাঁসি ফুটিয়ে বলে,

-” উনি যা বলবেন!”
____

শীতের কুয়াশামাখা রজনী। কুয়াশা পরছে টপ টপাটপ। শীত বুঝি এবার জাঁকিয়ে বসে! অরুণ সরকার লিফট থেকে বের হয়ে ডান দিকে অগ্রসর হয়। কলিং বেল বাজিয়ে হাত ঘড়ির দিকে তাকায়! ঘড়ির কাঁটা আটটার ঘরে। শীতের রাতে আটটা মানেই বেশ রাত! তবে শহরাঞ্চলে খুব একটা নয়। অরুণ বিরক্ত মুখে আবার কলিং বেল বাজায়। এই মা ছেলে ঘুমিয়ে পড়েছে বোধহয়! ভেবেই অরুণের মেজাজ বিগড়ে গেলো। সে ব্যাগ হাতরে চাবি খুঁজতে থাকে;পেয়েও যায়। তবে তার আগেই দরজা খুলে যায়।

পাতা হামি তুলে মিষ্টি হেসে কিছু বলবে এর আগে অরুণের গম্ভীর গলা শোনা যায়,

-” এতক্ষণ লাগে দরজা খুলতে?”

পাতার হাসি দপ করে নিভে যায়। কপাল কুঁচকে নিয়ে আঙ্গুল উঁচিয়ে বলে,

-” এতক্ষণ লাগে বাড়ি ফিরতে? বাড়িতে আমি ভোর একা থাকি এই খেয়াল থাকে না?”

অরুণ পাতাকে সরিয়ে দিয়ে ভিতরে ঢুকে বলে,

-” শুয়ে বসে থাকি না নিশ্চয়ই!”

পাতা থমথমে মুখে দরজা বন্ধ করে দেয়। লোকটা কি ইনিয়ে বিনিয়ে খোঁচা দিল?

ভোর ড্রয়িং রুমের সোফায় বসে উঁকি দিচ্ছিল কে এসেছে? বাবার গলা শুনতে পেয়েই পেন্সিল খাতা ছুঁড়ে ফেলে ছুটে আসে। বাবার কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ে। অরুণ হাসিমুখে ছেলেকে কোলে নিয়ে আদর করে প্রাণ ভরে। গালে ঠোঁট চেপে রেখেই বলে,

-” আমার কলিজা! আই মিসড ইয়ু সো মাচ!”

ভোর বাবার গলা জড়িয়ে ধরে অভিমানী সুরে বলে,

-” আব্বু তুমি এতো লেট লেট আসো কেন? আমি কখন থেকে তোমার জন্য ওয়েট করছিলাম!”

অরুণ ছেলেকে বুকে জড়িয়ে আদুরে গলায় বলে,

-” একটু কাজ ছিল আব্বু! কাল থেকে জলদি ফেরার চেষ্টা করবো! তোমার এক্সামের প্রিপারেশন কেমন?”

ভোরের হাসিমাখা মুখটা কাঁচুমাচু হয়ে যায়। সে আড়চোখে বাবার পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা আম্মুর দিকে তাকায়!

পাতা শাল জড়িয়ে শান্ত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে। দৃষ্টি বাবা ছেলেতেই। ভোরের কাঁচুমাচু মুখ দেখে অরুণের বুঝতে বাকি থাকে না পড়ালেখায় উদাসীন ছেলের পরীক্ষার প্রস্তুতি কেমন! অরুণ ছেলেকে সোফায় বসিয়ে হুকুম তামিল করে,

-” ভদ্র ছেলের মতো সব পড়া কমপ্লিট করবে বলে দিলাম! নইলে তোমার পিঠে নকশা আঁকবো!”

ভোরের বুঝতে বাকি রইলো না পিঠে নকশা কিভাবে আঁকবে! সে গাল ফুলিয়ে পেন্সিল খুঁজে লিখতে শুরু করে দেয়। আজ লিখে লিখে সব লেখাই শেষ করে দেবে!অরুণ পাতার দিকে একনজর চায়। তারপর হনহনিয়ে ঘরে ঢুকে যায়! পাতা মুখ ভেঙায়। লোকটার চাহনি বুঝতে পাতার এক সেকেন্ডও সময় লাগে নি। যাবে না সে ঘরে! পাতা ভোরের পাশে বসে তাঁকে পড়ানোতে মনোযোগী হয়। ঘর থেকে অরুণের ডাক ভেসে আসে! পাতা শুনেও না শোনার ভান করে বসে থাকে। তবে কান খাঁড়া করে রাখে দ্বিতীয়বার ডাক শোনার। কিন্তু শোনা যায় না।
একটু পরে অরুণ সরকার নিজেই বেরিয়ে আসে। পাতা আড়চোখে দেখে। খালি গায়ে নাভীর নিচে প্যান্ট পড়ে শব্দহীন পায়ে হেঁটে কিচেনে চলে যায়! পাতা ভাবে লোকটার কি শীত অনুভূত হয় না? সে সোয়েটার, শাল জড়িয়ে নিয়েছে আর লোকটা খালি গায়ে হট হট বডি প্রদর্শন করে ঘুরে বেড়াচ্ছে। পাতা কি বোঝে না যে এসব তাকে বশে আনার পাঁয়তারা চলছে। বোঝে সে ষোলআনা কিন্তু তবুও বশীভূত হয়ে যায়।
পাতা লম্বা শ্বাস টেনে ভোরকে পড়া বুঝিয়ে কিচেনে চলে যায়। ড্রয়িংরুম থেকে কিচেন স্পষ্টভাবে দেখা যায়। ভোর ঘার ঘুরিয়ে কয়েকবার তাকিয়ে থেকে নিজের লেখায় মনোযোগী হয়।

-” এগুলো রান্না করেছে কে?”

-” আমি। কেন বিশ্বাস হচ্ছে না? শুয়ে বসে থাকি তো তাই ভাবলাম একটু কাজ করি!”

অরুণ কেবিনেটের উপর রেখে বাঁকা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। পাতা তার একটু দূরত্বে! পাতার জবাবে অরুণের কপালে ভাঁজ পড়ে। গমগমে গলায় বলে,

-” আদৌ খাওয়ার উপযোগী তো?”

পাতা যেন ফুঁসে ওঠে। মানছে সে রান্না পারে না। তাই বলে এভাবে অপমান করবে? খাওয়ার অনুপযোগী হলেও হাসিমুখে সব খাবার গলাধঃকরণ করে আদর্শ হাসবেন্ডের মতো বলবে ‘ পাতাবাহার এতো সুস্বাদু খাবার জনমে খাই নি’ অথচ বলে কি না ‘খাওয়ার উপযোগী কি না!’ পাতা নাকের পাটা ফুলিয়ে বলে,

-” না। খাওয়ার অনুপযোগী।”

বলেই কিচেন থেকে বেরিয়ে যায়‌। লোকটা এমন কেন? মনে হয় তার প্রতি উদাসীন। পাতার প্রস্থান দেখে অরুণ দীর্ঘশ্বাস টেনে নেয়। খাবারের ঢাকনা সরিয়ে নাক টেনে ঘ্রাণ নেয়। অভিজ্ঞ অরুণ বুঝতে পারলো খাবার খাওয়ার অনুপযোগী নয়। বরং সুস্বাদু! কিন্তু কথা হলো এই অষ্টম আশ্চর্যের ঘটনা কিভাবে সংঘটিত হলো। অরুণ একটা প্লেটে পোলাও ও মুরগির মালাই কোফতা কারি নেয়। হাত ধুয়ে মুখে নেয় খাবার। মন্দ নয়! বেশ খেতে! তার পেটের ক্ষিধে যেন তরতরিয়ে বেড়ে যায়! প্লেট নিয়ে ড্রয়িংরুমের সিঙ্গেল সোফায় বসে আপন মনে খাবার খেতে থাকে।

পাতা একটু পর পর আড়চোখে দেখে। ভোর পিট পিট করে তাকিয়ে থেকে গাল ফুলিয়ে জোড়ে জোড়ে পড়তে থাকে।
অরুণ তাদের দুজনের কান্ড দেখে মুচকি হেসে বলে,

-” এভাবে আমার খাবারে নজর দিলে তো আমার অসুখ করবে!”

ভোর বাবার করা অভিযোগে তীব্র প্রতিবাদ করে বলে,

-” কোথায় নজর দিচ্ছি? বরং তুমি আমার লেখাপড়ায় ডিস্টার্ব করছো আব্বু”

অরুণ উঠে এসে টি টেবিলের উপর বসে। মাংস সমেত এক লোকমা পোলাও ভোরের মুখের সামনে বাড়িয়ে দিলে ভোর অন্যদিকে তাকিয়ে মুখে পুরে নেয়। পরপর পাতার মুখেও খাবার দিয়ে বলে,

-” ভালো খেতে! তা কিভাবে রাঁধলে?”

পাতা কিছু বলবে এর আগে ভোর বলে ওঠে,

-” তিনতলার ওই আন্টি আম্মুকে শিখিয়েছে।”

অরুণ পাতার দিকে তাকিয়ে বলে,

-” বলেছিলাম না কারো সঙ্গে না মিশতে?”

-” মিশলে কি হবে? একা একা কতক্ষণ থাকবো? ভালো লাগে না এখানে প্রতি সেকেন্ড দম বন্ধ বন্ধ লাগে।”

কাঠ কাঠ গলায় বলে পাতা। ভোরও অভিযোগ করে,

-” আমারও ভালো লাগে না। আমরা আমাদের বাড়িতে থাকতে চাই আব্বু!”

-” এটাও আমাদের বাড়ি কলিজা!”

-” এটা পঁচা বাড়ি। আনি নেই রুপ নেই! চাচি, চাচ্চু, দাদি,মিনু খালা, ভারি কাক্কু কেউ নেই। ভোরের একটুও ভালো লাগে না।”

কাঁদো কাঁদো গলায় বলে ভোর। অরুণ তার মুখে খাবার তুলে দেয়। কিছু বলে না। বরাবরের মতো চুপ থাকে। ভোর আবার বলে,

-” এই বাড়ি ছোট! ভোর ভালোভাবে খেলতে পারে না। দৌড়াতে পারে না। ক্রিকেট খেলার মাঠও নেই! ”

-” আরেকটু বড় হও! বড় বাড়ি বানিয়ে দিবো।”

পাতা এবার বলে,

-“এভাবে আর কতদিন চলবে ভোরের বাবা? ছোট একটা কথা কাটাকাটিকে কেন্দ্র করে ভরা সংসার ভেঙ্গে দেওয়া কতটা যুক্তিসঙ্গত!”

-” কথাটা আপন পরের পাতাবাহার! আমরা আপন নই ওদের। আর কিছু কিছু সম্পর্কে দূরত্ব জরুরী। কাছাকাছি থাকলে অল্প অল্প ঝগড়া বিবাদ, কথা কাটাকাটিতে সম্পর্কে তিক্ততা ছড়িয়ে বিষবাণে পরিণত হয়। সম্পর্ক ছিন্ন হওয়ার ভয় থাকে।”

অরুণের শান্ত গলা। পাতা চুপ থাকে।যুক্তি সেও দেখাতে পারবে। কিন্তু লোকটাকে মানানো যাবে না। ভোর ওত বড় বড় কথা না বুঝলেও বুঝতে পারে বাবা কখনো ওবাড়ি যেতে রাজি হবে না। অরুণ চুপচাপ নিজে দু এক লোকমা খেয়ে ভোর ও পাতাকেও খাইয়ে দিল। প্লেটের খাবার শেষ হলে অরুণ উঠে যায়। পাতা উশখুশ করে। তার পেট এখনো ভরে নি। এই টুকু খাবারে তার পেটের এক চতুর্থাংশও ভরেছে কি না সন্দেহ! সে জড়তাকে পিছনে ঠেলে বলে,

-” আমার পেট ভরে নি কিন্তু!”

অরুণ পিছনে ফিরে তাকালো। গলা খাঁকারি দিয়ে চোখে মুখে কৃত্রিম অবাকতা ফুটিয়ে বলে,

-” বলো কি পাতাবাহার! এতো খানি পোলাও কোফতা খেয়েও পেট ভরে নি? মজা করছো নিশ্চয়ই!”

অস্বস্তিতে পাতার আপাদমস্তক যেন নুইয়ে পড়ে। লজ্জায় জুবু জুবু অবস্থা। কি বলবে? মানা করে দেবে? কিন্তু খিদেয় যে পেটে ইঁদুর দৌড়ায়!
অরুণ মুচকি হেসে এগিয়ে আসে। এঁটো প্লেট দিয়ে পাতার মাথায় টোকা দিয়ে বলে,

-” হয়েছে লজ্জার কি আছে? আনছি খাবার! তবে পাতাবাহার বি কেয়ারফুল হুম? এরকম গুলুমুলু আদুরে টাইপ বউ ঠিক আছে। তবে বেশি মোটা হলে কিন্তু সমস্যা!”

পাতার এই মুহূর্তে বাচ্চাদের মতো ফ্লোরে গড়াগড়ি খেতে খেতে চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। শালার ইতর জামাই! সে কাঁদো মুখে ভোরের দিকে চায়। ভোরও তার দিকেই তাকিয়ে আছে আড়চোখে। সে তাকাতেই মিষ্টি করে হেসে দিলো। পাতা প্রতিত্তরে হাসলো না; লজ্জা পেলো। সে সোফা থেকে উঠে অরুণের দিকে তেড়ে যায়।

-” নাক উঁচু ম্যানারলেস ইতর লোক। ইনিয়ে বিনিয়ে আমাকে মোটা বলা হচ্ছে? উপর ওয়ালার দয়ায় একটু স্বাস্থ্য ফিরছে; আপনি নজর দিচ্ছেন? কোন দিকে আমাকে মোটা লাগে?”

অরুণ বড় বড় পা ফেলে ড্রয়িংরুম জুড়ে হাঁটতে থাকে। তাঁর পেছনে পাতা দৌড়াচ্ছে এক প্রকার। অরুণ হাসতে হাসতে বলল,

-” আরে পাতাবাহার। মজা করছি তো! রেগে যাচ্ছো কেন?”

-” আপনার মজা আমি ছোটাচ্ছি! দাঁড়ান বলছি! পালাচ্ছেন কেন?”

অরুণকে ধরার চেষ্টা করতে করতে বলে পাতা। হাঁপিয়ে উঠেছে সে।ভোর পড়া ছেড়ে হাসিমুখে সোফায় পা তুলে বসে দুজনের খুনসুটি দেখতে ব্যস্ত। অরুণ পাতার চাইল্ডিশ আচরণে বেশ মজা পায়! পায়ের গতি বাড়িয়ে দিয়ে বলে,

-” মোটেই পালাচ্ছি না। শরীরের আনাচে কানাচে একটু মেদ জমেছে। হেঁটে আয়ত্তে আনছি!”

পাতার ধৈর্য্যের বাঁধ ভেঙ্গে গেল নিমিষেই। সে দৌড় থামিয়ে দিয়ে সোফা থেকে কুশন গুলো তুলে একটা পর একটা ঢিল ছুঁড়ে অরুণের উদ্দেশ্যে। গলায় তেজ ঢেলে বলে,

-” বাড়াবাড়ি করছেন কিন্তু? আমি মোটা হয়েছি। আরো হবো! একেবারে ফুটবল বনে যাবো। আপনার কি তাতে? খবর দার নজর দিলে!”

অরুণ হাসি থামিয়ে সিরিয়াস মুখে বলে,

-” আমারই তো সব। লোকে বলবে ওই তো অরুণ সরকারের মোটা বউ! তখন আমার কষ্ট লাগবে না বলো? ভোর বলো লাগবে না?”

ভোর দাঁড়িয়ে উঠে বিজ্ঞদের মতো মাথা নাড়িয়ে বলে,

-” লাগবেই তো আব্বু। আমারো কষ্ট লাগবে!”

পাতা কটমট করে বাবা ছেলেকে দেখে নেয়। সিঙ্গেল সোফায় ধপাস করে বসে বলে,

-” বিরক্তিকর। মোটা আমি হচ্ছি। অথচ চিন্তা পুরো দুনিয়ার! ভোর আমি মোটা?”

ভোর এগিয়ে আসে। পাতার ফুলো গাল টেনে বলে,

-” একটুও না। আমার আম্মু সবথেকে ভালো ও সুন্দর! একদম পারফেক্ট!”

পাতার মুখে হাসি ফুটে ওঠে। হাসিটা বোধহয় একজনের সহ্য হলো না। অরুণ বড় বড় পা ফেলে পাতার নিকট আসে। বা হাতে ভোরের চোখ মুখ ঢেকে তড়িৎ বেগে ঝুঁকে আসে; পাতার ফুলো গালে আলতো কামড়‌ বসিয়ে অতি ধীমে গলায় ফিসফিসিয়ে কিছু বলে। পাতার চোখের আকার বড় হয়। অরুণ বলেই সরে আসে। ভোরের মুখের উপর থেকে হাত সরিয়ে এঁটো প্লেট হাতে কিচেনের দিকে চলে যায়। ভোর সন্দেহ নজরে বাবার প্রস্থান দেখে। আম্মুর দিকে তাকিয়ে বলে,

-” আব্বু কি বললো তোমায়?”

