পায়ে পায়ে হারিয়ে পর্ব-১০

0
42
পায়ে_পায়ে_হারিয়ে
পায়ে_পায়ে_হারিয়ে লেখনীতে : তামান্না বিনতে সোবহান

#পায়ে_পায়ে_হারিয়ে
লেখনীতে : তামান্না বিনতে সোবহান
পর্ব – ১০

হুটহাট সিদ্ধান্ত নিয়ে চাকরি হারিয়ে অথৈজলে হাবুডুবু খাওয়ার অবস্থা হয়েছে আদিয়ানের। গত এক সপ্তাহ ধরে অসুস্থ শরীর নিয়ে, অনলাইনে-অফলাইনে সব জায়গায় কাজের সন্ধান করে যাচ্ছে। কোথাও কাজ মিলছে না। এত তাড়াতাড়ি নতুন চাকরি পাওয়া সম্ভব নয়। এই শহরে সেটা আরও বেশি কঠিন। উপায় মিলছে না, দিক হারানোর দশা তার। ঠিক কী করবে সেটাও ভেবে পাচ্ছে না আদিয়ান। আসিফ, ইমরুল, রিফাত এই তিনজনকে বলে রেখেছে, কোথাও যদি কোনো খোঁজ পাওয়া যায়, তাকে যেন জানায়। ঘরে বসে থেকে হাঁপিয়ে উঠেছে সে। রুমঝুম তার এই অলস-অকর্মণ্য আচরণ দেখে চায়ের কাপ বাড়িয়ে দিয়ে বলল,

‘এত বাহাদুরি দেখানোর দরকার ছিল না। জানোই, চাকরি এখন সোনার হরিণ। জেনে-বুঝে সেটা হাতছাড়া করতে গেলে কেন?’

মেজাজ ঠিক রাখতে চায়ে চুমুক বসালো আদিয়ান। বলল,
‘ওই লোকটা আমাকে অপমান করেছে।’

‘মিথ্যে তো কিছু বলেননি উনি। তুমি অলরেডি তার মেয়ের প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছ। দু’জনার মধ্যকার তফাৎ নিয়ে নিজেও চিন্তায় অস্থির হয়ে যাও। ওনার সন্দেহটা তো মিছেমিছি না।’

‘সন্দেহ করুন, সেটা নিয়ে রাগ নয়। উনি আমাকে ছোটোলোক বলেছেন। কথাবার্তা দিয়ে এটাই বুঝিয়ে দিয়েছেন, আমি ওনার মেয়ের যোগ্য নই। আমার ইগোতে লেগেছে। তাই রিজাইন দিয়ে এসেছি।’

‘কিন্তু এখন, কী করবে? মেয়েটাকে তো তুমি অনুভব কোরো, এটা তো আর মিথ্যে না।’

‘একতরফা অনুভূতি সারাজীবন অপ্রকাশ্যেই বাঁচিয়ে রাখা যায়, ঝুম। আমার অনুভূতিটাও আমি ঠিক এইভাবেই বাঁচিয়ে রাখব। ভালোবাসার বিনিময়ে ভালোবাসা পেতেই হবে এমন কোনো যুক্তিতে আমি বিশ্বাসী নই। কিছু ভালোবাসা অপ্রকাশ্যে ও একতরফা অনুভবেই সুন্দর।’

এই নিয়ে আর কথা বাড়াল না রুমঝুম। শুভর কথা জানতে চেয়ে বলল,
‘তুমি তো বলেছিলে ওই ঠিকানায় যাবে। গিয়েছিলে?’

