পান পাতার বউ পর্ব-১৪+১৫

0
116

#পান_পাতার_বউ
চতুর্দশ_পর্ব
~মিহি

সীমান্ত লক্ষ করছে ইদানিং শর্বরী কেমন যেন অদ্ভুত আচরণ করে। রাতে ঘরেও থাকে না সে। সীমান্ত যদিও কেস-টেস নিয়ে অনেক দেরি অবধি সজাগ থাকে তাই শর্বরীর এ আচরণ তাকে ভালোই পীড়া দিচ্ছে।এভাবে হঠাৎ চুপচাপ হয়ে যাওয়ার মেয়ে তো শর্বরী না। তবে হলো টা কী?

রাত এগারোটার কাছাকাছি। শর্বরী বই হাতে নিয়ে মনে মনে পড়ছে আর পায়চারি করছে। ঘুম যেহেতু ধরছে না, একটু পড়া এগিয়ে রাখুক। আচমকা সীমান্ত এসে শর্বরীর হাত ধরে তাকে ছাদে টেনে আনলো। সীমান্তর স্পর্শ শর্বরীর মোটেও ভালো লাগছে না। মন বড্ড বিষাদঘন হয়ে আছে। সালমা খানমের কথা শোনার পর থেকে সীমান্তর প্রতিটা আচরণ আদিখ্যেতা মনে হচ্ছে।

-“শর্বরী কী হয়েছে তোমার? কী নিয়ে মন খারাপ বলো তো। মান অভিমান থাকা ভালো তবে সেটাকে দাম্পত্য জীবনের ইস্যু বানানো উচিত?”

-“আমার এখন কথা বলতে ভালো লাগছে না। আমি নিচে গেলাম।”

শর্বরী সীমান্তর দিকে ফিরে তাকালো না। বিশ্বাসঘাতকতার এক ফালি ছোরা সে নিজ বক্ষে অনুভব করতে পারছে। সীমান্ত আর নীচে নামলো না। শর্বরীর মন খারাপ হওয়াটা তাকেও ব্যথিত করে তুলছে খুব বাজেভাবে। সীমান্ত ছাদের সাথে লাগোয়া চিলেকোঠা ঘরটাতে গিয়ে বসলো। প্রচণ্ড ক্লান্ত লাগছে তার। যার চোখে সে স্বস্তি খুঁজতে গিয়েছিল, আজ সে চোখজোড়াই বেরঙিন আর বর্ণহীন! সীমান্ত চোখ বন্ধ করে ঘুমোনোর চেষ্টা করলো। ছাদের মন্দমধুর বাতাস সীমান্তর বাহু ছুঁয়ে যাচ্ছে লাজুকলতার ন্যায়। দীর্ঘশ্বাস ফেলে চোখজোড়া বন্ধ করলো সে।

___________

ঘুম থেকে উঠে নিচে নেমেই বাড়িভর্তি মানুষ দেখে হকচকাল সীমান্ত। সকলের মুখে রাগ বহাল। ঘটনা কী কিছুই বুঝতে পারছে না সে। গতবারের মহিলা অর্থাৎ আমেনা চাচীকেও সবার মধ্যে দেখলো সীমান্ত।

-“কী হয়েছে? আপনারা সবাই এখানে এভাবে জটলা পাকিয়ে আছেন কেন?”

আমেনা এগিয়ে এলো। নেত্রী স্বরূপ একটা ভাব নিয়ে কথা বলতে লাগলো সে।

-“তোমার স্ত্রী ঘুমের ঘোরে সবার বাসার দরজায় টব ছুঁড়েছে। এলাকাসুদ্ধ তাণ্ডব বাঁধিয়ে রেখেছে সে।”

-“আপনি নিজের চোখে দেখেছেন?”

