#পাপমোচন (৬ষ্ঠ পর্ব)
-বি*ষ!
কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে কয়েকমূহুর্ত বাবার হাতের শিশিটার দিকে নির্বিকার চোখে চেয়ে রইলাম। বাবার শরীরে তখনো প্রাণের শেষবিন্দুটা দিপদিপ করে জ্বলছে। বাবার হাতের পালস চেক করতেই দেখলাম বাবা বেঁচে আছেন।
দু’জন বিষ পান করা মানুষকে নিয়ে কি করবো কোথায় যাব মাথায় কোনো কাজ করছে না। হিতাহিতজ্ঞান ভুলে চিৎকার দিয়ে আর্তনাদ করে উঠলাম ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়ে। চিৎকার করে প্রতিবেশিদের কাছে সাহায্য চাইতেই কয়েকমিনিটের ভিতরে অনেকেই তাঁদের সুখনিদ্রা ভেঙে ছুটে এলো বাড়ির সামনে। আমার তখন পাগলপ্রায় অবস্থা। উপস্থিত তাদেরকে বাবা-মায়ের বি*ষ পান করার কথা জানাতেই সবাই ধরাধরি করে অতি দ্রুত বাবা-মাকে হাসপাতালে নেওয়ার ব্যবস্থা করলো।
হাসপাতালে পৌঁছে ডাক্তার দু’জনকে পরীক্ষা করে নিয়ে জানালো, মা অনেকক্ষণ আগেই মারা গিয়েছে,আর বাবার অবস্থা খুবই ক্রিটিক্যাল। বাবা বাঁচবেন কি-না সিউর দিতে পারবেন না তারা।
মা আর বেঁচে নেই কথাটা শুনতেই হৃৎপিণ্ডে অসহনীয় যন্ত্রণা অনুভব হলো আমার। মনে হলো কেউ একসাথে সহস্র সুঁই বিঁধিয়ে দিয়েছে।
মা মারা যাওয়ার পর বাবাকেও বেশিক্ষণ ডাক্তারেরা বাঁচিয়ে রাখতে পারলো না। বিষ পুরো শরীরটাকে এমনভাবেই গ্রাস করে নিয়েছিলো বিষ তুলে ফেলার পরও বাবার শেষ রক্ষা হলো না। কয়েকঘন্টা পর দিপদিপ করে বাবার ভিতরে জ্বলতে থাকা প্রাণের শিখাটা দপ করে নিভে গেলো! সেই সাথে আমার গোটা দুনিয়াটাও। চোখের সামনে যেন সবকিছু ধোয়াশার চাঁদরে ঢেকে নিলো মুহুর্তেই।
চোখের সামনে বাবা-মায়ের বিষে নীল অথচ ফ্যাকাসে হয়ে যাওয়া নিষ্প্রাণ দুটো দেহ পাশাপাশি শুয়ে আছে। দুনিয়ার সমস্ত অভিযোগ,অনুরাগ যেন এখন তাদের ধরাছোঁয়ার বাইরে। হতবিহ্বলের মত বাবা-মায়ের দিকে তাকিয়ে আছি আমি। অসহ্য যন্ত্রনায় বুকটা ফেটে যাচ্ছে,কিন্তু মুখ ফুটে কান্না বের হতে চাইছে না। চোখ থেকে টপটপ করে নিরবে পানি ঝরছে অনবরত। চাপ চাপ রাশি রাশি কষ্টগুলো হৃৎপিণ্ডের চারপাশে জমতে জমতে বুকের বা পাশটা ভারি হয়ে উঠছে ক্রমশই।
জামাল চাচা পাশে এসে কাঁধে হাত রাখতেই নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলাম না।
জামাল চাচাকে জড়িয়ে ধরে ডুকরে কেঁদে ফেললাম।
