#পাতা_বাহার
লেখনীতে: #বেলা_শেখ
#পর্ব- ৬০ (প্রথম অংশ)
(কপি করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ)
টিক টিক টিক! সময় বহমান। সময়ের পৃষ্ঠা উল্টে পাল্টে তিনটে বসন্ত কেটে যায় চোখের পলকে। পরিবর্তন সাধিত হয় প্রতিটি কোনায়। ঝড় ঝাপটা দুঃখ আনন্দ মিলে কেটে যায় মানব জীবন। সরকার বাড়ির আঙিনায় ক্রিকেট খেলার জন্য স্বল্প দূরত্বের পিচ বানিয়েছে আরিয়ান! ছোট বেলা থেকেই সে ক্রিকেট প্রেমী মানুষ! স্বপ্ন ছিলো ক্রিকেটার হবে। একদিন বাবা অনিক সরকারকে জানালে তিনি বাঁধা দেন না। তবে জানান,
-” আমারও ছোট বেলায় শখ ছিলো ইঞ্জিনিয়ার হবো! ক্লাস নাইনে সাইন্স নেওয়ার পর শখ মিটে গেছে। তুমি বাচ্চা ছেলে শখ করেছো, হবে! আগে ক্রিকেট খেলো তারপর দেখা যাক!”
আরিয়ান খুশিতে পারে না নেচে দেয়। চলতে থাকে টুকটাক খেলাধুলা! একবার এলাকার সমবয়সীদের সাথে ম্যাচ খেলার সময় বল লেগে মাথা ফাটিয়ে এনেছিলো। অরুণ তাঁর হাল দেখে পেটে হাত রেখে রাক্ষুসে হাসি হেসেছিল। পিঞ্চ করে কান পচিয়ে দিয়েছিলো! তাঁর ক্রিকেট খেলার শখ সেদিনই মাটি হয়ে গিয়েছিল।তবে ক্রিকেট ভালোবাসে সে। ছোট ভোরকেও তাঁরই পথে হাঁটতে দেখে আরিয়ান প্রথম প্রথম মনে মনে হাঁসতো। তবে ভোরের খেলার প্রতি ভালোবাসা ও দৃঢ় মনোবল দেখে আরিয়ান অবাক হয়। আর এইটুকুন বাচ্চা দুর্দান্ত বোলিং করে। ব্যাটিং অবশ্য কোনরকম! আরিয়ান অরুণকে জানালে অরুণ গুরুত্ব দেয় না খুব একটা। তাই আরিয়ান পাতাকে ভুজুং ভাজুং বুঝিয়ে কলাবাগান ক্রিকেট একাডেমি ভর্তি করিয়েছে। অরুণ আপত্তি করলেও পাতা তাকে সামলে নিয়েছে। তবে অরুণ হুমকি দিয়েছে পড়াশোনার ক্ষতি হলে দেখে নেবে একেকটাকে। ভোর তো খুশিতে আত্মহারা! পড়াশোনা যেমন তেমন সে ক্রিকেট চর্চায় খুব আগ্রহী। শুক্র শনি ছুটির দিন সকাল আটটা থেকে দশটা পর্যন্ত ট্রেইনিং করে। বুধ বৃহস্পতি বিকেল চারটা থেকে ছয়টা অবধি। স্কুল মিস গেলেও ভোর ট্রেনিংয়ের ব্যাপারে খুব নিয়মিত ও আগ্রহী! রেজাল্ট কোনরকম টেনেটুনে।এই নিয়ে অরুণের ঝাড়িও কম শোনে না। তবে তাঁর আম্মু আছে তো তাকে বাঁচানোর জন্য। বর্তমান সে সরকার বাড়ির আঙিনায় চাচুর বানানো পিচে খেলছে। তাঁর খেলার সঙ্গী আনিকা, রূপ, নয়ন ও আভারী! ছোট ভাবনাও উপস্থিত। সে হাত তালি দিয়ে ভাইকে চিয়ার্স করছে। নয়ন তাকে দূরে যেতে বলে। বল না লেগে যায়। ভাবনা তো ভাবনাই সে যাবে না মানে যাবে না। ভোর দক্ষ হাতে বল ঘুরিয়ে বল করার প্রস্তুতি নেয়। তখনই ব্যাট হাতে রূপক সরকার গলা উঁচিয়ে বলে,
-” ভোর ভাই আস্তে হ্যাঁ? আউট হলে খেলবো না কিন্তু! তোমার বল আমাকে ব্যাথা দিলে আমা’কে বলে বকা খাওয়াবো কিন্তু!”
ভোর ছোট ছোট চোখে চায়। রূপ তাঁর ধবধবে দাঁত দেখিয়ে হাসে হি হি করে। ভোর একটু দূরে যায় বল করার জন্য। পরনে থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট ও জার্সি। মাথায় স্পোর্টস ক্যাপ। ভোর এখন সেই ছোট্ট টি নেই। না সেই গুলুমুলু ভাব! হ্যাংলা পাতলা শরীর তাঁর; উচ্চতা সারে চারের হবে টেনেটুনে ।ছোট বেলার এখনকার ভোরের মাঝে বিরাট ফারাক! ভোর দূর থেকে দৌড়ে এসে দ্রুত গতিতে বল করে। বল কোথা দিয়ে গেলো রূপ বুঝতেই পারে না। সে ব্যাট ফেলে কোমড়ে হাত রেখে বলে,
-” খেলবোই না আমি! আমি ছোট না? আস্তে বল করতে পারো না?”
-” আচ্ছা! ব্যাট তোল। আস্তে বল করবো! এই আনি যা বল আন?”
গলা উঁচিয়ে বলে ভোর সরকার। আনি ফোঁস ফোঁস করতে করতে বল এনে দেয়। ভোর আস্তে বল করে। রূপ বলে আঘাত করলে সেটা বাউন্ডারির বাইরে! সে ব্যাট ফেলে নাচতে শুরু করে ‘ছক্কা ইয়ে’ ! দূর থাকা ছোট্ট ভাবনা দৌড়ে আসে পিচে। দু হাত উঁচুতে তুলে রূপের সাথে ঘুরে ঘুরে নাচে আর ‘চক্কা চক্কা’ বুলি আওড়াতে থাকে। ভোর এগিয়ে এসে বোনের মাথার উপর তাল গাছের ন্যায় ঝুটিটা টেনে বলে,
-” এই ভাবনা যাও? ওই খানে গিয়ে বসো। বল লাগবে!”
ভাবনা নাচ থামিয়ে মিষ্টি করে হেসে বলে,
-” আমি কেলি পিলিজ ভাই?”
-” নাহ্। আগে বড় হও তারপর খেলবে! যাও?”
ভাইয়ের নিষেধাজ্ঞা শুনে ছোট্ট ভাবনার মুখ খানি এইটুকুন হয়ে যায়। গাল ফুলিয়ে সে চলে যায়। নয়ন ভাবনার দুঃখি মুখখানি দেখে ভোরকে বলে,
-” অলু লাগ কললো তো!”
ভোর ভাবনার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে। হালকা গোলগাল পিচ্চিটা শব্দ করে হেঁটে যাচ্ছে। ভোর ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসে অল্প। রূপ ব্যাট হাতে তুলে নিয়ে বলে,
-” করুক রাগ! মিষ্টি চকলেট দিলে রাগ চলে যাবে। এই ভোর ভাই বল করো!”
আভারি বল এনে দেয়।ভোর বল করে। এবার আর ছক্কা হাঁকাতে পারে না রূপ। বল স্ট্যাম্পে আঘাত হানে। এবারের হাসি নয়ন উপহার দেয়। সে নাচতে নাচতে গিয়ে রূপের হাত থেকে ব্যাট নেয়। এবার তার ব্যাট করার পালা। আভারি ছেলের কান্ডে হাসে। রূপ গাল ফুলিয়ে চলে একপাশে দাঁড়ায়।
-” আমি আমা’কে বলে দিবো। তুমি আউট করেছো আমায়। আমি ছক্কা মেরেছি তোমার সহ্য হয় নি তাই না? পঁচা ভাই!”
ভোর এগিয়ে এসে তাঁর মাথায় চাটি মেরে বলে,
-” কিছু হলেই আমা’ আমা’ । আমা’র চামচা চুপ থাক! আরেকবার আমা’ আমা’ করলে তোকে বল বানিয়ে খেলবো বাঁদর!”
রূপ ঝাড়ি খেয়ে ভোঁতা মুখে দাঁড়িয়ে থাকে। সে সত্যিই বলে দিবে আমা’কে। হুহ! ভোর বল হাতে নিয়ে পিচে দাঁড়ায়। নয়ন মিষ্টি করে হেসে বলে,
-” ভোল ভাই? আস্তে বল কইলো? আচ্ছা?”
ভোর মাথা নাড়িয়ে সায় জানালো। নয়ন ‘র’ উচ্চারণ করতে হিমশিম খায়। ‘র’ বললেও শোনা ‘ল’ ই যায়। ভোর ধীর গতিতে পরপর বল করে। চারবারের বেলায় নয়ন আউট হয়ে যায়। এবার ব্যাটিং করতে আসে আনিকা। পরনে লেগিংস ও টি শার্ট ; মাথায় স্পোর্টস ক্যাপ। ফর্সা মুখটায় সূর্যের তেজে লাল হয়ে আছে। সে ভোরের দিকে ব্যাট তাক করে ভাব নিয়ে বলে,
-” এই ভোর! একদম ভাব দেখিয়ে জোরে বল করার চেষ্টা করবি না। আউট গেলে ব্যাট দিয়ে তোর নাক ফাটিয়ে দিবো!”
-” খেলতে পারিস না আবার বড় বড় কথা! দূর্গন্ধ যুক্ত মুখটা বন্ধ রাখ!”
ত্যাড়া গলায় বলে ভোর আনিকা কটমট করে চায়। কিছু বলবে তাকে বলতে না দিয়ে ভোর ব্যাঙ্গ স্বরে বলল,
-” এখন নিশ্চয়ই বলবি ‘আমি বড় চাচ্চু এলে সব বলেদিবো!’ কান খুলে শুনে রাখ তোর বড় চাচ্চুকে ভয় পাই না আমি!”
আনিকা ভেংচি কেটে বলে,
-” ভয় পাস না? তাহলে যখন বকা দেয় চাচি মনির আঁচলে লুকিয়ে কেন থাকিস হুম? ভিতুর ডিম!”
ভোর এবার রেগে তেড়ে যাবে আভারী বিপদ সংকেত বুঝতে পেরে আটকে নেয়। আনিকা’কে চুপ করতে বলে ভোরকে বলে ঝগড়া না করতে। তাদের বুঝিয়ে সে চলে যায় বাড়ির ভেতরে। তাকে বাজারে যেতে হবে। ভোর কটমট করে চেয়ে বল ঘুরিয়ে তাঁর সর্বোচ্চ গতিবেগে বল ছুঁড়ে মারে। আনিকা চোখ রসগোল্লার ন্যায় বানিয়ে ‘ও আম্মু ‘ বলে সরে যায়। বল তীব্র গতিতে চলে যায় অনেক দূরে। আনিকা রেগে মেগে বলে,
-” যদি লাগতো আমার?”