দূরবীন দিয়ে খুঁজেও কানা জব্বারের লোকেশন পাওয়া যাচ্ছে না। জাদীদ খুব সিরিয়াস হয়ে এই কেসটা দেখছে। সেদিন ফোন নম্বর নিয়ে রাজশাহীর ওই থানাতে সে যোগাযোগ করেছিল। এস আই এর কাছে শুভর কথা জিজ্ঞেস করলে এস আই বলেছিল,

‘ওনাকে তো পুলিশ হাতে-নাতে ধরেছিল। ব্যাগের মধ্যে হিরোইন পাওয়া গেছে। যদিও উনি অস্বীকার করেছিলেন, কিন্তু তবুও… প্রমাণস্বরূপ পাওয়াতে আইন তাকে শাস্তি দিয়েছে।’

এরপর জাদীদ কানা জব্বারের কথা জানতে চাইলে এস আই জানিয়েছিল,
‘লোকটা এখানকার চেয়ারম্যান। বেশ ভালো নামডাক। ওনার তরফ থেকে জামিনের নোটিশ এসেছিল। উনি তাকে নির্দোষ দাবী করে ছাড়িয়ে নিয়ে গেছেন।’

‘লোকটা কি আসলেই কানা? চোখে দেখে না?’

‘শুনেছিলাম, ছোটোবেলায় চোখে একটা অপারেশন হয়েছিল, এরপর থেকে একটা চোখে কম দেখেন। সবসময় সানগ্লাস ব্যবহার করেন।’

‘আমি কি ওনার সাথে দেখা করতে পারব?’

‘জি, স্যার। অবশ্যই পারবেন। আপনি কবে দেখা করতে চান?’

‘আগামীকালই আসতে চাইছি।’

‘ওকে স্যার…।’

পরেরদিনই রাজশাহী ছুটে গিয়েছিল জাদীদ। কিন্তু দুর্ভাগ্য কানা জব্বারকে পেয়েও তার বিরুদ্ধে কোনো প্রমাণ না থাকায় অ্যারেস্ট করা সম্ভব হয়নি। গ্রামের মানুষের সবার চোখে এই কানা জব্বার ফেরেশতার ন্যায়। যাকেই জিজ্ঞেস করে, সে-ই বলে, লোকটার মতো ভালো মানুষ আর একটাও নেই। যখন দেখা করতে গেল, তখন তার নিজেরও এটাই মনে হলো। সাদা জুব্বা পরিহিত বিশালদেহী জব্বার সাহেব দিনরাত তসবীহ হাতে নিয়ে ঘুরেন। কথা বলতে বলতে তসবীহর সবকটা গোটা শেষ করে ফেলেন। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়েন। মসজিদে ইমামতি করেন। তাকে দেখে অপরাধ জগতের লোক মনেই হয় না। তাছাড়া, তিনি গ্রাম ছেড়েই বের হোন না। দূরে কোথাও ভ্রুমণে যান না। দু’বছর আগে হজ্ব করে এসে সেইযে গ্রামের মানুষের সেবায় নিজেকে ব্যস্ত করে ফেললেন, এখনও তাই আছেন। ভদ্রলোকের সাথে দেখা করে, কথা বলে জেনেছিল, শুভকে সুস্থাবস্থায় তার বাড়িতেই পৌঁছানো হয়েছে। সেই বাড়িতে গিয়ে খোঁজ নিলে শুভর বাবা-মা বললেন, একদিনের জন্য বাড়িতে এসেছিল সে, এরপর থেকে আবার লা-পাত্তা। ফোনটোন ব্যবহার করে না। কোথায় গেছে, কেমন আছে, তারা কিচ্ছু জানেন না। পুরোদিন, তারপর দিন, মোট তিনদিন ওই গ্রামের আশেপাশে ঘুরঘুর করেও শুভর নাগাল পাওয়া যায়নি। কোথায় যে গেল! এসব থেকে জাদীদ নিশ্চিত হলো, কানা জব্বার দু’জন। একজন হলে ঢাকায় যার প্রভাব তার রাজশাহী থাকার কথা নয়। আর রাজশাহীর এই কানা জব্বার যদি খারাপ লোক হতো, থানায় তার নামে অভিযোগ থাকত। এত হিসাব-নিকাশ করতে গিয়ে ফলাফল এসে দাঁড়াল শূণ্যের কোঠায়। কোনোভাবেই সূত্র মিলাতে পারল না সে। খালি হাতেই ফিরে এসে সব ঘটনা আদিয়ানকে জানাল।

