পাপমোচন পর্ব-০১

0
294

#পাপমোচন (১ম পর্ব)
#আশিক_মাহমুদ

মাঝরাতে কলিং বেলের শব্দ শুনে দরজা খুলতেই দেখলাম বাইরে আপু দাঁড়িয়ে আছে। তার ডান হাতে একটা কালো রঙের ট্রলি ব্যাগ ধরা।
আটমাস আগে বোনের বিয়ের সময় ব্যাগটা আমি নিজেই পছন্দ করে কিনেছিলাম। আপুর চোখগুলো অসম্ভব রকমের লাল হয়ে আছে,আর নাকের পাটা ক্রমাগত কাঁপছে। এমনটা ঠিক তখনি হয় যখন আপু অনেক লম্বা সময় ধরে কান্না করে। তারমানে দুলাভাই-এর সাথে নিশ্চয় কোনোকিছু নিয়ে ঝামেলা হয়েছে।

অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম,’ আপু তুমি এত রাতে!’

কথার উত্তরে আপু ঝাঁঝালো স্বরে বললো,’ কেন আসতে পারিনা? তোদের সমস্যা হলে বল এখান থেকেই ফিরে যাচ্ছি আবার।’

আপুর এমন আচরণ এর আগে কখনো দেখিনি আমি। একটুর জন্য আপুকে আমার সম্পূর্ণ অচেনা মনে হলো। বললাম,’আরেহ্ কি বলো! আসো ভিতরে আসো।’

আপুর হাতে ধরা বিশাল সাইজের ব্যাগটা আমার হাতে দিয়ে হনহনিয়ে ভিতরে ঢুকে গেলে আমি বোকার মত আপুর দিকে একবার তাকিয়ে তারপর ঘরের দরজা লাগিয়ে ব্যাগটা নিয়ে ভিতরে এগিয়ে গেলাম।

বাবা-মা দুজনেই তখনো সজাগ। ড্রইংরুমে বসে বসে টিভি দেখছিলেন। রাতে খাবার খাওয়ার পর বাবা-মা দুজনেই অনেক রাত অবধি টিভি দ্যাখেন। এতরাতে ব্যাগ সমেত আপুকে আসতে দেখে দুজনেই অবাক হয়ে গেলেন। তবে বাবা কিছু বুঝতে দিলেন না। মা বোকাসোকা মানুষ, বুঝে কম। তাই আগ বাড়িয়ে আপুর একা একা এতরাতে চলে আসার কারণ জানতে চাইতেই আপু বাবা-মাকেও ঠিক একইভাবে রাগান্বিত কণ্ঠে বললো,’ আমি আর ওই বাড়িতে যাব না। তোমাদের যদি আমাকে এবাড়িতে রাখতে সমস্যা হয় তাহলে বলতে পারো, আমার যেদিকে দুচোখ যাই আমি চলে যাচ্ছি।’

আপুর মুখে এহেন রুক্ষ কণ্ঠস্বর শুনে আমার মত বাবা-মাও অবাক হলেন। অবাক হওয়াটাই স্বাভাবিক,কারণ তাদের মেয়ে এতবছরে এই প্রথম তাদের সামনে উঁচু গলায় কথা বলছে। তাও কোনোরকম ভয় আর সংকোচ ছাড়ায়!

আপুর এমন আচরণে বাবা-মা দুজনেই দুজনার মুখ চাওয়াচাওয়ি করলো কয়েকবার। তারপর মা থতমত খেয়ে আবার আপুকে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলো ঠিক তখনি বাবা, মা’কে থামিয়ে দিয়ে নরম স্বরে আপুর দিকে তাকিয়ে বললেন,’ আচ্ছা ঠিক আছে৷ এতটা পথ এসেছো,আগে ফ্রেশ হয়ে নাও।’

আপু আর কিছু বললো না। আমার হাত থেকে ব্যাগটা একরকম ছিনিয়ে নিয়ে আপু তার রুমে ঢুকে পড়লো।

‘এতরাতে কেউ শ্বশুরবাড়ি থেকে একা একা এভাবে চলে আসে? একটাবার ফোন তো করতে পারতো। আর সুমনা এভাবে কথা বলছে কেন!’