-“হ্যাঁ দেখছি আমি। তোমার বউ ছাড়া আর কোনো পাগল এ এলাকায় নাই যে এসব করতে পারবে।”

আমেনার কথা শর্বরীর কর্ণকুহরে আঘাত করলো। প্রচণ্ড আত্মগ্লানিতে শর্বরীর নিঃশ্বাস আটকে আসার উপক্রম হলো। আগের রাতে তো সীমান্তও ছিল না তার কাছে। শর্বরী ঘুমিয়েছিল কিভাবে যেন, খানিকটা দেরিতেই ঘুম ভেঙেছে তার। তবে কি সত্যিই সে এসব করেছে? হয়তো! সীমান্তও আজ তার পক্ষে কথা বলবে না। মাথা নিচু করে ফেলল শর্বরী।

-“আমার স্ত্রী কাল সম্পূর্ণ রাত আমার কাছেই ছিল। ও বাড়ি থেকে বের হয়নি। সম্ভবত এলাকায় কোনো মাথা পাগল লোক ঢুকেছে যে এসব করে বেড়াচ্ছে। রোজ রোজ আমার বাড়িতে এসে ঝামেলা না করে গলির মুখে একটা নাইটগার্ডের ব্যবস্থা করা উচিত। আপনারা যেহেতু আমার কাছেই আসছেন, গার্ডের ব্যবস্থা আমিই করে দিব। আর কিছু?”

আমেনার মুখ মলিন হয়ে এলো। সীমান্তর এমন জবাবের জন্য সে মোটেও প্রস্তুত ছিল না তবে সেও ছেড়ে দেওয়ার পাত্রী নয়।

-“বউকে বাঁচাতে নাটক করো না সীমান্ত। পাগল কেউ আমাদের দরজায় দরজায় টব ভাঙবে কেন?”

-“তাহলে আমার বউ কেন ভাঙতে যাবে?”

-“ও হয়তো ঘুমের ঘোরে..”

-“আপনি আমার বউকে ঘুমের মধ্যে হাঁটতে দেখেছেন কখনো? না জেনে কথা ছড়ানো বাদ দেন। আমার বউ এখন মানহানির মামলা করলে সবাই ফাঁসবেন, আপনারা রাজি তো সেসব ঝক্কি সামলাতে?”

উপস্থিত সবাই তখন একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে করতে ঘর থেকে বের হয়ে গেল। সীমান্তর বাবা-মাও আর দাঁড়ালো না সেখানে। সৌমিক হোস্টেলে ফিরেছে। বাড়ির এসব খবর তার কানে এখনো যায়নি। সীমান্ত নিজের ঘরে ফিরলো। ঠাই হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলো কেবল শর্বরী। প্রচণ্ড হতাশ অনুভব করছে সে।তার জন্য সবাইকে এভাবে অপমানিত হতে হচ্ছে। সীমান্তর সাথেও মন কষাকষি চলছে তবুও সে শর্বরীকে অপমানিত হওয়া থেকে বাঁচালো। নিজের প্রতি নিজের ঘৃণা হচ্ছে শর্বরীর।

সীমান্ত বেরোনোর পরপরই শর্বরী একটা চিঠি লিখলো সীমান্তর জন্য। কাঁচা হাতের এলোমেলো লেখা তার।

“সীমান্ত,

প্রথম দেখার নাটকীয় বিয়ে আমাদের। বোধহয় মায়ায় পড়েছিলেন অথবা করুণা করেছিলেন। এ করুণার প্রয়োজন ছিল না। আচ্ছা, মানুষকে ছাড়া কি খুব সহজ? আবার নিজের পছন্দের মানুষের পছন্দের মানুষের কথা জানতে পেরে মেনে নেওয়া কতটা সহজ? সহজ না তাই না? আমি বাবার বাড়িতে যাবো একটু। সরাসরি বলার সাহস হলো না। আমায় একটু একা থাকতে দিয়েন।”

চিঠিটা ড্রেসিং টেবিলের উপরে রেখে সালমা খানমের সাথে কথা বলে বেরোলো সে। মাথা ঘুরছে তার। শরীরটাও বড্ড দুর্বল মনে হচ্ছে। মানসিক অসুস্থতা তো আছেই।

__________

শর্বরীর উপস্থিতি বোধহয় ভালো লাগলো না আরজু বেগমের। চোখেমুখে কেমন এক ম্লানমেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে।

-“ভেতরে আসতে দিবে না মা?”