এত কথা রুমঝুমকে বলেনি আদিয়ান। আজও বলতে ভয় হচ্ছে। দিনরাত এক করে খুঁজেও শুভর কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। বাড়ি গিয়ে বাবা-মায়ের সাথে দেখা করল, কথা বলল, অথচ রুমঝুমের সাথে একবার যোগাযোগ করল না, এটাই মিলাতে পারছে না সে। কথা খুঁজে না পেয়ে আমতা-আমতা করে আদিয়ান বলল,

‘গিয়েছিলাম, কিন্তু পাইনি।’

রুমঝুমের মনে এখন একটাই ভয়, শুভ বেঁচে আছে তো? ভাবতে গিয়ে চিন্তা ঢুকে গেল তার। মানুষটাকে ছাড়া কিছু ভাবাই যায় না। আর ভালো থাকা, সেটা তো জীবন থেকে না-ই হয়ে গেছে। সে নিজেকে সামলাতে কাজের অজুহাতে সরে গেল দূরে। আদিয়ানের ফোন বাজলো। স্ক্রিনে ভাসলো ইমরুলের নম্বর। ফোন রিসিভ করতেই ইমরুল বলল,

‘শরীর ভালো আছে এখন?’

‘মোটামুটি।’

‘তুমি তো চাকরি খুঁজছ, তাই না?’

‘হ্যাঁ, পেয়েছ কিছু?’

‘টিউশনির অভিজ্ঞতা আছে?’

‘স্টুডেন্ট লাইফে হাতখরচ টিউশনি থেকেই যোগাড় করেছি।’

‘তাহলে তো ভালো। আমার কোম্পানির বস তাঁর দুটো মেয়ের জন্য ভালো একজন টিউটর চাইছেন। বাসা, বেশি দূরে না। তোমার বাসা থেকে দশ থেকে পনেরো মিনিটের রাস্তা। মেয়ে দুটো ক্লাস টেনে পড়ে। ফাইনাল এ্যাক্সামের জন্য ওদের ভালো প্রস্তুতি দরকার।’

‘কবে থেকে যেতে হবে?’

‘আজ তো রবিবার। আগামী সপ্তাহ থেকে আই মিন, শনিবার থেকে যাও।’

‘টাকা-পয়সা নিয়ে কিছু আলাপ করেছ?’

‘না না, এটা আমি করিনি। তুমি কোরো। আমি তোমার নম্বর ওনাকে দিয়ে দিচ্ছি।’

‘থ্যাংক ইউ, ভাই। আমার অনেক উপহার করলে।’

‘আরেহ্, দূর। থ্যাংকস্ দিতে হবে না। দেখা হলে এক কাপ কফি খাওয়ালে শোধ হয়ে যাবে।’

‘ওকে…। সময় করে একদিন দেখা করব।’

‘ঠিক আছে, সে কথাই রইল। এখন অ্যাড্রেসটা নোট কোরো।’

ইমরুল ঠিকানা বললে, সেই ঠিকানা নিজের নোটপ্যাডে সেইভ করে নিল আদিয়ান। আপাতত টিউশনি দিয়ে চালিয়ে নিতে হবে। পরবর্তীতে কপালে থাকলে কোথাও একটা চাকরি ম্যানেজ করে নিবে। এইভেবে, স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে চায়ের কাপে মুখ বসাল।