‘চাচা আমার যে আর কেউ রইলো না! সব শেষ হয়ে গেলো আমার। আমার শেষ আশ্রয়স্থলটাও হারিয়ে ফেললাম শেষমেশ। সন্তান হিসাবে কি খুব ভারী হয়ে গিয়েছিলাম তাঁদের কাছে? কেন করলো এমনটা? আর কোনোদিনও কেউ খোকা বলে ডাকবে না আমায়। বাড়ি ফিরতে দেরি করলেও কেউ হায় হুতাশ করবেনা। আমাকে নিয়ে যে অভিযোগ করার মত আর কেউ থাকলো না আর।’
জামাল চাচা কিছুক্ষণ নির্বাক চোখে চেয়ে থেকে আমার কাঁধে তার শক্ত হাতটা চেপে ধরে বললো,’ বাবা-মা তো চিরকাল কারও বেঁচে থাকেনা। তবে হায়দার ভাই এমন কাজটা না করলেও পারতো। নিজেকে শক্ত করো,আমরা আছি তো।’
কথাগুলো বলার পর তার হাতের মাঝে থাকা সাদা চিরকুট টা আমার হাতে দিয়ে বললো,’ তোমার বাবার হাতে এই কাগজটা ছিলো।’
কিছুক্ষণ পর রিয়াদ ভাইয়া আর পরিবারের লোকজন এসে পৌঁছালো। তারপর হাসপাতালের কাজ শেষ হলে
সবাই মিলে সে রাতেই বাবা-মায়ের মৃত শরীর হাসপাতাল থেকে নিয়ে আপুর পাশে দু’জনকেই কবরস্থ করা হলো।
একই সুতোয় পর পর তিনজন মানুষ সুখনিদ্রায় ঘুমিয়ে আছে। অথচ আমার সুখটা কোথায়? আমি যে বড্ড একা হয়ে গেলাম। আপু হারানোর শোক কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই বাবা-মা’কেও চিরতরে হারিয়ে ফেললাম।
রাত তখন প্রায় শেষের দিকে। রিয়াদ ভাইয়া আমাকে সাথে করে তাদের সাথে নিয়ে যেতে চাইলে আমি না করে দিলাম। বাবা-মায়ের শেষ স্মৃতি টুকু ছেড়ে শহরে গিয়ে থাকা কোনভাবেই সম্ভব নয় আমার পক্ষে।
শেষ রাতটা কয়েকজন আমার পাশে থাকলেও ভোর হতেই আশপাশের সবাই যে যার মত করে চলে গেলো। রিয়াদ ভাইয়া যাওয়ার সময় অনেক জোরাজোরি করলো আমাকে তাদের সাথে নেওয়ার জন্য। কিন্তু যে বাবা তার শিকড় ছেড়ে কোথাও যেতে পারেনি আমি তার সন্তান হয়ে কীভাবে পারবো? অন্যথায় দিনের আলো ফুটতে রিয়াদ ভাইয়াও তার পরিবার নিয়ে আবার শহরে ফিরে গেলো। একাকী নিস্তব্ধ বাড়িটাতে আমি একা পড়ে রইলাম।
এক রাতের ব্যবধানে সব হারিয়ে এখন নিঃসঙ্গ আমি।
সবাই চলে গেলে উদ্ভ্রান্তের মত বাবা-মায়ের ঘরে ঢুকলাম আমি। বিছনার উপরে তখনো মায়ের শেষ স্মৃতি মুখ থেকে নিঃসৃত হওয়া লালার কিছু অংশ শুকিয়ে গিয়ে দাগ হয়ে ফুটে আছে।
বিছানায় বসে বাবার দেওয়া চিরকুট টা এবার দু হাতে নিয়ে খুলে ধরলাম।
ভাঙা ভাঙা হাতে কাগজের উপরে বাবার লিখে যাওয়া শেষ কয়েকটা কথা চোখে পড়লো,’ খোকা স্বার্থপর এই পৃথিবীর মানুষগুলো আমাদেরকে আর বাঁচতে দিলো না রে। ব্যাথার পাহাড়টা জমতে জমতে এতটাই ভারি হয়ে উঠেছিলো আর বইতে পারলাম না। ক্ষমা চাইবো না পারলে মাফ করে দিস আমাদেরকে।’
