#পাতা_বাহার
#বেলা_শেখ
#পর্ব- ৮
(কপি করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ)
সকাল বেলা একটা স্কুলে যেমন পরিবেশ থাকে আজও তেমনি! বাচ্চারা ব্যাগ কাঁধে নিয়ে স্কুলে আসছে। কেউ কেউ বন্ধু বান্ধবীদের সাথে গলা জড়িয়ে গল্প করতে করতে আসছে! কেউবা চকলেট আইসক্রিম খেতে খেতে আসছে। ছোট বাচ্চাদের ,মা অথবা বাবা এনে রেখে যাচ্ছে আবার কোনো কোনো গার্ডিয়ান বাচ্চাকে ক্লাসে বসিয়ে প্যারেন্টস রুমে অপেক্ষা করে, ছুটি হলে নিয়ে যাবে। কিছু বাচ্চা বাবা মা’র কোলে হাসতে হাসতে যাচ্ছে তো কিছু বাচ্চা গলা ফাটিয়ে কাঁদছে স্কুলে যাবে না! মা বাবা এটা ওটা বলে ভুলানোর চেষ্টায়! পাতা স্কুটি স্কুলের পার্কিং জোনে রেখে ব্যাগ কাঁধে ঝুলিয়ে টিচার্স রুমের দিকে যাচ্ছে। ছোট মেয়ে দুটোকে আগেই নামিয়ে দিয়েছে। একটু এগোতেই ভোর মিস বলতে বলতে দৌড়ে আসে তার সামনে। হাঁপাতে হাঁপাতে বলে,
-” মিস আপনাকে কত ডাকলাম আপনি শুনলেন না কেন? আব্বুও ডেকেছিল আপনাকে! আপনি তাকলেনই না। আমি সেই কখন থেকে অপেক্ষা করছিলাম আপনার সাথে বাইকে আসবো বলে! আর আপনি ওই আপু দুটোকে নিয়ে আসলেন! আমি ডেকেছি আপনি শোনেননি কেন?”
একসাথে অনেকগুলো কথা বলে ভোর আরো হাঁপিয়ে যায়। শেষের কথা গুলো বলতে বাচ্চাটার গলা কাঁপছিল। পাতা বুঝতে পারে! একটু মায়াও হয়! পাতা সামনে তাকতেই দেখে ভোরের বাবা আসছে! সেদিনের মতোই গম্ভীর মুখশ্রী। কালো প্যান্ট সাদা ইন করা শার্টের উপর কালো কটি! ব্লেজারটা হাতে। চুল জেল দ্বারা সেটা করা। কানের পিঠের সাদা চুল গুলো উকি দিচ্ছে! গালে চাপ দাড়ি! চোখে কালো ফ্রেমের চশমা যেটা নতুন দেখলো পাতা। মনে মনে ভেংচি কেটে ভোরের প্রশ্নের জবাবে বলল,
-” শুনেছি তোমার ডাক সাথে তোমার আব্বুরও!”
ভোর মুখ মলিন হয়ে আসে। মিস তাহলে ইচ্ছে করেই তাকে আনে নি!
-” তাহলে দাঁড়ালেন না কেন?”
-” কাল বিকেলে তুমি দৌড়ে চলে গেলে! আমি ডেকেছিলাম কতবার দাঁড়িয়েছিলে?”
ভোর মাথা নাড়ে দাঁড়ায় নি!
-” আমি স্যরি মিস! আব্বু মানা করেছিল তাই!”
পাতা যা ভেবেছিল তাই! সব ওই নাটের গুরু ম্যানারলেস লোকের কার্যকলাপ।
ভোর পাতার হাত ধরে বলে,
-” আই এম স্যরি মিস! আর হবে না! সব দোষ আব্বুর! আপনি প্লিজ কালকে আমাকে নিয়ে আসবেন বাইকে? আমি ওয়েট করবো কিন্তু?!”
পাতা সামনে চায়! মি. অরুণ সরকার অল্প দূরত্বেই দাঁড়িয়ে তাদের দিকে চেয়ে! আজও কিছু বলছে না! খানিক মোটা গোছের আভারি নামক লোকটা তার পিছনে দাঁড়িয়ে, যেন বডিগার্ড! পাতা সেদিকে তাকিয়ে ভোরের মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,
-” তোমাকে বাইকে নিয়ে এলে দেখা যাবে তোমার আব্বু স্কুটির ডিজেলের দাম দিয়ে দেবে কৌশলে!! আর সেটা আমার চাই না! ভোর যাও ক্লাসে !”
বলেই চলে যায় টিচার্স রুমের দিকে । অরুণ ভ্রু কুঁচকে সেদিকে তাকায় একপল। এই হাঁটুর সমান মেয়ে তাকে খোঁচা মেরে কথা বললো!! এক ধমক দিলে জান হাতে নিয়ে পালাবে অথচ ভাবখানা দেখ যেন ঝাসি কি রানি!! ভোর অরুণের সামনে দাঁড়িয়ে রাগি চেহারায়। নাকে সর্দি আসায় নাক ডলে শাসানোর ভঙ্গিতে অরুণকে বলল,
-” আব্বু সব তোমার জন্য! কাল কেন করতে বললে এমন? মিস রেগে গেল তো!”
অরুণ পকেট থেকে রুমাল বের করে ছেলের নাক মুছে বলে,
-” কি বলল মিস পাতাবাহার?”
-” কাল আমি মিসের ডাকে দাঁড়াই নি তাই আজ মিস আমার ডাকে দাঁড়ায় নি!! সব তোমার জন্য হয়েছে! আমি তো স্যরি বলেছি! তুমিও স্যরি বলে নেবে? ঠিকাছে?”
আঙ্গুল তুলে ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে বলে ভোর! অরুণ ঝুঁকে তার আঙ্গুলে আলতো কামড় দিয়ে ভোরকে কোলে তুলে নিয়ে বলে,
-” কখনো না! বরং মিস পাতাবাহারকে বলবে সে যেন স্যরি বলে! আমি তার অনেক বড়! বড়দের কথা শুনতে হয়।আমি ডেকেছিলাম তবুও সে দাঁড়ায় নি! আমার আব্বুটাকেও কাঁদিয়েছে! সো তার স্যরি বলা উচিত! এখন চলো প্রিন্সিপাল ম্যামের কাছে! এক্সামের সব ডিটেইলস জেনে নিই! ফি ও তো পরিশোধ করতে হবে! এডমিট কার্ড নিতে হবে! আমার কলিজার টুকরোর প্রথম এক্সাম বলে কথা!!”
ভোর মুখ গোমড়া করে বাবার কোলে পড়ে থাকে। মিসের রাগ কিভাবে ভাঙবে সে? অরুণ ছেলেকে নিয়ে প্রিন্সিপাল ম্যামের কাছ থেকে এক্সামের সব খবরাখবর নিয়ে ছেলেকে আদর করে ক্লাস রুমে ব্রেঞ্চে বসিয়ে কপালে চুমু দিয়ে বলল,
-” আব্বু ভালোভাবে ক্লাস করবে! মনোযোগ দিবে ক্লাসে। দুষ্টুমি করবে না! টিচার্সদের কথার অবাধ্য হবে না! ছুটি হলে আভারি ভাইয়ের সাথে গাড়িতে বসে বাড়ি যাবে! অফিসে নয়! এমনিতেই কাল দুটো টিউশনিই মিস দিয়েছো! আর না! আসি আব্বু!”
বলে পাশে বসা রোহানের মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
-” আঙ্কেল আমার আব্বুটার খেয়াল রেখো কেমন? আর দুজনে মিলেমিশে থেকো ঝগড়া করবে না!”
বলে রুম থেকে বেরিয়ে এলো। দরজার কাছে এসে পিছনে ঘুরে ভোরের দিকে চায়! ভোর মিষ্টি হেসে হাত নাড়িয়ে ‘টাটা আব্বু’ বলতেই অরুণ পুনরায় রুমে ঢুকে ছেলের গালে মুখে আদর করে বলল,
-” কলিজা আব্বু! সাবধানে থাকবে! দৌড়ঝাঁপ করবে না। ”
________
ক্লাসের হৈচৈ শুরু হয়েছে। ক্লাস শেষের দিকেই! স্যার চলে যাবেন একটু পরেই এখন সবাইকে এক্সামের পড়াগুলো দাগিয়ে দিচ্ছে। ছোট ছোট বাচ্চারা হইচই করে সেটা বুঝে নিয়ে বইয়ে টুকে নিচ্ছে পেন্সিল দিয়ে। কিছু বাচ্চা কিছুই বুঝতে না পেরে পেন্সিল কামড়ে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। রোহান বুদ্ধিমান একটা ছেলে, খুবই শার্প ! একবার বলাতেই বুঝতে পারে পড়া! ক্লাসের সবার থেকে এগিয়ে আছে! নিয়মিত পড়া দেয় হোমওয়ার্ক করে। সব টিচার্সদের পছন্দের। সে স্যারের কথা শুনে সব পড়া টুকে নেয়! স্যার চলে যাওয়ার সময় সবাই ‘বায় বায় টিচার’ বলে দাঁড়িয়ে পুনরায় সিটে বসে এর ওর থেকে ভালো করে টুকে নেয় পড়া গুলো। রোহানও বসে ভোরের বই নিজের দিকে নিয়ে সব দাগিয়ে দিল। ভোর চুপচাপ বসে আছে। রোহান খেয়াল করেছে আজ আসার পর থেকেই ভোর চুপচাপ অথচ অন্যদিন ভোরের মুখ বন্ধই হয় না। বাড়িতে কি কি হলো! দাদি, চাচ্চু, চাচিমনি আনি, ছোট রূপম,টুম্পা মিস , হুজুর কি কি বলে সব বলবে! দুষ্টুমি করবে। ক্লাস চলাকালীন সময়েও একদন্ড চুপ থাকবে না! ফিসফিস করে কথা বলবে!
-” এই ভোর কি হয়েছে তোর? সকাল থেকেই চুপ করে আছিস? আঙ্কেল বকেছে?”
ভোর রোহানের দিকে তাকালাম মাথা নাড়ে।
-” না! মিস পাতা আমার উপর রেগে আছে!!”
রোহান প্রশ্ন করে,
-” কেন?”
ভোর ঠোঁট উল্টিয়ে সব বলে রোহানকে। রোহান বুঝতে পারে না। টিস্যু দেয়াতে মিস রেগে গেল কেন? ভোরের আব্বুই বা ভোরকে টিস্যু দেয়ার পর চলে আসতে বলেছিল কেন?
-” হয়েছে আর মন খারাপ করে থাকিস না। একটু পর পাতা মিস ক্লাস নিতে আসবেন। তখন আবার স্যরি বলিস!”
