#পায়ে_পায়ে_হারিয়ে
লেখনীতে : তামান্না বিনতে সোবহান
পর্ব – ১৩
পুলিশের গাড়ি দেখে সন্দিহান মন নিয়ে চারপাশে চোখ ঘুরিয়ে নিল নওমী। এখানে এমনকিছুই চোখে পড়ল না, যার জন্য পুলিশ আসা জরুরী হয়ে পড়েছে। পুরো ব্যাপারটা বোঝার জন্য আদিয়ান ও জাদীদের সামনে দাঁড়ালে জাদীদ বলল,
‘ম্যাডাম, আপনি বাসায় চলে যান।’
নওম হতবাক চোখে তাকিয়ে থেকে বলল,
‘কেন? এখানে কী হয়েছে?’
‘কিছু একটা সমস্যা আছে। আমরা দেখছি।’
এরপর শুধু নওমী নয়, আশেপাশে যত ছেলেমেয়ে ছিল, সবাইকেই নিরাপদ জায়গায় চলে যেতে বলল জাদীদ। এখানে কোথাও কোনো সিসিটিভি নেই। ক্যাম্পাসের সামনে যেটা আছে, সেটা দিয়ে এই রাস্তা পরিষ্কার দেখা যায় না। সামনে যে রেস্টুরেন্ট সেখানেও কোনো সিসিটিভি না পেয়ে হতাশ হয়ে জাদীদ বলল,
‘এখানে তো তেমন কিছু নেই। কী দিয়ে বুঝব যে কেউ কারো ক্ষতি করতে চেয়েছিল?’
নওমী চলে গেছে। এখন আর দ্বিধাদ্বন্দ নয়, বরং স্পষ্টস্বরে আদিয়ান বলল,
‘তোমার হয়তো আমার কথা বিশ্বাস হচ্ছে না। কিন্তু এটাই সত্য। এখানে কেউ ভিক্ষুক সেজে এসেছিল ওই মেয়েটাকে মারতে। আমি যদি টেনে না সরাতাম, হয়তো গুলিটা করেই ফেলত।’
‘গুলি করেনি বলছ?’
‘ট্রিগারে আঙুল রেখেছিল মাত্র, কিন্তু চাপ দেয়নি। আমি দেখে ফেলার পর পালিয়ে গেল।’
‘এই মেয়েটাকে কেউ কেন মারতে চাইবে?’
‘সেটা ওনার পরিবারের লোকজন ভালো জানবে। আমার মনে হয়, তুমি একবার মেয়েটার বাবা-মায়ের সাথে কথা বলে দেখো, তাদের কোনো শত্রু আছে কি না। কিংবা কেউ তাদের ক্ষতি করতে চায় কি না।’
‘হ্যাঁ, এটা জানা জরুরী আগে।’
ফোর্স দিয়ে ভালোমতো চারপাশ চেক করাল জাদীদ। সন্দেহজনক কোনোকিছু না পেলেও ময়লার স্তুপের কাছে একটা রিভলবার পেয়ে গেল। আর এটা পাওয়াতেই আদিয়ানের কথার সত্যতা বুঝতে পারল সে। টিস্যু দিয়ে রিভলবার হাতে নিয়ে কাছে এসে বলল,
‘এটাই আমাদের কাজটা সহজ করে দিবে। থ্যাংক ইউ আদি।’
আদিয়ান শুধু মুচকি হাসলো। জাদীদকে বিদায় দিয়ে রেস্টুরেন্টে প্রবেশ করে দেখল, বন্ধু আর বন্ধুর বউ আমোদে খাচ্ছে। বিস্ময়ে সে কথা হারিয়ে ফেলল। বলল,
‘হাউ স্ট্রেঞ্জ! আমাকে ছাড়াই খাওয়া হয়ে যাচ্ছে? কী স্বার্থপররে বাবা! এত কষ্ট আমি কাদের জন্য করি?’
আদিয়ানের কথা শোনে উচ্চস্বরে হেসে উঠল শুভ। টেনে বসাল পাশের সিটে। আলাদা করে সরিয়ে রাখা চিকেন বিরিয়ানি রেখে দিল বন্ধুর সামনে। বলল,
‘তোর ভাগ কিন্তু ঠিকই আছে।’
আদিয়ান মাথা নাড়ল। চামচে তুলে অল্প বিরিয়ানি মুখে নিয়ে বলল,
‘তারপর বল, এভাবে কতদিন?’
শুভ সিরিয়াস হয়ে বসে বন্ধুর কথার উত্তরে বলল,
‘আর কয়েকটা মাস, দোস্ত। দেখতে দেখতে কেটে যাবে।’
‘আম্মি ঢাকায় আসতে চান। গতকাল জোর করে ঠিকানা নিয়েছেন। আমি শিওর, যেকোনোদিন চলে আসবেন। ঝুমের যা অবস্থা, বুঝতে পারলে সত্যিটা চেপে রাখব কতদিন?’
‘আন্টি যদি ঢাকায় আসেন, আমাকে ফোন করিস। আমি এসে দেখা করব। যা বলার, আমি-ই বলব। তোকে কিছু বলতে হবে না। আর এত টেনশনে না থেকে চাকরির জন্য ভাব। টিউশনি করে তো আর বাড়তি টাকা আসে না।’
আদিয়ান নিজেও এই নিয়ে চিন্তিত বলেই যেখানে যেখানে ইন্টারভিউয়ের জন্য ডাকছে, দৌড়াচ্ছে। একটা চাকরি না হলে প্রতিমাসের খরচ চালিয়ে নেয়া কষ্ট। বাসাভাড়াতেই অনেক টাকার দরকার। টিউশনির এই টাকা দিয়ে পুষোয় না। যদিও এই মাসে আরও দুটো টিউশনি জুটিয়ে ফেলেছে, কিন্তু এগুলো করে তো সামান্য কিছু টাকা আসে হাতে। কিছুই আর ভাবতে পারল না সে। চিন্তায় কপালে ঘাম দেখা দিল। ফুঁস করে নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল,
‘আমার মনে হয় এই শহরটা আমাকে চাইছে না। নয়তো এত চেষ্টা, এত ছোটাছুটি সব কেন ব্যর্থ হয়ে যাচ্ছে?’
বন্ধুকে ভরসা দিয়ে শুভ বলল,
‘ওসব চিন্তা ছাড়। একটা না একটা উপায় ঠিকই পাওয়া যাবে। এখন আমি উঠি। আবার যখন সময় পাব, দেখা করব।’
শুভ এখুনি চলে যাবে রুমঝুমের মন খারাপ হয়ে গেল। সে ব্যথাতুর চোখে চেয়ে থেকে বলল,
‘এখুনি যাবে? আর কিছুক্ষণ পর গেলে হয় না?’
