#পায়ে_পায়ে_হারিয়ে
লেখনীতে : তামান্না বিনতে সোবহান
পর্ব – ১১
রাতে ঘুমোতে গিয়ে রাস্তায় দেখা হওয়া লোকটার কথা মনে পড়ল নওমীর। ফোন হাতে নিয়ে বাড়িতে কল করল। তার বাপি কল রিসিভ করে ভালোমন্দ জিজ্ঞেস করলেন। নানুর শরীরের অসুস্থতার কথা জানতে চাইলেন। এক পর্যায়ে নওমী বলল,
‘বাপি… জাহাঙ্গীর কে?’
ওপাশ থেকে কিছুক্ষণ কোনো আওয়াজ এলো না। নওমী আগ্রহী হয়ে বসে রইল। একটা সময় শুনল, তার বাপি জানতে চাইছেন,
‘তুমি এই নাম কোথায় পেয়েছ?’
‘আজ একটা লোক এসেছিল আমাদের বাড়ির কাছে। রাস্তা থেকেই লোকটা বাড়ির দিকে তাকিয়ে ছিল অনেকক্ষণ। এরপর আমাকে বলল, সে জাহাঙ্গীরের লোক। জাহাঙ্গীর তাকে পাঠিয়েছে। আটচল্লিশ ঘণ্টার মধ্যে তোমাকে দেখা করতে বলেছে।’
‘আচ্ছা, দেখা করব। তুমি এসব নিয়ে ভেবো না।’
এইটুকু বলেই সংযোগ বিচ্ছিন্ন করলেন তোফাজ্জল হোসেন। নওমী চিন্তিতমনে বসে রইল। দাঁত কামড়ে কিছু একটা ভাবল। মাথা থেকে চিন্তাটা সরছেই না। লোকটা কেমন যেন। ভীষণ অদ্ভুত। তার বড়ো মামী ডেকে বললেন,
‘নিমু, খেতে আয়। খাবার ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে।’
তার দুই মামা ও মামাতো ভাই-বোনেরা খেতে বসেছে। নানুর খাওয়া শেষ। অসুস্থ মানুষ, তাকে আগেভাগে রাতের খাবার ও ঔষধপত্র খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে রেখেছেন তার ছোটো মামী। এখন সবাই একসাথে খাবেন। তাই তাড়া দিয়ে তাকে ডাকলেন বড়ো মামী। সে এগিয়ে গিয়ে চেয়ার টেনে বসলো। বড়ো মামা মশিউর রহমান তার মুখের ভাবভঙ্গি খেয়াল করে বললেন,
‘কী মামণি, কী নিয়ে চিন্তিত?’
প্লেটে ভাত তুলে দিলেন বড়ো মামী। হাত ধুয়ে খাবার মুখে নিল নওমী। বড়ো মামার প্রশ্নের উত্তরে বলল,
‘আসার পথে একটা লোকের সাথে দেখা হলো। লোকটা বলল, আটচল্লিশ ঘণ্টার মধ্যে বাপি যেন জাহাঙ্গীরের সাথে দেখা করে। এই জাহাঙ্গীরটা কে? কিছুতেই বুঝতে পারছি না। এর আগে এই লোকটার নাম শুনিনি। বাপির অফিসে এই নামে কেউ আছে বলে তো জানি না।’
মশিউর রহমান নিজেও নাম শোনে বিচলিত হলেন। নওমী অবশ্য বড়ো মামার মুখের ভাবভঙ্গি খেয়াল করল না। সে একধ্যানে খাওয়ায় মনোযোগ দিল। আলোচনা ঘুরিয়ে দিতে বড়ো মামী বললেন,
‘ওসব নিয়ে তুই চিন্তা করিস না, নিমু। ব্যবসায়ীক কাজের জন্য তোর বাপির কত মানুষের সাথে ওঠাবসা হয়। লোকটা হবে তাদেরই একজন। এসব নিয়ে এত মাথা ঘামানোর দরকার নেই।’
এরপর নিজেই নওমীর পাশের চেয়ারে বসলেন। প্লেটে দু’পিস গোরুর গোশত তুলে দিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
‘শুধু একটু সাবধানে থাকিস। রাস্তাঘাটে খারাপ মানুষের অভাব নেই। রাস্তায় বের হলে অবশ্যই বুঝেশুনে চেনা-অচেনা মানুষ বুঝে কথাবার্তা এগোবি। যে কারও সাথে ভাব জমাবি না। তোর তো আবার মানুষের উপকার করার স্বভাব। যখন-তখন যে কারও উপকার করতে গিয়ে নিজের বিপদ ডেকে আনিস না। তুই তোর বাপির একমাত্র মেয়ে। তোকে নিয়ে আমাদের কত আশা-ভরসা। একটু নিজের খেয়াল রাখিস, মা।’
নওমী খেতে খেতে বলল,
‘আহা, আমাকে নিয়ে ভাবতে হবে না। আমি যথেষ্ট বড়ো হয়েছি। নিজের খেয়াল নিজেই রাখতে পারি। কয়েকমাস পর যখন লন্ডনে চলে যাব, তখন তো আমাকে একাই নিজেকে সামলাতে হবে। আদর-আহ্লাদ একটু কম দেখাও মামণি। বেশি হয়ে গেলে ভিনদেশে একা থাকা কষ্টের হয়ে যাবে।’
বড়ো মামী আর কিছু বললেন না। শুধু মুচকি হেসে স্বামীর দিকে একপলক তাকালেন। সেই দৃষ্টিতেই তার বড়ো মামা রাজ্যের ভয় ও আতঙ্ক খুঁজে পেলেন। তিনি বুঝে উঠতে পারলেন না, এত বছর পর এই জাহাঙ্গীর কেন আসছে তাদের জীবনে? কীসের জন্য আসছে? খেতে গিয়েও দুঃশ্চিন্তার কারণে খাবার মুখে তুলতে পারলেন না তিনি। মনে মনে আওড়ে গেলেন,
‘আবার কোন তুফান ধেয়ে আসছে, মাবুদ।’
***
নানুবাড়িতে দুটোদিন খুব আমোদের সাথেই কাটিয়ে দিল নওমী। শুধু ক্লাসের সময় ভার্সিটিতে গিয়েছে, ছুটির পর বাড়ি না গিয়ে এদিকেই চলে এসেছে। এই দু’দিনে কিটিকে ভীষণ মিস করেছে। ফোন করে সে কথা মাম্মিকে জানানোর পর দুপুরের আগেই কিটিকে নিয়ে বাবার বাড়িতে উপস্থিত হয়েছেন নুজাইফা আমীন। ভার্সিটি থেকে ফিরে কিটিকে পেয়ে আনন্দ আর ধরে না নওমীর। ফ্রেশ হয়ে তাকে নিয়েই ছোটাছুটি করছে সে। দুই মামী ও তার মাম্মি নানুর সাথে গল্প করছেন। রিংকি ও পিংকি বইখাতা নিয়ে টেবিলে বসে রয়েছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই তাদের স্যার চলে আসবেন। তাই তাদের আর বিরক্ত করল না, সে একাই কিটিকে নিয়ে সারা বাড়ি দাপিয়ে বেড়াল। খেলতে খেলতে কিটি বাড়ির সামনের দিকে দৌঁড়াচ্ছিল। একেকবার লাফ দিয়ে নওমীর কাঁধে উঠছিল, কখনও লম্বা শার্টের কোণায় দাঁত কামড়ে ঝুলছিল, আবার কখনও পা দিয়ে জামা পরিষ্কার করছিল। আদুরে বিড়ালের কাণ্ডকারখানায় খিলখিলিয়ে হাসছিল নওমী। একটা সময় কিটি তার কাঁধ থেকে লাফ দিয়ে বাড়ির ভেতরে এগিয়ে আসা পুরুষটার কাঁধের ওপর চাপতে গিয়ে নখের আঁচড় বসিয়ে শার্ট তো ছিঁড়লই, মুহূর্তেই কাঁধের একপাশটা রক্তাক্ত করে ফেলল। ঘটনা কি বুঝে উঠতে পারল না আদিয়ান। পিছু ঘুরে তাকাতেই দেখল, কিটি ততক্ষণে নওমীর কোলে। আস্তে করে নিজের কাঁধে হাত ঘষে নিল আদিয়ান। ভীষণ জ্বলছে। নতুন শার্টের দফারফা ঘটে গেছে সেটা বুঝতে পেরেই কপালের একপাশের শিরা ফুলে উঠেছে রাগে। সচরাচর কোনোকিছুর ওপর সহজে রাগে না আদিয়ান। কিন্তু যখন নিজের শখের কিছু নষ্ট হয়ে যায়, অকেজো হয়ে যায়, তখনই কষ্ট থেকে রাগ বেরিয়ে আসে। ঘটনার আকস্মিকতায় নওমী নিজেও আতঙ্কিত। বুঝতে পেরে আগ বাড়িয়ে কিটির হয়ে ক্ষমা চাওয়ার অজুহাতে বলল,