-” তো?”
ভোরের এক রোখা জবাব। আনিকা রেগে ব্যাট ছুঁড়ে ফেলে বলে,
-” শয়তান ছেলে! চাচ্চু এলে আমি সব বলবো!”
-” আমি তো ভয় পেয়ে গেলাম! চাচ্চুর চামচিকা যা বল নিয়ে আয়! নইলে তোর ডল হাউজ পিসপিস করবো!”
আনিকা রেগে গেলেও তার শখের ডল হাউজের কথা ভেবে দমে যায়। নইলে দেখা যাবে তাঁর ডল হাউজের রফাদফা করে ছাড়বে। সে রূপকে বলে বল এনে দিতে। রূপ সাফ সাফ মানা করে। আনিকা নয়নকে বললে নয়ন ভোরের দিকে চেয়ে মানা করে সে আনবে না। বল আনিকেই আনতে হবে। আনিকা ফোঁস ফোঁস করে ভোরের দিকে চায়। যেন এখুনি গিলে নেবে। সে ভাবনাকে ডাকে। ছোট ভাবনা ছুটে এলে আনিকা তাকে মিষ্টি করে বলে,
-” আমাদের অরু কতো ভালো আর মিষ্টি! ওই ওখানে বল আছে! এনে দিবে প্লিজ? আপু তোমাকে তোমার ফেবারিট চকলেট আইসক্রিম দিবে!”
আইসক্রিমের নাম শুনে ছোট ভাবনার চোখ মুখ উজ্জ্বল হয়ে আসে। সে মাথা কাত করে বল আনতে চলে যায়। ভোর পিছু ডাকে শোনে না। ভাবনা তো আইসক্রিমের ভাবনায় ডুবে আছে। আইসক্রিম পেলে ভাবনা সব ভাবনা ভুলে যায়। সে ছুটে গিয়ে বল এনে আনিকার হাতে দেয়। হাঁপাতে হাঁপাতে বলে,
-” আমাল আইকিলিম?”
তাঁর ছোট গোলগাল মুখ খানা লাল হয়ে আছে। বোচা নাকটা যেন টুকটুকে স্ট্রবেরি। আনিকা হেসে বলে,
-” এখুনি দিবো! চলো!”
ভাবনা খুশি হয়ে হাত তালি দিয়ে বলে,
-” আমাল এততা, ভাই এততা আততা?”
ভোর রেগে ভাবনাকে ছাড়িয়ে একটা চর লাগায় মাথায়। ভাবনা পিটপিট করে চায়। ভাই কেন মারলো তাকে? সে নাক টেনে ঠোঁট ভেঙ্গে ভেঙ্গে বলে,
-” মাচচো কেনু? আমি কি কচচি?”
ভোর আরেকটা লাগায় তাঁর গালে! ভাবনা কেঁদেই দেয়। আনিকা এসে ভোরকে ধাক্কা দিয়ে বলে,
-” মারলি কেন ওকে? ও কি করেছে?”
ভোর আনিকার গালেও লাগিয়ে দেয়! রূপ ভো দৌড়! ভোর ভাই রেগে আছে। তাকে না আবার মারে ধুমধাম! তাই সে সময় থাকতেই কেটে পরে। আনিকা চুপ থাকে না। সেও ভোরকে একটা বসিয়ে দিলো। ব্যস লেগে গেলো দুজনের। কেউ কম যায় না। আনিকা ভোরের চুল টেনে ধরে। ভোর তাঁর ঝুটি টেনে প্রতিশোধ নেয়। ছোট ভাবনা হা করে তাকিয়ে দেখে। তারপর আনিকার পা টেনে বলে,
-” আমাল ভাই মালু কেন? ছালু?”
আনিকা ভোরকে ছেড়ে দিয়ে ভাবনার দিকে তাকিয়ে বলে,
-” অরু তোর জন্য মার খেলাম। আর তুই আমাকে মারছিস! শয়তান ভাইয়ের শয়তান বোন! যা ফুট!”
বলে আনিকা হনহন করে চলে যায়। ভাবনা পিটপিট করে চায়। ভোর হেসে বোনকে কোলে তুলে দুই গালে আদর করে। ভাবনা গাল ফুলিয়ে অন্য দিকে চায়। ভোর হেসে তাঁর মাথার ক্যাপ খুলে ভাবনাকে পরিয়ে দেয়। ভাবনা এবার হেসে বলল,
-” চুন্দল?”
-” অনেক সুন্দর! ‘আব্বু যদি বলে ভাই মেরেছে?’ তখন কি বলবে?”
ভোর ভ্রু উঁচিয়ে জিজ্ঞেস করে। ভাবনা মিষ্টি করে হেসে বলে,
-” ভাই মালি নাই! ভাই আদুল কচচে!”
-” এই তো আমার মিষ্টি বোন! তোমাকে দুটো আইসক্রিম দিবো! চলো?”
হেসে বলে ভোর সরকার। ভাবনা খুশি হয়ে ভাইয়ের গালে চুমু দিয়ে গলা জড়িয়ে ধরে। ভোর তাকে কোলে নিয়ে পা বাড়ায়! বাড়ির মেইন ফটক পেরিয়ে ড্রয়িং রুমে আসতেই নজরে আসে সুধী মন্ডল!
পাতা খানিক রাগি চোখে চেয়ে আছে ভোরের দিকে। তাঁর আঁচলে মুখ লুকিয়ে রাখা রূপকেও চিনতে অসুবিধা হয় না। বাঁদর ছেলে নিশ্চয়ই গড়গড় করে সব বলে দিয়েছে। সোফায় বসে ফোঁস ফোঁস করা আনিকাও নজর এড়ায়নি! নয়ন পাতার পাশে দাঁড়িয়ে কুটুর মুটুর চোখে। এখন খালামুনি বকবে সবাইকে? ভোর ভাবনাকে নিচে নামিয়ে দিয়ে ইনোসেন্ট ফেস বানিয়ে বলে,
-” আম্মু কিছু বলবে? জলদি বলো হ্যা? ভোরের অনেক খিদে পেয়েছে!”
ভাবনা ভাইয়ের হাত ধরে বলে,
-” ভাই খিতে দাও!”
পাতা গম্ভীর সুরে বলে,
-” আনিকাকে মেরেছো কেন? রূপকেও বকেছো!”
ভোর রূপের দিকে চায়। কি মিথ্যুক ছেলে! রূপ পাতার আঁচল থেকে মুখ বের করে ভোরের দিকে চেয়ে হেসে দেয়। ভোর চোখ রাঙাতেই রূপ পাতার দিকে সেটে গিয়ে বলে,
-” দেখো আমা!কেমন করে তাকিয়ে আছে! তুমি চলে গেলে আবার মারবে। অরু কেউ মেরেছে! কিন্তু আমি জানি অরু বলবে না। ”
সাথে সাথে ভাবনা তেড়ে এসে রূপের পেটে একটা চাপড় মেরে বলে,
-” ভাই মালি নাই। ভাই মালি নাই!”
রূপ কাঁদো কাঁদো গলায় পাতার দিকে তাকিয়ে বলে,
-” তোমার মেয়েও মারলো!”
পাতা ভাবনাকে ছাড়িয়ে ধমক দিবে এর আগে ভোর এসে বোনকে টেনে নেয় নিজের কাছে। গম্ভীর সুরে বলে,
-” একটুও বকবে না ভাবনাকে। ওই বিচ্ছুটা এক নম্বরের মিথ্যুক! ওর আলোভোলা মুখের পেছনে আস্ত শয়তান লুকিয়ে থাকে!”
রূপ পিটপিট করে পাতার দিকে চায়। যেন বোঝাতে চাইলো সে নিরপরাধ! পাতা ভোরের দিকে তাকিয়ে বলে,
-” তুমি আগে বলো আনিকাকে মেরেছো কেন?”
-” রাগ উঠেছিলো মেরে দিয়েছি! তোমার আনি বুড়িও চুপ ছিলো না। ওউ মেরেছে। শোধবোধ। তাহলে আবার নালিশ করে কেন?”
-” ভোর! বেশি হয়ে যাচ্ছে কিন্তু!! সবার বড় কে? তুমি! তোমার উচিত ছোটরা ঝগড়া মারামারি করলে থামিয়ে বুঝিয়ে দেওয়া। সেখানে তুমিই মারামারি চুলাচুলি করো! দিন দিন দুষ্টু হচ্ছো!”
পাতা খানিক ধমকের সুরে বলে। ভোর মাথা নিচু করে সিঁড়ি বেয়ে উপরে চলে যায়। পাতা হতাশ হয়। এ ছেলেকে কিছু বলাই যাবে না। গাল ফুলিয়ে বসে থাকবে। ছোট ভাবনা মায়ের সামনে দাঁড়ায়। কোমড়ে হাত রেখে ফোঁস ফোঁস করে বলে,
-” ভাই বকছু কেনু! ভোলেল বাবা বলে দিবু!”
পাতা মেয়ের বোচা নাক টেনে ভেংচি কেটে বলে,
-” বুচুন! তোমাল ভোলেল বাবাকে আমি ভয় পাই নাকি!”
-” ভোলেল বাবা বুলি দিবু । বুচুন বলিচো!”
বলে কাঁদতে কাঁদতে সে আনিকার কোলে উঠে গলা জড়িয়ে ধরলো। আনিকা তাকে সরিয়ে দেওয়ার ভান করে বলে,
-” আমার কাছে আসছো কেন? যাও ভাইয়ের কাছে যাও!”
ভাবনা যায় না। শক্ত করে গলা জড়িয়ে রাখে। রূপ পাতাকে ছেড়ে পকেট থেকে একটা কিটক্যাট বের করে! চকলেট তাঁর কাছে সবসময় থাকে। তার অতি পছন্দ কি না! সে ভাবনাকে ডেকে বলে,
-” মিষ্টি অরুর জন্য মিষ্টি চকলেট! কাঁদে না!”
ভাবনা ফিরেও চায় না তাঁর চকলেটের দিকে। সে জানে রুপ ভাই চকলেটের কথা বললেও কখনো দিবে না। নিজেই খেয়ে বলবে পরে দিবো! নয়ন এগিয়ে এসে বলল,
-” এই অলু! এসো আমলা লুকোচুলি খেলবো! সবাই!”
ভাবনা নয়নের দিকে তাকিয়ে বলে,
-” কেলবু না!”
বলে আবার ঠোঁট ভেঙ্গে কেঁদে দেয়। তাঁর কান্নার আওয়াজ হলেও চোখে একফোঁটা পানির নিশান নেই। পাতা বুকে হাত গুটিয়ে মেয়ের কার্যকলাপ দেখে! এ কোন নমুনা? সে এগিয়ে এসে ভাবনাকে কোলে তুলে গালে ঠোঁট ডাবিয়ে চুমু বসিয়ে বলে,
-” নাক উঁচু বাপের ঢঙ্গি মেয়ে!”