কথাগুলো বলে জিজ্ঞাসূক দৃষ্টিতে বাবার দিকে তাকালো মা। বাবা মুখের ভাবটা খানিকটা গম্ভীর করে বললেন,’ থাক। এখন আর এসব নিয়ে মেয়েটাকে কিছু জিজ্ঞাসা করতে যেওনা আবার। মনে হয় রিয়াদের সাথে রাগারাগি করে চলে এসেছে। দেখি সকাল হোক,মেয়ের রাগটা একটু কমুক,তারপর না হয় সবটা শুনে জামাই বাবাজির কাছে ফোন করে তাকে আসতে বললেই হবে। তুমি গিয়ে একটু দ্যাখো, মেয়েটা কিছু খেয়ে এসেছে কি-না।’

বাবার কথা শুনে মা দমে গেলেন ঠিকি তবে তাঁর ভিতরের অস্থিরতা কমলো না। মা টিভি দেখা বাদ দিয়ে একটু পর আপুর রুমে গিয়ে ঢুকলো। তারপর কিছুক্ষণ পর আবার বিরস বদনে আপুর রুম থেকে বেরিয়ে এসে বাবার পাশে গিয়ে বসতেই বাবা জানতে চেয়ে বললো,’ কিছু বললো?’

‘কি আবার বলবে? মনে হয় জামাইয়ের সাথে রাগারাগি করে চলে এসেছে। বিছানায় বসে বসে কান্না করছে। তুমি একটাবার রিয়াদকে কল করে দ্যাখো তো।’

‘পাগল হয়েছো! এতরাতে কল করে জামাইকে এসব জিজ্ঞাসা করা যায় নাকি! থাক,এখন আর এসব নিয়ে ভেবে কাজ নেই। রাতটা যাক,কাল সকালে না-হয় রিয়াদকে ফোন করে একটাবার আসতে বললেই হবে। ততোক্ষণে মেয়েটারও রাগ পড়ে যাবে।’

মা এবার বাবার দিকে একরাশ বিরক্তি ভরা দৃষ্টি নিক্ষেপ করে সোফা ছেড়ে উঠে রুমে চলে গেলো।
আমি এতক্ষণ ড্রইংরুমের দোরগোড়ায় নিরব দর্শক হয়ে সবটা দেখছিলাম। বাবা আমার দিকে মুখ ফিরিয়ে বললেন,’ কিছু বলবি খোকা?’

আমি হকচকিয়ে উঠে বললাম,’ কোই না তো বাবা।’

তারপর নিজের রুমে চলে এলাম আমিও। তবে এভাবে হুট করে আপুর চলে আসাতে আর আপুর অন্যরকম আচরণ দেখে মায়ের মত আমার মনটাও খচখচ করছে। আপু তো এমন ছিলো না। হঠাৎ করে আপুর এমন পরিবর্তন! একটুর জন্য নিজের আপন বোনকেও চিনতে কষ্ট হচ্ছিলো আমার। তবে এতরাতে আপু ব্যাগ গুছিয়ে এ বাড়িতে চলে এসেছে মানে নিশ্চয় কোনো গুরুতর কিছু হয়েছে। কিন্তু দুলাভাই তো তেমন মানুষ নয়। তিনি তো আপুকে অনেক ভালোবাসেন। তাহলে কি এমন হলো,যে কারণে এই মাঝরাতে সবকিছু নিয়ে বাড়ি ছেড়ে চলে আসতে হলো আপুকে?

শুয়ে শুয়ে এসব ভাবছি হঠাৎ দোরগোড়ায় একটা পরিচিত কণ্ঠস্বর শুনে সেদিকে তাকালাম।
‘ভাই ঘুমাচ্ছিস?’