পাতা এদিকে ওদিকে তাকিয়ে নজর লুকিয়ে নিজেকে ধাতস্থ করে। অসভ্য বেহায়া লোক! ভোর পিট পিট করে তাকিয়ে বলে,

-” আবার মোটু বলেছে?”

পাতা ভোরের দিকে তাকালো। ভোর মিষ্টি করে হেসে বলল,

-” আব্বু তো মজা করে বলেছে। তুমি রেগেছো তাই আরো বেশি করে মজা নিচ্ছে!”

পাতা উঠে তাকে কোলে নিয়ে অন্যত্র বসিয়ে দিল। খাতা পেন্সিল এগিয়ে দিয়ে বলল,

-” তুমি তোমার পড়া কমপ্লিট করো?”

ভোর নাখোশ মনে বলে,

-” আম্মু ভোর অনেক পড়েছে আর পড়বে না‌‌। ভোর ভোরবেলা উঠে সব পড়া কমপ্লিট করে নেবে‌। প্রমিজ?”

পাতা ছোট ছোট করে তাকিয়ে বলে,

-“ভোর ভোর বেলা উঠে রিভিশন দিবে।এখন পড়া কমপ্লিট করবে‌। নাও?”

ভোর গাল ফুলিয়ে পেন্সিল হাতে নিয়ে ‘টুইঙ্কল টুইঙ্কল’ রাইম লিখতে থাকে। মাঝে মাঝে স্পেলিং ভুল যাচ্ছে পাতা ঠিক করে দেয়।
অরুণ প্লেট ভর্তি খাবার এনে পূর্বের জায়গায় বসে। ছেলের পড়ার ডিস্টার্ব না করে চুপচাপ দু’জনকে খাইয়ে দিতে থাকে। ভোর তিন লোকমা খেয়েই আর খাবে না। অরুণ জোড় করে না । পাতাকে খাইয়ে দেয়। পাতা লোকমা মুখে পুরে বলল,

-” আপনি খাচ্ছেন না কেন?”

অরুণের পেট ভরে গেছে আদিতেই‌। এখন এক লোকমাও গলাধঃকরণ করা অরুণের পক্ষে অতিরিক্ত। তবুও মুখে নেয়। নয়তো মেয়েটা লজ্জায় লাল হয়ে খাবেই না। অরুণ মুখে খাবার নেয়ায় পাতা যেন স্বস্তি পায়। ভোরের পড়ানোয় মনোযোগ দেয়। অরুণ প্লেটের খাবার শেষ করে পাতার উদ্দেশ্যে বলে,

-” আরেকটু আনবো?”

-” না পেট ভরে গেছে!”

সহজ স্বীকারোক্তি দিয়ে পাতা অরুণের দিকে তাকায়! লোকটা মিটমিট করে হাসছে। পাতা বিরক্তিকর চাহনি নিক্ষেপ করে। অরুণ এঁটো প্লেট নিয়ে চলে যায়। তখনই কলিং বেলে বেজে ওঠে। পাতা উঠে এগিয়ে যায় দরজার দিকে। অরুণ দ্রুত পায়ে এগিয়ে এসে পাতার গায়ের শাল খুলে নিজ গায়ে জড়িয়ে বলে,

-” তুমি যাও আমি দেখছি!”

বলেই দরজা খোলে। দরজার ওপাশের ব্যক্তিকে দেখে অরুণের মুখশ্রী জুড়ে রাজ্যের বিরক্ত এসে ভিড় জমায়। দাঁত কপাটি পিষে হিসহিসিয়ে বলে,

-” কি চাই?”

ইমন বঁত্রিশ পাটি বের করে কন্ঠে মধু মিশিয়ে ডাকে,

-” দুলাভাই! আপনার কথা খুউব মনে পড়ছিলো। বাংলা সিনেমার কাটিং সিনের মতো ধানগড়ায় চলে গিয়েছিলাম! ভালো আছেন দুলাভাই? খেয়েছেন?”

-” ভালো ছিলাম। খেয়েছি! তুমি এখন আসতে পারো!”

বলেই দরজা বন্ধ করে দেয় মুখের উপর। সাথে সাথেই কলিং বেল বেজে ওঠে পূনরায়। অরুণ ইগনোর করে কদম বাড়িয়ে চলে যাবে, পাতাকে দেখে থেমে যায়! গায়ের শালটা পাতার গা জড়িয়ে দিয়ে সাবধান করে বলে,

-” এই দরজা খুললে আজ তোমার একদিন কি আমার একদিন!”

বলেই হনহনিয়ে চলে যায়। পাতা দ্বিধায় ভোগে। এদিকে অনবরত কলিংবেল বাজিয়ে চলছে ইমন। পাতা দোনামোনা মনে দরজা খুলে ‌‌। ইমন বিজয়ী হেঁসে ভিতরে প্রবেশ করে ‘থাংকু বনু’ বলে ড্রয়িংরুমে চলে যায়। দেখে অরুণ সরকার ছেলেকে কোলে নিয়ে পড়াচ্ছে। ইমন ভদ্র ছেলের মতো তাদের সম্মুখে সিঙ্গেল সোফায় বসে। অরুণ ঘার তুলে একবার দেখে নিয়ে পাতার দিকে গরম চোখে তাকায়। ইমন হায় হায় করে বলে,

-” দুলাভাই আমার কিউট আদরের বোনটাকে একদম চোখ রাঙাবেন না! আপনার যত প্রবলেম আমার সাথে আমার উপরেই মিটাবেন খবরদার আমার বোনটাকে ধমকাবেন না!”

অরুণ চুপচাপ ছেলেকে দেখিয়ে দেয় কি লিখতে হবে‌। ভোরের সেদিকে নজর নেই সে পেন্সিল মুখে নিয়ে ইমনের দিকে তাকিয়ে হাসছে। অরুণ তাঁর পিঠে আলতো চাপ দিয়ে চর লাগায়। ভোর চমকপ্রদ হয়ে লিখতে শুরু করে। ইমন আবার হায়হুতাশ করে বলে,

-” দুলাভাই আমার রাগ আমার ভাগ্নের ওপর চাপাচ্ছেন? ও তো নবজাতক শিশু! আপনার পায়ে পড়ি এই কাজ করবেন না!”

অরুণ টি টেবিলের উপর পা তুলে দিলো সাথে সাথেই। পাতা মুখে শাল জড়িয়ে হাসি লুকানোর বৃথা প্রচেষ্টায়। ইমন সত্যি সত্যি পা ধরে সালাম করে বলে,

-” বড় বুজুর্গদের আশির্বাদ পেলে তাড়াতাড়ি বিয়ে হয় শুনছি। আজ পেয়েও গেলাম। আপু খুব শিগগিরই আমার বিয়ে খেতে চলেছো!”

পাতা ভোরের অপরপাশে বসে হেসে বলে,

-” আচ্ছা? তা পাত্রী টা কে শুনি?”

-” সেটা তুমিই খুঁজে বের করিও! আমার আবার লজ্জা করে খুউব!”

বলেই দু হাতে মুখ ঢেকে লজ্জা পাওয়ার ভান করে। ভোর হেসে ওঠে শব্দ করে। পাতাও হাসে অল্প। তবে অরুণ সরকারের মুখাবয়ব থমথমে। সে পাতার উদ্দেশ্যে বলে,

-” আমার ছেলের পড়ার ডিস্টার্ব হচ্ছে!”

শান্ত কন্ঠস্বর। কিন্তু পাতা জানে এটা ঝড়ের পূর্বাভাস! তবে ইমন বুঝতে পারলো না। সে তার ভাঙা রেকর্ডার চালু করে,

-” দুলাভাই এমন করেন ক্যান? আমি বলছি তো যৌতুক হিসেবে বাড়ির অর্ধেক সম্পত্তি লিখে দিবো আপনার নামে! তারপরও? একটু হাসিমুখে থাকতে পারেন না? সবসময় গোমড়া মুখো ফেস বানিয়ে থাকেন! এতো সুন্দর আদুরে বোন আমার; আপনার তো উচিত সবসময় বঁত্রিশ পাটি দেখিয়ে বেড়ানো। কিন্তু আপনার তো হাসা’ই মানা। এমন করলে কিন্তু আমি আপুর সাথে আপনার ডিভোর্স করিয়ে অন্য পাত্রস্থ করবো। আমার খালাতো ভাই আছে শান্ত নাম! শান্ত শিষ্টাচারে ভরপুর ‌সবসময় হাসিমুখে কথা বলে। এতো মিষ্টি ব্যবহার। আপুর সাথেও মানাবে ঢের একদম রাজযোটক। আপনার তো চুল পাকতে শুরু করেছে। খানিকটা বুড়ো বুড়োও লাগে। আপুর সাথে খুব একটা মানায় না! ওই শান্তর সাথে অনেক মানাবে। আপনি বলেন তো কথা আগাই?”

পাতা গোল গোল করে চায়। এই ছেলে তো তার সাজানো গোছানো সংসারটাতে আগুন লাগাতে চাইছে! অরুণ ট্যু শব্দ করে না। পাতার দিকে একবার তাকিয়ে বই খাতা গুছিয়ে ছেলেকে কোলে নিয়ে চলে যায় বেডরুমে। ইমন ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থেকে হেসে দেয়। পাতা তাকে চোখ রাঙানি দেয়। ইমন হেসে বলে,

-” আপু দুলাভাইয়ের রোগে আক্রান্ত হলে নাকি! ভালো তো! আমি তাহলে উঠি?”

পাতা মাথা নাড়ল। ইমন পা বাড়ায়। পাতা তার পিছনে। দরজার কাছে গিয়ে পাতা বলে,

-” ইমন? তুমি খুব ভালো মনের। মজা করতে ভালোবাসো! উনি কিন্তু খুব একটা রসিক নয়। বেশি কথা বলা পছন্দ করে না। তুমি ওনার সাথে মজা করো ইটস ওকে। বাট মজারও একটা লিমিট আছে। ডিভোর্স খুবই অভিশপ্ত শব্দ! ব্যাপারটা আমার মোটেই ভালো লাগে নি। আই ওয়ার্ন ইয়ু!
আর উনি বুড়ো হয়ে গেছে! চুল পেকে গেছে! এতে আমার চুল পরিমানও হেজিটেশন নেই। আমি ওনাকে এমনিই ভালোবাসি। প্লিজ এসব লেঈম কথাবার্তা বলে ওনাকে ছোট করবে না। আমার ভালো লাগে না। তুমি কিন্তু আমার কথায় মন খারাপ করবে না। তুমি আপু ডাকো তাই বড় বোন হয়ে উপদেশ দিলাম!”

ইমন মোটেও রাগ করে না। বিস্তর হেসে বলে,

-” আপু তুমি কতো ভালো! আমার জন্য তোমার মতোই একটা মেয়ে খুঁজি ও কেমন? ইশ্ এতো লজ্জা লাগে ক্যান!”

বলেই মুখ ঢেকে ঢং করে হেঁটে যায়। পাতা কপাল কুঁচকে তাকিয়ে নিঃশব্দে দরজা বন্ধ করে দেয়। বেডরুমে ঢুকে নিঃশব্দে!

অরুণ হাতে স্কেল নিয়ে ভোরকে ওয়ার্ড মিনিং ধরছে।

-” আমব্রেলা অর্থ?”

ভোরের উত্তর জানা; তাই চট করে উত্তর দেয় ,

-” ছাতা!”

-” স্কাই?”

-” আকাশ!”

-” ক্যাট ফিশ অর্থ?”

-‘ বিড়াল মাছ!”

অরুণ চোখ রাঙিয়ে স্কেল উঁচুতে তুলতেই ভোর ফট করে বলে,

-” মাগুর মাছ! আচ্ছা আব্বু ক্যাট অর্থ বিড়াল, ফিস অর্থ মাছ তাহলে তো বিড়াল মাছ’ই হওয়ার কথা। মাগুর মাছ কেন হবে?”

অরুণ গম্ভীর মুখে বলে,

-” ফালতু কথা নয়! পিজিয়ন অর্থ?”

-” বাক বাকুম পায়রা
মাথায় দিয়ে টায়রা!”

আর টুকুন বলে না। বললেই বাবা বিয়ের কথা বলবে! অরুণ ছেলের মনোভাব বুঝে মুচকি হাসলো। ভোর ভেংচি কেটে বলল,

-” আব্বু তোমার ছা’পোষা কই?”

অরুণ ত্যাছড়া নজরে চাইতেই ভোর জিভে কামড় দিয়ে বলে,

-” পাতাবাহার কই?”

এবার পাতা এগিয়ে এসে বিছানায় উঠে ভোরের পাশে বসে।

-” মহারানী ওই ঘরে ঘুমের সাগরে হাবুডুবু খাচ্ছে।”

ভোর তার গায়ে থাকা উষ্ণ কম্বল পাতার দিকে বাড়িয়ে দিল। পাতা ভোরের গা ঘেঁষে বসে দুজনেরই গাঁ কম্বলসহ ঢেকে নিলো!

অরুণ আড়চোখে তাকিয়ে দেখলো। তাঁর গায়েও একটা উষ্ণ কম্বল আছে হঠাৎ কম্বলটা মনে হয় বরফের মতো ঠান্ডা অনুভব করতে লাগলো। ইচ্ছে করলো ওদের কম্বলটাতে একটু জায়গা করে নিতে। ইচ্ছেকে ধামাচাপা দিয়ে সে বই হাতে ভোরকে আবার কয়েকটি ওয়ার্ড মিনিং ধরে। ভোর ফটাফট জবাব দেয় হাসিমুখে। অরুণ প্রশ্ন করে,

-” হিলশা অর্থ?”

-” ইলিশ!

-” টাইগার অর্থ?”

-” বাঘ!”

-” লায়েন?”

-” সিংহ!

-” লিফ অর্থ?”

এবার ভোর আড়চোখে পাতার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো।পাতা প্রতিত্তরে তার গাল টেনে দেয়! অরুণ তার জবাব পেয়ে বই বন্ধ করে খাতায় কিছু লিখে ভোরকে বলে,

-” এই ওয়ার্ড মিনিং লিখতে পারলেই ছুটি!”

ভোর চোখ মুখ উজ্জ্বল করে ঝটপট খাতা নিয়ে লিখতে শুরু করে। অরুণ সব বই খাতা পেন্সিল গুছিয়ে বেড সাইডের টেবিলে রাখে। আলগোছে পাতার কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়ে।পাতা ভোরের লেখার ভুল ধরিয়ে দিয়ে অরুণের চুলের ভাঁজে হাত গলিয়ে বলে,

-” মাথা ব্যাথা?”

-‘ উঁহু!”

বলেই গাঁয়ের কম্বল টেনে মাথা সহ আপাদমস্তক ঢেকে নেয়। কাত হয়ে পাতার পেটে মুখ গুঁজে আবেশে চোখ বুজে নেয়। পাতা কেঁপে ওঠে। ভয় নামক আতংক শরীরের রগে রগে ছড়িয়ে পড়ে নিমিত্তে। হাত পা শিথিল হয়ে আসে। কেমন রক্ত শূণ্য হয়ে পড়ে। লোকটা যদি বুঝে যায়? পাতা অরুণের মাথা ঠেলে সরিয়ে দেয়। অরুণ কপাল কুঁচকে বিরক্ত হয়ে উঠে বসে। পাতা নজর লুকিয়ে ভোরের খাতার দিকে তাকিয়ে থাকে। অরুণ বিরক্তিকর শ্বাস ফেলে বালিশে মাথা রেখে শুয়ে পড়ে। ভোর তার লেখা শেষ করে পেন্সিল খাতা ছুঁড়ে ফেলে উদ্দেশ্য হীন!লাফ দিয়ে বাবার কম্বলের ভিতর ঢুকে বাবাকে জড়িয়ে বলে,

-” আব্বু ভোরের শীত করে তো!”

অরুণ ছেলেকে বুকের সাথে চেপে ধরে লুকিয়ে রেখে বলে,

-” শীতের এতো সাহস হয় কি করে? বাবার বুকে চুপটি করে শুয়ে থাকো! শীত সুর সুর করে পালাবে!”

ভোর খিলখিলিয়ে হেসে বাবার গালে চুমু দিয়ে বলে,

-” আগে ভোরকে অনেক আদর করে দাও?”

অরুণ ছেলের গালে মুখে আদর করে পরণের জ্যাকেট খুব রাখে। পায়ের মুজো খুলে ছুঁড়ে ফেলে আবার বুকে টেনে নেয়! পাতা সব কিছু গুছিয়ে রেখে ওয়াশ রুমে গিয়ে চেঞ্জ করে আসে। কাঁপতে কাঁপতে সেও কম্বলের ভিতরে ঢুকে বলে,

-” ভোরের বাবা? শীত করে তো!”

