#পান_পাতার_বৌ
দশম_পর্ব
~মিহি
সীমান্তর দিকে চোখ তুলে তাকাতে পারছে না শর্বরী। অদ্ভুত এক লজ্জা ঘিরে ধরে আছে তাকে। সীমান্ত অবশ্য বিষয়টা নিয়ে ভালোই মজা নিচ্ছে। শর্বরী চুপচাপ বসে আছে। সীমান্ত তার গা ঘেঁষে বসে আছে।
-“কী হলো? এত চুপচাপ?”
-“এখানে আসাটা ঠিক হলো?”
-“এখানে তো তুরফা একা না, মোটামুটি পাড়ার সব বাচ্চা এসেছে। আড্ডা দিতে চেয়েছে, তুমি না তো আর করতে পারতে না।”
-“এখানে বাচ্চা কেউ না, টিনেজ সবাই আর অন্যরা যতই ভালো হোক, তুরফা যদি কিছু করে এখানে…”
-“শসস ..জান কিপ কোয়াইট। ওরা বসুক সবাই। তারপর যত কথা বলার আছে বলো।”
সীমান্তর মাতাল করা কণ্ঠের সম্মুখে প্রত্যুত্তর করার কিছু পেল না সে। সীমান্ত তাকে একহাতে জড়িয়ে রেখেছে। ছেলেটা কি তাকে একমুহূর্ত দূরে সরতে দেবে না?
-“সরুন। ওরা দেখলে কী ভাববে?”
-“ভাবুক যা ভাবার!”
সীমান্তর কথা শেষ হতে না হতেই এক ঝাঁক মেয়ে এসে বসলো। সীমান্ত খানিকটা ভ্রু কুঁচকালো। তুরফা কেমন একটা দৃষ্টিতে সীমান্তর দিকে তাকিয়েছে। এ দৃষ্টি বড্ড অস্বস্তিকর। আহ্লাদে আটখানা হয়ে সীমান্তর অপর পাশে বসলো তুরফা।
-“দুলাভাই, পরিচয় করিয়ে দিই। এটা নুর, লম্বা চুলওয়ালাটা সাথী আর ডানপাশেরটা অন্তরা, বামপাশেরটা লাভলী। সবচেয়ে খাটো যেটা ঐটা মিথি। আমাকে তো চেনেনই। আমি আপনার সবচেয়ে প্রিয় শালী, আধি ঘারওয়ালী! এরাও শালী আপনার।”
বলতে বলতে তুরফা আহ্লাদ করে সীমান্তর একহাত জড়িয়ে ধরার প্রচেষ্টা করতেই সীমান্ত সে হাতটা শর্বরীর হাতের ওপর রাখলো। তুরফা আর বিশেষ কিছু বললো না। সকলে গোল হয়ে বসলো।
“দুলাভাই, আপনি আপার প্রেমে কিভাবে পড়লেন?” অন্তরা প্রশ্ন করে বসলো। সীমান্ত প্রশ্ন শুনে হাসলো।
-“আমি তোমাদের আপার প্রেমে যে কিভাবে পড়েছি তা নিজেও বুঝিনি। হঠাৎ প্রেম বলে কথা! লাভ এট ফার্স্ট সাইট আর কী!”
-“লাভ এট ফার্স্ট সাইটেই বিয়ে? আপনাদের কাহিনী তো জোস। তা আপা তুমি কিছু বলবে না? দুলাভাইয়ের কথা?”
শর্বরী কিছু বলতে যাবে তার আগেই তুরফা লাফ দিয়ে উঠলো।
-“আরে আপু আর কী বলবে! যে হ্যান্ডসাম দুলাভাই আমাদের, আপুর বলতি তো এমনিই বান্ধ!”