ভোর মাথা নাড়িয়ে নাক টানে। কাল আইসক্রিম বেশি খাওয়ার জন্য ঠান্ডা লেগে গেছে আবারও। অবশ্য তার বারো মাসই ঠান্ডা! সর্বদা নাক পিট পিট করে! ভোর হাতের উল্টো পিঠে নাক মোছে! এতে হাতে সর্দি লাগে। রোহান সেটা দেখে নাক সিঁটকিয়ে বলে,
-” ভোর তুই কি নোংরা! ছিঃ ইয়াক! আমি তোর কাছে বসবোই না! আমার বমি পাচ্ছে!”
বলেই ব্যাগ বই নিয়ে উঠে পাশের সিটে বসে। ভোর দরজার পাশের সামনের সিটে একা বসে আছে। লজ্জা পায় বেশ! আশ্চর্য ওদের নাকে কি সর্দি হয় না নাকি? হয় তো! তাহলে বমি পাওয়ার কি আছে!! কই তার বাবার তো বমি পায় না! সে কত ভালো ভাবে পরিষ্কার করে দেয়!!ভোর মাথা নিচু করে ব্যাগে টিস্যু , রুমাল খোঁজে, বাবা রেখেছিল তো!! কিন্তু খুঁজে পায় না! একটু পরেই তো পাতা মিস আসবে! তাকে এভাবে দেখে যদি নোংরা বলে? চোখ ভরে ওঠে তার। পাশের সিটে রোহানের দিকে চায়! রোহান ঘার ফিরে ভোরের দিকে একবার চেয়ে বই ব্যাগ নিয়ে আবার তার পাশে বসে। ভোরের ব্যাগ থেকে রুমাল বের করে হাতে দেয়।
-” সবসময় সর্দি! তোর আব্বুকে বলতে পারিস না ভালো ডাক্তার দেখাতে?”
ভোর খুশি হয়ে রুমাল দিয়ে হাত নাক মুছে ব্যাগে রেখে বলে,
-” দেখিয়েছে তো! আবার হয়! আব্বুকে গিয়ে বলব নাকটাই কেটে দিতে। না থাকবে নাক না থাকবে সর্দি।”
রোহান খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে সাথে ভোরও। আশেপাশের কয়েকজন তাদের দিকে তাকিয়ে আবার যার যার মতো কথা বলায় ব্যস্ত হয়! কেউ কেউ টিফিন বক্স বের করে পাস্তা, নুডুলস, ওটস ইত্যাদি খাচ্ছে তো কেউ চকলেট খাচ্ছে। অনেকে হাই ব্রেঞ্চের উপর বসে খেলছে। ভোর রোহানকে বলে,
-” তোর না বমি পাচ্ছে! ওই সিটে বসলি! এখন এখানে আসলি কেন?”
-” বাহ রে! তুই না আমার বন্ধু? তো আলাদা কেন বসবো? তাই এসেছি।”
ভোর হেসে ব্যাগ থেকে বড় দুই টা চকলেট বের করে একটা রোহানকে দেয়। রোহান নেয় না।
-” আম্মু বলেছে কারো কোনো জিনিস না খেতে!”
ভোর তার হাতে দিয়ে বলে,
-” সে তো আমার আব্বুও বলে।তুই দিলে আমি খাইনা? তাহলে? না নিলে তোর সাথে কথা বলবো না কিন্তু?”
রোহান ইতস্তত করে চকলেট ছিঁড়ে কামড় বসায়। ভোর হেসে নিজের চকলেটে কামড় দেয়! দুই বন্ধু হাসিমজায় মেতে ওঠে। বাচ্চাদের বন্ধুত্ব তো এমনই। এই মারামারি ঝগড়া তো, এই গলায় গলায় ভাব!
একটু পরেই পাতা ক্লাসে প্রবেশ করে। সবাই দাঁড়িয়ে সালাম জানায়। পাতা হেসে জবাব দেয় সালামের। সবাইকে জিজ্ঞেস করে,
-” হাউ আর ইউ স্টুডেন্টস?”
সব বাচ্চারা সমস্বরে বলে ওঠে,
-” উই আর ফাইন মিস। হাউ এবাউট ইউ?”
-” আলহামদুলিল্লাহ! আই এম ওলসো ফাইন। লেটস স্টার্ট আওয়ার ক্লাস স্টুডেন্টস!”
হেসে ক্লাস শুরু করে দিল পাতা। ভোর সিটে বসে মিসের কথা শুনছে মনোযোগ দিয়ে! ক্লাসের মাঝখানে রোহান মিসের অগোচরে ভোরকে ফিসফিস করে বলে,
-” মিস কে স্যরি বলবি না?”
ভোরও রোহানের মতো ফিসফিসিয়ে বলে,
-” কিভাবে বলব? মিস যদি আরো রেগে যায়?”
পাতার নজরে পড়ে ভোরের ফিসফিস করে কথা বলা। গম্ভীর মুখে ডেকে ওঠে,
-” ভোর সরকার স্ট্যাড আপ! হোয়ায় আর ইউ ডিসটার্বিং ইন দা ক্লাস?
ভোর জিভে কামড় বসায়! ইশ ধরা পড়ে গেল! সে দাঁড়িয়ে কাঁচুমাচু করে বলে,
-” স্যরি মিস!”
পাতা ভোরের সামনে দাঁড়িয়ে বলে,
-” ওকে। টেল মি দা রাইমস ‘দা মুন’ ?
ভোর জানে ছড়াটা। গত রাতেও পড়েছে বাবার কাছে। তাই হাসি মুখে বলতে নেয়,
-” দা মুন
আই সি দা মুন
মু সি ব্লেস…”
আর বলতে পারে না। তার মনে পড়ছে না। সব তালগোল পাকিয়ে গেছে। অসহায় চোখে পাতার দিকে চায়। পাতা বুকে হাত গুজে গম্ভীর মুখে দাঁড়িয়ে।
-” নেক্সট?”
ভোর মিনমিনে গলায় বলে,
-” মনে পড়ছে না মিস!”
-” কেন? পারো না তুমি?”
-” পারি। তবে..”
-” পারো কিন্তু বলতে পারছো না! এটা কেমন কথা?”
ক্লাসের বাকি বাচ্চারা হেসে ওঠে। ভোর লজ্জা পায় বেশ! ছলছল চোখে মিসের দিকে চায়! পাতা সবাইকে চুপ করায়,
-” সাইলেন্টস! রোহান? দাঁড়াও, তুমি বলো তো?”
রোহান দাঁড়িয়ে সুন্দর ভাবে আবৃত্তি করে,
-” দা মুন
আই সি দা মুন
এন্ড দা মুন সিই’স মি
গড ব্লেস দা মুন
এন্ড গড ব্লেস মি ।
ভোর মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে শুনে। পাতা রোহানকে বসিয়ে ভোরকে বলে,
-” বাকি ক্লাস দাঁড়িয়ে থাকবে!”
ভোরের নাকের পাটা ফুলে ওঠে। পুরো ক্লাস মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে।
_______
স্কুল ছুটি হলে ভোর ব্যাগ কাঁধে নিয়ে বেরিয়ে আসে। রোহান তার সাথেই। তাকে সান্ত্বনা দিচ্ছে। মন খারাপ না করতে বলছে। ভোর কিছু বলছে না চুপচাপ হাঁটতে থাকে। টিচার্স রুমের পাশ দিয়ে তারা দুজন যেতে নিলে পাতার মুখোমুখি হয়। অন্যসময় হলে ভোর সালাম দিয়ে কত কথা বলতো মিসকে! কিন্তু এখন ভোর পাতার দিকে তাকায় না! মাথা নিচু করে সাইট কেটে চলে যায়! রোহান সালাম দেয় পাতাকে। পাতা উত্তর নিয়ে ভোরের দিকে চায়! মুখটা মলিন। ক্লাসে যে কোনো স্টুডেন্ট ডিস্টার্ব করলে পাতা দাড় করিয়ে রাখে। ক্লাসে ডিস্টার্বনেস তার পছন্দ নয়। তাই ভোরকেও দাড় করিয়ে ছিল। বাচ্চাটা তার থেকে মুখ ফুলিয়ে নিয়েছে। যেন পাতা তার টিচার নয় বন্ধু! পাতা হেসে ডাক দেয় ভোরকে।
-” ভোর? শুনে যাও তো! এই অরুণাভ ভোর সরকার? এদিকে এসো?”
ভোর একবার ঘার ফিরে তাকিয়ে হাঁটা দিল। রোহান তার পিছু পিছু। আভারি এসে ভোরের কাঁধ থেকে ব্যাগ নিয়ে তাকে কোলে তুলে রোহানের থেকে বিদায় নিয়ে গাড়িতে উঠে বসে। পাতা সেদিকে তাকিয়ে থাকে। ইশ বাচ্চাটা অনেক কষ্ট পেয়েছে বোধহয়! কাল এলে অনেক আদর করে দেবে!
ঝিরঝির বৃষ্টি পড়ছে! গ্রীষ্মের খরতাপে অতিষ্ট জনজীবন বোধকরি একটু স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়ল! ধুলা ধোয়া হীন পরিবেশ। বৃষ্টির পানিতে ধুলা ধোয়ার ছিটে ফোঁটা নেই। পানিতে ভিজিয়ে দিচ্ছে রাস্ত ঘাট দোকানপাট বাড়ি গাড়ি সব! কেউ কেউ ছাতা মাথায় হাঁটছে তো কেউ মাথায় পলি গুজে বাসে চড়ছে। বেশিরভাগ লোক দোকান পাঠ বা স্টপেজে দাঁড়িয়ে আছে বৃষ্টির কবল থেকে বাঁচতে। ফুটপাতের বাচ্চাদের ওসবে ধ্যান নেই! তারা তো রাস্তার পাশে বৃষ্টি বিলাসে ব্যস্ত! মনের আনন্দে লাফিয়ে লাফিয়ে নাচছে। ভাঙ্গা রাস্তায় জমে থাকা পানিতে লাফ দিয়ে হেসে কুটিকুটি। ভোর তাদের দিকে তাকিয়ে আছে গাড়ির গ্লাসে মাথা ঠেকিয়ে। একধ্যানে পলকহীন চোখে তাকিয়ে থাকা যাকে বলে। তবে অধরকোনে মিষ্টি হাসির ফুলঝুড়ি টা নেই। শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে। হঠাৎ করে একটা মহিলা এসে ফুটপাতের বৃষ্টি বিলাসরত বাচ্চাদের বকছে বৃষ্টিতে ভেজার জন্য। হাতে তার কাপড়ের ঝুলন্ত টুপলি। ওতে কি আছে? মহিলাটি একটা ছোট বাচ্চার পিঠে এক ঘা লাগিয়ে দিল। বাচ্চাটা কাদলো না বরং হেসে পুনরায় লাফাতে শুরু করে। মহিলাটি বিরক্ত হয়ে তাকে কোলে নিয়ে চলে যায় আর বাকি বাচ্চাদেরও শাসিয়ে যায়। ভোর ভাবতে থাকে মহিলাটি কে? ওই বাচ্চার মা?