ভাবনা কুটুর মুটুর চেয়ে বোঝার চেষ্টা করে তাখে বকলো না তো? পাতা হেসে মেয়েকে বুকের মাঝে লুকিয়ে বলে,
-” আমার সোনা মেয়ে। বকি নি তো! আমার মানিককে আমি বকতে পারি?”
ভাবনা হেসে উঠলো খিলখিলিয়ে। পাতা মেয়ের মাথায় চুমু দিয়ে সামনে চাইতেই দেখে সব বাচ্চারাই তাঁর দিকে তাকিয়ে আছে। রূপ, নয়ন হাসি মুখে থাকলেও আনি তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকিয়ে। পাতা এগিয়ে এসে আনির গালে হাত বুলিয়ে বলে,
-” ভোরকে আরো বকে দিবো! তুমি রেগে থেকো না কেমন? রাগলে বারবি ডলকে অ্যাংরি বার্ড লাগে! পাস্তা খাবে? বানিয়ে দিবো?”
আনিকা সায় জানালো সাথে রূপ! নয়ন চুপচাপ!
-” তাহলে আমি ঝটপট বানিয়ে আনছি। আনি বুড়ি তোমার চাচ্চুকে বলো না এসব হুম? আমি সত্যিই ভোরকে আবার বকে দিবো! প্রমিজ!”
আনিকা হেসে ওঠে এবার। চাচিমনি যতই বলুক ভোরকে বকে দেবে বকতে পারবে না। তবে সে চাচ্চুকে বলবে না। চাচ্চুকে বললে ভোরের খবর আছে। উল্টো করে ঝুলিয়ে পেটাবে। পাতা মেয়েকে নিয়েই কিচেনে যায়। তাকে দেখে মিনু ছুটে এসে বলে,
-” ম্যাডাম কি লাইগবে বলেন আমি রাইন্ধে দিতেছি! নইলে সুফিয়াকে ডাইকে দিই”
-” না মিনু আপা। আমিই বানাবো! তুমি শুধু একটু হেল্প করো!”
মিনু হাসিমুখে তাঁর হাতে হাতে সাহায্য করে। ছোট ভাবনা মায়ের কোল থেকে নেমে চলে যায় ড্রয়িং রুমে! আনিকা টিভিতে কার্টুন চালিয়েছে সবাই সেটাই দেখছে। ভাবনা গিয়ে আনিকার কোলে বসে হা করে টিভির দিকে তাকিয়ে থাকে। কিছুই বোঝে না সে। তবে যখন রূপ নয়ন হেসে গড়াগড়ি খায় সেও হি হি করে হেসে দেয়। তাঁরা টিভি দেখায় এতোটাই মগ্ন ছিল যে এক ব্যাক্তি এসে তাদের পাশে বসে আছে তাঁরা খেয়ালই করে নি। সবার আগে নয়ন দেখতে পায় ব্যাক্তিটিকে। সে হেসে ‘চাচ্চু’ বলে ডাকে! অরুণ মুচকি হেসে নয়নকে নিজ কোলে বসিয়ে গালে চুমু দিয়ে হাতে কোন আইসক্রিম ধরিয়ে দিলো। নয়ন ইতস্তত বোধ করে নেয়। মা দেখলে বকবে তাকে। ভাবনা সহ সবাই টিভি ছেড়ে নয়নের দিকে চায়। ভাবনা বাবাকে দেখে আনন্দে আত্মহারা হয়ে হাত বাড়িয়ে ডাকে ‘ভোলেল বাবা’ বলে। অরুণ মেয়ের দিকে চায় হতাশ চোখে। তোতা পাখির ন্যায় মেয়ে তাঁর। বাবা আব্বু বলে মিষ্টি করে ডাকবে! তা না ‘ভোলেল বাবা’ সম্মোধন করে। বাবা ডাকতে বললে ডাকবে না। সব দোষ পাতাবাহারের! তার থেকেই শিখেছে এ ডাক। অরুণ নয়নকে পাশে বসিয়ে মেয়েকে কোলে তুলে নিয়ে গালে মুখে চুমু দেয়। আনিকা উঠে এসে চাচ্চুর অপর পাশে বসে বলে,
-” আজ জলদি এলে যে?”
অরুণ আনিকার দিকে একটা আইসক্রিম বাড়িয়ে বলে,
-” মিস করছিলাম আমার দুষ্টু মিষ্টি ছানাদের তাই চলে এলাম! ভালো করি নি?”
-” অনেক!”
আইসক্রিম হাতে খুশি মুখে বলে আনিকা। রূপ অরুণের সামনে দাঁড়িয়ে হাত পাতে। অরুণ তাঁর হাতেও দেয়। ভাবনা বাবার দাঁড়ি টেনে বলে,
-” ভোলেল বাবা আমাল কুনে? দাও?”
অরুণ মেয়ের ছোট্ট হাত দুটোয় চুমু দিয়ে বলে,
-” দেবো না তোমাকে। আগে বাবা বলো তবেই দিবো? বলো আব্বু?”
-” ভোলেল বাবা!”
-” তোমারও তো বাবা হই! মা বাবা ডাকো?”
ভাবনা ডানে বামে মাথা নাড়লো। বলবে না সে।অরুণও তাঁর মতো ডানে বামে মাথা নেড়ে বলে,
-” তাহলে আমিও দেবো না আইসক্রিম! ভোরের বাবা আমি, তাই ভোরকেই দিবো!”
ভাবনা গাল ফুলিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে থাকে। আর একবারো আবদার করে না। অরুণ হেসে মেয়ের গালে চুমু দিয়ে আইসক্রিম বাড়িয়ে বলে,
-” নাও তোমার ফেবারিট চকলেট ফ্লেভারের!”
ভাবনা হাতে নেয়। তবে নিয়েই ছুঁড়ে ফেলে দেয়। আইসক্রিম ফ্লোরে গড়াগড়ি খায়। পাতা ট্রে হাতে পাস্তা এনে সবটা দেখে। এই টুকুন মেয়ের রাগ দেখো! সে ট্রে টেবিলের উপর রেখে আইসক্রিম তুলে বলে,
-” থাপড়ে গাল ফাটিয়ে দিবো! রাগ শুধু ওনারই আছে!”
ভাবনা চোখ পিটপিট করে কেঁদে দিবে দিবে ভাব। অরুণ পাতাকে চোখ রাঙিয়ে মেয়েকে আদর করে বুঝিয়ে আইসক্রিম খুলে দেয়। ভাবনা কান্না ভুলে আইসক্রিম মুখে নেয়। পাতা রাগি সুরে বলে,
-” আরো মাথায় তোলেন! যখন মাথায় উঠে নিজে নাচবে আপনাকেও নাচাবে তখন বুঝবেন! এদের এতো রাগ আসে কোথা থেকে!”
-” পাতাবাহার!”
অরুণের শান্ত গলায় প্রেক্ষিতে পাতা আর একটা কথাও বলে না। ভাবনা মাকে ভেঙ্গিয়ে আইসক্রিম খায় মজা করে। গাল মুখে মাখিয়ে একাকার। অরুণ রুমাল বের করে পরিষ্কার করে বলে,
-” আরেকজন কই? নবাব পুত্তুরকে দেখছি না যে?”
পাতা কিছু বলবে এর আগে রূপ দাঁত বের করে বলে,
-” ভোর ভাই ঘরে! আমা বকেছে তাকে। অরু ও আনি আপুকে মেরেছিলো তাই!”
অরুণের মুখাবয়ব গম্ভীর হয়! পাতা রূপের দিকে চায়। এই বাচ্চাটাও না! সিংহের সামনেই বলতে হবে? সে অরুণের দিকে তাকিয়ে বলে,
-” মারে নি। ঝগড়া বেঁধেছিল শুধু। বকেছি আমি। আপনি কিচ্ছুটি বলবেন না। বললে আপনার খবর আছে! পাস্তা বানিয়েছি আমি! আপনিও নিন!”
অরুণ উঠে মেয়েকে পাতার কোলে দিয়ে বলে,
-” দেখা করে আসি ওনার সাথে!”
পাতা অরুণের বাহু টেনে ধরে শান্ত ভাবে বলে,
-” একদম বাড়াবাড়ি করবেন না। সবেতে বাড়াবাড়ি আপনার। আমি বকেছি, এনাফ! আর একটা কথা শোনালে কিন্তু খুব খারাপ হবে!”
অরুণ মুচকি হাসে পাতার কথায়। তাঁর গালটা টিপে বলে,
-” চেঞ্জ করতে যাচ্ছি! এসে পাস্তা খাবো! দেখি কেমন রাঁধলে!”
বলে চলে যায় অরুণ সরকার। পাতা সন্দেহ চোখে চায়। সে রূপকে ডেকে বলে,
-” যাও তো চাচ্চুর পেছনে। চুপি চুপি যাবে। যদি ভোরকে বকে দৌড়ে এসে বলবে আমাকে!”
-” ভোর ভাই দেখলে মারবে আমাকে। আমি যাবো না। আপুকে বলো!”
পাতা রূপের দিকে চায়। আনি আইসক্রিমের শেষ অংশ মুখে পুরে নিয়ে বলে,
-” ফিকার নট চাচি মনি! ডিটেকটিভ আনিকা সরকার আছে না?”
বলে সে পা বাড়ায়। চুপিসারে হেঁটে সিঁড়ি বেয়ে ভোরের রুমের দিকে চলে যায়। চাচ্চুর ঘরের সাথেই ভোরের ঘর! সে দরজা সামনে দাঁড়ায়। দরজা তো বন্ধ! সে সবটা জানবে কি করে? আনিকা এগিয়ে দরজায় কান লাগিয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু কিছুই শুনতে পায় না। তাই বিরক্ত হয়ে দরজাটায় হাত রাখতেই একটু খুলে যায়। আনিকার অধর জুড়ে হাসি দোলা দেয়। সে দরজাটা অল্প একটু খুলে উঁকি দেয়। ভেতরের দৃশ্য চোখে ভাসতেই আনিকার হাসি গায়েব হয়ে যায়। সে দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করে। অরুণের হাত ধরে বলে,
-” চাচ্চু মেরো না! ভোর কিচ্ছু করে নি। সব আমার দোষ। প্লিজ চাচ্চু!”
বলেই ঝরঝরিয়ে কেঁদে দেয় আনিকা। অরুণ আনিকার মাথায় হাত রাখে। তাঁর রাগি মুখাবয়ব ভয়ঙ্কর। চোখে যেন সেই রাগের বহিঃপ্রকাশ করছে। সে আনিকাকে যেতে বলে। আনিকা যায় না। সে চাচ্চুর হাত টেনে বাইরে নিয়ে যেতে চায়। অরুণ যায় না। আবারও আনিকাকে যেতে বলে গম্ভীর গলায়। আনিকা ভয়ে কাঁপছে অনবরত। ভোরের উন্মুক্ত গায়ে নীল নীল জখম! চাচ্চু মেরেছে? সে ভোরকে ধরতে যাবে ভোর ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়ে চিল্লিয়ে বলে,
-” যেতে বলছে যাচ্ছিস না কেন? যা বের হ এখান থেকে! যা?”