-“সেটা তোমার আপুই বলুক শর্বরী। সেই বলুক আমার সম্পর্কে। তোমাকে তো বলতে বলা হয় নি।”
তুরফা অপমানবোধ করলো তবে গায়ে মাখালো না। শর্বরীকে শিক্ষা তো সে দেবেই। তাকে দেখিয়ে দেখিয়ে খুব তো দুপুরে কিস করা হচ্ছিল! সে বদলা তো নেবেই। অন্যান্যদের কথাবার্তায় আড্ডা জমতে লাগলো অল্প সময়েই। সীমান্তর নজর শর্বরীতেই আবদ্ধ।
-“এই সবাই ট্রুথ ডেয়ার খেলি?”
-“তুরফা, ভালো বুদ্ধি দিছিস! দুলাভাই, আপা খেলবেন?”
সীমান্ত শর্বরীর দিকে তাকালো। শর্বরী মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো। বোতল ঘুরানো হলো। সর্বপ্রথম বোতল সাথীর দিকে থামলো।
“এই আমি প্রশ্ন করবো সাথীকে!” নুর লাফ দিয়ে বলে উঠলো।
-“হ্যাঁ হ্যাঁ বল নে। তুই-ই কর প্রশ্ন, ট্রুথই নিলাম আমি।”
-“তুই কি ইদানিং আমার নয়ন ভাইয়াকে লাইন মারতেছিস? ভাইয়া ছাদে উঠলেই তোকেও দেখি ছাদে উঠিস। বল বল!”
উপস্থিত সবাই মুখ টিপে হেসে ফেলল। সাথী লজ্জায় হ্যাঁ না কিছু বলতে পারছে না।
-“বুঝে নিছি আমরা! তবে সাথী, নয়ন ভাইয়াও তোকে পছন্দ করে। লাড্ডু তুই একা খাচ্ছিস না।”
মুহূর্তেই সাথীর মুখে রাজ্যের খুশি এসে ভর করলো। শর্বরী অবাক চোখে দেখছে ওদের দুষ্টুমি। এই মেয়েগুলো ওর সাথে যথেষ্ট ফ্রি। তুরফার স্বভাব ভালো হলে তার সাথেও শর্বরীর সম্পর্কটা অন্যরকম হতো। দ্বিতীয়বার বোতল ঘুরানো হলো। এবার শর্বরীর কাছে গিয়ে থামলো। তুরফা বোধহয় এ সুযোগের অপেক্ষায় ছিল।
-“আপু ট্রুথ অর ডেয়ার?”
-“উমম..ট্রুথ।”
-“দুলাভাই ছাড়া তোমার দেখা সবচেয়ে হট পুরুষ কে?”
শর্বরী জানতো তুরফা এরকম কিছুই করবে। এ মেয়ের মাথায় এসব ছাড়া কিছুই নেই। শর্বরী সীমান্তর দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো।
-“আমার সাবেক প্রেমিক, তাওসীফ যোবায়ের, হি ইজ টু হট টু রেসিস্ট!”
উপস্থিত বাকিরা অবাক হলেও সীমান্ত হেসে উঠলো। সীমান্তকে হাসতে দেখে তুরফার মুখ মলিন হয়ে আসলো।
-“দুলাভাই হাসছেন? আপু তো তার এক্সকে হট বললো।”
-“তাওসীফ যোবায়ের আমারই নাম। আমিই তোমাদের আপুর সাবেক প্রেমিক। কিন্তু এখন অনেক রাত হয়ে যাচ্ছে। তোমরা যাও, আমরা দিনে কথা বলবো।”
সবাই মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো। তুরফাও গেল বাকি সবার সাথে যদিও তার মুখে রাজ্যের আঁধার নেমে এসেছে। সবাই যেতেই সীমান্ত শর্বরীর কোলে মাথা রাখলো। আজ আকাশে চাঁদটা বেশ সুন্দর দেখাচ্ছে। মেঘ আর চাঁদের লুকোচুরি চলছে।
-“শর্বরী, তুমি আজ একটা মারাত্মক ভুল করেছো।”
-“কী?”
-“তুমি একটা আগুনে পেট্রোল ঢেলেছো।”
-“আমি আবার কোন আগুনে পেট্রোল ঢাললাম?”
-“আমি জ্বলছিলাম। সেই জ্বলন্ত আগুনে ঢেলেছো। কিভাবে জানো?”