অরুণ কিছুই বলে না। পাতা ভোরের দিকে সেটে গিয়ে অরুণের উষ্ণ পায়ে নিজ বরফ শীতল পা রেখে শুয়ে পড়ে। হাত দুটো রাখে তাঁর নিজ পেটে! অনুভব করার চেষ্টা করে এখানে আদতে কেউ আছে কিনা? কিন্তু কিছুই অনুভব করে না। তবে এক অজানা ভয় মন কুঠিরে আবার হানা দেয়। পাতা উশখুশ করে ঘুমানোর চেষ্টা করে। চোখ বুজে নেয়। কেউ যেন ভিতর থেকে ‘আম্মু’ বলে ডাকে। পাতার ভয় বেড়ে যায়। এটা তো ভোরের গলা না। কে ডাকছে? যদি ভোর শুনতে পায়? রেগে যায় ভয়ঙ্করভাবে? পাতাকে ভুল বুঝে দূরে ঠেলে দেয়? ছেলে অন্তঃপাণ লোকটা যদি জানতে পারে?

হাবিজাবি ভাবনায় পাতা শীতের ভিতরেও ঘামতে শুরু করে। কানের ভিতরে কেমন ঝিঁঝিঁ শব্দ হচ্ছে। মনে হচ্ছে পোকা উড়ে বেড়াচ্ছে। পাতা ঢোক গিলে হাশফাশ করে। হঠাৎ পাতা নিজেকে শূন্যে অনুভব করে! সে কি মরে যাচ্ছে? আযরাইল তার জান কবজ করে রুহ টা নিয়ে চলে যাচ্ছে? তাই কি নিজেকে কেমন হালকা মনে হচ্ছে? ভয়ে পাতার গায়ের লোমকূপ জেগে ওঠে। পাতা জোড়ে জোড়ে শ্বাস টেনে ঝট কর চোখ খুলে! অরুণ সরকারকে দেখে পাতা সয়ংবিৎ ফিরে পায়। চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকে। কপালে তার ঘাম ছুটছে। সে কিছু বলতে চাইছে কিন্তু গলা দিয়ে শব্দ বের হচ্ছে না! এমন কেন হচ্ছে? তবে অরুণের গমগমে গলার আওয়াজ স্পষ্ট শুনতে পায়,

-” ভোর ঘুমিয়ে পড়েছে। আমরা ও ঘরে যাচ্ছি! কোনো সমস্যা? ঠিক আছো?”

পাতা জবাব দেয় না। ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। অরুণ কিছু না বলে পা চালায়!

চলবে…

#পাতা_বাহার
লেখনীতে: #বেলা_শেখ
#পর্ব-৪৯ (প্রথমাংশ)

(কপি করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ)

শীতের কুয়াশামাখা ভোর বেলা। মেইন শহরের ভিতরে হওয়ায় পাখির আনাগোনা শোনা যায় না খুব একটা। ঘনঘটা কুয়াশার আবরণও চোখে পড়ে না। এতো ব্যস্তবহুল রাস্তা, বড় বড় দালান কোঠার ভিড়ে শীতের সকাল উপভোগ করা খুব দুষ্কর!

অরুণ সরকার কিচেনে রুটি বেলছে। গত আড়াই মাসের পঞ্জিকায় নিত্যদিনের মতো মর্নিং ওয়াক শেষে বাড়ি ফেরার পর এটাই তার রুটিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। সকালের রান্না করে দুপুরের খাবারও রেডি করে রেখে যেতে হয়। রাতে ফিরে আবার রান্না! অরুণ স্বাচ্ছন্দ্য চিত্তে সব রান্না করে। করবে না কেন? তার রাজ্যের রানিসাহেবান, রাজপুত্রের জন্য রান্না করতে তার বেশ লাগে। তবে মাঝেমধ্যে ব্যস্ততা বেড়ে গেলে একটু কষ্টসাধ্য ব্যাপার হলেও কিচ্ছু করার নেই। একটা রাঁধুনী রেখেছিলো! অল্পবয়সী মেয়ে! রান্না বান্না, ঘরদোর পোছাসহ টুকটাক কাজের জন্য। কিন্তু তাঁর মহারানী ভাগিয়ে দিয়েছে! কেন? জিজ্ঞেস করলে কিছু বলে না। তবে অরুণ কিছুটা আন্দাজ করতে পেরেছে। তাই কিছু বলে নি। অরুণ গোল রুটি তাওয়ায় সেঁকতে দেয়। একটা কোমলমতি হাত তাওয়ার রুটি উল্টে দিতে উদ্যত হয়। অরুণ তার নরম হাতে বেলুনি দিয়ে আস্তে করে আঘাত করে নিজেই রুটি উল্টো করে দেয়।
পাতা কপালে ভাঁজ ফেলে হাত গুটিয়ে নিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। পূর্ব দৃষ্টি মেলে অরুণ সরকারের রুটি বানানো দেখে। কি সুন্দর গোল গোল করে বানাচ্ছে! দেখে পাতার নিজেরই লজ্জা করে। সে কেন পারে না? পারবে কিভাবে! তার রান্না করা একেবারে নিষিদ্ধ। যদিও নিষিদ্ধ হবার পেছনে এক অতি যুক্তিসঙ্গত কারণ আছে বটে। এ বাড়িতে আসার পাঁচ ছয়দিনের মাথায় একবার ভোরের আবদারে নুডুলস রান্না করার সময় গরম পানি পায়ে ফেলে লঙ্কা কাণ্ড বেঁধে ফেলেছিলো। ফুটন্ত গরম পানি পরার সাথে সাথেই যেন চামড়া পুড়ে যা তা অবস্থা হয়েছিল! ছোট ভোর সেদিন বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়েছে। পাতা ব্যাথায় ছটফট করছিলো; ভোর ভেঙ্গে না পড়ে তাকে সান্ত্বনা দেয়। পাতার পায়ে ফ্রিজের ঠান্ডা পানি ঢেলেছিলো! সাথে বরফ কুচি ডলে দিয়েছিলো। তবে পাতার ফোন থেকে বাবার নম্বরে কল করেই ভোর কেঁদে গঙ্গা যমুনা ভাসিয়ে ছিলো। আধাঘণ্টার ব্যবধানে লোকটা ডাক্তার সমেত হাজির হয়েছিলো। বকে বকে পাতার কান ঝালাপালা করে তার রান্না করা ব্যান করে দিয়েছে । ভাবতেই পাতার অধরকোনে হাসির ঝিলিক দেখা যায়।

অরুণ আড়চোখে লক্ষ্য করে নরম সুরে বলে,
-” হাসছো কেন?”
পাতার হাসি গায়েব হয়ে যায়। মাথা নেড়ে বোঝায় এমনিতেই। অরুণ ছোট ছোট করে তাকালো। মেয়েটার মাঝে মাঝে কেমন অদ্ভুত বিহেব করে। কখনো তার মুখশ্রী জুড়ে শীতকালীন মিষ্টি রৌদ্রের আনাগোনা তো কখনো ঠান্ডা কুয়াশার আবির্ভাব। আবার এই শীতের সিজনে কালো মেঘের উঁকিঝুঁকি! অরুণ রুটি সেঁকে ঝুড়িতে রেখে পাতার গালে অধর ছুঁয়ে আবার নিজ কাজে মনোনিবেশ করে বলে,
-” পাতাবাহার? রুটি বানানো শিখতে চাও?”

পাতা সন্দেহ চোখে তাকায়। অরুণ মুচকি হাসলো। পাতাকে দু হাতের মাঝে আটকে দুহাতে বেলুনি ধরিয়ে দিয়ে কাঁধে থুতনি রেখে বলে,
-” লেটস স্টার্ট!”
পাতা খানিক ঘাবড়ে গেলেও নিজেকে সামলে রুটি বেলতে থাকে। অরুণ তাকে দেখিয়ে দেয় কিভাবে কি করতে হবে। পাতা মুহুর্তের মাঝেই একটা অর্ধ গোলাকার রুটি বানিয়ে ফেলে। তার মুখশ্রীতে রুটি বানাতে সফলকাম হওয়ার আনন্দে উপচে পড়ছে। অরুণ পেছনে থেকে পাতাকে জড়িয়ে গালে চুমু দেয় সশব্দে। পাতা একটু লজ্জা পেলেও লজ্জাকে পাশে রেখে আরেকটা গোলা নেয় রুটি বানানোর জন্য। পাতা অরুণের সহায়তা ছাড়াই রুটি বেলতে থাকে। অরুণ পাতার ঘারে থুতনিতে অধর বুলাতে থাকে। মাঝে মাঝে ছোট তবে গভীর চুমু দেয়। পাতা কেঁপে ওঠে; পাতার ভালো লাগে তবুও কনুই দিয়ে অরুণের পেটে শক্তপোক্ত গুঁতো মেরে বাঁধা দেয়। অরুণ কাঁধে দাঁত বসিয়ে একহাত আঁচল গলিয়ে উন্মুক্ত পেটে রাখে। পাতার মস্তিষ্কে রক্ত সঞ্চালন বৃদ্ধি পায়। রগে রগে ছড়িয়ে পড়ে ভয় নামক উত্তেজনা। রুটি বেলতে থাকা হস্তদ্বয় থেমে শক্ত হয়ে আসে। শীতের ঠান্ডা ঠান্ডা আমেজেও পাতা ঘামতে শুরু করে। অরুণ পাতার ঘারে গরম শ্বাস ছেড়ে বলে,

-” কি হয়েছে পাতাবাহার? কিছুদিন হলো খেয়াল করছি আনমোনা হয়ে থাকো। ভয়ে ভয়ে তাকিয়ে থাকো। কাছে আসলেই কেমন অসাড় হয়ে যাও! আমার সাথে ঝগরাও কর না ঠিকমতো!”

পাতা মন কুঠির ভয় নাম উত্তেজনায় কিলবিল করে। লোকটা যদি বুঝে যায়! জেনে যায় সব কিছু? পাতাকে দূরে সরিয়ে দেয়? কিভাবে বাঁচবে পাতা? মরে যাবে তো! পাতার দম বন্ধ বন্ধ লাগে। কান্না পায়।অরুণের বাঁধন থেকে ছাড়া পাওয়ার প্রয়াসে ছটফট করে। অরুণ ময়দা মাখানো হাতটা পাতার পেটে রেখে দু হাতেই বেঁধে নেয়। গালে আদুরে চুমু দিয়ে বলে,
-” বলবে না আমায়? তোমার আদুরে মুখটাতে ভয় প্রস্ফুটিত হয়ে গেছে। কোন সমস্যা? নির্দ্বিধায় বলতে পারো পাতাবাহার!”

পাতা ঢোক গিলে। ভয়ে হাত পা শিথিল হয়ে আসে। শরীরের কম্পন বেড়ে যায়। তবুও অরুণের হাত সরিয়ে দিতে দিতে নিজেকে সামলে স্বাভাবিক গলায় বলে,
-” কোথায় ভয় ফুটে উঠেছে? আপনার চোখে সমস্যা দেখা দিয়েছে। ঘরে টেবিলে চশমা আছে পড়ে নেবেন! কিছুই হয় নি।”

পাতাকে ছেড়ে দেয় অরুণ। ফ্রিজ খুলে ডিম বের করে ধুয়ে নেয়! পাতা রুটি বানানো সম্পূর্ণ করে বলে,
-” সত্যিই কিছু হয় নি। সমস্যা হলে বলি তো আপনাকে!”

‘হুম’ বলে অরুণ রান্না করায় মগ্ন হয়ে পড়ে। পাতার মুখের আদল মলিন; চোখ জোড়া পানিতে টলমল। অরুণ খেয়াল করে তবে কিছু বলে না। পাতা একবার ভাবে চলে যাবে কিচেন থেকে; কি মনে করে যায় না। অরুণের পাশেই দাঁড়িয়ে চুপচাপ সব অবলোকন করে। টুকটাক কথা বলে। অরুণ স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে উত্তর দেয়। এর মাঝেই আগমন ঘটে পাতাবাহারের। কিচেনে অরুণের সাথে পাতাকে দেখে একপ্রকার ছুটে আসে। কেবিনেটের উপর উঠে পাতার দিকে তাকিয়ে মিও মিও করে! অবুঝ প্রাণী হয়তোবা জেলাসিতে ভুগছে। পাতা তাকে চোখ রাঙিয়ে অরুণের বাহু জড়িয়ে গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকে। বিড়ালটি ছোট ছোট চোখে তাকিয়ে বসে পড়ে; তার ঝলমলে চোখের তারায় অরুণ পাতার স্পষ্ট প্রতিচ্ছবি।
অরুণ দু’জনের কান্ডে হতাশ! ভেবেছিল দুই সখির গলায় গলায় ভাব হবে। অথচ একে অন্যকে দেখতেই পারে না। মনে হয় দুই সতিন! সে হতাশ গলায় ডাকে,
-” পাতাবাহার?”

অরুণের দুই পাতাবাহারই তার ডাকে সাড়া দেয় শতভাগ। অরুণ মুচকি হাসলো। পাতা যেন সুযোগ পায় পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার! সে অরুণের বাহুতে চিমটি কেটে বলে,
-” শুনুন ভোরের বাবা! দ্বিঘাত ত্রিঘাত সমীকরণে যেমন × এর মান হয় এটা; অথবা ওটা নির্বাচন করতে হয়! তেমনি আপনি হয় আমাকে পাতাবাহার ডাকবেন নয়তো আপনার ওই ছা’পোষা বিড়ালকে ! ওকে ডাকলে আমাকে ডাকবেন না। আমাকে ডাকলে ওকে না! কথা ক্লিয়ার?”

অরুণ ঠোঁট চেপে হেসে পাতার বাঁধন থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে বলে,
-” একদম ক্লিয়ার নয়। তোমাকে যেমন ভালোবেসে ডাকি ওকেও ডাকি! একটা অবুঝ বিড়ালকে কেউ হিংসে করে? হুম?”

পাতা স্বস্তিবোধ করে। লোকটা রেগে নেই তাহলে। সে বাহানা দিয়ে কেটে পড়ার উদ্দেশ্যে বলে,
-” আমি ভোরের কাছে যাচ্ছি।ওর রিভিশন কতদূর দেখি গিয়ে!”
অরুণ পাতাকে আটকিয়ে কাঁধ জড়িয়ে নিজের সাথে চেপে ধরে বলে,
-” আমার পাশে দাঁড়িয়ে থাকো ভোরের আম্মু!
পাতা উশখুশ করে বলে,
-” শুধু দেখে আসি..”
-” বলছিতো এখানে থাকো!”
শক্ত গলায় বলে অরুণ! পাতার যাওয়া হয় না। সে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে। অরুণ কিছুপল চুপ থেকে এক হাতে পাতাকে আটকে রেখে অপর হাতে কাজ করে! শান্ত গম্ভীর গলায় বলে,
-” কি হয়েছে পাতাবাহার?”

পাতার বুকটা কেঁপে ওঠে। নোনাজল ভিড় জমায়। একবার ভাবে বলে দেবে। এভাবে আর থাকা যাচ্ছে না। প্রতিটা মুহুর্তই দমবন্ধ লাগে তাঁর। অরুণ সময় দেয়! পিঠে হাত বুলিয়ে পাতাকে ভরসা দেয়। মাথায় চুমু দেয়। পাতা প্রস্তুতি নেয় সব বলার। জুবান ছিঁড়ে কথা বেড়োবে হঠাৎ নিজেকে থামিয়ে দেয় পাতা। কি করতে যাচ্ছিলো সে? এখন যতোই আদুরে গলায় বলুক; আদর যত্ন করে মনের খবর নিক! যখন সত্যিটা জানতে পারবে ঘার ধাক্কা দিয়ে পাতাকে দূরে ঠেলে দিতে একবার ভাববে না। সে জানে ছেলের ভালো থাকা অরুণ সরকারের কাছে সবার আগে। বাকি সবাই জাহান্নামে গেলেও লোকটা ফিরে তাকাবে না। ছেলের জন্য হয়তো আগত অতিথিকে সে দুনিয়ার আলো দেখতে দিবে তো? পাতা নিজেকে ধাতস্থ করে চুপচাপ থাকে।

অরুণ বেশ সময় দেয়। পাতাকে চুপ থাকতে দেখে বুঝতে বাকি থাকে না ব্যাপারটা গুরুতর; মেয়েটা তাকে ভয় পাচ্ছে! অরুণ পাতার কপালে চুমু দিয়ে বলে,
-” ইটস ওকে বলতে হবে না। হয়তো আমার উপর ভরসা নেই।”