সাথে সাথেই তাঁর গালে শক্তপোক্ত হাতের থাপ্পড় পড়ে। আনিকা হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো। ভোর তার দিকে চোখ পাকিয়ে চায়। আনিকা দৌড়ে বেরিয়ে যায়। ও চলে যেতেই ভোর আবার মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে। অরুণ ছেলের নীল জখমিত শরীর ছুঁয়ে শক্ত গলায় বলে,
-” দিন দিন উচ্ছন্নে যাচ্ছো! এই জখম! ব্যাথা লাগে না? গুন্ডামি করো স্কুলে? ক্লাস ফোরের বাচ্চা ছেলে! সিক্সের ছেলেপুলেকে মেরে নাক মুখ ফাটিয়ে হসপিটালে পাঠাও! ব্যাট তুলেছিলে নাকি মারার জন্য? পিয়ন না থামালে কি হতে পারতো?”
গর্জে ওঠে অরুণ! ভোর কেঁপে উঠলো কি? তবে সে মুখ দিয়ে ট্যু শব্দটি করে না। চোখ নোনা জলে ভরে এলেও তাকে আটকে রাখার প্রচেষ্টা শতভাগ! মাথা নিচু করে সে ক্ষণে ক্ষণে নাক টানে। অরুণের রাগ বেড়ে যায়। কখন থেকে প্রশ্ন করছে ছেলেটা একটা প্রশ্নেরও জবাব দেয় নি; কথাই বলে নি। অরুণ ভোরকে ছেড়ে দুই হাতে মুখ ঢাকে। রাগে শরীরটা কাপছে তাঁর। ছেলের গাঁয়ে কালচে নীল জখম দেখে বুকটা জ্বলছে। অরুণ পরনের ব্লেজার খুলে ছুঁড়ে ফেলে। একহাতে ভোরের গাল জোড়া চেপে ধরে বলে,
-” কলিজা? কি হয়েছিল ওখানে? বলো আমাকে? সবটা! আমার কলিজা এতটা নির্দয় নয় তো! বলো?”
ভোরের হ্যাংলা পাতলা শরীর কেঁপে কেঁপে ওঠে। চোখজোড়া বাঁধ ভেঙে বইতে থাকে। সে দু হাতে মুছে নিয়ে বলে,
-” ওরা লেগপুল করছিলো। আমার রাগ হচ্ছিলো তাই মেরেছি!”
-” কি বলেছিলো? বলো?”
ভোর বলে না। আবার নজর সরিয়ে নেয়। অরুণ হতাশ হয়! এরইমধ্যে কেউ ঝড়ের বেগে এসে অরুণের হাত থেকে ভোরকে ছাড়িয়ে নেয়। অরুণ পাতার দিকে চায়! পাতা ভোরের উন্মুক্ত শরীরে চোখ বুলায়। বুকে পিঠে কালচে জখম! পাতা অবাক চোখে অরুণের দিকে চায়। ভোরকে টেনে বুকে জড়িয়ে অরুণকে উদ্দেশ্য করে বলে,
-” এও বিশ্বাস করতে হবে? আমার ছেলের গায়ে জখম কিসের?”
আনিকা দরজায় দাঁড়িয়ে কাঁদছে। অরুণ তাকে দেখে নিয়ে বিছানায় বসে। ভোরের দিকে তাকিয়ে বলে,
-” ওর সাথে ঝামেলা করে কিছু ছেলে আছে চেনো? ম্যাম ফোন করেছিল দুপুরে। মারামারি করে এসেছেন উনি। যাকে মেরেছে সে ক্লাস সিক্সের; হাসপাতালে ভর্তি! নাক মুখ ফাটিয়ে দিয়েছে। ব্যাট তুলেছিলো মাথায় বাড়ি দিবে বলে। পিয়ন এসে আটকায়! মারামারি করে এই হাল করেছে নিজের! আমি অরুণ সরকারের বুক কাঁপবে না এভাবে নিজ কলিজায় আঘাত করতে?”
পাতা করুণ চোখে অরুণের দিকে চায়। ভোরের মুখটা তুলে বলে,
-” ওরা আবার তোমাকে ডিস্টার্ব করছিলো? বলেছিলাম না ওরা কিছু বললে ম্যামকে জানাতে? মারামারি কেন করেছো?”
অরুণের কপালে গাঢ় ভাঁজ পড়ে। সে দাঁড়িয়ে বলে,
-” কারা ডিস্টার্ব করে? আর আমাকে আগে কেন জানানো হয় নি? এই ভোর?”
এগিয়ে এসে ভোরকে ধরবে পাতা তাকে ঠেলে সরিয়ে দিতে দিতে বলে,
-” আপনাকে পড়ে দেখে নিচ্ছি। যান এখান থেকে বের হন বলছি? আমি কথা বলছি ওর সাথে যান?”
ধমকেই বলে পাতা। অরুণ দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বেরিয়ে যায়। পাতা আনিকাকে ইশারা করে দরজা বন্ধ করে সরে যেতে। আনিকা চলে গেলে পাতা ভোরকে বিছানায় বসায়। মুখটা আঁচলে মুছিয়ে জখমে আলতোভাবে হাত বুলিয়ে ফুঁপিয়ে বলে,
-” কতটা জখম হয়েছে! আমাকে বলো নি কেন? বাবা মেরেছে?”
ভোর পাতা কোমড় জড়িয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বলে,
-” দুটো চর মেরেছে। একটা আস্তে আরেকটা জোরে!”
পাতা ভোরের মুখটা তুলে দেখে ফর্সা গাল লাল হয়ে আছে।
-” বলো কি হয়েছিলো?”
-” ওরা আবার লেগপুল করছিলো আমাকে। বাজে বাজে কথা বলছিলো বাজে ভাষায়। তোমাকে নিয়ে, আব্বুকে নিয়ে। আমার রাগ হচ্ছিলো তাই মেরেছি!আবার বললে আরো মারবো!”
কন্ঠে তেজে ভরপুর! পাতা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে। ইদানিং স্কুলে কিছু উটকো ছেলে ভোরকে পেরেশান করে। এটা ওটা বলে ক্ষেপায়। বাজে টোনে কথা বলে। আর ভোর তো ভোরই। বাবার মতোই হাতটা বেশি চলে কি না। একবার জবাব দিয়েছিলো তবে হাতাহাতি হয় নি। পাতা প্রিন্সিপাল ম্যামকে বলে ছেলেগুলোর গার্ডিয়ান ডেকে ব্যাপারটা জানিয়েছিলো। এতে যেন ভোর ছেলেগুলোর চোক্ষু শূল হয়। তাদের ডিস্টার্বনেস বেড়ে যায়। পাতা ভোরকে সাবধান করে ছিলো। মারামারি নয়; ওরা ডিস্টার্ব করবে প্রিন্সিপাল ম্যামকে জানাতে। নইলে তাকে জানাতে। কিন্তু ভোর তো ভোরই! বাবার মতো হাতটা বেশি চলে কি না! পাতা অবাক হয়! এইটুকুন ছেলে সিক্সের ছেলেকে মেরে হাসপাতালে পাঠিয়েছে। শরীরে জখম নিয়েও সাচ্ছন্দ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ব্যাথা করছে না?
চলবে…..
#পাতা_বাহার
লেখনীতে: #বেলা_শেখ
#পর্ব- ৬০ (শেষ অংশ)
(কপি করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ)
মানুষ মরন শীল। প্রত্যেক প্রাণীকেই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে। এই ক্ষণিকের দুনিয়া ছেড়ে একদিন সবাইকেই যেতে হবে। আসমা বেগম পরলোকগমন করেন প্রায় বছর এক হবে। আদুরির বিয়ের পর থেকেই তিনি অনেকটাই চিন্তিত ছিলেন মেয়েকে নিয়ে। কেমন শান্ত হয়ে থাকতেন সবসময়। কারো সাথেই খুব একটা মিশতেন না। একদিন হুট করে অরুণের ফ্ল্যাটে গিয়ে পাতার হাত ধরে কেঁদে দেন। পাতা ঘাবড়ে যায় বেশ সাথে চিন্তাতেও পড়ে। অরুণ আসলে আসমা বেগম তাকে জড়িয়ে কেঁদে কেঁদে বলে বাড়ি ফিরে যেতে। অরুণ মূক হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো সেদিন ; জবাব দেয় নি। আসমা বেগম নিজেকে সামলে ফিরে আসেন নিজ বাড়ি। বুঝতে পারেন অরুণ আর আসবে না সরকার বাড়ি। তবে তাকে চমকিত করে অরুণ সরকার তিনদিন পর লাগেজ, বউ ,বাচ্চা সমেত সরকার বাড়িতে প্রবেশ করে। তারপর এখানেই তাঁদের ভেঙ্গে যাওয়া সংসার জুড়ে যায়। এসবে সবচেয়ে খুশি পাতা! তাদের আগমনের ছয়মাসের মাথায় আসমা বেগম স্বাভাবিকভাবেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তাঁর বিদায়ে সবচেয়ে ভেঙ্গে যায় আদুরি। বাবাকে কম সময়ই পেয়েছিলো সে। তাঁর দুনিয়া মা ভাইকে ঘিরে। মা নামক ছায়া চলে গেলে সে নিজেকে সামলাতে পারে নি। লুবমান তার পাশে ছিলো। পাতা লাবনী আক্তারের হাত ধরে অনুরোধ করেছে একটু স্নেহ ছায়ায় ননদ রূপি বোনকে একটু আগলে নিতে। লাবনী আক্তার মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে কেঁদেছিলেন সেদিন। মেয়েটাকে স্নেহের জালে আগলে নিতে পারে নি। তবে মেয়ের অনুরোধ তিনি ফেলেন নি। আর আরিয়ানকে সামলানোর জন্য অরুণ ছিলো তো! ছোট আনিকা দাদির কাছের ছিলো খুব। দাদি নেই এই কথাটা প্রথম প্রথম মানতেই চাইতো না। চিল্লাচিল্লি করতো। ধীরে ধীরে বুঝতে শিখেছে এখন আর চিল্লাচিল্লি করে না। আজকে আনিকার মনটা বড্ড খারাপ। তাঁর মন খারাপের কারণ ভোর। ভোর স্কুলে মারামারি করেছে; মার খেয়েও এসেছে। চাচ্চুও মেরেছে। নিশ্চয়ই ভোরের অনেক কষ্ট হচ্ছে। সে গালে হাত দিয়ে সোফায় বসে আছে। তাঁর পাশে রুবি বসে ছেলেকে ব্রাশ করিয়ে দিচ্ছে আর বকছে। চকলেট খেয়ে খেয়ে দাঁত গুলো শেষ করে দিয়েছে। দাঁত ব্যাথায় কেঁদে কুল কিনারা পায় না তবুও চকলেট ছাড়া একদন্ড চলবে না। রূপ কাঁদো কাঁদো চোখে বাবার দিকে চায়। আরিয়ান এমন ভাব করে যেন তাকে চেনেই না। রূপ বাবার পাত্তা না পেয়ে চাচ্চুর দিকে চায়। অরুণ সোফায় বসে টিভিতে নিউজ দেখছিলো। তাই রূপের মায়ের হাত থেকে বাঁচানোর আকুতি চোখে পড়ে না। হঠাৎ রূপের ছোট পেটে কিছু গুড়গুড় করে। সে মায়ের হাত সরিয়ে মুখের ফ্যানা ফেলে উঁচু গলায় বলে,
-” আব্বু জানো আজ ভোর ভাইয়া স্কুলে মারামারি করেছে তাই চাচ্চু ভোর ভাইকে মেরেছে! আমা’ ও বকেছে অনেক!”