আভারি ভোরের পাশে বসে। ভোর আজ চুপচাপ কিছু বলছে না। বাচ্চাটাল মন খারাপ! কিন্তু কেন? জিজ্ঞেস করলে কিছুই বলছে না। তাই আভারি আর কিছু বলে না। শুধু আড়চোখে নজর রাখছে। জানালায় মাথা ঠেকিয়ে আছে! হঠাৎ ব্রেক কষলে যদি ব্যাথা পায় তাই সে ডাকে ভোরকে। ভোর সারা দেয় না। আভারি কাঁধ ঘুরিয়ে এদিকে আনতেই ভোর ঢুলু ঢুলু চোখে চায়!
-” ঘুম পাচ্ছে?”
ভোর উপর নিচ মাথা রেখে আভারির কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়ে। আভারি খানিক হেসে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। অল্প সময় পরেই তারা বাড়ি পৌঁছে যায়। আভারি ব্যাগ কাঁধে নিয়ে ভোরকে কোলে করে বাড়িতে ঢোকার সাথে সাথে আসমা দ্রুত পায়ে এগিয়ে এসে উদ্বিগ্ন ভরা কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে,
-” আভারি কি হয়েছে ভোরের? ভোর?”
আভারি তাকে আস্বস্ত করে বলে,
-” কিছু হয় নাই ম্যাডাম! ঘুমাই পড়ছে!”
আসমা বেগম কিছুটা শান্ত হয়ে বলে,
-” ভয়ই পেয়ে গেছিলাম! দাও আমার কোলে দাও! শুইয়ে দিই। ঘুমিয়ে নিক!”
আভারি বিনা বাক্যব্যয়ে দিয়ে দেয়। আসমা বেগম তাকে কোলে নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে অরুণের রুমের দিকে যায়। আভারি নিজের ঘরে যায়। মিনুকে শুয়ে থাকতে দেখা কপালে হাত রেখে চিন্তিত স্বরে বলে,
-” কি হইছে? শুইয়ে আছো যে? জ্বর তো নাই তাইলে?”
মিনু আভারির দিকে তাকিয়ে বলে,
-“ওই একটু মাথার বিষ! ভোর আব্বা আইছে?”
-” হুম। ঘুমাইয়ে পড়ছে গাড়িতেই। মন খারাপ কেনো জানি! কিছু কইতেছেও না!দাড়াও স্যার রে ফোন করে জানাই।”
বলেই আভারি ফোন লাগালো অরুণকে। অরুণ কেটে দিল। একটু পরেই ব্যাক করে আভারি ফোন রিসিভ করতেই অরুণ বলে,
-” হ্যা আভারি ভাই বলো? তোমরা পৌঁছে গেছ বাড়িতে? ভোর কি করছে? বৃষ্টি হচ্ছে হালকা হালকা , ভেজে নি তো ?”
আভারি হাসে অরুণ সরকারের উদ্বিগ্নতা ভরা প্রশ্নের বানে। ছেলে যে তার প্রাণ ভোমড়া!
-” আমরা পৌঁছে গেছি স্যার। ভোর বাবা ঘুমিয়ে পড়েছে গাড়িতেই। আর বৃষ্টিতে ভিজে নি! না আবদার করেছে ভেজার!”
-” ভালো হয়েছে। এমনিতেই বারোমাস ঠান্ডা লেগেই থাকে। তবে আবদার করে নি শুনে অবাক হলাম!”
-” স্যার ভোর বাবার মনটা খারাপ! স্কুল ছুটির পর থেকেই গোমড়া মুখে! চুপচাপ ছিল! কারো সাথে মারামারি বা ঝগড়া কিছুই হয়নি। জিজ্ঞেস করলেও বলে নি!”
অরুণের কপালে ভাঁজ পড়ে। সর্বদা হাসিখুশি ছেলেটার আবার কি হলো? মিস পাতাবাহারের ব্যাপার টা নিয়ে কি মন খারাপ?
-” আচ্ছা আমি আসলে শুনব। ভোর উঠলে কিছু খাইয়ে দিও। আর ওর এক্সাম আছে শনিবার থেকে টিচার আসলে তাকে জানিও। রাখছি। ছেলেটার খেয়াল রেখ।”
বলেই কল কাট করে।
________
দুপুরে টানা বর্ষণে পরিবেশ শীতল। বর্ষনের পরপর সূরা উকি দিলে পরিবেশটা এক অনন্য অসাধারণ সৌন্দর্যে পরিণত হয়। বৃষ্টির পানিতে ভিজে থাকা ঘাস, গাছ গাছালির লতা পাতার উপর পড়ে থাকা বৃষ্টির ফোঁটার পরে সূর্যের আলো পড়লে ঝিলিক দিয়ে ওঠে।
হালকা মৃদুময় ঠান্ডায় বৃষ্টির উষ্ণতা বেশ উপভোগ্য! আর ভারি বর্ষণের পর মুক্ত আকাশে অল্প মেঘের ঘনঘটা আর সূর্যের অতি বেগুনি রশ্মি ছড়িয়ে এক অপরূপ সৌন্দর্য ফুটিয়ে তুলতে সক্ষম!
আসমা বেগম ও আরিয়ান ড্রয়িং রুমে বসে আলোচনায় ব্যস্ত সাথে রুবি, আদুরি। তাদের আলোচনায় বিষয়বস্তু অরুণের বিয়ে। তারা একটা ঘটক ঠিক করেছে। সেই ঘটক কিছু মেয়ের ছবি পাঠিয়েছে। মেয়েগুলো বেশ সুন্দর। কেউ ডিভোর্সি! কারো স্বামী মারা গেছে! আবার অবিবাহিতও আছে কয়েকজন। আসমা বেগম একজন ভালো ডিভোর্সি মেয়ে খুঁজছেন। তার ধারনা অবিবাহিত মেয়েরা অরুণের টাকার জন্য বিয়ে করলেও ভোরকে নিশ্চয়ই মেনে নেবে না! আর তাছাড়াও কোনো অবিবাহিত মেয়েই সাঁইত্রিশ বছর বয়সী এক বাচ্চার বাপকে ভালোবেসে বাচ্চাসহ মেনে বিয়ে করবে এটা নাইন্টি নাইন পয়েন্ট নাইন পার্সেন্ট মিথ্যে। রুবি শাশুড়ির পক্ষে কথা বলছে। আরিয়ান আদুরি একটু গাইমুসি করছে! দেখতে মাশাআল্লাহ ভাই তার! বিয়ে করবো বললে এখনো কত অবিবাহিত মেয়েরা হুমরি খেয়ে পড়বে। সাঁইত্রিশ বয়স হলে মোটেও বুড়িয়ে যায় নি। এখনো তাগড়া যুবক যেন ! তবে হ্যা চুল পেকেছে বেশ কয়েকগাছি।চাপ দাঁড়িতেও সেম অবস্থা। দেখতে সাতাশ আটাশ না লাগলেও বুড়ো বলা যাবে না। মাশাআল্লাহ সুদর্শন সুপুরুষ চেহারা তার!
-” দেখ আরিয়ান মেয়ে অবিবাহিত, ডিভোর্সি বা বিধবা সেটা বিষয় না। আসল কথা হলো ভোর! যে ভোরকে মায়ের মতো ভালোবাসা দিতে পারবে আগলে রাখতে পারবে নিজের সন্তান সন্ততি আসলেও দূরে ঠেলবে না !ভালোবাসা ফুরোবে না! সেরকম একজনকে দরকার আমাদের! তাই সব কিছু দেখে শুনে ভেবেচিন্তে খোঁজ খবর নিয়ে তবেই এগোতে হবে!! তাড়াহুড়ো করার কোনো প্রয়োজন নেই।”
রুবির কথায় আরিয়ান আদুরি সায় জানালো। আদুরি বলে,
-” ঠিক বলেছ ছোট ভাবি! তবে ভোরের সাথে ভাইকেও যেন একটু যত্নে আগলে নেয়! সেরকম!”
আসমা বেগম কিছু বলে না। চুপচাপ তাদের মতামত শুনতে থাকে । তার চোখে মুখে অনুতাপের ছাপ স্পষ্ট!
তাদের আলোচনার মাঝেই এক বাইশ তেইশ বছরের মেয়ে আসে তাদের সালাম দিয়ে বলে,
-” ভালো আছেন সবাই? ভোর কোথায়?”
আসমা বেগম খানিক হেসে বলল,
-‘ ভালো আছি আমরা। তুমি কেমন আছো টুম্পা? তোমার ছাত্র তো স্কুল থেকে এসেই ঘুমিয়ে পড়েছে। এখনো ওঠে নি। মিনু? এই মিনু?”
মিনুকে ডাকতে থাকে। মিনু না এসে আভারি এসে উপস্থিত হয় সেখানে।
-” মিনুর মাথাটা ধরেছে! আমায় বলেন ম্যাডাম?”
আসমা বেগম বলল,
-” ভোরকে তুলে দাও ওর টিচার এসেছে! ছেলেটা এখনো খায়নি। আর টুম্পা তুমিও যাও। বসো গিয়ে।”
আভারি সায় জানিয়ে চলে গেল উপরে।তার পিছু পিছু টুম্পা! তারা রুমে গিয়ে দেখে ঢোর শুয়ে আছে হাত পা ছড়িয়ে। পড়নে স্কুল ড্রেস। টাই ,আইডি কার্ড ড্রেসিং টেবিলের উপর। শু জোরা নিচে পড়ে আছে। মুজো এখনো পায়েই। আভারি গিয়ে ডাকে তাকে। ভোর গড়াগড়ি খেয়ে বিড়বিড় করে আবার শুয়ে পড়ে। টুম্পা হেসে এগিয়ে তার মাথায় হাত বুলিয়ে ডাকতে থাকে। ভোর খানিকটা বিরক্ত হয়ে চোখ খুলে। সামনে মিস টুম্পাকে দেখে ভ্রূযুগল কুঁচকে জিজ্ঞেস করে,
-” মিস আপনি এতো ভোরে কেন এসেছেন? আমি এখন পড়বো না। বিকেলে পড়বো। এখন ঘুমাবো! আব্বু?”