-“তু …তুই হঠাৎ এভাবে না বলে আসলি যে?”

-“বাবা কোথায়?”

-“তোর বাবা তো কাল কী এক ব্যবসার কাজে গেল। আয় ভেতরে আয়।”

শর্বরীর আশপাশটা অদ্ভুত রকমের লাগছে। মনে হচ্ছে কেমন একটা গা ছমছমে পরিবেশ যেন। নিচতলায় বসতে চাইছিল সে। হলঘরে বসতে যাবে তখনি তাকে আটকালো আরজু বেগম।

-“আরে এখানে বসিস না। এসব সাফ করবো আমি। উপরতলায় যা তুই। নাহলে চিলেকোঠার ঘরে বস।”

-“উপরে গরম মা, এখানে থাকি কিছুক্ষণ।”

-“না না, এসব ধোয়ামোছা করতে নিছি। কাজ হলে তুই নিচে আসিস।”

শর্বরী মায়ের কথায় সায় দিয়ে সিঁড়ির দিকে এগোতে যাবে তখনি দেখলো হলঘর বরাবর নিচতলার ঘরটার মাঝ বরাবর চেয়ার রাখা। ঘরের দরজা হালকা ভেজানো থাকায় স্পষ্ট দেখতে পেল না সে তবে তার অদ্ভুত লাগলো। আরজু বেগমের কথা উপেক্ষা করে সে ঘরে ঢুকতেই সে দেখলো ফ্যানের ওপর ওড়না গুটিয়ে রাখা। মায়ের দিকে তাকালো শর্বরী। আরজু বেগম শাড়ির আঁচল মুখে গুঁজে কাঁদতে লাগলেন। পরিস্থিতি বিবেচনায় হিতাহিতবোধশূন্য হয়ে পড়লো যেন শর্বরী। তার মা গলায় দড়ি দিতে যাচ্ছিল? মাকে জড়িয়ে কাঁদতে লাগলো সেও। আরজু বেগম এই প্রথম মেয়েকে সযত্নে বুকে স্থান দিলেন। মেয়ের কান্নায় তিনি খানিকটা ধাতস্থ হওয়ার চেষ্টা করলেন।

-“মা কী হয়েছে মা? এসব কী করতে যাচ্ছিলে তুমি?”

-“আমি অনেক বড় ভুল করেছি রে মা, অনেক বড় ভুল।”

-“মা আমাকে আগে ভালো করে বলো কী হয়েছে।”

-“বাবু …”

-“কী করছে শানজু ভাইয়া? ভাইয়ার কিছু হইছে মা?”

-“ও …ও বলছে আর দেশে আসবে না…”

-“তোমারে জ্বালানোর জন্য বলছে মা হয়তো। তুমি তাই বলে এসব পাগলামি করবা?”

-“বাবু দেশে আসার জন্য টাকা চাইছিল। তোর ভাগের জমি বেচে আমি ওরে টাকা দিছি।”

-“তাহলে ভাইয়া দেশে আসতে চাইতেছে না কেন?”

-“আরো টাকা চাইছে। পরে..পরে আমি তোর বাবার ঘুমের ঘোরে তার থেকে এ বাড়ির দলিলে সই নিয়ে বাড়ি বন্ধক রাখছি। সেই টাকা বাবুরে পাঠানোর পর ঐ বলে ঐ নাকি বিলেতি কোন মেয়েরে বিয়ে করছে! ওখানেই থাকবে এখন, আর আসবে না।”

-“কী! মা, বাবা এসব জানে?”

-“তোর বাবা জানলে আমাকে তালাক দিবে রে, আমি আর বাঁচতে চাই না রে। নিজের ছেলে আমারে এমনে ঠকাইলো! পেটে ধরছি ওরে, এই দান দিল তার? একটুও মায়ের কথা মনে হলো না ওর?”