আদিয়ান পরিস্থিতি বুঝে ওয়াশরুমের বাহানায় দূরে সরে গেল। শুভ উঠে দাঁড়িয়ে সামান্য ঝুঁকে রুমঝুমের কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে বলল,
‘টেনশনের কিছু নিই। আমি সময় বুঝে কল করব। তুমি রিল্যাক্স থাকো। যদি পারো, আবারও চেকআপ করিয়ে নিও।’
রুমঝুম ঘাড় নাড়ল শুধু। পকেট থেকে মোটা অংকের অ্যামাউন্ট রুমঝুমের হাতে তুলে দিল শুভ। বলল,
‘আদির সিচুয়েশন তো জানোই। প্রয়োজন হলে এখান থেকে খরচ করবে। ওর ওপর বেশি চাপ দিও না।’
রুমঝুম আবারও মাথা নাড়ল। মন খারাপের কারণে সে কথাই বলতে পারল না। শুভ তার অবস্থা বুঝতে পেরে দু’হাতে আগলে নিয়ে সান্ত্বনা দিয়ে বলল,
‘যতক্ষণ আমার দেহে প্রাণ আছে ততক্ষণ আমি শুধু তোমার, ঝুম। আমাকে নিয়ে ভয়ের কিছু নেই। আমি ঠিক থাকব। নিজের ও বাচ্চার খেয়াল রেখো। আসছি।’
রুমঝুম কেঁদেই ফেলল। এভাবে, এত তাড়াতাড়ি শুভকে বিদায় জানাতে মন থেকে সায় আসছে না। কান্নার দরুণ কথারাও ফুরিয়ে গেল। আলতো করে তার ঠোঁটে চুমু খেল শুভ। চোখের পানি মুছে দিয়ে বলল,
‘কাঁদে না, ঝুমসোনা। আমার কষ্ট হয়।’
***
বিকেলের শেষদিকে বাড়িতে জাদীদকে দেখে একটুবেশিই অবাক হলো নওমী। পুলিশের সাথে কোনো লেনাদেনা নেই তাদের। এমন কোনো সম্পর্ক নেই যে, তার বাপির খুঁজে পুলিশ আসবে। তোফাজ্জল হোসেন মাত্রই বাসায় ফিরেছেন। ফ্রেশ হয়ে ড্রয়িংরুমে বসে মেয়ের সাথে গল্প করছিলেন। তখুনি বাড়ির মূল ফটকে জাদীদের পা পড়ল। সে ভদ্রলোকের উদ্দেশ্যে সামাল ঠুকে বলল,
‘আপনি যদি আমাকে আধাঘণ্টা সময় দিতেন, তাহলে খুব উপকার হতো।’
তোফাজ্জল হোসেন হাসিমুখে জাদীদকে ভেতরে প্রবেশ করার অনুমতি দিলেন। মেয়েকে বললেন, চা নিয়ে আসার জন্য। নুজাইফা আমীন বাসায় নেই। আপাতত মেয়েই ভরসা। হুকুম পালনে সদা তৎপর নওমী বাপির কথা শোনে ছুটে গেল রান্নাঘরে। তোফাজ্জল হোসেন বললেন,
‘বলুন অফিসার, কী উপকার করতে পারি আমি?’
জাদীদ মুচকি হেসে বলল,
‘উপকারটা আমার নয়, আপনার প্রয়োজন।’
‘আমার?’
‘জি…।’
‘যেমন?’
জাদীদ চোখ ঘুরিয়ে দেখল, নওমী ব্যস্ত। কণ্ঠ খাদে নামিয়ে বলল,
‘আপনার মেয়ের খেয়াল রাখবেন। রাস্তাঘাটে ওনার ওপর অ্যাটাক হওয়ার সম্ভাবনা আছে।’
হকচকিয়ে গেলেন তোফাজ্জল হোসেন। নওমীর ওপর অ্যাটাক হবে, পুলিশ জানে কীভাবে? তিনি তো কাউকে জানাননি! ভয়ে-আতঙ্কে গলা শুকিয়ে এলো তার। তিনি বললেন,
‘কী বলছেন, অফিসার? কেন?’
‘সেটা তো আমরা জানি না। আপনি ভালো জানেন। আজ একটা দুর্ঘটনা ঘটতে যাচ্ছিল, আপনার মেয়ের সৌভাগ্য যে, আদিয়ান ফারুকী তাকে বাঁচিয়ে নিয়েছে। আমরা একটা রিভলবার পেয়েছি। ফিঙ্গারপ্রিন্টের রেজাল্ট এলেই বুঝে যাব, কে আপনার মেয়েকে মারতে চাইছিল।’
আর্তনাদ করে উঠলেন তোফাজ্জল হোসেন। জাহাঙ্গীর এত বাড়াবাড়ি করবে ভাবতেও পারেননি তিনি। সেদিনের পর থেকে নওমীকে তিনি নিজেও চোখে চোখে রাখছেন। ভয়ে পুলিশকে কিছু বলতে পারছেন না। পুরনো ঘটনা তুলে আনার কী দরকার? এতে মান-সম্মান যাবে! এই ভয়েই তো পুলিশের কাছে সাহায্য চাননি তিনি। কিন্তু এখন আর উপায় নেই। মেয়ের জীবন বাঁচাতে পুলিশের সাথে কো-অপারেট করতেই হবে। তিনি চিন্তিতমনে বললেন,
‘আপনারা যদি ওর সিকিউরিটির দায়িত্ব নেন, তাহলে হয়তো ওকে বাঁচানো যাবে।’
‘কিন্তু কেন সিকিউরিটি দেব? কে আপনার মেয়েকে মারতে চায়? আপনি কি কিছু বুঝতে পারছেন, কাউকে সন্দেহ করছেন?’
‘ঠিক সন্দেহ নয়, আমি নিশ্চিত। এটা জাহাঙ্গীরের কাজ।’
‘জাহাঙ্গীর কে? তার সাথে আপনার কীসের শত্রুতা?’
‘সব বলব, অফিসার। সব বলব। আপনি শুধু কয়েকটা মাস আমার মেয়েকে দেখে রাখার দায়িত্ব নিন। রাস্তাঘাটে, ভার্সিটিতে, সব জায়গায় ওর আশেপাশে সিকিউরিটি রাখার ব্যবস্থা করুন। প্রয়োজনে যত টাকা লাগে সব আমি দেব। শুধু আমার মেয়েটা লন্ডন চলে যাওয়ার আগ পর্যন্ত ওকে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা দিয়ে এখানে রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। এমনকি আমার বাড়িতেও। পারবেন?’
‘আমি আজ রাতেই ফোর্স পাঠাব।’
ভদ্রলোক চিন্তা দূরে সরাতে পারলেন না। থম মেরে বসে রইলেন নিজের জায়গায়। জাদীদ বলল,
‘জাহাঙ্গীরের ঠিকানা জানেন? কিংবা ফোন নম্বর?’
‘না…। তবে যদি আমাকে প্রয়োজন হয়, ওর লোকের মাধ্যমে ডাক পাঠায় অথবা চিঠি পাঠায়। এক মিনিট বসুন, আমি আসছি।’
তোফাজ্জল হোসেন নিজের ঘরের দিকে অগ্রসর হলেন। নওমী চা নিয়ে এলো। জাদীদের দিকে এক কাপ চা বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
‘কী হয়েছে বলুন তো? আপনি হঠাৎ আমাদের বাসায়?’
কথাটা এড়িয়ে যাওয়ার জন্য জাদীদ চায়ে চুমুক দিল। স্বাদ টের পেয়ে চমকিত হয়ে বলল,
‘আপনি তো দারুণ চা বানান।’
লজ্জিত হেসে নওমী বলল,
‘থ্যাংক ইউ।’
এরমধ্যেই তোফাজ্জল হোসেন চলে এলেন। গত কয়েকদিন আগের দেয়া চিঠিটা জাদীদের হাতে দিয়ে মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন,
‘তুমি যাও, পড়াশোনা কোরো।’
বাপির মেজাজ ভালো নেই হয়তো, কোনো কারণে চোখেমুখে বেশ চিন্তা ও অস্থিরতা। নওমী সেটা টের পেলেও ইচ্ছে করেই কিছু জানতে চাইল না। নিজের ঘরে চলে গেল। জাদীদ চিঠিতে চোখ বুলালো,
❝এখনও সময় আছে, ভাইজান। যদি মেয়েকে বাঁচাতে চাও তো, আমার প্রস্তাবে রাজি হয়ে যাও। নয়তো যেকোনো দিন, যেকোনো সময় মেয়ের লাশ তোমার দুয়ারে ফেলে রাখব। আমাকে চেনো না তুমি। এরপর ঠিকই চিনবে। মেয়েকে মৃত দেখলে টনক নড়বে তোমার। ভালোয় ভালোয় বলছি, আমার সব কথা মেনে নাও।❞ – জাহাঙ্গীর হোসেন।
বিস্ময় চেপে বসলো জাদীদের চেহারায়। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে চেয়ে থেকে বলল,
‘ভাইজান?’