‘ও আসলে নতুন কাউকে দেখলে এরকম আচরণ করে। আমি খুব দুঃখিত।’
আদিয়ান কিছু বলতে চাইল, মনে মনে কথা সাজিয়েও ফেলল, মাথার ভেতর লাইনগুলো ক্রমাগত বেজে উঠল, ‘আপনাদের মতো বড়োলোকদের বৈশিষ্ট্যই এমন। সাধারণ মানুষদের রক্তাক্ত না করলে আপনাদের শান্তি আসে না। কেউ রক্তাক্ত করে বুক, কেউ করে শরীর। নেহাৎ, আমার মতো ছোটোলোকদের ক’টা টাকার দরকার নয়তো এই টিউশনিকেও আমি দু’হাতের ধাক্কায় বিদায় জানাতাম।’ বলতে চেয়েও ঠোঁট কামড়ে কথাগুলো গিলে নিল সে। মুখ ঘুরিয়ে বাড়ির ভেতরে পা রাখল। নওমী রাগি চোখে কিটিকে দেখে শাসনের সুরে বলল,
‘তুই এত উড়নচণ্ডী কেন রে? বাড়ির শিক্ষকের সাথে কেউ এমন আচরণ করে? দেখলি তো, কতখানি রক্ত ঝরে গেল লোকটার। ইশ… কী করলি এটা? যা, ওনার কাছে স্যরি বলে আয়। যদি স্যরি না বলিস, আজ রাতের খাওয়া তোর বন্ধ করে দেব।’
রিংকি-পিংকি পড়াশোনা শুরু করেছে। উল্টোদিকের চেয়ারে বসে গতদিনের পড়াটা চেক করে নিল আদিয়ান। দু’জনই খুব সুন্দরভাবে অংকগুলো সলভ্ করেছে। খাতায় কিছুক্ষণ চোখ বুলিয়ে বলল,
‘চুরি করোনি তো?’
দু’জনেই একসাথে কানে হাত দিল। রিংকি গম্ভীরচোখে তাকাল আর পিংকি অসহায় চেহারা বানিয়ে ঠোঁট উলটে বোনকে কিছু একটা বলতে চাইল। ইশারা বুঝতে পেরে পিংকির খাতা তার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে আদিয়ান বলল,
‘এই অংকটা এক্ষুণি সলভ্ কোরো।’
‘এক্ষুণি?’
‘হ্যাঁ, এক্ষুণি।’
রাগে কিড়মিড় করে উঠল পিংকি। খাতা হাতে নিয়ে পূণরায় অংক করতে শুরু করল। রিংকিকে নতুন একটা অংকের সমাধান দেখিয়ে দিল আদিয়ান। এমন সময় পায়ের কাছে সুড়সুড়ি অনুভব হওয়াতে মাথানিচু করে টেবিলের নিচটা চেক করল সে। পায়ের আঙুলে পা ঘষছে পাজি বিড়ালটা। আলগোছে সরিয়ে নিতে চাইল কিন্তু পারল না। কেমন করে আঁকড়ে ধরল। পা উপরে তুললে বিড়ালটাও পায়ের কাছে ঝুলে রইল। বিরক্ত আদিয়ান ঘাড় ফিরিয়ে দরজায় মুখ ঘুরিয়ে দেখল, নওমী দাঁড়িয়ে আছে। চোখে চোখ পড়তেই কানে হাত দিয়ে মেয়েটা বলল,
‘ওর হয়ে আমি ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি, স্যরি…!’
দৃষ্টি সরিয়ে নিল আদিয়ান। রিংকিকে বলল,
‘রিংকি টেবিলের নিচে বিড়াল আছে। ওটা একটু সরাবে?’
সঙ্গে সঙ্গে নিচু হয়ে দু’হাতের সাহায্যে টেবিলের নিচ থেকে কিটিকে বের করে আনলো রিংকি। নওমীর হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল,
‘আপু, এটা নিয়ে যাও। বিরক্ত করছে।’
কিটির ওপরে থাকা যত বিরক্তি ছিল, সব এবার রিংকির ওপর গিয়ে পড়ল। কটমট চোখে তাকিয়ে রইল নওমী। রিংকি ঘাবড়ে গিয়ে বলল,
‘এভাবে তাকাচ্ছ কেন? যাও, স্যারের জন্য চা নিয়ে এসো।’
***
নানুর ঘরে তিনজনে বসে জমিয়ে গল্প করছেন। কাউকেই সেই গল্পের আসর থেকে সরানো গেল না। স্যার এসেছেন, স্যারের চা-নাশতা লাগবে, এইটুকু বলাতেই বড়ো মামী বললেন,
‘তুই তো খুব ভালো চা বানাতে পারিস, নিমু। এককাপ চা কর, ঘনদুধ দিয়ে। তোর নানুও চা খাবে। তুই সবার জন্যই চা বসা। পারলে একটু পাস্তা করে নিস। মিটসেফে প্যাকেট রাখা আছে।’
কী আর করা, বড়োদের আদেশ। অগত্যা কিটিকে কোলে নিয়ে রান্নাঘরে গেল নওমী। টুকটাক রান্নাবান্না সে পারে। একেবারে রাঁধতে পারে না বা জীবনে রাঁধেনি এমন নয়। মাঝেমধ্যে নিজের কিছু খেতে ইচ্ছে করলে, প্রিয় কোনো খাবারের লোভে দিশেহারা অবস্থায় পড়লে, নিজেই কষ্ট করে বানিয়ে নেয়। দশম শ্রেণীতে ওঠার পর থেকেই একটু-আধটু চা-নাশতা বানায় সে, পাশাপাশি কিছু কঠিন কঠিন রান্নাও শিখেছে। প্রতি শুক্রবারে একটা রেসিপি ট্রাই করার চেষ্টা করে। মা তাকে উৎসাহ দেন। ভুলচুক হলে শিখিয়ে দেন। প্রথম প্রথম হাত-পা পুড়িয়ে ফেলত, রান্নাবান্নাকে দুনিয়ার সব কষ্টকর কাজের একটা মনে হতো, এখন অভ্যাস হয়ে যাওয়াতে এতটাও কষ্টের মনে হয় না। কিটিকে একটা নিরাপদ জায়গায় বসিয়ে রেখে নওমী বলল,
‘একদম দুষ্টুমি করবি না। চুপচাপ এখানে বসে থাক্।’
কিটি বসলো। তার সামনে কিছু খাবার রেখে দিল নওমী। লম্বা চুলে হাতখোঁপা করে, রান্নায় মনোযোগ দিল। গুনগুনিয়ে গান গাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে পাস্তা ও চা প্রস্তুত করে সবার জন্য ট্রেতে সাজিয়ে নিল। বড়োদের সবাইকে আগে দিয়ে রিংকির রুম থেকে একটা কাগজ-কলম এনে তাতে কিছু লিখল। ট্রের মধ্যে নাশতার পাশাপাশি ছোট্ট হেক্সিসলের বোতল, তুলো, প্যারাসিটামল ও একটা ব্যান্ড-এইড নিয়ে পিংকির রুমের দরজায় নক দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে ছোট্ট টি-টেবিলে সবকিছু রেখে পিংকির দিকে তাকিয়ে বলল,
‘তোরা পাস্তা খাবি?’