বলেই দাঁত বের করে হাসে। রুবি অরুণের দিকে চায়। সত্যিই কথাটা? আরিয়ানও সন্দেহ চোখে চায়। অরুণ টিভি ওফ করে ঘটনা কাটছাঁট করে শোনায়। আরিয়ান ভ্রু কুঁচকে বলে,
-” এতে ভোরের কি দোষ? ওরা ভোরকে ডিস্টার্ব করতো বাজে ভাষায় লেগপুল করতো ! যে কেউ রেগে যাবে। ভোর ঠিক করেছে উচিত ছিলো আরো কয়েক ঘা বসিয়ে মুখটা ছেঁচে দেওয়া! আমি কাল ওর স্কুলে গিয়ে ব্যাপারটা দেখবো নি! কতবড় সাহস আমাদের ছেলেকে বাজে কথা বলে গায়ে হাত দেয়! ওর চৌদ্দ গুষ্টির নামে কেস ঠুকে জেলের রুটি খাওয়াবো!”
-” আব্বু জেলে চকলেট দেয় না?”
রূপের সহজ সরল প্রশ্ন!রুবি চোখ পাকিয়ে চায়। রূপের চাঁদ মুখখানিতে আঁধার নামে। অরুণ না হাসলেও আরিয়ান মুচকি হাসলো। সে ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বলে,
-” ভোরকে মেরেছিস কেন? ও এখন ছোট টি নেই যে একটু কিছু হলেই মারবি! আমার বিচ্ছু টা কে দেখ! মনে হবে ওর থেকে ভদ্র দু টো নেই! কিন্তু আনিকা ঠিক বলে মিনি শয়তান! গত সপ্তাহে কি করেছে জানিস? ক্লাস টিচারকে লাভ লেটার দিয়েছে! আই লিখে একটা লাভ শেপ তারপর ইউ! ম্যাডাম ওকে জিজ্ঞাসা করলে কি বলেছে জানিস? বলেছে আমি নাকি বলেছি দিতে! ভাবতে পারিস? ওর টিচার যদিও বুঝতে পেরেছে রূপের দুষ্টুমি ! সে রুবিকে ফোন করে হেসে হেসে বললো সেদিন! রুবি আমাকে এ নিয়ে সন্দেহ করে!”
অরুণ এ পর্যায়ে মুচকি হাসলো। রুবি মুখ লুকিয়ে হাসে। রূপ চাচ্চুর দিকে দাঁত বের করে হেসে বলে,
-” টিচার অনেক সুন্দর চাচ্চু! আমাকে চকলেট দেয়। আমি বড় হলে তাকে বিয়ে করবো! তাই লেটার দিয়েছিলাম! তুমি একটু টিচারের সাথে কথা বলবে?”
রূবি ছেলেকে চোখ রাঙায়। আরিয়ান হেসে উঠলো শব্দ করে। বাবার হাসি দেখে রূপও হেসে দেয়। আনিকা ভাইয়ের মাথায় চাটি মেরে বলে,
-” সুইটি ম্যাম বিয়ে করেছে! তোর সমান একটা বাচ্চাও আছে!”
রূপ সোফায় উঠে দাঁড়িয়ে ভ্রু কুঁচকে বলে,
-” আমি বড় হতে হতে টিচারের হাসবেন্ড মারা যাবে। তখন বিয়ে করবো। আর বাচ্চাকে চকলেট দিয়ে বেঁচে দিবো!”
এবার রুবি আনিকা হেসে ওঠে সমস্বরে। অরুণ খানিক হেসে উঠে এসে দু হাতে রুপের গাল টেনে বলে,
-” ইশ্ তখন তো টিচার বুড়ি হয়ে যাবে। এক কাজ করা যায়; তোমার টিচারের একটা মেয়ে হলে তার সাথে বিয়ে দিবো তোমাকে! আইডিয়াটা দারুণ না?”
রূপ সময় নিয়ে ভেবে জবাব দেয়,
-” দারুণ! আমি কালকেই টিচারকে বলবো জলদি জলদি মেয়ে আনতে!”
অরুণ হেসে দিল। এতো পাকা পাকা কথা বাচ্চাটার। এতো তাঁর কলিজার থেকেও বেশি চঞ্চলা! তাঁর ছেলে বিয়ের কথা উঠলেই লাজে রাঙা হয়;আর এ ছেলে বিয়ের জন্য মেয়ে পছন্দ করে লাভ লেটার অবধি পাঠিয়েছে! ওভার ফাস্ট ছেলে। রুবি আরিয়ান ছেলে মেয়েকে নিয়ে খুনসুটিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। রূপ এটা ওটা বলে বাকিরা তাঁর পাকা কথায় হেসে কুল কিনারা খুঁজে পায় না। কে শিখিয়েছে একে এতো কথা? অরুণ কিছু সময় বসে থেকে পা বাড়ায় নিজ রুমের উদ্দেশ্যে! রূপের পাকা কথায় মুখটা হাসলেও বুকটা তাঁর পুড়ছে খাঁ খাঁ! কলিজার গায়ে কালচে নীল আঘাত তাঁর উপরে সেও দুটো চর মেরেছে! ছেলেটা নিশ্চয়ই অনেক কষ্ট পেয়েছে। অরুণ ছেলের রুমে যাবে হঠাৎ নিজ রুম থেকে আওয়াজ আশায় দৌড়ে যায় ঘরে।দেখে ছোট্ট ভাবনা ফ্লোরে পড়ে আছে উপুর হয়ে।
ভাবনা বাবাকে দেখে দেখে কাঁদো কাঁদো গলায় বলে,
-” ভোলেল বাবা ভুত! আমাল বাঁচাও!”
অরুণ কপালে ভাঁজ ফেলে এগিয়ে মেয়েকে টেনে বুকে তুলে নেয়। হাত পা মুখ দেখে বলে,
-“আমার মা’টা পড়ে গেলে কি করে? ব্যাথা পেয়েছো? আর কোথায় ভুত? তোমার মা কোথায়? একা একা ঘরে কি করছো? কথা বলছো না কেন? এই চড়ুই সোনা?”
ছোট ভাবনা হা করে চেয়ে থাকে বাবার দিকে। এতো প্রশ্ন একসাথে ছোট্ট মাথায় লোড নিতে পারে নি বোধহয়! অরুণ মেয়ের লাল টকটকে ঠোঁটে চুমু দিয়ে বলে,
-” চড়ুই সোনার লেগেছে?”
ভাবনা এবার ডানে বামে মাথা নেড়ে না বোঝায়। লাগে নি তাঁর। বেলকনির দিকে আঙুল দেখিয়ে ইশারা করে বলে,
-” পাতু ভুত হয়ি গেচি!”
অরুণ ভ্রু কুঁচকে এগিয়ে যায়। পাতা ভুত হয়ে গেছে? ভাবনা বাবার বুকে মুখ লুকিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে,
-” ভুত কেয়ি ফেলিবু!”
-” কিচ্ছু হবেনা! বাবা আছে তো!”
অরুণও মেয়ের মতো ফিসফিসিয়ে বলে। বেলকনিতে যেতেই আবছা আলোয় নজরে আসে পাতাবাহার! এক ঝুড়িতে বসে আছে। সাথে তাঁর ছোট্ট ছানা! আবছা অন্ধকার হওয়ায় বিড়াল দুটির চোখ উজ্জ্বল! যেন দ্যুতি ছড়িয়ে দিচ্ছে। এটা দেখেই মেয়েটা ভয় পেয়েছে হয়তো। অরুণ বেলকনির লাইট জ্বালিয়ে মেয়েকে নিয়ে পাতাবাহারের সম্মুখীন হয়ে বসে। পাতাবাহার আর তাঁর ছানা মিও মিও করে ডাকে। ছানাটি মায়ের আড়ালে লুকিয়ে নেয় নিজেকে। অরুণ হাত দিয়ে ছানা ও তাঁর মা’কে আদর করে মেয়েকে বলে,
-” ওদের দেখে ভয় পেয়ে ছিলে? অন্ধকার ছিলো তাই চোখগুলো জ্বল জ্বল করছিলো। ভুত হয়ে যায় নি। ভুত বলতে কিছুই হয় না!”
ভাবনা বাবার বুক থেকে মুখ খানি বের করে পিটপিট করে চায়। স্বাভাবিক পাতাবাহার ও তার শাবক দেখে হেসে বিড়ালের কান টেনে বলে,
-” দুষতু পাতু! মা বলি দিবু। ভোলেল বাবা বকে দাও?”
-” আগে বাবা বলো? তাহলে বকে দিবো! বাবা না বললে তোমাকে বকবো!”
ভাবনা রাগি চোখে চায় বাবার দিকে। অরুণের মাথার চুল টেনে ধরে বলে,
-” ভাই বুলি দিবু! তুমায় বুকে দিবু!”
অরুণ হেসে দাঁড়িয়ে যায় মেয়েকে নিয়ে। ভাবনার ছোট হাতজোড়া থেকে নিজ চুল ছাড়িয়ে মেয়ের ঝুটি আলতোভাবে টেনে বলে,
-” পঁচা চড়ুই! তোমার ভাই বকবে আমাকে? আর আমি ভয় পেয়ে যাবো? হুঁ?”
ভাবনা এবার ঠোঁট ভেঙ্গে কেঁদে দেয় হাউমাউ করে। অরুণ ভড়কে যায়। সে মেয়ের গালে মুখে ছোট ছোট চুমু দিয়ে আদর করে বলে,
-” কাঁদছো কেন? এই চড়ুই সোনা? মা আমার কাদে না।”
ভাবনা কান্নার গতি কমিয়ে ভঙ্গুর গলায় বলে,
-” মালিচু কেনু? ভাইকে বলি দিবু!”
বলে আবার কান্না শুরু করে। অরুণের মাথার উপর দিয়ে যায়। কখন মারলো? মারতে পারবে তাঁর ছোট্ট চড়ুইকে? সে মেয়েকে বুকে জড়িয়ে বলে,
-” কখন মারলাম মা টাকে? এতো মিষ্টি মা’কে মারা যায়?”
ছোট ভাবনা নিজ মাথার ঝুটি টেনে বলে,
-” ইভাবে মেলিচো! ভাইকে বলি দিবু। ভাই মাববে তুমায়!”