বলেই বিছানা হাতরে বাবাকে খুঁজতে থাকে। না পেয়ে ঝট করে উঠে বসে আব্বু বলে। আভারি এসে কোলে তুলে নেয়। রুম্পা মুচকি হেসে বলে,
-” ভোর? এখন সকাল নয় বিকেল। ঠিক সময়েই এসেছি আমি। তুমি তো স্কুল থেকে ফিরে ড্রেস চেঞ্জ না করেই ঘুমিয়ে পড়েছো! এতক্ষণ ঘুমিয়ে ছিলে ভাবা যায়! যাও ফ্রেশ হয়ে এসো আমি স্টাডি রুমে বসছি। তোমার জন্য সারপ্রাইজ আছে!”
ভোরের ঘুম ছুটে গেছে ততক্ষনে। সারপ্রাইজের কথা শুনে চোখ মুখ উজ্জ্বল হয়। আভারির কোল থেকে নেমে রুম্পার কাছে গিয়ে মিষ্টি হেসে বলে,
-” কি সারপ্রাইজ মিস? এখনি দিন!”
টুম্পা হেসে তার গালে চুমু দিয়ে বলল,
-” আগে ফ্রেশ হয় আসো। তারপর বুঝলে ?”
ভোর মাথা নেড়ে বড় আলমারি খুলে ভিতর থেকে টি শার্ট ও হাফ প্যান্ট নিয়ে দৌড় লাগায় ওয়াশ রুমে। সারপ্রাইজ পেতে যে ভোরের খুবই ভালো লাগে। আভারি বেরিয়ে যায়। ছেলেটা সেই সকালে খেয়েছে তারপর থেকেই না খাওয়া। কিছু খাবার আনা যাক।
ওয়াশ রুম থেকে বেরিয়ে ভোর কোনো মতে তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছে স্টাডি রুমে যায়। তাদের ঘরের সাথেই লাগোয়া রুম। সেই রুমকে ছোট খাট লাইব্রেরী বলা যায়। রুমের দেয়াল ও তাক জুড়ে বিভিন্ন ধরনের বই। উপন্যাস, কাব্যগ্রন্থ, ছোটগল্প, পাঠ্যবই, একাডেমিক বই সমূহ, গবেষণা মুলক, সনেট ,নবেল ইত্যাদি ইত্যাদি। রুমে একটা চেয়ার টেবিল সহ ছোট্ট খাটে বিছানা পাতা আছে আর বই ছাড়াও ভোরের খেলনায় ভর্তি রুম। ভোর রুমে ঢুকে তড়িঘড়ি মিসকে সালাম দিয়ে ব্যাগ টেবিলে রেখে চেয়ারে বসে বলে,
-” আমার সারপ্রাইজ?”
টুম্পা হাসে ছেলেটা এতো আদুরে না? মনে হয় টুপ করে খেয়ে নিতে পুরাই রসগোল্লা! আর ছেলের বাবা তো মাশাআল্লাহ চমচম! সে প্রথম দেখায়ই তার এটিটিউড পারসোনালিটি আর মার্জিত স্টাইল দেখে বিরাট ক্রাশ খেয়েছে। যদিও সে জানে তার ক্রাশ খাওয়া পুরাই লস প্রজেক্ট! তবুও!!
ভোর মিসকে চুপ থাকতে দেখে তার হাত ঝাঁকিয়ে ডাকে, টুম্পার স্বয়ংবিত ফেরে। ভোরের গাল টিপে কাঁধের ব্যাগ থেকে একটা বাটি বের করে ঢাকনা খুলে। ভোরের দিকে বাড়িয়ে বলে,
-” তোমার জন্য আলুর পরোটা! তুমি খেতে চেয়েছিলে না? আমি বানিয়েছি স্পেশালি তোমার জন্য! নাও?”
ভোর বাটি হাতে নিয়ে নাক কাছে নিয়ে শ্বাস নেয়! আহ! সেই ঘ্রাণ বেরিয়েছে। তার ক্ষিধে যেন তরতর করে বৃদ্ধি পায়। মিসকে কোনো মতে ধন্যবাদ জানিয়ে অল্প ছিড়ে নিয়ে গপাগপ মুখে পুরে নেয়। মুখে নিয়ে অনেক মজা পায়! আলুর পরোটা পিস পিস করে কেটে রাখা হয়েছে বাটিতে। পাশে গরুর কলিজা ভুনা। ভোর অনভিজ্ঞ হাতে পরোটা দিয়ে সেটা গপাগপ মুখে নেয় পুনরায়। মুখে গালে লেগে একাকার। তবে সেটা ভাবার সময় নেই যে! অনেক ক্ষিধে পেয়েছে তার। টুম্পা হেসে টেবিলের পাশে টিস্যু বক্স থেকে টিস্যু তুলে নিয়ে ভোরের মুখ মুছে দেয়।ভোর মিষ্টি হেসে ছোট হাতে পরোটা মিসের মুখেও দেয়। টুম্পা বিনাবাক্য ব্যয়ে মুখে নেয়। ভোর হাসে । তার মন খারাবি দূর হয়ে গেছে খানিকটা যত্ন ও ভালোবাসার ছোঁয়ায়।
-” স্কুল থেকে এসে ড্রেস খুলে ফ্রেশ হয়ে খেয়ে দেয়ে ঘুমোতে যাবে। তার আগে না। বুঝলে?”
ভোর মাথা নাড়ে। মুখে পরোটা আছে বলে কথা বলতে পারছে না। এরই মধ্যে আভারি আসে ট্রে তে নুডুলস নিয়ে। দুই বাটি সাথে দুটো পানির গ্লাস। ভোরের টিচার ও ভোরের জন্য। ভোর তাকে দেখে বলে,
-” মিস কে দাও! আমি সারপ্রাইজ খাচ্ছি! আলুর পরোটা! অনেক টেষ্টি ! মিনু খালাকে বলব বানিয়ে দিতে! তবে তুমি কিন্তু বাবাকে বলবে না পরোটা খাওয়ার কথা? বললে তোমার সাথে আড়ি!”
আভারি চোখ পাকায় খানিকটা! মিসের সামনেই বলছে !!
টুম্পা চোখ ছোট ছোট করে বলে,
-” আমার আনা খাবার খেলে তোমার আব্বু বকবে? আর আপনি বলে দেন সব স্যারকে?”
আভারি হেহে করে হেসে বলে,
-” ছোট বাচ্চা কি থেকে কি বলে!! কিছু মনে করবেন না! আর ভোর বাবার পরীক্ষা শনিবার থাইকে! এই শনিবারেই। আমি গেলাম।এই নুডুলস দুইজনে শেষ করেন!”
বলে চলে যায়। টুম্পা গাল ফুলিয়ে বলে,
-” আমি কিছু দিলে তোমার বাবা বকে?”
ভোরও বুঝতে পারে ভুল জায়গায় ভুল কথা বলে ফেলেছে। সে মিষ্টি হেসে বলে,
-” না না মিস! কিছু বলে না। তখন মজা করে বলেছি।”
চলবে…..
#পাতা_বাহার
লেখনীতে: #বেলা_শেখ
#পর্ব- ৯
( প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য )
(কপি করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ)
দুপুরের ঝিরিঝিরি বৃষ্টির পর দিনটি সূর্যের উঁকিতে ঝলমল করলেও আবার মেঘমল্লারের আগমনে আকাশে তার কালো ঘনঘটা ছেয়ে আছে। দক্ষিণ দিগন্তে থেকে মেঘমল্লার যেন চোখ পাকিয়ে তাকিয়ে আছে নিরব গম্ভীর মুখে। যেন ঝড়ের পূর্বাভাস দিচ্ছে। সাথে হালকা ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি। বাতাস নেই ছিটেফোঁটাও! ঝড় না হয়ে কি ভারি বর্ষণ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে? কে জানে ! সব উপর ওয়ালার লীলাখেলা! পাতা রাস্তার পাশে স্কুটি থামিয়ে ফুটপাতের দোকান থেকে ভুট্টা পোড়া , পিয়াজি, কলার চপ, ভাজা বাদাম, ছোলা কিনল। বর্ষনের সময় ঘরে বসে এসব ভাজি পুড়ির সাথে আড্ডার তুলনা হয় না। আর লতা আপুও আছে আড্ডা জমে যেন ক্ষির হবে। তাই এসব কেনা! পাতা সব কিনে নিয়ে স্কুটিতে রেখে হেলমেট পড়ে যেই না স্টার্ট করবে তখনি এক বিরক্তিকর কণ্ঠ আওয়াজ কর্ণ কূহরে এসে বাড়ি খায়। পাতা মাত্রাতিরিক্ত বিরক্ত হয়ে পাশে তাকায়। এই জা**নোয়ারের বাচ্চা এখানে? অবশ্য যেখানে ভিড়ভাট থাকে সেখানে একে পাওয়া যাবে। বাজার, স্টেশন,লোকাল বাস ইত্যাদি জায়গায় মেয়েদের গায়ে হাত দিয়ে খুব মজা পায় কিনা! শালা মা***রির বাচ্চা।
-” পাতা মামুনি যে! স্কুল শেষে বাড়ি যাচ্ছো বুঝি! এই বৃষ্টিতেই?”
পাতা দাত কিড়মিড় করে জবাব দেয়,
-” তো কি আপনার মতো ভিড় ভাট্টায় চিপায় চাপায় অন্যকে হ্যারাস করবো নাকি মন্ডল কাকা?”
লোকটি গায়ে মাখলো না বরং বিশ্রী ভঙ্গিতে চোয়ালে হাত বুলিয়ে লালসা ভরা দৃষ্টিতে পাতাকে আগা গোড়া পরখ করলেন। হালকা ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টিতে পাতা ভিজে গেছে খানিকটা পরনের গোল জামা শরীরের সাথে লেপ্টে। মাথায় স্কার্ফ, গায়ে ওড়না থাকলেও সেটা পুরো শরীর ঢাকতে অক্ষম। পাতা তার দৃষ্টি লক্ষ করে তীব্র ঘৃনায় থু ফেলে স্কুটি টানতে নিলে শুকলা মন্ডল সামনে দাঁড়িয়ে আটকায়।
-” চলে যাচ্ছো কেন মামুনি? তোমার আঙ্কেল বৃষ্টিতে আটকে গেছে। একটু লিফট দাও তো! তোমারো ভালো লাগবে সাথে আমারও! দেখ ভিজে জামা শরীরে লে*প্টে গেছে। শীত করছে নিশ্চয়ই? আমি পিছনে গা লেগে বসলে উষ্ণতা পাবে অনেক! আর তোমার নরম নরম মাখনের মতো শরীরে হাত বুলিয়ে দিলে অনেক আরাম পাবে! সত্যি বলছি! তুমি তো ছোট নও! যুবতী মেয়ে।একা থাকা কি যে কষ্ট বুঝি তো! আঙ্কেল কষ্ট ঘুচিয়ে আরাম দেবে!!”