দু’জনই উপরনিচ মাথা নাড়ল। দু’জনের পাস্তা তাদের হাতে তুলে দিয়ে ট্রেসহ বাকিটুকু আদিয়ানের হাতের একপাশে রেখে গলা খাঁকারি দিয়ে বলল,
‘আমি পানি নিয়ে আসছি।’
এই ইঙ্গিতটা বুঝতে আদিয়ানের একটু সময় লাগল। অংক করানোর ফাঁকে পিংকি বলল,
‘স্যার, আপু বোধহয় একটা চিরকুট রেখে গেছে।’
কেমন লজ্জাজনক ব্যাপার হয়ে গেল এটা। যদিও তাদের সম্পর্কটা এমন হয়, তবুও বিব্রতকর একটা পরিস্থিতিতে পড়ে গেল আদিয়ান। আড়চোখে ট্রের দিকে চোখ রাখেতেই চিরকুট নজরে এলো। সে দু’জনার দিকে তাকিয়ে বলল,
‘তোমরা আশেপাশে তাকাচ্ছ কেন? জলদি সমাধান কোরো।’
কৌতূহল দমিয়ে রাখতে না পেরে চিরকুট হাতে নিল আদিয়ান। ভাঁজ খুলে তাতে চোখ বুলালো। গোটা গোটা অক্ষরে লেখা,
‘এবার কি স্যরি গ্রহণযোগ্য?’
ব্যস, এইটুকুই। সামান্য একটা স্যরির জন্য এতকিছু। ঠোঁট মুড়ে হাসলো আদিয়ান। নওমী পানির বোতল নিয়ে এলো। গ্লাসে ঢেলে দিয়ে দুইবোনের দিকে তাকিয়ে বলল,
‘তোরা এত হাসছিস কেন?’
পিংকি মুহূর্তেই বলে উঠল,
‘শুধু আমরা একা নই, স্যারও হাসছেন।’
কথার সত্যতা যাচাই করতে আদিয়ানের দিকে দৃষ্টি দিল নওমী। ছেলেটা হাসছে। মিটিমিটি হাসি। পাশেই চিরকুটটা মেলে রাখা। দুষ্টু দুটো ততক্ষণে খিলখিলিয়ে উঠেছে। নওমী ওদের ধমক দিয়ে বলল,
‘পাজির দল, তোরা পড়বি না-কি মার খাবি?’
দুটো মুখের সামনে কলম ধরল। আর কথা বলবে না কেউ। সরাসরি নওমীকে কোনোকিছু না বলে বুদ্ধি করে রিংকির দিকে তাকিয়ে আদিয়ান বলল,
‘তোমাদের আপুকে বলে দাও, যে জায়গাটা রক্তাক্ত হয়েছে সেখানে আমার হাত পৌঁছাবে না। কতটুকু কেটেছে সেটাও আমি দেখতে পাচ্ছি না। কেউ যদি স্বেচ্ছায়, মানবিকতার খাতিরে একটু সহমর্মিতা দেখিয়ে নার্সের দায়িত্ব পালন করে তাহলে তার স্যরিটা গ্রহণযোগ্যতা পাবে।’
এত কষ্টে রান্নাবান্নার পরও এবার নার্সের দায়িত্ব নিতে হবে, শোনে মনে মনে কিছু একটা বিড়বিড়াল নওমী। আদিয়ান ফের মনোযোগ দিল ওদেরকে পড়াতে। পাজি দুটো মিটিমিটি হাসছে। ওদের হাসি যেন সরছেই না। এতকিছু না ভেবে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ক্ষতস্থানের দিকে তাকিয়ে নওমী বলল,
‘আপনি একটু ওয়াশরুমে আসুন। ক্ষতস্থানটা একটু সাবান-পানি দিয়ে পরিষ্কার করতে হবে। এরপর ঔষধ…।’
‘আমার মনে হয়, এটার ট্রিটমেন্ট আমি বাসায় গিয়ে নিলেই ভালো হবে।’
‘ততক্ষণে অনেক দেরী হয়ে যাবে আর ক্ষতস্থানে জীবাণু বাড়বে। ইনফেকশন হয়ে যেতে পারে।’
কথা না বাড়িয়ে আদিয়ান উঠে দাঁড়াল। ক্ষতস্থানে জ্বলছে। কতটুকু কেটেছে কে জানে। সে ওয়াশরুমে গেলে নওমীও পিছন পিছন এগোলো। লাইট অন করে বেসিনের সামনে থাকা টোল দেখিয়ে বলল,
‘এখানে বসুন। যদি আপনি আনইজি ফিল না করেন, শার্টটা খুলে রাখবেন, প্লিজ।’
এই ব্যাপারটা একটু অস্বস্তিকর। কিন্তু কিছু করার নেই। বিড়ালের আঁচড়, ট্রিটমেন্ট নিতে দেরী হলে বাড়াবাড়ি পর্যায়ে চলে যাবে। সে সম্পূর্ণ শার্ট না খুলে, সামনের বোতাম খুলে একটা হাত বের করে পিঠের একপাশ উন্মুক্ত করে দিল। সেন্ডো গেঞ্জির উপরিভাগে চোখ পড়তেই চোখ বন্ধ করে নিল নওমী। আহা… অনেকখানি কেটেছে। দেরী না করে ছোট্ট একটা টাওয়েল ভিজিয়ে তাতে সাবান ঘষে ফেনা তুলে আস্তেধীরে পিঠের ক্ষতস্থানকে জীবাণুমুক্ত করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। আদিয়ান ঠোঁট কামড়ে বসে শুধু অচেনা এই মেয়েটার থেকে সেবা নিল। সাবান-পানি দিয়ে পরিষ্কার করা শেষ হলে শুকনো টাওয়েল দিয়ে ভেজা অংশ মুছে তুলো ও হেক্সিসল হাতে তুলে নিল নওমী। অল্প একটু হেক্সিসল তুলোয় ঢেলে আদিয়ানের পিছনে দাঁড়াল। নরম-কোমল হাত দিয়ে তুলো চেপে চেপে ক্ষতস্থাননে ভালোমতো ঔষধ লাগিয়ে ব্যান্ড-এইড বসিয়ে বলল,
‘ব্যথা থাকলে প্যারাসিটামল খেয়ে নিবেন। যদি রাতে জ্বর আসে, আগামীকাল ডাক্তার দেখাবেন।’
নওমী মনে মনে একগাদা বকে দিল কিটিকে। আদিয়ানকে ওয়াশরুমে রেখে সে বেরিয়ে এসে বাইরে চলে গেল। অনেকক্ষণ একধ্যানে ঠায় বসে রইল আদিয়ান। অদ্ভুত শূণ্যতা, না পাওয়া, অপ্রাপ্তি, দুর্ভাগ্য ও উঁচুনিচুর এই বিশাল ব্যবধানকে মনে করে বুক ছিঁড়ে হাহাকার বেরিয়ে এলো। মনে মনে আওড়ে গেল,
‘এরপর আর কোনো মেয়ে আমার এত কাছে না আসুক।’
***
টিউশনি শেষ করে একটা মার্কেটে ঢুকল আদিয়ান। রুমঝুম ফোন করে রান্নাঘরের জন্য কিছু খরচাপাতি নিতে বলেছে। তেল-মশলা কী কী যেন ফুরিয়ে গেছে। প্রয়োজনীয় খরচ শেষে ব্যাগগুলো রিকশায় তুলে নিল আদিয়ান। নিজে উঠতে গিয়ে সামনে দৃষ্টি পড়তেই মনে হলো, মার্কেটের আশেপাশে শুভকে দেখেছে। চটজলদি রিকশা থেকে নেমে রিকশাওয়ালাকে বলল,
‘মামা একটু দাঁড়ান, আমি আসছি।’
পূণরায় মার্কেটে ঢুকে এক মাথা থেকে অন্যমাথা পাগলের মতো ঘুরে ঘুরে শুভকে খুঁজল। খুঁজতে খুঁজতে হয়রান হয়ে মার্কেটের বাইরে এসে দাঁড়াতেই, আড়ালে লুকিয়ে থাকা ক্যাপ পরিহিত এক যুবককে দেখে সন্দিহান মন নিয়ে কাছে এগিয়ে গেল। যুবকটা সিগারেট ফুঁকছে। বিষণ্ণ মনে ধোঁয়া ছেড়ে দিচ্ছে আকাশের দিকে। খুব বেশি কষ্টে থাকলে শুভ এই কাজটা করে। একের পর এক সিগারেট শেষ করে ফেলে, তবু তাকে থামতে দেখা যায় না। হঠাৎ করেই সন্ধ্যের এই রহস্যময়ী আলোতে শুভকেও তার রহস্যময় মানব বলে মনে হলো। মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলল,
‘বেঁচে আছিস তাহলে!’