তোফাজ্জল হোসেন উপরনিচ মাথা নেড়ে বললেন,
‘হ্যাঁ, আমার ভাই। একই মায়ের সন্তান না হলেও একই বাবার রক্ত বইছে আমাদের শরীরে।’
‘আপনি এসব লুকিয়েছেন কেন? কেন পুলিশের কাছে সাহায্য চাননি?’
‘আমি ভেবেছি, ও মিথ্যে বলছে। আসলে ও তো দেশেই ছিল না। দীর্ঘ পঁচিশ বছর আমেরিকাতে ছিল। দেশে ফিরল কবে আর নওমীকে চিনল কীভাবে, সেটাই বুঝতে পারছি না। এজন্য মনে হয়েছিল, এসব মিথ্যে। কেউ টাকার জন্য আমার সাথে এমন করছে। কিন্তু আজকের পর মনে হচ্ছে, জাহাঙ্গীর দেশে এসেছে। আর ওর ফিরে আসার একটাই উদ্দেশ্য, আমাকে নিঃস্ব করে দেয়া।’
‘ঠিক কী কারণে আপনার ক্ষতি চাইছে লোকটা?’
এরপর তিনি যা বললেন, তাতে জাদীদের পায়ের তলার মাটি সরে যাওয়ার মতো অনুভূতি হলো। কেবল চেয়ে চেয়ে সব কথা শোনে গেল। অবিশ্বাস্য মনে হলেও তোফাজ্জল হোসেনের ভাঙা গলার আওয়াজে বুঝে গেল, ভদ্রলোক মিথ্যে বলছেন না। চিঠিটা হাতের মুঠোয় নিয়ে বলল,
‘আপনি চিন্তা করবেন না। এই জাহাঙ্গীরকে আমি ঠিকই খুঁজে বের করব। একবার ওর লোকেশনটা পাই…।’
***
রিংকি ও পিংকি পড়তে বসেছে। রিংকি পড়াশোনাতে ভালো হলেও পিংকি ছিল একটু গাধী টাইপের। সবকিছু পারলেও অংকের সূত্রগুলো ঠিকঠাক মনে রাখতে পারে না। সব সূত্র তার মাথার ওপর দিয়ে যায়। এজন্য পড়ানো শুরু করার পর, পিংকির এই দুর্বলতা বুঝতে পেরে, প্রথম সপ্তাহ তাকে শুধু সূত্র শিখিয়েছে। এখন মোটামুটি আগের চেয়ে বেশ উন্নতি হয়েছে তার। একবার বুঝিয়ে দিলেই বুঝতে পারে। অন্য কোনো সাবজেক্টে সমস্যা নেই, তবুও ইংরেজির জন্য রাতে আরও একজন টিচার আসেন দুইবোনকে পড়াতে। আজও পড়াতে বসিয়ে দু’জনকে পড়া দেখিয়ে দিচ্ছিল আদিয়ান। সেই সময় তাকে অবাক করে দিয়ে নানুবাড়িতে এলো নওমী। এসে নানুকে দেখে রিংকির রুমে উঁকি দিয়ে বলল,
‘এই তোর নেইলকাটারটা দে তো।’
আচমকা এসে নেইলকাটার চাওয়াতে দুইবোন অবাক হলো। রিংকি বলল,
‘এখন নেইলকাটার দিয়ে কী করবে?’
‘নখ কাটব।’
‘বাড়িতে কাটতে পারোনি? এখানে এসে মনে হয়েছে? সবসময় পড়ার মাঝে বিরক্ত করা।’
‘এ্যাই, এত চ্যাটাংচ্যাটাং কথা বলবি না। যা বলছি তাই কর। দে নেইলকাটার।’
বিরক্তিকর মেজাজ নিয়ে নিজের ড্রেসিংটেবিলের ড্রয়ার থেকে নেইলকাটার বের করে নওমীর দিকে সেটা বাড়িয়ে দিয়ে রিংকি বলল,
‘তুমি কি নখ কাটতেই এখানে এসেছ? না কি অন্য কোনো উদ্দেশ্য? তোমার তো লম্বা নখ পছন্দ। কেটে ফেলতে চাইছ কেন?’
নওমী মুচকি হেসে আদিয়ানের দিকে তাকিয়ে নেইলকাটার নিজের হাতে নিয়ে, অতি যত্নে রাখা নখের দিকে তাকিয়ে বলল,
‘এই নখ এখন বিপজ্জনক হয়ে গেছে রে। যখন-তখন যাকে-তাকে রক্তাক্ত করে ফেলে।’
‘মানে কী?’
‘আর বলিস না। রাস্তাঘাটে কখন, কী দুর্ঘটনা ঘটে সেটা তো আর খেয়াল থাকে না, তাই না? বেখেয়ালিতে উপকারীর গায়ে আঁচড় লেগে যায়। ভবিষ্যতে যেন এরকম সিচুয়েশন আর না আসে, এই কারণেই নিজের অতিপ্রিয়, যত্নে রাখা নখগুলোও কেটে ফেলার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমার কারণে কেউ নিজের এত দামী রক্ত কেন ঝরাবে বল? আমি তো আর স্পেশাল কেউ না।’
নওমী এতকিছু ভেবে ও বুঝে বলেনি। তার ইচ্ছে ছিল, আদিয়ানকে একটু খোঁচানো। এই কারণেই এভাবে বলছিল। কিন্তু তার একেকটা কথা সামনে বসে থাকা পুরুষটিকে একটু একটু করে ক্ষত-বিক্ষত করছিল। সে যদি জানত, এই মানুষটার কাছে সে কী, তাহলে এইভাবে বলতে পারল না।
নেইলকাটার নিয়ে নওমী ফিরে যাচ্ছিল। আদিয়ান নিজেই ডাক দিল,
‘শুনুন…।’
দরজার কাছে থেমে গিয়ে নওমী বলল,
‘আমাকে বলছেন?’
চেয়ার ছেড়ে উপরনিচ মাথা নেড়ে সামনে এগোলো আদিয়ান। প্যান্টের পকেটে হাত গলিয়ে মানিব্যাগ বের করে নওমীর প্রাপ্ত পনেরো’শ ষাট টাকা তার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
‘আপনার টাকা।’
নওমী অবাক হলো। ঠোঁট কামড়ে হাসলোও সামান্য। বলল,
‘এতদিন পর?’
‘সুদ নিতে চান? কত পার্সেন্ট দিতে হবে? পঁচিশ, পঞ্চাশ না কি আরও বেশি?’
এতক্ষণের খোঁচানো কথা এভাবে ফিরিয়ে দিবে, ভাবেইনি নওমী। কেমন যেন একটা দমবন্ধ করা যন্ত্রণাদায়ক অনুভূতি চেপে ধরল তাকে। বলল,
‘আমি কি সুদ চেয়েছি?’
‘তা চাননি। কিন্তু আমার মনে হলো। এতদিন পর টাকা ফেরত দিচ্ছি, হয়তো সুদ চাইতেও পারেন। এই টাকার জন্যই তো কথা শুনাচ্ছিলেন সেদিন। আসলে আমি পকেটে এত টাকা নিয়ে ঘুরি না, চুরি ও হারিয়ে ফেলার ভয়ে। একটু বেশি হিসেবী হওয়ার কারণে চলতে পথে বুঝে-শুনে পা ফেলি। যাইহোক, টাকাটা নিয়ে আমাকে ঋণমুক্ত করুন। আমি কারও কাছে ঋণী হয়ে থাকতে চাই না।’
নওমী হাসলো না, তর্কে গেল না, টাকাটার দিকে ফিরেও তাকাল না। শুধু বলল,
‘এটা রেখে দিন, ফেরত দিতে হবে না।’
‘কেন?’