পাতা অরুণের পিঠে হাত গলিয়ে জড়িয়ে ধরে শক্ত করে। অরুণ তাঁর মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। সে জানে সাথে বিশ্বাস করে, মেয়েটা তাকে পাগলের মতো ভালোবাসে। মাঝে মাঝে অবাক হয়; মেয়েটা এতটা ভালোবাসে কেন তাকে? এরকম পাগলের মতো ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্যতা তাঁর আদৌ আছে? সে পাতাকে ভালোবাসে! কিন্তু পাতার মতো না।
যেদিন রাস্তায় পাতাকে এক ট্রাফিক পুলিশ রাস্তা পার হতে সাহায্য করে। অরুণ হিংসাত্মক চোখে চেয়ে দেখেছিলো পুরোটা। ছেলের এক্সামের সময় মেল কলিগের সাথে হাসিমুখের কথাবার্তাও ভালো লাগে নি। কিন্তু সে এই হিংসার যথাযথ ব্যাখ্যা বের করতে পারে নি। ক্ষণিকের আকর্ষণ ছিলো হয়তোবা।যেদিন তার সাথে জুড়ে মেয়েটার নামে কুৎসা রটানো হয়। সে খুবই রেগে গিয়েছিল! সুজনকে দিয়ে মেয়েটার এ টু জেড ডিটেইলস জেনে নেয়। এতো আরেক হতভাগী! অরুণের বুকে স্নেহ জমেছিল ঢের! ঠিক সেদিনই মেয়েটার ফোন পেয়ে ছুটে গিয়েছিলো। সেই ভরা শালিশে মেয়েটার ক্রন্দনরত মুখটা দেখে মায়া লেগেছিল বেশ! মেয়েটার করুণ মায়াময় মুখ দেখে তাঁর মায়ায় ভরা ছেলেটার মুখ ভাসছিলো চোখের তারায়! ছেলের ‘মিস পাতার মতো আম্মু চাই! পাতা মিস আম্মু হলে অনেক ভালো হবে!’ কথাগুলো কানে বাজছিলো। অরুণ ভেবেচিন্তে কথা পাড়ে আতিকুর ইসলামের কাছে।সে আশাবাদী ছিল আতিকুর ইসলাম মানা করবেন না। কেননা এর আগে এক ডিভোর্সী ছেলের সাথেই মেয়ের বিয়ের কথা এগোচ্ছিলেন। কিন্তু মাঝখানে লতা অস্বীকার করে। অরুণ তাদের সিদ্ধান্তকে সম্মান জানিয়ে ফিরতি পথে পা বাড়িয়েছিলো। কিন্তু মেয়েটা যখন তাকে ডাকলো সে একবুক আশা নিয়ে এগিয়ে এসেছিলো। নিরাশ হয় নি। মেয়েটি স্বীকারোক্তি দিতেই অরুণ আর দেড়ি করে নি। যদি আবার সিদ্ধান্ত পাল্টে ফেলে! তবে অরুণের ভয় হতো মেয়েটা ভালো মনের; তবে আবেগী মন। তাঁর কলিজাকে ভালোবাসবে তো? মা হয়ে উঠতে পারবে তো? সে অনেক ভাবে মেয়েটাকে পরখ করেছে। মেয়েটা সবসময় ফুল মার্কস নিয়ে উত্তির্ণ হয়েছে। কথাটা স্বার্থপর হলেও এটাই সত্য যে, পাতা ভোরকে মন থেকে ভালোবেসে আপন করে নিয়েছে;ভোরের মা হয়ে উঠেছে। তবেই সে অরুণ সরকার ভালোবাসতে শুরু করেছিলো। এখন মেয়েটা তার হৃদয়ের অবিচ্ছেদ্য অংশ রূপে অধিপত্য বিস্তার করে অরুণ সরকারের মন প্রসূণের আঙ্গিনায়। অরুণ সব ভাবনা দূরে ঠেলে কন্ঠে মাধুর্য ঢেলে বলে,

-” ভোরের আম্মু ভোরকে অনেক আদর করেন! মাঝে মধ্যে ভোরের বাবাকেও আদর করতে পারেন! ভোরের বাবা মাইন্ড করবে না। বরং খুশি হয়ে ট্রিপল আদর ফিরিয়ে দেবে!”

পাতা অরুণের বুক থেকে মাথা তুলে শান্ত চোখে তাকায়। তবে ছাড়ে না। নাক টেনে পায়ের আঙ্গুলে ভর দিয়ে উঁচু হয়। অরুণ সাহায্য করে তাঁর রানি সাহেবান কে! কোমড় বেষ্টন করে বুকের উপর তোলে। পাতা লজ্জা পায় না মোটেও; তবে অরুণের চোখে চোখ রাখে না। যেন চোখের ভাষা পড়ে নেবে অরুণ! কুচকুচে কালো দাঁড়িতে ঢাকা কপোল জোড়া আঁজলায় করে আদরে আদরে ভরিয়ে দিল। বিড় বিড় করে অস্ফুট স্বরে বলে ‘অরুণ বিনা মরে যাবে পাতা!’ অরুণ সরকারের শক্ত পোক্ত বলিষ্ঠ শরীর যেন কেঁপে ওঠে সেই ক্ষুর ধারালো গভীর বাক্যে। বুকের বা পাশে আঘাত হানে তীব্র গতিতে।শক্ত বাঁধন আগলা হয়ে আসে। পাতা গভীরে ডুব দেয়। অরুণের আগলা বাঁধন ধীরে ধীরে মজবুত হয় ইস্পাতের মতো!

দুপুর গড়িয়ে দুটোর ঘরে যেতেই ঘন্টা বেজে ওঠে।এক্সামের সময় শেষ হয়ে গেছে। বাচ্চারা পেপার শীট জমা দিয়ে বের হয়। ভোর এক্সাম হল থেকে বেরিয়ে গুটি গুটি পায়ে অফিস রুমের দিকে যায়। বারান্দা খোলা থাকায় সেখান দিয়ে উঁকি ঝুঁকি দিয়ে বোঝার চেষ্টা করে আম্মু আছে কি না!
সৈয়দ ব্যাপারটা লক্ষ্য করে বেরিয়ে আসে রুম থেকে। ভোরের পিছনে দাঁড়ায় ভোর তাঁকে দেখেনি! সে তো উঁকি ঝুঁকি দিতেই ব্যস্ত। সৈয়দ গলা খাঁকারি দিতেই ভোর চমকে উঠে পেছনে তাকিয়ে আমতা আমতা করে বলে,
-” আসসালামুয়ালাইকুম স্যার! কেমন আছেন?”

এতো আদুরে বাচ্চাটা! দেখলেই গাল টিপে দিতে ইচ্ছে করে! সৈয়দ মুচকি হেসে তার ফুলো গাল টেনে দিয়ে বলে,
-” ভোরের আম্মু প্রিন্সিপাল ম্যামের রুমে!”

ভোর মিনমিনে গলায় ‘থ্যাংক ইয়ু’ বলেই দৌড়ে চলে যায় প্রিন্সিপাল ম্যামের রুমের সামনে। তবে ভিতরে প্রবেশ করে না। ম্যাম তাকে কাছে পেলেই চুমু খাবে। ভোরের লজ্জা করে তখন!

পাতা প্রিন্সিপাল ম্যামের রুম থেকে বের হয়ে ভোরকে দেখে মুচকি হাসলো। মাথার এলোমেলো চুল গুলো ঠিক করে হাত ধরে স্কুল মাঠ পেরিয়ে বেরিয়ে আসে। ড্রাইভার গাড়ি নিয়ে গেটেই অপেক্ষায় ছিলো। তাঁরা উঠতেই গাড়ি টান দেয়। পাতা ড্রাইভারের উদ্দেশ্যে বলে,
-” ভাইয়া সঞ্জিবনী ক্লিনিকে যাবেন!”
-” ম্যাডাম কোনো সমস্যা?”
-” না! ওই ক্লিনিকে আমার এক বান্ধবী বসে।তার সাথেই দেখা করতে যাবো!”

মিথ্যে কথা! তবে পুরোটা নয়! ওটা লতাপুর বান্ধবী। একজন গায়েনী বিশেষজ্ঞ ডাক্তার। লতাপু তাকে বলেছে দেখা করতে। পাতাও ভাবে দেখা করাই যায়। ব্যাপারটায় এনশিওর হতে হবে। রিপোর্ট হাতে এলেই সে বিশ্বাস করবে। আর পাতা এটাও ঠিক করে রিপোর্ট পজেটিভ এলে জানাবে অরুণ সরকারকে। ভয় পাবে না একটুও! কেন ভয় পাবে? সে কি ইচ্ছে করে করেছে নাকি।সে সর্বদা সজাগ থেকেছে তবুও কিভাবে হলো সে জানে না। এখন উপর ওয়ালা চায় কেউ আসুক! সেখানে পাতা কিভাবে আঁটকে রাখবে তাকে! তবুও ভয় করে তাঁর।লোকটার থেকে দূরে যাওয়ার ভয়! পাতা সুখানুভূতির সাথে শ্বাস নিতে শিখেছে। সেই অনুভূতি থেকে মুখ থুবড়ে পড়লে পাতা সত্যিই মরে যাবে।
এদিকে ভোর পাতাকে একের পর এক প্রশ্নবাণে জর্জরিত করছে। আম্মুর কতগুলো বান্ধবী? তাঁরা কেমন? আগে কেন বলেনি ভোরকে! পাতা ভুজুং ভাজুং বুঝিয়ে তাকে শান্ত করেছে। বুকে জড়িয়ে ঘুম পাড়ানোর চেষ্টা করেছে। ভোর ঘুমায় নি।
তাঁরা ক্লিনিকের সামনে পৌঁছালে পাতা ভোরকে বুঝিয়ে গাড়িতে থাকতে বলে সে জলদি চলে আসবে। ভোর বোঝে না। জেদ ধরে সেও সাথে যাবে কোনো কথা শুনবে না। অগত্যা পাতা তাকে নিয়েই ভেতরে চলে যায়। ভোর পাতার হাত ধরে নাচতে নাচতে হাঁটছে।

পাতা ভোর চলে যেতেই ড্রাইভার কল লাগায় অরুণ সরকারকে।
_____

একটা ছোট বাচ্চা গলা ফাটিয়ে কাঁদছে অনবরত। একটু আগেই গোসল করানো হয়েছে। মিনু পা মেলে বসে বাচ্চাটাকে পায়ের উপর বসিয়ে দিয়েছে। হাতে লোশন মেখে বাচ্চাটার গায়ে মালিশ করছে আর এটা ওটা বলছে। আনিকা গালে হাত দিয়ে বাচ্চাটার পাশে বসে আছে। রূপ আভারির কোলে বসে বাবু বাবু বলে ডাকছে আর খিলখিলিয়ে হাসছে। আভারি বসে দেখছে তার পঁচিশ দিনের ছেলেকে। খুশি উজাড় করে তাদের সংসারে আগমন ঘটেছে এই ছেলের! তাদের বুড়ো বয়সের সঙ্গির আগমন ঘটেছে। মিনুর চোখে মুখেও এক অনবদ্য দ্যুতি ছড়িয়ে পড়েছে। তার আনন্দ সীমার অন্ত নেই! সে ছেলের নাম রেখেছে নয়ন! তাদের বুড়ো বুড়ির নয়নের মনি! আনিকা গালে হাত রেখে গোমড়া মুখে বলে,
-” তোমার ছেলে পঁচা মিনু খালা! একদম ভোরের মতো! শুধু কাঁদে!”
মিনু মুচকি হেসে বলে,
-” ও তো ছোট তাই কাঁন্দে। আনিবুড়িও তো ছোট্ট বেলায় অনেক কান্দিতো!”
আনিকা নাক মুখ কুঁচকে বিছানা থেকে নেমে বেরিয়ে যেতে যেতে বলে,
-” আনিকা মোটেই কাদতো না। আনিকা তো ব্রেভ গার্ল! কাঁদে তো ভোর, রূপ আর তোমার ছেলে নয়ন।”

সে ড্রয়িংরুমে গিয়ে দেখে মা বাবাকে দেখতে পায়। রুবি আরিয়ানের পাশে বসে।আরিয়ান কেস সংলগ্ন কিছু ফাইল স্টাডি করছে। আনিকা কাছে গিয়ে ফাইল সরিয়ে রেখে বাবার কোল দখল করে বলে,
-” আনি মিসড ভোর সো মাচ!চাচিমনি বড় চাচ্চু সবাইকেই মিস করছে! আব্বু তুমি সবাইকে নিয়ে আসো না?
আরিয়ানের মুখটা গম্ভীর হয়ে যায় নিমিষেই। শক্ত গলায় আনিকাকে বলে,
-” কাল এক্সাম আছে না তোমার? যাও পড়তে বসো?”

আনিকা ভয় পায়। দৌড়ে চলে যায় নিজ ঘরে। আসমা বেগম সবটা লক্ষ্য করে। কফির মগটা এনে ছেলের সম্মুখে রাখে। সামনের সোফায় বসে বলে,
-” আরিয়ান প্রায় তিনমাসের মতোই হলো ওরা চলে গেছে। আমি বলছি কি তুই একবার ওখানে যা ওদের আনতে! তুই আনতে গেলে ওরা মানা করতে পারবে না!”

আরিয়ান কফির মগে চুমুক দিয়ে বলে,
-” আমি কেন আনতে যাবো? জেনেবুঝে সৎ ভাই ভাইয়ের পরিবারকে টেনে নিজ সংসারে নিয়ে আসবোই বা কেন? দূরে আছে সেও ভালো আছে আমিও ভালো আছি!”

রুবি ভ্রু উঁচিয়ে ত্যাছড়া নজরে তাকায়! আসমা বেগম অবাক হয় বেশ! আরিয়ান এসব বলতে পারলো? সে গম্ভীর মুখে বলে,
-” আরিয়ান এসব কেমন কথা? ভাই হয় ও তোর!”
-” না মা ভাই না সৎ ভাই হয়!বাবা এক হলেও আমাদের দুজনের মা আলাদা।”
আসমা বেগম বাকহারা। আরিয়ানের মুখে এসব শুনবে সে কখনো ভাবে নি। রুবি গালে হাত দিয়ে আরিয়ানের দিকে তাকিয়ে। তাঁর চোখে মুখেও একটু অবাকতার রেশ!
আরিয়ান স্বাভাবিক গলায় ফাইল দেখতে দেখতে বলে,
-” মা? ভাইয়ের সাথে আমার সম্পর্ক খুব একটা সুবিধার ছিল না। না আমি ভাইকে ভাইয়ের চোখে দেখতাম না ভাই আমাকে। সাপে নেউলে সম্পর্ক ছিলো! তবে বাবা চলে যাওয়ার পর সম্পর্কের ভিত্তি পাল্টায়। ভাই আমার বনে যায়। আমি ভাইকে ভাই ভাবলেও ভাই সেটা এখনো ভাবেই নি। সে আমাকে সৎ ভাইয়ের চোখেই দেখে। বাচ্চাদের মাঝে নোক ঝোঁক হয়। ভাই ভোরকে মারে। মারবে কেন? সেদিন ভাই ভোরকে মারলো! কথাকাটাকাটি হলো রুবির সাথে! রুবি কে? পরের মেয়ে না? সে কি বলল না বলল তাঁর উপর ভিত্তি করে ভাই বাড়ি কেন ছাড়বে? আমার সাথে একবার কথা বলেছে? একবার কথা বলে দেখতো! আমি কি অ্যাকশন নিতাম! কিন্তু না সে চলে গেলো!”

কথা শেষ করে আরিয়ান মাথা উঁচু করে মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে,
-” তবে আমার মনে হয় কি জানো? সেদিন রাতে আমার তোমার আর রুবির মাঝে যে কথা হয়েছিলো পাতা মেয়েটা সবটা শুনেছে। শুনে নিশ্চয়ই বসে থাকে নি। ভাইয়ের কান ভারি করেছে। যার জন্য ভাই এতো জলদি..”

তাকে থামিয়ে দিয়ে আসমা বেগম আত্নবিশ্বাসী হয়ে বলে,
-” পাতাকে আমি চিনি। সে ওরকম মেয়েই না। ও যদি শুনেও থাকে কথোপকথন তবুও বলবে না অরুণকে। এটুকু বিশ্বাস আছে। মেয়েটা নরম শোভা সাথে ভালো মনের। তার মধ্যে কোনো প্যাঁচ ধাচ নেই। না কোনো হিংসা বিদ্বেষ!”

রুবির দিকে সরাসরি তাকিয়ে বলে আসমা বেগম। তাঁর নজর যেন কটাক্ষ করছে রুবিকে। রুবি দাঁড়িয়ে বলে,
-” মা কথাগুলো আপনি আমাকে উদ্দেশ্য করে বললেন তাই তো?বড় ভাবীরা চলে গেছে এরজন্য আপনারা আমাকে দোষ দিচ্ছেন। হ্যাঁ আমি দোষী। ভুল স্বীকার করে ক্ষমা চাই নি? আমার ছেলেটা সেদিন দম আটকে মরতে বসেছিলো। যদি ভোরের ওমন অবস্থা করতো আমার ছেলে অরুণ ভাইয়া চুপ বসে থাকতো? তার ছেলে তাঁর কলিজা আমার ছেলে প্লাস্টিক? ছেলের ওমন অবস্থায় ভয় পেয়েছিলাম। ভাইয়াকে কটুক্তি করেছি ভোরকে কথা শুনিয়েছি। ভুল ছিল আমার! সেদিন বুঝতে না পারলেও পরদিন অনুতাপে পুরে ক্ষমাও চেয়েছিলাম হাত ধরে। উনি প্রতিক্রিয়া জানান নি। অনুরোধ করি নি বাড়ি ছেড়ে না যাওয়ার জন্য? প্রতিদিন অফিসে সময় সুযোগ পেলেই ক্ষমা চাই। বাড়ি ফিরতে অনুরোধ করি।উনি কানেই তোলেন না। মনে হয় আমি মাছি তাঁর আগেপিছে ঘুরঘুর করছি।অরুণ ভাইয়া বলেছিলো আদুরির মতো আমিও তার ছোট বোন! আদুরি ভুল করলে এভাবে মুখ ফিরিয়ে নিতে পারতো?এখন পায়ে ধরাই বাকি আছে। আপনারা বললে কাল দেখা হলেই পা ধরে ক্ষমা চাইবো!”
বলেই হন হন করে চলে যায়! আরিয়ান তার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে বলে,
-” ওর কথাগুলো কিছুটা হলে যুক্তিসঙ্গত মা! তুমি একবার গিয়ে ভাইয়ের সাথে কথা বলো! ভাই তোমাকে সম্মান করে।”
_______

অরুণ সরকার ছেলের ফোন ফোন পাওয়া মাত্রই বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়েছে। নিজেই ড্রাইভ করে হাওয়ার বেগে বাড়ি ফিরেছে। লিফট থেকে বের হয়ে কলিং বেল বাজায়। দরজা খুলে যায়। নজরে আসে তাঁর আদুরে কলিজা! অরুণ গম্ভীর মুখে হাসি ফুটে ওঠে। ছেলেকে কোলে তুলে দরজা বন্ধ করে দেয়। গালে চুমু দিয়ে বলে,
-” আমার কলিজা ভয় পাচ্ছে! কোথায় তোমার আম্মু?”