-“কিভাবে?”
-“মুখে বলা যাবেনা, করে দেখাই?”
শর্বরী দুপুরের ঘটনা মনে করে মুচকি হেসে পিছনে তাকাতেই খেয়াল করলো সিঁড়িঘরে কারো ছায়া। এই তুরফা এত বাড় বাড়বে আন্দাজ করেনি শর্বরী। এখন সে সীমান্ত আর শর্বরীর কথা শুনছে আড়াল থেকে? বজ্জাত কোথাকার! শর্বরীর চোখ অনুসরণ করে সীমান্তও দেখলো ছায়াটা তবে তাকে বিচলিত মনে হলো না।
-“দুপুরের ঘটনা রিপিট করার প্ল্যান করছো?”
-“মোটেও না!”
-“আমি করছি।”
শর্বরী কিছু বলার আগেই সীমান্ত অনেকটা কাছে এলো। ধুপধাপ শব্দে কেউ একজন সিঁড়ি বেয়ে নেমে গেল তৎক্ষণাৎ। শর্বরী খানিকটা হাসলো তবে সীমান্ত তখনো ভয়ানক চাহনিতে শর্বরীর চোখের দিকে তাকিয়ে আছে।
-“কী দেখছেন?”
সীমান্ত উত্তর দিল না। শর্বরী আবারো প্রশ্ন করলো। সীমান্ত কিছু না বলে শর্বরীর কোলে মাথা রেখে গুনগুন করে উঠলো,
“পৃথিবীর যত সুখ, যত ভালোবাসা,
সবই যে তোমায় দেব, একটাই আশা!
তুমি ভুলে যেও না আমাকে..
আমি ভালোবাসি তোমাকে ….”
শর্বরী সীমান্তর কপালে চুমু খেল। বিবাহিত জীবনের সূচনা বড্ড রঙিন লাগছে তার নিকট। এ বন্ধনের মায়াটা বড্ড অদ্ভূত। অনুভূতিগুলো বড্ড প্রখর, প্রগাঢ়।
-“তুমি ভালোবাসো আমাকে শর্বরী?”
-“না তো!”
-“বাসো না?”
-“উহু!”
-“একটুও না?”
-“না।”
-“এতটুকুও না?”
-“অনেক বেশি ভালোবাসি সীমান্ত, অনেক বেশি। যতটা বেশি ভালোবাসলে সব ফেলে কাউকে আপন করতে চাওয়ার তীব্র বাসনা মনকে আচ্ছন্ন করে ফেলে ততটা ভালোবাসি। বুঝলেন জনাব?”
-“জ্বী।”
শর্বরী কিছু বলতে যাবে তার আগেই নিচে শোরগোল পড়ে গেল।সীমান্ত শর্বরী কেউই বুঝে উঠতে পারছেনা কী হলো নিচে। এই তুরফা নিচে গিয়ে আবার কোনো ঝামেলা পাকালো কিনা কে জানে। সীমান্ত তাড়াহুড়ো করে উঠলো। শর্বরীও ওঠার সময় তাল সামলাতে না পেরে পড়ে যেতে ধরলো। সীমান্তর শক্ত হাত তাকে আষ্টেপৃষ্টে বেঁধে ফেললো বলে সে যাত্রায় রক্ষে! শর্বরীকে সাথে নিয়ে নিচে নামলো সীমান্ত। আরজু বেগম বিলাপ করছেন। শর্বরী কিছু বুঝে উঠতে পারছেন না কী হয়েছে। কেনই বা তার মা কাঁদছে? শর্বরীর চোখেমুখে অদ্ভুত একটা ভয় ফুটে উঠলো।
চলবে…
#পান_পাতার_বৌ
একাদশ_পর্ব
~মিহি