বাবার লিখে যাওয়া চিরকুট টা বুকের সাথে চেপে ধরে বিছানায় আঁচড়ে পড়ে পাগলের মত কাঁদতে লাগলাম হাউ হাউ করে। আমার যে আপন বলতে আর কেউ রইলো না বাবা। না পারলাম কারও ভাই হতে না পারলাম কোনো বাবা-মায়ের দায়িত্বশীল সন্তান হতে।
এরপর কেটে গিয়েছে একসপ্তাহ।
এখন দিনের বেশিরভাগ সময়টায় আমার বাবা-মা আর আপুর কবরের পাশে বসে থেকে কাটে।
গোটা পরিবারকে ওই অন্ধকার কবরে রেখে একা একা বাড়িতে কোনভাবেই মন টিকেনা আমার। শূন্য জনমানবহীন বাড়িটার সামনে গিয়ে দাঁড়ালেই সে যেন গিলে খেতে চায় আমাকে। জামাল চাচা এসে মাঝেমধ্যে জোর করে তাদের বাড়ি নিয়ে গিয়ে দু মুঠো খাওয়ার জন্য জোরাজোরি করলেও খাবারের উচ্ছিষ্ট আমার গলা দিয়ে নামতে চায় না। অদৃশ্য চাপা যন্ত্রনার আঘাতে সবকিছু ভোঁতা হয়ে গিয়েছে।
সামনে বাইশ তারিখে আপুর জন্মদিন। গত বছরেও সবাই কত আনন্দ করে আপুর জন্মদিন করেছিলাম। অথচ এই বছরে না আছে আপু আর না আছে আপুর মাথায় হাত দিয়ে দীর্ঘজীবী হও বলা সেই মানুষ দু’জন।
আপু মারা যাওয়ার পর থেকে আপুর ঘরটাতে আমি তেমনভাবে ঢুকিনি কখনো। তবে আজ খুব ঢুকতে ইচ্ছা করছে। দরজা খুলে ঘরটাতে ঢুকতেই আপুর শূন্যতাটা যেন আরও প্রবলভাবে ঘিরে ধরলো আমাকে। মনে হলো আজও সেদিনের মত আপুর নিথর দেহটা সিলিংফ্যানের সাথে ঝুলে আছে। সেই একজোড়া বিস্ফারিত চোখ,চিবুক পর্যন্ত নেমে আসা জিহ্বা বের করে আমার দিকে অসহায়ের মত তাকিয়ে আছে! আর বলছে,’ ভাইরে তুই পারলি না তোর আপুর খুনের বিচার করতে?’
কথাটা মনে আসতেই ভিতরটা কেঁপে উঠলো আমার। বুকে হাত চেপে ধরে ধির পায়ে এগিয়ে গেলাম দেওয়ালে ঝুলতে থাকা আপুর ছবিটার দিকে। কি সুন্দর হাস্যজ্বল আর মায়াভরা মুখ। অথচ এই মুখটায় মৃত্যুর পর ভয়ংকর হয়ে গিয়েছিলো!
আপুর ছবিটার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকার পর নিজের মনেই বলে উঠলাম,’ আপু তোমরা তো নিজেদের দুঃখ,কষ্টগুলো থেকে নিজেদের মুক্তি দিয়ে সবার আঁড়াল করে নিয়েছো। আমি কি করবো? তোমাদের দিয়ে যাওয়া বেদনার ভার বইতে বইতে আমিও যে অনেক ক্লান্ত। হয় আমাকে পথ দেখাও নয়তো তোমাদের কাছে নিয়ে নাও। একা একা যে পাহাড় সমান ব্যাথা আর সইতে পারছিনা।সেদিন যদি তোমাকে আরেকটু জোর করতাম কথাগুলো বলার জন্য তাহলে হয়তো আজ এইদিনটা দেখতে হতো না। সবকিছুর জন্য দায়ী আমি। আর সেই জন্যই এত কষ্ট দিচ্ছো সবাই মিলে তাই না?’