পাতার কান গরম হয়ে যায়। লোকটির কথায় গা গুলিয়ে আসে রাগে। শুকলা মন্ডল জিভ দ্বারা ঠোঁট ভিজিয়ে বিশ্রী ইঙ্গিত দেয়।পাতা আর চুপ থাকে না। স্কুটি থেকে নেমে দাঁত কটমট করে শুকলা মন্ডলের গালে সর্বশক্তি দিয়ে একটা থাপ্পড় লাগায়।
-” শু*য়ারের বাচ্চা! মেয়ে দেখলেই জিভ লকলক করে ? পি”নিক ওঠে রে কু*ত্তার বাচ্চা? মনে হচ্ছে জুতা খুলে পিটাই! শা*লা জা*নোয়ার! তুই লুচ্চা তো তোর মা মেয়েকেও রেহাই দিতি না? এইজন্যই আল্লাহ মেয়ে দেয়নি ঘরে! লজ্জা করে না রে মেয়ের বয়সী মেয়েকে খারাপ প্রস্তাব দিতে? অ*মানুষের বাচ্চা ভিড়ভাট্টা দেখলেই ঢুকে পড়ে মেয়েদের গায়ে হাত দিতে ভালো লাগে? হাত কেটে শকুন রে খাওয়াবো আর কখনো হাত দিলে! ***** কেটে হাতে ধরিয়ে দিব। না থাকবে বাঁশ না বাজবে বাশুরি! শালা বারো***রি!”
হিসহিসিয়ে বলে পাতা স্কুটিতে বসে চলে যায়। জা*নোয়ারটা মুডটাই নষ্ট করে দিয়েছে। পিছনে ফেলে যায় জলন্ত চোখে চেয়ে থাকা মানুষ রুপি হায়েনাকে। শুকলা গালে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে পাতার প্রস্থান দেখে। মা*গিকে দেখতে নরম শোভাই লাগতো। এভাবে পাবলিক প্লেসে থাপ্পড় মারার সাহস দেখাবে সে জন্মেও ভাবে নি! যাইহোক শিক্ষা একটা দিয়েই ছাড়বে! শুকলাকে তো চেনে না! আশেপাশের বেশ কয়েকজন লোক দাঁড়িয়ে দেখছে। কেউ কিছু বুঝে উঠতে পারছে না। কেন মারলো মধ্যবয়স্ক লোকটিকে! একজন লোক বলল,
-” একলা মেয়ে পেয়ে হয়তো জিভ চা*টছিল তাই দিয়েছে একটা! এই লু*চ্চা শালাদের নে*টা করে পেটানো উচিত!”
শুকলা তার দিকে একপল চেয়ে চলে গেল। পাবলিক ক্ষেপে গেলে সর্বনাশ। ভালোয় ভালোয় কেটে পড়া যাক!
____
বৃষ্টিভেজা বিকেল। বেশ ভালোই বারিধারা বইছে ধরনীতে। তীব্র কাঠখরার পরে একটু স্বস্তির বর্ষণ। পানির অভাবে ফেটে চৌচির হয়ে যাওয়া ফসলি ক্ষেত যেন বৃষ্টি পড়ার সাথে সাথেই শুষে নিচ্ছে। যেন কয় জনমের তৃষ্ণায় ছিল। ঝুম ঝুম বর্ষণের শব্দে পরিবেশ যেন এক অনন্য সুরে ভেসে বেড়াচ্ছে। যে সুরে ক্ষনিকের জন্য হলেও গ্লানি, দুঃখ,হতাশা, চাপ মন খারাবি, নিঃসঙ্গতা ভুলিয়ে দিয়ে মনে একরাশ প্রশান্তিতে ভরিয়ে তোলে! লতার ঘরের বেলকনিতে বসে আছে সবাই। লতা পাতা লুবমান, লাবিব , লাবনী আক্তার। ছোট্ট রুম্পা বৃষ্টিতে মজার ঘুমের স্বাদ নিচ্ছে। কারেন্ট নেই। বৃষ্টি শুরু হওয়ায় সাথে সাথেই গায়েব। এটা বাংলাদেশের জাতীয় সমস্যা বলা চলে। ঝড় ,মেঘ, বৃষ্টির শুরু হলো তো কারেন্ট শশুর বাড়ি বেড়াতে যাবে। পাতার আনা ভাজি পুড়ি ,বাদাম ,কালাই, ছোলা সবাই মুখে নিয়ে টুকটাক গল্প করছে। পাতাও টুকটাক গল্প করছে। তবে তার মনটা একটু বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে । তখন মন্ডলকে ওভাবে মেরে ভুল করে নি তো? ভুল অবশ্যই না! কিন্তু নিজের কোনো বিপদ ডেকে আনে নি তো! ভরা বাজারে ওভাবে থাপ্পড় মেরে গালিগালাজ! নিশ্চয়ই তার উপর ক্ষেপে গেছে! যদি কোনো ক্ষতি করে? খানিকটা ভয় হয় তার। সে চালাক চতুর না হলেও ভিতু নয়! তবে অন্ধকারে বেশ ভয় পায়। সেটা ছোটবেলা থেকেই! আর অতি সাহসী না! তখন মন্ডলের বিশ্রী কথাবার্তা ইঙ্গিতে মাথা গরম হয়ে যায়। কিভাবে যে থাপ্পড়টা মেরে দিল, সে নিজেও জানে না! তবে গালিগালাজ! সেটা সে ভালোই দিতে পারে!ওই বাড়ি পাভেলের দাদির থেকে শেখা!
লাবিব লুবমানের কোলে বসে আবদার করে,
-” মামু চল না বৃষ্টিতে ভিজি?অনেক মজা হবে!”
লতা চোখ পাকিয়ে বলে,
-” সাহস তো কম না তোর? ভয় করে না আমাকে? এক থাপ্পড় দিয়ে ভেজার শখ মিটিয়ে দিব !”
লাবনী আক্তার হেসে নাতির গালে আদর করে বলে,
-” আহা বকছিস কেন ভাইকে? বাচ্চা ছেলে! লাবিব বৃষ্টিতে ভিজলে ঠান্ডা লাগবে তো! তাছাড়া এখন বিকেল। কাল দুপুরের দিকে হলে ভিজো? ”
লাবিব হেসে মাথা নাড়ে। লতা মাকে বলে,
-” মা একদম আশকারা দেবে না। দেখো মাথায় উঠে হিপ হপ ডান্স করবে! একেবারে বদমাইশ! বিকেলে, সকালে আর সন্ধ্যা! মোটকথা বৃষ্টিতে ভেজা বারন। একেবারে হাই এলার্ট জারি করেছে ওর আব্বু!”
-” কি হবে একটু ভিজলে! ছোট বেলায় না তোরা কত ভিজতি? না করলেও শুনতি না! ”
লাবিব ভেংচি কেটে বলে,
-” নিজে ছোটবেলায় ভিজলে সমস্যা নেই অথচ আমার বেলা হাই এলার্ট!”
লতা বাদামের খোসা দিয়ে লাবিবকে ঢিল মেরে বলে,
-” আমরা তোদের মতো বজ্জাত ছিলাম না বুঝলি? আর মেয়েদের মতো ভেংচি কাটিস কেন? একদম মুখে মারবো!”
লাবিব মুখ ফুলিয়ে নেয়। তার মা এমনি। বকার সময় বকে ঝকে কানের পোকা মেরে ফেলবে আবার আদরের সময় আদর কোরেও কূল পায় না। লুবমান বোনের খিটখিটে মেজাজ দেখে বলল,
-” আপু তুই বেশি বেশি করিস! কথায় কথায় রেগে যাস! ঝাড়ি মারিস! কেমন খিটখিটে! পাতাকে দেখ শান্ত শিষ্ঠ ভদ্র !”
লতা লাবনী পাতার দিকে চায়। লাবিবও সায় জানিয়ে বলে,
-” মামু ঠিক বলেছো! পাতা খালামুনি কতো ভালো! একটুও রাগ নেই। মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে!”
লতা চোখ ছোট ছোট করে বলে,
-” তাই? আমি বুঝি তিতা কথা বলি?
লাবিব উপর নিচ মাথা নাড়ে। লতা তার মাথায় চাটি মেরে বলে,
-” মায়ের চেয়ে মাসির প্রতি দরদ বেশি! আর পাতা আব্বুকে ফোন করে বেশি করে আলুর চপ আর পিয়াজি আনতে বলতো? আমার ফোনে টাকা নেই!”
পাতা চমকপ্রদ হয়ে যায়। সে বাবাকে কল করবে? কখনো না! সে না করবেই তার আগে লুবমান জোর করে,
-” এই পাতু কল কর ! না করলে খবর আছে! এখনি কর?”
পাতা না ইশারা করে। লতা লুবমান চোখ রাঙায়। লাবনী আক্তার ভ্রু কুঁচকে ধমকে বলে,
-” বাপকে ফোন করতে এতো ঢং কিসের? জলদি কর?”
পাতা মায়ের ধমকে কাঁচুমাচু করে নিজের ফোন বের করে কল করে। রিং হচ্ছে। সাথে পাতার মন দুরু দুরু করছে। আতিকুর ইসলাম ফোন রিসিভ করে হ্যালো বলতেই পাতা সালাম দিয়ে বলে,
-” আব্বু আমি পাতা?”
আতিকুর ইসলাম অবাক হয় খানিকটা। পাতা কল করেছে? সচরাচর না সে পাতাকে কল করে না পাতা তাকে! আজ হঠাৎ!!
-” হুম বলো?”
-” কোথায় তুমি?কখন আসবে?”
-” কাচারিতেই। বৃষ্টি শেষ হওয়ার নাম নেই! তাই আসতে পারছি না। এই একটু কমলেই আসবো।”
পাতা আমতা আমতা করে এখন কি বলবে? লতা ইশারায় বলতে বলে ভাজিপুরির কথা। পাতা ঢোক গিলে বলে,
-” আব্বু লতা আপু আলুর চপ, পিয়াজি আনতে বলেছে। আসার সময় নিয়ে এসো!”
-” আচ্ছা! আর কিছু লাগবে? তোমার, লাবিব আর লুবমানের?”
পাতা চোখে হাসে অল্প। আজ আব্বু একটু হলেও তার কথা ভাবছে!
-” কলার চপ এনো।আর কিছু না।আর সাবধান এসো!”
-” হুম রাখছি!”