শর্বরীর অদ্ভুত লাগছে সবকিছু। একটা সোনার কানের দুল মূল্যবান তবে তার জন্য তার মা কখনোই মরাকান্না করার কথা না। বিষয়টা নিয়ে তেমন ঘাটার সময় পায়নি সে। শ্বশুরবাড়ি ফিরতে হয়েছে পরদিনই। সীমান্ত পরের সপ্তাহের কথা বলে পরদিনই বেরিয়েছে। সৌমিকও হোস্টেলে ফিরেছে। শ্বশুর শাশুড়িকে নিয়েই সময় কাটছে শর্বরীর। সালমা খানম অবশ্য তাকে খুব যত্ন করেন। ছোট বাচ্চার মতো খাওয়া শেষ হলে নিয়ম করে ঘুমোতে পাঠান দুপুরবেলা। রাতে ঘুমোনোর আগে বাদাম দেওয়া দুধ দিয়ে যান তবে কেন যেন শর্বরীর ঘুম আসেনা রাতে।সে হাজার চেষ্টা করলেও ঘুমাতে পারেনা। একবার ভাবলো দুপুরের ঘুমের কারণে বোধহয়। সিদ্ধান্ত নিল দুপুরে ঘুমাবে না। সেদিন আবার সালমা খানম তাকে সাথে নিয়ে দুপুরে ঘুমালেন। সেরাতেও নির্ঘুম বসে থাকতে হলো শর্বরীর। রাতের ঘুমের অভাবে শরীর দুর্বল হতে শুরু করেছে তার। সীমান্তর সাথেও যোগাযোগ হয়নি এর মধ্যে। সীমান্ত মানা করেছিল কল করতে। সব মিলিয়ে বড্ড অসহায় অনুভব করছে সে।
সীমান্ত ফিরলো ঠিক ঠিক সাতদিন পর। এসে দেখলো শর্বরীর শরীর অনেকটা দুর্বল।
-“তুমি কি আমার বিরহে খাওয়া দাওয়া ছেড়ে দিছো? এমন লাগতেছো কেন? আমি তো বলেছিলাম তাড়াতাড়ি ফিরবো।”
-“রাতে ঘুম হয় না কেন যেন। ডাক্তার দেখাবো ভাবছিলাম কিন্তু ..”
-“রেডি হও। এখনি যাবো ডাক্তারের কাছে।”
-“আপনি মাত্র আসছেন। ফ্রেশ হন আগে, পরে যাবো।”
-“তুমি কি মুখের কথায় মানবে নাকি কোলে করে নিয়ে যাবো?”
অগত্যা শর্বরী রাজি হলো। সালমা খানম তখন ছাদে ছিলেন। শ্বশুরকে বলে বের হলো সে। সীমান্ত শর্বরীর দিকে তাকিয়ে প্রচণ্ড মায়া অনুভব করছে। তার বউ অসুস্থ অথচ সে যোগাযোগটাও করতে পারেনি অবশ্য বিষয়টা একটু জটিল ছিল বটে।
ডাক্তারের সিরিয়াল এগারোটায়। এখন কেবল দশটা দশ। বসে থাকতে হবে অনেকটা সময়।
-“আমি বলেছিলাম আপনাকে ফ্রেশ হয়ে নিতে।”
-“এতদিন ডাক্তার দেখাওনি কেন?”
-“ভেবেছিলাম এমনিই ভালো হয়ে যাবে।”
সীমান্ত বিরক্তবোধ করলো। অসুস্থতা এমনিই ভালো হয়ে যাবে? একবার ডাক্তার দেখালে ডাক্তার কি রক্ত বের করে গিলে ফেলবে? কেন যেন মানুষ ডাক্তারের শরণাপন্ন হতেই চায় না! এগারোটা অবধি বসে থাকতে হলো না তাদের। ডাক্তার নবনী তাদেরকে ডাকলেন একটু পরেই। শর্বরী ঠিকমতো হাঁটতেও পারছে না। কোনো ডাক্তারের সামনে গিয়ে বসলো সে।
-“আপনি শর্বরী?”
-“জ্বী।”
-“স্টেরয়েড টাইপ কোনো মেডিসিন নেন?”
-“না।”
-“আপনার চোখমুখ দেখে মনে হচ্ছে। আপনার অসুবিধা বলুন।”
-“আমি কোনোভাবেই রাতে ঘুমাতে পারছি না। প্রচণ্ড ক্লান্ত লাগে।”
-“দিনে কতক্ষণ ঘুমান?”