ভোর ড্রয়িংরুমের সোফার দিকে ইশারা করে বাবার গলা জড়িয়ে ধরে। কিছু বলে না। অরুণ পা চালায়। ড্রয়িং রুমে পাতা একা নয়। ওই বাঁদর ইমনের মা উপস্থিত। ইমনের মা অরুণকে দেখে হেসে বলে,
-” ভালো আছো বাবা? তোমার দেখা পাওয়া তো আকাশের চাঁদ পাওয়ার মতো! সবসময় কাজ নিয়ে পড়ে থাকলে হবে? বউ বাচ্চার দিকেও একটু তাকিও!”

অরুণ মাথা কাত করে পাতার দিকে তাকিয়ে ঘরে চলে যায় পাশ কাটিয়ে। ইমনের মা কপাল কুঞ্চিত করে বলে,
-” পাতা তুমি কি মিষ্টি! আর তোমার জামাই দেখি করলার মতো! মুখে রসকষ কিছুই নেই। ভদ্রতার খাতিরে কিছু বলতে পারতো! সামাজিকতা জানে না দেখছি।”

পাতা বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পরে। লোকটা সত্যিই ম্যানারলেস! ম্যানারের ‘এম’ টাও জানেন না। নাক উঁচু ম্যানারলেস লোক! পাতা মিনমিনে গলায় বলে,
-” উনি কম কথা বলে! অপরিচিত লোক জনদের সাথে মিশতে পারে না। কি বলবে বুঝতে পারে না। আপনি কিছু মনে করবেন না প্লিজ!”

ইমনের মা হেসে বলে,
-” আরে না কিছু মনে করি নি। ছেলে মানুষ একটু আকটু ইগোস্টিক হয়। আমি উঠি হ্যাঁ ?তোমার জামাই এসেছে তার সাথে সময় স্পেন্ড করো!”

বিদায় নিয়ে চলে যান তিনি। পাতা ঘরে যায়! দেখতে পায় ফ্লোরে পড়ে আছে স্যুট বুট! পাতাবাহার সেগুলো টানছে। ভোর বিছানায় বসে। পাতা হতাশ ভঙ্গিতে ফ্লোর থেকে শার্ট স্যুট তুলে রাখে। অরুণ হুডি ট্রাওজার পড়ে ভোরকে ইশারা করে। ভোর বাধ্য ছেলের মতো মাথা নাড়িয়ে বের হয়ে যায় ঘর থেকে। পাতার কপাল কুঞ্চিত হয়। চলে গেল কেন? সে অরুণের দিকে প্রশ্নাতীত চাহনিতে চায়। অরুণ বিছানায় বসে পাতাকে কাছে ডাকে। পাতার সন্দেহ হয়। তবুও এগিয়ে যায়! অরুণ পাতা কপালে গলায় হাত রেখে তাপমাত্রা পরখ করে। স্বভাবিকই তো! দুহাত মুঠোয় ভরে শান্ত গলায় সুধায়,
-“পাতাবাহার কি হয়েছে? শরীর খারাপ?”
পাতা অবাক স্বরে বলে,
-” কই নাতো!”
অরুণ শান্ত চোখে পাতার দিকে তাকায়! কিছু সময় চুপ থেকে জিজ্ঞেস করে,
-” কি হয়েছে তোমার? কি লুকাচ্ছো আমার থেকে?”
পাতা যেন ঝটকা খায়! অরুণের হাত থেকে হাত ছাড়িয়ে নিয়ে নজর লুকিয়ে স্বাভাবিক সুরে বলে,
-” কি হবে? কি লুকাবো! সকাল থেকে কি আবোলতাবোল বকে যাচ্ছেন!”
-” ক্লিনিকে কেন গিয়েছিলে?”
পাতার ভয় হয়। তবে স্বাভাবিক ভাবে বলে,
-” আমার পেছনে স্পাই লাগিয়েছেন নাকি? সে বলে নি কেন গিয়েছিলাম?”
অরুণ হেসে বলে,
-” তোমার মুখ থেকে শুনতে চাইছিলাম!”
পাতা এবার ঘাবড়ে যায়!
-” এক কলেজ ফ্রেন্ডের সাথে দেখা করতে গিয়েছিলাম ফিমেল ফ্রেন্ড। অনেক দিন হলো যোগাযোগ করছিল! ওই ক্লিনিকে ও রেগুলার বসে।”

অরুণের মুখের আদল নিমিষেই পরিবর্তন হয়! পাতা বুকটা ধুকপুক করে। লোকটা বিশ্বাস করেছে কি? আচ্ছা সত্যিটা বলেদিবে? নাহ্। রিপোর্ট এলে সিওর হয়ে একেবারে কাল বলবে। ঠান্ডা মাথায় গুছিয়ে বলবে। ইয়া আল্লাহ শুধু আজকের দিনটা ম্যানেজ করে দাও!
-” আজ জলদি এলেন যে? আমি খাবার গরম করি কেমন?”
বলেই পাতা বেরিয়ে যাবে কিন্তু অরুণের কথায় থেমে যায়!

-” পাতাবাহার মিথ্যে কথা আমি সহ্য করতে পারি না। তুমি আমার থেকে কথা লুকাচ্ছো! আমি সকালেও জিজ্ঞেস করেছি। হয়েছে টা কি! তুমি আমার কথা গুরুত্বই দিচ্ছ না!”

পাতা বিরক্ত হয়। সাথে রাগও হয় বেশ! এমনিতেই চাপের মাঝে আছে সে। টেনশনে মাথা ফেটে যাওয়ার উপক্রম। মেজাজ হারিয়ে সে এক প্রকার চিল্লিয়ে বলে,
-” আমি একদিন গুরুত্ব দেই নি, আপনার ইগো তে লেগেছে। অথচ‌ আপনি কখনই আমার কথায় গুরুত্ব দেন না। আমি আপনার পার্সোনাল ব্যাপারে কিছু জানতে চাইলে আপনি চুপ করে যান। উত্তর দেয়া বা হু হা করার প্রয়োজনটুকু বোধ করেন না। আলগোছে ইগনোর করেন। আপনি বলেছিলেন না কি হয়েছে আমার? হ্যাঁ কিছু তো হয়েছে! পার্সোনাল ম্যাটার।সময় হলে আপনাকেও জানাবো। আপনার অতি মুল্যবান সময় অপচয় করার দরকার নেই!”

অরুণ চোয়াল শক্ত হয়। উঠে দাঁড়িয়ে শক্ত হাতের মুঠো পকেটে লুকিয়ে বলে,
-” ব্লাড সেম্পল কেন নিলো ডক্টর?”
পাতা এবার অবাক হয়। কে বলল লোকটাকে? তাকে প্রশ্ন করতে হয় না। অরুণ নিজ থেকেই বলে,
-” ভোর একটু আগে ফোন করে বলল!ছেলেটা ভয়ে আছে। ডাক্তার কেন তার আম্মুর রক্ত নিবে!”

দরজার কাছে শব্দ হয়। পাতা দরজার দিকে তাকাতেই ভোর দরজা বন্ধ করে দৌড়ে চলে যায় ড্রয়িং রুমে। হাত পা গুটিয়ে মলিন মুখে বসে থাকে চুপটি করে।

পাতা ভোরের প্রস্থান দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। অরুণের দিকে সরাসরি তাকিয়ে বলে,
-” কাল জানাবো আমি! প্লিজ ফোর্স করবেন না জানার জন্য। বলবো আমি। একটু সময় দিন শুধু!”

অরুণ এগিয়ে আসে। পাতার গাল টিপে কপালে চুমু দিয়ে বেরিয়ে যায় ঘর থেকে। পাতা উদাস মনে আয়নায় নিজ প্রতিচ্ছবির দিকে তাকিয়ে থাকে। নিজেই নিজেকে সুধায়,
-“পাতু তুই কি একটু বেশিই ভাবছিস না? লোকটা কিছুটা হলেও ভালোবাসে তোকে। যে আসবে সে লোকটারই অংশ।কেন ভুলে যাস!”
____

নিরবতা বিরাজ করছে পুরো ফ্ল্যাট জুড়ে। সর্বক্ষণ হইচই মাতিয়ে রাখা ভোর সরকারও আজ চুপচাপ। অরুণ ল্যাপটপ সমেত সোফায় বসে কাজ করছে সাথে ভোরকে ড্রয়িং করানো দেখিয়ে দিচ্ছে। পাতা চুপচাপ বসে। কারো সাথেই কথা বলছে না। না ভোর না অরুণ! কিছু সময় এভাবেই বসে থেকে পাতা উঠে রুমে চলে যায়। কাপড় চেঞ্জ করে বিছানায় শুয়ে পড়ে। চোখের পাতায় ঘুম না নামলেও চোখ বুজে শুয়ে থাকে। একটু পরে অনুভব করে কেউ রুমে এসেছে। পাতা অল্প চোখ খুলে দেখে ভোর আসছে। একেবারে চুপি চুপি করে যেন চুরি করবে। ভোর বেড সাইডের নিকটবর্তী দাঁড়িয়ে বোঝার চেষ্টা করে আম্মু ঘুমিয়েছে কি না। পাতার চোখ বন্ধ দেখে ভোরের চোখে মুখে আঁধার ঘনিয়ে আসে। আম্মু তাকে না নিয়েই ঘুমিয়ে পড়েছে! ভোরকে আদর না করেই! পাতাবাহার ভোরকে দেখে লেজ নাড়িয়ে উঠে আসে। ভোর বিছানায় উঠে জ্যাকেট মুজো খুলে ছুঁড়ে ফেলে বিড়ালটিকে কোলে বসিয়ে বিড়বিড় করে আম্মুর নামে নালিশ করে। পাতাবাহার মিও মিও করে ভোরের উষ্ণ পেটে মুখ ঘষে আরামে গা এলিয়ে দেয়। ভোর ভেংচি কেটে সোফার উদ্দেশ্যে ছুড়ে মারে। পাতার গায়ে থাকা কম্বল টেনে গায়ে জড়িয়ে কিনারা ঘেঁষে শুয়ে পড়ে। উশখুশ করে এপাশ ফিরে তো আবার ওপাশ। আম্মু নিশ্চয়ই রেগে আছে তাঁর উপর! আম্মুর প্রমিজ ভেঙে সে আব্বুকে সব বলে দিয়েছে। কেন দেবে না? ওই আন্টি টা আম্মুর হাতে সুঁই ফুটিয়ে কতখানি রক্ত নিলো। তাঁর ভয় লেগেছিল তো। ডাক্তার আন্টি তাঁর আম্মুর রক্ত কেন নিবে? তাই তো আব্বুকে বলে দিয়েছে। ভোর এ পাশ ওপাশ করতে থাকে। পাতা মৃদু চোখ খুলে তার কান্ড কারখানা পর্যবেক্ষণ করেছে। ভোর কম্বলের ভিতরে ঢুকে চুপচাপ শুয়ে থাকে; আস্তে আস্তে গড়াগড়ি খেয়ে পাতার দিকে এগিয়ে যায়। চুপটি করে পাতার উপর হাত তুলে দেয়। একটু পর পা তুলে দিলো। সময় নিয়ে বুকে মুখ লুকিয়ে বিড়বিড় করে বলে,
-” ভোর লাভস ইয়ু সো মাচ আম্মু!”

পাতার অধরকোনে হাসি ফুটে ওঠে। ভোরকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে চুমু দেয় তবে কিছু বলে না। ভোরও কিছু বলে না। চুপটি করে মুখ লুকিয়ে ঘুমের দেশে তলিয়ে যায়। পাতার চোখেও ঘুম নামতে শুরু করে। তবে দরজা বন্ধ হওয়ার শব্দে ঘুম যেন হাওয়া হয়ে যায়। নিশ্চয়ই লোকটা এসেছে! পাতা স্বাভাবিক ভাবে চোখ বুজে ঘুমের ভান ধরে পড়ে থাকে। খুবই কঠিনতম একটা কাজ এটি। পাতার চোখ পিটপিট করে। মনে হয় এই খুলে যাবে। পাতা কম্বলে আপাদমস্তক ঢেকে নেয় সুবিধার্থে। অরুণ সব লক্ষ্য করে। হুডি খুলে পাতার পাশে শোয়। কম্বল টেনে গলা পর্যন্ত ঢেকে দেয়। পেছন থেকে জাপ্টে ধরে। একহাত পাতার ঘার গলিয়ে পেঁচিয়ে নেয়। আরেক হাত কামিজ ভেদ করে যায়। বরফ শীতল হাতের স্পর্শে পাতার কাঁপন ধরে।এতো ঠান্ডা কেন হাত? অরুণ কানের কাছে অধর নিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে,
-” আমি জানি তুমি জেগে আছো!”
পাতা ধরা পরেও প্রতিত্তর করে না। সেভাবেই ঘুমের ভান ধরে পড়ে থাকে। অরুণ আবার বলে,
-” পাতাবাহার? বলবে না কি হয়েছে তোমার? হুম?”
পাতার বুকটা কেঁপে উঠলো আদুরে স্বরে। ইচ্ছে করলো লোকটাকে শক্ত করে জড়িয়ে সবটা বলে দিতে। কিন্তু নিজ ইচ্ছেকে প্রাধান্য না দিয়ে পাতা সেভাবেই ঘুমের ভান করে শুয়ে থাকে। একসময় ঘুমিয়েও যায়।

চলবে….

#পাতা_বাহার
লেখনীতে: #বেলা_শেখ
#পর্ব-৪৯ (শেষাংশ)
(প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য)

(কপি করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ)

ভোর তার এক্সাম শীট জমা দিয়ে ক্লিপ বোর্ড, পেন্সিল বক্স, রং পেন্সিল বক্স নিয়ে হাসিমুখে বের হয়। সঙ্গে টুটুল। তার সাথেই গল্প করতে করতে হাঁটছে বারান্দা ঘেঁষে। হঠাৎ একটা বাচ্চার সাথে ধাক্কা লাগে। ভোর বিরক্তিকর মুখে বলে,
-” দেখে হাঁটতে পারিস না।”
বলেই পেন্সিল বক্স হাতে তুলে হাঁটা দেয়। রোহান দৌড়ে গিয়ে ভোরের হাত ধরে আটকায়। ভোর গম্ভীর মুখে আশেপাশে দেখে নিয়ে বলে,
-” কি হয়েছে? তোর মা দেখলে বকবে তো!”
রোহান ভিতু মুখে এদিকে ওদিকে তাকিয়ে দেখে মা আছে কি না! দেখতে না পেয়ে বলে,
-” ভোর তুই আমার ফ্রেন্ড। তাহলে টুটুলের সাথে কেন খেলিস!”