‘আমার মনে হয় কিছু কিছু ঋণ আজীবন থেকে যাওয়াই ভালো।’
‘কিন্তু আমি চাই না, এই সামান্য কিছু টাকা আমার গলায় অসহ্যকর, যন্ত্রণাময় কাঁটা হয়ে বিঁধে থাকুক।’
‘এতে তো কোনো ক্ষতি হচ্ছে না। সামান্য কিছু টাকা। ফেরত দেয়ার প্রয়োজন নেই।’
কথাগুলো আদিয়ানের সহ্য হলো না আর। নওমীর একটা হাত টেনে এনে, হাতের মুঠোয় টাকাগুলো ধরিয়ে দিয়ে বলল,
‘যে ঋণের শুরু ও শেষটা বিষধর সাপের ছোবলের চেয়েও বিষাক্ত, সেই ঋণের বোঝা নিয়ে সারাজীবন ঘুরে বেড়ানোর মতো ধৈর্য্য ও মনের জোর আমার নেই। আমি নিশ্চিত, জীবনের প্রতিটা পদক্ষেপে এই সামান্য কিছু টাকাই আমাকে নিঃশেষ করে দেয়ার মতো যন্ত্রণা দিতে সক্ষম।’
এই কথাগুলো সঠিক কোনো অর্থই নওমী খুঁজে পেল না। সামান্য কিছু টাকা কেন কাউকে এত কষ্ট দিবে? কী কারণ তার? অবাক চোখে চেয়ে, টাকাগুলো হাতে নিয়ে বলল,
‘দিন তাহলে। ফিরিয়েই দিন। সামান্য কিছু টাকার জন্য কারও গোটা জীবন নষ্ট হয়ে যাক, আমি সেটা চাই না।’
টাকা মুঠোবন্দী করতে গিয়ে কখন যে আদিয়ানের হাতটা মুঠোয় চেপে ধরেছে, নওমী নিজেও সেটা খেয়াল করল না। অস্বস্তি হওয়াতে আদিয়ানই হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলল,
‘ধন্যবাদ দিয়ে ছোটো করব না। আশাকরি ভবিষ্যতে আরও অনেক ভালো ভালো কাজ করবেন, অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়াবেন। আপনাদের মতো মানুষ আছে বলেই, কিছু সহায়-সম্বলহীন মানুষের মুখে হাসি ফুটছে। সবাই কিন্তু এই ধরনের মানসিকতা নিয়ে জন্মায় না। আপনি পেরেছেন। এই অভ্যাস ও ইচ্ছেটাকে বাঁচিয়ে রাখবেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ উত্তম প্রতিদানকারী।’
কথা শেষ করে আগের জায়গায় ফিরে পিংকির পড়াশোনার দিকে নজর দিল আদিয়ান। রিংকিও আর দাঁড়িয়ে থাকল না। নিজের জায়গায় ফিরে এসে ফেলে রাখা অংক করতে বসে গেল। নওমী বেশ কিছুক্ষণ ওখানেই দাঁড়িয়ে রইল। কেন, কে জানে, কোনো এক অজানা কারণে চোখের কোণ ভরে উঠল তার। এত যন্ত্রণা হচ্ছে বুকে। কেন হচ্ছে, কী কারণে হচ্ছে, নিজেও বুঝতে পারছে না। তার মাথায় আদিয়ানের বলা আগের কথাগুলোই রিপিট হচ্ছে বার বার। চাপা কষ্ট মনে আগলে নিয়ে হাতের মুঠোয় চেপে রাখা টাকার দিকে তাকিয়ে বিড়বিড়াল,
‘সামান্য কিছু টাকা কেন কাউকে সারাজীবন যন্ত্রণায় রাখবে? কী কারণ তার? আমার কোনো আচরণ কি তাকে কষ্ট দিয়েছে না কি অন্যকিছু?’
***
চলবে…
#পায়ে_পায়ে_হারিয়ে
লেখনীতে : তামান্না বিনতে সোবহান
পর্ব – ১৪
রাত তখন দশটা। জাহাঙ্গীরের বিশ্বস্ত লোক ইমতিয়াজ শুভকে ডাক পাঠিয়েছে। কেন তাদের একজনকে আজ সে পিটিয়েছে, এটাই জানতে চান জাহাঙ্গীর হোসেন। তা-ই তিনি সরাসরি না এসে একটা রেস্টুরেন্টে ইমতিয়াজকে পাঠিয়েছেন। সেখানেই এসেছে শুভ। আশেপাশে আরও কয়েকজন লোক। সাধারণ পোশাকে ঘুরে বেড়াচ্ছে। দেখতে ভদ্র হলেও এরা কেউই ভদ্র নয়। লোকের চোখে ধুলো দিয়ে সারাদিন অন্যায় কাজকর্ম করে বেড়ায়। সবাই অবশ্য শুভকেই নজরে রাখতে এসেছে। চারিদিকে একবার চোখ বুলিয়ে শুভ বলল,
‘কী দরকার?’
‘রাসেলকে মেরেছ কেন?’
‘সবার সামনে ভুল করতে যাচ্ছিল। একটুর জন্য ধরা পড়ে যেত।’
‘তাইবলে এইভাবে মারবে?’
‘আরও দু’একটা দেয়া উচিত ছিল বোধহয়। কম দিয়েছি।’
‘বড়ো ভাই বার বার ওয়ার্নিং দিচ্ছেন। কেন এতবার সুযোগ হাতছাড়া করছ তুমি?’
শুভ বিরক্তিকর মেজাজে বলল,
‘আরেহ্ বাবা জানেনই তো কাজটা প্রথম। এর আগে এসব করিনি। হাত কেঁপে ওঠে আমার। মানুষজন দেখে ফেলে কি না সেই ভয়ে গুলি করতে পারি না।’
‘কিন্তু এভাবে চলতে থাকলে তো হবে না। বড়ো ভাই তোমার ওপর ভীষণ বিরক্ত।’
‘বড়ো ভাই, বড়ো ভাই, বার বার এক কথা। আপনার বড়ো ভাইকে আমার সামনে আসতে বলুন। কেন তিনি আমাকে দিয়ে এই কাজটা করাচ্ছেন? গাড়িতেও আমাকে ফাঁসানো হয়েছে। হাজত থেকে ছাড়িয়ে এনে এ কোন জায়গায় ফাঁসিয়ে দিচ্ছেন? এতে লাভ কী ওনার?’
অবাক করা বিষয় এটাই যে, জাহাঙ্গীর তাকে এই কাজ দিলেও কখনও সামনে আসেনি। আড়ালে থেকে হুকুম করছে। প্রথমদিন ছায়া দেখেছিল শুধু, সামনা-সামনি দেখেইনি। আর এখন, একের পর এক হুকুম। কী যে চায় লোকটা সেটাই বুঝতে পারে না শুভ। সে-ও কম যায় না। এত সহজে এই লোকটার কথায় খুনের মতো জঘন্য অপরাধ সে করবে না। শুধু রুমঝুমের জীবনটা জড়িয়ে গেছে নয়তো এই জাহাঙ্গীর ও তার লোককে পুলিশের হাতে ধরিয়ে দিত। যদিও পর্যাপ্ত প্রমাণ নেই। জাহাঙ্গীরকে স্বচক্ষে দেখেওনি। আন্দাজের ওপর কোনো কথা পুলিশও বিশ্বাস করবে না। ভাবতে গিয়ে মেজাজটাই নষ্ট হয়ে গেল তার। ইমতিয়াজ সবটাই লক্ষ্য করল। ফুলে-ফেঁপে গর্জে উঠে বলল,
‘ওনার লাভ-লস দিয়ে তোমার এত মাথাব্যথা না থাকলেও চলবে। যা করতে বলা হয়েছে, সেটা কোরো। টাকা চাইলে দ্বিগুণ দিব।’
মনে মনে অসংখ্য গালি আওড়ে গেল শুভ। তার জানামতে যত গালি ছিল সবই বিড়বিড় করল। পারল না শুধু লোকটার কলার টেনে ধরতে। চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,
‘ওখান থেকে একটাকাও প্রয়োজন নেই আমার।’
‘কেন? পাপের টাকা বলে? করছ তো পাপ কাজ। তাহলে টাকা নিতে এত আপত্তি কীসের?’