কথাগুলো বলতে বলতে আপুর ছবিটার গায়ে হাত দিতেই পেরেক থেকে খসে পড়ে ভেঙে গেলো ছবির ফ্রেমটা।
ছলছল চোখে ভাঙা ফ্রেমটা হাতে তুলতে গিয়ে ভাঙা কাচের টুকরোর মাঝে ভাজ হয়ে থাকা একটা কাগজের টুকরো দেখে থমকে দাঁড়িয়ে গেলাম।
ঝাপসা চোখে কাঁচের টুকরো গুলো সরিয়ে কাগজটা হাতে তুলে নিলাম, তারপর কাগজটা নিয়ে ধির পায়ে এগিয়ে গিয়ে বিছানার উপর বসে এবার কাগজটা খুললাম।
কাগজটা খুলতেই আপুর লেখা কয়েকটা লাইন চোখের সামনে ভেসে উঠলো, ‘ এই কাজগটা যখন কেউ পড়বে তখন হয়তো আমি আর বেঁচে থাকবো না। আমার সাথে ঘটে যাওয়া গত ছয় দিনের অমানুষিক নির্যাতন আর যৌন অত্যাচারের কথা ভাবলে আমার এখনো গা শিউরে উঠে। ঘৃণায় শরীর কাঁপতে থাকে তখন। এই ছয়টা দিন আমি অমানুষিক নির্যাতনের শিকার হয়েছি। এফ.কে কোম্পানির মালিক ফাইয়াজ হুসাইন সহ তার ড্রাইভার এমনকি বাড়ির কেয়ারটেকার পর্যন্ত আমাকে অপহরণ করার পর সবাই মিলে আমার শরীরটাকে নিজেদের ইচ্ছামত খুবলে খুবলে খেয়েছে। শরীরটাকে স্বইচ্ছায় তাদের কাছে সমর্পণ করিনি দেখে ড্রাগস ইনজেক্ট করে আমাকে মাতাল করে রাখতো সবসময়।
সারা শরীর জুড়ে প্রচন্ড ব্যাথা আর অমানুষগুলোর অমানুষিক আঁচড়ে দগদগে ঘা হয়ে উঠেছে। হয়তো কিছুদিন পর এই ঘা শুকিয়ে যাবে, সবাই সবকিছু ভুলে যাবে। কিন্তু আমার ভিতরের দাগ কোনদিনও ঠিক হওয়ার নয়। এই কলঙ্কের ভর আমি আর বইতে পারছিনা। প্রতিটা মূহুর্তে নিজের উপর হওয়া অন্যায় কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে আমাকে। আমি জানি এতবড় একটা মানুষের নামে বিচার দিয়ে কোন কাজ হবেনা। বরং সমাজ উল্টো আমার দিকেই আঙুল তুলে খারাপ মেয়ের তকমা লাগিয়ে দিবে।
দরজা খুলে যখন প্রথমবার ভাইটাকে দেখছিলাম,তখন জড়িয়ে ধরে নিজের ভিতরে থাকা সমস্ত গ্লানি ঝেড়ে ফেলতে চেয়েছিলাম। কিন্তু পারিনি। বাবা-মাকেও বলতে পারিনি কোনকিছু। হয়তো কোনদিনও বলতে পারবোও না। সবাই যখন এসব শুনবে তখন তাদেরকে আমি মুখ দেখাবো কীভাবে? একটু আগে সাহস করে ছোট ভাইটার কাছে গিয়েছিলাম সবটা তাকে বলে নিজেকে হাল্কা করার জন্য। কিন্তু বলতে পারিনি,নিজের উপর হওয়া পাষবিক অত্যাচারের কথা নিজের মুখে বর্ণনা করার মত সাহস আমার নেই। এই যন্ত্রনা থেকে আমি মুক্তি পেতে চাই,তাই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমার কারও প্রতি কোনো অভিযোগ নেই,অভিযোগ আমার নিজের উপরেই। কারণ আমি মেয়ে। এই শহরের অন্ধকারে আমার মত হাজারো নারী কলঙ্ক নিয়ে জীবন্ত লাশ হয়ে পড়ে আছে। তবে আমি পারলাম না,তাই সবার থেকে নিজেকে আড়াল করে নিচ্ছি।