পাতা ফোন কেটে গেলেও কানে ধরে রাখে। আজকের দিনটা মন্দ নয়। বাবার একটু যত্নে সব ক্লেশ যেন কেটে গেছে। সে এমনি অল্প স্বল্প যত্ন ভালোবাসা চায় বাবা মায়ের কাছ থেকে। একটু ভালোবাসুক স্নেহের হাত মাথায় বুলিয়ে বুকে স্থান না দিলেও দূরে না ঠেলে দেয় ।
________
অরুণ সন্ধ্যার পরপরই বাড়ি ফেরে আজ। ছেলের মন খারাপ শুনে কি আর কাজে মন বসে। তবুও সন্ধ্যা পর্যন্ত কাজ করে গেছে। ছেলেটা তার কলিজা।অরুণ ছেলের মন খারাপ ভেনিশ করতে একটা বিড়াল এনেছে তার বিড়াল প্রেমী বন্ধু তমালের থেকে। ধবধবে সাদা বিড়াল টার্কিস অ্যানগোরা। বিড়াল দেখতে এমনিতেই কিউট। এই সাদা বিড়ালটা আরো আদুরে। ভোর সেবার তমালের বাড়িতে কোনো এক অনুষ্ঠানে গেলে বিড়াল দেখে বায়না করে সে নিয়ে যাবে এটা। তমালও দিতে চায় । না করে না। কিন্তু বাঁধ সাধে অরুণ। ভোর তখন সারে তিন বছরের হবে হয়তো। বিড়ালের আচড় লাগে যদি। আর তাছাড়াও তার এইসব বিড়াল ফিড়াল একদম পছন্দ নয়। কেমনা গা ঘেঁষে! তাই নিয়ে আসে নি। ভোর মুখ ফুলিয়ে বাড়ি এসেছিল। পরে ভুলে গেছে অবশ্য। আজ দুপুরে যখন আভারির কাছ থেকে ভোরের মন খারাপ শুনলো তখন বিড়ালের কথা মাথায় আসে। তমালকে ফোন করে বিড়ালের কথা জানায়। সন্ধ্যায় সেখানে গিয়ে নিয়েও আসে সাথে। অরুণ বিড়ালের খাঁচা নিয়ে ড্রয়িং রুমের সোফায় বসে। সেখানে বসে আনিকা পড়ছে। আসমা বেগম তার পাশে বসে পড়াশোনার তদারকি করছে। রুবি ছেলেকে সবজি খিচুড়ি খাওয়ানোর চেষ্টায়। আরিয়ান হা করে ফোনের দিকে চেয়ে। অরুণের বুঝতে অসুবিধা হয় না যে আরিয়ান খেলা দেখছে। আদুরি নুডুলস খাচ্ছে বসে বসে তাকে দেখে এক গাল হেসে মুখে নুডুলস নিয়েই জিজ্ঞেস করে,
-” ভাই আজ এতো জলদি? আর হাতে ওটা কি?”
সবাই অরুণের দিকে চায়। আনিকাও পড়া বাদ দিয়ে চায় চাচ্চুর দিকে। অরুণ খাঁচাটা উঁচু করে দেখিয়ে বলে,
-” বৃষ্টির দিন তাই জলদি এলাম। ভোর কোথায়? ওর জন্য আনলাম বিড়ালটা! তমালের বাড়ি থেকে!”
আদুরি নুডুলসের বাটি সোফায় রেখে চট করে উঠে এসে খাঁচা খুলে বিড়াল শাবকটি বের করে বলে,
-” কি কিউট !! এটা তো বাচ্চা! এতো সুন্দর দেখতে! কি বিড়াল এটা হুম? আমার তো অনেক পছন্দ হয়েছে!আর তোমার ছেলে ঘরে খেলছে। পড়তে বসতে বললাম বললো সব পড়া শেষ মিস টুম্পার কাছে পড়েছে।”
আনিকাও উঠে আসে। তবে বিড়াল শাবকটিকে ধরতে সাহস পায় না। সে ভয় পায়। খামচি না দিয়ে দেয়? রুবি মেয়েকে টেনে ধরে বলে,
-” একদম কাছে যাবে না। আঁচড় কাটবে!”
আসমা বেগম নাক সিঁটকায়।
-” ছিঃ এটা তো ঘর বাড়ি নোংরা করে ফেলবে। বিড়াল এক নাম্বারের চোর হয়।”
আদুরি বিড়ালকে কোলে নিয়ে আদর করছে। বোঝাই যাচ্ছে তার বেশ পছন্দ হয়েছে। আর তাছাড়া নাইন্টি পার্সেন্ট মেয়েরাই বিড়াল ভক্ত কিনা!!অরুণ বিড়ালের খাঁচাটি টি টেবিলের উপর রেখে আসমা বেগমকে বলে,
-” ছোটমা! এটার জাত ভালো টার্কিশ অ্যানগোরা। ঘর বাড়ি নোংরা করবে না। দুই একবার পটির জায়গা দেখিয়ে দিলে সেখানেই করবে। আর খামচি দেয় না বেশি। সারাদিন ঘুমিয়েই কাটায়। তবে চুরির গ্যারান্টি দিতে পারছি না।”
আরিয়ানের এসবে মনোযোগ নেই। সে খেলায় মত্ত। আশেপাশে এখন ঝড় তুফান হয়ে গলেও তার খবর পাওয়া মুশকিল! আসমা বেগম অরুণের কথা শুনে খানিকটা আশ্বস্ত হলেন। আদুরি বিড়ালের গা বুলিয়ে ভাইকে বললো,
-” এতো আদুরে না বিড়াল টা? ঠিক ভোরের মতো! নাম কি ওর?”
অরুণ কাঁধ উঁচিয়ে বলে,
-” টম জেরী না বান্টি কি যেন নাম! খেয়াল নেই। তোর পছন্দ হলে তুই ই রাখ। ভোরকে আরেকটা এনে দেব!”
আদুরি হেসে বলে,
-” কি যে বলো না বড় ভাইয়া! রাজকুমারের জন্য আনা জিনিস আমি নেব? ওকেই দাও। আর বাড়িতেই তো থাকছে এটা। আমিও আদর করবো। রাজকুমারের হোক বা আমার কি আসে যায়! যাও তোমার ছেলের কাছে নিয়ে যাও। আজ কেমন মুড অফ অফ দেখলাম!”
বলে বিড়াল শাবকটিকে খাঁচায় রেখে দিল। শাবকটি মিও করে উঠলো। সে খাঁচায় থাকবে না। কোলে নাও আদর করো!
অরুণ খাঁচাটি নিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো।
-” যাই নবাব আবার কি নিয়ে মন খারাপ করে বসে আছে। আর আনি বুড়ি তোমার জন্য আইসক্রিম আছে। ভোরকে দেখাবে না। ওর ঠান্ডা খাওয়া যাবে না। তুমি চুপি চুপি খেয়ে নিও।”
আনিকা হেসে বলল,
-” লাভ ইউ চাচ্চু!
-” লাভ ইউ ট্যু আনি বুড়ি।”
বলে সিঁড়ি বেয়ে উপরে চলে আসে। ছেলেটার জন্য মন ছটফট ছটফট করছে সেই দুপুর থেকেই। কখন কোলে নিয়ে আদর করবে! অরুণ তন্ত পায়ে রুমে প্রবেশ করে। এদিকে ওদিকে তাকিয়ে ভোরকে খোঁজে। বিছানায় নজর যেতেই দেখে ভোর গুটিসুটি মেরে কম্ফোর্ট পেঁচিয়ে শুয়ে আছে। অরুণ খাঁচাটা নিচে রেখে দ্রুত পায়ে বিছানায় বসে ছেলের মাথায় হাত দিয়ে উদ্বেগ ভরা কন্ঠে ডাক দেয় ছেলেকে,
-” আব্বু? কি হয়েছে? অবেলায় শুয়ে আছো? আব্বু? শরীর খারাপ লাগছে? জ্বর তো নেই! আব্বু?”
ভোর ঘার ফিরিয়ে মিষ্টি হাসি দিয়ে বলে,
-” এমনি শুয়ে ছিলাম।একা একা ভালো লাগছিল না!”
অরুণ ছেলের কপালে চুমু দিয়ে ওঠে টাইয়ের নট খুললো।
-” নিচে সবার কাছে যেতে! আব্বু তোমার মন খারাপ? তোমার জন্য সারপ্রাইজ আছে! দেখো কি এনেছি?”
ভোর সারপ্রাইজের কথা শুনে লাফ দিয়ে উঠলো। বিছানা থেকে নেমে ফ্লোরে রাখা খাঁচার দিকে নজর যায়। ওতে কি আছে? সারপ্রাইজ? খাঁচার কাছে গিয়ে উঁকি দিলে বিড়াল শাবক মিও মিও করে ওঠে। ভোরের চোখ বড় বড় হয়ে যায়। বিড়াল!! সে খুশি তে দৌড়ে বাবার কোমড় জাপটে ধরে।
-” আব্বু থ্যাংক ইয়ু সো মাচ। বিড়ালটা অনেক কিউট। কোথা থেকে এনেছো?”
ছেলের খুশি দেখে অরুণের অধরকোনে হাসি ফুটে উঠলো। ব্লেজার, কটি খুলে শার্টের বোতাম খুলতে লাগলো।
-” তোমার তমাল আঙ্কেল আছে না? তার বিড়ালের বাবু হয়েছে বেশ কয়েকদিন আগে সেটাই দিল তোমাকে! তোমার মনে আছে কি না!!ছোট বেলায় তার বিড়াল দেখে নিয়ে আসবে বলে জেদ করছিলে! তখন ছোট ছিলে তাই আনি নি! আজ আমার আব্বুটার মন খারাপ ছিল তাই সারপ্রাইজ দিলাম! এখন বল মন খারাপ কেন ছিল?”
ভোর মিষ্টি হাসে।
-” পড়ে বলব আব্বু! আগে ওকে আদর করি!”
বলেই বিড়াল শাবকের কাছে যায়। অরুণ টি শার্ট ট্রাওজার নিয়ে ওয়াশ রুম ঢুকতে ঢুকতে বলল,
-” সাবধানে আব্বু! আঁচড় যেন না লাগে! লাগলে ওটাকে ধাক্কা মেরে বের করে দিতে দুবার ভাববো না!”
ভোর অনেক কষ্টে খাঁচা খুলে বিড়াল শাবকটিকে বের করে কোলে নিয়ে আদর করে। বিড়ালটি মিও মিও করে মুখ ঘষে ভোরের পেটে। ভোর হেসে আরো আদর করে। ইশ ক্যাট টা কত কিউট! ভোর ফ্লোরে বসে বিড়ালটিকে উঁচু করে জিজ্ঞেস করে,
-” এই কিউটি তোর নাম কি? হুম?”
