পান পাতার বৌ পর্ব-১২

0
110

#পান_পাতার_বৌ
দ্বাবিংশ_পর্ব
~মিহি

-“ঠিক আছো তুমি?”

সীমান্ত আলতো হাতে শর্বরীর কাঁধে হাত রেখে তাকে সামলালো। শর্বরীর মাথা ঘোরাচ্ছে তখনো। সম্ভবত নেশাজাতীয় কিছুই স্প্রে করেছে তাকে আলেয়া বেগম। তাতে শর্বরীর বিন্দুমাত্র রাগ লাগছে না বরং সমস্ত মায়া গিয়ে পড়ছে ফুপুর উপর। মানুষটা কত অত্যাচার সহ্য করে এসেছে তা শুনেও গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠেছে শর্বরীর।

-“সীমান্ত, ফুপুকে কোথাও নিয়ে যাবেন না প্লিজ।”

-“উনি সারেন্ডার করেছে শর্বরী। তাছাড়া উনি তোমাকে মারার চেষ্টা করেছে।”

-“উনি আমাকে মারতো না সীমান্ত, আপনারা ভুল বুঝছেন।”

সীমান্ত কিছু বলার আগেই আলেয়া বেগম শর্বরীকে ইশারা দিয়ে ডাকলেন। শর্বরী এগোলো ফুপুর দিকে। সীমান্ত নিষেধ করলেও সে শুনলো না।

-“শর্বরী, আমি যা করছি করতে দে। এসবে নাক গলাস না। এই নে চাবি, আমার ঘরের আলমারিতে টাকা আছে। বাড়ি ছাড়িয়ে নিস আর এসব আমি ভাইয়ের জন্য করছি। ওনার দোষ ছিল না তাই! ভালোমতো সংসার কর, আমাকে নিয়ে মোটেও মাথা ঘামাস না।”

শর্বরী কিছু বলার আগেই চাবিটা তার হাতে ধরিয়ে দিয়ে আলেয়া বেগম লেডি কনস্টেবলের সাথে চলে গেলেন। শর্বরীর চোখ বেয়ে অশ্রু গড়াচ্ছে অবিরত। হাতের পিঠ দিয়ে তা মুছে সীমান্তর কাছে এসে দাঁড়ালো সে।

-“ফুপুর কোনো দোষ নেই।”

-“উনি নিজে থেকে সারেন্ডার করেছে। এখন বাকিটা কোর্টের সিদ্ধান্ত তবে আমার মনে হচ্ছে উনি কোনো মানসিক ব্যাধিতে ভুগছেন। আমি চেষ্টা করবো ওনার চিকিৎসার ব্যবস্থা করার।”

-“ফুপুই আপনাকে এখানে আসতে বলেছে?”

-“না। তোমার ফোন অটোম্যাটিকালি রিসিভ হয়েছিল। তারপরের সবগুলো কথা আমি শুনেছি। লোকেশন ট্র্যাক করে আসতে আসতে একটু লেট হয়েছে আর কী!”

শর্বরী আর কিছু বললো না। তার কিছু বলতে ইচ্ছেও করছে না। নিজের মায়ের উপর তার অভিমান ছিল এককালে কিন্তু এখন যে ক্রোধ কিংবা ঘৃণা জমেছে তার বোধহয় অন্ত নেই।

-“আমাকে একটু বাবার ওখানে রেখে আসতে পারবেন?”

-“এই অবস্থায়? বিশ্রাম নিয়ে সুস্থ হও একটু। ঐ ওষুধের প্রভাব এখনো কাটেনি বোধহয়।”

-“বাড়িতে যেতে যেতে কেটে যাবে।”

-“আচ্ছা বেশ। চলো”

শর্বরী চুপচাপ। তার মুখে রাজ্যের উদাসীনতা ভর করেছে যেন। সীমান্ত চাইলেও কিছু বলতে পারছে না। শর্বরীরন কেন খারাপ তা তো সে জানে আর এ মুহূর্তে সান্ত্বনা দেওয়ার কোনো ভাষা সীমান্তর কাছে নেই। তবুও সীমান্ত শর্বরীর হাতে হাত রেখে এটুকু বোঝানোর চেষ্টা করলো যে সব পরিস্থিতিতে সে তার পাশে আছে।

__________

চাবিটা বাবার হাতে দিল শর্বরী। মেয়ে হঠাৎ বাড়ি থেকে যাওয়ায় শফিক সাহেব এমনিতেই দুশ্চিন্তায় ছিলেন কিন্তু এখন মেয়ের মুখাবয়ব দেখে তিনি আরো দুশ্চিন্তায় জর্জরিত হয়ে পড়লেন।

-“এটা কিসের চাবি মা?”