হাউমাউ করে কাঁদতে থাকলো আরজু বেগম। শর্বরী কী বলবে বুঝতে পারছে না। তার কি নিজের জন্য একটু কষ্ট পাওয়া উচিত? তার মা তার অধিকারের সামান্যটুকু অংশটাও তার ভাইয়ের তরে কুরবানি করে ফেলেছে অথচ এখন সে ছেলেই তাকে পিঠ দেখিয়ে চলে গেল। এই ছেলের জন্য শর্বরীকে কখনো দীর্ঘকাল কোলে বসিয়ে আদর করেননি তিনি। শর্বরী ছোট হলেও সব আদর শানজুর জন্য বরাদ্দ ছিল। আজ সেই ছেলেটাই শর্বরীর পরিবার তছনছ করে গেল। শর্বরী দীর্ঘশ্বাস ফেললো। জীবনে দুঃখ ও বিপদ একসাথেই আসে।

চলবে…

#পান_পাতার_বউ
পঞ্চদশ_পর্ব
~মিহি

-“শর্বরী বলে যায়নি কিছু, মা?”

-“না তো। হাসিমুখে কেবল বললো একটু বাইরে যাবো মা। আমি ভাবলাম আশেপাশে কোথাও যাবে। তোকে জানায়নি কিছু?”

-“নাহ!”

-“ওর বন্ধুদের কাছে খোঁজ নে।”

-“ওর বন্ধুদের তো আমি চিনিনা।”

-“একবার বেয়াই-বেয়ানকে কল করে জিজ্ঞাসা কর তো! ওনাদের ওখানে গেছে কিনা। মা-বাবার কথা মনে পড়েছে বোধহয়।”

সীমান্ত আরজু বেগমের নম্বরে কল দিল। বেশ কয়েকবার রিং বেজে কেটে গেল। রাত প্রায় দশটা বেজেছে। এই সময় আরজু বেগমকে যদি সে প্রশ্ন করে শর্বরী সেখানে গেছে কিনা আর শর্বরী যদি না গিয়ে থাকে তবে মানুষদুটো অযথাই দুশ্চিন্তা করবে। দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়লো সীমান্ত। আরজু বেগম কল ধরলেন না। সীমান্ত কী করবে কিছুই বুঝতে পারছে না। শর্বরীর পরিচিত আর কাকে চেনে সে? ঠিক সেসময় মাথায় এলো শর্বরীর ফুপু আলেয়া বেগমের কথা।

-“মা, আলেয়া আন্টিকে একটু কল দাও তো। শর্বরী ওখানে গেছে কিনা!”

-“আচ্ছা দাঁড়া, ঘর থেকে ফোনটা আনি।”

সালমা খানম মুখে চিন্তার ভাঁজ ফেলে ঘরের দিকে এগোলেন। তার ঠোঁটের কুটিল হাসি এড়ালো সীমান্তর চোখ। সালমা খানম মনে মনে হাসছেন। চুল কি বাতাসে পাকে? অভিজ্ঞতায় পাকে! ফোন কানে ধরে কথা বলতে বলতেই বাইরে এলেন তিনি।

“তোর ওখানেও যায়নি, তাহলে কোথায় গেল? ওর বন্ধু আছে কোনো…আছে?…ছোটবেলার বন্ধু?…ছেলে? সে ছেলের ওখানে ও কেন যাবে রাত বিরাতে….কী বললি…ছোট থেকেই এমন করতো…এসব তো আগে বলিসনি…সকালে ফিরবে মানে কী? বাড়ির বৌ বাইরে রাত কাটিয়ে..ছেলেটা ওর প্রতিবেশী? তো বাপের বাড়ি না গিয়ে ছেলের বাড়িতে যাবে কেন?….” সালমা খানম বেশ জোরে জোরে কথাগুলোর বলছেন। সীমান্ত কথার আগামাথা কিছু বুঝে উঠতে পারছেন না। সালমা খানম কল রেখে সীমান্তর দিকে এগিয়ে এলেন।

-“মা, কী হয়েছে?”