কি সুন্দর গোল গোল চোখ দিয়ে কিউট কিউট করে তাকিয়ে আছে। ভোর তার গাল টিপে দেয়। বিড়াল টি মিও মিও করে। ভোর ওকে ফ্লোরে নামিয়ে দিয়ে লেজ টানে। বিড়ালটার এক পা তুলে হ্যান্ডশেক করে। কান টানে। বিড়ালটি তবুও বিরক্ত না হয়ে মিও মিও করে ডাকছে। ভোরের কাছে বিড়ালটি মিস পাতার মতো লাগছে কেন জানি! মিস যেমন কুটুর কুটুর করে চায় এইটাও তেমন করেই তাকায়!!
অরুণ ওয়াশ রুমে গিয়ে দেখে সেথায় কাপড় চোপড়ের ছড়া ছড়ি ভোরের স্কুলের শার্ট ,প্যান্ট,মুজো সব পড়ে আছে ফ্লোরে। ভিজেও গেছে খানিকটা। ছেলেটা কাপড় চেঞ্জ করতে গিয়ে মনে হয় যুদ্ধ করেছে। অরুণ সেগুলো নিয়ে বিনে রাখে। ধুতে হবে। এখন শুকাবে না। কাল স্কুলের জন্য নতুন স্কুল ড্রেস টা বের করতে হবে। অরুণ নিজেও চেঞ্জ করে ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে আসে রুমে। দেখে ভোর ফ্লোরে বসে বিড়ালটির সাথে খেলছে আদর করছে। অরুণ এগিয়ে যায়। ভোর শাবকের সামনের দুই পা শুন্যে তুলে নাচাচ্ছে। অরুণ হাসে। হঠাৎ ছেলের হাতের দিকে নজর যায়। লাল লাল র ্যাশ । অনেক জায়গায় হালকা ছিলে গেছে চুলকানির ফলে। অরুণ তড়িৎ গতিতে ফ্লোরে বসে বিড়ালটাকে সরিয়ে ছেলেকে কোলে বসায়। হাত ভালো করে দেখে বলে,
-” আব্বু? এই র্য্যাশ ? এতো এলার্জি! কখন হলো? চুলকাচ্ছে আব্বু? কি খেয়েছিলে?”
বলেই টি শার্ট খুলে দেয় ভোরের। পুরো গা দিয়েই র্য্যাশ হয়ে বেরিয়ে এসেছে! চুলকিয়ে ফর্সা শরীর একদম লাল হয়ে গেছে। যেন রক্ত জমাট বেঁধে আছে। অরুণ ছেলের গায়ে হাত বুলিয়ে দেয়। কত কষ্ট হচ্ছে ছেলেটার?এই জন্যই শুয়ে ছিলো?
-” কি খেয়েছিলে আব্বু? বলো? বকবো না? বাড়িতে তো তোমায় এলার্জি জাতীয় কিছু দিবে না তাহলে?”
ভোর কাঁচুমাচু মুখে বলে,
-” কিছুই তো খাইনি আব্বু! কিভাবে যে হলো?”
অরুণ ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ধরে।
-” আব্বু সত্যি কথা বলো? বাইরে কিছু খেয়েছিলে? তোমার মিস পাতাবাহারের থেকে কিছু খেয়েছিলে?”
ভোর মাথা নাড়ে খায় নি। টুম্পা মিসের কথা কিছু বলে না। যদি বাবা তাকে বকা দেয়!! অন্য মিস ঠিক করে? টুম্পা মিস তাকে অনেক আদর করে ভালোবাসে। বিড়াল শাবকটি অরুণের কোলে থাকা ভোরের কোলে উঠে মিও মিও করে। অরুণ তাকে খাঁচায় ভরে ছেলেকে নিয়ে বাইরে যায়। বাড়ি ভর্তি কত লোক অথচ ছেলেটা এলার্জিতে গা চুলকে ঘা বানিয়ে কত কষ্ট পাচ্ছে!! কেউ নজরই রাখে নি! আর ভোর বকা খাওয়ার ভয়ে হয়তো কাউকে বলেই নি। কিন্তু বাকিদের একটু তো খেয়াল রাখা উচিত ছিল ,নয় কি? ছটফটে চঞ্চলতায় ঘেরা ছেলেটা একা ঘরে চুপচাপ শুয়ে ছিল কেউ কি গিয়ে একটু দেখে আসতে পারতো না! যে ছেলেটা চুপচাপ থাকার নয় সে চুপচাপ ঘরে ঘাপটি মেরে বসে আছে । অরুণের চোখ অল্প ভরে ওঠে ছেলের কষ্টে। সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামে। সবাই ব্যাস্ত যার যার কাজে। অরুণ কাউকে কিছু বলে না। আভারিকে ডেকে রুমে খাবার দিতে বলে পুনরায় উপরে চলে যায়। ঠান্ডা পানিতে তোয়ালে ভিজিয়ে ছেলের গা মুছে দেয়! একটু আরাম পায় যদি। এলার্জির ঔষধ ঘরেই আছে। অরুণ লুলিটপ মলম চুলকানো জায়গায় লাগিয়ে দিল। ছেলের গালে মুখে গায়ে চুমু খেল অগনিত। ভোর চুপটি করে বসে বাবার আদর উপভোগ করতে থাকে। আদর খেতে তার খুব ভালো লাগে। মনে হয় ভাত খাওয়া বাদ দিয়ে শুধু আদর খেতে। বিড়াল শাবকটি খাঁচায় বন্দি অবস্থায় মিও মিও করছে। ভোরের মায়া হলো খানিকটা।
-” আব্বু দরজা লাগিয়ে ওকে ছেড়ে দাও না!খেলবো ওর সাথে!”
অরুণের মুখশ্রী গম্ভীর হয়ে আছে ছেলের অবস্থা দেখার পর থেকেই।
-” না থাক। গা ঘেঁষবে তোমার! আরো চুলকাবে! পরে খেল! ওটা তো তোমারই!”
ভোর চুপচাপ বাবার কথা মেনে নেয়। বাবার গলা জড়িয়ে বিছানায় বসে রয়। একটু পরে আভারি আসে ঘরে। হাতে দুজনের রাতের খাবার। টেবিলে রেখে দিয়ে জগ ভরে পানি আনে । ভোর হঠাৎ কিছু মনে পড়ায় বাবাকে জিজ্ঞেস করে,
-” আব্বু সকালে না বলেছিলে অনেক গুলো আইসক্রিম নিয়ে আসবে! এনেছো?”
আভারি হেসে বলে,
-” দেখছেন স্যার ভোলেনি এখনো! ভোর বাবা ঠান্ডা না তোমার? আইসক্রিম খাওয়া যাইবে না!”
ভোরের দিকে তাকাতেই গায়ে হাতে লাল কিছু দেখতে পায়! তাতে সাদা মলম লাগানো। সে এগিয়ে এসে বলে,
-” স্যার কি হয়েছে ভোর বাবার গায়ে? ঠিকই তো ছিল বিকেলে!”
অরুণ গম্ভীর গলায় বলে,
-” এখন নজরে এলো তোমাদের আভারি ভাই? ছেলেটা কখন থেকে কষ্ট পাচ্ছে! বকবে বলে কাউকে বলেই নি। ঘাপটি মেরে বসে আছে। তোমরা একটু খেয়াল রাখবে না? আর ওকে কি খেতে দিয়েছিলে যে এলার্জি হলো? জানো না ওর একশ এক টা রোগ লেগেই থাকে?
”
আভারি মাথা নিচু করে নেয়। সত্যিই খেয়াল রাখা উচিত ছিল। মিনুটার মাথা ব্যাথা নিয়েই বাড়ির সব রান্না বান্না করছিল তাই তাকে টুকটাক সাহায্য করতে নিয়ে ভোরের কথা খেয়ালই ছিল না।
-” স্যার নুডুলস দিয়েছিলাম। ভাত তো খায়ই নি। তবে হ্যা ওনার ম্যাডাম আলুর পরোটা এনেছিল ভোরের জন্য। সেটাই খেয়েছে!”
ভোর বাবার গলা ছেড়ে আমারির দিকে বড় বড় করে চায়। যার অর্থ না করেছিলাম তার পরেও বললে কেন? আভারি তাকায় না। তার নজর ফ্লোরে নিবদ্ধ! অরুণ ছেলের দিকে তাকিয়ে শক্ত কণ্ঠে বলে,
-” না করে ছিলাম না? কেউ কিছু দিলে না খেতে? এত ছোচামি শিখেছো কোথা থেকে?”
ভোর নাক ফোলায়। চোখে পানি আসার আগেই সর্দি এসে হাজির। নাক ডলে ঠোঁট উল্টায়। অরুণ কিছুটা নরম হয়ে ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,
-” শুধু আলুর পরোটা খেয়েছো? সাথে আর কি? আর কোন মিস? মিস পাতাবাহার?”
-” পাতা মিস না! টুম্পা মিস! আলুর পরোটা আর কিসের মাংস যেন! আব্বু ওনাকে বকবে না প্লিজ? আমিই খেতে চেয়েছিলাম!”
অরুণের কপালে ভাঁজ পড়ে! মাংস ? গরুর নাকি? আভারিকে বলে,
-” তুমি দেখবে না কি খাচ্ছে? গরুর গোশত হলে সমস্যা ! ওর এলার্জি আছে তো! আচ্ছা যা হয়েছে,হয়েছে! যাও?”
আভারি চলে যায়। অরুণ ভোরকে বিছানায় বসিয়ে হাত ধুয়ে একটা প্লেট নিয়ে ভোরের সামনে বসে। প্লেটে খিচুড়ি আর কষা মুরগির মাংস। একটা রান আর কিছু মাংস। বৃষ্টির জন্য হয়তো খিচুড়ি রান্না হয়েছে। অরুণ প্রথমে নিজের মুখে নেয় গরম কেমন পরীক্ষা করার জন্য। তারপর অল্প ফু দিয়ে ছেলের মুখে দেয়। ভোর দু লোকমা খেয়ে মাথা নাড়ে। আর খাবে না। ঝালে হা হা করছে। অরুণ পানি খাওয়ায়।
-” আব্বু আর খাব না। পেট ভরে গেছে।”
অরুণ কপালে ভাঁজ ফেলে জিজ্ঞেস করে,
-” এই টুকুতেই পেট ভরে? হা কর আব্বু?”
-” না খাব না। ঝাল লাগে। প্লিজ আব্বু?”
কাঁদো কাঁদো গলায় বলে। অরুণ নিজের মুখে খাবার নেয়। একটু ঝালই।
-” অন্য কিছু খাবে? আমি রান্না করে আনি?”
-” না কিছু খাব না। গা চুলকায় তো!’
অরুণ বা হাত ছেলের গায়ে হাত বুলায় । ভোর আদর পেয়ে মিটমিট হাসে। অন্য সময় হলে বাবার হাতের রান্না মিস করতো না। অরুণ বেশ ভালোই রাঁধতে জানে। খেয়ে প্রশংসা কুড়ানোর মতো রান্না। ভোরও সুযোগ পেলে মিস করে না। তবে এখন খেতে মন চাইছে না। অরুণ ছেলেকে বলে,
-‘ আব্বু মন খারাপ ছিল কেন সারাদিন? পরে বলবে বলেছিলে? এখন বল?”