***

মাঝখানে কেটে গেল আরও কয়েকটা দিন। ক্লাস-ক্যাম্পাসে হরদম ছোটাছুটিতে ব্যস্ত ছিল নওমী। স্টাডিটেবিলে মুখ গুঁজে পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছে। ভালো রেজাল্ট আনতে হলে, মনোযোগ দিয়ে পড়াশোনাটা জরুরী। অন্যদিকে, বেশ কিছুদিন ধরে তার নানু খুব বেশি অসুস্থ। নিয়মিত সেই বাসায় যাওয়া-আসা চলছে। আজও যেতে হবে। দৌড়ের ওপর থাকলে পড়াশোনা ঠিক হয় না। এজন্য পড়তে বসলে মনোযোগ ধরে রাখার চেষ্টা করে নওমী। তাড়াহুড়ো থাকায়, সবকিছু ভ্যানিটিব্যাগে ঢুকিয়েছে কি-না সেটা রাস্তায় এসে চেক করছিল সে। সামনে-পিছনে কোনোদিকেই তার খেয়াল নেই। ব্যাগ হাতড়ে দেখল, ফোনের চার্জারটা ফেলে এসেছে। তার বদরাগী বাপি না গেলেও সে ও তার মা একদিন অন্তর অন্তর নানুকে দেখতে যায়। আজ নুজাইফা আমীন যেতে পারছেন না। প্রেশার খুব যন্ত্রণা দিচ্ছে। তাই মেয়েকেই একা যেতে বলেছেন। চার্জার আনতে আবারও বাড়িতে প্রবেশ করল নওমী। চার-পাঁচদিন ওখানে থাকবে। কিটিকে একটু আদর করে, পাঁচ-ছয় মিনিট পর চার্জারটা ব্যাগে ভরে পূণরায় রাস্তায় এলো। দূর থেকে রিকশাকে সিগন্যাল দিল। রিকশার পিছনে একটা বাইক এসে দাঁড়ালে বাইক থেকে নামল একটা যুবক। দু’পা এগিয়ে সামনে এলো। মাথায় কালো হেলমেট। পরনে কালো শার্ট, কালো জিন্স। চোখে চশমা। এতকিছুর দিকে খেয়াল ছিল না নওমীর। সে দূর থেকে তড়িঘড়ি পায়ে এগিয়ে এসে রিকশায় উঠতে চাইলে উল্টোদিক থেকে হেঁটে আসা যুবকের সাথে বেখেয়ালিতে ধাক্কা খেল। নওমী দূরে ছিঁটকে পড়লে খেয়াল করল, যুবকটা তারদিকে ফিরেও তাকাল না। কর্তব্যজ্ঞান থেকেও এগিয়ে এলো না। একদৃষ্টিতে তাদের বাড়ির দিকে তাকিয়ে রইল। সে অবাক হয়ে বলল,

‘এ্যাক্সকিউজ মি, কে আপনি? এখানে কী চাই?’

যুবকটা সামনে তাকাল। দু’পা এগিয়ে এসে প্যান্টের পকেটে হাত গুঁজে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে রইল। দৃষ্টিটা ঠিক কেমন বোঝা গেল না। চশমা ও হেলমেটের কারণেই মুখের ভাবভঙ্গি ঠিক বুঝতে পারল না নওমী। ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইল। যুবকটা বলল,

‘এটা কি তোফাজ্জল হোসেনের বাসা?’

‘জি…। কিন্তু আপনি কে?’

‘আপনি আমাকে চিনবেন না। আপনার বাবার সাথে জরুরী কিছু কথা ছিল।’

‘পরিচয় না দিলে বাপির সাথে দেখা করতে পারবেন না। তাছাড়া, বাপি এখন বাসায় নেই। অফিসে। জরুরী হলে আপনি সেখানে যান।’

ছেলেটা বোধহয় একটু হাসলো। আর কিছু জানতে না চেয়ে বাইকে চেপে বসে বলল,
‘বলবেন যে, জাহাঙ্গীরের লোক এসেছিল। আগামী আটচল্লিশ ঘণ্টার মধ্যে দেখা করতে বলেছে।’

‘জাহাঙ্গীর কে?’

‘সেটা জেনে আপনার কাজ নেই। আপনার বাপিকেই বলে দিবেন। কেমন?’

বাইক স্টার্ট দিয়ে চোখের পলকে দূরে চলে গেল যুবকটা। নওমী অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। চিন্তিতমনে রিকশায় চেপে বসলো। ব্যাগের ভেতর থেকে ফোন বেজে উঠলে রিসিভ করে কানে ঠেকিয়ে বলল,

‘আসছি, মামণি। বেশিক্ষণ লাগবে না।’

নানুর বাসায় উপস্থিত হয়ে দেখল, তার দুই মামী ঘরের কাজকর্ম করাতে ব্যস্ত। তাদেরকে একটু জড়িয়ে ধরে আদর নিয়ে বলল,

‘নানু কোথায়?’