মাথার ক্যাপ একপাশে সরিয়ে সিগারেট ফেলে দিল শুভ। মুখের মধ্যে জমে থাকা সবটুকু ধোঁয়া ছেড়ে দিয়ে রহস্যময়ী এক হাসি ফুটিয়ে তুলল ঠোঁটে। তারপর দু’হাতে বন্ধুকে জড়িয়ে ধরে ভেতরফাটা আর্তনাদ আটকে নিয়ে বলল,
‘মৃত্যু আসছে না রে, দোস্ত। যখন আসবে তখন সারা পৃথিবী খুঁজলেও শুভকে তুই কোত্থাও পাবি না।’
আদিয়ানের রাগ পড়েনি। এত সহজে বন্ধুকে ক্ষমা করতে পারল না। তাই দীর্ঘদিন পর দেখা হওয়া সত্বেও জড়িয়ে ধরল না। সান্ত্বনা দিল না। শুধু বলল,
‘এই লুকোচুরি কেন? তোর কি একটুও চিন্তা হয় না? আমি তোকে বিশ্বাস করেছিলাম শুভ। তোকে ভরসা করেছিলাম। তুই একজন সত্যিকার প্রেমিক দেখে তোর হাতে ঝুমকে তুলে দিয়েছিলাম। আর তুই কী করলি? আমার বিশ্বাসের সুযোগ নিলি? শুধু তোর এই হেয়ালি আচরণের জন্য আমাকে কতখানি ভুগতে হচ্ছে জানিস?’
বন্ধুকে ছেড়ে দূরে সরে গেল শুভ। মুচকি হেসে বলল,
‘সব জানি। তুই রুমঝুমকে নিয়ে ঢাকায় এসেছিস। ওর গর্ভে থাকা আমার সন্তানকে বাঁচাতে মিথ্যে বিয়ের নাটক করছিস।’
আদিয়ান ভীষণ অবাক হয়ে বন্ধুর দিকে চেয়ে রইল। শুভ তার কাঁধে হাত রেখে বলল,
‘মায়ের পেটের ভাইও এতকিছু করে না, যতটা তুই করছিস। এই জীবনে তোর কাছে যত ঋণ আমার জমা হয়েছে, সেটা এত সহজে শোধ হওয়ার নয়।’
‘তুই সবকিছু কীভাবে জানিস?’
‘কীভাবে আবার? তোদের ফলো করে।’
‘তাহলে দেখা করতে যাচ্ছিস না কেন? তোর জন্য প্রতিদিন, প্রতিরাত কেঁদেকেটে অস্থির হয়ে থাকে, ঝুম। তুই সব জেনেও মনের সুখে শহরের আনাচে-কানাচে ঘুরে বেড়াচ্ছিস? আমি জাস্ট বিশ্বাস করতে পারছি না।’
আদিয়ানের চোখে অবিশ্বাস দেখে, পিছনের সব কথা খুলে বলার সিদ্ধান্ত নিল শুভ। বলল,
‘তোকে সব বলব, কিন্তু এখনই নয়।’
‘আমি এগুলো নিতে পারছি না আর। প্রতিদিন ঝুমের কান্না, হাহাকার অসহ্য লাগে। ওর কষ্ট দেখলে নিজেকে চরম হেল্পলেস মনে হয়।’
শুভ ঝেড়ে কাশল। বলল,
‘আমি তো ওর জন্যই লুকিয়ে আছি।’
‘মানে!’
‘সেদিন রাজশাহী যাওয়ার পথে জাহাঙ্গীরের লোকজন আমাকে জাস্ট ফাঁসিয়ে দিয়েছে। আমার পাশের সিটে ওদের দলের একজন ছিল। তুই তো জানিস, লম্বা জার্নিতে আমার ঘুমের অভ্যাস। সেদিনও বাসে ঘুমোচ্ছিলাম আমি। ঘুম ভাঙল পুলিশের ডাকে। চোখ মেলে দেখি আমার সামনে হিরোইন আর আমি হাজতে। নিজেকে বাঁচানোর কোনো উপায় জানা ছিল না আমার। বিনা দোষে অপরাধী হয়ে জেল কাটলাম। এরপর কানা জব্বার আমার জামিনের ব্যবস্থা করল। জানি না কীভাবে ওই লোকটা জানল, আমি জেলে। জেল থেকে ছাড়া পেয়ে বাড়িতে গেলাম। ওখানে একদিন থাকার পর আমার কাছে অচেনা নম্বর থেকে কল এলো। সেই কলে, ঢাকার একটা ঠিকানা দিল কেউ। যেতে না চাইলে বলল, ঝুমকে যদি বাঁচাতে চাই, তাদের সাথে যেন দেখা করি। সেই ঠিকানায় গিয়ে, জাহাঙ্গীরের সাথে দেখা করে বুঝলাম, আমার ঘুমের সুযোগ নিয়ে কীভাবে আমাকে ফাঁসানো হয়েছে। লোকটার সাথে অকারণ ঝামেলা করতে চাইনি দেখে ফেরত চলে আসলাম। কিন্তু তবুও লোকটা ভয় দেখাল। মাদকব্যবসায়ী বলে আবারও ফাঁসিয়ে দিতে চাইল। কেন, কোনোকিছুই বুঝলাম না আমি। জানতে চাইলে বলল, যদি ওদের হয়ে কাজ করি, তাহলে আমাকে হাজতের সাজা থেকে বাঁচাবে, ঝুমের জীবন ভিক্ষা দিবে, নয়তো আবারও আমাকে জেলে ঢুকিয়ে দিবে আর ঝুমকে…। এই কারণেই তোদের সাথে দেখা করতে পারছি না। দূরে থাকতে হচ্ছে। আমি… খারাপ নই দোস্ত, বিশ্বাস কর… আমি ঝুমকে ঠকাতে পারি না। ও গড…।’
কথা শেষ করার আগেই শব্দ করে কেঁদে ফেলল শুভ। এই প্রথম শুভকে ভীষণ অসহায় দেখাল। কাঁদতে কাঁদতে সড়কে বসে পড়ে হাঁটুতে মুখ গুঁজে দিয়েছে। এই পানিটা তো মিথ্যে নয়। বন্ধুকে সে খুব ভালো করে চিনে। আদিয়ান আর দূরে থাকল না। বন্ধুর পাশে দাঁড়াল। ভরসার ন্যায় কাঁধে হাত রেখে বলল,
‘বাকি কথা পরে শুনব। এখন চল, ঝুমের সাথে দেখা করবি। ও তোর অপেক্ষায় আছে।’
শুভ সতর্ক দৃষ্টিতে চারপাশে তাকিয়ে বলল,
‘ওরা আশেপাশে আছে। আমাকে চব্বিশঘণ্টা নজরে রাখছে। তুই এখন বাসায় যা। আমি সুযোগ পেলে ঝুমের সাথে দেখা করব। প্লিজ, যা। কেউ দেখে ফেলবে। তোর ঠিকানা জেনে গেলে ওরা ঝুমের ক্ষতি করবে, দোস্ত। তুই, যা। এক্ষুণি যা।’
বন্ধুকে তাড়া দিয়ে ক্যাপ দিয়ে মুখের সামনের অংশ ঢেকে দৌঁড়ের ওপর সেখান থেকে হারিয়ে গেল শুভ। আদিয়ান অসহায় চোখে তাকিয়ে রইল। মনে সন্দেহ ও ভয় জেগে উঠল তার। অসংখ্য প্রশ্ন এসে ভিড় জমাল। ভালোবাসার মানুষকে বাঁচাতে, কী এমন কঠিন কাজের সাথে জড়িয়ে গেল শুভ? এর থেকে বাঁচার উপায় কী? আজকের সম্পূর্ণ ঘটনা কি জাদীদকে জানাবে? ছেলেটা কি তার প্রাণপ্রিয় বন্ধুকে সাহায্য করতে পারে? হয়তো…