‘এখনও কিন্তু বে’আইনী কোনো কাজ আমি করিনি। তাই পাপ কাজের সংজ্ঞা আমাকে বুঝাতে আসবেন না। কাজ দিয়েছেন, সময়মতো করে দেব। যখন কাজটা করে ফেলব, তখন বলবেন, পাপের সাথে জড়িয়েছি। তার আগে নয়।’
শক্তচোখে কথাগুলো বলে উঠে দাঁড়াল শুভ। ইমতিয়াজ বলল,
‘গলায় বেশ জোর আছে দেখছি।’
‘কেন? আপনাকে ভয় পেয়ে মিনমিন করব ভেবেছিলেন?’
‘আমাকে ভয় পেতে হবে না। বড়ো ভাইকে ভয় পেলেই হবে।’
‘আপনার বড়ো ভাইকে গিয়ে বলবেন আমি তাকে ভয় পাই না।’
‘সেটা তো সময় বলবে ভয় পাও কি পাও না।’
‘দরকারী কথা কি শেষ? আমি এখন যাব।’
ইমতিয়াজ তাকে পূণরায় বসার ইঙ্গিত দিলে শুভ দাঁড়িয়েই রইল। ইমতিয়াজ তার ঘাড়ত্যাড়ামি দেখে বলল,
‘মাথা গরম কোরো না। ঠাণ্ডা রাখো। আর আমার কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে শোনো।’
‘বলতে পারেন, আমি শুনছি।’
‘এভাবে দূর থেকে মেয়েটার ক্ষতি তুমি করতে পারবে না। তাই আমি বলব, মেয়েটার কাছে যাও। প্রয়োজনে প্রেমের নাটক কোরো। মেয়েটাকে দুর্বল করে তারপর সুযোগ বুঝে শেষ করে দাও।’
শুভ দাঁতপাটি বের করে হেসে বলল,
‘কারও প্রেমে পড়া এত সহজ?’
‘দূর, প্রেমে পড়বে কেন? প্রেমের নাটক করবে। ক’দিন চোখের সামনে একটু হিরো সাজো। একটু ভালো কাজ কোরো। প্রয়োজনে কিছু দান-খয়রাত কোরো। মেয়েটা এসবেই দুর্বল হয়ে যাবে। একটু দুর্বল হলেই তোমার কাজটা সহজ হবে বলে আশা রাখি।’
কিছুক্ষণ চুপ থেকে ভেবে গেল শুভ। এই কাজ করলে সে যথেষ্ট সময় পাবে। জাহাঙ্গীরকে ঘুরানো হবে, নওমীকেও চোখে চোখে রাখা হবে। মনে মনেই হাসলো সে। বলল,
‘ঠিক আছে। দেখি, প্রেমের ফাঁদে মেয়েটা পা দেয় কি না। যদি না দেয়?’
‘আরেহ্ দিবে দিবে। এসব মেয়েরা হিরো টাইপ ছেলেই পছন্দ করে। নিশ্চয়ই পা দিবে।’
‘ওকে… এখন আসছি। আপনার বড়ো ভাইকে বলবেন, কাজ হয়ে যাবে। ঝুমের যেন কোনো ক্ষতি না করেন।’
ইমতিয়াজ এই কথার জবাব দিল না। শুধু হাসলো। সিগারেটে আগুন ধরিয়ে আরামসে সেটা দুই ঠোঁটের ফাঁকে চেপে পরপর কয়েকটা টান দিয়ে ধোঁয়া ছেড়ে বলল,
‘বউয়ের জন্য চিন্তা হচ্ছে বুঝি? চিন্তা কোরো না। কথার বরখেলাপ না হলে তোমার বউয়ের কোনো ক্ষতি হবে না। বড়ো ভাই এক কথার মানুষ।’
***
মনের এই বেহাল দশা সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে নওমী। আগে কখনও এরকম হয়নি তার। কিন্তু ইদানীং ঘুমঘোরে খুবই অদ্ভুত সব ভাবনায় বুঁদ হয়ে থাকতে ভালো লাগে তার। সেই ভাবনায় উঁকি দেয় একটা রাজকুমার। তার সামনে এসে নানাভাবে তাকে হাসায়, রাগায়, মান-অভিমান দেখায়। হুটহাট মনের কোণে উঁকি মেরে কিছুক্ষণ তাকে সুখস্বপ্নে বিভোর করে দিয়ে আবারও হারিয়ে যায়। আবছায়া এই রাজকুমারের সাথে মনে মনে অনেক কথার ফুলঝুরি ছোটায় সে। কখনও ক্লান্তিও আসে না। কথার ছলে, গল্পের ছলে রাত যে কখন ভোর হয়, সেটাই টের পায় না নওমী। ঘুম ভাঙার পরপরই যখন সে চোখ মেলে তাকায়, সঙ্গে সঙ্গে রাজকুমার অদৃশ্য হয়ে যায়। এরপরই একগাদা উড়ো মেঘের দল এসে অবিরাম দুঃখের বৃষ্টি ঝরায়। মনটাই খারাপ হয়ে যায় তার। নিশ্চুপে বিছানায় বসে থাকে কতক্ষণ। আজও তার ব্যতিক্রম হলো না। সারাটা রাত সে সুখস্বপ্নে ডুবেছিল। অথচ ঘুম ভাঙতেই নেই। মনের এই বিশাল পরিবর্তনে নিজেই হতবাক নওমী ভেবে মরে সারাক্ষণ। কিশোরী বয়সে যে ভাবনাগুলো মনে উঁকি দেয়ার কথা, তা এখন দিচ্ছে। কেন? মন কি কোথাও আটকাচ্ছে? অবান্তর ভাবনা মনে করে মনকে সান্ত্বনা দিয়ে ফ্রেশ হতে বাথরুমে। কিছুক্ষণ আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখে। ঘুমঘোরে আসা সেইসব অনুভূতি তাকে ছুঁয়ে গেল আবারও। ড্যাবড্যাবে চোখে আয়নার দিকে তাকিয়ে নিজেকে শাসিয়ে বিড়বিড়াল,
‘তোর লক্ষ্য একটাই, লন্ডনে যাওয়া। খবরদার নওমী, পড়াশোনা ছাড়া আর কিচ্ছু নিয়ে ভাববি না।’
একা একা বকতে বকতে আবারও চুপ হয়ে গেল নওমী। নিজেকেই প্রশ্ন করল,
‘বাই অ্যানি চান্স, আমি কারও প্রেমে পড়ে যাইনি তো? নয়তো মনের মধ্যে কেন ঘর বাঁধার স্বপ্নেরা উঁকি মারবে? কেন কোনো রাজপুত্রকেই ভেবে মরবে সারাক্ষণ?’
এরপরই দু’দিকে মাথা ঝাঁকাল নওমী। মুখে পানি ঝাপটা দিয়ে আয়নার দিকে আঙুল তাক করে নিজেকে ইচ্ছেমতো শাসিয়ে বলল,
‘লক্ষ্যে না পৌঁছানো পর্যন্ত প্রেম-ভালোবাসাকে মনে ঠাঁই দিবি না, নওমী। ওটা হচ্ছে মরণফাঁদ। একবার পা দিবি তো সারাজীবনের জন্য ফেঁসে যাবি।’
ফ্রেশ হয়ে কিটিকে নিয়ে ডাইনিংয়ে এলো নওমী। বাবা-মাকে আজ একটু গম্ভীর দেখাচ্ছে। দু’জনেই যেন খুব বেশি চিন্তিত। সে চায়ের কাপ হাতে তুলে বলল,
‘কী হয়েছে, বাপি?’
তোফাজ্জল হোসেন ঝটপট চেহারা স্বাভাবিক করে ফেললেন। এখুনি মেয়েকে টেনশন দিতে চান না তিনি। এত চাপ নিতে পারবে না। তারচেয়ে যেসব কথা লুকিয়ে রেখেছেন, লুকোনোই থাক। কোনোদিন সময় ও সুযোগ এলে বলবেন। তিনি মেয়ের মুখে নাশতা তুলে দিতে দিতে বললেন,
‘তুমি যে বড়ো হয়ে যাচ্ছ, সেটা আমরা এতদিন টের পাইনি। তবে এখন মনে হচ্ছে, তুমি ঘর-সংসার সামলানোর মতো উপযুক্ত হয়েছ।’
নওমী হাস্যজ্বল চেহারা নিয়ে বলল,
‘তাই না কি? হঠাৎ এ কথা কেন মনে হলো?’