নওমীর বড়ো মামী বললেন,
‘বিশ্রাম নিচ্ছেন।’

নওমীর নানু দু’তলায় থাকেন। একেবারে শেষদিকের রুমে। মাঝখানে মামাতো ভাই-বোনদের রুম। দুই মামার দুটো ছেলে ও দুটো মেয়ে। এরাই ঘরকে মাতিয়ে রাখে। মেয়ে দুটো বড়ো আর ছেলে দুটো ছোটো। ছেলে দুটোও একসাথে ক্লাস সিক্সে পড়ছে। নানুর ঘরে যাওয়ার আগে বোনেদের ঘরের দিকে উঁকি মারল নওমী। পর্দা সামান্য ফাঁক করে, দুই পর্দার মাঝখানে মুখ ঢুকিয়ে ওদেরকে পড়াশোনায় মনোযোগী হতে দেখে বলল,

‘এই পণ্ডিতের দল। তোরা দেখি পড়াশোনা নিয়ে খুব সিরিয়াস হয়ে গিয়েছিস। আমার মতো লন্ডনে যাওয়ার প্ল্যান করছিস না-কি? তাহলে আয়, তোদেরকে ব্যাগে ঢুকিয়ে নিয়ে যাই। তিনবোনে মিলে জমিয়ে লন্ডন শহর দাপিয়ে বেড়াব।’

এইদুটো বলে চোখ ঘুরিয়ে রিংকি ও পিংকিকে সরাসরি দেখল নওমী। কিন্তু তাদের স্যারকে দেখল না। শুধু পিছনের দিক দেখা যাচ্ছে। সে ভেতরে প্রবেশ করতে চাইলে তার বড়ো মামী গলা উঁচিয়ে বললেন,

‘নিমু, স্যারের জন্য এই চা-নাশতাটা নিয়ে যা তো, মা।’

বড়ো মামী ও তার মা, এই দু’জনে তাকে নিমু বলে ডাকেন। ডাকটা আদুরে, কিন্তু নওমী বিরক্ত হয়। কতবার নিষেধ করেছে, ‘তোমরা আমাকে নিমু ডেকো না, নিজেকে বাচ্চা বাচ্চা লাগে।’ কে শুনে কার কথা? তাদের মতে, সে এখনও বাচ্চাই। বড়ো মামীর ডাক শোনে, ‘উফফ, এখনই চা’ বিড়বিড়িয়ে শব্দকটা উচ্চারণ করে নিচে নামলো নওমী। ট্রেতে সবকিছু সাজিয়ে আবারও ওদের রুমের দিকে এগোলো। এবার উঁকি দিল না, সরাসরি প্রবেশ করল। ছোট্ট টি-টেবিল সামনে এনে ট্রে রেখে বলল,

‘স্যার, আপনার চা। বেশি বেশি চা খাবেন, বেশি বেশি পড়াবেন। দুটোই কিন্তু ফাঁকিবাজ। ওদেরকে ভালো রেজাল্ট করিয়ে দিতে পারলে, আপনাকে আমি মোটা অংকের অ্যামাউন্ট দিব।

কথা শেষ করে চায়ের কাপ বাড়িয়ে দিল নওমী। আদিয়ান মুখ তুলে সরাসরি দৃষ্টি ফেলল। সঙ্গে সঙ্গে চোখদুটো বড়ো বড়ো হয়ে গেল নওমীর। মুখের ওপর হাত রেখে বলল,

‘আপনি!’

আদিয়ান কোনো কথা বলল না। আগ্রহ নেই। বাবা-মেয়ে দু’জনই এক। শুধু টাকা আর টাকা। টাকা ছাড়া এরা আর কিছুই বুঝে না। সে চায়ের কাপটা একপাশে সরিয়ে রেখে দু’জনকে অংক বুঝানোয় মনোযোগ দিল। নওমী মুহূর্তেই ক্ষ্যাপে গেল। লোকটা তাকে দেখতেই পারে না, আশ্চর্য! কেন? সে জ্বলন্ত দৃষ্টি নিয়ে বলল,

‘আপনার সমস্যা কী?’