-“শর্বরী ওর বন্ধুর বাসায় গেছে। ওর বাবার বাড়ির এলাকাতেই নাকি বাড়ি। সকালবেলা সেখান থেকে বাবার বাড়িতে যাবে। এটা কেমন কথা যে মন খারাপ থাকলে ছোটবেলার বন্ধুর বাড়িতে যাবে যেখানে বন্ধু কিনা ছেলে!”

-“ছেলে বন্ধু? কে এটা?”

-“তা তো বললো না। ঐ ছেলের মা নাকি শর্বরীর দূর সম্পর্কের চাচী তাই সেখানে যায়।”

-“আমি এখনি যাবো।”

-“রাত বিরাতে এভাবে যাওয়াটা কেমন দেখায় না? তার চেয়ে ও কাল মায়ের বাড়িতে আসুক তারপর যাস। এভাবে পরের বাড়িতে গিয়ে নিয়ে আসলে দেখতে কেমন লাগবে না?”

সীমান্তর ভিতরে যে ক্রোধের আগুন দাউদাউ করে জ্বলছে তার আঁচ টের পেয়ে সালমা খানমের মন খানিকটা প্রফুল্ল হয়ে উঠলো। চেহারা সুরত সরল সোজা হওয়ার এই এক ফায়দা, মানুষজন অবিশ্বাস করতেই পারে না!

সীমান্ত জোরে জোরে কদম ফেলে নিজের ঘরের দিকে গিয়ে প্রকাণ্ড শব্দে কপাট লাগালো। সালমা খানম মুখ টিপে হাসলেন। সীমান্তর বাবা ঘুমোচ্ছে। রাতের খাবারের পরপর উনি ওনার ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুমান। জেগে থাকলে হয়তো সালমা এ নাটকটা সাজাতে পারতো না। শ্বশুরমশাই আবার বৌমা ভক্ত কিনা! সালমা খানম সত্তর দশকের একটা গান গুনগুন করতে করতে স্বামীর পাশে গিয়ে শুয়ে পড়লেন।

_______________________

-“এসব তুমি আমাকে বলতে পারতা আরজু! আমার আচরণে তোমার কখনো মনে হইছে আমি তোমারে তালাক দিতে পারি? বাড়ি বন্ধক রাখছো আমারে না কয়ে এটা ভুল করছো তবে টাকার জন্য জান দেওয়া মহাপাপ। আমি মাফ করতেছি তোমারে এইবার। টাকার ব্যবস্থা আমি করবোনি। দ্বিতীয়বার ঐ কুলাঙ্গারের কথা আমার সামনে তুমি পাড়তে আসবা না আর।”

-“আমার ছেলে এমনে আমারে পর করলো! যার জন্য সব সবকিছু ত্যাগ করছি আমি!”

শর্বরী দূরে দাঁড়িয়ে বাবা-মায়ের কান্না দেখছে। এই মানুষগুলোর প্রতি তার বড্ড অভিমান ছিল, অভিযোগ ছিল তবে আজ সব অশ্রুবাষ্পে উধাও হয়ে যাচ্ছে কী এক মায়াময় আকর্ষণে! শর্বরী সিদ্ধান্ত নিল পড়াশোনাটাতে মন দিতে হবে আবার। সীমান্তর কাছে ফিরতে তো হবেই তবে শক্ত-দৃঢ় হয়ে তবেই ফিরবে সে। বিসিএস নিয়ে চিন্তাভাবনার একটু আধটু শর্বরীর ছিল। এখন সেটাকেই লক্ষ্য ভাবতে হবে। বাবা-মাকে এ বয়সে আশ্রয়হীন হতে দেখতে পারবে না সে। চোখ বন্ধ করতেই সীমান্তর চেহারাটা অস্পষ্ট হয়ে ভেসে উঠে। শর্বরী চোখ খোলে, নিজের অসহায়ত্বে ঘৃণা জমেছে তার। বাবা-মাকে একটু একা থাকতে দিয়ে ঘরে আসতেই লক্ষ করলো সীমান্ত বারবার কল করছে। শর্বরীর ফোন সাইলেন্ট করা ছিল বিধায় সে টের পায়নি। শর্বরী ভাবলো সীমান্ত বোধহয় চিঠিটা পড়ে তাকে কল করেছে। কল রিসিভ করে নিজেই বলতে শুরু করলো সে।

-“চিঠিতে যা লেখা আছে সবটাই সত্যি।”

-“কোন চিঠি?”