ভোর টুটুলের দিকে একবার তাকিয়ে রোহানের হাত ছেড়ে টুটুলের হাত ধরে বলে,
-” ও আমার বন্ধু। তোর মা বলেছে তোর সাথে যেন না মিশি। আর আমার আব্বু বলেছে টুটুলের সাথে মিশতে।”

বলেই ভোর টুটুলকে একপ্রকার টেনে নিয়ে হাঁটতে থাকে। টুটুল গোমড়া মুখে বলে,
-” আমি কি ছাগল যে টানছিস?”
ভোর হেসে বলল,
-” না তো! তুই হলি মানকি! এই বলতো মানকি মানে কি?”
-” ভোর বানর!”
বলেই খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে। ভোর গাল ফুলিয়ে তার পিঠে কিল বসিয়ে জিভ বের করে ভেংচি কেটে দৌড় লাগায়। টুটুল ‘এই ভোর দাঁড়া!’ বলে ভোরকে ধাওয়া করে। ভোর দাঁড়ায় না। হাসতে হাসতে এলোমেলো দৌড়াতে থাকে রৌদ্র উজ্জ্বল স্কুল মাঠে। মাঠে আরো অনেক ছোট বড় বাচ্চারা, তাদের গার্ডিয়ানদের ভিড়। আজ শেষ এক্সাম, পুরো স্কুলই যেন হইহুল্লোড়ে মেতেছে। নিত্যদিনের তুলনায় স্কুলে ভিড় দেখার মতো। সাথে ঝালমুড়ি, হাওয়াই মিঠাই সহ নানা দিনমজুরের ভিড় ভাট্টা। বাচ্চাদের আকর্ষণীয় খাবার সরঞ্জাম এনে নজর কাড়ছে। ভোর ভিড় ঠেলে দৌড়ায় আর খিলখিলিয়ে হেসে পেছনে মুড়ে টুটুলকে জিভ দেখিয়ে ভেঙায়।একসময় টুটুল ভোরকে হারিয়ে ফেলে। কোথায় গেল ঠাহর করতে পারে না। অনেক খুঁজে টিচার্স রূমের দিকে এগোয়। নিশ্চয়ই তার আম্মুর কাছে।
এদিকে ভোর এখনো লুকিয়ে লুকিয়ে এদিকে ওদিকে খুঁজছে টুটুলকে। হঠাৎ একটু দূরে কুকুরের ঘেউ ঘেউ শব্দে ভোর ভয় পেয়ে যায়। আশেপাশের সব বাচ্চারাই ভয়ে দৌড়াতে শুরু করে। ভোরও তাঁর ব্যতিক্রম নয়। সে ঘাবড়ে যায়। কুকুরটাকে চিনতে ভুল হয়নি তাঁর। সেদিন যে কুকুর দুটো তাঁর উপর আক্রমণ করেছিলো তাঁরই একটা! ভোর তাঁর সর্বোচ্চ বেগে দৌড়াতে থাকে! একটু দূরে যেতেই ছোট ছোট সবুজ ঘাস আচ্ছাদিত মাঠে মুখ থুবড়ে পরে যায়; ব্যথা পায় বেশ। সেখানে উপস্থিত বাচ্চারা হেসে ওঠে। গার্ডিয়ানরা অবশ্য হায় হায় করে।এক গার্ডিয়ান ভোরকে তুলে গায়ের ময়লা ঝেড়ে দেয়।ভোর উঠেই মাঠে পড়ে থাকা ক্লিপ বোর্ড, পেন্সিল বক্স, ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে থাকা রং পেন্সিল তুলতে নিলে এক মহিলা সব তুলে ভোরের হাতে দিয়ে বলে,
-” ব্যাথা পেয়েছো বাবু?”
ভোর নাকে হাত দিয়ে না বোধক মাথা নাড়ে। অথচ নাকটা রক্তবর্ণ হয়ে আছে যেন টোকা দিলেই রক্ত ছিটকে বেরিয়ে আসবে। ভরে ওঠে তাঁর চক্ষু যুগল। মহিলাটি বুঝতে পারলো ব্যথা পেয়েছে। সে ভোরের হাত ধরে বললো,
-“মিস পাতা তোমার আম্মু না?”
ভোর এবারও মাথা নেড়ে বিড়বিড় করে ‘থ্যাংক ইয়ু’ বলে সামনে হাঁটতে থাকে। একটু পর পর পেছনে তাকাতে ভোলে না!

দূর থেকে একজন বাঁকা হাসে। বুক পকেটে ঝুলিয়ে রাখা কালো চশমাটা চোখে দিয়ে বড় বড় পা ফেলে এগিয়ে আসে। ঠিক ভোরের সামনে দাঁড়িয়ে মুচকি হেসে হাত বাড়িয়ে বলে,
-” হ্যালো অরুণাভ ভোর সরকার! মাইসেল্ফ আকাশ!”

ভোর ভ্রু কুঁচকে চায়। হাত মেলায় না; হাতের সরঞ্জাম বুকের সাথে জড়িয়ে রাখে। কিছু বলে না। আকাশ হেসে ভোরের মাথার চুল এলোমেলো করে বলে,
-” কি কিউট তুমি! মনে হয় আদর করে গাল টিপে দিই! দিই?”
ভোর না বোধক মাথা নেড়ে আকাশের হাত ঝটকায় সরিয়ে দেয়। আকাশ নিজের হাত গুটিয়ে বলে,
-” ওকে বয়। রেগে যাচ্ছো কেন? রাগলে তোমায় আরো কিউট লাগে।‌বায় দা ওয়ে আমি তোমার আরিয়ান চাচ্চুর ফ্রেন্ড! তোমার চাচ্চুও এসেছে । আনিকা বায়না করেছিল তাই ওই হাওয়াই মিঠাই কিনতে গেছে। আমাকে বলল তোমাকে নিয়ে ওই গাড়িটার সামনে দাঁড়াতে!”

ভোর আশেপাশে তাকিয়ে বলে,
-” মিথ্যে কেন বলছো? চাচ্চুর সব ফ্রেন্ডকে আমি চিনি। আর চাচ্চু সত্যিই আসলে আমাকে নিতে নিজেই আসতো। তাঁর বন্ধুকে পাঠাতো না। তুমি কি ছেলেধরা?”

আকাশ মনে মনে বাহবা দেয়! একে বোকা বানানো সহজ হবে না! ভোর উল্টো দিকে পা চালিয়ে চলে যাবে; আকাশ তাকে থামিয়ে বলে,
-” আরিয়ান ঠিক! ও বলেছিলো তুমি এটাই বলবে। আমাকে চ্যালেঞ্জ করেছিলো তুই যদি ভোরকে আনতে পারিস তাহলে ও নাকি তোমার বাবার পায়ে ধরে হলেও তোমাদের সরকার বাড়িতে ফিরিয়ে আনবে!”

ভোর পিটপিট করে তাকালো। তারপর বাবার মতো হঠাৎ গম্ভীর মুখ বানিয়ে বলে,
-” এটাও মিথ্যে কথা। আমি যাবো না আপনার সাথে। আপনাকে আমি চিনি না!”
আকাশ এবার শয়তানী হাসে। ভোরের দিকে ঝুঁকে ফিসফিস করে বলে,
-” ঠিক আছে। তবে তোর..ওই কি যেন ডাকিস? আম্মু! সে আমাদের কব্জায়। হাত পা মুখ বেঁধে গাড়ির ডিকিতে আটকে রেখেছি।তুই যাবি না; তোর মায়ের গলায় ছুরি চালিয়ে নদীতে ভাসিয়ে দিবো এখনি!”

ভোরের চোখে মুখে ভয় ফুটে ওঠে। সে আশেপাশে তাকায়। অনেকেই আছে বড় মানুষ ছোট মানুষ! ভোর জোরে জোরে শ্বাস টেনে দুই কদম পিছিয়ে যায়। গলা দিয়ে শব্দ‌ বেরোতে চায় না তবুও হালকা উঁচু গলায় বলে,
-” মিথ্যে বলছো কেন? আম্মু টিচার্স রুম..!”
তাকে থামিয়ে আকাশ এগিয়ে আসে। ভোরের চুল ঠিক করে দিতে দিতে ফিসফিসিয়ে বলে,
-” বিশ্বাস হচ্ছে না তাই তো? ইটস ওকে। এখনি দৌড়ে যা! দেখে আয় আছে কি না! আমরা ততক্ষণে গলা কাটার ব্যবস্থা করি! হুম? তবে হ্যাঁ মনে রাখিস তুই চাইলেই তোর মা’কে বাঁচাতে পারতি। কিন্তু তুই তো চাস না। সৎ মা তো! ওত টান আসে না। কিন্তু তোর বাপের তো আপন বউ! তুই মা কে বাঁচানোর জন্য যাস নি তাই তোর আব্বু তোকেও ছেড়ে দেবে রাস্তায়। আর হ্যাঁ চিল্লাচিল্লি করবি না এখানে! করলে তোর মায়ের জবাই হবে ওখানে!”

ভোর চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকে। আশেপাশে সবার দিকে তাকায় সাহায্যের উদ্দেশ্যে। অথচ বাকি সবাই নিজ নিজ কাজে ব্যস্ত। ভোরের হাত পায়ের শক্তি কেমন ফুরিয়ে যায়। আকাশ শয়তানী হেসে কোলে তুলে নেয় ভোরকে।

অপরদিকে পাতা স্টুডেন্টদের এক্সামের খাতা গুছিয়ে ক্লাস রুম থেকে বেরোয়। বড় বড় পা ফেলে টিচার্স রুমে যায়। ভোর নিশ্চয়ই সেখানেই আছে তার অধির অপেক্ষায়। পাতা মুচকি হেসে আগাতে থাকে। হঠাৎ একটা লোক এগিয়ে এসে পাতার সম্মুখে দাঁড়িয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে বলে,
-” ম্যাম? ভোর আছে আপনার কাছে? খুঁজে পাচ্ছি না!”

পাতা কপালে ভাঁজ ফেলে লোকটার আপাদমস্তক দেখে বলে,
-” কে আপনি? আর ভোরকে খুঁজে পাচ্ছেন না মানে কি?”
লোকটি কপাল বেয়ে গড়িয়ে পড়া ঘাম মুছে নেয়। এই শীতের দিনেও সে ঘেমে গেছে। যাবে না কেন? এতো বড় ঘটনা ঘটে গেছে বস তাকে শুলে চড়াবে। গর্দান নেবে নিশ্চিত!

পাতা হন্যদন্য হয়ে খুঁজতে থাকে ভোরকে। টিচার্স রুম, ওয়াশ রুমে সব খুঁজে দেখেছে। প্রিন্সিপাল ম্যামের কাছেও খবর পাঠিয়েছে সৈয়দ কে দিয়ে। পাতা খুঁজতে খুঁজতে শহীদ মিনারের দিকে যায়। সেখানে এক লোককে দেখতে পায়।‌স্যুট ব্যুট পরা; দেখে ভদ্রলোক মনে হলো। চোখে মুখে হাসি লেপ্টে আছে। অদ্ভুত তো! একাই হাসছে কেন? পাতা এগিয়ে যায়। এদিকটায় জনমানব খুব একটা নেই। সে এগিয়ে গিয়ে লোকটাকে জিজ্ঞেস করে একটা বাচ্চাকে দেখছে কি না। ছয় বছরের; এই‌ স্কুলেরই।
আকাশ সানগ্লাস খুলে মুচকি হেসে পকেট থেকে ফোনটা বের করে পাতার দিকে বাড়িয়ে দেয়। পাতা ভ্রু কুঁচকে ফোন হাতে নেয়। ভিডিও কলে কেউ আছে ফোনের ওপাশে। পাতার চেনা পরিচিত মুখ! সাথে জ্ঞানহীন ভোর! ভোরের গলায় ছুরি ধরে ওপাশের লোকটা বিশ্রী ইঙ্গিত করে হাসে। ঘৃণায় পাতার গা গুলিয়ে আসে। হাত থেকে ফোনটা পড়ে যেতে নেয় আকাশ ধরে ফেলে। পকেটে পুরে বলে,
-” মিসেস অরুণ সরকার! আপনি বুদ্ধিমান। আশাকরি কিছু বলতে হবে না। টু শব্দ করবেন তো আপনাদের কলিজার টুকরা স্যরি কলিজার গলা আলাদা হয়ে যাবে ঘার থেকে!”

পাতার গা শিউরে ওঠে। মস্তিষ্ক ফাঁকা ফাঁকা লাগে।কি করবে সে? ভোরের বাবাকে কল করবে একটা? মেসেজ দেবে?ভোর ওদের কাছে গেলো কি করে? পাতা যেন জ্ঞানবোধ হারিয়ে ফেলে। কি করবে বুঝতে পারে না। আকাশ হাঁটতে থাকে। পাতা রোবটের ন্যায় পিছু পিছু। যাওয়ার পথে সদ্য চেনা লোকটাকে দেখতে পায়। লোকটা এগিয়ে আসছে। হঠাৎ পাতার মস্তিষ্ক সচল হলো যেন। সে লোকটাকে কিছু ইশারা করে আকাশের পিছনে হাঁটে! স্কুল প্রাঙ্গণ থেকে বেরিয়ে বাইরে আসে। ব্যস্ত রাস্তার পার্কিং জোনে একটা দন্ডায়মান কালো গাড়ির সামনে দাঁড়াতেই। দরজা খুলে গেল। পাতা দেখতে পায় ভেতরে শুক্লা , তাঁর ছেলে শামীম ও আরো দুইজন অপরিচিত লোক! সবার চাহনি বিশ্রী। পাতা আশেপাশে তাকায়। ব্যস্ত রাস্তা। লোক সমাগমও চোখে পড়ার মতো। সে কি সবার থেকে হেল্প চাইবে? চিল্লিয়ে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে ভোরকে বাঁচাতে পারবে? ওরা পাতার চিল্লানো শুনে ভোরের কোনো ক্ষতি করবে না তো?আকাশ তাঁর মনোভাব বুঝতে পেরে পাতাকে উদ্দেশ্য করে ফিসফিসিয়ে বলল,
-” চিল্লাবে? কেরি ওন! বাট সাবধান হ্যাঁ ছেলেটার গলায় ছুরি চালাতে সেকেন্ড সময় লাগবে না। তুমি লোক জড় করবে আমরা ওকে….! তারপর কি হবে? আমরা পালাতে পারবো না ভেবে হেসে লাভ নেই। পুলিশ ধরে নিয়ে যাবে আবার ছেঁড়েও দিবে! কিন্তু ছেলে হারালে ছেলে পাবে?”

পাতা গমগমে গলায় হিসহিসিয়ে বলে,
-” আমার ছেলে কোথায়?”
শুকলা তার গায়ের চাদরটা একটু সরিয়ে ভোরের একাংশ দেখিয়ে বলে,
-” মামনি জলদি এসো? দেড়ি করলে কিন্তু…”
হাতের ধারালো ছুরি ভোরের বাহুতে বসিয়ে পরনের ব্লু জ্যাকেট ছিঁড়ে নরম ফর্সা হাতে ছুঁড়ি দাবিয়ে সরিয়ে আনে। গলগলিয়ে তাজা রক্ত বেরিয়ে পরে! পাতা সেকেন্ডের মাঝে গাড়ির ভিতরে প্রবেশ করে। আকাশ মুচকি হেসে ফ্রন্ট সিটে বসে ড্রাইভারকে গাড়ি চালানোর নির্দেশ দেয়।

দূরে রাস্তার অপর পাশের ফুটপাতে সেই লোকটা ঘাম মুছে ফোন বের করে কল লাগায়! কানে ব্লুটুথ ডিভাইস সেট করে নিজ বাইকে বসে স্টার্ট দেয়! কল রিসিভ হওয়া মাত্রই এ টু জেড গড়গড় করে বলে দেয়।

-” বস? কিছু বলুন? চুপ করে আছেন কেন?”

পরপর কিছু ভাঙ্গার শব্দ ভেসে আসে ওপাশ থেকে। ঝন ঝন কাচ ভাঙার শব্দ। দিদার ভয় পায়! বস ক্ষেপেছে! সে বস ডেকে উঠতেই ওপাশ থেকে ভেসে আসে,

-” তোমাকে পড়ে দেখছি! ফলো দেম! আ’ম অন দা ওয়ে। ওদের দুজনের গায়ে তিল পরিমাণ জখমের অস্তিত্ব মিললে ওদের কবরের সাথে তোমার কবর কনফার্ম!”

শান্ত গলায় বললেও মনে হলো সিংহের গর্জন শুনলো দিদার। ঢোক গিলে দক্ষ হাতে বাইক চালিয়ে ফলো করে কালো গাড়িটিকে।
____
চাপা হাসির শব্দে গমগমে অবস্থা বিরাজমান গাড়িতে।‌ছোট জ্ঞানহীন ভোরকে বুকে জড়িয়ে পাতা গুটিসুটি মেরে বসে আছে। গাড়ি স্টার্ট করার পরপরই সে শুকলার কোল থেকে ভোরকে একপ্রকার ছিনিয়ে নিয়েছে।
তার পাশে বসে শুকলা মন্ডল। সামনে আকাশ ও ড্রাইভার।‌পেছনে শামীম সহ আরো দুজন লোক। তারা সবাই নানা ধরনের বাজে মন্তব্য করছে। পাতা সব শুনেও চুপচাপ বসে আছে।একটা কথাও বলে নি। কু*ত্তার বাচ্চাদের সাথে ঘেউ ঘেউ করার মানে নিজ বিপদ ডেকে আনা। সে শুধু সুযোগের অপেক্ষায়! শুকলা মুচকি হেসে নিজ পাকা ছোট ছোট দাড়িতে হাত বুলিয়ে পাতার ওড়না হাতে নেয়। পাতার কপাল‌ বেয়ে গড়িয়ে পড়া শ্বেতজল সেই ওড়নার কোনা দিয়ে মুছিয়ে দিতে দিতে বলে,
-” ইশ্! মামুনি শীতের ভিতরেও ঘামছে! দেখো দেখি কান্ড ভয় পাচ্ছো কেন? আমরা কি তোমার পর? শা*লী এখন ভয় পাচ্ছিস কেন? তখন লাগে নাই! **** ভরা শালিশে যেভাবে অপমান হইছি তাঁর চেয়ে ও ভয়ঙ্কর অপমান বোধ তোরে না করাইছি তো আমার নাম শুকলা না।”

পাতা মুখ বুজে সহ্য করে। ভোরকে আরেকটু শক্ত করে চেপে ধরে চুমু দেয় কপালে। শুকলা কপালে ভাঁজ ফেলে বলে,
-” কিরে পাতা? তোর সেই তেজ কই গেলো? এতো কিছু বললাম এখনো চুপ! আগে না সাপের মতো ফোঁস ফোঁস করে তেড়ে আসতিস হুম? তোর বুইড়া জামাই তে*জ কমাইছে? *** এতো পাওয়ার! আমারো কিন্তু কম না রে! অতি শিগগিরই দেখতে পারবি! তোর জামাইয়ের থাইকাও বেশি সু*খ দিমু! তুই খুশি হইয়া আর জামাইয়ের নাম মুখেই নিবি না। খালি শুকলা কাকু কাকু করবি! ভয় পাইস না!”