কথাটা কি আদিয়ানকে বলল? সন্দিহান মন নিয়ে চোখ তুলল আদিয়ান। নওমী কোমরে হাত রেখে দাঁত কিড়মিড় করে বলল,

‘অহংকারে মাটিতে পা পড়ে না, না? ভুলে যাবেন না, আপনি আমার কাছ থেকে পনেরো’শ ষাট টাকা ঋণ নিয়েছেন। আমার এতগুলো টাকা লস করিয়ে আমাকেই মেজাজ দেখাচ্ছেন? সামান্য ভদ্রতাও নেই আপনার মধ্যে? টাকা তো শোধ করেননি, উপকারের বিনিময়ে ধন্যবাদও দেননি। উলটে কী করলেন, ইগনোর করে পাশ কাটিয়ে চলে গেলেন! এখনও সেই একই ভাব বজায় রেখেছেন। কেউ উপকার করলে তার প্রতিদান বুঝি এইভাবে দেন?’

আদিয়ান কিছু বলার আগেই রিংকি বলল,
‘নওমীপু, যাও না। পড়তে দাও। এই ম্যাথটা খুব কঠিন। সলভ্ করতে না পারলে ক্লাসে কান ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। প্লিজ, আপু…। যাও। পড়াশোনা শেষে আমরা তোমার সাথে গল্প করব। প্রমিস…।’

নওমীর কী হলো কে জানে! আদিয়ানের ওপর জমে ওঠা রাগ থেকে চায়ের কাপ হাতে তুলে একটানে সবটুকু চা শেষ করে, বিস্কুট হাতে নিয়ে দুই বোনের দিকে তাকিয়ে বলল,

‘তোরা বিস্কুট খাবি?’

দু’জনেই মাথা দুলিয়ে অসম্মতি জানাল। সবকটা বিস্কুট হাতে তুলে নিয়ে, একটা একটা করে খাওয়া শুরু করল নওমী। খেতে খেতে রুম ছেড়ে বেরিয়ে গেল। মুখ চেপে হাসি আটকানোর চেষ্টা করল আদিয়ান। পিংকি অসহায় চেহারা নিয়ে বলল,

‘স্যার আপনাকে আরেক কাপ চা দিতে বলি?’

‘না, না…। আমার চা লাগবে না। তোমাদের বোনকে দাও।’

নওমী নিজের নানুর রুমে এলো। সেন্টার টেবিলে রাখা বোতল থেকে ডগডগ করে পানি খেল। এত গরম চা জীবনেও খায়নি। জিহ্বা পুড়ে গেল তার। ‘কোথাকার রাগ কোথায় ঢালল’ এই প্রশ্নটা মাথায় ঘুরপাক খাওয়া মাত্রই চিবিয়ে চিবিয়ে দরজার দিকে তাকাল। তার নানু চোখ খুলে নাতনীকে কিছু একটা বিড়বিড় করতে দেখে বললেন,

‘কী রে বুড়ি, কী হয়েছে?’

নওমী মেজাজ দেখিয়ে বলল,
‘হয়নি, হবে।’

‘কী হবে?’

‘তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ।’

‘কার সাথে?’

‘ওই হতচ্ছাড়া, বদ, খচ্চর লোকটার সাথে।’

‘সেটা আবার কে?’

‘কাকে কী বলছি আমি!’

নিজের ওপর বিরক্ত নওমী নানুর পাশে বসলো। গালে-মুখে হাত বুলিয়ে আলগোছে জড়িয়ে ধরে বুকে মাথা রেখে বলল,

‘দেখো, ক’দিন পরই তুমি ঠিক হয়ে যাবে। আমরা আগের মতো ছোটাছুটি করব, দৌড়াদৌড়ি করব। কানামাছি, বৌছি, লুকোচুরি খেলব।’

তার নানু শুধু হাসলেন। নাতনীর কপালে আদুরে স্পর্শ দিয়ে বললেন,
‘এখন কি আর এসব খেলার বয়স আছে, বোন? সময় ফুরিয়ে আসছে। কোনদিন জানি রবের ডাকে সাড়া দিয়ে চলে যেতে হয়, কে জানে!’