-“যেটা আমি রেখে এসেছিলাম।”

-“আমি তো চিঠি পাইনি। আমি কত দুশ্চিন্তায় আছি জানো? কোথায় তুমি? ফোন ধরছিলে না কেন?”

সীমান্তর কাতর স্বরের মোহে ফের পড়ে শর্বরী। বিবাহ বন্ধনের টানটাও যে বড্ড দৃঢ়, অভিমান পুষে রাখতে বড্ড যন্ত্রণা হয়। শর্বরীর অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছে বুকে, সীমান্তর মিথ্যে ধরতে পারার সেই যন্ত্রণা টা।

-“আপনি যখন ডাক্তার আপুকে ভালবাসতেন, ওনাকেই বিয়ে করতেন। একটা বাচ্চাই কি সবকিছু?”

-“তুমি ভুল ওষুধ খাইছো নাকি? কে ডাক্তার আপু? আর আমি কেন তাকে ভালোবাসতে যাবো? আর কিসের বাচ্চা?”

-“সত্যি লুকিয়ে লাভ নেই। আম্মা বলেছে আমাকে। আপনার আর…তিথি আপুর কথা।”

-“মা? শর্বরী তুমি এতটা বোকা কেন? তিথির সাথে আমার বিয়ে মা ঠিক করেছিল, মা-ই ভেঙেছে। আমি তো কখনো ওর সাথে কথাও বলি নাই!”

-“আমি সত্যি জানি তবে এইসব মিথ্যের কি দরকার? আমাকে একটু একা থাকতে দিন। এমনিতেও বাড়িতে অনেক ঝামেলা চলছে।”

আর কিছু না বলেই কল কেটে দিল শর্বরী। সীমান্ত কিছু বলতে গিয়েও বলতে পারলো না। নিজের মায়ের উপর সন্দেহটা তার ভুলবশত হয়নি। পুলিশি প্রফেশনের একটা জাত আছে তো! মায়ের ফোনে কথা বলার ধরন দেখেই সীমান্ত বুঝেছিল তার মা ফেক কল করেছে কিন্তু তিথিকে ঘিরে কী ষড়যন্ত্র তিনি করেছেন তা মাথায় ঢুকছে না সীমান্তর। মায়ের সামনে শর্বরীর উপর রাগ করার নাটকটা চালিয়ে যেতে হবে। তবেই কিছু একটা জানা যাবে।

শর্বরী তিথির দেওয়া ওষুধটা নিয়ে ঘরে বসলো। শরীর প্রচণ্ড দুর্বল লাগছে। বালিশে মাথা এলিয়ে দিতেই প্রচণ্ড মাথাব্যথায় কাঁতরাতে লাগলো সে। অস্ফূটস্বরের গোঙানি শুনে শফিক সাহেব দরজা ধাক্কাতে লাগলেন। আরজু বেগমও উঠে আসলেন। উপায় না পেয়ে দরজা ভেঙে ভেতরে ঢুকলেন তারা। শর্বরী তখন মেঝেতে পড়ে কাঁতরাচ্ছে। মেয়ের এ অবস্থা দেখে শফিক সাহেব হিতাহিতবোধশূন্য হয়ে পড়লেন। আরজু বেগম চটজলদি আশেপাশের সবাইকে ডেকে আনলেন। এ মুহূর্তে পড়শীদের সাহায্য ছাড়া তারা এক অসহায় পিতা-মাতা কোনোক্রমেই নিজেদের ঠিক রেখে মেয়েকে সামলানোর সাহস করে উঠতে পারবেন না। শর্বরীর আর্তনাদে এই প্রথম আরজুর বেগমের কলিজায় চিড় ধরা যন্ত্রণা অনুভব হচ্ছে। শর্বরীর চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে। আশেপাশের সবকিছু দ্রুতই ঘোলা দেখতে শুরু করলো সে।

চলবে..