বাবা-মা তোমরা পারলে আমাকে ক্ষমা করে দিও। এই নিষ্ঠুর পৃথিবী আমাকে বাঁচতে দিলো না।
ওহ হ্যাঁ আমার সাথে করে আনা লাগেজটার ভিতরে নাকি আমার কলঙ্ক মোছার জন্য কিছু টাকাও দিয়ে দিয়েছে! কি হাস্যকর তাই না? ওগুলো দিয়ে যদি কলঙ্ক মোছা যেতো তাহলে পৃথিবীর সমস্ত বেশ্যা মাথা উঁচু করে সমাজে ঘুরে বেড়াতো। চলে যাওয়ার আগে একটা কথায় বলবো, ভালোবাসার বলতে কোনকিছু নাই। সবটাই স্বার্থ। দীর্ঘজীবী হউক এই নিষ্ঠুর পৃথিবীর বেইমান মানুষগুলো।
বিদায় পাপের রাজ্য থেকে
আলবিদা….
লেখাগুলো পড়তে গিয়ে চোখ জোড়া জলে ভরে উঠলো আমার। আপু অন্তত আমাকে একটাবার তোমার মনের ভিতরের জমানো কষ্টগুলো খুলে বলতে। না জানি কতটা কষ্ট আর ক্ষোভ নিয়ে এই দুনিয়ার মায়া ত্যাগ করেছো তুমি। তবে তোমাকে যারা এভাবে অমানুষিক কষ্ট দিয়েছে সমাজের চোখে খারাপ বানিয়েছে তাদেরকেও তাদের পাপের ফল ভোগ করতে হবে।
আপুর লেখা চিঠিটা নিয়ে তৎক্ষনাৎ থানায় গিয়ে হাজির হলাম। তারপর চিঠিটা ওসি সাহেবের হাতে দিতেই তিনি পুরোটা পড়ার পর বললেন,’ যাক এতদিন পর একটা প্রমাণ হাতে এলো। এবার পালাবি কোথায় নরকের কিটগুলা। তোদের আর কোনো নিস্তার নেই। শ্রাবণ তুমি বাসায় যাও সন্ধ্যার আগেই সব-কয়টাকে ধরে হাজতে ঢুকানোর ব্যবস্থা করছি আমি।’
ওসি সাহেবের আশ্বাসবাণী শুনে বাড়ি ফিরে এলাম। তবে মনের মাঝে কোনো শান্তি নেই। চিঠিটা পেলাম ঠিকি কিন্তু সবকিছু হারানোর পর পেলাম। দুটো দিন আগে পেলেও হয়তো বাবা-মা’কে হারিয়ে অনাথ হতে হতো না আমাকে।
সন্ধ্যা সাতটা নাগাদ আবারও থানায় গেলাম আমি।
থানায় গিয়ে ওসি সাহেবের রুমে ঢুকতেই ওসি সাহেব আমাকে সাদরে ভিতরে আহ্বান জানালেন।
ভিতরে ঢুকেই জিজ্ঞাসা করলাম,’ স্যার আমার আপুর খুনিদেরকে গ্রেফতার করেছেন? কোথায় তারা?’
ওসি সাহেবের মুখে এবার ব্যাঙ্গাত্মের হাসি ফুটে উঠলো। হাসি থামিয়ে আমার কাছে এসে দাঁড়ালেন,তারপর বললেন,’ শোনো শ্রাবণ তোমাকে একটা কথা বলি, তোমার আপুর সাথে যা হয়েছে মানছি খুবই অন্যায় হয়েছে। কিন্তু ফাইয়াজ হুসাইনের মত একজন প্রভাবশালী মানুষ তোমার আপুর মত সাধারণ একজন নারীকে অপহরণ করেছে এই কথাটা কি কোনভাবে বাকিরা বিশ্বাস করবে?’