***
চলবে…
#পায়ে_পায়ে_হারিয়ে
লেখনীতে : তামান্না বিনতে সোবহান
পর্ব – ১২
কলেজের ক্যাম্পাস থেকে গেইটের দিকে বারকয়েক চোখ বুলালো রুমঝুম। আদিয়ান এলো কি না দেখল। কাছেপিঠে কোথাও আদিয়ানকে দেখা গেল না। আজ ভর্তির দিন। ফর্ম ফিলাপ করে বসে আছে। লাইনে দাঁড়াতে পারছে না। ইন্টারভিউ শেষ করে এখানেই আসার কথা আদিয়ানের। এখনও কেন আসছে না? চিন্তায় চিন্তায় অস্থির হয়ে গেল রুমঝুম। হঠাৎই ফোন বেজে উঠল, পরপর দৃষ্টি রাখল গেইটে। ঠোঁটে ফুটল হাসি। কাগজপত্র নিয়ে ছুটে এলো সামনে। হাস্যজ্বল মুখ নিয়ে বলল,
‘ইন্টারভিউ কেমন হলো?’
আদিয়ান গেইটের ভেতরে পা রেখে উত্তর দিল,
‘হয়েছে একরকম।’
পকেট থেকে টাকা বের করে দিল আদিয়ান। বলল,
‘তাড়াতাড়ি টাকা জমা দিয়ে আয়। তোর সাথে একজন দেখা করবে।’
গরমে ঘেমে গেছে রুমঝুম। টিস্যু দিয়ে ঘাম মুছে আগ্রহী হয়ে জানতে চাইল,
‘কে?’
‘আছে একজন। লাইনে দাঁড়া, যা। পিছনে পড়লে দেরী হয়ে যাবে।’
রুমঝুম দৌড় দিল। আদিয়ান পিছন থেকে চেঁচিয়ে বলল,
‘আরেহ্, আস্তে দৌঁড়া। হোঁচট খেলে ব্যথা পাবি।’
কড়ারোদ, বটতলায় একটু বিশ্রাম নিবে বলে সেখানেই গেল আদিয়ান। রুমঝুম লাইনে দাঁড়িয়েছে মাত্র। সবকিছু ঠিকঠাকমতো হতে যথেষ্ট সময় লাগবে। সে ফোন বের করে ফেসবুকে লগইন করে নিউজফিড স্ক্রল করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। দূর থেকে একজোড়া দৃষ্টি তাকিয়ে রইল তার দিকে, একধ্যানে। দৃষ্টিতে বিস্ময়, অসহায়ত্ব, অপ্রকাশিত অধিকারবোধ, যা মাত্রই মনের অভ্যন্তরে অঙ্কুরিত চারাগাছের ন্যায় মাটির বুক ছিঁড়ে সুবিশাল আকাশের দিকে দাবিত হচ্ছিল। অদৃশ্য ঝড়োহাওয়ায় মিনিটের মধ্যেই তা মুখ থুবড়ে পড়ে রইল। গরমে অতিষ্ঠ আদিয়ান পানি খাওয়ার জন্য ক্যান্টিনে পা রাখতেই কর্ণারে বসে থাকা রমণীর দিকে একপলক তাকিয়ে সঙ্গে সঙ্গে চোখ সরিয়ে নিয়ে আলাদা একটা ফাঁকা জায়গায় গিয়ে বসলো। একদৃষ্টিতে বাইরের দিকে তাকিয়ে আঙুলের নখ খুটছে নওমী। সম্ভবত তাকে দেখেনি, দেখলেও এড়িয়ে চলত। সে মুখ ঘুরিয়ে পানি ও নিজের জন্য এক কাপ চা অর্ডার দিল।
নওমীকে চিন্তিত দেখে মৌমি বলল,
‘ওদিকে কী দেখছিস তখন থেকে?’
দূরের লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা বোরখা, হিজাব ও নেকাব পরিহিত মেয়ের দিকে ইশারা করে নওমী বলল,
‘ওইযে, পার্পল হিজাবপরা মেয়েটা… তাকে।’
মৌমি সেদিকে একনজর তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল,
‘তাকে এত দেখার কী আছে?’
‘কিছুই না, জাস্ট চোখ পড়ল।’
‘এত মেয়ে রেখে তার দিকেই কেন চোখ পড়ল?’
‘কী জানি! সব চোখের দোষ। চল, উঠি…।’
বিল মিটিয়ে ক্যান্টিন থেকে বেরোবার মুখে সামনের টেবিলেই আদিয়ানকে দেখতে পেল নওমী। দেখেনি এরকম একটা ভাব নিয়ে বের হয়ে গেল। সেদিনের পর থেকে আদিয়ানকে খুব করে ইগনোর করছে নওমী। কেন সেটা সে নিজেও জানে না। বিড়ালের আঁচড়ের কারণে আদিয়ানকে সামান্য মুহূর্তের জন্য সেবাশুশ্রূষা দিতে গিয়ে নিজেই বিপাকে পড়ে গিয়েছিল সে। প্রেম কী, কীভাবে আসে, এসব নিয়ে এ যাবৎ কোনোপ্রকার অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়নি। কিন্তু ওইদিন, কী যেন হয়ে গেল। সব এলোমেলো। এরপর থেকে রাতে ঘুম হয় না, মন ছটফট করে। বন্ধ চোখের পাতায় একটাই অস্তিত্ব ভেসে উঠে। যখনই নিছকই একটা সাধারণ ঘটনা বলে এড়িয়ে যেতে চায়, তখনই তা প্রবলভাবে মনের অন্দরে ভিড় জমায়। নানানভাবে, নানান প্রশ্নের সম্মুখে দাঁড় করিয়ে দেয় তাকে। পরপর দুটোদিন একই অনুভূতি হওয়ার পর, তৃতীয়দিন আদিয়ান তার মামাতো বোনদের পড়াতে গেলে চা-নাশতার অজুহাতেও সামনে গেল না নওমী। বরংচ এরপর থেকে সে নানুবাড়ি যাওয়াটাই বাদ দিয়ে দিয়েছে। গত দেড় মাস ধরে নানান বাহানায় নানুকে বুঝিয়েছে, তার সামনে পরীক্ষা, পড়াশোনায় মনোযোগ দেয়া উচিত। এমনকি শুক্রবারেও অজুহাত দেখায়। এসব বলে নিজের মনটাকে সে আটকে রেখেছে। এখনই, এতদ্রুত কারও মায়ায় পড়তে চায় না। সামনে তার ক্যারিয়ার পড়ে রয়েছে। কী করে এসব নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতি আকৃষ্ট হতে পারে? আজও ঠিক একইভাবে মনকে আটকে নিল। তবুও কোথাও যেন মন কেমনের সুরে মনে বেজে উঠল একটাই প্রশ্ন,
‘কে এই মেয়ে? কী তার নাম?’