-“তিন-চার ঘণ্টা।”
-“রেগুলার?”
-“আসলে আমার রিসেন্টলি বিয়ে হয়েছে। বিয়ের পর থেকে দিনে ঘুমানোর অভ্যেস হয়েছে।”
-“এটা আসলে নতুন জায়গায় এডজাস্ট হতে না পারা রিলেটেড সমস্যা। কিছু ঘুমের ওষুধ দিচ্ছি, রেগুলার নিয়েন।”
-“ডাক্তার ম্যাম, আমার আসলে ঘুমের মধ্যে হাঁটার অভ্যাস আছে।”
-“এটার জন্য মেডিসিন নেন আপনি?”
-“নিতাম, এখন অফ আছে।”
-“মেডিসিন কন্টিনিউ করেন আর শরীরের প্রপার টেক কেয়ার করতে হবে। নিজেকে প্রেশারাইজ করবেন না। নিউলি ম্যারিড তো তাই স্ট্রেস হওয়া স্বাভাবিক তবে চেষ্টা করবেন লাইট থাকার।”
ডাক্তারের বলা কথাগুলো মন দিয়ে শুনলো শর্বরী। সীমান্তও শুনলো তবে শর্বরী এডজাস্ট করতে পারছেনা এ কথা কোনোক্রমেই মানতে প্রস্তুত না সীমান্ত। মেয়েটা এ সংসারটাতে নিজেকে দারুণভাবে মানিয়ে নিয়েছে প্রথম থেকেই। তার কোনো অসুবিধা হলে সে নিশ্চিত সীমান্তর থেকে লুকাতো না। ডাক্তারের বলা ওষুধগুলো নিয়ে বাড়ি ফিরলো দুজনে। সালমা খানম ছেলেকে পেয়ে ফুরফুরে মেজাজে রান্না বসাতে গেলেন। শর্বরী সাহায্য করতে চাইলেও তিনি তাকে বিশ্রামে পাঠালেন। ঘরে এসে বসলো শর্বরী।
-“আপনি যে কেইসের জন্য গেছিলেন সেটা সলভ হলো?”
-“হ্যাঁ হয়েছে তবে খুনী কখনো ধরা পড়বে না।”
-“মানে কেন?”
-“একটা লম্বা কাহিনী! রাতে ঘুমানোর আগে শুনাবো। তখন কাহিনী শুনতে শুনতে ঘুমিয়ো।”
শর্বরী মাথা নাড়লো। সীমান্ত শর্বরীর কপালে আলতো করে চুমু খেয়ে ফ্রেশ হতে গেল। তার কাজ এখনো বাকি। ইরতাজ সাহেবের সাথে কথা বলতে হবে। একজন বাবার জানা উচিত তার মেয়ের জীবনে কী কী ঘটেছিল।
_____________
রাতের খাবার ও ওষুধ খেয়ে বিছানায় হেলান দিল শর্বরী। খানিকটা ঘুম ঘুম লাগছে তার। সীমান্ত তা দেখে আর কথা বাড়াতে চাইল না। মেয়েটা একটু ঘুমাক, দুই সপ্তাহ ধরে ঘুমাচ্ছে না! এমনকি নিজের বাবার বাড়িতে গিয়েও এক রাত কেটেছে মায়ের কান্না শুনতে শুনতেই। দরজার শব্দে শর্বরীর ঘুম নড়েচড়ে উঠলো। ঘুম ঘুম চোখে ওঠার চেষ্টা করতেই সীমান্ত তাকে থামিয়ে নিজে গেল দরজা খুলতে। দরজা খুলেই দেখলো সালমা খানম বাদাম দেওয়া দুধ এনেছেন শর্বরীর জন্য।
-“মা? সব আদর বৌমার জন্য? ছেলের জন্য কোথায়?”