পাতা তাচ্ছিল্যের চোখে চায়। অধর বাঁকিয়ে হাসেও অল্প।
-” ভয় হচ্ছে! তবে তোদের জন্য। অরুণ সরকারকে পুরোপুরি জানিসই না তোরা! সব কটা শু*য়োরদের কলিজা ভুনা করে কুত্তাকে খাওয়াবে। তোদের ***** তেজ ছুটিয়ে দেবে। জীবনে আর বারো***র দরকার হবে না।”

শুকলার চোখ মুখ শক্ত হয়ে আসে। মাথার স্কার্ফের উপর দিয়েই পাতার চুলের মুঠি টেনে ধরে শক্ত করে। পাতা ব্যাথা পায় তবে তাঁর চোখ মুখ দেখে বোঝার উপায় নেই। শক্ত চোয়ালে এ যেন তেজস্বী রূপ। শুকলার দিকে এমন ভাবে তাকিয়েছে যেন নজরেই ভস্মীভূত করে দেবে। আকাশের ভালো লাগলো বেশ। সে পেছনে ঘুরে তাকিয়ে থাকে পাতার দিকে পলকহীন। শুকলাকে ইশারায় ছেড়ে দিতে বলে। শুকলা দাঁতের কপাটি পিষ্ট করে পাতাকে খি*স্তি দেয়। পাতা এক রাশ ঘৃণায় তার মুখের উপর থুতু ফেলে। শুকলা সহ শামীম রেগে তেড়ে আসবে আকাশের হুকুমে শান্ত হয়। আকাশ পাতার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলে,
-” ইউ আর টোটালি আ আইটেম! আ’ম ইমপ্রেসড! ফুপা? স্যরি হ্যাঁ এটা আমার!”

শুকলা কিছু বলবে আকাশ তোয়াক্কা না করে পাতার উদ্দেশ্যে বলে,
-” কি যেন বললে অরুণ সরকার কি করবে? আমি বলছি তোমায়! ওই ***** বা** কিচ্ছুটি করতে পারবে না। তোমার এই আদরের সৎ ছেলের উপর যে কুকুর হামলা হয়েছিল এই আমরাই করেছিলাম। কি করেছে তোমার অরুণ সরকার? বা** টাও ছিঁড়তে পারে নি।”

বলেই হো হো করে হেসে ওঠে। তার সাথে যোগ দেয় বাকি সবাই। শুধু শুকলার চোখে মুখে বিরক্তি। আর পাতার চোখে মুখে আকাশসম অবাকতা।
______

অরুণ হেলে পড়েছে পশ্চিম দীগন্তে। বেলা চারটা দশ/কুড়ি ঘড়িতে। শীতকালের রজনী দীর্ঘ এবং দিবাকাল পরিসরে ছোট। তাইতো বিকেল গড়ানোর সাথে সাথেই পশ্চিম দীগন্তের অরুণের তেজ কমতে শুরু করেছে। ধোঁয়ার ন্যায় কুয়াশার আগমন ঘটছে ক্ষীণ পরিসরে। জনমানবশূন্য এক নিরিবিলি পরিবেশে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে একতলা বাড়িটি। বাড়িটির আশেপাশে কোনো বাড়িঘর দেখা যাচ্ছে না‌‌! বাঁশের ছোপ ও নিমগাছের আড়ালে ঢেকে আছে বাড়িটি। ভিতরের পরিবেশ গমগমা! সেদিনের ন্যায় আজকেও মহল জমেছে ঢের।‌ বিদেশী ড্রিঙ্কসের সাথে চানাচুর ও বাজার থেকে কিনে আনা গরম গরম পেঁয়াজি! ঢক ঢক করে ড্রিঙ্কস গলা দিয়ে কোনো মতে নামিয়ে মুখ কুঁচকে ন্যায় আকাশ! একটু দূরে হাত মুখ বাঁধা পাতার দিকে তাকিয়ে চুমুর ভঙ্গিমা করে। পাতা রক্তিম চোখে চায়। চোখে তার পানি টলমল করলেও সেই পানি দূর্বলতার নয় মোটেও! চোখের সামনে ভাসমান মানুষরূপী উগ্র জা*নোয়ারদের প্রতি আকাশসম ক্ষোভ! শীতে কম্পমান ভোরের উদাম দেহ! করুণ চোখের চাহনিতে পাতার বুকটা জ্বলছে দাউদাউ করে। সেই দাউদাউ করে জ্বলে ওঠা আগুনের লেলিহান শিখায় পাতা ছটফট করতে থাকে। তাঁর সামনে তাঁর ছেলেকে এক প্রকার টর্চার করছে কু*ত্তার দল!
ভোরের গায়ের ব্লু ব্লেজার, শার্ট খুলে রেখেছে।‌পরনে স্কুল ইউনিফর্মের প্যান্ট শুধু।ছেলেটা শীতে কাঁপছে তাঁর উপর ছেলেটার গায়ে বরফ মাখছে শুকলা; সাথে তার বিশ্রী চাহনি। ভোরের চোখেও পানি টলটল করছে তবে কাঁদছে না সে। দাঁতে দাঁত চেপে ফোঁস করছে। ভোরের ফর্সা গায়ে নীল নীল দাগ দেখা যাচ্ছে।পাতা পারে না ছুটে এসে ভোরকে বুকের মাঝে লুকিয়ে ফেলতে। তাঁর হাত পা মুখ বাঁধা। পাতার ছটফটানি বেড়ে যায়। চিল্লানোর চেষ্টা করে; মুখে কাপড় বাঁধা থাকায় শুধু গোঙানির শব্দ বেরোয়। ভোর সেই শব্দে ফুঁপিয়ে ওঠে। বাকি সবাই হেসে ওঠে। শুকলা বরফ টুকরো ফেলে ভোরের চুল মুঠোয় ভরে পেছন দিকে টেনে ধরে। ব্যথায় ভোরের মুখ দিয়ে অস্ফুট শব্দ বের হয়। পাতা জ্বলে উঠলো। শুকলা হেসে তাঁর উদ্দেশ্যে বলে,
-” এখনো সময় আছে রাজি হয়ে যা! বাচ্চাটার কষ্ট চোখে পড়ছে না? নাকি সৎ ছেলে দেখে বুকে লাগছে না! ইশ্ কি কষ্ট!”

পাতা হাত পা ছোটানোর চেষ্টা করে হিসহিসিয়ে কিছু বলে‌। মুখে কাপড় বাঁধা থাকায় তা অস্পষ্ট। তবে শুকলা, আকাশসহ বাকি সবাই অনুমান করতে পেরে হেসে কুটিকুটি। শামীম উঠে পাতার দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বলে,
-” আকাশ ভাই কি নাটক শুরু করলে? জোরজবরদস্তির মজাই আলাদা! কিন্তু তোমার তো আবার অনুমতি চাই! ওই অরুণ সরকার একবার খোঁজ পেলে তখন আঙ্গুল চু*ষিও!”

বলেই পাতার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে তাঁর গালে হাত বুলাতে থাকে। পাতা যেন ক্ষ্যাপা বাঘিনীর ন্যায় গর্জে উঠলো। আকাশ মজা পায় বেশ! সে সিগারেটে আগুন জ্বালিয়ে সুখটান দিয়ে বলে,
-” আপোষেই তো আসল সুখ ভাই! আর অরুণ সরকারের ভয় পাচ্ছিস? শা** এতো দিন চিরুনি অভিযান চালিয়েও ছায়া মাড়াতে পারলো না! আজ চলে আসবে? হোয়াট আ জোক?”

হেসে উঠলো সে। তবে ভোরের চাহনিতে তাঁর কপালে ভাঁজ পড়ে। সিগারেটের ধোঁয়া ভোরের মুখের উপর ছেড়ে বলে,
-” কি‌ বেটা?”

পরবর্তী ঘটনায় সবাই বাক হারা। আকাশ চোখ চেপে ধরে আছে একহাতে। অসহ্যনীয় ব্যথায় সে চেঁচিয়ে ওঠে। ভোরের চোখ মুখ রক্তিম!হাতে জলন্ত সিগারেট ফেলে দৌড়ে যায় পাতার কাছে; মুখের বাঁধন খুলে দেয়। শামীম শুকলা সবাই আকাশকে নিয়ে ব্যস্ত হয়। আকাশ ব্যাথায় কাতর! ভোরকে উদ্দেশ্য করে ভয়ঙ্কর গালির বর্ষণ করছে। শামীম আকাশের চোখের উপর থেকে হাত সরিয়ে দেয়! আকাশের বন্ধ চোখ বেয়েই তাজা রক্ত গড়িয়ে পড়ছে অশ্রুর ন্যায়। আকাশ ব্যাথায় চিল্লিয়ে বলে,
-” শু*য়োরের বাচ্চাটারে ধর! ওর হাত কে*টে নেব আমি!”

শামীম ক্ষিপ্র গতিতে ভোরের দিকে এগিয়ে যায়। ভোর ততক্ষণে পাতার হাতের বাঁধন খুলে ফেলেছে। শামীমকে তেড়ে আসতে দেখে ভয় পায় সে। পাতাকে জড়িয়ে ধরে শক্ত করে ‘আম্মু আব্বু’ বলে কাঁদতে শুরু করে। পাতা ভোরকে জড়িয়ে ধরে না। সে পায়ের বাঁধন খোলার চেষ্টায়। শামিম এসে ভোরের বাহু ধরে টানতে থাকে সর্বশক্তি দিয়ে; সাথে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ। ভোর একহাতে পাতার গলা শক্ত করে ধরে করুণ চোখে চেয়ে ‘আম্মু’ বলে কাঁদে! পাতা চোয়াল শক্ত করে; ভেঙে পড়ে না। ঠান্ডা মাথায় পায়ের রশি খুলে ভোরকে একহাতে আগলে নেয়। শামীম যে হাতে ভোরের বাহু শক্ত করে ধরে রেখেছে সেই হাতে কামড় বসিয়ে দেয় সর্বশক্তি দিয়ে। শামীম হাত ঝটকায় ছাড়িয়ে নেয়। মাংস তুলে নিয়েছে একবারে! সে হাত বাড়িয়ে পাতার চুলের মুঠি ধরে টেনে তোলে। পাতা ভোরকে ছাড়িয়ে পেছনে লুকিয়ে রাখে। উঠে দাঁড়িয়ে ক্ষ্যাপা দুর্বাসার ন্যায় শামীমের দিকে চায়! শামীমের গোপনাঙ্গ বরাবর হাঁটু দিয়ে আঘাত করে। পাতাকে ছেড়ে ব্যাথায় গুঙ্গিয়ে উঠে ফ্লোরে বসে পড়লো সে। বাকি সবাই এদিকে তাকায়! আকাশ হুকুম দেয় পাতা ভোরকে ধরার! শুকলা অকথ্য ভাষায় খি*স্তি দিয়ে পাতাকে ধরার জন্য এগিয়ে আসে। পাতা পালায় না। ভোরের একহাত শক্ত করে ধরে সেও এগিয়ে আসে। ফ্লোর থেকে বিদেশী মদের বোতল তুলে শুকলার মাথায় আঘাত করে নিমিষেই। বোতল ভেঙে শুকলার মাথা থেঁতলে যায় কিছুটা। বোতলের ভিতরের পানীয়তে মেখে যায় শুলার শরীরের কিছু অংশ!সেও‌ ফ্লোরে বসে পড়লো। বাকি দু’জন আকাশকে ছেড়ে এগিয়ে আসলে পাতা ভাঙ্গা বোতলের অংশ টুকু তাদের দিকে তাক করে ঠান্ডা গলায় বলে,
-” মেয়ে বলে কম ভাবিস না! এগোবি তো জান হারাবি! আমি নারী কোমলমতি! তবে তোদের মতো জা*নোয়ারদের সামনে আমি নারী হিংস্র পশুর চেয়েও ভয়ঙ্কর!”

শুকলা মাথায় আঘাত প্রাপ্ত স্থানে হাত দিয়ে চেপে ধরে উঠে দাঁড়িয়ে বলে,
-” শা** বারো**** তোর হিংস্রতার মায়েরে ***! এই ধর মা***!

পাতা ভোরকে নিজের পেছনে লুকিয়ে নিরাপদ দূরে সরিয়ে দেয়। ভোর ‘ও আম্মু’ বলে কাঁদতে থাকে। পাতা শুকলার ভুরি ওয়ালা পেটে লাথি দেয় সর্বশক্তি দিয়ে। শুকলা পড়ে যায় ফ্লোরে।বাকি লোক দুটো পাতার দিকে তেড়ে আসলে পাতা ভাঙ্গা বোতল তাক করে ভয় দেখায় লোক দুটোকে। এগিয়ে এসে আরেকটা বোতল তুলে দৌড়ে আকাশের সামনে গিয়ে তৎক্ষণাৎ তার মাথায় আঘাত করে। আকাশ যেন বুঝে উঠতে পারছে না কি হচ্ছে! চোখে অসহ্যনীয় জ্বালায় তার মাথার আঘাত কিছুই মনে হয় না। সে হাত বাড়িয়ে পাতার গলা চেপে ধরে। পাতা ঘাবড়ে যায়। আঘাতে জর্জরিত এই জা*নোয়ার তাকে আক্রমণ করবে বুঝতে পারে নি। ভোর ‘আম্মু’ বলে এগিয়ে আসতে নিলে পাতা নিষেধ করে দূরে যেতে বলে। ভোর আসে না আবার দূরেও যায় না। বাকি দুটো লোক এগিয়ে এসে পাতাকে ধরে।দুই বাহু ধরে ফ্লোরে ঘার ঠেসে বসিয়ে দেয়। পাতা চুপচাপ বসে। এখন ঘাবড়ানো যাবে না। মাথা ঠান্ডা রেখে চাল চালতে হবে। পরিস্থিতি অনেকটাই তার নিয়ন্ত্রণে! শুকলা, শামীম আর আকাশ নামক লোকটা জখমিত! তাঁরা ক্ষেপে ওঠার আগেই পাতাকে কিছু করতে হবে! পাতা চোখ তুলে ভোরের দিকে এক নজর চায়। মাথায় কিছু আসতেই ফ্লোরে তাকায়! ওই তো আধ পোড়া জলন্ত সিগারেট তার পাশেই দামি লাইটার। পাতার কিছু প্ল্যান করে। তবে দুজন পুরুষের সাথে পাতা পেরে উঠবে না কখনো! কি করবে পাতা? ওদিকে শামীম ফ্লোর থেকে উঠে বিকৃত মুখে এগিয়ে আসছে! শুকলা ফ্লোরে শুয়ে আছে। জ্ঞান হারিয়েছে নিশ্চয়ই! আকাশ নামক লোকটাও সোফা ধরে দাঁড়িয়ে আছে এক হাতে চোখ চেপে। তার মাথা বেয়ে তাজা রক্ত পড়ছে যেন কেউ ঢেলে দিচ্ছে। রক্ত দেখে পাতার পেট গুলিয়ে আসে! পাতা শ্বাস নিতেও ভুলে যায়!

পাতাকে ধরে রাখা দুজন লোকের মধ্যে একজন পাতাকে ছেড়ে রশি আনতে যায় বাঁধার জন্য। পাতা আটকে রাখা শ্বাস ছাড়ে। সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে ভুলে না। দূর্বল পাতার মাঝেও যেন এক ক্ষ্যাপা সিংহীর আবির্ভাব ঘটে! পাতা এক দুই তিন কাউন্ট করে পাশের লোকটাকে ঝটকায় সরিয়ে ধাক্কা দেয়। লোকটা কয়েক কদম পিছিয়ে যায়! পাতা ফ্লোর থেকে লাইটার তুলে আকাশের দিকে তেড়ে যায়। আকাশ হাত তুলে, কষে থাপ্পড় মারার উদ্দেশ্যে । পাতা তড়িৎ বেগে লাইটার জ্বালিয়ে আকাশের দিকে ছুঁড়ে মারে! মদে ভেজা শার্টটায় আগুন জ্বলে উঠলো দাউদাউ করে! আকাশ গলা কাঁটা মুরগির ন্যায় ছটফট করতে করতে ফ্লোরে শুয়ে পড়লো। শুকলার নড়চড় নেই! শামীম আকাশকে নিয়ে ব্যস্ত। বাকি দুই লোক পানি আনতে গেল‌ বোধহয়! পাতা ভোরের কাছে এগিয়ে এসে কোলে তুলে নেয়! দরজার দিকে এগোবে শামীম সম্মুখে দাঁড়িয়ে বলে,
-” শা*** পালাবি? তোরে জীবন্ত দগ্ধ করবো!”