বিড়াবিড়ানিটা মৌমি শুনল। অবাক হয়ে বলল,
‘কী বিড়বিড় করিস? কোন মেয়ে? কার মেয়ে?’
হুঁশে ফিরে দু’দিকে মাথা নাড়ল নওমী। মনকে শান্ত করতে গভীরকরে শ্বাস টেনে বলল,
‘কেউ না।’
বান্ধবীর এই হেয়ালি আচরণ অদ্ভুত ঠেকল মৌমির কাছে। কতক্ষণ চেয়ে থেকে বলল,
‘তোর কী হয়েছে বল তো?’
‘কিছু হয়নি।’
হাঁটতে হাঁটতে বলল নওমী। মৌমি বিশ্বাস করল না। ভালোমতো মুখাবয়ব খেয়াল করে বলল,
‘কোনো কারণে আপসেট তুই? মন খারাপ? এতক্ষণ তো ঠিক ছিলি। হুট করে কী হলো?’
‘আমি ঠিক আছি। আমার আবার কী হবে?’
অকারণেই একবার পিছনে ফিরল নওমী। গেইটের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা আদিয়ান ও তার সাথের মেয়েটার দিকে চোখ পড়ে গেল। কেন তাকাল সে নিজেও জানে না, তবে তাকিয়েই বুঝল, কী ভুল করেছে! বাইরে এসে আদিয়ান একটা আইসক্রিম কিনল, সেটা ধরিয়ে দিল মেয়েটির হাতে। মুহূর্তেই মেয়েটি খলখলিয়ে হেসে উঠল। হাসল নওমীও। মনের ভেতর জমে ওঠা বিষাদের মেঘটা দূর হয়ে গেল। দৃশ্যটা যদি হয় ভালোবাসাময়, তাহলে এটা এমনই সুন্দর। ভালোবাসাদের ভালো থাকতে দেখলে শান্তি লাগে। চোখ ফিরিয়ে হাঁটায় মনোযোগ দিল। হাঁটতে হাঁটতে একটা রাস্তা ক্রস করে অন্য রাস্তায় এসে দাঁড়াতেই ফুটপাতে কাঁথামুড়ি দিয়ে শুয়ে থাকা বৃদ্ধ লোকটা নওমীর দিকে হাত বাড়িয়ে বলল,
‘ক’টা টাকা ভিক্ষা দিয়া যাও, মা। কয়দিন ধইরা না খাইয়া আছি।’
নওমীর খুব মায়া হলো। অভ্যাসবশত খানিকটা ঝুঁকে হাতের ইশারায় দূরের রেস্টুরেন্ট দেখিয়ে বলল,
‘আপনি আসুন আমার সাথে। ওই রেস্টুরেন্টে যাই।’
বৃদ্ধ লোকটি বলল,
‘ওত দামী রেস্তোরাঁয় যাওয়ার দরকার নাই, মা। আমি এইহানেই ঠিক আছি। পারলে কিছু টাকা দিয়া যাও, আমার মাইয়াডা খাবার কিইন্যা নিয়া আসব।’
আর বেশি জোরাজুরি করল না নওমী। ভ্যানিটিব্যাগ থেকে বেশকিছু টাকা বের করে লোকটির দিকে বাড়িয়ে দিল। থরথর করে কাঁপতে থাকা হাতে টাকাগুলো নিয়ে নওমীর জন্য রবের নিকট প্রার্থনা করল লোকটি। নওমী ফিরে যেতে পা বাড়াল। আচমকাই ঝড়েরবেগে কেউ তার হাতে টান মারল। সেই টানে কয়েক হাত দূরে তো সরে গেলই, টাল সামলাতে না পেরে কারও বুকের সাথে মিশে গেল একদম। অনবরত বুক কাঁপছে তার। কী হয়েছে কিছুই বুঝতে পারছে না। একটু রিল্যাক্স হতেই মাথা তুলে ধাক্কা খেল। সামনে থাকা পুরুষটা আদিয়ান আর সে আদিয়ানের বুকে। সঙ্গে সঙ্গে ছিঁটকে দূরে সরে গেল নওমী। ধিক্কার দিল নিজেকে। বিড়বিড়াল,
‘ছিঃ… নওমী, কী করলি এটা!’
নিজেকে বকেঝকে সামনে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেল। আশেপাশে হন্যে হয়ে চোখ বুলাচ্ছে আদিয়ান। কাউকে যেন খুঁজছে। এদিক-ওদিক ছুটে না পেয়ে নওমীর সামনে এসে কিছুক্ষণ আগে যে বৃদ্ধকে টাকা দিল, সেই জায়গায় এনে দাঁড় করিয়ে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল,
‘দেখুন, কাকে টাকা দান করছিলেন আপনি? কে আছে এখানে? কেউ নেই। ওই লোকটা একটা ধান্ধাবাজ।’
নওমীর যেন গা জ্বলে উঠল শোনে। সে যাকে খুশি তাকে দানখয়রাত করবে, এতে এই আদিয়ানের কী? তার এত মাথাব্যথা কেন? কিছুক্ষণ আগের বিব্রতকর পরিস্থিতির কথা ভেবে মেজাজ ধরে রাখতে না পেরে বলল,
‘আমি যাকে খুশি তাকে দানখয়রাত করব, তাতে আপনার কী? আমার ব্যক্তিগত চিন্তা-স্বাধীনতায় আপনি কেন নাক গলাচ্ছেন? আর এভাবে এতগুলো লোকের সামনে টেনে ধরার মানে কী? পারিবারিক শিক্ষা নেই? সাধারণ ভদ্রতা নেই? সুযোগ পেলেই মেয়েদের জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে হয়! অভদ্র কোথাকার…।’
আদিয়ানের ইচ্ছে হলো ঠাস করে চড় মেরে দিক, কিন্তু মেয়ে মানুষ ও অযাচিত আচরণ হয়ে যাবে ভেবে হাতকে কন্ট্রোল করে নিল। তবুও মেজাজ ঠাণ্ডা হলো না। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
‘ফর ইউওর কাইন্ড ইনফরমেশন, জড়িয়ে আমি ধরিনি – আপনি ধরেছেন। শুধু ধরেছেন বললে ভুল হবে, বুকে খামচি দিয়ে ধরেছেন।’
রাগে শার্টের উপরের বোতামদুটো খুলে খামচির আঘাতে লালচে হয়ে যাওয়া ব্যথাতুর অংশটা খুব সামান্যই দেখাল আদিয়ান। এরপর বোতাম আটকে বলল,
‘পারিবারিক শিক্ষা ও সাধারণ ভদ্রতা দুটোই আমার মধ্যে আছে। পর্যাপ্ত মনুষ্যত্ববোধও আছে। তাই বিবেকের কাছে স্পষ্ট ও সৎ থাকতে বিপদের হাত থেকে বাঁচিয়েছি মাত্র। এটা যদি আমার ভুল হয়ে থাকে, তাহলে মাফ করে দিবেন।’
কথা শেষ করে খানিকটা দূরে সরে মোবাইল বের করে জাদীদের নম্বরে কল করল আদিয়ান। জোর দিয়ে বলল,
‘জাদীদ, তোমার হাতে যদি সময় থাকে ফোর্স নিয়ে এখুনি ক্যাম্পাসে এসো। কুইক…।’
ফোর্সের কথা কানে আসাতে নওমী অবাক হয়ে চারপাশে তাকাল। বৃদ্ধ লোক ও আদিয়ানের সঙ্গের মেয়েটা, কাউকেই কোথাও দেখল না। এ এক আশ্চর্যজনক ঘটনা হয়ে ধরা দিল চোখে। দু’হাতে মুখ লুকিয়ে ফুঁপিয়ে উঠল। আদিয়ানের কথা যদি সত্যি হয়, উপকারের বিনিময়ে এই বিদ্রুপ আচরণটা কোনোভাবেই প্রাপ্য নয় তার। অথচ সে যা করল, ক্ষমার অযোগ্য…। কী করলে এই ভুল শোধরানো যাবে?