বলে নাক টানে। অরুণের মুখ হা হয়ে যায়। ঝুটিটা ধরেছিলো শুধু। ব্যাথার ব’টাও পাবে না। মেয়ে কেঁদে গঙ্গা যমুনা উল্টিয়ে দিচ্ছে। চোখে যদিও পানির ছিটেফোঁটাও নেই তবে কান্না দেখে ভাববে মেরে আস্ত রাখে নি। সে হেসে মেয়ের মাথায় চুমু দিয়ে বলে,
-” বাবা অনেক স্যরি! আমার ভাবনাতেই আসে নি আমার ভাবনা চড়ুই ব্যাথা পাবে! বাবা অনেক আদর করে দিবে হবে না?”
ভাবনা ডানে বামে মাথা নাড়লো হবে না। অরুণ ভ্রু উঁচিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
-” তাহলে কি করতে হবে?”
ভাবনা চোখ ডলে বিড়বিড় করে আঙুল গুনে দুটো আঙ্গুল উঁচিয়ে বলে,
-” পাচতা আইকিলিম দাও!”
অরুণ আঙুল দুটো মুখে পুরে চুমু দেয়। দুটো আঙ্গুল তুলে পাঁচটা আইসক্রিমের আবদার! সে মেয়েকে বিছানায় বসিয়ে ওয়াশ রুমে গিয়ে হাত ধুয়ে আসে। বিড়াল ছুঁয়ে ছিলো! এরপর ঘরের মিনি ফ্রিজ থেকে আড়াইশো মিলি আইসক্রিমের বাটি বের করে খুলে মেয়ের সামনে দিয়ে বলে,
-” এই নাও হবে না এতে?”
-” কুব হবে!”
অরুণ চামচ দিয়ে মেয়ের মুখে দিবে ভাবনা মুখে নেয় না।বাবার হাত থেকে চাচম কেড়ে নিজেই গপাগপ মুখে পুরে। অরুণ মেয়ের গালে চুমু দেয়। বাবা ভাইয়ের মতোই আইসক্রিম পাগলি। অরুণ পাশে বসে মেয়ের আইসক্রিম খাওয়া দেখে। সব মনোযোগ তাঁর আইসক্রিমের বাটিতে। অরুণ তর্জনী আঙ্গুল দিয়ে একটু আইসক্রিম তুলে মুখে দিবে ভাবনা চোখ রাঙিয়ে চায়। অরুণ মুচকি হেসে বলে,
-” এইটুকুন!”
ভাবনা বাবার হাত ধরে আঙুল মুখে পুরে নেয়। অরুণ ছোট ছোট চোখে চায়। কিপ্টুস মেয়ে! তাঁর কলিজা হলে বাবাকে রেখে খেতোই না! ভাবনার আইসক্রিম খাওয়ার মাঝেই পাতার আগমন ঘটে। ছোট ভাবনা চোখ বড় বড় করে চায়। হাতের আইসক্রিমের বাটিটা বাবার কোলে দিয়ে বাবার হাতে আইসক্রিম ধরিয়ে দেয়। অরুণ আহাম্মক হয়ে বসে থাকে।
পাতার মুখখানি থমথমে; বোঝাই যাচ্ছে রেগে আছে। রুমে প্রবেশ করে পাতা তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে বাবা মেয়ের দিকে। ভাবনা মিষ্টি হেসে মাকে বলে,
-” আইকিলিম কাই নাই। ভোলেল বাবা কেয়িছে!”
ইশারায় বাবাকে দেখিয়ে দেয়। অরুণ একবার মেয়েকে দেখে তো একবার তাঁর মাকে! পাতা বুকে হাত গুজে বলে,
-” আচ্ছা? আইসক্রিম তো তোমার মুখে লেগে আছে! তোমার বাবা খেলে তাঁর মুখে লেগে থাকতো তাই না?”
ভাবনা বাবার দিকে চায়। চোখ পিটপিট করে ঝড়ের বেগে বাবাকে জড়িয়ে মুখে লেগে থাকা আইসক্রিম বাবার মুখে লাগিয়ে সরে আসে। মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে,
-” লেগি আচে না?”
পাতার থমথমে মুখে হাসি ফুটে উঠতে চায়। সে জিভে কামড়ে হাসি আটকে রাখে। অরুণের দিকে এগিয়ে গিয়ে গমগমে গলায় বলে,
-” বেশি বেশি করে গিলুন আইসক্রিম! সকালে দুপুরে সন্ধ্যা রাতেও গিলুন! ঠান্ডায় নাক টানলে বোচা নাক কেটে দিবো! তখন সবাই নাক কাটা অরুণ সরকার বলে ডাকবে!”
অরুণ হেসে দেয়। আড়চোখে মেয়ের ভোঁতা মুখখানি দেখে পাতাকে শাসানো গলায় বলে,
-” খবরদার বোচা বলবে না। এতো সুন্দর কিউট নাক! তোমার নেই তাই হিংসে হয় বুঝি?”
পাতা অরুণের নাক টেনে মেয়ের বোচা নাকে চুমু দিলো। ভাবনা এখনো গাল ফুলিয়ে; মা সবসময় তাকে বোচা বুচুন বলে!
-” আরে তোমাকে বলি নি! তোমার বাবাকে বলেছি! তোমার বাবা নাক উঁচু বোচা লোক। বুঝলে? আমার মেয়ে তো মিষ্টি চড়ুই। তাই না?”
মায়ের আদুরে গলায় ভাবনা হেসে দেয়। পাতা আঁচল দিয়ে মেয়ের আইসক্রিমে মাখা মুখটা মুছে দিয়ে আদর করে। অরুণ গলা খাঁকারি দিয়ে বলে,
-” আমার মুখ খানি মুছে দিলে ধন্য হতাম মহারানী!”
পাতা কপালে ভাঁজ ফেলে বলে,
-” আমি আপনার উপর রেগে আছি!”
অরুণ উঠে পাতার আঁচল টেনে নিজেই মুখ মুছতে মুছতে বলে,
-” কারো উপর রেগে থাকলে তাকে জানাতে নেই এতে রাগের পাল্লা হালটা হয়ে যায় বুঝলে পাতাবাহার?”
পাতা আঁচল ছিনিয়ে নিয়ে হিসহিসিয়ে বলে,
-” একদম ফাজলামি করবেন না। আপনার অহেতুক বাড়াবাড়ি ভালো লাগে না। অসহ্য!”
অরুণের মুখের আকার পরিবর্তন হয়। গম্ভীর আদলে রাশভারী সুরে বলে,
-” আমি বাড়াবাড়ি করি? অসহ্য লাগে?”
-” হ্যাঁ লাগে।”
প্রশ্নের পৃষ্ঠে ফটাফট জবাব পাতার। অরুণের চোয়াল শক্ত হয়। ছোট ভাবনা মায়ের কোল থেকে কুটুর মুটুর চেয়ে দেখে বাবাকে। বাবা তাঁর দিকে চাইলে সে মুচকি হাসলো। অরুণের শক্ত চোয়াল শিথিল হয়ে আসে নিমিত্তে! এই তো তাঁর সব অসুখের ওষুধ! পাতা মেয়েকে বিছানায় বসিয়ে মেয়ের এলোমেলো কাপড় , পুতুল, খেলনা গুলো গুছিয়ে রাখতে রাখতে বলে,
-” ভোর ছোট নেই আর যে কথায় কথায় মারবেন…”
-” কথায় কথায় মারি আমি? স্কুলে মারামারি করে এক বাচ্চাকে হসপিটাল পাঠাবে গার্ডিয়ান ফোন করে হুমকি দেবে আমি চুপচাপ দেখবো? তুমি যদি আমাকে ব্যাপারটা আগেই জানাতে তাহলে জল এতো দূরে গড়াতো না!”
পাতাকে থামিয়ে অরুণ গম্ভীর সুরে বলে। পাতা অবাক চোখে চেয়ে বলে,
-” কি বোঝাতে চাইলেন আপনি? আমার জন্য হয়েছে এসব? আমি জানাই নি তাই!!”
-” সেটা বলি নি। কথা পেচাবে না!”
-“আমি না আপনি ঘুরাচ্ছেন কথা! যাই হোক আমি জানাই নি আপনার বাড়াবাড়ি স্বভাবের কারণে। আমি ম্যামের সাথে কথা বলে ওই ছেলেগুলোর গার্ডিয়ানকে অবধি অবগত করেছিলাম। ভোরকেও বুঝিয়েছিলাম ওরা কিছু বললে ম্যাম ও আমাকে জানাতে! কিন্তু ছেলেটা রাগ সামলাতে না পেরে মেরে দিয়েছে। নিজেও অক্ষত অবস্থায় আসে নি কিন্তু!”
কথা বলতে বলতে পাতা হাঁপিয়ে ওঠে। অরুণ ছোট ছোট করে চেয়ে বলে,
-” অক্ষত অবস্থায় এলে চর দুটো দিতাম না হয়তোবা! কত বড় সাহস আমার কলিজাকে আঘাত করে!”
পাতা চোখ বড় বড় করে চায়। অরুণের ভাবান্তর নেই। তাঁর ছেলেকে মেরেছে সে চুপ থাকবে? কাল দেখে নেবে! পাতা অরুণের দিকে তাকিয়ে বলে,
-” এই দু মুখো স্বভাব হজম হচ্ছে না। তাহলে বকলেন কেন? নিজেও তো মারলেন সেটা কিছু না? ”
-” আমার কলিজা আমি মারবো, ধমকাবো, কাঁদাবো। আমিই ভালোবাসবো, আদর করবো, হাসাবো। অন্যকেউ এসে আঘাত করবে এটা সহ্য করবো না!”
পাতা কটমট করে চায়। শালার ঘাড়ত্যাড়া জামাই! পাতার মাথা গরম হয়ে যায়। মাথার উপর ডিম ভেঙে দিলেই অমলেট হয়ে যাবে। আর ডিম হিসেবে কাজ করে ভাবনা। সে বিছানায় দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করে,
-” জগলা কলিচো কেনু? ভোলেল বাবা….”
কথা শেষ করতে পারে না ছোট্ট ভাবনা। বিছানায় পরে যায়। গালে হাত দিয়ে ঠোঁট ভেঙ্গে মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে,
-” মালচু কেনু? কি কচচি?”
-” ভোরের বাবা কি? হুঁ? তোর বাবা না? বাবা ডাকতে পারিস না? আরেকবার ভোরের বাবা ডাকলে থাপ্পড়ে কানে তালা ঝুলিয়ে দিবো! বেয়াদব!”
পাতা রাগে গজগজ করতে করতে বলে। ভাবনার কান্না দেখে কে? সে বিছানায় গড়াগড়ি খেতে খেতে চিল্লিয়ে কাঁদতে থাকে। তাঁর কান্নার আওয়াজে অরুণের হুঁশ ফিরলো যেন! সে পাতার হাত মুচরে ধরে বলে,
-” তোমার হাত আমি ভেঙে ফেলবো পাতাবাহার! কত সাহস তোমার!! আমার সামনে আমার মেয়েকে মারলে!!”