‘কেন বিশ্বাস করবে না স্যার, আপু তো মৃত্যুর আগে তার নিজের হাতে সবটা লিখে রেখে গিয়েছে।’
‘আচ্ছা একটা কথা বলো তো, তুমি বা তোমার পরিবারের কেউ ফাইয়াজ সাহেবকে চিনতে, বা তোমাদের কারও সাথে কোনরকমের পরিচয় ছিলো?’
‘না।’
‘তারমানে সে তোমাদের কাছে সম্পূর্ণ একজন অপরিচিত মানুষ। আর একজন অপরিচিত মানুষ যে কি-না শহরের নাম নামি ব্যক্তিদের ভিতরে একজন,সে কি-না অজ্ঞাত একজন নারীকে অপহরণ করিয়ে লাগাতার ছয়দিন ধর্ষণ করেছে! এমন কথা কি আদৌও বিশ্বাসযোগ্য? যার কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা,যার একটুখানি স্পর্শ পাওয়ার জন্য কত মেয়ে পাগল সেই মানুষটা কি-না তোমার আপুকে…
তোমার কি মনে হয় তোমার আপুর এই সামান্য একটা চিঠি তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে পারবে?
আরে ধোপেও টিকবে না। সবাই আরও মজা কুড়াবে তোমাদেরকে নিয়ে।’
‘তারমানে আপনি বলতে চাইছেন আমার আপু মরতে মরতে একজনার নামে মিথ্যা কথা লিখে গিয়েছে? স্যার আপনার কি মনে হয় একজন মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে যে কি-না কিছুক্ষণ পর ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করবে,তার ঠিক আগমুহূর্তে তার নিজের নামে এমন কুৎসা লিখে যাবে?’
‘সেটা তো বলিনি। তবে তার বিরুদ্ধে এমন ঠুনকো প্রমাণ দিয়ে কোনকিছুই হবেনা। তার থেকে বলি কি, জনগন তো এসব কবেই ভুলে গিয়েছে। তুমিও ভুলে যাও।
আমি ফাইয়াজ সাহেবকে বলে কিছু টাকার বন্দোবস্ত করে দিবো তাতে তোমার বাকি জীবনটা আয়েশ করে কাঁটিয়ে দিতে পারবে। কি দরকার খামখা এসবে জড়ানোর।’
ওসির কথাগুলো দাঁতে দাঁত চেপে ধরে শোনার পর বললাম, ‘তাদের জন্য আমার গোটা পরিবারটা শেষ হয়ে গিয়েছে। আপনি তাদেরকে না ধরে উল্টো আমাকে টাকার লোভ দেখাচ্ছেন? আমি টাকা দিয়ে কি করবো স্যার? টাকা দিয়ে কি আমার পরিবারটাকে ফিরিয়ে আনা যাবে?’
‘বি লজিক্যাল। বেকুবের মত কথা বলো কেন? যা হয়ে গিয়েছে তা নিয়ে পড়ে না থেকে ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করো।’
‘আচ্ছা স্যার চিঠিটা দেন।’
‘চিঠি দিয়ে কি করবা? শুনো ফাইয়াজ সাহেবের হাত অনেক উপর পর্যন্ত। তার সাথে পেরে উঠতে পারবেনা। আমার কথা শুনো, যা বলছি মেনে নাও।’
‘স্যার চিঠিটা দেন।’
চিঠিটা দিয়ে রুদ্ধশ্বাসে থানা থেকে বেরিয়ে এলাম। পাপিদের পাপের ঘড়া পূর্ণ হয়েছে৷ এবার পাপমোচনের পালা।
চলবে…
#আশিক_মাহমুদ