***
আড়ালে টেনে এনে একাধারে জাহাঙ্গীরের লোকটাকে ইচ্ছেমতো পেটাল শুভ। থাপড়ে, লাথি দিয়ে, নাকেমুখে ঘুষি মেরে বলল,
‘জানোয়ার কোথাকার! এত লোকের সামনে কেউ কারও ওপর গুলি চালায়? আর একটু হলে কী হতো? ওই মেয়েটাকে খুন করার দায়িত্ব জাহাঙ্গীর আমার হাতে তুলে দিয়েছে। যা আমার শিকার, তারদিকে চোখ তুলে তাকালে তোর চোখদুটো আমি উপড়ে ফেলব।’
মার খেয়েও দমে গেল না লোকটি। নাকমুখ দিয়ে বেরিয়ে আসা রক্ত মুছে নিয়ে বলল,
‘তুমি তো খুন করছ না। বার বার সুযোগ হাতছাড়া করছ। তাইতো আমাকে চান্সটা নিতে হলো।’
প্যান্টের পকেট থেকে রিভলবার বের করল শুভ। সোজা লোকটির মাথায় তাক করে বলল,
‘আর যদি তোদেরকে ওই মেয়েটার আশেপাশে দেখেছি, সোজা গুলি করে খুলি উড়িয়ে দিব।’
এরমধ্যেই পুলিশের সাইরেন শোনা গেল। শুভ লোকটাকে পরবর্তী আঘাত দেয়ার আগেই দৌড়ে কোথাও পালিয়ে গেল লোকটি। সাথে পালাল তার সঙ্গীরাও। শুভ আর দেরী করল না। রিভলবার প্যান্টের ফাঁকে আটকে সামনে থাকা রেস্টুরেন্টের দিকে পা বাড়াল।
তখন রেস্টুরেন্টের সামনে রুমঝুমকে রেখে কোথাও একটা ছুট দিল আদিয়ান। রুমঝুম জানতে চাইলে বলল,
‘তুই ভেতরে যা, আমি আসছি।’
বাইরের হট্টগোল কিছুই রুমঝুমের কানে গেল না। রেস্টুরেন্টে বসে অযথাই সময় অতিবাহিত করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। আদিয়ান যে কোথায় গেল! ভাবতে গিয়ে মেন্যুকার্ডে চোখ বুলালো। কিছু যদি অর্ডার করা যায়। অনেকক্ষণ ধরে অভুক্ত থাকায় পেটের ক্ষিধে তখুনি টের পেল সে। কার্ডে চোখ রেখে খাবারের নামগুলো দেখছিল, আচমকাই শুনল,
‘কী খাবেন, ম্যাডাম?’
পরিচিত কণ্ঠস্বর! ভুল শুনল না তো? চোখ তুলে সামনে তাকিয়ে ভয়ানকভাবে চমকে উঠল রুমঝুম। দু’হাতে মুখ চেপে বিস্ময় ধরে রেখে আওড়াল,
‘তুমি…!’
কাছে এসে টেবিলে হেলান দিয়ে দাঁড়াল শুভ। পাশের সিট দেখিয়ে বলল
‘বসব?’
বিয়ের পর থেকে যে মানুষটা তাকে জড়িয়ে ধরতে কোনোপ্রকার অনুমতির প্রয়োজনবোধ করত না, আজ সে বসার জন্য অনুমতি চাইছে। অনেকদিন পর শুভকে সামনে দেখে, সুস্থ ও জীবিত দেখে খুশি হওয়ার বদলে রেগে গেল রুমঝুম। ভীষণ দুঃখে চোখদুটো ভরে উঠল জলে। অনুমতি না দিয়ে নিজেই চেয়ার ছাড়ল। অভিমানে শুভকে উপেক্ষা করে বাইরে চলে যেতে চাইলে হাত বাড়িয়ে তাকে আটকে নিল শুভ। বলল,
‘চলে যাচ্ছ কেন?’
হাত ছাড়ানোর জন্য মোচড়ামুচড়ি শুরু করল রুমঝুম। শুভ ছাড়ল না। শক্ত করে ধরে, একটানে রুমঝুমকে নিয়ে পর্দার আড়ালে সরে গেল। এই কেবিনটা ঘণ্টাখানেক আগেই ভাড়া নিয়েছে আদিয়ান। শুধু বন্ধু তার বউয়ের সাথে দেখা করতে চেয়েছে বলে। হুটহাট এই ধাক্কায় চরম ক্ষ্যাপে গেল রুমঝুম। হাত ছাড়াতে গাইগুই শুরু করল। আটকে রাখা চোখের পানি গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ল ততক্ষণে। শুভ কাছে এগোলো। একটা নিরাপদ জায়গায় রুমঝুমকে বসিয়ে চট করে কোলে মাথা রেখে কোমর প্যাঁচিয়ে ধরে বোরখার ওপরেই উদোরে ঠোঁট ছুঁইয়ে বলল,
‘এত রাগ ভালো না, ঝুমসোনা।’
শান্ত হতে পারল না রুমঝুম। ক্ষ্যাপেটেপে অস্থির হয়ে বলল,
‘বেঈমান, মিথ্যেবাদী, স্বার্থপর। আমার সরলতার সুযোগ নিয়েছ তুমি। আমাকে ঠকিয়েছ। তোমার জন্য আমি ও আদি ভাইয়া কতবড়ো বিপদের মুখে দাঁড়িয়ে আছি আজ। যেখানেই পা ফেলি, স্বামী-স্ত্রী সাজতে হয়। নয়তো এই নরক আমাকে ঠাঁই দিত না। মৃত্যু ছাড়া আমার হাতে কোনো অপশন রাখোনি তুমি। ছিঃ… তোমাকে বিশ্বাস করে হাত ধরেছিলাম আর তুমি কী করলে…।’
রুমঝুমের অভিমানী কথা ও কান্নায় দিশেহারা হয়ে গেল শুভ। কোল থেকে মাথা তুলে পরপর অনেকগুলো আদর দিল সারামুখে। উদোরে হাত রেখে, কপালে কপাল ঠেকিয়ে বলল,
‘আমার বাচ্চার কসম ঝুম, আমি তোমাকে ঠকাচ্ছি না। ভীষণ অসহায় অবস্থা আমার। আদি সব জানে। তুমি আমাকে ভুল বোঝো না, জান। বিশ্বাস কোরো আমার কথা।’
রুমঝুম এত সহজে বিশ্বাস করতে পারল না। ফুঁসে ওঠা রাগকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে শক্ত কণ্ঠে শুভর উদ্দেশ্যে বলল,
‘এতদিন কোথায় ছিলে তুমি? তুমি জানো, তোমার জন্য একেকটা দিন, একেকটা রাত আমার কেমন কেটেছে? বাবার চোখে ধুলো দিচ্ছি, সমাজের চোখকে ফাঁকি দিচ্ছি। কী করিনি আমি বোলো তো? অথচ তুমি, ‘বেঁচে আছো’ এই একটা ইনফরমেশন আমাকে দিতে পারলে না। শুধু তোমার জন্য আজ আমার এই অবস্থা।’
সব অভিযোগ মাথা পেতে নিল শুভ। রুমঝুমের গাল ছুঁয়ে, গড়িয়ে পড়া অশ্রু মুছে দিয়ে বলল,
‘সব ঠিক করে দেব, আমাকে কয়েকটা মাস সময় দাও।’
‘কী হবে তাতে?’