পাতা ঢোক গিলে পিছু হটে। এদিকে ওদিকে তাকিয়ে একটা খোলা ঘরের দিকে ছুটে যায়। শামীম খুঁড়তে খুঁড়তে তাঁর পিছনে যায়। হাঁটতেও কষ্ট হচ্ছে। মা*** জায়গা মতো বসিয়েছে!
পাতা একটা ঘরে ঢুকে ভোরকে নামিয়ে দরজায় ছিটকিনি আটকাবে শামীম ঠেলে ভিতরে ঢুকতে নেয়। পাতা কাঁধ দিয়ে দরজা ঠেলে দেয়; হাত দিয়ে ছিটকিনি আটকানোর প্রচেষ্টায়। ভোরও সহায়তা করে। পাতা সফলকাম হয়। ছিটকিনি দুটো আটকে কাঠের টেবিল টেনে দরজার সম্মুখে রাখে। জানালার গ্লাস আটকে পর্দা টানিয়ে দেয়। বড় বড় শ্বাস ফেলে হাঁপাতে থাকে। ওপাশে শামীম দরজা আঘাত করে গালিগালাজ করতে ব্যস্ত। ভোর ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে পাতার পাশে দাঁড়িয়ে। পাতার চোখেও নোনাজল ভিড় জমায়। ধপাস করে ফ্লোরে বসে। দুই হাত মেলে ভোরকে ডাকে। ভোর দেড়ি করে না ঝাঁপিয়ে পড়ে। পাতা আগলে ন্যায় ভোরকে। বরফ শীতল শরীরটাকে বুকে শক্ত করে চেপে ধরে। পাশে বিছানার চাদর টেনে নামিয়ে ঢেকে নেয়। ভোরের গালে মুখে এলোপাথাড়ি চুমু দেয়। ভোরের কান্না থেমে যায় ধীরে ধীরে। তবে তার শরীর কম্পমান। ক্ষণে ক্ষণে ফুঁপিয়ে উঠছে। পাতা ভোরের মাথায় চুমু দিয়ে বলে,
-“আমার ছেলেটা কতটা সাহসী ভাবা যায়!! ওই লোকটার চোখে জলন্ত সিগারেট চেপে ধরেছে! ভয় লাগে নি? এই বুদ্ধি আসলো কিভাবে এই ছোট্ট মাথায়?”
ভোর জবাব দেয় না। চুপচাপ থাকে। পাতা আবার চুমু দিয়ে বলে,
-” আমার বাবা ভয় পাচ্ছে?
ভোর নাক টানার শব্দ‌ হয়! পাতার বুকের মাঝে লুকিয়ে গুটিসুটি মেরে বিড়বিড় করে বলে,
-” উঁহু! ভোরের আম্মু আছে তো!”

পাতা এপর্যায়ে নিজেকে ধরে রাখতে পারলো‌ না। গুনগুনিয়ে করে কেঁদে দেয় হালকা স্বরে। সব তাঁর জন্য!! সব দোষ তার! তাঁর দোষে অরুণ সরকারকে জুড়ে তাঁর নামে কুৎসা রটানো হলো। ভরা শালিশে হেন্যস্থ হয়ে কি দরকার ছিলো অরুণ সরকারকে কল করার? নিজে লড়তি নিজের লড়াই! না পারলে মাথা নত করে ক্ষমা চাইতি! চুন কালি মাখিয়ে লুকিয়ে থাকতি ঘরের এক কোনায়। লোকটাকে ডেকে তার সাথে নিজ নাম জড়ানো পাতার ভুল ছিলো! সেই ভুলের খেসারত এই নিষ্পাপ বাচ্চাটাকে দিতে হচ্ছে বারংবার!
________

দিদার দরজা ধাক্কায় অনবরত! দরজায় কান পেতে শোনার চেষ্টা করে। এখানে এসেছে প্রায় ঘন্টা খানিক। বসের ওয়াইফ ও বাচ্চাকে নিয়ে জা*নোয়ারের দল ভিতরে ঢুকেই দরজা বন্ধ করে; আর কেউ বের হয় নি, না ভেতরে কেউ প্রবেশ করেছে। সে ভেবেছিল ভিতরে ঢুকে একটা ব্যবস্থা করবে কিন্তু বস মানা করে দেয়! সে আসবে তাঁরপর। তবুও সে পুরোটা সময় সজাগ ছিলো। পুরো বাড়ি ঘুরে কান পেতে ছিলো। কোনো প্রকার গন্ডগোলের আভাস পেলেই সে ভিতরে ঢুকে যাবে। ইশ্ বন্দুক টা কেন সাথে রাখলো না আজ! তাহলে এভাবে হাত গুটিয়ে বসে থাকতে হতো না।
হঠাৎ চিল্লাচিল্লির আওয়াজে দিদার দরজা ধাক্কানো শুরু করে। কান খাঁড়া করতেই বুঝতে পারে আওয়াজ পুরুষালী গলার! কি হচ্ছে ভেতরে? সে দরজায় লাথি মেরে ভাঙার চেষ্টা করে যায়‌। কাঠের শক্ত দরজা হওয়ার দরুণ খুব একটা সুবিধা করতে পারে না। তবে চেষ্টায় বহাল সে। গাড়ির গর্নের আওয়াজে থামে সে। তিনটে গাড়ি এসে থামলো।দুটো সেনা গাড়ি থেকে বের হয় পোশাকধারী সৈনিকদের দল। অপর জিপ থেকে দুজন লোক! দিদার চেনে একজনকে। বসের বন্ধু। সে এগিয়ে যায়।
রাসেল গম্ভীর মুখে কিছু সেনাকে আদেশ করে বাড়ি ঘেরাও করতে। বাকি গুলোকে দরজা খুলতে বলে এগিয়ে এসে দিদারকে জিজ্ঞেস করে,
-” পরিস্থিতি কেমন? সব ঠিকঠাক?”
দিদার জবাবে বলে,
-” কিচ্ছু ঠিক নেই স্যার! ভিতর থেকে পুরুষের চিল্লানোর আওয়াজ ভেসে আসছে। আমি দরজা ভাঙার ট্রাই করেছি পারি নি। এদিকে আমার হাত ফাঁকা! বস কতদূর?”
-” এই তো এলো বলে!”

তখনই আরেকটা গাড়ি এসে থামে রাস্তার ধারে। গাড়ি থামতেই যেন ছুটে বেরিয়ে আসে অরুণ সরকার। পেছনে আরিয়ান, মুস্তাকীম, শুভ ও ফয়সাল! রাসেল ফোন করে জানিয়েছে ক্ষ্যাপাটে ষাঁড়কে একা না ছাড়তে। তাই তাদের আগমন! অরুণ ক্ষিপ্রতার সাথে এগিয়ে এসে দিদারের গালে সপাটে চর মেরে ধমক লাগালো তার গাফিলতির কারণে। দিদারুল আহসান চুপচাপ সয়ে নেয়। এটা তাঁর প্রাপ্য ছিল বোধহয়। আরিয়ান এসে ভাইয়ের কাঁধে হাত রেখে শান্ত হতে বলে। অরুণ শান্ত হয় না, এগিয়ে যায় দরজার দিকে। ততক্ষণে দরজা খুলে ফেলেছে এক দক্ষ সেনা‌! রাইফেল তাক করে সশস্ত্র তাঁরা ভিতরে প্রবেশের প্রস্তুতি নেয়। অরুণ তাদের টপকে এগিয়ে যায়! চোখ বুলায় পুরো ড্রয়িংরুমে। ভাঙ্গা মদের বোতলের টুকরো ফ্লোর জুড়ে। একপাশে পেটমোটা লোক পড়ে আছে। অরুণের চিনতে অসুবিধা হয় না ওটা শুকলা মন্ডল! সোফার উপর বসে ব্যাথায় কাতরাচ্ছে আকাশ! তার তাজা রক্ত বেয়ে পড়ছে কপোল ঘেঁষে। কাঁধের দিকটায় কালচেভাব! পুরে গেছে!! এদের এই অবস্থা কে করেছে? এই দু’জনেই? আর সবাই কই? অরুণ এদিকে ওদিকে তাকিয়ে ভোর, পাতাকে খোঁজে। দেখতে পায় না। সে সোফায় কাতরাতে থাকা আকাশকে টেনে ফ্লোরে ছিটকে ফেলে পেট বরাবর লাথি লাগায় লাগাতার! গলায় পারা দিয়ে ক্ষোভে ফেটে গর্জে ওঠে,
-“এই কু***বাচ্চা! ওরা কই?”

রাগে কথা জড়িয়ে আসছে। চোখ মুখের আদল ভয়ঙ্কর!যেন কোনো অসুর ভর করেছে! অরুণ পা পিষতে থাকে। আকাশের মুখটা রক্তিম হয়ে উঠছে। যেকোনো সময় জান পাখি বেরিয়ে যাবে। সে কোনমতে আঙ্গুল দিয়ে ইশারা করে বন্ধ ঘরের দরজার দিকে। অরুণ এক নজর সেদিকে তাকালো। আকাশের গলা থেকে পা সরায় না। ওদিকে আকাশের চোখ উল্টে গেছে। এক সেনাসদস্য এসে অরুণকে সরিয়ে দেয়। আকাশ ছাড়া পেতেই জোড়ে শ্বাস টানে। নাক মুখ দিয়ে রক্ত উঠে আসে। অরুণ আবার তেড়ে আসে, সেনা সদস্য আটকায়! অরুণ শুকলার দিকে এগিয়ে যায়! চিৎ হয়ে শুয়ে থাকা ভুরিটায় লাত্থি দেয় সজোরে। শুকলা দূর্বল চোখে তাকিয়ে থাকে। হাঁউমাঁউ করে কেঁদে অরুণের পা জড়িয়ে ধরে। অরুণ তার ছোট চুল মুঠোয় ভরে গর্জন করে বলে,
-” আমার ছেলে কই? এই শু*য়োরের বাচ্চা? পাতা কই?”

শুকলা মাথা নেড়ে বোঝাতে চায় সে জানে না! ক্ষ্যাপাটে অরুণ বুঝলে তো!চুল টেনে মুঠ পেতে শক্ত হাতে নাক বরাবর ঘুষি মারে। শুকলা ছিটকে পড়ে ফ্লোরে। ব্যাথায় বাচ্চাদের মতো কেঁদে দেয়।

সেনা সদস্যরা বাড়িতে উপস্থিত আরো তিনজনকে খুঁজে বের করে বাথরুম থেকে। তাদের টেনে বের করে ড্রয়িংরুমে আনে। অরুণ শুকলার থেকে দৃষ্টি তুলে শামীমের দিকে তেড়ে যায়! নাক বরাবর পরপর এলোপাথাড়ি ঘুষি মেরে চুলের মুঠি ধরে টেনে দেয়ালে মাথা ঠুকে দেয়। শামীম চিল্লিয়ে ক্ষমা চায়! অরুণকে বাপ বাপ বলে ডাকে। অরুণ ছাড়ে না।‌ পরপর তিনবার শামীমের মাথা দেয়ালে মাথা সজোরে আঘাত করে! দাঁত কপাটি পিষে রাশভারী গলায় বলে,

-” অরুণ সরকার শুদ্ধ পুরুষ! নিজ ঘর ব্যাতিত অন্য ঘরে যায় নি যে তোর মতো কুলাঙ্গার বাপ বলে ডাকবে! আরেকবার ডাকলে জিভ কেটে নিবো!”

বলেই শামীমকে ছিটকে ফেলে ফ্লোরে। বাকি দু’টোকেও উত্তম মধ্যম দেয়। রাগে তার মুখাবয়ব রক্তিম! কপালের নীল রাঙা শীরা উপশীরা দেখা যায়।‌হাতের রগ ফুলে আছে। যে হাতে মারছে সেই হাত লাল বর্ণ ধারণ করেছে। তবুও থেমে নেই অরুণ! একটাকে ছাড়ছে তো আরেকটাকে ধরে মারছে। কেউ থামাতে পারছে না তাকে। অরুণের বন্ধুরাও নয়! এ যেন খাঁচা ছেড়ে বেরিয়ে আসা হিংস্র সিংহের তান্ডব! তাই তাঁরা সিংহকে থামানোর জন্য তাঁর শাবক ও সিংহীর খোঁজ চালায়। পুরো বাড়ি তন্ন তন্ন করে খোঁজে;পায় না। তখন সবার নজর কাড়ে বন্ধ ঘরটা! সবাই গিয়ে দরজা ধাক্কায়। ‘ভোর’ বলে ডাকে অনবরত। দরজা খোলার নাম গন্ধও নেই। সবাই চিন্তিত হয়! সিদ্ধান্ত নেয় দরজা ভাঙার। উদ্যত হয় কিন্তু তার আগেই দরজাটা খুলে যায়। বেরিয়ে আসে পাতা! তার গলা জড়িয়ে ভোর সরকার! সবাই স্বস্তির শ্বাস ছাড়লো পাতা, ভোরকে সুস্থ অবস্থায় দেখে। শুভ এগিয়ে পাতার মাথায় হাত রেখে সুধায়,
-” আর ইয়ু ওকে?”

পাতা মাথা নাড়ল। কিছু বলবে এর আগেই কারো আক্রমণের স্বীকার হয়! পাতা ভোরকে শক্ত করে ধরে দুই কদম পিছিয়ে যায়। পড়তেই নিবে সামলে নেয় একজন! অরুণ জাপটে ধরেছে দু’জনকে। কখনো ভোর তো কখনো পাতার গালে চুমু দিতে থাকে এলোমেলোভাবে। বিড়বিড় গলায় থেমে থেমে বলে
-” ঠিকাছো তোমরা? আমি এসে গেছি তো। ভয় পেয়েছিলে? আমি থাকতে কিছু হবে না তোমাদের! আমি আছি‌ তো!”

পাতা ক্ষীন গলায় ‘হুম’ বলে! অরুণ আশ্বস্ত হয় তবে থামে না। ভোরকে কোলে নিতে চায়; ভোর আসে না,পাতার কোলেই ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে ওঠে। অরুণ উদ্ভ্রান্তের মতো একবার ভোরের গালে মুখে ঠোঁটে চুমু দেয় তো একবার পাতার! পাতার এবার অস্বস্তি হয়। আড়চোখে অরুণের বন্ধুদের দিকে তাকালো।‌ সবার চোখে মুখে চাপা হাসি! উপস্থিত সেনাসদস্যরাও বাদ যায় নি। এতক্ষণ যাকে একশন সিনে থামানো যাচ্ছিলো না এখন সে রোমান্টিক মুডে। পাতা উশখুশ করে সরে আসতে চায়! অরুণ ছাড়ে না। ভোরের কপালে ছোট্ ছোট চুমু দিয়ে পাতার থুতনি অধর ছুঁয়ে দেয়! পাতা চাপা স্বরে আতঙ্কিত সুরে বলে,
-” কি হচ্ছে টা কি ভোরের বাবা! সবাই দেখছে!”
অরুণ থেমে যায় মুহুর্তের জন্য আবারো পাতার কপালে চুমু দিয়ে ভোরের চোখে মুখে চুমুর বন্যা বইয়ে দেয়।
শুভ বাদে অরুণের বাকি বন্ধুরা আর চুপ করে থাকে না। সমস্বরে চেঁচিয়ে বলে,
-” কি হচ্ছে টাকি ভোরের বাবা? আমরা সবাই দেখছি তো!”

বলেই হেসে দেয়। অরুণ সরে এসে পায়ের শু খুলে তাদের দিকে ছুঁড়ে বলে,
-” দেখছিস কেন? বেরিয়ে যেতে পারছিস না? কতটা ভয় পেয়েছিলাম আমি! আরেকটু হলে হার্ট অ্যাটাকে পগারপার যেতাম। কেউ নেই তো আমার। এই দুটোই বেঁচে থাকার সম্বল। ওদের কিছু হলে কিভাবে বাঁচতাম? বাড়াবাড়ি লাগে তাই না? ন্যাকামি! একা থাকা খুবই যন্ত্রণার বুঝলি! আমি আর একা থাকতে চাই না। না কাউকে হারাতে চাই!”

থামে অরুণ! শার্টের হাতার কোনা দিয়ে অল্প জমা চোখের জল মুছে নেয়। পাতার দিকে ফিরে ভোরকে বুকে টেনে নেয়। পাতার চোখের পানি মুছে দিতে হাত বাড়ায়!

পাতা টলমলে চোখে যায়! সবকিছু কেমন ঝাপসা ঝাপসা লাগে। পেট গুড়গুড় করে। বেরিয়ে আসতে চায় নাড়িভুঁড়ি! পাতা গলগলিয়ে বমি করে দেয়! অরুণ ভোরকে নামিয়ে পাতাকে ধরে। ভোর ‘আম্মু আম্মু’ ডাকে। অরুণও ডাকে! পাতার কানে বাজে সব কিন্তু প্রতিত্তর করতে পারে না। শরীর কেমন অসাড় হয়ে যায়। পেটে চিনচিনে ব্যথা হয়। চোখে অন্ধকার ঘনিয়ে আসে। বসে পড়ে পাতা; অরুণের বাহুতে মাথা এলিয়ে চোখ বুজে নেয় নিমিত্তে। আর তো ভয় নেই! এখন আছে ভরসা! স্বস্তির জায়গা!

চলবে….