-“ছেলে খেয়ে খেয়ে ইতোমধ্যে দামড়া হইছে। ঐ বাচ্চাটার খাওয়ার দিকে নজর দিস না তো এখন। এই গ্লাসটা আমার মেয়েটাকে দিবি। বাদাম দুধ খেলে মাথা ঠাণ্ডা থাকবে।”
-“যথা আজ্ঞা মাতা!”
দুধের গ্লাসটা শর্বরীকে দাল সীমান্ত। শর্বরী এক ঢোকে সবটা শেষ করে গ্লাসটা পাশে রাখলো। সীমান্ত লাইট অফ করে দিল। আলো বন্ধ থাকলে হয়তো শর্বরীর তাড়াতাড়ি ঘুম আসবে। দেখতে দেখতে ঘণ্টা দেড়েক সেভাবেই কেটে গেল। সীমান্ত ঘুমে চোখ তুলতে পারছে না অথচ শর্বরীর ঘুমই আসছে না!
-“শর্বরী,ওষুধ ঠিকমতো খেয়েছিলে?”
-“আপনার সামনেই তো খেলাম। আমার মনে হয় ভয়ানক কোনো রোগ হয়েছে। এজন্য আমি সুস্থ হতে পারছি না। আমি মেইবি আর বাঁচবো না।”
-“এক থাপ্পড় দিয়ে সবকটা দাঁত ফেলে দিব। কাল আবার যাবো ডাক্তারের কাছে। এখন আমার বুকে মাথা রাখো, আমি ঘুম পাড়িয়ে দিচ্ছি।”
শর্বরী সীমান্তর বুকে মাথা রাখলো। পরম আদরে সীমান্ত শর্বরীর চুলে হাত বোলাতে লাগলো। সীমান্তর চিন্তার বিষয়টা অন্য জায়গায়। শর্বরীর ঘুম আসত ধরেছিল তবে হঠাৎ ঘুম ছেড়ে যাওয়ার কারণ শুধু দরজার টোকার শব্দ তো হতে পারে না নিশ্চিত। সীমান্ত একদৃষ্টিতে পাশে রাখা দুধের গ্লাসটার দিকে তাকিয়ে আছে। এটা খাওয়ার পর থেকেই শর্বরীর অবস্থা খারাপ হচ্ছে। দুধ বা বাদামে কোনো সমস্যা নেই তো? সীমান্তর মনে নানা প্রশ্ন উঁকি দেয়। শর্বরী চোখ বন্ধ করে সীমান্তর স্নেহমাখা হাত উপভোগ করে। তার একটুও ঘুমোতে ইচ্ছে করছে না বরং খোলা চোখে সীমান্তর দিকে সারাক্ষণ চেয়ে থাকতে ইচ্ছে করছে। এক সপ্তাহ তাকে দেখতে না পাওয়ার যন্ত্রণা যেন একদিনে মেটাতে চাইছে সে।
-“এভাবে কী দেখছো বউ?”
-“আপনি কাছে থাকলে শুধু আপনাকেই দেখে যেতে ইচ্ছে করে। ঘুম-টুমের প্রয়োজন নেই আমার।”
-“মার দিব! চোখ বন্ধ করো। সকালে দেখো মন ভরে।”
শর্বরী মুচকি হেসে অনেকটা জোর করেই চোখ বন্ধ করলো তবে তাতে বিশেষ কোনো লাভ হলো না বরং মায়ের সেই রাতের আর্তনাদ তার চোখের সামনে ভেসে উঠলো। শর্বরী জানে তার মা দুল হারানোর বেদনায় কাঁদেননি কিন্তু কেন কেঁদেছেন তাও তো জানেনা সে। সবকিছু কেমন যেন গুলিয়ে যাচ্ছে। কোনো নির্দিষ্ট সমাধানে পৌঁছাতে পারছেনা সে। না পারছে নিজের সাথে কী হচ্ছে তা অনুধাবন করতে আর না পারছে আশেপাশের ঘটনাগুলো পরখ করতে। অনুসন্ধানী চোখদুটো আজ বড্ড ক্লান্ত শর্বরীর অথচ কী নির্ঘুম এ দুই আঁখি! বড্ড যন্ত্রণার অনুভূতি!
চলবে…