-“এটা ফুপুর আলমারির চাবি বাবা, ওখানে টাকা আছে। তোমরা সেখান থেকে টাকা নিয়ে বাড়িটা ছাড়িয়ে নাও।”

-“আলেয়া এত টাকা পেল কোথায়?”

-“মা যে টাকা ভাইকে দিয়েছে তার অর্ধেক ফুপুর কাছে ছিল। ফুপুকে পুলিশ ধরেছে। কেন ধরেছে সেসব জিজ্ঞাসা করো না তবে একটা প্রশ্ন অবশ্যই করবে, তোমার স্ত্রীকে। তাকে প্রশ্ন করবে তার বিয়ের পর যদি তার দেবর এবং চাচা শ্বশুর তাকে পালাক্রমে ধর্ষণ করতো তবে সে কী উপায়ে মানিয়ে নিতো?”

-“শর্বরী!”

শফিক সাহেব হাত উঁচু করেও নামিয়ে ফেললেন। মেয়ের মুখে এ হেন কথা শুনে তিনি কিছু বলার ভাষা খুঁজে পাচ্ছেন না। শর্বরী হঠাৎ তাকে এমন কথা কেন বললো?

-“এসব কেমন কথা বলছিস তুই আর আলেয়া পুলিশের কাছে কেন? কেন সব ঘোলা করছিস? পরিষ্কার করে বল।”

-“আমি আর কিছু বলতে চাই না বাবা। আমার আর এক মুহূর্তও এ বাড়িতে দাঁড়িয়ে থাকতে ইচ্ছে করছে না। তোমার কখনো মন চাইলে ও বাড়িতে গিয়ে আমায় দেখে এসো। আমি আসছি।”

শফিক সাহেব কিছু বলার সুযোগটাও পেলেন না। শর্বরী ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। উঠোনে সীমান্ত দাঁড়িয়ে ফোনে কিছু একটা করছে। শর্বরীর প্রচণ্ড যন্ত্রণা হচ্ছে। সত্য বরাবরই নিষ্ঠুর! শর্বরী সীমান্তর দিকে আসার সময় খেয়াল করলো তুরফা বাড়ির ছাদে দাঁড়িয়ে সীমান্তর দিকে বেহায়া দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। এমনিতেই প্রচণ্ড যন্ত্রণায় শর্বরীর মাথা ঘোরাচ্ছে, ওষুধের প্রভাবে শরীরটাও অবশ হয়ে আসছে তার উপর এ দৃশ্য দেখে তার প্রতিটি শিরা-উপশিরায় ক্রোধ গতিশীল হতে শুরু করে। সীমান্তর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে সীমান্তর চুলের ভাঁজে হাত ঢুকিয়ে সীমান্তর ঠোঁটে দীর্ঘক্ষণের একটা চুমু খেয়ে জ্ঞান হারায় শর্বরী। ঘটনার আকস্মিকতায় সীমান্ত তখন হতভম্ব। ছাদে থাকা তুরফা কি আর থাকে সেখানে? সে ছুটে নিচে চলে গেছে। সীমান্ত বুঝতে পারলো ওষুধের প্রভাবে শর্বরী জ্ঞান হারিয়েছে। এ অবস্থায় তাকে নিয়ে আবার ফিরে যাওয়া সম্ভব না। শর্বরীকে কোলে নিতেই শফিক সাহেব ছুটে বাইরে এলেন। সীমান্ত দীর্ঘশ্বাস ফেললো। ভাগ্যিস দশ সেকেন্ড আগে আসেননি!

-“শর্বরী, মা আমার, কী হলো তোর? সীমান্ত বাবা, কী হলো আমার মেয়ের?”