ভোর মুখ গোমড়া করে পাতা মিসের সব কথা বলে দেয়। সব শুনে অরুণের অধরকোনে হাসির রেখা ফুটে ওঠে। বাহ্ ছেলে অভিমান করেছে মিস পাতাবাহারের উপর! ছেলেটা সবার উপরে অভিমান করে না। যাকে একটু বেশিই ভালোবাসে তার উপরেই করে। যেমন মিনু আপা, শুভ, ছোট মা, আদুরি, মিসেস রুণা এদের উপর করে। আজ মিস পাতাবাহারও যোগ হলো।
-” মিস পাতাবাহার ঠিক করেছে। ক্লাসের মাঝে কথা বলে নয়েজ সৃষ্টি করলে তো পানিশমেন্ট পেতেই হবে। আ’ম অন হার সাইট।”
ভোর মুখ ফুলিয়ে শুয়ে পড়ে। অরুণ খাওয়া শেষ করে বাকি খাবার নিচে রেখে আসে। ছেলেকে ডেসলর সিরাপ খাইয়ে ওয়াশ রুমে নিয়ে যায়। একটু পর বের হয়ে ছেলেকে শুইয়ে দিয়ে ফোন নিয়ে বেলকনিতে যায়। ঠান্ডা হাওয়া সাথে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি বহমান। বেলকনি ভিজে আছে। নেটওয়ার্ক স্লো হওয়ায় এখানে আসা। অরুণ টুম্পার নাম্বারে কল লাগায়। সাথে সাথেই রিসিভ হয়। মিষ্টি কণ্ঠে সালাম ভেসে আসে। অরুণ জবাব দিয়ে বলে,
-” টুম্পা ভোরের জন্য কি রেঁধে এনেছিলে?”
অপাশ থেকে থমথমে কণ্ঠ ভেসে আসে,
-” স্যার আমি কোনো ছেলে ধরা নই যে খাবারে কিছু মিশিয়ে কিডনাপ করে নেব!”
অরুণ হাসে খানিকটা শব্দহীন।
-” স্যার কাকে বলছো? আঙ্কেল হই তোমার। তোমার মামা শুভর বন্ধু হই আমি।সো আঙ্কেল ডাকবে। আর শোন ছেলেটার গায়ে লাল লাল র্য্যাশ উঠেছে এলার্জিতে চুলকিয়ে। তাই জিজ্ঞেস করলাম কি এনেছিলে!”
-” স্যরি স্যার আসলে গরুর মাংস আর আলুর পরোটা খেয়েছে। আমি জানতাম না। ইশ ছেলেটার খুব কষ্ট হচ্ছে?”
-” ঔষধ খাইয়ে দিয়েছি। ঠিক হয়ে যাবে। রাখছি।”
-” শুনুন স্যার? বন্ধুর বউ যেমন বউ হয় না তেমনি মামার বন্ধুও মামা বা আঙ্কেল হবে এমন নিয়ম নেই!”
বলেই খপ করে কেটে দেয়। অরুণের আহম্মক হয়ে ফোন কানে ধরে রাখে। আজকালকার পিচ্চি মেয়েদের কি হয়ে গেছে! দিনে দুপুরে ফ্লার্ট করে তাও মামার বন্ধুর সাথে!
অরুণ ফোন হাতে নিয়ে ভেতরে আসে। ভোর বিছানায় শুয়ে এপাশ ওপাশ করছে! অরুণ বিড়াল শাবকটিকে টি টেবিলে রেখে ক্যাট ফুড দেয়। তমাল সাথে দিয়ে দিয়েছে। তারপর ছেলের কাছে শুয়ে ছেলেকে বুকে টেনে নিল।
-” আব্বু? ঘুম আসছে না?”
ভোর মাথা নাড়ে আসছে না। অরুণ ছেলের চুলের ভাঁজে হাত গলিয়ে দেয়,
-” চোখ বন্ধ করে ঘুমানোর চেষ্টা কর।”
-” আসছে না তো!”
অরুণ হাসে।
-” কি করলে আসবে?”
ভোর মুখ ফুলিয়ে বলে,
-” পাতা মিসকে একটা ঝাড়ি দিলে!”
অরুণ চোখ ছোট ছোট করে চায় ছেলের দিকে। তারপর ফোন বের করে পাতার নাম্বার বের করে। ভোরের ক্লাসটিচার সবগুলোর নাম্বারই আছে তার কাছে। কল করে ভোরের কাছে দেয়।
-” দাও ঝাড়ি? কতড় সাহস আমার আব্বুকে ক্লাসে দাঁড় করিয়ে রাখে!নাও ধর?”
ভোর মাথা তুলে চোখ বড় বড় করে বাবার দিকে চায়। সত্যি কল করেছে? রিং হচ্ছে তো! ভোর ফোন হাতে নেয়। কানে ধরতে ধরতেই রিসিভ হয়।
-” আসসালামুয়ালাইকুম মিস! কেমন আছেন মিস?”
অপাশ থেকে কিছু সময় ঘুম জরানো কণ্ঠে পর জবাব আসে,
-” ওয়ালাইকুমুস সালাম। কে?”
-” মিস আমি ভোর!”
-” মি. ভোর দয়া করে একটু দেড়িতে আসবেন। আমি একটু বেশি করে ঘুমুতে চাই!”
ভোর চোখ পিটপিট করে বাবার দিকে চায়। মিস কি বললো কিছুই বুঝতে পারে না। অরুণের কানে ধরে ফোন। অরুণ হ্যালো বললে অপাশ থেকে আবার ভেসে আসে,
-” এই কে বে শালা? গভীর রাতে কল করে ঘুমের ডিস্টার্ব করিস?”
অরুণ ছেলের দিকে চায়। কি ভাষা তার মিস পাতাবাহারের!
-” এক থাপ্পড়ে কানে তালা ঝুলিয়ে দিব বেয়াদব মেয়ে!”
পাতা লাফ দিয়ে ওঠে। সে ঘুমিয়ে পড়েছিল সবে। কাঁচা ঘুম ভেঙে যাওয়ায় মেজাজ তুঙ্গে। ভোরের আওয়াজ চিনতে না পারলেও এই ম্যানারলেস লোককে ঠিকই চিনতে পারে। কিভাবে? জানে না।
-” স্যরি স্যরি মি. ভোরের আব্বু আসলে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম!ভেঙ্গে যাওয়াতে!”
অরুণ কপাল কুঁচকে বলে,
-” এত জলদি ঘুমান?”
পাতা পা ভাঁজ করে বসে বলে,
-” আপনি জানেন না? আরলি টু বেড এন্ড আরলি টু রাইজ! মেকস আ ম্যান হেলদি ওয়েলদি এন্ড ওয়াইজ! আমি এটাতে বিশ্বাসী। আপনিও করতে পারেন?”
অরুণ বেশি কথায় বিরক্ত হয়।
-” ভোর কথা বলবে আপনার সাথে! নিন কথা বলুন?”
বলেই লাউড স্পিকারে দেয় ফোন। পাতা সেটা বুঝতে পারে না। সে হেসে বলে,
-” ভোর সরকার কি রেগে আছো আমার উপর? দেখ ক্লাসে অপ্রয়োজনীয় কথা বললে আমি সবাইকেই পানিশমেন্ট দেই তোমাকেও দিয়েছি! আর তার উপর তুমি পড়াও পারো নি! ”
অরুণ ছেলের দিকে চায়। পড়াও পারে নি?
ভোর বাবার চাহনি দেখে আমতা আমতা করে বলে,
-” আসলে তখন মনে ছিল না। আচ্ছা ওসব বাদ দিন! আপনাদের ওখানে বৃষ্টি হচ্ছে?”
-” হচ্ছে তো! বেশ সময় ধরেই!”
-” আপনি ভিজেছেন?”
-” না! যদি ঠান্ডা লাগে?”
-” আমিও ভিজি নি। আব্বু বকা দেয়!”
পাতা ভেংচি কেটে বলে,
-” উনি পারেন ই একটা কাজ! নাক উঁচু ম্যানারলেস লোক কোথাকার!”
ভোর বাবার কোল থেকে মাথা তুলে বাবার নাক ধরে নাড়াচাড়া করে।
-” মিস আপনি ভুল জানেন। আমার আব্বুর নাক উঁচু না! এই যে ঠিকঠাকই তো!”
অরুণের হাসি পায়। সব কথাই তার কানে বাজছে।
পাতা চোখ ছোট ছোট করে বলে,
-” এই উঁচু সেই উঁচু নয়। তুমি বুঝবে না। আচ্ছা তোমার আব্বু কই?”
-” এই তো আমি আব্বুর বুকে শুয়ে আছি! কেন মিস?”
পাতার চোখ আপনে আপ বড় হয়ে যায়। বুকে শুয়ে আছে? তাহলে ওই ম্যানারলেস লোক সব শুনতে পেয়েছে !ইয়া আল্লাহ!!
-” তোমার আব্বু শুনতে পাচ্ছে আমার কথা?”
অরুণ ইশারা করে না বলতে। ভোর বুঝতে পারে না।
-” আব্বু কি বলছো? আর মিস ফোন স্পিকারে আছে তো!!
বলার সাথে সাথেই খট করে কেটে যায় কলটা। ভোর হ্যালো হ্যালো বলে সাড়া পায় না। অরুণ হেসে পাশ হাতরিয়ে রিমোট খুজে লাইট ওফ করে দেয়।এসির রিমোট বের করে অফ করে দেয়। এমনিতেই বেশ ঠান্ডা কম্ফোর্ট জড়াতে হবে গায়ে। ছেলের কপালে চুমু দিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,
-” ঘুমিয়ে পড় আব্বু! ভালো লাগবে! মিস পাতাবাহারকে কাল দেখে নেব!”
-” আব্বু বিড়ালটার নাম কি রাখবো?”
-” তুমিই রাখ?”
-” বিড়ালটিকে না মিস পাতার মতো লাগে?”
অরুণ হেসে বলে,
-” তাই?”
-” হুম!”
-” তাহলে পাতাবাহার রাখ!”
ভোরের পছন্দ হয় নামটা।
-” মিস যদি জানতে পারে?”
-” সে কিভাবে জানবে?”
-” তাহলে ওর নাম পাতাবাহারই! আব্বু ও ছেলে না মেয়ে?”
-” মেয়ে!”
-” ওর কি অন্ধকারে ভয় করবে?
-” নাহ আব্বু। হয়েছে অনেক আলাপ ঘুমাও তো কলিজা!”
চলবে…..