পাতা হাত ছোটানোর চেষ্টা করে বলে,
-” আপনার হাত দুটোও তাহলে ভেঙে ফেলা উচিত। আপনি আমার ছেলেকে মারেন! ”
বলে অরুণের হাতে শক্ত করে কামড় বসায়। অরুণ ব্যাথা পেলেও কিছু বলে না। বলবে কি সে? কথা বলার কোনো ভাষাই খুঁজে পাচ্ছে না। অরুণ হাসে! তাঁর প্রাপ্তির খাতায় সবটা জুড়ে এই পাতাবাহার!
ভাবনা কান্না ভুলে গেছে। সে হা করে বাবা মার মারামারি দেখে। তাঁরপর বিছানা থেকে ঘষে নেমে পড়ে। একদৌড়ে বের হয়ে যায়। ভাইয়ের ঘরের দরজায় জোড়ে ধাক্কা দিলে ধরাম করে খুলে যায়।
ভোর বিছানায় হেলান দিয়ে বসে কিউব ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে মেলানোর চেষ্টায় ছিলো। হঠাৎ এমন শব্দ করে দরজা খোলায় বিরক্ত ভঙ্গিতে চায়। ক্রন্দনরত বোনকে দেখে কিউব ছুঁড়ে এগিয়ে এসে বোনকে কোলে নিয়ে বলে,
-” এই ভাবনা কি হয়েছে? কাঁদছো কেন? মেরেছে কেউ? কে মেরেছে বলো? ভাই তাকে পিট্টি দিবে! কাঁদে না!”
ভাবনা ভাইয়ের কোলে উঠে ফোঁপাতে থাকে। দুই হাতে চোখ ডলে ঠোঁট নাড়িয়ে কি বলে ভোর বুঝতে পারে না। সে বোনের ভেজা গাল মুছে আদর করে গালে। ভাবনার কান্না থেমে আসে। তবে ফোপানো কমে নি। সে হিচকি তুলে বলে,
-” মা মালিচে! ভোলেল বাবা মালিচে!”
ভোরের কপালে চিন্তার রেখা ফুটে ওঠে। আম্মু মেরেছে ভাবনাকে? বাবাও মেরেছে? সে বোঝে না! নরম গলায় সুধায়,
-” কাকে মেরেছে?”
-” আমাকে! মাকে! বাবাকে!”
থেমে থেমে বলে ভাবনা। ভোর চিন্তিত মুখে ঘর থেকে বেরিয়ে বাবা মায়ের ঘরের দিকে যায়। ভেজানো দরজা টোকা দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে। ভেতরে ঢুকে ভোর যেন ভড়কে যায়। আম্মু আব্বুর চুল টানছে! ভোর গোল গোল করে চেয়ে ডাকে,
-” আম্মু?”
পাতা পাশ ফিরে চায়। ভোর ও তাঁর কোলে মেয়েকে দেখে অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। অরুণকে ছেড়ে দিয়ে সরে দাঁড়ায়। অরুণ ছাড়া পেয়ে স্বস্তির শ্বাস ছাড়লো। ইশ্ তাঁর চুল শেষ! সে চুলের ভেতর হাত গলিয়ে ছেলের দিকে চায়। ভোর সাথে সাথেই নজর সরিয়ে পাতার দিকে তাকিয়ে বলে,
-” ভাবনাকে কে মেরেছে?”
পাতা গোল গোল করে মেয়ের দিকে চায়। এতো জলদি নালিশ চলে গেছে। আজ পাতাকে কে বাঁচাবে ভোর সরকারের হাত থেকে! সে আমতা আমতা করে। অরুণ পাতার করুণ মুখ খানা দেখে ঠোঁট বাঁকিয়ে হেসে ভোরের উদ্দেশ্যে গমগমে গলায় বলে,
-” তোমার আম্মু মেরেছে আমার মেয়েকে। আমি প্রতিবাদ করেছি তাই আমাকে কামড়েছে? এই দেখো?”
বলে হাত বাড়িয়ে দেখায়। ফর্সা লোমশ হাতে লাল দাগ! দাঁত কপাটি স্পষ্টভাবে বোঝা যাচ্ছে। পাতা অরুণের দিকে চোখ পাকিয়ে চায়। এই লোক পাগল নাকি? অরুণ হাত সরিয়ে চুল পরিপাটি করতে করতে বলে,
-” বাকি সিন তুমি নিজ চোখে দেখেছো কলিজা!”
ভোর পাতার দিকে চায়। ভাবনাও মায়ের দিকে আঙুল তুলে হিচকি তুলে বলে,
-” আম্মু মালিচে! ওকে মালি দাও!”
বলেই আবার কান্নায় ভেঙে পড়ে ভাইয়ের গলা জড়িয়ে। পাতা এবার অসহায় বোধ করে। সবাই তাঁর বিরুদ্ধে চলে গেলো। সব দোষ এই নাক উঁচু ম্যানারলেস লোকের। ভোর পাতার দিকে এগিয়ে গিয়ে গম্ভীর সুরে বলে,
-” আমার বোনকে মারবে না কখনো। ও আমার সবচেয়ে আদরের। ওকে কেউ বকবে না মারা তো অনেক দূরে।”
বলেই বোনকে নিয়ে হনহন করে চলে যায়। ভাবনা কান্না থামিয়ে পাতাকে জিভ দেখিয়ে ভেঙায়। পাতা এবার আহম্মক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। ভোর ও ভাবনা চলে গেলে অরুণ শরীর দুলিয়ে হেসে উঠলো। হাসতে হাসতে তাঁর মুখখানি লাল হয়ে যায়। পাতা ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে তাঁর দিকে। অরুণ অনেক কষ্টে হাসি থামিয়ে পাতার কাছে গিয়ে জাপটে ধরে বুকে। আফসোসের সুরে বলে,
-” ও লে লে পাতাবাহার? কাঁদে না হ্যাঁ! তবে তোমার দোষ আছে কিন্তু!”
পাতা রেগে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে শব্দ করে পা ফেলে চলে যায় রুম থেকে। অরুণ পিছু ডাকে বেশ কয়েকবার। পাতা ঘর থেকে বেরিয়ে পুনরায় ফিরে আসে। অরুণকে ধাক্কা দিয়ে বিছানায় ফেলে বালিশ দিয়ে এলোপাথাড়ি মারতে শুরু করে,
-” নাক উঁচু ম্যানারলেস লোক! খুব হাসি পাচ্ছে তাই না? আপনার দাঁত গুলো ভেঙ্গে দিবো আমি! অসভ্য ইতর বদমাইশ লোক কোথাকার!”
অরুণ পাতার হাত থেকে বালিশ কেড়ে নিয়ে ছুঁড়ে ফেলে। শক্ত চোয়ালে পাতার হাত টেনে বিছানায় ফেলে দেয়। পাতা একটু ঘাবড়ে যায়। লোকটা রেগে গেলো কি? অরুণ পাতার উপর চড়াও হয়। হাত দুটো বিছানায় চেপে নাকে চুমু দিয়ে বলে,
-” সাহস বেড়ে যাচ্ছে, তাই না? এক থাপ্পড়ে কানে তালা ঝুলিয়ে দিবো বেয়াদব! এই চুনোপুঁটির ন্যায় শরীর নিয়ে আমার সাথে লড়তে আসো! এক ধমক দিলে কেঁদে কূলকিনারা পাবে না!”
পাতা হাত মুচড়া মুচড়ি করে; অরুণের চোখে চোখ রেখে বলল,
-” দিন ধমক! ভয় পাই না আপনাকে।”
অরুণ পাতার গালে গাল ঘষে ধমক দিয়ে বলে,
-” ভয় পাও না?”
দাঁড়ির ঘর্ষণে পাতা মুখ কুঁচকে নেয়। ছটফট করতে থাকে ছাড়া পাওয়ার জন্য। অরুণ ছাড়ে না মোটেও।
_____
ভোর বোনকে নিয়ে নিজের রুমে চলে আসে। বোনকে বিছানায় বসিয়ে বললো,
-” আজ ভাবনা বুড়ি আমার কাছে থাকবে! থাকবে না?”
ভাবনা গাল ফুলিয়ে চায়। সে তো মাকে ছাড়া থাকে নি কখনো। বাবাও থাকবে না! আর ভাইয়ের বিছানা ভিজিয়ে দিলে ভাই যদি মারে? সে মিনমিনে সুরে বলে,
-” মা নাই ঘুম নাই! ভোলেল বাবা নাই ঘুম নাই!”
ভোর তাঁর কপালে চুমু দিয়ে বলে,
-” ভাই আছে ঘুমও আছে!”
ভাবনা দুঃখি দুঃখি ফেস বানিয়ে চায়। ভোর গলে না। সে বিছানায় বোনকে শুয়ে দিয়ে দরজা চাপিয়ে নিজেও বোনের পাশে শোয়। ভাবনা কান্না ভেজা গলায় বলে,
-” আম্মু মন পুলচে! আম্মু যাই?”
ভোর বোনকে টেনে বুকে জড়িয়ে বলে,
-” আম্মু মেরেছে না? তাহলে আম্মু যাবে কেন?”
-” ভোলেল বাবা যাই?”
ভোর রেগে যায় সাথে সাথেই। ভাবনাকে বিছানা থেকে নামিয়ে দিয়ে ধমকের সুরে বলে,
-” যাও? ভাইয়ের কাছে আসবে না আর। যাও?”
ভাবনা ঠোঁট উল্টিয়ে কেঁদে দেয়; যায় না সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকে। ভোর চুপচাপ শুয়ে থাকে। ভাবনার কান্না থামার নাম নেই। ভোর আবার টেনে তুলে জাপটে ধরে গালে চুমু দিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে,
-” আমার মিষ্টি বোন কাঁদে না। কাঁদলে বকবো কিন্তু?”
ভাবনা কান্না থামিয়ে ভাইয়ের গলা জড়িয়ে চোখ বুজে রাখে। ভোর হেসে বোনকে ঘুম পাড়ায়। ছোট ভাবনা অল্প সময়ের মাঝেই ঘুমিয়ে পড়ে। ভোরের চোখও লেগে যায়। তবে দরজা খোলার শব্দে চকিত ভঙ্গিতে চোখ খোলে।
পাতা এগিয়ে এসে বিছানার কিনারায় বসে। ভোর হেসে বলে,
-” কিছু বলবে আম্মু?”
পাতা নড়েচড়ে বসল। অন্যদিকে চেয়ে বলে,
-” আমার মেয়েকে নিতে এসেছি!”
-” তুমি ওকে মেরেছো। দেবো না। তোমার পানিশমেন্ট!”
পাতা ভোরের দিকে চায়।
-” তুমি মারো না ভোর? মায়েরা কিন্তু সব জানে!”
ভোর ভাবলেশহীন জবাব দেয়,
-” আমার বোনকে আমি মারবো। আমিই ভালোবাসবো! আর কেউ মারতে পারবে না। তুমিও না!”