দোরগোড়ায় আপু দাঁড়িয়ে আছে। এখন তাকে বেশ খানিকটা স্বাভাবিক দেখাচ্ছে। আপুকে দেখে বিছানা ছেড়ে উঠে বসে বললাম,’ না আপু। ওখানে দাঁড়িয়ে আছো যে,ভিতরে আসো।’

আপু ধরা পায়ে ভিতরে প্রবেশ করে বিছানার একপাশে চুপটি করে বসলো। তারপর আমার ডান হাতটা তার দু’হাতের ভিতরে মুষ্টিবদ্ধ করে নিয়ে আমার চোখে চোখ রেখে বললো,’ আচ্ছা ভাই তোর আপু কি খুব খারাপ?’

কথাটা বলার সময় দেখলাম আপুর কণ্ঠস্বর জড়িয়ে আসছে। আমি আরেকটা হাত দিয়ে আপুর হাত দুটো ধরে বললাম,’ কে বলেছে তুমি খারাপ? আমার আপুর মত মেয়েই হয় না। আপু কি হয়েছে তোমার? রিয়াদ ভাইয়ার সাথে কিছু হয়েছে?’

আপু আমার কথার কোনো উত্তর দিলো না। নিষ্পলক দৃষ্টিতে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ, তারপর ফোঁস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,’ কিছুনা রে ভাই। জীবনে অনেক বড় রকমের একটা পাপ করেছিলাম,হয়তো এখন তারই প্রায়শ্চিত্ত করে পাপমোচন করতে হবে। আচ্ছা এখন ঘুমা। অনেক রাত হয়েছে।’

কথাগুলো বলে আপু যে পায়ে ঘরে প্রবেশ করেছিলো আবার সে পায়েই ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলো নিঃশব্দে। শুধু যেতে যেতে আমার মনের মাঝে একরাশ বিষাদের কালোছায়া আর কিছু অব্যক্ত প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়ে গেলো।

আপুর বলে যাওয়া কথাগুলো মনের ভিতরে একপ্রকার ঝড় তুলে দিয়ে গেলো আমার। আপুর কি হয়েছে? এমন তো তাকে কখনো দেখিনি। আপু কোন পাপের কথা বললো একটু আগে? আর কি প্রায়শ্চিত্ত করবে? এইভাবে আপুর চলে আসাটা নিছক শুধুমাত্র রিয়াদ ভাইয়ার সাথে মনোমালিন্য হতে পারেনা। নিশ্চয় অন্যকোনো কারণ আছে। যা আপু সবার আড়ালে আমাকে বলতে গিয়েও বলতে না পেরে চাপা দীর্ঘশ্বাস নিয়েই ফিরে গেলো আবার। কিন্তু কি?
এসব ভাবতে ভাবতে রাতে একটা সময় দু-চোখে ঘুম নেমে এলো আমার।

পরদিন সকালে মায়ের চিৎকারের শব্দে ঘুম ভাঙলো। হুড়মুড়িয়ে বিছানা ছেড়ে উঠতেই মায়ের বুক ফাটা আর্তনাদ কানে ভেসে এলো আমার। মা’কে এভাবে কখনো বিলাপ করতে শুনিনি আমি। বাবা সুস্থ আছেন তো? তাড়াহুড়ো করে বিছানা ছেড়ে ঘর ছেড়ে বেরুতেই বাবা-মা দুজনেই দেখতে পেলাম। মা আপুর রুমের দরজার সামনে উম্মাদের মত বিলাপ করছে,আর বাবা কাঁধ দিয়ে স্ব জোরে দরজায় ধাক্কা মারছে একের পর এক।

গতকাল রাতে আপু যে এই বাসায় এসেছে,তা মনে পড়তেই ভয়টা চাঁড়া দিয়ে উঠলো। দ্রুত পায়ে আপুর রুমের সামনে যেতে গিয়ে খোলা জানালায় চোখ পড়তেই থমকে গেলাম আমি। ঘুরে দাঁড়িয়ে জানালা দিয়ে ভিতরে তাকাতেই বুকটা ছ্যাঁত করে উঠলো। দেখলাম, আপুর প্রাণহীন শরীরটা সিলিংফ্যানের সাথে ঝুলে আছে!
চলবে…