‘আমরা তোমার বিয়ের কথা ভাবছি।’
‘বিয়ে! আর ইউ কিডিং?’
‘নো… আই এ্যাম রিয়্যালি ভেরি সিরিয়াস!’
‘কিন্তু এখনই কেন?’
‘প্রয়োজন আছে। মন থেকে প্রস্তুতি নাও। খুব শীঘ্রই তোমার বিয়ে হচ্ছে এবং তুমি শ্বশুরবাড়ি যাচ্ছ।’
‘বাপি, আ’ম এ্যাক্সট্রিমলি স্যরি। আমি এখুনি বিয়ে করছি না। বিয়ের কোনো প্রয়োজনই দেখছি না। সামনে আমার ফাইনাল এ্যাক্সাম। আমার প্রিপারেশন দরকার। আমাকে এই নিয়ে ফোর্স কোরো না।’
‘বিয়েটা তোমার ভালোর জন্যই।’
‘না বাপি…। বিয়ে করব না।’
‘কেন? সমস্যা কী?’
‘এখন সম্ভব নয়। বোঝাতে পারব না।’
‘তুমি কি কাউকে ভালোবাসো?’
কৌশলে মেয়ের পেট থেকে কথা বের করতে চাইলেন তোফাজ্জল হোসেন। সেদিন রাস্তায় হওয়া দুর্ঘটনা, গতকাল নওমীকে বাঁচানো, দুটো ঘটনাকে কেন জানি তাঁর চোখে লাগছে ভীষণ। সন্দিহান মন নিয়ে উত্তরের অপেক্ষায় মেয়ের দিকে চেয়ে আছেন তিনি। নওমী ঠোঁট মুড়ে হাসছে। মেয়ের হাসি দেখে বললেন,
‘কী হলো? উত্তর দাও। ভালোবাসো কাউকে?’
‘সেরকম কাউকে পাইনি, বাপি। পেলে জানাব।’
‘আর না পেলেও চলবে। আমি খোঁজ লাগিয়েছি। ভালো পাত্র খুব শীঘ্রই পেয়ে যাব। সামনেই তোমার জন্মদিন, ওইদিনই যদি অ্যানগেজমেন্ট হয়, আপত্তি আছে তোমার?’
বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে রইল নওমী। কথাগুলো অবিশ্বাস্য মনে হলো। এত জলদি বাঁধা পড়তে চায় না সে। কাউকে না চিনে, না বুঝে তো একেবারেই না। বিশ্বাস করতে না পেরে কণ্ঠে রাগ ধরে রেখে জানতে চাইল,
‘তুমি কি সত্যিই এটা চাইছ?’
‘হ্যাঁ, চাইছি।’
‘তাহলে আমার কথাও বলে রাখি। যদি এরকম কিছু হয়, সোজা সদরদরজা দিয়ে বেরিয়ে যাব। আর কোনোদিন এখানে আসব না। তোমরা ডাকলেও না।’
বাবা-মেয়ের কথার মাঝখানে এতক্ষণ নীরব দর্শক ছিলেন নুজাইফা আমীন। এবার আর নীরব থাকতে পারলেন না। মেয়ের দিকে কড়া শাসনের চোখে তাকিয়ে থেকে বললেন,
‘বাবা-মা সন্তানের খারাপ চায় না, নিমু। আমরাও তোমার খারাপ চাই না। তোমার ভালোর জন্যই এই সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে আমাদের।’
নওমী দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
‘এতে আমার কী ভালো হবে শুনি?’
তোফাজ্জল হোসেন ভেবেছিলেন, মেয়ের বিয়ে দিয়ে শ্বশুরবাড়ি পাঠিয়ে তাকে জাহাঙ্গীরের চোখের আড়ালে রেখে দিবেন। এরপর ভিসার কাগজপত্র এসে গেলে, চুপিসারে লন্ডনে পাঠিয়ে দিবেন। কিন্তু ঘাড়ত্যাড়া মেয়ে বিয়ের নাম শুনেই মেজাজ দেখাতে শুরু করেছে। এখুনি তো সব কথা বলার সময় নয়। তাই ঠান্ডা মাথায় বুঝানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। মেয়ে বুঝলে তো! নওমীর মেজাজ দেখে তিনিও একইভাবে বললেন,
‘কী ভালো সেটা পরবর্তীতে না হয় জানলে। এখন মন থেকে প্রস্তুতি নিয়ে রাখো। ভালো পাত্রের সন্ধান পেলেই বিয়ে কনফার্ম।’
***
মাজেদা খাতুনকে নিয়ে ডাক্তারের চেম্বারে এসেছে রুমঝুম। হিসেব অনুযায়ী চার মাসের প্রেগন্যান্সি তার। তবে দেখলে বোঝা যায় না। চিপচিপে শরীরে ঢোলা জামা অথবা আবায়া পড়লে মনেই হয় না সে গর্ভবতী। মাঝেমধ্যে তার নিজেরও সন্দেহ হয়, মনে প্রশ্ন জাগে, ওইটুকু পেটে বাচ্চা আছে তো? নিজের ভাবনায় নিজেই হেসে উঠে। এখনও মুভমেন্ট বুঝতে পারে না। অকারণ দুঃশ্চিন্তা মনে উঁকি দেয়। সেইসব দুঃশ্চিতার কথা ভদ্রমহিলার সাথে শেয়ারও করেছে সে। তাই আজ তিনি নিজে তাকে এখানে টেনে এনেছেন, ডাক্তার দেখিয়ে, পরামর্শ করে তারপর বাড়ি যাবেন। কিন্তু বিপত্তি শুরু হলো আধঘণ্টার মাথাতেই। মাজেদা খাতুনের বড়ো ভাই মারা গেছেন। আচমকাই সেই খবর এলো। তিনি আঁচলে মুখ চেপে কান্না শুরু করলেন। এখনও রুমঝুমের সিরিয়াল আসেনি। সিরিয়াল আসবে, ডাক্তার টেস্ট দিবে, এরপর রিপোর্ট আসবে, এসবে অনেক দেরী। এতক্ষণ একটা মানুষ তারজন্য বসে থাকবে? ভাইয়ের শোকে কেঁদে বুক ভাসাবে? রুমঝুমের খুব মায়া হলো। বলল,
‘আন্টি, আপনি বরং আপনার ভাইয়ের ওখানে যান। সবাই আপনাকে খুঁজবে। আমার ডাক্তার দেখাতে অনেক দেরী। এতক্ষণ আপনি কেন বসবেন? ভাইয়ের জন্য মন পুড়ছে নিশ্চয়ই! আপনি যান। আমি ঠিক চলে যেতে পারব। আর যদি না পারি, আদিকে কল করে নেব। ফ্রি হয়ে আমাকে নিয়ে যাবে। আপনি চিন্তা করবেন না।’
ভাইয়ের শোকে দিশেহারা মাজেদা খাতুন, রুমঝুমের কথাই মাথায় নিয়ে, তাকে একটু ভরসা দিয়ে রিকশা নিয়ে চলে গেলেন তিনি। রুমঝুম বসে রইল একা। অনাগত বাচ্চার সাথে বকবক করে সময় কাটাল। সিরিয়াল এলে চেকআপ করিয়ে, টেস্ট করল। রিপোর্ট এলো ঠিক সন্ধ্যে সাতটার দিকে। অনেকক্ষণ বসে থাকতে থাকতে কোমরে ব্যথা ধরে এলো তার। রিপোর্ট দেখিয়ে, পর্যাপ্ত সাজেশন নিয়ে আস্তেধীরে উঠে ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে বের হলো। ক্লান্তি ভর করেছে শরীরে। মাথা খানিকটা দুলছেও। এই শরীর দুর্বলতার কারণেই ডাক্তার দেখানো। অনেকগুলো ঔষধ দিয়েছেন তিনি। ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া করতে ও নিজেকে চিন্তামুক্ত রাখতে বলেছেন। সব টেস্টের রিপোর্টই ভালো। কোনো ত্রুটি নেই। তবে বাচ্চার পজিশন আপাতত উল্টোই। ডাক্তার জানিয়েছেন, এটা সময়ের সাথে সাথে ঠিক হয়ে যাবে। ভয়কে মনে জায়গা না দিয়ে দুর্বল শরীর নিয়ে ফার্মেসিতে গেল। প্রয়োজনীয় সব ঔষধ নিয়ে, দোকান থেকে একটা পানির বোতল কিনল। গলা শুকিয়ে কাঠ। কয়েক ঢোক পানি গিলে রাস্তায় থাকা পিলারের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়াল। শরীরে জোর দেয়ার সাময়িক চেষ্টা মাত্র। এরপর ফোন দিল আদিয়ানের নম্বর। ফোন সুইচড অফ এলো। বার কয়েক লাগাতার কল দিয়েও কাজ হলো না। দেরী না করে হাত বাড়িয়ে একটা সিএনজি থামানোর চেষ্টা করল। সেটাও হলো না। অনবরত মাথা ঘুরছিল শুধু। ব্যালেন্স রাখতে পারল না। মাথায় হাত চেপে মাটিতে ঢলে পড়ল।
কয়েক মিনিট পর চোখ মেলে নিজেকে কারও কোলে আবিষ্কার করল রুমঝুম। জোর দিয়ে উঠতে চাইলে অচেনা একটি মেয়ে তাকে বলল,
‘আপনি একা? সাথে কেউ নেই?’