পাতার মাথা ঘুরে ওঠে। এই বাবা ছেলেকে উপর ওয়ালা কি দিয়ে বানিয়েছে!
-” হ্যাঁ ভালো! যে যার মর্জি মাফিক চলো! আমি বলার কে? স্কুলে মারামারি করবে; মার খেয়ে আসবে। বাড়িতেও মারামারি করবে। তোমার বোন দুষ্টুমি করবে। তোমার বাবা, ঘারত্যাড়ামি করবে! আমাকে আল্লাহ পাক ধৈর্য শীল বানিয়েছে! যেদিন ধৈর্য হারিয়ে ফেলবো খুঁজেও পাবে না কেউ!”
বলে পাতা উঠতে নিবে ভোর হাত ধরে আটকে নেয়। ভাবনাকে আলগোছে ছাড়িয়ে নিয়ে পাতার গলা জড়িয়ে সেই পুরনো গলায় ডাকে,
-” ও আম্মু রাগ করছো কেন? তুমি তো আমার মিষ্টি মা। ভোর তোমাকে অন্নেক অন্নেক ভালোবাসে। তুমি হারিয়ে গেলে আমরাও হারিয়ে যাবো। তুমি তো আমাদের সকলের জান! ভোর লাভস ইয়ু সো সো মাচ!”
পাতা ভোরকে ছাড়িয়ে বলে,
-” হয়েছে তোমার রসে ভেজানো কথা? শুধু মিষ্টি মিষ্টি কথা! আমার একটা কথাও শোন না তুমি! আমার চেয়ে তোমার কাছে জেদ রাগ বড়!”
ভোর আবার জড়িয়ে ধরে। পাতার কপালে চুমু দিয়ে আদুরে সুরে বলে,
-” ও আম্মু? ভালোবাসি তো! তুমি সবার আগে!”
-” তোমার বাবারও আগে?”
অপকটে সুধায় পাতা। ভোর পাতার গলা ছেড়ে তাঁর কোলে মাথা রেখে বলে,
-” তুমি রাগ করো না আম্মু। আব্বু’কে আমি সবচেয়ে বেশি ভালোবাসি। আল্লাহ, তাঁর রাসুল তারপরে বাবা! বাবার পর তোমাকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসি।”
পাতা মুচকি হাসে। ভোরের গাল জোড়া টেনে কপালে হাত রাখতেই খেয়াল করে খানিকটা গরম। জ্বর আসছে। জ্বরের ওষুধ তো খাইয়েছে।
-” জ্বরের ওষুধ খাওয়ালাম তবুও গা গরম। এই ভোর খারাপ লাগছে? গায়ে ব্যাথা করছে?জল পট্টি দিই?”
ভোর হেসে বলে,
-“না। ঘুম পাচ্ছে। তুমি মাথায় হাত বুলিয়ে দাও!”
পাতা চুলের ভাঁজে হাত গলিয়ে টেনে দেয় হালকা করে। কপালে ম্যাসাজ করে দেয়। ভোর আরাম বোধ করে। ঘুমিয়ে যায় ক্ষণিকের মাঝে।পাতা তাকে ভালোভাবে শুইয়ে দিয়ে কম্ফোর্ট গলা অবধি টেনে দেয়। ছেলে মেয়ে দুজনেরই কপালে ভালোবাসা এঁকে বেরিয়ে যায় ঘর থেকে। বের হয়ে নিজ রুমে যায় না। স্টাডি রুমে গিয়ে পর্দা সরিয়ে দরজা খুলে সিক্রেট রুমটায় যায়। ফ্লোরে পাতানো বিছানায় বসে হাঁটু জড়িয়ে। নিস্তব্ধ শূন্য ঘরে পাতা একা বসে থাকে। ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক, দূর হতে কুকুর শেয়ালের ভুতুড়ে ডাকে গা ছমছম করলেও অদ্ভুত ভালো লাগে পাতার।
____
ভোর ও ভাবনা একে অপরের গলা জড়িয়ে ঘুমে বিভোর। ছোট ভাবনা হা করে ঘুমিয়ে ভোরও ব্যাতিক্রম নয়। তাদের রুমের দরজা হঠাৎ খুলে গেলো শব্দ বিহীন। কেউ প্রবেশ করে নিস্তব্ধ পায়ে। এগিয়ে এসে বিছানায় পা তুলে বসে। কম্ফোর্ট সরিয়ে অনাবৃত করে। ঘুমন্ত ভোরের টি শার্ট খুলে অনাবৃত বুকে ছোট ছোট চুমু দেয়। জখমে ঠোঁট বুলিয়ে ফু দেয়। বুকে টেনে বিড়বিড় করে মাথায় ফু দিয়ে কপালে চুমু এক বলে,
-” আমার কলিজার সমস্ত ব্যাথা কষ্ট আমার হোক! ইয়া আল্লাহ আমার বাবাটার উপর থেকে সকল বালা মুসিবত থেকে দূরে রেখো।”
ভোর ঘুমের ঘোরে ‘বাবা’ বলে বিড়বিড় করে। যেন সেই ছোট্ট ভোর’টি! যার বাবাকে ছাড়া এক মুহুর্ত চলতো না। অরুণ ছেলের গালে চুমু দিয়ে বেশ সময় বুকে লুকিয়ে রাখে। বালিশে শুইয়ে দিয়ে ঘুমন্ত মেয়ের দিকে চেয়ে মুচকি হাসলো। হা করে ঘুমোনোর দরুণ মুখ দিয়ে লালা পড়ছে। অরুণ লালা মুছে মুখটা বন্ধ করে দেয়। সেটা ক্ষণিকের জন্য। ভাবনার মুখ আবার হা হয়ে যায়। অরুণ মেয়ের কপালে চুমু দিয়ে দু’জনের গায়ে কম্ফোর্ট জড়িয়ে বেরিয়ে আসে। মহারানী কে খোঁজা যাক এখন। অরুণ দু হাতে তালু ঘষতে ঘষতে কিচেনে ড্রয়িং রুমে, রুমে,স্টাডি রুমে প্রায় সব জায়গায় খোঁজে, পায় না। আশ্চর্য! কোথায় গেলো পাতাবাহার? অরুণ কি মনে করে স্টাডি রুমে আবার যায়। পর্দা সরিয়ে দেখে দরজা খোলা। সে ভিতরে ঢুকে দেখে মহারানী এখানেই আছে। হাঁটুতে থুতনি ঠেকিয়ে শূণ্যে চেয়ে আছে।
-” এখানে আপনি! আর আমি পুরো বাড়ি খুঁজে হয়রান। আরেকটুর জন্য হার্ট অ্যাটাক করি নি যে আমার আদুরে বউটাকে কোনো প্রেমিক ভুত তুলে নিয়ে যায় নি তো!”
পাতা অরুণের দিকে একবার চেয়ে পুনরায় আগের ভঙ্গিতে বসে থাকে। অরুণ তীক্ষ্ম দৃষ্টি ফেলে বলে,
-” এই এমন বিহেব করছো কেন? ভুত টুত ভর করে নি তো? করলে বলো এক থাপ্পড় দিবো বাপ বাপ করে পালাবে!”
নাহ্ তাও কথা বলে না পাতা। অরুণ এবার চিন্তায় পড়ে। আবার কি হলো? সে নরম সুরে ডাকে,
-” এই পাতাবাহার?”
পাতা চায় না। অরুণ উদ্বিগ্ন হয়; তবে নিজেকে শান্ত রেখে পাতার সামনে বসে। পাতাকে টেনে কাছে আনে। ঘুরিয়ে পিঠ নিজ বলিষ্ঠ বুকে ঠেকিয়ে আগলে নেয়। পাতা পেছনে হেলে ভার ছেড়ে দেয় ব্যাক্তিগত জায়গায়। হাত দুটো টেনে এনে পেটে রাখে। অরুণ সন্দেহ গলায় বলে,
-“এখন এটা বলো না আরেকজন আসছে! কিছু দিন আগেই পিরিয়ড শেষ হয়েছে!”
এ যাত্রায় অনুভূতিহীন পাতা মুচকি হাসে। অরুণও হেসে পাতার কাঁধে থুতনি রেখে বলে,
-” কি হয়েছে আমার পাগলি বউটার!”
পাতা জবাব দেয় না। অরুণ পাতাকে নিজের দিকে আরেকটু টেনে নেয়। আঁচল গলিয়ে হাত গভীরে নিয়ে বলে,
-” আরে ভাই কি হলো বলবে তো? আদর করলাম তারপরও রাগ কমে নি?”
পাতার রেসপন্স না পেয়ে অরুণ চুপ করে যায়। দু’জনের মাঝে নিরবতা বিরাজ করে বেশ সময়। ঝিঁঝিঁ ডাক ও নিঃশ্বাসের আনাগোনা শোনা যায়। দূর হতে বাদুড়ের ডানা ঝাপটানোর ক্ষিণ আওয়াজ আসে। নীরবতা ভেঙ্গে অরুণ বলে,
-” ভোরের রাগ জেদ সব আমার থেকেই পাওয়া। তবে আমি চাই না ও আমার মতো হোক। আমি চাই ও তোমার মতো হোক। তুমি সব দিকেই পার্ফেক্ট পাতাবাহার। আমি দোষে ঘিরে। আমি কখনো কোনো কিছু নিয়ে আফসোস করি না বাট আমি ভাবি তুমি কেন আমার জীবনে প্রথমে এলে না! জানি এসব ছেলে মানুষী ভাবনা! বাট তবুও কখনো কখনো ভাবি। শোকর আদায় করি ওই মালিকের যে, তোমার সাথে আমার ভাগ্যটা জুড়ে দিয়েছে; হোক দেড়িতে!”
পাতা মুচকি হাসলো। ঘার ঘুরিয়ে অরুণের গালে চুমু দিয়ে সোজা হয়। অরুণ স্বস্তি পেলো যেন!
-” এই পাতাবাহার? মনব্রত রেখেছো নাকি? খুবই বাজে কাজ! চড়ুই চুপ থাকলে ভালো লাগে না।”
পাতা শব্দহীন হাসে। এই অরুণ সরকার আর আগের অরুণ সরকারের মাঝে বিরাট ফারাক। আগের অরুণ সরকার ছিলো রসকষহীন ষাঁড় মুখো লোক। বর্তমানের অরুণ সরকার রসহীন নয়। অনেক কথা বলে ; প্রাণ খুলে হাসেও মাঝে মাঝে। তবে হ্যা ঘাড়ত্যাড়ামি রোগ আছেই। এটা যাবার নয় হয়তোবা বংশগত!
পাতার চুপ থাকা ভালো লাগে না অরুণের। সে মেজাজ হারিয়ে বসে। পাতাকে ছেড়ে উঠে পড়ে। পাতা হেসে তাঁর হাত টেনে আবার বসিয়ে দেয়। জাপটে ধরে বুকটায় মাথা রেখে ফিসফিসিয়ে বলে,
-” ভালোবাসি নাক উঁচু ম্যানারলেস লোক!”
চলবে….