নওমীর নানুর বয়স পঁচাত্তরের উপরে। শরীরে বাসা বেঁধেছে নানান রোগবালাই। অসুস্থ শরীর নিয়ে নিচে নামার জোর নেই। এখন আর পায়ে ভর দিয়ে হাঁটতে পারেন না। খাওয়া-দাওয়া থেকে মন উঠে গেছে। জুস ও নরম খাবার খেয়ে দিন কাটে। সারাক্ষণই মৃত্যুভয়ে তটস্থ থাকেন তিনি। এসব শুনলে নওমীর খারাপ লাগে। সে নানুকে বুঝাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। ভুলিয়ে রাখতে হাসিখুশি ও ফুরফুরে মেজাজে গল্প জমিয়ে যায়। সময় যে কোনদিক দিয়ে সন্ধ্যার কিনারে পৌঁছায় টেরই পায় না। মাগরিবের আযান শোনে আড্ডায় সমাপ্তি টানে। নানুকে বিছানার ওপর নামাজের ব্যবস্থা করে দিয়ে রুম ছাড়ে। সেই সময় রিংকি-পিংকির রুম ছেড়ে বের হয় আদিয়ান। তাকে দেখে নওমীর মেজাজ আবারও আগের রূপে ফিরে গেল। ভস্মকরা চোখে তাকিয়ে থাকল নওমী। তার বড়ো মামী আদিয়ানকে দেখে বললেন,

‘চলে যাচ্ছ, বাবা?’

‘জি… আন্টি।’

‘চা খেয়েছ? আমি ব্যস্ত ছিলাম, খেয়াল রাখতে পারিনি।’

এই প্রশ্নের উত্তর দিল না আদিয়ান। শুধু হাসলো। বড়ো মামী রোকেয়া খানম বললেন,
‘ওরা দু’জন খুব বেশি চঞ্চল ও জেদী। পড়তে চায় না একদমই। ওদের সামলাতে তোমার অনেক কষ্ট হবে। রাগ ও মেজাজ সামলে একটু মানিয়ে নিও।’

‘না আন্টি, ওদেরকে এতটাও চঞ্চল ও জেদী মনে হয়নি। যতটুকু চঞ্চলতা ও জেদ, সেটা বয়সের দোষ। সঠিক গাইডলাইন পেলে ঠিক হয়ে যাবে।’

‘আমরা খুব চেষ্টা করছি।’

‘আমিও চেষ্টা করব, আন্টি। এখন আসি?’

‘ঠিক আছে। সাবধানে যেও।’

আদিয়ান বিদায় নিয়ে চলে গেল। পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা মেজাজী রমণীর দিকে একনজর ফিরেও তাকাল না সে। এর কারণ ঠিক বুঝে উঠতে পারল না নওমী। সামান্য একটা ধন্যবাদ দিতে এত কৃপণতা? এত ভালো চাকরি ছেড়ে টিউশনি? সবকিছু কেমন যেন একটা সন্দেহের জন্ম দিল মনে। নিজের বাপিকে সে হাড়েহাড়ে চিনে। যে কাউকে যেকোনোভাবে কথার দ্বারা আঘাত করার ক্ষমতা রাখেন তিনি। কোথাও এমনকিছু বলেননি তো, যা এই ছেলেটার আত্মসম্মানে আঘাত আসার কারণ হতে পারে? না চাইতেও আগ্রহী হয়ে উঠল নওমী। চট করে দুই বোনের রুমে প্রবেশ করল। জানতে চাইল,

‘তোদের এই স্যারের বাসা কোথায় রে?’

দু’জনই একসাথে বলে উঠল,
‘আমরা তো জানি না।’

‘ফোন নম্বর আছে?’

রিংকি বলল,
‘আমাদের কাছে কী করে থাকবে? আমরা কি ফোন ব্যবহার করি? জানো না, আমাদের জন্য ফোন ব্যবহার নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে?’

‘তাহলে তোরা জানিসটা কী?’

‘আমরা শুধু ওনার নামটাই জানি।’

‘নামটা আমিও জানি।’

এতক্ষণের কথায় রিংকি একটু কৌতূহলী হয়ে উঠল। বলল,
‘স্যারের নম্বর দিয়ে তুমি কী করবে, আপু?’

নওমী রেগে গেল মুহূর্তেই। কটমট চোখে চেয়ে থেকে বলল,
‘শরবতের সাথে গুলে খাব। তোরা খাবি?’

***

চলবে…