মেয়েটিকে চিনল না রুমঝুম। সোজা হয়ে বসতে চাইল। মেয়েটি তাকে দু’হাতে আঁকড়ে ধরে বসতে সাহায্য করল। পানি দিয়ে মুখ মুছিয়ে দিল। বলল,
‘আপনার বাসা কোথায়?’
‘মিরপুর।’
এরপর রোড নম্বর ও বাসা নম্বর বললে মেয়েটি বলল,
‘একা যেতে পারবেন?’
‘আসলে আমার সাথে বাড়িওয়ালী আন্টি ছিলেন। ওনার ভাই মারা যাওয়াতে উনি ওখানেই চলে গেলেন। আমি-ই জোর করে পাঠিয়েছি। ভেবেছি একা যেতে পারব।’
‘আপনার বাড়ির কাউকে ফোন করবেন?’
‘ফোন বন্ধ আসছে।’
‘ওহ, কিছু মনে না করলে একটা কথা বলি?’
‘হুম…।’
‘আমি আপনাকে পৌঁছে দিই?’
‘রাত হয়ে গেছে। আপনাকে বিরক্ত করে লাভ নেই। আমি একাই যেতে পারব।’
হিজাব খুঁজে নিয়ে সেটা মাথায় পেঁচিয়ে নিল রুমঝুম। নেকাব দিয়ে মুখ ঢেকে, ভ্যানিটিব্যাগ হাতে তুলে সোজা হয়ে উঠে দাঁড়ালে আবারও মাথা দুলে উঠল। মেয়েটি তাকে আগলে নিয়ে বলল,
‘আপনি আসুন তো।’
জোরপূর্বক রুমঝুমকে নিয়ে একটা সিএনজিতে উঠে বসল মেয়েটি। পুরোটা রাস্তা মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। রিল্যাক্স হওয়ার জন্য নিজের কাঁধ বাড়িয়ে দিল। নির্দিষ্ট গন্তব্যে এসে গাড়ি থেকে নেমে ভাড়া মিটিয়ে রুমঝুমকে ধরে ধরে গেটের ভেতরে পা রাখল। অমনি জাদীদ সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলল,
‘একী! আপনি একা কেন? মা কোথায়?’
মাত্রই বাসায় ফিরেছে জাদীদ। তার মামার মৃত্যুর খবর এখনও তার অজানা। বাইক গ্যারেজে ঢুকিয়ে সিঁড়িতে পা রাখতেই গেটের শব্দ শোনে ঘাড় ফিরিয়ে রুমঝুমকে একা দেখে অবাক হয়ে জানতে চাইল। এরপরই সাথে থাকা মেয়েটিকে দেখে বলল,
‘আরেহ, আপনি!’
নওমী মুচকি হেসে বলল,
‘উনি রাস্তায় মাথা ঘুরে পড়ে গিয়েছিলেন। একা দেখে নিয়ে এলাম।’
‘ভালো করেছেন। ভেতরে আসুন।’
মূল অ্যাপার্টমেন্টের সিঁড়িতে পা রাখতেই, পরনে শার্ট জড়িয়ে উপর থেকে দৌড়াতে দৌড়াতে নিচে নেমে এলো আদিয়ান। আসতেই সবার মুখোমুখি পড়ে গেল। জাদীদ বলল,
‘অসুস্থ স্ত্রীকে একা ছাড়লেন কেন, ভাই? দেখুন অবস্থা। রাস্তায় যদি কোনো দুর্ঘটনা ঘটত?’
আদিয়ান ও নওমী দু’জনের চোখেই বিস্ময়। একবার রুমঝুম ও আরেকবার আদিয়ান, পরপর দু’জনকে দেখে জাদীদের কথা স্পষ্ট বুঝতে পেরে ঠোঁটে হাসি টেনে নওমী বলল,
‘আপনার স্ত্রী বোধহয় একটু বেশি-ই অসুস্থ। ওনাকে একা ছেড়ে ঠিক করেননি আপনি।’
কথার কোনো উত্তর দিল না আদিয়ান। হাত বাড়িয়ে রুমঝুমের একটা হাত ধরে বলল,
‘ঠিক আছিস এখন?’
আদিয়ানের ফোনের চার্জ শেষ হয়ে গেছে। সেটা চার্জে বসিয়ে রাতের খাবার রান্না করছিল সে। হঠাৎই মনে হয়েছে রুমঝুম ডাক্তার দেখাতে গিয়েছে। এতক্ষণ ধরে আসছে না কেন, সেই চিন্তা মাথায় আসাতেই হুড়মুড়িয়ে নিচে নেমে জীবনের সবচেয়ে বড়ো ও অবিশ্বাস্য ধাক্কাটা সে খেয়েছে। নওমীর চোখে এখন সে ও রুমঝুম স্বামী-স্ত্রীই। ব্যাপারটা খুবই হাস্যকর হয়ে গেলেও কেমন যেন একটা ভোতা যন্ত্রণা ঘিরে ধরল আদিয়ানকে। নওমীর চোখ এড়াতেই রুমঝুমের সাথে কথা এগিয়ে নেয়ার চেষ্টা করল। রুমঝুম বলল,
‘মাথা এখনও দুলছে। ওই আপুটা হেল্প করেছে আজ। ওনার একটা থ্যাংকস প্রাপ্য।’
না চাইতেও পিছনে ফিরল আদিয়ান। জাদীদ ও নওমী বেশ উৎফুল্ল মেজাজে একে-অন্যের সাথে গল্প করছে। কথার ফাঁকে খিলখিলিয়ে হাসছে নওমী। সে একবার তাকিয়ে নওমীকে উদ্দেশ্য করে বলল,
‘আপনিও আসুন। চা খেয়ে যাবেন।’
নওমী মুচকি হেসে দু’দিকে মাথা নেড়ে বলল,
‘আজ না। অন্যদিন। মাম্মি-বাপি অপেক্ষা করছে।’
এ কথা শোনে রুমঝুম তৎক্ষনাৎ বলে উঠল,
‘একদম না আপু। আজ আমাদের সাথে চা খাবেন, ডিনার করবেন, এরপর যাবেন। প্লিজ…।’
‘বাসায় ফিরতে দেরী হয়ে যাবে।’
‘ঘণ্টাখানেক দেরী হলে কিচ্ছু হবে না। আসুন তো।’
পরক্ষণেই জাদীদের দিকে তাকিয়ে বলল,
‘জাদীদ ভাই, আপনিও আসুন।’
জাদীদের ব্যক্তিগত মোবাইল শব্দ করে বেজে উঠল। নানাবাড়ি থেকে কল দেখে রিসিভ করতেই শুনল, তার বড়ো মামা আর নেই। সে ফোন রেখে, পূণরায় বাইক নিয়ে ছুট দিল। তাকে চলে যেতে দেখে নওমীর একটা হাত চেপে ধরে রুমঝুম বলল,
‘আপু, আপনি আসুন। আমার এত বড়ো উপকার করলেন। এক কাপ চা অন্তত খেয়ে যান। আপনি না খেয়ে গেলে, আমার ভেতরে সারাক্ষণ খচখচ করবে। প্লিজ…।’
রুমঝুমের এত অনুরোধ ফিরিয়ে দিতে বাধ্য হলো নওমী। বলা নেই, কওয়া নেই, হুট করেই মনের কোণে বিষাদের ঢল নেমে এসেছে। সে মনের সমস্ত বিষাদ দূরে ঠেলে দিয়ে বলল,
‘আজ একটুও সময় নেই, আপু। অন্য একদিন আসব। এসে সারাদিন আপনার সাথে গল্প করব। প্রমিস…।’
ঠিক সেই মুহূর্তে পিছন ফিরে তাকাল আদিয়ান। নওমীও তাকাল। চোখাচোখি হতেই চোখ সরিয়ে রুমঝুমকে নিয়ে সিঁড়ি টপকে উপরের দিকে চলে গেল আদিয়ান। নওমী কয়েক সেকেন্ড ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রইল। ঠোঁট কামড়ে কিছু একটা ভাবল। আচমকাই আবিষ্কার করল, আদিয়ানের চোখে এখন আর বিস্ময় নয়, অসহায়ত্ব। আশ্চর্য! কেন? কিছু কি বলতে চায়?