-“আঙ্কেল জ্ঞান হারিয়েছে, চিন্তা করবেন না। ট্রাভেল করে ক্লান্ত তো, ঘরে গিয়ে বিশ্রাম নিলেই ঠিক হয়ে যাবে।”

-“এসো এসো ওকে ঘরে নিয়ে এসো।”

সীমান্ত শর্বরীকে বিছানায় শুয়ে দিল। মেয়েটার মুখ এখনো শক্ত হয়ে আছে। রাগ কি কমেনি?

শফিক সাহেব মেয়ের ঘর থেকে বেরিয়ে আরজু বেগমকে খুঁজতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। আরজু দরজার আড়াল থেকে শর্বরীর কথা শুনেছে। নিজের পাপের কথা স্মরণও হয়েছে তার। চাইলেই আলেয়াকে ঐ নরক থেকে বের করে আনতে পারতো সে কিন্তু সে তা করেনি, চেষ্টাও করেনি আলেয়াকে বাঁচানোর। শফিক সাহেবের কাছে কি জবাব দিবে সে? ভয়ে আত্মা কেঁপে ওঠে তার। তৎক্ষণাৎ শফিক সাহেব এসে তার মুখোমুখি দাঁড়ান।

-“শর্বরী কী বলছে আরজু? কী করেছো তুমি? কেন তোমায় প্রশ্ন করতে বলছে সে?”

আরজু বেগম কান্নায় ভেঙে পড়লেন। তিনি উত্তর দিতে পারলেন না, ক্রমাগত হিচকি উঠছে তার। শফিক সাহেব শর্বরীর কথাতে যেটুকু সন্দেহ করেছিলেন, এখন আরজু বেগমের এই কান্নার পর পুরোপুরি নিশ্চিত হলেন। প্রচণ্ড রাগ হলেও তা দমিয়ে রাখলেন তিনি। এত বছর সংসার করে এখন স্ত্রীকে চাইলেই তো আর ফেলে আসা যায় না কিন্তু ক্ষমা? তা কি করতে পারবেন? নিজের স্ত্রীর জন্য বোনের জীবন ধ্বংস হয়েছে জানার পর আদৌ ক্ষমা করা যায় তাকে?

-“তোমার সবচেয়ে বড় শাস্তি হবে আমার সাথে থাকা তবুও আমাকে চিরতরে হারিয়ে ফেলা।”

শফিক সাহেব ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। সীমান্তর সাথে কথা বলতে হবে তার। নিজের বোনকে আর কষ্ট পেতে দেখতে চাননা তিনি। বোনকে নিজের কাছে এনেই রাখবেন এখন। পরক্ষণেই শফিক সাহেব চিন্তা করেন কোন মুখে বোনের সামনে গিয়ে দাঁড়াবেন তিনি! নানান দ্বিধাদ্বন্দ্বে শফিক সাহেবের মনের জোর ক্ষয়ে আসে। যত যাই হোক, বোনকে তিনি নিজ বাড়িতে আনবেন এ ব্যাপারে তার আর সন্দেহ নেই। এখন প্রশ্ন এটাই যে আলেয়ার কাছে টাকাগুলো কেন এবং পুলিশই বা কেন তাকে গ্রেফতার করেছে। মেয়ের শরীর নিয়েও চিন্তিত শফিক। সব মিলিয়ে যেন ফাঁড়া কাটছেই না তার জীবনে। একটার পর একটা মুসিবত লেগেই আছে। বোধহয় বিধাতা মারাত্মকভাবে রুষ্ট হয়ে আছেন তার উপর নয়তো এতবার এতভাবে ধৈর্যের পরীক্ষা কেন দিতে হবে তাকে? শফিক দীর্ঘশ্বাস ফেলে। হতাশ, ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত শরীরটা উঠোনে এলিয়ে দিতেই চোখটা ঝাপসা হয়ে আসে। বোনের প্রতি হওয়া অবিচার মনে পড়তেই রক্ত গরম হয়ে উঠে। আরজুর উপর ভারি রাগ হয় তার। মেয়েমানুষ এতটা নির্দয় কী করে হতে পারে ভাবতেই তার গা শিরশির করে ওঠে।

চলবে…