‘একটা মেয়ের জীবন বাঁচাতে হবে।’
আঁৎকে উঠল রুমঝুম। জানতে চাইল,
‘কেন?’
‘মেয়েটা বিপদে আছে। কিন্তু সে জানে না, তার সামনে কত বড়ো বিপদ ওতপেতে আছে। তাকে বাঁচানোর চেষ্টা করতে গিয়ে তোমার থেকে দূরে থাকতে হচ্ছে। একটু সময় দাও, আর মাত্র কয়েকটা মাস, এরপরই মেয়েটা লন্ডনে চলে যাবে। দেশ ছাড়ার আগ পর্যন্ত তাকে বাঁচানোর জন্যই তার মৃত্যুদূত সেজে জাহাঙ্গীরের চোখে ধুলো দিতে হবে।’
‘মেয়েটা কে?’
‘তোফাজ্জল হোসেনের মেয়ে। নওমী…।’
‘নওমী’ নাম শোনে শরীরের সবগুলো পশম দাঁড়িয়ে গেল রুমঝুমের। এই নওমী কি আদিয়ানের ভালোবাসা? যদি হয়, কী হবে? ভয়ে তার অন্তরাত্মা কেঁপে উঠল। এই বুঝি জানটা বেরিয়ে গেল। সে শুভকে হারানোর ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে জানতে চাইল,
‘তুমিই কেন শুভ?’
‘আমি ফেঁসে গেছি, ঝুম। একটু প্রার্থনা কোরো আমার জন্য। সব যেন ঠিকঠাক হয়। আমি কোনো অপরাধ করতে চাই না। জেনে-বুঝে তো একেবারেই না।’
রুমঝুমের কান্না আবারও বেড়ে গেল। এতদিন পর ফিরে এসে এই কথা বলছে। বিশ্বাস করতে না চাইলেও বাচ্চা ছুঁয়ে কসম করতে দেখে অবিশ্বাস করতে পারল না রুমঝুম। বলল,
‘তাহলে কি আমাদের সংসারটা অপূর্ণই থেকে যাবে?’
মুচকি হাসলো শুভ। কপালে বিশ্বস্ততার চুমু এঁকে বলল,
‘না… সব হবে। ঘর হবে, সংসারও হবে, শুধু কয়েকটা মাসের ব্যাপার মাত্র। আমি বাবা-মাকে তোমার ও আমাদের অনাগত সন্তানের কথা জানিয়েছি। মা এখন বউমা ঘরে তুলতে প্রস্তুত। এই ফাঁদ থেকে বের হই আগে, এরপর গ্রামে ফিরে তোমাকে নিয়ে সংসার সাজাব। সেই অবধি একটু ধৈর্য ধরতে হবে তোমায়। পারবে না?’
এই কথায় একটু ভরসা পেল রুমঝুম। রাগ-অভিমান সব দূরে সরিয়ে কাঙ্ক্ষিত আশ্রয়ে মুখ গুঁজে দিল। কতদিন পর প্রিয় মানুষের বুকে মাথা রাখল সে। কলিজা ঠাণ্ডা হলো। কষ্ট কমে এলো। অনেকক্ষণ জড়িয়ে থেকে ভেতরে জমে থাকা যন্ত্রণার ঢেউকে দূরে সরিয়ে বলল,
‘কথা দিচ্ছ তো? এরপর আর হারাবে না! যদি হারাও, আমিও কিন্তু থাকব না। অনেকদূরে চলে যাব। যেখানে গেলে কেউ ফিরে আসে না।’
শুভর খুব কষ্ট হলো। মেয়েটা মাঝেমধ্যেই এরকম কথা বলে। তার হৃদয়কে ক্ষতবিক্ষত করে। এমনিতেই চিন্তায় রাতে ঘুম হয় না, তারমধ্যে রুমঝুমের এসব কথা। যদিও রাগ করা উচিত, কিন্তু শুভ রাগল না। অনেকদিন পর বউকে কাছে পেয়েছে। তার আবেগী কথাবার্তা নাহয় একটু সহ্য করে নিল। ক্ষতি তো নেই। কতদিন এই আদুরে অভিমান না শোনে দিন কাটিয়েছে। মনে মনে নিজেকে শান্ত করে কৌতুকের সুরে বলল,
‘ঠিক আছে, যাওয়ার আগে আমাকেও সাথে নিও। বিয়ের দিন কিন্তু কথা দিয়েছিলাম, বাঁচলে একসাথে বাঁচব, মরলে একসাথে মরব। কথার নড়চড় করবে না। তাহলে কিন্তু খুব খারাপ হবে।’
টিপ্পনী কাটল শুভ। রুমঝুম কিল বসাল বুকে। রাগতস্বরে বলল,
‘শয়তান…।’
নির্ভার হেসে শুভ বলল,
‘কিছু খাবে? অর্ডার করি?’
রুমঝুম হুঁশে ফিরল। অনেকক্ষণ ধরে সে এখানে আছে। আদিয়ান কোথায়? সে চিন্তিতমনে পর্দা সরিয়ে বাইরে দৃষ্টি দিয়ে বলল,
‘ভাইয়া কোথায়?’
‘আছে সামনেই।’
‘কোনো বিপদ হয়নি তো?’
‘না না, বিপদ হবে কেন?’
‘পুলিশের গাড়ির আওয়াজ শোনলাম।’
‘হ্যাঁ, লোকাল থানার ইনস্পেকটর এসেছে। কিছুক্ষণ আগে একটা ঝামেলা হয়েছে। আদি নিজেই পুলিশকে ইনফর্ম করেছে।’
‘ওহ…। তুমি নওমীর ব্যাপারটা পুলিশকে জানাচ্ছ না কেন?’
শুভ অসহায় চোখে তাকিয়ে বলল,
‘জানালে তোমাকে হারিয়ে ফেলব, ঝুম।’
জাহাঙ্গীর সম্পর্কে কিছু কথা রুমঝুমকে জানালে বেশিকিছু জানার আগ্রহ দেখাল না রুমঝুম। বুঝতে পারল, তাকে বাঁচানোর জন্যই আরেকটা মেয়েকে মেরে ফেলার মতো জঘন্য চুক্তিতে ফেঁসে গেছে গিয়েছে তার ভালোবাসা। ভাগ্য এত নিষ্ঠুরতা দেখাবে আগে যদি জানত…। কিন্তু এই জাহাঙ্গীর কেন নওমীর ক্ষতি চায়? তার এত ক্ষমতা কীসের? পুলিশ কেন তাকে অ্যারেস্ট করছে না? ভাবতে গিয়ে নওমীর জন্য চিন্তা হলো তার। কী আছে তাদের কপালে? বাঁচবে তো মেয়েটা? শুভ কি পারবে মেয়েটাকে শেষ পর্যন্ত রক্ষা করতে? যদি খারাপ কিছু হয়, আদিয়ান কী করবে? এত চিন্তায় দিশেহারা অবস্থা হলো তার। মাথা থেকে সব চিন্তা সরিয়ে দিয়ে সে আরেকটু শক্ত করে শুভকে জড়িয়ে ধরে বলল,
‘তুমি আমাকে আগলে রাখো, শুভ। একটু শক্ত করে জড়িয়ে রাখো। পৃথিবীর কোনো খারাপ শক্তি যেন আমাদের আলাদা করতে না পারে। ভালোবাসার বাঁধনের কাছে সব খারাপ শক্তিকে হারিয়ে দাও, প্লিজ। হারিয়ে দাও।’
***
চলবে…