***
চলবে…
এই সুরে কাছে দূরে | ই-বুক
⚫ খণ্ডাংশ –
নিজের ব্যাগপত্র গুছিয়ে রুম ছেড়ে বের হলো মাহরীন। উদ্দেশ্য এই বাড়ির আঙিনা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ত্যাগ করা। চারপাশে ভালোমতো দৃষ্টি দিয়ে দেখল, কাউকে কোথাও দেখা যায় কি-না। ড্রয়িংরুম, রান্নাঘর ফাঁকা। এই সুযোগেই পালাতে হবে তাকে। দরজার কাছে আসতেই পিছন থেকে আওয়াজ এলো,
-‘কোথায় যাচ্ছ, কুলসুম?’
ভয়ে শুকনো ঢোক গিলল মাহরীন। ঘাড় ফিরিয়ে দেখল, পিছনে তাইয়্যেবাহ দাঁড়িয়ে আছে। চোখাচোখি হতেই চোখ নাচাল মেয়েটা। বলল,
-‘আজই এসেছ, আবার আজই চলে যাচ্ছ। কেন বোলো তো?’
নতমস্তকে দাঁড়িয়ে রইল মাহরীন। মিথ্যে বলতে বাঁধছে আবার সত্য স্বীকার করতেও ভয় হচ্ছে। তার বাবার যা চরিত্র, তাতে তাকে মানুষ খারাপ বৈ ভালো ভাববে না। তার মুখ লুকানো আচরণ টের পেয়ে তাইয়্যেবাহ বলল,
-‘এক্ষুণি আমার রুমে এসো।’
আদেশের স্বরে আহ্বান জানিয়ে চট করে নিজের রুমের দিকে চলে গেল তাইয়্যেবাহ। মাহরীন দ্বিধান্বিত মন নিয়েই পিছন পিছন অগ্রসর হলো। রুমে প্রবেশ করে বলল,
-‘ক্যান ডাকছেন আমারে?’
মাহরীনকে একনজর দেখে দরজা আটকে দিল তাইয়্যেবাহ। ফের ঢোক গিলল মাহরীন। তাইয়্যেবাহ বিছানায় বসলো। ইশারায় তাকেও বসার অনুমতি দিয়ে মুচকি হেসে বলল,
-‘নাম বদলে ফেললে কী হবে? চেহারা তো আর বদলাতে পারোনি।’
চমকে গেল মাহরীন। বিস্মিত চোখজোড়া নিয়ে তাকিয়ে রইল পাশে বসে থাকা রমণীর দিকে। কম্পনরত স্বরে বলল,
-‘কী কইতাছেন আপনি?’
তাইয়্যেবাহ আবারও হেসে স্পষ্টস্বরে বলল,
-‘তুমি যে ভার্সিটিতে পড়ো, সেখানে আমিও পড়াশোনা করি। ওইদিন লাইব্রেরীতে ভাইয়া তোমার সাথে কথা বলেছিল। সেটা আমি আমার হলরুম থেকেই দেখেছি।’
-‘আপনি আমাকে চিনেন?’
-‘হুম… খুব ভালো করে চিনি।’
-‘প্লিজ খারাপ ভাববেন না। আমি কোনো উদ্দেশ্য নিয়ে এখানে আসিনি। আমার একটা কাজের খুব দরকার।’
-‘কাজ তো করছিলে, তাহলে চলে যাচ্ছিলে কেন?’
-‘বাবা…। এখানে থাকাটা রিস্ক। তাছাড়া আপনার ভাই…।’
কথা বলতে গিয়ে থেমে গেল মাহরীন। তাইয়্যেবাহ নিঃশব্দে হেসে বলল,
-‘ভাইয়া কখনও মিথ্যে বলে না।’
নিজের জায়গায় বসে কেঁপে উঠল মাহরীন। এটা যদি সত্যি হয়, তারজন্য তাশদীদের অনেক বিপদ হতে পারে। কিন্তু এটা কীভাবে হয়? জেনে-বুঝে সে কেন কারও ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াবে? আজ তার বাবা এসে চিৎকার-চেঁচামেচি করে গেছেন, অন্যদিন হয়তো এই ব্যাপারটা আরও ভয়ংকর হতে পারে। প্রতুত্তরে কিছু না বলেই, ব্যাগ হাতে নিয়ে রুম ত্যাগ করতে পা বাড়াল মাহরীন। তাইয়্যেবাহ বলল,
-‘এখন কোথায় যাবে?’
-‘জানি না।’
-‘যাওয়ার দরকার কী? এখানেই থাকো। কুলসুম হয়ে।’
-‘এতে আপনার ভাইয়ের বিপদ হবে আপু।’
-‘কেন? ভাইয়াকে তোমার খুব বেশি দুর্বল মনে হচ্ছে?’
-‘নাহ… নিজের বাবাকে আমি চিনি। প্রয়োজনে উনি খুনও করতে পারেন। তাছাড়া, বাবা ও আপনার মায়ের কথাতে একটা ব্যাপার স্পষ্ট যে, ওনারা পূর্বপরিচিত। পিছনে কোনো গল্প লুকিয়ে আছে কি-না, আমি জানি না। জানতেও চাই না। আমি শুধু চাই, বাবার দৃষ্টিসীমার বাইরে থাকতে। এমন কোথাও, যেখানে লুকোলে বাবা কোনোদিন আমাকে খুঁজে পাবে না।’
-‘ঠিক আছে, যাও। তোমার খুশি। তবে যদি কোনোদিন মনে হয়, তাশদীদ শিকদারকে তোমার দরকার। চলে এসো। এই বাড়ির কে, কীভাবে বিষয়টা বিবেচনা করবে আমি জানি না। তবে আমি অপেক্ষা করব, তোমার জন্য। তোমার জন্য বাবা ও মায়ের কাছে হাতজোড় করব।’
সময় নষ্ট না করে বেরিয়ে গেল মাহরীন। অতি সন্তর্পণে দীর্ঘশ্বাস ফেলল তাইয়্যেবাহ।
চলবে